Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টিগুণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় তালগাছ

পুষ্টিগুণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় তালগাছ
কৃষিবিদ মোহাম্মদ সাইফুল আলম সরকার
তাল বাংলাদেশের অত্যন্ত সুপরিচিত একটি ফলজ বৃক্ষ। এটি পাম গোত্রের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম ইড়ৎধংংঁং ভষধনবষষরভবৎ। ভাদ্র মাসে পাকা তালের রস দিয়ে বিভিন্ন মুখরোচক পিঠা তৈরি আবহমান বাংলার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। তালগাছ থেকে উৎপন্ন  কচি ও পাকা ফল, তালের রস ও গুড়, পাতা, কা- সবই আমাদের জন্য উপকারী । কচি তালবীজ সাধারণত তালশাঁস নামে পরিচিত যা বিভিন্ন প্রকার খনিজ উপাদান ও ভিটামিনে পরিপূর্ণ। মিষ্টি স্বাদের কচি তালের শাঁস শুধু খেতেই সুস্বাদু নয় বরং পুষ্টিতে ও ভরপুর। শরীরবৃত্তীয় কাজে অংশ নেয়া এই তাল শাঁসের পুষ্টিগুণের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : প্রতি ১০০ গ্রাম তালের শাঁসে পুষ্টি উপাদান  
এ সব পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে নানা রোগ থেকে রক্ষা করাসহ রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। যেমন :
ষ তালের শাঁসে প্রায় ৯৩% বিভন্ন প্রকার ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানি ও প্রাকৃতিক জিলেটিন থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে পরিশ্রান্ত কর্মজীবী মানুষেরা তালের শাঁস খেলে দেহকোষে অতিদ্রুত ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সের মাধ্যমে শরীরে পুনরুদন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং আমাদের শরীরকে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দূর করে প্রাকৃতিকভাবে ক্লান্তিহীন রাখে । এ কারণে তালের শাঁসকে অনেক পুষ্টিবিদ প্রাকৃতিক শীতলীকারকও বলে থাকেন।
ষ অতিরিক্ত রোদে ও গরমের কারণে ত্বকে বিভিন্ন র‌্যাশ বা এলার্জিতে দেখা দিলে তালের শাঁস মুখে লাগাতে পারেন। তাছাড়া সানবার্ন থেকে মুক্তি পেতে তালের শাঁসের খোসা ব্যবহার করা যায়।
ষ কচি তালের শাঁসে থাকা ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্স আপনার পানি পানের তৃপ্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, বমিভাব দূর করে, খাওয়ার রুচি বাড়ায়। তাছাড়া লিভারজনিত বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও তালের শাঁস বেশ কার্যকর।
ষ তালের শাঁসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম (৩৫%) হওয়ায় ডায়বেটিস রোগীর জন্য এটি একটি চমকপ্রদ খাদ্য উপাদান। অতিরিক্ত ওজনের কারণে কি খাবেন এ নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তারাও অনায়েসে খাদ্য তালিকায় তালের শাঁস রাখতে পারেন কেনানা এটি তুলনামূলক কম ক্যালরিযুক্ত একটি খাবার। তালের শাঁস অধিক আঁশসমৃদ্ধ হওয়ায় যারা কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অন্যান্য পেটের পীড়ায় ভুগছেন তালেরশাঁস হতে পারে তাদের জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত এক ঔষধ।  
ষ এতে থাকা ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট ও অন্যান্য খনিজ উপাদান হাড় ক্ষয়, উচ্চ রক্তচাপ, রক্ত স্বল্পতা ও ক্যান্সারসহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় বেশ উপকারী ভূমিকা পালন করে।  
খেজুর গুড়ের ন্যায় তালের রস জ্বাল দিয়ে তৈরিকৃত তালমিছরিও আমাদের দেশে অতি পরিচিত একটি খাদ্য উপকরণ, যা সাধারণত বিভন্ন অসুখবিসুখে পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তালমিছরি গুণাগুণ বর্ণনা করতে গেলে প্রথমত এর পুষ্টিগুণ বিবেচনা করতে হয়। এতে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬ বি১২, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক ও ফসফরাস। সর্দি-কাশি, রক্তস্বল্পতা ও পেটের পীড়াসহ নানাবিদ রোগের চিকিৎসায় এটি বেশ কার্যকর। যাদের ঘন ঘন ঠা-া লাগার ভয় রয়েছে বিশেষত কাশি, গলায় জমে থাকা কফ, শ্লেষ্মা দূর করতে হালকা গরম পানিতে গোলমরিচ গুঁড়া ও তালমিছরি গুলে খাওয়ালে বেশ উপকার হয়। তাছাড়া তুলসী পাতার রসের সাথে তালমিছরি গুলে খেলে পুরানো সর্দি-কাশি অতি দ্রুত নিরাময় হয়। চিনির তুলনায় গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশ কম হওয়ায় ডায়াবেটিক রোগীর পাশাপাশি সব বয়সের মানুষের জন্য চিনির বিকল্প হিসেবে এটি বেশ নিরাপদ। মিছরি ক্যালসিয়াম ও আয়রনসমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় ক্ষয় ও রক্তস্বল্পতায় ভুগা রোগীরা খাদ্য তালিকায় মিছরি রাখতে পারেন। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা ও অনায়াসে মিছরি খেতে পারেন কেননা মিছরিতে রয়েছে অধিক পরিমাণে পটাশিয়াম এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী সোডিয়াম প্রায় নেই বললেই চলে।
