Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

কালিজিরা কালোহীরা

কালিজিরা অতি জনপ্রিয় ও সুপরিচিত একটি ফসলের নাম। কালিজিরা বৈজ্ঞানিক নাম Nigella sativa L, Ranunculaceae, পরিবারভুক্ত বর্ষজীবী, বীরুৎ জাতীয় একটি উদ্ভিদ। Nigella sativa কে আরবি ভাষায় বলা হয় হাব্বাত-আল-বারাকাহ অর্থাৎ আশীর্বাদপুষ্ট বীজ, যার ফল শুষ্ক বীজকোষ হিসাবে পরিচিত। মিসরের তৎকালীন রাজা টুট রেডের সমাধি হতে কালিজিরা আবিষ্কৃত হয় এবং সে সময় এটা পরকালে ব্যবহার করা হবে বলে বিশ্বাস করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর থেকে কালিজিরা মসলা ও ঔষধি গাছ হিসাবে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি নাম। বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’ এ ‘কালোজিরা দেহের প্রাণশক্তি বাড়ায় এবং ক্লান্তি দূর করে’ উল্লেখ করেছেন। অতুলনীয় এ ফসলের গুণাগুণ প্রায় কিংবদন্তির মতো এবং সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর চিকিৎসায় এর গুরুত্ব দিন দিন পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এ ফসলটির উৎপত্তি মূলত পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্য প্রাচ্য থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। কালিজিরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, জাপান, চীন, তুরস্ক (শিওয়ে, ২০১১) প্রভৃতি দেশে চাষাবাদ হয়ে থাকে। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ টন কালিজিরা উৎপন্ন হয়।        


কালিজিরার গুণাগুণ ও ব্যবহার
শরীরের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে কালিজিরার মতো এত কার্যকর প্রাকৃতিক উপাদান সম্পন্ন আর কোনো ফসল  নেই। পুষ্টিমাণ ও ঔষধি গুণাগুণসহ কালিজিরা বহু গুণে গুণান্বিত। তাই ছন্দাকারে বলা যায়- ঔষধি গুণে অনন্য, কালিজিরা-খেয়ে হও ধন্য’। কিংবা ‘কালিজিরা কালোহীরা, দূর করে মৃত্যু ছাড়া সকল পীড়া’। কালিজিরার বীজে রয়েছে শর্করা, আমিষ, ফ্যাটি এসিড, অ্যামাইনো এসিড, সিস্টিন, মিথিওনিন ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি ১, ভিটামিন-বি ২, নিয়াসিন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান। এছাড়াও বীজে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, দস্তা, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের মতো মৌল উপাদান রয়েছে। কালিজিরায়
Thymoquinone, Nigellone, Melanthin নামক যৌগ পাওয়া যায়, যা ওষুধ শিল্পের মূল উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয়। মূলত বীজই ব্যবহার্য্য অংশ। কালোজিরার বীজ উদ্দীপক, স্মৃতিশক্তি বর্ধক, বায়ুনাশক, হজম বৃদ্ধিকারক, জীবাণুনাশক, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করে। এছাড়াও কালিজিরা বহুবিধ রোগ বিশেষ করে মাথাব্যথা, দাঁতব্যথা, ফোঁড়া সারাতে, চুল পড়া রোধে, বহুমূত্র, হাঁপানি, উদরাময়, সর্দি ও চর্মরোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর। তাছাড়া অনিদ্রা, মুখশ্রী সৌন্দর্য রক্ষা, অবসন্নতা, দুর্বলতা, নিষ্ক্রিয়তা, আহারে অরুচি দূরীকরণে কালিজিরা উপযোগী ভূমিকা পালন করে থাকে। কালোজিরার গুঁড়া নিয়ম করে খেলে আর্থ্রাইটিস রোগ উপশম হয় ও প্রসূতি মহিলাদের দুধের প্রবাহ ও পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে (জে.এস.প্রুথি ১৯৭৬)। এমনকি ধনুষ্টংকারে শিরদাঁড়ায় সেঁক দেয়ার জন্য কালিজিরার পাতার ক্বাথ ব্যবহার হয়। তাই সুস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল জীবনে কালিজিরার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং মানব দেহকে এর নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ করে তোলায় সহযোগিতা করে।


কালিজিরা ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি অপ্রধান মসলা ফসল হিসাবে পরিচিত। ব্যবহার ও উৎপাদনের দিক থেকে গৌণ হলেও এদেশের রসনাবিদদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মসলা। পাঁচফোড়নের একটি অন্যতম উপাদান এ কালিজিরা। রন্ধনশালায় দৈনন্দিন বিভিন্ন খাবার তৈরিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কালিজিরার বীজ সুগন্ধি, বেকারি ও ওষুধ শিল্পে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিভিন্ন আর্য়ুবেদিক, হারবাল, ইউনানি কোম্পানিগুলোর ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসাবে কালিজিরা ব্যবহার করায় এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।


কালিজিরার তেল অতি উচ্চমানের বিভিন্ন অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, যেমন- লিনোলেনিক (ওমেগা-৩), লিনোলিক (ওমেগা-৬),  অলিক এসিড (ওমেগা-৯) সমৃদ্ধ। এছাড়া কালিজিরা তেলে বিভিন্ন সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড যেমন-মিরিস্টিক এসিড, পামিটিক এসিড, স্টিয়ারিক এসিড, অ্যারাকিডিক এসিড উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে। তেলে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি থাকায় রক্তে কোলেস্টরলের পরিমাণ কমায়। সুতরাং ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৯ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ কালিজিরা তেল উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এবং ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৯ ফ্যাটি এসিড তেলের সংরক্ষণকাল বাড়ায়। এছাড়া কালিজিরা তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (আলফা টোকোফেরল), অ্যাস্টিটিউমার অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ রয়েছে।


এমনকি কালিজিরা ফুলের মধুও অত্যন্ত উপকারী। একমাত্র মৌমাছিই কালিজিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। কালিজিরা ফসলে ক্ষেত্রে মৌমাছি বাক্স স্থাপন করে দেখা গেছে, ফলন প্রায় ১০-১২% বৃদ্ধি পায় এবং বীজের গুণাগুণও অতি উচ্চমানের হয়।


পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে কালিজিরা
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যখন রোগ-যন্ত্রণা খুব বেশি কষ্টদায়ক হয় তখন এক চিমটি পরিমাণ কালিজিরা নিয়ে খাবে তারপর পানি ও মধু সেবন করবে। (মুজামুল আওসাত তাবরানী)। হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘প্রতিদিন ২১টি কালিজিরার ১টি পুটলি তৈরি করে পানিতে ভিজাবে এবং পুটলির পানির ফোঁটা নাসারন্ধ্রে (নাশিকা, নাক) ব্যবহার করবে (তিরমিজি, বোখারি , মুসলিম)। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন- ‘তোমরা কালিজিরা ব্যবহার করবে, কেননা একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সর্বরোগের মুক্তি এতে রয়েছে’ (বোখারি শরিফ, ৫৬৮৭)। প্রতিটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মধু সেবনের উপকারিতা এবং কার্যকারিতার কথা উল্লেখ রয়েছে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, ‘আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে আদেশ দিলেন : পর্বতে, গাছে ও উঁচু চালে বাড়ি তৈরি কর, এরপর সর্বপ্রকার ফুল থেকে খাও এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথে চলো। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার (সূরা আন-নাহল, আয়াত : ৬৮ ও ৬৯)। আল্লাহর হুকুম, রহমত ও কুদরতে কালিজিরার মধুও প্রতিটি রোগের ওষুধ।


বাংলাদেশে কালিজিরা
বাংলাদেশে ১৪,৭৪২ হেক্টর জমিতে ১৬,৫২৬ মেট্রিক টন কালিজিরা উৎপন্ন হয় (সূত্র : ডিএই, ২০১৭)। ফরিদপুর, মাগুরা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার উঁচু ও মাঝারি উঁচু এবং দোঁ-আশ থেকে বেলে-দোঁ-আশ মাটিতে চাষাবাদ বেশি হয়। মাটির পিএইচ
(pH) ৭.০-৭.৫ এবং উচ্চমাত্রায় অনুজীবের কার্যক্রমসম্পন্ন বেলে দোঁ-আশ মাটি কালিজিরা চাষের জন্য উত্তম। মে ২০১৭ প্রকাশিত বিবিএসের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ সালে ৫২০ মেট্রিক টন কালিজিরা (HS Code 0909-Black Cumin Seeds) ৫ কোটি ২২ হাজার টাকার বিনিময়ে রফতানি করা হয়। বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে ফসলটির হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৬০০-৭০০ কেজি।
 

কালিজিরার গবেষণা, অর্জন এবং সম্প্রসারণ
প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরার চাষাবাদ হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে অতীতে কালিজিরা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা পরিলক্ষিত হয়নি বললেই চলে। তবে মসলা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৯৯৭-৯৮ সাল হতে মূল্যায়ন ও বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে। পরবর্তীতে প্রাথমিক ফলন পরীক্ষা, অগ্রবর্তী ফলন পরীক্ষা ও আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ যাচাই বাছাই করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ‘বারি কালিজিরা-১’ নামে কালোজিরার একটি উচ্চফলনশীল জাত চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবন করা হয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সার, সেচ  ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়।


জাত উদ্ভাবনের পর বিগত বছরগুলোতে এর বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণে  লক্ষ্যে বিগত বছরগুলোতে বারি কালিজিরা-১ এর মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন এবং বীজ বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে ব্যবহার, বেসরকারি সং¯হায় সরবরাহ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গবেষণা এবং পরবর্তী মৌসুমে গবেষণা কাজের জন্য কালিজিরা বীজ সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া প্রযুক্তি হস্তান্তরের নিমিত্তে ২০১৭-১৮ সালে পাবনা, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম এবং রংপুর এলাকায় ৫টি ব্লক প্রদর্শনী (প্রতিটি ব্লক ৪-৫ বিঘা) স্থাপন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।


বারি কালিজিরা-১ এর বৈশিষ্ট্য
জাতটির জীবনকাল ১৩৫-১৪৫ দিন। এর উচ্চতা ৫৫-৬০ সেন্টিমিটার। প্রতিটি গাছে প্রায় ৫-৭টি প্রাথমিক শাখা এবং ২০-২৫টি ফল থাকে। প্রতিটি ফলের ভেতরে প্রায় ৭৫-৮০টি বীজ থাকে যার ওজন প্রায় ০.২০-০.২৭ গ্রাম। এ জাতের প্রতিটি গাছে প্রায় ৫-৭ গ্রাম বীজ হয়ে থাকে। এবং ১০০০ বীজের ওজন প্রায় ৩.০০-৩.২৫ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি এর গড় ফলন ০.৮০-১.০ টন। স্থানীয় জাতের তুলনায় এর রোগবালাই খুবই কম।


রাসায়নিক উপাদান
কালিজিরার তেল অত্যন্ত পুষ্টিকর, ঔষধি গুণাগুণ সমৃদ্ধ এবং অ্যারোমেটিক গন্ধযুক্ত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে কালিজিরা, সরিষা ও সয়াবিন বীজের নমুনার রাসায়নিক বিশ্লেষণের তুলনামূলক প্রাপ্ত তথ্য নিম্নরুপ

ফসলের নাম

শর্করা (%)

আমিষ (%)

ফ্যাট/তেল (%)

বারি কালোজিরা-১

২৮-৩০

২২-২৮

২৭-৩১

বারি সরিষা-১৪

১৮ .০

২০-২৪

৩৫-৪২

বারি সয়াবিন-৬

১৬-২০

৪০-৪৫

১৮-২০

 

নমুনার নাম

(তেল)

ফ্যাট/তেল

(%)

সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড  (%)

অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড (%)

মিরিস্টিক

পামিটিক

স্টিয়ারিক

অ্যারাকিডিক

অলিক

(ওমেগা-৯)

লিনোলিক

(ওমেগা-৬)

কালোজিরা

২৭-৩১

০.২৪

১৪.৫০

২.৫৮

০.২৯

২১.২১

৫৭.৩৭

সরিষা

৩৫-৪২

০.০৫

২.৮৭

১.৪৬

৫.৬৩

১৬.৫৩

১৫.০৯

সয়াবিন

১৮-২০

০.০৯

১০.৯৫

৩.১৫

০.২৫

৩১.৮৯

৪৭.


