ধানের টুংরো রোগ দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি
মোঃ মামুনুর রশিদ
ধানের মূখ্য রোগসমূহের মধ্যে যেসব রোগ বেশি মাত্রায় ক্ষতি করে তার মধ্যে টুংরো রোগ অন্যতম। কুমিল্লা অঞ্চলে ধানের টুংরো রোগ প্রধানত আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে দেখা যায়। বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লা অঞ্চল টুংরোপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। সবুজ পাতাফড়িং নামক এক ধরনের পোকা এ রোগটির বাহক। কুশি অবস্থা থেকে থোড় আসা পর্যায় পর্যন্ত যে কোন সময় এ রোগটি দেখা দিতে পারে। এ রোগের আক্রমণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বীজতলায় ধানের চারা গাছ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে, লাগানোর পর লক্ষণ প্রকাশ পেলে এবং রোগের মাত্রা বেশি হলে ক্ষেত্র বিশেষে ধানের ফলন ১০০% পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, কুমিল্লা হতে ধানের টুংরো রোগ দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করা হয়। কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট, দেবিদ্বার ও লাকসাম উপজেলার বিভিন্ন ব্লকে কৃষকের ধানের বীজতলায় ও জমিতে আউশ, আমন ও বোরো ২০১৯-২০, ২০২০-২১ মৌসুমে টুংরো রোগ দমনের পরীক্ষা স্থাপন করে তা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। উক্ত পরীক্ষা হতে দেখা যায় যে, টুংরো রোগের মূল কারণগুলো হলো বীজতলায় প্রচুর পরিমাণে সবুজ পাতা ফড়িং-এর উপস্থিতি, বীজতলা হতে টুংরো রোগের উপস্থিতি, বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কম বৃষ্টিপাত, টুংরো সংবেদনশীল ধানের জাত চাষাবাদ, বছরের তিন মৌসুমেই ধান চাষ ইত্যাদি।
রোগের কারণ ও লক্ষণ : এ রোগ জরপব ঞঁহমৎড় ঠরৎঁং (জঞঠ) নামক জীবাণু দ্বারা হয় যা সবুজ পাতাফড়িং নামক এক ধরনের পোকার মাধ্যমে ছড়ায়। তাই সবুজ পাতাফড়িংকে এ রোগের বাহক বলা হয়।
ধান গাছ প্রাথমিক পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে হলদে অথবা কমলা হলুদ রঙের হবে এবং সুস্থ্য গাছের তুলনায় গাছ খাট হয়ে যাবে। ধান গাছের নতুন শিকড় গজায় না ও শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে যার ফলে গাছ টান দিলে সহজে মাটি থেকে উঠে আসে। টুংরো আক্রান্ত গাছের পাতায় লম্বালম্বিভাবে হালকা সবুজ ও হালকা হলদে রেখা দেখা দেয়। পরে ধীরে ধীরে পুরো পাতাটাই হলদে থেকে কমলা হলদে রং ধারণ করে। আক্রান্ত কচি পাতা হালকা হলুদ রঙের হয় এবং মুচড়ে যায়। আক্রান্ত গাছ বেঁচে থাকলেও তাতে কিছুটা বিলম্বে ফুল আসে এবং এসব গাছে ধানের ছড়া আংশিক বের হয়, দানাগুলো কালো ও অপুষ্ট হয়। উক্ত গবেষণায় বীজতলায় ধানের চারা গাছ ভাইরাস দারা আক্রান্ত হলে মূল জমিতে লাগানোর পর প্রায় পুরো জমিতে লক্ষণ প্রকাশ পায় যদি প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি গাছে লক্ষণ দেখা যায় তবে ধরে নিতে হবে সবুজ পাতাফড়িং পোকা ধান লাগানোর পর আক্রমণ করেছে। কোনো ব্যবস্থাপনা না নিলে আক্রান্ত গাছের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইউরিয়া সার অর্থাৎ নাইট্রোজেন-এর অভাবে পুরো জমির ধান গাছের বয়স্ক পাতা এবং সালফারের অভাবে কচি পাতা সমভাবে হলুদ হয়ে যাবে কিন্তু টুংরোর ক্ষেত্রে বয়স্ক এবং কচি উভয় পাতাই হলুদ হয়ে যাবে।
রোগের অনুকূল অবস্থা
সাধারণত আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই ধান চাষ করলে এবং রোগপ্রবণ জাত লাগালে টুংরো রোগের প্রকোপ খুব বেশি দেখা যায়। আশেপাশে রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান, মুড়ি ধান (রেটুন) বা ঘাসজাতীয় আগাছায় টুংরো রোগের ভাইরাস বেঁচে থাকে। সবুজ পাতাফড়িং রোগাক্রান্ত গাছ খেয়ে ভাইরাস সংগ্রহ করে সুস্থ গাছে ছড়ায়। সাধারণত আক্রমণের ১৪-২১ দিন পরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত ধানক্ষেতে সবুজ পাতাফড়িং সংখ্যায় বেশি থাকলে রোগটি এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যেসব এলাকায় তিন মৌসুমে ধান চাষ করা হয় সেসব এলাকায় টুংরো রোগের প্রকোপ বেশি হতে পারে।
টুংরো রোগ দমনে ব্রি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি (কুমিল্লায় মাঠপর্যায়ের গবেষণা হতে প্রাপ্ত)
তিন মৌসুমের গবেষণা হতে একটি প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয় যা নিম্নরূপ
১) টুংরো প্রবণ এলাকায় বীজতলা হতে বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন (হাত জাল/আলোক ফাঁদ/কীটনাশক) করতে পারলে ধানের জমিকে টুংরো রোগ হতে রক্ষা করা যায়।
২) বীজতলা হতে সবুজ পাতাফড়িং দমনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল বীজতলায় শোষক পোকার জন্য সারণি-১ এ উল্লেখিত অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ২ বার স্প্রে করা।
৩) মৌসুমভেদে কীটনাশক স্প্রে করার সময় : আউশ মৌসুমে বীজ বপনের ১০ দিন পর একবার ও ধান লাগানোর ৩-৫ দিন পূর্বে আরেকবার; আমন মৌসুমে বীজ বপনের ১০-১৫ দিন পর একবার ও ধান লাগানোর ৫ দিন পূর্বে আরেকবার; বোরো মৌসুমে বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার ও ধান লাগানোর ৫ দিন পূর্বে আরেকবার। অথবা, ৫ দিন অন্তর অন্তর বীজতলায় আলোক ফাঁদ এবং হাত জাল দিয়ে সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো কীটনাশক এক শতক জমিতে স্প্রে করতে ২ লিটার পানি লাগবে।
১) প্রাথমিক অবস্থায় টুংরো আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তা উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা।
২) ধান গাছের সর্বোচ্চ কুশি পর্যায়ে পুরো জমিতে টুংরো আক্রান্ত হলে থিওভিট ১০০ গ্রাম, এমওপি (পটাস) ১০০ গ্রাম ১৬ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৮ শতক জমিতে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩) ধান লাগানোর পর টুংরো রোগের প্রাথমিক পর সারণি-১ এ উল্লেখিত যেকোনো কীটনাশক অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে যার ফলে রোগের বাহক পোকা মারা যাবে ও রোগের বিস্তার রোধ হবে।
দমন ব্যবস্থাপনার লাভক্ষতির বিশ্লেষণ
বীজতলায় কীটনাশক যেমন এমআইপিসি অথবা কার্টাপ ২ বার স্প্রে করলে প্রতি শতক বীজতলায় খরচ হবে ২২ টাকা অর্থাৎ ২ শতকে খরচ হবে ৪৪ টাকা। দুই শতক বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় ১ বিঘা জমির ধান লাগানো যায়। টুংরো রোগের ফলে ১০০% পর্যন্ত ফলন নষ্ট হয়। যার ফলে কৃষকের বিঘা প্রতি (যদি বিঘায় গড়ে ১৭ মণ হারে ও সর্বনিম্ন ১০৮০ টাকা মণ হলে) প্রায় ১৮৩৬০ টাকা ক্ষতি হয় যা বীজতলায় মাত্র ২২-৪৪ টাকা (কীটনাশকভেদে) খরচ করে রক্ষা করা যায়।
বি. দ্র : কীটনাশক ব্যবহারের সময় হাতে রাবার অথবা প্লাস্টিকের গ্লাভস এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন, যাতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি শরীরের সংস্পর্শে না আশে এবং শ্বাস-প্রশ^াসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে। ক্ষত হাতে ঔষধ মেশানো যাবে না প্রয়োজনে কাঠি দিয়ে ঔষধ মিশিয়ে নিন।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, কুমিল্লা। মোবাইল : ০১৭১২-৮৮৭৫০৭, ই-মেইল : mamunbrri@gmail.com
৮৩তম বর্ষ ড় ৪র্থ সংখ্যা ড় শ্রাবণ-১৪৩০ (জুলাই-আগস্ট ২০২৩)
সম্পাদকীয়
শ্রাবন বৈচিত্র্যময় মাস। মেঘ, বৃষ্টি, রৌদ্রছায়ায় পুরো আকাশে বহুমাত্রিক রূপ উদ্ভাসিত হয়। শ্রাবণের শেষ দিন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সে দিন মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবন। জাতি হারায় তার গর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৫ আগস্ট ২০২৩। জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতার ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদদের বিন¤্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা এ দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি প্রধানত কৃষিকেন্দ্রিক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন জ্ঞাননির্ভর আধুনিক কৃষিই উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রথম সোপান। তাই তিনি স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নিয়েছিলেন। চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী কার্যক্রম পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানি, কৃষিবিদ, সুশীল সমাজ ও কৃষক সমাজ নিবিড় পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ফলে স্বাধীনতার প্রায় ৫২ বছর পর কৃষি সমৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি হচ্ছে। জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। খোরপোশের কৃষি থেকে রূপান্তর হচ্ছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নে বর্তমানে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষি উন্নয়নের এ ধারা বহুলভাবে প্রশংসিত ও নন্দিত হচ্ছে। এ সম্পর্কে কৃষিকথায় এবারের সংখ্যায় ‘বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতা ও আজকের কৃষি গবেষণার সাফল্য’ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি, পুষ্টিবার্তা, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা।
আশা করি, কৃষিকথা বর্তমান প্রয়াসকে আরও গতিশীল করে ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে। সেসাথে ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার উন্নত, সুখী, সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
৮৩তম বর্ষ ড় ৪র্থ সংখ্যা ড় শ্রাবণ-১৪৩০ (জুলাই-আগস্ট ২০২৩)
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও আজকের কৃষি গবেষণার সাফল্য ০৩
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ড. সুস্মিতা দাস
লবণাক্ত অঞ্চলে আমন ধান উৎপাদন কৌশল ০৫
ড. সত্যেন ম-ল
খরিফ-২ মৌসুমে সয়াবিন চাষ ও বীজ হিসেবে ব্যবহার ০৭
ড. মো. আব্দুল মালেক
প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রঞ্জিতকরণ ০৯
ড. ফেরদৌস আরা দিলরুবা
সার ব্যবহার আধুনিকায়ন ১১
ড. মো. সদরুল আমিন
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে গ্লাডিওলাসের করমেল উৎপাদন প্রযুক্তি ১৩
ড. মো. খালিদ জামিল
আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ ১৫
ড. মো. শরফ উদ্দিন
খাদ্যে ঘনচিনির ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি ১৭
ড. মারুফ আহমেদ, সৌরভ প্রামানিক শুভ
ধানের টুংরো রোগ দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ১৮
মোঃ মামুনুর রশিদ
নিরাপদ উপায়ে পানের বালাই দমন ২০
নাহিদ বিন রফিক
আগামীর কৃষি ভাবনা
মাশরুম একটি অসীম সম্ভাবনাময় ফসল ২২
ড. আক্তার জাহান কাকন
স্মার্ট কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার ২৪
সমীরণ বিশ^াস
আলফা আলফা ঘাস চাষ পদ্ধতি ২৬
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
বর্ষাকালে মাছ চাষে করণীয় ২৭
মোঃ লতিফুর রহমান সুজান
সফল কৃষকের গল্প
বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাত ২৮
কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন
নিয়মিত বিভাগ
প্রশ্নোত্তর ৩০
কৃষিবিদ আয়েশা সুলতানা
ভাদ্র মাসের কৃষি (১৬ আগস্ট- ১৫ সেপ্টেম্বর) ৩২
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও আজকের কৃষি গবেষণার সাফল্য
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলার জন্য আজন্ম লড়াই করে গেছেন। স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়ন ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা। মহান স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন ‘কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে তা না হলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।’ তাঁর সেই ভবিষ্যৎ বাণীর বহিঃপ্রকাশ আজকের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সহজ ছিল না। কেননা পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতি বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যদিও ষাটের দশকে এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে এবং কৃষির উন্নয়ন ঘটে কিন্তু ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে যায় ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কৃষি ব্যবস্থা আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়ে কেননা নগণ্য সংখ্যক কৃষক জমি চাষ করার সুযোগ পায়। ফলে বিপুল পরিমাণ খাদ্য ঘাটতির বোঝা নিয়েই স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরু।
কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি এবং কৃষকের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে গ্রহণ করেন। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরির্বতন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তিচর্চার মতো আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কৃষি ক্ষেত্রে নানামুখী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল নামক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত কৃষি গবেষণা কাউন্সিল পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বর্তমানে নার্স এর শীর্ষ সংস্থা হিসেবে ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কৃষি গবেষণায় ও উন্নয়নে বিএআরসি বিভিন্ন নীতিমালা বা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। দেশের ১২টি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের গবেষণা কর্মসূচি পরিবীক্ষণপূর্বক অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। বিএআরসি কৃষি গবেষণায় মানবসম্পদ উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখছে। উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদীয়মান বিজ্ঞানীদের উচ্চশিক্ষা যেমন পিএইচডি, মাস্টার্স ও বিশেষ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ আয়োজন করে চলেছে। এতে দেশের কৃষি গবেষণার দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত এবং জাতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন এবং সমন্বয় সাধন করছে বিএআরসি। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর নিয়মিত বিএআরসি থেকে দেয়া হচ্ছে। কৃষি গবেষণালব্ধ ফলাফল বা প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কর্মকা- বিএআরসিতে চলমান রয়েছে এবং কীটনাশক, সার, বীজ ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মান নির্ধারণসহ নীতি প্রণয়ন সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিএআরসি’র নেতৃত্বে সারবিষয়ক কারিগরি উপকমিটি দেশে নতুন নতুন সার এবং সারজাতীয় দ্রব্যের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ও মাঠ গবেষণার মাধ্যমে কারিগরি মূল্যায়ন করে থাকে, যা কৃষি মন্ত্রণালয়ে জাতীয় সার প্রমিতকরণ কমিটিতে অনুমোদিত হয় এবং দেশে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়। বিগত মার্চ ২০২৩ খ্রি. বিএআরসি কর্তৃক জৈবসার ৯৭টি; রাসায়নিক সার ৭৭টি; পিজিআর ৫৯টি এবং ৮টি অণুজীবসহ মোট ২৪১টি সার ও সারজাতীয় দ্রব্য মূল্যায়নপূর্বক জাতীয় সার প্রমিতকরণ কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত ও দেশে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে সারবিষয়ক কারিগরি উপকমিটিতে মূল্যায়নপূর্বক ৩টি জৈবসার, ১টি রাসায়নিক সার এবং ৪টি পিজিআর অনুমোদনের সুপারিশ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। “সার (ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০০৬” হালনাগাদকরণের নিমিত্তে তা পর্যালোচনা ও সংশোধনপূর্বক “সার (ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন দেশ, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে বিএআরসি’র সমঝোতা স্মারক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে গবেষণা, দক্ষতা, উন্নয়ন ও কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ে স্বাক্ষরকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ উপকৃত হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) চত্বরে কানাডার সাস্কাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের Global Institute for Food Security (GIFS) এর আঞ্চলিক অফিস চালু হয়েছে। এ অফিস স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং কানাডার কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে গবেষণা সহযোগিতা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেন্টারটি দেশের কৃষি গবেষকদের জলবায়ু পরিবর্তনসহ কৃষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা প্রদান করবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি এর মধ্যে কৃষিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতাসহ বঙ্গবন্ধু রিসার্চ চেয়ার, ঢাকায় জিআইএফএস এর আঞ্চলিক অফিস স্থাপন এবং বঙ্গবন্ধু-পিয়ারে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ বঙ্গবন্ধু-পিয়ারে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এর তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসলের (খাদ্যশস্য) ভবিষ্যৎ চাহিদা ও জোগান নিরূপণ : অভিক্ষেপ (projection) কাল ২০৩০ ও ২০৫০ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসলসমূহের ভবিষ্যৎ চাহিদা ও জোগান নিরূপণপূর্বক এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হবে।
