জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, এমপি মহোদয়ের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় দেশ আজ দানাজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এ দেশের মানুষের জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। সে ক্ষেত্রে তেলজাতীয় ফসল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তেলজাতীয় ফসলের মাঠে মৌ চাষ করলে একদিকে ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ২০-৩০% বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার মধু উৎপাদিত হয়। মৌ চাষের প্রচলিত ধারণা মধু উৎপাদনের জন্য হলেও মধুর আয়ের চেয়ে ৭০-৮০ গুণ অধিক অর্থ আসে পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে।
মৌমাছি একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ অথচ এর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর। আমাদের দেশে ৪টি প্রজাতির (Apis florea, Apis cerama, Apis mellifera I Apis dorsata) মৌমাছি পাওয়া গেলেও বর্তমানে মৌ চাষে এপিস মেলিফেরা (Apis mellifera) প্রজাতির মৌমাছি ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি মৌ বাক্স থেকে বছরে গড়ে প্রায় ২০ কেজি মধু উৎপাদিত হয়, যার বর্তমান বাজারমূল্য (৩০০ টাকা/কেজি) প্রায় ৬,০০০ টাকা। এছাড়া পরাগায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসলের ফলন প্রায় ২০-৩০% বৃদ্ধি পায়। দেশে সরিষাসহ তেলজাতীয় ফসলের প্রায় ৬ লক্ষ হেক্টর আবাদি জমিতে হেক্টরপ্রতি একটি মৌ-বাক্স স্থাপন করলে প্রায় ১২,০০০ মেট্রিক টন মধু উৎপাদনসহ ফসলের ন্যূনতম ১০% ফলন বৃদ্ধি বিবেচনায় প্রায় ৭০,০০০ মেট্রিক টন অধিক তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন সম্ভব।
মধু অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার হিসেবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থসহ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় স্বীকৃত ও প্রমাণিত। মধুতে প্রায় ১৮১ ধরনের রাসায়নিক উপাদানসহ বিভিন্ন এনজাইম ও ভিটামিন রয়েছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ পুষ্টির জোগান দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদিত মধু ভারত ও জাপানসহ অন্যান্য দেশেও রফতানি হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশে একাধিক মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্টও স্থাপিত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪-৫ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদিত হচ্ছে অথচ সম্ভাব্যতা প্রায় ৪০-৫০ হাজার মেট্রিক টন। দেশে বিসিকসহ আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মৌ চাষ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের গ্রাম বাংলার সব শ্রেণীর কৃষক সমাজকে সম্পৃক্ত করে ফসলের ফলন ও মধুর উৎপাদন বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে মৌ চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘চাষি পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প-২য় পর্যায়’ এর মাধ্যমে ফসল ও মধুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারা দেশে মৌ চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যার মধ্যে সংস্থার ৬০০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ (টিওটি) ও ২,৫০,০০০ কৃষককে মৌ পালনের ওপর ওরিয়েন্টেশন প্রশিক্ষণ প্রদান উল্লেখযোগ্য। সমাপ্ত প্রায় প্রকল্পটির সফলতায়- এর পরবর্তীতে ‘কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প-৩য় পর্যায়’ এর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মৌ পালন কার্যক্রমকে আরও ত্বরান্বিত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের চলমান উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হলো মাঠ পর্যায়ের ৯০০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ (টিওটি) প্রদান, ৬০ জন কর্মকর্তাকে ৩ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স প্রশিক্ষণ প্রদান, ইউনিয়নভিত্তিক ৪,৫০০টি কৃষক উদ্যোক্তা (এসএমই) তৈরি এবং কৃষক উদ্যোক্তদের মধ্যে ২০০টি মৌ বাক্স বিতরণ। প্রকল্পগুলোর কার্যক্রমের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক রাজস্ব কার্যক্রমের আওতায় চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মৌ চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উল্লেখ্য, এ কার্যক্রমের আওতায় চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশব্যাপী সরিষা, কালিজিরা, ধনিয়া, পেঁয়াজ ও তিল ফসলের জমিতে প্রায় ১,০৯,২৬৫টি মৌ বাক্স স্থাপনের মাধ্যমে ফসলগুলোর ফলন ও মধুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে সংস্থাটির সম্প্রসারণ কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ফসলের মাঠে মৌ পালন, অর্থ পুষ্টি বাড়বে ফলন
দেশব্যাপী মৌ চাষ ও মধুর উৎপাদন বৃদ্ধিকরণে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সংস্থাসমূহগুলোতে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ সকল কর্মসূচির মধ্যে টেকসই মৌ চাষ পরিকল্পনা গ্রহণ, মৌ চাষ সম্প্রসারণে জনসাধারণকে মধুর চাষসহ মৌ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ, মৌ চাষ সম্প্রসারণে প্রশিক্ষক, আগ্রহী চাষি, মধু উৎপাদকগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান, মৌ চাষকে শিল্পে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়াও মধুর ভেজাল প্রতিরোধে ও গুণগত মান নিশ্চতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন, মৌ চাষের অভিজ্ঞতা বিনিময়, মৌ চাষের সরঞ্জাম স্বল্পমূল্যে সরবরাহ, মধু বাজারজাতকরণে সহায়তা এবং মৌ চাষকে স্থায়ী রূপ প্রদানে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি কমিউনিটি সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সকল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও আন্ত:সর্ম্পক গড়ে তোলার মাধ্যমে মৌ শিল্প আগামী দিনে আরো বেশি বিকশিত হবে। দেশব্যাপী ফসলের মাঠগুলোতে মৌ চাষ কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল ও মধুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকসহ সব পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারকে মৌ চাষে আরও উদ্বুদ্ধ করতে এবং আধুনিক কলাকৌশলগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে তুলে ধরতে মৌ মেলার আয়োজনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত কেনাফের একটি উন্নত জাত, যা ইরান থেকে আহরিত কৌলিক সম্পদ (এক্সেশন ১৬৪১) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে।
শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য : গাছের কাণ্ড গাঢ় তামাটে লাল, পাতার রঙ খয়েরি সবুজ ও করতলাকৃতি এবং পাতার বোঁটার উপরিভাগ তামাটে লাল রঙ।
চাষ উপযোগী জমি : উঁচু ও নিচু উভয় প্রকার অথচ বৃষ্টির পানি জমে না এরূপ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি এ জাতের জন্য উপযোগী। এছাড়াও উপকূলীয় ও চর অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর পতিত জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল বিজেআরআই কেনাফ-৪ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
বপন কাল : জাতটি চৈত্রের প্রথম থেকে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে উত্তম সময় ১৫ চৈত্র থেকে ১৫ বৈশাখ পর্যন্ত।
জমি তৈরি ও বীজ বপন : জমির প্রকারভেদে আড়াআড়ি ৩-৫ বার গভীর চাষের পর ২-৩ বার মই দিয়ে জমির মাটি মিহি করা প্রয়োজন। ছিটিয়ে ও সারিতে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৬-৭ সেমি.।
বীজের পরিমাণ : ছিটিয়ে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ১৭ কেজি এবং সারিতে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৪ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : প্রতি হেক্টর জমির জন্য ইউরিয়া ১৩০ কেজি, টিএসপি ২৫ কেজি এবং এমওপি ৪০ কেজি পরিমাণ সার দরকার। তবে শুকনা গোবর সার ব্যবহার করা হলে প্রতি হাজার কেজি শুকনো গোবর সার ব্যবহারের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের দিন নির্ধারিত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া প্রথম কিস্তি হিসেবে এবং সম্পূর্ণ মাত্রার টিএসপি এবং এমওপি সার জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করে এদিয়ে মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তি ইউরিয়া সার গাছের ৪৫ দিন বয়সে সামান্য শুকনো মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা : বীজ বপনের এক হতে দুই সপ্তাহ পর জমির জো অনুযায়ী আঁচড়া দিতে হবে। এ সময় চারার সংখ্যা ঘন হলে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করা যায়। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা হয় এবং সুস্থ সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ তুলে ফেলতে হবে। অধিক আঁশ ফসলের জন্য কেনাফ ফসলের প্রাথমিক পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিড়ানি ও পাতলাকরণে অবহেলা করলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে ফলন কমে যায়।
ফুল আসার সময়কাল : ১৪০-১৬০ দিন (বপনের ১২০ দিন পর থেকে কর্তনযোগ্য)।
কর্তন, জাক দেয়া, ধোয়া, শুকানো ও গুদামজাতকরণ : গাছের বয়স ১১০ থেকে ১২০ দিন হলে কাটা যায় এবং ফলন ভালো পাওয়া যায়। চিকন ও মোটা গাছ আলাদাভাবে আঁটি বেঁধে পাতা ঝরিয়ে গোড়া ৩/৪ দিন এক ফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরে পরিষ্কার পানিতে জাক দিতে হবে। জাক খুব পুরু না করে খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেয়া ভালো। আঁশ যাতে বেশি পচে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ আঁশ যত পরিষ্কার করে ধোয়া যায় ততই উজ্জ্বল হয়। ধোয়া আঁশ বাঁশের আড়ে শুকানো উচিত। মাটিতে শুকালে ময়লা হয়ে আঁশের মান খারাপ হয়। আঁশ শুকানোর পর বান্ডেল বেঁধে গুদামজাত ও বাজারজাত করা হয়। কাগজ শিল্পে ব্যবহারের জন্য বায়োমাস হিসেবে এ ফসল কাটা হলে হালকা আঁটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। এতে পাতা ঝরার সঙ্গে সঙ্গে কা-ে জলীয় বাষ্প কমে যাবে এবং কা- পচা প্রতিহত হবে।
বীজ উৎপাদন : আঁশের জন্য বপনকৃত গাছ থেকে আশানুরূপ বীজ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বীজ উৎপাদনের জন্য তিনটি পদ্ধতিতে নাবি কেনাফ বীজ উৎপাদন করা যায়। যথা-
১. সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদনের জন্য মধ্য জুলাই থেকে আগস্ট মাসের শেষ (শ্রাবণ থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি) পর্যন্ত কিছুটা উঁচুু এবং জলাবদ্ধতা মুক্ত জমিতে পাতলা করে (প্রতি শতকে ৪০-৫০ গ্রাম) বীজ বপন করতে হয়। জমির শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমির জন্য ১৯০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১৬০ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতক জমির জন্য চারা গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর ১৯০ গ্রাম এবং ৬০-৬৫ দিন পর আরও ১৯০ গ্রাম ইউরিয়া সার শুকনো ছাই বা শুকনো গুঁড়া মাটি মিশিয়ে বিকালে জমিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকালীন জমিতে পর্র্যাপ্ত রস থাকে এবং প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতা ও ডগায় না লাগে।
২. কাটিং বা ডগা রোপণ পদ্ধতি : গাছের বয়স ১০০-১১০ দিন হলে ডগা (১.৫-২.০ ফুট) ধারালো ছুরি বা চাকু দিয়ে কেটে ৩-৪ টুকরা করে (প্রতি টুকরায় কমপক্ষে ৩টি পর্ব থাকতে হবে) পর্যাপ্ত আর্দ্রতাসমৃদ্ধ জমিতে সারি করে উত্তরমুখী কাত (৪৫ ডিগ্রি কোন) করে ৫-৬ ইঞ্চি দূরে দূরে লাগাতে হবে। কাটিং লাগানোর আগে বড় পাতা গুলো ফেলে দিতে হবে। জমির শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমির জন্য ৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতক জমির জন্য গাছের বয়স ২০-২৫ দিন পর ৭০ গ্রাম এবং ৪০-৪৫ দিন পর আরও ৭০ গ্রাম ইউরিয়া সার জমিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তীতে এ রোপণকৃত কাটিং থেকে শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে এবং তা থেকে প্রচুর পরিমাণে বীজ উৎপন্ন হয়। বীজের গুণগত মানও ভালো হয়। এ পদ্ধতিতে প্রতি শতক জমিতে ২.৫-৩.০ কেজি বীজ সহজেই উৎপন্ন করা যায়।
৩. চারা রোপণ পদ্ধতি : চারা রোপণ পদ্ধতিতে প্রথমে বীজতলায় বীজ বপন করে চারা উৎপন্ন করা হয়। উঁচু জমিতে ৩ মি.x১ মি. সাইজের বীজতলা তৈরি করে আষাঢ় মাসে (১৫জুন-১৫জুলাই) বীজ বপন করতে হবে। বীজতলার চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে চারাগুলো রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। বীজতলা থেকে চারা তুলে নিয়ে ছায়ায় রাখতে হবে। প্রতিটি চারার ডগার ২/৩টি পাতা রেখে অন্যান্য সব পাতার বোঁটা বাদে বাকি অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। বীজতলা থেকে যেদিন চারা তুলা হবে ওইদিনই মূল জমিতে চারা রোপণ করা ভালো। মূল জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সেমি. বা ১ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব¡ ১০ সেমি. বা প্রায় ৪ ইঞ্চি রাখতে হবে। মেঘলা দিনে অথবা সন্ধ্যার আগে যখন রোদ থাকে না তখন চারা রোপণ করা ভালো।
বীজ ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ : গাছের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফল বাদামি রঙ ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। তবে রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোনো অবস্থাতেই বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। পর্যাপ্ত শুকানো বীজ ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিকের ক্যান, টিন, কাঁচের পাত্র ইত্যাদিতে ভরে মুখ ভালোভাবে (বায়ুরোধী) বন্ধ করে ঘরের মধ্যে এক কোণে ঠাণ্ডা স্থানে রাখলে ১/২ বছর বীজ ভালো থাকে। তবে বীজের পরিমাণ বেশি হলে প্লাস্টিক বা টিনের ড্রামে তা সংরক্ষণ করা যাবে। সংরক্ষণের পাত্র অবশ্যই বায়ুরোধী হতে হবে। বায়ুরোধী প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণকৃত বীজ প্রায় ২ বছর ভালো থাকে।
উপযুক্ত শস্যক্রম : গাছের বয়স ১১০ থেকে ১২০ দিনের মতো হলে কেটে জমিতে চাষ ও এদিয়ে রোপা আমন ধান চাষ করা যায় এবং পরবর্তী ফসল হিসেবে গম/অন্যান্য রবি ফসল চাষাবাদ করা যায়। আগাম বোরো ধান কর্তন করেও এ জাতের কেনাফ চাষাবাদ করা যায়।
