ড. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন মোল্লা
পেয়ারা বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত ফল যার উৎপাদন ও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৯৬.৬১ হাজার একর জমিতে ২.৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপন্ন হয়ে থাকে (বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরো, ২০১৯) যার অধিকাংশই সতেজ ফল হিসাবে ভক্ষণ করা হয়। প্রায় বছরব্যাপী সতেজ ফল হিসাবে এটি পাওয়া গেলেও প্রচলিত জেলি ছাড়া এর তেমন কোনো প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য বাজারে নাই বললেই চলে। আবার যে জেলিটি বাজারে বিদ্যমান তা সর্বত্র অপ্রতুল। তাই কোরিয়ান সরকারের অর্থায়নে AFACI-APPT, Bangladesh শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পেয়ারার বহুমুখী প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), গাজীপুর কর্তৃক উদ্ভাবিত হয়েছে। বাজারে যে কয়টি প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান খাদ্য বিজ্ঞানী, পুষ্টি বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, সিনথেটিক কেমিক্যাল এবং প্রিজারভেটিভ এর ব্যবহারের ফলে মানব শরীরের কোনো না কোনো অংগে পাশ্বের প্রতিক্রিয়া (Side effect) দেখা দেয় (মোল্লা এবং অন্যান্য, ২০১৬)। বাজারে বিদ্যমান প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্যের লেভেলে দেখা যায় যে, ফুড প্রসেসিং কোম্পানিগুলো সিনথেটিক কেমিক্যাল এবং প্রিজারভেটিভের নাম সরাসরি ব্যবহার না করে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে E-number (ই-নম্বর) ব্যবহার করছে যা সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে বুঝা কঠিন। বাজার জরিপে দেখা যায় যে, জ্যাম-জেলিগুলোতে সাধারণত ই-৪৪০ (E-440), ই-৩৩০ (E-330), ই-২১১ (E-211), ই-২১৪ (E-214), এসিই-১২৯ (ACE-129), ৪-আর ই-১২৪ (4RE-124) ইত্যাদি ব্যবহার করছে যা ক্রেতার পক্ষে বুঝা দুরূহ ব্যাপার। এখানে উল্লেখ্য যে, ই-৪৪০ হচ্ছে পেকটিন, ই-৩৩০ সাইট্রিক এসিড, ই-২১১ সোডিয়াম বেনজোয়েট, ই-২২৪ পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট, এসিই-১২৯ এবং ৪-আর ই-১২৪ ফুডকালার। পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের গবেষণা দেখা যায় যে, দেশী পেয়ারাতে ১৪-১৬% পেকটিন ন্যাচারালি বিদ্যমান থাকে। ফলে অতিরিক্ত পেকটিন যোগ করার প্রয়োজন হয় না।
সোডিয়াম বেনজোয়েট এবং পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট প্রিজারভেটিভ দুইটি একই সাথে একই পণ্যে ফুড প্রসেসিং কোম্পানিগুলো ব্যবহার করছে যা একই সাথে ব্যবহার না করলেও চলে । এর যে কোনো একটি আমরা প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। মানুষের বর্তমান চাহিদা ও সুস্বাস্থ্য বিবেচনায় রেখে তাই পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর সিনথেটিক কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ ছাড়াই পেয়ারার জেলি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা পেয়ারার ন্যাচারাল জেলি নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এর সংরক্ষণকাল ৬-৮ মাস। এর পুষ্টিমান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, প্রতি ১০০ গ্রাম জেলিতে ভিটামিন-সি ৩৪.১৬-৩৪৩.০১ মিলিগ্রাম, মোট ফেনলিক অ্যাসিড ৪.০১-৪.১৫ মিলিগ্রাম-গ্যালিক অ্যাসিড এবং মোট অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যাপাসিটি ১০৪.৪০-১০৯.১১ অ্যাসকরবিক এসিড/গ্রাম রয়েছে, যা শরীরে বিদ্যমান Reactive Oxygen Species (ROS) ধ্বংসের মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি, Acute liver injury এবং Coronary heart disease প্রশমনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
