ফুল। দুই অক্ষরের একটি সুন্দর শব্দ। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুল পবিত্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ যে কোনো উপলক্ষে কাউকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতে আমরা ফুল উপহার দেই। ফুল নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অনেক কাব্য ও সাহিত্য। কবি বলেছেন, জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুইটি যদি জোটে তার একটি ফুল কিনে নিও ওহে অনুরাগী। অতীতে ফুলের উৎপাদন ও ব্যবহার ছিল খুব সীমিত। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে এবং ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল উৎপাদনের শুভ সূচনা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। সে সময়ে একজন ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক জনাব শের আলী মাত্র ০.৮৩ ডেসিম্যাল জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। আজ বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫,০০০ কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত ১.৫০ লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল সেক্টরের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। ফুল শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে আজকাল ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। এখন বিয়ে শাদিতো বটেই, অন্যান্য সামাজিক ও জাতীয় অনুষ্ঠান যেমন-মাতৃভাষা দিবস, ভ্যালেনটাইনস ডে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ জাতীয় ও সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে যেমন-বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, পূজা পার্বণে ফুলের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া জাতীয় নেতাদের মৃত্যু দিবসেও তাঁদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফুলের বহুবিধ ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন গত এক যুগে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে দেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩৫২০ হেক্টর জমিতে ফুলের উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর (৭৪%) জমিতে ফুলের চাষ হয়। ২য় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর (২০%) এবং ৩য় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর (৩.৪৪%)। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর (০.২৯%)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মূল উৎপাদনের প্রায় ১৫০০০ হাজার কৃষক জড়িত। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ১১২৫০ জন (৭৫%), ঢাকা বিভাগে ৩০০০ জন (২০%)। বাকি ৫% কৃষক রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে ফুল চাষে নিয়োজিত।
বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপাদনের হিসাবে দেখা যায়, সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গ্লাডিওলাস ৯৯১৪ টন যার টাকার মূল্য মার্কেট শেয়ার ৩১%। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে গোলাপ ১১১৩২ টন (২৪%), রজনীগন্ধা ১০৮১৪ টন (১৭%), ম্যারিগোল্ড ১২৬২৪ টন (৮%) অন্যান্য ফুলের মার্কেট শেয়ার মোট ২০%। বার্ষিক হিসাবে ২০১৪-১৫ সালে ফুল উৎপাদন হয়েছে ৫৭,০০০ টন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা হচ্ছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয় গ্লাডিওলাস থেকে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা। তারপর গোলাপ ১৭০ কোটি, রজনীগন্ধা ১৩৩ কোটি, মেরিগোল্ড ৫৭ কোটি এবং অন্যান্য ফুল থেকে প্রায় ১৫০ কোটি।
গত ৫-৬ বছরে ফুল শিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত সন্তোষজনক। নিচের ছকে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য দেয়া হলো-
প্রবৃদ্ধি খাত |
২০০৯-২০১০ |
২০১৪-২০১৫ |
উৎপাদন এলাকা (হে.) |
১,৭৭৪ |
৩৫২০ |
উৎপাদন (মে. টন) |
২৩,৭২০ |
৫৬৬৪৯ |
খুচরা বিক্রয়ের পরিমাণ (মে. টন) |
১৮,০৫০ |
৪৫১৮৭ |
বিক্রয় মূল্য (টাকা) |
২৫২ কোটি |
৮০৫ কোটি |
ফুল শিল্প বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সালের হিসাবে গড় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক। ফুল উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২০%, বিক্রিত মূল্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৬%, খুচরা বাজারে বিক্রয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ২০%, তবে উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধি হার মাত্র ১৫% যা অপেক্ষাকৃত কম। সার্বিকভাবে ফুল শিল্পের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- ফুল চাষ ধান ও শাকসবজির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। ফুলের উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসারণের অন্যতম প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- ফুলের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি, হেক্টর প্রতি অধিক লাভ, ফুলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যান্য জেলায় ফুলের চাষ বৃদ্ধির সুযোগ, শহরের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফুল ক্রয়ের ব্যাপক অভ্যাস ও উৎসাহ।
ফুল শিল্পের এসব সুযোগ ও সম্ভাবনার মধ্যেও ফুল শিল্প বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তা হচ্ছে- ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর অনেক কৃষকের জ্ঞানের অভাব, অতিরিক্ত মূলধন ব্যয়, বাংলাদেশে ফুলের বীজ ও চারার অপ্রাপ্যতা এবং এ ব্যাপারে ভারত থেকে আমদানি নির্ভরতা, গ্রিনহাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অপ্রাপ্যতা, ফুল চাষের জন্য বিশেষ কম্পাউন্ড সারের অভাব, ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে স্থায়ী পাইকারি ফুলের বাজারের অভাব, আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব, কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে ২০% ফুল বিনষ্ট হওয়া, ফুল নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব ও একটি জাতীয় ফুল নীতি না থাকা।
তাই বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের আরও অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন তা হচ্ছে - বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফুল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা, ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহন কালে ফুল জাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুলের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন, দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা কর্তৃক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল সেক্টরে মহিলা উদ্যোক্তাদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন।
কৃষিবিদ মাহমুদ হোসেন*
বাংলাদেশে জমির অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় মাশরুম একটি সম্ভাবনাময় ফসল। এদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। অমিত সম্ভাবনাময় ফসল মাশরুম চাষের জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় দেশে মাশরুম উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে কোনো ফসলেরই উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই। যার মোটেই চাষের জমি নেই তিনিও বসত ঘরের পাশের অব্যবহৃত জায়গায় অনেক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। এজন্য ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ মাশরুম চাষ করতে পারেন। মাশরুম এমন একটি ফসল যা ধনী, দরিদ্র সবার ঘরে সমভাবে জায়গা করে নিয়েছে। গ্রাম-গঞ্জে, শহরে এমনকি অতিমাত্রায় বিলাসিদের প্রাসাদেও মাশরুম স্থান পেয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানব জাতির কল্যাণে দুনিয়ায় অগণিত জিনিসের সৃষ্টি করেছেন। এরকম কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী ও ঔষধিগুণে ভরপুর একটি দ্রব্যের সহজ-সরল নাম মাশরুম। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন খাবার। এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের কারণে এরইমধ্যে এটি সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাশরুম চাষ আমাদের দেশের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ মাশরুম অত্যন্ত স্বাস্থ্যপ্রদ একটি খাবার। মাশরুমের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে অত্যধিক এবং এর প্রোটিন অতি উন্নতমানের এবং মানব দেহের জন্য অতিশয় উপকারী। একটি পরিপূর্ণ প্রোটিনের পূর্বশর্ত হলো মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যাসিডের উপস্থিতি। মাশরুমে অতীব প্রয়োজনীয় এ ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিড বিদ্যমান। অন্যান্য প্রাণিজ আমিষ যেমন -মাছ, মাংস, ডিম অতি নামি-দামি খাবার হলেও এতে চর্বি স¤পৃক্ত অবস্থায় থাকায় যা অতি মাত্রায় গ্রহণ করলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে, যার ফলে মেদ-ভুঁড়ির সৃষ্টি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ প্রভৃতি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মাশরুমের প্রোটিনে-ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অতি স্বল্প এবং কোলেস্টেরল ভাঙার উপাদান-লোভস্ট্রাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় শরীরের কোলেস্টেরলস জমতে পারে না বরং মাশরুম খেলে শরীরে বহু দিনের জমানো কোলেস্টেরল ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যায়। ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে ২৫-৩৫ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যা অতি নামি-দামি খাবার হিসেবে মাছ, মাংস, ডিম খেয়ে থাকি তার মধ্যে ১০০ গ্রাম মাছ, মাংস ও ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ হলো ১৬-২২ গ্রাম , ২২-২৫ গ্রাম ও ১৩ গ্রাম মাত্র।
মানব দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সৃষ্টি করাই ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান কাজ। শরীরের চাহিদামতো প্রতিদিন ভিটামিন ও মিনারেল খেতে না পারলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল হয়ে নানারূপ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হয়। প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমেই সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান। মাশরুমে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম। সেলেনিয়াম উপাদানটি শুধু মাছেই পাওয়া যায়। যারা পুরোপুরি নিরামিষভোজী তারা মাশরুমের মাধ্যমে এ উপকারী উপাদানটি গ্রহণ করতে পারেন। মাশরুমে আরও আছে এরগোথিওনেইন নামে এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা মানব দেহের জন্য ঢালের মতো কাজ করে। মাশরুমে ভিটামিন বি-১২ আছে প্রচুর পরিমাণে যা অন্য কোনো উদ্ভিজ্জ উৎসে নেই। মাশরুম কোলেস্টেরল শূন্য। এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও খুবই সামান্য। এতে যে এনজাইম ও ফাইবার আছে তা দেহে উপস্থিত বাকি ব্যাড কোলেস্টেরলের বসতিও উজাড় করে দেয়।
মাশরুমে উচ্চমাত্রার আঁশ থাকে, সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকে এবং প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম থাকে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া মাশরুমে কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন, লোভাস্টটিন, এ টাডেনিন, কিটিন এবং ভিটামিন বি, সি ও ডি থাকায় নিয়মিত মাশরুম খেলে উচ্চ রক্তচাপও হৃদরোগ নিরাময় হয়। মাশরুমের ফাইবার বা আঁশ পাকস্থলী দীর্ঘক্ষণ ভরা রাখতে সাহায্য করে। মাশরুম রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে। উচ্চ ফ্যাট সমৃদ্ধ লাল মাংসের পরিবর্তে মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমানো সহজ হয়। ঋঅঝঊই তে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমে। মাশরুমে নিয়াসিন ও রিবোফ্লাবিন থাকে যা ত্বকের জন্য উপকারী। ৮০-৯০ ভাগ পানি থাকে যা ত্বককে নরম ও কোমল রাখে।
মাশরুমে পলিফেনল ও সেলেনিয়াম নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এতে মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সালফারও থাকে। এ অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো মারাত্মক কিছু রোগ, যেমন-স্ট্রোক, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে। এটি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিতাকে মাশরুম দৈনন্দিন কিছু অসুখ যেমন-কফ ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে যে মাশরুম উৎপন্ন হয় তাতে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে, যা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের শোষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে মাশরুম বেশ উপকারী। নিয়মিত মাশরুম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। মাশরুমের ফাইটোকেমিক্যাল টিউমারের বৃদ্ধিতে বাঁধার সৃষ্টি করে।
