Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

৮৩তম বর্ষ  ১ম সংখ্যা বৈশাখ-১৪৩০ (এপ্রিল-মে ২০২৩)

সম্পাদকীয়

বৈশাখ-১৪৩০। নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল সবার প্রতি। নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। প্রিয় খাবার পান্তা ইলিশ আর ভর্তা দিয়ে বাঙালি বৈশাখকে বরণ করেছে। বাংলা নতুন বছরের সাথে কৃষিকথা পত্রিকাটি ৮৩তম বছরে পদার্পণ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। এরই অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ফার্ম ম্যাগাজিন মাসিক কৃষিকথা ১৯৪১ সাল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রকাশিত হয়ে আসছে। কৃষিকথায় সমসাময়িক কৃষি প্রযুক্তি, তথ্য ও উপাত্ত সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে সাধারণ মানুষের বোধগম্য আকারে বিভিন্ন আঙ্গিক ও নান্দনিক কৌশলে উপস্থাপন করে প্রিন্ট করা হয়। যা কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। দেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে।  
বাংলাদেশের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির সঙ্গে খাদ্য জড়িত, আর খাদ্যের সঙ্গে জীবন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ অনুসরণ করে দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি এখন ঘাটতি উৎপাদন ব্যবস্থা হতে উদ্বৃত্ত ও বাণিজ্যিকীকরণ অভিমুখী। বর্তমান সরকার প্রত্যেক নাগরিকের সুস্থ জীবনযাপনের লক্ষ্যে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে সকল অনাবাদী পতিত জমি। কৃষির বহুমুখীকরণ নিশ্চিত করে প্রতিটি কৃষককে স্বয়ম্ভর হতে হবে কৃষি পণ্যের উৎপাদনে। সেদিক থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে কৃষিকথায় এবারের সংখ্যায় ‘গণভবনে কৃষি খামার ও জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার’ নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়াও আগামীতে কৃষি ভাবনা, উচ্চমূল্যের ফসলের চাষাবাদ, সফল কৃষকের গল্প, পুষ্টি বার্তা ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে পত্রিকাটি। আশা করি নতুন বছরে সব বাধা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে হবে স্মার্ট কৃষিতে পরিণত হবে। কৃষি এগিয়ে যাবে অদম্য গতিতে।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

৮৩তম বর্ষ  ১ম সংখ্যা  বৈশাখ-১৪৩০ (এপ্রিল-মে ২০২৩)

সূচিপত্র

নিবন্ধ
    
    গণভবনে কৃষি খামার ও জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার      ০৩    
    ড. জাহাঙ্গীর আলম
    আউশ ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা    ০৬    
    ড. মো. আব্দুল মালেক
    অম্লীয় মাটি ব্যবস্থাপনায় ডলোচুন প্রয়োগ প্রযুক্তি    ০৮
    ড. মোঃ নূরুল ইসলাম
    পেঁয়াজের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন পরাগায়ন এবং স্বাতন্ত্র্যীকরণ    ১০    
    ড. মো. আলাউদ্দিন খান, মো. মুশফিকুর রহমান    
    লেবুজাতীয়  বা সাইট্রাস ফল ঝরা সমস্যার সমাধান    ১২
    ড. মো. সদরুল আমিন    
    আম সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা    ১৪
    ড. মো. শরফ উদ্দিন
    কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে পলিনেটরের গুরুত্ব এবং এদের সুরক্ষায় করণীয়    ১৬
    ড. মোঃ আলতাফ হোসেন    
    আমের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা     ১৮
    কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
    ‘ঞগজ’ একটি আধুনিক গোখাদ্য প্রযুক্তি    ২০
    ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
    জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান    ২২
    কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম
আগামীর কৃষি ভাবনা

    ধান চাষে পরিবেশসম্মত কৌশল    ২৪    
    মৃত্যুঞ্জয় রায়

উচ্চ মূল্যের ফসল
    অ্যাভোকেডো : পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল    ২৬    
    ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
সফল কৃষকের গল্প

    প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি আবহাওয়া প্রকল্প : সফলতা পাচ্ছেন কৃষকেরা    ২৮    
    ড. মোঃ শাহ কামাল খান

নিয়মিত বিভাগ
    জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি (১৫ মে- ১৪ জুন)    ৩০
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

বিস্তারিত
গণভবনে কৃষি খামার ও জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার

গণভবনে কৃষি খামার ও জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার
ড. জাহাঙ্গীর আলম
কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জমির উপর মানুষের ঘনত্ব বাড়ছে। নিবিড় চাষাবাদের কারণে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি জমি হ্রাসের কারণে কমে যাচ্ছে ফসলের উৎপাদন। আর জমির উর্বরা শক্তি  হ্রাসের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে বিভিন্ন শস্যের চাষাবাদ। আমাদের জাতীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্থায়ীত্বশীল খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক বাঁধার সৃষ্টি করেছে। আগামী প্রজন্মকে দেশের সীমিত জমির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হলে এই প্রবণতাকে ঠেকাতে হবে। কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে সকল পতিত জমি। কৃষির বহুধাকরণ নিশ্চিত করে প্রতিটি কৃষককে স্বয়ম্ভর হতে হবে কৃষি পণ্যের উৎপাদনে।
স্বাধীনতার পর দেশে ছিল চরম খাদ্য সংকট। এই সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উদার সহায়তা দিয়েছিলেন। কৃষিকে তিনি বহুমুখী করার কথা বলেছিলেন। এক ইঞ্চি জমিও যাতে পতিত না থাকে তার জন্য উদাত্ত্ব আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। তিনি দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন দ্বিগুণ/তিন গুণ বৃদ্ধির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। সেই সফলতা তিনি পুরোপুরি দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তিনি দেশদ্রোহী একদল সৈনিকের বুলেটের আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন। তার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। দেশের কৃষির উৎপাদন দ্বিগুণ, তিন গুণ, ক্ষেত্রবিশেষে চার গুণ বৃদ্ধি  পেয়েছে। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ  নেতৃত্বে  দেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। তবুও দেশে খাদ্য ঘাটতি আছে। আবহাওয়া বিরূপ থাকলে ঘাটতির মাত্রা বেড়ে যায়। আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় অতি মাত্রায় আমদানির উপর। সম্প্রতি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যশস্যের দাম। গত কয়েক বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিঘিœত হয়েছে। গত বছর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং বেড়েছে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্য। সামনে এক বিশাল খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি খাদ্য উৎপাদনে আবাদি জমি সংরক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাছাড়া প্রতি ইঞ্চি পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে। এটি আমাদের মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় পাঁচ শতাংশ। এর মধ্যে আছে চিনিকল, পাটকল, ব্যক্তি পর্যায়ের মিল-কারখানা, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রেলের অধীনস্ত বিশাল আকারের পতিত জমি। তাছাড়া স্কুল-কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় রয়েছে অনেক পতিত জমি। তদুপরি জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ির চারপাশেও রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। সিলেট, বরিশাল, বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা এবং উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলেও অনেক জমি অনাবাদি রয়ে গেছে। এগুলো আবাদের আওতায় আনা দরকার। তাছাড়া আমাদের বসতবাড়ির চারপাশে যেসব জমি অনাবাদি পড়ে আছে তারও সর্বোচ্চ ব্যবহার প্রয়োজন। সেদিক থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনের বিশাল আঙ্গিনায় হাঁস-মুরগি, কবুতর, গরু পালনের পাশাপাশি শাকসবজি, ফুল ফল, মধু ও মাছ চাষ করেছেন। তিল, সরিষা ও পেঁয়াজের চাষ করেছেন। বাঁশফুল, পোলাও চাল, লাল চালসহ পালংশাক, ধনেপাতা, বতুয়া শাক, ব্রোকলি, টমেটো, লাউ, শিমসহ সব ধরনের শীতকালীন সবজির চাষ করেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মসলা, আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, বরই, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ফলিয়েছেন। তদুপরি গোলাপ, সূর্যমুখী, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলেরও চাষ করেছেন। এভাবে তিনি গণভবনের আঙ্গিনার পতিত প্রতি ইঞ্চি জমিকে উৎপাদনের আওতায় এনেছেন। দেশের জনগণের প্রতি নিজের আহ্বানকে বাস্তবে রূপদান করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাতে কৃষির উৎপাদনে আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত হবে সাধারণ মানুষ। এক সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ছোটবেলায় বাবার কাছেই কৃষির হাতখড়ি। তিনিই আমাদের ভাইবোনকে কৃষি অনুশীলনের সুযোগ করে দিতেন। পরবর্তীতে  দেশের রাজনীতির সঙ্গে যখন সরাসরি সম্পৃক্ত হলাম, তখনো গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। দেখেছি তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। আমাদের  দেশের অর্থনীতির ভীতই তো কৃষির উপর। অন্যদিকে জনসংখ্যাও  বেশি। সেটা বিচার করে কৃষির উপর জোর দিতেই হয় সবসময়।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের জমি এত উর্বর, একটু চেষ্টা করলেই আমরা আমাদের উৎপাদন আরো বাড়াতে পারি।’’
কৃষি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি আমাদের জাতীয় উপলব্ধিরই নামান্তর। তিনি নিজে তার সরকারি বাসভবনের ভিতরের জায়গাটাকে কৃষি খামারে রূপান্তরিত করেছেন। এর আগে তাঁরই উদ্যোগে জাতীয়ভাবে গড়ে উঠেছে, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প। এখন তিনি গণভবনের বিশাল চত্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি বড় ধরনের কৃষি খামার। আমাদের জন্য এটি বড় শিক্ষণীয় বিষয়।  দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও  জেলা শহরে অনেক সরকারি বাসভবন আছে  যেখানে প্রচুর জমি খালি পড়ে আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্যোগে আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাতে দেশের জনগণের নিকট এগুলো প্রদর্শনী খামার হিসেবে বিবেচিত হবে। তাছাড়া পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার ও অন্যান্য সরকারি স্থাপনার আওতাধীন পতিত জমিগুলোতেও বহুমুখী কৃষি খামার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া একান্ত  প্রয়োজন।
কৃষি জমির অকৃষি খাতে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন শিল্প, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অনেক উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতার অভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তাতে বিপুল পরিমাণ জমি চাষের আওতাবহির্ভূত হয়ে যায়। সেই অধিগ্রহণকৃত জমি সর্বোত্তমভাবে সুব্যবহার করা যায় না। আমাদের দেশে অনেক শিল্পনগরী আছে যেখানে অধিগৃহীত জমির ব্যবহার অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন কাজে আমাদের অধিগৃহীত জমির শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ অব্যবহৃত পড়ে আছে। এটা নিতান্তই অপচয়। এই অপচয় রোধ করতে হবে। বিশেষ করে সেচ সুবিধাযুক্ত জমির অধিগ্রহণ পুরোপরি নিষিদ্ধ করতে হবে। যে জমিতে দুই বা ততোধিক ফসল ফলে, এমন জমি ব্যক্তিগত বা সরকারি নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির পরিমাণ নূন্যতম পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। যেখানে সম্ভব সরকারি খাসজমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অপরদিকে অধিগ্রহণকৃত অব্যবহৃত জমি কৃষি কাজে ফিরিয়ে দিতে হবে। ইতোমধ্যে ইট ভাটার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য পাথর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ব্লক ব্যবহারের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। জমির খ- বিখ-তা হ্রাস এবং উর্বরতা হারানো জমিগুলোর উর্বরতা বাড়ানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, মহাসড়কের দুই ধার, স্কুল-কলেজের আঙিনা, স্থানীয় জলাভূমি ইত্যাদির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোতে বিভিন্ন শষ্যের চাষ, ফলদ বৃক্ষ রোপণ, পশু-পাখি পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদি উৎপাদনমূলক কর্মকা-ের প্রসার ঘটিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম করতে হবে।
আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ জমি শস্য চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ৪০ ভাগ জমি মধ্যম মাত্রার উপযোগী আর বাকি ২৫ ভাগ জমি শস্য উৎপাদনের জন্য কম উপযোগী। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য খাবার যোগাতে হলে ফসল চাষের জন্য ভালো উপযোগী জমি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে চাষযোগ্য জমি অকারণে গ্রাম সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহৃত না হয়। ছোটখাটো শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টারগুলোকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে বাড়িঘর তৈরি না করে সুপরিকল্পিতভাবে তা স্থাপন করতে হবে রাস্তার দু’পাশে নির্ধারিত এলাকায়। গ্রামীন আবাসনের জন্য যেখানে সম্ভব, সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বহুতল দালান। গ্রামীণ এলাকাকে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং কৃষি জোনে চিহ্নিত করে নিতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ। তেমনিভাবে শহর এলাকাগুলোকেও আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা হিসেবে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ ও খেলাধুলার স্থানগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে আলাদাভাবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই কেউ ল্যান্ড জোনিংকে অমান্য করে নতুন স্থাপনা গড়তে না পারে।
আমাদের দেশের বনাঞ্চলগুলো ক্রমেই উজাড় হচ্ছে। গাছ কেটে মানুষ বিরাণভূমিতে পরিণত করছে সংরক্ষিত বনভূমি। সেদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। বনায়নের উপযোগী ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়নের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ প্রক্রিয়াকে ঠেকানো যেতে পারে। তাছাড়া জুম চাষ ও স্থানান্তরিত চাষাবাদের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমির যে ক্ষতিসাধন হচ্ছে, জুমিয়াদের পরিকল্পিত স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার প্রতিকার করা যেতে পারে। ভূমি উদ্ধার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন জেগে উঠা চরে উপযুক্ত চাষাবাদের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
এক সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২শ’ কিলোমিটার জমি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। লবণাক্ততার কারণে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১০ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা থাকায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। খরার কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে ৪৩ শতাংশ জমির। তাতে করে কমে যাচ্ছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফসলের উৎপাদন। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে ভাঙন রোধ, লবণাক্ততা ও খরাসহিষ্ণু শস্যের বীজ সম্প্রসারণ এবং চাষাবাদের ধরন পাল্টিয়ে এই ক্ষতি থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। এরই মধ্যে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধানের জাত লবণাক্ততার মাঝেও ভালো উৎপাদনের সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। খরাসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্যও গবেষণা হচ্ছে। এ কাজে আরো সহায়তা প্রয়োজন। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় এনে কৃষি জমির   অকৃষি কাজে ব্যবহার ও জমির উর্বরতা হ্রাস রোধকল্পে এখন সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। এ বিষয়ে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০,   ই-মেইল : alamj52@gmail.com