বিজেআরআই মেস্তা-৩ : বিজেআরআই মেস্তা-৩ (মসৃণ মেস্তা) বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত মেস্তার একটি উন্নত জাত, যা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম (এক্সেশন ৫০৯৭) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। দ্রুতবর্ধনশীল ও নেমাটোড প্রতিরোধী এ জাতটি সম্পূর্ণ মসৃণ, যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত মেস্তা জাতগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং আগের জাতগুলো থেকে কৃষকের কাছে অধিক পছন্দনীয়। শিকড় মাটির গভীরে যায় বলে এ জাতটি তুলনামূলকভাবে খরাসহিষ্ণু।
শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য : গাছ সম্পূর্ণ সবুজ ও মসৃণ। কাঁটাবিহীন ও রোগমুক্ত এ জাতের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ ও করতলাকৃতি। ফুল ক্রিম রঙের। ফল ডিম্বাকৃতি ও মসৃণ।
চাষ উপযোগী জমি : উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে বৃষ্টির পানি জমে না এরূপ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি এ জাতের জন্য উপযোগী। এছাড়াও খরাপীড়িত চরাঞ্চলের পতিত বেলে জমি ও শুষ্ক অঞ্চলের প্রান্তিক জমিতে এ জাতটি বপন উপযোগী।
বপন কাল : জাতটি চৈত্রের প্রথম থেকে বৈশাখের শেষ (১৫ মার্চ থেকে ১৫ মে) পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে উত্তম সময় ১৫ চৈত্র থেকে ১৫ বৈশাখ পর্যন্ত।
জমি তৈরি ও বীজ বপন : জমির প্রকার ভেদে আড়াআড়ি ৩-৫ বার গভীর চাষের পর ২-৩ বার মই দিয়ে জমির মাটি মিহি করা প্রয়োজন। ছিটিয়ে ও সারিতে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৬-৭ সেমি.।
বীজের পরিমাণ : ছিটিয়ে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১২ থেকে ১৪ কেজি এবং সারিতে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : প্রতি হেক্টর জমির জন্য ইউরিয়া ১১০ কেজি, টিএসপি ২৫ কেজি এবং এমওপি ৩০ কেজি পরিমাণ সার দরকার। তবে শুকনা গোবর সার ব্যবহার করা হলে প্রতি হাজার কেজি শুকনো গোবর সার ব্যবহারের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের দিন নির্ধারিত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া প্রথম কিস্তি হিসেবে এবং সম্পূর্ণ মাত্রার টিএসপি এবং এমওপি সার জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করে মই দিয়ে মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। নির্ধারিত মাত্রার বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার গাছের ৪৫ দিন বয়সে সামান্য শুকনো মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকালীন জমিতে পর্র্যাপ্ত রস থাকে এবং প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতা ও ডগায় না লাগে।
পরিচর্যা : বীজ বপনের এক হতে দুই সপ্তাহ পর জমির জো অনুযায়ী আঁচড়া দিতে হবে। এ সময় চারার সংখ্যা ঘন হলে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করা যায়। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা হয় এবং সুস্থ সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ তুলে ফেলতে হবে। গাছে রোগ বালাই দেখা দিলে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। অধিক আঁশ ফসলের জন্য মেস্তা ফসলের প্রাথমিক পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিড়ানি ও পাতলাকরনে অবহেলা করলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে ফলন কমে যায়।
ফুল আসার সময়কাল : ১৮০-২১০ দিন (বপনের ১২০ দিন পর থেকে কর্তনযোগ্য)।
কর্তন, জাক দেয়া, ধোয়া ও শুকানো : গাছের বয়স ১২০ থেকে ১৩০ দিন হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়। চিকন ও মোটা গাছ আলাদা আলাদাভাবে আঁটি বেঁধে পাতা ঝরিয়ে গোড়া ৩/৪ দিন এক ফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরে পরিষ্কার পানিতে জাক দিতে হবে। জাক খুব পুরু না করে খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ভালো। আঁশ যাতে বেশি পচে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ আঁশ যত পরিষ্কার করে ধোয়া যায় ততই উজ্জ্বল হয়। ধোয়া আঁশ বাঁশের আড়ে শুকানো উচিত। মাটিতে শুকালে ময়লা হয়ে আঁশের মান খারাপ হয়।
বীজ উৎপাদন : নাবি বীজ উৎপাদন পদ্ধতি অবলম্বন করে কাক্সিক্ষত পরিমাণ বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদনের জন্য মধ্য জুলাই থেকে আগস্ট মাসের শেষ (শ্রাবণ থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি) পর্যন্ত কিছুটা উঁচু এবং জলাবদ্ধতা মুক্ত জমিতে পাতলা করে (প্রতি শতকে ৩৫ থেকে ৪৫ গ্রাম) বীজ বপন করতে হয়। জমির শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমির জন্য ১৬০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১২০ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতক জমির জন্য চারা গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর ১৬০ গ্রাম এবং ৬০-৬৫ দিন পর আরও ১৬০ গ্রাম ইউরিয়া সার শুকনো ছাই বা শুকনো গুঁড়া মাটি মিশিয়ে বিকালে জমিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
বীজ ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ : গাছের শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ফল বাদামি রঙ ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। পর্যাপ্ত শুকানো বীজ ঠা-া করে প্লাস্টিকের ক্যান, টিন, কাচের পাত্র ইত্যাদিতে ভরে মুখ ভালোভাবে (বায়ুরোধী) বন্ধ করে ঘরের মধ্যে এক কোণে ঠাণ্ডা স্থানে রাখলে ১/২ বছর ওই বীজ ভালো থাকে। তবে বীজের পরিমাণ বেশি হলে প্লাস্টিক বা টিনের ড্রামে তা সংরক্ষণ করা যাবে।
ফলন : অনুকূল আবহাওয়া ও উপযুক্ত পরিচর্যায় ১২০ দিনে এ জাতের ফসল কেটে কৃষকের জমিতে বিঘাপ্রতি প্রায় ৯-১০ মণ আঁশ এবং প্রায় ২৫-২৭ মণ খড়ি পাওয়া যায়। জমি ভেদে উপযুক্ত পরিচর্যায় এ জাত থেকে প্রতি শতাংশে ২.৫-৩.০ কেজি উন্নতমানের মেস্তা বীজ পাওয়া যায়।
উপযুক্ত শস্যক্রম : গাছের বয়স ১২০ দিন হলে কেটে জমিতে চাষ ও মই দিয়ে রোপা আমন ধান বোনা যায় এবং পরবর্তী ফসল হিসেবে গম/অন্যান্য রবি ফসল ও মেস্তা বীজ চাষাবাদ করা যায়। আগাম বোরো ধান কর্তন করেও এ জাতের মেস্তা চাষাবাদ করা যায়।
কৃষিবিদ মো. আল-মামুন*
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭; ০১৭১১১৮৬০৫১; almamunbjri@gmail.com
আম এদেশে চাষযোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বর্তমানে দেশের ২২টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে আমের চাষাবাদ। তবে জনপ্রিয় এই ফলটি দেশের সব জেলাতেই জন্মাতে ও ফলন দিতে পারে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ- গন্ধে আম একটি অতুলনীয় ফল। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আম বাগানে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। বর্তমান সময়ে আম বাগানে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আম চাষি নিজের অজান্তে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক বহুবার ব্যবহার করছেন। কীটনাশক স্প্রের বিষয়ে এখনই সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আম বাগানে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অল্প থেকে শুরু করে ব্যাপকও হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ছোট আকারের ফসলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দমন পদ্ধতি যেমন-আক্রান্ত পাতা বা গাছের অংশ ছিঁড়ে ফেলা, পোকার ডিম বা কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করা, জাল দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করা সম্ভব কিন্তু আমের মতো বৃহৎ গাছে রোগ বা পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। আমের ফলন মূলত নির্ভর করে আম গাছে মুকুল বা পুষ্পমঞ্জুরির সংখ্যার ওপর। তাই আমের মুকুলে পোকা বা রোগের আক্রমণ হলে মুকুল বা ফুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে ফলে ফলধারণ ব্যাহত হতে পারে। সুতরাং মুকুলে রোগ বা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়া মাত্রই বালাইনাশকের স্প্রে করার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্প্রের মূলনীতি : যে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করতে ৪টি মূলনীতি অবশ্যই মেনে চলা উচিত। এগুলো হলো সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ।
সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন : আমের রোগ বা ক্ষতিকর পোকা লাভজনকভাবে ও কম খরচে দমন করতে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা একটি অতীব গুরুত্বপূর্র্ণ পদক্ষেপ। ওষুধ নির্বাচনে কোনো ভুল হয়ে থাকলে স্প্রে কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে ভেস্তে যায়। এতে শ্রম, সময় ও অর্থের অপচয় ঘটে উপরন্ত আসল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। তখন কৃষক কীটনাশক ডিলারদের জিজ্ঞাসা করেন কি ওষুধ স্প্রে করতে হবে, এটা মোটেই ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সঠিক পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষিকর্মী, কৃষি অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। একই গ্রুপের কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বার বার স্প্রে না করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উচিত কারণ একই ওষুধ বার বার স্প্রে করলে পোকা বা রোগের জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে।
সঠিক মাত্রা নির্ধারণ : সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। বালাইনাশকের মাত্রা কম বা বেশি না হওয়াই উত্তম। উপযুক্ত মাত্রা না হলে রোগ বা পোকামাকড় ভালোভাবে দমন করা সম্ভব হয় না। উপরন্ত রোগের জীবাণু বা পোকার মধ্যে বালাইনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার অধিক মাত্রায় বালাইনাশকের ব্যবহার অর্থের অপচয় হয় এবং ফলগাছের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই বালাইনাশকের মাত্রার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এজন্য বোতল বা প্যাকেটের গায়ে লিখিত নির্দেশনা, কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং কৃষিকর্মীর পরামর্শমতো কাজ করা উচিত।
সঠিক সময় নির্বাচন : কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। এ কথা সত্য যে কোনো কাজ সঠিক সময়ে সমাধা করতে পারলে বাড়তি শ্রম ও বাড়তি খরচের অপচয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আম গাছে মুকুল আসার পর থেকে ফলধারণ পর্যন্ত সময়টুকু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে গাফিলতি করা মোটেই ঠিক নয়। এ সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে আমগাছে ফলধারণ নাও হতে পারে। আম বাগানে মুকুল আসার আনুমানিক ১০-১৫ দিন আগে আমগাছে প্রথম স্প্রে দিতে হবে। আমের মুকুল ১০-১২ সেমি. হলেই দ্বিতীয় স্প্রে দেয়া উচিত। মুকুলের ফুল ফোটার পর কোনো অবস্থাতেই স্প্রে করা যাবে না। আমের পরাগায়ন প্রধানত বিভিন্ন প্রজাতির মাছির দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ফুল ফোটার সময় কীটনাশক স্প্রে করলে মাছি মারা যেতে পারে এবং আমের পরাগায়ন ও ফলধারণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। গাছ থেকে ফল পাড়ার কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে গাছে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। গাছে মুকুল বের হওয়ার আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে প্রয়োজনীয় অর্থ, শ্রমিক, স্প্রে যন্ত্রপাতি, ওষুধ ইত্যাদি মজুদ রাখতে হবে।
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ : সঠিক ওষুধ, সঠিক মাত্রা, সঠিক সময় ইত্যাদি নির্ধারণের পর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন। স্প্রে কার্যক্রম থেকে পরিপূর্ণ ফল লাভ করতে হলে অবশ্যই সঠিক পদ্ধতিতে স্প্রে করতে হবে। ফলের মধ্যে বা ডালের মধ্যে ছিদ্রকারী পোকা অবস্থান করলে বাইরে কীটনাশক স্প্রে করলে কোনো লাভ হয় না। আমের হপার পোকা সুষ্ঠুভাবে দমন করতে হলে পাতায় স্প্রে করার সাথে সাথে গাছের গুঁড়িতেও স্প্রে করা প্রয়োজন। তাই সুষ্ঠুভাবে রোগ বা পোকা দমনের জন্য স্থানীয় কৃষি অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ করে পরামর্শ নেওয়া উচিত।
যে কোনো রোগ বা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটি জিনিস চিন্তা করা দরকার তা হলো রোগ বা পোকা দমন করে কতটুকু লাভবান হওয়া যাবে। রোগ বা পোকার আক্রমণে যে পরিমাণ অর্থের ক্ষতি করবে দমনের খরচ যদি তার চেয়ে বেশি হয় তবে সে রোগ বা পোকা দমনের জন্য স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। রোগ বা পোকার আক্রমণ কম হলে এবং তা মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সে ক্ষেত্রে স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত নয়। অহেতুক স্প্রে করলে অর্র্থ ও শ্রমের অপচয় হয়। তবে আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ বা পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ দেখা না গেলেও আবহাওয়া যদি রোগের আক্রমণের জন্য অনুকূল হয় তবে প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। অনুরূপভাবে আমের মুকুলে হপার বা শোষক পোকার উপস্থিতি কম হলেও প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। কেননা এ পোকা অনুকূল আবহাওয়ায় অতি অল্প সময়ে অনেক বংশ বৃদ্ধি করতে ও মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম।
সতর্কতা : কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক মাত্রই বিষ। তাই এদের ব্যবহারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সতর্কতা অবলম্বনে কোনো প্রকার গাফিলতি দেখালে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই কীটনাশক ডিলার ভাইদের উচিত কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বিক্রির সময় সেগুলো ব্যবহারে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা আমচাষি ভাইদের স্মরণ করে দেয়া। যে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে-
কোনো বালাইনাশক সরাসরি হাত দিয়ে স্পর্শ করা উচিত নয়। প্রয়োজনে হাতে গ্লাবস ব্যবহার করতে হবে। যিনি বালাইনাশক স্প্রে করবেন তার সমস্ত শরীর ঢেকে রাখার জন্য এপ্রোন পরিধান করতে হবে। চোখে চশমা ও মাথায় ক্যাপ বা হেলমেট পরতে হবে। পায়ে জুতা থাকা ভালো।