মাশরুমের ভিটামিন বি স্নায়ুর জন্য উপকারী এবং বয়সজনিত রোগ যেমন- আলঝেইমার্স রোগ থেকে রক্ষা করে। মাশরুম গ্রহণ করলে রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মাশরুমে এনজাইম ও প্রাকৃতিক ইনসুলিন থাকে যা চিনিকে ভাঙতে পারে। এতে থাকা ফাইবার ও এনজাইম হজমে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কাজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং কোলনের পুষ্টি উপাদান শোষণকেও বাড়তে সাহায্য করে। মাশরুমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি আছে। শিশুদের দাঁত ও হাড় গঠনে এ উপাদানগুলো অত্যন্ত কার্যকরী। মাশরুমে নিউক্লিক এসিড ও অ্যান্টি এলার্জেন থাকায় এবং সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকায় কিডনি রোগ ও এলার্জি রোগের প্রতিরোধক। মাশরুমে স্ফিংগলিপিড এবং ভিটামিন-১২ বেশি থাকায় স্নায়ুতন্ত্র ও স্পাইনাল কর্ড সুস্থ রাখে। তাই মাশরুম খেলে হাইপার টেনশন দূর হয় এবং মেরুদ- দৃঢ় থাকে। হেপাটাইটিস বি ও জন্ডিস প্রতিরোধ করে। অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মাশরুমের খনিজ লবণ দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ড. আখতার জাহান কাঁকন*
*উপজেলা কৃষি অফিসার (এল.আর), খামারবাড়ি, ঢাকা, সংযুক্ত : মাশরুম বিশেষজ্ঞ, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা
দুইটি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেট। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাংশে হাওর, বাঁওড়, বিল, পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল আর সমতল ভূমির অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত সিলেট অঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলার সমন্বয়ে এ সিলেট অঞ্চল। এ অঞ্চলের মোট আয়তন ১২,৫০৫.৩২ বর্গকিলোমিটার যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২% এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় ১,১৪,২৪,৭২০ জন। প্রায় ১১,৮১,২১৩টি কৃষি পরিবারের মোট ফসলি জমি প্রায় ১২,৫৬,৮৫৭ হেক্টর। ভূমির বিচিত্র লীলায় রয়েছে হাজারও পাহাড়-টিলা এবং হাওর-বাঁওড়ের সংখ্যা প্রায় ২১৮টি। এ অঞ্চলে আবাদি জমির শতকরা ৪০ ভাগই হাওর এলাকা যেখানে অসংখ্য ছোট বড় হাওর, বিল আর প্রাকৃতিক জলাধার আছে। বিশ্ব খ্যাত হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর এ সিলেট অঞ্চলেই অবস্থিত। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১২৭টি চা বাগান রয়েছে এ সিলেট অঞ্চলে। শস্য খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ অঞ্চল তবে শাকসবজি উৎপাদনে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখনও অনেক পেছনে। কৃষি পরিবেশ অঞ্চলেরও রয়েছে এক বিচিত্রতা মোট ৬টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল যথা এইজেড ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৯ এবং ৩০ ভুক্ত এ অঞ্চল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল সিলেট। সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য সূত্রে ২০১৬ সালে এ অঞ্চলে মোট বৃষ্টিপাত ছিল ৭,৮৫৩ মিমি.। এ অঞ্চলের মাটির কথা কি আর বলব, এ অঞ্চলের মাটিরও রয়েছে বৈচিত্রতা। টিলা, পাহাড় এবং সুরমা অববাহিকা হওয়ায় বেশিরভাগ মাটিই অম্লীয় মাটি। অনেকাংশে অম্লীয় মাত্রা পিএইচ স্কেলে ৪.০০ এর নিচে। মাটির গঠনেও রয়েছে ভিন্নতা। ধানভিত্তিক ফসল ধারায় স্বল্পমেয়াদি অন্যান্য ফসল সমন্বয় করে যথাযথ পরিকল্পনা ও উপযোগী কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে সিলেট অঞ্চলে তাই প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষির রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
একনজরে সিলেট অঞ্চলের কৃষির হালচাল
সিলেট অঞ্চলের মানুষের মূল উপজীব্য বিষয় কৃষি হওয়া সত্ত্বেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটের কৃষি এখনও অনেক পেছনে। সিলেট অঞ্চলে নিট ফসলি জমি প্রায় ৭,৯৭,৯৪৯ হেক্টর। জেলাওয়ারি নিট ফসলি জমির পরিমাণ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জে যথাক্রমে ২,১৪,৩৩৩ হেক্টর, ১,২৬,৬৮২ হেক্টর, ১,৮০,৫০০ হেক্টর এবং ২,৭৬,৪৩৪ হেক্টর। সিলেট অঞ্চলে এক ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৩,৭২,৪৫০ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৩,৩৩,৬৫৩ হেক্টর, তিন ফসলি জমির পরিমাণ মাত্র ৮৩,০০০ হেক্টর এবং তিনের অধিক ফসলি জমির পরিমাণ একবারেই নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ফসলের নিবিড়তা ১৯৭ শতাংশ। অথচ সিলেট অঞ্চলের শস্যের নিবিড়তা মাত্র ১৬৮%। যার মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলার ফসলের গড় নিবিড়তা যথাক্রমে ১৭৪%, ১৭৮%, ১৭২% এবং ১৪৯%। এ অঞ্চলে মোট কৃষক পরিবার প্রায় ১১,৮১,২১৩টি, এর মধ্যে ভূমিহীন পরিবার প্রায় ২,৩৪,০৬৩টি, প্রান্তিক চাষি প্রায় ৫,২১,৬৯২টি, ক্ষুদ্র চাষি প্রায় ২,৩০,৫২৮টি, মাঝারি ১,৫০,৮৭৩টি এবং বড় কৃষক পরিবার প্রায় ৪৪,০৫৭ টি। সিলেট অঞ্চলে মৌসুমি পতিত জমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রবি মৌসুমে প্রায় ১,৬৪,১৬৮ হেক্টর, খরিফ-১ এ প্রায় ১,৮১,৭২৫ হেক্টর এবং খরিফ-২ এ প্রায় ৫১,৫০১ হেক্টর জমি পতিত থাকে। খাদ্য পরিস্থিতির বিবেচনায় এ অঞ্চল শস্য খাদ্যে উদ্বৃত্ত- ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৯,৩৭,০৯১ মেট্রিক টন শস্য খাদ্য বেশি উৎপাদিত হয়েছিল।
এ অঞ্চলের প্রধান প্রধান শস্যবিন্যাস
প্রধান প্রধান শস্যবিন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বোরো-পতিত-পতিত (৩৪%), বোরো-পতিত রোপা আমন (১৭%), পতিত-আউশ-রোপা আমন (১২%), পতিত-পতিত-রোপা আমন (১০%), বোরো-আউশ-রোপা আমন (৪%), বোরো-বোনা আমন-রোপা আমন (৪%), সবজি-পতিত-রোপা আমন (৩%), সবজি-সবজি-সবজি (৩%), সরিষা+বোরো-পতিত-রোপা আমন (৩%), এসব।
সিলেট অঞ্চলের কৃষিতে প্রধান প্রধান সমস্যা
বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের কৃষি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষিজীবী মানুষের জীবন জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। অতিবৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে সর্বনাশা আগাম ও নাবি বন্যা কৃষকের জন্য আতঙ্কের বিষয়। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি ঢলে নদী ভরাট হওয়ায় নদীতে পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে খ- খ- বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফসলহানী হওয়া। ভূ-গর্ভস্থ পাথর, বালি ও গ্যাসের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনে অপরাগতা। শীত মৌসুমে নদী ও খালের পানি দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কাজ পরিচালনা ব্যাহত হওয়া। রবি মৌসুমে পতিত জমিতে গো-চারণের উপদ্রব। প্রবাসী মালিক ফলে অনেক সময় জমি বর্গা চাষে দিতে অনীহা। চা বাগানের অন্তর্গত টিলা জাতীয় জমি অনাবাদি থাকা। আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষাকল্পে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উফশী জাত ও সময়মতো বীজের অভাব। নদীর পাড় ও বাঁধ থেকে হাওরের জমি অত্যন্ত নিচু বিধায় পানির চাপে নদীর পাড় উপচিয়ে ও বাঁধ ভেঙে স্বল্প সময়ের মধ্যে মাঠের ফসল ডুবে যাওয়া। হাওর এলাকায় দেরিতে পানি সরার কারণে সঠিক সময়ে বোরো বীজতলা ও চারা রোপণ বিলম্বিত হওয়া। শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা, বোরো ধান সংগ্রহের সময় বৃষ্টিপাত হয় বিধায় ধান শুকানো সমস্যা, হাওর এলাকায় ফসলের মাঠ বাড়ি হতে দূরবর্তী স্থানে হওয়ায় কৃষি উপকরণসহ নিয়মিত জমি পরিদর্শন সমস্যা। তাছাড়া অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেচ ও নিষ্কাশনের অপ্রতুলতা, শ্রমিক সংকট।
সিলেট অঞ্চল উপযোগী ফসল ও জাত
ধান ফসলের জন্য প্রথমে আমন ধানের আগাম জাতের মধ্যে রয়েছে বিনাধান৭, বিনাধান১৭, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২ এসব জাত। মধ্যম মেয়াদি আমন ধানের জাতের মধ্যে আছে ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১ এবং ব্রি ধান৪৯ এবং নাবি জাত হিসেবে বিআর২২, বিআর২৩, বিনাশাইল, নাইজার শাইল এসব। অধিক ফলনশীল মাঝারি থেকে মোটা চালের জন্য বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১ চাষ করা যায়। সুগন্ধি চালের জন্য ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮ চাষ করা যায়। বন্যার পানি বা জলমগ্নতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২ এবং বিনাধান১১, বিনাধান১২ চাষ করা যায়। তবে সিলেট এলাকার জন্য ব্রি ধান৪৯ এবং বিআর১১ খুবই উপযোগী। বোরো ধানের উপযোগী জাতগুলো-উফশী জাত : ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮ এসব। হাওর এলাকায় বোরো ধানের জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৫৮ এবং বিনাধান-১০ চাষ করা খুবই উপযোগী। হাওর এলাকায় আগাম আকস্মিক বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রি ধান২৯ চাষ না করাই উত্তম। আউশ মৌসুমে উফশী ধান বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮ উল্লেখযোগ্য। সর্বোপরি এ এলাকায় সুগন্ধি ধান উৎপাদনের একটি বিশাল সুযোগ রয়েছে।
গম ফসলের মধ্যে বারি গম-২৪, বারি গম-২৫ এবং বারি গম-২৬ চাষ সম্প্রসারণ করা যায়। তেল ফসলের ক্ষেত্রে সরিষা (বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭ এসব), সয়াবিন, বাদাম, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী, তিল, তিসি; মসলা জাতীয় মরিচ, হলুদ; সবজি হিসেবে করলা, লাউ, বেগুন, টমেটো, শসা, মটরশুঁটি, ঢেঁড়শ, মিষ্টিকুমড়া; ফল চাষ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে খাটো জাতের নারিকেল, মাল্টা, আমড়া, থাই পেয়ারা, কাউফল, ডেউয়া, কুল, সফেদা, আমলকী, লটকন, তৈকর, আম, জাম, বাতাবিলেবু, তরমুজ, বাঙি লাগানো যায়। তাছাড়া অন্যান্য ফসল চুইঝাল, সাতকরা, গোলমরিচ, নাগামরিচ, লাইশাক, গাছ আলু, খাসিয়া পান, সুপারি, ফরাস, লতিকচু, চাষ বেশ উপযোগী। তাছাড়াও রয়েছে বেত, মূর্তা এসবের চাষ।
সিলেট অঞ্চলভিত্তিক উপযোগী প্রযুক্তিগুলো
এ এলাকার জন্য উপযোগী প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে প্রথমে হচ্ছে ডলোচুনের ব্যবহার-সিলেট এলাকার অম্লীয় মাটি দূর করার জন্য শতাংশ প্রতি ০৪ কেজি হারে ডলোচুন ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে, একবার ডলোচুন প্রয়োগ করলে পরবর্তী তিন বছর আর একই জমিতে ডলোচুন দিতে হয় না। ধান চাষে প্রযুক্তি- আমন মৌসুমে বন্যা সহনশীল জাতের ধান ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২ এবং বিনাধান১০, বিনাধান১২ চাষ করা। হাওর এলাকায় বোরো ধানের জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৫৮ এবং বিনাধান১০ চাষ করা খুবই উচিত। আউশে ব্রি ধান৪৮ চাষাবাদ করা। সবজি চাষে গোলাপগঞ্জ মডেল- সবজি বাগানের চারটি বেডে সারা বছর উৎপাদনের চারটি সবজি বিন্যাস অনুসরণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রথম বেডে : টমেটো অথবা মুলা পরবর্তীতে ডাঁটা তারপর গিমাকলমি, দ্বিতীয় বেডে : লালশাক অথবা বাঁধাকপি এরপর ডাঁটা তারপর ঢেঁড়শ, তৃতীয় বেডে : বেগুন বা লালশাক তারপর পুঁইশাক এবং তারপরে গিমাকলমি সবশেষে চতুর্থ বেডে : ফরাস শিম তারপর লালশাক পরবর্তীতে পুঁইশাক বা বরবটি চাষ করে সারা বছর বাড়ির আঙিনা থেকে শাকসবজি সংগ্রহ করা যায়। সম্পূরক সেচ ব্যবস্থাপনা-সিলেট অঞ্চলে রবি ফসলের সময় পানির অভাব দেখা দেয়, ফলে পরিকল্পিত উপায়ে ছড়া বা পুকুর কেটে পানি সংরক্ষণ করে সম্পূরক সেচ প্রদান করার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। টিলায় ফলবাগান স্থাপন, আম ধানের সাথে মিষ্টিকুমড়ার রিলে শস্য চাষ, বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, বসতবাড়িতে ফল বাগান স্থাপন, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা- হাওর এলাকায় একমাত্র ফসল বোরো ধান, পাশাপাশি কৃষকের হাস চাষ, গবাদিপ্রাণী লালন পালন, হাঁস-মুরগি পালন করেও আয় রোজগার করতে পারে। বস্তা পদ্ধতিতে ফল ও সবজি চাষ, জলাবদ্ধ এলাকার জন্য ভাসমান সবজি চাষ, মালচিংয়ের মাধ্যমে ফসল চাষ, বিনাচাষে ফসল উৎপাদন, আন্তঃফসল হিসেবে হলুদ, আদার চাষ; ভার্মিকম্পোস্ট, সবুজ সার, খামারজাত সার, সেক্স ফেরোমেন ট্র্যাপ, ফিতা পাইপ পদ্ধতিতে সেচ, স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রদান, রাবার ড্যাম, খাল ও নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ এসব। তাছাড়া পলিথিন সেচ বা পানি দিয়ে বোরো বীজতলা শৈত্যপ্রবাহ থেকে রক্ষা করা।
উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি
এলাকা উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে পাওয়ার টিলার, রিপার, বেড প্লান্টার, পাওয়ার থ্রেসার, প্যাডেল থ্রেসার, কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রাইস রিপার, ফুট পাম্প, স্প্রেয়ার। তাছাড়া মাটির অম্লত্ব পরিমাপের জন্য যন্ত্র পিএইচ মিটার, আবহাওয়াগত তথ্য প্রাপ্তির জন্য আবহাওয়া ডিসপ্লেবোর্ড, বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য বজ্রপাত এরেস্টার, আপেক্ষিক আর্দ্রতামাপক যন্ত্র, বীজ সংরক্ষণের জন্য ড্রামের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটার জন্য রাইস রিপার, মিনি কম্বাইন্ড হারভেস্টার খুবই উপযোগী তাছাড়া সময়মতো ধান শুকানোর জন্য ভাসমান মাড়াই স্থান/খলা (ফ্লোটিং থ্রেসিং ফ্লোর) সহ ড্রায়ার ব্যবস্থাপনা।
সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য কর্মসূচিভিত্তিক সুপারিশ