বিস্তারিত
আউশ ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

আউশ ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি
এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ড. মো. আব্দুল মালেক
ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় না হওয়ার বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধান চাষে কৃষকগণ আগ্রহী হয়ে উঠছেন, কারন বীজ-সার প্রান্তিক কৃষকদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছে সরকার, ফলে কৃষকরা আউশের উচ্চফলনশীল জাতের বীজ পেয়ে খুশি তাছাড়াও আউশ ধান চাষে সেচ কম লাগে বিধায় উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম এবং কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। ফলে দেশে আউশ ধানের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আউশের উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচনের মাধ্যমে চাষের সঠিক নিয়ম মেনে চললে ভালো ফলন পাওয়া এবং সর্বোপরি স্বল্প উৎপাদন খরচে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব; এ কথাগুলো কৃষকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কাজ করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। তাছাড়া গত কয়েক বছর ধরে আউশ মৌসুমকে সামনে রেখে সরকার  কৃষকদের সরকারি প্রণোদনা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রণোদনার মধ্যে থাকছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ও সার। আউশ আবাদ বাড়ানোর পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও নিবিড় মনিটরিং। ফলে সেচসাশ্রয়ী আউশ আবাদে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন কৃষকরা, যার সুফল পাচ্ছে পুরো দেশ।
তিন বছর আগে দেশে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ ধান আবাদ হতো। দুই বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরও এক লাখ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত মৌসুমে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে তা এক লাফে দুই লাখ হেক্টর বেড়ে যায়। গত ২০২১-২২ মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে আউশ ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে।
গত তিন মৌসুম আউশের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে সরকারের কৃষিবান্ধব নানামুখী উদ্যোগ, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে আউশ ধানের বীজ ও সার বিতরণ। এ ছাড়া স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল জাতের আউশ ধানের জাত উদ্ভাবন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রম এবং কৃষকদের মধ্যে আউশ ধান আবাদের সুফল ও উপকারিতা যথাযথভাবে তুলে ধরার ফলে আউশের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় : ফলন বৃদ্ধিতে প্রয়োজন ভালো জাতের ভালো বীজ। উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করে তার ভালো মানের বীজ নিশ্চিত করতে পারলেই কাক্সিক্ষত ফলন প্রত্যাশা করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে একমাত্র উচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন মানসম্মত বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ভাল বীজের বৈশিষ্ট্য : বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় থাকা, অন্য ফসল ও জাতের বীজ হতে মিশ্রণমুক্ত হওয়া, রোগ-জীবাণু ও কীট-পতঙ্গ মুক্ত হওয়া, উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকা, বীজের সঠিক আর্দ্রতা বজায় থাকা এবং সুনির্দিষ্ট কোন জাতের সকল বীজ প্রায় একই আকারের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ব ও পুষ্ট হতে হবে। এ ছাড়াও ভালো বীজের স্বাভাবিক উজ্জ্বল রঙ বজায় থাকবে।
আউশের উচ্চফলনশীল জাত : বোনা আউশ ধানের জনপ্রিয় ও উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতসমূহের মধ্যে ব্রি ধান৪৩, খরা সহনশীল ব্রি ধান৬৫ ও ব্রি ধান৮৩; খরাসহিষ্ণু ও স্বল্প জীবনকালের (৯৫-১০০ দিন) বিনাধান-১৯ এবং বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে চাষোপযোগী ব্রি ধান২৭ ও ব্রি ধান১০৬।
রোপা আউশ ধানের আধুনিক জাতসমূহ : ব্রিধান৪৮, ব্রিধান৮২ ও ব্রিধান৮৩, ব্রিধান৮৫, ব্রিধান৯৮ এগুলো রোপা আউশ ধানের আধুনিক জাত, খরাসহিষ্ণু ও স্বল্প জীবনকালীন জাতসমূহ (৯৫-১০০ দিন) বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১, অধিক ফলনশীল জাত (৬.৫-৭০ টন/হেক্টর) ব্রি হাইব্রিড ধান৭ এবং বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে চাষোপযোগী ব্রি ধান২৭ ও ব্রি ধান১০৬।
বীজ বপন ও হার : বোনা আউশে ২৫ মার্চ হতে ২০ এপ্রিলের মধ্যে বীজ বপন,  রোপা আউশে বীজ বপন ৩০ মার্চ হতে ৩০ এপ্রিল  পযর্ন্ত উপযুক্ত সময়। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে একর প্রতি ২৭-৩০ কেজি। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে একর প্রতি ১৮-২১ কেজি এবং সারিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন।
চারার বয়স : ১৫-২০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। প্রতি গোছায় ২-৩টি করে চারা ৮ ইঞ্চি দ্ধ ৬ ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা : কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম বেশি হতে পারে। তবে সাধারণভাবে একর প্রতি ৪২-৪৫ কেজি ইউরিয়া, ২০-২৫ কেজি ডিএপি, ৩০-৩৩ কেজি এমওপি, ১৫-১৮ কেজি জিপসাম এবং ২.০-২.২ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় ১/৩ ভাগ ইউরিয়া এবং অন্যান্য সকল সার প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তি ইউরিয়া সাধারণত রোপণের ১২-১৫ দিন পর অর্থাৎ কুশি আসা পর্যায় এবং ৩য় কিস্তি কাইচথোড় জন্মাবার ৫-৬ দিন পূর্বে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব না থাকলে শুধুমাত্র জিপসাম এবং দস্তা সার প্রয়োগের দরকার নেই। বোনা আউশে ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময় এবং ২য় কিস্তি বপনের ৩০-৩৫ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা দমন : সাধারনত হাত দিয়ে, নিড়ানী যন্ত্রের সাহায্যে অথবা আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে বীজ বপন/চারা রোপনের ৩০-৩৫ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সেচ : চারা লাগানোর সময় বা বীজ বপনের সময় বৃষ্টিপাত না হলে সময়মতো চারা রোপণ/বীজ বপনের জন্য সম্পূরক সেচ দিতে হবে। সরাসরি বীজ বপনের ক্ষেত্রে জমিতে জো অবস্থা বিরাজমান না থাকলে অঙ্কুরিত বীজ জমি কাদা করে লাইনে/ছিটিয়ে বপন করতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : আউশ মৌসুমে সাধারণত খোলপোড়া রোগ, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ, টুংরো এবং বাঁকানি রোগের প্রকোপ দেখা দিলে দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আউশের মুখ্য পোকাগুলো হলো মাজরা পোকা, পামরি পোকা, থ্রিপস, গান্ধি পোকা, সবুজ পাতাফড়িং এবং বাদামি গাছফড়িং। পোকা দমনে আলোর ফাঁদ এবং পার্চিং ব্যবহারসহ প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ধান কাটা ও মাড়াই : শতকরা ৮০ ভাগ ধান পাকলে কাটতে হবে। বৃষ্টির মৌসুমে আউশ ধান মাড়াইয়ের জন্য মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা উত্তম। মাড়াই করে সাধ্যমতো ঝেরে বৃষ্টিমুক্ত স্থানে ধান শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেন আউশ ধানের আবাদ বাড়াতে যা যা করণীয় তা করে যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপখাইয়ে ক্লাইমেট স্মার্ট এবং স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চফলনশীল আউশ ধানের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)সহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যা ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষাসহ স্বল্পখরচে বৃষ্টিনির্ভর আউশের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে আউশ তথা সার্বিকভাবে ধানের মোট উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  
   
লেখক : পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ, মোবাইল নম্বর : ০১৭১২১০৬৬২০, ইমেইল : malekdina@gmail.com

বিস্তারিত
অম্লীয় মাটি ব্যবস্থাপনায় ডলোচুন প্রয়োগ প্রযুক্তি

অম্লীয় মাটি ব্যবস্থাপনায় ডলোচুন প্রয়োগ প্রযুক্তি
ড. মোঃ নূরুল ইসলাম
মাটির অম্লত্ব কিংবা ক্ষারীয় অবস্থার উপর ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে। মাটির অম্লতা ও ক্ষারত্ব নির্ধারিত হয় মাটির পিএইচ (ঢ়ঐ) নির্ণয়ের মাধ্যমে মাটির পিএইচ মান সাধারণত ৪.০ থেকে ৮.০ মধ্যে থাকবে। মাটির পিএইচ (ঢ়ঐ)  মান ৪.৫ এর নিচে হলে সেই মাটিকে অত্যধিক অম্ল, ৪.৫ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত অধিক অম্ল, ৫.৬ থেকে ৬.৫ হলে মৃদু অম্ল এবং ৬.৬ থেকে ৭.৩ এর মধ্যে হলে তাকে নিরপেক্ষ মাটি বলা হয়। ফসলের বৃদ্ধির জন্য ১৬-১৭টি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এর মধ্যে গাছ কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন বাতাস ও পানি থেকে গ্রহণ করে। অবশিষ্ট সকল আবশ্যিক উপাদান মাটি থেকে গ্রহণ করে। মাটির পিএইচ এর মান ৫.৬ থেকে ৭.৩ এর মধ্যে থাকলে অর্থাৎ মৃদু অম্ল থেকে মৃদু ক্ষারীয় মাটিতে এসব পুষ্টি উপাদান ফসলের জন্য সহজলভ্য হয়। এই পিএইচ মান সম্পন্ন মাটি, মাটিতে অবস্থিত অণুজীবসমূহের বংশ বৃদ্ধির জন্য অনুকূল, যা ফসলের জন্য আবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের লভ্যতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৮৫ লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর (ঝজউও, ২০২০)। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির মাটি অত্যধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ এর নিচে) এবং  প্রায় ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির মাটি অধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ থেকে ৫.৫) (ঝজউও, ২০২০), অত্যধিক থেকে অধিক অম্লীয় মাটিতে ফসফরাস, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও মলিবডেনামের স্বল্পতা এবং অ্যালুুমিনিয়াম, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের আধিক্য থাকায় ফসলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং ফলন হ্রাস পায়।
বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চট্রগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলসহ বরেন্দ্র ও মধুপুর গড় অঞ্চলের অধিকাংশ মাটি অত্যধিক থেকে অধিক অম্ল (চিত্র ১: মানচিত্রের গাঢ় লাল ও ম্যাজান্টা অংশ)। ফলশ্রুতিতে, এই সকল অঞ্চলে আবাদকৃত ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে এ ধরনের মাটির অত্যধিক ও অধিক অম্লতা হ্রাস করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। ভালো ফসল উৎপাদনের নিমিত্ত মাটির অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে মাটির অম্লমান (পিএইচ) ৫.৬ বা এর উপর আসতে হবে। বাংলাদেশের বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মাটিতে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ক্ষারীয় উপাদানের ঘাটতি রয়েছে যা মাটির অম্লতা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। দেশের প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জমিতে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ নিম্ন থেকে অতি নিম্ন এবং প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ নিম্ন থেকে অতি নিম্ন।
অম্লীয় মাটি ব্যবস্থাপনা
গবেষণালব্দ ফলাফল হতে জানা যায় যে, বিভিন্ন ফসলে সুপারিশকৃত মাত্রায় ডলোচুন (ঈধঈঙ৩.গমঈঙ৩) প্রয়োগের মাধ্যমে অত্যধিক ও অধিক অম্লীয় মাটির অম্লতা হ্রাস করে ফসল উৎপাদনের জন্য অধিক উপযোগী পর্যায়ে (পিএইচ মান ৫.৬ এর উপরে) নিয়ে আসা সম্ভব। ডলোমাইট বা ডলোচুনে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ ২০ শতাংশ এবং ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ ১১ শতাংশ বিদ্যমান থাকায় ডলোচুন অত্যধিক ও অধিক অম্লীয় মাটির অম্লত্ব হ্রাস করার জন্য খুবই উপযোগি।
ডলোচুন ব্যবহারের সুপারিশকৃত মাত্রা : ডলোচুন একটি সাদা পাউডার জাতীয় দ্রব্য যা বাজারে ডলোচুন, ডলোঅক্রিচুন বা ডলোমাইট নামে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মাটির অম্লীয়তা কমানোর জন্য ডলোচুনের সুপারিশকৃত মাত্রা প্রধানত : মাটির বর্তমান অম্লমান (পিএইচ), মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ও মাটির বুনটের উপর নির্ভর করে। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে, সাধারণত প্রতি শতাংশ জমিতে ৪ কেজি বা একরে ৪০০ কেজি বা হেক্টরে ১ টন হিসাবে ডলোচুন প্রয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এই মাত্রায় ডলোমাইট বা ডলোচুন প্রয়োগ করা হলে মাটির অম্লতা হ্রাস পাবে এবং ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে। তবে, মাটির পিএইচ মান, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ও মাটির বুনটের উপর ভিত্তি করে ডলোচুনের সুপারিশকৃত মাত্রা এর কম বা বেশিও হতে পারে।
ডলোচুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা : ডলোমাইট বা ডলোচুনে ঈধ ও গম থাকে যা ফসলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান; ডলোচুন প্রয়োগ প্রযুক্তি খুব সহজ, খরচ কৃষকের সামর্থের মধ্যে এবং লাভজনক; ডলোচুন একবার প্রয়োগ করলে পরবর্তী তিন বছর প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না; ডলোচুন প্রয়োগ করা হলে ম্যাগনেশিয়াম জাতীয় সার আলাদাভাবে প্রয়োগের প্রয়োজন হয়; গবেষণায় দেখা গেছে যে, অধিক অম্লীয় মাটিতে ডলোচুন প্রয়োগ করা হলে বিশেষ করে আলু, ডাল, সরিষা ও সবজি জাতীয় ফসলের ফলন প্রায় ১৫-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ডলোচুন প্রযুক্তি প্রয়োগ পদ্ধতি : প্রথমেই জমির অম্লীয় মাত্রা জেনে নিয়ে প্রতি শতাংশে ৪ কেজি/প্রয়োজনমত হারে অর্ধেক ডলোর সমস্ত জমির জন্য প্রয়োজনীয় ডলোচুন মেপে নিয়ে জমিতে জো থাকা অবস্থায় উত্তর-দক্ষিণ বরাবর এবং বাকি অর্ধেক পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অর্থাৎ আড়াআড়িভাবে সমস্ত জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। জমি শুষ্ক হলে হালকা সেচ দিয়ে জো নিয়ে আসার পর ডলোচুন প্রয়োগ করা এবং ডলোচুন প্রয়োগের সাথে সাথেই জমি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে ডলোচুন সুন্দরভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সাধারণত ডলোচুন প্রয়োগের ১৫ দিন পর, তবে কমপক্ষে ১০ দিন পর প্রয়োজনীয় চাষ ও মই দিয়ে ফসল রোপণ/ বপনের জন্য উপযুক্ত।
ডলোচুন প্রয়োগের সময় ও ফসল : সাধারণত রবি মৌসুম ডলোচুন প্রয়োগ করা উত্তম  সময়। তবে যেকোন মৌসুমেই বিভিন্ন  মাঠ ফসল যথা- গম, ভুট্টা, আলু, সবজি, ডাল ও মসলাজাতীয় ফসলে ফলন বৃদ্ধির জন্য অধিক অম্লীয়  মাটিতে ডলোচুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। সাধারণত ধান ফসলে অথবা জলাবদ্ধ অবস্থায় আবাদ করা হয় এমন ফসলে ডলোচুন প্রয়োগ করা হয় না। তবে ধান ফসলের জমিতে ডলোচুন প্রয়োগ করা হলে ডলোচুনে থাকা ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের কারণে ফলন বৃদ্ধি পেতে পারে।
ডলোচুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সাবধাণতা : সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণে ডলোচুন প্রয়োগ করবেন না; ডলোচুন প্রয়োগের পরপরই চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন; ফসল আছে এমন জমিতে ডলোচুন প্রয়োগ করা যাবে না; বেশি বাতাসের সময় মাঠে ডলোচুন না ছিটানো ভালো; ডলোচুন প্রয়োগের সময় চুন প্রয়োগকারীকে অবশ্যই মাস্ক অথবা কাপড় দিয়ে ভালভাবে নাক মুখ বেঁধে নিতে হবে এবং চমশা ব্যবহার করতে হবে। তথ্যসূত্র : এঁরফবষরহব ভড়ৎ অপরফরপ ঝড়রষ গধহধমবসবহঃ, ঝজউও, ২০২২

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭১৮৯৩৭৯১৯, ই-মেইল : nurulsrdi78@gmail.com

 

বিস্তারিত
পেঁয়াজের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন পরাগায়ন এবং স্বাতন্ত্র্যীকরণ