এছাড়াও বর্তমান সরকার কৃষিতে বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কার করে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে সহায়তা করছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘ক্রপ জোনিং’ এর গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রমবর্ধমান খাদ্য উৎপাদন চাহিদার বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্রপ জোনিংভিত্তিক ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে, ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৩০০টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং সম্পন্ন হয়েছে, অবশিষ্ট ১৯৫টি উপজেলার ক্রপ জোনিং কার্যক্রম চলমান (উপজেলা তালিকা সংযুক্ত)। ক্রপ জোনিং কার্যক্রমের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের হালনাগাদকৃত তথ্য-উপাত্ত এবং মৃত্তিকা ও ভূমিরূপ মানচিত্র বিএআরসিকে সরবরাহ করছে এবং ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IWM) জিআইএসভিত্তিক ক্রপ জোনিং ইনফরমেশন সিস্টেম সফটওয়্যার, ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ, ক্রপ জোনিং ড্যাশবোর্ড এবং কৃষি পরামর্শক বাতায়ন নির্মাণ কার্যক্রমের সংগে জড়িত রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ফোকাল পয়েন্ট সংস্থা হিসেবে ক্রপ জোনিং কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
GAP Standard নির্ধারণ, বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট stakeholder দের প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা এবং খাদ্যে ভেজালসহ মাঠ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে কৃষি পণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধকল্পে বিএআরসি কর্তৃক বাংলাদেশ উত্তম কৃষি পদ্ধতিGAP নীতিমালা-২০২০ চূড়ান্তকরণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
এছাড়াও মুজিবর্ষ উপলক্ষ্যে ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষিত জাত ও প্রযুক্তির বর্ণনা সম্বলিত ১০০ কৃষি প্রযুক্তি অ্যাটলাস, বাংলাদেশের কৃষিখাতের পরিবর্তন ও অগ্রগতি নিয়ে 100 years of Agriculture Development in Bangladesh. বাংলাদেশের বিশেষ ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলগুলোয় কৃষির উন্নয়ন নিয়েA Development for Fragile Ecosystems in Bangladesh’ এবং একটি খাদ্য সঙ্কটের দেশ হতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে বাংলাদেশের পরিক্রমা নিয়ে ‘A Development Trajectory of Bangladesh Agriculture from Food Deficit to Surplus’ বই প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, দানাদার খাদ্যোৎপাদনে মূল কৃষির পাশাপাশি এর উপখাত হিসেবে প্রোটিনের উৎস মাছ, ডিম, মাংস ইত্যাদিতেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করছে। এক সময় আন্তর্জাতিক নিন্দুকরা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে যে অপপ্রচার চালাতেন জননেত্রী শেখ হাসিনার তিন মেয়াদের সরকার সেটা ঘুচিয়ে বিশ্বের দরবারে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, উপকরণসমূহ ব্যবহারে দক্ষতা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি, কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও বিতরণসহ ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমিতে ক্রমবর্ধমান বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বাংলাদেশের কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দরকার আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এর সোনার বাংলাকে একটি স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
লেখক : নির্বাহী চেয়ারম্যান১, প্রধান ডকুমেন্টস কর্মকর্তা২, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮; ই- মেইল :susmitabarc@gmail.com
লবণাক্ত অঞ্চলে আমন ধান উৎপাদন কৌশল
ড. সত্যেন ম-ল
বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি, বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক বিন্যাসেও আমূল পরিবর্তন এসেছে, ফলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও কৃষকদের সেচ দিয়ে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লক্ষ হেক্টর উপকূলীয় অঞ্চল এর মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। তার মধ্যে ৬.৫ লক্ষ হেক্টর বৃহত্তর খুলনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুর জেলায় লবণাক্ততা রয়েছে। সাধারণত (শূন্য) ০-২ ডিএস/মিটার মাত্রার মাটিকে লবণাক্তশূন্য মাটি বলা হয়। এছাড়া ২-৪, ৪-৮, ৮-১৫ ও ১৫ ডিএস/মিটার এর অধিক মাত্রাকে যথাক্রমে স্বল্প, মধ্যম, লবণাক্ত ও অতিমাত্রার লবণাক্ত মাটি বলা হয়। যাইহোক বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে আমন ধান উৎপাদন প্রযুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করি।
বীজধান শোধন প্রক্রিয়া
বীজধান বপনের পূর্বে শোধন করে নিলে অনেক বীজবাহিত রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয়। বীজ যদি দাগযুক্ত হয় এবং বাঁকানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকে তাহলে কার্বেনডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা যেতে পারে। তিন গ্রাম ছত্রাকনাশক এক লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে এক কেজি পরিমাণ বীজ পানিতে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর বীজ পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এভাবে শোধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা চটের বস্তায় ভরে খড়/বস্তা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখুন। এভাবে জাগ দিয়ে আমন মওসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা বা দুই দিনে, ভাল বীজের অঙ্কুর বের হলে বীজতলায় বপন করা যেতে পারে।
আমন মৌসুমে লবণাক্ত এলাকায় বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন
উঁচু এবং উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে। পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫ আষাঢ়- ১৫ শ্রাবণ (যাদের জীবনকাল ১৩৫ দিন বা তার বেশি)। চারা রোপণের উপযুক্ত সময় ১৫ শ্রাবণ থেকে-১৫ ভাদ্র (৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা, যাদের জীবনকাল ১৩৫ দিন বা তার বেশি)। আবার যেসব জাতের জীবনকাল ১২০-১৩৫ দিন, সেইসব জাতগুলো ২৫ আষাঢ়ের পর বীজ বপন করে ২৫-৩০ দিনের চারা রোপণ করা যায়। তবে যেসব জাতের জীবনকাল ১২০ দিনের কম সেই জাতগুলো ১০ শ্রাবণের পর বীজ বপন করে, ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করতে হবে। অন্যদিকে নাবি রোপা আমন ধানের জাত ৪৫-৬০ দিনের বয়সের চারা ভাদ্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রোপণ করা যায়। লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতগুলো (যেমনঃ ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮) ও আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলো (যেমনঃ বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৫৪) এর ৩০-৩৫ দিনের চারা ১৫ ভাদ্র (৩০ আগস্ট) পর্যন্ত রোপণ করা যায়। তবে অধিক আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলো, ক্ষেত্র বিশেষে ১ আশ্বিন (১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত রোপণ করা যেতে পারে।
আমন বীজতলায় রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন বীজতলায় বাঁকানি রোগ দেখা দিতে পারে। বাঁকানি রোগাক্রান্ত ধানের চারা স্বাভাবিক চারা অপেক্ষা হালকা সবুজ, লিকলিকে, ও স্বাভাবিক চারার চেয়ে অনেকটা লম্বা হয়ে অন্য চারার ওপরে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত চারাগুলো ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আক্রান্ত চারার নিচের গিট থেকে অস্থানিক শিকড়ও দেখা যেতে পারে। বাঁকানি রোগ দমনের জন্য ১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটোস্টিন বা নোইন মিশিয়ে তাতে ১ কেজি ধানের বীজ অথবা চারা ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করা যায়। অন্য উপায়গুলো হলো-আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা। বীজতলা হিসেবে একই জমি বারবার ব্যবহার না করা।
সম্পূরক সেচ
আমন ধান পুরোপুরি বৃষ্টিনির্ভর হলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়াতে আমন চাষাবাদ আজকাল আর পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর থাকছে না। আমনের বৃষ্টিপাত সময়মতো না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টিনির্ভর ধানের জমিতে যে কোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে লবণাক্ত অঞ্চলে অবশ্যই স¦াধু পানি দিয়ে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূরক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া আবাদি জমির এক কোণায় গর্ত বা ছোট পুকুর (যা মূল জমির শতকরা ৫ ভাগ) করে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পরবর্তীতে রবি মৌসুমে মাদাজাতীয় সবজি যেমন-তরমুজ, কুমড়া ইত্যাদি চাষে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা
মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। তবে লবণাক্ত এলাকায় রোপণকৃত জমিতে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৩-৯-১৩-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত টিএসপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতে, ১ম কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল জিংক স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈবসার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
ধানক্ষেত রোপণের পর ৩০-৪০দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে। রোপা আমনে ধান রোপণের ১৫ দিন পর একবার এবং প্রয়োজনে ৩০-৩৫ দিন পর আবার নিড়ানি দিতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকলে ভাল। আমন মৌসুমে আগাছানাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। তবে প্রয়োজনে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪০ দিন পর হাত নিড়ানি দিতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সাদা পিঠ গাছফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদাপোকা, পামরি পোকা ইত্যাদি। পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধানক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটলসহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে রোপা আমন মওসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে। ধানক্ষেতে ডালপালা পুঁতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরাপোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতাফড়িং ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়। উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পোকার আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলে মাজরাপোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য সানটাপ ৫০ পাউডার প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি প্রতি বিঘায় ১০ গ্রাম হারে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাদামি গাছফড়িং ও সাদা পিঠ গাছফড়িং দমনের জন্য মিপসিন ৭৫ পাউডার প্রতি বিঘায় ১৭৫ গ্রাম, পাইমেট্রোজিন ৪০ ডব্লিউজি ৬৭ গ্রাম, ডার্সবান ২০ ইসি ১৩৪ মিলি হারে ব্যবহার করতে হবে। পাতা মোড়ানো পোক্,া চুংগি পোকা ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল ৮৫ পাউডার অথবা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মেীসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, ব্লাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাঁকানি, এবং লক্ষ্মীরগু সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রোগগুলো হলো খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, ব্লাস্ট, টুংরো, বাঁকানি এবং লক্ষীরগু রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দুই কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ফলিকুর, নেটিভো এবং ¯েপার ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এ মওসুমে সকল সুগন্ধি ধানে নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে থোড়ের শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক যেমন ট্রপার অথবা ন্যাটিভো ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
উপরে উলে¬খিত বিভিন্ন কলাকৌশল সঠিকভাবে মেনে ধানের আবাদ করলে কিছুদিন পর ধানের শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, মোবাঃ ০১৭১২৪০৫১৪৯, ই-মেইল; satyen@bsmrau.edu.bd
খরিফ-২ মৌসুমে সয়াবিন চাষ ও বীজ হিসেবে ব্যবহার
ড. মো. আব্দুল মালেক
পুষ্টিতে সমৃদ্ধ সয়াবিন বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠির আমিষ ও ক্যালরির ঘাটতি পূরণ এবং অপুষ্টি দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের খাবার হিসেবে চীনে সয়াবিন নানাবিধ পদ্ধতিতে রান্না করে খাওয়া হয়। সয়ামিল চীন ও ভারতের বেশ জনপ্রিয় বিশেষ করে ভারতে নিরামিষভোজীরা সয়ামিল খেয়ে থাকেন। সয়া দুধ উন্নয়নশীল দেশে দুধের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও উৎপাদিত সয়াবিনের বেশিরভাগই ব্যবহার হয় মাছ এবং মুরগীর খাবার ফিডমিলে এবং কিছুটা তেলও করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ফসলটির আবাদ দিন দিন বাড়ছে এবং রবি মৌসুম অর্থাৎ শীতের পাশাপাশি খরিফ-২ মৌসুম বা বর্ষাকালেও সয়াবিন চাষ হচ্ছে।
নিবিড় চাষাবাদের ফলে বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই প্রচলিত শস্য বিন্যাসে বাতাস হতে নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী শিমজাতীয় ফসল সয়াবিন অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা সময়ের দাবীও বলা যায়, যা খুবই জরুরি। অপরপক্ষে সয়াবিন চাষ পরবর্তী ফসলে রাসায়নিক সারও কম লাগে। তাই বোরো ধানের আবাদ সীমিত করে সয়াবিন-রোপা আউশ-রোপা আমন শস্যবিন্যাসের প্রচলন করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, যাতে ধানের উৎপাদন ঠিক রেখেও সয়াবিনের উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর শস্য বিন্যাসটি কৃষকের নিকট একটি লাভজনক শস্য বিন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে আর এর সাথে দেশের ভোজ্যতেলের দেশীয় চাহিদা মিটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সয়াবিনের চাষাবাদ পদ্ধতি
মাটি : সয়াবিন সাধারণত বেলে দোআঁশ এবং দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মায়। এ ছাড়া সয়াবিন মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু হওয়ায় দেশের উপকূলীয় জেলাসমূহে সয়াবিন চাষের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। খরিফ-২ বা বর্ষা মৌসুমে সয়াবিন চাষের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই পানি নিস্কাশনের সুবিধাযুক্ত এবং উঁচু হতে হবে।
বপনের সময় : রবি মৌসুমে পৌষ মাস (মধ্য-ডিসেম্বর থেকে মধ্য-জানুয়ারি পর্যন্ত) উপযুক্ত বপনকাল। খরিফ-২ অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে শ্রাবণ থেকে মধ্য ভাদ্র মাস পর্যন্ত (মধ্য-জুলাই থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত) বপন করা ভালো।
উল্লেখযোগ্য জাতসমূহ : খরিফ-২ অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে চাষযোগ্য জাতসমূহ হলো বিনাসয়াবিন-২, বিনাসয়াবিন-৩, বিনাসয়াবিন-৫, বিনাসয়াবিন-৬, বিনাসয়াবিন-৭, বারি সয়াবিন-৫, বারি সয়াবিন-৬, এবং বিএইউ সয়াবিন-২।
