আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে বায়োটেক ও জিএম শস্যের প্রবর্তন ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি।
তিনি আজ (মঙ্গলবার) বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত "বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইসের গবেষণা অগ্রগতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ” শীর্ষক কর্মশালার পলিসি সেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, প্রতিবছর দুই মিলিয়ন নতুন মূখ আমাদের জনসংখ্যার সাথে যোগ হচ্ছে। তাদের খাবার ব্যবস্থাও আমাদের করতে হবে। আমরা যদি হলুদ ভূট্টা খেতে পারি, ভূট্টার জিন নিয়ে তৈরি হলুদ গোল্ডেন রাইস খেতে অসুবিধা কোথায়। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা দুটোই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফজলে ওয়াহেদ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু রাতকানা ও অপুষ্টিজনিত খর্বতা এখনো দেশের জনসংখ্যার একটি অংশের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা এই সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের পুষ্টিগুন বাড়ানোর বিকল্প নেই। তিনি কর্মশালার প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও সুপারিশ দেশে গোল্ডেন রাইস অবমুক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়ার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের বিেেশষ অতিথি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. ম্যাথু মোরেল বলেন, ইরি বাংলাদেশ সম্পর্ক দীর্ঘ ৪৮ বছরের বেশি সময়ের। ব্রি আমাদের অন্যতম গ্লোভাল পার্টনার। এই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে আমরা অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও ব্রিকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখবে ইরি। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ইরি-ব্রি পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমঝোতার আগামী বছরগুলোতে আরো বৃদ্ধি পাবে।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীর বলেন, আমরা বিশ্বের প্রথম জিংক ধানসহ ৫টি জিংক সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করেছি। গোল্ডেন রাইস এর জাত উন্নয়নও আমাদের অন্যতম গবেষণা মাইলফলক। দেশে দুধের ও ডিমের উৎপাদন ১০গুন বাড়লেও অধিকাংশ আমাদের গরীব মানুষষের তা কিনে খাওয়ার সামর্থ নেই। তাই আমরা ভাতের মধ্যে প্রয়োজনীয় মূখ্য ও গৌন খাদ্য উপাদান সংযোজনের লক্ষ্যে গবেষণা অব্যাহত রেখেছি। আশা করি আমরা অবশ্যই সফল হবো।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মো: কবীর ইকরামুল হক বলেন, আমি জেনে খুশি যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কতিপয় পুষ্টি এবং কৃষি গবেষণা সংস্থার সহযোগীতায় ব্রি ভিটামিন-এ ঘাটতি জনিত অপুষ্টি লাঘবে সম্ভাবনাময় নতুন কৌশল হিসেবে গোল্ডেন রাইসের উন্নয়ন এবং মূল্যায়নে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কাজ করে চলেছে। ব্রি’র বিজ্ঞানীরা ফলন, রোগ-বালাই প্রতিরোধশীলতা অক্ষুন্ন রেখে গোল্ডেন রাইস সংস্করণ উদ্ভাবনে নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদন্ড অনুযায়ী সকল বিধিমালা মেনে গোল্ডেন রাইসের পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
"বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইসের গবেষণা অগ্রগতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ” শীর্ষক মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্পের রেগুলেটরি ও স্টুয়ার্ডশীপ লীডার ড. ডোনাল্ড জে. ম্যাকেনজি। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইরি বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. হামনাথ ভান্ডারী।
উল্লেখ্য গোল্ডেন রাইস হলো বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ এক নতুন জাতের ধান যার চাল সোনালি বর্ণের। বিটা ক্যারোটিন মানুষের শরীরে প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশসহ ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে ভিটামিন-এ এর মোট চাহিদার ৩০-৫০ শতাংশ গোল্ডেন রাইস থেকে পূরণ করা সম্ভব । ভূট্টা থেকে সংশ্লিষ্ট জিন (Zmpsy1) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ধানে সন্নিবেশ করে গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবন করা হয়েছে।
গোল্ডেন রাইসের ভাত খাওয়ার মাধ্যমে বিটা-ক্যারোটিন মানবদেহে প্রবেশ করে, যা দেহে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। বিভিন্ন পরিক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে যে (গোল্ডেন রাইস) এর অ্যালার্জিসিটি ও টক্সিসিটির প্রভাব নাই। এখানে উল্লেখ্য যে, এ যাবত গবেষণায় কোন এলার্জি সংশ্লিষ্ট কোন প্রোটিনের সাথে গোল্ডেন রাইসের ডিএনএ এর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই গোল্ডেন রাইস গ্রহণে পার্শ্বপতিক্রিয়া জনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি হবে না। এছাড়াও বিটা-ক্যারোটিন একটি স্বাদহীন যৌগ বিধায় এর প্রভাবে ভাতের স্বাদেরও কোনরকম পরিবর্তন হবে না আশা করা যায়। অন্যদিকে যেহেতু গোল্ডেন রাইস জিন একমাত্র সশ্যকোষে (Endosperm) প্রকাশিত হয় তাই একমাত্র পরপরাগাযন ছাড়া অন্য কোন উপায়ে এ জিন কোন ফসলে বা অন্য ধানের জাতে ছড়ানোর সুযোগ নাই। ধান একটি স্বপরাগী ফসল হওয়ায় এতে পরপরাগায়নের সম্ভাবনা খুবই নগন্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিগত বোরো ২০১৫-১৬ মৌসুমে প্রোভিটামিন-এ সমৃদ্ধ GR2E BRRI dhan29 (গোল্ডেন রাইস) এর নিয়ন্ত্রিত-মাঠ পরীক্ষা (Confined Field Trial) গাজীপুরে সম্পাদন করে। এ পরীক্ষা চলাকালীন গোল্ডেন রাইসের ফলনশীলতার পাশাপাশি পরিবেশের বিভিন্ন অনুসঙ্গের উপর এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
পরবর্তীতে ব্রি’র চারটি আঞ্চলিক কার্যালয় (বরিশাল, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ এবং রাজশাহী) এবং ব্রি গাজীপুরে নিয়ন্ত্রিত-মাঠ পরীক্ষার সম্পাদন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষনে কোন প্রকার অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য এবং রোগ ও পোকা-মাকড় এর উপদ্রব পরিলক্ষিত হয়নি। পরীক্ষণ চলাকালে কোন প্রকার অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য (যেমন- অতিরিক্ত ঝরে পড়া, দীর্ঘায়িত সুপ্তাবস্থা, খর্বাকৃতি গাছ ইত্যাদি) এবং অপরিচিত রোগ ও পোকা-মাকড় এর উপদ্রব পরিলক্ষিত হয়নি। যদিও কৌলিক সারিসমূহ বোরো মৌসুমের উপযোগী, তবুও সার্বিক বিবেচনায় গ্রিন হাউজ ও স্ক্রিন হাউজে সংরক্ষিত পরীক্ষায় উক্ত ফসলের কৃষিতাত্ত্বিক মান সন্তোসজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অঙ্গজ বৈশিষ্ট্য, সম্ভাব্য ফলন, ইত্যাদি বিবেচনায় বাছাই করা সমগোত্রিয় লাইনগুলো থেকে প্রতিটি গাছের বীজ আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রোভিটামিন-এ সমৃদ্ধ GR2E BRRI dhan29 (গোল্ডেন রাইস) এর পরিবেশগত ও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরুপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ন্যাশনাল কমিটি অন্ বায়োসেফ্টি (এনসিবি) এর নিকট ব্রি কতৃক আবেদন করা হয়েছে।