পেঁয়াজের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন
পরাগায়ন এবং স্বাতন্ত্র্যীকরণ
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ মো. মুশফিকুর রহমান২
সলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ (অষষরঁস পবঢ়ধ খ.) বাংলাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। এ দেশে প্রায় ১.৯৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৩৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে বছরে প্রায় ২৩ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। প্রতি বছর প্রায় ১৮০০-২০০০ হেক্টর জমিতে “কালো সোনা” নামে পরিচিত পেঁয়াজের বীজ উৎপাদিত হয়, যার ফলন গড়ে ৬৫০ কেজি/হেক্টর। পেঁয়াজ চাষে বীজ হার ৬ কেজি/হেক্টর ধরলে বছরে প্রায় ১০০০-১১০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বীজের প্রয়োজন হয়, যার সিংহ ভাগই কৃষক উৎপাদন করে। কিন্তু চাহিদার সামান্য অংশ (৫-৭%) সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান/প্রাইভেট কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত বীজ মানসম্পন্ন। কৃষক নিজেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন এবং সংগ্রহ করে। এ বীজই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের মাধ্যমে কন্দ উৎপাদিত হয়। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের নিয়ম না মানার কারণে কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত বীজ নিম্নমানের হওয়ায় কন্দের ফলন ও গুণগত মান উভয়ই নিম্নমানের হয়। পেঁয়াজে পর-পরাগায়ন সংঘটিত হয়। বিধায় বিভিন্ন জাতের মধ্যে মিশ্রণ প্রতিরোধে স্বাতন্ত্র্যীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পেঁয়াজের ফুলে বিভিন্ন প্রজাতির পোকা ভ্রমণ করে থাকে। পেঁয়াজের ফুলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরাগবহনকারী হলো মৌমাছি, কারণ তাদের নিজস্ব বাসা থাকে। পেঁয়াজের ফুলে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পরাগায়নকারী পোকাগুলো হলো মৌমাছি, হুলবিহীন মৌমাছি, ঘরেরমাছি, সবুজ বোতল ফ্লাই, হোভার/সিরফিড ফ্লাই, পেঁয়াজের থ্রিপস। প্রতিদিন নয় তবে প্রচুর পরিমাণে পরাগায়ন সংঘটনকারী পোকা হলো ট্রু ফ্লাই, নীল বোতল ফ্লাই, বিটল পোকা, ফ্লাওয়ার বাগ। তাছাড়া প্রজাপতি, মথ, ঘাসফড়িং, ড্রাগনফ্লাই, বোলতা, ভীমরুল, ভ্রমর, পিঁপড়া, হ্যালিকটিড মৌমাছি, সলিটারি মৌমাছি, ড্রোন ফ্লাই ইত্যাদি মাঝে মাঝে পরাগায়ন সংঘটিত করে। পেঁয়াজে বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমেও পরাগায়ন হয়।
পেঁয়াজে উত্তম পরাগবহনকারী  এবং এর কার্যক্রম : অন্যান্য মধুধারী ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। স্ত্রী মৌমাছি সাধারণত ফুল থেকে দুই ধরণের প্রতিদান যেমন, মধু এবং পরাগরেণু খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করার জন্যই ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময়ই অন্য ফুলের গর্ভমু-ে পরাগরেণু স্থানান্তরিতের মাধ্যমে পরাগায়ন এবং পরিশেষে বীজ উৎপাদন হয়। পেঁয়াজ ফুলের পরাগরেণু আঠালো এবং মৌমাছির দেহ লোমাবৃত বিধায় পরাগরেণু বহনে খুবই উপযোগী। মৌমাছি ভ্রমণের সময় এককালীন একই প্রকার ফুলের প্রতি মনোনিবেশ করে থাকে, ফলে পরাগায়নের কার্যকারিতা বেড়ে যায়।
পরাগবহনকারীর সক্রিয়তা নির্ভরকারী নিয়ামক : পরাগবহনকারীর সক্রিয়তা নির্ভরকারী উপাদানগুলো হলো পোকার সংখ্যা, শ্রেণী, আকার, গায়ে লোমের সংখ্যা, ফুলের আকার, রং, গন্ধ, মধুর পরিমাণ ও ধরন, মধুতে পটাশিয়ামের পরিমাণ, পরাগরেণুর ধরন, মধু ও পরাগরেণু সংগ্রহকালীন স্বভাব, ভ্রমণের সংখ্যা, কলোনী যুক্ত মৌ-বক্সের সংখ্যা, পার্শ¦বর্তী ফসলের ধরন, কীটনাশক ব্যবহার, আবহাওয়া, মৌমাছির আবাসস্থল, বৈষ্যিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ইত্যাদি।  হলুদ ফুলে মৌমাছি বেশি যায় বিধায় সরিষা, মৌরি ইত্যাদি পাশর্^বর্তী ফসল হিসাবে চাষ না করাই ভালো। নিয়ন্ত্রিত পরাগায়নের সাফল্য মৌ-বক্সের সংখ্যার উপরও নির্ভর করে। হেক্টরে ১০টির কম মৌ-বক্স হলে পরাগায়নের হ্রাস পায়। যে ফুল থেকে বেশি লাভজনক মধু উৎপাদন হয় এমন ফুলের প্রতি মৌমাছির অধিক আকর্ষণ থাকে। পেঁয়াজের ফুলের মধুতে সুক্রোজ, গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকে। ইহা বিভিন্ন পোকার জন্য খুবই মূল্যবান খাবারের উৎস, ফলে পোকা আকৃষ্ট হয়। পেঁয়াজের ফুলের মধুতে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকলে তা মৌমাছির জন্য অপছন্দনীয়। পেঁয়াজের জাতভেদে ও উৎপাদনের অঞ্চলভেদে মধুতে পটাশিয়ামের পরিমাণ তারতম্য হয়। মাঠ বেশি শুষ্ক কিংবা বেশি ভিজা থাকলে ফুলে মধুর পরিমাণ হ্রাস পায়। উজ্জ্বল রোদে পোকার সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। মৌমাছি সকাল ৮.০০টা থেকে বিকাল ৪.০০ টার মধ্যে ফুল থেকে মধু ও পরাগরেণু সংগ্রহ করে থাকে, তবে উত্তম সময় সকাল ১১.০০ থেকে দুপুর ১২.০০ টার মধ্যে। বীজ উৎপাদনের কাছাকাছি এলাকার মধ্যে মৌমাছির বাসা না থাকলে জমিতে মৌমাছির সংখ্যা কম থাকাই স্বাভাবিক। মৌমাছির জন্য ফুলে ভ্রমণ উপযোগী তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহের গতি এবং মেঘের পরিমাণ যথাক্রমে >২১ক্ক সে., ৭৫%, ২৫ কিমি./ঘণ্টা এবং মেঘমুক্ত আকাশ বা কম মেঘ। পেঁয়াজের পরাগরেণু ভিজা হওয়ায় বায়ু প্রবাহের মাধ্যমে পরাগায়নের হার কম হয়। অযাচিতভাবে কীটনাশকের ব্যবহার, খরা, মৌমাছির আবাসস্থল ধ্বংস, মৌমাছির খাবার ঘাটতি, বায়ু দূষণ, বৈষ্যিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি, অতি বৃষ্টি, রোগবালাই ইত্যাদির কারণে মৌমাছি মারা যেতে পারে।
পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে উপযুক্ত পর-পরাগায়নের গুরুত্ব : পেঁয়াজ ফুলের গর্ভমু-ের  গ্রহণক্ষমতার পূর্বেই পরাগরেণু ঝরে যায়। তাই পেঁয়াজে পর-পরাগায়নের জন্য পরাগরেণু অবশ্যই একই গাছের অন্য ফুল কিংবা আলাদা গাছের ফুল থেকে আসতে হয়। পেঁয়াজের একই ফুলের মধ্যে স্ব-পরাগায়ন অসম্ভব। গবেষণা প্রতিবেদন মতে পেঁয়াজে ১০০% পর-পরাগায়ন সংঘটিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৮৭%, ১০% এবং ৩% যথাক্রমে মৌমাছি, বায়ুপ্রবাহ এবং অন্যান্য পরাগবহনকারীর মাধমে পরাগায়ন সংঘটিত হয়। এ পরিসংখ্যানগত তথ্যের মধ্যে অঞ্চল/দেশভেদে ভিন্নতা রয়েছে। পোকার মধ্যে মৌমাছি মধু ও পরাগরেণুর উপর নির্ভরশীল। অন্যান্য পরিচর্চা নিখুঁতভাবে হলেও প্রাকৃতিক পরাগবহনকারীর অনুপস্থিতিতে বীজ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পরে। প্রাকৃতিক পরাগবহনকারীর অভাবে অপর্যাপ্ত পরাগায়নের কারণে কদমে বীজ উৎপাদনের পরিমাণ একেবারেই হ্রাস পেতে পারে। এ সমস্যার ফলে কদমে যে পরিমাণ বীজ উৎপন্ন হয় তার অধিকাংশ বীজই অপুষ্ট এবং ছোট হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম হার ও ফলন উভয়ই হ্রাস পায়। উপযুক্ত পরাগায়নের ফলে বীজের ফলন এবং গুণগত মান উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে উপযুক্ত স্বাতন্ত্র্যীকরণের গুরুত্ব : একই প্রজাতির জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ফসলের দুই বা ততোধিক জাতের মধ্যে পৃথিকীকরণের যে পদ্ধতির প্রয়োজন হয় তাকে স্বাতন্ত্র্যীকরণ (ওংড়ষধঃরড়হ) বলে। পেঁয়াজ পর-পরাগায়িত ফসল বিধায় স্বাতন্ত্র্যীকরণ বিভিন্ন জাতের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত পর-পরাগায়ন প্রতিরোধ করে কিংবা পর-পরাগায়নের সম্ভাবনা পরিহার বা সীমিত করে প্রতিটি জাতের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনে প্রাথমিক চাহিদা হলো বিভিন্ন জাতের মানসম্পন্ন বীজের প্রাপ্যতা। মানসম্পন্ন বীজের মাধ্যমে কন্দের ফলন এবং গুণগতমান উভয়ই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের সময় জমিতে অফ-টাইপ গাছের সর্বাধিক অনুমোদিত সীমা হলো ০.১-০.২%। এ তথ্য থেকে স্বাতন্ত্র্যীকরণের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। প্রতি বছর সঠিক স্বাতন্ত্রীকরণের নিয়ম না মেনে বীজ উৎপাদনের কারণে সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন পেঁয়াজের জাতগুলোর উন্নত বৈশিষ্ট্য ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। তাই পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে স্বাতন্ত্র্যীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
পেঁয়াজে উপযুক্ত স্বাতন্ত্র্যীকরণের ব্যবস্থাপনা : পর-পরাগায়িত ফসল বিধায় জাতের স্বকীয় মানবজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতের বীজ উন্মুক্তভাবে পাশাপাশি জমিতে উৎপাদন করা যায় না। পেঁয়াজের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্বাতন্ত্র্যীকরণ পদ্ধতি।
বীজ উৎপাদনে স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব : একই প্রজাতির জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ফসলের দুই বা ততোধিক জাতের মধ্যে যে সর্বনিম্ন পৃথিকীকরণ দূরত্বের প্রয়োজন হয় তাকে স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব বলে। বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরী। পেঁয়াজে ভিত্তি বীজ এবং প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদনের জন্য স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব যথাক্রমে ১০০০ ও ৫০০ মিটার। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন কন্দ থেকে হয় বিধায় মাতৃ কন্দের শারীরিক গুণাবলিও মানসম্পন্ন হতে হয়। মাতৃ কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জাতের মধ্যে কমপক্ষে ৫ মিটার স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। মূলত কৃষকের পর্যাপ্ত জমি না থাকার কারণে একই জমিতে বিভিন্ন জাতের বীজ উৎপাদন করে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে বীজ উৎপাদনকারী কৃষকগণ সমবায় পদ্ধতিতে “এক গ্রামে এক জাত (ঝববফ ারষষধমব পড়হপবঢ়ঃ)”-র নীতি মেনে বীজ উৎপাদন করলে জাতের মিশ্রণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন সহজ হবে, পাশাপাশি কৃষকদের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ব্রান্ডের বীজ উৎপাদিত হবে, যা সহজেই বাজারজাত করা যাবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অংশীজন যেমন, সরকারের নির্দেশনা, সরকারি-বেসরকারি গবেষণা, সম্প্রসারণ বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় এবং সহযোগিতায় এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলোতে তুলনামূলকভাবে নিম্ন তাপমাত্রা ও শুষ্ক আবহাওয়া দীর্ঘ দিন বিরাজ করে। ফলে উত্তর অঞ্চল বীজ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী বিধায় সে অঞ্চলেও বিভিন্ন জাতের পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাতন্ত্র্যীকরণ  
পর্যাপ্ত পরিমাণে জায়গা না থাকলে স্বাতন্ত্র্যীকরণ দূরত্ব বজায় রেখে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে ভৌত বাধা সৃষ্টি করে যেমন, নাইলন কাপড় দিয়ে তৈরি জালের বড় খাঁচার মধ্যে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা হয়। এ খাঁচার মধ্যে মৌ-বক্স স্থাপন করে পরাগায়নের ব্যবস্থা করে বীজ উৎপাদন করা হয়। তাছাড়া ঘরের মাছি চাষ করে খাঁচার মধ্যে ছেড়ে দিয়েও পরাগায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতি অধিকতর কঠিন এবং ব্যয়বহুল। একক গাছ কিংবা সীমিত কিছু গাছের বীজ উদপাদনের জন্য নাইলনের ছোট ছোট থলে ব্যবহার করা হয়।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৩৬১, ই-মেইল : khanalauddinsrsc@gmail.com

বিস্তারিত
লেবুজাতীয় বা সাইট্রাস ফল ঝরা সমস্যার সমাধান

লেবুজাতীয়  বা সাইট্রাস ফল ঝরা সমস্যার সমাধান

ড.মো.সদরুল আমিন
লেবু-কমলা ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ। ঈরঃৎঁং ংঢ়.  রোটেসি (জঁঃধপবধব) পরিবারভুক্ত। রোটেসি পরিবারে প্রায় ১৪টি  প্রজাতির সাইট্রাস ফল রয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ু এবং আবহাওয়া জাত ভেদে বছরব্যাপী লেবু জাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। লেবু, কাগজী, জারা লেবু, এলাচি লেবু আদা লেবু, সাতকরা, তৈকর, বাতাবি লেবু  রপ্তানি ফসলের মধ্যে মোট রপ্তানিকৃত উদ্যান ফসলের  প্রায় ৩৫%। ২০২১-২২ বছরে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন লেবুজাতীয় ফল উৎপন্ন হয়
ফল ঝরা লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে বড় সমস্যা। এ সমস্যা গাছের বয়স, জাত ও বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল। লেবুজাতীয় গাছে ফল ধারণ থেকে শুরু করে পরিপক্বতার পূর্ব পর্যন্ত কিছু ফল ঝরে যায়। গ্রীষ্মের শুরুতে উচ্চতাপমাত্রার দরুণ কিছু ফল ঝরে পড়ে। গাছ থেকে সংগ্রহের আগে ফল ঝরে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাইট্রাস ফুল, ফল উৎপাদন ও ঝরা সমস্যার সমাধানে অন্তত ৪টি বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত কারিগরি কাজ সম্পাদন করতে হবে। যেমন- (১) মাটি ও জলবায়ু অনুসারে ফলের জাত নির্বাচন (২) সার প্রয়োগ ও ফসলের পুষ্টি ও বালাই নিয়ন্ত্রণ অণুপুষ্টি ও শারীরবৃত্ত্বীয় রোগের সমন্বিত সমাধান ও (৪) সাইট্রাস ফলের বিশেষ পরিচর্যা সম্পাদন।
মাটি ও জলবায়ু অনুসারে ফলের জাত নির্বাচন
মাটি ও জলবায়ু : একটু উচু সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভাল। সামান্য ঠা-া আবহাওয়ার ফসল। অনুকূল তাপমাত্রা ২০-৩০ সে:। বাতাসের তাপ ৩৫ সে পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। আর্দ্র জলবায়ুতে বালাই উপদ্রব বেশি হয়। সাইট্রাস চাষের জন্য বার্ষিক ৬০০ মিমি. বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। এ ফল চাষের আদর্শ পিএইচ মাত্রা ৫.৫ - ৬.৫ ও লবণাক্ততা সংবেদনশীল। মাটির গভীরতা ১.৫ মিটার থাকা উত্তম।
সাইট্রাস ফল অঞ্চলভিত্তিক প্রায় ১৪ প্রজাতির ও শতাধিক জাত রয়েছে। তা থেকে উপযুক্ত বিশুদ্ধ জাতটি বেছে নিতে হবে। যেমন : আদা জামির (ঈরঃৎঁং রহফরপধ/ ধংংধসবহংরং), সাইট্রন (ঈরঃৎঁং সবফরপধ), গ্রেপ ফ্রুট (ঈরঃৎঁং ঢ়ধৎধফরংব), কিনো (ঈরঃৎঁং হড়নরষরং/ফবষরষরড়ংধ), লেবু (ঈরঃৎঁং ষরসড়হ)।
বর্তমানে দেশে বারি-২, বারি-৩, বিনা-২, চায়না লেবু-১, চায়না লেবু-২, বারি মাল্টা-১, বারি মাল্টা-২, কমলা (বারি ও ভারতীয়) জাতের বড় বড় বাগানে নানা সমস্যা নিয়ে বাণিজ্যিক চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ফল ঝরার ম্যাক্রোপুষ্টি ও বালাই সংক্রান্ত কারণের মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : খাদ্যোপাদানের অভাব বা পুষ্টি নিশ্চিতকরণের জন্য বর্ণিত সুষম হারে সার দিতে হবে। গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য হরমোন ব্যালেন্স মিরাকুলান, এনপিকে ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, লিবরেল জিংক ও সলুবর বোরন সার দিতে হবে। ক্যাংকার, স্ক্যাব, গ্রিনিং, ডাইব্যাক ইত্যাদি রোগের সমন্বিত নিরাময় করতে হবে। সবুজ গান্ধি, মাছি ও পাতা ও ফলের রস শোষক পোকার আক্রমণে অধিকাংশ ফল ঝরে থাকে। এ জন্য জৈব আইপিএমসহ পাইটাফ, টাফগর, ডারসবান, সানমেক্টিনসহ অন্যান্য বালাইনাশক অনুমোদিত মাত্রা, সময়, পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা  : খরা মৌসুমে ডাবল রিং পদ্ধতিতে ৪-৭ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। বয়স্ক গাছ যাতে বাতাসে হেলে না যায় সে জন্য খুঁটি দিতে হবে। ক্যাংকার ঢধহঃযড়সড়হঁং ধীড়হড়ঢ়ড়ফরং  রোগের কারণে গাছের পাতা, ফল ও কচি কা-ে নেক্রসিস হয়। ক্যাংকারী স্ক্যাব (ঊষংরহড়ব ভধপিবঃঃর) রোগের কারণে বিন্দু বিন্দু অসমান উঁচু দাগ পড়ে। পাতা ও ফলের ত্বকে  লালচে দাগ হয়ে থাকে। এ রোগ দমনে বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে; লিফ মাইনার  দমন করতে হবে; ব্লিটক্স প্রয়োগ করতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে আক্রান্ত স্থান হতে যাতে বেশি স্থানে না ছড়াতে পারে সেজন্য কেটে ফেলা উচিত।
সাইট্রাস গাছে ক্লেরোসিস লক্ষণ দেখা দেয়। মধ্যপাতায় ক্লোরোসিস হয়। প্রথমে পাতার শিরা সবুজ থাকে কিন্তু অন্যান্য স্থান হলদে হয়ে যায়। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের একত্র অপুষ্টি লক্ষণ পাতা নৌকার মতো, কুঁকড়ানো, কুঁচকানো ও বিবর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু নাইট্রোজেনের অভাব হলে নিচের পাতা হলদে হয়। সালফারের ঘাটতি হলে উপরের পাতা  হলদে হয়। ক্লোরোসিয় হলে হেক্টরে ৫০০ কেজি ডলোচুন জমি তৈরির সময় দিতে হবে; জমিতে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট   বিঘা প্রতি ১-২ কেজি  দিতে  হবে।
গাছে দস্তার ঘাটতি হলে অসমতা  লক্ষণ দেখা দেয়। গাছের নতুন পাতার গোড়ার দিকে এবং মধ্যশির কিনারা দিয়ে সাদাটে হয়; পাতা প্রথমে সাদাটে সবুজ ময়লা রং ধারণ করে। ফসফরাসের অভাব হলে গাছে চারা বয়সে নীলাভ-সবুজ লক্ষণ দেখা দেয়।   
এ লক্ষণ দেখা দিলে জিঙ্ক সালফেট প্রতি হেক্টরে ৭-৮ কেজি ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে; চারা অবস্থায় শতকরা ০.৫ ভাগ জিঙ্ক সালফেট দ্রবণ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সাইট্রাস গাছের বিশেষ পরিচর্যা
পুরাতন বাগানে খাদ্যোপাদানের অভাব, গামোসিস বা গোড়া পচা রোগের আক্রমণের পরও ৫০ ভাগের অধিক ডালপালা সতেজ আছে এবং কা-ের অন্তত ৫০ ভাগ বাকল ভালো আছে সেই সব গাছকে পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদনশীল করা যায়। পরিচর্যাগুলো হলো :
চারা রোপণের ২-৩ বছর ফল উৎপাদন নিরুৎসাহিত করতে হবে। মৌসুমী ফুল আসার সময় বা ঠিক আগে সেচ ও ইউরিয়া ব্যবহার করা যাবে না বা বালাইনাশক দেওয়া যাবে না। গুটি বাঁধার পর হালকা সেচ, ইউরিয়া ও বালাইনাশক দেয়া যাবে। ফল গুটি হওয়ার পর সলুবর বোরন দিতে হবে। নিরাপদ ফলের জন্য আইপিএম জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। মরা শাখা প্রশাখা ও তাতে জন্মানো পরগাছা অপসারণ করতে হবে। খরার সময় গাছের গোড়া  কচুরিপানা দিয়ে মালচ দিতে হবে। ফল সংগ্রহের পর মরা শুকনা ডাল  ছাঁটাই করতে হবে।

