Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ

বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ
কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী

জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পানীয় হিসাবে চায়ের পরেই কফির স্থান। কফি ফলের পরিপক্ব বীজ ভেজে গুঁড়ো করে কফি তৈরি করা হয়। বিশ্বের প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছেÑব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভারত, ইন্দেনেশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, গুয়েতেমালা প্রভৃতি।


কফি Rubiaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কফি একটি চিরসবুজ, ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ। পাতা সরল, চওড়া, গাঢ় সবুজ বর্ণের। ফুল সাদা, সুগন্ধযুক্ত এবং প্রতি কুড়িতে ২-২০টি ফুল থাকতে পারে। ফল ড্রুপ, লাল বা হলদে বর্ণের এবং আকারে অনেকটা গোলাকার। এটি বেরি অথবা চেরি ফল নামেই অধিক পরিচিত। প্রতি ফলে অর্ধ গোলাকার ২টি বীজ থাকে। এই বীজ বিন (Bean) নামে পরিচিত প্রাথমিক শাখাকে প্লাজিওট্রপিক শাখা বলে এবং এই শাখা অনেকটা ভূমির সমান্তরালভাবে বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে মাধ্যমিক শাখাকে শোষক বা অর্থোট্রপিক শাখা বলে এবং এই শাখা খাঁড়া থাকে। কেবল প্রাথমিক তথা সমান্তরাল শাখাতে ফুল ও ফল হয়।


পরিবেশগত চাহিদা : কফি উষ্ণমণ্ডলীয় ফসল। এর জন্য উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন। তবে ফসলের পরিপক্বতার সময়ে কিছুটা শুষ্ক জলবায়ু দরকার। কফির জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমপক্ষে ১২৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। তবে কম বৃষ্টিপাতের স্থানে জমিতে সেচ, জাবড়া প্রয়োগ ও অন্যান্য পদ্ধতিতে মাটির রস সংরক্ষণের মাধ্যমে কফির চাষ করা যেতে পারে।


মাটি : যে কোন বুনটের মাটিতেই কফির চাষ করা সম্ভব। তবে ৬ থেকে ৬.৫ পিএইচ মানের সামান্য অম্লযুক্ত জৈব পদার্থ যুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি কফির জন্য উত্তম। পাহাড়ি উপত্যকা, ঝরনার পাশের জমি এবং যে জমিতে লবণাক্ততা নেই সেসব জমি কফি চাষের জন্য উত্তম। কফি গাছ গোড়ায় জমানো পানি সহ্য করতে পারে না।


জমি প্রস্তুত : চা এর ন্যায় কফিও পাহাড়ের/টিলার ঢালেই বেশি চাষ করা হয়। জমিকে আগাছামুক্ত করে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। তবে কফি গাছ ছায়া পছন্দ করে বিধায় জমিতে বিদ্যমান কোন বড় গাছ থাকলে তা রেখে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ট্রেসিং এবং কন্টুর পদ্ধতি অনুসরণ করে কফি গাছ লাগানো যেতে পারে। 

 
চারা তৈরি : কফির বীজ ও কলম থেকে চারা তৈরি করা যায়। বীজ থেকে চারা তৈরি করতে প্রথমে নির্বাচিত জাতের কফি গাছ থেকে সম্পূর্ণ পরিপক্ব, পুষ্ট এবং রোগ-পোকার আক্রমণ মুক্ত ফল সংগ্রহ করা হয়। এরপর ফলের খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার পনি দ্বারা ধুয়ে নিয়ে চালুনির মাধ্যমে ছেকে ভালো বীজগুলোকে আলাদা করা হয়। বীজগুলো ভালোভাবে শুকানোর জন্য শুকনা কাঠের গুঁড়া বা ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে ছায়াতে ছড়িয়ে রাখা হয়। ৪/৫ দিন পর বীজ থেকে কাঠের গুঁড়া/ছাই সরিয়ে ফেলা হয়। চারা তৈরির জন্য ১ মিটার চওড়া ও ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু বীজতলা তৈরি করা হয়। ৬ মিটার লম্বা ও ১ মিটার চওড়া বীজতলার মাটিতে ৪ ঝুড়ি গোবর বা কম্পোস্ট, ২ কেজি কৃষি চুন এবং ২০০ গ্রাম টিএসপি সার ব্যবহার করা উচিত। বীজের সমতল দিক নিচের দিকে রেখে ১.৫ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাইনে বীজ বপন করা হয়। এরপর বীজের উপর খুব ছোট দানার মাটির গুঁড়া ছিটিয়ে পাতলা আবরণে ঢেকে দেয়া হয়। বীজতলার উপরে ৫ সেন্টিমিটার পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর নিয়মিত ঝাঁজরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। বীজতলায় যাতে সরাসরি সূর্যালোক না পড়তে পারে সেজন্য ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে বীজ গজিয়ে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এই চারাকে দ্বিতীয় নার্সারি বেডে বা পলিব্যাগে  স্থানান্তর করা হয়। খুব সকালে বা পড়ন্ত বিকেলে এ কাজটি করা হয়। পলিথিনের মাটির মিশ্রণ হবে দো-আঁশ মাটি ৬ ভাগ, গোবর বা কম্পোস্ট ২ ভাগ এবং বালু ১ ভাগ। নিয়মিত পানি সেচ দেয়ার পাশাপাশি চারার বয়স ২ মাস হলে ৪.৫ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার গুলিয়ে ১ বর্গমিটার স্থানের চারার উপর স্প্রে করলে সুস্থ-সবল চারা পাওয়া যায়। বীজতলার উপরের ছাউনি পাতলা করে দিতে হবে এবং বর্ষার শুরুতে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে হবে।