পেয়ারার ন্যাচারাল জেলির প্রস্তুত নিয়মাবলী
জেলি তৈরি করার সময় ফলের রস ব্যবহার করা হয়। বেশি মিহি চালনি বা মসৃণ কাপড়ে ফলের শাঁসকে ছেঁকে নেয়া হয়। পেয়ারায় বিদ্যমান পেকটিন চিনির উপস্থিতিতে রস অথবা পাল্পকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে তাই এতে বাড়তি পেকটিন যোগ করার প্রয়োজন হয় না। পেয়ারার ন্যাচারাল জেলি প্রস্তুতকরণে উপকরণ (সারণি দ্রষ্টব্য)। হ্যান্ড রিফ্রাক্টোমিটার, ব্যালেন্স, সসপেন, ছুরি অথবা বটি, বোতল, চামচ, মসৃণ পাতলা কাপড় ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ও দ্রব্যাদি প্রয়োজন।
সারণি : পেয়ারার ন্যাচারাল জেলি তৈরির উপকরণ
উপকরণ | পরিমাণ |
পেয়ারার রস | ১ কেজি |
চিনি | ৪৫০ গ্রাম |
লেবুর রস | ১০০ মি.লি. |
মধু | ৩০ গ্রাম |
প্রস্তুত প্রণালী
রস নিষ্কাশন : পরিপুষ্ট অথচ কাঁচা পেয়ারা পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে নিতে হবে। পেয়ারার ওজনের অর্ধেক পরিমাণ পানি যোগ করে সিদ্ধ করতে হবে (সাধারণত ৩০-৩৫ মিনিট)। সিদ্ধ হওয়ার পর নেট দিয়ে রস আলাদা করে নিতে হবে। পরিষ্কার মসৃণ কাপড় দিয়ে রস ছেঁকে নেয়া ভাল।
জেলি তৈরিকরণ : উপকরণের পরিমাণ অনুযায়ী রস, চিনি, লেবুর রস আলাদা করে ওজন নিতে হবে। এবার রসের সাথে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। রান্না চলাকালীন সময় অনবরত নাড়তে থাকুন যাতে পাত্রের তলায় লেগে না যায়। মিশ্রণটি মোটামুটি গাঢ় হয়ে আসলে রিফ্রাক্টোমিটার দিয়ে ঘন ঘন গাঢ়ত্ব পরীক্ষা করতে হবে। রিফ্রাক্টোমিটারের পরিবর্তে শিট পরীক্ষার মাধ্যমে জেলি হয়ে যাওয়ার চ‚ড়ান্ত অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব। টিএসএস ৫০-৫৫ ডিগ্রি ব্রিক্স অথবা কিছুটা ঘন হয়ে আসলে পরিমাপকৃত লেবুর রস যোগ করা যায়। টিএসএস ৫৬-৫৮ ডিগ্রি ব্রিক্স আসলে পরিমাপকৃত মধু যোগ করা ভাল। মিশ্রণটি ৬৫-৬৭ ডিগ্রি ব্রিক্স আসা (অথবা শিট পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ) পর্যন্ত রানা করতে হবে। অতপর চুলা থেকে পাত্রটি নামিয়ে জীবাণুমুক্ত বোতলে ভরে ভালোভাবে ছিঁপি এঁটে শুকনো ও ঠাণ্ডা জায়গায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে।
শিট পরীক্ষা : এই পদ্ধতিতে রান্নার সময় চামচ মিশ্রণের মধ্যে ডুবানো হয় এবং ঠাণ্ডা করে চামচ বেয়ে মিশ্রণটিকে পানি ভর্তি স্বচ্ছ গ্লাসে পড়তে দেয়া হয় । যদি এটা একাধারে না পড়ে শিটের আকারে স্বচ্ছ গøাসে পড়তে থাকে অর্থাৎ পানির উপরিতল থেকে তলা পর্যন্ত যেতে ছড়িয়ে না যায় তাহলে বুঝতে হবে জেলি হয়ে গেছে।
বোতল জীবাণুমুক্তকরণ : সসপেনে পানি নিয়ে তাতে বোতলগুলোকে ডুবিয়ে দিয়ে ১৫-২০ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে। ফুটানো হয়ে গেলে বোতলগুলোকে পাত্র থেকে উঠিয়ে পানি নিংড়িয়ে নেয়া ভাল।
সতর্কতা
বোতল জীবাণুমুক্ত করার সময় অধিক সময় ধরে ফুটানো যাবে না, এতে বোতলগুলো অস্বচ্ছ হয়ে যেতে পারে। জেলি তৈরি করার সময় এমনকি বোতলজাত করার পরেও কোনোভাবেই হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না, এতে ছত্রাক জন্মাতে পারে। রস ভালোভাবে ছেঁকে নিতে হবে, কোনোভাবেই রসের সাথে পাল্পের মিশ্রণ থাকা যাবে না। এতে জেলি অস্বচ্ছ হয়ে যেতে পারে। যেহেতু পেয়ারায় পেকটিন বিদ্যমান তাই এতে বাড়তি পেকটিন যোগ করার প্রয়োজন হয় না।
হ্যান্ড রিফ্রাক্টোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে রস অথবা সিরাপে দ্রবণীয় কঠিন পদার্থের টিএসএস পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। যা ডিগ্রি ব্রিক্স হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২২৩১১২১, ই-মেইলঃ mainuddinmolla@yahoo.com