লেখক : প্রফেসর (অব.), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৯৮৮৮০২২৫৩, ই-মেইল :sadrulamin47@gmail.com

বিস্তারিত
আম সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা

আম সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা
ড. মো. শরফ উদ্দিন
আম এদেশের একটি জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। কিন্তু সরবরাহকাল মাত্র ৩-৪ মাস। তবে এই সময়ের পরও বাজারে আম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর মূল্য অধিক (৪০০-৬০০ টাকা প্রতি কেজি) হওয়ায় অধিকাংশ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ হতে জানা যায়, আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ৩০ ভাগের উপরে এবং এর বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে আমাদের কৃষক শ্রম ও অর্থ খরচ করে যে পরিমাণ আম উৎপাদন করেন তার প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ আম নষ্ট হয় বা এ গুলো হতে নায্যমূল্য পাওয়া যায় না। যদি ক্ষতির পরিমাণ টনে বলতে চাই তাহলে ৩.৫-৪.০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয় তারচেয়েও বেশি পরিমাণ আম নষ্ট হয়। যেহেতু আমাদের দেশে জমির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে, সেক্ষেত্রে নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোই বেশি কাম্য। আমের সংগ্রহ হতে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত কী ক্ষতিটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং আম সংগ্রহ হতে শুরু করে ভোক্তা খাওয়া পর্যন্ত সকলে সতর্ক হলে এই অনাকাঙ্খিত ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আম হতে ভালো স্বাদ পেতে হলে সঠিক পরিপক্বতায় আম সংগ্রহ করা উচিত। আমকে আমরা দু’অবস্থায় সংগ্রহ করতে পারি যেমন: কাঁচা এবং পাকা অবস্থায়। আমগাছ হতে আম দু’ভাবে সংগ্রহ করা যায়, হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক ব্যবহার করে। আম গাছের উচ্চতা কম হলে আম সহজেই হাত দ্বারা সংগ্রহ সম্ভব। কিন্তু গাছ বড় হলে বা উচ্চতা বেশি হলে বাঁশের তৈরী আম সংগ্রাহক বা ঠুসি (সধহমড় যধৎাবংঃবৎ) ব্যবহার করা হয়। গাছ থেকে কখন আম সংগ্রহ করতে হবে সে সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরী। পরিপূর্র্ণ পুষ্টতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা উচিত নয়। পরিপূর্ণভাবে পুষ্ট (সধঃঁৎব) হলে আমের উপরের অংশ অর্থাৎ বোঁটার নিচের ত্বক সামান্য হলুদাভ রঙ ধারণ করবে। আমের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০১ - ১.০২ এর মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ পরিপক্ব আম পানিতে ডুবে যাবে। প্র্রাকৃতিকভাবে দু একটা পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে এবং পাখি আধাপাকা আম ঠোকরাবে। আম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন: বেশিরভাগ আমে পরিপক্বতা এলেই গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে, আাম এমনভাবে সংগ্রহ করতে হবে যেন কোন আঘাত না পায়, গাছ থেকে আম সংগ্রহের ১৫/২০ দিন পূর্বে আমগাছে কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক ¯েপ্র্র করা বন্ধ করতে হবে। আমকে কিছুক্ষন উপুড় করে রাখতে হবে যাতে আঁঠা ঠিকমত ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগতে পারে, গাছের নীচ থেকে আম দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে এবং বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে দফায় দফায় আম সংগ্রহ করাই ভাল।
বাছাইকরণ বা গ্রেডিং
সংগৃহীত আমের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বাছাইকরণ একান্ত প্রয়োজন। আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকা দ্বারা আক্রান্ত এবং গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখতে হবে কারণ এসব আম খুব তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। দূরবর্তী বাজারে প্রেরণের জন্য স্বাভাবিক, উজ্জ্বল এবং পরিপুষ্ট আম বাছাই করে প্যাকিং করা উচিত। যে কোন ফল প্যাকিং এর আগে ছোট, মাঝারি এবং বড় এই তিন ভাগে ভাগ করা উচিত যাতে প্যাকিং, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়।
রাইপেনিং চেম্বারের মাধ্যমে আম পাকানো
ইথিলিন প্রয়োগের সঠিক উপায় ও পদ্ধতি হলো গ্যাসীয় পদ্ধতিতে ইথিলিন প্রয়োগ, আর এ জন্য সারা বিশে^ স্বীকৃত উপায় হচ্ছে রাইপেনিং চেম্বার তৈরি করে তার মধ্যে ফল রেখে ইথিলিন প্রয়োগ করে ফল পাকানো। রাইপেনিং চেম্বারে ইথিলিন গ্যাস ব্যবহার করে প্রত্যেকটি জাত ৭-১০ দিন পূর্বে পাকানো সম্ভব। পৃথিবীর অনেক আম উৎপাদনকারী দেশে রাইপেনিং চেম্বারে আম পাকানো পদ্ধতিটি বহুল প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি। রাইপেনিং চেম্বার ব্যবহার করে কাঙ্খিত ফলাফল পেতে অবশ্যই রাইপেনিং চেম্বারের মুলনীতি ভালোভাবে জানা এবং তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা উচিত। বিভিন্ন দেশে ফল পাকার জন্য একটি ইটের তৈরী ঘর ব্যবহার করা হয় যা রাইপেনিং চেম্বার নামে পরিচিত। রাইপেনিং চেম্বার হল হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি ঘরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও এর ভিতরের ইথিলিন গ্যাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিপক্কতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এখানে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়স্ত্রণের মাধ্যমে ফলের পরিপক্কতাকে ধীর বা তরান্বিত করা হয়। অপর দিকে এখানে ইথিলিন গ্যাস প্রয়োগের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো সম্ভব হয়।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য কৃষিপণ্যে বা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ সংক্রান্ত কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ফল পাকাতে ইথোফেন ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ণয়, মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিরসন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ইথোফেনের রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশ নিরূপণে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মাঠপর্যায় থেকে ফলের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে ২৫০-১০০০০ পিপিএম ইথোফেনে প্রয়োগ ও তার অবশিষ্টাংশের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, টমেটো, আমসহ বিভিন্ন ফলে ইথোফেন প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইথোফেনের অবশিষ্টাংশ যা থাকে তা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত/অনুমোদিত মাত্রার (২ পিপিএম) নিচে চলে আসে, যা মানবদেহের জন্য নিরাপদ। এখানে উল্লেখ্য, সঠিক উপায়ে ও মাত্রা ব্যবহার করে আম পাকানো হলে ইথোফেন শতভাগ নিরাপদ এবং তা কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে না।
প্যাকিং
আম সংগ্রহের পর ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর জন্য আমের যে ব্যবস্থাপনা হয় তাকে প্যাকিং বলে। আম দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকিং একান্ত প্রয়োজন। আম সামান্য আঘাতে ক্ষত হতে পারে এবং এতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। আম প্যাকিং এর সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত। সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো প্লাষ্টিকের ক্রেটে আম পরিবহন করা। প্লাষ্টিক ক্রেট এর গায়ে খবরের কাগজ দিয়ে লাইনিং করে এবং প্রতিটি আমকে টিসু পেপার বা খবরের কাগজ দ্বারা মুড়িয়ে দেওয়া ভালো। প্র্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে ফলের নাম, জাতের নাম, প্রাপকের নাম ইত্যাদি লিখে রাখা উচিত। প্যাকিং এর আগে আমকে গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের সংরক্ষণকাল ৫-৭ দিন বৃদ্ধি পায় এবং আমের রঙ কিছুটা হলুদ হয় এবং বেশ কিছুদিন রোগমুক্ত থাকে।
পরিবহন
আমাদের দেশে প্রধানত: সড়ক পথেই আম পরিবহন করা হয় কারণ এতে সময় কম লাগে। তাছাড়া বাগান থেকে বাজারে আম পরিবহনের জন্য রিক্সা, ভ্যান, নৌকা ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়। আম পরিবহনে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যানবাহনে আম উঠানো, নামানো ও পরিবহনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন ফলের গায়ে বা প্যাকেটে আঘাত না লাগে।
পরিবহনে বেশি সময় নষ্ট না করাই ভাল। কারণ তাতে আম পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পরিবহন শেষে প্যাকেট খোলা ও আম গুদামজাত করা উচিত।
গাদাগাদি করে আম পরিবহন করলে নিচের আমে বেশি চাপ পড়ে ও আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গুদামজাতকরণ
গাছ থেকে আম সংগ্রহ পর বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আমকে গুদামজাত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কোন ফল গাছ থেকে সংগ্রহ পরও তার মধ্যে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তাই আম গুদামজাত করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যে ঘরে আম রাখা হবে তা অবশ্যই বাতাস চলাচলের উপযোগী ও শীতল হতে হবে। প্রয়োজনে ইলেকট্রিক ফ্যান বাবহার করা যেতে পারে।
আর্দ্র আবহাওয়ায় ও বদ্ধ ঘরে আম তাড়াতাড়ি পাকে এবং সহজে পঁচন ধরে যায়। তাই পাকা আম বেশি দিন গুদামে সংরক্ষণ না করে তাড়াতাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজারজাতকরণ
যে কোন জিনিস বাজারজাতকরণ একটি সুন্দর শিল্প। দক্ষ ব্যবসায়ীগণ বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসামগ্রীকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন যাতে ক্রেতাসাধারণ অতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। আম বাজারজাতকরণের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত।
কোন আমে পঁচন দেখা মাত্রই আলাদা করে রাখতে হবে, কারণ এর জীবাণু অন্যান্য সুস্থ আমকে সংক্রমণ করতে পারে। ছোট, মাঝারি ও বড় তিন সাইজের ফল বাছাই করে বাজারজাত করতে হবে।
আম রপ্তানি
বিবিএস ২০২১ অনুসারে আম চাষাবাদের আওতাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৯৫২৮৩ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন ১২.২২ লাখ মেট্রিক টন। অপর দিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক দেশে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে আম চাষা হচ্ছে। যার বাৎসরিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ও বিদেশে এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন আমের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এতে আমের রপ্তানিও বাড়বে। রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে দেশি বাজারে আমের কদর বাড়বে এবং আম চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদেশে ভালো আমের উৎপাদন যে হারে বাড়ছে রপ্তানির পরিমাণ (১৬০, ৫৮০,৬৬৫, ৩০৯, ২৩২, ৩০৯, ২৭৯, ১৬২২, ১৭৩৮ মেট্রিক টন) আশানুরুপভাবে বাড়ছে না। অথচ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আম রপ্তানি করা হলে প্রতি বছর ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান উৎপাদনের ২ ভাগ আম রপ্তানি করা সম্ভব হলে ২০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হবে।

লেখক : উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল-sorofu@yahoo.com

বিস্তারিত
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে পলিনেটরের গুরুত্ব এবং এদের সুরক্ষায় করণীয়

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে পলিনেটরের গুরুত্ব
এবং এদের সুরক্ষায় করণীয়
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
বৈচিত্র্যময় অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমন্বয়ে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। উদ্ভিদকুল স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠে এবং নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করে। কিন্তু প্রাণীকুল খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল এবং অধিকাংশ উদ্ভিদের ফল ও বীজ ধারণের নিমিত্তে অত্যাবশ্যকীয় পরাগায়ন বা পলিনেশন সংঘটিত হওয়ার জন্য প্রাণীকুলের সহায়তা প্রয়োজন। যে সকল প্রাণীকুল পরাগায়ন সংঘটিত করে থাকে তাদেরকে পলিনেটর বলে। এরা ফুলের পুরুষ অংশ অর্থাৎ পরাগধানী থেকে পরাগরেণু বহন করে একই ফুল বা অন্য ফুলের স্ত্রী অংশে অর্থাৎ গর্ভমু-ে স্থানান্তরে সহায়তা করে ফুলের নিষেকক্রিয়া সম্পন্ন করে। ফলে ফল ও বীজ তৈরি হয়, যা নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেয়। সুতরাং ফল ও বীজ তৈরির জন্য পরাগায়ন অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়া। যা কীটপতঙ্গ, পাখি, বিভিন্ন ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, বাতাস, পানি এবং মহাকর্ষীয় বল ইত্যাদি বাহকের মাধ্যমে।
এক লাখেরও বেশি অমেরুদন্ডী প্রাণী যেমন- মৌমাছি, প্রজাপতি, বিটল, মথ, বোলতা, বিভিন্ন মাছি এবং এক হাজারেরও বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী উদ্ভিদের পরাগায়ন করে থাকে। বন্যপ্রাণীদের এই বৈচিত্র্যময় গ্রুপ তাদের খাদ্য যেমন- ফুলের আমিষ সমৃদ্ধ পরাগরেণু এবং উচ্চ শক্তিসম্পন্ন নেকটার সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায় এবং পরাগরেণু বহন ও স্থানান্তর করে এভাবে ফুলকে নিষিক্ত করে ফল ও বীজ ধারণে সহায়তা করার মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি করে।
এসব বাহকের মধ্যে শুধু কীটপতঙ্গ দ্বারাই পরাগায়ন নির্ভর করে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি ফসলের উৎপাদন। যার অধিকাংশই ফল, সবজি, তেল, ডাল, নাট, মসলা, কফি এবং কোকো জাতীয় ফসল। কীটপতঙ্গ হচ্ছে মাঠ ও উদ্যান ফসলের জন্য সবচেয়ে সাধারণ এবং কার্যকরী পরাগায়নকারী (চড়ষষরহধঃড়ৎ)। এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছি, মাছি, বিটল, প্রজাপতি, মথ, বোলতা ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি পুষ্পধারণকারী উদ্ভিদের পরাগায়ন নির্ভর করে কীটপতঙ্গ তথা বিভিন্ন প্রজাতির মধু সংগ্রহকারী মাছির উপর। পৃথিবীতে ২৫০০০ এর বেশি প্রজাতির মধু সংগ্রহকারী মাছি আছে। যাদের মধ্যে রয়েছে- মৌমাছি, ভ্রমর, স্টিংলেস-বি, সলিটারী-বি ইত্যাদি।
আবার এই মাছিগুলোর মধ্যে মৌমাছি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কার্যকর, দক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ পলিনেটর। তারা আমাদের শস্য এবং বন্য উদ্ভিদ উভয়কেই পরাগায়ন করে থাকে। মৌমাছি পৃথিবীর ৭০% চাষাবাদকৃত ফসলকে পরাগায়িত (চড়ষষরহধঃব) করে থাকে। মৌমাছি, মধু মৌমাছি বা ভ্রমর যখন এক ফুল থেকে অন্য ফুলে নেকটার এবং পরাগরেণু সংগ্রহের জন্য ভ্রমণ করে তখন তাদের দেহের সংগে পরাগধানীর ঘর্ষনের ফলে স্কোপায় অথবা পোলেন বাস্কেটে পরাগরেণু লেগে যায়। এক ফুল থেকে যখন অন্য ফুলে ভ্রমণ করে তখন অন্য ফুলের গর্ভমু-ে পরাগরেণু স্থানান্তরিত হয়, এভাবে তারা নিজের অজান্তেই পরাগায়নের মহৎ কাজটি করে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা উদ্ভিদ থেকে ফল, সবজি ও নাট জাতীয় বিভিন্ন খাদ্য পেয়ে থাকি, নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি হয় এবং ইকোসিস্টেম সুরক্ষিত থাকে। আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, পানীয়, ওষুধ, তেল ও মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য পৃথিবীতে ১,৪০০ ধরণেরও বেশি ফসল উদ্ভিদ জন্মানো হয় এবং এদের প্রায় ৮০ ভাগই প্রাণী/জীব পরাগায়িত।
প্রজাপতি এবং মথ ও উদ্ভিদকে বিভিন্ন মাত্রায় পরাগায়নের সাহায্য করে থাকে। এরা ফুল থেকে নেকটার সংগ্রহ করতে গিয়ে পরাগায়ন সংঘটিত করে থাকে। নলাকৃতির উজ্জল রঙ্গিন ফুল- যেগুলো দিনের বেলা ফোটে এবং যার উপর ভালোভাবে অবতরণ করা যায় এমন ধরণের ফুলের প্রতি প্রজাপতিরা আকৃষ্ট হয়। অন্য দিকে নলাকৃতির ফ্যাকাশে অনুজ্জ¦ল ফুল যারা খুব সুগন্ধিযুক্ত এবং রাতে ফোটে এ ধরণের ফুলের প্রতি মথসমূহ আকৃষ্ট হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির বিটল, বোলতা, মিজ, থ্রিপস, হোভার ফ্লাই, ফ্রুট ফ্লাই, বি ফ্লাই, পিঁপড়া এমনকি মশাও পলিনেটর হিসেবে কাজ করে থাকে।
মেরুদ-ী প্রাণীদের মধ্যে বাদুর, বিভিন্ন ধরণের পাখি যেমন- হামিংবার্ড, সানবার্ড এবং অন্যান্যদের মধ্যে বানর,ভ্যাম-বিড়াল, ইঁদুর, টিকটিকি ইত্যাদি প্রাণীও পলিনেটর হিসেবে কাজ করে থাকে। এ ছাড়া মানুষ নিজেও হাত দ্বারা পরাগায়ন করে। বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
গ্রীষ্মপ্রধান এবং মরুভূমি আবহাওয়ায় বাদুর একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিনেটর। আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং প্যাসিফিক আইল্যান্ডের অধিকাংশ পুষ্প উৎপাদনকারী উদ্ভিদে বাদুর পরাগায়ন করে থাকে। ১,৮০,০০০ এর বেশি উদ্ভিদ প্রজাতিতে পলিনেটরেরা পলিনেশন সার্ভিস প্রদান করে থাকে। আমাদের প্রতি ৩ গ্রাস খাবারের ১ গ্রাস পলিনেটর পলিনেটেড খাবার। পলিনেটররা শুধু আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, এরা বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্য ও আবাসের জন্যও সহায়তা করে। এরা নির্মল বাতাসের সুস্থ ইকোসিস্টেম, মাটি ক্ষয়রোধ করে মাটিকে স্থায়ী করা এবং দূষিত আবহাওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন গাছে ফল ও বীজ ধারণে সহায়তার মাধ্যমে বণ্যপ্রাণীদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পলিনেটর ছাড়া মানবকূলসহ পৃথিবীর স্থলজ ইকোসিস্টেম নষ্ট হবে।
পলিনেটর পপুলেশন
বর্তমানে পলিনেটরের পপুলেশন প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে পলিনেটরের প্রাচুর্য্যতা, বৈচিত্র্যতা এবং স্বাস্থ্য হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক দশকে জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু বন্য পলিনেটর প্রজাতির পরিভ্রমণ, প্রাচুর্য্যতা এবং ঋতুভিত্তিক কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ তার কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক ভূচিত্র এবং ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন এনেছে যার ফলে বন্য পলিনেটরের প্রাকৃতিক আবাসস্থল কমে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ পলিনেটর কমে যাওয়ার একটি নির্দেশক হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সকল কৃষি পরিচর্যা করা সত্ত্বেও ফসলের ফলন ও গুণগত মান কমে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ভারতের হিমাচল প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, উত্তর পাকিস্তানে এবং চীনের কিছু কিছু অংশে সকল কৃষি পরিচর্যা করা সত্ত্বেও ফলজাতীয় শস্য যেমন- আপেল, আলমন্ডস, চেরি এবং নাশপাতির উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যাচ্ছে।
হিমালয়ান অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মৌমাছি পালন করে তাদের দ্বারা পরাগায়ন ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরণের ফলের ফলধারণ ও গুণগতমান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ফল ঝরে পড়া কমে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- আপেল, পীচ, পাম, সাইট্রাস, স্ট্রবেরী ইত্যাদি ফলের ফলধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- শতকরা ১০, ২২, ১৩, ২৪ এবং ১১২ ভাগ এবং ফলের ওজন বেড়েছে যথাক্রমে- শতকরা ৩৩, ৪৪, ৩৯, ৩৫ এবং ৪৮ ভাগ। আবার দেখা গেছে মৌমাছি পরাগায়নের দ্বারা লেবু জাতীয় ফলের রস ও মিষ্টতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের সবজি জাতীয় ফসল যেমন- বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, লেটুস ইত্যাদি ফসলের ফলধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- শতকরা ২৮, ২৪, ২৩ এবং ১২ ভাগ এবং বীজধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- শতকরা ৪০, ৩৭, ৩৪ এবং ৯ ভাগ। গবেষণায় দেখা গেছে নিয়ন্ত্রিত মৌমাছি পরাগায়ন তেলবীজ জাতীয় ফসল যেমন- সরিষা ও রাইজাতীয় ফসল এবং সূর্যমূখীতে জাতভেদে শতকরা ২০-৪০ ভাগ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করে এবং এ ছাড়াও বীজে তেলের পরিমাণ ও বীজের অংকুরোদগম হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। মসলাজাতীয় ফসল যেমন- পেঁয়াজ বীজ, ধনিয়া, কালোজিরা, মৌরি, শলুক, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি ফসলের ফলন গড়ে ২০-৩০% বেড়ে যায় এবং বীজের সজীবতা ও অংকুরোদগম হারও বৃদ্ধি পায়।
ভারতের তামিলনাডু কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে মৌমাছি পরাগায়নের ফলে যথাক্রমে সরিষার শতকরা ৪৩ ভাগ, সূর্যমুখীর শতকরা ৩২-৪৮ ভাগ, তুলার শতকরা ১৭-১৯ ভাগ, পেঁয়াজের শতকরা ৯৩ ভাগ এবং আপেলের শতকরা ৪৪ ভাগ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুতরাং কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের গুণগতমান এবং উৎকর্ষ সাধনে পলিনেটরের সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজন।
পলিনেটর সুরক্ষায় বালাইনাশক ব্যবহারে করণীয় : সরাসরি ফুলে বালাইনাশক স্প্রে করা যাবে না। সাধারণত দুপুরের আগে পলিনেটররা যখন ফুলে মধু সংগ্রহ করে সেসময় স্প্রে করা যাবে না। বিকেলে মৌমাছিগুলো তাদের মৌচাকে ফিরে গেলে স্প্রে করতে হবে। সব সময়ই বালাইনাশকের প্যাকেটে/বোতলের লেবেলে ব্যবহার নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্প্রে করতে হবে। বিশেষ করে পরিবেশের প্রতি ঝুঁকির দিকটা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। তরল বালাইনাশকের তুলনায় দানাদার বালাইনাশককে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা দানাদার বালাইনাশককে গাছের উপরিপৃষ্ঠে কম অবশেষ থাকে। যতটুকু সম্ভব শুধুমাত্র টার্গেট পেস্টকে স্প্রে করার চেষ্টা করতে হবে। মৌমাছি এবং অন্যান্য পলিনেটরদের জন্য পানির প্রয়োজন হয়। এজন্য খোলা জায়গায় কোন পাত্রে অথবা কোন চৌবাচ্চায় পানি আছে এমন জায়গায় কোন বালাইনাশক না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। স্থানীয় আবহাওয়া ও মাটির সাথে খাপ খায় এবং যেসব ফসলের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য কম বালাইনাশক প্রয়োজন হয় সে সব ফসলের চাষ করতে হবে।
পলিনেটর পপুলেশনকে উন্নত করতে করণীয় : সংরক্ষণ কৃষির মাধ্যমে পরিবেশে গাছপালা বৃদ্ধি করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপকতা/তীব্রতা বাড়াতে হবে। এতে জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন হবে। যা পলিনেটর পপুলেশন উন্নত করবে। কৃষি বনায়ন করা এবং কৃষি বনায়ন কার্যক্রমে পুষ্পোদগম উদ্ভিদ যেন প্রাধান্য পায় সে দিকে নজর রাখতে হবে। কৃষির সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কীটপতঙ্গ পরাগায়ন তথা মৌমাছির পরাগায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য আবাসস্থলের সংরক্ষণ করতে হবে। একক উদ্ভিদের চেয়ে ঝাড় আকারে উদ্ভিদ জন্মাতে হবে, যাতে অধিক পলিনেটরকে আকর্ষণ করে। বাড়ির পিছনের উঠোনে পলিনেটর বান্ধব গাছপালা লাগাতে হবে। যে সকল উদ্ভিদ যারা বছরের বিভিন্ন সময়ব্যাপি ফুল উৎপাদন করে সেসকল উদ্ভিদকে পছন্দ করে নির্বাচন করতে হবে, যাতে পুরো মৌসুমে নেকটার ও পরাগরেণুর জোগান থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, পলিনেটর ও উদ্ভিদকুল তথা কৃষির উৎপাদন ও উৎকর্ষ সাধন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের অন্ন, বন্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা ও সুরক্ষায় পলিনেটর অত্যাবশ্যকীয়। সুস্থ ও সুন্দর ইকোসিস্টেম বজায় রাখতে এখনই পলিনেটরের গুরুত্ব ও সুরক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল নম্বর: ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫,Email:hossain.draltaf@gmail.com

বিস্তারিত
আমের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা

আমের বিভিন্ন প্রকার রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ- গন্ধে ইহা একটি অতুলনীয় ফল। এই উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। তাই আম সকল ফলের সেরা। আম এমন একটি ফল যা ছোট থেকে শুরু করে পাকা পর্যন্ত সব অবস্থায় খাওয়া যায়। বাংলাদেশে আম চাষাবাদের এলাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের দেশে আম চাষে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো প্রতিহত করতে না পারলে আম চাষ লাভজনক হয় না। এরমধ্যে আমের নানা ধরনের রোগ জনিত সমস্যা অন্যতম। দমন ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে নি¤েœ আলোচনা করা হলোঃ
এনথ্রাকনোজ : এই রোগ গাছের কচিপাতা, কা-, কুঁড়ি, মুকুল ও ফলে দেখা যায়। পাতায় অসমান আকৃতির ধুসর বাদামি বা কালচে রঙের দাগ পড়ে। পাশাপাশি কয়েকটি দাগ একত্র হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। বেশি আক্রান্ত হলে পাতা ঝরে পড়ে। আমের মুকুল বা ফুল আক্রান্ত হলে কালো দাগ দেখা দেয়। ফুল আক্রান্ত হলে তা মারা যায় এবং ঝরে পড়ে। মুকুল আক্রান্ত হলে ফলধারণ ব্যাহত হয়। আম ছোট অবস্থায় আক্রান্ত হলে আমের গায়ে কালো দাগ দেখা দেয়। আক্রান্ত ছোট আম ঝরে পড়ে। বাড়ন্ত আমে রোগের জীবাণু আক্রমণ হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। পাকা আমে ধুসর বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি করে। গুদামের আবহাওয়া অনুকূল হলে রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। আম বড় হওয়ার সময় ঘন ঘন বৃষ্টি ও মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করলে আমে আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার : রোগাক্রান্ত বা মরা ডালপালা ছাটাই করে পুড়ে ফেলতে হবে;  গাছের রোগাক্রান্ত ঝরা পাতা ও ঝরে পড়া আম সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, প্রয়োজনে মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে; মুকুলে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করতে হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ভালভাবে ¯েপ্র্র্র করতে হবে। মুকুল ১০-১৫ সে:মি: লম্বা হলে প্রথম ¯েপ্র্র শেষ করতে হবে। আম মটরদানার মত হলে দ্বিতীয় বার ¯েপ্র করতে হবে। কীটনাশক এবং  ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে ¯েপ্র্র করা যেতে পারে; বাড়ন্ত আমকে রোগমুক্ত রাখতে হলে আম সংগ্রহের ১৫ দিন আগ পর্যন্ত  মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক বা একরোবেট এম জেড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে বা কার্বেন্ডাজিম প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে ১৫ দিনের ব্যবধানে ৩/৪ বার ¯েপ্র করতে হবে; গাছ থেকে আম পাড়ার পরপরই গরম পানিতে (৫৫০ সেঃ তাপমাত্রায় ৫ মিনিট) ডুবিয়ে রাখার পর শুকিয়ে অর্থাৎ গরম পানিতে শোধন করে গুদামজাত করতে হবে।
বোঁটা পচা : আম গাছ থেকে পাড়ার পর পাকতে শুরু করলে বোঁটা পচা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথমে বোঁটায় বাদামি অথবা কালো দাগ দেখা দেয়। দাগ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং গোলাকার হয়ে বোঁটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জীবাণু ফলের ভেতরে আক্রমণ করে পচিয়ে ফেলে। আক্রান্ত আম ২/৩ দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। রোগের জীবাণু বোঁটা ছাড়াও অন্যান্য আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দিয়ে আমের ভেতরে প্রবেশ করে আম পচিয়ে ফেলতে দেখা যায়।
প্রতিকার : রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে গাছ থেকে আম পাড়তে হবে। আম পাড়ার সময় যাতে আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;  ৫ সেমি. (২ ইঞ্চি) বোঁটাসহ আম পাড়লে এ রোগের আক্রমণ কমে যায়; আম পাড়ার পর গাছের তলায় জমা না রেখে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে; আম পাড়ার পর পরই গরম পানিতে (৫৫০ সে: তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট) অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দ্রবণে (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম) ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখার পর গুদামজাত করলে বোঁটা পচা রোগের আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়।  
আমের আঠা ঝরা এবং হঠাৎ মড়ক : বর্তমানে আম গাছের যে সমস্ত রোগ দেখা যায় তাদের মধ্যে আমের আঠা ঝরা এবং হঠাৎ মড়ক সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এরোগে আক্রান্ত গাছ খুব অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায়। প্রথমে কা- অথবা মোটা ডালের কিছু কিছু জায়গা থেকে হালকা বাদামি থেকে গাড় বাদামি রঙের আঠা বা রস বের হতে থাকে। বেশি আক্রান্ত ডগা বা ডালটি অল্প দিনের মধ্যেই মারা যায়। কিছুদিন পর দেখা যায় আরেকটি ডাল একইভাবে মারা যাচ্ছে। এভাবে একপর্যায়ে সম্পূর্ণ গাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকার : গাছে মরা বা ঘন ডালপালা থাকলে তা নিয়মিত ছাঁটাই করতে হবে; আঠা বা রস বের হওয়ার স্থানের আক্রান্তসহ সুস্থ কিছু অংশ তুলে ফেলে সেখানে বোর্দো পেস্টের (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা যায়) প্রলেপ দিতে হবে; আক্রান্ত ডাল কিছু সুস্থ অংশসহ কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। কাটা অংশে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দো পেস্টের প্রলেপ দিতে হবে; গাছে নতুন পাতা বের হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ১৫ দিনের ব্যবধানে ২ বার ¯েপ্র্র করতে হবে।
আগামরা : রোগের জীবাণু প্রথমে কচি পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতা বাদামি হয় এবং পাতার কিনারা মুড়িয়ে যায়। পাতাটি তাড়াতাড়ি মারা যায় ও শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা থেকে এ রোগের জীবাণু কুড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ডগার সামনের দিকে মরে যায়। মরা অংশ নিচের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ফলে বহু দুর থেকে আগামরা রোগের লক্ষণ বোঝা যায়। ডগাটি লম্বালম্বিভাবে কাটলে বাদামি লম্বা দাগের সৃষ্টি করে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকার : আক্রান্ত ডাল কিছু সুস্থ অংশসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা অংশ পুড়িয়ে ফেলা ভাল। কাটা অংশে বোর্দো পেস্টের (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা যায়) প্রলেপ দিতে হবে; গাছে নতুন পাতা বের হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ১৫ দিনের ব্যবধানে ২/৩ বার ¯েপ্র্র করতে হবে।
কাল প্রান্ত : ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধোয়ার কারণে এ রোগ হতে পারে। আমের বয়স দেড় মাস হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। আক্রান্ত আমের বোঁটার দিকের অংশ স্বাভাবিকভাবে বাড়লেও নিচের অংশ ঠিকমতো বাড়তে পারে না। ফলে আমের গঠন বিকৃত হয়। নিচের অংশ কুঁচকে যায়, বেশি আক্রান্ত আমের নিচের অংশ কাল হয়ে যায়। কোন কোন সময় আমের বিকৃত অংশ ফেটে যেতে পারে এবং পচে যেতে পারে।
প্রতিকার : আম মার্বেল আকারের হলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক পাউডার ১০-১৫ দিন পর পর ৩-৪ বার ¯েপ্র করতে হবে; ইটের ভাটা আম বাগান থেকে ২ কিমি. দূরে স্থাপন করতে হবে; ইটের ভাটার চিমনি কমপক্ষে ৩৭ মিটার (১২০ ফুট) উঁচু করতে হবে।
আম ফেটে যাওয়া : আম ছাড়াও কাঁঠাল, ডালিম, পেয়ারা ইত্যাদি ফল ফেটে যেতে দেখা যায়। সব ধরনের ফল ফাটার কারণ মোটামুটিভাবে একই। মাটিতে রসের দ্রুত হ্রাস-বৃদ্ধি আম ফাটার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। আবহাওয়া শুকনা হলে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হলে আমের উপরের খোসা শক্ত হয়ে যায়। এরপর হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে বা সেচ প্রদান করলে আম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। আমের ভেতরের দিক ঠিকমতো বাড়লেও বাহিরের আবরণ শক্ত হওয়ার কারণে তা বাড়তে পারে না। এ অবস্থায় আম ফেটে যায়। মাটিতে বোরণের ঘাটতি থাকলেও আম ফাটতে সহায়তা করে বলে জানা যায়।
প্রতিকার : মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈবসার দিতে হবে। জৈবসার মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে শুকনা বা খরার সময়ও মাটিতে যথেষ্ট রস থাকবে। জৈবসারের মধ্যে গোবর সব চেয়ে উত্তম বলে বিবেচিত; সার দেওয়ার মৌসুমে ২০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের গাছে ৫০ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে।
আমচাষি ভাইয়েরা উপরোক্ত বিষয়সমুহ সময়মতো সঠিকভাবে মেনে চললে উপরোক্ত রোগ হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। যেহেতু অন্যান্য ফসলের মতো আমেও বেশ কিছু রোগের আক্রমণ হয়, যা আমের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই আমের উৎপাদন বাড়াতে হলে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা জানা এবং মেনে চলা অপরিহার্য।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী। মোবাইল : ০১৮১৯৯২২৬১৩,ই-মেইল : rajshahi.ais@gmail.com

