Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয়

পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয়
ড. এটিএম মোরশেদ আলম
পাট একটি দ্বি-বীজপত্রী আঁশ উৎপাদনকারী ফসল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম এবং ঐতিহ্যবাহী অর্থকরী ফসল যা সোনালী আঁশ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পাট আঁশের মান পৃথিবীর অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর চেয়ে অনেক ভাল এবং আঁশ উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য যে, পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের পাটের খ্যাতি এখনও বিশ্বজোড়া। বর্তমানে গোটা বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এদেশের পাটচাষি কৃষকরা বিগত কয়েক বছর ধরে পাটের ভালো দাম পাচ্ছে। সুতরাং, পরিবেশ বান্ধব পাটের উৎপাদনশীলতা ও আঁশের ফলন বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরও মনোযোগী এবং সচেষ্ট হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
পাট আঁশের উৎপাদন 
বাংলাদেশে খরিফ মৌসুমে পাট ফসলের চাষাবাদ হয়। পাট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার ফসল যা ২৪-৩৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এবং ৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা সম্পন্ন এলাকায় ভালো জন্মে। নদ-নদী বিধৌত এদেশের পলি মাটি পাট চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। তাই বাংলাদেশের মাটিতে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাট আঁশ উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭.০-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়ে থাকে এবং আবাদকৃত জমি হতে প্রায় ৮০.০-৯০.০ লাখ বেল পাটের আঁশ পাওয়া যায়। বিগত ৫ বছর পাটের আবাদকৃত জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন এবং আঁশের ফলন সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
সারণি-১ তে বর্ণিত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিগত ৫ বছরে বাংলাদেশে পাট আবাদের পরিমাণ গড়ে ৭.০ লাখ হেক্টর, আঁশের মোট উৎপাদন গড়ে ৭৮.৩১ লাখ বেল বা ১৪.২১ লাখ টন এবং পাট আঁশের গড় ফলন ১১.১৭ বেল/হেক্টর বা ২.০৩ টন/হেক্টর। সুতরাং পাটের আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যদি পাটের আবাদ বাড়ানো যায় তাহলে আঁশের মোট উৎপাদনও বেড়ে যাবে।
পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য করণীয়
(১) উচ্চফলনশীল জাতের পাটের আবাদ সম্প্রসারণ করা : বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিগত ১৩ (২০০৮-২০২১) বছরের শাসনামলে বিজেআরআই কর্তৃক পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের  মোট ১৩টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তন্মধ্যে দেশি পাটের ৬টি, তোষা পাটের ৩টি, কেনাফের ২টি এবং মেস্তার ২টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এই ১৩টি উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে আগাম কর্তনোপযোগী বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) এবং লবণাক্তসহিষ্ণু বিজেআরআই দেশি          পাট-১০ সর্বশেষ উদ্ভাবিত জাত যেগুলোকে যথাক্রমে ২০১৯ এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সারাদেশে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। উল্লিখিত জাতগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সারণি-২ এ উল্লেখ করা হলো।
বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত এসব উচ্চফলনশীল জাতের পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসলের চাষাবাদ কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২) ভালো গুণগত মানসম্পন্ন পাটবীজ সময়মতো কৃষকদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করা : বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫.০০-৫.৫০ হাজার মেট্রিক টন পাট বীজের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে মাত্র ১০০০ মেট্রিক টন পাট বীজ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি বীজ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে বা অবৈধ পথে বাংলাদেশ প্রবেশ করে। এসব বীজ বেশির ভাগ সময়ই নিম্নমানের হয়ে থাকে। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশের পাটচাষিরা বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের ভালো বীজ সময়মতো না পাওয়ায় তারা সুলভ মূল্যে সহজপ্রাপ্য ভারতীয় বীজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ভারতীয় জাতের বীজ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাট বীজ বপন মৌসুমের পূর্বেই কৃষকদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) সঠিক সময়ে বীজ বপন করা : সঠিক সময়ে বীজ বপনের উপর পাট ফসলের আঁশের ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে। পাট বীজ বপনের সঠিক সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস। এ সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য ১২-১৩ ঘণ্টা, তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সে.-৩৫ ডিগ্রি সে. এবং বাতাসের আর্দ্রতা ৬০% থেকে ৯০% থাকে যা পাট গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। এ সময়ের আগে বা বেশি পরে বীজ বপন করলে পাট গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং গাছে অকালে ফুল আসে। ফলে আঁশের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সময়ে পাটের বীজ বপন করতে হবে যাতে পাট গাছ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সুযোগ পায়।
(৪) অপ্রচলিত এলাকায় পাটের আবাদ সম্প্রসারণ করা : পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যাদি আবিষ্কারের ফলে একসময় বিশ্বব্যাপী পাট পণ্যের চাহিদা কমতে থাকে। ফলে বিশ্ব বাজারে পাটের দাম কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং একপর্যায়ে তারা পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তখন পাটের চাষাবাদ কমতে কমতে প্রান্তিক জমিতে (গধৎমরহধষ ষধহফ) নেমে আসে। কিন্তু, সম্প্রতি পরিবেশ সচেতনতার কারণে মানুষের মাঝে পরিবেশবান্ধব পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে বিশ্ব বাজারে পাট পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে পাটের মূল্যও বেশ বেড়ে যায়। এরই প্রভাবে আমাদের দেশের পাটচাষিরা বিগত কয়েক বছর থেকে পাটের ভাল মূল্য পাচ্ছে এবং কৃষকদের মাঝে পাট চাষের আগ্রহ বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ উপযোগী লবণাক্তসহিষ্ণু পাট জাতের চাষাবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে তেমনি কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং পাটের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
পাট পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তু। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতার ফলে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে ধরে রাখার জন্য পাটের আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য আরও অধিক উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন পাটের জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অপ্রচলিত এলাকায় ও অনাবাদি জমিতে পাটের আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতঃ  বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাটবীজ বপন মৌসুমের পূর্বেই কৃষকদের কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রণীত রোডম্যাপ অতি দ্রুততার সাথে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন বলে পাট সংশ্লিষ্টরা সকলে মনে করেন।


লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭৪০৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : সড়ৎংযবফনলৎর@মসধরষ.পড়স