Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

লবণাক্ত সহিষ্ণু জাতের বোরো ধান ব্রি ধান৬১

বোরো মৌসুমে ধান গাছ প্রচুর সূর্য কিরণ পায়, সার বেশি গ্রহণ করে অথচ গাছ ও পাতা হেলে পড়ে না, ফলবান কুশি বেশি হয় এবং পরিশেষে অধিক ফলন পাওয়া যায়। তাই এ মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধানের চাষ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। এ মৌসুমে বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল বোরো ধানের চাষ হয়। এদের মধ্যে ব্রি ধান৬১ একটি নতুন জাতের লবণাক্ততা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল বোরো ধান।


ব্রি ধান৬১ এর বৈশিষ্ট্য
ব্রি ধান৬১ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডিএস/মিটার (৩ সপ্তাহ পর্যন্ত) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাছাড়া এ জাতটি অঙ্গজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সকল ধাপে (Salt sensitive stage) ৮ ডিএস/মিটার মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে সক্ষম, যা প্রচলিত উচ্চফলনশীল জাত ব্রি ধান২৮ পারে না। এ জাতটি ব্রি ধান৪৭ এর মতো লবণ সহ্য করতে পারে। শীষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। পূর্ণবয়স্ক ধানগাছ ৯৫ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়। এর জীবনকাল ১৪৫-১৫০ দিন। লবণাক্ততার মাত্রা ভেদে হেক্টরপ্রতি ৩.৮-৭.৪ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। যা ব্রি ধান২৮ এর থেকে ১.৫ টন/হে. বেশি। এ ধানের চাল মাঝারি চিকন। এক হাজার পুষ্ট দানার ওজন প্রায় ২১ গ্রাম। চালে প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৮% এবং অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২২%।


জমির প্রকৃতি : মাঝারি উঁচু থেকে উঁচু জমি এ ধান চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
 

জমি তৈরি : ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এজন্য জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সেমি. গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়িভাবে ৪/৫টি চাষ ও মই দিতে হবে যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। প্রথম চাষের পর অন্তত ৭ দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচনের ফলে গাছের খাদ্য বিশেষ করে অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পায়।


সার ব্যবহার : বোরো মৌসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন  পেতে জমিতে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দরকার। ব্রি ধান৬১ জাতের বোরো ধান চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ১৪ কেজি টিএসপি, ১৬ কেজি এমওপি, ১৪ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। শেষ চাষের সম সবটুকু টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করা উচিত। ইউরিয়া সার সমান তিন ভাগ করে চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম, ৩৫-৪০ দিন পর ২য় এবং ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ছিটিয়ে মাটির সাথে হাত দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং মাটিতে দূষিত বাতাস থাকলে তা বের হয়ে যাবে।


চারা রোপণ : ব্রি ধান৬১ জাতের ধান ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর এর মধ্যে বীজ বপন করে বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানে তুলে এনে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মৌসুমে সারি থেকে সারি ২০-২৫ সেমি. এবং চারা থকে চারা ১৫-২০ সেমি. দূরত্বে লাগাতে হবে। জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছড়ানোর ওপর ভিত্তি করে এ দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে। প্রতি গোছায় ২/৩টি সুস্থ ও সবল চারা ২.৫-৩.৫ সেমি. গভীর রোপণ করতে হবে। খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়। এতে কুশি গজাতে দেরি হয়। কুশি ও ছড়া কম হয়। কম গভীরে রোপণ করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের সময় জমিতে ১.২৫ সেমি. এর মতো ছিপছিপে পানি রাখা ভালো। কাদাময় অবস্থায় রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যেসব জায়গায় চারা মরে যায় সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। এর ফলে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়।


সেচ ব্যবস্থাপনা : গাছের প্রয়োজনমাফিক সেচ দিলে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। বোরো মৌসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সেমি. পানির প্রয়োজন। তবে কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এ সময় জমিতে দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়। ধানের চারা রোপণের পর থেকে কোনো অবস্থায় কতটুকু পানির দরকার তা নিম্নে সারণিতে দেয়া হলো।  

সারণি ১

ধান গাছের অবস্থা/সময় পানির পরিমাণ
চারা রোপণের সময় ২-৩ সেমি.
চারা রোপণ থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সেমি.
চারা রোপণের ১১ দিন থেকে থোড় আসা পর্যন্ত ২-৩ সেমি.
কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের ফুল ফোটা পর্যন্ত ৫-১০ সেমি.


ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি পর্যায়ক্রমে বের করে দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেত থেকে মাঝে মাঝে পানি বের করে দিয়ে জমি শুকিয়ে নিতে হবে। এতে মাটিতে জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে যাবে এবং চারাগুলো মাটির জৈব পদার্থ থেকে সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারবে। তবে জমির মাটি যেন ফেটে না যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে চুল ফাটা দেখা দেয়া মাত্র পুনরায় সেচ দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেল জমি ফেটে যাবে এবং সেচের পানিও ফাটল দিয়ে চুইয়ে বিনিষ্ট হবে।


আগাছা দমন : সাধারণত বোরো ধানের বেলায় চারা রোপণের পর থেকে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ সময়ের মধ্যে অন্তত ২-৩ বার জমির আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করেই ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা উচিত। অন্যথায় আগাছার উপদ্রব বেড়ে যায়।

বিভিন্নভাবে আগাছা দমন করা যেতে পারে। যেমন- পানি ব্যবস্থাপনা, জমি তৈরি পদ্ধতি, নিড়ানি যন্ত্রের ব্যবহার, হাত দিয়ে টেনে উঠানো ইত্যাদি। নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহারের জন্য ধান সারিতে লাগানো দরকার। এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কেবলমাত্র দুই সারির মাঝের আগাছা দমন হয়। কিন্তু দুই গুছির মাঝের যে আগাছা বা ঘাস থেকে যায় তা হাত দিয়ে টেনে তুলে পরিষ্কার করতে হবে। সংগৃহীত ঘাসে যদি পরিপক্ব বীজ না থাকে তবে তা পায়ের সাহায্যে মাটির ভেতরে পুঁতে দিলে পচে জৈব সারে পরিণত হবে।


পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন : বোরো মৌসুমের শুরুতে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশ কম থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পোকার আক্রমণের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। বোরো ধানে সাধারণত পামরি, মাজরা, থ্রিপস, বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে।
তাছাড়া বোরো ফসলে টুংরো, ব্লাস্ট, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও পোড়া পচা, ছত্রাকজনিত কা- পচা, খোলপোড়া, খোলপচা, পাতার বাদামি দাগ ও বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের এসব রোগ ও পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।


ধান কর্তন : বোরো ধান সঠিক সময়ে কাটা ও মাড়াই করা উচিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরো ধান পাকে। পাকার সঙ্গে সঙ্গে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়। কারণ যে কোনো মুহূর্তে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া নিচু জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হলে এবং কাটতে দেরি করলে বৃষ্টির পানিতে অনেক সময় পাকা ধান তলিয়ে যেতে পারে। তাই পাকা ধান মাঠে না রেখে সময়মতো কেটে নিলে ফলনের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমানো যায়।
 

ফলন : লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩.৮-৭.৪ টন পর্যন্ত ব্রি ধান৬১ এর ফলন পাওয়া যায়।

 

মো. আবদুর রহমান*

*উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, তেরখাদা, খুলনা