Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

মান সম্মত বীজ, আইসোলেশান এবং কৃষক-কৃষিবিদদের ভূমিকা

শিরোনাম দেখে সম্মাণিত পাঠকবৃন্দের মাঝে এ ধারণা সৃষ্টি হবে যে, এখানে লেখক বীজ সম্পর্কিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাচ্ছেন। সত্যি তাই, “বীজ হলো কৃষির প্রাণ”। চিরন্তন শুনে আসছি,‘ সুবীজে সুফসল’, ‘সুবংশে সুসন্তান’। বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য উপকরণ ঠিক রেখে শুধুমাত্র উন্নতমানের ভালো বীজ ব্যবহারে ২০-২৫ % ফলন বৃদ্ধি পায়। তাহলে একটি প্রশ্ন, ভালো বীজই কি মান সম্মত বীজ ? হ্যাঁ, এখানে ভালো বীজকে মান সম্মত বীজ বলা হয়েছে। বীজের উদ্ভিদতাত্ত্বিক ও কৃষিতাত্ত্বিক সংজ্ঞা রয়েছে। কৃষিতাত্ত্বিক দিক হতে উদ্ভিদ বা শস্যের যে কোন অংশ যা তার বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম সেটিকে বলা হয় বীজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঃ আখের কান্ড, পাথরকুচির পাতা, লেবুর কান্ড, মিষ্টি আলুর লতা বা মূল ইত্যাদি। ফসল উৎপাদনের কথা মুখে আনলে যে উপকরণটির একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে-তার নাম হলো বীজ। এজন্য বলা হয়,“বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ”। তাই ভাল ফসল পেতে হলে ভাল বীজ প্রয়োজন। কৃষিজ উৎপাদনে যে কয়টি উপকরণ ব্যবহার হয় তার মধ্যে বীজ ব্যাতিক্রম ধর্মী উপকরণ। সার, কীটনাশক, বালাইনাশক, পাওয়ার টিলার, স্প্রে মেশিন, কমবাইন্ড হারভেস্টারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি কারখানায় প্রস্তুত করা হয় অর্থাৎ এগুলো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট। কিন্তু বীজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট নয়। বীজ কৃষকের দ্বারা মাঠেই উৎপাদন করে নিতে হয়। বিগত এক দশক যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাংলার কৃষক ‘হাইব্রিড’ নামক বীজের জন্য জান পরাণ। চাই সে যে কোন ফসলের বীজ হোক না কেন। কারণ, কৃষকের মনে এ ধারণা বিদ্ধ হয়েছে যে, হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়ে। কৃষকের এই ‘পজিটিভ এ্যাটিচিউড’ কে কাজে লাগিয়ে ফটকা কারবারি, অসাধু বীজ ব্যবসায়ী অনুন্নত বীজকে হাইব্রিড বীজের মোড়কে  ঢুকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ-কোটি টাকা, সর্বশান্ত  হচ্ছে হাইব্রিড প্রেমী হাজার হাজার কৃষক।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে,“বৃহৎ পরিসরে মান সম্মত বীজ উৎপাদনকারি চাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা”। বিভিন্ন বীজের মোট চাহিদার শতকরা মাত্র ৮-১০ ভাগ উন্নতমানের বীজ বিভিন্ন বীজ উৎপাদনকারী বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানী এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি সংস্থা হিসাবে বিএডিসির সক্ষমতা শতকরা ৫-৬ ভাগ থেকে ১০-১২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এটা অনেকটা হতাশার মাঝে আশার আলো। অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের নিজস্ব সনাতনী পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে যার গুনগত মান নিশ্চিত নয়। যেহেতু শতকরা ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের উপর নির্ভরশীল, তাই মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ব্যাপারে কৃষি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরো ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে আইসোলেশান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তা হলে আসা যাক, ‘আইসোলেশান’ সম্পর্কে কিছু জানার।


আইসোলেশান ঃ বীজের জন্য উৎপাদিত ফসলকে একই ফসলের অন্য জাত থেকে ন্যূনতম দূরত্বে ভিন্ন মাঠে/একই মাঠে আবাদ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আইসোলেশান বা পৃথকীকরণ পদ্ধতি। এই আইসোলেশান পদ্ধতি বা দূরত্ব বিভিন্ন ফসলের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।


আইসোলেশানের প্রয়োজনীয়তা ঃ  (১) জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে অনাকাংখিত পরাগরেণুর মাধ্যমে পর-পরাগায়ন এবং মুক্ত পর-পরাগায়ন ফসলের পরাগায়ন প্রক্রিয়াতে বাধা সৃষ্টি করা।(২) স্ব-পরাগায়িত জাতসমূহে পর-পরাগায়ন প্রক্রিয়া সৃষ্টির সুযোগ এবং যান্ত্রিক মিশ্রনকে (গবপযধহরপধষ গরীঃঁৎব) নিয়ন্ত্রণ করা।(৩) পরাগায়ন দূষণ (চড়ষষবহ ঈড়হঃধসরহধঃরড়হ) প্রক্রিয়া বন্ধ করা।  সর্বপরি বলা যায়, আইসোলেশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করা। নি¤েœ বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশান (নোটিঢাইড ফসল) দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
তালিকায় প্রজনন বীজের দূরত্ব উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, প্রজনন বীজ বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় উৎপাদন করা হয়।


বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে নন-নোটিঢাইড ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশান দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
 এখানে উল্লেখ্য যে, আইসোলেশানের ন্যূনতম দূরত্ব ভিত্তি বীজের ক্ষেত্রে প্রত্যায়িত বীজ অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি। আবার স্ব-পরাগায়িত বীজের আইসোলেশান দূরত্ব পর-পরাগায়িত/মুক্ত পর-পরাগায়িত বীজের তুলনায় অতি সামান্য।


আইসোলেশান নিয়ে কৃষক পর্যায়ে বিরাজিত সমস্যা ও করণীয় ঃ
বর্তমানে বিএডিসি, কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর, এনজিও এবং বীজ ব্যবসায়ীদের বহুবিধ বীজ উৎপাদনমূলক কর্মকান্ড দৃশ্যমান। আইসোলেশানের দূরত্ব বজায় রেখে মাঠ পর্যায়ে কৃষক বীজ উৎপাদনের বেলায় জমি ছাড় দিতে রাজী হয় না। আইসোলেশান গ্যাপে কোন বেরিয়ার ফসল উৎপাদনে হয় নিরৎসাহিত। কাজেই আইসোলেশান বিষয়ের উপর কৃষক প্রশিক্ষণে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে ঐ সমপরিমাণ জমির জন্য ভূর্তকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর জনবল বৃদ্ধি করতঃ তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অসাধু বীজ ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতারোধে বীজ আইন ১৯৯৮ ও ২০১৬ কে কার্যকর করতে হবে।

 ড.মুহাম্মদ মহী উদ্দীন চৌধুরী

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী, মোবাইল ঃ ০১৮২৭-৮৬৫৮৬০, ই-মেইল- ঢ়ংড়ড়ভৎফনধৎর@মসধরষ.পড়স

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (বৈশাখ-১৪২৫)

সাদেক হোসেন, গ্রাম : বাগমারা, উপজেলা : হোমনা, জেলা : কুমিল্লা
প্রশ্ন :  কুল গাছের পাতা এক ধরনের পোকা আক্রমণ করেছে। পাতা ছিদ্র করে ফেলছে। এ সমস্যার সমাধান কী?  