কালিজিরা, সরিষা ও সয়াবিন বীজের রাসায়নিক বিশ্লেষণের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, কালিজিরা তেলে পামিটিক এসিড ও লিনোলিক এসিডের পরিমাণ অন্য তেলের তুলনায় বেশি এবং ফ্যাট, বিভিন্ন সম্পৃক্ত এসিড, অলিক এসিডের পরিমাণও সন্তোষজনক পর্যায়ে বিদ্যমান।


কালিজিরার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা
কালিজিরার নতুন নতুন জেনেটিক মেটারিয়াল সংগ্রহ ও মূল্যায়নের পাশাপাশি সারের পরিমাণ নির্ধারণ, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, তেল বের করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে ও কিছু প্রযুক্তি নির্ণয়ের কাজ চলছে। বর্তমানে মসলা গবেষণা কেন্দ্রে দেশ ও  বিদেশে থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ৯ টি জার্মপ্লাজম রয়েছে যা থেকে খুব শিগগিরই আরও একটি উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। ‘কালিজিরার জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও মূল্যায়ন’ শিরোনামে কালিজিরার নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য ২০১৬-১৭ বছরে সম্পাদিত গবেষণার ফলাফলে
BC009 Ges BC010 জার্মপ্লাজম দ্ইুটিতে বারি কালিজিরা-১ জাতের তুলনায় অধিক ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষাটি আরও ২ বছর সম্পন্ন করার পর নতুন জাত উদ্ভাবন করার সম্ভাবনা রয়েছে।


সীমাবদ্ধতা
কালিজিরার বহুবিধ গুণাগুণ ও ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও কালিজিরার চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া চাহিদা অনুযায়ী দেশে কালিজিরার উৎপাদনও কম হচ্ছে। সাধারণত কালিজিরা একটি গৌণ মসলা ফসল বিধায় চাষিরা এটি চাষাবাদে খুব বেশি আগ্রহী নয় এবং যেহেতু রবি মৌসুমে অধিকাংশ ফসলের চাষাবাদ হয় সেজন্য কৃষক একক ফসল হিসাবে কালিজিরা চাষাবাদ করতে চায় না। ন্যায্য বাজারমূল্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, দুর্বল বাণিজ্যিক কাঠামো, বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনার জন্য কাক্সিক্ষত পরিমাণে কালিজিরার বীজ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কালিজিরার উৎপাদন বৃদ্ধিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যেমন কৃষকের মধ্যে কালোজিরার বীজ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর, কৃষক প্রশিক্ষণ জোরদারকরণ ইত্যাদি। গাজীপুর ও কারওয়ান বাজারে বিগত ৫ বছরের পরিবর্তনশীল বাজার মূল্যে দেখা যায় গাজীপুর ও কারওয়ান বাজার উভয় ক্ষেত্রেই কালিজিরার বাজার মূল্য ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি এবং ২০১৭ সালে সবচেয়ে কম পরিলক্ষিত হয়।

কালিজিরা সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কালিজিরা এবং কালিজিরার দ্বারা উৎপাদিত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
 

বাংলাদেশে কালিজিরা চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের মাটি এবং জলবায়ু কালিজিরা চাষের জন্য উপযোগী।
দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুরের চরাঞ্চলে উন্নত জাতের কালিজিরার চাষ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
কালিজিরা চাষাবাদে সেচ কম দিতে হয়, কখনও ১/২ টি সেচে ভালো ফলন পাওয়া যায় বিধায় বরেন্দ্র এলাকায় এর চাষাবাদ বৃদ্ধি করার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে।
চলনবিল এলাকায় পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে কালিজিরা চাষ করা যেতে পারে।


ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা এলাকার চাষিরা পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে। পেঁয়াজ বীজ ক্ষেতের চারপাশে এবং ক্ষেতের ভেতর পেঁয়াজের ১০-১৫ সারি পর কালিজিরা বপন করা যায়। এতে কালিজিরার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া অন্যান্য রবি ফসলের ক্ষেতের চারপাশেও কালিজিরা বপন করা যেতে পারে। কালিজিরা একটি অর্থকরী এবং বহুগুণে গুণান্বিত উচ্চমাণসম্পন্ন পুষ্টিকর মসলা জাতীয় ফসল। তাই এর প্রচার, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা আবশ্যক। তাছাড়া এ ফসলের  গুণাবলি ও ব্যবহারের ব্যাপকতা বিষয়ে প্রচারণার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করার এখনই সময়।

 

কৃষিবিদ ড. রুম্মান আরা* কৃষিবিদ ড. মো. মাসুদুল হক**
কৃষিবিদ ড. শাহানা আকতার***

* এসএসও,**এসএসও,*** এসএসও আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর

বিস্তারিত
কালিজিরা ম্যাজিক ফসল

কালিজিরার ইংরেজি নাম Fennel flower, Nutmeg flower, Roman Coriander, Blackseed or Black caraway| অন্যান্য বাংলা নাম কালিজিরা, কালোজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে, নিজেলা, কালঞ্জি এসব। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কালো বীজের গুণাগুণ স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম অসাধারণ কালজয়ী। কালিজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। কেউ কেউ বলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর উৎপত্তি স্থান। ওষুধ শিল্প, কনফেকশনারি শিল্প ও রন্ধনশালায় নিত্যদিনের ব্যঞ্জরিত খাবার তৈরিতে কালিজিরার জুড়ি নেই। বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি পানীয় দ্রব্যকে রুচিকর ও সুগন্ধি করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে মসলা ফসলের মধ্যে কালিজিরার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার আছে বিশ্বব্যাপী। পাঁচ ফোড়নের একটি অন্যতম উপাদান। কালিজিরা আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহু রকমের ব্যবহার আছে। প্রসাধনীতেও ব্যবহার হয়। কালিজিরার যে অংশটি ব্যবহার করা হয় তাহলো শুকনো বীজ ও বীজ থেকে পাওয়া তেল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কালিজিরাকে একটি অব্যর্থ রোগ নিরাময়ের উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করে। হাদিসে আছে কালিজিরা মৃত্যু ব্যতীত অন্য সব রোগ নিরাময় করে। এজন্য কালিজিরাকে সব রোগের ওষুধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নিয়মিত ও পরিমিত কালিজিরা সেবনে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি সমৃদ্ধি সাধন করে। আশ্চর্য বীজ কালিজিরার উপকারিতা বহুমুখী।   
 

কালিজিরার বোটানি
কালিজিরা মাঝারি জাতীয় নরম মৌসুমি গাছ, একবার ফুল ও ফল হওয়ার পর মরে যায়। পাতা সরু ও চিকন, সবুজের মধ্যে ছাই-ছাই রঙ  মেশানো। পত্রদ-ের দুই দিকে যুগ্ম বা জোড়া পাতা ধরে সোজা হয়ে জন্মায়। পাতাগুলো ছোটো ফলকের মতো বিভাজিত অবস্থায় দেখা যায়। স্ত্রী, পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়, নীলচে সাদা কিংবা জাত বিশেষে হলুদাভ পীত বর্ণেরও হয়। পাঁপড়ি পাঁচটি, ফল গোলাকার, কিনারায় আঁকর্শির মতো বাড়তি অংশ থাকে। পুংকেশরের সংখ্যা অনেক। গর্ভকেশর বেশ লম্বা হয়। বীজ কালো রঙের তিনকোণা আকৃতির। বীজগুলো বীজকোষ খাঁজ আকারে ফলের সাথে লম্বালম্বিভাবে থাকে। বীজে তেল থাকে। গাছ লম্বায় জাতভেদে ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। প্রতি গাছে ৫ থেকে ৭টি প্রাথমিক শাখা এবং ২০ থেকে ২৫টি ফল থাকে। প্রতিটি ফলের ভেতর ৭৫ থেকে ৮০টি বীজ থাকে যার গড় ওজন ০.২০ থেকে ০.২৭ গ্রাম। বারি কালিজিরা-১ এর প্রতিটি গাছে ৫ থেকে ৭ গ্রাম বীজ হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের ওজন ৩.০ থেকে ৩.২৫ গ্রাম। বীজ পরিপক্ব হতে ১৩০ থেকে ১৪৫ দিন সময় লাগে। দেশি জাতের কালিজিরা পরিপক্ব হতে আরেকটু কম সময় লাগে। বাংলা কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে এর ফুল ফোটে এবং শীতকালে ফল ধরে, শীতের শেষে ফল পাকে।

 

কালিজিরার পুষ্টিগুণ
কালিজিরাতে প্রায় শতাধিক পুষ্টি ও উপকারী উপাদান আছে। কালিজিরা খাদ্যাভাসের ফলে আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কালিজিরা ফুলের মধু উৎকৃষ্ট মধু হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিবেচিত, কালোজিরার তেল আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। বর্তমানে কালিজিরা ক্যাপসুলও বাজারে পাওয়া যায়। এতে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক ক্যারোটিন ও শক্তিশালী হরমোন, প্রস্রাব বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, পাচক এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান এবং অম্লরোগের প্রতিষেধক। এর প্রধান উপাদানের মধ্যে আমিষ ২১, শতাংশ, শর্করা ৩৮ শতাংশ, স্নেহ বা ভেষজ তেল ও চর্বি ৩৫ শতাংশ। এছাড়াও ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি গ্রাম কালিজিরা পুষ্টি উপাদান হলো-প্রোটিন ২০৮ মাইক্রোগ্রাম; ভিটামিন বি১ ১৫ মাইক্রোগ্রাম; নিয়াসিন ৫৭ মাইক্রোগ্রাম; ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম; আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম; ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম; কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম; জিংক ৬০ মাইক্রোগ্রাম; ফোলাসিন ৬১০ আইউ। কালিজিরার অন্যতম উপাদানের মধ্যে আরও আছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল। পাশাপাশি কালিজিরার তেলে আছে লিনোলিক এসিড, অলিক এসিড, ফসফেট, লৌহ, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, নিয়াসিন ও ভিটামিন-সি ছাড়াও জীবাণুনাশক বিভিন্ন উপাদান যা হাজারও উপকার করে।

 

কালিজিরার ঔষধি গুণ
কালিজিরা আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহুবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার হয়। মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হলেও ইউনানি মতে নারীদের বিভিন্ন রোগে ও সমস্যায় কালিজিরা অব্যর্থ মহৌষধ। এছাড়া প্রসবকালীন ব্যথা কমাতে, প্রসূতির স্তনে দুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য প্রসবোত্তর কালিজিরা বাটা ভর্তা খাওয়ার প্রমাণিত উপকারী বিধান আছে। প্রশ্বাব বাড়ানোর জন্য কালিজিরা খাওয়া হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, কফ, অরুচি, উদরাময়, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা ও দাঁতের ব্যথা, বাতের ব্যথা, পেটের বাথা, মাথাব্যথা কমাতে, মাথা ঝিমঝিম করা, মাইগ্রেন নিরাময়ে যথেষ্ট উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। পেটফাঁফা, চামড়ার ফুসকুরি, ব্রঙ্কাইটিস, এলার্জি, একজিমা, এজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগ; ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাসট্রিক আলসার, জন্ডিস, খোসপাঁচড়া, ছুলি বা শ্বেতি, অর্শরোগ, দাদে কালিজিরা অব্যর্থ ওষুধ হিসেবে কাজ করে। স্নায়ুবিক উত্তেজনা; উরুসদ্ধি প্রদাহ; আঁচিল; স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে; শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে, স্ট্রোক, স্থূলতা নিরাময়ে দারুণ কাজ করে কালিজিরা। গায়ের ব্যথা দূর করতে কালিজিরা বিশেষভাবে উপকার করে। ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কালিজিরা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কালিজিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে, বহুমূত্র  রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয় ইনসুলিন সমন্বয় করে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করে। হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হাইপারটেনশন, নিম্ন রক্তচাপকে বাড়ায় আর উচ্চ রক্তচাপকে কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে রক্তের স্বাভাবিকতা রক্ষা করে। এছাড়া মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।

 

কালিজিরার বিশেষত্ব
কালিজিরার তেলের উপকার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, হৃদরোগজনিত সমস্যার আশঙ্কা কমায়, ত্বকের সুস্বাস্থ্য, আর্থাইটিস ও মাংসপেশির ব্যথা কমাতে কালিজিরার তেল উপযোগী। কালিজিরা শরীরের জন্য খুব জরুরি।  পেটের যাবতীয় রোগ-জীবাণু ও গ্যাস দূর করে। কালিজিরা কৃমি দূর করার জন্য কাজ করে। কালিজিরার যথাযথ ব্যবহারে দৈনন্দিন জীবনে বাড়তি শক্তি অজির্ত হয়। এর তেল ব্যবহারে রাতভর অনিদ্রা দূর করে প্রশান্তির নিদ্রা হয়। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধন থেকে শুরু করে শরীরের কোষ ও কলার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কালিজিরা। শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা কমায়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে যেসব সমস্যা হয় সেসবের যন্ত্রণাকর উপসর্গের তীব্রতা কমাতে পারে কালিজিরা। রিউমেটিক ফিভার পিঠে ব্যথা কমাতে কাজ করে। হাঁটুর/বাতের ব্যথা, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও উন্নয়ন; মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাড়ানোর মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। দেহের সাধারণ উন্নতি; চেহারার কমনীয়তা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে টনিকের মতো কাজ করে।


বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ সারাতে; শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি করতে; স্বাস্থ্য ভালো রাখতে; হজম সমস্যা দূরীকরণে; লিভারের সুরক্ষায়; দেহের সাধারণ উন্নতি; রুচি বাড়াতে, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, যকৃতের বিষক্রিয়ানাশক, প্রতিরোধক। টিউমার এবং ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কালিজিরা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুখশ্রী ও সৌন্দর্য রক্ষা, অবসন্নতা-দুর্বলতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অলসতা, আহারে অরুচি, মস্তিষ্ক শক্তি তথা স্মরণশক্তি বাড়াতেও কালিজিরা অব্যর্থ উপযোগী দাওয়াই। পেটের যাবতীয় রোগ-জীবাণু এবং দেহের কাটা-ছেড়া শুকানোর জন্য কাজ করে। এছাড়া শরীরে সহজে ঘা, ফোঁড়া, সংক্রামক রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ হয় না। কিডনির পাথর দূর করতে ও ব্লাডার সুরক্ষায়। তারুণ্য ধরে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যে কালিজিরা খাওয়াটা দীর্ঘদিনের রীতি। কাজ করার শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে কালিজিরা।


কালিজিরার তেলে রয়েছে খিদে বাড়ানোর উপাদান। অন্ত্রের জীবাণুকে নাশ করে শরীরের জমে থাকা গ্যাসকেও দূর করতে কালিজিরার বিকল্প নেই। যারা মোটা হতে চান, তাদের জন্য কালিজিরা একটা ভালো পথ্য। আবার যারা চিকন হতে চান তারাও নিয়ম করে কালিজিরা খেলে কাজ হয়। বয়স হলে হাত পা ফুলে যাওয়াটা একটা বড় সমস্যা। কালিজিরা এ সমস্যা সমাধান দেয়। কালিজিরা শিশুদের ক্ষেত্রে মেধার বিকাশ ঘটে। অ্যান্টিসেপটিক বলেও অনেক ভেষজবিদ মনে করেন। দেহের কাটা-ছেড়া শুকানোর জন্য কাজ করে। কালোজিরায় রয়েছে শরীরের রোগজীবাণু ধ্বংসকারী উপাদান। এ উপাদানের জন্য শরীরে সহজে ঘা, ফোঁড়া, সংক্রামক রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ হয় না।


কালিজিরার ব্যবহার কৌশল
কালিজিরা মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হয়। এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। কালিজিরা সরাসরি তেল হিসেবে, কাঁচা চিবিয়ে, ভেজে পরিমাণমতো খাওয়া যায়। সরাসরি খাওয়ার থেকে শুরুতে ভাত রুটি বা মুড়ির সাথে কালিজিরা খাওয়াটা অভ্যাস করতে পারলে ভালো। যখনই গরম পানীয় বা চা পান করা হয় তখনই কালিজিরা কোনো না কোনোভাবে সাথে খাওয়া ভালো। গরম খাদ্য বা ভাত খাওয়ার সময় কালিজিরা বেশ উপকারী। কালিজিরা একটা দারুণ ঘরোয়া ওষুধ। দাঁতে ব্যথা হলে কুসুম গরম পানিতে কালিজিরা দিয়ে কুলকুচ করলে ব্যথা কমে; জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু মরে স্বস্তি এনে দেবে। জিহ্বা, টাকরা বা মাড়িতে থাকা খাদ্যের জীবাণু সহজেই মরে যায়। ফলে মুখে আর দুর্গন্ধ হয় না। চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে চুলের গোড়া শক্ত করে ও চুল পড়া কমায় বন্ধ করে। ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখে পরিবেশের প্রখরতা, স্ট্রেস থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং ত্বককে সুন্দর করে ও ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখে। কালিজিরা তরকারির সাথে রান্না করে, ভর্তা করে, চাটনি করে খাওয়া হয়। মিষ্টি, কেক, হালুয়া, ফিরনি, বিস্কুট, বরফি এসবের সাথে দেয়া যায়। বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাদ্যপণ্যে কালিজিরা মেশানো হয়। কালিজিরা খেলে অপারেশনের দাগ দূর হয়, ব্রেইন টনিক হিসেবে কাজ করে। কালিজিরার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আশ্চর্যজনকভাবে অতুলনীয়, আর তা কালোজিরার রস/তেলের মধ্যেই আছে। ফলে কালিজিরার তেল ব্যবহার ও সেবন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়ায় এবং রোগমুক্ত রাখে। তিলের তেলের সাথে কালিজিরা বাটা বা কালোজিরার তেল মিশিয়ে ফোঁড়াতে লাগলে, ফোঁড়ার উপশম হয়। মধু ও কালিজিরার পেস্ট বানিয়ে ত্বকে লাগিয়ে আধাঘণ্টা বা একঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেললে ত্বক উজ্জ্বল হয়। নিয়মিত লাগালে ব্রণ দূর হবে। প্রত্যেকের রান্নাঘরেই কালিজিরা থাকে যা খাবারকে সুবাসিত সুরক্ষা করে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ব্যাখ্যা
অন্যান্য সব ভেষজের মতো কালিজিরা নিয়েও গবেষণা কম হয়নি। ১৯৬০ সালে মিসরের গবেষকরা নিশ্চিত হন যে, কালিজিরা নাইজেলনের কারণে হাঁপানি উপশম হয়। জার্মানি গবেষকরা বলেন, কালোজিরার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-মাইকোটিক প্রভাব রয়েছে। এটি বোনম্যারো ও প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে উত্তেজিত করে এবং ইন্টারফেরন তৈরি বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকার গবেষকরা প্রথম কালিজিরার টিউমারবিরোধী প্রভাব সম্পর্কে মতামত দেন। শরীরে ক্যান্সার উৎপাদনকারী ফ্রির‌্যাডিক্যাল অপসারিত করতে পারে কালিজিরা। পারকিনসন্স রোগের প্রতিকারে, কালিজিরায় থাইমোকুইনিন থাকে যা পারকিনসন্স ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের দেহে উৎপন্ন টক্সিনের প্রভাব থেকে নিউরনের সুরক্ষায় কাজ করে। ক্ষতিকর জীবাণু নিধন থেকে শুরু করে শরীরের কোষ ও কলার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কালিজিরা।
Medical Science Monitor Journal এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, নিয়মিত কালিজিরা খেলে মৃগীরোগ, শিশুদের হৃৎপি-ের অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। কালিজিরায় খিঁচুনি বন্ধ করার উপাদান থাকে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিরাময় করে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, প্রতিদিন ২ গ্রাম কালিজিরা খেলে রক্তের সুগার লেভেল কমায়, ইনসুলিনের বাঁধা দূর করে এবং অগ্নাশয়ে বিটা কোষের কাজ বাড়ায়। কালিজিরা একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট। এটি সহজেই শরীরের রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে দিতে পারে। এ অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল উপাদানের জন্য দেহের ঘা, ফোঁড়া কম সময়েই সেরে যায়। একদিকে প্রস্টেটজনিত সমস্যা সে সাথে কিডনিজনিত রোগে কম বেশি বয়স্করা পা ফোলা সমস্যায় ভোগেন। কালিজিরা তাদের এ সমস্যা রুখতে পারে সহজেই। প্রত্যেকের রান্নাঘরেই কালিজিরা থাকে যা খাবারকে সুবাসিত করে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানতে পেরেছেন যে কালোজিরার সব গুণ লুকিয়ে আছে এর তেলে। এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, কালিজিরা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে পারে এবং রক্তচাপ কমিয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে পারে।


কালিজিরার সর্তকতা
কালিজিরা নিয়মিত ও পরিমিত খেতে হয়। অতিরিক্ত খুব বেশি খেলে বা ব্যবহার করলে হিতের বিপরীত হয়। কালোজিরার তেল গর্ভাবস্থায় গ্রহণ করা যাবে না। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত কালিজিরা খেলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। কালিজিরা গ্রহণ করার সবটাই করতে হবে পরিমিত পর্যায়ে। অনেকেই কালিজিরা হজম করতে পারেন না। তবে আস্তে আস্তে অভ্যাস করলে ভালো। যারা সহজে কালিজিরা হজম করতে পারেন না তারা খাবেন না, যারা পারেন তারাই নিয়মিত পরিমিত খাবেন। গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালিজিরার তেল সেবন করানো উচিত নয়। নকল বা কৃত্রিম কালিজিরার তেল কখনও খাওয়া ঠিক না। জেনে শুনে বুঝে নিশ্চিত হয়ে কালিজিরা বা কালিজিরার তেল সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে খেতে হবে। পুরনো কালিজিরা তেল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।


কালিজিরার উৎপাদন কৌশল
শুকনা ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া কালিজিরা আবাদে খুব অনুকূল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আবহাওয়া বালাইয়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি হলে কালিজিরার ফলন কমে যায়। ৩ থেকে ৪টি চাষ ও আড়াআড়ি মই দিয়ে মাটি ঝুরাঝুরা করে আগাছা পরিষ্কার করে জমি সমতল করে বীজ বপন করতে হয়। অল্প পরিমাণ এক বিঘা বা তার কম জমিতে চাষ করলে ৫ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চি উঁচু খ-িত বেড তৈরি করা ভালো।


বপন : অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করা যায়। তবে নভেম্বর মাসের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহ বীজ বপন করার উত্তম সময়।  অগ্রহায়ণের শেষ থেকেই লাগানো যায়। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে পৌষের প্রথমে লাগানো ভালো। সফলভাবে কালিজিরা উৎপাদনের জন্য ১৫x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বপন করলে ভালো হয়। ১-৪ ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে ২-৩টি করে বীজ পুঁততে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ যেন বেশি গভীরে না যায়। বীজ বপনের আগে আলাদা করে শোধনের দরকার নেই। তবে বোনার আগে ভালো করে ধুয়ে ধুলাবালি ও চিটা বীজ সরিয়ে নেয়া ভালো। ভেজা বীজ বপন করা উচিত না। ১ বিঘা জমিতে ১ কেজি থেকে ১.৫ কেজি বীজ লাগে। হেক্টরপ্রতি ৪ থেকে ৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে লাইনে লাগালে ৩.৫ কেজি থেকে ৪.৫ কেজি বীজই যথেষ্ট।


সার প্রয়োগ : জমি তৈরির সময় ছাড়া পরে আর সার দেয়া তেমন প্রয়োজন নেই। জৈব ও অজৈব সারের সমন্বয়ে হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ হলো পচা গোবর ৫ থেকে ১০ মেট্রিক টন, ইউরিয়া ১২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫ থেকে ১০০ কেজি, এমওপি ৭৫ কেজি। জমি তৈরি ও শেষ চাষের সময় জৈবসার, অর্ধেক ইউরিয়া, পুরো টিএসপি ও এমওপি মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের ৪০ দিন পর বাকি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ হিসেবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। কেউ কেউ ভালো ফলনের জন্য খৈল ব্যবহার করেন।
পরিচর্যা : বীজ লাগানোর পরই হালকা করে মাটি দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে। পাখিতে বীজ খেতে না পারে, সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন হলে আগাছা পরিষ্কার, গাছ পাতলাকরণ কাজগুলো নিয়মিত ও পরিমিতভাবে করতে হবে।


সেচ ও নিকাশ : সাধারণত সেচের প্রয়োজন নেই। তবে নতুন চারা লাগানোর পর রোদ বেশি হলে ছিটিয়ে পানি দেয়া যায়। সন্ধ্যায় পানি ছিটিয়ে দেয়া ভালো। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে। তবে প্লাবন সেচ দিলে বীজ এক জায়গায় জমা হয়ে যেতে পারে। মাটির ধরন আর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে পুরো জীবনকালে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। কোনো কারণে জমিতে পানি জমলে দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।


বালাই ব্যবস্থাপনা : কালিজিরা সহজে তেমন কোনো পোকামাকড়ে আক্রান্ত করে না। বরং এর স্বাভাবিক পোকামাকড় ধ্বংসের ক্ষমতা আছে। সে রকম রোগবালাইও তেমন হয় না। মাঝে মাঝে কিছু ছত্রাক আক্রমণ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড বা ডাইথেন এম ৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১০ দিন পরপর ছিটিয়ে দিতে হবে।
 

জীবনকাল : অংকুরোদগম-চারা গজানো- ১২-১৬ দিন; গাছের বৃদ্ধি- ৩০-৪০ দিন; ফুল আসবে ৩৫-৪২ দিন; ফল আসবে ৪২-৫৫ দিন; ফল পাকবে : ৬০ থেকে ৮৫ দিন। বীজ বপনের পর সর্বমোট ১৩৫ থেকে ১৪৫ দিনে গাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে মরে যায়। ১৫-২০ সপ্তাহের মধ্যে ফসল পাকবে ও তোলার সময় হবে অর্থাৎ পৌষের প্রথমে চাষ করলে ফাল্গুন-চৈত্রে ফসল তোলা যাবে।