জমি তৈরি : জমিতে ৩-৪ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে আগাছামুক্ত করে জমি প্রস্তুত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে সেচ প্রয়োগসহ খরিফ-২ মৌসুমে পানি নিষ্কাশনসহ আন্ত:পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। তবে বীজ বপনের সময় ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলে খরিফ-২ মৌসুমে জমি চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বপন পদ্ধতি : সয়াবিন সারিতে বপন করা উত্তম। তবে মাষকলাই বা মুগের ন্যায় ছিটিয়েও বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সেমি হলেও খরিফ-২ মৌসুমে জাতভেদে ৩৫-৪০ সেমি রাখতে হবে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪-৬ সেমি রাখতে হবে। বিশেষ করে খরিফ-২ মৌসুমে বীজ বপনের সময় জমিতে পাওয়ার টিলারের সাহায্যে ২-৩টি চাষ দিয়ে পরবর্তী মই দিয়ে মাটি সমান করার পর সারিতে বীজ বপন করে প্রয়োজনে মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হবে, আর যদি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র সারিতে বীজ ফেলানোর পর মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। সাধারণভাবে একর প্রতি অনুমোদিত সারের মাত্রা
ইউরিয়া ২০-২৫ কেজি; টিএসপি ৬০-৭০ কেজি; এমপি ৩৫-৪০ কেজি এবং জিপসাম ৩০-৩৫ কেজি; জিংক সালফেট ১.৫ - ২.৫ কেজি এবং জীবাণুসার (ইউরিয়ার পরিবর্তে) ৫০ গ্রাম (প্রতি কেজি বীজের জন্য) জমিতে পঁচা গোবর অথবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে। রাসায়নিক সার শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে পরে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
জীবাণুসার প্রয়োগ ও ব্যবহার পদ্ধতি: একটি পাত্রে এক কেজি পরিমাণ বীজ নিয়ে পরিষ্কার পানিতে হাত ভিজিয়ে ভিজা হাতে সয়াবিন বীজ নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে সকল বীজের উপরিভাগ ভিজে যায়। এক কেজি সয়াবিন বীজে ২০-৩০ গ্রাম চিটাগুড় বা ভাতের ঠা-া মাড় ভালোভাবে মিশানোর পর ৫০ গ্রাম জীবাণুসার মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে চিটাগুড় মিশ্রিত আঠালো বীজের গায়ে জীবাণুসার সমভাবে লেগে যায়। জীবাণুসার মিশানোর পর বীজ তাড়াতাড়ি বপন করতে হবে, কারণ জীবাণুসার পাউডার মিশানোর পর বীজ অনেকক্ষণ ফেলে রাখলে জীবাণুসারের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
পানি নিস্কাশন : রবি মৌসুমে সেচের প্রয়োজন হলেও খরিফ-২ মৌসুমে সেচের প্রয়োজন নেই বরং ভারী বৃষ্টিজনিত কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হতে পারে সেজন্য নিস্কাশনের সুব্যবস্থা রাখাই হবে।
আন্ত:পরিচর্যা : চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর প্রয়োজনে আগাছা দমন করতে হবে এবং গাছ ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে খরিফ-২ মৌসুমে ৪০-৪৫ টি গাছ রাখেই উত্তম।
রোগ-বালাই দমন
বিছাপোকা : এ পোকা সয়াবিনের মারাত্মক ক্ষতি করে। ডিম থেকে ফোটার পর ছোট অবস্থায় বিছাপোকার কীড়াগুলো একস্থানে দলবদ্ধভাবে থাকে এবং পরবর্তীতে আক্রান্ত গাছের পাতা খেয়ে জালের মতো ঝাঁঝরা করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত পাতা পোকাসহ তুলে মেরে ফেলতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া পাতা ভাঁজ করে ভিতরে অবস্থান করে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। উভয় পোকার আক্রমণ বেশি হলে সেভিন ৮৫ এসপি এর ৩৪ গ্রাম পাউডার প্রতি ১০ লিটার পানিতে অথবা এডভান্টেজ ২০ এসসি এর ৩০ মি.লি. প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
কা-ের মাছি পোকা : এ পোকার কীড়া কা- ছিদ্র করে ভিতরের নরম অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত গাছ দ্রুত মরে যায়। এ পোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন ৬০ ইসি ২৫-৩০ মি. লি. প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে।
কা- পঁচা রোগ : মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং কা- ও মূলে কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরে যায়। গভীর চাষ এবং জমি হতে ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলে এ রোগের উৎস নষ্ট করা যায়।
হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ : সয়াবিনের সবুজ পত্র ফলকের উপরিভাগে উজ্জ্বল সোনালি বা হলুদ রঙের চক্রাকার দাগের উপস্থিতি এ রোগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সুস্থ এবং রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ অনেকটা কমানো যায়। উল্লেখ্য যে, বিনা সয়াবিন৭ হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগসহনশীল। তবে সুস্থ এবং রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ অনেকটা কমানো যায়।
পরিপক্বতা ও ফসল সংগ্রহ : খরিফ-২ মৌসুমে দেশীয় জাতগুলো পরিপক্ক হতে ৯০-১২০ দিন সময় নেয়। পরিপক্ব হলে শুটিসহ গাছ হলদে হয়ে আসে এবং পাতা ঝরে পড়তে শুরু করে। এ সময় গাছ কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হয়।
সংগৃহীত গাছ শুটিসহ রোদে ৩-৪ দিন ভালোভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করে শুকিয়ে ঠা-া করে বীজ গুদামজাত করতে হবে। উল্লেখ্য সংরক্ষণের ২-৩ মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে।
পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে :
জ মাড়াই করার পর বীজ বিশেষ যত্নসহকারে শুকাতে হবে। প্রতিদিন অল্প সময় করে অর্থাৎ ৩-৪ ঘণ্টা করে ৪-৫ দিন শুকাতে হবে। বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে। শুকানো বীজ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে ‘কট’ শব্দ করে বীজ ভেঙে গেলে বুঝতে হবে যে বীজ ভালোভাবে শুকিয়েছে।
জ শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং রোগাক্রান্ত পঁচা বীজ বেছে ফেলে দিতে হবে।
জ বীজ সংরক্ষণের পূর্বে এর অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
জ বীজ সংরক্ষণের জন্য বায়ুরোধী মোটা পলিথিন ব্যাগ, প্লাষ্টিক ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসী ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মোটা পলিথিনের ব্যাগে বীজ রেখে মুখ শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তা আবার একটি প্লাষ্টিক বা চটের বস্তায় ভরে রাখলে ভালো হয়। তবে যে পাত্রই ব্যবহার করা হোক প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভিতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। উল্লেখ্য বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠান্ডা হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
সয়াবিন বীজ আর্দ্রতার প্রতি খুবই সংবেদনশীল বিধায় আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে বীজের গুণগত মান বিশেষ করে অংকুরোদগম ক্ষমতা দ্রুত কমে যায় এবং বীজ গজায় না।
খরিফ-২ মৌসুমে বীজ উৎপাদনই একমাত্র বড় সমাধান। কারণ বীজের গুণগতমান নির্ভর করে সয়াবিনের পরিপক্ব পর্যায়ে অর্থাৎ সংগ্রহকালীন বৃষ্টিপাত এবং সঠিকভাবে বীজ সংরক্ষণের উপর। আরও উল্লেখ্য যে, সংগ্রহকালীন বৃষ্টিপাতমুক্ত সংগৃহীত বীজের আর্দ্রতা কমিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের গুণগত মান বিশেষ করে বীজ গজানোর হার ৯০% পর্যন্ত বজায় রাখা সম্ভব।
সঠিক আর্দ্রতায় ও বায়োরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণের উপর কৃষকদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বীজের গুণগত মান বজায় রাখতে পারেন না, ফলে প্রতি বছরই বীজের সংকট দেখা দেয়। অপরদিকে বিএডিসি কর্তৃক উৎপাদিত বীজ চাহিদার তুলনায় খুবই কম এবং রবি মৌসুমে উৎপাদিত বীজ পরবর্তী রবি মৌসুমে ভালো গজায় না। বিএডিসি কর্তৃক খরিফ-২ মৌসুমে পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন করে রবি মৌসুমে ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে উৎপাদিত সয়াবিনের পুরোটাই যাতে বীজ হিসেবে উৎপাদনের উদ্যোগটি বিএডিসি এবং প্রশিক্ষিত কৃষককেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে বীজ উৎপাদনে মাঠমান ও বীজমান অনুসরণ করার করার সঠিক উদ্যোগটিও গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ, মোবাইল নম্বর : ০১৭১২১০৬৬২০, ই- মেইল :malekbina@gmail.com
প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রঞ্জিতকরণ
ড. ফেরদৌস আরা দিলরুবা
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে পাটই প্রধান অর্থকরী ফসল। সুপ্রাচীন কাল হতে আমাদের দেশে পাটের আবাদ ও ব্যবহার শুরু হয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পাটই ছিল প্রধান রপ্তানি আয়ের পণ্য। এখানকার আলো, বাতাস ও জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাই পাট চাষিগণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট চাষ করে আসতেছে।
পাট বহুবিধ কল্যাণমুখী গুণে গুণান্বিত, যেমন- পরিবেশবান্ধব, দ্রুত পচনশীল, সহজলভ্য ইত্যাদি। মূলত এ সমস্ত গুণগত বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্ববাজারে পাট পছন্দের তন্তু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের ফলে সারাবিশ্বে কৃত্রিম আঁশের উদ্ভাবন এবং স্বল্প ব্যয়ে এর বহুমুখী ব্যবহারের ফলে বিশ্ববাজারে পাট আজ চরম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। তাই বিশ্ববাজারে পাটকে টিকিয়ে রাখার জন্য এর বহুমুখী ব্যবহার এবং সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক।
পাটের বহুমুখী ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পাটের কাপড়কে ব্লিচিং ও নরমীকরণ করে, রঙিন ডিজাইন বা নকশা তৈরির মাধ্যমে উহাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে “প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রংকরণ পদ্ধতি” একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।
প্রাকৃতিক রং : প্রাকৃতিক রং বলতে এমন কিছু উপাদানকে বোঝায় যা, প্রকৃতি বা আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে সংগৃহীত এবং এর ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশ এর কোনো ক্ষতি হয় না।
বাংলাদেশ রং উৎপাদনকারী গাছের এক সম্পদশালী ভা-ার। দেশীয় জরিপে দেখা যায় যে, কৃত্রিম রং এর ক্ষতিকর প্রভাবে গ্রাম্য শিল্প লুপ্ত প্রায়। বর্তমানে সহজলভ্য কৃত্রিম রং প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ,নদী-নালার পানিতে মিশে ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই উপমহাদেশে তিন শতাধিক রং প্রস্তুতকারী গাছের নাম নানাবিধ ঐতিহাসিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। উৎসগুলোর মধ্যে গাছের ছাল, গাছের পিন্ড, বীজ, ফুলের গুচ্ছ অন্তর্গত।
প্রাকৃতিক রংকরণ পদ্ধতি
ধৌতকরণ : পাটবস্ত্রের মাড় ও অন্যান্য ময়লা দূর করার জন্য প্রথমে ধৌত করা প্রয়োজন। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে কাপড় কাঁচা সোডা, গলিত সাবান, কষ্টিক সোডা ও পানি একত্রে গরম করা হয়। উক্ত দ্রবণে পাটবস্ত্র সিদ্ধ করা হয়ে গেলে প্রচুর পরিষ্কার পানিতে ধৌত করা হয়।
ব্লিচিং : যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে টেক্সটাইল দ্রব্য হতে প্রাকৃতিক রং জাতীয় পদার্থ বিনষ্ট করা হয় তাকে ব্লিচিং বলে।
রংকরণ : কাপড় রং দ্রবণে ডুবিয়ে সব জায়গায় সমানভাবে লাগানোর প্রণালীকে রংকরণ বলে।
মর্ডান্ট : একটি সাহায্যকারী বস্তু যা প্রাকৃতিক রং এর সাথে মিলে সুতার সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। বিভিন্ন মর্ডান্ট দ্বারা বিভিন্ন রং হয়। প্রাকৃতিক রং হইতে সূক্ষ্ম চমৎকার রং পাওয়া যায়। যাহার স্থায়িত্ব ও ঘনত্ব “মর্ডান্ট” দ্বারা বদলান যায়।
সারণি-২ : প্রাকৃতিক রং করার উপাদান (মর্ডান্ট)
উপরোক্ত মর্ডান্ট বা উপকরণ ভিন্নভাবে ভিন্ন সময়ে ব্যবহার করতে হবে।
রংকরণ পদ্ধতির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ধাপ আছে যা ভালো ফলাফলের জন্য অবশ্যই পালন করতে হবে। সুতা/কাপড় মেপে নেওয়া (সকল কিছুর হিসাব সুতা/কাপড়ের ওজনের উপর করে নিতে হবে)। রং এর উপাদান ও মিনারেলের ওজন এবং এদের হিসেব করা। মর্ডান্ট এর দ্রবণ তৈরি করা। মর্ডান্টিং করা। রং এর উপাদান থেকে রং বের করা। রং করা। ডেভেলপিং করা এবং ধৌত করা।
ভালো ফলাফলের জন্য সুতা/পাটবস্ত্র প্রথমে ফিটকিরির দ্রবণে জ্বাল দিতে হবে। পানি গরম করে তাতে রং এর চাহিদা অনুযায়ী মিনারেল দিতে হবে এবং ভালো করে গলাতে হবে। ফিটকিরি দিয়ে ট্রিট করা সুতা/পাটবস্ত্র এই দ্রবণে দিয়ে আধাঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। এইভাবে সুতা/পাটবস্ত্র রং করার জন্য তৈরি হবে। পানি গরম করে এতে ১০০% রং এর উপাদান দিতে হবে। সাথে এক চিমটি কাপড় কাঁচার সোডা দিলে ভালো হয়। সম্পূর্ণ রং বের করার জন্য কমপক্ষে আধাঘণ্টা জ্বাল দিয়ে পরে সেটা পাতলা কাপড় দিয়ে ছেকে নিতে হবে।
মর্ডান্ট দ্রবণ থেকে সুতা/পাটবস্ত্র তুলে চিপে নিতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। তারপর এটাকে রং এর দ্রবণে আধাঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। রং করার পর সুতা/পাটবস্ত্র প্রচুর পানিতে খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে যাতে আলগা রং সম্পূর্ণ উঠে যায়। পরিশেষে সাবান দিয়ে ধুয়ে ছায়ায় শুকাতে হবে।
প্রাকৃতিক রং খয়ের থেকে রং তৈরি
প্রথমে হামান দিস্তার সাহায্যে খয়েরের টুকরাকে ভেঙে গুঁড়া করে নিতে হবে। খয়েরের সাহায্যে ১০০ গ্রাম সুতা/পাটবস্ত্র রং করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
সুতা/পাটবস্ত্র ১০০ গ্রাম; খয়ের ৩০% (৩০ গ্রাম, সুতা/কাপড়ের ওজনের ভিত্তিতে); তুতে ৫% (৫ গ্রাম, সুতা/কাপড়ের ওজনের ভিত্তিতে); পানি : ২০ গুণ (১০০ গ্রাম সুতা/পাটবস্ত্রী২০ = ২০০০ গ্রাম = ২ লিটার); ফলাফল হবে খয়েরি রং এর সুতা/পাটবস্ত্র।
পদ্ধতি : প্রথমে খয়েরের গুঁড়া তুতেসহ গরম পানিতে দিয়ে ভালো করে গলাতে হবে যাতে সম্পূর্ণ গলে যায়। অতঃপর ছেঁকে নিয়ে পুনরায় চুলায় বসাতে হবে। এতে সুতা/পাটবস্ত্র ডুবিয়ে রং করতে হবে। রং করার সময় সুতা/পাটবস্ত্র ভালো করে নাড়তে হবে যাতে রং সর্বত্র সমানভাবে লাগে। আধাঘণ্টা রং করার পর সুতা/পাটবস্ত্র রং এর দ্রবণ থেকে তুলে নিতে হবে। এতে খয়েরি রং পাওয়া যাবে। রং করার পর প্রচুর পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে যাতে আলগা রং উঠে যায়। ধোয়ার পর ছায়ায় শুকাতে হবে।
উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট আঁশ দিয়ে নানাবিধ পণ্য তৈরি হচ্ছে। পাট আঁশ হতে উদ্ভাবিত নানাবিধ দ্রব্যের মধ্যে বিভিন্ন রং এর পাট উল, কম্বল, সুয়েটার, জায়নামাজ, হাল্কা শপিং ব্যাগ, পর্দার কাপড়, সোফার কভার ইত্যাদি হরেক রকমের পণ্য উল্লেখযোগ্য।
পরিবেশগত কোন দূষণীয় পদার্থ পাট ও পাটজাত দ্রব্যে নাই। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য অতি সহজেই পচনশীল। কাজেই সচেতন নাগরিক ও নতুন প্রজন্মদের পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : পরিচালক (জুট-টেক্সটাইল), জুট-টেক্সটাইল উইং, বিজেআরআই, ঢাকা। মোবাইল নং - ০১৬৮০৯৭৮৬৫৮, ই-মেইল : drfdilruba70@gmail.com
সার ব্যবহার আধুনিকায়ন
ড. মো. সদরুল আমিন
বর্তমানে দেশে সার ব্যবহারে নানারূপ সমস্যার কারণে সারভেদে মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সেভাবে বাড়ছে না। তাই বর্তমান কৃষি প্রযুক্তি ও উপকরণ বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহার করে ফসল চাষ ব্যয় সমন্বয় করা সম্ভব। সার ব্যবহার লাভজনক ও নিরাপদ করতে হলে অবশ্যই এর স্মার্ট আধুনিকায়ন করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে ৩টি কাজ করতে হবে। যেমন-(১) সার ব্যবহারে মাটির পুষ্টি উপাদান পরীক্ষা ও অপুষ্টি লক্ষণ বিবেচনায় নিতে হবে। (২) সংগায়িত সার প্রযুক্তি সুপারিশ উদ্ভাবন ও সার আইন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন এবং (৩) সারকে কল্যাণধর্মী উপকরণ বিবেচনা করে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
দেশে উপরে বর্ণিত ৩টি করণীয় সম্পাদন করে সার বাবদ খরচ ২০% কমানো সম্ভব এবং ফসলের উৎপাদন ২০% বাড়ানো সম্ভব। নয়তো সার বাবদ খরচ বছরে ২০% পর্যন্ত বেড়ে কৃষিকে অকার্যকর করে দিতে পারে।
উদ্ভিদের বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফুল, ফল এবং বীজ উৎপাদনের জন্য অত্যাবশ্যক খাদ্যোপাদান প্রয়োজন। এর সংখ্যা ১৮টি। কোন উপাদানের অভাব হলে উদ্ভিদ মারা যাবে এবং ঘাটতি হলে উদ্ভিদের দেহ ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে, যা নির্দিষ্ট লক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। পরিশোষণের পরিমাণের ভিত্তিতে এসব অত্যাবশ্যক খাদ্যোপাদান দুই প্রকার। যথা :
১. মুখ্য খাদ্যোপাদান- বেশি পরিমাণে প্রয়োজন। মুখ্য উপাদান ৯টি (কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম ও সালফার)।
২. গৌণ খাদ্যোপাদান- কম পরিমাণে প্রয়োজন। গৌণ উপাদান ৭টি (জিংক, বোরন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, মলিবডেনাম কোবাল্ট স্ট্রনসিয়াম ও ক্লোরিন)।
সার ব্যবহার লাভজনক করতে অবশ্যই গাছ অপুষ্টি লক্ষণ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বালাই লক্ষণের সাথে মিল-অমিল যাচাই করতে হবে । এজন্য পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা ও স্মার্ট জ্ঞান প্রয়োজন।
পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত বৈজ্ঞানিক সুনির্দিষ্ট লক্ষণ (একটি উপাদান একটি লক্ষণ)
নাইট্রোজেন : গাছের গোড়ার দিকে বয়স্ক পাতা হলুদ হয়ে যায়।
ফসফরাস : গাছের রং গাঢ় সবুজ, কিন্তু বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
পটাশিয়াম : গাছের গোড়ার পাতায় বাদামি দাগ দেখা যায়।
সালফার : সালফারের অভাবে গাছের নতুন গজানো পাতা হলুদ হয়।
ম্যাগনেসিয়াম : বয়স্ক পাতার আন্তঃশিরা হলদে-সাদা ছিটপড়া দাগ দেখা যায়। যদিও প্রধান শিরাগুলো সবুজ থাকে।
ক্যালসিয়াম : নতুন গজানো পাতার শীর্ষদেশ সাদা হয়ে কুঁকড়ে যায়।
জিংক : পাতার গোড়া সাদা বাদামি, অসম বৃদ্ধি ।
বোরন : ফল আঁকাবাঁকা হয়।
মলিবডেনাম : পাতা চিকন ও পেঁচিয়ে যায়।
ম্যাঙ্গানিজ : কচি পাতা সরু ও খাটো হয়।
আয়রন : নতুন পাতায় প্রথমে সাদাটে ক্লোরোটিক দাগ দেখা যায়।
কপার : কচি পাতা সূচের আকার ধারণ করে।
সার প্রযুক্তি
বর্ধনশীল জনসংখ্যার বসতবাড়ি এবং রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, শিল্প কারখানা ইত্যাদি নির্মাণ ও জমির বহুবিধ ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের খাদ্য চাহিদা বেশি হওয়ায় এখন জমি থেকে অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যোপাদান অপসারিত হচ্ছে। ফলে জমির জৈব পদার্থ ও উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আগে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপিসহ ১০-১২টি সার দিয়ে ফসল চাষ করা যেত। এখন সেখানে এ সার ছাড়াও জিপসাম, দস্তা, বোরনসহ মোট ৫০-৬০টি সার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
তাই মাটি স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং ভবিষ্যৎ টেকসই ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা বজায় রাখার স্বার্থে মাটি ও সার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাটির উর্বরতা ঠিক রাখা এবং ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য জৈবসার ও ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সুষম সারের ব্যবহার জরুরি।
সারের শ্রেণি বিভাগ
সারকে বিভিন্নভাবে শ্রেণি বিভাগ করা হয়ে থাকে, যেমন- সারের উৎস, সারে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান এবং সারের আকৃতি প্রকৃতি ও গঠন অনুসারে। উৎস অনুসারে সারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-রাসায়নিক উৎস থেকে প্রস্তুতকৃত সার, যেমন-ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি। জৈব উৎস থেকে প্রস্তুতকৃত সার অর্থাৎ জৈব দ্রব্য পচিয়ে যে সার প্রস্তুত করা হয়। ফসলের জন্য উপকারী অণুজীব সম্বলিত সার। বাংলাদেশে সুক্ষদানা, তরল ও স্মার্ট ন্যানো সাার ব্যবহার করা দরকার।
পুষ্টি অনুসারে মুখ্য পুষ্টি উপাদান বিশিষ্ট সার, যেমন- ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম। গৌণ পুষ্টি উপাদান বিশিষ্ট সার, যেমন- জিংক সালফেট (মনো/হেপ্টাহাইড্রোট), বরিক এসিড, সলুবোর।
সারের আকৃতি প্রকৃতি ও গঠন অনুসারে, যেমন- একক উপাদান সার (সরল সার), যেমন- ইউরিয়া (নাইট্রোজেন), টিএসপি (ফসফরাস), এমওপি (পটাশ)। রাসায়নিকভাবে সংযুক্ত একাধিক পুষ্টি উপাদন সার (যৌগিক সার), যেমন- ডিএমপি (নাইট্রোজেন ও ফসফেট), এসওপি (ফসফরাস ও সালফার)। একাধিক সার মিশ্রণের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত সার (মিশ্র সার), যেমন- এনপিকেএস (ঘচকঝ) মিশ্র সার।
সার প্রয়োগের জরুরি বিষয় : সার প্রয়োগের পর তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে; জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে এ সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়; জৈবসার ফসল বপন/রোপণের কমপক্ষে ৭ দিন পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করে মাটি সাথে মিশিয়ে দিতে হবে; ফসলের বর্ধনশীল অবস্থায় গৌণ পুষ্টির অভাব দেখা দিলে স্প্রে করা উত্তম।
সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হলে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬০-৭০% ভাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উফশী ধান চাষে ইউরিয়া তিন বারে প্রয়োগ করতে হবে। জমি শেষ চাষের পূর্বে বা ধানের চারা মাটিতে লেগে যাওয়ার পরপরই ১ম বার, বর্ধনশীল পর্যায়ে ২য় বার এবং ডিগ পাতা বের হওয়ার ১৫-২০ দিন পূর্বে ৩য় বার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের সময় ক্ষেতে ছিপছিপে পানি থাকতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর পরই তা ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এক্ষত্রে তরল বা ন্যানো আকারে একটি স্প্রে করলে ব্যয় কমে যাবে।
আলু ফসলে অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি ও অন্যান্য সার শেষ চাষের পূর্বে দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর ভ্যালি তৈরির সময় পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। আলু ফসলে মোট সারের ১০-২০ % ইউরিয়া কমানোর সুযোগ রয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে ভেজাল সার সনাক্তকরণ
মিশ্র সার, জৈবসার, সালফেট, বোরন সার ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে বেশি ভেজাল পাওয়া যায়। মাঠ পর্যায়ে ভেজাল সার শনাক্তকরণের আধুনিক পদ্ধতি-
ইউরিয়া : ১ চা চামচ (প্রায় ১ গ্রাম) ইউরিয়া সার ২ চামচ পরিমাণ পানিতে গলে সচ্ছ ঠা-া দ্রবণ তৈরি করবে।
টিএসপি : টিএসপি সারের দানা বেশ শক্ত। তাই টিএসপি দানা দুই বুড়ো আঙুলের নখের মাঝে রেখে চাপ দিয়ে তা ভাঙা যায় না। কিন্তু ভেজাল টিএসপি অপেক্ষাকৃত নরম। ভাঙা দানার ভেতরের অংশ বিভিন্ন রঙের হতে পারে।
ডিএপি সার : ২ চা চামচ ডিএপি সার একটি কাগজের উপর খোলা অবস্থায় ১-২ ঘণ্টা রেখে দিলে ভিজে না উঠে তবে নমুনাটি ভেজাল ডিএপি। এক চা চামচ ডিএপি সার আধাগ্লাস পানিতে মিশালে পানিতে গলে যাবে।
এমওপি : লালচে স্ফটিকাকৃতির। ঝাঁঝালো গন্ধ নেই। বর্ষাকালে এমওপি আর্দ্রতা শোষণ করে ভিজে উঠে। এমওপি সার গলে পরিষ্কার দ্রবণ তৈরি করে। এমওপি সারের রং হাতে লাগবে না।
এনপিকেএস মিশ্র সার : বোরো ধানের জন্য অনুমোদিত ৮ : ২০ : ১৪ : ৫ এবং গমের জন্য অনুমোদিত ১২ : ১৫ : ২০ : ৬.৫ গ্রেডের মিশ্রসার দুটিই দেশে বেশি প্রচলিত। এ সারের ভেজাল হিসেবে মাটি, ডলোমাইট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভেজাল সারের দানা আঙুল দিয়ে চাপ দিলে গুঁড়া হয়ে যাবে। দানার ভেতর ও বাইরের প্রলেপের রং আলাদা হবে।
জিপসাম : চুনের গুঁড়া ও মটির গুঁড়া মিশিয়ে জিপসাম সারে ভেজাল দেয়া হয়। ১ চামচ ভেজাল জিপসাম সারে ১০ ফোটা হাইড্রোক্লোরিক এসিড মেশালে বুদ বুদ দেখা দিবে ।
জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) : আধা গ্লাস পানিতে ১-২ চা চামচ জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) দ্রবীভূত করলে দ্রবণ ঘোলাটে হবে। দ্রবণে পেজা তুলার মতো বস্তু ভাসতে থাকবে। কিন্তু হেপ্টাহাইড্রেট গলে যাবে।
লিবরেল জিংক : চিলেটেড জিংক স্ফটিক সাদা বা হলদেটে পাউডারের ন্যায় এবং ওজনে হালকা। এক গ্লাস পানিতে আধা চা চামচ চিলেটেড জিংক মেশালে গলে যাবে।
সলুবর বোরন সার : সলুবর সাদা, হালকা, পাউডার ২০% বোরন।
লেখক : প্রফেসর (অব:) হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৯৮৮৮০২২৫৩; ই-মেইল :sadrulamin47@gmail.com
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে গ্লাডিওলাসের
করমেল উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. মো. খালিদ জামিল
গ্লাডিওলাস একটি খুবই জনপ্রিয় ফুল। এই ফুলের আকর্ষণীয় গঠন এবং দীর্ঘ সময় সজীব থাকার জন্য সকলের কাছে এই ফুলটি কদর বেশী। প্রধানত ল্যটিন ভাষায় ‘গ্লাডিওলাস ’ মানে তলোয়ার। এই ফুলের পাতার চেহারা অনেকটা তলোয়ারের মতো। সুন্দর পুষ্পদ- ও আকর্ষণীয় রঙিন ফুল, প্রায় সকলেরই নজর কাড়ে। গ্লাডিওলাস ফুলের বাজার চাহিদা আকাশছোঁয়া হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ বেশ লাভজনক। বাহারি বর্ণের ফুল ও আকর্ষণীয় পুষ্পদ-ের জন্য গ্লাডিওলাস বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ইহা একটি কন্দজাতীয় ফুল, যা সাধারণভাবে সোর্ড লিলি নামে পরিচিত। ফুলদানিতে এই ফুলের জীবনকাল ৮-৯ দিন ফলে কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সারা বছর এ ফুলের চাষ করা যায় তবে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস চাষের জন্য উত্তম সময়। বাংলাদেশের সব এলাকাতেই এ ফুলের চাষ করা সম্ভব তবে যশোর, ঝিনাইদহ, সাভার, পঞ্চগড়, গাজীপুর ও কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপকভাবে এ ফুলের চাষ করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস চাষের ক্ষেত্রে করম ও করমেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত একটি মাতৃ করম থেকে একটি অপাত্য (Daughter) করম এবং গুচ্ছাকারে কিছু করমেল উৎপন্ন হয়। জাত ও মৌসুম ভেদে এই করমেল উৎপাদনে তারতম্য দেখা যায়। গ্লাডিওলাস উচ্চমাত্রার হেটারোজাইগাস ) প্রকৃতির ফুল। তাই বীজ থেকে উৎপন্ন চারা অবিকল মাতৃগাছের মতো হয় না। বীজ থেকে চারা উৎপাদন বেশ সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য। অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ রোগমুক্ত করমেল উৎপন্ন করে গ্লাডিওলাসের বংশবিস্তার করার জন্য টিস্যু কালচার একটি উত্তম পন্থা। এ ছাড়া গ্লাডিওলাসের যে সমস্ত জাত স্বাভাবিকভাবে পর্যাপ্ত করমেল উৎপাদনে অক্ষম সেক্ষেত্রে টিস্যু কালচার পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জীব প্রযুক্তি বিভাগের গবেষণাগারে গ্লাডিওলাস ফুলের করমেল উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে করমেল উৎপাদন করা সম্ভব।
টিস্যুকালচার বা আবাদ মাধ্যমে গ্লাডিওলাসের করমেল উৎপাদন প্রযুক্তি : টিস্যুকালচারের মাধ্যমে গ্লাডিওলাসের করমেল উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বারি গ্লাডিওলাস-৪ এর সবল ও রোগমুক্ত গাছ থেকে করম ও অপ্রস্ফুটিত পুষ্পদ- সংগ্রহ করা হয়। তারপর জীবাণুনাশক দ্রবণে সেগুলো জীবাণুমুক্ত করা হয়। জীবাণুুমুক্ত পরিবেশে অর্থাৎ লেমিনার এয়ার ফ্লো কেবিনেটের মধ্যে এক্সপ্লান্ট তৈরি করার পর সেগুলো স্যুট ইনিসিয়েশন মিডিয়ায় স্থাপন করা হয়। স্যুট ইনিসিয়েশন শুরু হলে সেগুলোকে পুনরায় হরমোন সমৃদ্ধ স্যুট মাল্টিপ্লিকেশন মিডিয়ায় কালচার করা হয়। এই মিডিয়ায় একটি স্যুট থেকে অনেকগুলো স্যুট এর সৃষ্টি হয়। এই স্যুটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধির জন্য তিন থেকে চার সপ্তাহ পর পর একই হরমোন সমৃদ্ধ নতুন তৈরি মিডিয়ায় সাবকালচার করা হয়। এভাবে কয়েকবার সাবকালচার করলে প্রচুর পরিমাণে অনুচারা পাওয়া যায়। তারপর করমেল উৎপাদনের জন্য স্যুট গুলোকে নতুন হরমোন সমৃদ্ধ করমেল উৎপাদন মিডিয়ায় স্থাপন করা হয়। এই মিডিয়ায় ৩০-৪৫ দিনের মধ্যেই করমেল উৎপাদন শুরু হয়। তারপর কয়েকবার সাব কালচার করে করমেল কিছুটা শক্ত ও বাদামী বর্ণ ধারণ করলে সেগুলো কালচার ভেসেল থেকে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত করমেল কিছুদিন নিম্ন তাপমাত্রায় (৪ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড) সংরক্ষণ করা হয়। তারপর সেগুলো জীবাণুমুক্ত মাধ্যমে ছোট ছোট টবে লাগিয়ে চারা উৎপাদনের জন্য গ্রিনহাউজে রাখা হয়। ২-৩ মাসের মধ্যেই করমেল থেকে নতুন চারা উৎপন্ন হয়। পরবর্তীতে করমেলের আকার বৃদ্ধি পায়। এভাবে উৎপন্ন করমেল থেকে ৩-৪ বছর পর যে গাছ উৎপন্ন হয় তাতে মাতৃগাছের অনুরূপ পুষ্পদ- দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কন্দের চেয়ে পুষ্পদ-ের গিট বা নোড ব্যবহার করে অধিক পরিমাণে চারা ও করমেল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
গ্লাডিওলাস চাষের জন্য প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। তারপর সেখানে করমেল থেকে উৎপন্ন চারা মাটির ৫-৬ সেমি. গভীরে এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে সারি থেকে সারি ২০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছ ১৫ সেমি. দূরত্বে থাকে। গ্লাডিওলাস চাষে হেক্টরপ্রতি ১০ টন পচা গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ২২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৯০ কেজি এমওপি দিতে হবে। শেষ চাষের সময় গোবর, টিএসপি ও এমওপি মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক রোপণের ২০-২৫ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক পুষ্পদ- বের হওয়ার পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
গ্লাডিওলাসের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা হচ্ছে মাটি উঠানো। গাছের ৩-৫ পাতা পর্যায়ে একবার এবং প্রয়োজনবোধে ৭ পাতা বের হওয়ার পর অর্থাৎ স্পাইক বের হওয়ার সময় গাছের গোড়ার দুইপাশ থেকে মাটি তুলে দিতে হবে। মাটি তুলে দিলে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে এবং বাতাসে গাছ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। সেচ দেয়ার পর করম মাটির উপরে উঠে এলে পাশ থেকে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে পড়ে যাওয়া থেকে গাছ রক্ষার জন্য স্টেকিং প্রয়োজন। সারিতে ২ মিটার দূরে দূরে বাঁশের কাঠি পুঁতে দিতে হবে। এ ছাড়াও বাতাসে গাছ হেলে পড়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য ছোট ছোট খুটি বা প্লাস্টিকের রশি টেনে দেয়া প্রয়োজন।
সাধারণত স্পাইকের নিচ থেকে ১-২টি পাপড়ি ফুটলে ফুল সংগ্রহ করতে হয়। ফুল সংগ্রহের পরপরই বালতি ভর্তি পানিতে সোজা করে ডুবিয়ে রেখে পরে নিম্ন তাপমাত্রায় (৬-৭ ডিগ্রি) সংরক্ষণ করা উত্তম। স্পাইক কাটার সময় গাছের গোড়ায় ৪-৫টি পাতা রাখতে হবে তাহলে করম পুষ্ট হবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর। মোবাইল নং ০১৭২১৬৩০৮০১, ই-মেইল :hre@yahoo.com
আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ
ড. মো. শরফ উদ্দিন
আম সারা বিশে^ সব মানুষের কাছে একটি পছন্দনীয় ফল। কিন্তু এদেশে আমের মৌসুম মাত্র ৩-৪ মাস। ফলে বছরের অন্যান্য সময় আমের চাহিদা থাকলেও সে সময়ে আমের চাহিদা মেটানো যায় না। সারা বছর এই জনপ্রিয় ফলকে ভোক্তাদের নিকট সহজলভ্য করার অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমের অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উৎপন্ন করে। তারা এই প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলো দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করে। এই ভাবে কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় আমের ব্যবহার হয় এবং চাষিরা আমের নায্যমূল্য পেয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমের প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য উৎপাদিত করে থাকে। এই পণ্যগুলোর মধ্যে আমের আচার, চাটনি, আমসত্ত্ব, আমচুর ড্রিংস ইত্যাদি। তাছাড়া বাড়িতে মা বোনেরা আমের বিভিন্ন পণ্য ঘরোয়াভাবে তৈরি করে থাকেন। নি¤েœ আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরিকৃত পণ্য এবং এদের প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে আলোচনা করা হলো-
আমসত্ত্ব
উপকরণ: পাকা আম ১ কেজি, সরিষার তেল ১০০ এমএল, চিনি পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী: আম ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে তা থেকে রস বের করে নিতে হবে। রস চুলায় জ্বাল দিয়ে কিছুটা ঘন হয়ে আসলে ঠা-া করে একটি প্লেটে রসের একটি প্রলেপ দিয়ে তা রোদে শুকাতে হবে। প্রলেপ শুকিয়ে আসলে পুণরায় নতুন প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে ৫-৭টি প্রলেপ শুকিয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করা হয়। আমসত্ত্ব ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে সুবিধামতো সাইজ করে কেটে সংরক্ষণ করতে হবে। প্লেট থেকে আমসত্ত্ব উঠানোর সুবিধার্থে রসের প্রলেপ দেয়ার আগে একটু সরিষার তেল মাখিয়ে নিতে হবে। রোদে শুকানোর সময় এতে যাতে মাছি না বসে ও ধুলি ও বালি না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রস চুলার তাপে না দিয়ে সরাসরি শুকিয়েও আমসত্ত্ব তৈরি করা যায়। আম টক হলে রসের সাথে কিছুটা চিনি যোগ করতে হয়। আমসত্ত্ব দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে হলে রসের সাথে ০.০৫% সাইট্রিক এসিড ও ০.১% পটাশিয়াম মেটা-বাইসালফেট যোগ করা যেতে পারে। তবে বিদেশে এই পণ্যটির ব্যাপক চাহিদা আছে। ফলে তারা বাণিজ্যিকভাবে এটি তৈরি করে থাকেন। আমাদের দেশে সাধারণত খোলা আকাশের নিচে শুকানোর কাজটি করা হয় কিন্তু বিদেশে এটি পলিনেট হাউজ এ সম্পন্ন করা হয়। ফলে ধুলাবালি ও কীটপতঙ্গের সংস্পর্শে আসার আশঙ্কা কম থাকে। আমাদের দেশে আমসত্ত্বগুলো ৫০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু বিদেশে প্যাকেটজাত আমসত্ত্বগুলো ১২০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রকৃতপক্ষে এর জন্য বড় কোন কলকারখানা স্থাপনের প্রয়োজন হয় না। বেশ কয়েকজন আমচাষি একত্রে মিলে এই কাজটি করতে পারেন।