এ ছাড়াও  প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন কাজেই তালগাছ আমাদের  নিত্য অনুষঙ্গ। তালগাছের কাঠ মূলত ঘরের খুঁটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে তালগাছের নৌকা বিশেষত হাওর অঞ্চলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পূর্বেকার দিনের বিভিন্ন ধর্মীয় ও অন্যান্য পুস্তক মূলত তালপাতাতেই লেখা হতো। গ্রামেগঞ্জে এখনও তালপাতার হাতপাখার রয়েছে বিশেষ কদর।  তাছাড়া, তালপাতা জ্বালানির পাশাপাশি, মাদুর, ঘর ছাউনি ও বেড়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
তবে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনে কারণে সৃষ্ট  দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বত্র অধিকহারে তাল গাছ রোপণ এখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বজ্রপাতের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২০০০-২৪০০  জন মানুষ বজ্রপাতের কারণে মারা যায় এবং ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে মে মাসে মাত্র একদিনের ব্যবধানে ৮২ জনসহ সর্বমোট   ৪৫০  মানুষের মৃত্যু বজ্রপাতের ভয়াবহতার চিত্র করুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে বজ্রপাতের কারণে প্রায় ৩০৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে যা ২০১৫ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। সরকারি তথ্যমতে, বজ্রপাতের কারণে প্রতিনিয়তিই মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, যেমন, ২০১৮ সালে ব্রজপাতের কারণে মৃত্যুর এ সংখ্যা ছিল ৩৫৯। ব্রজপাতের কারণে এই হতাহতের ঘটনা সবচেয় বেশি হচ্ছে হাওরাঞ্চলে। মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর প্রতিকারে করণীয় নির্ধারণে তৎপর হয়। বজ্রপাতের কারণে অতি উচ্চ ভোল্টেজসম্পন্ন বিদ্যুৎ সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠের সবচেয়ে উচু স্থাপনা বা বস্তুতে আঘাত হানে। এজন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিদগণ পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ করে বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য অধিকহারে তালগাছ রোপণের উপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তালগাছ সাধারণত ৩০ মিটার (৯৮ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয়, এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি বজ্রপাতে সৃষ্ট অতি উচ্চ ভোল্টেজ সম্পন্ন বিদুৎ পরিবহন করে মাটিতে পৌঁছে দিয়ে বজ্রাহতের হাত থেকে রক্ষা করে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে সারা দেশব্যাপী কয়েক মিলিয়ন তালগাছ রোপণও করেছে।
তাছাড়া, ভাঙ্গন ও মাটি ক্ষয়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়ও তালগাছের জুড়ি মেলা ভার। তালগাছ গুচ্ছমূলীয় হওয়ার কারণে নদীর ভাঙ্গন ও মাটির ক্ষয়রোধে এর রয়েছে বিরাট ভূমিকা। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে প্রবল স্রোতে নেমে আসা উজানের পানির কারণে সৃষ্ট বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ভাঙ্গনের কবলে জর্জরিত  রাস্তা ও বেড়ি বাধ বন্যা পরবর্তী যোগাযোগক্ষেত্রে অবর্ণনীয় দুর্যোগের সৃষ্টি করে । প্রতি বছরই এই সব অঞ্চলে রাস্তা ও বাধ পুন:নির্মাণে জন্য মোটা অংকের রাজস্ব ব্যয় হয়। এ সমস্ত বন্যাপ্রবণ এলাকার রাস্তা ও বাধের দুই পাশে তালগাছ রোপণ করে ভাঙ্গনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এই বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরপর দুইবার ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন বন্যায় রাস্তাঘাটের ভাঙ্গন অধিকহারে তালগাছ রোপণের গুরুত্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে তালগাছের জন্য তেমন বিশেষ কোন পরিচর্যারও প্রয়োজন হয় না।
এ জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বজ্রপাত, বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে আমাদের সকলকে পরিবেশবান্ধব এই বৃক্ষ রোপণে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : বিজ্ঞানী (ফলিত গবেষণা), পাট বিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্প, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইমেইল :saiful.barj@gmail.com মোবাইল: +৮৮০১৬৯০-০৫৭৫৭৭