রোপণ : বর্ষা মৌসুমের শুরুতে কফির চারা রোপণ করা উত্তম
(মে-জুন)। কোন কোন জাতের শাখা প্রশাখার যথেষ্ট বৃদ্ধি হতে বেশ সময় লাগায় ঐ ক্ষেত্রে ঘন করে গাছ রোপণ করা হয় এবং পরবর্তীতে মাঝে মাঝে গাছ কেটে পাতলা করা হয়। এরাবিকা জাতের জন্য গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ থেকে ২.৫মিটার আর রোবাস্টার জন্য ২.৫ মিটার থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত রাখতে হবে। আবার প্রথমে ১ থেকে ১.৫ মিটার দূরত্বে ঘন করে গাছ লাগিয়ে ২/৩ বছর কফির ফলন তোলার পর অর্ধেক গাছ তুলে ফেলা যায়। জুন থেকে অক্টোবরে ১৬ থেকে ১৮ মাস বয়সের চারা লাগাতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা হবে ৪৫ সেন্টিমিটার করে। গর্তে চারা লাগানোর সময় প্রধান মূল যাতে পেচিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রোপণের পর ভালোভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটি কিছুটা উঁচু রাখতে হবে। প্রথম কিছুদিন চারা গাছকে প্রখর সূর্যালোক হতে রক্ষা করলে ভালো হয়। প্রবল বাতাসে হেলে যাওয়া রোধে চারাকে খুঁটির সংগে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।


সার প্রয়োগ : সার প্রয়োগের মাত্রা সারণি-১ দ্রষ্টব্য। গাছের গোড়ার ৩০ সেন্টিমিটার দূর দিয়ে চওড়া নালায় সার প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পর সেচ দিয়ে খড় কুটার জাবড়া দিতে হবে। আবার গাছের বৃদ্ধি কমে গেলে এবং ফুল ও ফল ধরার সময় ২০০ লিটার পানিতে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ৪০০ গ্রাম এবং ৩৫০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করা যেতে পারে।
অঙ্গ ছাঁটাই (ট্রেনিং/প্রুনিং) : কফি গাছকে সঠিক কাঠামো দেয়ার জন্য এবং ফলধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। কম বয়সের কফি গাছে দুইভাবে ট্রেনিং করা হয়। যথা: একক কাণ্ড পদ্ধতি এবং একাধিক কাণ্ড পদ্ধতি এক্ষেত্রে এরাবিকা এবং রোবাস্টার ক্ষেত্রে গাছের উচ্চতা গড়ে যথাক্রমে ৭৫ এবং ১১৫ সেন্টিমিটার হলে প্রধান কাণ্ডের মাথার শীর্ষকুঁড়ি কেঁটে
(topping/capping)   দেয়া হয়। এতে পার্শ্বশাখা তথা ফলধারণক্ষম শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে গাছ ঝোপালো হয়। মাটির উর্বরতা এবং গাছের বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে ৩/৪ বার ফলন নেয়ার পর পুনরায় আর একবার এটা করা যেতে পারে। বয়স্ক গাছ থেকে পরিপক্ব ফল সংগ্রহের ৩/৪ সপ্তাহ পর থেকে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগ পর্যন্ত ৩/৪ বছর পরপর একবার কফি গাছের অতিরিক্ত মাধ্যমিক শাখা কেটে প্রুনিং করা হয়।


রোগ ও পোকামাকড় : কফির ক্ষেত্রে রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। তবে বালাই আক্রমণের লক্ষণ দেখে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
ফল সংগ্রহ : চারা রোপণের ২ বছর পর ৩য় বছর থেকে কফি সংগ্রহ করা যায়। এরাবিকা কফিতে ফুল ফোটার ৮-৯ মাস এবং রোবাস্টা কফিতে ১০-১১ মাস পরে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। নভেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। পরিপক্ব ফলের রং লাল হয় এবং ফলে জোরে চাপ দিলে বীজ সহজে বের হয়ে আসে। সাধারণত হাত দ্বারাই ফল তোলা হয়। ১০-১৫ দিন পর পর ৪-৬ কিস্তিতে ফল সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছ থেকে ৫০/৫৫ বছর পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টরপ্রতি ৭৫০-১০০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।


কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ : ভিজা পদ্ধতিতে কফিকে প্রক্রিয়াজাত করে প্লানটেশন বা পার্চমেন্ট কফি তৈরি করা হয়। এ পদ্ধতিতে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহের পরপর ফলের খোসা ও মাংসল অংশকে আলাদা করা হয়। এরপর সাধারণ তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা গাজিয়ে (fermentation) নিয়ে অথবা ১-২ ঘণ্টা ১০% কস্টিক সোডা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে বীজের গায়ে লেগে থাকা পিচ্ছিল পদার্থ অপসারণ করে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করা হয়। তারপর কফি বিনকে ৭ থেকে ১০ দিন রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। আবার শুকনা পদ্ধতিতে চেরি কফি তৈরি করার জন্য গাছ থেকে পরিপক্ব ফল পাড়ার পর পরিষ্কার মেঝেতে ১২ থেকে ১৫ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।


সম্ভাবনা : পার্বত্য জেলাগুলোতে বিগত কয়েক বছর যাবত বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হয়ে আসছে। খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে কফি উৎপাদিত হচ্ছে, যা গুণগতভাবে আন্তর্জাতিক মানের। রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং রাঙ্গমাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলায় বিভিন্নস্থানে কফির প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় বেশ কিছু কফি বাগান গড়ে উঠেছে।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাঙ্গামাটি।  মোবাইল : ০১৭১২৮১৬৩৫২, prosenjit0759@yahoo.com