সম্পাদকীয়
মার্চ মাস। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় মাস। ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে মা সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদী কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমণ চালায়। ২৬ মার্চ জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। বাঙালি দীর্ঘ ৯ মাস পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। ১৭ মার্চ ২০২৪ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য- “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ধরে, আনব হাসি সবার ঘরে”।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্ন ছিল জনগণের সার্বিক মুক্তি। কৃষি সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার অদম্য চেষ্টা। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমানে বিশ^ব্যাপী মহামারি, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী প্রভাব মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার মহাসড়কে রয়েছে। বিশ^পরিম-লে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে উন্নয়নের রোল মডেল। এ ধারা অব্যাহত রেখেছে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের দিকনির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন যুগোপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বর্তমান দেশে দানাদার শস্যের ঘাটতি নেই, রয়েছে উদ্বৃত্ত। সে সাথে কৃষিপণ্য স্থান করে নিয়েছে বিশে^র শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায়। প্রকৃতপক্ষে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ-স¥ার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে সবাইকে দেশের জন্য কাজে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে এবারের কৃষিকথায় ’বঙ্গবন্ধুর গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধনটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কৃষিকে টেকসই ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা গতিশীল রাখতে কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যায়। কৃষিকথায় এসব মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি লেখা দিয়ে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি প্রকাশিত লেখাসমূহ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে সহায়ক হবে।
বঙ্গবন্ধুর গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা
ড. জাহাঙ্গীর আলম
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিল স্বনির্ভর। কোনো অভাব ছিল না; বৈষম্য ছিল না। যার যতটুকু প্রয়োজন জমি চাষ করত। ফসল ফলাত। পশু-পাখি পালন করত, মাছ ধরত। মানুষের চাহিদাও ছিল কম। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসনামল পর্যন্ত গ্রামীণ জীবন ছিল সচ্ছল। জীবিকার প্রধান উৎস ছিল কৃষি। তার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল কুটির শিল্প, তাঁত ও ক্ষুদ্র পাটশিল্প। গ্রামসমাজ ও পঞ্চায়েতের ভিত্তিতে সংগঠিত ছিল গ্রামীণ জীবন। ইংরেজ আমলে কৃষক বাঁধা পড়ে গেল জমিদারদের জোয়ালে। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ল পুরনো গ্রামীণ সমাজ, গ্রামসভা ও পঞ্চায়েত। ভেঙে গেল স্বনির্ভরতা ও আত্মশক্তি। প্রতিকূল উৎপাদন সম্পর্ক, বৈরী আবহাওয়া, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং উৎপাদিত পণ্যের অবনমিত মূল্য অভাবও দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয় কৃষকের। তারা হয়ে পড়ে ঋণগ্রস্ত।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক মহাত্মা গান্ধী কৃষকের এ দৈন্যদশাকে ব্যাখ্যা করেন ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের ফল হিসেবে। তিনি বিদেশি পণ্যের ব্যবহার বর্জনের আহ্বান জানান। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেন। নিজের চরকায় সুতা কেটে কাপড় বোনাকে তিনি স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন। গান্ধীর স্বরাজ ও স্বদেশ আন্দোলনের মূলেই ছিল গ্রামোন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা। তাতেই নিহিত ছিল ভারতবাসীর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও শোষণমুক্তি। এর বিপরীতে ইংরেজ শাসকদল পল্লী পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মূল প্রবক্তা ছিলেন এফএল ব্রায়ন। তিনি গান্ধীজির সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির দুর্দশার ব্যাপারে একমত ছিলেন; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কারণে যে এই দুর্দশা তা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, গ্রামীণ মানুষের অশিক্ষা, কুসংস্কার, তামাক খাওয়া, অস্বাস্থ্য, মামলায় জড়ানো, ব্যয়বহুল বিয়ে এবং মরণোত্তর আনুষ্ঠানিকতার কারণে আর্থিক অনটন ও দারিদ্র্য দৃশ্যমান। এর নিরসনকল্পে তিনি গ্রামীণ জীবন সংস্কার এবং অফিসিয়াল কর্মসূচি অনুকরণের আহ্বান জানান। ইতোমধ্যে ভারতবর্ষের এক অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে জনচিত্তকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন। তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে তিনি উন্নতর কৃষি উৎপাদন, কুটির শিল্প ও কৃষি শিল্প স্থাপন, পশু-পাখি পালন, কৃষিপণ্য ও শিল্পজাতসামগ্রীর বিপণন ইত্যাদির ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশের খাদ্য সংকট ছিল প্রকট। দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। রাস্তা-ঘাট ছিল ভাঙা। অনেক কল-কারখানা বন্ধ ছিল। যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রয়োজনীয় সংযোগ ছিল না। লক্ষ লক্ষ যুবক ছিল কর্মহীন। দেশে ছিল অর্থাভাব। শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ ছিল অপ্রতুল। বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। দেশের জনগণকে এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ উন্নয়নের পথ বেছে নেন। সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন কৃষি উন্নয়নের ওপর। তিনি সামাজিক বৈষম্য দূর করে সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন দেশের অর্থনীতিকে।
একদিকে তিনি মহাত্মা গান্ধীর স্বনির্ভর গ্রামোন্নয়নের ভাবনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, অপরদিকে তিনি কবিগুরুর আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ও সমবায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত দেশের সংবিধানে ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চল বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের অমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এর আগের অনুচ্ছেদে সমবায় ব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। ...আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানিদের। আমাদের যা কিছু করতে হবে, সবকিছু বিদেশ থেকে আনতে হবে। কোথায় পাবেন বিদেশি মুদ্রা? দু’হাতে কাজ করতে হবে; ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতিকে প্রশ্ন করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ স্বনির্ভর কর্মসূচি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। মরিলাইজ দি পিপল। পাম্প যদি পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায়, তবে স্বনির্ভর হন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিল? দরকার হয় কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত, আট হাত কাটলেই পানি ওঠে। সেখানে অসুবিধা কী আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করার জন্য চিন্তার কী আছে?’... (১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)।
বঙ্গবন্ধু স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যে কর্মীদের উপদেশ দিয়েছেন, নিজে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জনগণকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
দেশের জনগণের সঙ্গে একান্ত হয়ে খাল খনন, রাস্তা নির্মাণ- এমন অনেক কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। গান্ধীজি যেমন চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে স্বদেশি হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুও বাঁশকে বিদেশি খাম্বার বদলে বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে স্বদেশ প্রেমের নজির তুলে ধরেছেন। (শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম, আতিউর রহমান, ২০১৮)।
বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সবার আগে কৃষি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ ও অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছেন। শীতকালীন শস্য উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পানি সেচের জন্য গভীর নলকূপ ও পাওয়ার পাম্প স্থাপন ও সেচের নালা নির্মাণের জন্য কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমার একবার সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস। আমার বাবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ দুই নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মীর প্রথম সাক্ষাৎ। বাবা আমাকেও নিয়ে যান সঙ্গে করে। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ¯েœহ ও ভালোবাসায় আমাদের আপ্লুত করলেন। বললেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেচের ব্যবস্থা করো। উচ্চফলনশীল জাতের শস্য লাগাও। রাস্তাঘাট ঠিক করো। গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াও। এখন গ্রামই হবে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এরপর থেকে এ দুই নেতাকে দেখছি তিতাসের তীরঘেঁষে অনেক সেচের নালা কাটায় জনগণকে সহায়তা করতে। গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভ করে গভীর নলকূপ বসাতে। আধুনিক জাতের ধান চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে। শুধু আমার থানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি থানায় এভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন কৃষককে। বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনা ছাড়া এভাবে কাজ করা সম্ভব হতো না।
দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কৃষককে যান্ত্রিক চাষে উদ্বুদ্ধকরণ, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সুষম বণ্টন এবং দেশের বেকার যুবসমাজকে কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিতকরণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমবায় ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। সমবায়কে তিনি বেছে নেন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ হিসেবে। তার লক্ষ্য ছিল গ্রামভিত্তিক বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। তবে তিনি জমির মালিকানা কেড়ে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং জমির মালিকানা কৃষকেরই থাকবে বলে তিনি জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে তিনি কৃষকের ছোট ছোট খ-ে বিভক্ত জমি একসঙ্গে করে যৌথ কৃষি খামার গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, যাতে আধুনিক চাষাবাদ সম্ভব হয়। যান্ত্রিকীকরণ সহজ হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে- এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এ কো-অপারেটিভ; এ জমির মালিকের জমি থাকবে; কিন্তু তার যে অংশ বেকার, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্টরিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে, আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। (মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু, ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রচিন্তা, উন্নয়ন দর্শন। নূহ-উল আলম লেনিন, পৃষ্ঠা ১০৭)।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব। অন্য কোনো দেশ থেকে ধার করা নয়। তিনি গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলেছিলেন। একে আখ্যায়িত করা হয় ‘মুজিববাদ’ হিসেবে। এখানে তিনি একজন অনন্য জাতীয়তাবাদী নেতা। গান্ধীজির মতো স্বদেশি। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে নবগঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলছি, সে অর্থনীতি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কোনো জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোনো ইজম চলে না। এদেশে কেন, কোনো দেশেই চলে না। আমার মাটির সঙ্গে আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ, আমাদের দেশে অনেক সুবিধা আছে। কারণ আমার মাটি কী, আমার পানি কত, আমার এখানে মানুষের কালচার কী, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কী তা না জানলে হয় না। ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চাই। বাট দি সিস্টেম ইজ আওয়ার্স। উই ডু নট লাইক টু ইমপোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড’।