কোনো বালাইনাশক মুখে দেয়া বা গন্ধ নেয়া যাবে না। স্প্রেকালীন কোনো প্রকার খাওয়া-দাওয়া বা ধূমপান করা যাবে না। স্প্রে সময়ে পুকুর বা অন্য কোনো পানির উৎস যাতে দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্প্রে শেষ হলে শরীর ও জামাকাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। খাদ্যদ্রব্য ও পশুখাদ্য স্প্রে এলাকা থেকে দূরে রাখতে হবে। স্প্রে করার ২ দিনের মধ্যে গাছের নিচে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি চরতে দেয়া অনুচিত কারণ তারা ঘাস বা মৃত পোকামাকড় খেয়ে বিপদে পড়তে পারে। বাতাসের অনুকূলে স্প্রে করতে হবে অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে বাতাস পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হলে গাছের পূর্ব দিকে দাঁড়ায়ে স্প্রে করতে হবে। বালাইনাশকের খালি প্যাকেট বা বোতল অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
ব্যবহারের পর স্প্রে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
স্প্রে করার ১৫-২০ দিনের মধ্যে গাছের আম খাওয়া যাবেনা তাই আম পাড়ার ১৫-২০ দিন আগেই আম গাছে স্প্রে বন্ধ করতে হবে। সব বালাইনাশক শুষ্ক ও ঠাণ্ডা জায়গায় তালাবদ্ধ অবস্থায় এবং শিশুদের নাগালের বাইরে সংরক্ষণ করতে হবে।
আম বাগানের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনায় প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থায় বেশি কার্যকরী। উল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপর নজর দিলে খুব সহজেই এবং কম খরচে আম বাগানের রোগ-পোকামাকড় দমন করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব হবে। পরিশেষে আমচাষির জন্য একটি পরামর্শ হলো সম্ভব হলে একই এলাকার সব আম বাগানে একই সময়ে স্প্রে করা, এটি পোকামাকড় দমনে খুবই কার্যকর ও ফলপ্রসূ।
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
এ দেশের বনে জঙ্গলে, ঝোপ ঝাড়ে, রাস্তার ধারে পান পাতার মতো পাতাবিশিষ্ট লতানো পিপুল গাছ মাঝে মধ্যে দেখা যায়। পিপুল ফলের স্বাদ ঝাল। পিপুল ফল খাওয়া যায়।
গাছটি এদেশে দুষ্প্রাপ্য নয় কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। ওষুধার্থে পিপুল গাছের পাতা কখনও ব্যবহৃত হয় না, এর মূল ও অপক্ব ফল ব্যবহার করা হয়। পিপুলের বীজ পপি বীজের মতো সূক্ষ্ম কণাবিশিষ্ট। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ে বেদে পিপুলের নাম কন বা কণা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পিপুল খুব সূক্ষ্ম হয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে বলেই এর এরূপ নাম। দ্রব্যটি সূক্ষ্ম হয়ে দেহে প্রবেশ করে রসধাতু পান করে নেয় আবার সূক্ষ্ম হয়ে বেরিয়ে যায়। তার এই পান বা শোষণ করার ধর্ম থেকে নাম রাখা হয়েছে পিপ্পল, এ থেকে পিপ্পলি, পিপলি বা পিপুল। তামিল শব্দ পিপ্পলি থেকে পিপুল নামের উদ্ভব। বৈদিক যুগে পিপুল ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত ভেষজ গাছ। বেদশাস্ত্রে প্রথম পিপুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদে পিপুলকে উঁচু স্থানও দেয়া হয়েছে ও পিপুলের ভেষজ গুণ বর্ণিত হয়েছে। চরকসংহিতার যুগে পিপুল ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত ভেষজ উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম Long pepper পিপুলের ফল লম্বা ও ঝাল বলে হয়তো এর ইংরেজি নাম হয়েছে লং পিপার।
উৎপত্তি ও বিস্তার : পিপুলের জন্মভূমি প্রাচীন ভারতবর্ষের মগধদেশ বলে দাবি করেছেন শিবকালী ভট্টাচার্য। মগধ দেশ ছিল বর্তমান বিহার প্রদেশের দক্ষিণাংশ। কোশল বা উত্তর প্রদেশও ছিল মগধের অঙ্গভূমি। এজন্য পিপুলের আর একটি নাম মাগধী। খৃস্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষ থেকে পিপুল গ্রিসে প্রবেশ করে এবং হিপোক্রেটাস পিপুলকে মশলার চেয়ে ভেষজ হিসেবেই বেশি আলোচনা করেন। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও আসাম, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, তিমুর প্রভৃতি দেশে পিপুল বেশি জন্মে।
উদ্ভিদতাত্ত্বিক বর্ণনা : পিপুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Piper longum L.ও পরিবার Piperaceae. চার রকমের পিপুল দেখা যায়- ১. পিপলি- এর আর এক নাম মাগধী। মগধ প্রদেশে এক সময় এ পিপুল গাছ জন্মাত বলে এর এরূপ নাম। ভারতবর্ষের প্রায় সব স্থানে এই গাছ দেখা যায়। ছোট ও বড় পিপুল এ শ্রেণীর অন্তর্গত। ২. গজপিপুল- এটি আসলে প্রকৃত পিপুল নয়, চুইঝাল গাছের ফলকে বলে গজপিপুল। ৩. সিংহলী পিপুল- সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এই পিপুল জন্মে। একে জাহাজী পিপুলও বলে। ৪. বনপিপুল- অযত্ন এই পিপুল বনে আপনা আপনি জন্মে। এর গাছ আকারে ছোট, ফলও ছোট, ঝাঁঝ কম, সরু। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে যেখানে সেখানে বনে জঙ্গলে এ পিপুল গাছ দেখা যায়। পিপুল পানের মতো একটি লতানো স্বভাবের গাছ। অবলম্বন না পেলে গাছ মাটিতেই পড়ে থাকে। অবলম্বন পেলে তা বেয়ে ওপরে ওঠে। লতায় গিঁট আছে। লতার আগা কোমল, পাতা পানপাতার মতো হৃৎপিণ্ডকার। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, নিচের পিঠ হালকা সবুজ। পত্রকক্ষ থেকে পুষ্পমঞ্জরি বের হয় ও ফল ধরে। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক গাছে আলাদাভাবে ফোটে। ফুল লম্বা দণ্ডের মতো মঞ্জরিতে ফোটে। বর্ষাকালে ফুল হয়, শরৎকালে ফল ধরে। ফল ডিম্বাকার। পিপুল ফল দেখতে অনেকটা মরিচের মতো, তবে ফল অমসৃণ ও কুঁচকানো। ফল হালকা সবুজ, কমলা ও হলুদ রঙের হয়। পাকলে ফলের রঙ লাল হয়ে যায়। শিকড় ধূসর বাদামি ও লম্বালম্বিভাবে কুঁচকানো।
মাটি ও জলবায়ু : পিপুল সাধারণত সুনিষ্কাশিত লাল, দো-আঁশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটিতে ভালো জন্মে। উর্বর মাটিতে শুধু জৈব সার দিয়ে পিপুল চাষ করা যায়। বেলে দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য ভালো। যেসব অঞ্চলে উচ্চ আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বিরাজ করে সেসব অঞ্চলে পিপুল ভালো হয়। পিপুলের জন্য ৩০-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, ৬০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও বার্ষিক ১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত উত্তম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ১০০ থেকে ১০০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে পিপুল জন্মে থাকে। অধিক উচ্চতা ও উঁচু পাহাড়ে ফলন ভালো হয় না। গাছের ভালো বৃদ্ধির জন্য আংশিক ছায়া (২০-২৫%) উত্তম।
ব্যবহার : পিপুলের বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনও প্রধানত মশলা হিসেবে। ভেষজের চেয়ে মশলা ফসল হিসেবেই বেশি চাষ করা হয়। আচার ও চাটনি তৈরিতে পিপুল চূর্ণ মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় কোনো কোনো খাদ্য সামগ্রী রান্নায় পিপুল ব্যবহার করা হয়। ভারতের বাজারে মুদি দোকানে পিপুল চূর্ণ পাওয়া যায়। পাকিস্তানে নিহারি বা নেহারি রাঁধতে পিপুল চূর্ণ এক আবশ্যকীয় মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মশলা ছাড়া এর যথেষ্ট ভেষজ গুরুত্ব রয়েছে।
ভেষজ গুণ : চরকসংহিতার সূত্র স্থানে ৯টি বিশিষ্ট রোগে পিপুলকে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এ ৯টি রোগ হলো- কণ্ঠ রোগ, তৃষ্ণা রোগ, শিরো রোগ, হিক্কা, কাশি, শূলরোগ, শীত বা ঠাণ্ডা লাগা প্রশমন ও দীপনীয়। সে যুগে পিপুল এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যেন কৃমিরোগ ও অন্ত্ররোগ চিকিৎসায় দেবতারাই তা গ্রহণ করতেন। দেহের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় পিপুল কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, আন্ত্রিক ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, মস্তিষ্কেও টিউমার, গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার প্রভৃতি রোগের বিরুদ্ধে পিপুল কার্যকর। পিপুলের মধ্যে পিপারলংগুমিনাইন নামক রাসায়নিক যৌগ থাকায় তা এসব ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও আরও যেসব রাসায়নিক উপাদান পিপুলে রয়েছে সেগুলো হলো পিপারিন, পিপলারটাইন, পিপারনোলিন, লং এমাইড, পিপারলংগিন, পিপারসাইড, পেল্লিটোরিন, বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল ইত্যাদি। শিকড়ে রয়েছে পিপারিন, স্টেরয়েডস, গ্লুকোসাইডস, পিপেলারটিন ও পিপারলংগুমিনাইন নামক রাসায়নিক উপাদান। ওষুধার্থে পিপুলের শিকড় ও ফল ব্যবহৃত হয়। সাধারণ পিপুল ফলের গুঁড়া আধা থেকে ১ গ্রাম পরিমাণ এক মাত্রা হিসেবে রোজ সেবন করা হয়। নিচে পিপুলের উল্লেখযোগ্য ভেষজ গুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
নিদ্রাহীনতা দূর করে : রাত গভীর হচ্ছে অথচ কিছুতেই ঘুম আসছে না। এ অবস্থাটা আসলে অসহ্য। একে বলে নিদ্রহীনতা। এ অবস্থা হলে পিপুলের শরণাপন্ন হতে হবে। পিপুলের ১-৩ গ্রাম শিকড় সামান্য চিনি সহকারে ছেঁচে বা বেঁটে সেই রস ছেঁকে দিনে দুবার সকাল বিকেলে খেতে হবে। বয়স্ক লোকদের এই রস সেবনে বিশেষ উপকার হয়। চিনির বদলে আখের গুড়ও ব্যবহার করা যায়। এতে হজমও ভালো হয়।
কাশি সারে : খুসখুসে কাশি আর ঘুষঘুষে জ্বর। এটা যক্ষ্মা রোগের পূর্ব লক্ষণ। এরূপ অবস্থা হলে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে ও পরীক্ষা করাতে হবে। তবে তার আগে পিপুলচূর্ণ ২৫০ মিলিলিটার সামান্য গরম জলে গুলে সকাল-বিকেল অর্থাৎ দিনে দুইবার খেতে হবে। এভাবে ৪-৫ দিন খাওয়ার পর সেটা চলে যেতে পারে। যদি না যায়, তখন অবশ্যই যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা করাতে হবে।
জ্বর সারায় : যে জ্বরে রক্তের বল কমে যাচ্ছে, শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে, চামড়া শুষ্ক হয়ে পড়ছে, চোখ ফ্যাকাসে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলছে, অথচ জ্বর সারছে না। সেক্ষেত্রে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ ৫/১০ ফোঁটা ঘি মিশিয়ে রোজ খেলে কয়েক দিনের মধ্যে এই জীর্ণ জ্বর সেরে যাবে।
মেদ কমায় : যারা মোটা ও মেদস্বী তারা মেদ কমাতে চাইলে রোজ খাওয়ার ১০-১৫ মিনিট পর ১ কাপ হালকা গরম জলে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ গুলে তাতে আধা চা-চামচ মধু মিশিয়ে খাবেন। দিনে দুইবার খাওয়া যায়। এভাবে ১০-১৫ দিন খেলে মেদ কমবে। এ সময় কোনো চিনি বা মিষ্টি খাওয়া চলবে না ও একবেলা ভাত ও দুইবেলা রুটি খেতে হবে। এটা খাওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে কোনো শক্ত খাবার খাওয়া যাবে না, তবে তরল খাবার খাওয়া যেতে পারে।
হাঁপানির উপশম হয় : অল্প পরিশ্রমে যাদের শ্বাসকষ্ট হয়, হাঁপ ধরে তারা পিপুলচূর্ণ ২৫০ মিলিলিটার সামান্য ১ কাপ জলে গুলে খাবার গ্রহণের কিছু পরে খেতে পারেন। তা না হলে ২ গ্রাম পিপুল ফল একটু থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ২-৩ ঘণ্টা পর পর তা ৩-৪ বারে খেতে পারেন। এতে শ্বাসের কষ্ট কমবে।
কৃমি কমায় : শিশু বৃদ্ধ যারই গুঁড়া বা ঝুড়ো কৃমি হোক তাদের উচিত রোজ সকাল-বিকেল ১ কাপ বাসি জলে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ গুলে খাওয়া। এতে কৃমির উপদ্রব কমবে।
মাথাব্যথা কমায় : মাথা ব্যথা হলে তা সারানোর সবচেয়ে সহজ ওষুধ হলো পিপুল ফল বেঁটে মলমের মতো করে কপালে লেপে দেয়া। এতে দ্রুত মাথাব্যথা কমে। এছাড়া পিপুল, গোলমরিচ ও আদা একসাথে জলের সাথে বেঁটে ছেঁকে সেই রস রোগীকে খাওয়ানো। এতেও মাথাব্যথার উপশম হয়।
দাঁত ব্যথা সারায় : দাঁতে যন্ত্রণা হলে ১-২ গ্রাম পিপুল চূর্ণ লবণ, হলুদের গুঁড়া ও সরিষার তেলে মিশিয়ে দাঁতের ব্যথা স্থানে লাগালে তা কমে যায়।
হৃদরোগে : সমপরিমাণ পিপুল মূল ও দারচিনি একসাথে বেঁটে মিহি গুঁড়া করতে হবে। তারপর তা ঘিয়ের সাথে মিশিয়ে রোজ দুইবার খেতে হবে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য ও হৃদরোগের উপশম হয়। সমপরিমাণ শুকনো পিপুল মূল ও লেবুর গাছের শিকড়ের বাকল একসাথে বেঁটে গুঁড়া বানাতে হবে। রাতে ১ কাপ জলে অর্জুনের ছাল ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে সেই অর্জুনের ক্বাথের সাথে এই চূর্ণ মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে। এতে হৃৎপিণ্ডের ব্যথা থাকলে তাও সেরে যায়।
অর্শ নিরাময় করে : অর্শ হলে আধা চা-চামচ পিপুল চূর্ণ, ভাজা জিরার গুঁড়া সামান্য লবণ ১ গ্লাস ঘোলে মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে। এতে অর্শ রোগ কমে যাবে। ঘোল পাওয়া না গেলে ছাগলের দুধে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এমনকি এই মিশ্রণ জ্বাল দিয়ে ঘন করে মলমের মতো অর্শের বুটিতে লাগিয়ে দেয়া যায়।
কীট দংশনের ব্যথা কমায় : পিপুলের শিকড় বেঁটে পোকামাকড়ের কামড়ানো স্থানে লেপে দিলে দ্রুত ব্যথা কমে যায়।
সতর্কতা : দুধের শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতিদের পিপুল খাওয়ানো চলবে না। মাত্রারিক্ত সেবনে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে, অন্ত্র ফুলে যেতে পারে ও দেহের তাপ বেড়ে যেতে পারে।
চাষাবাদ : সাধারণত এ দেশে কেউ পিপুল চাষ করে না। নাটোরে কোনো কোনো চাষি স্বল্প আকারে চাষ করেন। শিকড় গজানো কাণ্ডের কাটিং দ্বারা সহজে পিপুলের চারা তৈরি ও চাষ করা যায়। বীজ থেকেও পিপুলের চারা হয়। লতা মাটির সাথে শুইয়ে দাবাকলম করে গিঁট থেকে শিকড় গজিয়ে নেয়া যায়। এক বছর বয়সী লতার আগার দিকের অংশ যেখানে ৫-৭টি গিঁট থাকে তা কাটিং করার জন্য ভালো। পলিব্যাগ বা বেডে চারা তৈরি করা যায়। সাধারণত লতা থেকে পিপুলের চারা তৈরি করা হয়। মার্চ-এপ্রিল মাস চারা তৈরির উপযুক্ত সময়। নতুন শিকড় ও লতায় ছাতরা পোকার আক্রমণ যাতে না হয় বা কম হয় ও প্রথম বর্ষার পরপরই যাতে চারা লাগানো যায় সেজন্য এ সময় চারা তৈরি করা যেতে পারে। পিপুল চাষ করতে চাইলে জমি ভালো করে চাষ দিয়ে ২.৫ মিটার চওড়া করে বেড বানাতে হবে। দুই বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। বেড জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা হতে পারে। পিপুল চাষের জন্য ৩ মিটার লম্বা ও ২.৫ মিটার চওড়া আকারের বেড উত্তম। বেডের মাঝে ৬০ সেন্টিমিটার পর পর সারিতে ৬০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে কাটিং লাগাতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ২ মিটার পর পর পিপুলের কাটিং লাগাতে হবে। কাটিং লাগানোর আগে রোপণ স্থানে গর্ত করে তার মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে ভরতে হবে। প্রতি গর্তের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম জৈব সার মিশিয়ে দিতে হবে। হেক্টরে ১০-১৫ টন জৈব সার দিলে ভালো হয়। গর্ত ১৫ সেন্টিমিটার গভীর হলেই চলবে। গর্তের ঠিক মাঝখানে কাটিং লাগাতে হবে। প্রতি গর্তে দুটি কাটিং লাগাতে হবে।