উত্তর : আপনার কুলের গাছে কুলের বিছা পোকার আক্রমণ হয়েছে। এ পোকা আক্রমণ করলে এ রকম অবস্থা হয়ে থাকে। এ পোকার আক্রমণ রোধে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি প্রতি ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে কুল গাছে স্প্রে করলে সুফল পাবেন। এছাড়া গাছের ডালপালা পরিষ্কার রাখলে এ পোকার আক্রমণ কম হবে।


তারেক আজিজ, গ্রাম : হরকাডাঙ্গা, উপজেলা : গোমস্তাপুর, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : মুসুর ডালের গাছের বয়স ৪৫ দিন। মাটিতে রসের পরিমাণ ঠিক আছে তবুও মুসুরের গাছের পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যাচ্ছে। প্রতিকার কী  ?
উত্তর : মুসুর গাছের এ সমস্যাটি মুসুরের গোড়া পঁচা রোগের কারণে হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ৭ হতে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে রোগ দমন করা যায়। সবচেয়ে ভালো মুসুর বপনের আগে বীজ শোধন করা। সেজন্য প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দিয়ে ভালোভাবে বীজ শোধন করে নেওয়া। তাহলেই আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।

 

জিয়াউল হক, গ্রাম : গাঁওকুরা, উপজেলা : ইসলামপুর, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : আম পাকলে ভেতরে পোকা দেখা যায়। পোকা ভেতরে আঁকাবাঁকা গর্ত করে ওখানে থাকে, গর্তে ময়লা দেখা যায়। প্রতিরোধ হিসেবে কী করণীয়?

উত্তর : এ সমস্যাটি আমে ভোমরা পোকা আক্রমণ করলে হয়ে থাকে। এ পোকা প্রতিরোধে ফলের মার্বেল অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে গাছের কাণ্ড, ডাল ও পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া মুকুল আসার আগে পৌষ-মাঘ মাসে সম্পূর্ণ বাগান বা প্রতিটি আম গাছের চারদিকে ৪ মিটারের মধ্যে সব আগাছা পরিষ্কার করে ভালোভাবে মাটি কুপিয়ে উল্টে দিলে মাটিতে থাকা ভোমরা পোকাগুলো ধ্বংস হবে।  আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সেটি হলো আম সংগ্রহের পর সব পরগাছা ও পরজীবী উদ্ভিদ ধ্বংস করে ফেলতে হবে। তাহলেই এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

 

আবদুল আহাদ, গ্রাম : খাটুরিয়া, উপজেলা : গোবিন্দগঞ্জ, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন :  বেগুন গাছের ফল ও কা- পচে যাচ্ছে। কী করব?

উত্তর : বেগুন গাছে এ ধরনের সমস্যাটি ফমোপসিস নামক প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এ রোগে বেগুন গাছ আক্রান্ত হলে বেগুন গাছের কা- পচে যায় এবং ফলে কালো ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ফল পচে যায়। এ রোগ প্রতিরোধে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে বেগুন গাছে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া বেগুন ক্ষেত পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন রাখা এবং একই জমিতে প্রতি বছর বেগুন চাষ না করা। এসব বিষয় মেনে চললে আপনি লাভবান হবেন।  

 

ঋদ্ধিনন্দন সানা, গ্রাম : বামনডাঙ্গা, উপজেলা : আশাশুনি, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : পটোল গাছে এক ধরনের পোকা কাণ্ড ও পাতার রস চুষে ক্ষতি করছে। কী করব?

উত্তর : পটোল গাছে মিলিবাগের আক্রমণ হলে এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এতে করে পটোল গাছ নষ্ট হয়ে যায়। পটোল গাছের মিলিবাগ দমনে ইমিডাক্লোরপিড ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই এ পোকা দমন করা সহজ হবে। আপনি আপনার কাক্সিক্ষত ফল পাবেন।

 

মো: হাবিবুর রহমান, গ্রাম : মাঝাডোবা, উপজেলা : দেবীগঞ্জ, জেলা : পঞ্চগড়
 প্রশ্ন : মিষ্টিআলুতে এক ধরনের নীলাভ পোকা আক্রমণ করে পাতা নষ্ট করে ফেলছে। প্রতিকারে কী করণীয়?

উত্তর : মিষ্টিআলুতে মিষ্টি আলুর উইভিল পোকা আক্রমণ করলে এ সমস্যা হয়ে থাকে। এ সমস্যার সমাধানে জমি তৈরির সময় কার্বোফুরান জাতীয় বালাইনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন। আর যদি গুটিকয়েক গাছে এ সমস্যা দেখা দেয় তবে তা উঠিয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা ভালো। এভাবেই এ পোকার প্রতিকার করা সম্ভব।  


মো: তাসনিম, গ্রাম : দৌলতপুর, উপজেলা : নড়াইল সদর, জেলা : নড়াইল
প্রশ্ন : চিংড়ির ফুলকা কালো হয়ে গেছে কী করব?

উত্তর : চিংড়ির ফুলকায় কালো ও পচন দেখা যায়, শ্বাস প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে এবং খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা যায়। এ রোগের কারণ হচ্ছে পুকুরের তলদেশে জৈব পদার্থের পচন বৃদ্ধি পেলে এবং ফুসোরিয়াম ও ম্যাপ্রোলেগনিয়া ছত্রাক এ রোগের কারণ। এ সমস্যার প্রতিকারে হররা টেনে দ্রুত পানি পরিবর্তন করতে হবে। অ্যাসকরবিক এসিড ২০০ মিলি গ্রাম প্রতি কেজি খাদ্যে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যাবে।  


মো: আসাদুজ্জামান, গ্রাম : লাউযুতি, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : পুকুরে মাছ বড় হচ্ছে না কী করব?

উত্তর : বিশ্বস্ত ও নামি হ্যাচারি  বা সরকারি হ্যাচারির সুস্থ ও সবল পোনা সরবরাহ না করলে এ ধরনের সমস্যা হয়। পোনা ছাড়ার আগে পুকুরে চুন ও সার প্রয়োগ করে নিতে হবে। পুকুর প্রস্তুত হওয়ার পর সুস্থ সবল পোনা পুকুরে ছাড়ার পর নিয়মতি সুষম খাবার দিতে হবে মাছের ওজন অনুযায়ী। ১০০ কেজি মাছের জন্য দৈনিক ৫ কেজি করে খাবার দিতে হবে এবং ১৫ দিন পর পর রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানির পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। খাদ্য চাহিদা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এভাবে সবকিছু নিয়মমাফিক করলে পুকুরে মাছ বড় হবে।


মোবারক হোসেন, গ্রাম : বামইন, উপজেলা : নিয়ামতপুর, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : আমার টার্কি মুরগির চোখের ওপরে গুটি উঠে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মাথায়ও গুটি উঠেছে। এ অবস্থায় আমি কী করব? পরামর্শ চাই।

উত্তর : আপনার টার্কির বসন্ত রোগ হয়েছে। এটি ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য ফাউল পক্সের ভ্যাকসিন দিতে হয়। আর রোগ হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মক্সাসিল ভেট পাউডার অথবা এনফ্লক্স ভেট সলিউশন দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।


হুমায়ুন কবির, গ্রাম : সনগাঁও, উপজেলা : বালিয়াডাঙ্গি, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : আমার গরুর শরীরের তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি। বাদামি রঙের মতো প্রশ্বাব হচ্ছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?