দেশের গ্রামীণ উন্নয়নকে সফল করার জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমতাভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে চালু করেছিলেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লা উদ্ভাবিত দ্বিস্তরবিশিষ্ট নতুন সমবায় ব্যবস্থা যা পরে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে গ্রামীণ উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার জন্য ২.২ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলেন বগুড়া একাডেমি। পরে ১৯৯০ সালে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। পরে এ কার্যক্রম দেশের সব উপজেলাকে আওতাভুক্ত করে রাজস্ব বাজেটের অধীনে পরিচালিত করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু দেশে পল্লী উন্নয়নের ভিত রচনা করেন।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়ী উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। সমবায়ী মালিকানাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মালিকানাখাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে উৎপাদনখাত, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনব্যবস্থাসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত গ্রামভিত্তিক বহুমুখী কৃষি সমবায়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য প্রয়োজন ছোট ছোট খ-ে বিভক্ত জমির একত্রীকরণ। যাতে যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্ভব হয়। উপকরণ সংগ্রহ ও আর্থিক সংস্থান সহজতর হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কর্মহীন যুবকদের কর্মসংস্থান করা যায়। সর্বোপরি গ্রামীণ আয় বৈষম্য নিরসন সম্ভব হয়। এ সম্পর্কে সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে কিছু মাঠ গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে কুমিল্লার বামইল প্রকল্প, ময়মনসিংহের শিমলা যৌথ খামার প্রকল্প, চট্টগ্রামের রাঙুনিয়ায় গুমাইবিল প্রকল্প এবং রাজশাহীর গুরুদাসপুর প্রকল্প অন্যতম। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ওই প্রকল্পগুলো অস্তিত্ব হারায়। এদের সমস্যা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা, যৌথ কৃষি খামারের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক দিক বিশ্লেষণ করা এবং দেশে সমবায় কৃষি খামারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সত্তরে দশকের গোড়ার দিকে বেশ কিছু সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে কুমিল্লা একাডেমিতে, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহস্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ১৯৭৩ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের রাঙুনিয়ায় অনুষ্ঠিত সেমিনারসমূহ উল্লেখযোগ্য। ওই সকল সেমিনারের আলোচনা ও সুপারিশসমূহ ভবিষ্যতে যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রণয়নে কাজে আসতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো বঙ্গবন্ধুর যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় আজও প্রাসঙ্গিক। শিমলা প্রকল্পের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থেকে এবং এ নিয়ে গবেষণা করে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যৌথ কৃষি খামার ব্যবস্থাকে খুবই কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে মনে হয়েছে আমার। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সমলয় চাষাবাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমানে শ্রমিক সংকট নিরসন ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য এটি একটি উত্তম পন্থা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০, ই-মেইল : ধষধসল৫২@মসধরষ.পড়স
শিশুর পুষ্টি
তাসনীমা মাহজাবীন
১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস ২০২৪ যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপন করা হয়। এ দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে আগামী দিনের কর্ণধার শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় শিশুর পুষ্টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
একটি দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি পরিমাপের অন্যতম সূচক হলো শিশুর পুষ্টিগত অবস্থা। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে যত্ন শুরু করতে হবে তার জন্মের আগে থেকেই অর্থাৎ মা যখন গর্ভবতী হবেন তখন থেকেই। এই সময়কালকে বলা হয়ে থাকে সোনালী ১০০০ দিন। মায়ের গর্ভকালীন সময়ে শিশুর ২৭০ দিন এবং তার দুই বছর বয়স পর্যন্ত ৭৩০ দিনকে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে গণনা করা হয়।
গর্ভকালীন সময়ে মায়ের সুষম খাবার, বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যগত যত্ন নিলে শিশু সঠিক ওজন (ন্যূনতম ২.৫ কেজি) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই দুই বছরে শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়। শিশুর জন্মের সাথে সাথে মায়ের বুকের শালদুধ খাওয়াতে হবে এতে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির পাশাপাশি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। মায়ের দুধ এর বিকল্প আর কিছুই নাই তাই শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানোর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। নবজাতকের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি পরিমাণ মতো মায়ের দুধে বিদ্যমান থাকে। এরপর শিশুর ৬ মাস বয়সের পর থেকে আস্তে আস্তে অন্যান্য সহজপাচ্য খাবারে অভ্যস্ত করাতে হবে। প্রথম দিকে পাকা কলা বা পাকা পেঁপে জাতীয় খাবার চটকে খাওয়াতে হবে এবং অবশ্যই প্রতিদিনের ঘরে তৈরি খাবার অভ্যস্ত করতে হবে। খুব বেশি ব্লেন্ডারে পেস্ট করা খাবার না দিয়ে ঘরের স্বাভবিক খাবার খাওয়ালে শিশুর চাবানোর ক্ষমতা ও মাংসপেশির স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা ঠিক থাকে। এছাড়া এসময়ে শিশুর অনুপুষ্টি নিশ্চিত করতে ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র বা (গরহরসঁস ফরবঃধৎু ফরাবৎংরঃু ভড়ৎ পযরষফৎবহ) অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
শিশুকে প্রতিদিন নিম্নলিখিত ৮টি খাবারের তালিকা থেকে মায়ের দুধসহ কমপক্ষে ৫টি শ্রেণীর খাদ্য খাওয়াতে হবে। উল্লিখিত ৮টি খাদ্য শ্রেণি হলো: (১) মায়ের দুধ; (২) শস্য ও শস্যজাত খাবার, মূল এবং কন্দ; (৩) ডাল, বীজ ও বাদামজাতীয় খাবার; (৪) দুধ ও দুধজাতীয় খাবার যেমন- দই, পনির ইত্যাদি); (৫) মাছ-মাংসজাতীয় খাবার; (৬) ডিম; (৭) ভিটামিন এ জাতীয় ফল ও সবজি (যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া); (৮) অন্যান্য ফল ও সবজি। এতে তার দৈনন্দিন ভিটামিন ও খনিজলবণের চাহিদা পূরণ হবে। এছাড়া শিশুর পযাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। (ঋঅঙ. ২০২১. গরহরসঁস ফরবঃধৎু ফরাবৎংরঃু ভড়ৎ ড়িসবহ. জড়সব. যঃঃঢ়ং://ফড়র.ড়ৎম/১০.৪০৬০/পন৩৪৩৪বহ)
শিুশুর স্বাভাকি ওজন ও উচ্চতা থেকে তার পুষ্টি অবস্থা নির্ণয় করা হয়। শিশুর বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট উচ্চতার কম হলে খর্বকায় (ঝঃঁহঃরহম) বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে বয়সের তুলনায় কম ওজন সম্পন্ন শিশুকে কৃষকায় বা (ধিংঃরহম) বলা হয়ে থাকে। এধরনের শিশু একটি পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার অভাবকেও চিহ্নিত করে। বর্তমানে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী খর্বকায় (ংঃঁহঃরহম) শিশুর সংখ্যা ২৪% ও কৃশকায় (ধিংঃরহম) শিশু ১১% এবং কম ওজন (ঁহফবৎ বিরমযঃ) সম্পন্ন শিশু ২২%। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে খর্বকায় শিশুর সংখ্যা ১৫% নামিয়ে আনতে হবে। বিগত বছরের তুলনায় যদিও বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে কিন্তু শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে কারণ শিশুর বুদ্ধি বৃত্তি, মানসিক বিকাশ ও শারিরিক বিকাশ এর জন্য সঠিক খাদ্যাভাস এর কোন বিকল্প নেই।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিতপুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান)। মোবাইল : ০১৭৮১৮৮৭৮৮৫
সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধির উপায়
ড. উৎপল কুমার
ফসল বা গাছপালা জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্যোপাদন গ্রহণ করে থাকে। এই ১৬টি খাদ্যোপাদনের যে কোন একটির অভাবে ফসল তার কাক্সিক্ষত মাত্রায় ফলন দিতে পারে না। ১৬টি খাবারের মধ্যে ফসল মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে ১৩টি। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের মাটিতে সব ক’টি খাবারের অভাব দেখা দেয়নি তবে অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা বাড়ছে মানুষ, কমছে আবাদি জমি। স্বল্প পরিমাণ আবাদি জমিতে অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে একই জমিতে একের অধিক ফসল চাষবাস করতে হচ্ছে। এতে করে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাটিতে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় ৮ থেকে ৯ ধরনের খাবারের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই ঘাটতিযুক্ত খাবার আমরা সার হিসেবে জমিতে প্রয়োগ করে থাকি। এটা সত্য যে, ফসল উৎপাদনে সার একটি অতি প্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল উপকরণ। কিন্তু বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার সারে ভর্তুকি দেবার কারণে এটি বাজারে এখন কম মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। যার ফলে কৃষাণ-কৃষাণীরা এই মৃল্যবান উপকরণটি যথেচ্ছা ব্যবহার করছেন। এ কারণে সারের অপচয় বেশি হচ্ছে। তাই প্রয়োগকৃত সারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য সকল প্রকারের প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এজন্য (ক) সঠিক পরিমাণ সার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ (খ) সঠিক প্রকারের সার নির্বাচন (গ) সঠিক পদ্ধতিতে সারপ্রয়োগের ব্যবস্থা (ঘ) সঠিক স্থানে সারদ্রব্য প্রয়োগ এবং (ঙ) সঠিক সময়ে সারপ্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজীবী ভাই ও বোনেরা এবার আসুন জানি কিভাবে সার প্রয়োগ করলে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
রবি ফসলের ক্ষেত্রে : রবি ফসলে সেচের সুবিধা না থাকলে ইউরিয়া সারের সবটুকু জমি প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রবি ফসলে সেচের সুবিধা থাকলে ইউরিয়া সার ২-৩ কিস্তিতে প্রযোগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে প্রয়োগের পর মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে, দ্বিতীয় কিস্তি দ্রুতবর্ধনশীল অবস্থায় এবং শেষ কিস্তি গাছে ফুল আসার ৫ থেকে ৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
ধান চাষের ক্ষেত্রে : ইউরিয়া সার তিনটি কিস্তিতে সমানভাবে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তির ইউরিয়া সার জমিতে চারা রোপণের ৮-১০ দিনের মধ্যে চারা স্থায়ী হয়ে গেলে জমি ভেজা অবস্থায় অথবা আগাছা দমনকালে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার দ্রুত কুশি গজানোর সময় অর্থাৎ চারা রোপণের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আগাছা পরিষ্কারকালে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। তৃতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে অর্থাৎ চারা রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে মাটি ভেজা অবস্থায় অথবা জমিতে স্বল্প পমিাণ পানি দাঁড়ানো অবস্থায় ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। জমি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময় শেষ চাষের আগে সমুদয় ফসফেট সার, অর্ধেক এমওপি সার এবং অর্ধেক জিপসাম সার একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে চাষের সংগে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। দস্তা ও ফসফেট সার একসঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত নয়। তাই দস্তা সার প্রথম কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় ভালোভাবে মিশিয়ে সমস্ত জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক এমওপি এবং অর্ধেক জিপসাম সার দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সারের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে একত্রে প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
শাকসবজি চাষের ক্ষেত্রে : শাকসবজির বেলায় ইউরিয়া সার ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি শস্যগুলো বেলায় সমুদয় ইউরিয়া সার জমি তৈরির শেষপর্যায়ে একবারেই প্রয়োগ করা যায়। অধিকাংশ মসলাজাতীয় ফসলে ইউরিয়া সার ২/৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছে ফুল আসার সময় ছাড়া জমি আর্দ্র অথবা সামান্য ভেজা অবস্থায় শেষ বিকেলের দিকে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলেই সবচেয়ে ভালো ফল আশা করা যায়। ধানের জমি বিশেষ করে বোরো ধানের জমিতে পূর্ণ দুই স্তর এ্যাজোলা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩০-৪০ কেজি নাইট্রোজেন কম প্রয়োগ করতে হবে।
