Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পরিবেশ সুরক্ষায় ধান চাষে করণীয়

পরিবেশ সুরক্ষায় ধান চাষে করণীয়
ড. মো. শাহজাহান কবীর

বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে উদ্বৃত্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়। এ সমস্ত জমি থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস-মিথেন (CH4), কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ও নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) যেমন নিঃসরিত হয় তেমনি ধান গাছ তার শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড ফর্মে এসব গ্যাস শোষণ করছে। ধান গাছ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের চেয়ে বেশি শোষণ করে প্রকৃত ব্যাখ্যা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হলো। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ ২০১৩ সাল থেকে এর উপর গবেষণা করে আসছে। যেখানে তারা দেখেছে ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে ৬৬৬ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড, ৫৩ গ্রাম মিথেন এবং ০.৫ গ্রাম নাইট্রাস অক্সাইড ধানক্ষেত থেকে নিঃসরিত হয়। অন্যদিকে এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ধানগাছ ২২০০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড ফটোসিনথেটিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করে। এছাড়া মিথেন বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্পের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও হাইড্রোজেন গ্যাসে রূপান্তরিত হয়, যা ধান ও অন্যান্য গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করে। একইভাবে নাইট্রাস অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্পের সাথে বিক্রিয়া করে এমোনিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে এবং এই এমোনিয়াম বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে এমোনিয়ায় রূপান্তরিত হয় এবং বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে আসে যা গাছ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রেও ধান গাছের অ্যারেনকাইমা ((Aerenchyma)) চ্যানেল দিয়ে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ধান গাছের শিকড়ের মাধ্যমে মাটিতে আসে যা মিথেনের সাথে বিক্রিয়া করে মিথানোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কার্বন  ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে যা গাছ গ্রহণ করে এবং এই প্রক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে মিথেন নিঃসরণে বাধা দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ধান চাষাবাদে ধানগাছ মাত্র ৫-১০% মিথেন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে বাকি ৯০-৯৫% মিথেন মাটি থেকে আসে। জলাবদ্ধ জমিতে লেবাইল জৈব কার্বন 
(Labile organic carbon) এবং মিথানোজেনিক ব্যাক্টেরিয়া মিথেন উৎপন্ন করে। অতএব, দেখা যায়, ধান চাষের চেয়ে পতিত জমি মিথেন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী।


বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মওসুম মিলিয়ে পাঁচ কোটি টনের অধিক ধান উৎপাদন হয়। সে হিসাবে মোট পাঁচ কোটি টন ধান উৎপাদনে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৩৩.৩ মিলিয়ন টন, মিথেন ২.৬৫ মিলিয়ন টন এবং নাইট্রাস অক্সাইড এর পরিমাণ ০.০২৫ মিলিয়ন টন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং পটেনশিয়াল ফর্মুলা অনুযায়ী এই তিনটি   গ্রিনহাউজ গ্যাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য নিঃসরণের পরিমাণ ১০৬.২ মিলিয়ন টন। অপরদিকে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ধানগাছ ২২০০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। অতএব মোট পাঁচ কোটি টন ধান উৎপাদনে প্রায় ১১০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে শোষিত হয়। উল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী ধান চাষে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের তুলনায় ৩.৮ (১১০.০-১০৬.২) মিলিয়ন টন বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ করে। ফলশ্রুতিতে ধান চাষ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের চেয়ে অনেক বেশি শোষণ করে বরং বায়ুমণ্ডলকে পরিচ্ছন্ন করছে।