উত্তর : গরুর এ সমস্যা প্রতিকারে ব্যবকপ অথবা বেব কিওর ইনজেকশন মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট ওষুধ না পেলে ৮-১৬ গ্রাম ফিটকারি এবং ৮-১৬ গ্রাম বোরিক এসিড ২৫০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে দিনে ৩ বার খাওয়াতে হবে। তবেই গরুর উল্লিখিত সমস্যাটির সমাধান হবে।


কৃষির যে কোন প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে  কোন জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানিঅর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

 

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*

*উপ-প্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫; taufiquedae25@gmail.com

 

 

 

বিস্তারিত
আলুর তৈরি রকমারি খাবার

একই পণ্য থেকে ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধ পেতে কার না ভালো লাগে! আগেকার দিনে পণ্যের বহু ব্যবহারের কৌশল জানা ছিল না। পুষ্টি এবং মুখরোচক খাবারের কথা ভেবে আজকাল বিলাসী গৃহিণীদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। এর পেছনে মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। এখন শহরের পাশাপাশি গ্রামেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যে পণ্যগুলোর নাম উচ্চারিত হয়; এর মধ্যে আলু শীর্ষস্থানে। কেউ কেউ মনে করেন, আলুর পুষ্টিমান কম। আসলে এ ধারণা ভুল। কারণ পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, আলুতে ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি রয়েছে। অথচ চালে মোটেও নেই। এছাড়া ভিটামিন বি, শর্করা, আমিষ, জিংক, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং আয়রন তো আছেই। সে সাথে আছে মূল্যবান উপাদান ওমেগা-৩ এবং অ্যামিনো এসিড। অপরদিকে চর্বির পরিমাণ চালের তুলনায় অনেক কম এবং গমের পাঁচ ভাগে এক ভাগ। কিডনি রোগীর জন্য এর প্রোটিন বেশ উপকারী। আলু স্কার্ভি ও রিউমেটিক প্রতিরোধী। ডায়রিয়ার ক্ষয় পূরণে কাজ করে। পাশাপাশি শরীরের ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক চাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। আলু একমাত্র সবজি, যা সব ধরনের মাছ ও মাংস রান্নার সাথে তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই হাতে কাছে পাওয়া এ সবজির তৈরি খাবারগুলোর পরিচয় জেনে নেয়া দরকার।  


আলুর পাকোরা উপকরণ : আলু ১টি,  চালের গুঁড়া ২ টেবিল চামচ,  বেসন ১ কাপ,  তেল  ৪ টেবিল চামচ, জিরা গুঁড়া ১ চা চামচ,  ধনেপাতার কুচি ২ চা চামচ, পানি আড়াই কাপ আর লবঙ্গ ও লবণ পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমেই খোসা ছাড়িয়ে আলু ছোট ফালি করে কেটে নিতে হয়। এরপর একটি পাত্রে চালের গুঁড়া এবং বেসন রেখে এর সাথে জিরা গুঁড়া ধনেপাতার কুচি, লবঙ্গ ও লবণ ভালোভাবে মিশাতে হবে। এবার ফ্রাইপ্যানে তেল দিয়ে চুলায় গরম করে তা মিশ্রিত উপকরণগুলোর সাথে মিশিয়ে অল্প পানি দিয়ে ঘনমিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর কেটে রাখা আলুর একটি ফালি মিশ্রণে ডুবিয়ে ডুবোতেলে উল্টেপাল্টে ভাজতে হয়। ভাজার কাজ ততোক্ষণ পর্যন্ত করতে হবে যখন বাদামি রঙ ধারণ হবে। এভাবেই হয়ে যাবে আলু পাকোরা।


আলুর চিপস উপকরণ : আলু ৩০০ গ্রাম এবং তেল  ৩০০ মিলিলিটার।


প্রস্তুত প্রণালি : আলু পরিষ্কার করে ধুয়ে পাতলা করে কেটে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে চালুনিতে রেখে পানি ঝরিয়ে ডুবোতেলে বাদামি রঙ করে ভাজতে হবে। ভাজা শেষ হলে একটি পাত্রে রেখে পরিমাণমতো লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করা যাবে।


আলুর কাটলেট উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, ডিম ১টি, পাউরুটির স্লাইস ১টি, পাউরুটির গুঁড়া ১ কাপ, পেঁয়াজ বাটা ১ কাপ, ময়দা ১ টেবিল চামচ,  কাঁচামরিচ ১টি এবং ধনেপাতা, তেল ও লবণ পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি :  আলুগুলো সিদ্ধ করার পর খোসা ছাড়িয়ে  ভালোভাবে পিষে নিতে হয়। এবার একটি পাত্রে  ময়দা,  পেঁয়াজ, মরিচ কুচি, ধনেপাতা কুচি এবং লবণ দিয়ে আলু মাখিয়ে নিতে হবে। এরপর কাটলেটের পিস তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ডিম বিট করে নিতে হবে। কাটলেটের পিস ডিমে ডুবিয়ে এবং পাউরুটির গুঁড়ায় মেখে ফ্রাইপ্যানে গরম তেলে ভাজতে হবে। এরপর পরিবেশন।


আলুর লুচি উপকরণ : আলু ৬ টি, গমের আটা ২ কাপ, গরম মশলা ২ চা চামচ, এবং লবঙ্গ গুঁড়া, তেল ও লবণ পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি :  আলু সিদ্ধ করে আটার সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হয়। এরপর লুচির মতো তৈরি করে সুজির মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে ডুবোতেলে ভাজতে হয়। এভাবেই হয়ে যাবে আলুর লুচি।
 

আলুর সিঙ্গাড়া উপকরণ : আলু ২৫০ গ্রাম, মাংসের কিমা ১৫০ গ্রাম, আদা ২টি (ছোট টুকরো), পাঁচফোড়ন ১ গ্রাম, পেঁয়াজ ৩০ গ্রাম, মরিচ ৩টি, ময়দা ৬০০ গ্রাম, লবণ ১০ গ্রাম, তেল ৫০ মিলিলিটার, পানি ৭০ মিলিলিটার, সেইসাথে কয়েকটি তেজপাতা।