তামাক ও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে : মিউরেট অব পটাশের পরিবর্তে পটাশিয়াম সালফেট ব্যবহার করা উচিত। প্রয়োজনবোধে গন্ধক ও দস্তার সার উপরিপ্রয়োগ করা যায়, বিশেষ করে যদি এসব সারের সুপারিশকৃত পূর্ণমাত্রা প্রাথমিকভাবে প্রয়োগ করা না হয়ে থাকে। সময়মতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা সত্ত্বেও গাছের কচিপাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করা গন্ধকের ঘাটতি নির্দেশ করে। এসব ক্ষেত্রে সুপারিশকৃত গন্ধক সারের পূর্ণমাত্রা যথাশিগগির সম্ভব উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। গাছের কচিপাতা সাদাটে হওয়া (গোড়ায় পাতা থেকে পর্যায়ক্রমে উপরের পাতায়) এবং এর সাথে পাতায় ছোট ছোট বাদামি দাগ সাধারণত দস্তার ঘাটতি নির্দেশ করে। এ সমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে সুপারিশকৃত পূর্ণমাত্রার দস্তা সার তাৎক্ষণিকভাবে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
পাট চাষের ক্ষেত্রে : বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে যদি ভালোমতো পচে যাওয়া গোবর সার হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৭.৫ টন হিসেবে মাটিতে প্রয়োগ করা হয় তবে ও-৯৮৯৭ জাতের পাট ছাড়া অন্য জাতের পাটে ইউরিয়া ব্যতীত অন্যান্য সার সাধারণত প্রয়োজন হয় না। ও-৯৮৯৭ জাতের পাটের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৫.০ কেজি ফসফরাস এবং ১৭.০ কেজি পটাশিয়াম সার প্রয়োগ করা দরকার। ও-৯৮৯৭ জাতের পাট চাষের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সার হিসেবে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার সুপারিশকৃত মাত্রা থেকে শতকরা ৫০ ভাগ কমানো যেতে পারে। অন্যান্য জাতের বেলায় প্রাথমিক সার হিসেবে নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না এবং দ্বিতীয় কিস্তির (বপনের ৪৫ দিন পর) ইউরিয়া সারের পরিমাণ সুপারিশকৃত মাত্রা থেকে শতকরা ২৫ ভাগ কমানো যেতে পারে।
আখের সাথে আন্তঃফসল চাষের বেলায় : আন্তঃফসলের নিবিড়তার উপর ভিত্তি করে সার সুপারিশ করা হয়। সাধারণত আন্তঃফসলের সারির সংখ্যা অর্থাৎ ওই ফসলের গাছের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি ফসলের (আন্তঃফসলের) জন্য সুপারিশকৃত সারের অর্ধেক অথবা এক তৃতীয়াংশ সার প্রয়োগ করতে হবে। কোন ফসল একক ফসল (ংড়ষব পৎড়ঢ়) হিসেবে আবাদ করার সময় যে পদ্ধতিতে সারপ্রয়োগ করা হয় ওই ফসলটি আন্তঃফসল হিসেবে আবাদ করার ক্ষেত্রে একই পদ্ধতিতেই সার প্রয়োাগ করতে হবে।
ডালজাতীয় ফসলে : জীবাণুুসার ব্যবহার করা হলে ইউরিয়া সারপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। প্রতি হেক্টর জমিতে এক কেজি জীবাণু সারই যথেষ্ট। এক লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ঝোলা গুড় মিশিয়ে ১৫ মিনিট সিদ্ধ করে পানি ঠা-া করতে হবে। অত:পর জীবাণুুসার এবং বীজ ঠা-া দ্রবণে ভালোভাবে মিশিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকাতে হবে। তারপর বীজ মাঠে বুনতে হবে।
যে সব এলাকার মাটির অম্লীয় প্রকৃতির (সাধারণত পিএইচ ৫ এর নিচে) সেসব এলাকার মাটিতে ফসল লাগানোর ৭-১৫ দিন পূর্বে প্রতি শতাংশে ৪ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কারণ নিরপেক্ষ মাটিতে পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা বেশি।
তাই কৃষিজীবী ভাই ও বোনেরা আসুন মাটি পরীক্ষা করে জমির উর্বরতা মান জেনে এই নিয়মগুলো মেনে জমিতে সারপ্রয়োগ করি, অধিক ফসল ঘরে তুলি এবং সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করি।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিসিএস (কৃষি), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, টাঙ্গাইল, মোবাইল : ০১৭১২-৭০৩৩৭৩; ই-মেইল : ঁশংৎফর@ুধযড়ড়.পড়স
উত্তম কৃষি চর্চার আলোকে আম সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী এবং বাণিজ্যিক ফসল। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে মৌসুমি এ ফলটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আম উৎপাদনকারী এলাকায় আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই আমের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রধান উৎপাদনকারী এলাকার ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সাথে জড়িত থাকে। বর্তমানে যে ফলগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে আম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিবিএস ২০২২ সালের তথ্য মতে এদেশে ১২.১৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা এর তথ্য অনুযায়ী এদেশে আম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমাদের দেশে আমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট। তারপরও বাজারে ভালোমানের আমের অভাব রয়েছে। ফলে আম রপ্তানি কার্যক্রম আশানুরূপভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভালোমানের গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের এখনই উপযুক্ত সময়। এখন থেকে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন করা সম্ভব হলে ভালো মানের আম উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
সংগ্রহপূর্ব আম বাগানের যত্ন
আমের গুটি বাঁধার পর পরই শুরু হয় গুটি ঝরা। এরপর দেখা যায় বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। তাই প্রথমে গুটি ঝরা কমানোর জন্য শুকনো মৌসুমে বাগানে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সেচের সুবিধা না থাকলে গাছে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। আম মটরদানা হতে শুরু করে মার্বেলাকৃতি সময় পর্যন্ত বোরণ পাউডার অথবা বোরিক এসিড ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করলে ফল ঝরা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আরেকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করেও আমের গুটি ঝরা কমানো যায়। একটি থোকায় বা পুষ্পমঞ্জরিতে ১-২টি আম ভালো ফলনের জন্য যথেষ্ট এর বেশি থাকলে প্রাকৃতিক ঝরা বন্ধ হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়াও এই অবস্থায় নিয়মানুযায়ী কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে নির্দেশিত মাত্রায় মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তবে মাটির অবস্থা বুঝে ২৫-৩০ দিন পরপর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হবে। আমের ফলছিদ্রকারী ও মাছি পোকা দমনের জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমের শরীরে যতবেশি বৃষ্টির পানি পড়বে তত দ্রুত আমের রং নষ্ট হবে এবং সংরক্ষণকাল কমে যাবে। ফলে এদেশের আবহাওয়ায় ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকরী। আগাম ও মধ্যম জাতের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৪০-৫০ দিন এবং নাবি জাতের ক্ষেত্রে ৫৫-৬০ দিন পর্যন্ত ব্যাগিং প্রযুক্তি গ্রহণ করলে বালাইনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন হবে না। এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারে ভালোমানের আমের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আম সংগ্রহের পূর্বে বাগান ব্যবস্থাপনা ভালো হলে আমের সংরক্ষণকাল বেড়ে যায় এবং আমের গুণগতমান ভালো হয়। সুতরাং আমের সংগ্রহ পূর্ব ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা সঠিক নিয়মে ও সময়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
আম সংগ্রহ
আম সঠিকভাবে পরিপক্ব হলেই সংগ্রহ করা উচিত। পরিপূর্র্ণ পুষ্টতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা উচিত নয় কারণ অপুষ্ট আম ঠিক মতো পাকে না এবং সঠিক রঙ ধারণ করে না। উপরন্তু উপরের খোসা কুঁচকে যায় ফলে বাজারমূল্যে কমে যায়। পরিপূর্ণভাবে পুষ্ট (সধঃঁৎব) হলে আমের উপরের অংশ অর্থাৎ বোঁটার নিচের ত্বক সামান্য হলুদাভ রঙ ধারণ করবে। আমের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০১ - ১.০২ এর মধ্যে থাকবে অর্থাৎ পরিপক্ব আম পানিতে ডুবে যাবে। প্র্রাকৃতিকভাবে দুই একটা পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে এবং পাখিতে আধাপাকা আম ঠোকরাবে। উপযুক্ত সময়ের আগে বা পরে সংগ্রহ করলে পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আম সংগ্রহ করতে হবে অত্যন্ত যতেœর সাথে। আম গাছ হতে আম দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়, হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক ব্যবহার করে। গাছের উচ্চতা কম হলে তা সহজেই হাত দ্বারা সংগ্রহ করা সম্ভব কিন্তু গাছের উচ্চতা বেশি হলে বাঁশের তৈরি আম সংগ্রহক বা ঠুসি (গধহমড় যধৎাবংঃবৎ) ব্যবহার করা হয়। গাছ থেকে আম সংগ্রহ করতে হবে মেঘমুক্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এবং সকাল বেলায়। আম কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখতে হবে যাতে আঠা ঠিকমত ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগতে পারে। আমের কষ ঝরানোর জন্য আঠা ঝরানো যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। আম সংগ্রহ করার পর যত দ্রুত সম্ভব আমগুলোকে ঠা-া জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে দফায় দফায় আম পাড়া যেতে পারে। গাছ থেকে আম সংগ্রহ করার ১২-১৫ দিনের মধ্যে আমগাছে কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। বালাইনাশক স্প্রে করা এবং ফল সংগ্রহ করার মধ্যবর্তী পার্থক্য মেনে চললে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে আসে।
বাছাইকরণ বা গ্রেডিং
সংগৃহীত আমের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বাছাইকরণ একান্ত প্রয়োজন। আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকার দ্বারা আক্রান্ত এবং গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখতে হবে কারণ এসব আম খুব তাড়াতাড়ি পচে যায়। দুরবর্তী বাজারে বা রপ্তানির জন্য স্বাভাবিক, উজ্জ্বল এবং পরিপুষ্ট আম বাছাই করে প্যাকিং করা উচিত। যে কোনো ফল প্যাকিং এর আগে ছোট, মাঝারি এবং বড় এই তিন ভাগে ভাগ করা উচিত যাতে প্যাকিং, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়।
সংগ্রহোত্তর পচন রোধ
আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর আমের পচন জনিত রোগ দমন করতে হবে। আম রোগমুক্ত রাখা বা সংগৃহীত আমের পচন রোধ করার জন্য বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত যেমন- গরম পানিতে আম শোধণ এবং বাষ্পীয় আম শোধন। এক্ষেত্রে গাছ থেকে ফল সংগ্রহের কিছুক্ষণ পরই ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে আমের সংগ্রহোত্তর পচন দমন করা যায়। তবে উন্নত দেশে আম সংগ্রহের পর নির্দিষ্ট মাত্রায় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে আমকে শোধন করা হয়।
প্যাকিং
আম সংগ্রহের পর ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর জন্য আমের যে ব্যবস্থাপনা করা হয় তাকে প্যাকিং বলে। আম দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকিং একান্ত প্রয়োজন। কেননা আমের শরীর বেশ নরম এবং সামান্য আঘাতে জখম হতে পারে এবং তাতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। আম প্যাকিংয়ের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত। আমাদের দেশে আম প্যাকিংয়ে প্রধানত বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়। বাঁশের ঝুড়ির চাইতে ছিদ্রযুক্ত কাঠের বাক্সে আম পরিবহন বেশি যুক্তিসঙ্গত। তবে সবচাইতে ভাল ব্যবস্থা হলো প্লাস্টিকের ক্রেটসে আম পরিবহন। তবে সম্ভব হলে প্যাকেটের তলায় কিছু খড় বিছানো এবং প্রতিটি আমকে টিস্যু পেপার বা খবরের কাগজ দ্বারা মোড়িয়ে দেওয়া ভালো। প্র্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে ফলের নাম, জাতের নাম, প্রাপকের নাম ইত্যাদি লিখে রাখা উচিত। প্যাকিংয়ের আগে আমকে গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের রঙ কিছুটা হলুদ হয় এবং বেশ কিছুদিন রোগমুক্ত থাকে। গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের স্বাদ বেড়ে যায়।
পরিবহন
আমাদের দেশে আম প্রধানত সড়ক পথেই পরিবহন করা হয় কারণ এতে সময় অল্প লাগে। তাছাড়া বাগান থেকে বাজারে আম পরিবহনের জন্য সাইকেল, রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, নৌকা ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়। আম ফল পরিবহনে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যানবাহনে আম উঠানো, নামানো ও পরিবহনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন ফলের গায়ে বা প্যাকেটে আঘাত না লাগে; পরিবহনে বেশি সময় নষ্ট না করাই ভালো কারণ তাতে আম পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে; পরিবহন শেষ হলেই প্যাকেট খোলা ও আম গুদামজাত করা উচিত; গাদাগাদি করে আম পরিবহন করলে নিচের আমে বেশি চাপ পড়ে ও আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গুদামজাতকরণ/ সংরক্ষণ