ফসল সংগ্রহ ও ফলন : ১ বিঘা জমিতে চাষ করলে গড়ে ৯০ থেকে ১১০ কেজি কালিজিরা পাওয়া যাবে। একরপ্রতি ৩০০ কেজি থেকে ৩৩০-৩৪০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বারি কালিজিরা-১ সঠিক পরিচর্যায় হেক্টরপ্রতি ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন দেয়। ফাল্গুন-চৈত্রে গাছ মরে গেলে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে হাতে সাবধানে আঘাত করে মাড়াই করে বা লাঠি দিয়ে বীজ সংগ্রহ করা যায়। গাছে সামান্য রস থাকতেই ফল সংগ্রহ করা উচিত, তা নাহলে বীজ জমিতে ঝরে পড়তে পারে। বীজ রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে কুলা দিয়ে পরিষ্কার করে চটের বস্তায় বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে অন্তত এক বছর পর্যন্ত বীজ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। মানসম্মত বীজ সংরক্ষণে পাত্র শুকনো, ঠাণ্ডা, অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।


কালিজিরা প্রকৃতির এক অভাবনীয় গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান নিয়ামত। নিয়মিত পরিমিত কালিজিরা খেলে ব্যবহার করলে তা শরীরের ভেতরের ও বাহিরের অংশের জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধে কালোজিরার মতো এত সহজে এত কার্যকর আর কোনো প্রাকৃতিক উপাদান আছে বলে জানা যায়নি। কালিজিরাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কালো বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম। কালিজিরা সব ধরনের রোগের বিরুদ্ধে তুলনাহীন। কালিজিরাকে সব রোগের মহৌষধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এত কম দামে এত বহুমুখী উপকারিতা সম্পন্ন কালিজিরা সব ধরনের রোগের বিরুদ্ধে তুলনাহীন তো বটেই তার ওপরে শরীরের হাজারো উপকার করে। বাণিজ্যিক বা পারিবারিক প্রয়োজনে সামান্য এক টুকরো জমিতে পরিকল্পিতভাবে কালিজিরা চাষ করে নিজেদের বার্ষিক প্রয়োজন মেটানো যায়। সুতরাং সুন্দর সুস্থ সবল সুস্বাস্থ্যের জন্য কম দামি দাওয়াই, পথ্য, ভেষজ উপাদান আর পুষ্টি উপাদান হিসেবে নিয়মিত ও পরিমিত কালোজিরার চাষ করে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে সবাইকে নিজেদের জন্য আবশ্যকীয়ভাবে। তখন লাভ হবে নিজেদের, লাভ হবে জাতির। সমৃদ্ধ হবে কৃষি ভাণ্ডার।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা subornoml@gmail.com

বিস্তারিত
ধানের রোগ ও প্রতিকার

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৩২টি রোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় এবং বিভিন্ন জাতের ধানে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ১০টি মুখ্য রোগ বাকি ২২টি গৌণ। এ রোগগুলো দ্বারা ধানের ফলন শতকরা ১০-১৫ ভাগ কম হয়। রোগগুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত ২টি, ব্যাকটেরিয়াজনিত ৩টি, ছত্রাকজনিত ২২টি, কৃমিজনিত ৫টি। নিম্নে ধানের ৯টি রোগের বিবরণ ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনা বর্ণনা করা হলো-


১. রোগের নাম : বাদামি দাগ রোগ (Brown spot)
 

রোগের কারণ : বাইপোলারিস ওরাইজি (Bipolaris oryzae) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
এ রোগটি চারা অবস্থা থেকে যে কোনো বয়সের ধান গাছে হতে পারে। তবে চারার বয়স বেশি হলে রোগটির প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মাটিতে পুষ্টি উপাদানের অভাব বা পানির অভাব হলে রোগের মাত্রা বেড়ে যায়।

 

রোগের লক্ষণ  
পাতায় প্রথমে তিলের দানার মতো ছোট ছোট দাগ পড়ে। দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানে সাদা ও কিনারা বাদামি হয়ে যায়।
একাধিক দাগ মিলে বড় দাগ সৃষ্টি হয়ে পাতাটিকে মেরে ফেলতে পারে। ধানের পাতার চেয়ে রোগটি বীজে বেশি দেখা যায়। রোগ আক্রান্ত গাছে অপুষ্ট বীজ হয় ও বাদামি বর্ণ হয়।

 

রোগের প্রতিকার :  সুস্থ বীজ বপন করতে হবে; বীজ গরম পানিতে (৫০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট ভিজে রাখতে হবে) শোধন করতে হবে; কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে; জৈব সার ব্যবহার করতে হবে; জমিতে সঠিক পরিমাণ নাইট্রোজেন ও পটাশ সার ব্যবহার করলে রোগ কমে যায়; সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে; জমিতে রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
 

২. রোগের নাম : ব্লাস্ট রোগ (Blast)। ধান গাছের ৩টি অংশে রোগটি আক্রমণ করে থাকে। গাছের আক্রান্ত অংশের ওপর ভিত্তি করে এ রোগ তিনটি নামে পরিচিত যেমন- ১. পাতা ব্লাস্ট, ২. গিট ব্লাস্ট এবং ৩. নেক/শীষ ব্লাস্ট।


রোগের কারণ
পাইরিকুলারিয়াগ্রিসিয়া
(Pyricularia grisea) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
এ রোগটি আমন ও বোরো উভয় মৌসুমেই হতে পারে। ধানের চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় এ রোগটি হতে পারে। বীজ, বাতাস, কীটপতঙ্গ ও আবহাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে পাতলা শিশির জমা হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা কম সেখানে রোগ বেশি হতে দেখা যায়। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে।


রোগের লক্ষণ
পাতা ব্লাস্ট

পাতায় প্রথমে ডিম্বাকৃতির ছোট ছোট ধূসর বা সাদা বর্ণের দাগ দেখা যায়। দাগগুলোর চারদিক গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এ দাগ ধীরে ধীরে বড় হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পুরো পাতাটাই মেরে ফেলতে পারে। এ রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে জমিতে মাঝে মাঝে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোল ও পাতার সংযোগস্থলে কাল দাগের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে পচে যায় এবং পাতা ভেঙে পড়ে ফলন বিনষ্ট হয়।।


গিঁট বা নোড ব্লাস্ট
ধান গাছের থোড় বের হওয়ার পর থেকে এ রোগ দেখা যায়। গিঁটে কালো রঙের দাগ সৃষ্টি হয়।  ধীরে ধীরে এ দাগ বেড়ে গিঁট পচে যায়, ফলে ধান গাছ গিঁট বরাবর ভেঙে পড়ে।

 

নেক বা শীষ ব্লাস্ট
এ রোগ হলে শীষের গোড়া অথবা শীষের শাখা প্রশাখার গোড়ায় কাল দাগ হয়ে পচে যায়। শীষ অথবা শীষের শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়ে। ধান চিটা হয়।

রোগের প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
মাটিতে জৈব সারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের সার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত জমির খড়কুটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, দাগি বা অপুষ্ট বীজ বেছে ফেলে দিয়ে সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। রোগের আক্রমণ হলে জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জমিতে সব সময় পানি রাখতে হবে। রোগের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৪০ কেজি (বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ট্রাইসাইক্লাজল (ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি) বা টেবুকোনাজল + ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন (নাটিভো৭৫ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।


৩. রোগের নাম : খোল পচা রোগ (Sheath rot) রোগের কারণ স্যারোক্লেডিয়াম ওরাইজি (Sarocladium oryzae) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
 

রোগের বিস্তার : এটা বীজবাহিত। রোগাক্রান্ত নাড়া ও বিকল্প পোষকে অবস্থান করে। মাজরা পোকা ও টুংরো রোগ আক্রান্ত গাছে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। গরম ও সেঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির ঝাপটায় এ রোগ ছড়ায়। খোলপচা রোগটি সব মৌসুমেই দেখা যায়। সাধারণত গাছের থোর অবস্থা এ রোগটির উপযোগী সময়।


রোগের লক্ষণ
রোগটি কোনো অবস্থাতেই পাতায় হয় না। খোলপচা রোগটি যে কোনো খোলে হতে পারে তবে শুধুমাত্র ডিগ পাতার খোল আক্রান্ত হলেই ক্ষতি হয়ে থাকে। ধানে থোড় আসার সময় এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। প্রথমে শেষ পাতার খোলের ওপর গোলাকার বা অনিয়মিত লম্বা দাগ হয়। দাগের কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামি রঙ বা ধূসর বাদামি হয়। দাগগুলো একত্রে বড় হয়ে সম্পূর্ণ খোলেই ছড়াতে পারে। থোড়ের মুখ বা শীষ পচে যায় এবং গুঁড়া ছত্রাংশ খোলের ভেতর প্রচুর দেখা যায়। রোগের আক্রমণ বেশি হলে অনেক সময় শীষ আংশিক বের হয় বা মোটেই বের হতে পারে না এবং ধান কালো ও চিটে হয়ে যায়।


রোগের প্রতিকার
সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।  জমির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। সুষম সার ব্যবহার ও ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে। পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। খোল পচা দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে কিছুদিন পর আবার সেচের পানি দিতে হবে। প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।


৪. রোগের নাম : খোলপোড়া রোগ (Sheath blight) রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি (Rhizoctonia solani) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
আউশ ও আমন মৌসুমে এ রোগটি বেশি হয়। মাটি ও পরিত্যক্ত খড়কুটায় ছত্রাক থাকে। বেশি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় এ রোগের প্রকোপ বেশি হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিয়া সারের ব্যবহার করলে এবং ঘন ঘন বৃষ্টিপাত ও জমিতে পানি জমে থাকলে ও এ রোগের আক্রমণ বাড়ে।


রোগের লক্ষণ : পানির স্তর বরাবর খোলের ওপর পানি ভেজা সবুজ রঙের দাগ পড়ে। দাগগুলোর কেন্দ্র ধূসর এবং প্রান্তে বাদামি রঙ ধারণ করে। দাগগুলো একত্র হয়ে পাতার খোল ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ে যা দেখতে গোখরা সাপের মতো মনে হয়। আক্রমণ বেশি হলে ক্ষেতের মাঝে মাঝে আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়।


রোগের প্রতিকার : রোগ সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ (২০-২৫ সেমি দূরে) ও আক্রান্ত জমির খড়কুটা জমিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুষম সারের ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার পরিহার করা।  রোগ দেখা দেয়ার পর বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ এবং প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) বা টেবুকোনাজল(ফলিকুর২৫০ ইসি) বা হেক্সাকোনাজল (কনটাফ৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
 

৫. রোগের নাম : গোড়া পচা ও বাকানি রোগ (Foot rot and Bakanae) রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম মোনিলিফরমি (Fusarium moniliforme) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ ছত্রাক জিবেরিলিন নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে যা গাছের দ্রুত অঙ্গজ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাকানি আক্রমণের ফলে ফসলে শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।
 

রোগের বিস্তার : বীজ বাকানি রোগের অন্যতম বাহক। মাটি, পানি, বাতাসের মাধ্যমেও এ রোগের জীবাণু এক জমি হতে অন্য জমিতে ছড়ায়। মাটিতে আগে থেকেই এ রোগের জীবাণু থাকলে ধান গাছে এ রোগ হয়। অতিরিক্ত ইউরিয়া সারের প্রয়োগে এ রোগের আক্রমণ বাড়তে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রায়ও (৩০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়।
 

রোগের লক্ষণ  
বাকানি রোগ ধান গাছের চারা অবস্থা থেকে শুরু করে থোড় আসা পর্যন্ত যে কোনো সময়ে হতে পারে। তবে চারা অবস্থায় হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। আক্রাস্ত ধানের চারা সাধারণ চারার চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আক্রান্ত চারার পাতা হালকা সবুজ রঙের ও দুর্বল মনে হয়। আক্রান্ত কুশি চিকন ও লিকলিকে হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় গাছের গোড়ার দিকে গিঁট হতে শিকড় বের হতে দেখা যায়। গাছের গোড়া পচে যায় এবং ধীরে ধীরে আক্রান্ত গাছ শুকিয়ে মরে যায়। চারা অবস্থায় বা রোপণের পরপরই এ রোগে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত গাছে কোনো ফলন হয় না। তবে গর্ভাবস্থায় এ রোগ হলে চিটা এবং অপুষ্ট ধান বেশি হয় এবং শীষ অনেক ছোট হয়।

 

রোগের প্রতিকার
রোগ সহনশীল ধানের জাত চাষ করতে হবে। সুস্থ বীজের ব্যবহার করতে হবে। খড়কুটা জমিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজতলা হতে চারা তোলার সময় রোগাক্রান্ত চারা বেছে ফেলে দিতে হবে। আক্রান্ত গাছটি ফুল আসার আগেই তুলে ফেলতে হবে। চারা রোপণের পর এ রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিতে হবে। সুষম মাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার করেও এ রোগের প্রকোপ কমানো যেতে পারে। গোড়া পচা রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে জমির পানি শুকিয়ে ফেলতে হবে। কার্বেনডাজিম (অটোস্টিন, নোইন, ইভাজিম) নামক ছত্রাকনাশক এক লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করতে হবে।

 

৬. রোগের নাম : লক্ষীর গু (False Smut) রোগের কারণ : উস্টিলাজিনোইডিয়া ভাইরেন্স (Ustilaginoidea virens) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
 

রোগের বিস্তার :  ধানের দুধ অবস্থার পর থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় এ রোগটি  দেখা যায়। ধানের ফুল আসার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত এবং জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সারের ব্যবহার করলে রোগের প্রকোপ বেশি হয়।