প্রস্তুত প্রণালি : আলু ছোট করে চারকোনা আকারে কেটে নিতে হয়। এরপর পেঁয়াজ কুচি, আদা, মাংসের কিমা, লবণ ও তেজপাতা সিদ্ধ করে ফ্রাইপ্যানে তেল গরম করে পাঁচফোড়ন দিয়ে আলুসহ ভালোভাবে ভাজতে হবে। আলু পুরোপুরি সিদ্ধ না হলে পানি দিয়ে আরো কিছুক্ষণ ভেজে নিতে হবে। ময়দার সাথে লবণ ও তেল মেখে আধাঘণ্টা রাখতে হবে। পরে ময়দার কাই ছোট টুকরো করে লুচির আকারে বানিয়ে ছুরি দিয়ে দুই ভাগ করতে হয়। প্রতি ভাগ লুচিপানের খিলির মতো ভাঁজ করে ভেতরে আলু ও মাংসের তরকারি ভরে নিয়ে খোলামুখে পানি লাগিয়ে মুখ বন্ধ করতে হবে। এরপর ডুবোতেলে ভেজে নিলেই মুখরোচক সিঙ্গাড়ার স্বাদ নেয়া  যাবে।
আলুর পুরি উপকরণ : আলু ৩০০ গ্রাম, ময়দা ৩০০ গ্রাম, ঘি অথবা ডালডা কিংবা সয়াবিন তেল ১৫ মিলিলিটার, লবণ ৩ গ্রাম।


প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে চটকিয়ে নিতে হয়। এরপর ময়দা, লবণ ও সয়াবিন তেল একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এ মিশ্রণের কিছু অংশ নিয়ে বলের মতো করে প্রতিটি কেন্দ্রে চটকানো আলু ঢুকিয়ে দিতে হবে। পরে বলগুলোকে রুটির মতো বেলে চ্যাপ্টা গোলাকার পুরি তৈরি করে ডুবোতেলে ভাজতে হবে। এরপর অতিরিক্ত তেল ঝরিয়ে নিয়ে পরিবেশন করা যাবে।


আলুর চপ উপকরণ : আলু ৬০০ গ্রাম, টোস্টের গুঁড়া ৩০ গ্রাম, লবণ ৫ গ্রাম, আদা ৫ গ্রাম, রসুন ১০ গ্রাম, কাঁচামরিচ ২০ গ্রাম, গোলমরিচের গুঁড়া ৫ গ্রাম, মাংসের কিমা ১০০ গ্রাম, পেঁয়াজ ৬০ গ্রাম, পুঁদিনাপাতা ২ গ্রাম, ফেটানো ডিম ১০০ গ্রাম, লবণ ৫ গ্রাম এবং পরিমাণমতো তেল।


প্রস্তুত প্রণালি : আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে চটকে নিতে হবে। মাংসের কিমার সাথে এক কাপ পানি ও তেজপাতা দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। ফ্রাইপ্যানে সামান্য তেল দিয়ে পেঁয়াজ ও মরিচের কুচি ভেজে, এর সাথে সিদ্ধ কিমা দিয়ে দিতে হয়। এরপর আদা বাটা ও পুঁদিনাপাতা দিয়ে কিমাকে শুকনো করে ভাজতে হবে। পরে টোস্টের গুঁড়া, ডিম ও লবণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। চটকানো সিদ্ধআলু চপের আকারে তৈরি করে, এর ভেতরে কিমা ঢুকিয়ে দিতে হবে। পরে ফেটানো ডিমে ডুবিয়ে টোস্টের গুঁড়াতে গড়াগড়ি দিয়ে ডুবোতেলে এমনভাবে ভাজতে হবে যেন বাদামি রঙ ধারণ করে। এরপর চুলা থেকে উঠিয়ে হালকা গরম অবস্থায় খেলে বেশ লাগবে।
 

আলুর চটপটি উপকরণ : আলু ৬০০ গ্রাম, মটরশুঁটি ৬০০ গ্রাম, তেঁতুল ১০০ গ্রাম, ডিম ২টি, শসা ১০০ গ্রাম, খাবার সোডা ১ চা চামচ আর জিরা, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ এবং ধনেপাতা পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি : মটরশুঁটি ধুয়ে ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভেজানো মটরশুঁটি ভালোকরে সোডার পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে। আলু ও ডিম সিদ্ধ করে আলাদাভাবে ছোট করে কেটে নিতে হয়।  জিরা ও মরিচ ভেজে গুঁড়া করে নেয়ার পাশাপাশি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা  কুুচি করার কাজ সেরে ফেরতে হবে। এছাড়া তেঁতুল ধুয়ে, পরে পানিতে ভিজিয়ে রস বের করে নিতে হবে। এবার উপকরণগুলো একসাথে মিশিয়ে চুলার আগুনে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই  হয়ে যাবে চটপটি। এবার তেঁতুলের রস, কাঁচামরিচ, আলুসহ অন্য মসলা দিয়ে রুচিমতো নিজে খাওয়া এবং অপরকে পরিবেশন করা।


আলুর মোগলাইপরোটা উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, আটা ৫০০ গ্রাম, সয়াবিন তেল ২৫০ মিলিলিটার, ডিম ৩টি আর পেঁয়াজ, লবণ, কাঁচামরিচ এবং ধনেপাতা পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি : আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে, এরপর চটকিয়ে নিতে হয়। চটকানো আলুর সাথে আটা ও লবণ ভালোভাবে মিশাতে হবে। দরকার হলে পানি ব্যবহার করা প্রয়োজন। এবার ডিম, পেঁয়াজ কুচি ও ধনেপাতা দিয়ে মামলেট বানিয়ে তা ভেঙে ঝুরঝুরে করে, সেইসাথে চটকানো আলু ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। এ মিশ্রণ থেকে পরিমাণমতো নিয়ে রুটি তৈরি করে ফ্রাইপ্যানে গরম তেলে ভাজতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে আলুর মোগলাই পরোটা।
আলুর সবজিখিচুরি উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, চাল ১০০ গ্রাম, ডাল ১০০ গ্রাম, গাজর অথবা মিষ্টিকুমড়া ৫০০ গ্রাম, আদাবাটা ১ চা চামচ, ডিম ১টি, তেল ৩০ মিলিলিটার, লবণ ও হলুদের গুঁড়া পরিমাণমতো।


প্রস্তুত প্রণালি : আলু এবং গাজর ধুয়ে কুচি করে কেটে নিতে হয়। এর সাথে চাল ভালোভাবে ধুয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে গরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ও মরিচের ফালি ভেজে নেয়ার কাজ সেরে ফেলতে হবে।  পেঁয়াজ ও মরিচ বাদামি রঙ ধারণ করলে আলু, চাল, ডাল এবং গাজর সবগুলো তেলের মধ্যে ঢেলে, সেইসাথে আদা, হলুদ, লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়তে হবে। এতে পরিমাণমতো গরম পানি দিতে হয়, যেন সবটুকু সিদ্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধ হলে ডিম ভেঙে ফেটে দিতে হবে। কিছুক্ষণ রেখে দিলেই হয়ে যাবে আলুর সবজি খিচুরি।