বিস্তারিত
‘TMR’ একটি আধুনিক গোখাদ্য প্রযুক্তি

‘TMR’ একটি আধুনিক গোখাদ্য প্রযুক্তি
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
টোটাল মিক্সড রেশন ‘ঞগজ’ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত একটি খাদ্য প্রযুক্তি। শস্য উপজাত ও দানাদার খাদ্যের ঘনীভূত সংমিশ্রণে গঠিত একটি পরিপূর্ণ সুষম গোখাদ্য।
ঞগজ গ্রহণে প্রাণীর সকল পুষ্টি উপাদান প্রাপ্তিই নিশ্চিত করে। এ খাদ্য ২৪ ঘণ্টাই প্রাণীকে সরবরাহ করা যায়, এবং অন্য কোন প্রকার খাদ্যের প্রয়োজন থাকে না। সকল পুষ্টি উপাদান যেমন- মাইক্রো ও ম্যাক্রো সুষম আকারে বিদ্যমান থাকে।
শস্যের অবশিষ্টাংশ যা সাধারণত পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা জমিতে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। এগুলোকে ব্যবহার করে ঞগজ প্রস্তুত করার কারণে খাদ্য খরচ কমে যায়।
ঞগজ খাদ্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাণীর বাছাই করে খাওয়ার অভ্যাস দূর করে, খাদ্য অপচয় রোধ করে। প্রাণীর প্রতিটি কামড়েই সুষম খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করে।
গবাদি পশুর পাকস্থলীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ঠিক রাখে, পাকস্থলীতে খাদ্যের গাজন নিশ্চিত করে, পরিপাচ্যতা বৃদ্ধি করে, কম মানের আঁশজাতীয় খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে, ফলে পশুর দুধ ও মাংস উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। খাদ্য খরচ কমে যায়- খামারের মুনাফা বেড়ে যায়। এ খাদ্য তৈরির পর বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিবহন করা যায়। সুতরাং খামারীদের জন্য এটি একটি চমকপ্রদ খাদ্য প্রযুক্তি।
TMR প্রস্তুতের আগে খামারিকে খাদ্যোপাদান বাছাই করতে হবে। ঞগজ  তৈরি করতে দুই ধরনের খাদ্যোপাদান লাগে-
ক) আঁশজাতীয় খাদ্য যেমন- শুকনা খড়, শুকনা গমের খড়, সয়াবিন খড়, শুকনা ভুট্টার গাছ, সাইলেজ।
খ) দানাদার খাদ্য যেমন- গমের ভূষি, চালের কুড়া, ভুট্টা ভাঙ্গা, সয়াবিন মিল, ডালের ভুষি, তিল বা সরিষার খৈল, শুঁটকি মাছের গুঁড়া, লালীগুড়, ডিসিপি, লবণ, ভিটামিন- মিনারেলস ইত্যাদি।
প্রাণীর জাতভেদে খাদ্যের অনুপাত নির্ধারণ করতে হবে। পশুর বয়স, মাংস বা দুধ উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে আঁশ ও দানাদারের অনুপাত ৭০:৩০ বা ৬০:৪০ বা ৫০:৫০ হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশের জন্য ৬০:৪০ অনুপাতই হচ্ছে সবচেয়ে অর্থনৈতিক সাশ্রয়ী। খাদ্যোপাদানের রাসায়নিক মান বা পুষ্টিমান ফরমুলা ১ ও ২ দ্রষ্টব্য।
প্রথমে খাদ্যোপাদান বাছাই করে আঁশ ও দানাদার খাদ্যের আনুপাত ঠিক রেখে শতকরা ১৫-১৬ ভাগ আমিষ এবং প্রতি কেজি শুষ্ক খাদ্যে ১০-১২ মেগাজুল বিপাকীয় শক্তি সম্পূর্ণ একটি সুষম খাদ্য মিশ্রন তৈরি করতে হবে।
ফরমুলা-১
আাঁশ ও দানাদারের অনুপাত ৬০:৪০
দ্বিতীয় ধাপে- আঁশ জাতীয় খাদ্যগুলোকে ভালভাবে চপিং/গ্রাইন্ডিং করে নিতে হবে। একদম পাউডার করা যাবে না।
তৃতীয় ধাপে- সকল উপাদানগুলোকে ভালভাবে মিশ্রিত করে নিতে হবে। মিক্সর মেশিনে করলে ভাল হয়, নতুবা হাত দ্বারা ভালভাবে মিশিয়ে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে।
TMR -ব্লক তৈরি করা যায়, সে ক্ষেত্রে ৯ী৯ ী৯ সে.মি লোহা বা কাঠের তৈরি ছাঁচে ঢেলে চাপ দিয়ে ইটের মতো খাদ্য ব্লক তৈরি করা যায়। (যেটির ওজন ৫ কেজির মতো) এর পর ব্লকটিকে কিছুটা শুকিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে কয়েক দিনের জন্য সংরক্ষণ করা যায়।
খাওয়ানোর নিয়ম
ম্যাশ আকারে তৈরি করা হলে, বানানোর পর পরই গরুকে খাওয়ানো যায়। ব্লক আকারের হলে পলিথিন খুলে সরাসরি গরুর চাড়িতে দিলেই হবে।
দুধের গাভীর ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সারাদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে TMR সরবরাহ করতে হবে। অতিরিক্ত দেয়া যাবে না কারণ বেশি খেতে দিলে দেহে চর্বি বেড়ে গিয়ে প্রজনন দক্ষতা হ্রাস হয়ে যাবে।
মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে, যতটুকু খেতে পারে ততটুকু দেয়া যেতে পারে। গাভীকে ঞগজ -এর পাশাপাশি কাঁচা ঘাস দেয়া যাবে। যেহেতু TMR শুকনা জাতীয় খাদ্য তাই গরুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিস্কার পানি খেতে দিতে হবে।
সতর্কতা
সকল প্রকার খাদ্য উপাদানের গুণগত মান দেখে নিতে হবে। খাদ্য উপাদান অবশ্যই দুর্গন্ধ, ময়লা, ধুলাবালু ও ছত্রাকমুক্ত হতে হবে। TMR - তৈরির ২-৩ দিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে। তৈরির পর খোলা ভাবে না রেখে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে করে ইঁদুর, পাখি ও পোকামাকড় না লাগে।
TMR-এর কার্যকারিতা :
TMR  খাওয়ালে গাভীর দুধ উৎপাদন ১০-১৫% এবং দুধে ননীর পরিমাণ ৭-১০% বৃদ্ধি পাবে। বাড়ন্ত দেশি ষাঁড় বাছুরের দৈহিক মাংস বৃদ্ধি পায় ৪০০-৫০০ গ্রাম, সেখানে ঞগজ খাওয়ালে দৈহিক বৃদ্ধি হয় ৭০০-৮০০ গ্রাম।
TMR -প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ শস্য উপজাতের অপচয় রোধ করে তা প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে এর পুষ্টিমান বৃদ্ধি করে গবাদি পশুর বিশাল খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা।
তথ্য সুত্র : প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল উখঝ (২০২২)
ড. এস.এম. জাহাঙ্গীর হোসেন, মহা-পরিচালক, প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার, ঢাকা-১৩৪১
লেখক : ভেটেরিনারি অফিসার, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ঝিনাইদহ, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল : drmonojit66@gmail.com

বিস্তারিত
জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান

জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান
কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম
গ্যাস, তেল ও খনিজের মতোই মাছ আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই প্রবাদেও বলা আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। জনবহুল বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ও অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্য খাত বিগত কয়েক দশক যাবত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মাছচাষি, মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষক এবং সম্প্রসারণবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ মৎস্য সম্পদে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে বর্তমানে দেশের মানুষ গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে।
বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হলেও মৎস্য সেক্টরে এর প্রভাব পড়েনি। এর ফলস্বরূপ দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে শতকরা ২৬ দশমিক ৯৬ ভাগ বেশি।২০১৯-২০ অর্থবছরে টাকার অংকে মৎস্য উপখাত থেকে জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে ৮২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৭৪ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এই খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি সেক্টরে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত থাকার ফলে মাছ উৎপাদন নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিম-লে মাছ উৎপাদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় রেকর্ড তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বিশ্বে ৩য়, স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম, অ্যাকোয়াকালচার, অর্থাৎ মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ আহরণে বিশ্বে ১ম, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়া এবং ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম। তাছাড়া তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য় (অ.স ২০২২)। মাছের সম্ভাবনাময় উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎতের কথা ভেবে এজন্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে কুমিল্লার এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ’।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করে দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করতে এবং বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহর এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে। এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। গ্রামীন মৎস্য চাষি ও জেলেদের তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটিও দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ এখন ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে; বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৮-২০০৯ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ। এছাড়া গত ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের। দেশে মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান শতকরা ১২ দশমিক ২২ ভাগ। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান বর্তমানে শতকরা ১ ভাগ। ইলিশ উৎপাদনের সাথে দেশের ৫ লক্ষ লোক সরাসরি এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
বাংলাদেশ পানিসম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-দিঘি, ডোবা-নালা, নদ-নদী, খাল-বিল ও বাঁওড়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিশাল হাওর এলাকা যা আমাদের মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ দশমিক ০৫ লক্ষ হেক্টর আয়তনের প্রায় ১৩ লক্ষ পুকুর-দিঘি রয়েছে। দেশের ২৪ হাজার কিমি. দীর্ঘ নদ-নদীর আয়তন প্রায় ১০ দশমিক ৩২ লক্ষ হেক্টর। এ ছাড়া রয়েছে ১ দশমিক ১৪ লক্ষ হেক্টর জলায়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর কাপ্তাই হ্রদ, প্রায় ২.০০ লক্ষ হেক্টর সুন্দরবন খাঁড়ি অঞ্চল এবং ২৮ দশমিক ৩০ লক্ষ হেক্টরের বিশাল প্লাবনভূমি (ম.অ.২০২০)। এসব ক্ষেত্রে মানুষ সারা বছরই কোন না কোনোভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং আমিষের চাহিদা পূরণ করছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে মানুষের মাছ খাওয়া বেড়েছে ১২২ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকের বেশি আসে মাছ থেকে। বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। আর বিশ্বে গড়ে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ২০ শতাংশ আসে কেবল মাত্র মাছ থেকে। এদিকে গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় শতভাগ বেড়েছে বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন মূলত আহরণ নির্ভর। উপকূলব্যাপী ৭১০ কিমি. দীর্ঘ তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ১ দশমিক ৬৬ লক্ষ বর্গ কিমি. বিস্তৃত বিশাল সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসম্পদে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগর হতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রল ফিশিং এবং আর্টিসেনাল মৎস্য আহরণের মাধ্যমে মোট ৪ দশমিক ৩৯ লক্ষ মে. টন মৎস্য আহরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের ন্যায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৎস্যজীবীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত প্রায় ২ দশমিক ৭০ লক্ষ মৎস্যজীবীর পরিবারের ন্যূনতম ১৩ দশমিক ৫০ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে উপকূলীয় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মাধ্যমে।
এছাড়া মৎস্য খাতে চিংড়ি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে করে এটি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি নিয়ে আসবে। মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়, ২ হাজার ৭ শত ৩০ দশমিক ৫৬ কোটি টাকার। তাই বলা যায়, সম্ভাবনাময় এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
মাছ শুধু খাবার ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক অবদান রেখে চলছে। মাছের চর্বি, কাটা ও হাড় ইত্যাদি জৈবসার, ঔষধ, সাবান, ছাপার কালি, আঠা প্রভৃতি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া মাছের আঁইশ, হাড়, দাঁত, ইত্যাদি দিয়ে কুটির শিল্প জাত সৌখিন দ্রব্য তৈরি করা হয়। এছাড়াও মাছের আঁইশ, কাটা, নাড়ি-ভুড়ি চূর্ণ হাঁস-মুরগির সুষম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব শিল্পের মাধ্যেমে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হচ্ছে অন্যদিকে অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা।
বাংলাদেশে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে মাছচাষ জোরদার করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ হতে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিস ফিলেট ইত্যাদি ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্যপণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। রপ্তানিকৃত মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ি, শুঁটকি মাছ, কাঁকড়া, কুচিয়া ও ব্যাঙ ইত্যাদি রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে মাছের বিভিন্ন ফুড আইটেম বিক্রি হচ্ছে। ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ বল, সল্টেড প্রোন, প্রোন বল, ফিস পাউডার, ফিস নুডুলস ইত্যাদির চাহিদা মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন এসব শিল্পের সাথে জনবল যুক্ত হয়ে বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতেও মাছের অবদান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে গণভবন লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার শুভ সূচনা করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ আজ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছ ও পুষ্টি পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হচ্ছে।

লেখক : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৭৪৬৭৪৯০২০ ই-মেইল :alam4162@gmail.com

 