রোগের লক্ষণ : ধানের ছড়ার কিছু ধানে বড় গুটিকা দেখা যায়। গুটিকার ভেতরের অংশ হলদে-কমলা রঙ ও বহিরাবরণ সবুজ রঙের হয়। বহিরাবরণ পরবর্তীতে আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়। কচি গুটিকাগুলো ১ সেমি. এবং পরিপক্ব অবস্থায় আরও বড় আকারের হতে পারে। এক রকমের আঠা জাতীয় পদার্থ থাকার জন্য গুটিকা থেকে ক্ল্যামাইডোস্পোর জাতীয় অনুজীব সহজে বের হয় না। সাধারণত কোনো শীষে কয়েকটা ধানের বেশি আক্রমণ হতে দেখা যায় না।


রোগের প্রতিকার : সঠিক মাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। জমির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। আক্রান্ত গাছ বা শীষ তুলে ফেলা এ রোগ দমনের সবচেয়ে ভালো উপায়। তবে এটি সকাল বেলা আক্রান্ত শীষ পলিব্যাগে সাবধানে আবদ্ধ করে গাছ তুলতে হবে যাতে স্পোর ছড়াতে না পারে। জমিতে রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- অটোস্টিন বা নোইন ১.৫ গ্রাম/লিটার হারে অথবা প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।


৭. রোগের নাম :
ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া  রোগ
(Bacterial Blight)
 

রোগের কারণ : জ্যানথোমোনাস অরাইজি পিভি অরাইজি (Xanthomonas oryzae pv.oryzae) এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে।
 

রোগের বিস্তার : রোগটি আউশ, আমন ও বোরো এ তিন মৌসুমেই ব্যাপকভাবে দেখা  যায়। উচ্চ তাপমাত্রা (২৬-৩০ ডিগ্রি সে.), ৭০% এর ওপরে আপেক্ষিক আর্দ্রতা, ঝড়ো-বৃষ্টি আবহাওয়া, রোগপ্রবণ জাত লাগানো,  রোপণের সময় শিকড় অথবা গাছে ক্ষত সৃষ্টি, উচ্চ মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ ইত্যাদির কারণে রোগের প্রকোপ বেশি হয়। পাতাপোড়া রোগ ধানের খড়, মাটি, পোকা, বাতাস ও সেচের পানির মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়ায়।


রোগের লক্ষণ : প্রথমে পাতার অগ্রভাগ বা কিনারায় নীলাভ পানিচোষা দাগ দেখা যায়। দাগগুলো আস্তে আস্তে হালকা হলুদ রঙ ধারণ করে পাতার অগ্রভাগ থেকে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। শেষের দিকে আংশিক বা সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায় এবং ধূসর বা শুকনো খড়ের রঙ ধারণ করে। ফলে গাছটি প্রথমে নেতিয়ে পড়ে ও আস্তে আস্তে পুরো গাছটি মরে যায়। চারা ও কুশি অবস্থায় সাধারণত ক্রিসেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ রোগের ফলে গাছটি প্রথমে নেতিয়ে পড়ে ও আস্তে আস্তে পুরো গাছটি মরে যায়। অনেক সময় এ রোগের লক্ষণের অগ্রভাগ দিয়ে ব্যাকটিরিয়ার কোষগুলো বেরিয়ে আসে এবং কোষগুলো একত্রে মিলিত হয়ে ভোরের দিকে হলদে পুঁতির দানার মতো গুটিকা সৃষ্টি করে এবং এগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে পাতার গায়ে লেগে থাকে। পরবর্তীকালে পাতার গায়ে লেগে থাকা জলকণা গুটিকাগুলোকে গলিয়ে ফেলে, ফলে এ রোগের জীবাণু অনায়াসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত গাছের কা- ছিড়ে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজের মতো তরল পদার্থ বের হয়। রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি (৮-১০ ডিগ্রি সে.) হলে কচি পাতায় ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের লক্ষণটি প্রকাশ পায়।


রোগের প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে। রোগাক্রান্ত জমির ধান কাটার পর নাড়া ও খড় পুড়িয়ে ফেলতে হবে। চারা উঠানোর সময় যেন শিকড় কম ছিড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার ও ইউরিয়া সার ৩/৪ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু রোগ দেখার পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। ক্রিসেক আক্রান্ত জমি শুকিয়ে ৫-১০ দিন পর আবার পানি দিতে হবে। রোগ দেখার পর বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার ছিপছিপে পানিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে চিলিটেড জিংক স্প্রে করলে রোগের তীব্রতা কমে যায়।


৮. রোগের নাম : টুংরো (Tungro)। অনেক এলাকায় এ রোগকে লোনা ধরা, বসে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
 

রোগের কারণ : রাইস টুংরো ভাইরাস (Rice Tungro Virus) নামক এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
 

রোগের বিস্তার : এ রোগটি আউশ ও আমন মৌসুমে বেশি হয়। টুংরো আক্রান্ত চারা রোপণের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। সবুজ পাতাফড়িং (নেফোটেটিকস ভাইরেসেন্স), আশপাশে স্বেচ্ছায় গজানো রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান বা ঘাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বাহক পোকা আক্রান্ত গাছ থেকে ২-৩ মিনিট কাল রস শোষণ করেই ভাইরাস সংগ্রহ করতে পারে এবং তা পরবর্তী ২-৩ মিনিটে সুস্থ গাছে রস শোষণ কালে সংক্রমণ করতে পারে। ফলে সুস্থ গাছটিতেও ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।


রোগের লক্ষণ
টুংরো আক্রান্ত গাছের পাতায় প্রাথমিক অবস্থায় লম্বালম্বিভাবে শিরা বরাবর হালকা সবুজ ও হালকা হলদে রেখা দেখা দেয়। পরে আস্তে আস্তে সব পাতাটাই হলদে বা কমলা হলদে রঙ ধারণ করে। আক্রান্ত কচি পাতা হালকা রঙের হয় এবং মুচড়ে যায়। চারা/কুশি অবস্থায় আক্রান্ত হলে সুস্থ গাছের তুলনায় আক্রান্ত গাছ বেশি খাটো হয় কিন্তু বয়স্ক গাছে হলে ততোটা খাটো হয় না। আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কুশি কম হয় এবং শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতাগুলো ভূমির দিকে নুয়ে পড়ে। রোগাক্রান্ত গাছ ধান পাকা পর্যন্ত বাঁচতে পারে তবে আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছগুলো শুকিয়ে মরার মত হয়ে যায়। হালকাভাবে আক্রান্ত গাছ বেঁচে থাকে, তবে তাতে  কিছুটা দেরিতে ফুল আসে এবং ফলন অনেক কম হয়।


রোগের প্রতিকার : রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে। হাত জাল দিয়ে সবুজ পাতাফড়িং ধরে মেরে ফেলতে হবে। টুংরো আক্রান্ত জমির আশপাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান এবং আড়ালি ঘাস দমন করতে হবে। আলোকফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলতে হবে। জমিতে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে পার্চিং করতে হবে। বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপিড (অ্যাডমায়ার/ইমিটাফ) ০.৫ মিলি/লিটার অথবা ডায়াজিনন (৬০ তরল) ১.৫ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে  স্প্রে করতে হবে।
 

৯. রোগের নাম : উফরা রোগ (ডাক পোড়া) (Ufra)। বিভিন্ন এলাকায় এ রোগ উর্বা, ডাকপোড়া, জ্বলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, লোনা লাগা ইত্যাদি নামে পরিচিত। সাধারণত  শতকরা ৪০-১০০ ভাগ ফলন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগের কারণ : ডাইটিলেংকাস এ্যাংগাসটাস (Ditylenchus angustus) নামক এক ধরনের কৃমি দ্বারা এ রোগ হয়।
 

রোগের বিস্তার : সেচের পানি, ঘন ঘন বৃষ্টিপাত, মাটি, রোগাক্রান্ত চারা, নাড়া ও খড় দ্বারা এ রোগ ছড়িয়ে থাকে। শুরুতে এ রোগ জলি আমন ধানে হলেও বর্তমানে সব মৌসুমেই দেখা যায়। সেচের পানিতে ভেসে এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে আক্রমণ করে। আক্রান্ত জমির পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটা, শীষের অংশ বা ঝরে যাওয়া ধানে এবং মাটিতে কোন খাদ্য ছাড়াই এ কৃমি কু-লী পাকিয়ে ৬-৮ মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।


রোগের লক্ষণ : কৃমি ধান গাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটা-ফোটা সাদা দাগ দেখা দেয়। সাদা দাগ ক্রমে বাদামি রঙের হয় এবং পরে এ দাগ বেড়ে সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে ফেলে। অনেক সময় থোড় হতে ছড়া বের হতে পারে না বা বের হলেও অর্ধেক বা আংশিক বের হয়। ছড়া বের হতে না পারলে তা ভেতরে মোচড়ানো অবস্থায় থাকে। গাছ কিছুটা বেটে হয়। ধান খুব চিটা ও অপুষ্ট হয়। আক্রমণ থোড় গজানোর সময় হতে শুরু হলে সে ধানের কোনো ফলনই পাওয়া যায় না।


রোগের প্রতিকার : রোগাক্রান্ত ফসল কাটার পর নাড়া ও খড় জমিতেই পুড়িয়ে ফেলতে হবে; ঘাস জাতীয় আগাছা এবং মুড়ি ধান ধ্বংস করতে হবে; বছরের প্রথম বৃষ্টির পর জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন শুকাতে হবে; পর পর ধান না করে পর্যায়ক্রমে অন্য ফসলের চাষ করতে হবে; আক্রান্ত জমিতে বা জমির পাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে; প্রথম অবস্থায় আক্রমণ দেখা দিলে ধানের আগার অংশ কেটে পুড়ে ফেলতে হবে; চারা লাগানোর ১২-২০ ঘণ্টা আগে বীজতলা থেকে চারা তুলে শিকড় ১.৫% কৃমিনাশক যেমন- ফুরাডান ৫জি অথবা কুরাটার ৫ জি দ্রবণে ভিজিয়ে রেখে জমিতে রোপণ করতে হবে; জমিতে রোগ দেখা দিলে ২ ইঞ্চি পানি থাকা অবস্থায় কার্বোফুরান (ফুরাডান ৫জি অথবা কুরাটার ৫ জি) বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।

 

বিজ্ঞানী ড. কে এম খালেকুজ্জামান*

*এসএসও (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া

 

বিস্তারিত
পরিবর্তিত জলবায়ুতে মসুর ডাল উৎপাদন প্রযুক্তি

মানুষের সুষম খাদ্য চাহিদা পূরণে ডাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। ডালে পর্যাপ্ত পরিমাণে হজমযোগ্য আমিষ থাকে অথচ মাংস অপেক্ষা দাম কম। তাই ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়। শুধু মানুষের খাদ্যই নয় পশুর খাদ্য ও মাটির খাদ্য হিসেবে পরিবেশবান্ধব কৃষি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ডাল এদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। FAO এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫ গ্রাম করে ডাল খাওয়ার কথা থাকলেও আমরা খাচ্ছি মাত্র ১২-১৩ গ্রাম করে। বর্তমানে ৭.০৭ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ৭.৬৯ লাখ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হচ্ছে। ডালের ঘাটতি দূর করতে জমির পারিমাণ ও ফলন উভয়ই বাড়াতে হবে। মসুর বাংলাদেশের ডাল ফসলের মধ্যে অন্যতম প্রধান ডাল ফসল। প্রতিদিন খাবার টেবিলে মসুর ডালের উপস্থিতিই প্রমাণ করে এর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা। কিন্তু বর্তমানে মসুর উৎপাদন নিম্নমুখী। এর কারণ আমন ধান কেটে জমি তৈরি করতে মসুর বপনের উপযুক্ত সময় (Optimum sowing time) চলে যায়, যার কারণে মসুর দেরিতে বপন করতে হয়। এতে মসুরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এছাড়া ফুল ধারণের সময়েই (Flowering stage) ব্যাপকভাবে স্টেম ফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। তাছাড়া ইদানীং চাষকৃত জমিতে ব্যাপকভাবে মসুরের গোড়া পচা (Foot rot) রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তাই চাষ করে মসুর আবাদের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ৩টি কারণে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না-
 

ক. উপযুক্ত সময়ের পরে বপন (Late planting) করার জন্য শারীরবৃত্তীয় কারণে ফলন কম হচ্ছে।
খ. গোড়া পচা
(Foot rot) রোগের কারণে ব্যাপকভাবে গাছের সংখ্যা (Plant population) কমে যাচ্ছে।
গ. স্টেম ফাইলিয়াম ব্লাইট
(Stemphylium Blight) দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
 

এসব সমস্যাগুলো থেকে মসুরকে রক্ষা করে কাঙ্খিত ফলন অর্জনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে পরিবর্তিত জলবায়ুতেও মসুর উৎপাদনের লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আর তা হল বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে (সাথী ফসল হিসেবে) মসুর চাষ। প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুরের আবাদ ও রিলে পদ্ধতিতে বিনা চাষে মসুরের আবাদের একটি গবেষণালব্ধ তুলনামূলক ফলাফল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-


টেবিল-১ : প্রচলিত ও রিলে ফসল হিসেবে মসুরের ফলন ও ফলনে সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক ছক, আটঘড়িয়া, পাবনা, ২০১৬-১৭

ট্রিটমেন্ট

গাছের উচ্চতা  (সে.মি.)