তীব্র রোদে পিপুল গাছের ক্ষতি হয়। তাই পিপুল ক্ষেতের মধ্যে কিছু কলাগাছ লাগিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আন্তঃফসল হিসেবে কলা থেকে বাড়তি আয় হতে পারে। ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়েও পিপুল ক্ষেতে ছায়ার ব্যবস্থা করা যায়। নারিকেল বা সুপারি বাগানের মধ্যে আন্তঃফসল হিসেবে পিপুল চাষ করা যায়। পিপুল গাছ এসব গাছ বেয়ে উঠতে পারে। মে মাসের শেষে কাটিং লাগানো সবচেয়ে ভালো যদি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়। তা না হলে জুন-জুলাই কাটিং লাগানোর উত্তম সময়। লাগানোর সময় বৃষ্টি থাকলে সেচের দরকার নেই, না হলে রোপণের পরই সেচ দিতে হবে। বর্ষার পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও কাটিং রোপণ করা যায়। আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের অবস্থা বুঝে পরবর্তীতে সেচ ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যেতে হবে। দরকার হলে সপ্তাহে একবার সেচ দিতে হবে। রোপণের পর ৩ মাস পর্যন্ত আগাছা পরিষ্কার করে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। খরার সময় বা গ্রীষ্মকালে গাছের গোড়ার মাটি খড় দিয়ে ঢেকে দিলে বা মালচিং করলে উপকার হয়। এ সময় সেচ দিতে পারলে অসময়েও ফুল-ফল ধরে। বর্ষাকালে পাতায় দাগ রোগ বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডায়থেন এম ৪৫ বা নাটিভো ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন : চারা রোপণের ৬ মাস পর থেকে গাছে ফুল আসতে শুরু করে। ফুল আসার ২ মাস পর সেসব ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। যখন ফলগুলো পূর্ণতা পায় অথচ পাকে না ঠিক সে অবস্থায় পিপুলের ফল সংগ্রহ করা উচিত। এ অবস্থায় ফল না তুলে রেখে দিলে দ্রুত তা পেকে যায় ও ঝাঁঝ অনেক কমে যায়। এছাড়া পিপুলের ফল পেকে গেলে সেসব ফল শুকানোর পর সহজে ভাঙা বা গুঁড়া করা যায় না। সেজন্য পাকা পিপুল ফল তোলা হয় না। একবার লাগালে সেসব গাছ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। ফলের রঙ গাঢ় সবুজ হলে তা সংগ্রহ করা উচিত। প্রথম বছর প্রতি হেক্টরে গড় ফলন পাওয়া যায় ৭৫০ কেজি শুষ্ক ফল, দ্বিতীয় বছরে ১৫০০ কেজি ও তৃতীয় বছরে ১০০০ কেজি। তবে ব্যবস্থাপনার কারণে ফলনের কম-বেশি হতে পারে। তিন বছরের পর আর গাছ রাখা উচিত নয়। এরপর নতুন করে আবার কাটিং লাগাতে হবে।গাছের গোড়ায় মোটা কা- বা শিকড় কেটে তোলা হয়। একে বলে ‘পিপুলমূল’। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম জেলায় পিপুল শুধু মূলের জন্য চাষ করা হয়। সেখানে পিপুল গাছ লাগিয়ে ১৮ মাস বয়স হলে তা থেকে শিকড় সংগ্রহ শুরু করা হয়। গাছ ১০-৩০ বছর পর্যন্ত রেখে দেয়া হয় এবং তা থেকে প্রতি বছর শিকড় সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত গাছের বয়স ১৮ মাস হলে সেসব গাছ থেকে মূল সংগ্রহ শুরু হয়। মূল ২.৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার টুকরো করে কাটা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৫০০ কেজি শুষ্ক মূল পাওয়া যায়।
ফল শুষ্ককরণ : ফল তোলার পর তা উল্টে পাল্টে রোদে ৪-৫ দিন শুকাতে হয়। ভালো করে না শুকানো পর্যন্ত তা ঘরে রাখা উচিত নয়। সাধারণত ১০ কেজি কাঁচা ফল শুকালে ১.৫ কেজি শুষ্ক ফল পাওয়া যায়। ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য শুষ্ক ফল বায়ুবদ্ধ পাত্রে মজুদ করে রাখা যায় বা বস্তা ভরে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো যায়। পিপুল ফল শুকানো সহজ হলেও শুকানোর প্রক্রিয়াগত কারণে অনেক সময় ফল নষ্ট হয় ও অপচয়ের পরিমাণ বাড়ে। পিপুল ফল শুকানোর জন্য ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উত্তম। এতে রাসায়নিক উপাদান সর্ব্বোচ্চ থাকে। পাতলা স্তরে বিছিয়ে পিপুল ফল শুকানো উত্তম।
মৃত্যুঞ্জয় রায়*
* প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা
রফতানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণে কৃষি পণ্যের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বলতে গেলে নীরবেই এ দেশ ফসল উৎপাদনে অনেক অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য পাওয়া না গেলে কৃষক কৃষিতে আগ্রহ হারানোর আশক্সকা রয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি পণ্য রফতানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আবার বিভিন্ন দুর্যোগকালীন প্রয়োজন হয় খাদ্য আমদানির। তাছাড়া সব ফসল, ফল-মূল জলবায়ুজনিত কারণে আমাদের দেশে উৎপাদন সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় কৃষি পণ্য আমদানির। উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন সর্তকতা। পণ্য আমদানিতে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা না হলে বিদেশ থেকে ফসলের নানা ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগজীবাণু দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশক্সকা রয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বালাইয়ের আক্রমণে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। তাই পৃথিবীর সব দেশেই কৃষি পণ্য আমদানি ও রফতানির সাথে জড়িয়ে আছে নানা বিধি বিধান ও নিয়মাবলি। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেকেই এ বিষয়ে অবগত নন। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আমদানি রফতানিতে আমাদের কী করণীয় সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে এ সম্পর্কিত কাজে জড়িত কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর গুরুত্ব অল্প বিস্তর আলোচনা করা প্রয়োজন।
উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি ও রফতানিতে ইমপোর্ট পারমিট বা আমদানি অনুমতির ওপর ভিত্তি করে ছাড়পত্র এবং রফতানির জন্য Phytosanitary Certificate (PC) যাকে বাংলায় উদ্ভিদ স্বাস্থ্য প্রমাণপত্র ইস্যুর মাধ্যমে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ০২টি সমুদ্রবন্দর, ০৩টি বিমানবন্দর, ২৪টি স্থলবন্দর, ০১টি নৌবন্দর ও ICD কমলাপুরের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় আরও কয়েকটি কোয়ারেন্টিন স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
এখন স্বভাবতই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, ‘উদ্ভিদ সংগনিরোধ’ বলতে আসলে কি বলতে চাচ্ছি? উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পণ্যের সাথে পরিবাহিত হয়ে ধ্বংসাত্মক পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের জীবাণু দেশের অভ্যন্তরে বা আমাদের দেশ থেকে অন্যান্য দেশে অনুপ্রবেশ ও বিস্তার রোধ করার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে উদ্ভিদ সংগনিরোধ বা Plant Quarantine। কৃষিজাত পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ সরকারের আইনকানুন এবং রফতানি আন্তর্জাতিক আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত হয়।
বৃটিশ সরকারের প্রণীত DIP (Destrative Insect & Pest) রুলস ১৯৬৬ Rules টি July ১৯৮৯ সালে Ammendment করে স্বাধীন বাংলাদেশে Plant Quarantine কার্যাবলি পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার নতুনভাবে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নতুন করে ৫ এপ্রিল ২০১১ সালে মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন ২০১১ নামে গেজেট আকারে অনুমোদন লাভ করে। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গভাবে উদ্ভিদ সংগনিরোধ রুলস হিসাবে প্রকাশিত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আমদানি/রফতানির উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) কর্তৃক গঠিত International Plant Protection Convention (IPPC)। IPPC কর্তৃক বিশ্বর বিভিন্ন দেশে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আমদানি রফতানির লক্ষে এ পর্যন্ত ৪১টি Standard প্রণয়ন করেছে। যেগুলো International Standard of Phytosanitary Measures (ISPM) নামে পরিচিত। বিশ্বের ১৯১টি দেশ বর্তমানে IPPC এর সদস্য। IPPC এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি রফতানির লক্ষ্যে এ আইন সঠিকভাবে প্রতিপালনের জন্য প্রত্যেক দেশে National Plant Protection Organization (NPPO) সরকারের পক্ষে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষে NPPO এর প্রধান হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের পরিচালককে এ ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে।
কৃষি পণ্য আমদানি রফতানিতে এ বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রফতানি বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন নতুন বাজার খোঁজার জন্য সবাইকে আহ্বান করেছেন। আমাদের দেশ থেকে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য এখন দরকার প্রশিক্ষিত জনবল। যারা আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন জেনে বিদেশে উদ্ভিদ, উদ্ভিদ জাত পণ্য রফতানি করবেন। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যায় দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে Plant Quarantine বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। যার ফলে সেখান থেকে পাস করা গ্রাজুয়েটরা চাকরির জন্য শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং নিজেরাই আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রফতানির বাজারকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারবেন।
এখন আমার কর্মক্ষেত্রে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামে কাজের সুবাদে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে আলোচ্য বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই আমি আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যেসব ব্যবসায়ী কিংবা তাদের মনোনীত C&F এজেন্ট এ কাজটি করে থাকে তাদের এ ব্যাপারে Technical জ্ঞান একেবারে নেই বললেই চলে। তাদের Academic Knowledge অত্যন্ত দূর্বল। আমদানির ক্ষেত্রে যেসব বিধি বিধান মেনে চলতে হয় তাদের সে জ্ঞান অনুপস্থিত। ফলে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের প্রকারভেদ অনুযায়ী আমদানি অনুমতিপত্র (Import Permit) IP দেয়ার সময় Pest Risk Analysis (PRA) অনুযায়ী IP তে কিছু অতিরিক্ত শর্তাবলি দেয়া হয়। এই শর্তাবলী প্রতিপালন সাপেক্ষে তিনি যে দেশ থেকে পণ্যটি আনতে চাচ্ছেন তা আনতে পারবেন। অন্যথায় আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত শর্তাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়নি বিধায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এ পণ্য আমদনিকারকের নিজস্ব অর্থায়নে পুনরায় ফেরত পাঠানোসহ সব পণ্য ধ্বংস করার আইনগত ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমদানিকারক IP পাওয়ার আগেই যে দেশ থেকে পণ্যটি আনবেন তাদের সঙ্গে LC চুক্তি সম্পাদন করে ফেলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে অতিরিক্ত শর্তাবলি না জেনেই Phytosanitary Certificate (PC) পর্যন্ত নিয়ে জমা দেন। যা কোয়ারেন্টি Rules এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এক্ষেত্রে পরিচালক, উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর বিশেষ ক্ষমতাবলে সংক্ষেপে SRO অর্থাৎ Special Release Order ইস্যুর মাধ্যমে ওই পণ্য ছাড়করণের ব্যবস্থা করা ছাড়া আইনগত আর কোনো উপায় থাকে না।
এ বিষয়ে আমদানি/রফতানিকারক C&F সহ কাজের সাথে সম্পৃক্ত জনবলকে সচেতন করার লক্ষ্যে বিগত বছরে কয়েকবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে আমদানি রফতানি প্রায় ৯২% সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ পরিসংখ্যানই এ বন্দরের গুরুত্ব ও কর্মক্ষেত্রের ব্যাপকতা তুলে ধরে। বিদেশ থেকে আগত কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের নমুনা সংগ্রহ ও প্রাপ্ত নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে ছাড়পত্র প্রদানের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলেই কেবলমাত্র Release Order (RO) বা ছাড়পত্র প্রদান করা হয়ে থাকে। বিগত বছরে অত্র স্টেশনে রাশিয়া থেকে আগত ২১,০০০ মেট্রিক টন গম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দেশের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু ও আগাছা বীজ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় সে দেশে ফেরত প্রদান করা হয়।
কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আমদানির তুলনায় রফতানির চিত্র হতাশাজনক। কাজেই রফতানির বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য দরকার প্রশিক্ষিত জনবল যারা আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে পণ্য রফতানি করবেন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে Sanitary and Phytosanitary Agreement (SPS Agreement) অনুযায়ী (IPPC) এখন পর্যন্ত যে ৪১টি Standard নির্ধারণ করেছে তা প্রতিপালন করে রফতানির জন্য সুস্পষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে উদ্ভিজাত পণ্য রফতানি করতে হবে। কিন্তু তা না জানার জন্য আমরা অনেক পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পাচ্ছি না। বিদেশে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের সিংহভাগই সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমদানিকারকের সাথে আমাদের রফতানিকারকের Contract Paper Agreement হয়ে থাকে। Contract Paper এর চুক্তিগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা এবং পণ্যটি সঠিকভাবে Grading, Sorting এবং Packaging করা হয়েছে কিনা তা সরেজমিন Inspection করে প্রয়োজন বোধে ল্যাবরেটরি টেস্টের সন্তোষজনক মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে Phytosanitary Certificate (PC) ইস্যু করা হয়।
আমাদের দেশ থেকে বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মালেয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ব্রনাইয়ে প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আলু রফতানি করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন আলু রফতানি করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে আমরা জেনেছি বিভিন্ন কোল্ডস্টোরেজে সঠিকভাবে আলু সংরক্ষণ না করতে পারায় এবং কৃষকের উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কম পাওয়ায় কৃষক মাঠ থেকে অনেক আলু উত্তোলনই করেনি ফলে মাঠেই পচে ব্যাপক পরিমাণ আলু নষ্ট হয়ে গেছে। যা কখনও কখনও আমাদের কাম্য হতে পারে না।