আমের মোরব্বা
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ২ কেজি, এলাচ, দারুচিনি, তেজপাতা পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : কাঁচা আমের খোসা ছাড়ানোর পর ফালি ফালি করে কেটে নিয়ে ফালিগুলো কাঁটাচামচ বা অন্য কোন শলাকা দিয়ে কেঁচে ছিদ্র ছিদ্র করতে হবে। এবার ফালিগুলোকে গরম পানিতে ডুবিয়ে হাত দিয়ে চিপে চিপে টক পানি বের করে ফেলতে হবে। চিনির সিরা তৈরি করে আগুনে জ¦াল দিতে হবে। সিরা ঘন হয়ে আসলে তাতে আমের ফালিগুলো দিয়ে অল্প তাপে রান্না করতে হবে। সিরা যখন আমের ফালির গায়ে লেগে আসবে তখন তাপ বন্ধ করে দিতে হবে। ঠা-া হলে পরিষ্কার পাত্রে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে। চিনির সিরা তৈরির সময় তাতে এলাচ, দারুচিনি ও তেজপাতা মিশানো যেতে পারে।
আমের জেলি
উপকরণ : পাকা আম ২ কেজি, চিনি ৪০০ গ্রাম, পানি ২ লিটার, লেবুর রস ২ চা চামচ।
প্রস্তুত প্রণালী : আমের খোসা ছাড়িয়ে পাত্রে পানি নিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। আম সিদ্ধ হলে এবং পানি অর্ধেক হলে নামাতে হবে। সিদ্ধ আম ভাল করে মিশিয়ে পাতলা কাপড়ে ছেঁকে রস আলাদা করতে হয়। সংগ্রহীত রসের সাথে চিনি মিশিয়ে রান্না করতে হবে। যখন পাত্র ফেনায় ভরে উঠবে তখন লেবুর রস দিতে হবে। আমের রস ঘন হয়ে আসলে তার এক ফোঁটা পানিতে ফেলে যদি দেখা যায় যে তা বসে যাচ্ছে তখন তাপ বন্ধ করে শুকনা বোতলে বা কাঁচের বয়মে ভর্তি করে ঠা-া জায়গায় রেখে দিতে হবে। জেলি ঠা-া হলে বোতলের মুখ বন্ধ করতে হবে। জেলি তৈরিতে কাঁচা আমও ব্যবহার করা যায়। তবে চিনির পরিমাণ একটু বেশি দিতে হয়। লেবুর রসের পরিবর্তে ভিনেগার বা সাইট্রিক এসিডও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমের আচার
কাঁচা আম দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের সুস্বাদু ও মুখরোচক আচার তৈরি করা হয়। এদের কোনটি ঝাল, কোনটি মিষ্টি, কোনটি গুড় দ্বারা আবার কোনটি চিনি দ্বারা তৈরি। অনেকে আচার তৈরি করে তা বিক্রিও করে থাকেন। নি¤েœ আচার তৈরির ৪টি পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।
প্রথম পদ্ধতি
উপকরণ : পরিপুষ্ট কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ৫০০ গ্রাম, ভিনেগার ১৭৫ মিলি., এলাচ, শুকনা মরিচ এবং লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : এটি আচার তৈরির অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রথমে আমের খোসা ছাড়িয়ে সাইজমতো কেটে তাতে লবণ মাখিয়ে রোদে শুকাতে হবে। ২/৩ দিন শুকানোর পর একটি পাত্রে কাটা আম নিয়ে তাতে চিনি, ভিনেগার, এলাচ, শুকনা মরিচ যোগ করে কিছুক্ষণ চুলায় তাপ দিতে হবে। ফালিগুলো সিদ্ধ হলে ঠা-া করে পরিষ্কার বয়মে ভর্তি করে সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ৩৭৫ গ্রাম, মৌরি ৫ গ্রাম, মেথি ৫ গ্রাম, শুকনা মরিচ ৩/৪ টি, রসুন ২টি, আদা ২০ গ্রাম, তেজপাতা ২/৩ টি, লবণ পরিমাণমতো।
প্রণালী : আমের খোসা ছাড়িয়ে গোল বা লম্বা করে কাটতে হবে। এবং আমের ফালিগুলো কাঁটা চামচ দিয়ে কেঁচে ছিদ্র ছিদ্র করতে হবে। তারপর কাটা আম গরম পানিতে সিদ্ধ করে পরিষ্কার পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এরপর আমের সাথে চিনি ও অন্যান্য উপাদানগুলো মিশিয়ে তাপ দিতে হবে। কিছুক্ষণ তাপ দিলে আচার প্রস্তুত হয়ে যাবে। কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে কাঁচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।
তৃতীয় পদ্ধতি
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, চিনি ২৫০ গ্রাম, মৌরি ৫ গ্রাম, মেথি ৫ গ্রাম, শুকনা মরিচ ৩/৪টি, রসুন ২টি, আদা ২০ গ্রাম, তেজপাতা, লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী: যে কোন বয়সের আম দ্বারা এ আচার বানানো যায়। আম খোসা ছাড়ানোর পর ফালি করে কেটে নিতে হবে। একটি পাত্রে সরিষার তেল নিয়ে চুলায় তাপ দিতে হবে। তেল গরম হলে সেখানে সমগ্র উপকরণ কিছুটা ভেজে নিয়ে তাতে কাটা আম চিনিসহ আরও তাপ দিতে হবে। আচার ঘন হয়ে আসলে চুলা থেকে নামাতে হবে। আম বেশি টক হলে চিনির পরিমাণ বাড়াতে হবে। আচার ২/৩ দিন রোদে শুকিয়ে কাঁচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।
চতুর্থ পদ্ধতি
উপকরণ: কাঁচা আম ১ কেজি, পাঁচ ফোড়ন ৩০ গ্রাম, সরিষার তেল ২০০ মিলি., সরিষা বাটা ২ টেবিল চামচ, হলুদ ১ চা চামচ, আস্তা ধনিয়া ২ চা চামচ, রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, চিনি, ভিনেগার, লবণ, তেল পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালী : প্রথমে আম খোসাসহ ফালি করে কেটে ভিনেগার, লবণ ও হলুদ মাখিয়ে ৫/৬ ঘণ্টা রোদে রেখে দিতে হবে। এরপর একটি পাত্রে সরিষার তেল নিয়ে রসুন, পাঁচফোড়ন, ধনিয়া, সরিষা বাটা, চিনিসহ চুলায় তাপ দিতে হবে। মিশ্রণটি ঘন হয়ে এলে তার ভেতর আমের ফালিগুলো দিয়ে উল্টো করে নাড়তে হবে। এরপর ঠা-া করে দুই-একদিন রোদে শুকিয়ে কাচের বয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।
আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা
এদেশে স্থানীয় জাতের আমের উৎপাদন অনেক বেশি এবং প্রায় সকল জেলাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু এর ব্যবহার অনেক কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খুব কম দামে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় হয়। আম গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আশাবাদ অন্যান্য দেশের মতো আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব হলে আমের ক্ষতি অনেকাংশে কমে আসবে। মোট উৎপাদনের ১০-২০ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব হলে আমের দাম বাড়বে এবং আমচাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। বর্তমানে যে কোম্পানিগুলো আমের প্রক্রিয়াজাত করছে তার পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি, আম সেক্টরে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। গ্রাম, গঞ্জ ও শহরে অনেক মহিলারা আছেন যারা অত্যন্ত মজাদার পণ্য তৈরি করতে পারেন। এইসব দক্ষ মহিলাদের চিহ্নিত করে তাদের তৈরি পণ্যকে ব্রান্ডিং করা যেতে পারে। তাঁদের বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। আমের প্রক্রিয়াজাতকরণে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিগত কয়েক বছর আমচাষিরা আমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ছাড়া আমের মৌসুমে ঝড়ে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা ও আধাপাকা আম ঝরে পড়ে। এমতাবস্থায়, কাঁচা ও পাকা আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের বিকল্প নেই। সুতরাং বাংলাদেশের যে এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদন হয় সেসব এলাকায় আম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হলে আমের ব্যবহার বাড়বে, চাষিরা আমের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক কমে আসবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯ ই-মেইল sorofu@yahoo.com
খাদ্যে ঘনচিনির ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি
ড. মারুফ আহমেদ১ সৌরভ প্রামানিক শুভ২
স্যাকারিন শব্দটি বাংলাদেশে সুপরিচিত হলেও ঘনচিনি নামটি অনেকটা নতুন। বাংলাদেশে স্যাকারিন, ঘনচিনি দুটি কেমিক্যালই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করছেন ঘনচিনি নামের ক্ষতিকর রাসায়নিক। যে সকল খাদ্যদ্রব্যে পূর্বে অসাধু ব্যবসায়ীরা স্যাকারিন ব্যবহার করতেন, সেখানে এখন ঘনচিনি ব্যবহার করছেন। এ যেন এক বিষের জাল থেকে বের হতে না হতেই আরেক জালে আবদ্ধ হচ্ছি আমরা। সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘনচিনি হচ্ছে Cyclamic Acid এর সোডিয়াম লবন বা এস্টার যার রাসায়নিক সংকেত- C6H12NNaO3S, আণবিক ভর-২০১.২২ গ্রাম/মোল। এটি একটি কৃত্রিম মিষ্টিবর্ধক (artificial sugar) যা সাধারণ চিনি অপেক্ষা ৩০-৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। কোনো খাবারে মিষ্টতা আনতে যদি ৫০ কেজি চিনির প্রয়োজন হয় সেখানে মাত্র ১ কেজি ঘনচিনিই যথেষ্ট।
ঘনচিনি দেখতে অনেকটা সরু সাদাটে চিনির মতোই ক্রিস্টাল বা পাউডার। স্যাকারিন, সাইট্রিক এসিড, সোডিয়াম সাইট্রেট ইত্যাদি কেমিক্যালের সাথেও এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। ঘনচিনি পূর্বে সাধারণত ঔষধশিল্পে ব্যবহার করা হতো ঔষধের তিক্ততা দূর করে মিষ্টতা আনতে। এটি একটি ক্যালরি ফ্রি সুগার হওয়ায় এর ব্যবহার খাদ্যদ্রব্যেও বাড়তে থাকে। ঘনচিনির স্বাদও অনেকটা সাধারণ চিনির মতোই। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Food and Drug Administration (FDA) খাদ্যদ্রব্যে ঘনচিনির ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৯ সালে ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে পাওয়া যায় যে মাত্রাতিরিক্ত ঘনচিনি বৃক্কের ক্যান্সার হওয়ার জন্য দায়ী। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেট যখন আমাদের দেহে প্রবেশ করে তখন এর প্রায় ০-৬০% আমাদের অন্ত্রে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হাইড্রোলাইজ হয়ে সাইক্লোহেক্সিলামাইন (cyclohexylamine) তৈরি করে যার কিছু অংশ আমাদের শরীর কর্তৃক শোষিত হয় এবং বাকি অংশ মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। সাইক্লোহেক্সিলামাইনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নানান মতামত রয়েছে, তবে European Commission এটিকে একটি reproductive tixicant হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে artificial sweeteners গ্রহণের ফলে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া কমে যেতে পারে, ব¬াড সুগার নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্থ হতে পারে, বিভিন্ন ধরনের এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া ব্যক্তিভেদে মাথাব্যথা, ডিপ্রেশনের মতো উপসর্গগুলো কম বেশি দেখা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশে ঘনচিনির ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও প্রায় একশরও অধিক দেশে এখনও ঘনচিনি ব্যবহারের অনুমোদন আছে। কিন্তু তা অবশ্যই অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে। ঘনচিনি যে সকল দেশে খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শর্করাবিহীন পানীয়, চুইংগাম, আইস্ক্রিম, কেক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।JECFA (Joint FAO/WHO Expert Committee on Food Additives) এর তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ঘনচিনির দৈনিক গ্রহনযোগ্যতা প্রতি কেজি দৈহিক ওজনে মাত্র ০-১১ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তির ওজন ৬০ কেজি হয় তাহলে সে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬৬০ মিলিগ্রাম বা মাত্র ০.৬৬ গ্রাম ঘনচিনি গ্রহণ করতে পারবে। শিশুদের মিষ্টির প্রতি ঝোক বেশি থাকায় (WHO) এর মতে প্রতি কেজি খাবারে ২৫০ মিলিগ্রামের কম ঘনচিনি ব্যবহার করলে সাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘনচিনির ব্যবহার হয় JECFA বা WHO কর্তৃক অনুমোদিত মাত্রা থেকে কয়েকগুণ বেশি পরিমানে। ঘনচিনি বাংলাদেশে ঘোল,মাঠা, দই, মিষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মিল্কসেক,জুস, আইস্ক্রিম, আচারসহ যাবতীয় মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্যে চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি সাধারণত সরাসরি খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় চিনির সাথে অথবা কখনও কখনও স্যাকারিনের সাথে সমন্বয় করে ব্যবহার করা হয়। যদিও অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে ঘনচিনি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে এর মাত্রাবিহীন ব্যবহার আমাদের জনসাস্থ্যর জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশে ঘনচিনির আমদানি, বিতরণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন মুনাফালোভী অসাধু আমদানিকারক গোপনে এটি আমদানি করছে। যার ফলে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পরেছে ঘনচিনি নামের বিষ। আমাদের খাদ্যাভাস আমাদেরকেই পরিবর্তন করতে হবে। ভেজাল খাদ্যের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অস্বাভাবিক দামে ক্রয়-বিক্রয়ের ঝোক কমিয়ে ন্যায্যমূল্যে ক্রয়-বিক্রয়ের অভ্যাস করতে হবে। এছাড়া মার্কেট মনিটরিং আরও জোরদার করতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ Food Safety Authority, বিএসটিআইসহ সংশি¬ষ্ট অন্যান্য সংস্থা আরও তৎপর হলে আমরা ভেজাল খাদ্যের জাল থেকে বের হতে পারবো।
লেখক : ১প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অফ ফুড প্রসেসিং এন্ড প্রিজারভেশন, ২বিএসসি ইন ফুড এন্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং (৪র্থ বর্ষ), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর-৫২০০, মোবাইল: ০১৭৫০৭৭৭৮৯৯, ই-মেইল: maruffpp@gmail.com
নিরাপদ উপায়ে পানের বালাই দমন
নাহিদ বিন রফিক
অর্থনৈতিক বিবেচনায় পান একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। কোনো কোনো আদিবাসীদের প্রধান ফসল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত পান খান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভোজের শেষে বিশেষ আপ্যায়নের তালিকায় এর স্থান থাকে সবার উপরে। পুষ্টিবিদদের মতে, এর মধ্যে ২১ ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কম বেশি পানের চাষ হয়ে থাকে। দেশে পানের মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর আর মোট উৎপাদন প্রায় ২.৫ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য জেলাগুলো হলো : চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদাহ, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট এবং যশোর। অল্প পরিমাণ জমিতে পান চাষ করে যে লাভ আসে তা দিয়ে ৫ জনের একটি পরিবার সচ্ছলভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। তাই পানবরজকে পারিবারিক ব্যাংক বলা যায়।
দেশে-বিদেশে চাহিদার কারণে পানের বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পান রফতানি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তবে পানের গুণগত মান ঠিক না থাকায় কয়েক বছর আগে রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে ২০২১-২২ সাল থেকে আবারো পান রফতানি শুরু হয়েছে। পান যেহেতু কাঁচা অবস্থায়ই খেতে হয়। তাই এর আবাদ হওয়া চাই শতভাগ নিরাপদ।
নিরাপদ পান উৎপাদনের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চাষকৃত গুরুত্বপূর্ণ ফল, পান, সুপারি ও ডাল ফসলের পোকামাকড় শনাক্তকরণ ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিস্তার নামে একটি কর্মসূচি মাধ্যমে ফসলের ৫ ধরনের পোকা দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হলো : নারিকেল গাছে বিধ্বংসী সাদা মাছি পোকার আক্রমণ ও নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, নারিকেলে মাকড়ের আক্রমণ ও সমন্বিত নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, আমড়া পাতার বিটল পোকার আক্রমণ ও নিরাপদ দমন ব্যবস্থাপনা, মুগডালের ফুলের থ্রিপস এবং ফুল ও ফল ছেদক পোকাসমূহের দমন ব্যবস্থাপনা এবং পানের কালোমাছি পোকার নিরাপদ জৈবিক দমন ব্যবস্থাপনা।