গাছ থেকে আম সংগ্রহ করার পর বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আমকে গুদামজাত বা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কোন ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করার পরও তার মধ্যে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তাই আম গুদামজাত করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যে ঘরে আম রাখা হবে তা অবশ্যই বাতাস চলাচলের উপযোগী ও শীতল হতে হবে। প্রয়োজনে ইলেকট্রিক ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে; আর্দ্র আবহাওয়ায় ও বদ্ধ ঘরে আম তাড়াতাড়ি পাকে এবং সহজে পচন ধরে যায়। ফলে পাকা আম বেশি দিন গুদামে সংরক্ষণ না করে তাড়াতাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; ঘরের তাপমাত্রা যত কম হবে ততই উত্তম। তবে ২০-২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে আমের ওজন হ্রাস কম হয়।
বাজারজাতকরণ
যে কোন জিনিস বাজারজাতকরণ একটি সুন্দর আর্ট। দক্ষ ব্যবসায়ীগণ বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসামগ্রীকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন যাতে ক্রেতাসাধারণ অতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। আম বাজারজাতকরণের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত।
বেশি পাকা আম আগে বিক্রয় করতে হবে; কোন আমে পচন দেখা মাত্রই আলাদা করে রাখতে হবে কারণ এর জীবাণু অন্যান্য সুস্থ আমকে আক্রমণ করে; ছোট, মাঝারি ও বড় এ তিন আকারের ফল বাছাই করে বাজারজাত করতে হবে; বাজারজাতকৃত আমের গাদায় জাতের নাম এবং দর লিখে রাখতে হবে।
পরিশেষে, পছন্দনীয় এ ফলটির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আম উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশের সকল ভোক্তাগণ মৌসুমী ফল আম হতে প্রত্যেকটি জাতের আসল স্বাদ পাবেন এই প্রত্যাশাই গবেষকদের। ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হলে তা দেশের মানুষের পষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং আম রপ্তানির পরিমাণও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে আম চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং দেশে অর্থনীতি আরো দৃঢ় ও মজবুত হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল: ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল: ংড়ৎড়ভঁ@ুধযড়ড়.পড়স
ধুন্দুল
গ্রীষ্মকালীন একটি
নিরাপদ সবজি
ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ
ধুন্দুল কুমড়া গোত্রের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সবজি। পূর্বে এই সবজিটি শুধুমাত্র বসতবাড়িতে স্বল্প পরিসরে চাষ হতো কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। শীতকালের কিছু সময় বাদ দিয়ে বাকি সারা বছরেই এই সবজি চাষ করা যায়। এই সবজির বিশেষ কিছু গুণের কারণে (যেমন- রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি) খুব সহজেই চাষ করা যায়। বর্তমানে সবজি চাষাবাদে কৃষকগণ বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ধুন্দুলে কীটনাশক খুব কম ব্যবহার করলেই চলে। মাছি পোকাকে যদি ফাঁদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং ভালো মানের বীজ ব্যবহার করা হয় তবে শতভাগ নিরাপদ সবজি হিসাবে ধুন্দুলকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
আমাদের দেশে এই সবজির ব্যবহার শুধুমাত্র সবজি হিসেবে, কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই এর বহুবিধ ব্যবহার হচ্ছে। পরিপক্ব ধুন্দুলের স্পঞ্জকে শরীর পরিষ্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কারে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে জৈব পরিষ্কারক হিসেবে এই সবজির স্পঞ্জের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চায়না ও কোরিয়াতে বিভিন্ন জৈব প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে এই সবজির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। এই সবজিতে বিভিন্ন পুষ্টি উৎপাদন পরিমাণে কম হলেও ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এর একটি ভালো উৎস এই সবজি। এই সবজিতে আঁশ বেশি থাকায় কৌষ্ঠকাঠিন্য দূরকরণে এই সবজি বেশ কার্যকর। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে ধুন্দুলের দুটি মুক্ত পরাগায়িত উচ্চফলনশীল জাত (বারি ধুন্দুল-১ ও বারি ধুন্দুল-২) মুক্তায়িত হয়েছে এবং অতি শীঘ্রই হাইব্রিড ধুন্দুলের জাত মুক্তায়নের প্রক্রিয়া চলছে। উক্ত জাত দু’টি কৃষক ভাইয়েরা প্রচলিত নিয়মে বীজ রাখতে পারবেন এবং পরবর্তী বছর তা ব্যবহার করতে পারবেন।
বারি ধুন্দুল- ১ : আকর্ষণীয় সবুজ রঙের লম্বা আকৃতির (৩০-৩২ সেমি.) ফল। ইহার উপরের প্রান্ত ও নিচের প্রান্ত কিছুটা শরু। প্রতি ফলের গড় ওজন ২০০-২৩৫ গ্রাম। ফলে কোনরূপ তিক্ততা ভাব পরিলক্ষিত হয় না। পরাগয়নের পর হতে ৮-১০ দিন পর তা খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৯৫-১১০টি এবং ফল ধরা শুরু হওয়ার পর হতে প্রায় ৯০-১১০ দিন পর্যন্ত ফল ভালো ভাবে সংগ্রহ করা যায়।
বারি ধুন্দুল- ২ : আকর্ষণীয় সবুজ রঙের, মাঝারি আকৃতির (১৮-২৫ সেমি.) ফল। প্রতি ফলের গড় ওজন ১৮৫ গ্রাম। ফলে কোনরূপ তিক্ততা ভাব পরিলক্ষিত হয় না। পরাগায়নের পর হতে ৮-১০ দিন পর তা খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ১০০-১২৫টি এবং ফল ধরা শুরু হওয়ার পর হতে প্রায় ৮০-৯০ দিন পর্যন্ত ফল ভালো ভাবে সংগ্রহ করা যায়। গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক বৃদ্ধি কম এবং ছাদ বাগানের জন্য খুবই উপযোগী।
বছরের যে কোন সময় ধুন্দুলের চাষ সম্ভব হলেও এদেশে প্রধানত খরিফ মৌসুমেই ধুন্দুলের চাষ করা হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি হতে মে মাসের মধ্যে যে কোন সময় পর্যন্ত ধুন্দুলের বীজ বপন করা যায়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ধুন্দুল ভালো জন্মে। পরিবেশগতভাবে এটি একটি কষ্টসহিষ্ণু উদ্ভিদ। এরা খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পরাগায়ন বিঘিœত হয় ফলে, ফলন কমে যায়। শীতকালের ২/৩ মাস ছাড়া বাংলাদেশে প্রায় সারা বছরেই ধুন্দুল চাষ করা সম্ভব। ধুন্দুলের জন্য হেক্টরপ্রতি ৩-৪ কেজি এবং শতাংশ প্রতি ১২-১৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বাণিজ্যিকভাবে ধুন্দুল চাষের জন্য উঁচু, পানি জমে থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। প্রথমে সম্পূর্ণ জমিকে ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে জমি উপযুক্ত করে নিতে হবে। সম্পূর্ণ জমিতে ১.২ মি. চওড়া ও ১০-১৫ সেমি. উঁচু করে বেড করে নিতে হবে। বেডের দৈর্ঘ্য জমির দৈর্ঘ্যরে উপর নির্ভর করবে এবং এক বেড হতে অন্য বেডের মাঝখানে কমপক্ষে ৬০ সেমি. এর নালা রাখতে হবে। এরপর বেডের মধ্যে ৩-৩.৫ মি. পরপর মাদা তৈরি করতে হবে। উক্ত মাদাতে সরাসরি ২/৩টি বীজ বপন করা যেতে পারে অথবা পলিব্যাগে চারা তৈরি করে ১০-১৫ দিন বয়সের চারা মাদাতে লাগানো যেতে পারে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : ধুন্দুলের জমিতে শতাংশ প্রতি সার প্রয়োগ সারণি দ্রষ্টব্য। মাদায় চারা রোপণের পূর্বে, সার দেয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। অতঃপর মাটিতে ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।
পরবর্তী পরিচর্যা : ধুন্দুল গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয় বলে তখন সবসময় পানি সেচের প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। তখন অনেক সময় কোন বৃষ্টিই থাকে না। উক্ত সময়ে ৫-৬ দিন অন্তর নিয়মিত পানি সেচের প্রয়োজন হয়। ধুন্দুলের কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে অবশ্যই মাচায় বা কঞ্চিতে চাষ করতে হবে। ধুন্দুল কঞ্চিতে/মাচায় চাষ করলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন বেশি হওয়ায় ফলন ভাল হয়। সেচের পর জমিতে চটা বাঁধে। চটা বাঁধলে গাছের শিকড়াঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়। কাজেই প্রত্যেক সেচের পর হালকা মালচ করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সবসময়ই আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। এ ছাড়াও গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদন ও রস শোষণ করে নেয়। ফলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। চারা রোপণের পর গাছ প্রতি সারের উপরিপ্রয়োগের যে মাত্রা উল্লেখ করা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে। সময়মতো গাছের গোড়ায় শোষক শাখা অপসারণ করলে ফলন বৃদ্ধি পাবে। ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে ৪-৬ মাসব্যাপী ফল সংগ্রহ করা যায়। ধ্ন্দুুলের ফল পরাগায়নের ৮-১০ দিন পর সংগ্রহের উপযোগী হয়।
রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
পাউডারি মিলডিউ : পাতার উভয় পাশে প্রথমে সাদা পাউডার বা গুঁড়া দেখা যায়। ধীরে ধীরে এ দাগগুলো বড় ও বাদামি হয়ে শুকিয়ে যায় কোন একটি লতার পাতায় আক্রমণ বেশি হলে ধীরে ধীরে সেই লতা ও পরে পুরো গাছই মরে যেতে পারে। আগাম চাষ করে রোগের প্রকোপ কমানো যায়। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম থিওভিট বা সালফোলাক্স/ কুমুলাস অথবা ১০ গ্রাম ক্যালিক্সিন ১৫ দিন পর পর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা।
ডাউনি মিলডিও : এটি ধুন্দলের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের ফলে পাতার নিচের পৃষ্ঠে হলুদ দাগ দেখা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে দাগগুলো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। এ রোগ দমনের জন্য অটোস্টিন অথবা ইনডোফিল ১গ্রাম/প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করে এই রোগ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফলের মাছি পোকা : স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাস খায়, ফল পচে যায় এবং অকালে ঝরে পড়ে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার করতে হবে। বিষটোপের জন্য থেঁতলানো ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টিকুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিষটোপ ৩-৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়।
পামকিন বিটল : পূর্ণাঙ্গ পোকা চারা গাছের পাতা খায়। কীড়া গাছের গোড়ায় মাটিতে বাস করে এবং গাছের শিকড়ের ক্ষতি করে, বড় গাছ মেরে ফেলতে পারে। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সেভিন/কার্বারিন ৮৫ ডব্লিউপি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীড়া দমনের জন্য প্রতি গাছের গোড়ায় ২-৫ গ্রাম বাসুডিন/ডায়াজিনন-১০ জি মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
ফলন : উপরোক্ত নিয়ম মেনে চাষ করলে বিঘাপ্রতি ৬.৫ টন (শতাংশ প্রতি ১৯৭ কেজি) পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
লেখক : উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৫৫৬৩৬৩৯০১; ই-মেইল : নধযধঁফফরহধযঢ়হবফ৫৭@ুধযড়ড়.পড়স
ভুট্টার ছত্রাকজনিত (ফিউজারিয়াম
স্টক রট) রোগের
দমন ব্যবস্থাপনা
কিশওয়ার-ই-মুস্তারিন
দানাজাতীয় ফসলের মধ্যে সাড়া বিশে^ ভুট্টা উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশে ধানের পরেই এর অবস্থান। বাংলাদেশে ভুট্টার চাহিদা প্রতি বছর ১০-১২% হারে বেড়েই চলেছে। ভুট্টার চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়গুলোর মধ্যে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের আক্রমণ অন্যতম। এসব রোগবালাইয়ের মধ্যে একটি হলো ‘ফিউজারিয়াম স্টক রট রোগ’ যা ফিউজারিয়াম নামক ছত্রাকের বিভিন্ন প্রজাতি দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে। ভুট্টার বিভিন্ন রোগের মধ্যে এ রোগটি অন্যতম এবং যার সংক্রমণের ফলে ক্ষেত্রবিশেষে ফলনের ১০০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এটি মূলত মাটি ও বীজবাহিত রোগ এবং এর পোষক দেহের (ঐড়ংঃ ৎধহমব) সংখ্যা অনেক বেশি। সাম্প্রতিককালে, ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা খরিপ মৌসুমে আবাদকৃত ভুট্টা ফসলে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ফলে ভুট্টা ফসল চাষের ক্ষেত্রে এই রোগের দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
রোগের গুরুত্ব/ক্ষতির পরিমাণ
সংবেদনশীল ভুট্টার জাত চাষাবাদ করলে ক্ষতির আশংকা বেশি থাকে। ফসলের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের সংক্রমণ হলে অপরিপক্ব অবস্থায় ভুট্টার গাছ মারা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে এ রোগের সংক্রমণে সাধারণত ১০-৪০ ভাগ ফসলের ক্ষতি সাধিত হয় তবে অনুকূল পরিবেশে ক্ষেত্র বিশেষে এর পরিমাণ ১০০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়াও দানা গঠন পর্যায়ে সংক্রমণ হলে মোচা ও দানার ওজন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।
রোগের বিস্তৃতি ও পোষকদেহ