আমরা জানি পৃথিবীর অনেক দেশে আলুই প্রধান খাদ্য। এক সময়ে রাশিয়ায় ব্যাপক পরিমাণ আলু রফতানি হতো। বিগত ৪-৫ বছর ধরে রাশিয়ায় আলু রফতানি করা যাচ্ছে না। ইউরোপসহ রাশিয়ায় আলু রফতানি করতে পারলে আমাদের দেশের কৃষক পণ্যের ন্যাযমূল্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেন ইউরোপের বাজারে আমাদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য রফতানি করতে পাচ্ছি না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে গেলে কোন পণ্য কোন এলাকায় উৎপাদন করা হবে, সেখানে ওই পণ্যের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগজীবাণু আছে কিনা তার সব তথ্য উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে রফতানি করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য কোন পণ্য কোন দেশে রফতানি করব তা নির্ধারণ করে ওই দেশের Import Requirement অনুযায়ী প্রতিটি পর্যায়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের সহায়তায় কিছু পণ্য বিদেশে রফতানির জন্য Contact Farming এর মাধ্যমে উৎপাদন করা শুরু হয়েছে। সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামের মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হিমায়িত সবজি, হিমায়িত খাবার, শুকনা মরিচ, বিস্কুট, মুড়ি, সুগন্ধি চাল, ড্রাইফুড জেলি ও বেন্ডেড চা রফতানি হয়েছে। সম্প্রতি বিস্কুটে খাদ্য উপাদান হিসেবে যে দুধ ও ডিম ব্যবহৃত হয় তার উৎস হিসেবে ওই গাভী বা মুরগিকে কি খাদ্য উপাদান খাওয়ানো হয়েছে এবং এর MRL অর্থাৎ Maximum Residue Limit কত তা জানার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। এর সঠিক তথ্য না থাকার জন্য দুধ ও ডিম খাদ্যোপদান যুক্ত বিস্কুট রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের আমলে দেশ এখন ডিজিটাল ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর। সেই সাথে তাল মিলিয়ে জ্ঞান, বিজ্ঞানে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের কৃষির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমরা প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে নিবেদিত হয়ে কাজ করব এ প্রত্যাশা করি।
সৈয়দ মুনিরুল হক*
*সংগনিরোধ রোগতত্ত্ববিদ, উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম, মোবাইল : ০১৭৫১-৬৪৬৬১১, ইমেইল :syedhq742gmail.com
একটি ধাঁধা দিয়ে যদি শুরু করি, বলুন তো দেখি যার হাত নাই, পা নাই এমনকি মুখও নাই কিন্তু ঠিকই খায়; অনেকেই চিন্তার মধ্যে থাকলেও উত্তর কিন্তু খুবই সহজ যার নাম পরিবেশ বন্ধু গাছ। এবার প্রশ্ন হলো, গাছ তাহলে কিভাবে খায়; মূলত গাছের মূল বা শিকড় দিয়ে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান পানির সাথে টেনে শরীরে প্রবেশ করায়। তাছাড়া গাছের পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে তা দিয়েও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করতে পারে। জীবনধারণ ও শরীরে পুষ্টির জন্য গাছের খাদ্যের দরকার। গাছের জীবনচক্র সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ১৭টি খাদ্যোপাদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান বলে। গাছ এসব খাদ্যোপাদান বাতাস ও মাটি থেকে সংগ্রহ করে পাতায় খাদ্য তৈরি করে। মাটিতে বিদ্যমান খনিজ পদার্থ ও জৈব পদার্থ খাদ্য উপাদানের প্রাথমিক উৎস। তাছাড়া সার প্রয়োগ করেও এসব খাবারের জোগান দেয়া হয়। আশানুরূপ ফসল পেতে সার সরবরাহ করে মাটিকে উৎপাদনক্ষম রাখতে হচ্ছে। তাই দিন দিন আমরা রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার তা হলো রাসায়নিক সারের অপরিকল্পিত ও বেশি ব্যবহার কৃষিতে খরচ বৃদ্ধি করে, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে এমনকি পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্যকেও বিপন্ন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে সার ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা সময়ের দাবি।
সার প্রয়োগের কিছু সাধারণ নীতিমালা : বীজ, নতুন শিকড় ও গুল্ম জাতীয় গাছের কা-ের অতি সন্নিকটে বা কোনো ভেজা কচি পাতার ওপর রাসায়নিক সার ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। রাসায়নিক সারগুলো এক ধরনের ঘনীভূত লবণ বিধায় এগুলো গাছের নাজুক সব বাড়ন্ত অংশকে পুড়িয়ে দিতে পারে। সার যত দূর সম্ভব ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা গভীর পানিতে প্রয়োগ করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, জিঙ্ক ও ফসফেট সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কেননা এসব সারের উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ফসল তা গ্রহণ করতে পারে না। জৈব সার ফসল বপন/রোপণের কমপক্ষে ৭-১০ দিন পরে জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে হবে। সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা মাটিতে মিশানোর কমপক্ষে ৭ দিন পর ধানের চারা রোপণ করতে হবে। গৌণ উপাদানের (গাছের জন্য যে খাদ্যোপাদান কম প্রয়োজন যেমন জিংক, বোরন, ম্যাঙ্গানিজ এসব) দ্রবণ পাতায় ছিটিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে (বিশেষ করে উদ্যান ফসলের ক্ষেত্রে)। সাধারণ ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশি ফসল পাওয়া যায় এবং পরিমাণে শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে। তাছাড়া গুটি ইউরিয়া মৌসুমে একবার ব্যবহার করতে হয়।
জমিতে তিন পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা হয়। হাতে ছিটানো, স্থানীয় প্রয়োগ এবং পাতায় বা পল্লব গুচ্ছে সিঞ্চন/ছিটিয়ে দেয়া। হাতে ছিটানো পদ্ধতি সাধারণত মাঠ ফসলে এবং স্থানীয় প্রয়োগ সাধারণত ফল বাগান ও সবজিতে করা হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য ফসল ও মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে সার ব্যবহারের সাধারণ নির্দেশাবলি অনুসরণ করা উচিত।
ধান চাষের বেলায় ইউরিয়া ০৩ অংশে ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিত। শাকসবজি চাষের বেলায় ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউরিয়া ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করা যায়। স্বল্পমেয়াদি ফসলের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের পুরোমাত্রা শেষ চাষের সময়েই প্রয়োগ করা যায়। অধিকাংশ মশলার ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। ভেজা মাটি অথবা জো আসা মাটিতে পড়ন্ত বিকালে ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিলে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যায়।
ফসফেট সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন আগে প্রয়োগ করা উচিত এবং দস্তা সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ ও গন্ধক জাতীয় সারগুলো একবারে প্রয়োগ করা চলে। তবে মোটা বুনটযুক্ত মাটিতে পটাশ সার দুইভাগে ভাগ করে ব্যবহার করা যায়। প্রথম ভাগ জমি তৈরির শেষ সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ দ্রুত কুশি বের হওয়ার সময় প্রয়োগ করতে হবে। রসুন ফসলে এমওপি সার ব্যবহারের পরিবর্তে পটাসিয়াম সালফেট সার ব্যবহার করতে হবে। সালফার এবং জিংক সারের সুপারিশকৃত মাত্রা শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা না হলে প্রয়োজনবোধে এগুলো উপরিপ্রয়োগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। সময়মতো ইউরিয়া প্রয়োগের পরেও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে তা সালফারের ঘাটতি বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যত শিগগিরই সম্ভব সুপারিশকৃত সালফার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। কচি পাতা সাদা হয়ে গেলে এবং সে সঙ্গে পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামি রঙের ছিট দেখা দিলে তা জিঙ্ক সারের ঘাটতির ইঙ্গিত করে। এরূপ লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদিত পুরো মাত্রায় জিঙ্ক সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
সুবিবেচক হিসেবে সার প্রয়োগ : ফসলের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হলে মাটি পরীক্ষা করে সার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া অনলাইন ফার্টিলাইজার সুপারিশ নির্দেশনা মেনেও সার প্রদান করা যায়।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
* আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট
কৃষাণী
দুলাল চন্দ্র সরকার*
কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে
যে ফসল করে উৎপাদন
কৃষানি তাতে যত্নের সাথে ঘরে তুলে
নানাবিধ খাবার করে যে রন্ধন॥
মাটি চিড়ে ফসল ফলাতে
কৃষক ধরেছে হাল
ক্ষুধার অন্ন জোগায় নারী
প্রতিদিন চিরকাল॥
রান্নার ভার নারীর ওপর
তবু তারা খায় না কো আগে
পুরুষকে খাওয়ায়ে খায় সে পরে
যা কিছু থাকে তার ভাগে॥
রাঁধিল খাবার অতি চমৎকার
মনের মাধুরী মিশিয়ে
সারাদিন ভরে শত কাজ করে
সংসার রাখে সে গুছিয়ে॥
লাকড়ি ঠেলে অনল জে¦লে
চুলায় চড়ায়ে হাঁড়ি
নানাবিধ ব্যাঞ্জন করিতে রন্ধন
ভিজে যায় পরনের শাড়ি॥
মায়াবিনী নারী মায়ার বাঁধনে
গড়ে তুলে নতুন সংসার
তবুও এ সংসারে বহু বহু কাজে
নারীকেই হতে হয় গঞ্জনার স্বীকার॥
রূপান্তরের স্রোত
মো. জুন্নুন আলী প্রামানিক**
আগের দিন চলমান আছে রূপটি হয়তো ভিন্ন,
সবুজে ভরা অগণিত বৃক্ষ প্রচুর কর্তনে শূন্য।
দিনের শেষে প্রতি রাত ফেরে দুঃখ সুখের স্রোতে,
আনন্দ যত নিরানন্দ শত সম্মুখে দাঁড়ায় মেতে।
মাটির শক্তি ক্রমান্বয়ে কমে সঠিক সেবার ভুলে,
অনেক জমি রূপান্তরে ডুবে স্বরূপ হারিয়ে ফেলে।
নদীর গতি এলোমেলো বয় নিয়মে ব্যাঘাত হলে,
অকালে বন্যা ঝড়বৃষ্টি শীত দুর্যোগ বৃদ্ধির তালে।
নিয়মে চলা জলবায়ু কাঁদে বাধার পাহাড় দেখে,
মাধুর্য দিতে অপারগ হলে দৃষ্টির বক্রতা চোখে।
বনের স্বস্তি জীবজন্তু গাছ নীরবে হারিয়ে যায়,
বিচিত্র সৃষ্টি উপকার করে বিশুদ্ধি সর্বদা দেয়।
মানব সাথী পশুপাখি সব অভাব দুঃখ বুঝে,
সুখের দিন খোঁজাখুঁজি করে অপুষ্টি দেহের মাঝে।
নদীর জলে দেশি মাছ কম পাখির আহার যাতে,
বনজ ফলে বনভূমি অল্প খাবার জোটে না তাতে।
পাহাড় বন সুবিশাল মাটি জড়িত প্রকৃতি বুকে,
সুগতি পেতে ভূমিকম্পে মাতে ঐতিহ্য ফেরার শোকে।
বাতাসে রাগ অনুরাগ স্রোত প্রশান্তি নষ্টের মূল,
শুদ্ধতা ক্ষয় দূষিতের চাপে সুপথে অনেক ভুল।
সমস্যা নানা আজগুবি আসে ভাবতে অবাক লাগে,
সুন্দর ক্ষেতে ভরাডুবি ঘটে আক্রান্ত ভীষণ রোগে।
হঠাৎ বন্যা আক্রমণ করে ভাসায় আশার শস্য,
রক্ষার চেষ্টা ব্যর্থতায় ভরে ভাঙনে অশুভ দৃশ্য।
দুর্বার বেগে ঘুরপাক খায় বুঝতে দেয় না কিছু,
ফসল ক্ষেতে কৃষকের ঠাঁই ছাড়ে না কৃষক পিছু।
*পরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ **গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম
মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। প্রকৃতির বিচিত্র বাহারি মাছ যখন স্বচ্ছ কাচের জলজবাগানে ঘুরে বেড়ায় তা দেখতে কার না ভালো লাগে! অ্যাকুরিয়াম হচ্ছে এমনি ধরনের চারদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পাত্র, যেখানে মাছ ও উদ্ভিদ রাখা সম্ভব। অ্যাকুরিয়াম কেবল শখ কিংবা শোভাবর্ধনকারী নয়, এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও রয়েছে বেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানীর কাঁটাবনে গড়ে উঠেছে অ্যাকুরিয়ামের জমজমাট ব্যবসা। পাশাপাশি নিউমার্কেট, গুলশান এবং বনানীতে বেশ কয়টি দোকান রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও এর যাবতীয় উপকরণ পাওয়া যায়। যদিও কোনো এক সময় অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালন ছিল ব্যয়সাধ্য। এখন তা কিন্তু নয়। শৌখিনতা ও ক্রয়ক্ষমতার কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইচ্ছে করলে আপনিও এর অংশীদার হতে পারেন।
অ্যাকুরিয়াম তৈরি : অ্যাকুরিয়াম তৈরির জন্য প্রথমেই আকৃতি নির্বাচন করতে হয়। আয়তাকার, ত্রিকোণাকার, বোতলাকৃতি, ছয়কোণা যে কোনো ফ্রেমেই হোক; তাতে পানির চাপ সহ্য করতে পারবে এমন শক্ত ও স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করা উচিত। এজন্য কাচের পুরু হবে কমপক্ষে ৬০ মিলিমিটার এবং এর সংযোগস্থলে বিশেষ ধরনের আঠা লাগাতে হবে। তলার কাচটি (ধারক) অবশ্যই ভারি হওয়া দরকার, যাতে অ্যাকুরিয়ামের পুরো ওজন বহন করতে পারে। তবে আকার বড় হলে লোহার ধারক ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। ওপরের ঢাকনা হিসেবে কাঠ, প্লাস্টিক কিংবা অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা যায়। এছাড়া ঢাকনা খোলা এবং বন্ধ করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে অ্যাকুরিয়ামের প্রস্থ এবং উচ্চতা উভয়ই যেন দৈর্ঘ্যরে অর্ধেক হয়।
উপকরণ : অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালনের জন্য যেসব উপকরণ দরকার তাহলো- মোটা বালি, পাথর কুচি, জলজ উদ্ভিদ, ফিল্টার, এয়ার মটর বিশেষ ক্ষেত্রে এয়ার এক্সিকিউটর, এনার্জি বাল্ব, ওয়াটার হিটার এবং রাবারের পাইপ।
পরিবেশ সৃষ্টি : মাছ পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অ্যাকুরিয়ামে পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর এজন্য উপকরণগুলো একেক করে সাজাতে হবে। অ্যাকুরিয়ামে পানি দেয়ার আগে উদ্ভিদ লাগানোর জন্য তলা প্রস্তুত করতে হয়। এক্ষেত্রে মোটা বালি, পাথরের কুচি এবং রঙিন দ্রব্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তলা প্রস্তুত হলে ভেলিসনেনিয়া, সেরাটোফাইলাম, ওয়াটার স্পাইট, অ্যানাক্যারিশ, ঝাঁঝি, জলজ পদ্ম, শাপলা এসবের যে কোনো উদ্ভিদ রোপণ করতে পারেন। এগুলো শুধু শোভাবর্ধনই নয়, এর উপকারিতাও আছে। মাছের বর্জ্য থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে পরিবেশ অনুকূূলে রাখে। সব কাজ শেষে পরিষ্কার পানি দিয়ে অ্যাকুরিয়াম ভর্তি করতে হবে। সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণের জন্য অ্যাকুরিয়ামে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাই প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা করে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হবে।
বাহারি মাছ : বাহারি মাছের অধিকাংশই বিদেশি। এ ধরনের মাছের মধ্যে গোল্ড ফিশ অনন্য। ওরা শান্ত প্রকৃতির হয়। দেহের গঠন অনুযায়ী গোল্ড ফিশ দুই ধরনের। লম্বা ও ডিম্বাকৃতি। এগুলো হলোÑ রুইকিন, ওয়াকিন, জাইকিন, কমেট, ওরান্ডা, ফান্টাইল, রানচু, ব্লাক মোর, ভেইল টেইলসহ আরো শতাধিক। অন্য মাছের মধ্যে অ্যানজেল, টেট্রা জেব্রা, এলিফ্যান্ট নোজ, ক্যাট ফিশ, সাকিং ক্যাট, সিলভার শার্ক, রেইনবো শার্ক, টাইগারশার্ক, এলবিনো শার্ক, টেলিচো, অস্কার, ফ্লাওয়ার হর্ন, হাইফিল নোজ, ব্লাক গোস্ট, ব্লু আকারা, ব্লু গোড়ামি, রোজি বার্ব, টাইগার বার্ব, ফাইটিং ফিশ, সোর্ড টেইল, ব্ল্যাক মলি, গ্লাসফিশ, টাইগার বাথ, রেইনবো অন্যতম। আর দেশি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে খলিশা, পুঁটি, চান্দা, মলা, পটকা, টেংরা, বেলে, কৈ, চিংড়িসহ ছোটজাতীয় মাছ। এক সময় থাইল্যান্ড, চীন, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশ থেকে মাছের পোনা আমদানি হতো। এখন অধিকাংশ পোনা এদেশেই উৎপাদন হয়।
মাছের খাদ্য : মাছের ওজনের প্রায় ৫% হারে সকাল বিকাল দুইবার খাবার দিতে হয়। এজন্য শুকনো টিনজাত, প্যাকেটজাত এবং প্রাকৃতিক খাবার রয়েছে। শুকনো খাদ্যের মধ্যে আছে আটা, ময়দাসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের মিহি গুঁড়া। টিনজাত খাবারের মধ্যে সিদ্ধ নরম সবজি, চিংড়ি, লবস্টার, বিভিন্ন প্রাণীর হৃৎপি-, যকৃত, কিডনি এবং ডিমের কুসুম। আর প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন-এককোষী প্রাণী, কেঁচো, প্লাংকটন, লার্ভা ও টিউবিফেক্স। এছাড়া বাজারে কৃত্রিম খাবারও পাওয়া যায়।
অন্যান্য : অ্যাকুরিয়ামে বায়ু সঞ্চালন অত্যাবশ্যক। তাই কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। অ্যাকুরিয়ামের সৌন্দর্য বাড়াতে এর তলদেশের মাটি দিয়ে পাহাড়, পর্বত, নালা এসব তৈরি করা যায়। এছাড়া শামুক কিংবা ঝিনুকের খোল অথবা চীনামাটির টুকরো দিয়েও সাজাতে পারেন।
পরিচর্যা : মাছের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি বজায় রাখতে নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। এর অবহেলায় মাছের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। পানির রঙ ঘোলাটে, লাল বা সবুজ বর্ণ কিংবা গন্ধ বের হলে সাথে সাথে পরিবর্তন করা উচিত। এ কাজ সপ্তাহে একদিন করলে ভালো হয়। প্রথমে মাছগুলো একটি পানির পাত্রে রাখতে হবে। এরপর একটি লম্বা রাবারের পাইপ অ্যাকুরিয়ামের তলদেশে রেখে মুখ দিয়ে একটু বাতাস টেনে ছেড়ে দিয়ে নিচে রাখা খালি বালতি বা পাত্রে পানি রাখতে হবে। এরপর পুনরায় পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে পুকুর কিংবা নলকূপের পানি ব্যবহার করা যাবে। তবে আয়রনের পরিমাণ বেশি হলে পানি অবশ্যই ফুটিয়ে ঠা-া করে ছেঁকে নেয়া উচিত। পানিতে অ্যাকুরিয়ামসল্ট মিশানো উত্তম। শীতে অ্যাকুরিয়ামের পানি সাধারণত ঠা-া থাকে। তাই এ সময় ডুবন্ত হিটার ব্যবহার করতে হবে। অ্যাকুরিয়ামে পাথর কুচির নিচে ওয়েটডাস্ট ফিল্টার স্থাপন করতে হয়। এর সাথে এয়ার এক্সিকিউটর রাখতে হবে। এর মাধ্যমে যখন বাতাস বের হবে তখন ঊর্ধ্বচাপের সৃষ্টি হবে। ফলে ময়লাগুলো ধীরে ধীরে ফিল্টারের নিচে জমা হবে। এজন্য যন্ত্রটি সবসময় চালু রাখা দরকার।
রোগ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার : অন্য মাছের ন্যায় বাহারি মাছেও রোগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই অ্যাকুরিয়ামকে সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এজন্য ফরমালিন, ডেটল, সেভলন, লবণ এসব ব্যবহার করতে পারেন। তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। যদি রোগ হয়েই যায় তখন চিকিৎসা জরুরি। অ্যাকুরিয়ামে পালিত মাছে যেসব রোগ হতে পারে; এর মধ্যে লেজ পচা, অ্যাঙ্কর, কোষ্ঠকাঠিন্য, সাদা দাগ রোগ অন্যতম। এসব রোগের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার একেক করে দেয়া হলো-
লেজ পচা রোগ : অ্যাকুরিয়ামে পালিত মাছের মধ্যে লেজ পচা রোগ বেশি হয়। ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। তবে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের প্রকোপ বেশি। প্রথমে লেজ কিংবা পাখনায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পরে লেজ আস্তে আস্তে পচন ধরে। প্রতিকার হিসেবে অক্সি সাইক্লিন গ্রুপের যে কোনো ওষুধ প্রয়োগ করলে উপকার পাওযা যায়। তবে আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে টেট্টাসাইক্লিন ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি ক্যাপসুলের ভেতরে থাকা পাউডার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ওষুধ ব্যবহারের পর অ্যাকুরিয়ামের পানির রঙ হলুদ অথবা লালচে বর্ণ, সেসাথে পানির ওপর ফেনা জমতে পারে। এতে কোনো ক্ষতি নেই। শুধু ফেনা সরিয়ে ফেললেই হবে।
অ্যাঙ্কর : মাছের পেটের নিচে পাখনার কাছাকাছি কিংবা লেজের আগের অংশে লাল ফুসকুরি দেখা যায়। পরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এরপর ওখান থেকে গাছের শিকড়ের মতো বের হয়। প্রতিকার হিসেবে লেজ পচা রোগের ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে কয়েক দিনের মধ্যে আক্রান্ত মাছ সুস্থ হয়ে যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ : এ রোগে মাছের পেটে গ্যাস হয়ে ফুলে যায়। খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মলত্যাগে অসুবিধা হয়। প্রতিকার হিসেবে খাবার পরিবর্তন জরুরি। সাধারণত বাজার থেকে কেনা লাল ও সবুজ রঙের দানাদার খাবার পরিবর্তন করে খাওয়াতে হবে। খাবার হিসেবে জীবন্ত ওয়ার্ম এবং কৌটাবদ্ধ মৃত ওয়ার্ম (প্রক্রিয়াজাতকৃত) ব্যবহার করলে ভালো হয়।
সাদা দাগ রোগ : এ রোগ হলে মাছের শরীরে সাদা দাগ দেখা যায়। এক ধরনের পরজীবীর কারণে এ রোগের সৃষ্টি। এর আক্রমণ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। এমনকি মাছ মারাও যেতে পারে। প্রতিকার হিসেবে আলাদা একটি পানির পাত্রে পরিমাণমতো ফরমালিন এবং ক্লোরাইড সল্ট মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় গোসল করাতে হবে। এ কাজ সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত দিনে দুইবার করতে হবে।
অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কার রাখা এবং পানি পরিবর্তন করাকে কেউ কেউ ঝামেলা মনে করেন। আসলে এ কাজের জন্য সপ্তাহের ছুটির দিনই যথেষ্ঠ। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছেশক্তি এবং কিছুটা সময় বের করে নেয়া। এর ফলাফল দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, সেসাথে মনের প্রশান্তি। এমন সুযোগ হতে আমরা যেন বঞ্চিত না হই।
নাহিদ বিন রফিক*
* টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর : ০১৭১৫৪৫২০২৬ ই. মেইল : tpnahid@gmail.com
বাংলাদেশে জমির অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় মাশরুম একটি সম্ভাবনাময় ফসল। এদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। অমিত সম্ভাবনাময় ফসল মাশরুম চাষের জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় দেশে মাশরুম উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে কোনো ফসলেরই উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই। যার মোটেই চাষের জমি নেই তিনিও বসত ঘরের পাশের অব্যবহৃত জায়গায় অনেক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। এজন্য ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ মাশরুম চাষ করতে পারেন। মাশরুম এমন একটি ফসল যা ধনী, দরিদ্র সবার ঘরে সমভাবে জায়গা করে নিয়েছে। গ্রাম-গঞ্জে, শহরে এমনকি অতিমাত্রায় বিলাসিদের প্রাসাদেও মাশরুম স্থান পেয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানব জাতির কল্যাণে দুনিয়ায় অগণিত জিনিসের সৃষ্টি করেছেন। এরকম কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী ও ঔষধিগুণে ভরপুর একটি দ্রব্যের সহজ-সরল নাম মাশরুম। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন খাবার। এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের কারণে এরইমধ্যে এটি সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাশরুম চাষ আমাদের দেশের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ মাশরুম অত্যন্ত স্বাস্থ্যপ্রদ একটি খাবার। মাশরুমের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে অত্যধিক এবং এর প্রোটিন অতি উন্নতমানের এবং মানব দেহের জন্য অতিশয় উপকারী। একটি পরিপূর্ণ প্রোটিনের পূর্বশর্ত হলো মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যাসিডের উপস্থিতি। মাশরুমে অতীব প্রয়োজনীয় এ ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিড বিদ্যমান। অন্যান্য প্রাণিজ আমিষ যেমন -মাছ, মাংস, ডিম অতি নামি-দামি খাবার হলেও এতে চর্বি সম্পৃক্ত অবস্থায় থাকায় যা অতি মাত্রায় গ্রহণ করলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে, যার ফলে মেদ-ভুঁড়ির সৃষ্টি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ প্রভৃতি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মাশরুমের প্রোটিনে-ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অতি স্বল্প এবং কোলেস্টেরল ভাঙার উপাদান-লোভস্ট্রাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় শরীরের কোলেস্টেরলস জমতে পারে না বরং মাশরুম খেলে শরীরে বহু দিনের জমানো কোলেস্টেরল ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যায়। ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে ২৫-৩৫ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যা অতি নামি-দামি খাবার হিসেবে মাছ, মাংস, ডিম খেয়ে থাকি তার মধ্যে ১০০ গ্রাম মাছ, মাংস ও ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ হলো ১৬-২২ গ্রাম , ২২-২৫ গ্রাম ও ১৩ গ্রাম মাত্র।
মানব দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সৃষ্টি করাই ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান কাজ। শরীরের চাহিদামতো প্রতিদিন ভিটামিন ও মিনারেল খেতে না পারলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল হয়ে নানারূপ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হয়। প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমেই সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান। মাশরুমে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম। সেলেনিয়াম উপাদানটি শুধু মাছেই পাওয়া যায়। যারা পুরোপুরি নিরামিষভোজী তারা মাশরুমের মাধ্যমে এ উপকারী উপাদানটি গ্রহণ করতে পারেন। মাশরুমে আরও আছে এরগোথিওনেইন নামে এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা মানব দেহের জন্য ঢালের মতো কাজ করে। মাশরুমে ভিটামিন বি-১২ আছে প্রচুর পরিমাণে যা অন্য কোনো উদ্ভিজ্জ উৎসে নেই। মাশরুম কোলেস্টেরল শূন্য। এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও খুবই সামান্য। এতে যে এনজাইম ও ফাইবার আছে তা দেহে উপস্থিত বাকি ব্যাড কোলেস্টেরলের বসতিও উজাড় করে দেয়।
মাশরুমে উচ্চমাত্রার আঁশ থাকে, সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকে এবং প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম থাকে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া মাশরুমে কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন, লোভাস্টটিন, এ টাডেনিন, কিটিন এবং ভিটামিন বি, সি ও ডি থাকায় নিয়মিত মাশরুম খেলে উচ্চ রক্তচাপও হৃদরোগ নিরাময় হয়। মাশরুমের ফাইবার বা আঁশ পাকস্থলী দীর্ঘক্ষণ ভরা রাখতে সাহায্য করে। মাশরুম রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে। উচ্চ ফ্যাট সমৃদ্ধ লাল মাংসের পরিবর্তে মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমানো সহজ হয়। FASEB তে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমে। মাশরুমে নিয়াসিন ও রিবোফ্লাবিন থাকে যা ত্বকের জন্য উপকারী। ৮০-৯০ ভাগ পানি থাকে যা ত্বককে নরম ও কোমল রাখে।
মাশরুমে পলিফেনল ও সেলেনিয়াম নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এতে মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সালফারও থাকে। এ অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো মারাত্মক কিছু রোগ, যেমন-স্ট্রোক, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে। এটি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিতাকে মাশরুম দৈনন্দিন কিছু অসুখ যেমন-কফ ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে যে মাশরুম উৎপন্ন হয় তাতে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে, যা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের শোষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে মাশরুম বেশ উপকারী। নিয়মিত মাশরুম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। মাশরুমের ফাইটোকেমিক্যাল টিউমারের বৃদ্ধিতে বাঁধার সৃষ্টি করে।
মাশরুমের ভিটামিন বি স্নায়ুর জন্য উপকারী এবং বয়সজনিত রোগ যেমন- আলঝেইমার্স রোগ থেকে রক্ষা করে। মাশরুম গ্রহণ করলে রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মাশরুমে এনজাইম ও প্রাকৃতিক ইনসুলিন থাকে যা চিনিকে ভাঙতে পারে। এতে থাকা ফাইবার ও এনজাইম হজমে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কাজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং কোলনের পুষ্টি উপাদান শোষণকেও বাড়তে সাহায্য করে। মাশরুমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি আছে। শিশুদের দাঁত ও হাড় গঠনে এ উপাদানগুলো অত্যন্ত কার্যকরী।
মাশরুমে নিউক্লিক এসিড ও অ্যান্টি এলার্জেন থাকায় এবং সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকায় কিডনি রোগ ও এলার্জি রোগের প্রতিরোধক। মাশরুমে স্ফিংগলিপিড এবং ভিটামিন-১২ বেশি থাকায় স্নায়ুতন্ত্র ও স্পাইনাল কর্ড সুস্থ রাখে। তাই মাশরুম খেলে হাইপার টেনশন দূর হয় এবং মেরুদ- দৃঢ় থাকে। হেপাটাইটিস বি ও জন্ডিস প্রতিরোধ করে। অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মাশরুমের খনিজ লবণ দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ড. আখতার জাহান কাঁকন*
*উপজেলা কৃষি অফিসার (এল.আর), খামারবাড়ি, ঢাকা, সংযুক্ত : মাশরুম বিশেষজ্ঞ, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা
আরসিসি বা রেড চিটাগাং ক্যাটেল/অষ্টমুখী লাল গরু/লাল বিরিষ জাতের গরু চট্টগ্রামের বিশেষ জাতের সুদর্শন গরু। এ জাতের গরু চট্টগ্রাম ছাড়া পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায়ও কিছু সংখ্যক দেখা যায়। হালকা লাল বর্ণের এ জাতের গরু দেখতে ছোটো খাটো, পেছনের দিক বেশ ভারী, চামড়া পাতলা, শিং ছোটো ও চ্যাপ্টা। এদের মুখ খাটো, চওড়া, মাঝারি ধরনের গলকম্বল, গলাখাটো ও সামান্য কুঁজ আছে। ওলান বেশ বর্ধিত, বাট সুডৌল, দুগ্ধ শিরা স্পষ্ট, গাভী অনুপাতে লেজ যথেষ্ট লম্বা, শেষ প্রান্তের লেজের গুচ্ছ লাল বর্ণের। প্রজনন অঙ্গ লাল বর্ণের গরুর দৈহিক ওজন ২০০-৩০০ কেজি। দুধ উৎপাদন ২.২ কেজি। দুগ্ধদান কাল ২৬০ দিন। এক বিয়ানে ৫০০-৬০০ কেজি দুধ পাওয়া যায়। এ জাতের গরুর দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি (৫-৬% পর্যন্ত হয়ে থাকে)। সাধারণ ব্যবস্থাপনায়ও এ জাতের গরু থেকে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে এরা সহজে মানিয়ে নিতে পারে। ১০ বছরে এ জাতের গরু থেকে ৬-৭টি বাচ্চা পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের ৫টি উপজেলাতে (পটিয়া রাউজান, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও সাতকানিয়া) এ জাতের গরু পালনের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এ জাতের গরুর গর্ভধারণের হার বেশি, প্রায় প্রতি বছর বাচ্চা পাওয়া যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি, প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে এ জাতের গরুর খামার লাভজনক। চট্টগ্রামের ৫টি উপজেলাতে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, এদের দৈনিক দুধ উৎপাদন ২.৭ লিটার, এক বিয়ানে দুগ্ধদানকাল ২১৫ দিন এবং এক বিয়ানে প্রাপ্ত দুধের পরিমাণ সর্বমোট ৫৮১ লিটার। প্রাপ্তবয়স্ক গাভী থেকে বার্ষিক আয় ২৫৩০০ টাকা/গাভী/বছর। এসব সুবিধার জন্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র খামারিদের কাছে এ জাতটির বেশ চাহিদা রয়েছে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৬-৭ বছর বয়সে অথবা ৫ম বিয়ানে দুধের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। যার পরিমাণ ৫৫০-৬০০ কেজি। রেড চিটাগাং ক্যাটেল বর্তমানে বাংলাদেশের একটি মূল্যবান জেনেটিক রিসোর্স। কিন্তু অপরিকল্পিত প্রজননের ফলে জাতটিতে অন্য জাতের বৈশিষ্ট্যর প্রবেশ ঘটছে। তাই পরিকল্পিত প্রজনন পদ্ধতি অনুসরণ করে এ জাতটি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জাতের ষাড় থেকে সিমেন সংগ্রহ করে তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করে প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করতে হবে। সঠিক প্রজনন নীতি অনুসরণই এ জাত সংরক্ষণের কার্যকর পদক্ষেপ।
জাত উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো গবাদিপশুর কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন- দুধ উৎপাদন, দৈহিক বৃদ্ধি, যৌন পরিপক্কতা, মাংস উৎপাদন ইত্যাদির উন্নয়ন সাধন। চট্টগ্রামের অষ্টমুখী লাল গরুর জাত উন্নয়ন দুইভাবে ঘটানো যায় কৌলিক মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটিয়ে।
উপযুক্ত খাদ্য, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটানো যায় কিন্তু কৌলিক মানের উন্নয়নের জন্য চাই সঠিক প্রজনন কৌশল। পশু প্রজননের দুটো হাতিয়ার রয়েছে বাছাই (Selection) ও সমাগম (Mating)। চট্টগ্রামের অষ্টমুখী লাল গরুর জাত উন্নয়নের জন্য প্রথমেই দরকার এ জাতের গরুগুলো থেকে বাছাই করে অধিক উৎপাদনক্ষম ও অধিক গুণাগুণ সম্পন্ন গরু নির্বাচন করা। বাছাই কার্য সঠিক ও উন্নত না হলে প্রজনন কর্মসূচি কখনোই সফল হবে না। পশুকে তার নিজস্ব গুণাগুণের ভিত্তিতে প্রজননের জন্য বাছাই করা যেতে পারে। কোনো এলাকায় যদি ৫০০ গাভী থাকে তবে তাদের দুধ উৎপাদনের রেকর্ড দেখে যাদের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি তাদের বাছাই করতে হবে। সারা জীবনের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেও প্রাণী বাছাই করা হয়। একটি গাভী তার জীবনকালে প্রতি দুগ্ধদানকালে কী পরিমাণ দুধ উৎপাদন করেছে তার ওপর নির্ভর করে ওই গাভীটি বাছাই করা যায়। পরিবেশগত নানাবিধ অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও উন্নত কৌলিক গুণাসম্পন্ন একটি প্রাণীর সারা বছরের গড় উৎপাদন মোটামুটি একই থাকে। একজন প্রজননকারী খুব সহজেই একটি গাভীর উৎপাদন ক্ষমতার তথ্যগুলো দেখে তার ভবিষ্যৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল তা জেনে ওই স্বতন্ত্র প্রাণীতে কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেটা জানা যায়। প্রতিটি প্রাণী তার পিতা থেকে অর্ধেক এবং মাতা থেকে অর্ধেক বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে। কোনো প্রাণীর বাচ্চার বৈশিষ্ট্য পরীক্ষার মাধ্যমে ওই প্রাণীর প্রজননমান নির্ণয় করে বাছাই করার পদ্ধতিকে সন্তান পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই বলা হয়। যেসব বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র একটি লিঙ্গে প্রকাশ পায় সে ক্ষেত্রে সন্তান পরীক্ষার ভিত্তিতে পশু বাছাই করা হয়। যেমন- দুধ উৎপাদন বৈশিষ্ট্য শুধু একটি লিঙ্গে প্রকাশ পায়। পুরুষ দুধ উৎপাদন না করলেও ওই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জিন বহন করে। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পশু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে progeny testing বা সন্তান পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রাণী বাছাই পদ্ধতি বেশ কার্যকর পদ্ধতি। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাণী বাছাই করার পর কোনো পদ্ধতিতে এদের মিলন ঘটানো হবে সেটা ঠিক করতে হয়। প্রজননের জন্য বাছাইকৃত পশুর মধ্যে মিলন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন প্রজনন পদ্ধতি রয়েছে যেমন ক্লোজ ব্রিডিং ও আউট ব্রিডিং। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত প্রাণীদের মধ্যে প্রজনন, সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের প্রাণীর মধ্যে প্রজনন এবং উন্নত জাতের প্রাণীর সাথে অনুন্নত প্রাণীর প্রজনন ইত্যাদি প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহার করে পশুর জাত উন্নয়ন করা যায়।
ইতিহাস হতে চলেছে রেড ক্যাটেল অব চিটাগাং। উচ্চমাত্রার সংকরীকরণের ফলে চট্টগ্রামের লাল গরু প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের লাল গরুর কদর ছিল বহু আগে থেকেই। একটা সময় চট্টগ্রামের লোকজন লাল গরু ছাড়া কোনো কোরবানি দিতেন না। মেজবানি/বিয়েতেও বেশ চাহিদা ছিল এ লাল গরুর। চাটগাঁইয়া গরু/সুন্দরী গরু/অষ্টমুখী গরুর উচ্চমাত্রার সংকরীকরণের ফলে নিজের স্বকীয়তা তথা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি ঘটছে। সত্তরের দশক থেকে দেশে সংকরায়ন শুরু হয়। কৃত্রিম প্রজননের ফলে চাটগাঁইয়া লাল গরু ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের লাল গরু সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সাতকানিয়া, চন্দনাইশ লোহাগাড়া বাঁশখালী, আনোয়ারসহ চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় বর্তমানে ৫-৬ হাজার বিশুদ্ধ অষ্টমুখী লাল গরু রয়েছে। সংকরায়িত অষ্টমুখী লাল গরুকে হিসাবে ধরলে মোট অষ্টমুখী লাল গরুর সংখ্যা হবে বিশ হাজার। চট্টগ্রামে কোরবানির হাটে ৮-১০ হাজার লাল গরুর সরবরাহ আসে।
আমাদের দেশের গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের লাল গরুর জাত উন্নয়নে উন্মুক্ত নিউক্লিয়াস প্রজনন কর্মসূচি (Open nucleus Breeding system) গ্রহণ করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চট্টগ্রামের লাল গরুর মধ্য থেকে অধিক উৎপাদনশীল ১০০০ টি (স্ত্রী পশু) গবাদি পশু নির্বাচন করা হয় এবং একটি কেন্দ্রে এনে রাখা হয়। তারপর আবারও উৎপাদনের ভিত্তিতে ২০০টি লাল গরু (গাভী) বাছাই করা যেতে পারে। এটিই নিউক্লিয়াস পাল। এ পালের প্রতিটি প্রাণীর বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনুমানকৃত প্রজনন মান (predicted breeding value) দ্বারা ২০টি পুরুষ লাল গরু নির্বাচন করে নিউক্লিয়াস পালে সংযোজন করা হয়। অতঃপর এদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনক্ষম প্রাণীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাছাই করা হয় এবং ২০% নিম্নমানের প্রাণীকে ছাঁটাই করা হয়। নিউক্লিয়াস পালের পুরুষ প্রাণীগুলোকে কৃত্রিম প্রজননের কাজে ব্যবহার অথবা প্রাকৃতিকভাবে প্রজননের কাজে ব্যবহার করে কৃষকের বাড়িতে থাকা স্ত্রী লাল গরুকে পাল দেয়া যেতে পারে। ফলে কৃষকের খামারে যে বাচ্চা উৎপন্ন হবে তা কিছুটা উন্নত মানের হবে। তখন আবার গ্রামীণ কৃষকদের প্রাণীগুলো থেকে ২০% অধিক উৎপাদনশীল স্ত্রী প্রাণী বাছাই করে নতুন নিউক্লিয়াস পাল তৈরি করা হয়। এভাবে এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৪-৫ বারে অর্থাৎ ২০-২৫ বছরে উন্নত ও অধিক উৎপাদনক্ষম অষ্টমুখী লাল গরু তৈরি করা সম্ভব।
উচ্চমাত্রার সংকরীকরণের কারণে দেশীয় জাতের এ গরু বিলুপ্তির পথে। অতি মুনাফার জন্য সংকরীকরণ করলেও এতে কৃষক তেমন লাভবান হন না। সংকর জাতের গরু পালন করতে গিয়ে হিমশিম খান কৃষক। বর্তমানে কিছু বেসরকারি সংস্থা খাঁটি রেড চিটাগাং গরু সংগ্রহ করে সেগুলোর বংশবিস্তারের জন্য কাজ করছে। এতে রেড চিটাগাং গরুর সংখ্যা হয়তো আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। সম্প্রতি পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহযোগী সংস্থা হিসেবে আইডিএফ চট্টগ্রামে লাল গরু সংরক্ষণ এবং পালনে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আইডিএফ সাতকানিয়া উপজেলার সাতকানিয়া সদর, আমিলেশ ইউনিয়ন ও পদুয়া ইউনিয়নকে বাছাইকরণসহ সাতকানিয়ায় আরসিসি/অষ্টমুখী/লাল বিরিষ গরুর একটি প্রদর্শনী খামার স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
রেড চিটাগাং ক্যাটেলের উচ্চমাত্রার সংকরীকরণ বন্ধ করে, প্রতি বছর অষ্টমুখী লাল গরুর প্রদর্শনী মেলা করে কৃষক পর্যায়ে অষ্টমুখী লাল গরু পালনে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটিয়ে এবং সর্বোপরি উন্মুক্ত নিউক্লিয়াস প্রজনন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের অষ্টমুখী লাল গরুকে বাণিজ্যিকভাবে ব্র্যান্ডেড বিফ হিসেবে বাজারজাত করাসহ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব হবে।
মো. আকতার হোসেন*
*প্রাণিসম্পদ প্রশিক্ষক, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী, চট্টগ্রাম
মো. আবু হানিফ, গ্রাম : ঘোলদাড়ি, উপজেলা : আলমডাঙ্গা, জেলা : চুয়াডাঙ্গা
প্রশ্ন : লাউয়ের বয়স্ক পাতায়-বাদামি-হলুদ দাগ হয়, ধীরে ধীরে পাতা পুড়ে যায়, কী করলে সমাধান পাব?
উত্তর : লাউ গাছের এ ধরনের সমস্যা সারকোস্পোরা নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ রোগে পাতায় পানি ভেজা দাগের মতো ছোট ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। দাগগুলো একত্রে বড় হয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। পরে আক্রান্ত পাতাগুলো শুকিয়ে যায়। এ রোগ প্রতিকারে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে লাউ গাছে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তবেই আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
মো. হেলাল উদ্দীন, গ্রাম : গৌরাঙ্গপুর, উপজেলা : মোহনপুর, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : পানের পাতায় কালো পানি ভেজা দাগ হয়ে আস্তে আস্তে পচে যায়। কী করলে উপকার পাব?
উত্তর : সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণে নিচের পাতার আগায় বা কিনারায় প্রথমে হলুদ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। দাগ আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে যেতে থাকে। আবার তাপমাত্রা বেশি হলেও এ রোগ বেড়ে যায়। এ ধরনের সমস্যায় কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে সুফল পাবেন।
মো. জয়নাল উদ্দীন, গ্রাম : লক্ষীরপাড়, উপজেলা : বিশ্বম্বরপুর, জেলা : সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন : স্ট্রবেরির পাতায় প্রথমে বাদামি, পরে কালো দাগ পড়ে, এর প্রতিকার কী?
উত্তর : স্ট্রবেরির এ সমস্যাটিকে পাতায় দাগ পড়া রোগ বলে। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিকারে ফেনামিডন ও মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে আপনি সুফল পাবেন।
মো. গোলাম মোস্তফা, গ্রাম : পিরোজপুর, উপজেলা : মেহেরপুর সদর, জেলা : মেহেরপুর
প্রশ্ন : আমার আম্রপালি ও হিমসাগর আমগাছে সাদা ছত্রাকের মতো দেখা যাচ্ছে । বর্তমানে গাছের কাণ্ড ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ছে । আমি কিভাবে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি?
উত্তর : আক্রমণের বর্ণনা অনুযায়ী মনে হচ্ছে আপনার আম গাছে মিলি বাগ নামক পোকার আক্রমণ হয়েছে। ব্রাশ দ্বারা সাদা বস্তু/ পোকা সরিয়ে ফেলে কিংবা আক্রান্ত পাতা ও ডগা সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। গুঁড়া সাবান (হুইল/জেট পাউডার) পানিতে (৫ গ্রাম/লি) মিশিয়ে স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ডাইমেথয়েট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই আপনি উপকার পাবেন।
মো. শরিফ উদ্দীন, গ্রাম : পুরনাপাইল, উপজেলা : ক্ষেতলাল, জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : এক বছর আগে আমি একটি আনারের কলমের চারা কিনে রোপণ করি এবং গাছে প্রচুর ফুল আসে। কিন্তু ফুল টিকে না এবং ফলও হয় না। এ অবস্থায় আমার করণীয় কী?
উত্তর : বাংলাদেশে ডালিমের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। ডালিমের ক্ষেত্রে কলমের চারা ভালো। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার, পানি ও পরিচর্যা প্রয়োজন। চারা কলম লাগানোর পর প্রথম ৩ বছর গাছে কোন ফুল ও ফল ধরতে দেয়া যাবে না। বরং ফুল এলে তা অপসারণ করতে হবে। গাছের বয়স অনুযায়ী সারের মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর অবশ্যই সেচ দিতে হবে। ১ম কিস্তি বর্ষার শুরুতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ইউরিয়া ও এমওপি অর্ধেক করে। ২য় কিস্তি ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ইউরিয়া ও এমওপির বাকি অর্ধেকসহ সব সার। ৩য় কিস্তি শীতের শেষে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে আনারের চাষ করলে আশা করা যায় আপনি আপনার কাক্সিক্ষত ফল পাবেন।
মুক্তা আকতার, গ্রাম : দক্ষিণভাদারতিল, উপজেলা : কালীগঞ্জ, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : লাউ গাছের পাতায় সাদা সাদা গুঁড়া দেখা যাচ্ছে। কী ব্যবস্থা নিলে উপকার পাব?