পাহাড়, টিলা ও বসতবাড়িতে ফল বাগান স্থাপন করা, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজি আবাদ করা, অপ্রচলিত ফলের (কাউফল, ডেউয়া, লটকন, বাতাবিলেবু, শরিফা, তৈকর) আবাদ সম্প্রসারণ করা, তাছাড়া (খাটো জাতের নারিকেল, আমড়া, পেয়ারা, মাল্টা, সফেদা) বাগান তৈরি করা, উচ্চমূল্যের ফসলের (গ্রীষ্মকালীন টমেটো ও শিম, কুল, কলা, সুপারি, পান, সূর্যমুখী) আবাদ সম্প্রসারণ করা, বসতবাড়ির আঙিনায় গোলাপগঞ্জ মডেল অনুসরণ করে সবজি উৎপাদন করা, হাওরাঞ্চলে সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রম (সবজি চাষ, হাস পালন, গবাদিপ্রাণী পালন) চালু করা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কম্পোস্ট সার ও ডলোচুনের ব্যবহার নিশ্চিত করা, ডিএপি ও এমওপি সারের ব্যবহার বাড়ানো, রাস্তার দুই ধারে তাল, খেজুর, সজিনা বাগান তৈরি করা, জলাবদ্ধ স্থানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাসমান বেডে সবজির চারা এমনকি সবজি উৎপাদন, পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ওয়াটার রিজার্ভার, বিল, খাস পুকুরসহ অন্যান্য জলাশয় খনন করে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য আগাম জাত চাষাবাদ নিশ্চিত করা ও বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও প্রয়োজনীয় স্লুইস গেট স্থাপন করা, পলিথিন সেচ ও পানি দিয়ে বোরো বীজতলাকে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা থেকে রক্ষা করা, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, রিপার, পাওয়ার থ্রেসার ও ড্রায়ার যন্ত্রসহ অন্যান্য যন্ত্রগুলো সহজীকরণ ও সহজলভ্যকরণ করা, হাওর এলাকায় সাবমার্সিবল রোড নির্মাণ, দূরবর্তী স্থানে থ্রেসিং ফ্লোর এবং গুদাম ঘর তৈরি করা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমাগার তৈরি করা, ফসল/ফল/সবজি সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ সহায়ক কার্যক্রম এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংযোগ সৃষ্টি করা, কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও ঋণ প্রাপ্তি সহজলভ্যকরণ; সেচের জন্য ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার এসব। পতিত জমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে আউশ আবাদ বৃদ্ধি করা, প্রবাসী মালিকাধীন জমিগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা। বোরো ধান রোপণ ও কর্তনের সময় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করা। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রয়োজন মাফিক দক্ষ জনবল নিশ্চিত করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সম্ভাবনাময় সিলেট অঞ্চল
পতিত জমি, পাহাড় টিলায় ফলবাগান স্থাপন, বসতবাড়ির আঙিনায় ফল ও সবজি চাষ সম্প্রসারণ, স্বল্প পানির চাহিদা সম্পন্ন ফসলের আবাদ বাড়ানো, উচ্চ মূল্যের ফসলের চাষাবাদ সম্প্রসারণ, স্থানীয় ফসলের জাতগুলোর উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রায়োগিক কার্যক্রম গ্রহণ করা, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন, পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, আউশ ধানের আবাদ বৃদ্ধি, সমতল ভূমির জন্য বিশেষ ফসল যেমন ভুট্রা, ফরাস, লতিকচু, হলুদ, আদা, ডাল, শাকসবজি, কচু, ক্যাপসিকাম, নাগামরিচ, তরমুজ, কলা, গোলআলু, মিষ্টিআলু ফসলের আবাদ সম্প্রসারণ সিলেট এলাকার কৃষি ব্যবস্থায় উন্নয়নের সম্ভাব্য সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া হাওর এলাকার জন্য রবি সবজি, চিনাবাদাম, গর্জন, তিল, তিসি, তরমুজ এসব ফসল এবং পাহাড়ি ও টিলায় কমলা, মাল্টা, বাহারি রকমের লেবু, জারালেবু, সাতকরা, লিচু, আনারস, আদা, হলুদ, পেয়ারা এসব ফসল আবাদ করা যায়। যার ফলে পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহারসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজিত কৃষি প্রযুক্তিগুলো সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব।
জমি পতিত রাখা নাকি অপরাধের তালিকায় পড়ে। তাছাড়া বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের তাগিদ রয়েছে জমিকে চাষের আওতায় আনার। চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ সিলেট অঞ্চলের রয়েছে। হাওর অঞ্চলকে বিশেষ নজরে নিয়ে অম্লীয় মাটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নব উদ্যোগে নব কৌশলে সিলেটের কৃষিকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণের সমন্বিত উদ্যোগ। (তথ্যসূত্র : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েবসাইট এবং কৃষক কর্তৃক ধারণালব্দ জ্ঞান)।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
কৃষি প্রধান আমাদের এই বাংলাদেশ। কৃষি ও কৃষকের ওপর নির্ভর করে খাদ্য নিরাপত্তা। ষড়ঋতুর এ দেশে আজ আর ছয়টি ঋতু দেখা যায় না। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা এই তিন ঋতুতে যেন আটকে গেছে দেশ। কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রায় সারা বছর সব ধরনের ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এরই ফলশ্রুতিতে বর্ষার সবজি গ্রীষ্মে, আর গ্রীষ্মের সবজি শীতে পাওয়া যাচ্ছে, শুধু প্রয়োজন একটু নিষ্ঠা ও সচেতনতা। এতে যেমন আমাদের উদ্ভিজ পুষ্টি চাহিদা মিটছে তেমনই কৃষি ও কৃষক অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
অর্থকরী ফসল হিসাবে ভুট্টার কথাই ধরা যাক, সারা বছরই চাষ করা যায় এ ফসলটি। ফাল্গুন মাসে সরিষা ও আলু তোলার পর অনেক কৃষক জমিতে ধান চাষ করতে আগ্রহী হয়ে পরেন। এ সময়ে ধান চাষে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের কৃষক ভাইদের। চারার বয়স বেশি হয়ে যাওয়াতে বীজতলায় কিছু পোকা আক্রমণ ও রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে, যা মূল জমিতে চারার সাথে বয়ে নিয়ে যায়। এতে চারা অবস্থায় ধান গাছের বৃদ্ধি যেমন বাধাগ্রস্ত হয় তেমনই নানারকম বালাইয়ের আবির্ভাব হয়ে থাকে। কৃষক তখন আগাছা দমনের সাথে সাথে বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন করতে না পারায় বা স্টাবলিশমেন্ট অবস্থায় অধিক বালাইনাশক ব্যবহার করায় একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে অন্যদিকে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে এ সময়ে কৃষক তার চাহিদা মতো চারা পান না আবার ফেলেও মূল জমিতে অধিক বয়সের চারা রোপণের ফলে কৃষক তার কাক্সিক্ষত ফলনও পাচ্ছেন না। এসব ঝামেলা এড়িয়ে সচেতন কৃষক যদি ভুট্টা আবাদের দিকে মনোনিবেশ করেন তাহলে একদিকে যেমন ঝামেলাবিহীন উৎপাদন নিশ্চিত হবে অন্যদিকে উৎপাদন খরচও নিয়ন্ত্রণ করে অধিক ফলন পেতে পারেন। আলু চাষে কৃষক যথেষ্ট পরিমাণে সার ব্যবহার করে থাকেন তাতে পরে ওই জমিতে ভুট্টা চাষ করলে সারের পরিমাণ যেমন কম লাগে তেমনই লিচিং হওয়া খাদ্য উপাদান ভুট্টা গাছের গভীর মূল দ্বারা গৃহীত হয়। এ সময়ে ভুট্টা চাষে, ভুট্টা গাছের জীবনকালও কমে আসে তাই খেয়াল রাখতে হবে জীবন চক্রের পাঁচটি ধাপে যেন জমিতে রসের অভাব না হয়। ধাপ পাঁচটি হলো ১. চারা অবস্থায় (৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সে ৪-৬ পাতা পর্যায়), ২. হাঁটু উচ্চতায় (৫০ থেকে ৫৫ দিন বয়সে ৮-১২ পাতা পর্যায়), ৩. টাসেলিং অবস্থায় (৭০ থেকে ৭৫ দিন বয়সে মাথায় ফুল/পরুষ ফুল আসা পর্যায়), ৪. সিল্কিং অবস্থায় (৮০ থেকে ৮৫ দিন বয়সে মোচা বা মহিলা ফুল আসা পর্যায়), ৫. দানা পরিপূর্ণতা হওয়ার সময় (১০০ থেকে ১১০ দিন বয়সে)। এবার একটু দেখা যাক ভুট্টার পুষ্টিগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে।
ভুট্টার বিভিন্ন অংশ |
আমিষ (%) |
চর্বি (%) |
শর্করা (%) |
আঁশ (%) |
ক্যালসিয়াম (গ্রাম/১০০কেজি) |
ফসফরাস (গ্রাম/১০০ কেজি) |
ভুট্টার কচি পাতা |
১১.১ |
১.১ |
৪৪.২ |
২৯.৬ |
৬৮০ |
২১০ |
ফুল আসার সময়ের পাতা |
৬.৪ |
০.৯ |
৫১.২ |
২৯.৯ |
৬১০ |
১৯০ |
দানা পুষ্ট হওয়ার সময়ের পাতা |
৫.১ |
১.৫ |
৫৯.২ |
২৬.৯ |
৪৯০ |
১৯০ |
ভুট্টার হলুদ দানা |
১২.১ |
- |
৭৯.৬ |
১.৪ |
২০ |
৩৬০ |
ভুট্টার সাদ দানা |
১০.৬ |
- |
৮১.৪ |
১.৯ |
২০ |
৩৬০ |
ভুট্টার মোচা |
২.১ |
- |
৫৬.৪ |
- |
৫০ |
৬০ |
ভুট্টার পুষ্টি মূল্য
ভুট্টার ব্যবহার
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভুট্টা মানুষের প্রধান খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হলেও আমাদের দেশে তা এখন সেই পর্যায় যায়নি। ব্যবহার মধ্যে রয়েছে যেমন- মানুষের খাবার- পরটা, লুচি, খিচুরি, রুটি, মোয়া, নাড়– এবং পোড়া ও সিদ্ধ মোচা। ভুট্টার পাতা গবাদিপশু পাখিকে খাওয়ানো যায় আর দানা মোরগ-মুরগির সুষম খাবার যা বর্তমানে পোলট্রি ও ফিশ ফিড তৈরিতে প্রধান কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভুট্টার গাছ ও পাতা ঘরের ছাউনি ও বেড়ায় ব্যবহার করা যায় এবং অবশিষ্টাংশ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
সর্বোপরি আমাদের দেশে ফসলের উৎপাদন খরচ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একমাত্র ভুট্টা ফসল আবাদ করে কৃষক কখনও ক্ষতির সম্মুখীন হন নাই। শুধু নিয়মতান্ত্রিক চাষাবাদ ও সঠিক সেচ ব্যবস্থপনাই ভুট্টা ফসলের অধিক ফলন কৃষকের ঘরে আসে, তাতে কৃষি ও কৃষকের জীবনমানের উন্নয়ন আসবে।
কৃষিবিদ খন্দকার ইয়াছিন মোহাম্মদ শওকত*
*প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ
মাল্টা সাইট্রাস পরিবারভুক্ত একটি বিদেশি ফল। কমলা আর বাতাবি লেবুর সংকরায়ণে এ ফলের সৃষ্টি। এর ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। হিন্দিতে সান্তারা। অন্য ভাষায় ভিন্ন নাম। এর আদি উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। রোগির পথ্য হিসেবে মাল্টা হিতকর। খেতে সুস্বাদু। দারুণ গন্ধ। মাল্টায় পুষ্টিতে ভরপুর। পুষ্টিবিদদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে (আহারোপযোগী) ২০০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি আছে প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম। অন্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২ এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিগ্রাম, ১ মিলিগ্রাম, ০.২ মিলিগ্রাম, ৪০ মিলিগ্রাম, ০.৮ মিলিগ্রাম, ০.১১৩ মিলিগ্রাম, ০.০৪৬ মিলিগ্রাম এবং ২০০ কিলোক্যালরি। এতে কিছু ঔষধিগুণও আছে। সর্দিজ্বর কমাতে মাল্টা বেশ উপকারী। এর খোসা দিয়ে প্রসাধনী তৈরি হয়। এছাড়া ওষুধ শিল্পেও ব্যবহার হয়। বিশ্বে ফলটি বেশ জনপ্রিয়। তেমনি এদেশেও। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, কমলা লেবুর তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি। তাই চাষের জন্য পাহাড়ি এলাকা উৎকৃষ্ট। তবে হালকা লবণ মাটিতে এর মিষ্টতা এবং ফলন ভালো। এমনি প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় পিরোজপুর সদরের বেশ কয়টি গ্রামে। ওখানে ছোট-বড় দুই শতাধিক বাগান রয়েছে। ভরা মৌসুমে থোকায় থোকায় ধরা ফলগুলো দেখলে কার না ভালো লাগে! শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, ফলগুলো প্রচুর মিষ্টি এবং রসালো। এসব গুণের কথা শুনে দক্ষিণের অন্য জেলাগুলোতেও নতুন নতুন বাগান স্থাপন হচ্ছে। এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো অঞ্চলে। তাই বলতেই হয়; মাটি, পানি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দক্ষিণাঞ্চল মাল্টা চাষের বিরাট সম্ভাবনাময়।
জলবায়ু
শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য উত্তম। বায়ুর আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। অতি বৃষ্টিতে ফল বেশি রসালো হয়। এছাড়া খোসা পাতলার পাশাপাশি গুণগতমান হয় নিম্ন। রোগ-পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। তবে শুষ্ক আবহাওয়া ফলের স্বাদ ও মানকে করে উন্নত।
মাটি
মাল্টা প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মে। তবে ছায়া পড়ে না এমন সুনিষ্কাশিত উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। মাটির অম্লত্ব ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া উত্তম। মাল্টাগাছ লবণ এবং উচ্চ তাপমাত্রা সংবেদনশীল। জলাবদ্ধতার সহ্যক্ষমতা নেই।
জাত
দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাত রয়েছে। তবে এদেশে চাষ উপযোগী জাতের মধ্যে বারি মাল্টা-১ অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এ জাতটি উচ্চফলনশীল। গাছের ডালপালা ছড়ানো এবং ঝোপানো থাকে। মধ্য ফাল্গুন (মার্চ) থেকে মধ্য চৈত্রে (এপ্রিল) ফুল আসে। ফল পাকে কার্তিক মাসে। ফল দেখতে সবুজ। তবে পরিপক্ব অবস্থায় কিছুদিন রেখে দিলে কমলা রঙ ধারণ করে। ফলের নিচে ছোট গোলাকার চিহ্ন থাকে। প্রতিটির ওজন প্রায় ১৫০ গ্রাম। ফলের শাসের রঙ হালকা হলুদ। গাছপ্রতি ফল ধরে ৩০০ থেকে ৪০০। সে হিসেবে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২০ টন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম এফটিআইপি বাউ মাল্টা-১। প্রতিটি ফলের ওজন ১৭০ হতে ২০০ গ্রাম। মিষ্টতা ১৭-২১ টি.এস.এস.। গাছ বামনাকৃতি। বিচি কম হয়। ফল রসালো ও মিষ্টি। মার্চএপ্রিল মাসে ফুল আসে। সেপ্টেম্বরÑঅক্টোবরে ফল পাকে।
কলম
বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার বংশবিস্তার হয়। তবে মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রুত ফল ধরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। জোড় কলম (গ্রাফটিং) ও চোখ কলমের (বাডিং) মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। জোড় কলমের জন্য রুটস্টক (আদি জোড়) নির্বাচন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাতাবি লেবুর চারা ব্যবহার উত্তম। এরপর মাতৃগাছ হতে সায়ন (উপজোড়) সংগ্রহ করে রুটস্টকের ওপর স্থাপন করে গ্রাফটিং তৈরি করা হয়। আদি জোড়ের জন্য এক থেকে দেড় বছরের সুস্থ, সতেজ এবং সোজা চারা বেছে নিতে হবে। সায়নে অবশ্যই কমপক্ষে দুইটি চোখসহ ২/৩ ইঞ্চি লম্বা থাকা চাই। এছাড়া ডালের বয়স যেন ৮/৯ মাস হয়। সাধারণত ১০-১২ দিন পর সংযোগস্থলে জোড়া লাগে। তখন সায়নের সুপ্ত কুঁড়ি থেকে পাতা বের হয়। একাধিক ডাল বের হলে ভালোটি রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হবে। কলমের নিচের অংশে কোনো কুঁড়ি বা ডাল যেন না থাকে। মধ্য বৈশাখ হতে মধ্য ভাদ্র (মে-আগস্ট) গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময়।
চারা প্রাপ্তিস্থান
চারা অবশ্যই মানসম্মত হওয়া চাই। চাষাবাদের ক্ষেত্রে অন্য সব কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হলে ও জাত নির্বাচন ভুল হলে কাক্সিক্ষত ফলন হবে না। তাই নিশ্চিত হয়েই চারা ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান হর্টিকালচার সেন্টার এবং বেসরকারি বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা উত্তম।
রোপণ পদ্ধতি
ষড়ভুজ এবং বর্গাকার উভয় পদ্ধতিতে চারা লাগানো যায়। সারা বছরই রোপণ করা যেতে পারে। তবে বর্ষা মৌসুমে উত্তম। চারা লাগানোর আগে মাদা তৈরি করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে গর্তের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা (গভীরতা) হবে ৭৫ সেন্টিমিটার (৩০ ইঞ্চি) করে। গর্তপ্রতি ১৫ কেজি পচা গোবর কিংবা অন্য জৈব সার, সেই সাথে ৫ কেজি কাঠের ছাই এবং রাসায়নিক সার হিসেবে টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ গ্রাম, বরিক এসিড ৫ গ্রাম ও চুন দিতে হবে ৫০০ গ্রাম হারে। সম্পূর্ণ সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরে দিতে হবে। ১৫ থেকে ২০ দিন পর গর্তের মাঝখানে সোজা করে চারা রোপণ করতে হবে। গাছ লাগানোর পর চারাটি শক্ত খুঁটি সাথে সামান্য ঢিলে করে বেঁধে দিতে হবে, যেন ঝড়ে হেলে না পড়ে।
সার ব্যবস্থাপনা
গাছের বৃদ্ধি এবং কাক্সিক্ষত ফল ধারণের জন্য বছরে তিন বার সার দেয়া দরকার। বর্ষার আগে মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্রে এবং মধ্য বৈশাখ হতে মধ্য জ্যৈষ্ঠে। বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশি^ন মাসে। দুপুরবেলায় মাটিতে গাছের ছায়া যতটুকু পড়ে ততোটুকু স্থানে ৬ ইঞ্চি গভীর করে ভালোভাবে কুপিয়ে সার দেয়া উত্তম। অথবা গাছের গোড়া হতে ১ ফুট বাদ দিয়ে এরপর ৪ ফুট পরিমাণ জমি বৃত্তাকারে অনুরূপভাবে কুপিয়ে দিলেও হবে। সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয়। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। তাই বয়সভেদে যে পরিমাণ জৈব ও অজৈব সার দেয়া প্রয়োজন তা হলো-
আগাছা পরিষ্কার
আগাছা খাবারে ভাগ বসায়। ক্ষতিকর পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার হয়। তাই বাগান সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়া হতে একটু দূরে শুকনো লতাপাতা, খড়, কুটা বিছিয়ে মালচিংয়ের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। এতে আগাছা জন্মাবে না। মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
খাদ্য তৈরির জন্য পানি গাছের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। সেজন্য শীত মৌসুমে এবং অন্য সময় খরা দেখা দিলে গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। তেমনি বর্ষার পানিতে জলাবদ্ধতা যেন না হয়, সেজন্য দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফল পাতলাকরণ
কোনো কোনো কলমের গাছে প্রথম বছরে ফল আসতে পারে। তবে পরপর দুই বছর ফুল ভেঙে দেয়া উত্তম। এতে গাছের কা- মোটা হয়। ফলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরিণত বয়সে প্রতিটি গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল ধরে। পুরো ফল রাখা হলে এর আকার ও গুণগতমান হ্রাস পায়। তাই প্রতি বোঁটায় দুইটি রেখে অবশিষ্ট ফল ছোট (মার্বেল আকৃতি) অবস্থায় ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
ব্যাগিং
ব্যাগিং ফলের জন্য আশীর্বাদ। চীনে উৎপাদিত এ ব্যাগ এখন আমাদের দেশেও পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটির মূল্য আড়াই থেকে তিন টাকা। ব্যাগিং করলে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ হয় না। তাই ফল পরিপক্বতার আগেই ছত্রাকনাশক (টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলিলিটার/১ লিটার) প্রয়োগ করে ব্যাগিং করতে হবে। এর কিছু বাড়তি সুবিধাও আছে। যেমন-পাতার ঘর্ষণ থেকে ফলকে রক্ষা করে। তীব্র সূর্যকিরণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিভিন্ন পাখি এবং বাঁদুরের উপদ্রব হয় না। ফল নিরাপদ হয়। পরিবেশ ভালো থাকে। বাজার মূল্য পাওয়া যায় বেশি। এ ব্যাগ দুই-তিন বছর ব্যবহার করা যায়। দেশীয় পদ্ধতিতে পলিথিন, কাপড় কিংবা বাটার পেপার দিয়ে ব্যাগিং করা যেতে পারে।
বালাই ব্যবস্থাপনা
মাল্টা ফসলে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় এবং রোগের আক্রমণ হতে পারে। পোকার মধ্যে সাইলিড সবচেয়ে ক্ষতিকর। এছাড়া রয়েছে পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা, খোসা পোকা, উঁইপোকা। রোগগুলো হলো আগামরা রোগ, গ্রিনিং, ক্যাংকার এবং আঠাঝড়া।
সাইলিড পোকা : পোকার বাচ্চা গাছের পাতা, পাতার বোঁটা, কচি ডগা এবং ফলের রস চুষে খায়। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। রস চোষার সময় এরা গাছের রসের মধ্যে গ্রিনিং রোগের ভাইরাস ছড়ায়। সেইসাথে মিষ্টি আঠালো পদার্থ নির্গত করে। প্রতিকার হিসেবে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা বা ডাল অপসারণ করতে হবে। মে মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক যেমনÑঅ্যাডমায়ার বা ফেনিট্রথিয়ন জাতীয় কীটনাশক যেমন-সুমিথিয়ন ২ মিলিলিটার/লিটার পানিতে মিশিয়ে মাল্টা গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। তাহলে ডিম ও পোকা থাকলে ধ্বংস হবে। গ্রিনিং রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা : এ পোকা ছোট অবস্থায় (কীড়া) মাল্টা পাতায় আক্রমণ করে। এরা রাতের বেলা গাছের কচি পাতায় গর্ত খুঁড়ে আঁকা বাঁকা দাগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে হয়। তামাক নির্যাস ও সাবান গোলা পানি স্প্রে করা যেতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে ইটাপ ৫০ এসপি ১.২০ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
ফলের মাছি পোকা : এ পোকার আক্রমণে ফল নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করা সম্ভব।
মাকড় : এক ধরনের ক্ষুদ্র মাকড়ের কারণে গাছের পাতা নিচের দিকে কুঁকড়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে ভার্টিম্যাক অথবা ইকোম্যাক ১ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
আগামরা রোগ : এ রোগ দেখা দিলে পুরো গাছ বা গাছের ডাল আগা থেকে শুরু করে ক্রমে নিচের দিকে মরে যায়। রোগটি ছত্রাকের আক্রমণে হয়। প্রতিকার হিসেবে কিছুটা সুস্থ অংশসহ আক্রান্ত স্থান কেটে পুড়ে ফেলা এবং কর্তিত অংশে বোর্দোমিশ্রণ বা নোইন (ছত্রাকনাশক) ২ গ্রাম/লিটার অথবা কুপ্রাভিট ৭ গ্রাম/ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গ্রিনিং রোগ : এ রোগে পাতার মধ্যশিরা হলদে হয়ে যায় এবং শেষ পর্যায়ে হলুদাভ রঙ ধারণ করে। শিরা উপশিরাগুলো ক্রমশ গাঢ় সবুজ হতে থাকে, শিরা দুর্বল ও পাতা কুঁকড়ে যায়। এটি ভাইরাসজনিত রোগ। সাইলিড পোকা এর বাহক। তাই পোকা দমন (ব্যবস্থাপনা আগে দেয়া আছে) করতে হবে। আক্রান্ত হলে অন্য গাছে রোগ যেন না ছড়ায় সেজন্য গাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ফল সংগ্রহ
পরিপক্ব অবস্থায় মাল্টা সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহের সময় ফল যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ফলের আকার অনুযায়ী গ্রেডিং করা উত্তম। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে প্যাকেট করে বাজারজাত করতে হবে।
‘ফল খাই বল পাই’ এ কথা সবাই জানি। তারপরও প্রয়োজনমতো খাওয়া হয় না। অসচেতনতা আর প্রাপ্তির অভাবই এর কারণ। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছেশক্তি এবং পরিকল্পনা। আপনার পছন্দমতো যে কোনো ফল বাগান তৈরি করতে পারেন। চাষাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পাশে আছেন উপজেলা কৃষি অফিসার, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তাই আসুন, প্রতিটি বসতবাড়িতে অন্য ফলের পাশাপাশি দুই-চারটি হলেও মাল্টার গাছ লাগাই। এ ব্যাপারে অপরকেও করি উৎসাহিত।
নাহিদ বিন রফিক*
*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর : ০১৭১৫৪৫২০২৬
আখ আমাদের দেশের খাদ্য ও শিল্পে ব্যবহার্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। চিনি, গুড় ও চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আখ ফসল চাষ করা হয়ে থাকে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা জমিতে প্রায় ১৩-১৪ মাস থাকে। দেশে খাদ্যাভাব যখন কম ছিল, তখন আখ চাষ বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু দিন দিন খাদ্য শস্যসহ অন্যসব জিনিসের বাজারমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। অথচ তুলনামূলকভাবে আখের মূল্য না বাড়ার কারণে কৃষক ভাইয়েরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। উচ্চফলনশীল ও স্বল্পসময়ে চাষ করা যায় এমন ফসল চাষ করে বেশি আয় করার ফলে ক্রমশ আখ চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সাথে সাথে তুলনামূলকভাবে নি¤œমানের জমিতে আখের চাষ করা হচ্ছে। ফলে আখের ফলন দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে দেশের চিনি শিল্পের ওপরে।
তাই আখ ফসলকে এ বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার। কারণ আখ ফসল জমিতে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ মাস অবধি থাকে, তাই দীর্ঘ সময়টি আমাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। আর সে কারণেই আমাদের আখের সাথে যাতে করে, আরেকটি স্বল্পমেয়াদি ফসল সুষ্ঠুভাবে চাষ করতে পারি, সে ব্যবস্থাও জনপ্রিয় করতে হবে।
আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে আমরা ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মটরশুঁটি, ছোলা, মশুর, মুগ ইত্যাদি। মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন ও তেল ফসলের মধ্যে তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম ইত্যাদি চাষ করতে পারি।
আখের সাথে সাথি ফসলের চাষের কারণগুলো হলো
* আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে ডালজাতীয়, তেলজাতীয় ফসলগুলো আলাদা জমি ছাড়াই বিনা সেচে বৃষ্টিনির্ভর অবস্থায় চাষ করা যায়, যা এককভাবে আখ চাষের চেয়ে অনেক লাভজনক।
* সাথি ফসল পরিচর্যার সময় আখের আংশিক আন্তঃপরিচর্যার কাজও হয়ে যায়।
* ডাল ফসলের গাছ ছোট, পাতা কম সেজন্য আখের সাথে এর পুষ্টি এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রতিযোগিতা কম।
* সাথি ফসল হিসেবে ডালজাতীয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
* এছাড়াও আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে পেঁয়াজ রসুন চাষ করলে অতি অল্প সময়ে অতিরিক্ত একটি ফসল পাওয়া যায়।
* সাথি ফসল চাষে জমির ব্যবহার বৃদ্ধি ও জাতীয় উৎপাদন বেড়ে যায়।
* পেঁয়াজ ও রসুনের গাছ ছোট, পাতা কম ও সরু এবং গুচ্ছ মূলের পরিধি সীমিত হওয়ায়, আখের সাথে এদের মাটি থেকে পুষ্টি নিতে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না।
* প্রাকৃতিক দুর্যোগে আখ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাথি ফসল থেকে আংশিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।
* পেঁয়াজ ও রসুনের পাতায় তীব্র ঝাঁঝ থাকায় সাথি ফসল হিসেবে আখ চাষ করলে আখে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়।
* আখের সাথে সাথি ফসল চাষ করলে জমিতে আগাছা কম হয় ফলে মূল ফসলের ফলন অনেকাংশে বেড়ে যায়।
আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে ডাল ফসল চাষ
আখের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আখের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে ডাল ফসল চাষ করতে পারি। আখের সাথে ডাল প্রথম এবং দ্বিতীয় সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। প্রথমবার সাথি ফসল হিসেবে চাষ করার জন্য কার্তিক মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত আখের বীজ বা চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। আবার দ্বিতীয়বার চাষের জন্য মার্চ/এপ্রিল মাসে অনায়াসে ডাল ফসল চাষ করা যায়। আখের দুই সারির মাঝে ডাল ফসলের বীজ সারি করে বুনে দিতে হবে। ভালো ফলনের জন্য পরিচর্যার সময় আখ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার কাজ হয়ে যায়।
জমি নির্বাচন
দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি আখ চাষের জন্য খুবই ভালো।