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই রোগের সংক্রমণ পরিলক্ষিত হয়েছে বিশেষত আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতসহ বাংলাদেশের কিছু কিছু জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। দানা ফসলের মধ্যে ধান ও গমসহ বিভিন্ন সবজি ফসলে (বেগুন, টমেটো, কলা ইত্যাদি) এ রোগের জীবাণুর বিকল্প পোষক হিসেবে কাজ করে।
রোগের জীবনচক্র
এই রোগের জীবাণু মাটির পৃষ্ঠে অথবা মাটিতে বিদ্যমান ফসলের অবশিষ্টাংশ ও বীজে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকে। পরবর্তীতে ভুট্টা ফসল লাগানোর পর অনুকূল পরিবেশে এই রোগের জীবাণু ভুট্টা গাছের মূলে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত স্থান পচিয়ে ফেলে এবং গোড়া সংলগ্ন অংশের জাইলেম ও ফ্লোয়েম ভেসেল টিস্যুগুলো নষ্ট করে ফেলে এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ গাছ শুকিয়ে মারা যায়। এ ছাড়াও পাতায় এ রোগের জীবাণু থাকলে বাতাস বা বৃষ্টির পানির ঝাপটায় এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ ফসলে বিস্তার লাভ করে।
রোগের বিস্তারের অনুকূল আবহাওয়া
চারা অবস্থায় শুষ্ক আবহাওয়া এবং সিল্ক বের হওয়া অর্থাৎ ফুল আসার পর বৃষ্টিপাত হলে অথবা উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজমান থাকলে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়; তাপমাত্রা ২৬-৩৫০ সেন্টিগ্রেড এবং অধিক আর্দ্রতা (৮০-১০০%) এই রোগের সংক্রমণের হার তরান্বিত করে; গাছের ঘনত্ব অধিক হলে এবং সেই সাথে নাইট্রোজেন সারের আধিক্য ও পটাশ সারের অভাব হলে এই রোগের আধিক্য বেড়ে যায়; মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে ও অধিক মাত্রায় ভাসমান সেচ প্রয়োগ করলেও এই রোগের আধিক্য বেড়ে যায়।
রোগের লক্ষণ
আক্রান্ত গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়, গাছ শুকিয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করে এবং অপরিপক্ব অবস্থায় মারা যায়; শিকড়, গোড়া এবং নিচের ইন্টারনোডগুলো পচে যায়; কা-ের নিচের অংশ বিভক্ত করলে ভেতরে বিবর্ণতা দেখা যায় এবং জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যুগুলো নষ্ট হয়ে আক্রান্ত গাছের পিথ নষ্ট হয়ে যায়; আক্রান্ত গাছের কা-ে চাপ দিলে নরম বোধ হয় এবং নীচের ইন্টারনোডগুলো সহজেই ভেঙে যায়; আক্রান্ত গাছের মোচাগুলো হেলে পড়ে এবং দানা অপুষ্ট থাকে।
রোগের দমন ব্যবস্থাপনা
শক্ত কা- বিশিষ্ট এবং পাতার রোগ প্রতিরোধী হাইব্রিড জাত নির্বাচন; উপর্যুক্ত ছত্রাকনাশক (কার্বক্সিন+থিরাম) দ্বারা শোধনকৃত বীজ ব্যাবহার; গাছের উপর্যুক্ত ঘনত্ব (সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ২৫ সেমি.) বজায় রাখতে হবে; সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ বিশেষ করে নাইট্রোজেন এবং পটাশসার এর ভারসাম্য বজায় রাখা; অম্ল মাটিতে ফসল লাগানোর ১ সপ্তাহ আগে অনুমোদিত মাত্রায় ডলোচুন প্রয়োগ; একই জমিতে বারবার ভুট্টার আবাদ না করে ধান/গম/তরমুজ/বাদাম/শাকসবজি প্রভৃতি দ্বারা শস্য পর্যায় অনুসরণ; আক্রান্ত জমির ফসল সংগ্রহ করার পর গাছের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলা; কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি ২ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে মাটি হতে গাছের গোড়ার এক ফিট উপর পর্যন্ত প্রথমবার গাছের ৮ পাতা অবস্থায় (হাঁটু সমান উচ্চতা) এবং দ্বিতীয়বার সিল্ক বের হওয়ার পর (মোচায় ফুল আসার পর) স্প্রে; প্রপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা টেবুকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন ফলিকুর ২৫০ ইসি অথবা এজোক্সিস্ট্রোবিন+ডাইফেনোকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি ১ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর ২ বার পাতায় স্প্রে করতে হবে।
উপরোক্ত দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ‘ফিউজারিয়াম ষ্টক রট’ ছাড়াও ভুট্টার অন্যান্য ছত্রাকজনিত রোগ যেমন- পাতা ঝলসানো, পাতার মরিচা পড়া, মোচা পঁচা ইত্যাদি দমন হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১২০০২৭৬১, ইমেইল : ৎরসঁনধৎর@ুধযড়ড়.পড়স
দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের স্বাস্থ্য উপকারিতা
ডা. মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
দুধ আমাদের দেহের জন্য সব চাইতে উপাদেয় খাবার। আমাদের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি পরিচালনার জন্য দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেলের প্রয়োজন, তার একটি বিরাট অংশ আমরা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য থেকে পেয়ে থাকি। প্রতিদিন খাবার তালিকায় মাত্র এক গ্লাস দুধ আমাদের দেহের যতটা উপকার করে তা অন্য কোনো খাবার করতে পারে না। এই কারণেই দুধকে বলা হয় সর্বগুণ সম্পন্ন খাবার অর্থাৎ আদর্শ খাদ্য (ওফবধষ ঋড়ড়ফ)। নি¤েœ দুধ ও দুধ থেকে তৈরিকৃত খাদ্যের উপকারিতা আলোচনা করা হয়েছে।
দৈনিক দুধ পানের উপকারিতা
মজবুত হাড় ও দাঁত : দুধ ক্যালসিয়ামের সব চাইতে ভালো উৎস। ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। এ ছাড়াও ক্যালসিয়াম ভিটামিন ডি এর সাহায্যে আমাদের হাড় ও দাঁতে শোষিত হয়ে হাড় ও দাঁতের গঠন দৃঢ় করে এবং দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। নিয়মিত দুধপান করলে দেহে বার্ধক্যও আসে দেরিতে।
মাংসপেশির গঠন উন্নত করে : দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন যা মাংসপেশির গঠনে অনেক বেশি সহায়তা করে। দুধ মাংসপেশির আড়ষ্টতা দূর করতে সক্ষম। যারা নিয়মিত ব্যায়াম এবং খেলাধুলা করেন তাদের জন্য প্রতিদিন ১ থেকে ২ গ্লাস দুধপান অত্যন্ত জরুরি। বাচ্চাদের মাংসপেশির গঠন উন্নত করতেও প্রতিদিন দুধপান করা প্রয়োজন।
ওজন কমাতে সহায়তা করে : প্রতিদিন ১ গ্লাস দুধ পান করলে অন্যান্য খাবারের চাহিদা অনেকাংশে কমে যায় এবং নাশতার সময় দুধ পান করলে অনেকটা সময় দুধ পেটে থাকে। ফলে আজেবাজে খাবারের চাহিদা কমে। এতে করে ওজনও কমে যায়। দুধ পানের ফলে দেহে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান পৌঁছায় যার কারণে যারা ডায়েট করে ওজন কমাতে চান তাদের জন্যও এটি সুপারফুড।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে : প্রতিদিন দুধ পান করলে ত্বকে এর বেশ ভালো প্রভাব পড়ে। ত্বক হয় নরম, কোমল ও মসৃণ। তাই প্রতিদিন খাবার তালিকায় ১ গ্লাস দুধ রাখা প্রয়োজন।
মানসিক চাপ দূর করে : দুধের অন্য একটি বড় গুণ হচ্ছে এটি মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে। দুধ পানে ঘুমের উদ্রেক হয়, যার ফলে মস্তিষ্ক শিথিল হয়ে যায় এবং মানসিক চাপ দূর হয়।
বুক জ্বালাপোড়া বন্ধ করে : অনেক ধরনের খাবার আমরা খাই যার ফলে আমাদের অ্যাসিডিটি হয় এবং বুক প্রচ- জ্বালাপোড়া করে। এর সব চাইতে সহজ এবং সুস্বাদু সমাধান হচ্ছে দুধপান। দুধপানে পাকস্থলী ঠা-া হয় এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা দূর হয়।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে : দুধে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন, মিনারেল রয়েছে যা দেহের ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্ত পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
দই খাওয়ার উপকারিতা
দুগ্ধজাত সব খাবারের মধ্যে দই সবচেয়ে সহজপাচ্য। দুধের সব পুষ্টিগুণ এতে আছে। অনেকে মনে করেন, দই চর্বিহীন খাদ্য। এ ধারণা ভুল। দইয়ে দুধের সমানই চর্বি থাকে। মিষ্টি দইয়ে চিনি মেশানো হয় বলে ক্যালরি দুধের চেয়ে বেশি থাকে। তবে অন্যান্য উপাদান একই থাকে। দুধ পাকস্থলীতে গিয়ে বিপাক হয়ে দইয়ে পরিণত হয় বলে দইকে ডাইজেস্টেড দুধ বলা যেতে পারে। এটা ‘মিট টেন্ডারাইজার’ হিসেবে কাজ করে। মাছ-মাংস বা অধিক গুরুপাক খাবার খেলে শরীরে ‘পিউট্রিফ্যাকটিক’ নামের ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়। যা শরীরে ক্ষতি করতে পারে। এটা প্রতিরোধ করার জন্য দই খুবই উপকারী। টক দই শরীরের মেদ কমায়। প্রতিদিন ১৮ আউন্স (৫১০ গ্রাম) দই খেলে ওজন কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ২ কাপ করে দই খান, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের থেকে বেশি থাকে। দই যেকোনো ব্যাকটেরিয়াল/ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকে রক্ষা করবে। টক দই রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল (খউখ) কমায়। দইয়ে থাকা অ্যান্টিআক্সিডেন্ট শরীর ঠা-া রাখে। রক্ত পরিষ্কারেও সাহায্য করে। রক্তে থাকা টি সেলকে শক্তিশালী করে। দইয়ে থাকা ব্যাকটেরিয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ভিটামিন ¯œায়ুতন্ত্র (নার্ভাস সিস্টেম) ভালো রাখে। দইয়ে আছে আমিষ ও শর্করার সঠিক অনুপাত। তাই ব্যায়াম করার পর দই খাওয়া স্বাস্থ্যকর। বেশির ভাগ মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ লবণ গ্রহণ করে। যা উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদরোগের জন্য দায়ী। প্রতি ৮ আউন্স (২২৬ গ্রাম) দইয়ে আছে ৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করে দিতে সাহায্য করে। টক দইয়ে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ আছে, যা হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া দই খেলে ক্যাভিটিস (ক্ষয়রোগ) হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
খুশকি দূর করতে মাথার স্ক্যাল্পে দই ব্যবহার করা হয়। দইয়ে থাকা ল্যাকটিক এসিড ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান খুশকি কমায়। টক দইয়ের আছে ল্যাকটিক এসিড, যা কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া কমায়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত টক দই খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হার্টের রোগীরাও নিয়মিত টক দই খেয়ে গ্লুকোজ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা
শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ঘি খুবই উপকারী। পুষ্টিবিদদের মতে, আলসার ও কোষ্টকাঠিন্য এবং স্বাস্থ্যকর চোখ ও ত্বকের চিকিৎসায় ওষুধ তৈরিতে ঘি ব্যবহার করা হয়। ঘিতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’ ও ‘কে’। অন্যান্য উপাদানের চেয়ে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ই’-এর চমৎকার উৎস ঘি। জলপাইয়ের তেল ও নারিকেলের তেলের মতো ঘিতেও সে সমস্ত স্বাস্থ্যকর পুষ্টি বিদ্যামান, যা শরীরের চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে এবং ওজন হ্রাস করে। ঘিতে মধ্যম চেইন ফ্যাটি এসিড বিদ্যমান। যা, লিভার সরাসরি শোষণ করতে পারে এবং দ্রুত বার্ন করতে পারে। আমরা যে সকল কার্বযুক্ত খাবার গ্রহণ করি, তার মধ্যে এটি শক্তির একটি স্বাস্থ্যসম্মত উৎস। ঘি লিনোলেনিক এসিডসমৃদ্ধ, এটি এক প্রকার ফ্যাটি এসিড যা ‘প্লাক’কে প্রতিরোধ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং হার্টের বিভিন্ন রোগ দূর করে। ঘিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বিদ্যামান। যা রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলে এবং হার্টের সুরক্ষা প্রদান করে।
ঘিয়ে রয়েছে বিউটারিক অ্যাসিড, একটি সংক্ষিপ্ত চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড যার বেশ কিছু সুবিধা আছে। অনেক সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী সুবিধা হলো এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। আমাদের শরীর ফাইবারকে বিউটারিক অ্যাসিডে রূপান্তর করে। তাই ঘি খাবার ফলে বিউটারিক অ্যাসিড পরিপাক নালীর কাজে সাহায্য করে এবং এটি সুস্থ রাখে। বিউটারিক অ্যাসিড শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি শরীরের ক্ষতিকারক সেল ধ্বংস করতে পারে। প্রদাহ দূর করার এটি একটি প্রাকৃতিক উপায়। নিয়মিত ঘি খাদ্য তালিকায় রাখলে, তা শরীরের প্রদাহ দূর করে। হজমশক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘি ক্ষুধা কমানোর ক্ষেত্রেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ঘি ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ। যা আমাদের চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মস্তিষ্কের সুরক্ষায় ঘি খুবই উপকারী। এটি একাগ্রতা বাড়াতে ও স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে শরীর ও মন ভালো রাখে। ঘি একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার। এ উপাদান অন্যান্য খাবারের ভিটামিন ও মিনারেলের সঙ্গে মিশে রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে দেয়। মাংসপেশির সঙ্গে হাড়ের গঠন মজবুত করে ঘি এবং ঘি দিয়ে তৈরি খাবার। ত্বকের যতেœ ঘি খুব উপকারী। ঘি সুন্দর থাকতে এবং চামড়া টানটান রাখতে সাহায্য করে। ঘি এবং ঘিযুক্ত খাবার গ্রহণে পরিমিত হতে হবে। একবারে বেশি খাওয়া যাবে না। দিনে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম ঘি খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভুগলে ঘিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলাই উত্তম বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। (অশৎধস.গবঃ.ধষ. (২০২০). ঐবধষঃয. ইবহবভরঃং ড়ভ সরষশ ধহফ গরষশ চৎড়ফঁপঃং.)
মাখনের উপকারিতা
মাখনকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় মৃক্ষণ। দইয়ে জল মিশিয়ে মন্থন করলে মাখন বেরিয়ে আসে। গবেষকদের মতে, মাখন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী একটি খাদ্য। মাখনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, যা আমাদের চোখের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। এ ছাড়াও ভিটামিন ডি, ই এবং কে এর অন্যতম উৎস হলো মাখন। মাখনে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন- ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, জিংক, কপার এবং সেলেনিয়াম। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের অন্যতম উৎস মাখন। যা রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলে এবং হার্টের সুরক্ষা প্রদান করে। মাখনে রয়েছে গ্লাইকোস্পিনগোলিপিডস, যা পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা থেকে দেহকে রক্ষা করে। মাখন একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার। এ উপাদান অন্যান্য খাবারের ভিটামিন ও মিনারেলের সঙ্গে মিশে রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে দেয়। মাখনে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-বি হাড় এবং অস্থিসন্ধির রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পনিরের উপকারিতা
পনির একটি দুগ্ধজাত খাবার। এটি চর্বিজাতীয় খাবার হওয়ায় অনেকের ধারণা, এটি ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠান ছাড়া আমাদের দেশে পনিরের ব্যবহার খুব বেশি চোখে পড়ে না। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত খাদ্য তালিকায় পনির রাখা উচিত। কারণ পনিরে রয়েছে ক্যালসিয়াম, সোডিয়ামসহ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ। পনিরে বিদ্যমান উচ্চমানের প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম স্বাস্থ্যসুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পনিরে লিনোলিক এসিড ও স্পিনগোলিপিডস নামে এক ধরনের উপাদান রয়েছে যা মরণব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। পাশাপাশি এর ভিটামিন বি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পনিরের উচ্চমানের ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন বি হাড়কে শক্তিশালী করে। এছাড়াও শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পনির সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ কারণে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত সবার প্রতিদিনের খাবারে কিছুটা হলেও পনির রাখা উচিত। (ণড়ঁহম, ড.চ. বঃ ধষ. (২০১৩). গরষশ ধহফ ফধরৎু চৎড়ফঁপঃং রহ ঐঁসধহ ঘঁঃৎরঃরড়হ : চৎড়ফঁপঃরড়হ, ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ ধহফ ঐবধষঃয, ১৮, ৩৯০-৪০২)
লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল-০১৮১১-৯৮৬৬০৫; ইমেইল-ংসসড়যরনঁষষধয@মসধরষ.পড়স
মিষ্টিভুট্টার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
মোঃ মনিরুজ্জামান
বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশের তালিকায় অষ্টম যদিও আয়তনে ৯২তম। ২০২৩ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে আমাদের দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সতেরো কোটি। এই অত্যধিক জনবহুল দেশে মিষ্টিভুট্টা (সুইট কর্ন) এবং খই-ভুট্টা (পপকর্ন) তাদের পুষ্টির মূল্য, বহুমুখী ব্যবহার, চাষের সহজতার কারণে মূল্যবান খাদ্য উৎস ও কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মিষ্টিভুট্টা (সুইট কর্ন) ও খই-ভুট্টা (পপকর্ন) ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
মিষ্টিভুট্টা
মিষ্টিভুট্টা সুইট কর্ণ নামেও পরিচিত, এটি একটি জনপ্রিয় এবং বহুমুখী ফসল যার বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে। এটি বিশ্বের অনেক অংশে একটি প্রধান খাদ্য এবং বিভিন্ন খাদ্য পণ্য যেমন কর্নমিল, কর্ন অয়েল এবং কর্ন সিরাপ তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, মিষ্টিভুট্টার পুষ্টিগুণ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য এর চাষের আগ্রহ বাড়ছে।
মিষ্টিভুট্টার পুষ্টির মান
মিষ্টিভুট্টা একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফসল যা প্রয়োজনীয় পুষ্টির একটি পরিসীমা প্রদান করে। এটি কার্বোহাইড্রেটের একটি ভালো উৎস, যা শরীরের শক্তির প্রাথমিক উৎস। এটিতে খাদ্যতালিকাগত ফাইবারও রয়েছে, যা হজমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু মিষ্টি ভুট্টা ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬ এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। এই পুষ্টিগুলো সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
মিষ্টিভুট্টার প্রধান পুষ্টিগত সুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হলো এর উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সামগ্রী। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো এমন যৌগ যা শরীরকে ফ্রি র্যাডিক্যালের কারণে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে (ফ্রি র্যাডিক্যাল হলো একধরনের ক্ষতিকারক অণু যা ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিকাশে অবদান রাখতে পারে। মিষ্টিভুট্টায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লুটেইন এবং জেক্সানথিন, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেইসাথে ফেরুলিক অ্যাসিড, যেটির অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-ক্যান্সার বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মিষ্টিভুট্টার ব্যবহার প্রচার করে এবং এটিকে খাদ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলোর জন্য, এটি মূল পুষ্টির ঘাটতিগুলোকে মোকাবিলা করতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতায় অবদান রাখতে সহায়তা করতে পারে।
আমাদের দেশে এরই মধ্যে মিষ্টিভুট্টার একটি জাত ২০০২ সালে বারি মিষ্টিভুট্টা-১ নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। মিষ্টিভুট্টা কাঁচা অবস্থায় খাওয়া হয়। তাই দানা যখন নরম থাকে তখনই মোচা সংগ্রহ করতে হয়। সিল্ক বের হবার ২০-২৫ দিনের মধ্যে অর্থাৎ বপনের মাত্র ১১৫-১২০ দিনে খাওয়ার উপযোগী মোচা সংগ্রহ করা যায়। এর হলুদ দানা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। জাতটির ফলন রবি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ১০-১০.৩ টন (খোসা ছাড়ানো কচি মোচা) এবং প্রায় ২৪ টন/হেক্টর সবুজ গো-খাদ্য পাওয়া যায়।
মিষ্টিভুট্টার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
পুষ্টিগুণ ছাড়াও মিষ্টিভুট্টার উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। কাঁচা মিষ্টিভুট্টা মাত্র ১১৩-১২০ দিনে সংগ্রহ করা যায় এবং বীজ পাকতে ১৪০ দিন লাগে। তুলনামূলকভাবে ছোট এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করাসহ এটির উচ্চফলন সক্ষমতা রয়েছে। উপরন্তু এটি তাজা সবজি হিসাবে খাওয়া ছাড়াও, বিভিন্ন পণ্য যেমন টিনজাত ভুট্টা, হিমায়িত ভুট্টা এবং কর্নমিলে প্রক্রিয়া করা যেতে পারে। এই পণ্যগুলোর একটি দীর্ঘ শেলফ লাইফ রয়েছে এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি করা যায়, যা কৃষক এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি অতিরিক্ত উৎস তৈরি করে।
চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ
যেখানে মিষ্টি ভুট্টা বাংলাদেশে পুষ্টি সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য সুযোগ উপস্থাপন করে, সেখানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে যেগুলোর মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো মিষ্টি ভুট্টার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং জ্ঞানের অভাব। বাংলাদেশের অনেক মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে মিষ্টি ভুট্টার সাথে পরিচিত নয় এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে এটি মিষ্টি ভুট্টার উপকারিতা প্রচার করতে এবং এর ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষা এবং সচেতনতা প্রচারের একটি সুযোগ তৈরি করে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো মিষ্টি ভুট্টা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য উন্নত অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ-মানের বীজ, সেচ ব্যবস্থা এবং ফসল কাটার পর হ্যান্ডলিং সুবিধা উন্নতির সুযোগ।
এই ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে, মিষ্টি ভুট্টার উৎপাদনশীলতা এবং গুণমান উন্নত করা যেতে পারে, যা কৃষক এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের জন্য আরও বেশি অর্থনৈতিক আয়ের দিকে (রপ্তানিমুখী) নিয়ে যায়। এছাড়া পণ্যের চাহিদা বাড়াতে বাজার উন্নয়ন ও প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে খুচরা বিক্রেতা, খাদ্য প্রস্তুতকারক এবং খাদ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের সাথে কাজ করা, তাদের পণ্যের অফারগুলিতে মিষ্টি ভুট্টা অন্তর্ভুক্ত করা। একইসাথে সরকারিভাবে মিষ্টি ভুট্টা চাষের জন্য কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, ফসলের ফলন এবং পুষ্টির মান উন্নত করার জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং মিষ্টি ভুট্টা পণ্যের গুণমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রবিধান বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
খই-ভুট্টার (পপকর্ন) অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাপী পপকর্ন মার্কেটের আকার ২০২২ সালে ১৩,৬৫৩.১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল যা ২০২৮ সালে ২১,৬৬২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খই-ভুট্টার ফলন ভালো হওয়ায় এটির চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে পারলে এশিয়ার বাজারে এটির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি সুন্দর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশের হাটে-বাজারে, শহরের অলিতে-গলিতে ভ্যান গাড়ি নিয়ে রাস্তায় পপকর্ন বিক্রির একটি জোয়ার দেখা যাচ্ছে। এদেশের অসংখ্য মানুষ বাদাম, বুট, ছোলাভাজা ইত্যাদির পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ভ্যানেই পপকর্ন ভেজে প্যাকেটে করে অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়াও গণপরিবহনে হকাররা পপকর্ন ভাজা বিক্রয় করছে। যদিও এই সম্পর্কে বিস্তারিত অর্থনৈতিক সমীক্ষার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক অবমুক্ত জাত এর নাম খই-ভুট্টা। এটি রবি মৌসুমে ১২৫-১৩০ দিনে এবং খরিফ মৌসুমে ৮০-৯০ দিনে পাকে। ফলন প্রতি হেক্টরে রবি মৌসুমে ৩.৫-৪.০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২.৫-৩.৫ টন।
সুযোগ
বর্তমানে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক অধিক ফলনশীল মিষ্টি ভুট্টা এবং খই-ভুট্টার অগ্রবর্তী সারি নির্বাচনের কাজ চলমান। খুব দ্রুতই নতুন বৈশিষ্ট্যের উচ্চফলনশীল মিষ্টিভুট্টা এবং খই-ভুট্টার জাত অবমুক্তির ব্যাপারে অত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আশাবাদী।