এছাড়া আলুভাজি, আলুর দম, আলুর ঝোল, ভর্তা, চাটনি, লাবড়াও নিরামিষ সবার পরিচিত। এর পাশাপাশি আধুনিক রেসিপিও আছে; যেমনÑ আলুর পোস্ত, আলুর চাট, কাঠি কাবাব, দোপেঁয়াজো, টোস্ট, বার্গার, টিক্কি এবং দোলমা। আবার মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন- আলুর পায়েশ, আলুর দই, বুন্দিয়া, রসমালাই, জিলাপি, বরফি, হালুয়া, কালোজাম, পিঠা, মোরব্বা, জর্দাসহ আরো অনেক।


এক খাবার বার বার খেতে মন চায় না তবে স্বাদ পরিবর্তন করে খেলে ভালো লাগে। আর তা যদি হয় কম খরচের তাহলে তো কথাই নেই। তাই আসুন, আলুর তৈরি এসব রকমারি খাবার খেয়ে দেহে পুষ্টি বাড়াই। সে সাথে ভাতের  চাপ কমাই।

নাহিদ বিন রফিক*

*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর : ০১৭১৫৪৫২০২৬; ই-মেইল :tpnahid@gmail.com

 

বিস্তারিত
আমের রোগ ও দমন ব্যবস্থাপনা

আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ গন্ধে এটি একটি অতুলনীয় ফল। এই উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। তাই আম সব ফলের সেরা। বাংলাদেশে আমই হচ্ছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফল। এর সাথে অন্য কোনো ফলের তুলনা হয় না কারণ উৎকৃষ্ট জাতের আম স্বাদে গন্ধে ও দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। আম এমন একটি ফল যা ছোট থেকে শুরু করে পাকা পর্যন্ত সব অবস্থায় খাওয়া যায়। আম পছন্দ করে না এমন লোক হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই অনেকে আমকে ফলের রাজা বলে থাকেন। বাংলাদেশে আম চাষাবাদের এলাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের দেশে আম চাষে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো প্রতিহত করতে না পারলে আম চাষ লাভজনক হয় না। এর মধ্যে আমের নানা ধরনের রোগজনিত সমস্যা ও তাদের দমন ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হলো-


এনথ্রাকনোজ : এই রোগের আক্রমণে গাছের কচি পাতা, কাণ্ড, কুঁড়ি, মুকুল ও ফলে দেখা যায়। পাতায় অসমান আকৃতির ধূসর বাদামি বা কালচে রঙের দাগ পড়ে। পাশাপাশি কয়েকটি দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। বেশি আক্রান্ত হলে পাতা ঝরে পড়ে। আমের মুকুল বা ফুল আক্রান্ত হলে কালো দাগ দেখা দেয়। ফুল আক্রান্ত হলে তা মারা যায় এবং ঝরে পড়ে। মুকুল আক্রান্ত হলে ফলধারণ ব্যাহত হয়। আম ছোট অবস্থায় আক্রান্ত হলে আমের গায়ে কালো দাগ দেখা দেয়। আক্রান্ত ছোট আম ঝরে পড়ে। বাড়ন্ত আমে রোগের জীবাণু আক্রমণ হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। পাকা আমে ধূসর বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি করে। গুদামের আবহাওয়া অনুকূল হলে রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। আম বড় হওয়ার সময় ঘন ঘন বৃষ্টি ও মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করলে আমে আক্রমণ বেশি দেখা যায়।


প্রতিকার : রোগাক্রান্ত বা মরা ডালপালা ছাঁটাই করে পুড়ে ফেলতে হবে। গাছের রোগাক্রান্ত ঝরা পাতা ও ঝরে পড়া আম সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, প্রয়োজনে মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে। মুকুলে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করতে হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। মুকুল ১০-১৫ সেমি. লম্বা হলে প্রথম স্প্র্রে শেষ করতে হবে। আম মটর দানার মতো হলে দ্বিতীয় বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশকের এবং ছত্রাকনাশক মিশিয়ে একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। বাড়ন্ত আমকে রোগমুক্ত রাখতে হলে আম সংগ্রহের ১৫ দিন আগ পর্যন্ত মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক বা একরোবেট এম জেড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে ১৫ দিনের ব্যবধানে ৩/৪ বার স্প্রে করতে হবে।


গাছ থেকে আম পাড়ার পরপরই গরম পানিতে (৫৫০ সে. তাপমাত্রায় ৫ মিনিট) ডুবিয়ে রাখার পর শুকিয়ে অর্থাৎ গরম পানিতে শোধন করে গুদামজাত করতে হবে।


বোঁটা পচা : আম গাছ থেকে পাড়ার পর পাকতে শুরু করলে বোঁটা পচা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথমে বোঁটায় বাদামি অথবা কালো দাগ দেখা দেয়। দাগ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং গোলাকার হয়ে বোঁটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জীবাণু ফলের ভেতরে আক্রমণ করে পচিয়ে ফেলে। আক্রান্ত আম ২/৩ দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। রোগের জীবাণু বোঁটা ছাড়াও অন্যান্য আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দিয়ে আমের ভেতরে প্রবেশ করে আম পচিয়ে ফেলতে দেখা যায়।


প্রতিকার : রোদ্রোজ্জ্বল দিনে গাছ থেকে আম পাড়তে হবে। আম পাড়ার সময় যাতে আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ৫ সেমি. (২ ইঞ্চি) বোঁটাসহ আম পাড়লে এ রোগের আক্রমণ কমে যায়।  আম পাড়ার পর গাছের তলায় জমা না রেখে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। আম পাড়ার পর পরই গরম পানিতে (৫৫০ সে. তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট) অথবা বাভিস্টিন দ্রবণে (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম) ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখার পর গুদামজাত করলে বোঁটা পচা রোগের আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়।


আমের আঠা ঝরা এবং হঠাৎ মড়ক : বর্তমানে আম গাছের  যেসব রোগ দেখা যায় তাদের মধ্যে আমের আঠা ঝরা এবং হঠাৎ মড়ক সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এ রোগে আক্রান্ত গাছ খুব অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায় । প্রথমে কা- অথবা মোটা ডালের কিছু কিছু জায়গা থেকে হালকা বাদামি থেকে গাড় বাদামি রঙের আঠা বা রস বের হতে থাকে। বেশি আক্রান্ত ডগা বা ডালটি অল্প দিনের মধ্যেই মারা যায়। কিছুদিন পর দেখা যায় আরেকটি ডাল একইভাবে মারা যাচ্ছে। এভাবে এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ গাছ মারা যেতে পারে।


প্রতিকার : গাছে মরা বা ঘন ডাল পালা থাকলে তা নিয়মিত ছাঁটাই করতে হবে। আঠা বা রস বের হওয়ার স্থানের আক্রান্ত সহ সুস্থ কিছু অংশ তুলে ফেলে সেখানে বোর্দোপেস্টের (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা যায়) প্রলেপ দিতে হবে। আক্রান্ত ডাল কিছু সুস্থ অংশসহ কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। কাটা অংশে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দোপেস্টের  প্রলেপ দিতে হবে। গাছে নতুন পাতা বের হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ১৫ দিনের ব্যবধানে ২ বার স্প্রে করতে হবে।