পোকামাকড় এবং রোগবালাই পানের প্রধান সমস্যা। সম্প্রতি গবেষণাগারে পান পরীক্ষা করে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই পানের বালাইদমনে নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বরিশালের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পান ফসলে আক্রমণকারী প্রজাতির পোকামাকড়, চার প্রজাতির রোগ এবং এক প্রজাতির অন্যান্য বালাই শনাক্ত করা হয়েছে। পোকাগুলো হলো: কালোমাছি পোকা, সাদামাছি পোকা, পাতা খেকো লেদা পোকা, সাধারণ কাটুই পোকা, ছাতরা পোকা, মিলিবাগ, জাবপোকা, থ্রিপস পোকা, পানের শোষক পোকা, উইপোকা এবং ঘাসফড়িং এসব পোকা আক্রমণ করে থাকে। মাকড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র মাকড়। আর রোগের মধ্যে : পাতা পচা, পাতার দাগ বা ক্ষতরোগ, লতা কিংবা গিট বা কা- পচা এবং গোড়া বা মূল পচা রোগ এবং অ্যানথ্রাকনোজ হয়ে থাকে। আর শামুক হচ্ছে অন্যান্য বালাই। সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হচ্ছে কালোমাছি। দক্ষিণাঞ্চলের অনেকেই স্থানীয়ভাবে কালো কইতরী পোকা হিসেবে চেনেন। পানের কালোমাছি পোকা শুষ্ক মৌসুমে বেশি আক্রমণ করে থাকে। সাধারণত মার্চ-মে এবং আগস্ট-অক্টোবর মাসে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তবে বর্ষা ও শীত মৌসুমে উপস্থিতি কম থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকা ও বাচ্চা উভয়ই পানের কচিপাতার নিচের অংশ এবং কচিডগা থেকে রস চুষে খায়। ফলে পানের পাতা কুঁকড়ে বিকৃতরূপ ধারণ করে। সেইসাথে বাদামি বর্ণের দাগ পড়ে। এতে পাতার আকার ছোট হয়ে যায়। তাই এই পোকা দমন জরুরি। আর তা নিরাপদ উপায়েই সম্ভব। এ কাজের উপযুক্ত সময় হচ্ছে মার্চ মাস। তখন পানের বরজে হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য হেক্টরপ্রতি ৪০টির মতো ফাঁদ প্রয়োজন হবে। এ ধরনের ফাঁদ তৈরি করা অত্যন্ত সহজ। প্লাস্টিকের বৈয়মে হলুদ রঙ করে তাতে মবিল লেপ্টে দিলেই হয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির সিট আকৃতির ফাঁদ বাজারে পাওয়া যায়। যদি আক্রমণের মাত্রা বেশি হয়, তখন জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করা দরকার। এক্ষেত্রে একবার ফিজিমাইট এবং পরের বার বায়োক্লিন প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে পানের লতা এবং পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফিজিমাইট (১ মিলি./ লিটার) এবং সাকসেস প্রতি লিটার পানিতে ১.২ মিলি. হারে একই পদ্ধতিতে প্রয়োগ যেতে পারে। এভাবে ১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। এপ্রিল-মে মাস এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। পাতা খেকো লেদাপোকা দমনের জন্য গাছের গোড়ায় প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম লাইকোম্যাক্স স্প্রে করতে হবে। বিকল্প হিসেবে হেক্টরে ৭ কেজি হারেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সাকসেস ১.২ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পানপাতায় স্প্রে করা যাবে। পানের লতা ও কা- পচা রোগের জন্য মে-আগস্ট মাস পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর পর্যায়ক্রমে লাইকোম্যাক্স প্রয়োগের পাশাপাশি ট্রাইকোডার্মা কিংবা চুন, তুঁতে আর পানি মিশ্রণের (১ঃ১ঃ১০০) বর্দোমিক্সার ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া পাতা পচা রোগের জন্য ডাইনামিক ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে বরিশাল অঞ্চলের ৬ জেলার ১৩ উপজেলার ১৫ হেক্টর বরজে নিরাপদ পান উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আশেপাশের পানচাষিদের মধ্যে। তারা এখন বেশ উৎসাহিত।
যেকোনো প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়। তাই রোগপোকা প্রতিরোধে পানবরজ পরিষ্কার রাখতে হবে। সেই সাথে দরকার সুষ্ঠু সার ব্যবস্থাপনা এবং সময়মতো পরিচর্যা। এ ছাড়াও চাই নিয়মিত পরিদর্শন। এর মাধ্যমে পান ফসল থাকবে অনুকূলে। সম্প্রতি উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অল্পখরচে এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই পানের কালো মাছিসহ অন্যান্য পোকার উপদ্রব খুব সহজেই দমন করা যাবে। এ ছাড়া বালাইও থাকবে নিয়ন্ত্রণে। ফলে পানের শতকরা ৫৫-৫৮ ভাগ ফলন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। তাই নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদনে লাগসই এই প্রযুক্তিগুলো সারাদেশে সম্প্রসারণ করা দরকার। এতে কৃষকের আয় বাড়বে। হবে জীবনমানের উন্নয়ন। আর জাতীয় অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
লেখক : নাহিদ বিন রফিক, টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর: ০১৭১৫৪৫২০২৬; ই- মেইল:tpnahid@gmail.com
মাশরুম একটি অসীম সম্ভাবনাময় ফসল
ড. আক্তার জাহান কাকন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপোযোগী দিকনির্দেশনা ও কৃষি খাতে অকুণ্ঠ সমর্থনে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের এখন লক্ষ্য কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও লাভজনক করা এবং সকলের জন্য পুষ্টিসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মাশরুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মাশরুম একটি পুষ্টিকর (উন্নত মানের আমিষ, ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ), সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন ফসল। মাশরুম চাষ করার জন্য কোন আবাদি জমির প্রয়োজন হয়না। অনুৎপাদনশীল ফেলনা জমির স্বল্প পরিমাণ ব্যবহার করেই অধিক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করা যায় বিধায় মাশরুম চাষ বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিতে পারে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ কৃষিজ, শিল্পজ ও বনজ উপজাত যেমন- খড়, আখের ছোবরা, ভুট্টার কব ও কাঠের গুঁড়া উৎপন্ন হয়, তা দিয়েই মাশরুম উৎপাদন সম্ভব। মাশরুম একটি জৈব ফসল কারণ এটি চাষের জন্য কোন কীটনাশক, রোগনাশক এমনকি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়না। মাশরুম স্বল্প পুজিঁতে চাষ শুরু করা যায়। বেকার, প্রতিবন্ধী ও মহিলাদের বিশেষ করে গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী মাশরুমের চাহিদা আছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া সারাবছর মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী। মাশরুম ঘরে চাষ করা হয় বিধায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খড়া, বন্যা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাশরুমের কোন ক্ষতি করতে পারে না।
সম্ভাবনাময় এ ফসলটির চাষ সম্প্রসারণের প্রধান অন্তরায় আমাদের খাদ্যাভ্যাসে মাশরুম না থাকা। এদেশের প্রচলিত অন্যান্য ফসলের চাষ পদ্ধতির সাথে মাশরুম চাষ পদ্ধতির মিল না থাকা এবং মাশরুম চাষে উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ও উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হওয়া। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এদেশে মাশরুম চাষের উপযোগী স্বল্পখরচের যন্ত্রপাতি ও সহজ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, তবুও এসব যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জনগণের ব্যাপক পরিচিতির অভাব রয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে, মাশরুমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য, ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মাশরুম চাষে সম্পৃক্ত করতে বর্তমান সরকার ৫ বছর মেয়াদে (জানুয়ারি ২০২৩ হতে ডিসেম্বর ২০২৭) ৯৬৬৪.১১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করেছেন, যেখানে সহজ সরল প্রযুক্তির প্রদর্শন থাকবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে এবং আরও নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের সুযোগ থাকবে।
অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় ফসল উপখাতের কৌশলসমূহে পুষ্টিকর, নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, বসতবাড়ির আঙ্গিনায় খালি জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিশেষ জোর দিয়ে হলিস্টিক ফার্মিং সিস্টেম এ্যাপ্রোচ এর মাধ্যমে কৃষকদের জীবিকা ও আয় বৃদ্ধি করা, প্রধান খাদ্যে (চাল) এরই মধ্যে অর্জিত স্বয়ম্ভরতা অক্ষুণœ রেখে বিদ্যমান ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, ভূমির ঠবৎঃরপধষ ঊীঢ়ধহংরড়হ এর মাধ্যমে নগর কৃষির প্রসার, কৃষিতে নারী ও যুবদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, মাশরুমের গুণাগুণ, সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ফলে দেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মাশরুম রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি, নতুন মাশরুম উপকেন্দ্র স্থাপন, পুরাতন উপকেন্দ্র ও মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশে ভূমির ঠবৎঃরপধষ ঊীঢ়ধহংরড়হ বৃদ্ধি পাবে। এতে মাশরুম চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এবং ৩৪টি মাশরুম উপকেন্দ্র/হর্টিকালচার সেন্টার রিসোর্স সেন্টার হিসেবে এবং ৬৪টি জেলার ১৬০টি উপজেলা ও ১৫টি মেট্রোপলিটন থানা সম্প্রসারণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। প্রকল্প সমাপ্তে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এবং ৩৪টি মাশরুম উপকেন্দ্র/হর্টিকালচার সেন্টারকে প্রদত্ত অর্থ রিভলব করার জন্য এবং উদ্যোক্তার বাড়িতে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য প্রদর্শনীর বীজ/স্পণ ও মাশরুম বিক্রির লভ্যাংশ থেকে যন্ত্রপাতি, চাষঘর মেরামত ও স্পণ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে তাতে সকলের বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।
মাশরুম নতুন ও অপ্রচলিত ফসল এবং প্রচলিত আবশ্যিক অন্যান্য ফসলের মতো কোন খাদ্য না হওয়ার কারণে এতদিনেও মানুষের তেমন কোন চাহিদা তৈরি হয়নি। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় আমাদের খাদ্যাভাসে মাশরুম যুক্ত করলে দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাস; এরা প্রতিদিন মাত্র ২৫ গ্রাম করে মাশরুম খেলেও বছরে ১৬৪২০০০০ মে. টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। আর ১০% মানুষও যদি মাশরুম খান তাহলে প্রতিদিন ৪৫০ মে. টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০-৪২ হাজার মেট্রিক টন মাশরুম প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
যে সকল জেলায় হর্টিকালচার সেন্টারে কার্যক্রম চালু আছে, বড় উদ্যোক্তা আছে, সেখানে সাধারণ চাষিদের উৎপাদনের আগ্রহ বেশি কারণ উদ্যোক্তারা তাদের বাজারের নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে অধিক মাশরুম উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব উৎপাদিত মাশরুম স্থানীয় কাঁচা বাজার (বিশেষ করে পাহাড়ে), ফ্রাই শপে, সুপার শপে, ছোট ছোট হোটেলে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মাশরুমজাত বিভিন্ন পণ্য যেমন : স্যুপ, আচার, ফেসপ্যাক, হেয়ার ওয়েল, সাবান, মাশরুম ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, শুকনা ও পাউডার মাশরুম বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মাশরুম খাওয়ার পদ্ধতি জনগণের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করলে ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে ও বাজার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অনেক দেশেই মাশরুম রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। শিক্ষিত বেকার যুবক, যুবতীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে পারলে মাশরুমের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন হওয়ায় সহজেই মানুষের পুষ্টি চাহিদার অনেকটা পূরণ হবে। আশা করা যায় মাশরুম চাষের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সারা দেশে দ্রুততার সাথে কৃষক ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করার মাধ্যমে অচিরেই বাংলাদেশে এক অসবুজ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক (উপপরিচালক), মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প, সাভার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮১৩৭১১৩; ই-মেইল : kakon.smdp@gmail.com
স্মার্ট কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার
সমীরণ বিশ্বাস
কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সাথে স্মার্ট কৃষিতে পরিণত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার অন্যতম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব নয় এমন ক্ষেত্র খুব কমই আছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য কৃষি একটি উজ্জ্বল ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে কৃষিতে উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু করেছে। আর এগুলো উৎপাদনকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষিকাজকে করেছে ব্যাপক সহজ। জমি রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে কৃষির মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে।
ইন্টারনেট অব থিংকস (IOT), রোবটিক্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বিগ ডাটা, থ্রিডি প্রিন্টিং, সব উপাদানসমূহ নিয়েই স্মার্ট এগ্রিচালচার গঠিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে লেন্স জুম ব্যবহার করে মেশিনকে আকার ও টেক্সচার সম্পর্কিত ধারণা প্রদান করা যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন, মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, আগাছার উপস্থিতি, আগাম ফসল ব্যবস্থাপনা ফুল, ফল এর সময় নির্ণয়, ফসলের সম্ভাব্য পরিমাণ ইত্যাদি নির্ণয় করা যায়। সার ও বালাই ব্যবস্থাপনাও খুব সহজেই করা যায়। ফলশ্রুতিতে কৃষিক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় ভবিষ্যতের কৃষি ও কৃষককে সুরক্ষা দিতে স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তরিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। ক্রপ মডেলিং, প্রিসিসন এগ্রিকালচার এখন ব্যাপক সুপরিচিত, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কৃষিতে দিনে কয়েক হাজার বীজ বপন করে চারা স্থান্তরিত করা খুবই সাধারণ দৈনন্দিন ঘটনা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টোলিজেন্স ব্যবহার করে বপন উপযোগী চারা সহজেই শনাক্ত করা যায় একই সাথে পরিপক্ব ফসল শনাক্ত করার পাশাপাশি ফসলের সম্ভাব্য ফলন বের করা যায়। কোন জমিতে কি পরিমাণ সার, বীজ, কীটনাশক প্রয়োজন তা সিমুলেশন মডেল থেকে পূর্বেই ধারণা পাওয়া যায়। স্যাটেলাইট দিয়ে ইমেজিং করে ফার্টি/ড্রোন ব্যবহার করে জমির ফার্টিলিটি নির্ণয় করে সার ও বীজ প্রয়োগ ও বপন করা যায়। একইভাবে ওড়ঃ ডিভাইস কাজে লাগিয়ে জমিতে চাহিদা অনুপাতে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। এতে করে একদিকে যেমন পানির অপচয় রোধ করা যায় অন্যদিকে সঠিকসময়ে সেচের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশের কৃষিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে উঠেছে শিক্ষা এবং আধুনিক কৃষি ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার অংশ। ইতিমধ্যে কৃষিতেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু হয়েছে। তারি ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) ধানের রোগবালাই চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে ‘রাইস সল্যুশন’ (সেন্সরভিত্তিক ধানের বালাই ব্যবস্থাপনা) নামক একটি মোবাইল অ্যাপস উদ্বোধন করা হয়েছে। যা, ধানের খেত থেকেই আক্রান্ত ধান গাছের ছবি দেখে রোগ চিহ্নিত করতে সক্ষম। ২ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার- কৃষিমন্ত্রী গাজীপুরে ব্রিতে অনুষ্ঠিত ছয় দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ মোবাইল অ্যাপসটি উদ্বোধন করেন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নেদারল্যান্ডসের টুয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র যৌথভাবে ‘স্টারস’ প্রকল্পের আওতায় দেশের কৃষি গবেষণায় আধুনিক, উন্নত ও কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
কৃষি খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে “ই-ভিলেজ” নামক প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। সেন্সরের মাধ্যমে ফসল বা সবজির ক্ষেত থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। “ই-ভিলেজ” নামক এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা যায়, ফসল সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে ফসলে কোন রোগ দেখা দিয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সাথে সাথেই জানা যায় এবং সেই সাথে অ্যাপ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে কৃষক তার উৎপাদন খরচ কমিয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে পারবেন। এই প্রজেক্টের আর্থিক সহায়তায় রয়েছে চীনা দূতাবাস।
কৃষিতে (AI) প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একদল তরুণ আইটি ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদগণ যুগন্তকারী ‘ডা. চাষি’ মোবাইল এ্যাপ গুগোল প্লে-স্টোরে রিলিজ করেছেন। এ এ্যাপ দিয়ে পাওয়া যায়। ছাদ-বাগান এবং মাঠ ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের সঠিক তথ্য ও সমাধান। এ এ্যাপ দিয়ে ফসলের আক্রান্ত স্থানের ছবি তুলেই ‘ডা.চাষি’ বলে দিবে ফসলের সমস্যা ও সমাধান।
ড্রোনের সঙ্গে অও কাস্টমাইজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইন্টিগ্রেট করলে ড্রোন একবার ফসলের খেতের উপর দিয়ে উড়ে গেলে ঐ এলাকার যে সার্বিক অবস্থা জানান দিতে সক্ষম তা হলো ফসলের মাঠের আর্দ্রতা পরিমাপ; ফসলে উপাদানের উপস্থিতি নির্ধারণ; শস্য রোপণ ডিজাইন; বীজ বপন; পোকার আক্রমণ জানা (ইমেজ প্রযুক্তি); কীটনাশক স্প্রে; সেচ মনিটরিং; ফসলের উৎপাদন জানা; ফসলের সার্বিক মনিটরিং করা; মাটির নিউট্রেন্ট; আর্দ্রতা; তাপমাত্রা; পিএইচ; লবনাক্ততা ফসলের নিউট্রেন্ট এর অভাব ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের উপস্থিতি জানা, কৃষি ওয়েদার ফোরকাস্টিং এন্ড আগাম এলার্মিং দেয়া, ফসলের আগাম সম্ভাব্য ফলনের পূর্বাবাস দেয়া , কৃষি কলসেন্টার সেবা দেওয়া, সর্বোপরি কৃষিপণ্যের বাজারদর জানা।
স্মার্ট ফারমিং/কৃষিতে ডিজিটালাইজেশন, অর্থাৎ আগামীতে কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও প্রযুক্তি) সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ; কৃষিকে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধদীপ্ত প্রযুক্তিভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়।
লেখক : লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, মদিনা টেক লিমিটেড, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭৪১১২২৭৫৫, ই-মেইল :srb_ccdbseed@yahoo.com
আলফা আলফা
ঘাস চাষ পদ্ধতি
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
গবাদিপশুর দৈনিক খাদ্য তালিকার প্রধান উপাদান হলো কাঁচা ঘাস। প্রবাদ আছে “গাভীর মুখে দিলে ঘাস, দুধ পাবে বারো মাস”। গবাদিপশুর স্বাস্থ্য রক্ষা, দুধ উৎপাদন ও বৃদ্ধির জন্য ঘাস প্রয়োজন। দেশি ঘাসের উৎপাদনও কমে গেছে, তাই উন্নত জাতের অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ঘাসের চাষ করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আলফা আলফা ঠিক তেমনই একটি উৎকৃষ্ট মানের ঘাস। এ ঘাসকে পশু খাদ্যের “রাণি” বিবেচনা করা হয়।
এ ঘাসের অপর নাম “লুছার্ন”। ইহা একপ্রকার লিগুম জাতীয় ঘাস। একবার চাষ করলে ৪-৫ বছর পর্যন্ত ঘাস সংগ্রহ করা যায়। এ ঘাসের উৎপত্তি পশ্চিম এশিয়াতে তবে ইরানে প্রথম চাষ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর সব দেশেই চাষ করা হয়ে থাকে। তবে আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে বেশি উৎপাদিত হয়।
এ ঘাস অতিরিক্ত গরম বা ঠা-া সহ্য করতে পারে না। ইহা বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। শীতকালের যে কোন সময় বপন করা যায়। তবে অক্টোবর জানুয়ারি হলো উত্তম সময়।
রোপণ পদ্ধতি
জলাবদ্ধ জমি ছাড়া যে কোন জমিতে চাষ করা যায় তবে দো-আঁশ মাটি উপযুক্ত।
শুকনো জমিতে ভালভাবে চাষ দিতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে গোবর সার দিতে হবে এবং মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে। একর প্রতি ৫০ কেজি টিএসপি সার চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
এ ঘাসের বীজ ছিটিয়ে বা সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা যায়। ছিটিয়ে বপন করলে একরপ্রতি ৫-৭ কেজি এবং ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে রোপণ করলে ৪-৬ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। প্রতি গর্তে ৩-৪টি বীজ দিতে হবে এবং একটি থেকে আরেকটি গর্তের দূরত্ব ৫ সেন্টিমিটার। ১-২ সেন্টিমিটার গভীরে রোপণ করতে হয়। তবে বীজ বপনের আগের দিন বিকালে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বীজের মুখ ফেটে গেলে চারা গজাতে সুবিধা হবে। বীজ থেকে চারা না হওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহেই সেচ দিতে হয়। তবে পরবর্তীতে ২১ দিন পরপর সেচ দিলেই চলে।
এ ঘাস ডালজাতীয় (লিগুম) ঘাস তাই নাইট্টোজেন সংযোজন ব্যাকটোরিয়া বাতাস হতে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে। তাই পানি সেচের পর প্রতি একরে ৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করলে উৎপাদন বেশি হবে।
ঘাস কাটার নিয়ম
প্রথম বার ফুল ফোটার সময় কাটতে হয় এবং পরবর্তীতে ৩৫-৪০ দিন পরপর ঘাস কাটতে হবে। ২-৩ ইঞ্চি উপরে হতে ঘাস কাটতে হয়। এতে অপচয় কম হয় এবং পরবর্তীতে ফলনও বেশি হয়। বছরে ৮-১০ বার ঘাস কাটা যায়। একর প্রতি উৎপাদন প্রায় ২৫-৩০ মে.টন/বছর।এ ঘাসের বড় সুবিধা হলো এর পুষ্টি উপাদান অন্য যে কোন খাবারের চেয়ে দ্রুত শরীরে শোষিত হয়।
পুষ্টি উপাদানসমূহ
ড্রাই ম্যাটার ২০%; ক্রড প্রোটিন ২১-২৩%; ক্রড ফাইবার ২৬.৬%; ক্রড ফ্যাট ২.৯%; নিউট্রাল ডিটারজেন্ট ফাইবার ৩৯.৩%; আঁশ ১১.৫%; লিগনিন ৭.৬%; হজমযোগ্য এলার্জি ১১.৯%; গ্রস এনার্জি ১৮.১ মেগাজ্জল/কেজি; ক্যালশিয়াম ১৯.৪%; ম্যাগনোশিয়াম ৭৬ মি. গ্রাম/কেজি।
আলফা আলফা ঘাসে সরগম ঘাস অপেক্ষা ৫ গুণ বেশি আমিষ এবং ভিটামিন বিদ্যমান। গবেষণায় জানা গেছে ফুল ফোটার আগে কাটলে ঘাসে আমিষ ৩% অন্যান্য পুষ্টি ১৭.৪% এ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম কেরোটিন এবং সামন্য পরিমাণে ফসফরাস থাকে। উচ্চমাত্রার বিটা কেরোটিন ও ভিটামিন গরুর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ঘাস খাওয়ানোর নিয়ম গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হলে দৈনিক খাদ্য তালিকার ০.৭৫ কেজি দানাদার, ১ কেজি শুকনা খড় এবং ৪ কেজি কাঁচা আলফা আলফা ঘাস সরবরাহ করা উচিত। গাভীকে ইউএমএস খাওয়ালে ০.৫ কেজি দানাদার ২.৫-৩ কেজি কাঁচা আলাদা আলাদা ঘাস এবং ২ কেজি ইউএমএস দিলেই হবে। এই হিসাব অনুযায়ী গাভীর ওজন অনুপাতে খাদ্য নির্ধারণ করে অর্ধেক সকালে, অর্ধেক অংশ বিকালে খেতে দিতে হবে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
ঘাসে ফুল হওয়ার আগেই কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে “হে” আকারে সংরক্ষণ করা যায়, কাঁচা ঘাস ২-৩ দিন উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। কোনভাবেই যেন আর্দ্রতা ১৪% বেশি না থাকে।
সতর্কতা
এ ঘাসে কিছু পরিমাণে ব্লোটিং এজেন্ট, ফাইটোস্ট্রজেন এবং স্যাপোনিন থাকে। কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর আগে কয়েক ঘণ্টা রৌদ্রে রেখে দিতে হবে। প্রজনন করানোর ১৫ দিন আগে এবং পরে ৭ দিন এ ঘাস অধিক পরিমাণে খাওয়ানো উচিত নয়। (তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট/ ডিএলএস পুস্তিকা)
লেখক : ভেটেরিনারি অফিসার, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ঝিনাইদহ, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল : suzan.dof@gmail.com
বর্ষাকালে মাছ চাষে করণীয়
মোঃ লতিফুর রহমান সুজান
বর্ষাকালে নদী খাল বিল থই থই থাকে পানিতে। মাছ চাষের জলাশয় বা পুকুর থাকে পানিতে পরিপূর্ণ। মাছের প্রাকৃতিক আধার হিসেবে বিল ও ছড়া জাতীয় জলাশয়গুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবনভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রজনন করে তাদের বংশধারা বজায় রাখে এবং নার্সারি ও বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। আবার বর্ষা মৌসুমে বিলের নিকটবর্তী ফসলের জমিগুলো যখন পানির নিচে প্লাবিত হয়, তখন অধিকাংশ স্থানেই এগুলো হয়ে যায় অব্যবহৃত সম্পদ। সামান্য কিছু সংস্কারের মাধ্যমে এসব মাঠের বর্ষার পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে মাছচাষ করা সম্ভব। প্লাবনভূমির একই মাঠে অনেক কৃষকের ফসলের জমি থাকে বিধায় এখানে প্রয়োজন সবার সম্মতি, ঐক্যবদ্ধতা। প্লাবনভূমিতে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণ যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবেই লাভবান হয় তা নয়, বরং এলাকাজুড়ে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনও হয়।
জলাশয়ে ব্রুড মাছ বা মা মাছ মজুদ করা এবং মাছ বড় হওয়ার এখন উৎকৃষ্ট সময়, তাই মাছচাষি সঠিকভাবে এই কাজটি করতে পারেন। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ মাছ চাষ হয়ে থাকে। তবে মাছচাষে ঋতুভেদে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তা না হলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় এবং মাছ চাষে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। তাই মাছ চাষের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়। বর্ষা মৌসুমে মাছ চাষে সতর্কতা
বৃষ্টির পানি কিছুটা অম্লীয়, তাই পুকুরে পানির পিএইচ মান কমে যেতে পারে। সেজন্য বৃষ্টির পর পানির পিএইচ পরীক্ষা করে প্রয়োজনমতো পাথুরে চুন পরিমাণমতো পানিতে গুলে ঠা-া করে প্রয়োগ করতে হবে।
বৃষ্টির পানি কিছুটা ঠা-া হওয়ায় অতি বৃষ্টিতে পুকুরে পানির তাপমাত্রা এবং পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। যদি কোন কারণে পুকুরে অক্সিজেন সংকট দেখা দেয় তবে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতা দূর করার জন্য প্যাডেল হুইল এরেটর, ডাবল স্পিড এরেটর, পুশ ওয়েব এরেটর, কুলিং এরেটর ইত্যাদি, যা পুকুরে স্থাপন করে কার্যকরভাবে এই সমস্যা দূর করা যায়। কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহে জিওলাইট বালুর সাথে মিশিয়ে পুকুরের সর্বত্র প্রয়োগ করে অক্সিজেন স্বল্পতার সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বর্ষা মৌসুমে মাছ চাষের পুকুরগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে যেতে পারে। তাই মাছ চাষের পুকুর থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পানি ঢুকানোর পথের ছাঁকনিটি দু’স্তর বিশিষ্ট হতে হবে। এর প্রথমটির ফাঁস ১.৫ মিমি এবং দ্বিতীয়টির ফাঁস ০.৫ মিমি। পানি বের হবার পথে একটি ছাকনি থাকলেই চলে। এ জালের ফাঁস হবে ১.৫ মিমি। ছাঁকনির বাইরে একটি নিরাপত্তা বানার ব্যবস্থা রাখলে মূল ছাঁকনিটির কার্যক্ষমতা বাড়বে। প্রয়োজন অনুযায়ী পানি বদল করার সুবিধা কাজে লাগানো যায়।
পুকুরের পানি নিয়মিত পরীক্ষা ও খেয়াল রাখতে হবে। মাছ চাষের জন্য তাপমাত্রা ২৮-৩১ ডিগ্রি সে., দ্রবীভূত অক্সিজেন কমপক্ষে ৫ পিপিএম বা মিলিগ্রাম/লিটার, কার্বন ডাই-অক্সাইড ১২ মিলিগ্রাম/লিটার এর নিচে, এমোনিয়া ০.০২৫ মিলিগ্রাম/লিটার এর নিচে, পিএইচ ৭.৫-৮.৫, ক্ষারত্ব ৪০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার, ঘোলাত্ব ২০০০০ মিলিগ্রাম/লিটার এর নিচে, স্বচ্ছতা ২৫-৩০ সেন্টিমিটার।
পুকুরে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট জায়গায় খাদ্য দিতে হবে। তবে বৃষ্টির দিনে মাছ চাষের পুকুরে সার ও খাদ্য দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে মাছের রোগবালাই তুলনামূলক কম হয়। মাছ চাষে প্রতি মাসে প্রতি শতকে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি হারে (পানির পিএইচ পরীক্ষা করে) পাথুরে চুন পরিমানমত পানিতে গুলে ঠা-া করে প্রয়োগ করতে হবে।
চুন প্রয়োগ করলে মাটি ও পানির অম্লতা প্রশমিত করে; সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি; ক্ষতিকর গ্যাস ও রোগজীবাণু দূর করে; চুনের ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান; প্লাঙ্কটন বৃদ্ধির জন্য কাদায় আবদ্ধ ফসফরাস মুক্ত করে; পানির ঘোলাত্ব দূর হয়।
মাছচাষের পুকুরে পরিমাণমতো চুন পানিতে গুলে ঠা-া করে পুকুরের সর্বত্র ছিটিয়ে দিতে হবে। মাটি ও পানির পিএইচ পরিমাপ করে সাধারণ প্রয়োগমাত্রা ০.৫-১ কেজি/শতক হারে চুনের পাশাপাশি জিওলাইট ব্যবহার করতে হবে।
বর্ষার ভরা মৌসুমে অবিরাম বৃষ্টি বা আকস্মিক বন্যার পানিতে পাড় ডুবে মাছ ভেসে যেতে পারে। আবার বৃষ্টির সময় পুকুরে যাতে বাইরের ময়লা পানি গড়িয়ে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ সময় পুকুরের পাড় উঁচু করে দিতে হবে। পুকুর পাড় এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে পানি বৃদ্ধির কারণে পুকুর থেকে কোন মাছ বের হয়ে যেতে না পারে।
অতি বৃষ্টিতে/বন্যার সময় পুকুরে মাছ আটকানোর জন্য পুকুর পাড়ের চারদিকে মশারির নেট বা জাল, বাঁশের বানা দিয়ে ঘের/বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের কোণায় ও মাঝখানে ঝোপঝাড় দিয়ে মাছের আশ্রয়স্থল বানাতে হবে। মাছ দ্রুত আকৃষ্ট হয় এমন খাবার যেমন সরিষার খৈল, চিটাগুড় পুকুরে দুই বা তিন স্থানে দিয়ে রাখা যেতে পারে।
পুকুর পাড়ে/পুকুরের কাছাকাছি বড় গাছ থাকলে গাছের কা- কেটে ফেলতে হবে। পুকুরে ডাল বা পাতা পড়া উচিত নয়।
বর্ষায় ডুবে যাওয়া পুকুর বা জলাশয়ে বর্ষা পরবর্তী পোনার চাহিদা মেটানোর জন্য খাঁচায় পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
মাছ চাষে লাভবান হওয়ার জন্য পুরো বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে হয়। মাছ চাষের ক্ষেত্রে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মাছ চাষের যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ১৬১২৬ এই নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে অথবা মৎস্য পরামর্শ সংক্রান্ত মোবাইল অ্যাপ ‘উৎ. ঋরংয (মাছের ডাক্তার)’ থেকে মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
লেখক : সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার, গাজীপুর সদর। মোবাইল : ০১৭৬৫১১১৪৪৪, ই-মেইল :suzan.dof@gmail.com
বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে
ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাত ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৬, বঙ্গবন্ধু ধান১০০ ও ব্রি ধান১০২
কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন
ধান উৎপাদনে সর্বাধিক উৎপাদনশীল মৌসুম বোরো। এ কথা অনস্বীকার্য বোরোর ওপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। কেননা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৮ ভাগ আসে এ মৌসুম থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ লাখ ৭৬ হেক্টর আর আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল। মাঠে কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্ত ব্লাস্ট আক্রমণ ছাড়া কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি কম হওয়ায় এবার বোরো ধানের ফলনের অবস্থা বেশ ভালো ছিল, হাওরের ধানও নির্বিঘেœ শতভাগ কৃষকের ঘরে উঠেছে। ফলে আশা করা হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বোরোর উৎপাদন ১০ লাখ টন বেশি হবে। শুধুমাত্র হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর এই ৭টি জেলায় হাওর ও হাওরের বাইরে উচুঁ জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে যেখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। কিন্তু ধান কাটার পর বিঘাপ্রতি গড় উৎপাদনের ধারা দেখে সবাই বলছেন এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বোরোর উৎপাদন।
এতদিন ধরে বোরোর সেরা জাত ছিল ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯। ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত এই দুটি বোরো জাত দেশের মোট বোরো এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ দখল করে ছিল। অনেক বিকল্প জাত উদ্ভাবিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে বোরো আবাদে কৃষকদের বড় একটি অংশের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জাত ছিল ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আবাদ হওয়া এই জাত দুটোর রোগবালাই সহনশীলতা ক্রমে হ্রাস পাওয়ায় স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা এ জাত দুটি আবাদে নিরুৎসাহিত করে আসছিলেন। পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত বিকল্প জাত ব্রি ধান ৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ৯৬ বঙ্গবন্ধু ধান১০০ ও ব্রি ধান১০২সহ কয়েকটি জাত চাষ করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। রোগবালাই সহনশীল ও উচ্চফলনের কারণে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর প্রতি কৃষকের আস্থা ক্রমশ বেড়েছে। এবার মাঠে কৃষকের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে এ ৫টি বোরোর জাত। কৃষকরা বলছে এই জাতগুলোর ফলন আশাতীত ও অভাবনীয়।
কৃষকের বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত নতুন এসব জাত। এবার এলাকাভেদে নতুন জাতগুলোর গড় ফলন ছিল বিঘাপ্রতি ২৮-৩৩ মণ। কোথাও কোথাও তার বেশি ফলনের রেকর্ড রয়েছে। এতদিনের আকাক্সিক্ষত সেই বিকল্প জাত এখন কৃষকের হাতে হাতে।
গত ৩০ এপ্রিল ২০২৩ কৃষি সচিব জনাব ওয়াহিদা আক্তার ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর সংস্থার প্রতিনিধি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী ইউনিয়নের রামচন্দ্রর গ্রামে দুটি স্থানে মাঠ দিবস ও ফসল কর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। উপজেলায় ৪৮ জন কৃষকের ১৫০ বিঘা যৌথ জমিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে। যৌথ চাষাবাদের কৃষক দুলহাস শেখ জানালেন “আগে আমাদের এখানে ৩৩ শতাংশের বিঘায় যেখানে ১৮ থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যেত এখন সেখানে আমাদের ধান গবেষণা উদ্ভাবিত ধান (ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৯ এবং বঙ্গবন্ধু ধান১০০) চাষ করে বিঘায় ৩৩ মনেরও বেশি ধান ফলন হচ্ছে এবং যার ফলে আমি ও আমার প্রতিবেশী কৃষকরা খুশি। একটা সময় ধান চাষে পরিশ্রম বেশি হওয়ায় ধান চাষে কৃষকের অনীহা দেখা যেত কিন্তু এখন সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও প্রণোদনা সহায়তার কারণে কৃষক পতিত জমিতে ধান চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে। নতুন জাতের ধানের ফলন ভালো হওয়ায় বেশ লাভবান হচ্ছে।” অনুরূপভাবে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমরিয়া গ্রামের কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, “ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু ধান১০০ ধান বীজ ও সার বিনামূল্যে পাই। দারুণ ফলন পেয়েছি। বিঘায় প্রায় ৩০মণ। এই জাতের ধানে রোগবালাই নেই। ভবিষ্যতে আমি এই ধানের চাষ আরো বাড়াবো।”
