কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যতম চালিকাশক্তি। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি আমাদের সার্বিক উন্নয়নে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই কৃষির উন্নয়ন মানে দেশের সার্বিক উন্নয়ন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই স্বাধীনতার পরপরই কৃষিকে উন্নয়ন করতে নিয়েছিলেন নানামুখী পদক্ষেপ। তারই ধারাবাহিকতায় টেকসই কৃষি উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনায় খোরপোষের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন চলছে সারাদেশে। মুজিববর্ষে কৃষিতে বদলাবে বাংলাদেশ, কৃষিতে বদলে যাবে উপকূল।
কপিজাতীয় ফসলের চাষে সফলতার মুখ দেখেছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপক‚লীয় এলাকার কৃষকেরা, যাদের বেশ কিছু জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত । শুকনো মৌসুমে এই বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থাকে লবণাক্ততার কারণে, যা এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এক বড় হতাশা আর দুর্ভোগ। বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের এই সমস্যা সমাধান করে কৃষকের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইকো কোঅপারেশন দি সল্ট সলিউশন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের ৪টি জেলার (পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট ও খুলনা) এবং ৮টি উপজেলার (কলাপাড়া, গলাচিপা,বরগুনা সদর,তালতলী, বাগেরহাট সদর, রামপাল, দাকোপ ও কয়রা) ৫০০০ চাষিপরিবার নিয়ে কাজ করছে। প্রকল্পটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেক এবং কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে নেদারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সল্ট ফার্ম টেক্সেল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের কৃষকরা লবনাক্ততায় আক্রান্ত জমিতে শীতকালীন কপি জাতীয় ফসলের লবণ সহনশীল জাতের উন্নত চাষাবাদের জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে । কৃষকগণ প্রকল্পের থেকে প্রাপ্ত বীজ ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে কপিজাতীয় ফসল চাষে পাচ্ছেন সফলতা যা এই অঞ্চলের কৃষকদের পারিবারিক আয় এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার এক অনন্য সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কপিজাতীয় ফসলের গুরুত্ব
বাঁধাকপি : বাঁধাকপির মূলত বাংলাদেশের একটি শীতকালীন সবজি, যা পাতাকপি নামে বেশি প্রচলিত। বাঁধাকপি কাঁচা কিংবা রান্না করে খাওয়া যায়। ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটকেমিক্যালসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর এই সবজি। এতে রয়েছে রিবোফ্লোভিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, থায়ামিন, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি ও কে। এছাড়াও বাঁধাকপি আয়রনের ভাল উৎস। বাঁধাকপি ওজন কমাতে সাহায্য করে, হাড় ভালো রাখতে সহায়তা করে, আলসার নিরাময়ে উপকারী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কিডনি সমস্যা প্রতিরোধ করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
ফুলকপি : ফুলকপি রান্না বা কাঁচা যে কোন প্রকারে খাওয়া যায়, আবার এটি দিয়ে আচারও তৈরি করা যায়। সাধারণত ফুলকপির ফুল অর্থাৎ সাদা অংশটুকুই খাওয়া হয় আর সাদা অংশের চারপাশে ঘিরে থাকা ডাঁট এবং সবুজ পাতা দিয়ে স্যুপ রান্না করা যায়,যা আমাদের দেশে ফেলে দেওয়া হয়। এতে রয়েছে ভিটামিন বি,সি,কে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংক। একটি মাঝারি আকারের ফুলকপিতে রয়েছে শক্তি-২৫ কিলোক্যালরি । এছাড়াও ফুলকপিতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, আঁশ, ফোলেট, নিয়াসিন, থায়ামিন, প্যানথানিক এসিড। বাঁধাকপি এবং ফুলকপি উভয়ই রক্তে প্রোথম্বিন তৈরি হতে সাহায্য করে।
ওলকপি : ওলকপিতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, লৌহ ভিটামিন বি, সি, কে এবং ভিটামিন এ। এছাড়াও রয়েছে ডায়েটারি ফাইবার এবং ফাইটোকেমিকেলস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ বিভিন্ন ক্যারোটিন। গøুকোসিনোলেটস ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলো স্তন ও প্রোস্টেটসহ সব রকম ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