আগামরা : এ রোগের জীবাণু প্রথমে কচি পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতা বাদামি হয় এবং পাতার কিনারা মুড়িয়ে যায়। পাতাটি তাড়াতাড়ি মারা যায় ও শুকিয়ে যায়। আক্রমণ পাতা থেকে এ রোগের জীবাণু কুড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ডগার সামনের দিকে মরে যায়। মরা অংশ নিচের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ফলে বহু দূর থেকে আগামরা রোগের লক্ষণ বোঝা যায়। ডগাটি লম্বালম্বিভাবে কাটলে বাদামি লম্বা দাগের সৃষ্টি করে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।


প্রতিকার : আক্রান্ত ডাল কিছু সুস্থ অংশসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা অংশ পুড়াই ফেললে ভালো। কাটা অংশে বোর্দোপেস্টের (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা যায়) প্রলেপ দিতে হবে। গাছে নতুন পাতা বের হলে মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- ডায়থেন এম ৪৫/ পেনকোজেব/ ইন্ডোফিল ইত্যাদি (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) ১৫ দিনের ব্যবধানে ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।


কাল প্রান্ত : ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধোয়ায় কারণে এ রোগ হতে পারে। আমের বয়স দেড় মাস হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। আক্রান্ত আমের বোঁটার দিকের অংশ স্বাভাবিকভাবে বাড়লেও নিচের অংশ ঠিক মতো বাড়তে পারে না।  ফলে আমের গঠন বিকৃত হয়। নিচের অংশ কুঁচকে যায়, বেশি আক্রান্ত আমের নিচের অংশ কাল হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় আমের বিকৃত অংশ ফেটে যেতে পারে এবং পচে যেতে পারে।
প্রতিকার : আম মার্বেল আকারের হলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক পাউডার ১০-১৫ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।  ইটের ভাটা আম বাগান থেকে ২ কিমি. দূরে স্থাপন করতে হবে। ইটের ভাটার চিমনি কমপক্ষে ৩৭ মিটার (১২০ ফুট) উঁচু করতে হবে।


আম ফেটে যাওয়া : আম ছাড়াও কাঁঠাল, ডালিম, পেয়ারা ইত্যাদি ফল ফেটে যেতে দেখা যায়। সব ধরনের ফল ফাটার কারণ মোটামুটিভাবে একই। মাটিতে রসের দ্রুত হ্রাস-বৃদ্ধি আম ফাটার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আবহাওয়া শুকনা হলে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হলে আমের ওপরের খোসা শক্ত হয়ে যায়। এরপর হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে বা সেচ প্রদান করলে আম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। আমের ভেতরের দিক ঠিকমতো বাড়লেও বাহিরের আবরণ শক্ত হওয়ার কারণে তা বাড়তে পারে না। এ অবস্থায় আম ফেটে যায়। মাটিতে বোরণের ঘাটতি থাকলেও আম ফাটতে সহায়তা করে বলে জানা যায়। প্রতিকার মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার দিতে হবে। জৈব সার মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে ফলে শুকনা বা খরার সময়ও মাটিতে যথেষ্ট রস থাকবে। জৈব সারের মধ্যে গোবর সব চেয়ে উত্তম বলে বিবেচিত। সার দেয়ার মৌসুমে ২০ বছর বা তদূর্ধ্ববয়সের গাছে ৫০ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে।


আম চাষি ভাইয়েরা উপরোক্ত বিষয়গুলো সময় মতো সঠিকভাবে মেনে চললে উপরোক্ত রোগ হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। যেহেতু অন্যান্য ফসলের মতো আমেও বেশ কিছু রোগের আক্রমণ হয়  যা আমের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই আমের উৎপাদন বাড়াতে হলে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা জানা এবং মেনে চলা অপরিহার্য।

 

কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি*

*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী

 

বিস্তারিত
জারা লেবুর উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা

জারা লেবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ও রপ্তানিযোগ্য ফসল। সাধারণ লেবুর চেয়ে জারা লেবু একটু ব্যতিক্রমই বটে। জারা লেবুর রস নয় মূলত বাকল খাওয়া হয়। খাবার টেবিলে জারা লেবুর সালাদের বেশ কদর রয়েছে। লেবুটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আকার সাধারণ লেবুর চেয়ে বেশ বড়, এক একটি লেবুর ওজন প্রায় দুই থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর চামড়া বেশ পুরু তবে রসের পরিমাণ খুবই কম। লেবুটির চামড়ার একটি বিশেষ মিষ্টি গন্ধ রয়েছে। যার মিষ্টি স্বাধের আবদার রয়েছে ভোক্তাদের। খোসা দিয়ে আচারও তৈরি করা হয়। এ লেবুটি বিদেশে রপ্তানি হয়। প্রবাসী বাংলাদেশীরা এ লেবুর প্রধান ভোক্তা। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলসহ বাংলাদেশের সব এলাকায় এ লেবুর ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জারা লেবুর বাজার মূল্য বেশ চড়া, একেকটি লেবুর দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চল তথা সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলায় জারা লেবুর চাষ করা হচ্ছে।


জলবায়ু ও মাটি : আর্দ্র ও উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে জারা লেবু ভালো জন্মে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনযুক্ত অম্লীয় মাটি এটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী। উৎপাদনের জন্য বছরে ১৫০০-২০০০ মিলি লিটার বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। ২৫-৩০ সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা প্রয়োজন। মাটির অম্লত্ব ক্ষারত্ব মান ৫-৬ হলে ভালো হয়। লেবু চাষের জন্য হালকা দোঁ-আশ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা সম্পন্ন অম্লীয় মাটি প্রয়োজন।
 

বংশবিস্তার : বীজ (চারা) ও অঙ্গজ (কলম) দুইভাবে বংশবিস্তার করা যায়। খুব ভালো মাতৃগুণ সম্পন্ন চারা পেতে কলমের চারা উত্তম। সাধারণত গুটি কলম দিয়ে বংশবিস্তার করা হয়। অঙ্গজ উপায়ে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে। অঙ্গজ উপায়ে উৎপন্ন চারায় ২ থেকে ৩ বছরেই ফল ধরতে শুরু করে। তাই চারার চেয়ে গুণগত কলম লাগানো উত্তম।
 

মাদা তৈরি : চারা বা কলম রোপণ করার ১৫-২০ দিন আগে ২.৫ মিটার থেকে ৩.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ৬০ সেন্টিমিটার প্রস্থ এবং ৬০ সেন্টিমিটার গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে ২০ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১১১১-১৬০০টি চারা রোপণ করা যায়।
রোপণ পদ্ধতি : লেবুর চারা বা কলম সারি বা বর্গাকার পদ্ধতিতে লাগানো উচিত। ফলে বাগানের আন্তঃপরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ করা সহজ হয়। তাছাড়া পাহাড়ি ঢালু জমিতে আড়াআড়ি লাইনে বা সারি করে কলম বা চারা রোপণ করা ভালো। এর ফলে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় কম হয়।