উত্তর : লাউ গাছের এ সমস্যাটিকে পাউডারি মিলডিউ বলে। এ রোগে পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের আবরণ দেখা যায়। আক্রমণ বেশি হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধানে প্রপিকোনাজল গ্রুপের ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে উপকার পাবেন। এছাড়া পরবর্তীতে আগাম বীজ বপন, রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার এবং সুষম সার ব্যবহার করলে এ সমস্যা থেকে আপনি সুরক্ষা পাবেন।
মো. মিনহাজুল ইসলাম, গ্রাম : ফলিয়ামারি, উপজেলা : ময়মনসিংহ সদর, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : আমার গরু ৮ মাসের গর্ভবতী। নড়াচড়া করতে চায় না। বসে থাকলে উঠতে পারে না। কিছু খেতে চায় না। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : গাভীর মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর হয়েছে। গাভীকে শিরার মাধ্যমে ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট প্রয়োগ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় গাভীকে ক্যালসিয়াম প্রিপারেশন (ক্যালপ্লেক্স) খাওয়াতে হবে। দুগ্ধ জ্বর হলে গাভী যাতে কাত হয়ে না শোয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ একপাশে ভর করে শুয়ে থাকলে নিউমোনিয়া হতে পারে।
শফিকুল ইসলাম, গ্রাম : বাকতা, উপজেলা : ফুলবাড়ীয়া, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : আমার গাভীকে বীজ দেয়া হয়। কিন্তু বীজ দেয়ার ২১ দিন পর আবার গরম হয়। এভাবে দুইবার বীজ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আমার করণীয় কী?
উত্তর : যদি দেখা যায় বীজ দেয়ার ২১ দিন পর আবার গরম হচ্ছে তাহলে বীজ দেয়ার ২ ঘণ্টা আগে ২.৫ সিসি ওভুরেলিন ইনজেকশন ঘাড়ের মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। আর বকনার ক্ষেত্রে ২.৫ সিসি ওভুপ্রোস্ট ইনজেকশন মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। আশা করি আপনার সমস্যাটি দূর হয়ে যাবে।
মো. কাশেম, গ্রাম : বিষ্ণুগ্রাম, উপজেলা : পাইকগাছা, জেলা : খুলনা
প্রশ্ন : আমি এ মৌসুমে পুকুরে মাছ ছাড়তে চাই। তবে আমি কি মাছ চাষ করলে লাভবান হব?
উত্তর : আপনি স্বল্প সময়ে লাভবান হতে চাইলে থাই কই, মনোসেক্স তেলাপিয়া, থাই সরপুঁটি এবং গিফট তেলাপিয়া চাষ করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে হাতে কলমে আরো বেশি প্রশিক্ষণও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনি অনেক লাভবান হবেন।
নাজমুল করিম, গ্রাম : বালাগ্রাম উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : পুকুরে শোল মাছ চাষ করতে চাই। এ ব্যাপারে পরামর্শ দিলে উপকৃত হব?
উত্তর : পুকুরে শতকপ্রতি ১ কেজি করে চুন প্রয়োগ করে তারপর পুকুরে পানি ঢুকাতে হবে। পানি ঢুকানোর ১ সপ্তাহ পর পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। শোল মাছের রেণু পোনা আমরা সাধারণত হ্যাচারি থেকে পাই না। শোল মাছের প্রজনন সাধারণত পুকুরেই হয়ে থাকে। একক চাষের জন্য শতকপ্রতি ১০টি মাছ এবং মিশ্র চাষের জন্য শতকপ্রতি ৪টি করে দেয়া যেতে পারে। খৈল বা চালের কুড়া দিয়ে বানানো খাবার সাধারণত শোল মাছ খায় না। ছোট মাছই এর প্রধান খাবার। পোনা মাছের প্রিয় খাবার শুঁটকির গুঁড়া ভালোভাবে পিষে দিতে হয়। আর বড় মাছের জন্য ছোট ছোট মাছ যেমন পুঁটি, চান্দা এগুলো দেয়া যেতে পারে। তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খায়। কিন্তু পচা মাছ এরা খায় না। এছাড়াও এরা খাবার হিসেবে কেঁচো ও ব্যাঙ খায়। বাগদা চিংড়ির মাথাও শোল মাছের প্রিয় খাবার। যে পুকুরে শোল মাছ চাষ করবেন সেই পুকুরে কচুরিপানা অথবা কলমিলতা থাকলে ভালো কারণ শোল মাছ আড়ালে আবডালে থাকতে পছন্দ করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কচুরিপানায় পুকুর ভরে না যায়। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড় দিতে হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে মাছ বের হয়ে যাবে। এভাবে শোল মাছ চাষ করলে আপনি অবশ্যই লাভবান হবেন।
কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এল আর, সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ suman_arefin@yahoo.com
নতুন বছরের শুভেচ্ছা সবাইকে। বৈশাখ মাস দিয়ে শুরু হয় বাংলা বর্ষ। এ মাসে চলতে থাকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেলা, পার্বন, উৎসব, আদর, আপ্যায়ন। পুরনো বছরের ব্যর্থতাগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন দিনের প্রত্যাশায় কৃষক ফিরে তাকায় দিগন্তের মাঠে। প্রিয় পাঠক আসুন এক পলকে জেনে নেই বৈশাখে কৃষির করণীয় দিকগুলো।
বোরো ধান
দেরিতে রোপণ করা বোরো ধানের জমিতে চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
নাবি বোরো ধানের থোড় আসার সময় যাতে খরার জন্য পানির অভাব না হয় তাই আগে থেকেই সম্পূরক সেচের জন্য মাঠের এক কোনে মিনিপুকুর তৈরি করতে হবে;
থোড় আসা শুরু হলে জমিতে পানির পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়াতে হবে;
ধানের দানা শক্ত হলে জমি থেকে পানি বের করে দিতে হবে;
এ মাসে বোরো ধানে মাজরা পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধিপোকা, লেদাপোকা, ছাতরাপোকা, পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকার আক্রমণ রোধ করতে হবে। আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করা দরকার; এসব উপায়ে পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে সঠিকভাবে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে;
এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, বাদামি দাগ রোগ, ব্লাস্ট, পাতা পোড়া ও টুংরো রোগসহ অন্যান্য রোগ হতে পারে। সঠিক বালাইনাশক ব্যবহার করে রোগ দমন করতে হবে;
এ মাসে শিলাবৃষ্টি হতে পারে, বোরো ধানের ৮০% পাকলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে;
বন্যাপ্রবণ নিচু এলাকায় আগাম জাতের আউশ ধান (ব্রি ধান২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৪৮ এসব) চাষ করতে পারেন;
আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকায় আগাম জাত ও স্বল্পমেয়াদি বিনাধান-৭, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯ এসব চাষ করতে পারেন।
গম ও ভুট্টা (রবি)
মাঠ থেকে কাটার পর এ দুটি দানাদার ফসল ভালোভাবে শুকিয়ে উপযুক্ত পাত্রকে বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ পাত্রকে মাটি বা মেঝ থেকে আলাদাভাবে রাখতে হবে।
সংরক্ষণ পাত্রে শুকনো নিমপাতা, বিষকাটালি পাতা রেখে দিলে সহজেই পোকার আক্রমণ রোধ করা যাবে।
ভুট্টা (খরিপ)
খরিপ ভুট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে;
জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং একই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে;
পাট
বৈশাখ মাস তোষা পাটের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। বিজেআরআই তোষা-৭, ও-৩৮২০, ও-৭৯৫ ভালো জাত;
দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে তোষা পাট ভালো হয়;
বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স বা ১৫০ গ্রাম রসুন পিষে বীজের সাথে মিশিয়ে শুকিয়ে নিয়ে জমিতে সারিতে বা ছিটিয়ে বুনতে হবে;
সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে ৩৫-৪০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়;
ভালো ফলনের জন্য শতাংশপ্রতি ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;
জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময় শতাংশপ্রতি ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ কেজি দস্তা সার দিতে হবে;
শতাংশপ্রতি ২০ কেজি গোবর সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের পরিমাণ অনেক কম লাগে;
আগে বোনা পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে;
এ সময় পাটের জমিতে উড়চুঙ্গা ও চেলা পোকার আক্রমণ হতে পারে; সেচ দিয়ে মাটির উপযোগী কীটনাশক দিয়ে উড়চুঙ্গা দমন করতে হবে;
চেলা পোকা আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ফেলে দিতে হবে এবং জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে;
পাটের জমিতে কাণ্ড পচা, কালপট্টি, নরম পচা, শিকড় গিট, হলদে সবুজ পাতা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। নিড়ানি, আক্রান্ত গাছ বাছাই, বালাইনাশকের যৌক্তিক ব্যবহার করলে এসব রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
শাকসবজি
বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কলমিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে;
মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন;
আগের তৈরি করা চারা থাকলে ৩০/৩৫ দিনের সুস্থ সবল চারাও রোপণ করতে পারেন;
লতানো সবজির জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাচা তৈরি করে নিতে হবে;
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য গাছের বাড়বাড়তি বেশি হলে লতার/গাছের ১৫-২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিতে হবে। এতে গাছে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে;
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে।
এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুনভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে চাইলে বারি টমেটো ৪, বারি টমেটো ৫, বারি টমেটো ৬, বারি টমেটো ১০, বারি টমেটো ১১, বারি হাইব্রিড টমেটো ৪, বারি হাইব্রিড টমেটো ৫, বা বিনা টমেটো ১, বিনা টমেটো ২-এর চাষ করতে পারেন;
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে হলে পলিথিনের ছাওনির ব্যবস্থা করতে হবে সেসাথে এ ফসলটি সফলভাবে চাষের জন্য টমেটোটোন নামক হরমোন প্রয়োগ করতে হবে।
গাছপালা
এ মাসে আমের মাছি পোকাসহ অন্যান্য পোকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। মাছি পোকা দমনের জন্য সবজি খেতে যে রকম বিষটোপ ব্যবহার করা হয় সে ধরনের বিষটোপ বেশ কার্যকর। ডিপটরেক্স, ডারসবান, ডেনকাভেপন সামান্য পরিমাণ দিলে উপকার পাওয়া যায়;
এ সময় কাঁঠালের নরম পচা রোগ দেখা দেয়। এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে ফলে রোগ দেখা দেয়ার আগেই ফলিকুল ০.০৫% হারে বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা রিডোমিল এম জেড-৭৫ প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩ বার স্প্রে করতে হবে;
নারিকেলের চারা এখন লাগাতে পারেন। ভালো জাতের সুস্থ সবল চারা ৬-৮ মিটার দূরে লাগানো যায়। গর্ত হতে হবে দৈর্ঘ্যে ১ ফুট, প্রস্থে ১ ফুট এবং গভীরতায় ১ ফুট। নারিকেলের চারা রোপণের ৫-৭ দিন আগে প্রতি গর্তে জৈব সার ১০ কেজি, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৫৫০ গ্রাম এবং জিপসাম ৫০০ গ্রাম ভালোভাবে গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
গ্রামের রাস্তার পাশে পরিকল্পিতভাবে খেজুর ও তালের চারা এখন লাগাতে পারেন। যতœ, পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে ২-৩ বছরেই গাছগুলো অনেক বড় হয়ে যাবে;
ভালো ফলনের জন্য এসময় বৃক্ষ জাতীয় গাছের বিশেষ করে ফল গাছের প্রয়োজনীয় যতœ নিতে হবে; মাতৃগাছের পরিচর্যা, আগাছা দমন, প্রয়োজনীয় সেচ দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে;
বৃষ্টি হয়ে গেলে পুরনো বাঁশ ঝাড় পরিষ্কার করে কম্পোস্ট সার দিতে হবে এবং এখনই নতুন বাঁশ ঝাড় তৈরি করার কাজ হাতে নিতে হবে;
যারা সামনের মৌসুমে গাছ লাগাতে চান তাদের এখনই জমি নির্বাচন, বাগানের নকশা প্রস্তুত এবং অন্যান্য প্রাথমিক কাজগুলো সেরে রাখতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
ব্রুডার হাউসের শেডে মুরগির বাচ্চা তোলার সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি ও গ্লুকোজ খাওয়াতে হবে;
লেয়ার হাউস ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শেডের চাল বা ছাদে তাপ বিকিরণ করতে পারে এমন সাদা, অ্যালুমিনিয়িাম রঙ দেয়া প্রয়োজন;
অতিরিক্ত গরমে পাইপ বা ঝর্ণার মাধ্যমে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র খামারের ক্ষেত্রে চালের ওপরে পাটের চট দিয়ে পানি ছিটাতে হবে;
হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া জরুরি। সেজন্য মুরগির রানীক্ষেত, ব্রংকাইটিস, ফাউল কলেরা, ম্যারেক্স এবং হাঁসের প্লেগ ও কলেরা রোগের টিকা দেয়ার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
গোখাদ্যের জন্য নেপিয়ার, বাজরা, প্যারা, ভুট্টা, ইপিল ইপিল এর চাষ করার ভাল সময় এখন। বাড়ির আশপাশে, পুকুর পাড়ে, রাস্তার ধারে, পতিত জায়গায় গোখাদ্যের চাষ করে লাভবান হওয়া যায়;
গ্রীষ্মের তাপদাহে গবাদি পশুর জন্য অতিরিক্ত খাবার, বিশ্রাম, ঘরে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, বেশি পানি খাওয়ানোসহ অন্যান্য কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে হবে;
এ সময় গবাদি পশুর তড়কা ও গলাফুলা রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য টিকা প্রদানসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
বৈশাখ মাস পুকুরে মাছ ছাড়ার উপযুক্ত সময়; ভালোভাবে পুকুর তৈরি অর্থাৎ কাদা সরিয়ে, চুন প্রয়োগ করে, আগাছা পরিষ্কার, পানি দেয়া, পানি পরীক্ষা, পুকুর পাড়ে নিত্য পাতা ঝরা গাছ ছাঁটাই বা কেটে ফেলাসহ অন্যান্য কাজগুলো করতে হবে। এরপর প্রতি শতকে মিশ্রচাষের জন্য ৩০-৪০টি ৪-৫ ইঞ্চি বড় সুস্থ সবল পোনা ছাড়তে হবে;
পানির ৩ স্তরের কথা বিবেচনা করে তেলাপিয়া, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, কার্পজাতীয় মাছ, রুই, কাতল, মৃগেল, কালো বাউস এবং সম্ভব হলে চিংড়ি পোনাও ছাড়া যাবে;
পোনা সংগ্রহের সময় বিশ্বস্ত উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
প্রিয় পাঠক, বৈশাখ আসে আমাদের জন্য নতুন আবাহনের সৌরভ নিয়ে। সাথে আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসে কালবৈশাখীকে। কালবৈশাখীর থাবা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কৃষিতে আগাম বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুবিবেচিত লাগসই কৌশল আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বাধাঁ ডিঙিয়ে আমরা কৃষিকে নিয়ে যেতে পারব সমৃদ্ধির ভুবনে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য আবারও নতুন বছরের শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