মিষ্টিভুট্টা এবং পপকর্নের মধ্যে পুষ্টি উপাদানের তুলনা
এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে পপকর্নের পুষ্টি উপাদানগুলো প্রস্তুতির পদ্ধতি এবং লবণ, মাখন বা স্বাদের মতো যোগ করা উপাদানগুলোর উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে। উপরন্তু মিষ্টি ভুট্টা প্রায়শই প্রাকৃতিক অবস্থায় খাওয়া হয় বা ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যখন পপকর্ন সাধারণত একটি প্রক্রিয়াজাত ¯œ্যাকস ফুড। প্রতি ১০০ গ্রাম পপকর্ন এবং কাঁচা মিষ্টিভুট্টা পুষ্টি উপাদানের তুলনামূলক পার্থক্য- সারণি দ্রষ্টব্য।
পপকর্ন হলো একটি সম্পূর্ণ শস্য, যার মানে এতে বেশি ফাইবার এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। ফাইবার উপাদান কার্বোহাইড্রেটের হজম এবং শোষণকে ধীর করতে সাহায্য করতে পারে, যা খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এয়ার-পপড পপকর্ন, যোগ করা মাখন বা অত্যধিক লবণ ছাড়া, একটি কম ক্যালোরি, কম চর্বিযুক্ত খাবারের বিকল্প হতে পারে। পপকর্ন ডায়েটারি ফাইবারের একটি ভালো উৎস, যা হজমে সাহায্য করতে পারে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য, পপকর্ন সাধারণত আলুর চিপসের তুলনায় একটি বেশি পছন্দনীয় খাবার।
সুইটকর্ন এবং পপকর্ন উভয়েরই বৈচিত্র্যময় ব্যবহার রয়েছে, রন্ধনসম্পর্কীয় অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে শিল্প এবং বিনোদনের ব্যবহার পর্যন্ত, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান এবং বহুমুখী পণ্য তৈরি করে। এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইউটিউবে মিষ্টিভুট্টা এবং খই-ভুট্টা দিয়ে নানা প্রকার পুষ্টিকর, উপাদেয় খাবার তৈরির ভিডিও পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে মিষ্টি ভুট্টার পুষ্টিগুণ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য এর চাষের আগ্রহ বাড়ছে একই সাথে খই-ভুট্টার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে; কিন্তু চাহিদার তুলনায় উচ্চফলনশীল জাতের বীজের ঘাটতি আছে।
সরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নতি এবং নীতি সহায়তাসহ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারলে বাংলাদেশে মিষ্টিভুট্টা এবং খই-ভুট্টা উৎপাদনের পূর্ণ সম্ভাবনাকে পূর্ণ মাত্রায় ছড়াতে সাহায্য করতে পারে এবং উন্নত পুষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, মিষ্টিকর্ন এবং পপকর্নের চাষ এবং ব্যবহার অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ভুট্টা প্রজনন), বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৬৬০১৮৫১৩১, ০১৭১৭০৩১২৫২, ইমেইলঃ সড়হরৎুুঁধসধহ@নসিৎর.মড়া.নফ
বাংলাদেশে অর্কিড চাষাবাদের সফলতা
তাহসীন তাবাসসুম
প্রতিনিয়ত দেশে অর্কিড জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে বাড়ছে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও। এটির চাষ বাড়িয়ে যেমন কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। তেমনি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে অনেকেই অর্কিড চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধি, ঔষধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অর্কিডের জনপ্রিয়তা এখন বাড়ছে।
চাষাবাদের উপর ভিত্তি করে অর্কিড প্রধানত দুই প্রকার।
পার্থিব বা ঞবৎৎবংঃৎরধষ : যা অন্যান্য ফুলের মতো মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে যেমন- ফায়াস, সিমবিডিয়াম, লেডি স্লিপার ইতাাদি।
আর এক প্রকার হচ্ছে পরাশ্রয়ী বা ঊঢ়রঢ়যুঃরপ : যা অন্য কোন গাছের শাখা বা কা-ের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে ও বাতাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে যেমন- ডেনড্রোবিয়াম, ভ্যান্ডা, এরিডিস ইতাাদি।
পার্থিব অর্কিডের ক্ষেত্রে টব, গামলা বা ঝুলন্ত বাস্কেটে চাষ করা যায়। ভেতরের তলদেশে কয়লা, খোয়া অথবা ঝামার টুকরা স্থাপন করতে হয় এবং এর উপরে নারিকেলের ছোবড়ার টুকরা ছড়িয়ে দিয়ে প্রয়োজন মতো পানি সেচ দিতে হয়।
পরাশ্রয়ী অর্কিড বিশেষ ধরনের কাঠের বা মাটির টব অথবা বাঁশের ঝুড়িতে চাষ করা যায়। মরা কাঠের ওপর জন্মানোর ক্ষেত্রে আম, জারুল বা কড়ই গাছে রশি দিয়ে সঙ্গে নারিকেলের ছোবড়াসহ বেঁধে দেয়া যেতে পারে।
অর্কিড ছায়াযুক্ত সুনিষ্কাশিত কিন্তু স্যাঁতসেঁতে জমিতে চাষ করা যায়। প্রখর সূর্যের আলোতে এ ফুল ভালো হয় না। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য জমিতে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয়, যেন ৪০-৬০% সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। গাছের ফুল কাটার পর প্রতিটি গাছ থেকে পার্শ্বীয়ভাবে সাকার বের হয়। এই সাকারগুলো গাছে লাগানো অবস্থায় যখন শেকড় বের হয়, তখনই গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মূল জমিতে লাগানো যেতে পারে। বিভাজন প্রক্রিয়ায় গাছ থেকে সাকার সংগ্রহ করে অথবা টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারা তৈরি করে জমিতে লাগাতে হয়। সাকারগুলো লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হয়, যাতে এগুলো মাটিতে লেগে যায়। পরবর্তীতে আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে সেচ দিতে হবে। অর্কিডের চারদিকে বাতাস সব সময় আর্দ্র রাখতে হয়।
অর্কিড গাছে সার দেবার ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ টন গোবর/কম্পোস্ট, ৩ টন কোকোব্লক, ১৭৫ কেজি টিএসপি এবং ১৫০ কেজি এমওপি সার মাটিতে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ২১০ কেজি ইউরিয়াকে সমান তিন ভাগ করে গাছ রোপণের ৩০-৪৫ দিন পর প্রথম ভাগ এবং ৬০-৭৫ দিন পরে দ্বিতীয় ভাগ এবং শেষ ভাগ স্পাইক আসার পূর্বে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া অর্কিড গাছের নিয়মিত ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সমৃদ্ধ ২০: ২০:২০ অনুপাতে মিশ্র সার প্রয়োগ বেশ উপযোগী। ১ গ্রাম সার ১ লি. পানির সাথে মিশিয়ে খুব সকালে গাছের পাতা, ডগা ও শিকড়ে স্প্রে করতে হয়।
সারা বছর জাতভেদে অর্কিডের ফুল ফোটে তবে দেশীয় অর্কিড মার্চ-মে মাসে সর্বাধিক পাওয়া যায়। কিছু কিছু ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড বছরে ২-৩ বার ফোটে। প্রতি হেক্টরে প্রথম বছর ৮ হাজার স্টিক, দ্বিতীয় বছর ১৫ হাজার স্টিক এবং তৃতীয় বছর ২৫ হাজার স্টিক পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রতি বছর গাছ থেকে চারা রেখে ২-৫টি সাকার সংগ্রহ করা যায়। ফুলের স্থায়িত্বকাল বাড়ানোর জন্য ২-৩% সুক্রোজ কার্যকরী। বৃষ্টির সময় অথবা ভেজা অবস্থায় ফুল চয়ন করা উচিত নয়। ফুল সংগ্রহের পর পরই এর ডাটার গোড়া পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ফুল বেশি দিন সতেজ থাকে।
ফুলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এটি এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য পণ্য যার মূল্য হাজার হাজার কোটি ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল উৎপাদিত হয়। বিশ্বে অর্কিডের ৩০ হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। সবুজে ভরপুর আমাদের এ উষ্ণম-লীয় দেশে প্রায় ৮০টির অধিক অর্কিড প্রজাতি রয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে কয়েক হাজার কোটি ডলারের অর্কিড বাণিজ্য হয়। এর বেশির ভাগই করে থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ড প্রতি বছর ৫০টি দেশে ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের অর্কিড রপ্তানি করে। এছাড়াও হল্যান্ড ভারত, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুরও অর্কিড ফুল রপ্তানিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অনসিডিয়াম, মোকারা, ভ্যান্ডা, ক্যাটেলিয়া, এরিডিস নামে বিভিন্ন অর্কিড প্রজাতির চাষ হচ্ছে। এ দেশের আবহাওয়াও অর্কিড চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী (িি.িধরং.মড়া.নফ)। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী অর্কিডের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। উদহারণস্বরূপ : ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুলমা। এই গ্রামটিতে দীপ্ত অর্কিড লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান রীতিমতো বিশাল এলাকাজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন করছে। এমনকি এই বাগানে অর্কিডের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য একটি গবেষণাগারও আছে। সেখানে প্রতি বছর এক লাখ চারা উৎপাদন করা হয়। ফুল ও চারা বিক্রি করে প্রতি বিঘায় মুনাফা হয় গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি। এই প্রতিষ্ঠানটি দুলমা গ্রামে ১২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন করছে। প্রতি বছর ৪০-৫০ লাখ টাকার অর্কিডের চারা ও ফুল বিক্রি করেন তারা। এ বাগানের অর্কিডের ক্রেতা মূলত রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজারেও নিয়মিত ফুল ও চারার চালান যায়। (যুগান্তর নিউজ- ৪ এপ্রিল,২০১৯)।
প্রতি সপ্তাহে দুবার রাজধানীতে অর্কিডের চালান আসে। প্রতি চালানে গড়ে ৫ হাজার অর্কিড ফুল এবং ৫০টির মতো চারাগাছ কেনেন পাইকারেরা। প্রতিটি ফুলের দাম বাগান পর্যায়ে ২০ টাকা এবং গাছের দাম জাতভেদে ৩০০-৫০০ টাকা। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪০-৫০ হাজার টাকার অর্কিড চারাগাছ ও ফুল রাজধানী ঢাকাতেই আসে।
দীপ্ত অর্কিড লিমিটেডের গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ শরীফ উদ্দিন আহমেদ জানান, দিন দিন অর্কিডের চাহিদা বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করতে পারলে এ ব্যবসা বেশ লাভজনক। তিনি আরো বলেন, প্রথম বছরে একটি চারায় দুটি করে ফুল ফোটে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম বছরে ফোটে চারটি করে ফুল। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ফুল ফোটানো সম্ভব হবে। প্রতিটি ফুলের মূল্য ২০ টাকা ধরলে পাঁচ বছরে মোট আয় হবে ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর পাঁচ বছরে নিট মুনাফা হবে ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া বছরে মুনাফা পাওয়া যাবে ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ঠিক একইভাবে পাহাড়েও অর্কিড চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে অর্কিড চাষ করা গেলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এছাড়া বিদেশে অর্কিড রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব হবে।
লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭২০২৫২৭৬৫, ই-মেইল : ংঁনযধঃযধংযরহ@মসধরষ.পড়স
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
জনাব মো: জামাল হোসেন, উপজেলা : বাকেরগঞ্জ, জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : ড্রাগন গাছে কখন কিভাবে ট্রেনিং প্রুনিং করা হয়?