রোপণ সময় : বর্ষাকাল চারা বা কলম লাগানোর উৎকৃষ্ট সময়। এক্ষেত্রে মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যেতে পারে। তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
 

চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা : মাদা তৈরি করার ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম লাগাতে হয়। চারা বা কলম গর্তের ঠিক মাঝখানে খাঁড়াভাবে লাগাতে হবে এবং চারা বা কলমের চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালোভাবে বসিয়ে দিতে হবে। চারার গোড়ায় ঝাঁঝরি দিয়ে পানি দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি চারায় পৃথকভাবে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।


গাছে সার প্রয়োগ : চারা লাগানোর পর ভালো ফলন পেতে হলে নিয়মিতভাবে সময়মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নে বয়স অনুপাতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ দেওয়া হলো-
 

সার প্রয়োগ পদ্ধতি : ছকে বর্ণিত সার তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটি সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
 

অঙ্গ ছাঁটাই : গাছের গোড়ার দিকে জল শোধক শাখা বের হলেই কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া গাছের ভেতরের দিকে দুর্বল ডালপালা মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে। ডালপালা ছাঁটাই করলে গাছ আলো বাতাস ঠিকমতো পাবে। ফলে গাছে ফলন বৃদ্ধি পায়।
 

পানি সেচ ও নিষ্কাশন : খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ প্রয়োগ করা দরকার। লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।


জারা লেবুর পোকামাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা : সিলেট অঞ্চলে লেবু ফসলে প্রায় ১৬ প্রজাতির পোকামাকড় আক্রমণ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেবুর প্রজাপতি পোকা, লিফ মাইনার, সাইলিড বাগ, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কা- ছিদ্রকারী পোকা। এসব পোকামাকড় লেবু ফসলের ক্ষতিসাধন করে।
 

লেবুর প্রজাপতি পোকা : লেবুর প্রজাপতি পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে। এ পোকা মূলত নার্সারিতে ও ছোট গাছে আক্রমণ করে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি, জুলাই ও আগস্ট মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আলোক ফাঁদ দ্বারা পূর্ণাঙ্গ পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ  (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।


লেবু পাতার ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকা : লিফ মাইনার বা সুড়ঙ্গকারী পোকার কীড়াগুলো পাতার উপত্বকের ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে আকা-বাঁকা সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে গাছের পাতার কিনারার দিক মুড়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়। আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে। আগস্ট ও অক্টোবর মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গ্রীষ্ম ও শরৎকালে নতুন পাতা গজানোর সময় কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।


লেবুর থ্রিপস পোকা : লেবুর থ্রিপস পোকা লেবুর কচিপাতা ও কচি ফলের রস চুষে খায়। আক্রান্ত পাতা ওপরের দিকে বেঁকে নৌকার মতো আকৃতি ধারণ করে এবং পাতা খসখসে ও পুরু হয়ে যায়। আক্রান্ত ফল বড় হওয়ার সাথে সাথে ধূসর বা রুপালি বর্ণের দাগ পড়ে এবং খসখসে হয়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে সাদা আাঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন  ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আক্রান্ত গাছে ফিপ্রোনিল ১ মিলি হারে মিশিয়ে অথবা ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। অ্যাডমায়ার ২০০ এসএল বা টাফগর ৪০ ইসি ২মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
 

লাল পিঁপড়া : লাল পিঁপড়া কয়েকটি পাতা একত্র করে বাসা তৈরি করে। এতে গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যায় এবং সালোক সংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এসব বাসায় মিলিবাগ আক্রমণ করে, ফলে গাছে শুটিমোল্ড রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। গাছ থেকে পিঁপড়ার বাসা অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেভিন ৮৫ এসপি ২ মিলি/লিটার পানি বা ডারসবান ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে পিঁপড়ার বাসায় প্রয়োগ করতে হবে।


লাল মাকড় : লাল মাকড় লেবুজাতীয় ফলের কচিপাতা ও ফলে আক্রমণ করে। এদের আক্রমণে পাতার নিচের দিক বাদামি বর্ণ ধারণ করে। পাতা কুঁকড়ে যায় ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যে কোনো মাকড়নাশক যেমন ভারটিম্যাক বা ওমাইট ৫৭ ইসি ১.৫ মিলি লিটার প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।


ছাতরা পোকা : সাধারণত গ্রীষ্মকালে এ পোকা শাখা প্রশাখা, পাতার নিচের দিকে এবং ফলের বোঁটার কাছে একত্রে গাঁদা হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকা ও নিম্ফ পাতা, ফল ও শাখা প্রশাখা থেকে রস চুষে খায়। এ পোকা থেকে নিঃসৃত পদার্থে শুটিমোল্ড নামক ছত্রাকের জন্ম হয়। আক্রমণের প্রথম দিকে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা/কা-/ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। তাছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবান পানি মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
 

তাছাড়া পোকার জন্য জৈব বালাইনাশক হিসেবে বাইকাউ-১ প্রতি শতাংশ জমির জন্য ৪ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন। পাতার এপিট ওপিট এবং ১০-১২ দিন অন্তর কয়েক বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
জারা লেবুর রোগ ব্যবস্থাপনা

 

ক্যাঙ্কার : এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। কচি পাতা, বাড়ন্ত কুঁড়ি, পাতা ও ফলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। আক্রান্ত পাতার উভয় পাশে খসখসে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত অংশের চারদিকে গোলাকার হলুদ কিনারা দেখা যায়। পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং আক্রান্ত ডগা ওপর দিক থেকে মরতে থাকে। ফলের ওপর আক্রমণ বেশি হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। ঘন ঘন বৃষ্টি হলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত বাতাস জনিত কারণে ও লিফ মাইনার পোকার আক্রমণে গাছের ডাল ও পাতায় যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ভেতর দিয়ে রোগ জীবাণু প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করে।
 

প্রতিকার : পরিকল্পিতভাবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে জাড়া লেবুর বাগান স্থাপন করতে হবে। রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকট হলে কুপ্রাভিট ৮০ ডব্লিউপি (কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রতি লিটার পানিতে ৭ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। বোর্দোমিশ্রণ (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন লিটার পানিতে মিশিয়ে) ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।


স্ক্যাব : লেবুর চামড়ার ওপর ছোট ছোট বাদামি বা লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে খসখসে হয়ে যায় যা দেখতে অনেকটা দাদ রোগের মতো মনে হয়। কিছু কিছু দাগ গভীর হয় আবার কিছু কিছু দাগ বাইরের দিকে খাঁড়া থাকে। এ রোগ ব্যবস্থাপনায় ম্যানকোজের জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।


রফতানিযোগ্য লেবু উৎপাদন করতে লক্ষণীয় দিক
 - রোগ এবং পোকামাকড়মুক্ত লেবু উৎপাদন করতে হবে।
- রোগের ক্ষেত্রে ক্যাঙ্কার রোগটি আমদানিকারকদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর তাই কোনোক্রমেই বাগানে ক্যাঙ্কার রোগ থাকতে পারবে না।
- পোকার ক্ষেত্রে বাগানটি অবশ্যই থ্রিপস এবং লিফ মাইনার মুক্ত হতে হবে।
- লেবু তোলার সময় অবশ্যই হাতে গ্লোবস পরতে হবে। লেবু তোলার পর বাছাই করতে হবে। লেবু তোলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিপক্ব এবং কম পরিপক্বতাকে পরিহার করতে হবে। রঙ এবং আকৃতি অবশ্যই আকর্ষণীয় হতে হবে।

