Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জনপ্রিয় সুগন্ধি ধানের চাষ ও বাহারি ব্যবহার

জনপ্রিয় সুগন্ধি ধানের চাষ ও বাহারি ব্যবহার
কৃষিবিদ ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম

সুগন্ধি চাল তৈরি হয় বিশেষ জাতের ধান থেকে যা স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর। এদেশে এলাকাভিত্তিক প্রচুর সুগন্ধি ধান আবাদের প্রচলন আছে। দেশি জাতগুলোর চাল আকারে ছোট ও অনেকটা গোলাকার হয়। সুগন্ধি ধানের জাতগুলোর বেশির ভাগই আলোক সংবেদনশীল, দিনের দৈর্ঘ্য কমে গেলে হেমন্তকালে ফুল ও দানা গঠন হয়। আর এ কারণে প্রধানত আমন মৌসুমে (খরিফ-২ তে) সুগন্ধি ধানের চাষ করা হয়। এ মৌসুমে প্রায় ১০% জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ করা হয়। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে আমন ও বোরো দুই মৌসুমে এ সুগন্ধি ধান চাষ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে সুগন্ধি ধানের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দিনাজপুর জেলা। এছাড়া ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ এবং রাজশাহী জেলায় সুগন্ধি ধান চাষ হয়। উল্লেখ্য এ চাল বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
উত্তরাঞ্চলে উপযোগী সুগন্ধি ধানের জাতগুলো
আমাদের দেশে আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৮০, বিনা ধান-৯ ও বিনাধান-১৩ এবং স্থানীয় জাতের মধ্যে কাটারিভোগ, কালিজিরা, চল্লিশাজিরা, চিনিগুঁড়া (জিরাকাটারী), ফিলিপাইন কাটারী, জটাকাটারী, চিনিকাটারী, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, দুলাভোগ, উকনী, কৃষ্ণভোগ, তুলসীমালা উল্লেখযোগ্য। ব্রি ধান৩৪ স্থানীয় সুগন্ধি জাতের ধান চিনিগুড়া বা কালিজিরার মতোই অথচ ফলন প্রায় দ্বিগুণ। কৃষকেরা এ ধানের আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ব্রিধান৭০ ও ব্রিধান ৮০ আমন মৌসুমে ব্রি কর্তৃক সর্বশেষ উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধান এবং আলোক অসংবেদনশীল। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৪.৫-৫.০ মেট্রিক টন, যা কাটারিভোগ ধানের চেয়ে দ্বিগুণ। ব্রি ধান৭০ ধানের চাল দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারি ভোগের চাইতে আরও বেশি লম্বা। আর ব্রি ধান৮০ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় জেসমিন ধানের মতো, সুগন্ধিযুক্ত এবং খেতেও সুস্বাদু। অপরদিকে বোরো মৌসুমে সুগন্ধিযুক্ত আধুনিক জাত হচ্ছে ব্র্রিধান৫০ (বাংলা মতি)। এ জাতের চালের মান বাসমতির মতোই। হেক্টর প্রতিফলন ৬ মেট্রিক টন। তবে চাল তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
মাটি ও আবহাওয়া
সব ধরনের মাটিই সুগন্ধি ধানের উপযোগী, তবে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি উত্তম। ফুল আসার সময় থেকে পরিপক্বতা পর্যন্ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এসময় প্রয়োজন সামান্য আর্দ্রতা, মৃদু বাতাস, শীতল রাত্রি (২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং রৌদ্রজ্জ¦ল আলোকিত দিন (২৫-৩২ডিগ্রি সেলসিয়াস)।
চাষাবাদ পদ্ধতি
রোপা আমন মৌসুমে ৫-২৫ জুলাই (২১ আষাঢ়-১০ শ্রাবণ) পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ২৫-৩০ দিনের চারা প্রতি গুছিতে ২-৩টি করে ২০ সেন্টিমিটারী১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করা হয়।
সার ব্যবস্থাপনা : সুগন্ধি ধানের জমিতে আমন মৌসুমে প্রতি বিঘা বা ৩৩ শতকে ইউরিয়া ১৮-২০ কেজি, টিএসপি ১০-১২ কেজি, এমওপি ১৩ কেজি, জিপসাম ৯ কেজি, দস্তা ১.৩ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার সমান ৩ কিস্তিতে জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে, রোপণের ২০-২৫ এবং ৪৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যে, স্থানীয় সুগন্ধি ধানের জাতে ইউরিয়ার পরিমাণ সাধারণত কম লাগে। তবে এলসিসিভিত্তিক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা উত্তম। শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে উফশী জাতে স্থানীয় জাতের ধানের মতো
সুগন্ধিযুক্ত হয় না। তাই জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সুগন্ধ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
রোপণের পর ৩০-৪০ দিন জমি আগাছা মুক্ত রাখা আবশ্যক। চাল শক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। সুগন্ধি ধানের জাতগুলো সাধারণত ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সেজন্য আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সুগন্ধি শীষ বের হওয়ার আগে ট্রাইসাইক্লাজল/স্ট্রবিন গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে।
ফসল কর্তন ও ফলন
ফসল কর্তনের উপযুক্ত সময় ০১-১৫ অগ্রহায়ণ (১৫-৩০ নভেম্বর)। অধিকাংশ ধানের ছড়ায় শতকরা ৮০ ভাগ ধান পাকা অবস্থাতেই ধান কাটা হয়ে থাকে। সংরক্ষণের জন্য আর্দ্রতা ১২ ভাগের নিচে রাখতে হবে। জাত ও পরিচর্যা ভেদে হেক্টরপ্রতি ২.০-৫.৫ টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব।
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার
কাটারি ভোগ ধানের আতপ চালের পোলাও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাটারিভোগ ধানের চিড়া হয় হালকা ধবধবে সাদা ও মিষ্টিসুগন্ধ। আদিকাল থেকে সুগন্ধি চাল অভিজাত শ্রেণির আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আজও দিনাজপুরের কাটারিভোগ সুগন্ধি চাল দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে সুনাম বজায় রেখেছে। সুগন্ধি চালের পোলাও ছাড়া পিঠা-পুলি, বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, ভুনা-খিচুড়ি, পায়েশ ও ফিরনিসহ বেশ চমৎকার ও সুস্বাদু-যা জিভে জল আনে। বিয়ে, পূজা-পার্বণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের ব্যবহার অতি জনপ্রিয়। অনেক সচ্ছল পরিবারে, বনেদি ঘরে সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ, বাংলামতি) সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়ার রেওয়াজ অহরহ দেখা যায়। দিন দিন এ চালের যেমন ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি উৎপাদনও বাড়ছে। চাইনিজ, ইটালিয়ান, ইন্ডিয়ান হোটেল/রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল/মোটেল পর্যটন কেন্দ্রে প্রধানত সুগন্ধি চালের ভাত, পোলাও নানা পদের খাবার পরিবেশনে সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয়।
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার সম্প্রসারণে করণীয়
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার সম্প্রসারণ কোন একক প্রতিষ্ঠানের সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর/প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নতুন নতুন কর্মসূচির নিয়ে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। যেমন-সুগন্ধিচালে ইনস্ট্যান্ট ফাস্ট ফুড তৈরি করা যেতে পারে। আজকাল দেশ-বিদেশে নানা পদের আধাসিদ্ধ চালের সঙ্গে কিছু পরিমাণ ডাল, সবজি ও প্রক্রিয়াজাত মাংশ একত্রে মিশিয়ে ম্যালামাইন জাতীয় গ্যাস বা মগে সংরক্ষণ করে তা সিল করে বিপণন করা হয়। ফাস্ট ফুড দোকান থেকে তা কিনে উপরের মোড়ক সরিয়ে তাতে পরিমাণ মতো গরম পানি মেশানো হলে তা উপাদেয় পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী বিশেষ করে স্কুল কলেজ পড়ুয়া            ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এ খাবার অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সুগন্ধি চাল দিয়ে এ ধরনের ইনস্ট্যান্ট ফাস্ট ফুড তৈরি ও বিপণনে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিলে সুগন্ধিচাল জনপ্রিয়করণে গুরুত্বপূর্ণ এক নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। সেসাথে ফাস্ট ফুড তৈরির রেসিপি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে তা উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাজারজাতকরণে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে।
সুগন্ধি চালের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থাকে বেগবান করতে হলে এলাকাভিত্তিক দিনব্যাপী কিছু সংখ্যক খাদ্য মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। সেখানে বিদেশি মিশনসহ বিভিন্ন তালিকাভুক্ত হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাওয়াতপত্র বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায়            অংশগ্রহণকারীরা খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ও দেশি সুগন্ধি চালের নানা গুণাগুণ সরেজমিন দেখে উদ্বুদ্ধ ও আকর্ষিত করা সম্ভব। দেশি সুগন্ধিচাল সংশ্লিষ্ট হরেক রকম খাবারের তৈরি রেসিপি ভিডিও তৈরি করে প্রচার উপযোগি দিকগুলো তা হোটেল              কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করে তাদের এ খাবার পরিবেশনে আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। দেশি সুগন্ধি চালের উপকারী ও আকর্ষণীয় দিকগুলো সুন্দরভাবে ভিডিও ডকুমেন্টারি মাধ্যমে প্রচারের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
 রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের তৈরি দেশি সুগন্ধিচালের তৈরি নানা পদের আকর্ষণীয় খাদ্য পরিবেশিত হয়। সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন একই পন্থা অবলম্বন করতে সক্রিয় হয় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন গণমাধ্যম, সরকারি/বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক সংশ্লিষ্ট সব অনুষ্ঠানে এমনকি টকশোতে দেশি সুগন্ধিচাল ও তা থেকে তৈরি খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয়ভাবে সেমিনার/ওয়ার্কশপ আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যেখানে অংশগ্রহণকারী হিসেবে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চি, ম্যানেজার, উৎপাদনকারী ও বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিবর্গ।   আলোচনায় উঠে আসা সুপারিশমালার ভিত্তিতে উৎপাদনকারীরা প্যাকিং, গ্রেডিং, লেবেলিং এর মান উন্নয়ন এবং তা থেকে নিত্য নতুন সুস্বাদু খাবার তৈরি ও পরিবেশন জনপ্রিয়করণে সংশ্লিষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে সুগন্ধি চালের উৎপাদন বাড়ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ দেশি অতি উন্নতমানের সুগন্ধি চালের জাতগুলোর পরিবর্তে বিদেশি বাসমতি জাতের চাল ব্যবহার প্রচলন দেখা যায়। অথচ নিজ দেশের উৎপাদিত সুগন্ধি চাল ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। য়

১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর; ২কৃষিবিদ মো. রাকিবুল হাসান, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ব্রি, রংপুর।