চারা রোপণ : আখ ফসলের দুই সারির মাঝ খানের মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা নিড়ানির সাহায্যে আলগা করে নিতে হবে এবং আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে। ডাল বীজ ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে নিতে হবে। ডাল বীজের গায়ের পানি ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ডালবীজ নির্ধারিত দূরত্বে বুনে দিতে হবে।
পরিচর্যা
ডাল ফসলের তেমন পরিচর্যা করার দরকার হয় না। তবে আগাছা দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ডালের চারা গজানোর পর নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রেখে বাড়তি ঘন চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। তবে ছোলার ডালপালা এমনিতেই বেশি হয়, সেজন্য বীজ একটু পাতলা করে বুনলেও কোনো ক্ষতি নেই।
রোগবালাই দমন
ডাল ফসলের মধ্যে মসুর ও ছোলার সাধারণত জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। জাব পোকার আক্রমণ হলে কেরোসিন মেশানো ছাই ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কেবলমাত্র তখনই অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। তবে ডাল ফসলের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে থিয়ন গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। আবার মুগ ডালে বিছা পোকার আক্রমণ হলে কেরোসিন মেশানো দড়ি ক্ষেতের ওপর দিয়ে টেনে দিলে আক্রমণের মাত্রা অনেকটাই কমে যায়। আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ও ডায়াজিনন গ্রুপের যে কোনো কীটনাশক স্প্রে করে দমন করতে পারেন। গোড়া পচা রোগ দেখা দিলে ব্যাভিস্টিন স্প্রে করে দমন করতে হবে।
সার প্রয়োগ
আখ ফসলের সঙ্গে সঙ্গে সাথি ফসল চাষে অতিরিক্ত কোনো সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।
আখের সঙ্গে মসলা ফসল চাষ
আখ চাষ উপযোগী বেলে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ ভালো হয়। যেসব জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে এবং রস ধারণ ক্ষমতা বেশি সেসব জমিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। তবে জমিতে পানি সেচ ও নিকাশের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
জমি তৈরি
দুই সারি আখের মাঝের খালি জায়গার মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় পরিমাণে গোবর সার এবং অন্যান্য রাসায়নিক সার ছিটিয়ে তা ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। আখের আগাম জাতের সাথে রসুন ও পেঁয়াজ কন্দ এবং মধ্য নাবি জাতের আখের সঙ্গে চারা পেঁয়াজ লাগানো যাবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫ থেকে ২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৮ থেকে ১০ সেমি.। দুই সারি আখের মধ্যে পাঁচ সারি পেঁয়াজ বা রসুন লাগানো যাবে। এছাড়া ধনিয়ার বীজও জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে ছিটিয়ে বুনতে পারেন। আবার দুই সারির মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় সারি করেও ধনিয়ার বীজ বুনতে পারেন।
পরিচর্যা
পেঁয়াজ ও রসুন লাগানোর পর আগাছা পরিষ্কার, উপরি সার প্রয়োগ, পানি সেচ ও নিকাশ এবং রোগবালাই দেখা গেলে সময়মতো সঠিক নিয়মে দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আখ, পেঁয়াজ ও রসুন ক্ষেতের যত্ন-পরিচর্যার কাজ এক সঙ্গেই করা সম্ভব। জমিতে রসের অভাব হলেই পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে পানি নিকাশের ব্যবস্থাও করতে হবে। পানি সেচ দেয়ার পর জমিতে ‘জো’ এলে বিশেষ করে পেঁয়াজ ও রসুন ক্ষেতে নিড়ানি দিয়ে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। সাথি ফসল হিসেবে পেঁয়াজ ও রসুন চাষে বাড়তি কোনো উপরি সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ মূল ফসল আখে যে সারটা ব্যবহার করা হয় তাতেই এ ফসল দুইটির কাজে লাগে। পেঁয়াজ ফসলে থ্রিপস পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া পার্পল ব্লচ ও লিফ ব্লাইট নামে মারাত্মক রোগ হতে পারে। পোকা ও রোগের আক্রমণ হলেই অনুমোদিত কীটনাশক অথবা ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও আপনি আখের সঙ্গে তেল ফসল হিসেবে সরিষা, রাই, তিল, তিসি, সূর্যমুখী এগুলোর চাষ করতে পারেন। এজন্য আলাদাভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয়না। আখ লাগানোর আগে শেষ চাষের সময় পরিমাণ মতো বীজ বুনে দিতে পারেন। আবার আখের দুই সারির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাতে সারি করেও বীজ বুনতে পারেন। আখের সঙ্গে কি ধরনের সাথি ফসলের চাষ করতে পারব সে বিষয়ের আলোচনাগুলো যথাযথভাবে মেনে সাথি ফসলগুলোর চাষ করতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন আখের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারব, তেমনি পাশাপাশি দেশের চিনি, গুড় অন্যান্য ডাল, তেল ও মসলার ঘাটতি অনেকটাই পূরণে সহায়ক হবে।
মো. দেলোয়ার হোসেন*
*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী
আমাদের দেশে কুল ঐতিহ্যবাহী একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফল। স্বাদ ও পুষ্টিমানের বিচারে কুল একটি উৎকৃষ্ট মানের ফল। বিশেষ করে ভিটামিন সি-এর দিক থেকে আমলকী ও পেয়ারার পরই এর জায়গা। মানব দেহের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ও ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ এর সহজ ও সস্তা উৎস হচ্ছে কুল। কুল শুধু ফল হিসাবেই নয় এ থেকে আচার, চাটনি ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয়। ভিটামিন-সি হৃদরোগকেও প্রতিরোধ করে এবং কুলে পাওয়া যায় এমন ফ্রি র্যাডিক্যালগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। ভেষজ গুণেও কুল অনন্য। কবিরাজি মতে, কুল রক্ত শোধন ও রক্ত পরিষ্কার এবং হজমিকারক। পেটে বায়ু ও অরুচি, অতিসারে প্রদর রোগে কুল থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা যায়।
আমাদের দেশে প্রায় ২৭৫০ হাজার হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয় এবং উৎপাদন প্রায় ৭২০০০ মেট্রিক টন। বর্তমানে আপেল কুল, বাউ কুল, বারি কুল-১, বারি কুল-২, বারি কুল-৩ ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে। তবে কুল চাষে এর আগে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন দেখা না গেলেও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কুল চাষ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু পোকা কুলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে কুলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফসলটি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এ পোকামাকড়ের মধ্যে কুল বাগানে ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা ও টিউব স্পিটল বাগ পোকা অন্যতম।
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা
ফল ছিদ্রকারী উইভিল কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুলের উন্নত জাতে এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পোকার সদ্যজাত লার্ভা হালকা হলুদ বর্ণের এবং এদের পা থাকে না। পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণের হয়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা থেকে পূর্ণ রূপ ধারণ করে।
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা যেভাবে কুলের ক্ষতি করে থাকে -
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, সদ্য জাত লার্ভা কচি ফলের বীজে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ বীজ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফলের নিচে কাল দাগ পড়ে এবং বীজের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ফল ছোট গোলাকার হয় এবং ফ্যাকাশে ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে বা গাছ শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলে পোকার লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকার মল দেখা যায়। ফলের ভেতরের অংশ খাওয়ার পর গোলাকার ছিদ্র করে পোকা বের হয়ে আসে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে বাগানের সব গাছের ফল আক্রান্ত হয়। তবে আপেল কুল ও বাউ কুলে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত গাছে ফুল আসার পর এ পোকার আনাগোনা দেখা যায় এবং পরাগায়নের পর গাছে ফল ধরা শুরু হলে পোকার আক্রমণ শুরু হয়।
এ পোকা দমনের জন্য যা করতে হবে-
কুল বাগানের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
কুল গাছে অসময়ে আসা ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলতে হবে।
গাছ ও মাটিতে পড়ে যাওয়া আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ করে লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে।
বেশি আক্রান্ত এলাকায় ফুল ধরার আগেই সব বাগান ও এলাকা অনুমোদিত কার্বারাইল জাতীয় কীটনাশক বা ডাইমেথোয়েট জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
যেহেতু পোকাটি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ফলের ভেতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেজন্য আক্রমণের আগেই পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য পরাগায়নের পর ফল ধরা শুরু হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
টিউব স্পিটল বাগ
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, এ পোকা কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে এবং এর আগে কখনও এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। পোকার নিম্ফগুলো সরু, লম্বা চুন যুক্ত টিউবের মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। নিম্ফগুলো টিউবের মধ্যে তাদের তৈরি ফ্লুয়িডে (fluid) নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং টিউবে এদের মাথা নিচে এবং পেট ওপরে রাখে। নিম্ফগুলোর পেটে একটি বর্ধিত প্লেট থাকে যা টিউবের খোলা প্রান্তে দরজা হিসাবে কাজ করে এবং টিউবকে বন্ধ করে দেয়।
ক্ষতির প্রকৃতি
পূর্ণ বয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ ফুল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত ফুল সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারণের অনুপযোগী হয়। অধিক আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ রূপে ফল ধারণে ব্যর্থ হয়। এরা মধু রস নিঃসৃত করে যেখানে শুটি মোল্ড জন্মে। ছায়াযুক্ত স্থানে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত কুল গাছে ফুল আসার সময় আক্রমণ বেশি হয় এবং টিউবের মধ্যে নিম্ফ দেখা যায়। পরবর্তীতে ফুল ধরা শেষ হলে এরা টিউব ছেড়ে চলে যায় এবং গাছে শুধু খালি টিউব পড়ে থাকে।
দমন ব্যবস্থাপনা
জমি সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যাতে ডালপালায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় কুল চাষ না করাই উত্তম।
হাত বা শক্ত লাঠি দিয়ে টিউবগুলো নিম্ফসহ ধ্বংস করতে হবে।
যেহেতু ফুল ধরার সময় এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় সেজন্য গাছে ফুল আসার সময়ে কা- বা শাখায় টিউব দেখামাত্র সাইপারমেথ্রিন বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
সাথি ফসল চাষ
বাণিজ্যিকভাবে লাগানো কুলের বাগানে প্রথম ৪-৫ পর্যন্ত আন্তঃফসল হিসাবে শীতকালীন শাকসবজি পেঁপে, ডালজাতীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। এতে বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। রোগ বালাই পোকার উপদ্রব ও আক্রমণ থেকে বাগানকে রক্ষা করা যায়।
রোগে আক্রান্ত এলাকায় করণীয়
অত্যধিক আক্রান্ত এলাকায় গাছে ফুল ধরার আগে বাগানের সব গাছ ও এর আশপাশের এলাকায় কার্বারাইল (সেভিন ৮৫ এসপি বা কার্বারাইল ৮৫ ডব্লিউপি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা ডাই মেথোয়েট (টাফগর ৪০ ইসি বা সানগর ৪০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
চারা গাছ লাগানোর ১ মাস পর চারা গাছের চারদিকে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার হিসাবে পচা গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্টা পচানো কম্পোস্ট সার, খৈল ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাসায়নিক সার ভিন্ন বয়সের গাছে ভিন্ন অনুপাতে দেয়া হয়। কুলের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত ও পরিমাণমতো সার দিতে হবে। সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স, আকার ও মাটির উর্বরতার ওপর। নিম্নে বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা দেয়া হলো-
গাছের বয়স (বছর)
|
পচা গোবর (কেজি)
|
ইউরিয়া (গ্রাম)
|
টিএসপি (গ্রাম)
|
এমওপি (গ্রাম)
|
১-২ ৩-৪ ৫-৬ ৭-৮ ৯ বা তদুর্ধ |
১০ ২০ ২৫ ৩৫ ৪০ |
২৫০-৩০০ ৩৫০-৫০০ ৫৫০-৭৫০ ৮০০-১০০০ ১১৫০-১২৫০ |
২০০-২৫০ ৩০০-৪৫০ ৫০০-৭০০ ৭৫০-৮৫০ ৯০০-১০০০ |
২০০-২৫০ ৩০০-৪৫০ ৫০০-৭০০ ৭৫০-৮৫০ ৯০০-১০০০ |
উপরোক্ত সার বছরে সমান দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি মে-জুন মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি ফল ধরার পর পরই অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রয়োগ করতে হবে। সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
তরল সার প্রয়োগ
