Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর-গ্রামীণ-উন্নয়ন-ভাবনা

বঙ্গবন্ধুর গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা
ড. জাহাঙ্গীর আলম
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিল স্বনির্ভর। কোনো অভাব ছিল না; বৈষম্য ছিল না। যার যতটুকু প্রয়োজন জমি চাষ করত। ফসল ফলাত। পশু-পাখি পালন করত, মাছ ধরত। মানুষের চাহিদাও ছিল কম। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসনামল পর্যন্ত গ্রামীণ জীবন ছিল সচ্ছল। জীবিকার প্রধান উৎস ছিল কৃষি। তার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল কুটির শিল্প, তাঁত ও ক্ষুদ্র পাটশিল্প। গ্রামসমাজ ও পঞ্চায়েতের ভিত্তিতে সংগঠিত ছিল গ্রামীণ জীবন। ইংরেজ আমলে কৃষক বাঁধা পড়ে গেল জমিদারদের জোয়ালে। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ল পুরনো গ্রামীণ সমাজ, গ্রামসভা ও পঞ্চায়েত। ভেঙে গেল স্বনির্ভরতা ও আত্মশক্তি। প্রতিকূল উৎপাদন সম্পর্ক, বৈরী আবহাওয়া, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং উৎপাদিত পণ্যের অবনমিত মূল্য অভাবও দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয় কৃষকের। তারা হয়ে পড়ে ঋণগ্রস্ত।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক মহাত্মা গান্ধী কৃষকের এ দৈন্যদশাকে ব্যাখ্যা করেন ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের ফল হিসেবে। তিনি বিদেশি পণ্যের ব্যবহার বর্জনের আহ্বান জানান। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেন। নিজের চরকায় সুতা কেটে কাপড় বোনাকে তিনি স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন। গান্ধীর স্বরাজ ও স্বদেশ আন্দোলনের মূলেই ছিল গ্রামোন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা। তাতেই নিহিত ছিল ভারতবাসীর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও শোষণমুক্তি। এর বিপরীতে ইংরেজ শাসকদল পল্লী পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মূল প্রবক্তা ছিলেন এফএল ব্রায়ন। তিনি গান্ধীজির সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির দুর্দশার ব্যাপারে একমত ছিলেন; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কারণে যে এই দুর্দশা তা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, গ্রামীণ মানুষের অশিক্ষা, কুসংস্কার, তামাক খাওয়া, অস্বাস্থ্য, মামলায় জড়ানো, ব্যয়বহুল বিয়ে এবং মরণোত্তর আনুষ্ঠানিকতার কারণে আর্থিক অনটন ও দারিদ্র্য দৃশ্যমান। এর নিরসনকল্পে তিনি গ্রামীণ জীবন সংস্কার এবং অফিসিয়াল কর্মসূচি অনুকরণের আহ্বান জানান। ইতোমধ্যে ভারতবর্ষের এক অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে জনচিত্তকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন। তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে তিনি উন্নতর          কৃষি উৎপাদন, কুটির শিল্প ও কৃষি শিল্প স্থাপন, পশু-পাখি পালন, কৃষিপণ্য ও শিল্পজাতসামগ্রীর বিপণন ইত্যাদির ওপর জোর দেন। 
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশের খাদ্য সংকট ছিল প্রকট। দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। রাস্তা-ঘাট ছিল ভাঙা। অনেক কল-কারখানা বন্ধ ছিল। যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রয়োজনীয় সংযোগ ছিল না। লক্ষ লক্ষ যুবক ছিল কর্মহীন। দেশে ছিল অর্থাভাব। শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ ছিল অপ্রতুল। বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। দেশের জনগণকে এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ উন্নয়নের পথ বেছে নেন। সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন কৃষি উন্নয়নের ওপর। তিনি সামাজিক বৈষম্য দূর করে সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন দেশের অর্থনীতিকে।
একদিকে তিনি মহাত্মা গান্ধীর স্বনির্ভর গ্রামোন্নয়নের ভাবনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, অপরদিকে তিনি কবিগুরুর আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ও সমবায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত দেশের সংবিধানে ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চল বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের অমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এর আগের অনুচ্ছেদে সমবায় ব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। ...আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানিদের। আমাদের যা কিছু করতে হবে, সবকিছু বিদেশ থেকে আনতে হবে। কোথায় পাবেন বিদেশি মুদ্রা? দু’হাতে কাজ করতে হবে; ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতিকে প্রশ্ন করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ স্বনির্ভর কর্মসূচি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। মরিলাইজ দি পিপল। পাম্প যদি পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায়, তবে স্বনির্ভর হন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিল? দরকার হয় কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত, আট হাত কাটলেই পানি ওঠে। সেখানে অসুবিধা কী আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করার জন্য চিন্তার কী আছে?’... (১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)। 
বঙ্গবন্ধু স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যে কর্মীদের উপদেশ দিয়েছেন, নিজে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জনগণকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
দেশের জনগণের সঙ্গে একান্ত হয়ে খাল খনন, রাস্তা নির্মাণ- এমন অনেক কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। গান্ধীজি যেমন চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে স্বদেশি হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুও বাঁশকে বিদেশি খাম্বার বদলে বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে স্বদেশ প্রেমের নজির তুলে ধরেছেন। (শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম, আতিউর রহমান, ২০১৮)।
বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সবার আগে কৃষি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ ও অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছেন। শীতকালীন শস্য উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পানি সেচের জন্য গভীর নলকূপ ও পাওয়ার পাম্প স্থাপন ও সেচের নালা নির্মাণের জন্য কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমার একবার সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস। আমার বাবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ দুই নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মীর প্রথম সাক্ষাৎ। বাবা আমাকেও নিয়ে যান সঙ্গে করে। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ¯েœহ ও ভালোবাসায় আমাদের আপ্লুত করলেন। বললেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেচের ব্যবস্থা করো। উচ্চফলনশীল জাতের শস্য লাগাও। রাস্তাঘাট ঠিক করো। গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াও। এখন গ্রামই হবে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এরপর থেকে এ দুই নেতাকে দেখছি তিতাসের তীরঘেঁষে অনেক সেচের নালা কাটায় জনগণকে সহায়তা করতে। গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভ করে গভীর নলকূপ বসাতে। আধুনিক জাতের ধান চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে। শুধু আমার থানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি থানায় এভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন কৃষককে। বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনা ছাড়া এভাবে কাজ করা সম্ভব হতো না।
দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কৃষককে যান্ত্রিক চাষে উদ্বুদ্ধকরণ, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সুষম বণ্টন এবং দেশের বেকার যুবসমাজকে কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিতকরণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমবায় ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। সমবায়কে তিনি বেছে নেন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ হিসেবে। তার লক্ষ্য ছিল গ্রামভিত্তিক বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। তবে তিনি জমির মালিকানা কেড়ে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং জমির মালিকানা কৃষকেরই থাকবে বলে তিনি জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে তিনি কৃষকের ছোট ছোট খ-ে বিভক্ত জমি একসঙ্গে করে যৌথ কৃষি খামার গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, যাতে আধুনিক চাষাবাদ সম্ভব হয়। যান্ত্রিকীকরণ সহজ হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে- এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এ কো-অপারেটিভ; এ জমির মালিকের জমি থাকবে; কিন্তু তার যে অংশ বেকার, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্টরিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে, আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। (মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু, ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রচিন্তা, উন্নয়ন দর্শন। নূহ-উল আলম লেনিন, পৃষ্ঠা ১০৭)।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব। অন্য কোনো দেশ থেকে ধার করা নয়। তিনি গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলেছিলেন। একে আখ্যায়িত করা হয় ‘মুজিববাদ’ হিসেবে। এখানে তিনি একজন অনন্য জাতীয়তাবাদী নেতা। গান্ধীজির মতো স্বদেশি। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে নবগঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলছি, সে অর্থনীতি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কোনো জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোনো ইজম চলে না। এদেশে কেন, কোনো দেশেই চলে না। আমার মাটির সঙ্গে আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ, আমাদের দেশে অনেক সুবিধা আছে। কারণ আমার মাটি কী, আমার পানি কত, আমার এখানে মানুষের কালচার কী, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কী তা না জানলে হয় না। ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চাই। বাট দি সিস্টেম ইজ আওয়ার্স। উই ডু নট লাইক টু ইমপোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড’।  
দেশের গ্রামীণ উন্নয়নকে সফল করার জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমতাভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে চালু করেছিলেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লা উদ্ভাবিত দ্বিস্তরবিশিষ্ট নতুন সমবায় ব্যবস্থা যা পরে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে গ্রামীণ উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার জন্য ২.২ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলেন বগুড়া একাডেমি। পরে ১৯৯০ সালে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। পরে এ কার্যক্রম দেশের সব উপজেলাকে আওতাভুক্ত করে রাজস্ব বাজেটের অধীনে পরিচালিত করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু দেশে পল্লী উন্নয়নের ভিত রচনা করেন।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়ী উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। সমবায়ী মালিকানাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মালিকানাখাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে উৎপাদনখাত, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনব্যবস্থাসমূহের মালিক  বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। 
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত গ্রামভিত্তিক বহুমুখী কৃষি সমবায়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য প্রয়োজন ছোট ছোট খ-ে বিভক্ত জমির একত্রীকরণ। যাতে যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্ভব হয়। উপকরণ সংগ্রহ ও আর্থিক সংস্থান সহজতর হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কর্মহীন যুবকদের কর্মসংস্থান করা যায়। সর্বোপরি গ্রামীণ আয় বৈষম্য নিরসন সম্ভব হয়। এ সম্পর্কে সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে কিছু মাঠ গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে কুমিল্লার বামইল প্রকল্প, ময়মনসিংহের শিমলা যৌথ খামার প্রকল্প, চট্টগ্রামের রাঙুনিয়ায় গুমাইবিল প্রকল্প এবং রাজশাহীর গুরুদাসপুর প্রকল্প অন্যতম। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ওই প্রকল্পগুলো অস্তিত্ব হারায়। এদের সমস্যা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা, যৌথ  কৃষি খামারের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক দিক বিশ্লেষণ করা এবং দেশে সমবায় কৃষি খামারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সত্তরে দশকের গোড়ার দিকে বেশ কিছু সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে কুমিল্লা একাডেমিতে, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহস্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ১৯৭৩ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের রাঙুনিয়ায় অনুষ্ঠিত সেমিনারসমূহ উল্লেখযোগ্য। ওই সকল সেমিনারের আলোচনা ও সুপারিশসমূহ ভবিষ্যতে যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার নীতিমালা প্রণয়নে কাজে আসতে পারে। 
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো বঙ্গবন্ধুর যৌথ কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় আজও প্রাসঙ্গিক। শিমলা প্রকল্পের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থেকে এবং এ নিয়ে গবেষণা করে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যৌথ  কৃষি খামার ব্যবস্থাকে খুবই কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে মনে হয়েছে আমার। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সমলয় চাষাবাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমানে শ্রমিক সংকট নিরসন ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য এটি একটি উত্তম পন্থা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রয়োজন। 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০, ই-মেইল : ধষধসল৫২@মসধরষ.পড়স