পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রযুক্তি
কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী
দেশের মোট ভূমির প্রায় ১২% এলাকা পাহাড়ি ভূমি দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন প্রকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে প্রতিনিয়ত ভূমিক্ষয় ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটে থাকে। দেশের বেশির ভাগ পাহাড় নরম মাটির হওয়ায় বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মাটি ক্ষয় ও ভূমিধসের ঘটনা বেশি ঘটে। তাছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ঢালে ফসল চাষ ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক হারে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি কারণে মাটি ক্ষয় ও ভূমিধস ত্বরান্বিত হচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে যুগ যুগ ধরে আদিবাসী কৃষকগণ অপরিকল্পিত জুম চাষ করে আসছে। কিছুকাল আগেও পার্বত্য অঞ্চলের এক একটি পাহাড়ে ২০-২৫ বছর পর পর জুম চাষ করা হতো যা পরিবেশের জন্য তত ক্ষতিকর ছিল না এবং প্রকৃতি তার জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়তি লোকের অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাতে এখন একই জমিতে ২-৩ বছর পর পর জুম চাষের ফলে ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধস ত্বরান্বিত হচ্ছে ও মাটির উর্বরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া ফসলের ফলন বাড়াতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির গঠন দুর্বল হয়ে মাটি ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে পাহাড়ে ক্রমবর্ধমান ফল বাগানে কৃষকরা ব্যাপকহারে আগাছানাশক ব্যবহার করায় পাহাড়ি ঢালের মাটি উন্মুক্ত হয়ে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণœ রেখে দীর্ঘকাল উৎপাদনশীল রাখার লক্ষ্যে পাহাড়ের। ভূমি ব্যবস্থাপনায় লাগসই প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে বেশ বিছু প্রযুক্তি যেমন পাহাড়ি অঞ্চলে মৃত্তিকা ক্ষয়রোধে ঝাড়ের বেড়া (Hedge Row) পদ্ধতিতে চাষাবাদ, জুট-জিও ((Jute-Geo Textile) টেক্সটাইল পদ্ধতি, গ্যাবিয়ন (Gabion Check Dam) চেকডেম পদ্ধতি, ব্রাশ উড চেকডেম (Brush Wood Checkdam) পদ্ধতি, বেঞ্চ টেরাস ((Bench Terrace) পদ্ধতি, মৃত্তিকা সংরক্ষণে পাহাড়ি ঢালে কণ্টুর (Contou) চাষাবাদ, আচ্ছাদন ফসল (Cover crop) চাষ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে বেড়া ও বেঞ্চ টেরাস প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সারি (Hedge row) পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য : এ পদ্ধতিতে পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের ঢালে শস্যের মাঝে, ফলজ এবং সবজি বাগানের ভেতর নির্দিষ্ট দূরত্বে বিভিন্ন হেজ বা বেড়া হিসাবে ব্যবহৃত প্রজাতির গাছ দ্বারা আড়াআড়িভাবে হেজ-রো বা হেজ স্ট্রিপ তৈরি করা হয়। পাহাড়ি ঢালের সাথে আড়াআড়িভাবে (ধপৎড়ংং ঃযব যরষষ ংষড়ঢ়ব) ভ্যাটিভার (বিন্না ঘাস), ন্যাপিয়ার, আনারস, বগা মেডুলা, ইন্ডিগোফেরা (নীল), ডেসমোডিয়া, গি¬রিসিডিয়া, খাগড়া, ফুলঝাড়–, লেমন ঘাস ইত্যাদি গাছকে হেজ বা বেড়া হিসাবে লাগিয়ে হেজ-রো স্থাপন করা হয়। বৃষ্টির পানিতে ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি নিচের দিকে নেমে আসার সময় হেজ-রো-এর ঘন আচ্ছাদনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জমা হয় এবং সেখানে মাটির গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে বৃষ্টির পানির গতিবেগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। হেজ-রো প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ধুয়ে যাওয়া রোধ করে। যার ফলে অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে নিরাপদ ও অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়। পাহাড়ি এলাকার ঢালু ভূমির ভূমিক্ষয় রোধে এ প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপযোগী। যে কোন এলাকায় ঢালু জমির ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের তথ্য : পাহাড়ি এলাকায় বা ঢালু জমিতে ঢালের আড়াআড়িভাবে উপর থেকে নিচে ৪-৫ মিটার পরপর ভ্যাটিভার, ন্যাপিয়ার, আনারস, বগা মেডুলা, ইন্ডিগোফেরা ইত্যাদি গাছকে কৃষকের চাহিদা অনুসারে ঘনভাবে লাগিয়ে হেজ-রো বা হেজ স্ট্রিপ তৈরি করতে হবে; পাহাড়ি ঢালে দুটি হেজ-রো এর মাঝে ঢালের আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন সবজি/ফসল/জুম চাষ /ফল বাগান ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে চাষ করা যেতে পারে; বছরে এক বা দুইবার হেজে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; হেজ বা ঝাড়ের গাছ বেশি লম্বা বা ঝোপালো হয়ে গেলে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত অংশ বা ডালপালা ছাঁটাই করে দেয়া যেতে পারে, যা সবুজ সার বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