গাছে এক ধরনের জৈব তরল সার ব্যবহার করতে পারেন। তরল সার তৈরি পদ্ধতি : খৈল ১ কেজি, গোবর ২ কেজি, পানি ৫০ লিটার ও কুচামাছ ২৫০ গ্রাম একই সঙ্গে পানিতে ৭ দিন পচিয়ে তরল সার তৈরি করে কুল গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করবেন। খেয়াল রাখতে হবে তরল সার প্রয়োগের সময় জমিতে যেন রসের টান না থাকে সেজন্য সেচ দেয়ার ৩০ মিনিট পর এ সার প্রয়োগ করা উচিত এতে ফল গাছের উপকার হয়।
হরমোন ও দস্তা-বোরনের ব্যবহার
বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ ছাড়াও অন্য কারণে কুলের ফুল ও ফল ঝরে পড়তে পারে। যেমন- হরমোনের অসামঞ্জস্যতা, পুষ্টি উপাদানের অভাব বিশেষ করে দস্তা ও বোরনের অভাব। হরমোনের অভাবে প্লানোফিক্স নামক হরমোন স্প্রে করতে হবে। দস্তার অভাব হলে জিংক সালফেট ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। চিলেটেড জিংক ০.৫ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বোরনের অভাব কুল ফেটে যায়। এজন্য সলুবর বা বাম্পার সলুবর ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
প্রুনিং বা ছাঁটাই
গাছের অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম বছর গাছের অবকাঠামো মজবুত করার জন্য গোড়া থেকে ৭৫ সেমি. উঁচু পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। গাছের অবস্থা অনুযায়ী এর ওপরে শক্ত সামর্থ্য ৩-৪টি শাখা প্রশাখা রাখতে হবে যাতে গাছ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে। ফল সংগ্রহের পর প্রতি বছর কুল ফসল সংগ্রহের পর ১ বার ছাঁটাই করা উচিত। ছাঁটাইয়ের সময় শক্ত শাখাগুলো গোড়া থেকে না কেটে কিছু রেখে অগ্রভাগ কেটে ফেলতে হবে। একে অতি ছাঁটাই Heavy (pruning) বলে। ফল সংগ্রহ শেষ হলে মাঘ-ফাগ্লুন মাসে ২ সেমি. মোটা পর্যন্ত সব ডাল ছেটে দেয়া প্রয়োজন। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ এড়ানো যায়। এছাড়া সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে হালকা করে কিছু কিছু ডাল ছেটে দিলে গাছে বেশি কুল ধরে। ফলে বাগান মালিক লাভবান হয়।
উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার দ্বারাই একটি কুল গাছ বা কুল বাগান থেকে আশানুরূপ ভালো গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক ফলন আশা করা যায়। কুল বাগানে প্রথম ৪-৫ বছর শীতকালীন ও অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল চাষ করে তা থেকে আলাদা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী
বাংলাদেশে ব্রয়লারসহ গোমাংস ও অন্যান্য মাংস উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মেধা ও শারীরিক গঠনের জন্য দৈনিক ১২০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ ভক্ষণ খাওয়া প্রয়োজন। বাজারে অনেক মাংস উপস্থিত থাকলেও শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মাংস সন্ধান করেন। কারণ সবাই সুস্থ-সবল ও দীর্ঘজীবী হতে চান। একটি সুস্থ-সবল, মেধাবী জাতি ছাড়া শিক্ষা ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই পোলট্রি মাংস গ্রহণযোগ্য। উচ্চমাত্রার কোলস্টেরলের কারণে গো-মাংস কম গ্রহণ করে। ব্রয়লার সহজলভ্য ও সবত্রই পাওয়া যায়, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণও সহজ। আগামীতে পোল্ট্রি মাংসই প্রোটিনের চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
পশুপাখির রোগের কারণে ভবিষ্যতে মাংস গ্রহণ কম হবে বলে প্রতীয়মান হয়। আগামীতে মাংস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে জুনোটিক রোগসমূহ যেমন- এভিয়ান ফ্লু, ম্যাড-কাউ, ক্ষুরারোগ, তড়কা ইত্যাদি। এছাড়াও অপ্রত্যাশিত কারণ যেমনÑ মাংসে ডাইঅক্সিন অথবা এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির কারণে মাংস গ্রহণ হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখের মতো ছোট বড় মুরগির খামার রয়েছে। এসব খামারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান কেমন তা মূল্যায়ন করার সময় এসে গেছে। পরিকল্পনা ছাড়া যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে পোলট্র্রি খামার। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। মানসম্মত বাচ্চার অভাব, বাসস্থান স্বাস্থ্যসম্মত নয়, ত্রুটিপূর্ণ রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সঠিক জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই ফলে ব্রয়লার মুরগির ওজন বৃদ্ধি হয় না এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে চাষিরা বাধ্য হয়ে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।
এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রদানের ফলে রোগ জীবাণু ও এন্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ মুরগির শরীরে থেকে যায়, যা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে। ব্রয়লার উৎপাদনে খামারিরা পালন ব্যবস্থাপনায় নিম্নে বর্ণিত ৫+৫= ১০টি বিষয় মেনে চললেই নিরাপদ মাংস উৎপাদন সম্ভব হবে।
জীবাণুমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদনে ৫ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
১. মুরগির খামারকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে সুরক্ষা করা। খামারের চতুর্দিকে ২ মিটার দূর দিয়ে বেষ্টনী/ বেড়া দিতে হবে। এই বেষ্টনীকে পেরিমিটার ফেন্সিং বলে। বেষ্টনী নির্মাণ করলে অবাঞ্ছিত পশুপাখি খামারের আশপাশে আসতে পারবে না। অবাঞ্ছিত পাখি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। পৃথকীকরণ না থাকলে খামারে রোগব্যাধি লেগেই থাকে, যে কারণে ওষুধ খরচ বেড়ে যায় এবং মুরগির ওজন আশানুরূপ হয় না। খামারে কোনো যানবাহন প্রবেশের পূর্বে চাকা পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। খামারে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত পোশাক, জুতা, গ্লভস এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। খামারের প্রবেশ মুখে ফুটবাথ থাকতে হবে এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খামারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে হবে।
২. নিরাপদ উৎপাদন উপকরণ ব্যবহার করা। নির্ভরযোগ্য উৎস এবং লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধ ও ভিটামিন সংগ্রহ করতে হবে। বাচ্চা গ্রহণের সময় গড় ওজন দেখতে হবে। সব বাচ্চা একই গ্রেডের, আকৃতির আছে কিনা? খাদ্য ক্রয়ের সময় বস্তার গায়ে পুষ্টিমানের বিবরণ দেখে নিতে হবে।
৩. উত্তম খামার ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম অনুসরণ করা। রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় টিকা দিতে হবে। অল-ইন-অলআউট পদ্ধতি অনুসরণ করা। ধারণক্ষমতার বেশি মুরগির বাচ্চা উঠানো যাবে না। অসুস্থ মুরগি আলাদা রাখতে হবে। মৃত মুরগি যেখানে সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে।
৪. উত্তম ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করা। খামারে কাজ করার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। পায়খানা করার পরও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। খামারে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি যেমন-গামবুট, গ্লভস, মাক্স ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। যেসব কর্মী অসুস্থ অথবা হাতে কাটা, ক্ষত, ঘা রয়েছে তাদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। উত্তম স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনে মানুষ থেকে মুরগিতে বা মুরগি থেকে মানুষে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে না।
৫. উত্তম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পালন করা। মৃত মুরগি যেখানে সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতিদিন খামারের বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে। খামারের পাশে ময়লা জমিয়ে রাখা যাবে না। খামার আবর্জনা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ইঁদুর দমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। খামারের পানি নিষ্কাশনের জন্য ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকতে হবে। পোলট্রি লিটার বা বিষ্ঠা দিয়ে জৈবসার তৈরি করে খামার বর্জ্য সম্পদে পরিণত করা দরকার।
রাসায়নিক দূষণমুক্ত নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদনে ৫ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
১. ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত মানসম্পন্ন খাদ্য ক্রয় করা। নির্ভরযোগ্য উৎস এবং লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে মুরগির খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক খাদ্যে আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গবেষণাগারে খাদ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রাসায়নিক দ্রব্য মুরগির মাংস ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জমা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
২. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত মানসম্পন্ন ভিটামিন ও মিনারেল ক্রয় করা। নির্ভরযোগ্য উৎস ও লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলার থেকে ভিটামিন, মিনারেলও ওষুধ সংগ্রহ করতে হবে। ওষুধের মেয়াদ দেখে নিতে হবে। প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত। নি¤œমানের ভিটামিন-মিনারেল ব্যবহার করলে মুরগির ওজন হ্রাসসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। রাসায়নিক দ্রব্য মুরগির মাংস ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৩. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যমুক্ত নিরাপদ ও পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা। পানিতে রাসায়নিক দ্রব্য যেমন-আর্সেনিক, আয়রন ধাতুর উপস্থিতি ক্ষতিকর। তাই বছরে একবার পানি পরীক্ষা করা দরকার। প্রতি মাসে দুইবার ব্লিচিং পাউডার দ্বারা পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে হবে। পানি কীটনাশক দ্বারাও দূষিত হতে পারে।
৪. প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার এড়াতে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা দরকার। সঠিক মাত্রা ও প্রত্যাহার সময়সীমা মেনে চললে মুরগির মাংসে এন্টিবায়োটিক এবং রেসিডিও সহনশীল মাত্রায় কমে আসে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিমুক্ত। উত্তম ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি এর বিকল্প হিসেবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।
৫. খাদ্য, ওষুধ ও পানিকে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা দূষিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। খামারের বাইরে আলাদা জায়গায় খাদ্য ও ওষুধ মজুদের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বিরূপ আবহাওয়া, রাসায়নিক (যেমন- লুব্রিকেন্ট বা কীটনাশক) এবং পরিবেশগত দূষণ থেকে সুরক্ষা করা যায়। ফিডার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
সর্বোপরি পোলট্রি ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা উন্নয়ন করতে হবে। আমরা যদি মানসম্মত পোলট্রি উৎপাদন করতে পারি তাহলে পোশাক শিল্পের মতো পোলট্রি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
তথ্য সূত্র :
১. নিরাপদ ব্রয়লার উৎপাদন প্রকল্পের লিফলেট-DLS
২. ‘মাসিক খামার’-২০০৮
কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার*
* উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা। মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও মাছ দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে স্থান দখল করেছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩৮.৭৮ লাখ মে. টন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। একই অর্থ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ১,৮৬,৬০৫ মে. টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে যার মধ্যে ১,৩২,৭৩০ মে. টন চাষকৃত চিংড়ি। খুলনা অঞ্চলে নিচু ধানক্ষেতের চারদিকে খনন করে বাঁধ বা ঘেরা দিয়ে ঘের তৈরি করা হয়, যেখানে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ধান চাষ হয় এবং জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সনাতন বা উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ির সাথে বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছের চাষ হয়। কার্প ও চিংড়ি মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব থাকায় এসব মাছ প্রধানত অর্থ উপার্জনের জন্য বিক্রয় করা হয়। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষি পরিবারের মাছ খাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। গৃহস্থলির আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও AquaFish Innovation Lab-USAID এর যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করা হয়, যেখানে চিংড়ি ও কার্পের ঘেরে মলা মাছ (SIS) এবং পাড়ে মৌসুমি সবজি চাষ করা হয়।
মলা মাছের পরিচিতি
মলা (Amblypharyngodon mola) একটি দেশীয় প্রজাতির (SIS) ছোট মাছ। মলা মাছ সাধারণত ডিম থেকে ফোঁটার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে ৩-৬ গ্রাম ওজন বা ৬-৮ সেমি. লম্বা হলে খাওয়ার উপযোগী হয়ে থাকে। তবে অঞ্চল ভেদে এ মাছ ছোট বা বড় আকারের হতে পারে। এটি স্বাদুু পানির মাছ এবং সাধারণত নদী-নালা, খাল, বিল, পুকুর ও ছোট জলাশয় এমনকি নিচু ধান ক্ষেতে এদের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময় (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) মলা মাছের উপযুক্ত প্রজনন মৌসুম। তবে এ মাছ সারা বছরব্যাপী কম বেশি প্রজনন করে থাকে। জন্মের ২.৫-৩ মাস পর মলামাছ প্রজননক্ষম হয় এবং এরা পুকুর, ঘের ও যে কোনো জলাশয়ে ডিম দিয়ে থাকে। এ মাছের কাঁটা নরম হওয়ায় মাথা ও কাঁটাসহ সম্পূর্ণ মাছটি শিশুসহ সব বয়সের মানুষ খেতে পারে। এ মাছ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং এতে বিদ্যমান প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, জিংক ও আয়রন শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। দিনদিন পরিবেশ বিপর্যয় ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছটির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এঅবস্থায় এ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মাছটির চাষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হয়ে পড়েছে।
চিংড়ি ঘেরে মলা চাষের গুরুত্ব
মলা মাছ সাধারণত পানির ওপরের স্তরের খাবার খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক খাবার যেমন, উদ্ভিজ্জকণা, প্রাণিজ্জকণা, প্রোটোজোয়ান ও ছোট ক্রাস্টাসিয়ান লার্ভি, ডিম এবং দ্রবীভূত জৈবিক কণার আধিক্য দেখা যায়। চিংড়ি ও মলা মাছ ভিন্ন স্তরের খাদক, এবং এদের খাবারের ধরন ভিন্ন হওয়ায় খাদ্যের প্রতিযোগিতা হয় না। উপরন্তু চিংড়ির জন্য প্রয়োগকৃত খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ এবং প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে মলা মাছ জলজ পরিবেশকে ভালো রাখে।
চিংড়ি-কার্প-মলার মিশ্রচাষ
সনাতন বা উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে ঘেরে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে সাধারণত ১০,০০০-২০,০০০টি চিংড়ি ও ৫০০-১,০০০টি কার্প জাতীয় মাছ মজুদ করা হয় এবং সপ্তাহে ১-৩ দিন অনিয়মিতভাবে খাবার দেয়া হয়। ঘেরে গলদার মজুদ ঘনত্ব, খাদ্য প্রয়োগ, পানির গভীরতা ও ব্যবস্থাপনার তারতম্যের কারণে প্রতি হেক্টরে ৩৫০-৬০০ কেজি গলদা উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এ গবেষণায় প্রতি হেক্টরে ২০,০০০টি চিংড়ির জুভেনাইল, ১,০০০টি আঙুলে রুই, এবং ২০,০০০টি ব্রুড মলা মজুদ করা হয়, এবং সপ্তাহে ৩ দিন খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। ঘেরে প্রাকৃতিক খাবার বাড়ানোর জন্য প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ কেজি চিটাগুর ও ১৫০-২০০ গ্রাম ইষ্ট ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ঘেরে প্রয়োগ করা হয়। পাশাপশি ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া ও ৮-১০ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে ঘেরে মলাসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, গলদা ঘেরে মলা চাষের জন্য খাবার ও ব্যবস্থাপনা বাবদ অতিরিক্ত শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘেরে গলদা-কার্পের সাথে মলা মাছ চাষ করলে উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। ওই গবেষণায় সনাতন পদ্ধতিতে ঘেরে ৬ মাস চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৫০৮.৮ কেজি গলদা ও ৬৩৩ কেজি রুই মাছের পাশাপাশি ৪৪০ কেজি অতিরিক্ত মলা মাছ উৎপাদিত হয়েছে। চাষকালীন প্রতিটি পরিবার প্রায় ৫০-৬০ কেজি মলা মাছ খাবার জন্য নিয়মিত আহরণ করেছে। মলামাছের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এ মাছ ছাড়ার ১ মাস পর থেকে প্রয়োজন মতো আহরণ করে চাষিদের পারিবারিক আমিষ, প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ মাছে ভিটামিন-এ, আয়রন, জিংক, ও ক্যালসিয়াম এর প্রাচুর্যতা থাকায় রাতকানা, ও রক্তশূন্যতা, ত্বকের ক্ষত এবং রিকেট্স রোগের প্রতিরোধক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চিংড়ি ঘেরে সবজি চাষ
মাছ চাষের পাশাপাশি ঘেরের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি সবজি যেমন-লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি, ঢেঁড়স, কলা, ফুলকপি, শালগম, বাঁধাকপি, করলা, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, পালংশাক ইত্যাদি চাষ করা যায়। যার মাধ্যমে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
ঘেরে ধান, মাছ ও সবজির পুষ্টিচক্র
ধান গাছের অবশিষ্টাংশ এবং সবজির উচ্ছিষ্ঠাংশ পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয় যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। মাছের খাবারের উচ্ছিষ্ঠাংশ ও মলমূত্র তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
চিংড়ি ঘেরে মলা মাছ ও সবজির সমনি¦ত চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। চিংড়ি ঘেরে মলা ছাড়াও অন্যান্য ছোট মাছ ও সবজির সমনি¦ত চাষের ফলে খাদ্য স্তরের সঠিক ব্যবহার সম্ভব হয়, ফলে জলজ পরিবেশ ভালো থাকে এবং চিংড়ি ও কার্প মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। গবেষকবৃন্দ এ গবেষণায় আর্থিক সহায়তার জন্য AquaFish Innovation Lab-USAID এর নিকট কৃতজ্ঞ।
খন্দকার আনিছুল হক* শিকদার সাইফুল ইসলাম**
জয়ন্ত বীর** ওয়াসিম সাব্বির**
*প্রফেসর **সহকারী অধ্যাপক, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা
রাজপুঁটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দ্রুত বর্ধনশীল এক বিশেষ প্রজাতির মাছ। এ মাছ ১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে। তাই আমাদের দেশে থাই রাজপুঁটি নামেই বহুল পরিচিত। মাছটি দেখতে আমাদের দেশীয় সরপুঁটির চেয়ে আরও উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। এ মাছটিকে অনেকে থাই সরপুঁটি নামেও আখ্যায়িত করেন।
থাই রাজপুঁটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এটি বেশ শক্ত প্রকৃতির অধিক ফলনশীল মাছ। প্রতিকূল পরিবেশে কম অক্সিজেনযুক্ত বেশি তাপমাত্রার পানিতেও এ মাছ বেঁচে থাকতে পারে।
আমাদের দেশে অধুনা মাছের দারুণ সংকট। প্রয়োজনের তুলনায় মাছের সরবরাহ দিনদিন প্রকটভাবে হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাছের উৎপাদন আনুপাতিক হারে মোটেই বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের প্রতিদিনের মাছ তথা আমিষের চাহিদা ন্যূনতম পর্যায়েও মেটানো সম্ভব হয়ে উঠছে না।
এ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুকুর, ডোবা, জলাশয়। বেশির ভাগ নি¤œবিত্ত চাষির বাড়ির আশপাশেই রয়েছে একটি বা দুইটি মাঝারি আকারের পুকুর অথবা ডোবা। এ সব পুকুর ডোবায় বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি থাকে না। তাই অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
গ্রামাঞ্চলের পতিত এ পুকুর-ডোবাগুলো সামান্য সংস্কার করে অতি সহজেই মাছ চাষোপযোগী করা যায়।
এ দেশের গরিব প্রান্তিক চাষিরা স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে এ ধরনের জলাশয়ে রাজপুঁটির চাষ করে পরিবারের প্রয়োজনীয় মাছ তথা আমিষের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয়ের একটি নির্ভরযোগ্য উৎসের সন্ধান পেতে পারেন।
রাজপুঁটি চাষের কিছু সুবিধাজনক দিকও রয়েছে। রুই জাতীয় মাছের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম খরচে, কম সময়ে ও সহজতর ব্যবস্থাপনায় এ মাছ থেকে অনেক বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মিশ্র চাষ পদ্ধতি অর্থাৎ রুইসহ অন্যান্য উন্নত প্রজাতির মাছের সাথেও অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে এ মাছ চাষ করা যায়। এ মাছের রোগবালাই খুবই কম। ছয় মাসে একটি রাজপুঁটি গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। একই পুকুরে বছরে দুইবার এ মাছের চাষ করা যায়।
নিম্নে রাজপুঁটি মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো-
রাজপুুঁটি চাষের জন্য পুকুরের আয়তন ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হলেও ক্ষতি নেই। তবে একরের ঊর্ধ্বে হলেই ভালো হয়। পুকুরের গভীরতা হবে ১.৫ থেকে ২ মিটার অর্থাৎ তিন থেকে চার হাত। পোনা ছাড়ার আগে ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হয়। শুকনো মৌসুমে পুকুরের সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করে তলার মাটি ১০-১৫ দিন ধরে রোদে শুকাতে হবে। অতঃপর লাঙল দিয়ে কর্ষণ করে নিতে হয়। পুুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী মেরে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ পর্যায়ে পুকুর প্রস্তুতির জন্য প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হয়। চুনে পানির বিষাক্ত গ্যাস দূরীভূত হয়; উপরন্তু চুন পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াও ত্বরাণি¦ত করে। চুন প্রয়োগের সাত দিন পর প্রতি শতাংশে ৪ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়।
সারগুলো পুকুরের তলায় মাটির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কোদালের সাহায্যে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর পুকুর পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে।
প্রস্তুতকৃত পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত হয়ে প্রতি শতাংশে ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ৬০ থেকে ৬৫টি রাজপুঁটির পোনা ছাড়া যেতে পারে। পুকুরে যে পরিমাণ মাছ আছে সে মাছের মোট ওজনের শতকরা ৪ থেকে ৬ ভাগ হারে চালের কুড়া বা গমের ভুসি সম্পূরক খাদ্য হিসাবে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুইবার ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি মাসে একবার জালটেনে মাছের গড় ওজন নির্ধারণ করে খাবার পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে হবে।
পুকুরে মাছের খাবারের ঘাটতি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ওই পরিমাণ টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। রাজপুঁটি মাছ সাধারণত নরম ঘাস বেশি পছন্দ করে। তাই তাদের জন্য ক্ষুদে পানা, টোপা পানা, নেপিয়ার ও কলাপাতা ইত্যাদি নরম ঘাস প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে হলেও সরবরাহ করতে পারলে মাছের আনুপাতিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
ওই প্রক্রিয়ায় পাঁচ ছয় মাস পালনের পর একেকটি মাছের গড় ওজন দাঁড়াবে ১২০ থেকে ১৫০ গ্রাম। ওই সময়ে মাছ বাজারজাত করার পুরোপুরি উপযোগী হয়।
ছয় মাস পর জাল টেনে সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করে আবার ওই পুকুরে পোনা মজুদ করা যায়। এভাবে পুকুরে রাজপুঁটি মাছ চাষ করে বছরে পূর্ণ দুইটি ফলণ পাওয়া সম্ভব। রাজপুঁটি চাষাবাদ করে যথেষ্ট লাভবান হতে পারেন ।
দলিল উদ্দিন আহমদ*
*মৎস্য কর্মকর্তা (অব.), প্রযতেœ, শক্তি ঔধালয়, উকিলপাড়া, বি.বি. রোড, নারায়ণগঞ্জ
বুদ্ধিমান চাষি
আবদুল হালীম খাঁ*
মওসুম মতো তরুতরকারি যারা চাষ করে
অভাব অনটন থাকে না সেই চাষিদের ঘরে।
সংসারে সব কৃষিকাজে তারাই বুদ্ধিমান
তারাই দেশ ও জাতির জন্য রাখছে অবদান।
ধুলি কাদা মাটির সাথে যাদের লেগে আছে হাত
ক্ষেত খামারে কাজ সদা করছে দিবস-রাত।
তারাই আসল দেশপ্রেমিক তারাই দেশের প্রাণ
সব জিনিসেই লেগে আছে তাদের গায়ের ঘ্রাণ।
বাংলাদেশের মাটি এ যে নয় শুধুই এ মাটি
সবার মুখের অন্ন জোগায় সোনার চেয়ে খাঁটি।
মাঠে ফলে সোনার ফসল-নদী বিলে ঝিলে মাছ
বাড়ি বাড়ি রাস্তাঘাটে কত রকম ফলের গাছ।
ঘরের সামনে উঠোন তার পাশের এক কোনা
ইচ্ছে করলেই ফলানো যায় নানা রকম সোনা।
কয়টা মরিচের চারা লাগালে উঠোনের আঙিনায়
পরিবারের সারা বছরের খাওয়া চলে যায়।
ছাদে কেউ লাউ কুমড়া শিমেরও করে চাষ
যখন-তখন ইচ্ছে মতো খাওয়া যায় কয় মাস।
হাট-বাজারের তরুতরকারি ভালো নয় তত
নিজের হাতের তৈরি জিনিসের স্বাদ মনের মতো।
বসন্তের বোরো চারা
মো. জুন্নুন আলী প্রামাণিক**
বসন্তের মাঘ ফাল্গুনে বোরো রোপার ভিড়।
পাখিগুলো খর কুটায় রচে সুখের নীড়।
কোকিলের কুহু কণ্ঠের তালে নাচন মেলা,
চারাগুলো মাঠে সেবার বলে কাটায় বেলা।
ভূ-গর্ভের পানি প্রচুর উঠে তাদের সাথী,
দিবসের সূর্য রাতের চন্দ্রে থাকে না ভীতি।
অনাহারে থাকা বড়ই কষ্ট চারার কাছে,
নানারূপ সার চাষির যত্ন প্রস্তুত আছে।
মৃত্তিকার অঙ্গে সঞ্চিত খাদ্যে বাড়তে থাকা,
স্নেহময় হাতে আদরে নেড়ে সোহাগ মাখা।
সুন্দরের মাঝে রূপের তেজে বাড়বে লুকে,
কাদাময় মাটি গলিত অঙ্গে চারার সুখে।
সুখ প্রিয় পক্ষিছানার মতো সবুজ পাখা,
প্রতিদিন সেথা শিল্পীর প্রিয় রঙের আঁকা।
শিকড়ের বোঝা জড়িয়ে ধরে মাটির গায়,
উপযুক্ত খাদ্য তরল হলে খাইতে পায়।
সচেতন চাষি সেবার জোরে নজরে রাখে;
ফসলের চারা বাড়ার পালা মাটির ফাঁকে।
মহব্বতগুলো বিস্তৃত হয় চারার মাঝে,
বেগবান দেহে সুযোগ্য চারা ফলন কাজে।
কৃষ্ণচূড়া ফোটে শিমুল হাসে একই লালে,
মৌসুমের গুণে ফুলের তোড়া খাঁদার ডালে।
কৃষকের স্বপ্ন বাস্তব করা প্রচেষ্টা নিয়ে,
চাহিদার পূর্ণ ভাণ্ডার দিতে রয়েছে চেয়ে।
আধুনিক জাতে আগ্রহী চাষি নিমগ্ন অতি,
প্রযুক্তির পূর্ণ প্রয়োগে লাভ এড়িয়ে ক্ষতি।
* গ্রাম+ডাকঘর+উপজেলা : ভূঞাপুর, জেলা: টাঙ্গাইল-১৯৬০, মোবাইল : ০১৯৩৩৬৮৫৯৭৭; গ্রাম: বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম
মো. সিরাজুল ইসলাম, গ্রাম : তাম্বুলখানা, উপজেলা : ফরিদপুর সদর, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন : সরিষা গাছের পাতায় কালো দাগ পড়ে এবং পাতা ঝলসে যায়, এর প্রতিকার কী?
