Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আধুনিক পাট উৎপাদন প্রযুক্তি

কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস

আমাদের দেশ স্বাধীনের পর কৃষি ছিল বন্যা, খরা, রোগবালাই, অনুন্নতবীজ ও উৎপাদন প্রযুক্তি,       উপকরণ স্বল্পতা এসব বহুবিধ সঙ্ককে জর্জরিত। বঙ্গবন্ধু দূরদৃষ্টির কারণে উন্নত জাত, উপকরণ, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল সহায়তায় আধুনিক কৃষির নতুন দ্বার উন্মচিত হয়। তাঁর সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিতে আসে অভ‚ত পরিবর্তন। বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাটের অবস্থান শীর্ষে। এক সময় এই পাটই ছিল       কৃষকের অর্থ উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উৎস। পাটের সাথে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, এদেশের মানুষ আর আমাদের মহান স্বাধীনতার এক নিবিড় যোগসূত্র। দেশ বিভাগের পর থেকেই তৎকালীন পাকিস্তানি   ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠী এ অঞ্চলের মানুষের অধিকারও উন্নয়নের প্রশ্নে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। দেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হতে অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্যহিসাব থেকে বঞ্চিত করে। এ অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচির ৫ম দফায় বৈদেশিক মুদ্রার উপর প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন। আপামর জনগণের প্রাণের এ দাবি পরবর্তীতে জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে দিক্ষিত করে।
এদেশের ফসলি জমির একটা বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে আমাদের এই পাট। দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ ধরনের মাটি বিশিষ্ট যে কোন জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ভালো হয়। কিন্তু ভালো ফলন পেতে হলে এ ধরনের জমির মধ্যেও জাত ভেদে জমি নির্বাচন করতে হবে যেমন, তোষা এবং ধবধবে দেশি পাট জাতের জন্য বিশেষ করে যে সকল জমি ঋতুর প্রথমে বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় না এবং বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। তবে এই ধরনের জমির মধ্যেও যে জমিটি তুলনামূলক উঁচু সে জমিতে তোষা এবং তুলনামূলক নিচু জমিটিতে দেশি জাতের পাট চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। বাগানের আশপাশে বা বসতবাড়ির পাশের জমিতে পাট ভালো হয় না। এর কারণ জঙ্গলাকীর্ণ জমিতে ছত্রাক জাতীয় রোগ এবং কীটপতঙ্গ বিশেষ করে চেলে পোকা, মাকড় প্রভৃতির আক্রমণ অধিক হয়। অবশ্য এসব জমিতে অন্য ফসল না হলে কেনাফ ও মেস্তার চাষ করতে পারেন। মেস্তার জন্য একটু টান বা উঁচু জমি হলেও ভালো ফলন পাওয়া যায়।
অংকুরোদগম পরীক্ষা
পাটের বীজ বপনের আগে অংকুরোদগম পরীক্ষার মাধ্যমে বীজ ভালো কিনা তা পরীক্ষা করা উচিত। খুব সহজে এবং অল্প খরচে এই পরীক্ষা করা যায়। প্রথমে বীজের পাত্র থেকে ১০০টি বীজ গুনে নিতে হবে। এবার একটি মাটির সানকিতে এক পরত ভেজা কাপড় বা চোষ কাগজ অথবা তা না থাকলে নিউজপ্রিন্ট ২-৩ পরত বিছিয়ে পানি দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে তার উপর ওই ১০০টি বীজ ভালোভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এবার আরেকটি সানকি দিয়ে ওই বীজসহ সানকি ঢেকে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সানকির কাপড় বা কাগজ শুকিয়ে না যায় অথবা বীজ পানিতে ডুবে না যায়। বীজ বসানোর তিন দিন পর মোট যে ক’টি বীজ গজানো দেখা যাবে সেটাই হলো বীজ গজানোর শতকরা হার। শতকরা ৮০টির অধিক বীজ গজালে তাকে ভালোবীজ বলা যাবে। যদি শতকরা ৭০টির বেশি কিন্তু ৮০টির কম বীজ গজায় তা হলে বীজ বপনের সময় কিছু বেশি বীজ বপন করতে হবে। শতকরা ৭০টির কম বীজ গজালে ওই বীজ বপন না করাই ভালো।  
জমি তৈরি ও বীজবপন
পাটের বীজ খুব ছোট বলে পাট ফসলের জমি মিহি করে চাষ দিতে হয়। পাট গাছ চার মাসব্যাপী বৃদ্ধি পায় এবং ৩-৫ মিটার উঁচু হয় বলে এর জন্য জমি গভীর করে চাষ দেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য ভালো যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাষ দেয়া উচিত। এপাশ ওপাশ করে ৫-৬ বা প্রয়োজনে তারও অধিক বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ দিতে হয়। পাট চাষের জন্য খরচ কমাতে হলে যে সব জমিতে আলু বা সবজি করা হয় সে সব জমিতে একবার চাষ করে মই দিয়ে পাট বীজ বপন করেও ভালো ফসল পাওয়া সম্ভব। এসব জমিতে আগাছা নির্মূলজনিত খরচ কম হয়। সারি করে সিড ড্রিলের সাহায্যে বীজ বপন করা হলে বীজগুলো মাটির নিচে সমান গভীরতায় পড়ে বলে সমানভাবে অংকুরোদগম হয়।
যে কোনো ফসলের মতো পাট ফসলেও যথোপযুক্ত সার   পরিমিত মাত্রায় উপযুক্ত সময়ে প্রয়োগ করে আঁশের ফলন ও মান যথেষ্ট বাড়ানো সম্ভব। পাটের উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য জমি তৈরির সময় শতাংশ প্রতি ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া,  ৪০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০ গ্রাম জিপসাম, সার ছিটিয়ে দিতে হবে। পাট বীজ বপনের ১৫ দিন আগে জমিতে একর প্রতি ২ টন গোবর সার প্রয়োগ করলে অন্যান্য সার প্রায় অর্ধেক হলেই চলে। পাট গাছের দৈহিক বৃদ্ধি এবং আঁশ ফলন বাড়ানোর ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌল। এ ছারা ফসফরাস আঁশের মানউন্নত করে এবং পটাশিয়াম ব্যবহারের মাধ্যমে রোগ হওয়ার হার কমানো যায় এবং কাÐ মজবুত হয়। বাংলাদেশের অনেক পাট চাষের জমিতে সালফার এবং জিংক কম রয়েছে। সে সব জমিতে সালফার ও জিংক প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
জমিতে জৈব পদার্থ হিসেবে গোবর সার দিলে অবশ্যই বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের দিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়া (অর্থাৎ অর্ধেক ইউরিয়া), টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করে মই দিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার বীজ বপনের ৪৫ দিন পর প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস থাকে।
পাটের জাত ভেদে বপন সময় বিভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত দেশী পাট চৈত্র মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এবং তোষা পাট বৈশাখ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বপন করা হয়। তবে বেশির ভাগ পাটের জাত মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি অর্থাৎ চৈত্র মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বপন করার উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য মে বা বৈশাখের শেষ পর্যন্তও পাট বীজ বপন করা যায়। এছাড়া কেনাফ ও মেস্তার বপন সময় হচ্ছে চৈত্র মাসের প্রথম থেকে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত দুই মাসব্যাপী।
প্রচলিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ছিটিয়ে বীজ বপন করা। তবে সারিতে বীজ বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ছিটিয়ে বপন করলে দেশি এবং তোষা পাটের ক্ষেত্রে একরপ্রতি প্রায় আধা কেজি বীজ বেশি লাগবে ভালো মানের বীজ হলে এবং বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বর্তমানে পাট, কেনাফ ও মেস্তার বীজ বপনের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলোÑ
পাটের জমিতে পোকামাকড় বা রোগবালাই দেখা দিলে তা সাথে সাথে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ায় সোনালি আঁশ পাটের  সোনালি অধ্যায় আজ আর স্বপ্ন নয়। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকৃত্রিম ভালোবাসা আর সময়োপযোগী ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে পাট খাত আজ দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় এক অন্যতম অনুষঙ্গ। বৃদ্ধি পেয়েছে এর বহুমুখী মূল্যবান ব্যবহার। পাট বিষয়ে আমাদের আছে দুদক্ষ পাট চাষি, আছে আধুনিক উপযোগি জাত, উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা, আর আছে বহুমুখী ব্যবহারের বিভিন্ন পাটপণ্য এবং ব্যবহারের বিভিন্ন উপযোগী ক্ষেত্র। শুধু প্রয়োজন একটু প্রয়াস, একটু দেশাত্ববোধ, একটু কার্যকর আন্তরিকতা। পাট চাষ ও পাট জাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরো বহুদূরে। য়
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত¡ বিভাগ,বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা, মোবা : ০১৫৫২৯৯৯১৪৯, ইমেইল : tanny.jannat92@gmail.com