Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মুজিব শতবর্ষে মাছ চাষে করণীয়

কৃষিবিদ মোঃ আলতাফ হোসেন চৌধুরী

১৯৭২ সালের  জুলাই মাসে কুমিল্লার  এক জনসভায়  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন মাছ হবে ২য় প্রধান  বৈদেশিক  মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ । এরই অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালে  গণভবনের লেকে বঙ্গবন্ধু মাছের  পোনা  অবমুক্তকরণের  মাধ্যমে মাছ উৎপাদনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন । দীর্ঘদিন পরে  হলেও বঙ্গবন্ধুর দুরদর্শিতা বাস্তবে  রূপ লাভ করেছে । তাই মুজিব শতবর্ষে  মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘নিরাপদ মাছে  ভরবো দেশ মুজিব বর্ষে বাংলাদেশ’। এই প্রতিপাদ্যকে  সামনে রেখে  মৎস্য অধিদপ্তর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে ।
মাছ চাষ মূলত : তিনটি বিষয়ের উপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিষয়গুলো হলোঃ (১) ফিড (খাবার), (২) সিড (পোনা), (৩)ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা)। উক্ত বিষয়গুলোর একটির ঘাটতি হলেও মাছ চাষ ব্যাহত হয়। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে শীতকালীন মৌসুমী হাওয়া বইছে এবং এই সময়ে তাপমাত্রা ও অনেক কম থাকে বিধায় মাছ চাষে অনেক সমস্যা দেখা যায়। তাছাড়াও মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুনাবলি মাছ চাষের জন্য বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তাপমাত্রা কম ও ভৌত রাসায়নিক গুণাবলির সঠিক সমন্বয় মাটি ও পানিতে বিদ্যমান না থাকার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি জটিল হয়ে পড়ে। অতীতে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ব্যাপক মৎস্য আহরণ সম্ভব ছিল কিন্তু বর্তমানে মনুষ্য সৃষ্টি কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।         প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে চাষের মাছের উপরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। আর অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করতে এবং অধিক উৎপাদন লাভের জন্য একদিকে যেমন অধিক পুঁজির প্রয়োজন তেমনি মাছের রোগবালাইসহ বিভিন্ন সমস্যা ও দেখা যায়। মুজিববর্ষে মাছ চাষে করণীয়সমূহ আলোচনা করা হলোঃ-
মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
রোগ জীবাণু দেহে প্রবেশ করার পর মাছের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়। অত্যন্ত উচ্চরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মাছে রোগ জীবাণুসহ  সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। অপর পক্ষে, মাছের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হলে সহজেই রোগ হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা মাছের সার্বিক পরিবেশ, পানি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। উন্নত জলজ পরিবেশ, সুষম খাদ্য ও উত্তম খামার ব্যবস্থাপনার দ্বারা মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়।
মাছের  ক্ষতরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ                                                                                                                                                         ক্ষতরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান (জরংশ ঋধপঃড়ৎ) সমূহের উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত ০৪টি মৌলিক কৌশলের মাধ্যমে  রাগ প্রতিরোধ/নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১. আক্রান্ত পুকুরে বিদ্যমান রোগ জীবাণু উচ্ছেদকরণ
ষ     শুষ্ক মৌসুমে পুকুর সম্পূর্ণরূপে শুকানো,  প্রয়োজনে তলদেশের পচাকাদা অপসারণ, বার বার চাষ দিয়ে চুন প্রয়োগ (শতাংশে ১ কেজি তবে মাটি ও পানির পিএইচ মাত্রার উপর চুন প্রয়োগের মাত্রা কম বেশি হয়)।
ষ     কমপক্ষে ২/৩টি ফসল উঠানোর পর পুকুর শুকানো ও চুন প্রয়োগ (শতাংশে ১ কেজি)।
২. বাইরের রোগ জীবাণুর  প্রবেশরোধ
ষ     পুকুরের পাড় উঁচুকরণ, পাড়ের সকল রকম গর্ত ও অন্তরমুখী নালা বন্ধ করা যাতে বন্যাসহ অন্যান্য বাইরের পানি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
ষ     পুকুরে নলক‚পের অথবা শোধিত পানি সরবরাহ করা, পুকুরের সাথে নদী-নালা, খাল-বিল বা অন্য কোন নর্দমা বা ড্রেন কেটে সংযোগ দেওয়া যাবে না। কারণ পানি রোগ জীবাণুর একটি অন্যতম প্রধান বাহক।
ষ     রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ ও সবল পোনা লবণ জলেশোধন করার পর মজুদ করা (২.৫% লবণ জলে ২/৩ মিনিট বা সহ্যক্ষমতা অনুযায়ী ততোধিক সময়ে গোসল করানো)।