উত্তর : অলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে সরিষা গাছের পাতায় কালো দাগ পড়ে। পরে এ দাগগুলো একসাথে মিশে বড় বড় দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রমণ বেশি হলে পাতাগুলো ঝলসে যায় এবং সরিষার ফলন কমে যায়। এ রোগের আক্রমণ হলে ডায়থেন এম-৪৫ বা ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের রোভরাল ২ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করা। তাহলে আপনার সমস্যাটি দূর হবে। এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আগামীতে আপনি রোগমুক্ত বীজ বপন এবং রোগ প্রতিরোধী সরিষার জাত ব্যবহার করবেন। সেক্ষেত্রে বীজ বপনের আগে ২.৫ গ্রাম প্রোভ্যাক্স দিয়ে ১ কেজি বীজ শোধন করলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
মো. জহুরুল ইসলাম, গ্রাম : তৈলটুপি, উপজেলা : হরিণাকুণ্ডু, জেলা : ঝিনাইদহ
প্রশ্ন : বোরো ধানের বীজতলায় চারাগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : বোরো ধানের বীজতলায় চারাগাছ হলুদ হয়ে যেতে পারে দুইটি কারণে। প্রথমত নাইট্রোজেনের অভাবে দ্বিতীয়ত গন্ধকের অভাবে। সেজন্য চারাগাছ হলুদ হয়ে গেলে আপনি প্রতি শতক বীজতলায় ২৮৩ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাবেন। কিন্তু ইউরিয়া সার প্রয়োগের পরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে আপনাকে অবশ্যই জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। কারণ চারা হলুদ হওয়ার পেছনের কারণটি হলো গন্ধকের অভাব। সেক্ষেত্রে প্রতি শতকে ৪০৪ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আপনি বোরো ধানের চারাগুলো হলুদ হয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার সেটি হলো আমরা অবশ্যই বোরো ধানের বীজতলার জমি প্রস্তত করার সময় উর্বর জমি বেছে নেব। এতে করে পরবর্তীতে এ ধরনের সমস্যা অনেক কমে যাবে।
মো. জয়নাল উদ্দীন, গ্রাম : লক্ষীরপাড়, উপজেলা : বিশ্বম্বপুর, জেলা : সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন : শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের কালো দাগ পড়ে এবং শিমগুলো পচে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাব?
উত্তর : শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের দাগ পড়ে শিম পচে যায় অ্যানথ্রাকনোজ রোগের জীবাণু আক্রমণ করলে। এ সমস্যার সমাধানে প্রপিকোনাজল গ্রুপের যেমন টিল্ট ১ মিলিলিটার ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে সুফল পাবেন। কিংবা কার্বেনডাজিম গ্রুপের যেমন টপসিন ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে শিম গাছে বিকাল বেলা স্প্রে করলে ভালো ফল পাবেন। এছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আর শিম গাছ ও বাগানকে সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কমে যাবে। আর অনেক বেশি ফলনও পাওয়া যাবে।
সুমন মজুমদার, গ্রাম : নারায়ণপুর, উপজেলা : কেশবপুর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : ভুট্টা গাছের মাইজ মরা দেখা যায় এবং মধ্যপাতা হালকা টান দিলে উঠে আসে, প্রতিকার কী?
উত্তর : ভুট্টার কাণ্ডের মাজরা পোকা আক্রমণ করলে ভুট্টা মাইজ মরা এবং মধ্যপাতা হালকা টান দিলে উঠে আসে। এ সমস্যা দূরীকরণে ভুট্টা ক্ষেত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন এবং জমিতে কার্বোফুরান গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করা। তবেই আপনি এ সমস্যার সমাধান পাবেন।
মো. সিদ্দীক হায়দার, গ্রাম : বাহুগুলপুর, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া
প্রশ্ন : আলু গাছের মড়ক কিভাবে দমন করব?
উত্তর : আলু গাছে মড়ক দেখা দিলে দেরি করার কোনো সুযোগ থাকে না। সেজন্য রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই সিকিউর ২ গ্রাম প্রতি লিটার অথবা মেলোডিডুও ৪ গ্রাম ও সিকিউর ২ গ্রাম প্রতি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে উপকার পাবেন। এছাড়া অ্যাক্রোভেট এম জেড নামক ছত্রাকনাশকও ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া রোগের মাত্রা বেশি হলে ৩-৪ দিন পর পর সঠিক মাত্রার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। কিন্তু যদি পাতা ভেজা থাকে তবে অবশ্যই প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম সাবানের গুঁড়া পাউডার ছত্রাকনাশকের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ছত্রাকনাশক এমনভাবে স্প্রে করতে হবে যাতে করে আলু গাছের পাতার নিচ ও ওপরের অংশ ভালোভাবে ভিজে যায়। সবচেয়ে ভালো পাওয়ার স্প্রে ব্যবহার করা। আর আক্রান্ত জমিতে সাময়িকভাবে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাহলেই আপনি সুফল পাবেন।
মো. গোলাম মোস্তফা, গ্রাম : পিরোজপুর, উপজেলা : মেহেরপুর সদর, জেলা : মেহেরপুর
প্রশ্ন : ভুট্টা গাছের বয়স ১.৫ মাস, গাছে জোর নেই। করণীয় কী?
উত্তর : আপনার ভুট্টা গাছের সমস্যার সমাধানে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স অনুযায়ী দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে সুফল পাবেন। এছাড়া জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। পরবর্তীতে মোচা বের হলে ভুট্টা গাছে তৃতীয় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। এসব কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা নিলে আপনার ভুট্টা আবাদ অন্য যে কারোর চেয়ে ভালো হবে। আপনি লাভবান হবেন।
মো. রুবেল ইসলাম, গ্রাম : খাটুরিয়া, উপজেলা : ডোমার, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : পেঁয়াজের পাতা আগা থেকে পুড়ে আসছে এর প্রতিকার কী?
উত্তর : পেঁয়াজের পাতা আগা থেকে পুড়ে যাওয়া রোগটির নাম পেঁয়াজের ব্লাইট রোগ। এটি ছত্রাকের আক্রমণ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতায় পানি ভেজা বাদামি দাগ পড়ে। পরে রোগাক্রান্ত পাতা মরতে থাকে। এ রোগ দমনে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক এককভাবে কিংবা ২ গ্রাম রোভরাল ও ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাবেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ, গ্রাম : ধল্লাপাড়া, উপজেলা : ঘাটাইল, জেলা : টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : মুরগি চোখ বুজে, মাথা এবং ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিমাচ্ছে। সাদা চুনা পায়খানা করছে। হঠাৎ মারা যাচ্ছে। পরামর্শ চাই।
উত্তর : মুরগির রানীক্ষেত রোগ হয়েছে। আর এ রোগ হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে সিপ্রোফ্লক্সাসিন বা অ্যামোক্সিসিলিন গ্রুপের ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া এ রোগে মুরগি যাতে আর আক্রান্ত না হয় সে কারণে প্রতিষেধক হিসেবে রানীক্ষেত রোগের টিকা দিতে হবে। ৫-৭ দিন বয়সে বিসিআরডিভি টিকা এবং ২ মাস বয়সে আরডিভি টিকা দিতে হবে। তবেই এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
মো. ওমর আলী, গ্রাম : চৈতন্যপুর, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : গরুর দুগন্ধযুক্ত ও মিউকাস মিশ্রিত ডায়রিয়া হচ্ছে। পায়খানার সাথে রক্তের ছিটা ও আম দেখা যাচ্ছে। কী প্রয়োগ করতে হবে?
উত্তর : গরুর কক্সিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় হয়েছে। এমোডিস ভেট বোলাস ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন খাওয়াতে হবে ৩-৫ দিন সাথে গ্লুকোলাইট অথবা রেনালাইট খাওয়াতে হবে যতদিন ভালো না হয়। আরও যে কোনো পরামর্শের জন্য আপনার কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে যোগাযোগ করলে লাভবান হবেন।
মাজহারুল ইসলাম, গ্রাম : ধরধরা উপজেলা : বোদা, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : পোনা বড় হচ্ছে না করণীয় কী?
উত্তর : পুকুরে বিশ্বস্ত ও নামি হ্যাচারি বা সরকারি হ্যাচারির সুস্থ ও সবল পোনা সরবরাহ না করলে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তত করে পোনা ছাড়ার আগে শতক প্রতি ১ কেজি করে পাথরের চুন দিতে হবে এবং ৭ দিন পর রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। এরপর মাছের ওজনের শতকরা ৫ ভাগ খাবার সরবরাহ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ভালো কোম্পানির গুণগত মানসম্পন্ন ফিড খাওয়াতে হবে। আবারো ২ মাস পরপর চুন এবং ১৫ দিন পরপর রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে।
মো. খাইরুল আলম, গ্রাম : এলাইগা, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : মাছ চাষের ক্ষেত্রে নার্সিং করার পদ্ধতি কী?
উত্তর : ঘেরের একপাশে অল্প জায়গায় পরিমাণমতো ৪০০০-৫০০০টি পোনা ১০ থেকে ১৫ দিন রেখে পোনাকে ভালোভাবে লালনপালন করতে হবে। ডিমের কুসুম, আটা ও পানি মিশ্রিত করে পোনার খাবার হিসেবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পরে ঘেরে ছেড়ে দিতে হবে। আরও যে কোনো পরামর্শের জন্য আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে সুফল পাবেন।
কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এল আর, সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ suman_arefin@yahoo.com
চৈত্র বাংলা বছরের শেষ মাস। অর্থাৎ আমরা ১৪২৪ বঙ্গাব্দের শেষ অংশে চলে এসেছি। কিন্তু কৃষির শেষ বলে কিছু নেই। এ মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এক সাথে করতে হয় বলে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিতে আপনাদের শুভ কামনাসহ সংক্ষিপ্ত শিরোনামে জেনে নেই এ মাসে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না।
সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে।
এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম সালফার ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে।
পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাইমুক্ত করতে পারেন।
এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
দেরিতে বপন করা গম পেকে গেলে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
শুকনো বীজ ছায়ায় ঠা-া করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি ইত্যাদিতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিপ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে।
শতাংশ প্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম ।
প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম দিতে হবে ।
পাট
চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়।
পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪।
পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে প্রয়োজন হয় ২৫-৩০ গ্রাম বীজ।
পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো।
ভালো ফলনের জন্য শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময় ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ২০ গ্রাম দস্তা সার দিতে হবে।
চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টিআলু, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন যদি এখনও মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে।
সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে।
এসময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও অ্যান্থাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কান্্জা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
কলা বাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে।
পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে।
নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ বপন করতে পারেন।
যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈব সার প্রয়োগ করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
শীতকাল শেষ হয়ে গরম পড়ার সময়টিতে পোলট্রি খামারি ভাইদের বেশ সর্তক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাই আগ থেকেই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিতে পারে। সে জন্য খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে।
চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে, তাই গবাদিপশুর এ সময় বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনার গবাদিপশুকে ছায়ায় রাখতে হবে এবং বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে, সেই সাথে নিয়মিত গোসল করাতে হবে।
গবাদিপশুর গলাফুলা, তড়কা, বাদলা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের আঁতুর পুকুর তৈরির কাজ এ মাসে শেষ করতে হবে।
পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাঁদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে।
পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষিকথায় কৃষি কাজের জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণীসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আপনাদের সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