Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি জোগানে ভুট্টার উপযোগিতা

ড. মো: মুজাহিদ-ই-রহমান১ ড. মোঃ এছরাইল হোসেন২

আদিকাল হতে বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের প্রচেষ্টা যেন নিরন্তর। প্রায় দশ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যবহৃত হতে থাকে। বাংলাদেশে দানাশস্যের মধ্যে ধান ও গমের পরেই রয়েছে ভুট্টার অবস্থান। ভুট্টার পুষ্টিমান ধান ও গমের চেয়েও অধিক। ভুট্টার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।    ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার মোট আবাদি জমি ও উৎপাদনের  পরিমাণ যথাক্রমে ১.৭৪ লক্ষ হেক্টর এবং ১১.৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন ছিল যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫.৫৪৪ লক্ষ হেক্টর এবং ৫৪.০২৫ লক্ষ মেট্রিক টন এ দাঁড়িয়েছে।  প্রাণি খাদ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ এবং মাছের খাদ্যে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ  ভুট্টা ব্যবহৃত হয়। ভুট্টায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় দেশে পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও ভুট্টার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ভুট্টা সংযোজন করা গেলে তা  নিঃসন্দেহে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
ভুট্টার পুষ্টিমান
ভুট্টার দানাই প্রধানত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভুট্টায় বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের প্রায় সবকিছুই রয়েছে। ভুট্টার পুষ্টিমান সারণি-১ দ্রষ্টব্য। ভুট্টায় রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ রাসায়নিক যৌগ যা মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভুট্টা থেকে তৈরি  একশত এরও বেশি খাদ্য রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৮২টি প্রধান খাদ্য, ১৫ ধরনের পানীয় এবং ১২ টিরও বেশি নাশতা জাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির উপাদান হিসেবেও এর কোন জুড়ি নেই।     
স্বাস্থ্য রক্ষায় ভুট্টার উপকারিতা
১।  ভিটামিন এ এর ভালো উৎস হওয়ায় ভুট্টা দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে। লুটিন ও জিজান্থিন আমাদের চোখকে বার্ধক্যজনিত চোখের ক্ষয় রোগ থেকে রক্ষা করে। তাই প্রতিদিন ৫-৬ গ্রাম ভুট্টা খেলে চোখে ছানি পড়াও  প্রতিরোধ করতে পারে। ভুট্টায় উপস্থিত ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সুন্দর ত্বক, চুল এবং হজমের জন্য অপরিহার্য যা বাত রোগের নিরাময়েও ব্যবহৃত হয়।    ভিটামিন এ, সি, ও কে একত্রে  বিটা ক্যারোটিন ও সেলেনিয়ামের সাথে থাইরোয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
২। ফাইটোস্টেরল, বায়োফ্লাভোনয়েডস ও লিনোলেনিক এসিডে সমৃদ্ধ থাকায় রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিÐকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ভুট্টার এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রি রেডিকেল এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
৩। ভুট্টায় উপস্থিত ল্যাক্টিন এ রয়েছে এইচআইভি ভাইরাসের প্রতিষেধক। ভুট্টায় উপস্থিত ক্যারটিন কোলন ক্যান্সার, লিউকোমিয়া ও গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। ভুট্টায় উপস্থিত অ্যান্থোসায়ানিনে       এন্টি-কার্সিনোজেনিক, এন্টি-ডায়াবেটিক ও এন্টি-মাইক্রোবিয়েল জাতীয় বিশেষ গুণাগুণ বিদ্যমান রয়েছে।
৪। ফলিক এসিডের চমৎকার উৎস বেবিকর্ন যা শিশুর ওজন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের খাদ্যতালিকায় বেবিকর্ন যুক্ত খাদ্য থাকা বেশ জরুরি। এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে যা রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে।
৫। কচি হলুদ ভুট্টার শাঁসে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও কপার থাকে এবং বিশেষ করে ফসফরাস থাকে যা মজবুত হাড়ের জন্য অপরিহার্য।
৬। ভুট্টাজাতীয় খাবার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ও সঠিক কার্যক্রমের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৭। উচ্চমাত্রার ফাইবার থাকে বলে ভুট্টা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। সে কারণে কোলন ক্যান্সারের রোগীদের ভুট্টা খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ভুট্টার ব্যবহার
ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও দেশে প্রধানত পোলট্রি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মুরগি ও মাছের খাদ্য তৈরিতে শতকরা ২৮ ভাগ হতে ৮০ ভাগ পর্যন্ত ভুট্টা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে পোলট্রি ফিড হিসেবে ভুট্টার চাহিদা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোখাদ্য হিসেবে ভুট্টার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে ভুট্টা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার সাইলেজ গবাদি পশুর অন্যতম খাদ্য। যদিও দেশে স্টার্চ উৎপাদনে অনেক আগে থেকেই ভুট্টার কিছু ব্যবহার রয়েছে। তবে মানুষের খাবার হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার এখনও সীমিত আকারেই রয়েছে। ভুট্টার খই, সিদ্ধ ভুট্টা, পোড়ানো ভুট্টা, চাপাতি, সবজি  (বেবিকর্ন), সুপ, আটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভুট্টার ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  অনেক ক্ষেত্রেই গমের আটার সাথে ভুট্টার আটা মিশ্রিত করে বিভিন্ন খাদ্য তৈরির কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে মানুষের খাবার হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা গবেষণার অগ্রগতি
দেশে মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ১৯৮৬, ২০০২, ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে পপকর্ন (খই ভুট্টা), বারি মিষ্টি ভুট্টা-১ ও বারি বেবিকর্ন-১ অবমুক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে খই ভুট্টা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাবিøউএমআরআই হাইব্রিড বেবিকর্ন- ১ (২০২০ সালে) অবমুক্ত করে। ভোজ্যতেল হিসেবে ভুট্টা তেলের পুষ্টিগুণ উপলব্ধি করে সয়াবিনসহ অন্যান্য তেলের উপর চাপ কমাতে অত্র প্রতিষ্ঠান ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে পরীক্ষামূলক গবেষণায় সাফল্য লাভ করে ও ভবিষ্যতে যাতে দেশে ব্যাপক হারে ভুট্টা তেল ব্যবহার হয় তার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশেই বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা দিয়ে কর্নফ্লেক্স ও কর্ন অয়েল তৈরিতে উদ্যেক্তাদের সংশ্লিষ্ট করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান কোভিড-১৯ জনিত মহামারির এ সংকটকালে সুস্থ ও সবল জাতি গঠনের বিকল্প নেই। বিশেষ করে খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে আমাদের চাল নির্ভর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় অধিকতর পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার সংযোজন করা দরকার। ভুট্টা একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যার শিল্প উপযোগিতাও রয়েছে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং জৈব রাসায়নিক উপাদান ভুট্টার পুষ্টিমান আরও বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ভুট্টার চাষও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এদেশেও ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহারের  সম্ভাবনা রয়েছে। অধিক ও মানসম্পন্ন আমিষ, স্বাস্থ্যকর তেল এবং ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ হওয়ায় মানুষের খাদ্য হিসেবে সর্বস্তরে ভুট্টার ব্যবহার এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।য়

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা  ২মহাপরিচালক, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৭১৭৪৩৪৯০৬৬, ই-মেইল :mmer_bari@yhoo.com