উত্তর : ড্রাগন ফল দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মোটা শাখা ডগা তৈরি করে। এক বছরের একটি গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে এবং ৪ বছর বয়সী একটি ড্রাগন ফলের গাছ ১৩০টি পর্যন্ত প্রশাখা তৈরি করতে পারে। তবে শাখা-প্রশাখা উৎপাদন উপযুক্ত ট্রেনিং ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বাংলাদেশের ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ফল সংগ্রহের পর ৪০-৫০টি প্রধান শাখায় প্রত্যেকটিতে ১/২টি সেকেন্ডারি শাখা অনুমোদন করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রের টারসিয়ারি ও কোয়াটারনারী প্রশাখা কে অনুমোদন করা হয় না। ট্রেনিং ও প্রুনিং করার পর অবশ্যই যে কোন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে।
জনাব আব্দুল করিম, উপজেলা : চিরিরবন্দর, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : কাকরোল গাছের পাতায় হলুদ থেকে বাদামি রঙের দাগ দেখা যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। করণীয় কি?
উত্তর : এটি কাকরোলের ডাউনি মিলডিউ রোগ নামে পরিচিত এবং এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। বয়স্ক পাতায় এই রোগ প্রথম দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার গায়ে সাদা বা হলদে থেকে বাদামি রঙের তালির মতো দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে এই দাগ অন্যান্য পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে আক্রান্ত হলে গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং পানি নিষ্কাষণের ভাল ব্যবস্থা রাখতে হবে। (ম্যানকোজেব ((৪%)+ মেটালেক্সিল (৮%)) গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : মেটারিল বা রিডোমিল গোল্ড এমজেড ৬৮ ডব্লিউপি অথবা (ম্যানকোজেব (৫০%) ফেনামিডন (১০%)) গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : সিকিউর ২ গ্রাম/লিটার হারে অথবা সালফার গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : কুমুলাস ২ কেজি/ হেক্টর হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না। আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আগাম বীজ বপন, সুষম সার ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন : বারি উদ্ভাবিত/ অন্যান্য উন্নত জাত চাষ করে অনেকাংশে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
জনাব আমজাদ মিয়া, উপজেলা : কোটচাঁদপুর, জেলা : ঝিনাইদহ
প্রশ্ন : লিচুর ফলের বোটার কাছে পোকা ছিদ্র করে ভেতরে ঢোকে এবং সম্পূর্ণ বীজ নষ্ট করে ফেলছে। এ অবস্থায় করণীয় কি?
উত্তর : এটি লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা। এই পোকা ফলের বোটার কাছে ছিদ্র করে এবং বীজকে আক্রমণ করে। পরে ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় এবং বাজারমূল্য কমে যায়। লিচু বাগান নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুঁতে ফেলতে হবে। লিচু গাছতলায় শুকনো খড়ে আগুন দিয়ে তাতে ধুপ দিয়ে ধোঁয়া দিতে হবে। এতে এ পোকার মথ বা কীড়া বিতাড়িত হবে। এর ফলে পোকা লিচুর ভেতরে ডিম পারবে না। বোম্বাই জাতে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয় তাই আক্রমণ প্রবণ এলাকায় চায়না ৩ জাত রোপণ করতে হবে। এছাড়া নিমতেল ২ মিলি/লিটার পানিতে গুলে স্প্রে করে দেয়া যেতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেথ্রিন ১ মিলি বা সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জনাব মো: ফারুক শিকদার, উপজেলা : কালিয়াকৈর, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : পটোল গাছের গোড়া ও পটোলে পানি ভেজা নরম পচা রোগ দেখা দিয়েছে। কী করণীয়?
উত্তর : পটোল গাছের গোড়া ও ফল পচা রোগের কারণে কা- ও পটোলের গায়ে সাদা সাদা মাইসেলিয়াম দেখা যায় এবং গাছের গোড়া, শিকড় ও পটোলে পানি ভেজা নরম পচা রোগ দেখা যায় পরবর্তীতে পটোল গাছসহ পটোল নষ্ট হয়ে যায়। গাছ বাদামি বর্ণ ধারণ করে ডগা ও ফল পচে যায়। চযুঃড়ঢ়যঃযড়ৎধ ঢ়ধৎধংরঃরপধ নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছ ও পটোল গুলো সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে। প্রতি বছর পটোল চাষ না করে শস্যপর্যায় অনুসরণ করতে হবে। রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কম্প্যানিয়ন, ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম ও ২ গ্রাম ম্যানকোজেব+ মেটালেক্সিল একত্রে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
জনাব মো: মাসুদ, উপজেলা : পোরশা, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : করলার পাতার উপরে ছোট ছোট হলুদ এবং পতার নিচে গোলাপী ছত্রাক দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : করলার ডাউনি মিলডিউ রোগের কারণে পাতার উপরে ছোট ছোট হলুদ এবং পাতার নিচে গোলাপী ছত্রাক দেখা দেয়। চংবঁফড়ঢ়বৎবহড়ংঢ়ড়ৎধ পঁনবহংরং নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত গাছের বয়স্ক পাতা মারা যায়। আক্রান্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। গাছের রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১-২ গ্রাম সিকিউর বা ম্যানকোজেব ২ গ্রাম বা ম্যানকোজেব+ মেটালেক্সিল ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জনাব মো: রিপন, উপজেলা : পাকুন্দিয়া, জেলা : কিশোরগঞ্জ
প্রশ্ন : মুগ গাছের পাতা কীড়া দলবদ্ধভাবে সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে ঝাঝরা করে দিচ্ছে। এর প্রতিকার কী?
উত্তর : বিছাপোকার আক্রমণে এই সমস্যা হয়ে থাকে। এর প্রতিকার হিসেবে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের রিপকর্ড ১ মিলি. বা ডায়াজিনন গ্রুপের রাজধান ১০জি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া কীড়াগুলো সংগ্রহ করে কেরোসিন মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে নষ্ট করতে হবে।
জনাব মো: আজিজুল মালিথা, উপজেলা : ঈশ্বরদী, জেলা : পাবনা
প্রশ্ন : আমের খোসায় কালো দাগ দেখা যাচ্ছে, ভেতরে কালো দাগ এবং ছোট ছোট কীড়া দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : সাধারণ আমের মাছি পোকার জন্য এ সমস্যা হয়ে থাকে। মাছি পোকা ফল পরিপক্ব হওয়ার সময় অভিপজিটর ঢুকিয়ে তাতে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হওয়ার পর থেকেই মাংসল অংশ খেতে থাকে। এবং ফলের ভেতরের অংশ পচে যায়। এ সমস্যা সমাধানে ফল ব্যাগিং করতে হবে। আক্রান্ত ফল বাগান থেকে অপসারণ করতে হবে। ১০০ গ্রাম পাকা আমের রস+৫ গ্রাম ভিটামিন+১০০ মিলি পানি মিশিয়ে বিষটোপ বানিয়ে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। ফেরোমন ফাঁদ (যেমন : ব্যাকট্রো ডি ৮০টি লিউর/হেক্টর হারে) ব্যবহার করা যেতে পারে। ফেনিট্রোথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক যেমন : সুমিথিয়ন ২.৪ মিলি/লি. হারে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। তাছাড়াও বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ফল সংগ্রহের পর মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগাক্রান্ত ডালপালা, অতিঘন ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। পরিষ্কার করার পর একটি ছত্রাকনাশক ও একটি কীটনাশক দ্বারা পুরো গাছ ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। বাগান নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে এবং কোনো সমস্যা দেখামাত্রই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
জনাব মো: সানোয়ার, উপজেলা : বড়াইগ্রাম, জেলা : নাটোর
প্রশ্ন : কুমড়া জাতীয় ফসলের হাত পরাগায়ন কীভাবে করব?
উত্তর : বেশির ভাগ কুমড়াজাতীয় ফসলে স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল আলাদা হয়। ফলে পরাগায়নের জন্য কীটপতঙ্গের প্রয়োজন হয়। কীটপতঙ্গের মাধ্যমে পরাগায়ন ঠিকমতো না হলে ফুল শুকিয়ে পচে যায় বা ঝরে গিয়ে প্রায় ৯৫% ফলন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন হাত পরাগায়নের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ন করিয়ে দিতে হয়। সাধারণত সকাল ৮-১০টার মধ্যে, যতক্ষণ রোদের তাপ কম থাকে তখন হাত পরাগায়ন করতে হয়। লাউয়ের ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর আবছা আলো থাকা পর্যন্ত পরাগায়ন ভালো হয়। পুরুষ ফুলের পাপড়িগুলো আস্তে আস্তে টেনে ছিঁড়ে ফেলে পরাগদ-টি উন্মুক্ত করতে হবে। স্ত্রী ফুলের পাপড়িগুলো আলতো করে নিচের দিকে চেপে রাখতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এরপর পুরুষ ফুলটি স্ত্রী ফুলের গর্ভদ-ের মাথায় নিয়ে সংম্পর্শ ছাড়াই টোকা দিতে হবে। এতে পরাগদ- থেকে পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে পড়বে এবং পরাগায়ন সম্পন্ন হবে। সাধারণ ১টি পুরুষ ফুল দিয়ে ১০-১২টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন সম্ভব হয়।
সতর্কতা : মাটিতে প্রয়োজনীয় রসের যোগান অবশ্যই থাকতে হবে। পুরুষ ফুলের পরাগদ- দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমু- কখনোই ঘষে দেয়া ঠিক নয়। সংস্পর্শ না করে টোকা দিয়ে পরাগরেণু গর্ভমু-ে ফেলতে হবে। অবশ্যই সকালের মধ্যে পরগায়ন সম্পন্ন করতে হবে। রোদ বাড়তে থাকলে পরাগরেণু শুকিয়ে যেতে থাকে। হাত পরাগায়নের মাধ্যমে ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
জনাব মঞ্জুরুল ইসলাম, উপজেলা : পলাশবাড়ি, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : পেয়ারা গাছের পাতায় সাদা তুলোর মতো যার কারণে পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। করণীয় কী?
উত্তর : আক্রমণের মাত্রা কম থাকা অবস্থায় আক্রান্ত স্থান পাতলা কাপড় কেরোসিন বা পেট্রোল দিয়ে মুছে দিলে এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। আক্রান্ত পাতা, ডগা, ফুল ও ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ডায়াজিনন ৬০ ইসি ২ মিলি/লি: হারে পানির সাথে মিশিয়ে ১০ থেকে ১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে অতি সহজেই এ পোকা দমন করা যায়।
লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল : ধশষরসধফধব@মসধরষ.পড়স