Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা ও সফলতা


বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা ও সফলতা
ড. মোঃ নুর আলম চৌধুরী
বাংলাদেশে পেঁয়াজ একটি উচ্চমানের গুরুত্বর্পূণ অর্থকরী মসলা ফসল। এর উৎপত্তিস্থল ইরান, পশ্চিম ভারত উপমহাদেশে এবং মধ্য এশিয়া বলে ধরা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই কম বেশি পেঁয়াজ এর আবাদ পরিলক্ষিত হলেও চীন (২৫%) এবং ভারতে (২৩%) বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। পুষ্টিমানের দিক থেকে ইহা যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ। পেঁয়াজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফাইটোকেমিকেলস, পলিফেনল, হলুদ পেঁয়াজের ফ্লাভেনয়েড, লাল পেঁয়াজের এন্থোসায়ানিন এবং আরও ২৫ ধরনের বিভিন্ন জটিল যৌগ যা আমাদের নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ও উপশমে সহায়তা করে। পেঁয়াজ এমন একটি ফসল যা কৃষক তার ঘরে রেখে প্রয়োজনে বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধিসহ পেঁয়াজের ঘাটতি (১১-১২ লাখ. মে.টন) অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। 
আমাদের দেশে প্রায় ২.১৬ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৩.৭৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। যার গড় ফলন ১১ টন/হেক্টর (কৎরংযর উরধৎু, উঅঊ, ২০২০)। উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় শতভাগ শীতকালে উৎপাদিত হয়। উৎপাদন ও আমদানি বিবেচনায় এদেশের বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। এ ৩৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে মোট দেশজ উৎপাদন ২৩-২৪ লাখ টন হলেও সংগ্রহোত্তর ২৫-৩০% অপচয়ের ফলে ব্যবহার উপযোগী উৎপাদন দাঁড়ায় ১৭-১৮ লাখ টন। বিগত বছরে প্রায় ১১-১২ লক্ষ টন পেঁয়াজের ঘাটতি ছিল, যা  বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়েছিল। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে যথাক্রমে প্রায় ১১ ও ১২ লাখ টন, যার মূল্য প্রায় ৫-৬ হাজার কোটি টাকা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ এবং এর আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে উল্লেখিত ঘাটতি সহজেই মেটানো সম্ভব। কারণ শীতকালীন পেঁয়াজ শুধু শীতকালেই চাষাবাদ করা সম্ভব। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ সারা বছর চাষ করা যায়, (রবি মৌসুমে এবং খরিফ-১ ও খরিফ-২)। বর্তমানে পেঁয়াজের চাষে এলাকা বৃদ্ধি ও উন্নত জাত ব্যবহারের কারণে ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘাটতি কমিয়ে বর্তমান দাড়িয়েছে বছরে প্রায় ৪-৫ লাখ মেট্রিক টন। 
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা
আমাদের দেশে পাহাড়ি এলাকায় সমতল ভূমিতে, ছাদ বাগানে, বসতবাড়িতে এবং আন্তঃফসল হিসেবে অন্য ফসলের সাথে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশের মোট আয়তনের ১ দশমাংশ জমি পাহাড়ি এলাকায় । পাহাড়ি এলাকায় মোট জমির ৬ শতাংশ সমতল জমি বিদ্যমান। এই সমতল জমিতে সহজেই আমরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে পারি। তাছাড়া লেট খরিপে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ টন ফলন পাওয়া  সম্ভব। ইক্ষু একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। বাংলাদেশে প্রায় (১.৫১ লাখ) হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস, ২০১৯)। ইক্ষু লাগানো থেকে কর্তন করা পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাস সময় লাগে। এই সময়ে আমরা সহজেই ইক্ষুর সাথে আন্তঃফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে পারি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ একটি স্বল্প মেয়াদি ফসল। চারা লাগানোর ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। কাজেই ইক্ষু রোপণের পর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে ঘাটতি মেটানোসহ ইক্ষু চাষির অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া আদা, হলুদ ও মরচিসহ ভুট্টা ও মুখিকচুর সাথে আন্ত:ফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে অতিরিক্ত পেঁয়াজ উৎপাদন এবং অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