বিটকপি/রেডবিট : তবে লবণাক্ত এলাকার জন্য এটি হতে পারে এক আশীর্বাদ, কারন এটি প্রাকৃতিকভাবেই লবণ সহিষ্ণু। দি সল্ট সল্যুশন প্রকল্পের মাধ্যমে রেডবিটের বোরো নামক জাতটি খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে চাষাবাদ করা হয়। এতে দেখা যায় সমুদ্রের পানি দিয়ে সেচ দিলেও গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয় না। তাই দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় শুকনো মৌসুমে যখন মিষ্টি পানি থাকে না তখন সহজপ্রাপ্য লবণাক্ত পানি ব্যবহার করেই রেডবিট ফলানো সম্ভব। রেডবিট বা বিটকপির কোনো অংশই ফেলার নয় এর পাতা এবং মূল দুটোই খাওয়া যায়। শহর এলাকায় কিংবা বিভিন্ন সুপারশপে রেডবিট কেজি প্রতি ২০০-৬০০ টাকা মূল্যেও বিক্রি হয়। অতএব কৃষকের আয় বৃদ্ধিতেও রেডবিট এর সম্ভাবনা অনেক এবং এটি পুষ্টি গুণেও অনন্য। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। এছাড়াও এতে রয়েছে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬ ইত্যাদি। রক্ত পরিষ্কার করতে, যকৃতের অসুস্থতায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে, স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা রক্ষায় রেডবিট উপকারী।
লবণাক্ত জমিতে কপিজাতীয় ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি
জাত পরিচিতি: আমাদের দেশে বাঁধাকপি, ওলকপি এবং ফুলকপির কোনো লবণ সহিষ্ণু জাত নেই। দি সল্ট সল্যুশন প্রকল্পের মাধ্যমে নেদাল্যান্ডস থেকে এই সকল সবজির বিভিন্ন লবন সহিষ্ণু জাত এনে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত কৃষকদের দেয়া হয় এবং লিড ফার্মারের মাধ্যমে প্রদর্শনী প্লট বাস্তবায়ন করা হয়।
চারা উৎপাদন পদ্ধতি : বাঁধাকপি, ওলকপি এবং ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। সীড ট্রে তে করে চারা উৎপাদন করাই সবচেয়ে উত্তম। অধিক পরিমাণে জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটিতে ০.৫-১.৫ সেমি গভীরে বীজ বপন করতে হবে। প্রতিটি গর্তে বা বক্সে ১-২টি বীজ রোপণ করতে হবে। বীজতলায় বীজ অবশ্যই লাইন করে রোপণ করতে হবে। অনেকেই এলমেলোভাবে বীজ বপন করে এতে চারা খুব ঘন হয় এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় সহজেই।
বীজতলার আকার ১ মিটার পাশে ও লম্বায় ৩ মিটার হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালি, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরাঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। বীজতলায় চারা রোপণের আগে ৭/৮ দিন পূর্বে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমত না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভাল। রেড বিটের বীজ সাধারনত সরাসরি বুনতে হয় তবে চারা উৎপাদন করেও রেডবিট আবাদ করা যায়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ : গভীর ভাবে ৪-৫টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর বা দুই থেকে তিনটি পাতা সমৃদ্ধ প্রায় ১০ সেমি লম্বা সুস্থ সবল চারা রোপন করতে হবে। লবনাক্ততা মোকাবেলায় রিজ-ফারো পদ্ধতিতে জমি তৈরি করতে হবে। এ পদ্ধতিতে বাঁধাকপি ও ফুলকপির জন্য বেডের সাইজ একই এবং রেডবিট, ওলকপির জন্য আলাদা। চারা আঁকাবাঁকা বা জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে রোপণ করতে হবে চারা থেকে চারার দূরত্ব হলো- বাঁধাকপি: ১৮-২০ ইঞ্চি, ফুলকপি: ২০-২২ ইঞ্চি, ওলকপি: ৯-১২ ইঞ্চি, রেডবিট: ৩-৪ ইঞ্চি।
সার প্রয়োগ ও সেচ দেয়া : মাটি পরীক্ষা করে অথবা এস আর ডি আই কর্তৃক নির্দেশকৃত সার ব্যবহার করতে হবে । তবে লবণাক্ত মাটিতে শতাংশ প্রতি ২৫-৩০ কেজি জৈবসার এবং ৪-৬ কেজি জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ২ কিস্তিতে চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর একবার এবং ৩০-৪০ দিন পর আর একবার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া বাদে বাকি সার জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া ২-৩ দিন পর পরই সেচ দিতে হবে।
কৃষিতাত্তি¡ক পরিচর্যা : সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা : সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া জমি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। সার দেয়ার আগে মাটির আস্তর ভেঙে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা : গাছের সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দুইপাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দেয়া যায়। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়।
রোগ ও পোকা দমন : ফসলের রোগ ও পোকা দমন করতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেমন (১) আগাম বীজ বপন করা (২) বীজ শোধন করে রোপণ করা (৩) সুষম সার ব্যবহার করা (৪) সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা (৫) চারা লাগানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই জমিতে ফেরোমন ফাঁদ পাততে হবে । (৬) ফসলের ক্ষেত সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে (৭) পানি নিষ্কাশনের সুব্যাবস্থা থাকতে হবে (৮) শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে (৯) হাত দ্বারা পোকার কীড়া ও ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করা (১০) আক্রমণের তীব্রতা খুব বেশি হলে নির্দিষ্ট মাত্রায় অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
কৃষিবিদ মোঃ মাসুদ রানা
সিনিয়র এগ্রিকালচার অফিসার, ইকো কোঅপারেশন, বাংলাদেশ, মোবাইলঃ ০১৭১৬৩৩০৭৭৫, m.rana@icco.nl