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জ জেলার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে বঙ্গবন্ধু ধান১০০ চাষ হয়েছে। এরমধ্যে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৬ হেক্টর, মুকসুদপুরে ৩৫ হেক্টর, কাশিয়ানীতে ১৮ হেক্টর, কোটালীপাড়ায় ১৯০ হেক্টর ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ১৯৬ হেক্টরে নতুন এই ধানের চাষ হয়েছে। কোটালীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় বলেন, “কোটালীপাড়া উপজেলায় বঙ্গবন্ধু ধান১০০ কাটা শুরু হয়েছে। আমরা নমুনা ফসল কর্তন করে দেখেছি প্রতি হেক্টরে এই ধানের ফলন হয়েছে সাড়ে ৭ টন। জিংক সমৃদ্ধ এই ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকেরা এই জাতের ধানের চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।”
অনুরূপভাবে প্রায় ৫০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু ধান১০০ আবাদকারী দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক মতিউর রহমান জানান, অন্যান্য ধানের তুলনায় এ ধানের ফলন ভালো। পাশাপাশি এ ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড় আক্রমণ রোধ করার ক্ষমতা থাকায় উৎপাদন খরচও কম হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতি একর জমিতে এ ধানের ফলন হয়েছে ৮৫ মণ, যা অন্যান্য ধানের তুলনায় বেশি। কম সময়ে ভালো ফলন ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এ ধান আবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন অন্য কৃষকরাও। ইতোমধ্যেই তার কাছে বীজ চাইতে আসছেন অনেক কৃষক।
কালীগঞ্জ উপজেলার ধনপুর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আলতাফ হোসেন প্রবাসে থাকতেন। তিনি জানালেন, ‘ধানের নতুন জাত ব্রি ধান৯২ চাষ করে প্রতি বিঘায় ফলন পেয়েছি ৩৩ মণ, যা কল্পনাতীত। এ জাতের ধান চাষে পানি কম লাগে, কীটনাশক লাগে না বললেই চলে। তিনি বলেন, ‘আগে বিদেশে ছিলাম। কৃষিকাজ করতে আগ্রহ বোধ করতাম না। ভাবতাম কৃষির চেয়ে প্রবাসে চাকরিই লাভজনক। কিন্তু ব্রি ধানের নতুন জাত আমার ধারণা বদলে দিয়েছে। আর বিদেশ নয়; দেশেই কৃষিকাজ করব।’
বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে বিঘাপ্রতি সাড়ে ২৮ মণ ফলন দিয়েছে ব্রি ধান৯২। লাভজনক হওয়ায় খরা সহিষ্ণু ও পানি সাশ্রয়ী এই জাতের ধান জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ অঞ্চলে। চলতি বোরো মৌসুমে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধোকড়াকুল এলাকায় ১১০ বিঘা জমিতে চাষ হয়েছে উচ্চফলনশীল এই ধান। আর এই উদ্যোগে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) রাজশাহী আঞ্চলিক অফিস।
বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের চরগাছিয়া গ্রামের একটি মাঠে ২০০ বিঘা জমি এবার প্রথমবারের মতো বোরো চাষের আওতায় এসেছে, আগের বছরগুলোতে এই সময়ে জমিগুলো পতিত থাকত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্যোগে এবং উপকূলীয় শস্য নিবিড়করণ কর্মসূচি’র আওতায় ওই ২০০ বিঘা (২৭ হেক্টর) জমিতে ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৭ ও ব্রি ধান৯৯ জাতের ধান চাষ করা হয়। ৩০০ জন কৃষককে বীজ, সেচ, সারসহ সকল উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ফলে এ বছর মাঠজুড়ে চাষ করা হয়েছে ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৯ ও বঙ্গবন্ধু ধান ১০০। নমুনা শস্য কাটায় রেকর্ড ফলন পাওয়া যায়। যেখানে প্রতি বিঘাতে ব্রি ধান৮৯ এর ফলন হয়েছে ৩৭ মণ এবং ব্রি ধান৯২ হয়েছে বিঘায় ৩৩ মণ। এছাড়া ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪ ও ব্রি ধান৯৯ হয়েছে প্রতি বিঘায় ২৮ মণ করে।
১৭ মে ২০২৩ মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার মুশুদ্ধি-কামারপাড়া গ্রামে ব্রি ধান৯২ ও ব্রি ধান১০২ এর ফসল কর্তন ও কৃষক সমাবেশে সরিষা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দুই ফসলি শস্যবিন্যাসকে তিন ফসলি শস্যবিন্যাসে রূপান্তর প্রদর্শনীর ফসল কর্তন ও কৃষক সমাবেশে স্থানীয় কৃষক প্রতিনিধি সোহরাব উদ্দিন জানান, তিনি আগে যে জমিতে দুই ফসল করতেন ব্রির বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এখন আমনের পর সরিষা তারপর বোরো আবাদ করছেন। নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান৯২ জাতের ধানের আবাদে ধান পাওয়া যাচ্ছে হেক্টরে সাড়ে ৯ টন। আর ব্রি ধান১০২ এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৮.৬টন। তাছাড়া এ ধানে জিংকের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম।
অনুরূপভাবে স্থানীয় কৃষক আনসার আলী বলেন, এবার মুশুদ্ধিতে ব্রির নতুন জাতের ধান ব্রি ধান৯২ চাষ করে তিনি ৩০ শতকের বিঘায় ফলন পেয়েছেন ৩৪ মণ এবং ব্রি ধান১০২ এর ফলন পেয়েছেন ৩২ মণ। বাড়তি হিসেবে আমনের পরে বারি সরিষা-১৪ আবাদ করে বিঘায় প্রায় ৬ মণ করে সরিষা পেয়েছেন যার বাজার মূল্য ২৪০০০ টাকা।
পরিশেষে, প্রতি বছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার সাথে ২০-২২ লক্ষ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে খাবারের জোগান দিতে হলে অবশ্যই ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতের উচ্চফলনশীল ধানগুলো চাষ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কেননা নতুন জাতগুলো ফলন আগের পুরনো জাত ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ এর তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং এখন পুরনো জাতগুলো বাদ দিয়ে নতুন জাতের ধান ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০ এবং ব্রি ধান১০২ চাষ করতে হবে। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু ধান১০০ এবং ব্রি ধান১০২ চিকন, উচ্চ জিংকসমৃদ্ধ, জিরা টাইপের যা আমাদের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করবে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল : ১৭১৬-৫৪০৩৮০, মেইল :smmomin80@gmail.com
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ আয়েশা সুলতানা
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: তুহিন, উপজেলা : পিরগঞ্জ, জেলা : রংপুর।
প্রশ্ন : ফুলকপির আগাম জাত সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবিত বা আমদানিকৃত ফুলকপির বিভিন্ন আগাম জাত রয়েছে। তার মধ্যে বারি ফুলকপি-২ অন্যতম। প্রতিটি ফুলকপির গড় ওজন ৭৫০-৮০০ গ্রাম। বীজ বপন থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে ফুলকপি খাওয়ার উপযুক্ত সময়। ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক রোপণ করা যায়। ফলন ২৫ টন/হেক্টর হয়। এ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকৃত হাইব্রিড বীজসমূহ মধ্য শ্রাবণ থেকে মধ্য ভাদ্র মাসে বপন করা যায়।
মো: কামাল, উপজেলা : হাজীগঞ্জ, জেলা : চাঁদপুর।
প্রশ্ন : পেয়ারার ফলে অসমান কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : সাধারণত কলেটোট্রিকাম সিডি নামক ছত্রাক পেয়ারার এ রোগের কারণ। একে এ্যানথ্রাকনোজ রোগ বলে। এ রোগের আক্রমণে পেয়ারার গায়ে ছোট বাদামি দাগগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে পেয়ারার গায়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। অনেক সময় ফল ফেটে যায় এবং ফলের শাঁস শক্ত হয়ে যায়। এ রোগের প্রতিকারে গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে ফুল ধরার পর টপসিন-এম প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
মো: রহিম, উপজেলা : হাতিবান্ধা, জেলা : লালমনিরহাট।
প্রশ্ন : পাটের কা- পচা রোগে করণীয় কী?
উত্তর : ম্যাক্রোফোমিনা ফেসিওলিনা ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগটি হয়ে থাকে। এ রোগের প্রতিকার ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগমুক্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ফেলতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম হারে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। রোগ দেখা দিলে ম্যানকোজেব (২ গ্রাম) অথবা প্রোপিকোনাজল (০.৫ মিলি) অথবা হেক্সাকোনাজল/টেবুকোনাজল ২ মিলি/লিটার হারে স্প্রে করতে হবে। উল্লেখ্য, ফসল কাটার পর শস্য অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।
মো: আরমান, উপজেলা : খেতাবগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর।
প্রশ্ন : তুলার উন্নত জাত ও বপন সময় সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল যেমন- সিবি ১৬, সিবি ১৭, সিবি ১৮, সিডিবি তুলা এম-১, সিবি হাইব্রিড-১ জাতের তুলা মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।
মো: জনি, উপজেলা : বাগমারা, জেলা : রাজশাহী।
প্রশ্ন : আমের বোঁটা পচা রোগে করণীয় কী?
উত্তর : লেসিওবট্রিডিপ্লোডিয়া প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে। এ রোগের প্রতিকারে পরিষ্কার ও বৃষ্টিহীন দিনে আম সংগ্রহ করতে হবে, আম পাড়ার সময় একটু (১ সেমি.) বোটাসহ গুদামজাত করতে হবে। ৫২০ সে. তাপমাত্রায় পানিতে ১০ মিনিট ডুবানোর পর গুদামজাত করতে হবে। বাগানে এ রোগটি হয় জানা থাকলে সালফার জাতীয় যেকোন ছত্রাকনাশক ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে গুলে ১৫ দিন অন্তর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মো: রুবেল, উপজেলা : ফুলপুর, জেলা : ময়মনসিংহ।
প্রশ্ন : আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী ধানের কি কি উন্নত জাত আছে?
উত্তর : চলতি আমন মৌসুমে ব্রি ধান১০৩, ব্রি ধান৯৫, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭৮, ব্রি ধান৭৭, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫২ ব্রি হাইব্রিড ধান৬, ব্রি হাইব্রিড ধান৪ বিনা ধান-২৩, বিনা ধান-২২, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-৭, সহ আরও অনেক জাত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আপনার এলাকায় চাষ উপযোগী যেকোন জাত আপনি চাষ করতে পারেন।
মো: মাহবুব ইসলাম, উপজেলা : মঠবাড়িয়া, জেলা : পিরোজপুর।
প্রশ্ন : বরবটির ফল ছিদ্র করে ভেতরে পোকা থাকছে, কী করতে পারি?
উত্তর : ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে এ লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। এ পোকা দমন ব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত ফল ও ফুল কীড়াসহ সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে এবং মাটিতে পড়ে যাওয়া পাতা ও আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে; গাছের কা- ও পাতায় ছাই ছিটিয়ে দিতে হবে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মো: নোমান, উপজেলা : সিলেট সদর, জেলা : সিলেট।
প্রশ্ন : চালকুমড়ার পাতায় গোলাকার সাদা পাউডারের মতো দাগ দেখা যাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : ঙরফরঁস ংঢ়ঢ় গ্রুপের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিকারে সঠিক মাত্রায় সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে। ম্যানকোজে + মেটালেক্সিল ২ গ্রাম অথবা হেক্সাকোনাজল প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি বা কার্বেন্ডাজিম প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে স্প্রে করতে হবে।
মো: মোত্তালিব, উপজেলা : গৌরনদী, জেলা : বরিশাল।
প্রশ্ন : পানের পাতা পচা রোধে করণীয় কী?
উত্তর : কলেটোট্রিকাম পিপারিস ছত্রাকের আক্রমণে পাতায় পানি ভেজা বিক্ষিপ্ত দাগের সৃষ্টি হয়। এ রোগের প্রতিকারে সুষম সার ব্যবহার প্রথম শর্ত। এ ছাড়াও রোগমুক্ত লতা বপন করতে হবে। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ১% বোর্দোমিশ্রণ বা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে বিকাল বেলা স্প্রে করতে হবে।
মো: জাহিদ, উপজেলা : শাহজাহানপুর, জেলা : সিরাজগঞ্জ।
প্রশ্ন : ভুট্টার পাতা ধূসর বর্ণের দাগ হয়ে সমস্ত পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ, ঝরা পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত জমিতে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে প্রোপিকোনাজল/হেক্সাকোনাজল/টেবুকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মো: সুলতান, উপজেলা : বিজয় নগর, জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
প্রশ্ন : পুঁইশাকের পাতায় কালো গোল দাগ হচ্ছে, কী করতে পারি?
উত্তর : সারকোস্পোরা প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে পুঁইশাকে এই পাতায় দাগ রোগ হয়। এ রোগের প্রতিকারের জন্য রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে; আক্রান্ত পাতাগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; প্রোভ্যাক্স/কার্বেন্ডাজিম প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। এ ছাড়াও রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মোহাম্মদ আলী, উপজেলা : দৌলতপুর, জেলা : কুষ্টিয়া।
প্রশ্ন : কলাপাতা কিনারা হলুদ হয়ে পুড়ে যাওয়ার মতো দেখাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : ঈবৎপড়ংঢ়ড়ৎধ সঁংধব এ রোগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে; কলার জমিতে পানি নিস্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে; কলা পাকার এক মাস আগ পর্যন্ত প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কার্বে-াজিম অথবা প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি ডাইফেনোকোনাজল অথবা প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হেক্সাকোনাজল স্প্রে করতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, কাঁঠালিয়া, ঝালকাঠি। সংযুক্ত : কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৬৫৩২৫৫; ই- মেইল : ayesha_sultana07@yahoo.com
ভাদ্র মাসের কৃষি
(১৬ আগস্ট-১৫ সেপ্টেম্বর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ভাদ্র মাসে শরৎ ঋতুর আগমন। শরতকে বলা হয় ফসল সম্ভাবনার ঋতু। কৃষকেরা নবান্নের আশায় দিন গোনেন। বৈশি^ক আবহাওয়া পরিবর্তনে এসময় ঝরে অঝোর বৃষ্টি। আগাম বন্যা বা নাবি বন্যার কারণে কৃষিতে অনেক সময় বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলো জেনে নেবো সংক্ষিপ্তভাবে।
আমন ধান
আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যত্ন নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি একর জমিতে ৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিনভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, প্রভৃতি পোকা এবং খোলপড়া, পাতায় দাগ পরা রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
পাট
এসময় পাট বীজ উৎপাদনের জন্য ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে লাইনে বুনলে প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতকপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ১০-২০ দিন পরপর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
আখ
এসময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কা- পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী জাত ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩০, ঈশ^রদী ৩৯, ঈশ^রদী ৪০, ঈশ^রদী ৪৫, ঈশ^রদী ৪৬ চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
তুলা
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছা নাশক প্রয়োগ করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে।
শাকসবজি
এ সময় লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো-বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলা করে সেখানে উন্নতজাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে হবে।
গাছপালা
ভাদ্র মাসেও ফলদবৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হলে মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণ করতে হবে।
এ মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফল গাছে রোগও কম হয়।
তালের ফল ও বীজ আগস্ট মাস থেকে শুরু করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। নির্বাচিত মাতৃবৃক্ষ থেকে পাকা তাল থেকে রস বের করে নেয়ার পর সংগৃহীত বীজ সাথে সাথে বীজ তলায় বপন করতে হবে। বীজ শুকিয়ে গেলে তা থেকে চারা পাওয়া যাবে না। পরিপক্ব তালের বীজের অংকুরোদগমের হার ৭০% এর উপর হয়ে থাকে।
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd