Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষক গ্রুপসমূহের করণীয় কার্যক্রম

কৃষক গ্রুপসমূহের করণীয় কার্যক্রম
রাজেন্দ্র নাথ রায়

বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর গ্রুপ কৃষকদের নিয়েই অধিকাংশ কাজ করছে। আগে প্রদর্শনী এবং কৃষি যন্ত্রপাতি একক কৃষককে দেয়া হলেও, বর্তমানে গ্রুপ কৃষকদের দেয়া হচ্ছে। আধুনিক এই কৃষি সম্প্রসারণ নীতির অনেক ভালো দিকও রয়েছে। কারণ কৃষক গ্রুপে কোন উপকরণ/প্রদর্শনী/কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়া হলে, এর সুফল গ্রুপে থাকা প্রায় ২০-৩০ জন কৃষক পেয়ে থাকে। তবে কোনো গ্রুপে সদস্যদের মধ্যে কোন্দল থাকলে, সে গ্রুপের পারফরম্যান্স তেমন ভালো হয় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চলমান অধিকাংশ প্রকল্পগুলো যেমন : রাডারডিপি, এনএটিপি, জিকেবিএসপি, ব্লুগোল্ড, আইএফএমসি, ধান, গম ও পাট ও ডাল, তেল ও মসলা ইত্যাদি প্রকল্পগুলো গ্রুপ কৃষক নিয়ে কাজ করছে। গ্রুপের সফলতা নির্ভর করে সেই গ্রুপে থাকা সদস্যদের কাজের পারফরম্যান্সের ওপর। তাই, সদস্য কৃষকরা গ্রুপে থেকে কি কি কাজ করবে, গ্রুপ মিটিং এ কি করবে, সঞ্চয় কোন কোন খাতে ও কোন পদ্ধতিতে খরচ করবে এসব সুস্পষ্টভাবে জানা দরকার।
কৃষক গ্রুপগুলোর ৩ ধরনের কাজ করা প্রয়োজন।
ক) কৃষি বিষয়ক কাজ
যেকোন কৃষক গ্রুপের কৃষি বিষয়ক কাজগুলোই হচ্ছে প্রধান কাজ। কৃষিবিষয়ক কাজগুলোর মাধ্যমে কৃষকরা বিভিন্ন রকম ফসল যেমন : দানা ফসল, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি উৎপাদন করে। কৃষি বিষয়ক কাজগুলো সফলতার সাথে করতে পারলে পরবর্তিতে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজের সফলতা আশা করা যায়। কৃষিবিষয়ক কাজগুলো হচ্ছে : শাকসবজি আবাদ, নতুন ফসল (যেমন : ক্যাপসিকাম/সূর্যমুখী), ফসলের নতুন আধুনিক জাত চাষাবাদ  (যেমন: রেডলেডি পেঁপে/বারি ১৪ সরিষা/ ৮৯ ধান/থাই পেয়ারা), উচ্চমূল্য ফসল আবাদ (যেমন: কাজুবাদাম), উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন ফসল আবাদ (যেমন: সজিনা), পারিবারিক সবজি বাগান/৫ বেডে ৫ শাকসবজি ও মাচায় লাউ/শসা/শিম,  বিষমুক্ত/নিরাপদ ফসলের চাষাবাদের ক্ষেত্রে জৈবিক পদ্ধতি অনুসরণ (যেমন: লিউর, পার্চিং, আলোক ফাঁদ, ছাই/নিম/মেহগনি/ বিষকাটালী ব্যবহার), কম বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার (যেমন: সাকসেস/ট্রেসার), সমকালীন চাষাবাদ (যেমন: একসাথে বীজতলা তৈরি ও চারা লাগানো), কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার (যেমন: কম্বাইন হারভেস্টার), কম্পোস্ট/কেঁচো কম্পোস্ট, কৃষি ভিজিট/মোটিভেশনাল ট্যুর (১৩টার মধ্যে কমপক্ষে ১০টা করতে হবে)
বিষমুক্ত/নিরাপদ ফসল আবাদ এর গুরুত্ব : প্রতিদিন বিষ খাওয়া হচ্ছে, তাই আমাদের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হচ্ছে। অবস্থা এত খারাপ যে, যেকোন কৃষক গ্রুপে গিয়ে ১০০% সুস্থ ব্যক্তিদেরকে হাত তুলতে বললে, কেউ হাত তোলে না যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাই বলে, তাদের কোন না কোন অসুখ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হলো স্বাস্থ্যের এমন খারাপ অবস্থা? সত্যি কথা বলতে, আমরা কেউই কীটনাশক বোতলের এক চামচ কীটনাশক খাওয়াার সাহস রাখি না। কিন্তু পরোক্ষভাবে সবাই বিষাক্ত খাবার দিন-রাতে ৩বার খাচ্ছি। বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বললে বলা যায় যে, আমরা শাকসবজি ও বিভিন্ন ফসলে যে কীটনাশক স্প্রে করে থাকি তার কিছু অংশ বিষ রান্না করার পরেও রয়ে যায় যাকে ইংরেজিতে বলে রেসিডিউয়াল ইফেক্ট এবং এই বিষাক্ত ফসল আমরা দিন-রাতে ৩ বার খাই। এজন্যই আমাদের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হচ্ছে। তাই নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা/উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করা বাঞ্চনীয়।
খ) কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ
কৃষিবিষয়ক কাজের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজগুলো করা প্রয়োজন। একাজগুলো হচ্ছে : উপজেলা শহর/ জেলা শহর/ বিভাগীয় শহর/ রাজধানী শহরে (ঢাকায়) ফসল বিক্রয়, কৃষি খামার গঠন, কৃষি ভ্যান চালুকরণ, কৃষিযন্ত্র ভাড়া দেয়া, প্রতি মাসে মিটিং ও সঞ্চয় জমা করা, কৃষি লোন (৪% সুদ মাত্র) গ্রহণ, বীজ উৎপাদন ও বিক্রয় (যেমন: এসএমই সরিষা/রসুন/ধান) (৭টার মধ্যে কমপক্ষে ২টা করতে হবে)
উদাহরণস্বরূপ জাপানের কৃষক গ্রুপ কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজের মধ্যে -বিষমুক্ত/নিরাপদ ফসলের হোটেল, অটো রাইস মিল, কৃষি খামার, কৃষি পর্যটন, মাইক্রো ক্রয় ও পরিবহণ ইত্যাদি কাজ করছে।
গ) সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজ
কোন কৃষক গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলে সেই কৃষক গ্রুপ দ্রুত সফল হয়। এজন্য সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজগুলো করা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে: বাল্যবিবাহ রোধ, নববর্ষ উদ্যাপন, পিকনিক, গরিব-অসহায়কে সাহায্য, জাতীয় দিবস উদ্যাপন ইত্যাদি (৫ টার মধ্যে কমপক্ষে ১টা করতে হবে)
রেজিস্টারের তথ্য পূরণ
কৃষক গ্রুপের বিভিন্ন তথ্য, আয়-ব্যয় ও অন্যান্য বিষয়ের রেকর্ড রাখার জন্য রেজিস্টারে তথ্য পূরণ করা একান্ত প্রয়োজন। গ্রুপে বিভিন্ন রকম রেজিস্টার থাকে। রেজিস্টারের নাম, উদ্দেশ্য এবং রেজিস্টারের তথ্য আপডেট করার সুবিধা সারণি-১ দ্রষ্টব্য।     
গ্রুপ মিটিংয়ে করণীয়
গ্রুপ মিটিং হচ্ছে কৃষক গ্রুপের জন্য অনেক কাক্সিক্ষত একটি দিন। কারণ এদিন সকল সদস্য একত্র হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গ্রুপ মিটিং প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে যেমন: ০১ তারিখে করলে ভালো হয়। গ্রুপ মিটিং এ করণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে: ১। কৃষি বিষয়ক/কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ/সমাজ সচেতন বিষয়ক আলোচনা এবং নিজেদের পারফরম্যান্স এবং স্কোর নির্ধারণ করা; ২। গ্রুপে আবাদকৃত সকল ফসলের বর্তমান ও আগামী ১ মাসের পরিচর্যা সম্বন্ধে আলোচনা- উৎপাদন রেজিস্টারে আয়-ব্যয় হিসাব করা; ৩। ট্রেনিং ম্যানুয়াল নিয়ে এসে আলোচনা করা; ৪। উপসহকারী কৃষি অফিসার/কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার/উপজেলা কৃষি অফিসার কে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফ্রি পরামর্শ গ্রহণ করা; ৫। সঞ্চয় ও খরচের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তা রেজিস্টারে পূরণ করা; ৬। প্রয়োজনে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি/ সেক্রেটারি/ক্যাশিয়ার পাল্টানো; ৭। সভাপতি/সেক্রেটারির মাধ্যমে কৃষি অফিস/ডিলার/কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করা; ৮। কৃষি অফিসার ও ডিলার এর সাথে যোগাযোগ করে ন্যায্যমূল্যে সার বীজ ক্রয় করা, যাতে দাম ১ টাকা বেশি না লাগে; ৯। কৃষি অফিস হতে বিনামূল্যে বরাদ্দকৃত কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন কর্মসূচির সার বীজ পেতে ইউপি চেয়ারম্যানকে আমন্ত্রণ জানানো এবং মাঝেমাঝে যোগাযোগ করা; ১০। ফসলের সমস্যায় কৃষি পরামর্শ/প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করা; ১১। কৃষি অফিস হতে কৃষক গ্রুপে দেয়া প্রদর্শনী প্লট সকল সদস্য মিলে পরিদর্শন করে প্রদর্শনীর বিশেষ/ভালো বৈশিষ্ট্য সকল সদস্যকে জানতে হবে; ১২। প্রদর্শনী ফসল ভালো মনে হলে বীজ সংরক্ষণ করে আগামী বছর সকল সদস্য মিলে চাষাবাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সঞ্চয় কাজে লাগানোর পরামর্শ
সঞ্চয়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো কোন একটি কৃষক গ্রুপের বড় একটি সফলতা। তাই সঞ্চয় কাজে লাগানোর ভালো একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে; ১। কৃষিবিষয়ক যেকোন ১০টি কাজের জন্য ভালো কোম্পানির ভালো জাতের শাকসবজির বীজ/চারা ক্রয় ও সকলে মিলে আবাদ করা। অনুরূপভাবে,  কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ ও সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজে বিনিয়োগ করা যেতে পারে; ২। পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিতকরণে ভালো জাতের শাকসবজির বীজ/চারা ক্রয়, লিউর ক্রয়, সার ক্রয় করে সকল সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে- ৫ বেডে ৫ রকম শাকসবজি ও মাচায় লতাজাতীয় সবজি আবাদ করতে হবে; ৩। বসতবাড়ির ফলগাছ পরিচর্যার জন্য একসাথে সব বাড়ির জন্য সার কিনে প্রয়োগ, মুকুল ঝরে যাওয়া রোধে স্প্রে (যেমন: ফ্লোরা) করা; ৪। ৫/৭ জনকে লটারির মাধ্যমে গরু/ছাগল/মুরগি/হাঁস/ভেড়ার বাচ্চা ক্রয় ও বিতরণ; ৫। নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ করা; ৬। ১/২ সদস্যকে ভ্যান/অটোরিকশা ক্রয় ও বিতরণ; ৭। জমি লিজ/অন্য পুকুর/জলাশয় লিজ নিয়ে চাষাবাদ করা; ৮। কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়া হিসেবে পরিচালনা করা।    
কৃষক গ্রুপের মূল্যায়ন/স্কোর নির্ধারণ
কোন কৃষক গ্রুপ ভালো না মন্দ তা জানার জন্য কৃষক গ্রুপের মূল্যায়ন/স্কোর নির্ধারণ প্রয়োজন। একটি ভালো   কৃষক গ্রুপের স্কোর কমপক্ষে ৮০ হতে হবে।
স্কোর নির্ধারণের সূত্র নিম্নরূপ
কৃষক গ্রুপ স্কোর= কৃষিবিষয়ক কাজের সংখ্যা ী ৬ + কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ ী ৭+ সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজ ী৬।
হাজীপাড়া কৃষক গ্রুপ যদি কৃষি বিষয়ক কাজ ১১টি, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ ১টি ও সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজ ১টি করে তাহলে গ্রুপটির স্কোর হবে=১০ী৬ + ১ী৭ +১ী৬= ৭৩। (এখানে উল্লেখ্য যে, হাজীপাড়া কৃষক গ্রুপ ১১টি কৃষি বিষয়ক কাজ করলেও সারণি-২ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০টির স্কোর পেয়েছে)।
সোনারায় কৃষক গ্রুপ যদি কৃষি বিষয়ক কাজ ১০টি, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ ৩টি ও সমাজ সচেতন ও ঐক্য স্থাপন বিষয়ক কাজ ১টি করে তাহলে গ্রুপটির স্কোর হবে=১০ী৬ + ২ী৭ +১ী৬= ৮০ (অনুরূপভাবে, সোনারায় কৃষক গ্রুপ ৩টি কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ক কাজ করলেও সারণি-২ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২টির স্কোর পেয়েছে)।
পরিশেষে কৃষক গ্রুপসমূহের করণীয় কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় নিরাপদ ফসল ও প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন ও আহারের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে। কৃষিপণ্য বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি সম্ভবপর হবে। পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।

উপজেলা কৃষি অফিসার, নাগেশ্বরী, কৃড়িগ্রাম। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৭৩৬১, ই-মেইল : royrazen.dae@gmail.com