বসতবাড়িতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বসতবাড়ির আশেপাশে মাত্র ৫ মি. ও ২মি. (১০ হাত ও ৪ হাত) পরিমাণ জায়গা থাকলে একই জমিতে ফেব্রুয়ারি (মাঘ) মাসে চারা রোপণ করে ১৫-২০ কেজি, জুন (জ্যৈষ্ঠ) মাসে চারা রোপণ করে ১৫-২০ কেজি এবং সেপ্টেম্বর মাসে চারা রোপণ করে ২০-২৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। এ হিসাবে সারা বছর বারি পেঁয়াজ ৫ জাতের চাষ করে সর্বমোট ৬০-৬৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। একটি পরিবারের ৪-৫ জন সদস্যর জন্য মাসে গড়ে ৪ কেজি পেঁয়াজ কন্দের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে একটি পরিবারের বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ৪৮ কেজি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি পরিবার নিজেদের বার্ষিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ (কৃষি ডাইরি ডিএই, ২০২১) বসতবাড়ি আছে। প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এই প্রযুক্তিটি যদি বাংলাদেশের ৫০ লাখ বসতবাড়িতে নিবিড় ভাবে সম্প্রসারণ করা যায় তবে ৫০০০ হেক্টর জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে প্রায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। ফলে প্রতিটি পরিবার তাদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, মহিলাদের কর্মসংস্থান ও পরিবারের আয়ও বৃদ্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। রুফটপ গার্ডেনিং বা ছাদ কৃষি আমাদের দেশে ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে ঢাকা সিটিতে বিল্ডিংয়ের উপর যে ছাদ তার আয়তন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির সমান। সেখানে সফলভাবে ছাদ বাগানে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ছাদ বাগানে ১ মিটার ও ০.৬ মিটার আকারের ৪টি ট্রেতে ৭০-৮০ দিন পর ২.৫-৩.০ কেজি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব যা ৪-৫ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক পারিবারিক চাহিদা মেটানো সম্ভব। 
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সফলতার গল্প
মোঃ কুতুব উদ্দিন, গ্রাম : ঘাগুরদুয়ার, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া থেকে কোকোপিটে উৎপাদিত বারি পেঁয়াজ-৫ এবং বারি মরিচ-২ এর চারা আন্তঃফসল হিসেবে ১৫ শতক জমিতে রোপণ করে (খরিফ-১)  ৮০ দিন পর পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন এবং ফলন পান প্রতি শতাংশে প্রায় ১.৫ মণ এর বেশি। তিনি জমিতে মোট ২০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলেন। উক্ত পেঁয়াজ থেকে ছোট আকৃতির (১০-২০ গ্রাম) প্রায় ৬ মণ পেঁয়াজ রেখে দিয়েছিলেন পরবর্তী মৌসুমে মুড়ি পেঁয়াজ করার জন্য। বাকি পেঁয়াজ প্রতি মণ ৮৫০/- (আটশত পঞ্চাশ) টাকা হিসাবে মোট ১১৯০০/- (এগারো হাজার নয়শত) টাকায় বিক্রয় করেন। বারি মরিচ-২ থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করেন। পরবর্তীতে তিনি তার সংরক্ষিত ছোট আকৃতির পেঁয়াজ মুড়ি পেঁয়াজ করার জন্য আন্তঃফসল হিসেবে কলা এবং বেগুনের জমিতে খরিপ-২ তে  রোপণ করেন (১৪/১০/২০২১ইং তারিখে)।  ৮৮ দিন পর ফসল সংগ্রহ করেন। পাতাসহ পেঁয়াজ বিক্রি করেন ২২০০০/- টাকার। প্রতিটি পেঁয়াজের গড় ওজন ছিল ২৫০-৩৫০ গ্রাম, পাতাসহ গড় ওজন ছিল ৩৫০-৪৫০ গ্রাম। বাল্ব  পেঁয়াজ হিসেবে ১২ মণ পেঁয়াজ এবং প্রতি মণ ১২০০/- টাকা হিসাবে মোট ১৪,৪০০/- টাকায় বিক্রয় করেন । আন্তঃফসল হিসেবে ১৫ শতক জমিতে ৭ মাসে ২১৯০০/- (একুশ হাজার নয়শত) টাকা খরচ বাদে আন্তঃফসল হিসেবে শুধু পেঁয়াজ এবং মরিচ ফসল তার মোট আয় হয় ৪৬,৪০০ (ছেচল্লিশ হাজার চারশত) টাকা মাত্র। 
এ ছাড়াও বগুড়া, জয়পুরহাটের অধিকাংশ কৃষক পেঁয়াজ চাষ করে সফল হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ অতি উচ্চমূল্যের লাভজনক একটি অর্থকরী ফসল। চারা রোপণের ৭০-৮০ দিন পর সবুজ অবস্থায় সংগ্রহ করা যায় বলে, অনেক ফসলের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে লাভজনকভাবে চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশের সকল পেঁয়াজ উৎপাদন এলাকায় সহজেই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও বিএডিসি যৌথভাবে কৃষক পর্যায়ে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছে। কৃষকদের যথা সময়ে বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পেঁয়াজের উপযুক্ত বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ দ্রুত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। ফলে আমাদের দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করে অতিরিক্ত পেঁয়াজ বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, শিবগঞ্জ, বগুড়া। মোবা: ০১৭১১২৪৬৩৫২, ই-মেইল: ফসহধষধস@ুধযড়ড়.পড়স