 

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*

*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট

 

বিস্তারিত
পাট নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব

পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। পাট উৎপাদনকারী পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভালো। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট এবং পাটজাতীয় (কেনাফ ও মেস্তা) ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৫৭ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি পাটের আঁশের মান, দৈর্ঘ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী চারটি জিনের পেটেন্ট (কৃতিস্বত্ব) পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এছাড়া ক্ষতিকারক ছত্রাক Macrophomina phaseolina-এর তিনটি জিন শনাক্ত করে সেগুলোর পেটেন্টও পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্মোচিত জীবনরহস্যের এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে স্বল্প জীবনকালসমৃদ্ধ, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম, রোগবালাই সহনশীল, বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য উৎপাদন এবং উচ্চফলনশীল পাটের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা এগিয়ে চলছে।


একদিকে সোনালি আঁশ, অন্যদিকে রুপালি কাঠি-দুয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট। পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠির অর্ধেকও যদি সঠিকভাবে চারকোল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। ভেষজ হিসেবে পাটপাতা বহুল ব্যবহৃত একটি  উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিজেআরআই) পাটের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু করে এবং বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় গুয়ার্ছি অ্যাকুয়া এগ্রো টেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান পাটের পাতা দিয়ে তৈরি অর্গানিক চা জার্মানিতে রফতানি করছে। সম্প্রতি পাটের পাতা থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন সবুজ চা উৎপাদন বড় পরিসরে শুরু করতে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আঁশ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্য তেল এবং মেস্তার মাংসাল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি প্রস্তুতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাটে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সেলুলোজ রয়েছে। পাট থেকে পাল্প তৈরি করে পুনরায় সেলুলোজ রি জেনারেট করে ভিসকস তৈরি করা সম্ভব। আর এই ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।


ঢাকাই মসলিন, সিল্কের শাড়ি কিংবা কাপড় যেমন নামে-ডাকে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক পাটের তৈরি অনেক জিনিসপত্রও এখন দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের প্যাভিলিয়নে পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চবারকোল), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাটের তৈরি বিশেষ সোনালি ব্যাগ ও পাটপাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় মেলায় আগত দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশে^র গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত  করতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পে কাপড় তৈরির উপযোগী সুতা বর্তমানে পাট থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। কম লিগনিনসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন সম্ভব হলে বস্ত্র শিল্পে তুলার বিকল্প হিসেবে অথবা তুলার সঙ্গে সংমিশ্রণে পাটের ব্যবহারের প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। বিজেআরআইয়ের যুগান্তকারী পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে চাহিদামাফিক (কৃষিতাত্ত্বিক/পণ্যভিত্তিক) পাটের জাত উদ্ভাবন এবং পাট ও ছত্রাকের সাতটি জিনের পেটেন্ট কাজে লাগিয়ে শিল্পের উপযোগী পাটপণ্য উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।


জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে পালিত হওয়ায় বিশ^ব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর কদর আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুবাদে পাট ও পাটজাত পণ্যের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার হতে থাকে। বিশ্ব প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক স্থল ও জলজ প্রাণী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এ বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বনডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বনডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। সাম্প্রতিককালে ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে ওঠেছে বিকল্প অবলম্বন। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতি মাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক আঁশের তৈরি ব্যাগের প্রয়োজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বর্তমানে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বিশে^র এ চাহিদা মেটাতে পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।


পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার সম্প্রতি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্বুদ্ধকরণে পাট আইন, ২০১৭ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। পাট চাষিদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ লক্ষ্য এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পাটকল মালিকদের অনুরোধে সরকার তিন ধরনের কাঁচা পাট রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা পাটশিল্পের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাটকে বিশ^বাজারে তুলে ধরতে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) ১৩৫ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ৪৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০ কোটি ৬০ লাখ পিস পাটের বস্তা সরবরাহ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাটচাষিদের পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর পরিচালনাকারী সংস্থা বিজেএমসি গত মৌসুমে ১ হাজার কোটি টাকার পাটআঁশ ক্রয় করেছে। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান  করা, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সরকার ৬ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো দেশব্যাপী জাতীয় পাট দিবস উদযাপন করছে।


পাট চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে বিজেআরআই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)-এর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পাট স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজার মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেহেতু বিশ্বসেরা পাট বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়, সেহেতু সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের পাট নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

 

মো. আল-মামুন*

*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা

 

বিস্তারিত
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি (বৈশাখ ১৪২৫ কৃষিকথা)

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা ও মিষ্টি ফলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা থাকে বাংলার দিক প্রান্তর। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফলের সৌরভ আমাদের রসনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও মৌসুমি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি জ্যৈষ্ঠের গরমে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। আর এই মধুমাসে প্রিয় পাঠক, চলুন একপলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ভুবনের কাজগুলো-
 

বোরো ধান : জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বীজ ছায়ায় ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।


আউশ ধান : এখনও আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতি দ্রুত বীজ বপন করতে হবে। চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
 

আমন ধান : নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়। এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে। জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়। ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে।


জ্যৈষ্ঠ মাসে আউস ও বোনা আমনের জমিতে পামরি পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরি পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরি পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।


পাট : পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে। ফাল্গুনী তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির করণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ মাসে পাটের বিছা পোকা এবং ঘোড়া পোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছা পোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়া পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
 

শাকসবজি : মাঠে বা বসতবাড়ির আঙিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতা জাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।


সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাব পোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তাছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
 

বিবিধ : বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন। মাঠের মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে। গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানি কচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন। যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।


গাছপালা : আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে। উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারিকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
 

প্রাণিসম্পদ : এ সময়ে প্রাণিচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে।
এছাড়া হাঁস মুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহাণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে। মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে। বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। গবাদি পশুর গলাফোলা, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।


মৎস্যসম্পদ : মাছ প্রজননে আগ্রহী চাষিভাইদের স্ত্রী-পুরুষ মাছ (ব্রুড ফিশ), পিটুইটারি গ্রন্থি, হাপা এবং ইনজেকশনের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখতে হবে। আঁতুড় পুকুর বন্যায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে পোনার আকার ১ ইঞ্চি হলে সাবধানে ধরে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত তদারকি, রাক্ষুসে মাছ তোলা, আগাছা বা জংলা পরিষ্কার, খাবার দেয়া, সার দেয়া, সম্পূরক খাবার দেয়া, জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এসব প্রাসঙ্গিক কাজগুলো নিয়মিত করতে হবে। এছাড়া যে কোনো সমস্যায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
 

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরও বেশি লাভবান হবেন।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*

*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সাভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon