Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষিবিদ দিবস ও কৃষির অগ্রযাত্রা

কৃষিবিদ দিবস ও কৃষির অগ্রযাত্রা

কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী

কৃষিবিদ দিবসের প্রাক্কালে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা। ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বাকসু (Bangladesh Agricultural Central students Union- BAUCSU) 
আয়োজিত এক সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণা দেন। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণাকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আন্দোলন করছিস বলে আমি দাবি মেনে নিলাম তা কিন্তু নয়, আমি চাই ভালো ছাত্র-ছাত্রী কৃষি পড়ুক। আমি তোদের দাবি মেনে নিলাম তোরা আমার মুখ রাখিস।”
কৃষিতে মেধাবী ও অগ্রসর চিন্তার মানবসম্পদ গড়ে তুলতে এবং কৃষি শিল্প, গবেষণা ও সম্প্রসারণে তথা সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে এক সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
বঙ্গবন্ধুর অবদান, অনুপ্রেরণা তথা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সবুজ বিপ্লবের চেতনা চির জাগরুক রাখতে এ দেশের কৃষিবিদ সমাজ ২০১১ সাল হতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি নানা আয়োজনে উদ্যাপন করে আসছে। কৃষিবিদ দিবসের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কৃষিবিদগণ কৃষির ব্যাপক সাফল্য ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সর্বোচ্চ মেধা ও আন্তরিকতার সাথে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের হাল ধরেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতা ও  নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন যেটিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিপ্লব হিসেবেই জানি। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কৃষক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে সবুজ বিপ্লব সফল করে তুলুন। বাংলাদেশকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলুন।”
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির জন্য     কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
* প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষিতে শতকরা ৩১ ভাগ অর্থের সংস্থান রাখেন এবং ১ম ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের ১০১ কোটি টাকা কৃষিতে বরাদ্দ রেখেছিলেন।
*  সমবায় চাষ ব্যতিরেকে পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা জমির সিলিং নির্ধারণ করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন এবং ১৪ এপ্রিল ১৯৭২ পর্যন্ত সকল খাজনা মওকুফ করা হয়।
* কৃষিতে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।
* ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণের ব্যবস্থা করেন। দশ লক্ষাধিক ঋণগ্রস্ত কৃষকের সার্টিফিকেট মামলা সুদসহ মওকুফ করা হয়। উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ দিয়ে দশ লাখ একর জমির ফসল রক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাইশ লক্ষ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ফিলিপাইন হতে সংগ্রহ করে উফশী ধানের বীজ ওজ-৮ কৃষকের মাঝে বিতরণ করেন এবং আধুনিক সেচযন্ত্রের প্রবর্তন করেন।
* এ ছাড়া কৃষি উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ বিভিন্ন  কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্থাপন ও পুনর্গঠন করেন। এভাবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষির যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সেটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত করেছেন। মূলত আজকের কৃষির যে   অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মসূচি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন। এখানে যুক্তিসঙ্গতভাবে উল্লেখ করা যায়। 
২০০৮ সালে দিন বদলের সনদ/২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ৭ নং দফায় ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ৫ নং দফায় পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং ১৫ নং দফায় আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা-যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার   কর্তৃক দেশের কৃষি উন্নয়নে যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে ফসল উৎপাদনে ২০০৮-২০০৯ সাল হতে ২০২০-২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে (সারণি দ্রষ্টব্য)। এ ছাড়া বিগত দশ বছরে ফলের উৎপাদন ১০৩  লক্ষ  মেট্রিক টন হতে ১২২ লক্ষ মেট্রিক টন উন্নীত হয়েছে।
ফসল,মাছ, মাংস উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। ডিম এবং মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ডিম ও মাংসের জনপ্রতি চাহিদা ও প্রাপ্যতা ১০৪টি/জন/বছর এবং ১০৪.২৩টি/বছর/জন। মাংসের চাহিদা ও প্রাপ্যতা ১২০ গ্রাম/দিন/জন এবং ১২৬ গ্রাম /দিন/জন।জনপ্রতি বার্ষিক মাছ গ্রহণ ও চাহিদা ২৩ কেজি (গ্রহণ) এবং ২১.৯০ কেজি (চাহিদা)।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টেকসই, আধুনিক এবং লাভজনক রপ্তানিমুখী কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি সংশ্লিষ্ট যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেমন: জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮, জাতীয় জৈব কৃষি নীতি-২০১৭, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০২০, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতি-২০২০, বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা  নীতিমালা-২০২০সহ বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বীজ আইন-২০১৮, বালাইনাশক আইন-২০১৮, সার ব্যাবস্থাপনা (সংশোধন) আইন-২০১৮সহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় কোভিড-১৯ এর অভিঘাতসহ বিভিন্ন আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কৃষিতে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে, টেকসই আধুনিক এবং লাভজনক রপ্তানিমুখী কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় জাত উদ্ভাবন, সার ব্যবস্থাপনা, কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন, খামার যান্ত্রিকীকরণ, উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি), প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, কৃষকের বাজার, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা সম্প্রসারণ, কৃষি পণ্যের রপ্তানি সহায়তা ইত্যাদি জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করছে। রূপকল্প-২০২১, এসডিজি, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়নে  কৃষি মন্ত্রণালয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীর সর্বাধিক জনঘনত্বের দেশ বাংলাদেশ। ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি হতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ক্রমবধ্যমান জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করাই এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ দেশের কৃষিবিদ সমাজ তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে এটাই কৃষিবিদ দিবসের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। য়

লেখক : সাবেক পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৫০১৪৯২, ই-মেইল : chakrobortykc@gmail.com