প্রযুক্তির প্রভাব : এ প্রযুক্তির প্রধান উপকারিতা হচ্ছে মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ জৈব পদার্থের প্রাপ্যতা যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, মাটির গঠন উন্নত এবং ফসলের নিরাপদ ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে জ্বালানি কাঠের প্রাপ্যতা নিশ্চিত, পশু খাদ্যের যোগান, অবক্ষয় প্রাপ্ত ঢালু জমির পুনঃ উৎপাদনশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়। তা ছাড়া হেজ রো হিসাবে ব্যবহৃত গাছ থেকে (যেমন আনারস, লেমন ঘাস) বাড়তি আয়ও করা যায়। এছাড়া ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পানি দূষণ রোধ, ভূমিধস রোধ, ঝিরি ঝর্ণার পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নতির পাশাপাশি মাটিতে জৈব পদার্থের জোগান নিরাপদ খাদ্য উপাদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে জুুম চাষ করলে প্রতি বছর ৪৫ টন/হে: মাটি ক্ষয় হয়। আর হেজ রো চাষাবাদ প্রযুক্তিতে পাহাড়ের
ঢালের আড়াআড়ি কন্টুর লাইন বরাবর ঝাড়ের বেড়া দ্বারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাটি ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হয়। এই প্রকার ব্যবস্থাপনায় ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ প্রতি বছর ৪৫ টনের স্থলে ৬ টনে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া ঝাড়ের বেড়া হতে
প্রায় ২৬ টন/হেক্টর সবুজ সার প্রতি বছর পাওয়া সম্ভব।
ধাপ পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য : মৃদু ও মধ্যম ঢালু পাহাড়ের ঢালে সারা বছর ফসল উৎপাদনের জন্য বেঞ্চ টেরাস একটি উপযুক্ত পদ্ধতি। টেরাস পদ্ধতি ব্যবহার করে একই ঢালে প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, মাঠ ফসল, স্বল্প ও মধ্যমমেয়াদি ফল ফলানো সম্ভব। এ পদ্ধতিতে পাহাড়ি ঢালে সার প্রয়োগ সহজীকরণ হওয়ায় মাটি পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে মাটি ও পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং পানি সেচের ব্যবহার করতে পারলে বছরে একাধিক ফসল ফলানো যায়। ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের তথ্য : এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালকে সমোচ্চতা রেখা (ঈড়হঃড়ঁৎ ষরহব) ঢালের মাটি অপসারণ করে স্থায়ীভাবে পরপর ধাপ বা সিঁড়িতে পরিণত করা হয়; টেরাসগুলো পাহাড়ের ঢালের আড়াআড়িভাবে তৈরি করা হয় যাতে বৃষ্টির পানি কম গড়িয়ে যায় এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; এই পদ্ধতিতে একটি লম্বা ঢালের দৈর্ঘ্যকে কয়েকটি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে ঢালের দৈর্ঘ্য কমানো যায়।
প্রযুক্তি হতে প্রাপ্তি : ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাটিতে আর্দ্রতা বজায় থাকে। ঢালের দৈর্ঘ্য কমানো যায় ফলে পানির গতিবেগ (জঁহ ড়ভভ) নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেখানে চাষাবাদ করা কঠিন সেখানে ধাপ কেটে ধাপে চাষাবাদ করা যায়। পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে সারা বছর ফসল ফলানো যায়।
পাহাড়ি এলাকার ঢালু ভূমির ভূমিক্ষয় রোধে এ প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপযোগী। যে কোন এলাকায় ঢালু জমির ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালকে কেটে ধাপ তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের একার পক্ষে এর বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কৃষকদের সহায়তা করা গেলে পাহাড়ে এ প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
(সূত্র : মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বান্দরবান)
লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাঙ্গামাটি, মোবাইল- ০১৭১২৮১৬৩৫২, ই-মেইল : chittagong@ais.gov.bd