ষ     পুকুরে সকল প্রকার বন্য মাছ,  পোকা-মাকড়, কাকড়া, সাপ ব্যাঙ ইত্যাদির প্রবেশ রোধ করতে হবে। কারণ এরা বাইরের রোগ জীবাণু পুকুরের ভিতরে নিয়ে আসে।
ষ     পুকুরে সকল গৃহপালিত/বন্য পশুপাখির আগমন রোধ করতে হবে।
ষ     প্রাকৃতিক জলাশয়, ধানক্ষেত,  হাওর, বাওড়, বিলের পানিতে কাজ করার পর পুকুরে নেমে হাত-পা বা অন্য কোন সামগ্রী ধৌত করা যাবে না।
ষ     জালসহ অন্যান্য খামার সরঞ্জাম পুকুরে ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করতে হবে (বিøচিং পাউডার, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ইত্যাদি ব্যবহার করে)।
ষ     খামারে/হ্যাচারিতে প্রবেশের পূর্বে খামার কর্মী ও দর্শানার্থদের পা, জুতা ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করা উচিত।
ষ     রোগের যাবতীয় বাহক (ঈধৎৎরবৎ) যেমন- পানি, বন্যমাছ, মানুষ, গরু, ছাগল, পাখি, পোকামাকড় ইত্যাদি দ্বারা রোগ ছড়ানোর ব্যপারে সতর্ক হতে হবে।
৩.     পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাছের উপর শারীরিক চাপ পরিহার
ষ     সঠিক উপায়ে পুকুর প্রস্তুতকরণ ( পুকুর শুকানো, তলদেশের পচাকাদা অপসারণ, বার বার চাষ দিয়ে শুকানো এবং চুন প্রয়োগ)।
ষ     পানির উন্নত গুণাবলী বজায় রাখা (পিএইচ, অক্সিজেন, এ্যামোনিয়া ইত্যাদি)।
ষ     মাছকে সকল প্রকার পরিবেশগত চাপ/পীড়ন থেকে মুক্ত রাখা যেমনÑ অতিরিক্ত মাছ মজুদ না করা। পরিমিত মাত্রায় সুষম খাদ্য প্রয়োগ। অতিরিক্ত জাল টানা বানড়া চড়ানা করা, যা মাছের শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষতের সৃষ্টি করে। কম ঘনত্বে মসৃণ পাত্রে মাছ পরিবহন করা। একই আকারের মাছ মজুদ করা। পানিতে নিয়মিত অক্সিজেন ঘাটতি, গ্যাসের আধিক্য বা দূষণ হলে পানি পরিবর্তন করা।
ষ     শীতকালই ক্ষতরোগ সংক্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাই ইসময়ে মাছ ও তার পরিবেশ ও ঝুঁকি পূর্ণ সকল বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা।
ষ     শীতের শুরুতে শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা (তবে এটা পানির ক্ষারত্বের উপর নির্ভর করে পরিবর্তনশীল)।
ষ     অন্যান্য রোগ ও পরজীবীর ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
ষ     আক্রান্ত এলাকায় রোগ সহিষ্ণু  প্রজাতির মাছ মজুদ করা।
ষ     মাছ ও খামারের নিয়মিত পরিচর্যা।
৪. মাছ ও খামারের নিয়মিত তদারকি ও মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা
মাছের আচরণের দিক দৃষ্টি রাখা। মাঝে মাঝে জালটেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। মাছ রোগাক্রান্ত  হলে তার        চিকিৎসা ততসহজ নয়। রোগের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। তাইরোগ প্রতিরোধে পানির গুণাবলি উন্নয়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনা অধিক গ্রহণযোগ্য। সকল মৃত ও অর্ধমৃত মাছ অপসারণ করা ও মাটির নিচে পুঁতে ফেলা। দূষিত পানি পরিবর্তনে চুন প্রয়োগ (কলিচুন)            ১ কেজি/শতক (পিএইচ ও ক্ষারত্বের উপর ভিত্তি করে)। জিওলাইট শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম ব্যবহার করে পানির এ্যামোনিয়াজনিত বিষক্রিয়া কমানো যায়। এককোষী/বহুকোষী পরজীবী সংক্রমণ হলে ৫০ পিপিএম ফরমালিনে (৩৭%) ২৮ ঘণ্টা গোসল করাতে হবে। আরগুলাস (উকুন) সংক্রমণে ০.২৫ থেকে ০.৫০ পিপিএমডি পটারেক্স আক্রান্ত পুকুরে ১০/১৫ দিন অন্তর অন্তর ২/৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াজনিত ক্ষত বা পচন হলে ৫০ মি.গ্রা.  টেট্রাসাইক্লিন/কেজি মাছকে প্রতিদিন খাবারের সাথে মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। ছত্রাক সংক্রমণ করলে ২০০     পিপিএম লবণ জলে আক্রান্ত মাছকে ১ ঘণ্টা গোসল (সপ্তাহে ১ বার) অথবা আক্রান্ত পুকুরে ০.৫ পিপিএম মিথাইলিন বøু প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই অধিক শ্রেয়। মাছ চাষের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটির গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ একটি জলজ প্রাণী। পানির সঠিক ভৌত রাসায়নিক গুণাবলি অর্থাৎ সুস্থ জলজ পরিবেশের উপরই এদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি পাওয়া নির্ভর করে। অতএব, উন্নত জলজ পরিবেশ ও খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছকে সুস্থ রাখা অধিকতর সহজসাধ্য, কম ব্যয়বহুল, কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরিবেশ বান্ধব। য়
খামার ব্যবস্থাপক, মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা, মোবা : ০১৭১২৪০৮৩৫৩, ঊসধরষ: Email: Chowdhari_33@yahoo.com