উদাহরণস্বরূপ খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর বিল। বিলটিতে আবাদি জমির পরিমাণ দুই হাজার বিঘার বেশি। পাশেই পশ্চিম মহারাজপুর। সেখানে জমির পরিমাণ ছয় হাজার বিঘার মতো। লবণাক্তপ্রবণ ওই বিলসহ আশপাশের বিলে একসময় মাত্র একটি ফসল হতো। আর সেটি হলো বর্ষায় আমন ধান। এরপর পুরো বছরই জমি পড়ে থাকে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গরম বাতাস আর ধূলিঝড় ছিল সেখানে নিত্যকার ঘটনা। কিন্তু ২০১৭ সালে ব্রি বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো পূর্ব মহারাজপুর বিলে বোরো ধানের চাষ করেন কৃষকেরা। বর্তমানে মহারাজপুর গ্রামে প্রায় প্রতিটি বিলেই ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯ ও বিনাধান-১০সহ অন্যান্য ধান চাষাবাদ হচ্ছে যেখানে আগে কখনও বোরো ধান আবাদই হতো না। ওই জমিতে কৃষক বিঘাপ্রতি (০.১৩৭৫ হেক্টর) ২২ থেকে ২৫ মণ (৮.২১১ থেকে ৮.৩৩১ মেট্রিক টন) ফলন পাচ্ছেন উপরন্তু যেখানে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গরম বাতাস আর ধূলিঝড়ের কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারতো না, মহিলারা দিনের বেলায় চুলা জ¦ালাতে পারত না। আর এখন ধান চাষের কারণে ধূলিঝড় নেই, পরিবেশও আগের তুলনায় অনেক ঠাণ্ডা ও নির্মল হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি ধান চাষই এ বিলের বায়ুমণ্ডলকে পরিছন্ন করেছে। এ ধরনের অনেক উদাহরণ খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকায় রয়েছে।


অনুরূপভাবে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের। যেখানে রাজশাহীতে মরুকরণ ঠেকানোর জন্য কত পরিকল্পনা, কত প্রকল্প নেয়া হলো কিন্তু যখন থেকে বোরো ধান চাষাবাদ শুরু হলো তখন থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে আগের ধুলোও নেই, এত গরমও নেই, যা ধান আবাদেরই সুফল। অধিকন্তু দেশের খাদ্য উৎপাদনের বিশাল একটি অংশ আসে বরেন্দ্র অঞ্চলের বোরো আবাদ থেকেই।


যে বিষয়টির প্রতি আমাদের সবচেয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন তা হলো সবকিছু ঠিক রেখে কিভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানো যায়। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এবং তা বাস্তবায়নে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। যেমন-ব্রি এমন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছে যা বেশি পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। কারণ আমরা জানি ধানগাছ একটি C3 উদ্ভিদ। বায়ুতে CO2 এর পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে ধানগাছ বেশি পরিমাণে CO2 শোষণ করে নেয় এবং অধিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট উৎপন্ন করে। এর ফলে ধানের ফলন বৃদ্ধি পায়। অধিক ঈঙ২ শোষণকারী জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ব্রি জিন ব্যাংকে সংরক্ষিত জার্মপ্লাজম থেকে পরীক্ষণের মাধ্যমে এমন জাত শনাক্ত করেছে যাদের CO2 এর প্রতি Responsiveness বেশি এবং অধিক উৎপাদনক্ষম। ভবিষ্যতে অধিক CO2 শোষণকারী এবং অধিক উৎপাদনক্ষম জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে এ জার্মপ্লাজমগুলো ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ধানচাষ থেকে আরো কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানোর পদ্ধতি ব্যবহার, পরিমিত ও ব্যালেন্স সার ব্যবহার, ইউরিয়া সার ছিটিয়ে ব্যবহারের পরিবর্তে মাটির গভীরে প্রয়োগ এবং Good Agriculture Practices (GAP) অর্থাৎ উত্তম কৃষি চর্চা ব্যবহারের জন্য কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।


আমরা এখন ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের (4IR) দ্বারপ্রান্তে এবং বাংলাদেশ এরই মধ্যে এর সাথে যুক্ত হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ আশাতীত কমে যাবে বলে আমি মনে করি কেননা এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রিসিশন এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস নিশ্চিত হবে। জেনোম এডিটিং এর মাধ্যমে গ্রিনহাউজ গ্যাস শোষণকারী কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবন এবং ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমেও নিঃসরণ কমানো যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহারের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত (Artificial rainfall) ঘটানো সম্ভব হবে, ডি-স্যালিনাইজেশন (De-Salinization) প্রক্রিয়া সহজতর হবে এবং সোলার এনার্জি (Solar energy) এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আশাহত না হয়ে আশান্বিত হয়ে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করাই শ্রেয়। য়

মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। ফোন : ৪৯২৭২০৪০, ই-মেইল : dg@brri.gov.bd