বিস্তারিত
ধান চাষে পরিবেশসম্মত কৌশল

ধান চাষে পরিবেশসম্মত কৌশল
মৃত্যুঞ্জয় রায়
আমরা প্রায় সবাই জানি যে জলবায়ু বদলাচ্ছে আর এর প্রভাবে এখন ঝড়-জলোচ্ছা¦াস, বৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, বন্যা-বজ্রপাত, ঠা-া-গরম ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে। মূলত বায়ুম-লে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো হলো কার্বন ডাই অক্সাইড (ঈঙ২), মিথেন (ঈঐ৪), নাইট্রাস অক্সাইড (ঘ২ঙ), হাইড্রোফ্লুয়োরোকার্বন (ঐঋঈং), পারফ্লুয়োরোকার্বন (চঋঈং), সালফার হেক্সাফ্লুয়োরাইড (ঝঋ৬) ও নাইট্রেড ট্রাইফ্লুয়োরাইড (ঘঋ৩). গ্রিনহাউজ গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস প্রধান। এই গ্যাস বেড়ে যাওয়ায় বায়ুম-লের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এর পরই রয়েছে মিথেন গ্যাস, যা আমরা রান্নার চুলায় ব্যবহার করি। এটি একটি প্রাকৃতিক গ্যাস, যা পচা জলাডোবা থেকে বের হয়। জলমগ্ন ধানখেত থেকেও মিথেন গ্যাস বের হয়। বিগত ২০০ বছরের মধ্যে বায়ুম-লে মিথেন গ্যাসের ঘনত্ব বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এ সময়ের মধ্যে আয়তনিকভাবে মিথেন গ্যাসের ঘনত্ব ০.৭ পিপিএম থেকে বেড়ে হয়েছে ১.৭ পিপিএম যা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। এ সময়ের মধ্যে বায়ুম-লের আয়তনে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়েছে ২৭৫ পিপিএম থেকে ৩৪৫ পিপিএম। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুম-লকে যতটা উত্তপ্ত করছে তার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি উত্তপ্ত করছে মিথেন গ্যাস। বায়ুম-লে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির বার্ষিক হার প্রায় ১% যা ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এক বড় হুমকি। বিশ্বে মিথেন নিঃসরণ মাত্র ২০% ঘটছে প্রাকৃতিক উৎস থেকে এবং ৮০% নিঃসরিত হচ্ছে মানুষের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা। সম্প্রতি জলমগ্ন ধানখেত মিথেন গ্যাস নিঃসরণের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ডাটা সেন্টার ফর গ্রিনহাউজ গ্যাসেস (ডউঈএএ) পর্যবেক্ষণ করেছে যে, বছরে গড়ে বাতাসে মিথেন গ্যাস মেশার পরিমাণ ১৮৫৩+২ পিপিবি (ঢ়ধৎঃং ঢ়বৎ নরষষরড়হ)। তাদের হিসেব মতে, বিগত দশকে প্রতিবছর বাযুম-লে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৬.৮ পিপিবি যার জন্য ধানখেতকে অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দায়ী করেছে। বৈশ্বিক বাযুম-লে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ মিথেন গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী ধানখেত। সব ধানখেতের মধ্যে সেচ দিয়ে চাষ করা ধানখেত নিঃসরণ করছে ৭৮% মিথেন গ্যাস। সবচেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস ধানখেত থেকে নিঃসরিত হচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে, যার পরিমাণ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০ মিলিগ্রাম ও যা ধানখেত থেকে নিঃসরিত মিথেনের বৈশ্বিক পরিমাণের প্রায় ৯০%, আফ্রিকা থেকে হচ্ছে ৩.৫% ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে হচ্ছে ৪.৭%।
খুব বেশিদিন না হলেও আশির দশকের গোড়ার দিকে ধান ক্ষেত থেকে মিথেন নিঃসরণের কথা জানা যায়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ধানখেত থেকে মিথেন নিঃসরণের ঘটনাটি প্রথম গবেষকদের নজরে আসে।  ধানখেত যখন দীর্ঘদিন ধরে জলমগ্ন থাকে তখন সেখানে আবদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ মাটি বাতাসের অক্সিজেন পায় না। এর ফলে মাটিতে থাকা জৈব পদার্থ পচে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি করে। সেই গ্যাস পানিতে বুদবুদ তৈরি করে বায়ুম-লে গিয়ে মেশে। এমনকি ধানগাছের শিকড় ও কা-ের মাধ্যমেও তা যায়। সম্প্রতি জলমগ্ন ধানখেত থেকে কি পরিমাণ মিথেন নিঃসরিত হয় তা পরিমাপ করে দেখা গেছে যে, ধানখেত থেকে বৈশ্বিক মিথেন নিঃসরণের পরিমাণ ২০ থেকে ১০০ টিজি/বছর (আইপিসি, ১৯৯২) যা বায়ুম-লে বিশ্বব্যাপী মোট নিঃসরিত মিথেনের ৬-২৯%।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, পানি ছাড়া ধান হবে না। ধান উৎপাদন ব্যাহত হলে তা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা ও এরূপ পরিবেশের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে ধান উৎপাদন করা হয় জলমগ্ন অবস্থায়। আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রেরও অনেক এলাকায় এখন জলমগ্ন ধানচাষের প্রসার বাড়ছে, ইউরোপে কম। ধান চাষ করা হয় সেচনির্ভর, বৃষ্টিনির্ভর ও গভীর জলে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিথেন নিঃসরিত হয় সেচ দেওয়া ধানখেত থেকে। অন্য দুই পদ্ধতির ধান চাষের ক্ষেত্রে আসলে নিঃসরিত মিথেন হ্রাসের তেমন কোন উপায় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু সেচনির্ভর ধানখেত থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
সাধারণত রোপা ধান চাষে ধানের চারা লাগানোর পর প্রায় দুই সপ্তাহ ক্ষেতে পানি ধরে রাখা হয়। অধিকাংশ কৃষক সেই পানি সহজে বের করতে চায় না। পানি সরালেই সেখানে আগাছা বেশি জন্মে, যা পরিষ্কার করতে শ্রমিক খরচ বেড়ে যায়। তাই সেচনির্ভর ধানখেতে সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়ানো পানি থাকে। এর ফলে এসব ক্ষেত থেকে মিথেন নিঃসরণ বেড়ে যায়। তাই ধানখেতে সবসময় পানি আটকে না রেখে বা অবিরাম সেচ না দিয়ে পর্যায়ক্রমে জমি ভিজিয়ে ও শুকিয়ে দিলে মিথেন নিঃসরণ অনেক কমে। এতে সেচ কম লাগে অথচ ফলন ঠিক থাকে। ধানখেতে অধিক পরিমাণে জৈবসার প্রয়োগ করলে তা প্রায় ৫৮-৬৩% মিথেন নিঃসরণ কমাতে পারে। পতিত জমিতে খড় বিছিয়ে বা মাটিতে ফসফোজিপসামের সাথে মিশিয়ে প্রায় ১১% মিথেন নিঃসরণ কমানো যায়। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ধানের চারা লাগানোর আগে যদি পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ (খড়) জমির মাটিতে চাষ দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তা মিথেন কমায়। ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়াম সালফেট সার ব্যবহারেও মিথেন নিঃসরণ কমে, তবে এ সার প্রয়োগের ফলে আর একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস নাইট্রাস অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটে।
থাইল্যান্ডে সেচনির্ভর ধান চাষে চার ধরনের সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থারও ওপর মিথেন নিঃসরণের পরিমাণ নিরূপণে এক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন সে দেশের কয়েকজন গবেষক। জনৈক গবেষক ও তাঁর সাথীরা বলেন, ধানের জমি থেকে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে পারলে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের নিঃসরণ কমতে পারে। পাশাপাশি মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের প্রভাবে ধানের ফলনের যে ক্ষতি হয় তাও কমে। তারা মধ্য থাইল্যান্ডে গবেষণার জন্য ধানখেতে চার ধরনের সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাকে বেছে নেন। এগুলো ছিল (১) ধানখেতে সবসময় পানি রাখা, (২) মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে ধানখেত থেকে পানি বের করে দেওয়া, (৩) ধানখেত থেকে একাধিক বার পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা ও (৪) স্থানীয় একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে নিকাশের ব্যবস্থা করা। গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন যে, কোন ধরনের নিকাশ ব্যবস্থা আসলে ধানখেত থেকে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করতে পারে ও ধানগাছের চেহারা এবং ফলনের ওপর কি প্রভাব পড়ে? তাঁরা গবেষণার ফলাফলে দেখতে পান যে, ধানের ফুল ফোটার সময় ক্ষেত থেকে পানি বের করে বা শুকিয়ে দিলে তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমায়। মজার বিষয় হলো, নাইট্রাস অক্সাইডের নিঃসরণ সম্পর্কিত হলো কতদিন ধানখেতে থেকে পানি বের করে রাখা হলো তার ওপর, কত বার বের করা হলো তার ওপর নয়। গবেষণায় অবশ্য তাঁরা ধানের ফলনের ওপর এরূপ নিকাশের কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব দেখতে পান। তাঁরা গবেষণা ফলাফলে উল্লেখ করেন যে, মাঝ-মৌসুমী নিকাশ ও একাধিক বার নিকাশের প্রভাবে স্থানীয় নিকাশ ব্যবস্থার তুলনায় ধানের ফলনের ক্ষতি হয় যথাক্রমে ৬.৯% ও ১১.৪%। তথাপি তা এক মৌসুমে ধানখেত থেকে মিথেন নিঃসরণ কমাতে পারে যথাক্রমে ২৭% ও ৩৫%। ফলনের কিছুটা ক্ষতি মেনে নিয়েও বৃহত্তর পরিবেশগত স্বার্থে গবেষকরা শেষে ধানখেত থেকে মাঝে মাঝে পানি শুকিয়ে দেওয়া বা নিকাশের মাধ্যমে বের করে দেওয়াকে সুপারিশ করেন। ধানখেতে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো (এডব্লিউডি) পদ্ধতি অনুসরণ করে সেচ দিলে ধানখেত থেকে মিথেন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ কমতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীলক্ষ্য ১৩ (এসডিজি ১৩)-তে ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাপান ২০৩০ সালের মধ্যে সে দেশ থেকে ২৫ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বৃক্ষরোপণ ও বনসৃজন, ধানক্ষেতে সেচের পানির ব্যবহার ও অবিরাম জলমগ্নতা কমানো, ইউরিয়া সারের ব্যবহার সীমিত করা, জৈবসারের ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে পরিমাণগতভাবে জাপানের মতো আমাদেরও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমম্বয়ে একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা ও সময় নির্ধারণ করা উচিত এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া দরকার। না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর্যুপরি আঘাত আমাদেরই সইতে হবে, বিপন্ন হবে জীবন।

লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (অব:), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন। মোবাইল ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityun@gmail.com

বিস্তারিত
অ্যাভোকেডো : পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল

অ্যাভোকেডো : পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
অ্যাভোকেডো একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল সমূহের মধ্যে অ্যাভোকেডো অন্যতম। অ্যাভোকেডো উষ্ণ ও অবউষ্ণম-লীয় একটি উদ্ভিদ। এটিকে নতুন পৃথিবীর ফল বলা হয়। এ ফলটি চর্বি, প্রোটিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ এবং এতে স্বল্প মাত্রার কার্বোহাইড্রেট থাকে। প্রধান ফ্যাটি এসিডগুলো হলো অলিক, পামিটিক এসিড এবং লিনোলেনিক এসিড। তবে ফ্যাটি এসিড কম্পোজিশন জাত, পরিপক্বতার পর্যায় ও ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। পাকা ফল সালাদে ব্যবহৃত হয়। আইসক্রীম এবং মিল্কসেক (সরষশ ংযধশব) এ অ্যাভোকেডো ব্যবহৃত হয়। এমনকি পাল্প ফ্রিজ এ সংরক্ষণ করা যায়। অ্যাভোকেডোর উৎপত্তি মধ্য আমেরিকায়। ভারতে এটি ৫০-৭৫ বৎসর পূর্বে প্রবর্তিত হয়। বর্তমান বিশ্বে মেকি্রাকো, ইউএসএ, ডমিনিকান রিপাবলিক, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হাইতি, ভেনিজুয়েলা, চিলি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হচ্ছে প্রধান অ্যাভোকেডো উৎপাদনকারী দেশ। অ্যাভোকেডো খধঁৎধপবধব পরিবারভুক্ত একটি ফল। এর প্রায় ৪৭টি গণ ও ১৯০০ প্রজাতি রয়েছে।
জাত
নতুন বিশ্বে বেশ কিছু জাত চাষ হয় যেমন: ঋঁবৎঃব, ঐধংং, খঁষধ, চড়ষষড়পশ, অৎফরঃয ইত্যাদি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে বারি অ্যাভোকেডো-১ নামে একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতের বৈশিষ্ট্য  
উচ্চফলনশীল ও নিয়মিত ফলদানকারী। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১৮০-২০০টি। টিএসএস ১৪.৬%; ফলের রং গাঢ় সবুজ এবং উপবৃত্তাকার; প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৫৬২ গ্রাম এবং গড় খাদ্যোপযোগী অংশ ৬৮%; প্রতিটি ফলে বিটা-কেরোটিনের পরিমাণ ৫৭.২ মি. গ্রাম/১০০ গ্রাম এবং দেহের জন্য উপকারী চর্বি লিনোলিক/ওমেগা-৬ (অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড) এর পরিমাণ ২০.২%।
ফুল ও ফল ধারণ
বীজের গাছ থেকে ফুল ও ফল হতে ৫-৬ বছর লাগে। কিন্তু কলমের গাছ ৩-৪ বছর বয়স থেকে ফল রাখা যুক্তিযুক্ত। নিম্ন দিবস (২০০ সে.) ও রাতের (১৫-১৫০ সে.) তাপমাত্রা ফুল ফোটাকে ত্বরান্বিত করে। দিনের তাপমাত্রা ২৫-৩০০  সে. হলে ফুল ফোটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি দিনে ১ ঘন্টাও যদি ৩০০ সে. তাপমাত্রা থাকে তবে ফুল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
অ্যাভোকেডোর জাতগুলোকে ফুলে প্রস্ফুটিত হওয়ার উপর ভিত্তি করে ২ ভাগে ভাগ করা হয়;  এ টাইপ ও বি টাইপ।
এ টাইপ জাত
সকাল বেলায় ফুলটি কার্যকর স্ত্রী হিসেবে ফোটে এবং দিনের মধ্যভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় পরবর্তী দিনের বিকেল বেলায় কার্যকর পুরুষ হিসেবে ফোটে।
বি টাইপ জাত
বিকেল বেলায় ফুলটি প্রথমে স্ত্রী হিসেবে ফোটে এবং দ্বিতীয় দিনের সকাল বেলায় পুনরায় পুরুষ হিসেবে ফোটে।
মাটি
অ্যাভোকেডো সঠিক নিকাশযুক্ত বেলে থেকে কর্দম দোআঁশ যে কোন প্রকার মাটিতে চাষ করা যায়। গভীর দো-আঁশ বা উর্বর মাটি অ্যাভোকেডো চাষের জন্য সর্বোত্তম। তবে এটি পাহাড়ের ঢালে এবং জলাধারসংলগ্ন উঁচু জায়গাতেও ভাল জন্মে। এটি অ¤ীøয় মাটিতে (পিএইচ- ৪.৫-৫.৫) সবচেয়ে ভালো জন্মে। কিন্তু কিছু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রেস এর রুটস্টক ক্যালকেরিয়াস ক্ষারীয় মাটিতে (পিএইচ-৭.৬-৭.৯) জন্মাতে পারে।
জলবায়ু : ভারতের তামিলনাড়–তে গড় সর্বোচ্চ ও গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্র যথাক্রমে ২৭-২০ সে. থেকে ৩৩.৯০ সে. এবং ১৪.৯০ সে. থেকে ২২.২০ সে এ অ্যাভোকেডো ভালো জন্মে। অ্যাভোকেডোতে নিম্নতাপমাত্রা ফুল ধারণকে বৃদ্ধি করে।
বংশবিস্তার
বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করা যায় তবে এতে জাতের বিশুদ্ধতা বজায় থাকেনা। এজন্য অংগজ উপায়ে এর বংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এর বীজের সজীবতা দ্রুত (২-৩ সপ্তাহ) নষ্ট হয়ে যায়। বীজের আবরনটি সরিয়ে বপন করলে অংকুরোদগম তাড়াতাড়ি হয়। রুটস্টক তৈরির জন্য বীজ ব্যবহৃত হয়। একটি বীজকে ভ্রুণসহ প্রয়োজনে ৪-৬ টি ভাগে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন টবে বা বেডে স্থাপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বেডে বীজ থেকে বীজ ৩৫-৪৫ সেমি. এবং সারি থেকে সারি ৬০-৭৫ সে. মি. দূরত্ব বজায় রেখে বীজ বপন করতে হবে। বীজের উপর ১ সেমি. এর বেশি মাটি দেয়া যাবেনা। বীজ থেকে চারা গজাতে ৫৫-৯৫ দিন সময় লাগে।
কাটিং, বাডিং এবং গ্রাফটিং এর মাধ্যমে অঙ্গজ বংশবিস্তার করা যায়। তবে গ্রাফটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা ভালো। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফাটল গ্রাফটিং পদ্ধতিতে  মাতৃগাছের গুণাগুণ সম্পন্ন চারা গাছ উৎপাদন করা যায়।
গ্রাফটিং এর উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতি
জুন-আগস্ট মাসে এক বছর বয়সী অ্যাভোকেডো রুটস্টকের উপর ছয় মাস বয়সী উপযুক্ত সায়ন ক্লেফট/ফাটল গ্রাফটিং এর মাধ্যমে জোড়া লাগাতে হবে, জোড়া লাগানো স্থানসহ সম্পূর্ণ সায়নটি পলিথিন ক্যাপ দ্বারা ঢেকে বেঁধে দিতে হবে যাতে এটি শুকিয়ে না যায়; অতঃপর কলমগুলো ৭ দিন অন্ধকার পরিবেশে রেখে দিতে হবে; অন্ধকার পরিবেশ থেকে বের করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখলে ৩০ দিনের মধ্যে কলমগুলো সফলভাবে জোড়া লেগে যায়; এভাবে তৈরিকৃত ৮০ শতাংশ অ্যাভোকেডো কলম সফল হয় এবং পরবর্তী এক বছরে মাঠে রোপণের উপযুক্ত হয়।
রোপণ
মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উত্তম সময় তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়। সাধারণত জাতের তেজ (ঠরমড়ঁৎ) এবং দৈহিক বৃদ্ধি  বিবেচনায় অ্যাভোকেডো এর স্বাভাবিক রোপণ দুরত্ব ৮-১০ মিটার। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে সাধারণত ৮ মি.ঢ৮ মি. দূরত্বে ৬০ সেমি.ঢ৬০ সেমি.ঢ৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈবসার এবং ১৫০ গ্রাম টিএসপি ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। মাটিতে রস কম থাকলে গর্তে পানি দিতে হবে। গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকের মাটি দিয়ে গোড়ায় মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি এবং বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জলাবদ্ধমুক্ত জমিতে অবশ্যই অ্যাভোকেডো রোপণ করতে হবে।
সেচ
সর্বোচ্চ ফলন ও ফলের বিকাশের জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা/রস থাকা আবশ্যক। যদি শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাত না হয় তবে ফলন বৃদ্ধি করার জন্য সেচ দিতে হয়। এ জন্য খরা মৌসুমে অ্যাভোকেডো বাগানে ২-৩টি সেচ দেয়া প্রয়োজন। অ্যাভোকেডো গাছ তাদের প্রয়োজনীয় ৯০-৯৫% পানি মাটির ০-৬০ সেমি. গভীরতা থেকে সংগ্রহ করে। ইসরাইলে এক গবেষণায় দেখা গেছে ২১ দিন পর সেচ দিয়ে ফলে উচ্চ মাত্রায় তেলসহ উচ্চফলন পাওয়া গেছে এবং আগাম ফল সংগ্রহ করা গেছে। বর্ষাকালে অথবা অন্য কোনভাবে গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ
অ্যাভোকেডো চাষের জন্য নাইট্রোজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরৎকালে হালকা মাটিতে ফসফরাস ও নাইট্রোজেন এর প্রয়োগ ফলন বৃদ্ধি করে। ১-২ বছর বয়সের গাছে পঁচা গোবর ১৫ কেজি, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমওপি ২০০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৫০ গ্রাম; ৩-৫ বছর বয়সের গাছে পঁচা গোবর ২০ কেজি, ইউরিয়া ৪০০ গ্রাম, টিএসপি ৩৫০ গ্রাম, এমওপি ৩০০ গ্রাম, জিপসাম ১৫০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৬০ গ্রাম এবং ৬ এর অধিক বছর বয়সের গাছে পচা গোবর ২৫ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৩৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৭০ গ্রাম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে (এপ্রিল-মে), দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক (সেপ্টে¤¦র-অক্টোবর) মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা-রোগ-পোকা দমন
গাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সবসময় জমি পরিষ্কার বা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ১ মিটার পর্যন্ত জায়গা সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতটিতে রোগ ও পোকামাকড় এর আক্রমণ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না।
পোকা মাকড়
এতে স্কেল পোকা, মিলিবাগ ও মাইট এর প্রকোপ দেখা দিতে পারে। কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক (যেমন সেভিন ডব্লিউপি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে স্কেল পোকা ও মিলিবাগ দমন করা সম্ভব।
এবামেকটিন গ্রুপের মাকড়নাশক (ভার্টিম্যাক বা অন্য নামের) ১.৫ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ব্যবহার করা মাইট দমন করা সম্ভব।
রোগ
অ্যাভোকেডো ফলের দাগ (ঋৎঁরঃ ংঢ়ড়ঃ) রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর ফলে কচি ফল ঝরে পড়তে পারে। ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: ইন্ডোফিল এম-৪৫ ২ গ্রাম/ ১ লিটার পানি এই হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। শিকড় পচা (ৎড়ড়ঃ ৎড়ঃ) রোগ অ্যাভোকেডোর সবচেয়ে মারাত্মক রোগ। এতে গাছ মারা যায়। রিডোমিল গোল্ড গাছের চারপাশে মাটিতে প্রয়োগ করে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব।
ফল সংগ্রহ
ফল সংগ্রহের সময় আগস্ট-অক্টোবর মাস পর্যন্ত। সাধারণত ফলে তেলের ও শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ এর উপর ভিত্তি করে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এটি ক্লাইমেকটেরিক ফল বিধায় শারীরবৃত্তীয় পরিপক্বতায় সংগ্রহ করলে ৬-১২ দিনের মধ্যে পেকে যায়।
ফলন
ফল হাত দ্বারা বা বড় গাছের ক্ষেত্রে লম্বা হারভেস্টার দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। ফল সংগ্রহের সময় যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতটির হেক্টর প্রতি গড় ফলন প্রায় ১০.৬ টন ও গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১৮০-২০০টি।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, এইচআরসি, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৬০০৯৩১৯ ই-মেইল : bsarker_64@yahoo.com

বিস্তারিত
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি আবহাওয়া প্রকল্প : সফলতা পাচ্ছেন কৃষকেরা

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি আবহাওয়া
প্রকল্প : সফলতা পাচ্ছেন কৃষকেরা
ড. মোঃ শাহ কামাল খান
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। কাজেই নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের মাঝে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যেমন ফসল রক্ষা করা যাবে তেমন অনুকূল আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যাবে। সে কারণেই বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর “কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প” বাস্তবায়ন করছে। কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আবহাওয়া এবং নদ নদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত উন্নত মানের এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো এবং এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারে ডিএইর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে দুর্যোগকালীন এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আবহাওয়া ও জলবায়ু, নদ-নদীর পানির অবস্থা, কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের  মাঝে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের কাছে তাদের উপযোগী ভাষায় সরবরাহ করে যাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রাপ্ত তথ্য ও কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ কাজে লাগিয়ে কৃষকগণ প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবিলার পাশাপাশি অনুকূল আবহাওয়ায় করণীয় বিষয়ক তথ্যসমূহ সদ্ব্যবহার করে মাঠের ফসল রক্ষা, অর্থের সাশ্রয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন। ইতোমধ্যে প্রকল্পের আওতায় বামিস পোর্টাল  স্থাপিত হয়েছে। এটি একটি ডায়নামিক ওয়েব পোর্টালু যেখানে কৃষি আবহাওয়া পরামর্শসহ বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত নদ নদীর  তথ্য উপাত্ত সন্নিবেশিত হয়। এই পোর্টাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সংযুক্ত।
প্রকল্পের আওতায় নিয়মিত সপ্তাহে দুইদিন ৬৪ জেলার জন্য এবং একদিন জাতীয় পর্যায়ে কৃষি আবহাওয়া বুলেটিন তৈরি ও সরবরাহ করা হয়। এ পর্যন্ত জেলা পর্যায়ে চারশতাধিক এবং জাতীয় পর্যায়ে দুইশতাধিক বুলেটিন প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড় ফণী, বুলবুল, বন্যা ও আকস্মিক বন্যা, আম্পানসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ) এর আগে ও পরে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বিশেষ কৃষি আবহাওয়া বুলেটিন প্রদান করা হয়েছে। কৃষি আবহাওয়া বুলেটিন বামিস পোর্টালে নিয়মিত আপলোড করা হয় এবং বামিস পোর্টালের মাধ্যমে এই সেবা সবার জন্য উন্মুক্ত।
নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিষয়ক ঝুঁকি সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত কৃষকের উপযোগী করে প্রস্তুত করে তা বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে এ প্রকল্প। কৃষি আবহাওয়া বার্তা বিভিন্ন সম্প্রসারণ মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য ও কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ কাজে লাগিয়ে কৃষকগণ প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবিলার পাশাপাশি অনুকূল আবহাওয়ায় করণীয় বিষয়ক তথ্যসমূহ সদ্ব্যবহার করে মাঠের ফসল রক্ষা, অর্থের সাশ্রয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন।
উদাহরণসরূপ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরের কৃষক জানান, “আমি মোঃ সোহরাব হোসনে হেমায়েতপুর, সাভার এর একজন সবজি উৎপাদনকারী কৃষক। বিগত ২০ বছর যাবৎ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদ করে আসছি। আগে প্রাকৃতিক  দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর ফসল নষ্ট হয়ে যেতো। বর্তমানে কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শ পেয়ে  আবহাওয়া ও জলবায়ুর অনুকূল অবস্থাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ মোকাবিলা করতে পারছি। গত বছর বামসি মোবাইল অ্যাপ এর মাধ্যমে পূর্বাভাস পেয়ে অনাকাক্সক্ষাতি বৃষ্টিপাত ও হঠাৎ বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেয়েছি। বৃষ্টিপাতের আগাম তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রায় ২,০০,০০০ টাকার ফসল রক্ষা করতে পেরেছি। সেচ খরচ বেঁচেছে প্রায় ১০,০০০ টাকার মতো। ফলে প্রচুর লাভবান হয়েছি। এ সফলতার মাধ্যমে বাণিজ্যিকি কৃষির দিকে ঝুঁকিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক মোঃ আবু হানিফ মোড়ল বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে থেকে আমি বিভিন্ন রকম সবজি চাষ করছি। আগে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির কারনে প্রায়ই আমার সবজি নষ্ট হয়ে যেত। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নকরণ প্রকল্পের আওতায় এক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে এবং বামিস পোর্টাল দেখে আবহাওয়া পরিস্থিতি জেনে ফুলকপি, অফসিজন সিম, বেগুন, লালশাক ইত্যাদি চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, কর্তন করি। আমি একদিন জমিতে সেচ দিতে গিয়ে আবহাওয়া পূর্বাভাস পেয়ে আর সেচ দিইনি, এতে আমার সেচ খরচ বেঁচে যায়।
অনুরূপভাবে শেখ মনজুর রহমান খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের একজন কৃষক। প্রায় ১২ বছর ধরে ধান বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিক্রয়ের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত আছেন। বামিস পোর্টাল থেকে গত বোরো মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় অশনি এর গতিবিধি খেয়াল করে এবং এলাকাবাসী সময়মতো সমস্ত বোরো ধান কর্তন করে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। চলমান মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস জেনে আমন ধানের বীজতলা করায় জুলাই-আগস্ট মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম হলেও আমনের বীজতলার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। এজন্য কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নকরণ প্রকল্পকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।”    
বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার চাকলমা গ্রামের মো: জাব্বির হোসেন কৃষক এবং কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি জানান সেপ্টেম্বর/২০২২ আগাম বৃষ্টিপাতের তথ্য জানার কারণে তরমুজের জমিতে বৃষ্টি শুরুর আগেই নিষ্কাশন নালা তৈরি করি এবং  পুরনো ড্রেন সংস্কার করি। আমার ১ বিঘা জমিতে প্রায় ৭০০টি তরমুজ গাছ রয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে তরমুজের গোড়া পচাসহ অন্যান্য রোগবালাইয়ের ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল। এবং ঐ সময়ে বালাইনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকার কারণেও আমার আর্থিক ক্ষতি কম হয়। আবহাওয়ার আগাম বার্তা কৃষি কাজে সঠিকভাবে ব্যবহারের কারণে আমি প্রায় =১৪,৫০০/- (চৌদ্দ হাজার পাঁচশত টাকা) ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।”
সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার দঃ সখিপুর গ্রামের একজন কৃষক মোঃ আব্দুর রকিব বলেন, “কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প থেকে প্রদত্ত ডিসপ্লে বোর্ডে যে কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করা হয় তিনি তা নিয়মিত দেখেন। গত ০৫/১২/২০২১ তারিখে ডিসপ্লে বোর্ড এ বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখে তিনি ৬৬ শতক সরিষার জমিতে পানি অপসারণের জন্য নালা তৈরি করেছিলেন। এর ফলে তিনি সম্ভাব্য ২৫,০০০/- টাকা ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন।” এভাবে অত্র প্রকল্পের মাধ্যমে আগাম তথ্য/পূর্বাভাস পেয়ে দেশের অনেক কৃষক আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন এবং লাভবান হয়েছেন।
কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পটি আইসিটি এবং ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার নির্ভর। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, স্মার্ট এবং যুগোপযোগী একটি প্রকল্প। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক একটি প্রকল্প। কৃষি আবহাওয়ার মত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা/পরামর্শ তৈরিপূর্বক বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের কাছে সফলতার সাথে যথাসময়ে পৌছে দিচ্ছে এ প্রকল্প। প্রকল্পটির অধীনে বিদ্যমান অপারেশনাল কৃষি আবহাওয়া অ্যাডভাইসরি সার্ভিসেস গ্রহণযোগ্যতা এবং অগ্রগতি বিবেচনা করে কিছু নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সুষ্ঠ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি আবহাওয়া পরিষেবাগুলোকে আরও শক্তিশালী ও জোরদার করা হচ্ছে। দেশে কৃষিবিদ এবং আবহাওয়াবিদ রয়েছে কিন্তু  কৃষি-আবহাওয়াবিদ নেই। কৃষি আবহাওয়া প্রযুক্তির উপর মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য দেশে কৃষি আবহাওয়া শিক্ষাকে আরও জোরদার করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে চরম আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন পুরো কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাবিত করছে। কৃষি আবহাওয়া কৌশলগুলো এবং ধারণাগুলোর ব্যাপক ব্যবহার এবং প্রয়োগের প্রচারের জন্য, শিক্ষার পরিমিত স্তর (মডেস্ট লেভেল) প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য কৃষি আবহাওয়া ডিগ্রী অফার করা হয় না। কৃষি-আবহাওয়াবিদ তৈরি ও এক্ষেত্রে তাদের অবদান নিশ্চিত করার লক্ষে এবং বাংলাদেশের চলমান কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ সেবাকে আরও জোরদার করার জন্যে এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউ) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরইউ)-এ কৃষি আবহাওয়া বিভাগ চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে কৃষি আবহাওয়া বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (পিজিডি) কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে যা দেশের কৃষি আবহাওয়া ক্ষেত্রের জন্য এক যুগান্তকারী অর্জন। প্রকল্প থেকে উল্লেখিত দুটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি, গ্রীন হাউজ ও অটোমেটিক ওয়েদার স্টেশন স্থাপন এবং দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ তৈরী ও বিস্তারের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা এবং কৃষকদের দক্ষতা ও সচেতনতা আরও বাড়াতে পারলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষকের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২১৮৪২৭৪, ই-মেইল: kamalmoa@gmail.com

বিস্তারিত
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি (১৫ মে- ১৪ জুন)

জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি
(১৫ মে- ১৪ জুন)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
জ্যৈষ্ঠ মাসকে অনেকেই মধুমাস বলে থাকে। আম, জাম, বাহারি মজার মজার ফলের আনন্দ রসে ভরপুর থাকে কৃষিজীবিসহ জনসাধারণ। কৃষিজীবী ভাইবোনেরাই কৃষির অগ্রযাত্রার হাতিয়ার। বর্তমান সরকার এর লক্ষ্য কৃষি সমৃদ্ধিতে কৃষকের পাশে থেকে স্মার্ট কৃষি গড়তে। আর তাই প্রিয় পাঠক চলুন, এক পলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ভুবনের কাজগুলো।
বোরো ধান
জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে সময়, শ্রম ও অর্থসাশ্রয়ী শুকনো বীজ ছায়ায় ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
আউশ ধান
এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতিদ্রুত বীজ বপন করতে হবে। আউশের উচ্চ ফলনশীল ব্রিধান২১, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৬৫, ব্রি ধান৮৩, ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮, ব্রি ধান১০৬, বিনা ধান ১৯ এসব জাতগুলো চাষ উপযোগী। চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে।
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়।
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও স্বল্প সময়ে, অধিক জায়গায় ধানের চারা নির্দিষ্ট, দূরত্বে, সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যায়, নির্দিষ্ট গভীরতায় লাগানোর জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ যন্ত্র দ্বারা চারা রোপণের জন্য ট্রে অথবা পলিথিন সিটের উপর চারা উৎপাদন করতে হয়। ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট ২০-২২ দিন বয়সের চারা এ যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে রোপণ করা যায়। জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়। ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।
ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়াপোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়াপোকা গাছের কচিপাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছাপোকা ও ঘোড়াপোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন- শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা
আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তুলাবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আপনার যদি তুলাচাষ উপযোগী উঁচু জমি থাকে এবং আপনি তুলাচাষে আগ্রহী হোন তাহলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিকটবর্তী অফিস/ইউনিট অফিস যোগাযোগ করূন।
শাকসবজি
মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়াজাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাবপোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তা ছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে   বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।  মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন। মাঠের মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে। গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানিকচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন। যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭-১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে।
উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরও বেশি লাভবান হবেন। প্রয়োজনে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। য়

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ইমেইল :editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon