Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

মৎস্য খাতে ভ্যালু চেইন : নিরাপদ খাদ্য ব্রান্ডিং

মৎস্য খাতে ভ্যালু চেইন : নিরাপদ খাদ্য ব্রান্ডিং
মোঃ কাওছারুল ইসলাম সিকদার
বাংলাদেশের মৎস্য খাত প্রাকৃতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। নদী বিধৌত এ বদ্বীপের সৃষ্টিলগ্ন হতে হিমালয়ের বরফগলা পানির অবিরাম প্রবাহের কারণে মিঠা পানির মৎস্যের যেমন প্রাচুর্যতা ছিল, তেমনি এ অঞ্চল ছিল মৎস্যের অভয়ারণ্য। অসংখ্য প্রজাতির মৎস্য দেশের প্রায় সর্বোত্র পাওয়া যেত। আমিষজাতীয় খাদ্যের বেশির ভাগ পূরণ হতো মিঠা পানির মৎস্য হতে। আর সে কারণে বাঙালির পরিচয় ছিল “মাছে ভাতে বাঙালি”। দেশের সর্বোত্র তথা সকল নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ও ডোবাতে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্যের প্রজনন ও বৃদ্ধি ঘটত। বর্ষার শেষ পর্যায়ে মাছের প্রাচুর্যতার কারণে গ্রামীণ জনপদে মাছ রৌদ্রে শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখত। তাই ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা নববর্ষে মাছ/শুঁটকির সাথে পান্তাভাত পরিবেশন করা হয়। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ও সহজলভ্যতা ঘটলেও মৎস্য খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার মূলত সংরক্ষণ স্তরেই রয়ে গেছে। এ দেশে প্রক্রিয়াজাত মৎস্য শিল্পের বিকাশ তেমনটি আজও লক্ষ করা যায় না।
পানির অভাবে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে দেশের প্রায় সকল নদ-নদী শীর্ণ হয়ে পড়ে। অনেক নদীর শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে যায়। মাছের পরিবর্তে সেখানে শাকসবজি ও ফসলের আবাদ হয়। পানির গভীরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ায় সে সময় অধিকাংশ মাছ ধরা পড়ে যায়। যার কারণে মা মাছসমূহ আর বংশবিস্তার করতে পারে না। তাই দেশে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মাছের চাহিদা পূরণে বর্তমানে  কৃত্রিমভাবে জলাশয় তৈরি করে বিশেষ কিছু প্রজাতির মাছের চাষ করা হচ্ছে। দেশের প্রায় সর্বোত্রই কৃত্রিম পদ্ধতিতে এ মাছ চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ খাতকে ঘিরে পুকুর তৈরি, মাটি ও পানির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি ঘটেছে। সেইসাথে মাছের খাবারের জন্য অনেক আধুনিক মৎস্য খাদ্য তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমদানি করা হচ্ছে মাছের খাবারের কাঁচামাল। তবে উৎপাদিত মৎস্য আহরণের পর থেকে ভোক্তা অবধি পৌঁছানোতে দেশে তেমন কোনো প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ও চেইনশপ-ব্রান্ডশপ অদ্যাবধি গড়ে উঠেনি। সৃষ্টি হয়নি মৎস্য উপযোগ সৃষ্টিকারী ধাপ। নেয়া হয়নি মাছের স্বাদের পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আনয়নে দেশী-বিদেশী রেসিপি সংযোজন।
 এ প্রজন্মের শিশু-কিশোররা মাছের প্রতি অনেকটা নিরাসক্ত। এর কারণ মূলত মাছ রান্না ও পরিবেশনে বৈচিত্র্যহীনতা। এ দেশে মাংস (হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরু, মাহিষ প্রভৃতি) রান্নায় ব্যাপক বৈচিত্র্য এসেছে। যুক্ত হয়েছে দেশি ও বিদেশী প্রযুক্তি এবং রন্ধন প্রণালী। মাংস দিয়ে তৈরি হচ্ছে হরেক রকমের কাবাব, কিমা, কালিয়া, কোপ্তা, টিকা, রেজালা, কোর্মা, গ্রীলসহ অসংখ্য রেসিপি। অথচ প্রচলিত মাছ ভাজা ও মাছ-তরকারি ছাড়া তেমন কোন ভিন্ন রন্ধন প্রণালী বা রেসিপি দেখা যায় না। মৎস্য খাতে নেই কোন চেইনশপ অথচ মাংসে যুক্ত হয়েছে দেশি ও বিদেশি অসংখ্য ব্র্যান্ডের চেইন শপ। মাংস উৎপাদন ও আমদানি এবং ভোক্তাদের নিকট পৌঁছাতে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক সংরক্ষণ, পরিবহন বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি। পরিবেশনের জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামিদামী রেস্তোরা এবং প্রচারেও ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ।
বাংলাদেশের মৎস্য খাত প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এ খাতে অদ্যাবধি ভ্যালু চেইন (ধাপ) যুক্ত করতে আমরা সক্ষম হয়নি। মৎস্য খাতে নিযুক্ত চাষিরা মূলত মাছ চাষ করে ফরিয়ার মাধ্যমেই মাছ বাজারজাত করছে। তবে ভোক্তার নিকট পৌঁছাতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা বা উপযোগ এখনো তৈরি হয়নি বিধায় মৎস্য চাষিরা উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। অপর দিকে মাছের জন্য তৈরি খাবারের দামের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনাগত খরচ বাড়ায় মাছ চাষ ক্রমেই অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ফলে গ্রমীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণীত হওয়ার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের নিয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে উৎপাদন হতে ভোগ পর্যন্ত খাদ্য নিরাপদ রাখতে সকলস্তরের মানুষ ও খাদ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পালনীয় বিষয়ে বিধি ও প্রবিধিমালা তৈরি করছে। দেশের মানুষের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে যেমন ধারণার ঘাটতি রয়েছে, তেমনি ভুলধারণাও রয়েছে। যার কারণে অনেক নিরাপদ খাবারও মানুষ গ্রহণ করছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে সঠিক তথ্য ও জ্ঞানের অভাব। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমরা প্রায় সর্বোত্র ফরমালিনমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূলের প্রচারণা ও পোস্টার দেখতে পাই, অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত বিষয় হলো শাকসবজি ও ফলমূলে ফরমালিন কোন ক্রিয়া করে না। তাই এতে ফরমালিন ব্যবহারে প্রশ্নই ওঠে না; অথচ অনেক শিক্ষিত জনসাধারণ ফরমালিনের ভয়ে ফল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে হবে। সঠিক তথ্যের অভাবে ভোক্তার ভোগ কমে গেলে  সংশ্লিষ্ট পণ্যের চাহিদা কমে যায়, চাহিদা কমে গেলে দ্রব্যমূল্যও হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে দেশের মোট উৎপাদনও হ্রাস পায়।
কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় যে মাছ চাষ হয় সে মাছ অনেকেই খেতে চান না। তার মূলত কারণ হলো প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাছের তুলনায় চাষের মাছের স্বাদ কম। বদ্ধ জলাশয়ের পানির গুণগতমান অনেক সময় নিম্ন থাকে। এ ছাড়া মাছের খাবারের গুণগত মানও সবক্ষেত্রে যথাযথ থাকে না। তাই চাষের মাছের খাবার ও পরিবেশের উন্নয়ের মাধ্যমে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। মাছ বাজারজাতকালে মাছ চাষে গৃহীত নিরাপদতামূলক ব্যবস্থাসমূহ যদি ভোক্তাদের কাছে তুলে ধরা যায় এবং ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করা যায়। তবেই মাছের ভোগ ও চাহিদা বাড়বে, মূল্যও বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদনও প্রবৃদ্ধি ঘটবে। মৎস্যে নিরাপদতা নিশ্চিতকল্পে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপদতার মানদ-ের সার্বিক চিত্র ভোক্তার মাঝে তুলে ধরতে হবে। যুক্ত করতে হবে যথাযথ মোড়ক, লেবেলিং এবং পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে গ্রহণ করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।  বিশেষ করে মৎস্য খাতে ভ্যালু চেইন যুক্ত করতে হবে, যাতে সমাজের উচ্চ ও মধ্যম আয়ের ভোক্তাদের নিকট পৌঁছানো যায় এবং প্রত্যাশিত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
নিরাপদ মৎস্যের নির্ণায়ক হলো- ১) মাছ ভৌত, জৈবিক, কেমিক্যাল ও আলার্জি দূষণ হতে মুক্ত হতে হবে। ২) মাছে ভারী ধাতুর উপস্থিতি যেন না থাকে সেজন্য জলাশয়, পানি ও মাছের খাবার ভারী ধাতু মুক্ত হতে হবে। ৩) প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম রাসায়নিক দূষণ হতে জলাধারা নিরাপদ রাখতে হবে। ৪) প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রন্ধনে ব্যবহৃত মসলা বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হতে হবে। ৫) অর্গানিক রং ব্যবহার করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে “ফিস এন্ড চিপস” এর চেইন শপ রয়েছে। এসব দোকানে সামুদ্রিক মৎস্যের ফিলেট মেরিনেট করে রাখা হয়। ক্রেতার অর্ডার পেলে তৎক্ষণাৎ এসব ফিলেট জৈতুনের তেলে ভেজে চিপসসহ পরিবেশন করা হয়। সুস্বাধু ও হালাল হওয়ার  এই মাছ  সকল বয়সের ও ধর্মের মানুষের নিকট জনপ্রিয়। আমরাও কোরাল/ভেটকি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মৎস্যের ফিলেট দিয়ে ফিস এন্ড চিপস এর মতো চেইন শপ করতে পারি। দেশি-বিদেশি সকলের নিকট সমাদৃত করতে এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে নিরাপদতার সার্টিফিকেশন। সাধারণত বিদেশীরা সমুদ্রের মৎস্যই ভক্ষণ করে। পর্যটকদের জন্য মিঠা পানির মৎস্য আকর্ষণীয় খাবার হতে পারে। অধিকাংশ দেশে সুমিষ্ঠ পানির প্রাচুর্যতা নেই বিধায় মিঠা পানির মৎস্য তাদের অনেকের কাছে অপরিচিত। তাই অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মৎস্য আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য হিমায়িত মৎস্যের পাশাপাশি রেস্তোরাঁর সম্মুখে জীবন্ত মাছ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় কিছু মাছের রেস্তোরাঁ দেখা যায়, যেখানে শুধু মাছ পরিবেশন করা হয়। এসব রেস্তোরাঁ বেশ জনপ্রিয়, সেখানে প্রায়ই ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ করা যায়। এসব রেস্তোরাঁর সম্মুখে জীবন্ত মৎস্য অ্যাকুরিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। ক্রেতারা পছন্দের মৎস্য চিহ্নিত করে দিলে, রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ সেটি তৎক্ষণাত পরিচ্ছন্ন করে ভেজে পরিবেশন করে। এটির প্রচলন আমাদের দেশেও হতে পারে।
মৎস্য খাতে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে এবং মৎস্য চাষ টেকসই করার জন্য ব্রান্ডিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। সকল স্তরের মানুষের কাছে মৎস্য জনপ্রিয় করার মাধ্যমে সার্বিক চাহিদা বৃদ্ধি ও মৎস্য চাষির প্রাপ্য মুনফা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মাঝে আস্থা অর্জনে মৎস্য উৎপাদন হতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানো অবধি  প্রতিটি স্তরে নিশ্চিত করতে হবে মৎস্যের নিরাপদতা, সেইসাথে যুক্ত করতে হবে উন্নত রেসিপি  এবং রন্ধন প্রণালীতে আনতে হবে বৈচিত্র্য। যুক্ত করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি। ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে গ্রহণ করতে হবে গবেষণা কার্যক্রম এবং চালাতে হবে প্রচার। বিশেষ করে সব বয়সী মানুষের জন্য পছন্দসই স্বাদের মৎস্য রেসিপি তৈরি করে ব্র্যান্ডিং ব্যবস্থাপনায় চেইনশপের মাধ্যমে ভোক্তা অবধি পৌঁছাতে হবে। তবেই মৎস্য খাতের বিকাশ ঘটবে, মৎস্য চাষিরা কাক্সিক্ষত মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধি হবে। সেইসাথে মৎস্য থেকে প্রাপ্ত সহজপাচ্য আমিষের দ্বারা শিশু-কিশোরদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি মৎস্যখাতের নিরাপত্তা, নিরাপদতার উন্নতি ঘটবে এবং আমিষ জাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণ হবে। সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ জনপদ ও জনপদের মানুষ।

লেখক : উপসচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : addldirector.ict@bfsa.gov.bd

বিস্তারিত
সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

মাঘ মাস। শীতের দাপট নিয়ে হাজির হয় এই বাংলায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি। পাল্টে যাচ্ছে মাঘের শীতে বাঘের কাঁপুনি প্রবাদটি। বিরূপ প্রকৃতির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী চলছে মহামারি, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী প্রভাব। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে থেমে নেই কৃষকের ব্যস্ততা।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জীবিকা নির্বাহের অন্যতম চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর ১ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন হতো। বর্তমানে ৪ কোটি ৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। গম, ভুট্টা, শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও এসেছে ব্যাপক সাফল্য। খাদ্য নিরাপত্তায় আমন একটি অন্যতম ফসল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরিপ-২ মৌসুমে আমন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬৩.৪৫৬ মে.টন/হেক্টর। ৯২.৫৫ শতাংশ কর্তন করে অর্জন হয়েছে ১৬৪.৬৫৯ মে. টন/হেক্টর (০১ জানুয়ারি ২০২৩, ডিএই)। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ অর্জনের কারিগর হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীলসমাজ, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও কৃষকেরা। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সহযোগিতা করে আসছে। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনুমান করছেন পৃথিবীতে খাদ্য সংকট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে বাংলাদেশের কৃষির অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি উল্লেখ করেন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার কোনরকম সম্ভাবনা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শীতায় বিশ্বব্যাপী অনাগত এই সংকট বাংলাদেশে যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। এ সম্পর্কে ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন- দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে বাস্তবায়নের রূপরেখা’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারের কৃষিকথায়।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, আগামীর কৃষি ভাবনা, উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের এ সংখ্যা। আশা করি, মাসিক কৃষিকথা নতুন বছরে আপামর জনসাধারণের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে তথা কৃষি উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সবার জন্য রইল ইংরেজি নতুন বছর ২০২৩ এর প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

বিস্তারিত
আমন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি

আমন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি

ড. জাহাঙ্গীর আলম
করোনার অভিঘাতে কৃষির উৎপাদনে স্থবিরতা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিপনন চেইন ভেঙে পড়ার কারণে বিশ^ব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্যশস্যের সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং মূল্য বেড়েছে। তাতে খাদ্য আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলো খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিচ্ছে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাতে খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোতে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছুতে পারে। কঠিন খাদ্যভাব দেখা দিতে পারে বাংলাদেশেও। এমনই শংকার মাঝে গত আউশ মৌসুমে বন্যার কারণে ধানের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পরে দীর্ঘ খরায় বিলম্বিত হয়েছে আমনের উৎপাদন। তবে পরবর্তী লাগাতার বৃষ্টির ফলে পূরণ হয়েছে আমন চাষের প্রত্যাশা। সোনালী ধানে ভরে গেছে মাঠ। ফলনও হয়েছে ভালো। ইতোমধ্যেই ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। ধানের দামও এবার ভালো। ভিজা ধান মাঠ থেকেই সরাসরি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা মণ দরে। শুকনো ধানের দাম ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা মণ। তাতে আমন ধান চাষ করে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন। ধান চাষের বর্তমান মূল্যে উৎপাদনকারী কৃষকগণ বেশ খুশি। সারা দেশেই এখন কৃষির জন্য আছে সুখবর। এবার ধানে কোন রোগবালাই নেই। নেই পোকার আক্রমণ। তাই প্রতি ইউনিট জমিতে ফলন হয়েছে ভালো। অনেকেই বলেছেন বাম্পার ফলন। এ মৌসুমে ধান চাষ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন। বুক তার অনেক আশায় ভরা। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এবার আমন চাষে বেশ সন্তুষ্ট কৃষক।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ঘাটিয়ারা গ্রামের কৃষক রাজিব খান। সম্ভান্ত বংশের এক শিক্ষিত যুবক। তিনি নিজের জমি চাষ করেন। অন্যের জমিও চাষ করেন বার্ষিক চুক্তিতে। তাতে আধুনিক পদ্ধতিতে ধানের চাষ করেন প্রতি মৌসুমে। এবার রোপা আমন বুনে দিয়েছিলেন ৫০ বিঘারও বেশি জমিতে। ফলন হয়েছে বিঘাপ্রতি প্রায় ১৫ মণ। শতকে প্রায় ১৮ কেজি। গত বছরের চেয়ে বিঘা প্রতি প্রায় ১ মণ ধান বেশি হয়েছে এবার। এ গ্রামে সর্বত্রই এখন ধান কাটার ব্যস্ততা। মাঠে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার চলছে। ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দী করা হচ্ছে একই সঙ্গে। কোথাও বা আঁটি বেঁধে          কৃষক ধান নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি। পদচালিত যন্ত্রের সাহায্যে চলছে এর মাড়াই। মেয়েরা সিদ্ধ করছে ধান। রোদে শুকাচ্ছে। অতঃপর ধান ভানা হচ্ছে মেশিনে। একদল যুবক বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেশিনে ধান ভানছে। গ্রাম বাংলায় এখন এসব কাজে কায়িক শ্রমের চেয়ে যন্ত্রের প্রচলন অনেক বেশি। জমি চাষ, ফসল মাড়াই, ধান ভানা সবই হচ্ছে মেশিনে। তাতে মানুষের পরিশ্রম লাঘব হচ্ছে। সম্ভব হচ্ছে দ্রুত কাজ সম্পাদন। বাজারে এখন চালের দাম ভাল। ৫২ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা মণ মাঝারি চাল। এখন কিছুটা নেমে এসেছে দাম। একদিকে ধানের ভালো ফলন। অন্যদিকে মূল্য আশাপ্রদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আধুনিক কৃষক রাজিব খান তাতে অনেক খুশি। এ খুশি ছাড়িয়ে পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে, দক্ষিণাঞ্চলে ও মধ্যাঞ্চলে। আমন ধানের লাভ তাদের আগের মূল্য ধসের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। সারা দেশেই এখন কৃষির জন্য, কৃষকের জন্য আছে সুখবর। পাকা ধানের গন্ধে তাদের ভরে আছে মন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভগের তথ্য অনুযায়ী এবার রোপা আমন চাষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৬৩ লক্ষ টন। উৎপাদন হবে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ লক্ষ টন বেশি। আবাদি জমির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৫৯ লক্ষ হেক্টর। অর্জিত হয়েছে ২৩ হাজার হেক্টর বেশি। গত বছর (২০২১-২২ অর্থবছরে) আমন ধানের আবাদ হয়েছিল ৫৭.২ লক্ষ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন চাল। এবার উৎপাদন ও জমির পরিমাণ দুটোই বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মৌসুম শুরুতে দীর্ঘ খরার কারণে আমন উৎপাদনে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল পরে টানা বৃষ্টির কারণে তা কেটে গেছে। অনেকে সম্পূরক সেচ দিয়েও চাষ করেছে আমন ধান। বৈশি^ক মন্দা, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা এবং খাদ্যশস্যের মূল্যেবৃদ্ধি এবার আমন চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে দেশের কৃষকদের। বাংলাদেশে রোপা ও বোনা আমন মিলে মোট চাল উৎপাদনের প্রায় ৩৮ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। অতএব, মোট চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে আমনের উৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক মাস ধরে চালের উচ্চমূল্য প্রশমনে ও সরবরাহ সংকট নিরাময়ে  চলতি আমন মৌসুমের ভালো ফলন বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটা দেশবাসীর জন্য সুখবর। ইতোমধ্যেই আমন চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করছে সরকার। এবার কেজি প্রতি আমন চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২ টাকা। ধানের মূল্য ২৮ টাকা। এ সংগ্রহ মূল্য উৎপাদন খরচের খুবই কাছাকাছি।
ধানের উৎপাদন খরচ এবার কেজিপ্রতি ২৭.৬৪ টাকা। চাল ৪১.৫৮ টাকা। এর সঙ্গে ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ লাভ যোগ করা হলে কৃষকপর্যায়ে ধানের বিক্রি মূল্য হবে প্রতি কেজি ৩০ টাকা এবং চালের ৪৫ টাকা। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে নিয়মিত শুল্ক পরিশোধসহ ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করা হলে প্রতি কেজি চালের দাম এমনই দাঁড়াবে। বাজারে এখন চালের দাম তার চেয়ে বেশি। সেটা কমানোর সুযোগ আছে। মানুষের বর্তমান ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় এবং গরিব ভোক্তাদের স্বার্থে তা নিম্নমুখী হওয়া উচিত। সে জন্য বাজারে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
গত আউশ মৌসুমে আগাম বন্যার কারণে আউশের ফলন কম হয়েছিল। এবার আমনের ভালো ফলন সেই ক্ষতিপূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী ৪ মাস দেশে খাদ্য সংকটের কোন আশঙ্কা নেই। সামনের বোরো ধান উৎপাদন ভালো হলে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশকে ছুতে পারবে না। কৃষি সম্প্রাসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী আগামী বোরো মৌসুমে ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে উচ্চফলনশীল ব্রি ধান৮৯ এবং ব্রি ধান৯২ এর চাষ সম্প্রসারিত হবে। উচ্চফলনশীল বঙ্গবন্ধু১০০ জাতের ধানের আবাদও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া বাড়বে হাইব্রিড ধানের চাষ। ফলে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন বৃদ্ধি পাবে। মোট ৪৯ লক্ষ ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে সম্ভাব্য চালের উৎপাদন হবে ২ কোটি ১৫ লক্ষ টন। তাতে চালের মোট উৎপাদন দাঁড়াবে ৪ কোটি টনেরও বেশি। ফলে আগামী বছর বাংলাদেশে চালের সংকট হবে না।
বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তার পরও আমরা প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি করছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এর একটা প্রধান কারণ অপচয়। এক হিসেবে দেখা যায়, প্রতি বছর ১৬ লক্ষ টন চাল অযথাই নষ্ট হয়ে যায় ক্রাশিং করার সময়। মোটা চাল মেশিনে চিকন করা এর প্রধান কারণ। মিল মালিকরা ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য অপেক্ষকৃত মোটা চাল চিকন করে বাজারে সরবরাহ করে থাকে। তাতে অটো মেশিনে ২-৩ ছাট, ক্ষেত্র বিশেষে তারচেয়েও বেশি ছাঁটাই করে প্রস্তুত করা হয় চিকন চাল। ফলে চালের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুষ্টিমান কমে যায়। বর্তমানে বাজারে সরবরাহকৃত নাজির ও পাজাম জাতের চাল প্রধানত ব্রি ধান৪৯ এর ছাঁটাইকৃত রূপ। স্থানীয় জাতের উপস্থিতি তাতে খুবই কম। ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ এবং কিছু হাইব্রিড ধান অতিরিক্ত ছাঁটাই করার মাধ্যমে তৈরি করা হয় মিনিকেট চাল। জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২, ও ব্রি ধান৮৪ অতিরিক্ত ছাঁটাই করার ফলে তাতে জিংক এর পরিমাণ হ্রাস পায়। ওজনেও কমে যায়। কিন্তু এর উচ্ছিষ্ট এতোই গুঁড়ো হয়ে যায় যে তার আর কোন বিকল্প ব্যবহার সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞতা, অসাবধানতা ও অসাধুতা দায়ী। আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কৃষকদের ও মিল মালিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অপচয় হ্রাসের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে মিল মালিকদের অসাধুতা ঠেকাতে আইনের কঠিন প্রয়োগ দরকার। কিছুদিন আগে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়ছিল যে ধানের নাম বস্তায় লিখে চাল বাজারজাত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতনতা কাজে আসতে পারে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন তার সফল বাস্তবায়নে দৃঢ় পদে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১, এসডিজি ও ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সময়োচিত নীতি, কৌশল এবং কার্যকর কর্মকা-ের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল  ভিলেজ। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০, ই-মেইল :almj52gmail.com

বিস্তারিত
প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন “দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে” বাস্তবায়নের রূপরেখা

প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন “দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে” বাস্তবায়নের রূপরেখা
ড. শামীম আহমেদ
বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আয়তনে ছোট্ট কিন্তু জনবহুল একটি দেশ এ কথা যেমন সত্য, তেমনি ফসল উৎপাদনে এক সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবেও বিশ্বব্যপী সমাদৃত। একবিংশ শতাব্দীর আজকে এই সময়ে দাড়িয়ে গোটা বিশ্ব ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। এর কারণ হিসেবে ইদানীং ঞযৎবব ‘ঈ’ কে অনেকেই দায়ী হিসেবে বিবেচিত বলে মনে করছেন। আর সেগুলো হলো ১. মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ২.জলবায়ু পরিবর্তন, ৩. কোভিড-১৯। মানব সভ্যতার উপর অতর্কিত করোনার নির্মম হামলা দুমড়ে-মচুড়ে দিয়েছে পৃথিবীটাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব গত কয়েকটি বছর ধরেই চলছে বিশ্বজুড়ে। দুই বছরের করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে চরম খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে ৯ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ, চীন, কানাডাসহ সব রাষ্ট্রেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আরও বাড়বে বলে শঙ্কার কথা শোনাচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা। যার ফলে বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)-র মতে, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশ আছে ৯টি, যার মধ্যে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ১.৪ শতাংশ। শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের আর সব মহাদেশ বা অঞ্চলেই এবার খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। আর এই দিকগুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুশাসন প্রদান করেন সকল দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ‘দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুশাসন বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ ও কর্মসূচি কৃষিবান্ধব এই সরকারের সফল মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে মোট ১ কোটি ৬১ লাখের মতো ফসলি জমির মধ্যে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে ৮৬ লাখ ২৯ হাজার হেক্টরের মতো। তন্মধ্যে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজারের (সূত্র : কৃষি বর্ষগ্রন্থ ২০২০, ভূমি ব্যবহার জরিপ ২০১৯-২০)। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই পরিমাণ আবাদযোগ্য পতিত জমি যদি আবাদের আওতায় আনা যায়, তাহলে আমাদের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় যেমন ভূমিকা পালন করবে, তেমনি গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে ফলপ্রসূ হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুন গাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউ গাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য কর। কয়টা মুরগি পালো, কয়টা হাঁস পালো। জাতীয় সম্পদ বাড়বে’। (বাণী চিরসবুজ, কৃষি মন্ত্রণালয়, জুন ২০২১, পৃষ্ঠা নং ১৪২)। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিই বলে দেয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। মূলত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা।
অপরপক্ষে বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩.৬০ লাখ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ ৫.৪০ লাখ হেক্টর। দেশের বসতবাড়ির গড় আয়তন ০.০২ হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৬৫.৬২ লাখ এবং আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২.২৩ লাখ হেক্টর। এই জমিগুলো আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প কাজ করছে। প্রকল্পের আওতায় সকল শ্রেণির কৃষক-কৃষানি যাদের বসতভিটা অনাবাদি পড়ে আছে সেই সকল জমি পরিকল্পিত উপায়ে চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত গৃহের বসতভিটায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপনের মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রকল্পটি কাজ করছে। ৬,৮৩,৫৬০টি কৃষক পরিবার এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে এবং ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন ও ৩৩০টি পৌরসভার প্রায় ৪১ লাখ কৃষক-কৃষানি পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। উল্লেখিত প্রকল্পটির মেয়াদকালে পারিবারিক সবজি পুষ্টিবাগান প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৪,৮৮,৪০০টি, স্যাঁতসে্যঁতে জমিতে কচুজাতীয় সবজি চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি এবং ছায়াযুক্ত স্থানে/বসতবাড়িতে আদা/হলুদ চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি। সকল প্রদর্শনীর সফল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ৫,০৩,১৬০টি বসতবাড়ির অনাবাদি/পতিত জমি বছরব্যাপী সবজি চাষাবাদের আওতায় আসবে। আর এভাবেও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনটি বাস্তব রূপ পাবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের আর একটি বড় ক্ষেত্র হলো আমাদের বনাঞ্চল ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্র। বাংলাদেশে পাহাড়ি বনের পরিমাণ প্রায় ১৩.৭৭ লাখ হেক্টর আর গ্রামীণ বন রয়েছে ৭.৭৪ লাখ হেক্টর। এ সমস্ত বনাঞ্চল থেকে বনজদ্রব্য আহরণের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো কাঠ (প্রায় ৩১.৩২ লাখ ঘনফুট), জ্বালানি (প্রায় ১৬.৮৪ ঘনফুট) ও গোলপাতা (৫৪৬.০২ লাখ কেজি) (সূত্র : বন অধিদপ্তর-২০২১)। এর বাইরেও পাহাড়ে অনেক পতিত জমি রয়েছে।      কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা বলছে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান; এই তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত পাঁচ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। এই জমিগুলো কাজুবাদাম ও কফি চাষাবাদের উপযোগী। এ ছাড়া পাবর্ত্য জেলায় পাহাড়ে এরই মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে আম্রপালি, কাটিমন আম, লিচু ও ড্রাগনের বাগান। এ ছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের আরও বড় খাত হলো সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত পতিত জমি। বিশেষ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবহৃত জমি, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্ক, লাইব্রেরি, ধর্মীয় উপাসনালয়ের অব্যবহৃত জমি রয়েছে যেগুলো অনায়াসেই আবাদের আওতায় আনা যায়। বসতবাড়ির ছাদে বাগান করা হলেও বেশ জনপ্রিয় একটি কর্মসূচি।
প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনটি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যে কাজগুলো চলমান তার মধ্যে রয়েছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার বিশ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে অঞ্চলভেদে ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে ধান কাটাসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদেরকে দেয়া হচ্ছে। এটি সারাবিশ্বে একটি বিরল ঘটনা। এ সমস্ত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে বর্তমানে দেশের প্রায় শতভাগ কৃষি জমি যান্ত্রিক চাষাবাদের আওতায় আসবে। এবারে আমন মৌসুমে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অনেক শস্যকর্তন করা হয়েছে ফলে আগের চেয়ে শ্রম ও খরচ দুটোই কম লেগেছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৭ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে রবি/২০২০-২১ মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ ও পরবর্তী খরিপ-১ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন মুগ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ সহায়তা প্রদান বাবদ কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ৮৬৪৩.০০ লাখ টাকার অর্থ ছাড় করা হয়। এই অর্থ দেশের ৬৪টি জেলায় ৮ লাখ উপকারভোগীর মাঝে উল্লেখিত ৯টি ফসল চাষের জন্য সহায়তা বিতরণ করা হয়। ফসলভেদে বিভিন্ন পরিমাণে বীজ সহায়তা, ডিএপি ও এমওপি সার সহায়তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিটি কৃষকের মাঝে পৌঁছে যাচ্ছে।
পরবর্তীতে গত বছর একইভাবে এই প্রণোদনা ১৭ নভেম্বর, ২০২০ তারিখ রবি মৌসুমে বোরো ধানের হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহারকারীদের মাঝে ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চৌদ্দ লাখ সাতানব্বই হাজার কৃষকের মাঝে ৭৬ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ৭৬০ টাকা, ২৩ নভেম্বর, ২০২০ তারিখ রবি মৌসুমে পেঁয়াজ ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে পঞ্চাশ হাজার  কৃষকের মাঝে ২৫ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ২৫ মার্চ, ২০২১ তারিখ খরিপ-১ মৌসুমে আউশ ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে চার লাখ পঞ্চাশ হাজার কৃষকের মাঝে ৩৯ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার সার ও বীজ সহায়তা বিতরণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নে এটি বেশ গুরুত্ববহন করে।
কৃষি বাঁচলে দেশের মানুষ দুমুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে, যে কথাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন বর্তমান কৃষিবোন্ধব সরকারের প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রায় সমস্ত জনসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় বক্তৃতায়         কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। আর তাই প্রতিটি ইঞ্চি কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়টিকে তিনি সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছে। গত অক্টোবর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে যেতে পারে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। এই সম্ভাবনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় এনে ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮, নিরাপদ খাদ্য আইন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০সহ উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে কৃষি গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ‘দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।

লেখক : উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি মন্ত্রণালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫, ই-মেইল : ashamim.uni@gmail.com

বিস্তারিত
পুষ্টি নিরাপত্তায় শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব

পুষ্টি নিরাপত্তায় শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ
ও সংরক্ষণের গুরুত্ব
ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো: হাফিজুল হক খান২
আমরা প্রতিদিন যেসকল খাবার গ্রহণ করি তার মধ্যে সবজি অন্যতম। শরীর সুস্থ রাখতে পরিমিত ফল খাওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনি সবজিরও বিকল্প নেই। দেহ গঠন ও পুষ্ঠির চাহিদা পূরণেও অত্যাবশ্যক। প্রতিদিন আমরা কমবেশি কিছু কিছু সবজি খাই যা আমাদের শরীরের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এমন অনেকেই আছে যারা সবজি খেতে একেবারেই পছন্দ করে না। বিশেষ করে শিশু ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা সবজিকে এড়িয়ে চলে। এতে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবার, এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফেনলিক উপাদানসহ অন্যান্য পুষ্ঠিগুণাগুণ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২-এর তথ্য মোতাবেক ২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪.৫৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ৪৭.৩০ লক্ষ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয় যেখানে উৎপাদনের হার প্রায় প্রতি হেক্টরে ১০.৪১ মেট্রিক টন। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী একজন মানুষের বছরে ১৪৬ কেজি ফল ও সবজি খাওয়া প্রয়োজন সেখানে আমরা অর্ধেক এর কম পরিমাণ (৭০ কেজি) খেয়ে থাকি। ২০১০-২০১৮ এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সবজি কম খাওয়ার প্রবণতার দরুন প্রতি বছর ক্যান্সারের ঝুঁিক বাড়ছে অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ক্যান্সারেই মারা যাচ্ছে।
গবেষণা তথ্যে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, যথাযথ পুষ্টি ঘাটতির জন্য অন্ধত্ব, হাড়ক্ষয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার, উচ্চ রক্তচাপ, দেহের রক্তস্বল্পতা, হৃদরোগের ঝুঁকি, বার্ধক্যসহ বহুবিধ রোগের কারণ হতে পারে। আবার বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যে, সবজির যথাযথ সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবছর প্রায় ২০-৪৫ ভাগ পর্যন্ত গুণগত ও পরিমাণগত অপচয় হয়ে থাকে যা টাকার অংকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমনকি ভরা মৌসুমে সবজির মূল্য ক্রমেই কমতে থাকে ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। তখন কৃষকের মজুরি পর্যন্ত উঠে না ফলে কৃষক ক্ষেতেই অনেক সময় সবজি রেখে আসে।
পরিচর্যা ও প্যাকেজিংর মাধ্যমে বিভিন্ন শাকসবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় উৎপাদিত অধিকাংশ শাকসবজি মাঠ থেকে সংগ্রহের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত ২-৩ দিনের বেশি সতেজ ও খাবার উপযোগী থাকে না। মাঠ থেকে সংগ্রহের পর প্রতি লিটার পানিতে ২০০ পিপিএম ক্লোরাক্স দ্রবণ বা ২-৩টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে ধৌত করার পর মুখবন্ধ ৩৫-৪০ মাইক্রন পুরুত্বের পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে পুঁইশাক, কাঁচামরিচ, ঢ়েড়স ও লালশাক যথাক্রমে ৮ দিন, ১০ দিন, ১১ দিন এবং ৭ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। অন্যদিকে ১.৫% ও ১.০% ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ৯ দিন পর্যন্ত যথাক্রমে ঝিঙা ও ধুন্দুল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করা যায়।
এনজাইম নিস্ক্রিয়করণের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মটরশুঁটিসহ অন্যান্য কাঁচা শাকসবজিকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (৬০-৮০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড বা বেশি) ব্লাঞ্চিং এর (৩০ সেকেন্ড-৩ মিনিট) মাধ্যমে এনজাইম নিষ্কিৃয়করণের করে সবজির সংরক্ষণকাল ৬-৮ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। যা পরে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তৈরি বা অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের কাঁচামাল হিসেবে দীর্ঘ সময় ব্যবহার করা যায়। যেমন- পরিপক্ব গাজর ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মিনিট ব্লাঞ্চিং করে -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। মিশ্র সবজির আচার, চাটনি, সাওয়াক্রাউট (বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি ফার্মান্টেড খাবার), কিমচি (গাঁজন করা শাকসবজি), পেস্ট বা পাউডার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
শুষ্কীকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
শাকসবজিকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে কেটে টুকরা টুকরা করে ব্লাঞ্চিং বা শোধন করলে এনজাইম নিষ্কিৃয় হয়। অতঃপর কিছুক্ষণ ঠা-া পানিতে রেখে পরে পরিচর্যা করে সোলার বা কেবিনেট ড্রাইয়ারে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় শুকালে গুণগতমান বজায় থাকে। এভাবে কাঁচা কাঁঠাল, গাজর, কাঁচা পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো ইত্যাদি যথাযথভাবে শুকিয়ে মোড়কজাত করলে দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যায়।  
জিরো এনার্জি কুল চেম্বারে বিভিন্ন সবজি সংরক্ষণ
জিরো এনার্জি কুল চেম্বার হলো বাঁশ ও ছন বা খড় দ্বারা নির্মাণ করা ঘরের মধ্যে ইট, বালু ও সিমেন্ট নির্মিত দু’টি দেয়াল ঘেরা চেম্বার বিশেষ। দেয়াল দু’টির মাঝখানের ফাঁকা জায়গা বালি দ্বারা পূরণ করা হয় এবং সকাল-সন্ধ্যায় এ বালি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়। বাষ্পীভবনের নীতি অনুযায়ী এ চেম্বারের ভেতরে তাপমাত্রা মৌসুমভেদে ২-৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ১২-১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত কমে যায় এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০-১২% থেকে ২৫-৩০% পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে চেম্বারের ভেতরে রাখা পচনশীল পণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায়। গবেষণা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জিরো এনার্জি কুল চেম্বারে রাখা বিভিন্ন সবজি যেমন-লালশাক, গিমাকলমী, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও টমেটো পণ্যের প্রকৃতি ও মৌসুম ভেদে ২-১৬ দিন পর্যন্ত বিক্রয় যোগ্য রাখা যায়।
‘কুলবট’ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি সংরক্ষণ
কুলবট প্রযুক্তি মূলত কোল্ডস্টোরেজ একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বিভিন্ন সবজি বেশি সময় সংরক্ষণের জন্য স্বল্প ব্যয়ে তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তিতে কুলবট নামক একটি ছোট্ট ডিভাইস সাধারণ এয়ার কন্ডিশনারের সাথে স্থাপন করে একটি সাধারণ এয়ার কন্ডিশনারের তাপমাত্রা সীমা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে কমিয়ে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত নামিয়ে আনা যায়। ফলে এই বিশেষ যন্ত্রটি ইনসুলেটেড বা বায়ুরোধক কক্ষে স্থাপিত এয়ার কন্ডিশনারের সাথে যুক্ত করে কক্ষটিকে কোল্ডরুমে রূপান্তর করা যায় এবং উল্লেখযোগ্য স্বল্প খরচে কোল্ড স্টোরেজের সুবিধা এখানে পাওয়া যায়। কুলবট কোল্ড স্টোরেজ প্যাক-হাউজ কিংবা পাইকারি বাজারে স্থাপন করা যেতে পারে। গ্রীষ্মম-লীয় সবজি সংরক্ষণের জন্য কোল্ড রুমের তাপমাত্রা ১৩ক্ট১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং উপ-গ্রীষ্মম-লীয় সবজির জন্য ৫-৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বজায় রাখতে হয়। তবে এ দুই ধরনের সবজি একসাথে সংরক্ষণাগারে রাখা যাবে না। কোল্ডস্টোরেজের আপেক্ষিক আর্দ্রতা অনেক সময় ৫০% এর নীচে নেমে যেতে পারে যা সবজি থেকে পানি বের হয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করে। এক্ষেত্রে কোল্ডরুমের আর্র্দ্রতা বাড়ানোর জন্য ভিজা কাপড় ঝুলিয়ে কিংবা পানি স্প্র্রে করতে হয় অথবা ছিদ্রযুক্ত পলিথিন প্যাকেটে সবজি ভরে তা সংরক্ষণ করতে হয়। গবেষণায় দেখা যায়, টাটকা সতেজ বেগুন ০.০১% ক্যালসিয়াম কার্বাইড দ্বারা ধুয়ে ও পানি ঝরিয়ে ০.৫% ছিদ্রযুক্ত পলিথিন প্যাকেটে ভর্তি করে ১৩ক্ট১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও ৭৫% এর বেশি আপেক্ষিক আর্দ্রতায় কুল বট কোল্ডস্টোরেজ রুমে ১৪ দিন পর্যন্ত গুণগতমান বজায় রেখে বাজারজাতকরণের উপযোগী রাখা গেছে যেখানে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) সংরক্ষিত বেগুন মাত্র ৩ দিন পর্যন্ত ভালো ছিল।
বিভিন্ন সবজির আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, প্রিজার্ভ, কেন্ডি, চিপ্স তৈরিকরণ
বিভিন্ন শাকসবজিকে পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মসলা, লবণ, চিনি, এসিটিক এসিড ইত্যাদি মিশিয়ে উৎকৃষ্টমানের স্বাদ, গন্ধযুক্ত আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, কেন্ডি, চিপ্স তৈরিকরণ করা যায়। যেমন-মিশ্র সবজির আচার তৈরির জন্য প্রথমেই পরিমাণমত মটরশুঁটি, ফুলকুপি, সিম ও গাজর ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। অতঃপর টুকরোগুলো ওজন নিয়ে তেলে ভেজে নিতে হবে। পরিমাণমত আদা ও রসুন ১০০ সিসি ১% অ্যাসেটিক এসিডসহ বেটে পেস্ট তৈরি করতে হবে এবং সসপেনে বাকি তেল গরম করে নিতে হবে। এখন আদা-রসুন পেস্ট, কাঁচামরিচ, ভাজা সবজির টুকরো, চিনি, মরিচের গুঁড়া, সরিষার গুঁড়া, হলুদের গুঁড়া, জিরার গুঁড়া ইত্যাদি এক এক করে সসপেনে ঢালতে হবে এবং সামান্য জ্বাল দিতে হবে। শেষে লবণ এবং অবশিষ্ট এসেটিক এসিড যোগ করতে হবে এবং জ্বাল দিতে হবে। মিশ্র সবজি মসলাসহ ঘন হয়ে আসলে বা আচার ঘন হয়ে এলে জ্বাল বন্ধ করতে হবে এবং গরম অবস্থায় বয়ামে ভরে বোতলের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে তৈরিকৃত আচার ভর্তি বয়াম ঘরের শুকনো এবং ঠা-া জায়গায় ১০-১২ মাস স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।
স্টিপিং পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সবজি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ
স্টিপিং পদ্ধতিতে সবজি সংরক্ষণের জন্য লবণের দ্রবণ আদিকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে লবণ সংরক্ষক, খাদ্যের রুচিকর সুগন্ধ  দান ও স্বাদবর্ধক হিসেবে কাজ করে। লবণ, হলুদের গুঁড়া, গ্ল্যাসিয়াল এসেটিক এসিড ও পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট (কেএমএস) নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে মিশিয়ে সংরক্ষক দ্রবণ তৈরি করা যায়। বিভিন্ন প্রকার ফলের ন্যায় সবজি যেমন-টমেটো, মটরশুঁটি, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা ইত্যাদি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৮-১০ মাস পযর্šÍ স্টিপিং দ্রবণে অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষিত সবজি পরবর্তীতে আচার, চাটনি, জুস, শুল্ক পণ্যসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। স্বল্প ব্যয় সম্পন্ন এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন সবজির সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করা সম্ভব। প্রথমেই সবজিকে পানিতে ধুয়ে নিয়ে সবজির আকার অনুযায়ী ব্লাঞ্চিং (৫৫-৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার গরম পানিতে ৩০ সেকেন্ড থেকে ২-৩ মিনিট রাখা) করে ১০ মিনিট স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে রাখতে হবে। স্টিপিং দ্রবণ তৈরির জন্যে ৫-১০% লবণ, ১% এসেটিক এসিড এবং ০.১% কেএমএস ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক ড্রাম বা কনটেইনারটি অথবা গ্লাস বয়াম ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করে পুরো সবজি বা টুকরো সবজি উক্ত পাত্রে রেখে স্টিপিং দ্রবণ যোগ করতে হবে। পরিশেষে দ্রবণ ও সবজি ভর্তি পাত্র ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে পাত্রটি বায়ুরোধী হয়।
বর্তমান বৈষ্ণিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অপচয়রোধের কোন বিকল্প নেই। সবার জনসচেতনতা ও উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারই সবজি ফসলের অপচয় রোধের অন্যতম হাতিয়ার। কৃষিপণ্যের মধ্যে সবজি ফসলের গুণগতমান বজায় রেখে সতেজ ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যদ্রব্য হিসেবে বিএআরআই উদ্ভাবিত সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হচ্ছে পরিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : ১ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১, মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১,

বিস্তারিত
শীতকালে গবাদিপশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয়

শীতকালে গবাদিপশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয়
ড. হোসেন মোঃ সেলিম
বাংলাদেশ ষড় ঋতুর দেশ যেখানে সাধারণত ২ মাস পর পর ঋতু বদল হয়। এ ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আবহাওয়া ও জলবায়ুরও পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে এ পরিবর্তনসমূহ গবাদিপশুর বাসস্থান, খাদ্য ও উৎপাদনে ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হয় বিশেষ করে বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ শীত অনুভূত হচ্ছে তাতে গবাদিপশুর খাদ্য গ্রহণ ও উৎপাদনের উপর প্রভাব পড়ছে। তাই শীতকালে গবাদিপশুর সঠিক বাসস্থানের পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
সাধারণত প্রতি বছর এসময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দেশব্যাপি গবাদিপশু ও হাঁসমুরগির টিকা দান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাই এসময় বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়া না থাকলে অতিসত্বর কৃষক ভাইয়েরা তাদের গবাদিপশুকে টিকা দিয়ে নিবেন। এছাড়া কৃমি গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে তাই গবাদিপশুকে নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
বিগত কার্তিক মাসে চাষ করা মাসকলাই এ মাসে গবাদিপশুকে খাওয়ানোর উপযুক্ত সময়। গবাদিপশুর জন্য উন্নত জাতের ঘাস বিশেষ করে ভুট্টা, নেপিয়ার, পাকচং ইত্যাদি ঘাস চাষের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। তাই নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস হতে উন্নত জাতের ঘাসের বীজ, কাটিং ও চারা সংগ্রহ করে নিতে হবে। শীতের মৌসুমে দেশের অনেক এলাকায় মাসকলাই ফসল উঠার সময়। তাই মাসকলাইয়ের গাছগুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ এগেুলো বর্ষাকালে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এসময় তিসির গাছ বা এর অন্য কোন অংশ গবাদিপশুকে খাওয়ানো উচিত নয় কেননা এতে সায়ানাইড এবং অন্যান্য টক্সিন থাকে, যা গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিকারক। তাছাড়া এসময় রবিশস্য ক্ষেতের আগাছা তুলে তা ভালো করে ধুয়ে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে।
বর্তমানে দেশের অনেক এলাকায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে বিধায় গবাদিপশুর উপর স্ট্রেস বা প্রীড়ন পড়বে এবং গবাদিপশুর খাদ্য গ্রহণ কমে যাবে। তাই গবাদিপশুর সুষম খাদ্য এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে অল্প খাবারে পশুর দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান সঠিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। এজন্য গবাদিপশুর দানাজাতীয় খাদ্যে অধিক কার্বোহাইড্রেট বা অধিক চর্বি এবং তেলজাতীয় খাদ্য উপকরণ সরবরাহ করা প্রয়োজন। তাই দানাজাতীয় খাদ্য তৈরিতে ভুট্টা, গম ও অন্যান্য তেলজাতীয় দানাদার খাদ্য উপাদানসমূহ বেশি পরিমাণে সরবরাহ করতে হবে। ফলে গবাদিপশু অধিক এনার্জি বা শক্তি পাবে এবং স্ট্রেস থেকে রক্ষা পাবে। এ ছাড়া এসময় গবাদিপশুর খাদ্যে স্বাভাবিকের তুলনায় ২-৫% অধিক মোলাসেস বা চিটাগুড় ব্যবহার করা যেতে পারে যা গবাদিপশুর খাদ্য গ্রহণ ক্ষমতা বাড়াবে এবং শক্তি জোগাবে।
অন্যদিকে হাঁসমুরগির দানাজাতীয় খাদ্যে বেশি পারিমাণে এনার্জি বা শক্তি বাড়ানোর জন্য ১-২% সয়াবিন তেল যোগ করা যেতে পারে ফলে হাঁস-মুরগি অধিক পারিমাণে শক্তি বা এনার্জি পাবে এবং শীতের স্ট্রেস থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া গবাদিপশু ও পোল্ট্রির খাদ্যে ভিটামিন ও মিনারেলস  ০.২৫-০.৫% যোগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে অর্থাৎ গবাদিপশুর উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
এসময় তীব্র শীতের কারণে পানি অনেক ঠা-া থাকে তাই গবাদিপশুকে বিশুদ্ধ কুসুম গরম পানি বা ভাতের মাড় সরবরাহ করা যেতে পারে। কোনভাবেই গবাদিপশুকে ঠা-া পানি সরবরাহ করা যাবে না। এতে গবাদিপশু নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য ঠা-াজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
যেহেতু এসময় প্রচুর ঠা-া পড়ে সেহেতু সরাসরি কাঁচাঘাস খাওয়ানোর চেয়ে পূর্বে সংরক্ষিত সাইলেজ এবং হে বা শুকনো খড়ের সাথে মিক্স করে খাওয়ানো যেতে পারে। সাইলেজ একটি উত্তম আঁশজাতীয় এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ গোখাদ্য যা গবাদিপশু খেতে খুব পছন্দ করে এবং সাইলেজ খাওয়ালে গবাদি পশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও উৎপাদন দুটোই বৃদ্ধি পায়। তাই কৃষক ভাইয়েরা এসময় প্রাপ্ত অধিক পরিমাণ ভুট্টা পরিপক্ব হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ গাছে ফুল আসার সাথে সাথে কেটে সাইলেজ তৈরি করে রাখতে পারে, যা বছরের অন্যান্য সময় বা খাদ্য সংকটকালে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। তাই সাইলেজ তৈরির উত্তম সময় হচ্ছে এখন, যা গবাদিপশুর সারাবছরের আঁশজাতীয় খাদ্যের জোগান দিবে।
সবশেষে বলা যায়, পরিকল্পনামতো যদি গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা যায় বছরের অন্যান্য সময়ও সমানহারে গবাদিপশুকে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন আঁশজাতীয় খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে এবং গবাদিপশুর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : উপপরিচালক (প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান), পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১। ই-মেইল : hmsalim@gmail.com

বিস্তারিত
মৌচাষে স্মল হাইভ বিটল প্রতিরোধে করণীয়

মৌচাষে স্মল হাইভ বিটল প্রতিরোধে করণীয়
জুবায়ের আহমেদ
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মৌমাছির উপকারিতা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন ‘ওভ ঃযব নবব ফরংধঢ়ঢ়বধৎবফ ভৎড়স ঃযব ংঁৎভধপব ড়ভ ঃযব মষড়নব, ঃযবহ ঃযব সধহ যধাব ড়হষু ভড়ঁৎ ুবধৎং ঃড় ষরাব (যদি মৌমাছি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তবে মানুষের জীবন পরবর্তী চার বছরেই শেষ হয়ে যাবে)’। পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ খাদ্য উৎপন্ন হয় মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে। যৌবন ধরে রাখতে মধু খাওয়ার বিকল্প নেই, কারণ মধু হলো একমাত্র খাদ্য যাতে পিনোসেমব্রিন নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে। মৌচাক থেকে মধু ও মোম ছাড়াও উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় রয়েল জেলি, পোলেন, মৌ বিষ, প্রপেলিস ইত্যাদি। বাজারদর ও চাহিদা বিবেচনায় মধু ও মোম থেকে উপজাতগুলোর দাম অনেক বেশি। এ পর্যন্ত প্রায় ১৩৬ প্রজাতির গাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে মৌমাছি নেকটার ও পোলেন সংগ্রহ করে। তন্মধ্যে সরিষা, লিচু, খলিশা, কুল, তিল, কালোজিরা, সূর্যমুখী, ধনিয়া উল্লেখযোগ্য।
মৌচাষের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও আধুনিক মৌচাষ মূলত শুরু হয় ১৮৫১ সালে ল্যাংস্ট্রোথ নামে এক বিজ্ঞানীর হাত ধরে। আমাদের দেশে প্রায় ২৫ হাজার মৌ চাষি রয়েছেন। দেশে বার্ষিক ৩০ হাজার টন মধুর চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১০ হাজার টন মধু দেশে উৎপাদিত হয়। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে মৌচাষ শিল্পে পরিণত হতে যাচ্ছে। রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে প্রকৃতিতে ফুলের প্রাপ্যতা থাকলেও মূলত বর্ষাকালে এর প্রাপ্যতা কমে আসে। তাই মধ্য জুন হতে মধ্য অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ সময়কাল মৌচাষে ডার্থ পিরিয়ড নামে পরিচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সব ঋতুতেই মৌবাক্সে একটি পোকা মৌ চাষিদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোকাটির নাম ঝসধষষ ঐরাব ইববঃষব (অবঃযরহধ ঃঁসরফধ), যা ঈড়ষবড়ঢ়ঃবৎধ বর্গের ঘরঃরফঁষরফধব গোত্রের অন্তর্গত। পোকাটি প্রথমে ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়। পরবর্তীতে এটি কানাডা, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের (ডার্থ পিরিয়ডে) বিভিন্ন জেলায় মৌ-বাক্সে এ পোকার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, যে পোকাটি বাংলাদেশে পাওয়া গিয়েছে তা এই পোকার এশিয়ান সাব স্পেসিস। এই পোকার পৃষ্ঠীয় অংশে সূক্ষ্ম লোম থাকে যার ফলে সহজে এদের কলোনি থেকে আলাদা করা যায় না। পিঠে শক্ত আবরণ থাকার কারণে মৌমাছি এদের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না। অনকূল পরিবেশ ও শারীরিক গঠনের কারণে আগামীতে এটি মৌচাষে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জীবন চক্র
পূর্ণাঙ্গ পোকা মৌ কলোনি শনাক্ত করে তাতে প্রবেশ করে। এরা মৌ বাক্সের ফাটল/ছিদ্র খুঁজে বের করে সেখানে ডিম পাড়ে। একটি স্ত্রী পোকা তার জীবদ্দশায় গড়ে ১,০০০টি ডিম পাড়তে পারে। ডিমগুলির বেশির ভাগই তিন দিনের মধ্যে ফুটে বাচ্চা (গ্রাব) বের হয়। সদ্য ফোটা গ্রাবগুলো মৌচাকের মধু, পোলেন এবং মৌমাছির লার্ভা খাওয়া  শুরু করে। ১০-১৬ দিনের মধ্যে এরা মাটিতে পুত্তলী গঠন করে। বিচরণ পর্যায়ে লার্ভা উপযুক্ত মাটি খুঁজে পেতে মৌচাক থেকে অনেক দূরে ঘুরে বেড়াতে পারে। তা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ লার্ভা মৌচাকের ৯০ সেন্টিমিটারের মধ্যে পুত্তলী গঠন করে। প্রায় ৮০% গ্রাব মাটির উপরিভাগ থেকে ১০ সেন্টিমিটারের কম দূরত্বে মাটিতে পুত্তলী গঠন করে। মাটির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে পুত্তলীর সময়কাল ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। সাধারণত তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পোকা পুত্তলী থেকে বেরিয়ে আসে এবং উপরিউক্ত প্রক্রিয়ার পুনারাবৃত্তি ঘটে।
শনাক্তকরণ
সাধারণত পরিদর্শনের মাধ্যমে এই পোকা সহজেই শনাক্ত করা যায়। মৌ বাক্স খুলে ১০ মিনিট সূর্যালোকে রাখলে পূর্ণবয়স্ক বিটলগুলো ছোটাছুটি করতে থাকে। মৌচাকের মৌমাছিদের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকে না। লার্ভা প্রায়ই মৌচাকের কোণে বা ফ্রেমে দলবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আক্রান্ত মৌচাক থেকে মধু পড়তে থাকে। মধুতে পচা কমলার গন্ধ পাওয়া যায়।
ক্ষতির ধরন
পোকাটির জীবন চক্রের চারটি ধাপের মধ্যে কীড়া (গ্রাব) মূলত ক্ষতি করে থাকে। গ্রাব মৌচাকের মধ্যে সঞ্চিত মধু ও পোলেন খাওয়া শুরু করে। এতে মৌচাকের ক্যাপিং এবং কম্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লার্ভার ক্রিয়াকলাপের ফলে মধু নষ্ট হয়ে যায়। তা থেকে একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত গন্ধ বের হয়। খাবার সংকটের কারণে মৌচাকে মৌমাছির সংখ্যা কমে যায়। এতে একদিকে যেমন মৌমাছির সংখ্যা কমে যায়, অপরদিকে মৌচাক থেকে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে মৌমাছি বাসস্থান পরিত্যাগ করে। মৌমাছির মৌ কলোনি ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রতি কলোনিতে গড়ে ১০০০টির বেশি প্রাপ্তবয়স্ক পোকা থাকতে হয়।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
যেহেতু এই পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন পদ্ধতি দেশে এখনও সহজলভ্য নয়। তাই নিয়মিত পরিদর্শন ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এই পোকার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নিচে কিছু বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হলো-
নিয়মিত মৌ-বাক্স পরিদর্শন করা, যাতে এই পোকা দেখামাত্রই প্রাথমিক অবস্থাতে নিয়ন্ত্রন করা যায়; ২-৩ দিন পর পর নিচের তলা/বটম বোর্ড পরিষ্কার করতে হবে; আক্রমণ বেশি হলে একটি পরিষ্কার ফ্রেমে আক্রান্ত বাক্সের মৌমাছি স্থানান্তর করা এবং সম্ভব হলে হাত দিয়ে পূর্ণাঙ্গ পোকা, গ্রাব ধরে মেরে ফেলা; উন্নতমানের মৌবাক্স ব্যবহার করা যাতে কোন ফাটল/ছিদ্র না থাকে। এক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা ফসল উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প (৩য় পর্যায়) এর সরবরাহকৃত বাক্সগুলো মডেল হিসেবে নেয়া যতে পারে; মৌবাক্স সরাসরি মাটিতে স্থাপন না করা। মৌবাক্স সবসময় মাটি হতে খানিকটা উপরে স্থাপন করা; যেহেতু এই পোকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৌবাক্সের কাছাকাছি স্থানের মাটিতে পুত্তলী গঠন করে, তাই ঐ স্থানের মাটি কিছুটা আলগা করে দিলে, পুত্তলী বাইরে বের হয়ে আসবে; মৌবাক্স পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। মৌবাক্সে চারপাশ থেকে মধু, কম্ব এবং ক্যাপিং অপসারণ করতে হবে যাতে এই পোকা আকৃষ্ট হতে না পারে; আক্রমণের তীব্রতা ও ক্ষতি কমাতে চাকে মধু জমা হয়ে গেলে ১-২ দিনের মধ্যে দ্রুত সংগ্রহ করা। কারণ ক্যাপিং করা মধু পূর্ণাঙ্গ পোকা ও লার্ভাকে আকৃষ্ট করে; মধু ঘর এবং অন্যান্য স্থানে যেখানে মধু সংরক্ষণ করা হয় সেখানে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৫০% এর কম রাখলে তা ডিম ফুটতে বাধা দেয়; এই পোকা মোকাবিলা করার জন্য এপিয়ারিতে দুর্বল কলোনিগুলো অপসারণ করা বা শক্তিশালী করা উচিত। এর জন্য কলোনিতে ব্রুড রোগ, মাইট সমস্যা, দুর্বল রানী ইত্যাদির সুষ্ঠু সমাধান করা; আক্রান্ত কলোনিতে সুপার চেম্বার থাকলে তা অপসারণ করার ব্যবস্থা করা; ডার্থ পিরিয়ডে কলোনিতে যেন পুষ্টির ঘাটতি না হয় সেজন্য পোলেন, চিনির পানি (১:১) ও পানির উৎস নিশ্চিত করা; সাধারণত এই পোকা পুত্তলী গঠনের জন্য আদ্র, আলগা ও বেলে মাটি পছন্দ করে সেক্ষেত্রে এটেল দোআঁশ বা এটেল মাটিতে মৌ বাক্সগুলো রাখলে আক্রমণ কম হতে পারে। আমাদের দেশে প্রচলিত না হলেও বিভিন্ন দেশে এই পোকার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যহার করা হচ্ছে।
স্মল হাইভ বিটল পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ইন-হাইভ ফাঁদ যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। যেমন: হুড ট্র্যাপ, ফ্রিম্যান বিটল ট্র্যাপ, ওয়েস্ট ট্র্যাপ, এজে বিটল ট্র্যাপ, সনি মেল ট্র্যাপ, টঝউঅ বিটল ট্র্যাপ ইত্যাদি। হুড বিটল ট্র্যাপ যেখানে এটিকে মৌবাক্সের ফ্রেমে লাগিয়ে দেয়া হয়। তাতে অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে (আকর্ষক) ভরা থাকে এবং আটকা পড়া পোকাকে মারার জন্য ঐ ফাঁদে খনিজ তেল (কিলিং এজেন্ট) থাকে। অন্যান্য ফাঁদগুলোও সাধারণত একই নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
মাটিতে বসবাসকারী দুই প্রজাতির নেমাটোড (ঝঃবরহবৎহবসধ ৎরড়নৎধাব ও ঐবঃবৎড়ৎযধনফরঃরং রহফরপধ) এই পোকার বিরুদ্ধে কার্যকরী। উপকারী নেমাটোডগুলোকে (পারমেথ্রিন) মাটিতে প্রয়োগ করা হলে, পোকামাকড়ের সন্ধানে নেমাটোডগুলো নিচের দিকে গর্ত করে। একবার একটি পোকা পাওয়া গেলে, নেমাটোডগুলো পোকার শরীরে প্রবেশ করে এবং একটি শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দেয়া যা দ্রুত কীটপতঙ্গকে মেরে ফেলে। নির্গত ব্যাকটেরিয়া পোকার অভ্যন্তরীণ টিস্যু দ্রবীভূত করে যা নেমাটোডের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য খাদ্য হয়ে ওঠে। পরিপক্ব নেমাটোড তারপর সঙ্গম করে এবং ডিম পাড়ে যাতে মৃত পোকার মধ্যে আরও নেমাটোড তৈরি হয়। এই ধরনের বেশ কয়েকটি প্রজন্ম মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ঘটতে পারে। পোকামাকড়ের অভ্যন্তরে খাওয়ার পরে, ক্ষুদ্র সংক্রামক পর্যায়ের নেমাটোডগুলো মৃত পোকার খোসা ছেড়ে দেয় এবং আরও কীটপতঙ্গের সন্ধান শুরু করে। মাত্র ১০-১৫ দিন পর একটি মৃত পোকা থেকে প্রায় ৩,৫০,০০০ নেমাটোড বের হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসে ঈড়ঁসধঢ়যড়ং নামক এক ধরনের রাসায়নিক স্ট্রিপ মৌ কলোনিতে ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় ৪৫ দিন পর্যন্ত এই স্ট্রিপ কার্যকর থাকে। প্রতি হাইভে ১টি করে স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়।
এই পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকরী পদ্ধতি বের করতে গবেষণা চলমান রয়েছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এর কার্যকরী কোন ব্যবস্থাপনা মৌচাষিদের কাছে সহজলভ্য হবে। তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে বর্তমানে আমাদের এই পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অন্যথায় মৌচাষের মতো সম্ভাবনাময় একটি শিল্প হুমকির মধ্যে পড়তে পারে, যা দেশের আর্থসামাজিক খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

লেখক : অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, নরসিংদী সদর, নরসিংদী। মোবাইল: ০১৬৭৪৯২৬৪৩৭, ইমেইল: jubayergepbsau@gmail.com

বিস্তারিত
পুষ্টির চাহিদা পূরণে সবজির ভূমিকা

পুষ্টির চাহিদা পূরণে সবজির ভূমিকা
ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক
বাংলাদেশ এখন টেকসই খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে এর উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমান জলবায়ুর পরিবর্তন, কৃষি জমি কমে যাওয়া, মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, মানুষের শহরমুখী হওয়া, শ্রমিক অপ্রতুলতা, জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি নানা কারণে মূল খাদ্যের পাশাপাশি সবজি উৎপাদনে কঠিন সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে যথাসময়ে সব ধরনের খাদ্য উপাদান বিশেষত সবজি থেকে পাওয়া অনুপুষ্টিসমূহ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে পরিবারিক পর্যায়ে যদি সময় মতো বীজ, কৃষির আনুষাঙ্গিক অন্যান্য উপকরণ ও সঠিক তথ্য সরবরাহ করা যায় তবে তারা নিজেরাই নিজ জমিতে শাকসবজি উৎপাদন করে পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা বহুলাংশে মিটাতে পারে সাথে বাজারে সবজির সরবরাহও বাড়বে। ফলে মানুষের পুষ্টির চাহিদাও যথাযথভাবে পূরণ হবে।
আমাদের শরীরের জন্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের প্রধান উৎস হচ্ছে সবজি। এটি আমাদের শরীরের অপুষ্টি, দেহের নানাবিধ সমস্যা এবং বিভিন্ন রোগ ব্যাধি, যেমন-রক্তশূন্যতা, অন্ধত্ব, চর্মরোগসহ অন্যান্য অনেক ধরনের অসংক্রামক রোগ হতে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের শারীরিক এবং মানসিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং কর্মক্ষম জীবনকে দীর্ঘায়িত করে, যা পক্ষান্তরে জাতির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে বিরাজমান ব্যাপক অপুষ্টিজনিত সমস্যা মোকাবেলায় সবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা ২০১৫ অনুযায়ী গড়ে দৈনিক অন্তত ২০০ গ্রাম সবজি ও ১০০ গ্রাম শাক গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপাদন হওয়ায় আমরা সুপারিশকৃত মাত্রায় সবজি গ্রহণে এখনও পিছিয়ে রয়েছি এবং সঠিকভাবে পুষ্টিমান বজায় রেখে শাকসবজি প্রস্তুতেও জ্ঞানের কমতি রয়েছে। সঠিক পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন, সংরক্ষন, মোড়কজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণন না হওয়ায়  শস্য আরোহন পরবর্তী সময়ে পরিমাণ ও মানগত উভয়ভাবে শস্যের ক্ষতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে যা সবজি ঘাটতির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
খাদ্য উৎপাদন করে বিক্রির মাধমে আয়বৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বসতভিটার গুরুত্ব রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সামগ্রিক উন্নতি ঘটে। বসতবাড়ীতে পরিকল্পিতভাবে গড়া শাকসবজির বাগান পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সবজি উৎপাদনের কাঁচামাল যেমন- বীজ, সার, চারা, কীটনাশক এর উচ্চমূল্য অনেক ভূমিহীন প্রান্তিক পরিবারগুলোর পক্ষে বহন করা কঠিন। স্বল্পমূল্যের উপকরণ যথা-মিশ্রসার বা ভার্মিকম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার,  বেড়া, রোগ ও পোকা দমনের জৈবিক উপায় যেমন- ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ, আঠালো ট্রাপ ব্যবহার করে ভালো সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। অনেক প্রকার সবজি বীজ স্থানীয়ভাবে বাগানেই উৎপন্ন করা যায়। দেশীয় শাক-সবজি যেমন, লাল নটেশাক, সবুজ নটে শাক, পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক, ধনেপাতা, সজনেপাতা ইত্যাদি এবং অন্যান্য সবজি যেমন চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙ্গা, চিচিংগা, করলা, লাউ, বরবটি ইত্যাদি উৎপাদন করা সম্ভব। সুতরাং বসতভিটায় সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা একটি বাগান হলো একটি সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থা যা দিতে পারে মানসম্মত পুষ্টিকর খাদ্যেও জোগান। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ পুষ্টি বাগান প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ছাড়াও  বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) তার প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কার্যক্রমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, পুষ্টিগত মান নির্ণয় ও খাদ্যে পুষ্টিমান বজায় রাখা নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম চলমান রেখেছে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর সংস্থা সবজি উৎপাদনে নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে পুষ্টির চাহিদা পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখবে। এবার আসুন জেনে নেই, বিভিন্ন প্রকার সবজির পুষ্টিগুণাগুণ ও উপকারিতা (সারণি দ্রষ্টব্য)।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান)। মোবাইল : ০১৭৫৯৬৭৬৮৫৯, ই-মেইল :ssosunamganj@gmail.com

বিস্তারিত
সোনালি আঁশের রূপালি কাঠি

সোনালি আঁশের রূপালি কাঠি
কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস
পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। আমাদের দেশের মতো এত ভালো মানের পাট পৃথিবীর আর কোথাও উৎপন্ন হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একাধিক ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘পাট সম্পদ থেকে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের প্রাপ্য, তা থেকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা আমাদের বঞ্চিত করছে। লড়াই করে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে।’ স্বাধীনতার পর জুট অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে প্রাক্তন জুট অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে পুনর্গঠন করা হয়। পাট দেশি  ও তোষা দু’প্রজাতির হয়ে থাকে। পাট গাছের ছাল থেকে আহরিত আঁশ ‘পাট’ নামে পরিচিত যা বাংলাদেশের সোনালী আঁশ নামে সমাধিক পরিচিত। মনে করা হয় সংস্কৃত শব্দ ‘পট্ট’ থেকে পাট শব্দের উদ্ভব হয়েছে।
আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পাটবস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে মহর আলীর পাটের শাড়ি, হাজার বুটিক পাটের শাড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদিনের সারাজীবনে আগুন পাটের শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাট বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। পাটখড়ি থেকে বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা পারটেক্স আবিষ্কার করেছেন।
পাট উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের অবস্থান শীর্ষে এবং বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৭.২৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদন হয় ৮৪.৩২ লাখ বেল পাট। দেশের প্রায় ৫০ লাখ কৃষক পাট চাষের সঙ্গে জড়িত। দেশে মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩-৪ ভাগ আসে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে । তৈরি পোশাকশিল্পের পরই পাট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট চাষের ফলে পাটের পাতা পচে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈবসার সরবরাহ করে। পাটশাক যেমন মুখরোচক, তেমনি স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। এর মাংসল বৃতি থেকে আচার, জ্যাম, জেলি, জুস, ঠা-া পানীয় তৈরি করা হয়ে থাকে। এছারা চুকুরের পানীয় চা এর মতো পান করা হয়ে থাকে যা বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৭৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপন্ন হয়।
পাট চাষে একদিকে সোনালি আঁশ, অন্যদিকে রূপালি কাঠি দুইয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। পাটকাঠি এত দিন গ্রামে রান্নার কাজে জ্বালানি ও ঘরে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে।
পাটের আঁশ থেকে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, পর্দার কাপড়, গয়না, অলংকারসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য, যা দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পাট পণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। এছাড়া পাট দিয়ে নন্দন ও রুচিশীল ফ্যাশন্যাবল বা সৌন্দর্যমন্ডিত পণ্য, দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী সামগ্রী, নানা প্রকারের হ্যান্ডিক্রাফট, হোম টেক্সটাইল পার্টেক্স বোর্ড ইত্যাদি বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বে গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত  করতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে।
পাট থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ও বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির যে অমিত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, যাতে রূপকথার সোনার কাঠি- রূপোর কাঠি ছোঁয়ার মতো বাস্তব জীবনেও সোনালি আঁশের রূপালি কাঠির ছোঁয়ায় আমাদের দেশ পৌঁছে যাক সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫২৯৯৯১৪৯ ই-মেইল : jannatul@bjri.gov.bd

বিস্তারিত
বাসায় উপকারী শোভাবর্ধক সাকুলেন্টের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা

বাসায় উপকারী শোভাবর্ধক সাকুলেন্টের
উৎপাদন ব্যবস্থাপনা
পার্থ বিশ^াস১ তিথি মন্ডল২
বর্তমানে বাংলাদেশি সৌখিন বাগানীদের কাছে সাকুলেন্ট একটি বহুল প্রচলিত নাম। ছোট থেকে বৃদ্ধ যেকোন বয়সের বাগানী সাকুলেন্ট এর চিত্তাকর্ষকরূপে মুগ্ধ। শুধু রূপে নয়, সাকুলেন্ট বাসায় রাখার অন্যান্য উপকারিতাও আছে। যেমন- সাকুলেন্ট ঘরের বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখে, রাতে অক্সিজেন নির্গত করে ঘুমে সহায়তা করে, স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং সার্বিকভাবে মনকে প্রফুল্ল রাখে। সাকুলেন্ট মূলত শীত প্রধান দেশের গাছ। শীত প্রধান দেশে খোলা পরিবেশে বা শেডের মধ্যে এরা খুব ভালোভাবে জন্মে এবং বেড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশের মিশ্র আবহাওয়া বা পরিবেশ সাকুলেন্ট উৎপাদনে কিছুটা প্রতিকূল। তবে সঠিক পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশেও ভালোভাবে সাকুলেন্টের উৎপাদন করার পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সাকুলেন্টের মাধ্যমে উপার্জন করাও সম্ভব। বর্তমানে ৪র্থ শিল্প বিল্পবের যুগে বিভিন্ন শ্রেণির পেশা বা উপার্জনের উৎস সৃষ্টি হচ্ছে। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থাকে টেকসই এবং সর্বোচ্চ করাই বর্তমান সময়ের অন্যতম লক্ষ্য যা এসডিজি ও বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এ উল্লেখ আছে। আমরা যারা ভাড়া বাড়িতে থাকি তারা অনেকেই ইচ্ছা করলেই ছাদে গাছ রাখতে পারি না। সেক্ষেত্রে বাসার জানালা বা বারান্দায় লোহা বা প্লাস্টিকের র‌্যাকে (উলম্বভাবে) সাকুলেন্ট এর উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা যেতে পারে।
সাকুলেন্টের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা (নতুন সাকুলেন্ট প্রেমিদের ক্ষেত্রে)
পরিবেশ : শীত প্রধান দেশের গাছ হওয়ায় এরা তুলনামূলক ঠা-া ও খোলামেলা পরিবেশ পছন্দ করে। অতিরিক্ত রোদ, গরম, পানি বা সার কোনটাই এদের পছন্দ নয়। অতিরিক্ত রোদ এর কারণে এদের পাতায় সানবার্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা সাকুলেন্টের গোড়া পচে যায়। তাই গরমকালে ২-২.৫ ঘণ্টা এবং শীতকালে ৪-৫ ঘণ্টা সকালের বা বিকালের রোদ এদের জন্য যথেষ্ট।
মিডিয়া : মিডিয়া অনেকভাবে তৈরি করা যায়। গোবর সার, পাতাপঁচা সার, নিমখৈল, হাড়ের গুঁড়া ও ধানের চিটা ব্যবহার করে মিডিয়া তৈরি করা হয়। কিন্তু এর অধিকাংশগুলোই ভালোভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা থাকে না যার ফলে বর্ষাকালে মিডিয়ায় ছত্রাক হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থকে। তাই নতুন সাকুলেন্টপ্রেমীরা এগুলো ব্যবহার না করাই ভালো। আবার কোকোপিটের পানিধারণ ক্ষমতা অধিক হওয়ায় মিডিয়াতে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা যাবে না কারণ সাকুলেন্ট কম পানি পছন্দ করে। মিডিয়া তৈরির সাথে সাথেই ব্যবহার না করে এক সপ্তাহ বা পনের দিন পর ব্যবহার করা ভালো। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে অপেক্ষাকৃত ভালো মিডিয়া নির্দিষ্ট পরিমাণের নি¤েœাক্ত কয়েকটি উপাদানের সমন¦য়ে তৈরি করা যায় (সারণি-১)।
পট নির্বাচন : যত বড় পট তত পানিধারণ ক্ষমতা বেশি এবং সাকুলেন্ট মারা যাওয়ার আশঙ্কাও তত বেশি। তাছাড়া এদের শিকড় বেশি বড় হয় না এবং গভীরে যায় না। তাই এদের জন্য সবসময় ছোট পট নির্বাচন করা ভালো। সেক্ষেত্রে সাকুলেন্টের আকারের তুলনায় ১ বা ২ ইঞ্চি বড় পট নির্বাচন করতে হবে। যেমন- সাকুলেন্টের আকার যদি ২ ইঞ্চি হয় তবে এর জন্য পট হবে ৩ বা ৪ ইঞ্চি এবং পট মাটি বা প্লাস্টিক উভয় রকম হতে পারে। তবে মাটির পট নির্বাচন করা উত্তম।
পানি দেওয়া : সাকুলেন্ট এমন একটি প্রজাতির গাছ যারা কা- ও পাতায় প্রচুর পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারে। আর এজন্যই প্রয়োজনের অধিক পানি এদের পছন্দ নয়। পানির অভাবে সাকুলেন্ট মারা গিয়েছে এমন ঘটনা খুব কম শোনা যায় কিন্তু বেশি পানি দেওয়ায় সাকুলেন্ট মারা যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। কাজেই এ গাছে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটু বেশি সচেতন হতে হবে। সপ্তাহে ১ দিন বা কিছু ক্ষেত্রে ২ দিন পানি দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ মিডিয়া ৯০-৯৫% শুকালে পানি দিতে হবে। যারা নতুন সাকুলেন্ট বাগানী তারা নিচের দিকের ২-১টা পাতা হালকা চাপ দিয়ে একটু নরম অনুভব করলে পানি দিতে পারেন। অথবা একটি টুথ্পিক মিডিয়ায় ঢুকিয়ে তুলে আনলে যদি দেখা যায় যে তার গায়ে বালু লেগে নেই তাহলে বুঝতে হবে পানি দেওয়ার সময় হয়েছে। সাকুলেন্টে এমন সময় পানি দিতে হবে যেন পানি দেওয়ার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পর গাছে রোদ এসে পড়ে অথবা গাছ থেকে রোদ সরে যাওয়ার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পর পানি দিতে হবে। তবে সাকুলেন্টে পানি দেওয়ার সবথেকে ভালো সময় সূর্যাস্তের পরে। গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে এবং পানি দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পাতার গোঁড়ায় পানি জমে না থাকে। কারণ দীর্ঘক্ষণ পাতার গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছ পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও সার প্রয়োগ : সাকুলেন্টে অনেক সময় রুটমিলি হয়। রুটমিলি ছোট ছোট সাদা রং এর পোকা যারা শেকড় থেকে পুষ্টি শোষণ করে বেঁচে থাকে। গাছের বৃদ্ধি না হওয়া, নিস্তেজ হওয়া সাধারণত রুটমিলি হওয়ার লক্ষণ। রুটমিলি হলে সম্পূর্ণ মিডিয়া পরিবর্তন করে দেওয়া ভালো। অথবা ১ লিটার পানিতে ১-২ ফোঁটা (কোনভাবেই এর বেশি নয়) নাইট্রো অথবা ইমিটাফ মিশ্রিত করে মিডিয়ায় দিতে হবে। পাতায় থাকলেও স্প্রে করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে পাতা যেন দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে সাধারণ পানি দ্বারা স্প্রে করতে হবে। আর কীটনাশক অবশ্যই শেষ বিকেলে বা সূর্যাস্তের পর প্রয়োগ করতে হবে। মাসে ১-২ বার অর্থাৎ ১৫ দিন অন্তর এক লিটার পানিতে ১/২ চা-চামচ ছত্রাকনাশক ভালোভাবে মিশ্রিত করে মিডিয়াতে দেওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত সার এদের পছন্দ নয়। শুধু ভার্মিকম্পোস্টে খুশি সে। তবে পটে (২ ইঞ্চি এর জন্য) ৪-৫টা দানা অসমোকট দিতে পারলে ভলো। এটি ঝষড়ি জবষবধংব ঋবৎঃরষরুবৎ তাই ১ বার দিলে ৬ মাস পর্যন্ত এর প্রভাব থাকবে। সাকুলেন্টে আর কোন রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করাই ভলো। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
চারা তৈরি : সাকুলেন্টের চারা মূলত পাতা থেকে করা হয় এবং পাশাপাশি কাটিং এর মাধ্যমেও করা যায়। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সাকুলেন্টের চারা সাধারণত অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে করতে হয়। গাছ থেকে সাবধানে পাতা তুলতে হবে যেন পাতার গোড়ায় ক্ষত না হয়। তারপর পাতাগুলো পরিষ্কার টিস্যু পেপারে ৪-৫ দিন খোলা আলো বাতাসে রেখে মিডিয়াতে বসাতে হবে। পাতা থেকে চারা তৈরির ক্ষেত্রে গোলাকার, চওড়া এবং কম উচ্চতা (১ বা ২ ইঞ্চি) বিশিষ্ট মাটির পট বা সিডলিং ট্রে নির্বাচন করলে ভালো হয়। মিডিয়াতে মাতৃপাতা দেওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর অল্প পরিমাণে পানি স্প্রে করতে হবে। এরপর মিডিয়া শুকালে (প্রায় ২-৩ দিন পর পর) অল্প পরিমাণে পানি স্প্রে করে দিতে হবে। এর ফলে দ্রুতই চারার উদ্ভব হবে। চারার বয়স প্রায় ১ মাস হলে পটটি এমন জায়গায় রাখতে হবে যেন সকালের প্রায় এক ঘন্টা রোদ পায়। কাটিং থেকে চারা করার পদ্ধতিও প্রায় একই রকম।   মাতৃগাছ থেকে ডাল কেটে ৪-৫ দিন রেখে তারপর মিডিয়াতে বসাতে হবে। মিডিয়াতে বসানোর আরও ৪-৫ দিন পর থেকে মিডিয়া শুকালে পানি দিতে হবে এবং সহজেই শিকড় এসে ডাল চারায় রূপান্তরিত হবে। তবে কাটিং থেকে চারা করার ক্ষেত্রে প্রতি কাটিং এর জন্য একক পট (২-৩ ইঞ্চি) নির্বাচন করা ভালো। পাতার চারা পরবর্তী শীতে অর্থাৎ এক বছর পর রিপটিং করা ভালো।
আমাদের দেশে এর মূল্য : আমাদের দেশে সাইজ ও ভ্যারাইটি অনুযায়ী প্রতিটি সাকুলেন্টের মূল্য ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বা এর বেশিও হতে পারে। শখের বাগানীরা এর থেকে অতিরিক্ত চারা উৎপাদন করে অনলাইনে বা সরাসরি বিক্রি করে নিজের শখের গাছগুলো কেনার পাশাপাশি বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।
পরিশেষে বলা যায়, নতুন বাগানিরা এভাবে করলে আশা করি নিরাশ হবেন না। আশা করি বাংলাদেশও এক সময় সাকুলেন্ট চাষে সমৃদ্ধ হবে। তখন তাদের আর শীত প্রধান দেশের সাকুলেন্ট নয়, দেশি সাকুলেন্ট বলা যাবে।

লেখক: ১বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ; ফোন-০১৭২৭৬৫৬২১৬, ই-মেইল: ঢ়ধৎঃযর.নরংধিং@মসধরষ.পড়স ২মাস্টার্স (উদ্ভিদ বিজ্ঞান) এবং নারী উদ্যোক্তা, ফোন-০১৭৯৪৮৭৬৯১৬, ই-মেইল:parthi.biswas@gmail.com

বিস্তারিত
তেল ফসলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিনা উদ্ভাবিত তিলের জাতসমূহের সম্ভাবনা

তেল ফসলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিনা উদ্ভাবিত
তিলের জাতসমূহের সম্ভাবনা
ড. মো. আব্দুল মালেক১ মো. সৈকত হোসেন ভূইয়া২
যদিও জনবহুল এই দেশের মানুষ খাবার বলতে শুধু ভাতকেই বুঝে থাকে। কিন্তু শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের জন্য তেলফসল গুরুত্ব অপরিসিম। তেলফসল চাষাবাদ বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন কিছু নয়। মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনী সমস্ত উপাদান এতে বিদ্যমান রয়েছে। তেল ফসল হচ্ছে শর্করা, আমিষ, চর্বি, লৌহ, জিংক ও বিভিন্ন ভিটামিন যথা ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, থায়ামিন ও রাইবোফ্লোভিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তেল ফসলে সিদ্ধ চালের (ভাত) তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের বেশি আমিষ, অর্ধেক শর্করা, চার গুণের বেশি লৌহ ও জিংক থাকে। এছাড়া তেল ফসল চর্বির অন্যতম উৎস। দেশের ক্রমবর্ধান জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ তথা পুষ্টি সমৃধ্য খাদ্য নিশ্চিত করা বর্তমান সময়ের কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত কৃষি বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত তেলফসলের জাতের সংখ্যা ৩২টি। এদের মধ্যে সরিষার ১১টি, চিনাবাদামের ১০টি, সয়াবিনের ৭টি ও তিলের ৪টি জাত রয়েছে।
দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ গ্রাম করে তেল গ্রহণ করে থাকে। চাহিদার এক তৃতীয়াংশের মতো পূরণ হয় দেশে উৎপাদিত তেল থেকে এবং বাকিটা আমদানি করে মেটানো হয়। দেশে তেলের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। এই বাস্তবতা বিবেচানা করে আমাদের এখনি সময় তেল ফসল চাষাবাদে গুরুত্ব দেয়া। দেশে প্রচলিত তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী চাষ হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সরিষা, তিল এবং সয়াবিন থেকেই সাধারণত তেল বানোনো হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত জাতের তেল ফসলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তেল পাওয়া যায় তিল হতে। তিলে প্রায় ৪৩ ভাগ, সরিষায় ৪০ ভাগ, এবং সয়াবিনে ১৮ ভাগ তেল থাকে। তেল ফসলের মধ্যে তিল হচ্ছে ক্যালসিয়ামে ও আয়রনের সব থেকে বড় যোগান দাতা। এতে প্রায় ৯৬৯ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের জন্য প্রতিদিন ৮ মিলিগ্রাম ও মহিলাদের ১৮ মিলিগ্রাম আয়রনের প্রয়োজন হয়। তিলে প্রায় ১০ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। বিনা উদ্ভাবিত বিনাতিল-১ হতে ৫২%, বিনাতিল-২ হতে ৪০%, বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ হতে ৪৩% তেল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত বিনাতিল-১, বিনাতিল-২, বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ এর গড় ফলন ১.৩-১.৫ মে. টন/হে.।
দেশের সকল এলাকায় তিল চাষ সম্ভব। বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি জাতগুলো চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত। তাপমাত্রা ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে বীজ গজাতে দেরি হয় এবং চারাগাছ ঠিকমতো বাড়তে পারে না। তিল জাতগতভাবে খরা সহনশীল তবে জলাবদ্ধতা সহনশীল নয়, বাড়ন্ত অবস্থায় অনবরত বৃষ্টিপাত হলে তিল গাছ মরে যায়। তবে বপনের সময় মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে একটি হালকা সেচ দিয়ে জোঁ আসার পর চাষ দিয়ে বীজ বপন করে বীজ গজানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এর পর ফুল আসার সময় জমিতে রসের অভাব হলে একবার এবং পরবর্তীতে ফল ধরার সময় আবার খরা হলে আরও একবার সেচ দেয়া যেতে পারে। যেহেতু তিল ফসল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই জমির মধ্যে মাঝে মাঝে নালা কেটে বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে ফসলকে রক্ষা করতে হবে এবং উৎপাদন মৌসুমে পানি জমে থাকে না এ রকম জমি তিল চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। অধিক ফলন পেতে হলে অন্যান্য ফসলের মতো তিলের জমিও আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা অবস্থায় প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত তিল গাছের বৃদ্ধি ধীর গতিতে হতে থাকে, ফলে এ সময় জমির আগাছা দ্রুত বেড়ে তিল গাছ ঢেকে ফেলতে পারে। তাই এ সময় একটি নিড়ানি দিতে হবে। তাছাড়া বীজ বপনের পূর্বেই জমি থেকে ভালোভাবে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। আমরা জানি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কমবেশি হয়ে থাকে। তাই সাধারণভাবে একরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি ইউরিয়া, ৫৫-৬০ কেজি টিএসপি, ১৬-২০ কেজি এমওপি এবং ৪০-৫০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমি প্রস্তুতকালে অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্যান্য সকল সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া সার বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর গাছে ফুল আসা পর্যায়ে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তেল ফসলের বীজের পুষ্টতার উপর বোরন সারের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এই সারের অভাবে বীজ পুষ্ট হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় জিংক ও বোরন সারের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই জিংক ও বোরন সারের ঘাটতি এলাকায় একর প্রতি ৪ কেজি জিংক সালফেট ও ৩ কেজি বরিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে।
বিনা উদ্ভাবিত বিনাতিল-২ জাতটি আকস্মিক বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট সাময়িক জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। বিনাতিল-২ জাতটি অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ৮ মাত্রার লবণাক্ততা সহনশীল, তবে বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ জাত দু’টি। ৬ ডেসিমেন/মিটার পর্যন্ত লবণক্ততা সহনশীল। বিনাতিল-২ জাতটির বীজাবরণ কালো তবে বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ জাতের বীজাবরণ ধূসর কালো। শাখাবিহীন বিনাতিল-১ এর প্রতি পত্রকক্ষে ৪-৫টি ফল থাকে এবং ফলগুলো আকারে লম¦াটে। বিনা উদ্ভাবিত অন্য জাতগুলোর মধ্যে বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৩ এর প্রতি পত্রকক্ষে ২-৪টি ফল এবং বিনাতিল-৪ এর প্রতি পত্রকক্ষে ৩-৫টি ফল থাকে। জীবনকাল বিবেচনায় বিনাতিল-৩ একটি আগাম তিলের জাত। জাতটির জীবনকাল ৮০-৮৫ দিন। তবে পরিপক্ব অবস্থায় কৃষি পরিবেশভেদে জমির রসের উপর ভিত্তি করে জীবনকাল ২-৫ দিন বৃদ্ধি পায়। শাখাবিহীন বিনাতিল-১ এর জীবনকাল-৮৫-৯০ দিন। ২-৪টি প্রাথমিক শাখাযুক্ত বিনাতিল-২ ও ৩-৫টি প্রাথমিক শাখাযুক্ত বিনাতিল-৪ এর জীবনকাল ৮৭-৯২ দিন। তবে যদি আকস্মিক বৃষ্টিতে সাময়িক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তবে জীবনকালের সাথে জলাবদ্ধতার সময়কাল যোগ করতে হবে।
আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি না করে শুধুমাত্র উন্নত জাত ব্যবহার করে একই পরিমান জমি হতে ০.৩৫৮ লক্ষ টন অতিরিক্ত তিল উৎপাদন সম্ভব। বিনা’র চলমান গবেষণা হতে দেখা যায় পানি সাশ্রয়ী তিল শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির (আমন-গম-তিল) মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬৮% বেশি লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া আমন-মসুর-তিল শস্য বিন্যাস প্রচলনের মাধ্যমে নড়াইল, ফরিদপুর, কৃষ্টিয়া এলাকায় ৪৫% বেশি লাভ করা সম্ভব। শস্য বিন্যাসে তিলের অন্তর্ভুক্তি জমির উর্বরতা নিশ্চিত করে। তিলের শিকড় মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। এটি জমির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জমির বুনট ও গঠনের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাছাড়া শস্যবিন্যাসে তিলের অন্তর্ভুক্তি ফসলের নেমাটোডিয়াল রোগের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ চর এলাকা খরিফ মৌসুমে প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে পতিত থাকে।আবার কিছু চর এলাকার পানি সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে নামতে শুরু করে। খরিফ-১ মৌসুমের মতো বিনা উদ্ভাবিত তিলের জাতসমূহ রবি মৌসুমেও চাষ করা যায়। তাই চর এলাকায় বর্ষার পানি নেমে গেল সাথে সাথে তিল বপন করা সম্ভব। মুগসহ অন্যান্য ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবেও তিলের আবাদ করা সম্ভব, তবে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করলে প্রধান ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হবে। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৭.৫-৮ কেজি এবং সারিতে বপন করার জন্য ৬-৭ কেজি বীজ প্রয়োজন। তবে সাথী ফসল হিসেবে আবাদ করার সময় উভয় ফসল কি হারে বা কত সারি পর পর কোন ফসলের বীজ বপন করা হবে, তার উপর নির্ভর করে বীজের হার নির্ধারণ করতে হবে। প্রতি বছর ৫% করে অতিরিক্ত জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব হলে ২০৩০ সালের মধ্যে আর ০.৫৪ লক্ষ হেক্টর জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব, যা হতে অতিরিক্ত ০.৭৫ লক্ষ টন তিল পাওয়া সম্ভব। খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিনা উদ্ভাবিত তিলের জাতসমূহের যথাযথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের চর এলাকা ও উপকূলীয় এলাকার ৬-৮ লবণাক্ত জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব। তেল ছাড়া সরাসরি তিলের ব্যবহার ও বহুল পরিচিত। গরম ভাতের সাথে তিলের ভর্তা একটি মুখরোচক খাবার। তাছাড়া কুষ্টিয়া এলাকার তিলের খাজা দেশ বিখ্যাত। একই সাথে কনফেকশনারিতে বিস্কুট, পাউরুটি, রোল, কেকে, কুকিজ ও ক্যান্ডি তৈরিতেও তিল ব্যবহৃত হয়। বিনাতিল-১ এর খোসা পাতলা ও রং সাদা হওয়ায় এটি সরাসরি ব্যবহার করা যায়, অন্যদিকে বিনার অন্য জাতগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ব্যবহার করা যায়। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য এটি অল্প পরিসরে বসতবাড়ির আঙিনায় কিংবা বেগুন ও অন্যান সবজি ফসলের সীমানায় লাগোনো যায়। খোসা থেকে তিল ছাড়ানোসহ তিলের খাজা, নাড়ু ইত্যাদি কাজ সরাসরি মহিলাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে করে বাড়তি কর্মসংস্থানসহ কৃষিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে।
দেশে করোনাভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে ‘খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। কোন জমি যেন পতিত না থাকে। পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে দেশকে তৈল ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে বিনা উদ্ভাবিত তিল ফসলের উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক : ১পরিচালক (গবেষণা), বিনা ময়মনসিংহ-২২০২, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বিনা ময়মনসিংহ-২২০২, যোগাযোগের জন্য : মোবাইল : ০১৭১৭১৮০৩৯৫, ইমেইল :saikat.ag88@gmail.com

 

বিস্তারিত
মানসম্পন্ন বীজের জন্য বীজের জেনেটিক বিশুদ্ধতা অপরিহার্য

মানসম্পন্ন বীজের জন্য বীজের জেনেটিক বিশুদ্ধতা অপরিহার্য
ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ
বীজ হলো কৃষির মৌলিক উপকরণ ফসল উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও বাংলাদেশের জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বীজ। উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সময়মতো বীজের প্রাপ্যতা কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে যুক্তিসঙ্গত মূল্যে মানসম্পন্ন বীজ প্রয়োজন। মানসম্পন্ন বীজের দক্ষ ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে সার এবং সেচের মতো উপকরণ, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা শুধুমাত্র উচ্চফলন পেতে, উচ্চ আর্থিক রিটার্ন পেতে ও গুণমান বৃদ্ধি করে ২৫% উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। অন্যান্য ইনপুটগুলোর সাথে মিলিতভাবে ফলনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। গুণগত বীজ সাধারণভাবে শারীরবৃত্তীয় গুণমান এবং আগাছা বীজের উপস্থিতি, বীজবাহিত রোগ এবং অন্যান্য উপকরণ ব্যতিরেকে জেনেটিকভাবে প্রভাবিত হয়ে বিশুদ্ধ বীজ উৎপাদিত হয়। জেনেটিক বিশুদ্ধতাসম্পন্ন বীজ হলো  অন্য জাত বা প্রজাতির জেনেটিক উপকরণ দ্বারা দূষণ শতাংশ। জিনগত বিশুদ্ধতা হলো উদ্ভিদ প্রজনন এবং বীজ উৎপাদনকারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, যা টাইপের সত্যতা বা অবাঞ্ছিত জেনেটিক জাত বা প্রজাতির দ্বারা সৃষ্ট বীজের দূষণের মাত্রা বোঝায়। এটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন উদ্ভিদের ধরন, বৃদ্ধি চক্রের সময়কাল, বীজের রঙ এবং আকৃতি, বীজের সজীবতা, পোকামাকড় ও রোগ প্রতিরোধ, ঠা-া ঋতুর উৎপাদনশীলতা, উচ্চ বীজের ফলন, অবীজ বিচ্ছিন্নকরণ এবং নির্দিষ্ট শস্য বা বীজের গুণাবলী নিয়ে গঠিত হয়ে জেনেটিক বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করতে পারে এবং যে বীজ স্থানীয় অবস্থা বা পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নিতে পারে এবং প্রায়ই কৃষক এবং বাজারের চাহিদাকে প্রভাবিত করে। সময় ও জেনেটিক কিছু কারণে বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বীজের বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে, এটিকে অবনতি বলা হয়, উন্নয়নশীল তারতম্যের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট শস্যের জাত, যান্ত্রিক মিশ্রণ, প্রাকৃতিক ক্রসিং, জেনেটিক প্রবাহ, রোগের প্রভাব  যা জেনেটিক বা জীনের মিউটেশনের মাধ্যমে ঘটে থাকে। বীজের জেনেটিক বিশুদ্ধতা বেশির ভাগই যৌনভাবে প্রবাহিত হয়ে উদ্ভিদের সাথে যুক্ত; স্বপরাগায়িত ফসলের চেয়ে ক্রস-পরাগায়নে এটি আরও গুরুতর। হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের সাফল্য পিতামাতার জীনগত জেনেটিক বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল। আউটক্রসিং এবং বীজের অসাবধানতাবশত: মিশ্রণ উভয়ই বীজের গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অতএব, জেনেটিক বিশুদ্ধতা রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরীক্ষাগুলো বীজ উৎপাদনকারী এবং উদ্ভিদ প্রজননকারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
বীজের জেনেটিক বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ করতে হলে শুরুতেই প্রথমেই জানতে হবে কিভাবে বীজ তৈরি হয়। একটি গাছের বংশগত প্রক্রিয়াটি  তৈরি হয় তার ফুলে, আর ফুলের কয়েকটি অংশ হলো ফুলের বৃতি, দলম-ল, পুংকেশর ও স্ত্রীকেশর। প্রতিটি স্ত্রীকেশরের তিনটি অংশ থাকে তা হলো গর্ভাশয়, গর্ভদ- এবং গর্ভমু-। গর্ভাশয়ে ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়।
এই ডিম্বক নিষিক্ত হয়েই বীজ তৈরি হয়। আর নিষেক প্রক্রিয়াটি ঘটে যখন ফুলের গর্ভমু-ে পরাগরেণু পতিত হয়। পরাগরেণু উদ্দিপিত হয়ে তা অঙ্কুরোদগমণের মাধ্যমে গর্ভদ-ের ওপরে পরাগনালী তৈরি করে এবং পরাগনালীতে দু’টি পুং গ্যামেট তৈরি হয়। তা গর্ভমু- ভেদ করে একটি নালী তৈরি করে এই নালীর মাধ্যমে পুং গ্যামেটদ্বয়ের একটি গিয়ে ডিম্বকের সঙ্গে মিলিত হয় আর অন্যটি গিয়ে যুক্ত হয় দু’টি নিউক্লিয়াসের সাথে, যা পরবর্তীতে ‘শস্য’ (বহফড়ংঢ়বৎস) গঠন করে। এরপর ডিম্বক কোষটি  নিষিক্ত  হতে থাকে এবং ক্রোমোজোম বিভাজিত হয় ও রূপান্তর ঘটে তৈরি হয় বীজের ভ্রুণ। পরাগনালীর অন্য তিনটি নিউক্লিয়াস মিলে যে একটি কোষ তৈরি করে তা বিভাজিত হতে হতে রূপান্তরিত হয়ে তৈরি হয় সস্য বা এন্ডোস্পার্মে। বীজের প্রাচীর তৈরি হয় বাহিরের অংশে। সবগুলো একসাথে তৈরি হয়  একটি বীজ।  উত্তম প্যারেন্টের মধ্যে মিলনের  মধ্য দিয়ে যে বীজ তৈরি হয়েছে তাইই হলো মানসম্পন্ন বিশুদ্ধ বীজের প্রাথমিক স্তর।
বীজের দূষণ প্রক্রিয়া
ভালো বীজ মানেই অধিক ফলনশীলতা এটা আমরা জানি। আবার এটাও আমরা মনে করি বিশুদ্ধ বীজ মানেই হলো উত্তম বীজ, কিন্তু এটা আদৌ ঠিক নয়। যে বীজের উত্তম কৌলিক মানসম্পন্নতা নেই, সেই বীজ মানসম্পন্ন বীজ নয়। যে বীজের কৌলিতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধতা রয়েছে সেই বীজই  হলো বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন বীজ। এছাড়াও কিছু পরিবেশের ফ্যাক্টর যেমন বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, আর্দ্রতা, কৌলিক বিশুদ্ধতা ও ভাইয়াবিলিটি এসব যদি পুরোপুরি থাকে, তবে তাকে মানসম্পন্ন বীজ বলা হয়। পর-পরাগায়নের মাধ্যমে বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে, পর-পরাগী ফসলে সহজেই বাতাস, পোকামাকড় বা অন্যান্য বাহকের মাধমে পরাগরেণু অন্য প্রজাতির ফুলের গর্ভমু-ে পতিত হয়ে কৌলিক গঠনকে পরিবর্তন করে দেয়, ফলে বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে। পরাগরেণু একটি উদ্ভিদের জীনগত সকল বৈশিষ্ট্য বহন করে। যখন একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন জার্মপ্লাজম থাকে, তখন এক একটি জার্মপ্লাজমের কৌলিক বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এর অর্থ হলো একই প্রজাতির  কোনো একটি জাতের ফলের সংখ্যা বা অন্য কোনো গুণগত বৈশিষ্ট্যের জীন অন্যটির থেকে বেশি (উড়সরহধহঃ) বা কম (জবপবংংরাব) হতে পারে, এটা হলো এক একটি জার্মপ্লাজমের জীনগত বৈশিষ্ট্য। অন্য প্রজাতির অনাকাক্সিক্ষত জীনগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পরাগরেণু গর্ভমু-ে পতিত হলে সেই ভিন্ন পরাগরেণুর সকল কৌলিক উপকরণ দুটি পুংগ্যামেট কোষের (পুংগ্যামেট কোষে যে ক্রোমোজোম সংখ্যা বিদ্যমান থাকে তার অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে) মাধ্যমে এই পুংগ্যামেট কোষ অন্য প্রজাতির গর্ভাশয়ের ডিম্বককে নিষিক্ত করে ও কৌলিক বিশুদ্ধতাতে মিউটেশন ঘটিয়ে বীজের দূষণ ঘটায়।
যে সকল উপায়ে বীজকে বিশুদ্ধ করা হয় তা নিম্নরূপ:
১। কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা : বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলি অবশ্যই থাকতে হবে, ২। মিশ্রণ মুক্ততা ভালো বীজ অবশ্যই মিশ্রণ মুক্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ ভালো বীজে জড় পদার্থ, আগাছার বীজ এমনকি অন্য ফসলের বীজ থাকাও চলবে না এবং ৩। রোগ ও কীটপতঙ্গমুক্ত : বিশুদ্ধ ভালো বীজ অবশ্যই রোগজীবাণু মুক্ত ও কীটপতঙ্গ মুক্ত হতে হবে।
এখানে কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা কিভাবে করা হয় সে সম্পর্ক কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা : কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা হলো অবাঞ্ছিত জেনেটিক জাত বা প্রজাতির দ্বারা সৃষ্ট বীজের দূষণের মাত্রা বোঝায়। যেমন-হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের সাফল্য প্যারেন্টের জেনেটিক বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল। বীজের আউটক্রসিংও অন্যান্য অসাবধানতাবশত মিশ্রণ উভয়ই বীজের গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাই জেনেটিক বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা বীজ উৎপাদনকারী এবং উদ্ভিদ প্রজননকারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জিনগত বিশুদ্ধতা মান নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো বীজের গুণগত মান আর তা নির্ণীত হয় বীজের ভালো অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা, বিশুদ্ধতা, সজীবতা এবং বীজের স্বাস্থ্য। বীজ শিল্প বৃদ্ধির সাথে সাথে জেনেটিক বিশুদ্ধতা পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত কৌশলগুলিতে পরিমার্জন। জেনেটিক বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করার পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত বীজের বিভিন্ন বাহ্যিক আকারগত বা শরীরবৃত্তিয় বৈশিষ্ট্য বা মরফোলজিকাল পরীক্ষা, রাসায়নিক, জৈব রাসায়নিক এবং জেনেটিক মার্কার পরীক্ষা যেমন-
শারীরবৃত্তীয় পরীক্ষা : এই পদ্ধতিতে যে পরীক্ষাগুলো করা হয় তা হলো- বীজের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের পরীক্ষা, চারা পরীক্ষা, গ্রিন হাউজে পরীক্ষা এবং গ্রো আউট টেস্ট (এঙঞ)
রাসায়নিক পরীক্ষা : পটাশিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড পরীক্ষা, সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড পরীক্ষা, ফেরাস সালফেট রঙ পরীক্ষা,পটাশিয়াম ডাইক্রোমেট পরীক্ষা, খঁমড়ষ’ং ংড়ষঁঃরড়হ পরীক্ষা, হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং ডিডিটি পরীক্ষা
বায়োকেমিক্যাল মার্কার বা জৈব রাসায়নিক পরীক্ষা : এখানে যতগুলো পরীক্ষা আছে তার মধ্যে বায়োকেমিক্যাল মার্কার বা জৈব রাসায়নিক পরীক্ষা হলো বীজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল পরীক্ষা। এখানে বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে যে সকল পরীক্ষা করা হয় তা হলো-ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি মলিকুলার মার্কার দিয়ে বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয় করা হয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্যাটেলাইট মার্কার দিয়ে বীজের মলিকুলার সিকুয়েন্সে বীজের বিশুদ্ধতা বা দূষণতা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। যেমন ঝঝজ মার্কার অন্যান্য উঘঅ মার্কারগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পলিমরফিজম ও কো-ডোমিনেন্ট প্রদর্শন করে। অধিক পরিমাণ চড়ষুসড়ৎঢ়যরপ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঈড়হঃবহঃ (চওঈ) থাকার কারণে ঝঝজ মার্কার উঘঅ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং করতে মাইক্রোস্যাটেলাইট মলিকুলার মার্কার হিসাবে প্রয়োগ এবং উচ্চ দক্ষতা ও সরলতার কারণে ঝঝজ মার্কার গুলি বর্তমানে অনেক ফসলের বিশুদ্ধতা শনাক্তকরণের জন্য পছন্দের মলিকুলার মার্কার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আমরা জানি, যে দেশ যত উন্নত, সে দেশে ভালো বীজের ব্যবহারও তত বেশি। সার্কভুক্ত দেশেগুলোর  মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করছে। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের দিক থেকে আউশ মৌসুমে প্রায় ৬০ শতাংশ, আমনে ৩০ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে ১০০ শতাংশ ব্যবহার করে চাষিরা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ফসল গম; এক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বীজ মানসম্পন্ন। ভুট্টার ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ জমিতে আমদানিকৃত হাইব্রিড ভুট্টা বীজ ব্যবহার করা হয়। পাটের ক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা হয়। আলু বীজের ১৩ শতাংশ মানসম্পন্ন প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করে। সবজি বীজের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ জমিতে চাষিরা হাইব্রিড সবজি বীজ ব্যবহার করে। গবেষণায় দেখা গেছে একই ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র মানসম্পন্ন ভালো বীজ ব্যবহারের ফলে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত  ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। অপরদিকে বীজের মান যদি ভালো না হয় তাহলে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অন্যান্য সবগুলোর  ব্যবহার ও আন্তঃপরিচর্যা করলেও কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে ভবিষৎ এ দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, ভালো বীজের অভাবে কাক্সিক্ষত উৎপাদন বাড়ছে না। বছরের পর বছর ধরে কৃষক ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট ১৩ লাখ টন বিভিন্ন ফসলের বীজের চাহিদা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো বীজ সরবরাহ করলেও বীজের চাহিদার অধিকাংশই প্রথাগত পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীজ  সরবরাহ করছে প্রান্তিক চাষিরা। এসব বীজের মান ঠিক থাকছে না, বিধায়  ফলন কম হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে জাত। অন্যদিকে বাজারে মানসম্পন্ন বীজের চাহিদার এ বিশাল শূন্যতা পূরণে এ সময়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিছু বীজ তারা দেশে উৎপাদন করছে, কিছু বীজ আমদানি করা হচ্ছে। তবে প্রান্তিক চাষিদের বীজই দেশের চাহিদার প্রায় ৩৮ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। যা মোটেও বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন বীজ নয়। ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমাদের কৃষি জমির পরিমাণ প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলাতে হলে ভালো বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার, শস্যবিন্যাস ও ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে ভালো বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া খুবই প্রয়োজন।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী, পাবনা মোবাইল : ০১৬৮৮৬৬৬৭০৮, ইমেইল: kuahamed70@yahoo.com

বিস্তারিত
কৃষিতে প্রোবায়টিক ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহারে সম্ভাবনা

কৃষিতে প্রোবায়টিক ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহারে সম্ভাবনা
ড. মুহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন
ক্টেরিয়া কিংবা জীবাণুর নাম শুনলেই মানুষ আগে ভয় পেতো। এখন আর ভয় নয়, বন্ধু হিসেবে উপকারী ব্যাক্টেরিয়াকে গ্রহণ করা যাবে। ব্যাক্টেরিয়ার সাথে প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে বেশি মিল, যা শতকরা ৩৭ ভাগ, যেখানে বানরের সাথে মাত্র ৬ ভাগ। এই মিলের সাদৃশ্যকে কেন্দ্র করে উপকারী ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই গবেষণার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আবার এই মিলের সাদৃশ্যকে বিবেচনায় এনে প্রকৃতি হতে উপকারী ব্যাক্টেরিয়া সংগ্রহ করাও সম্ভব। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য দামী এন্টিবায়োটিক দ্রব্যগুলো যেমন এজিথ্রোমাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, ভেলেডিমাইসিন, রাইফাম্পাসিন, কানামাইসিন ব্যাক্টেরিয়া হতেই উৎপাদিত, যা জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার হচ্ছে। যত্রতত্র নিয়মবহির্ভূত রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহারের জন্য জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা বহু গবেষণায় উঠে এসেছে। আবার উন্নত দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে রাসায়নিক ব্যবহারকে কমিয়ে এনে ব্যাক্টেরিয়াল ফরমুলেশান জৈব পণ্য ব্যবহার হচ্ছে। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের কৃষিতে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে ব্যাক্টেরিয়ার উৎপাদিত ফরমুলেশান পণ্য ব্যবহার  হতে পারে দৃষ্টান্ত।
কৃষিতে উপকারী বেসিলাস এর ব্যবহার কৃষি বন্ধব যা একটি ভালো উদ্যোগ। উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশে ক্ষুদ্র আকারে গবেষণাগারে শুরু হয়েছে। মূলত ব্যাক্টেরিয়াগুলো শক্তিশালি পেপ্টাইডোগ্লাইকোন এর মাধ্যমে প্রতিকূল অবস্থায় গাছকে খাদ্যরস গ্রহণে সহয়তা করে বিভিন্ন হরমোন প্রবৃত্ত করে শক্তিশালি করে এবং ক্ষতিকর জীবাণুর এন্টাগনাস্টিক হিসেবে কাজ করে যার ফলে জীবাণুরা অবস্থান করতে পারে না। ফলে গাছ আর রোগাক্রান্ত হয় না। বেসিলাস নামক ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহার এবং প্রয়োগ একটি নতুন বিষয় যার উপর ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম এর হাটহাজারীস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ২০১৫ সাল হতে অনেকটা পথ এগিয়েছে। বর্তমানে গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার উপর জোর দেয়া হচ্ছে। দেশব্যাপী এই প্রযুক্তি কৃষকের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছে।  উপকারী ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করে বেগুনের ঢলে পড়া রোগ ইতোমধ্যেই দমন করা সম্ভব হয়েছে যা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া হতে জানা যায় ।
প্রোবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়ার গুরুত্ব
জীবিত অণুজীব পোষকের (প্রাণী/ উদ্ভিদ/ অন্য জীব) দেহে ও পরিবেশে উপস্থিত থেকে পোষককে ক্ষতিকর রোগ জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয় ও পোষকের দৈহিক বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে সেসব উপকারী অণুজীবকেই প্রোবায়োটিক বলা হয়। সহজ কথায় প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারী/বন্ধু অণুজীব ব্যাক্টেরিয়া যাদের উপস্থিতিতে ক্ষতিকর অণুজীব দমন করা যায়। ফলে চাষযোগ্য ফসলকে বিভিন্ন রোগব্যাধি হতে বাঁচিয়ে এবং পরিবেশবান্ধব চাষ ব্যবস্থাপনার আওতায় ফসলের সার্বিক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়। আজকাল বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী এমনকি মানুষকেও নির্ধারিত প্রোবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে তাদের পেটের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য। এতে করে পেটের ভেতরের ক্ষতিকর অণুজীবের সংখ্যা কমে যায়, উপকারী অণুজীবের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ক্ষতিকর অণুজীবের ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে যাওয়ায় সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। আমাদের দেশে উদ্ভিদের জন্য বেসিলাস প্রোবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়ার প্রয়োগ সবে মাত্র শুরু হয়েছে যার ফলে গাছে বা ফসলে ক্ষতিকর জীবাণুর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এই জন্য প্রোবায়োটিক বেসিলাস কৃষির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মরণব্যধী রাসায়নিক বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে উক্ত উপকারী বেসিলাস ব্যাক্টেরিয়া এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য জীব-বালাইনাশক হিসেবে ব্যবহার করা আজ সময়ের দাবি। দেশে বড় আকারে বায়োসেন্টার করে এ ধরনের কাজকে অগ্রাধিকার দেবার জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। তবেই উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের কৃষিতে প্রোবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহার  হতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে এখনও কোন বড় আকারের বায়োফারমেনটার বিশিষ্ট বায়োসেন্টার গড়ে ওঠেনি। ফলে উন্নত দেশের মতো বেসিলাস, মাইকোরাইজা, ট্রাইকোডার্মার কোন ফরমুলেশান পণ্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ল্যাবরেটরি নির্ভর স্বল্প আকারে গবেষণাভিত্তিক উপকারী জীবাণুর কালচার, ফরমোলেশানের কাজ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের বালাইনাশক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘বালাইনাশক অধ্যাদেশ-১৯৭১’, বালাইনাশক রুলস ১৯৮৫, বালাইনাশক সংশোধনী অধ্যাদেশ, ২০০৭, সংশোধনী আইন ২০০৯, বালাইনাশক আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হলেও বিধিমালায় স্থানীয় পর্যায়ে বালাইনাশক উৎপাদন (ফর্মুলেশন) শিল্পসহায়ক কোনো নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত নেই। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বালাইনাশকের নিরাপদ ব্যবহার অপরিহার্য। দেশের বালাইনাশক কোম্পানিগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত অতি উচ্চমাত্রা (শ্রেণি-১এ), উচ্চমাত্রা (শ্রেণি-১বি) ও মাঝারি মাত্রার (শ্রেণি-২) বিষক্রিয়ার শ্রেণিভুক্ত বালাইনাশক আমদানি করে থাকে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বালাইনাশক ব্যবহারে মাটি, পানি, বাতাস ও ফসলে বিষক্রিয়ার অবশিষ্টাংশ থাকার সুযোগ থাকে। অন্যদিকে জৈব বালাইনাশক কিংবা অপেক্ষাকৃত অধিক নিরাপদ শ্রেণি-৩ ভুক্ত বালাইনাশকের স্থানীয় উৎপাদনে সরকারি নীতিগত সহযোগিতা অপরিহার্য। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এই খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতে হবে।
 
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। মোবাইল : ০১৮৭৩৪৮৮৭৩৩, ই-মেইল :thronybari@gmil.com

 

বিস্তারিত
অর্থকরী ফসল তুলার শস্যবিন্যাস

অর্থকরী ফসল তুলার শস্যবিন্যাস
অসীম চন্দ্র শিকদার
ফসল হলো পাট। বর্তমানে হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে আর হাইব্রিড জাতের তুলা আগাম চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই তুলার পরে আর একটি লাভজনক ফসল চাষ করতে হলে আগাম জাতের তুলা চাষ করা প্রয়োজন। তবে সব জমিতে পাট চাষ করা যায় না। তাই অঞ্চলভেদে তুলার পর পাট ছাড়াও গ্রীষ্মকালিন মুগ, গ্রীষ্মকালিন তিল, নাবী জাতের গম, আলু, ভুট্টা প্রভৃতি রবি ফসল চাষ করা যায়। তাই তুলা ফসলের সাথে শস্যবিন্যাসে তুলা ফসলকে মূল ফসল ধরে নি¤েœ তিনটি লাভজনক ফসল নিয়ে আলোচনা করা হলো।                      
তুলা-পাট শস্যবিন্যাস : জৈব সার যুক্ত দো-আঁশ বেলে দো-আঁশ মাটিতে তুলা যেমন ভালো হয় তেমনি পাটও ভালো হয়। এছাড়া উভয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা বজায় থাকে। তাই তুলা ফসলের পর পাট চাষ একটি লাভজনক শস্যবিন্যাস। তুলা চাষের পর পাট চাষ করতে হলে আগাম জাতে তুলা যেমন সিবি-১৪, সিবি-১৫,এম-১ আর হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-২ ইত্যাদি জাতের তুলা চাষ করা যেতে পারে। আর তুলা বপন করতে হবে মৌসুমের শুরুর দিকে অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের অর্ধেকের মধ্যে (জুলাই মাসে) করতে পারলে ভালো হয়। এতে পাট বপনের পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে।                                                                  
পাটের অনেক ধরনের জাত আমাদের দেশে চাষ করা হয়ে থাকে। তবে বিজেআরআই-এর দেশী পাট-৫, দেশী পাট-৬, দেশী পাট-৭ এবং বিনা দেশী পাট-২ তুলা ফসলের শস্যবিন্যাসের জন্য উপযুক্ত (এ গুলোকে তোষা পাট বা মিঠা পাটও বলা হয়ে থাকে)। কারণ এ জাতের পাটে সময় লাগে ৯৫ থেকে ১১৫ দিন। এ জাতের পাটের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৩ টন (৮২.৫মন) অর্থাৎ বিঘাপ্রতি গড় ফলন ১১ মনের মত। আর এ জাতের পাট আষাঢ়ের মধ্যেই কাঁটা সম্ভব হয়। ফলে তুলা চাষের পর্যাপ্ত সময় থাকে। চাষিপর্র্যায়ে এ পাটের প্রতি ৪০ কেজির মূল্য বর্তমানে ৩২০০ টাকা থেকে ৩৬০০ টাকার মতো। অর্থাৎ একজন তুলা চাষি তুলার পর পাট চাষ করে বিঘা প্রতি ৩৫,২০০.০০ টাকা থেকে ৩৯৬০০ টাকার মতো পেতে পারেন। ফলে তার বাৎসরিক আয় হবে উন্নত জাতের তুলা ফসলসহ ৭৮,২০০ টাকা থেকে ৯৩,৬০০ টাকা এবং হাইব্রিড জাতের তুলা ফসলসহ ৮৯২০০ টাকা থেকে ১,১১,৬০০ টাকা পর্যন্ত। পাট চাষের সময় হলো ফাল্গুনের শেষ থেকে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ তুলা ফসল উঠানোর পরই পাট চাষ করা যায়। তুলা ফসল উঠার পরই যদি জমিতে রসের অভাব থাকে তবে হালকা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে। কেন না চৈত্র মাসের মধ্যে পাট বপন না করলে ফসল উঠতে বিলম্ব হবে এবং সময় মতো তুলা চাষের বিঘœ সৃষ্টি হবে।                                                 
তুলা-মুগ শস্যবিন্যাস : শ্রাবণ মাসের মধ্যে তুলা বপন করে তুলা উঠার পর সহজেই গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষ করা যায়। সিবি-১৪, সিবি-১৫, এম-১ এবং হাইব্রিড রূপালী-১, সৌরভ, ডিএম-২ জাতের তুলা চাষ করে পরবর্তীতে গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষ করা যায়। তবে মুগডালের চাষ করতে হলে তুলা আগাম চাষ করাই ভালো অর্থাৎ শ্রাবণের ১৫ তারিখের মধ্যে। এতে ফাল্গুন মাসে সহজেই গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষ করা যাবে।
গ্রীষ্মকালীন মুগডাল ফাল্গুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বপন করতে হয় (ইংরেজি ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ)। আগাম বীজ বপন করলে আষাঢ়ের অর্থাৎ বর্ষার আগেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। বেলে এবং বেলে দো-আঁশ মাটি মুগ চাষের জন্য উপযুক্ত। বীজের পরিমাণ একরে ১০ থেকে ১২ কেজি। বপনের সময় জমিতে রস না থাকলে হালকা সেচ দিয়ে মাটি উপযুক্ত করে নিলে ভাল হয় এবং সময় মতো বীজ বপন করা যায়।
তুলার সাথে শস্যবিন্যাসের উপযুক্ত জাতগুলো হলো: বারিমুগ-৬, বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৭, বিনামুগ-৮ এবং বিইউ মুগ-৪। গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৮টন বা বিঘাপ্রতি ২৪০ কেজি বা ৪০ কেজি মণে ৬ মণ যার বাজার গড় মূল্য ৪০কেজি মণে ৩৫০০ টাকা ধরে ২১০০০ টাকার মতো। ফলে কৃষকের বার্ষিক আয় হবে বিঘাপ্রতি উন্নত জাতের তুলার ফসলসহ ৬৪,২০০ টাকা থেকে ৭৫,০০০ টাকা এবং হাইব্রিড জাতের তুলার ফসলসহ ৭৫,০০০ টাকা থেকে ৯৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।
ডালজাতীয় ফসলে ইউরিয়া সার প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন হয় না। এরা বায়ুমন্ডল থেকে শিকড়ের সাহায্যে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করতে পারে। আর তুলাচাষের পর মুগডাল চাষ করলে রাসায়নিক সার তেমন ব্যবহারও করতে হয় না। এ-ছাড়া ডাল জাতীয় ফসল চাষ করলে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়।                                                                                                                           
তুলা-তিল শস্যবিন্যাস ঃ তুলা চাষের পরে গ্রীষ্মকালীন তিল চাষ কৃষকদের নিকট আর একটি লাভজনক ফসল। এছাড়া উভয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা বজায় থাকে। শ্রাবণ মাসের মধ্যে তুলা বপন করে তুলা উঠার পর সহজেই গ্রীষ্মকালীন তিল চাষ করা যায়। সিবি-১৪, সিবি-১৫, এম-১ এবং হাইব্রিড রূপালী-১, সৌরভ, ডিএম-২ জাতের তুলা ফাল্গুন মাসের মধ্যেই উঠে যায়। ফলে ফাল্গুন মাসেই তিল বপন করা যায় এবং আষাঢ়ের অর্থাৎ বর্ষার আগেই কাটা যায়।
তুলা চাষের পর বারি তিল-৩, বারি তিল-৪, বিনা তিল-৪ খুবই উপযোগী জাত। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে তিল বপন করা উত্তম। মাটিতে রসের অভাব হলে হালকা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে নিয়ে সময় মতো তিল চাষ করতে হবে। বিঘাপ্রতি ১ থেকে ১.১৫০ কেজি বীজের দরকার হয়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১২০০ কেজি থেকে ১৫০০ কেজি বা বিঘাপ্রতি ১৬০ থেকে ২০০ কেজি বা ফলন ৪ থেকে ৫ মন (৪০কেজি মনে)। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি ৪০ কেজি ৩২০০ টাকা থেকে ৩৬০০ টাকা ধরে ১২,৮০০ টাকা থেকে ১৮,০০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে কৃষকের বার্ষিক আয় হবে বিঘাপ্রতি উন্নত জাতের তুলা ফসলসহ ৫৬,০০০ টাকা থেকে ৭২,০০০ টাকা এবং হাইব্রিড জাতের তুলা ফসলসহ ৬৪,০০০ টাকা থেকে ৯০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
আষাঢ় মসের মধ্যে ফসল উঠে যাবে। তখন তুলা বপনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।
ফসলের শস্য বিন্যাস নির্ভর করে চাষিদের ইচ্ছার উপর আর উপযুক্ত জমি এবং অঞ্চলভিত্তিক প্রচলিত ফসলের উপর। বর্তমানে তুলা ফসলের জনপ্রিয় শস্যবিন্যাস হলো: তুলা-পাট, তুলা-গ্রীষ্মকালীন মুগ এবং তুলা-গ্রীষ্মকালীন তিল চাষ। আবার কিছু কিছু ফসল তুলা ফসলের সাথে রিলে চাষ করা যেতে পারে। যেমন গম, ভুট্টা ইত্যাদি। তবে কৃষকদের তুলা ফসলের উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে; কেননা, তুলা বর্তমানে যথেষ্ট লাভজনক ফসল। এক বিঘা জমিতে উন্নজাতের বীজতুলা ১২ থেকে ১৫ মণ উৎপাদিত হয় যার বর্তমান বাজারমূল্য ৪৩,২০০.০০ টাকা থেকে ৫৪,০০০.০০ টাকা এবং হাইব্রিড জাতের বীজতুলা ১৫ থেকে ২০ মন পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫৪,০০০.০০ টাকা থেকে ৭২,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি মণ (৪০ কেজি) ৩৬০০০ টাকা ধরে ; যা প্রচলিত যে কোন মাঠ ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। তাই কৃষক ভাইদের প্রতি পরামর্শ, শস্যবিন্যাসে তুলা ফসলের পর কোন ফসল চাষ করবেন তা সঠিকভাবে নির্বাচন করুন এবং বেশি লাভবান হোন।                                                            

লেখক : কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, মোবাইল : ০১৫৫২-৩৬২৯০১

বিস্তারিত
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পানিকচু

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার
পানিকচু

মোঃ আবদুর রহমান
কচু, আমাদের দেশে অপ্রচলিত সবজিগুলোর একটি। সবজি হিসেবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কচুর ব্যবহার বেশ পুরানো।  একসময় এ সবজিটি বসতবাড়ির অনাবাদি পতিত জমিতে অযতেœ অবহেলায় চাষ হতো। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিবেচনায় বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ফসলটি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ফসলটি এখন অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। আগাগোড়া খাওয়া যায় এ সবজির পুষ্টিগুণ অবাক করার মতো। বর্ষার শেষে বাজারে যখন সবজির ঘাটতি দেখা দেয় তখন পানিকচুর লতি ও কা- বেশি বিক্রি হতে দেখা যায়। কচুর মূল উপাদান হলো আয়রন (ঋব), যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে। প্রতি ১০০ গ্রাম কচুশাকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৮ গ্রাম শর্করা, ১৫ গ্রাম চর্বি, ২২৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম আয়রন ও  ৫৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি থাকে।
কচুর শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ,বি,সি, ক্যালসিয়াম ও লৌহ। ভিটামিন এ জাতীয় খাদ্য রাতকানা প্রতিরোধ করে আর ভিটামিন সি শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। কচুতে আছে আয়রন, যা রক্ত শূন্যতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যাদের রক্ত শূন্যতা আছে তারা নিয়মিত কচু খেলে উপকার পাবেন। কচুতে আছে নানা রকমের ভিটামিন যা গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য দারুণ উপকারী। কচুর ডাঁটায় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, তাই গরমের সময় কচুর ডাঁটা রান্না করে খেলে শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ হয়। কচুর শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ থাকে যা হজমে সহায়তা করে। কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা মানব শরীরের জন্য অনেক দরকারী উপাদান। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। কচুতে আছে অক্সলেট নামক উপাদান। তাই কচুশাক বা কচু খেলে অনেক সময় গলা চুলকায়। তাই কচু রান্না করার সময় লেবুর রস বা সিরকা ব্যবহার করা উচিত। কচুরমুখি অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মূল্যবান খনিজ উপাদান রয়েছে। এসব উপাদান ভালো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা মানবদেহে রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় এবং বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর করে। তবে যাদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো।
উপযুক্ত জমি ও মাটি : পলি দোআঁশ ও এটেল মাটি পানি কচু চাষের জন্য উপযুক্ত। বন্যার ক্ষতি এড়াতে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে পানিকচুর চাষ করা যায়। তবে জমিতে সবসময় পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিকচুর জমিতে ৮ থেকে ১০ সেমি. পানি রাখতে হবে, এর বেশি হলে ফলনের উপর প্রভাব পড়ে সেইসাথে দাঁড়ানো পানি মাঝেমধ্যে নাড়িয়ে দিতে হবে। বর্ষায় অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
জাত পরিচিতি : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) পানিকচুর বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলি হলো-
বারি পানিকচু-১ (লতিরাজ) : লতি লম্বায় ৯০-১০০ সেমি. সামান্য চেপ্টা , সবুজ। লতি সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ এবং গলা  চুলকানি মুক্ত হয়। বোঁটা ও সংযোগস্থলের উপরিভাগের রং বেগুনি। জীবনকাল ১৮০-২৭০ দিন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষাবাদ করা যায়।
বারি পানিকচু-২ : লতি লম্বায় প্রায় ১ মিটার, গোলাকার, অপেক্ষাকৃত মোটা ও গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ২৫-৩০ টন ও ১৮-২২ টন কান্ড পাওয়া যায়। লতি সমানভাবে সিদ্ধ হয় এবং গলা চুলকায় না।
বারি পানিকচু-৩ : প্রধানত কা-ই খাওয়া হয়। হেক্টর প্রতি ফলন কা- ২৫-৩০ টন এবং ১০-১২ টন লতি উৎপন্ন হয়। এটিও গলা চুলকানি মুক্ত।
বারি পানিকচু-৪ : গলা চুলকানি মুক্ত এ জাতের কচুর কা- মোটা ও গোলাপি বর্ণের হয়। রাইজোম গোলাপি বর্ণের ও ফ্লেস হালকা গোলাপি। হেক্টর প্রতি কা- ৩৫-৪৫ টন ও লতি ৫-৮ টন পাওয়া যায়।
বারি পানিকচু-৫ : এ জাতের কচুর রাইজোম হালকা সবুজ বর্ণের ও ফ্লেস হালকা সাদাটে। প্রধানত রাইজোমই খাওয়া হয়। হেক্টর প্রতি কা- ৩৫-৪০ টন ও লতি ৫-৮ টন উৎপন্ন হয়। এটি খেলেও গলা চুলকায় না।
বারি পানিকচু-৬ : এ কচুর রাইজোম ১ মিটার লম্বা ও ৩০-৩৫ সে.মি গোলাকার হয় এবং হালকা সবুজ বর্ণের হয়। এর শাঁস আকর্ষণীয় সাদা। হেক্টর প্রতি কা- ৮০-৯০ টন ও লতি ৬-৭ টন উৎপন্ন হয়।
চারা রোপণ : আগাম ফসলের জন্য কার্তিক (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর)। নাবী ফসলের জন্য মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে লাগানো যায়। দক্ষিণাঞ্চলে বছরের যে কোন সময় লাগানো যায়। প্রতি শতকে প্রায় ১৫০টি লতা রোপনের জন্য প্রয়োজন। জমি ভালোভাবে তৈরি করে লাইন থেকে লাইন ২ ফুট ( ৬০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছ ১.৫ ফুট (৪৫ সেমি.) রাখতে হবে। 
পানি কচুর চারা রোপণের আগে এর সব পাতা,শিকড় ও কা-ের তলার কিছু অংশ কেটে ফেলতে হবে। এর ফলে চারা দ্রুত মাটিতে লেগে যায়। জমি কাদাময় না হলে রোপণের পরপরই পানি সেচের ব্যবস্থা করা দরকার। দেশের যেসব এলাকায় বন্যার সম্ভাবনা থাকে সেখানে কার্তিক মাসের মধ্যে চারা লাগানো ভালো, এর ফলে বন্যার আগেই ফসল তোলা সম্ভব হয়।
সার ব্যবস্থাপনা
ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম; এমওপি ৭৫০ গ্রাম; গোবর ৫০ কেজি; (প্রতি শতকে)।            
গোবর, টিএসপি এবং এমওপি সার জমি তৈরির শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। তবে প্রথম কিস্তি রোপণের ২০-২৫ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা
পানি কচুর গোড়ায় দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে এবং দাঁড়ানো পানি মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দিতে হবে।
লাতিরাজ জাতের জন্য দাঁড়ানো পানির গভীরতা ৮-১০ সেমি. হওয়া দরকার।
পানিকচুর রোগ ব্যবস্থাপনা : কচু পাতা ঝলসানো (মড়ক) রোগের আক্রমণে পাতা পচে যায়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা প্রথমে ছোট ছোট কালো দাগ দেখা যায়, যা পরে বেগুনি থেকে বাদামী রঙে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এ সমস্ত দাগ আকারে বেড়ে একত্র হয়ে পুরো পাতায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা ঝলসে যায়। পরে তা কচু ও কা-ে বিস্তার লাভ করে ও পচে যায়।
অনুকূল পরিবেশ
উচ্চ তাপমাত্রা, আর্দ্র আবহাওয়া ও পর পর ৩-৪ দিন বৃষ্টি থাকলে এ রোগের মাত্রা খুব বেড়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা : এ রোগটি বীজবাহিত হওয়ায় রোগমুক্ত এলাকা থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। রোগ দেখা মাত্র ডায়থেন এম-৪৫ বা রিডোমিল গোল্ড ২০ গ্রাম, ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩ থেকে ৪  বার স্প্রে করতে হবে। প্রয়োগ করার আগে ট্রিকস মিশিয়ে নিতে হয়।
লিফ স্পট বা পাতায় দাগ পড়া রোগ : এটি ছত্রাকজনিত রোগ। এর আক্রমণে কচুপাতায় শুকনো ও মাঝারি আকারের দাগ পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে সম্পূর্ণ গাছই পুড়ে যায় ও উৎপাদনের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
দমন ব্যবস্থা : সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপন ও ফসল আবাদে শস্য পর্যায় অনুসরণ করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গোড়া পচা রোগ : ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগটি হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের সাদা মাইসোলিয়াম দেখা যায়, যা পরবর্তীতে গাছটি সম্পূর্ণভাবে হলুদ হয়ে ঢলে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা : রোগমুক্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ক্ষেতের পানি সরিয়ে অনুমোদিত বালাইনাশক বেভিস্টিন ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বালাইনাশক প্রয়োগের একদিন পর জমিতে আবার পানি দেয়া যাবে।
কচুর পোকা মাকড় :
কচুর লাল মাকড় : কচুর পাতার নীচে লাল রঙের জমাট বাঁধা পোকার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো আসলে মাকড় ,যা খালি চোখে বিছিন্ন আকারে দেখা যায় না। এর পূর্ণবয়স্ক ও নিম্ফ উভয়ই কচুর ক্ষতি করে থাকে।
দমন ব্যবস্থা : কচুর লাল মাকড় দমনের জন্য মাকড়নাশক ভার্টিমেক ১.৮ ইসি, ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জাব পোকা : এ পোকা কচু থেকে রস শোষণ করে এবং ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে ফসলের ক্ষতি করে থাকে।
দমন ব্যবস্থা : এ পোকা দমনের জন্য হলুদ স্টিকার ক্ষেতের মাঝে মাঝে দিলে উপকার পাওয়া যায়। আক্রমণ বেড়ে গেলে এডমায়ার ১০০ এসপি ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করার ব্যবস্থা করতে হবে।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, কচুপাতায় ছত্রাক বা কীটনাশক প্রয়োগের সময় ডিটারজেন্ট বা গুঁড়ো সাবান ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে, নতুবা বালাইনাশক বা কীটনাশক গড়িয়ে পড়ে যাবে।
ফলন( টন/হেক্টর)  লতি : ২৫-৩০; কা- : ১৮-২০
ফসল সংগ্রহ : রোপণের ২ মাস পর থেকে ৭ মাস পর্যন্ত লতি সংগ্রহ করা যায়।
উৎপাদন খরচ ও ঝুঁকি কম, আর লাভ বেশি হওয়ায় কচু চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। রবি মৌসুমে জানুয়ারিতে কচুর কন্দ জমিতে রোপণের পর মে মাসেই তা বাজারজাত করা যায়। পানিকচুর চাষ বৃদ্ধি করা হলে প্রতি ইঞ্চি জমি সর্বোত্তম ব্যবহার হবে। নিচু প্রকৃতির জমি আবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি জৈব কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।

লেখক : এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। মোবাইল : ০১৯৪৩-৫১৭৫০৬। ই-মেইল : rahmankhulna00@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষিতে নারী উদ্যোক্তা

কৃষিতে নারী উদ্যোক্তা
ফারজানা হক দীপু
বাংলাদেশর অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক অর্থনেতিক উন্নয়নে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রয়েছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক।
দেশে মোট শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নারী। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের বেশির ভাগ কৃষিকাজে নিয়োজিত। ফসলের প্রাক বপন থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি এবং বাড়ির বাইরে ফসল ও সবজি চাষ, মসলা উৎপাদন, শুঁটকি ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরি ও মেরামত, পোনা উৎপাদন, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালনের কাজে নারীরা আজ প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সামাজিক বনায়নের কাজও নারীর হাত দিয়ে হয়।
গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনেতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে কয়েক কোটি শ্রমশক্তি নতুন সংযোজিত হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশিই নারী এবং এর বেশির ভাগই কৃষি খাতের নারী শ্রমিক এবং উদ্যোক্তা। নতুন এ সকল নারী উদ্যোক্তা মূলত গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদনসহ ধান, পাট ও গম চাষাবাদে নিয়োজিত রয়েছে। মূলত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিকে গতিশীল করতে নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই মুখ্য।
একজন নারী উদ্যোক্তা যখন নিজের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে কোন চাকরি বা কারো অধীনস্থ না থেকে নিজে থেকেই কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার চেষ্টা করেন বা পরিকল্পনা শুরু করেন তখন তাকে উদ্যোক্তা বলা হয়। কৃষিতে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যতা বেড়েছে। নারীরা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি উচ্চফলনশীল শাকসবজি ও ফলমূলসহ নানা জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে।
বর্তমানে দেশে লক্ষাধিক নারী কৃষি উদ্যোক্ত রয়েছে। তন্মধ্যে ময়মনসিংহের সাহিদা খানম অন্যতম। তিনি নিজ বাসার ছাদে মাত্র ৪৪০ বর্গফুট জায়গায় অভিনব কায়দায় লাগিয়েছেন এক হাজারের বেশি ড্রাগন গাছ এবং চলতি মৌসুম এ প্রায় ২৮০ কেজি ড্রাগন ফল উত্তোলন করে বাজারজাত করেছেন।
সাহিদা খানমের ছাদ বাগানে শুধু ড্রাগন ফল গাছই নয় সঙ্গে রয়েছে কাঠবাদাম, ৩০ রকমের বিভিন্ন পাতা বাহার, ২০ রকমের ফুল গাছ, অ্যাভোকাডো, খেজুর, লিচু, বিভিন্ন আম, মালবেরী, তীন ফল, করমচা, কমলা, মাল্টা, লেবু, কাশ্মিরি কুল, জামরুল, চেরী, বারমাসি সজনে, বারমাসি আমড়া, বারমাসি সিম, বিভিন্ন মৌসুমি সবজি ও এলোভেরাসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ। আর এসব গাছ নিজেই পরিচর্যা করেন সাহিদা খানম। তিনি অর্গানিকভাবে জৈব সার ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন। নারী উদ্যোক্তা সাহিদার কাছ থেকে ড্রাগন ফলের চারা নিয়ে বাগান করেছেন অনেকেই। ময়মনসিংহ জেলা কৃষি অফিসার, বিভিন্ন উপজেলা কৃষি অফিসারসহ অনেকেই সাহিদা খানমের ড্রাগন ছাদ বাগান পরিদর্শন করে অনেক প্রশংসা করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ ছোট বড় শখের বাগানিকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ড্রাগন ফলের চারা সরবরাহ করেছেন এবং কমপক্ষে ৫০০ পিস চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। তারা সবাই বাড়ির ছাদে, মাঠে ও বাড়ির আঙ্গিনায় ড্রাগন বাগান করেছেন।
ঈশ^রদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম বিশ^াসের স্ত্রী গ্রাম্যবধূ নুরুন্নাহার একজন সফল উদ্যোক্তা। চার দেয়ালের গ-ির মধ্যে যার নিরিবিলি জীবনযাপন করার কথা তিনি আজ রীতিমতো একজন সমাজ উন্নয়ন কর্মী ও নারী উদ্যোক্তার দায়িত্ব পালন করছেন। নিবিড় সবজি, ফলমূল, পোল্ট্রি ও গাভীর খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নুরুন্নাহারের অর্জন দেশের গ্রামীণ নারীদের জন্য অনুসরণীয়।
উদ্যোক্তা হওয়ার পর নুরুন্নাহারের ঝুলিতে আসে অসংখ্য সম্মাননা। ২০১১ সালে দেশের সেরা নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জপদক, ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক ও ২০১৭ সালে নারী উদ্যেক্তা হিসেবে নগদ ১ লাখ টাকাসহ মাছরাঙ্গা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে তিনি দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন। জয়বাংলা নারী উন্নয়ন মহিলা সমবায় সমিতি ও এনসিডিপি গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভানেত্রী নারী উদ্যোক্তা নুরুন্নাহার ১ হাজারের বেশি নারীদের সংগঠিত করে তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
এছাড়াও রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে মাত্র ৪০০ হাঁস দিয়ে খামার করেছিলেন রাজিয়া সুলতানা। প্রতিদিন হাঁসের ডিম বিক্রি করে দুই তিন হাজার টাকা লাভ হচ্ছিল। তা থেকে উৎসাহী হয়ে সবজি চাষ, ছাগল পালনসহ নানামুখী কর্মকা- শুরু করেন তিনি। শহুরে ও শিক্ষিত নারী চাষাবাদে নেমেছেন তাই উপহাস করেছিল অনেকে। অথচ ৫ বছরে তার চাষাবাদের ব্যাপ্তি ঘটেছে ১৮ বিঘা জমিতে, শুধু সবজি বিক্রি করেই এক মৌসুমে তার আয় হচ্ছে ৭-৮ লাখ টাকা। এভাবেই গুটিগুটি পায়ে দেশের নারী উদ্যোক্তাগণ এগিয়ে যাচ্ছেন আপন শক্তিতে।
যদিও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দেশে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষি উদ্যোক্তাদের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদেরকে। উদ্যোক্তা হিসেবে আর্থিক সংকট, ঋণ না পাওয়া, ভূমির মালিকানায় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব এবং গ্রামীণ হাটবাজারে প্রবেশেসহ যোগাযোগ অবকাঠমো ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে নারীরা কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত হয় না। বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান (এনজিও) থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের কারণে তাদের নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকে আরো সহজীকরণ করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণনের লক্ষ্যে নারীদের জন্য বিশেষ বাজার স্থাপনসহ অনলাইনে বাজার বিপণন ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারাও যাতে অনলাইন বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের তৈরিকৃত পণ্য বাজারজাত করতে পারেন এজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে।
যেকোনো দেশের নারীদের বাদ দিয়ে বা অবহেলা করে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনোই সফল হবে না। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। সেই বিবেচনায় এ দেশের জন্য উন্নয়ন কার্মকা- তথা কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ আরো বেশি জরুরি। আগের তুলনায় দেশে নারী-পুরুষের মধ্যকার ব্যবধান বা জেন্ডার গ্যাপ কমে আসছে। আয় উপার্জনক্ষম কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ায় নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য কমে আসছে। তাই বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রায় এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১ ও ভিশন ২১০০ অর্জনেও কৃষিতে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশক।

লেখক : সিনিয়র সহকারী পরিচালক, জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমী (নাটা), গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭৭১৩৭১৩৬৪
ইমেইল:farzana.dae@gmail.com

বিস্তারিত
মাঘ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা

মাঘ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
বোরো ধান
    ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন।
    বোরো ধানে অল্টারনেট ওয়েটিং ও ড্রায়িং (অডউ) পদ্ধতিতে সেচ দিন।
    রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করুন।
    ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করুন।
    আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করুন।
    রোগ ও পোকা দমনে অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করুন।
গম
    গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে তা পাতলা করে দিন।
    গম গাছ থেকে যদি শিষ বেড় হলে বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হলে জরুরিভাবে গমক্ষেতে সেচ দিন।
    ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দিন।
    গমক্ষেতে ইঁদুর দমনের কাজটি সকলে মিলে একসাথে করুন।
ভুট্টা
    ভুট্টাক্ষেতে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিন।
    গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে জমিতে একটি সেচ দিন।
    গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙ্গে দিন।
আলু
    আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে ¯েপ্রয়িং শিডিউল মেনে চলুন।
    মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (২ গ্রাম এক্সট্রামিল অথবা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা মেলুডি ডুও প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে) নিয়মিত ¯েপ্র করুন।
    মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ রাখুন।
    আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিন এবং ১০ দিন পর পটেটো ডিগার দিয়ে আলু তুলে ফেলুন।
    আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করুন এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।
তুলা
    তুলা সংগ্রহের কাজ এ মাস থেকেই শুরু করতে হবে।
    শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করুন।
    রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা সংগ্রহ করুন।
    ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন।
শাকসবজি
    সমন্বিত বালাই দমন পদ্ধতিতে শাকসবজির রোগ ও পোকা দমন করুন।
    শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিন।
ডাল ও তেল ফসল
    সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন।
    ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করুন। এতে জমির উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।
গাছপালা
    শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিন।
    গোড়ার মাটি আলগা করে দিন এবং আগাছামুক্ত রাখুন।
    আম গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ১ মিলি কন্জা প্লাস অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) ¯েপ্র করুন। আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার ¯েপ্র করুন।
    আম গাছের হপার পোকা দমনের জন্য মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই অনুমোদিত কীটনাশক (প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে) গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করুন।
    ফলগাছে স্প্রে করার জন্য ফুটপাম্প ব্যবহার করুন।
বিবিধ
    অধিক লাভবান হতে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন ।
    স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
    শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি (১৪ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)

ফাল্গুন মাসের কৃষি
(১৪ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ফাল্গুন মাস বছরের শেষ ঋতু। শীতের পরে প্রকৃতিতে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, আর অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আগমন ঋতুরাজ বসন্তের। ঋতু পরিবর্তনের সাথে আমাদের কৃষিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। কৃষকরা উদ্যমী হয়ে নতুন চাষাবাদে আগ্রহী হয়। কৃষক ভাইবোনেরা আসুন জেনে নেই ফাল্গুন মাসের কৃষিতে করণীয় যা আছে।
বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে    ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার আগে উইডার দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাইমুক্ত রাখতে হবে। এ সময় ধানক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোন  কৃমিনাশক যেমন-ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা ন্যাটিভো বা ব্যাবিস্টিন ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।
গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার এর মাধ্যমে সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে।  সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাটি বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।  
ভুট্টা (খরিপ)
খরিপ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি ভুট্টার উন্নত জাত।
পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ফাল্গুন মাসে বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাটশাক-১ (বিজেসি-৩৯০), ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২)। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও উত্তম কৃষি চর্চা মেনে শাকসবজি আবাদ করতে হবে।
গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে  প্রোপিকোনাজল অথবা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এ ছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার ¯েপ্র করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আমগাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর এক মাস পর আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। গ্রাফটিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের বাডিং বা চোখ, দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে।   
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসে কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এ ছাড়াও কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।   

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত