প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল ধানের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আহ্বান
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও রোগবালাইসহ প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল ধানের জাত ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি কম পানিতে বেশি ধান উৎপাদন এবং উত্তরাঞ্চল কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে ধান চাষাবাদকে দক্ষিণাঞ্চল কেন্দ্রিক করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরও বলেন, আগে আমি বলতাম লবণের বাটিতে ধান উৎপাদনের কথা এখন আমি বলছি মরুভূমিতে ধান উৎপাদনের কথা। অর্থাৎ সবচেয়ে কম পানিতে বেশি ফলন দেয় এমন ধানের জাত আমরা চাই।
শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) গাজীপুরে ব্রির বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা ২০১৬-১৭ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। ব্রি’র প্রধান কার্যালয়ে শুরু হওয়া এ কর্মশালা শেষ হবে আগামী বৃহস্পতিবার।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বলেন, আগে শুধু বোরো জাত উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব দেয়া হতো। বর্তমানে আউশ ও আমনের উপর জোর দিচ্ছি। বোরো কিন্তু ইনকিউবেটর বেবি। বোরো উৎপাদনে পানির খরচও বেশি। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রয়োজন কি, তা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কিন্তু খুব স্বাদে উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে বলছি না। এতো পানি খরচ করে কতোদিন বোরো করবো তা চিন্তা করতে হবে।
মাননীয় মন্ত্রী উল্লেখ বলেন, গত মৌসুমে শুধু যে বন্যার পানি ক্ষতি করেছে তা নয়, ব্লাস্ট রোগেও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। যেখানে ৫০ মন করে ধান হতো সেখানে তা ৪০ মনে নেমে এসেছে। সব জায়গায় এ ক্ষতি হয়নি, তবে কিছু জায়গায় হয়েছে। এতে মোট উৎপাদন কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। তাই ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধানের জাত উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্ এর সভাপতিত্বে বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালায় গবেষণা অগ্রগতি ২০১৬-১৭ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রি’র পরিচালক (গবেষণা) ড. তমাল লতা আদিত্য। এ সময় আলোচক হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. কবির ইকরামুল হক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসীন । অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর।
ডিএই, ব্রি, বারি, বিএআরসি, ইরিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তী পাঁচদিন ধরে চলবে কর্মশালার বিভিন্ন কারিগরী অধিবেশন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছর ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজের অর্জন ও অগ্রগতির বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালার কারিগরী অধিবেশনগুলোতে গত এক বছরে ব্রির ১৯টি গবেষণা বিভাগ ও নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা ফলাফল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলে ধরা হবে।
কর্মশালায় জানানো হয়, গত বছর ব্রি মোট ১০টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে । এর মধ্যে আছে জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল আমন ধানের জাত ব্রি ধান৭৯, জেসমিন সদৃশ সুগন্ধি আমন ধানের জাত ব্রি ধান৮০, অনুকূল পরিবেশের উপযোগী স্থানীয় জনপ্রিয় জিরাশাইল জাতের অনুরূপ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮১, নেরিকা ১০ এর বিশুদ্ধ সারি থেকে উদ্ভাবিত রোপা আউশ ধানের স্বল্প মেয়াদি জাত ব্রি ধান৮২, স্থানীয় জনপ্রিয় কটকতারা জাতের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বোনা আউশ জাত ব্রি ধান৮৩, যা চারা অবস্থায় মধ্যম মাত্রায় খরা সহনশীল। এছাড়া আছে উচ্চমাত্রার জিংক (২৭.৬ পিপিএম) সমৃদ্ধ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৪, বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের উপযোগী রোপা আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৮৫,অ্যানথার কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৬। অধিকন্তু গত বছর ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে দু’টি হাইব্রিড ধানের জাত-ব্রি হাইব্রিড ধান৫ ও ব্রি হাইব্রিডধান৬।এছাড়াও ব্রি ৪০টি উফশী ধানের জাতসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল বোরো জাত ব্রি ধান৬১ ও ব্রি ধান৬৭, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২ ও ব্রি ধান৭৪, ঐতিহ্যবাহী বালাম চালের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং সরু বালাম নামে পরিচিত জাত ব্রি ধান৬৩, সরাসরি বপনযোগ্য আগাম আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৬৫, খরা সহনশীল ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ বোরো জাত ব্রি ধান৬৬, বোরো মৌসুমের আদর্শ উফশী জাত ব্রি ধান৬৮ এবং কম খরচে আবাদযোগ্য উফশী জাত ব্রি ধান৬৯ ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে, দেশে কৃষক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিতে সক্ষম ব্রি ধান২৯ এর সমপর্যায়ের গুণাগুণ সম্পন্ন ব্রি ধান৫৮ এবং আমন মৌসুমের জনপ্রিয় বিআর১১ এর সমতুল্য ব্রি ধান৪৯। তবে এটি ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগাম। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্রি বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত নয়টি লবণ-সহিষ্ণু, দু’টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, তিনটি খরা সহিষ্ণু, একটি খরা পরিহারকারী, দু’টি শীত সহনশীল এবং চারটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী আরো ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ধানের গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্য তারা ভিটামিন এ এবং আয়রন সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত সরু ও সুগন্ধযুক্ত বোরো মৌসুমের জাত ব্রি ধান৫০ বা বাংলামতি রফতানি সম্ভাবনাময়। বর্তমানে দেশের ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এর থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৯১ ভাগ।
ব্রি এ পর্যন্ত ছয়টি হাইব্রিডসহ মোট ৯১টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে বেশ ক’টি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এবং উন্নত পুষ্টি গুণ সম্পন্ন। আশা করা যাচ্ছে, এগুলো কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হবে এবং সামগ্রিকভাবে ধান উৎপাদন বাড়বে।