প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা

প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা

এক হাজার বীজের ওজন(গ্রাম)

হেক্টর প্রতি ফলন (কেজি)

হেক্টরপ্রতি খড়ের ফলন  (কেজি)

বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুর আবাদ ৪৫.৫৫ ৫৪.২৫ ২.০০ ১৮.৫৬ ১৬১৩ ১৩৮৮
প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুর আবাদ ৩৯.৫০ ৪৪.৭৫ ১.৮৫ ১৮.১১ ১৩৬২ ১২৬৮

উৎস : বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, গাজীপুর, ২০১৬-১৭

 

টেবিল-২ : মসুর উৎপাদনে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও বিনা চাষে রিলে পদ্ধতির খরচ ও লাভের তুলনামূলক হিসাব, আটঘড়িয়া, পাবনা, ২০১৬-১৭

ট্রিটমেন্ট

প্রতি হেক্টরে বীজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ (টাকা)

প্রতি হেক্টরে খড় থেকে প্রাপ্ত অর্থ (টাকা) প্রতি হেক্টররে মোট প্রাপ্ত অর্থ (টাকা) প্রতি হেক্টরে মোট খরচ (টাকা)

প্রতি হেক্টরে লাভ (টাকা)

বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুরআবাদ ১,২০,৯৭৫.০০ ১৩,৮৮০.০০ ১,৩৪,৮৫৫.০০ ২৮,০২০.০০ ১,০৬,৮৩৫.০০
প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুর আবাদ ১,০২,১৫০.০০ ১২,৬৮০.০০ ১,১৪,৮৩০.০০ ৩২,৫২০.০০ ৮২,৩১০.০০


ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, মসুরের ফলনে সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্য ও ফলন প্রচলিত চাষের চেয়ে বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে বেশি এবং রিলে পদ্ধতিতে ফলন প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ বেশি। বিনিয়োগ ও লাভের হিসাবেও দেখা যাচ্ছে কম খরচ করে বেশি লাভ পাওয়া যাচ্ছে রিলে পদ্ধতিতে প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে এবং তা প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। তাই উল্লিখিত গবেষণার ফল থেকে দৃঢ়ভাবে বলা যায় প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুর উৎপাদন একটি লাভজনক প্রযুক্তি যা বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।


বিনা চাষে রিলে ফসল হিসেবে মসুর উৎপাদনের কলাকৌশল
এ পদ্ধতিতে আমন ধান কাটার ১০-১৫ দিন আগে (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ) জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই কাদার মধ্যে মসুর বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হয়। যদি জমিতে রসের অভাব থাকে তাহলে বীজ বপনের ১ দিন আগে একটি হালকা সেচ দিয়ে নিতে হবে। সাধারণত মাঝারি উঁচু জমির ক্ষেত্রে আমন ধানের শেষ সেচের পরই মসুরের বীজ বপন করা যেতে পারে। রিলে পদ্ধতিতে একটু বেশি বীজের প্রয়োজন হয় এবং তা হেক্টরপ্রতি ৪৫-৫০ কেজি। বপনের আগে বীজ মোটামুটি  ৬-৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে (প্রাইমিং) রাখলে ভালো হয়। যদিও এ পদ্ধতিতে গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব কম তারপরও বপনের আগে বীজ কেজি প্রতি ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন করলে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।


সার ব্যবস্থাপনা পরিমাণ : ইউরিয়া ৪৫ কেজি/হেক্টর; টিএসপি ৯০ কেজি/হেক্টর; এমপি  ৪৫ কেজি/হেক্টর। সমুদয় সার বীজ বপনের আগের দিন অথবা একই দিনে বীজ বপনের আগে প্রয়োগ করা যাবে।


আন্তঃপরিচর্যা এ পদ্ধতিতে মসুরের জমিতে সাধারণত আগাছা দমন ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে মাটিতে যদি রসের অভাব হয় এবং রসের অভাবে যদি গাছের বৃদ্ধি কম হয় সেক্ষেত্রে চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন পর একবার হালকা সেচ দিতে হয়। জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ মসুর জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। আগাছার প্রকোপ বেশি হলে বীজ গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর একবার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।


রোগ দমন মসুরের প্রধান রোগ হলো স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট যা Stemphylium প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত গাছের পাতায় ছত্রাকের সাদা জালিকা (মাইসেলিয়াম) দেখা যায়। দূর থেকে আক্রান্ত ফসল আগুনে ঝলসানো মনে হয়। আক্রমণের শেষ পর্যায়ে গাছ লালচে বাদামি রঙ ধারণ করে। বীজ, বিকল্প পোষক, বায়ু প্রভৃতির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। রিলে পদ্ধতি যেহেতু সঠিক সময়ে মসুর বপন করা হয় সেহেতু সাধারণত দানা গঠন পর্যায়ে এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ফুল আসা শুরু করলেই (Flowering stage) রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি নামক ছত্রাকনাশক ১০ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে ফসলকে রক্ষা করা যায় এবং ফলনের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না।


ফলন এ পদ্ধতিতে মসুরের ফলন হেক্টরপ্রতি ১৫০০-২০০০ কেজি।


বাজারদর : বীজ- প্রতি কেজি ৭৫ টাকা, খড়- প্রতি কেজি ১০ টাকা।

 

ড. মো. জাহেরুল ইসলাম* ড. মো. রবিউল আলম**

*সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাবনা # ০১৭১৫-৫২৪১২৬

 

বিস্তারিত
আগাম শীতকালীন সবজি সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ

রবি বা শীত মৌসুমে যেসব সবজি পেয়ে থাকি সেগুলো হচ্ছে শীতের সবজি। শীত মৌসুম শুরুতে বা শীত মৌসুম শুরুর মাস খানেক আগে থেকে যে সব আগাম জাতের চাষকৃত শীতের উৎপাদিত সবজিগুলো সংগ্রহ করে বাজারজাত করা হয়, সেগুলোকে শীতের আগাম সবজি বলা যেতে পারে।


অনেক কৃষক ভাই চাষকৃত আগাম জাতের উৎপাদিত শীতের সবজি সংগ্রহ করে নিজেদের পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বাজারজাত করে বাড়তি বাজার মূল্য পেয়ে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। বাজারের দিকে চোখ ফেরালে এ সময়ে শীতের আগাম সবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া এসব সবজিগুলো পাওয়া যাচ্ছে অহরহ।


আগাম শীতের সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে সঠিক নিয়মে সবজি সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণ বিষয়টি ওতপ্রতোভাবে জড়িত। এর ব্যতিক্রম ঘটলে গুণগত মানের সবজি ও  সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হবে।


এজন্য কিছু বিষয় খেয়াল রেখে সঠিক নিয়মে সঠিকভাবে আগাম সবজি ফসল কোমল ও সতেজ অবস্থায় সংগ্রহ করে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদিত সবজি দেরিতে সংগ্রহ করা হলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। আবার বেশি কচি অবস্থায় সংগ্রহ করলে ফলন কিন্তু অনেকাংশে কমে যায়। তাই সবজি ফসল তখনই সংগ্রহ করতে হবে যখন এসব ফসল খাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে এবং বেশি দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। উপযুক্ত পর্যায়টি হলো না কচি, না পরিপক্ব এবং সংগৃহীত পর্যায়টি  হতে হবে ক্রেতা বা ভোক্তার পছন্দ ও চাহিদার উপর।


সবজির ধরনভেদে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশলে সংগ্রহে নিয়ম
 যেমন- ১. টমেটো, বেগুন. শসা, কুমড়া এসব সবজিকে বোঁটা থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে গাছ থেকে আলাদা করে নিতে হবে।
২. চারা গাছ পাতলা করার সময় ছোট গাছ হিসেবে লালশাক, পালংশাক এসবের শাককে সংগ্রহ করে নিতে হবে ।   
৩. পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক সংগ্রহের সময় সম্পূর্ণ গাছটি শিকড়সহ উপড়ে ফেলে সংগ্রহ করতে হয় ।
৪. শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগা প্রুনিং বা ছাঁটার করাই সময় গাছের অংশ কেটে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আবার বিভিন্ন সবজি সংগ্রহের উপযোগী সময় ও উপযুক্ত অবস্থাভেদে  সংগ্রহ করতে হবে।


 যেমন- বেগুন সবজি : ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় তবে এটি পরিপূর্ণ আকার এবং রঙ প্রাপ্তির পর সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
 

ঢেঁড়স :  কোমল ও কচি অবস্থায় ঢেঁড়সের ফল তুলতে হবে, তা না হলে ফল শক্ত ও খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফল বের হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর ঢেঁড়স খাওয়ার উপযোগী হয়। ফল তোলা না হলে কান্ডের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন কম হয়।
 

ধুন্দল :  বীজ বুনার দেড় থেকে দুইমাস পর থেকে ধুন্দল ফল ধরা শুরু হয় এবং এটি দুই-তিন মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। গাছে ফল ধরার ৮ থেকে ১০ দিন পরেই সংগ্রহ উপযোগী হয়। ফল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত, এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে। বেশি পরিপক্ব ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান দুইটিই কমে যায়।
 

বরবটি : শুটি পরিপূর্ণ লম্বা ও মোটা হলে এবং বীজের অংশ সামান্য স্ফীত হতে শুরু করলে বরবটি তোলা যাবে।
 

লাউ : ফলের ত্বকের লোমশ ভাগ পরিপক্বতার সাথে সাথে কমতে থাকে, ফলের লোমশ ঘনত্ব দেখেও এর সংগ্রহ উপযোগিতা নির্ণয় করা যায় এবং সংগ্রহ করতে হয়।
 

মূলা : বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায়। শাকের জন্য ঘন করে লাগালে ফসল ২০ দিন পর এবং মুলার জন্য ৪০ দিন পর থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে।
 

শিম : ফুল ফোঁটার ২০-২৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। শুটি পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে এর বীজের অংশ কিছুটা স্ফীত হওয়ার পর পরই সংগ্রহ করতে হবে। তবে অতিরিক্ত পরিপক্ব শুটিতে আঁশ জন্মালে কোমলতা ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।


সবজি সংগ্রহের সময় যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তাহলো-
হাত দিয়ে মোচড়ায়ে সবজি ফসল সংগ্রহ করা যাবে না, এতে মাতৃ গাছের ক্ষতি হয়। মোচড়ানোর ফলে গাছে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়ে রোগ জীবাণুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষতি এড়ানোর জন্য ধারালো ছুরি বা ক্লিপার দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহ করে ফসল তোলার পাত্রে রাখতে হবে ।
সবজি সংগ্রহ থেকে বাজারে নেয়া পর্যন্ত কার্যক্রমকে বাজারজাতকরণ বলা হয়ে থাকে। আর যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখলে বাজারজাতকরণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করে শাকসবজির সংগ্রহোওর ক্ষতির পরিমাণকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।


এ বিষয়ে যেসব খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলো -
ক. মাঠে থাকা অবস্থায় সংগ্রহের সময় সবজির গায়ে ধুলাবালি লাগতে পারে। এজন্য সংগ্রহের পর পরই পরিষ্কার পানিতে সবজি ধুয়ে নিলে আকর্ষণ বাড়ে এবং নেতিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে। তবে অপরিষ্কার পানিতে ধোয়া উচিত নয়, কেননা রোগ-জীবাণুর আক্রমণের আশংকা বৃদ্ধি পায়।

 

খ. নিকটবর্তী বা দূরের বাজারে পাঠানোর আগে আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য ছাঁটাই করতে হবে। খুব ধারালো ছুরি দিযে ছাঁটাই করতে হবে।
 

গ. আকর্ষণ এবং মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে সটিং এবং গ্রেডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজি ভেদে আকার-আকৃতি, বর্ণ, বাওি, পরিপক্বতা অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে গ্রেড প্রচলন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
 

ঘ. যেহেতু রসালো সবজি সংগ্রহ করার পরও শ্বসন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সে জন্য  ঠাণ্ডা ঘরে বায়ু শূন্য করে  অল্প সময়ের জন্য হলেও মাঠের তাপ সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
 

ঙ. দূরে পাঠাতে বা অনেকক্ষণ সবজি টাটকা রাখার জন্য মোড়কায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সংখ্যক সবজি সংগ্রহের পর পরই খুব কম সময়ের মধ্যেই পানি পরিত্যাগ করে এবং নেতিয়ে পড়ে। এসব শাকসবজি বাজারজাত করা খুবই অসুবিধাজনক। তাই এগুলো খুব পাতলা ও স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যাগে রাখলে নেতিয়ে পড়া কমে যায়। খুবই পাতলা পলিথিনের ভেতর দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। কিন্তু জলীয় বাস্পের কণা চলাচল করতে পারে না বলে নেতিয়ে পড়া বন্ধ হয়। শাক, ব্রোকলি, শিম, লেটুস, ধনিয়াপাতা এগুলোকে মোড়কায়ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
 

চ. মোড়কায়নের পর দূরের বাজারে পরিবহনের সময় সবজি যাতে আঘাত না লাগে সেজন্য বস্তা বন্দি না করে বায়ু চলাচলের সুবিধাযুক্ত প্লাস্টিক, কাঠ, বাঁশের খাঁচা অথবা কার্ড বোর্ডের বাক্সে করে সবজি চালান দেয়া উচিত। পরিবহনের সময় ট্রাকের ও ট্রেনের বগিতে পরিচ্ছন্নতা ও বাতাস চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
আগাম শীতের শাকসবজির সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয় তবে উৎপাদনকারীর অপচয় রোধ হবে এবং তিনি অধিক মুনাফার মুখ দেখবেন। আর দেশের শাকসবজির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ হবে সুগম ।

 

এ বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শের জন্য নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিস কিংবা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

 

তুষার কুমার সাহা*  

*কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী 

বিস্তারিত
ভালো বীজ চেনার উপায়

বীজ কী ও ভালো বীজের গুরুত্ব : বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষি। আর যে কোনো ফসল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে বীজ। কৃষি নির্ভর এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের প্রত্যায়িত বীজ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে একই ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ফলন পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে বীজের মান যদি ভালো না হয় তাহলে বীজ/ফসল উৎপাদনে অন্যান্য সব উপকরণের ব্যবহার ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যা প্রকারন্তে দেশ ও জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বীজের গুরুত্ব অনুধাবন করে পৃথিবীর সব দেশে অধিক ফসল উৎপাদনে, মাঠমান ও বীজমান নিশ্চিতকরণে প্রত্যায়িত বীজের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে মৌল, ভিত্তি, প্রত্যায়িত শ্রেণীর বীজের ব্যবহার ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। আর তাই প্রত্যায়িত বীজ সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা উচিত।

 

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য : ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের প্রথমটিই হলো বীজ অর্থাৎ বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। তাই চিরন্তন সত্য হচ্ছে ‘ভালো বীজে ভালো ফসল’। এর কোনো বিকল্প নেই। আর তাই আমাদের বাঙালি সমাজে একটি জনপ্রিয় ও সর্বজনবিদিত প্রবাদ বা শ্লোক হচ্ছে-

‘ভালো বীজে ভালো ফসল সুধীজনে কয়-প্রত্যায়িত বীজই ভালো বীজ জানিবে নিশ্চয়’
আর এ সুবীজ তথা ভালো বীজই হচ্ছে মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজ। তাই প্রত্যেক বীজ ক্রেতা-বিক্রেতা, বীজ ব্যবসায়ী ও কৃষক ভাইদের জানতে হবে ভালো বীজ তথা মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্য এবং চেনার উপায়। ভালো বীজের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ-

 

১. কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা (Genetical Purity) : বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলি অবশ্যই থাকতে হবে। জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজের বিশুদ্ধতা হতে হবে ৯৬% হতে ৯৯% ভাগ।   

      
 ২. মিশ্রণ মুক্ততা
(Free from admixture) : ভালো বীজ অবশ্যই সব ধরনের মিশ্রণ মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ একটি ভালো বীজে জড় পদার্থ, আগাছার বীজ বা অন্য ফসলের এমনকি অন্য জাতের মিশ্রণ থাকা চলবে না। জাতীয় বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজে সর্বোচ্চ ০১ ৩% পর্যন্ত জড় পদার্থ, অন্য ফসলের বীজ বা আগাছার বীজ থাকতে পারে।
 

৩. রোগ ও কীটপতঙ্গ মুক্ততা (Free from Insect and Diseases) : বিশুদ্ধ ভালো বীজ অবশ্যই রোগ জীবাণুমুক্ত এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে।


৪. অংকুরোদগম ক্ষমতা (Germination Capacity) : ভালোবীজ মানেই উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ অর্থাৎ অংকুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে ৮৫% বা তার ওপরে। জাতীয় বীজ মান অনুসারে ভালো বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কোনো ক্রমেই ৮০% এর নিচে নয়।


 ৫. বীজের আর্দ্রতা (Moisture Content) : ভালো বীজের আর্দ্রতা ধান ও গমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২% এবং অন্যান্য ফসলের বেলায় সর্বোচ্চ ১০% হতে হবে।


৬. বীজের আকার-আকৃতি (Seed Size and Shape) : নির্দিষ্ট ফসলের নির্দিষ্ট জাতের সব বীজ প্রায় একই আকারের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ব ও পুষ্ট হতে হবে। এছাড়া বীজের জীবনীশক্তি (Viability) এবং বীজের স্বাভাবিক উজ্জ্বল রঙ থাকতে হবে।


বীজের শ্রেণী (Classes of Seeds) : ভালো বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করতে হলে আমাদের প্রথমে বীজের শ্রেণী বিন্যাস (Classes of Seeds) জানা একান্ত প্রয়োজন। বীজ বিধি ১৯৯৮ এর ৯নং ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে বীজের ৪ টি শ্রেণী বিদ্যমান আছে। বীজের শ্রেণীগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ-


ক. প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ (Breeder Seed)
খ. ভিত্তি বীজ (Foundation Seed)
গ. প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed)
ঘ. মান ঘোষিত বীজ (
TLS : Truthfully Labeled Seed)


ক. প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ (Breeder Seed) :   

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত জাতের যে বীজ গবেষণাগারে/গবেষণাগার মাঠে উৎপাদন করা হয় সেটাই হচ্ছে প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ব্রিডার বীজ (Breeder Seed)। কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিশিষ্ট প্রজননবিদের নিবিড় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত বীজই হচ্ছে  ‘প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ অর্থাৎ ব্রিডার বীজ’, যা থেকে পরবর্তীতে ভিত্তি শ্রেণীর বীজ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
 

এ বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা (Genetical Purity) থাকে সর্বাধিক অর্থাৎ ৯৯%-১০০% ভাগ। এ শ্রেণীর বীজ চেনার জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক ‘সবুজ রঙের প্রত্যয়ন ট্যাগ’ সংযুক্ত করে দেয়া থাকে। জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারীরা এ বীজ গ্রহণ করে পরবর্তী শ্রেণীর ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে থাকে।
 

খ. ভিত্তি বীজ (Foundation Seed) :
মৌল বা ব্রিডার বীজ হতে বর্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে ‘ভিত্তি বীজ
(Foundation Seed)’ তৈরি করা হয়ে থাকে। এছাড়া ভিত্তি বীজ হতেও ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়ে থাকে যা প্রজনন বীজের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বহন করে থাকে। প্রত্যয়নের স্বপক্ষে ভিত্তি বীজের ব্যাগে অবশ্যই বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত ‘সাদা রঙের প্রত্যয়ন ট্যাগ’ সংযুক্ত থাকতে হবে। নিবন্ধিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান এ বীজ হতে পরবর্তীতে ভিত্তি/প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে থাকে।


গ. প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed) : প্রত্যায়িত বীজ হচ্ছে ওই শ্রেণীর বীজ যা সরকার অনুমোদিত সংস্থা যেমন  বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক বীজ অধ্যাদেশ, বীজ আইন ও বীজ বিধির সব ধারা পূরণপূর্বক প্রত্যয়ন করা হয়ে থাকে। এ শ্রেণীর বীজ হচ্ছে ভিত্তি বীজের বংশধর অর্থাৎ ভিত্তি বীজ হতে বীজ প্রত্যয়নের সব নিয়ম কানুন অনুসরণ করে উৎপাদিত ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত বীজই হচ্ছে প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed)। এ শ্রেণীর বীজ চিহ্নিত করার জন্য প্রদত্ত ‘প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ হচ্ছে নীল’। এ বীজের বিশুদ্ধতা ভিত্তি বীজের তুলনায় কিছুটা কম থাকে। কিন্তু জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত বীজমান অনুযায়ী গুণাগুণ বজায় রাখা হয়। এ শ্রেণীর বীজ উৎপাদন করতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়ন আবশ্যক। সরকারি/বেসরকারি/ব্যক্তি উদ্যোগে বীজ উৎপাদনকারীরা এ বীজ কৃষকের জন্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। মূলত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ধান উৎপাদনকারী কৃষকই এ বীজ ব্যবহার করে থাকে।


ঘ. মান ঘোষিত বীজ (TLS: Truthfully Labeled Seed)

এ শ্রেণীর বীজ সাধারণত ভিত্তি ও প্রত্যায়িত শ্রেণীর বংশধর হয়ে থাকে যা উৎপাদনের পর বীজ ব্যাগে বা মোড়কে বীজের সমুদয় মান, উৎপাদনকারীর নাম, ঠিকানা লেবেল করে বা প্যাকেটের গায়ে সুস্পষ্টভাবে লিখে দিতে হয়। এ বীজের ক্ষেত্রে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কোনো প্রত্যয়ন বা প্রত্যয়ন ট্যাগ সংযোজনের প্রয়োজন হয় না। তবে এ শ্রেণীর বীজের বীজমান অবশ্যই প্রত্যায়িত বীজের মানের সমতুল্য হতে হবে এবং এ মান বজায় রাখার সব দায়-দায়িত্ব বীজ উৎপাদনকারীর। এ শ্রেণীর বীজ চেনার জন্য বীজ ব্যাগে ‘হলুদ রঙের লেবেলিং কার্ড’ লাগানোর বিধান রয়েছে  

                          
প্রত্যয়ন ট্যাগ (
Certification Tag) : প্রত্যয়ন ট্যাগ হচ্ছে অদৃশ্য গোপনচিহ্ন সংবলিত একটি সরকারি প্রত্যয়নপত্র যা বীজ বপন হতে শুরু করে মাঠ পরিদর্শনকালীন মাঠ মান ও বীজ পরীক্ষাগারে বীজ মানের সন্তোষজনক ফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সরকারিভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক ০২ কেজি ও ১০ কেজির বীজ ব্যাগে সংযোজনের জন্য প্রদান করা হয়ে থাকে। বীজের শ্রেণী অনুসারে প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। ব্রিডার, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত শ্রেণীর বীজের জন্য প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ যথাক্রমে সবুজ, সাদা ও নীল রঙ হয়ে থাকে। প্রতিটি প্রত্যয়ন ট্যাগে লেখা থাকে ফসলের নাম, জাতের নাম, বীজের শ্রেণী, বীজ ডিলার/উৎপাদকের নাম ও ঠিকানা, লট নম্বর, বীজ পরীক্ষার তারিখ, ট্যাগ ইস্যুর তারিখ, বৈধতার মেয়াদ ও যে পরিমাণ বীজের জন্য প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রদানকৃত তার পরিমাণ।


প্রত্যায়িত বীজের মাঝে যেহেতু একটি ভালো বীজের সব প্রকার ভালো গুনাগুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তাই এ বীজ ব্যবহারে ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সুতরাং অধিক ফসল উৎপাদনে প্রত্যায়িত মানের বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কারণেই বলা যায়-


‘আজ তাই সব কৃষকের দৃঢ় সংকল্প, প্রত্যায়িত বীজ বিনা নাই যে বিকল্প’
বাংলাদেশ সরকারের বীজ আইন অনুসারে প্যাকেটকৃত বীজের মানের নিশ্চয়তা বীজ বপন হতে শুরু করে বীজ প্যাকেট করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজের মাঠ মান ও বীজ মান নিশ্চিত প্রাপ্তি সাপেক্ষেই যেহেতু প্রত্যয়ন পত্র দেয়া হয়ে থাকে তাই প্রত্যয়নকৃত বা প্রত্যায়িত বীজ মানেই ভালো বীজ, এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সব বীজ উৎপাদনকারী ও কৃষকের জন্য একটাই পরার্মশ,‘প্রত্যায়িত বীজ ব্যবহার করুন, অধিক ফসল ঘরে তুলুন’। সুতরাং বীজ বপন হতে শুরু করে মাঠ পরিদর্শনের মাধ্যমে নির্ধারিত মাঠমান যাচাইকরণ, বীজ সংরক্ষণাগার পরিদর্শন, প্রত্যয়নকৃত বীজ নমুনা সংগ্রহ, সন্তোষজনক বীজ পরীক্ষার ফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রতিটি বীজ ব্যাগে যথাযথভাবে প্রত্যয়ন ট্যাগ সংযোজন এবং মার্কেট মনিটরিং পদ্ধতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বীজের মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সেই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটিই পালন করছে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি।

 

শেখ মো. মুজাহিদ নোমানী*

*জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, (কৃষি মন্ত্রণালয়) জামালপুর।  ই-মেইল : nomani1961@gmail.com, মোবা : ০১৭১৮-৭৩৯৮৫

 

বিস্তারিত
শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ

অনেকেই খাদ্য এবং পুষ্টিকে একই মনে করেন। আসলে এটি ভুল ধারণা। কারণ খাদ্য পুষ্টিকর নাও হতে পারে, তবে পুষ্টি অবশ্যই খাদ্য। সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান। সে সাথে আঁশে ভরপুর। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, খাবারে রুচি আনে। এ ছাড়া হজমশক্তি বৃদ্ধিতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে যথেষ্ট সহায়তা করে। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২ শত গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৬০-৭০ গ্রাম। তাও আলুসহ। তাই চাওয়া-পাওয়ার এ গড়মিলে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক দৈহিক এবং মানসিক অসুখে ভুগছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছেন শিশু ও নারী। মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোক, বিশেষ করে মেয়েরা লৌহের অভাবে রক্তস্বল্পতার শিকার। একমাত্র ভিটামিন-এ’র অভাবে বছরে ৩০ হাজারেরও অধিক শিশু অন্ধ হয়ে যায়। চোখে কম দেখার সংখ্যা আরও বেশি। তবে সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টির ঘাটতি যতটুকু তার চেয়ে বড় বাধা পুষ্টির উৎস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা। যারা দিন আনে দিন খায় তারাই কেবল পুষ্টিতে ভোগে তা কিন্তু নয়। বিত্তশালী শিশুরাও আজকাল শাকসবজি না খেয়ে রাতকানায় ভুগছে; যে কারণে ওরা চোখে চশমা পরতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ হাতের কাছে পাওয়া কচুশাক, কলমিশাক, হেলেঞ্চা, সজিনাসহ নানারকম শাকসবজি অভাবী মানুষের পুষ্টি সরবরাহ করে।  সেজন্য বিভিন্ন শাকসবজির  পুষ্টি ও ভেষজগুণ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার।
 

টমেটো
শীতকালীন সবজির মধ্যে টমেটো অন্যতম। পুষ্টিসমৃদ্ধ এ সবজিকে গ্রামাঞ্চলে অনেকেই বিলাতি বেগুন নামে চেনে। টমেটো (পাকা) দেখতে খুবই আকর্ষণীয় এবং খেতেও সুস্বাদু। কাঁচা ও  রান্না উভয় অবস্থায়  খাওয়া যায়। টমেটো দিয়ে টক তরকারি, সালাদ এবং প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা যায় সস, স্যুপ, জ্যাম, জেলি, কেচাপ, মোরব্বা এসব লোভনীয় খাবার। এর রয়েছে বহু গুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা টমেটোতে ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি আছে ৩৫১ মাইক্রোগ্রাম এবং ২৭ মিলিগ্রাম আর ভিটামিন-বি, শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম  ও লৌহের পরিমাণ যথাক্রমে ০.৩৩ মিলিগ্রাম, ৩.৬ গ্রাম, ১.১ গ্রাম, ৪৮ মিলিগ্রাম এবং ০.৪ মিলিগ্রাম। প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে টমেটো ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান- লাইকোপেন, যা দেহকোষ থেকে বিষাক্ত ফ্রিরেডিক্যালকে সরিয়ে প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ মূত্রথলি, অন্ননালি এবং অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। পাশাপাশি হৃদরোগকে করে প্রতিহত। টমেটো হজমের জন্য বেশ উপকারী। এর রস স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে দেহ ও দাঁতকে নিরোগ রাখে। টমেটোর রস কেবল স্কার্ভিই নয়, রিকেটস এবং বেরিবেরির মতো কঠিন রোগেরও নিরাময় ঘটায়। টমেটো বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে দেহকে সজীব রাখে। এ ছাড়া শরীরের মেদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দেহের শক্তিকে রাখে অটুট।

 

লাউ
লাউ অতি জনপ্রিয় সবজি। অত্যন্ত সুস্বাদু  এ সবজিটি গ্রামাঞ্চলে কদু নামে পরিচিত। এর আকার-আকৃতি হয় নানা রকম। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের লাউ কোনটি দেখতে গোল, কোনোটি আবার লম্বাটে। কচি লাউয়ের তরকারি খেতে বেশ। ডালের সাথেও এটি রান্না করা যায়। এছাড়া লাউ দিয়ে তৈরি হয় পায়েশ, হালুয়া, মোরব্বা এসব লোভনীয়  খাবার। লাউ এ রয়েছে অনেক পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি এবং খাদ্যশক্তি আছে যথাক্রমে ১৫.১ গ্রাম, ১.১ গ্রাম, ০.০১ গ্রাম, ২৬  মিলিগ্রাম, ০.৭ মিলিগ্রাম, ০.০৩ মিলিগ্রাম, ৪ মিলিগ্রাম এবং ৬৬ কিলোক্যালরি।  লাউশাকে রয়েছে আরো বেশি পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ক্যারোটিন ৭১৯৬ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন-সি আছে ৯০ মিলিগ্রাম করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা ৬.১ গ্রাম, আমিষ ২.৩ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৩৯ কিলোক্যালরি। আয়ুর্বেদ মতে, লাউ হচ্ছে মধুরস। লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এ ছাড়া শরীর ও মস্তিষ্ককে ঠা-া রাখে। তাই আমাদের বেশি করে লাউ খাওয়া প্রয়োজন।

 

ফুলকপি    
ফুলকপি শীতের সবজি। পুষ্টিসমৃদ্ধ এ সবজি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি খেতেও সুস্বাদু। এর ভাজি আর তরকারি খেতে দারুণ। ফুলকপির তৈরি সিঙ্গারা, চপ, ফুলরি, পুরি এসব খাবার খুবই মজাদার। ব্রোকলি ছাড়া অন্য যে কোনো সবজির তুলনায় ফুলকপিতে ভিটামিন-সি’র পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন-সি রয়েছে ৯১ মিলিগ্রাম। অথচ করল্লায় এর পরিমাণ হচ্ছে ৬৮ মিলিগ্রাম, সাজিনায় ৪৫ মিলিগ্রাম, ওলকপিতে ৫৩ মিলিগ্রাম, মুলায় ৩৪ মিলিগ্রাম এবং টমেটোতে আছে ৩১ মিলিগ্রাম। ফুলকপিতে ভিটামিন-কে’র পরিমাণও রয়েছে যথেষ্ট। এর অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন ও ভিটামিন-বি  আছে যথাক্রমে ২.৬ গ্রাম, ৭.৫ গ্রাম, ০.১ গ্রাম, ৪১ মিলিগ্রাম, ১.৫ মিলিগ্রাম, ৩০ মাইক্রোগ্রাম এবং ০.০৫৭ মিলিগ্রাম। শরীর সুস্থ রাখার জন্য মানবদেহে ভিটামিন-সি খুবই দরকারি।

 

বাঁধাকপি
খাদ্যমান বিবেচনায় বাঁধাকপি একটি পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা ৪.৭ গ্রাম, আমিষ ১.৩ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩১ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ১২০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১১ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন-সি রয়েছে ৩ মিলিগ্রাম করে। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- রাতকানা, হজমের অসুবিধা, ঘন ঘন অসুস্থতা, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাশাপাশি ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্থি ও কংকাল গঠনে বিঘœ ঘটে, শিশুদের রিকেট রোগ এবং অন্তঃসত্ত্বা  নারীর উদরস্থ শিশুর দৈহিক গঠন অসম্পূর্ণ  হতে পারে। এসব প্রতিরোধে বাঁধাকপি অনন্য। বাঁধাকপি বহুমূত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।

 

গাজর
গাজর অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ মূল জাতীয় সবজি। কাঁচা ও রান্না উভয় অবস্থায়ই এটি খাওয়া যায়। গাজর বেশ জনপ্রিয় খেতে সুস্বাদু। দেখতেও চমৎকার। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে ১০৫২০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন রয়েছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, শর্করা ১২.৭ গ্রাম,  ক্যালসিয়াম ১৭ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, লৌহ ২.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৬ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি আছে ৫৭ কিলোক্যালরি। এ ছাড়া গাজরের পাতায় ক্যারোটিন, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, চর্বি, লৌহ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ৫৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ৫.১  গ্রাম, ১৩.১ গ্রাম, ৩৬০ গ্রাম, ৫.১ গ্রাম, ১০ গ্রাম, ০.০৬ মিলিগ্রাম, ৭৯ মিলিগ্রাম এবং ৭৭ কিলোক্যালরি। সালাদ ছাড়াও গাজর দিয়ে তৈরি করা যায় স্যুপ, চপ, বড়া, হালুয়া, পায়েস আরো কত কি! নিরামিষভোজীদের কাছে গাজর অতি প্রিয়। কেবল খাদ্য হিসেবেই নয়, রূপচর্চায়ও এর তুলনা নেই। রুক্ষ আর খসখসে ভাব দূর করে, গাজর ত্বককে রাখে সজীব, সতেজ। এজন্য গাজর ছেঁচে রস বের করে সারা শরীরে মাখতে হবে। এভাবে কমপক্ষে ১৫/২০ মিনিট রেখে পরে গোসল করা উচিত। মুখ ও শরীরের কালো দাগ দূর করার জন্য গাজর কেটে শুকিয়ে গুঁড়া করে এর সঙ্গে পরিমাণমতো ময়দা ও দুধের সর মিশিয়ে সাবানের মতো ব্যবহার করতে হয়। গাজরের আছে আরো গুণ। কাঁচা গাজর কৃমিনাশক। এছাড়া প্লীহাবৃদ্ধি রোধ এবং আমাশয়ে বেশ কার্যকর। সস্তা, সহজলভ্য এ সবজি আমাদের অনেক উপকারে আসে।

 

মিষ্টিকুমড়া
মিষ্টিকুমড়া এ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। সারা বছর পাওয়া যায় এবং পাকা অবস্থায় এটি বহুদিন সংরক্ষণযোগ্য। এর ফল, ফুল ও ডগা অত্যন্ত সুস্বাদু। পুষ্টিকরও বটে। ভাজি এবং তরকারি ছাড়াও এ দিয়ে তৈরি করা যায় বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিকুমড়ায় ভিটামিন-এ ৭২০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-সি ২৬ মিলিগ্রাম এবং ক্যালসিয়াম আছে ৪৮ মিলিগ্রাম করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা, আমিষ, লৌহ, চর্বি, ভিটামিন-বি ও খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ৪.৫ গ্রাম, ১.৪ গ্রাম, ০.৭ মিলিগ্রাম, ০.৫ গ্রাম, ০.১৩ মিলিগ্রাম এবং ৩০ কিলোক্যালরি। এ দেশে ভিটামিন-এ’র অভাব যথেষ্ট। এটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়  শিশু, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের মধ্যে। এতে শিশুরা রাতকানায় আক্রান্ত হয়। তবে চিকিৎসা না করলে পুরোপুরি অন্ধ এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া এদের স্বাভাবিক  বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশে হয় বাধাপ্রাপ্ত। পাশাপাশি বড়রাও হচ্ছে নানা রোগের সম্মুখীন। অথচ মিষ্টিকুমড়াসহ অন্যান্য  ক্যারোটিনসমৃদ্ধ সবজি নিয়মিত  খেলে এসব সমস্যা  প্রতিরোধ সম্ভব।  

 

বেগুন
সারা বছর পাওয়া যায় এমন সবজির মধ্যে বেগুন একটি। এর আকার-আকৃতি হয় নানা রকম। কোনটি দেখতে লম্বাটে, কোনোটি গোলাকার (অনেকটা), কোনোটি আবার সরু। বর্ণও হয় একাধিক। কারণ বেগুনে রয়েছে যথেষ্ট পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন-এ আছে ৮৫০ মাইক্রোগ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ২.২ গ্রাম, চর্বি ২.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৫ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি  রয়েছে ৪২ কিলোক্যালরি। ভাতের সাথে বেগুন ভাজি আর মুড়ি দিয়ে গরম গরম বেগুনি খেতে দারুণ! বিশেষ করে রমজানের ইফতারিতে বেগুনির জুড়ি নেই। কেবল খাদ্য হিসেবেই নয়, এর ঔষধিগুণও আছে যথেষ্ট। বেগুন যকৃতের জন্য উপকারী এবং ডায়াবেটিক রোগীর ভালো পথ্য। কফ নিরাময়ে এর কার্যকারিতা বেশ। পাশাপাশি দেহের চর্বি কমাতেও সহায়তা করে। এজন্য বেগুন আগুনে পুড়ে পরিমাণমতো লবণ মেখে নিয়মিত খেতে হবে।

 

করলা
উচ্ছে-করলা উভয়েরই গুণাগুণ সমান। ‘কিউকার বিটাসিন’ নামক এক প্রকার পদার্থ থাকায় এর স্বাদ তিতা। খেতে তিতা হলেও খাদ্যমান ও ঔষধিগুণ বিবেচনায় এ সবজি সবার নিকট বেশ সমাদৃত। এর কচি ফল আর চিংড়ির ভাজি দারুণ! মাছের সাথে রেধেও খাওয়া যায়। করলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রামে ১৪৫০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ৬৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ২.৫ গ্রাম, শর্করা ৪.৩ গ্রাম, চর্বি ০.১  গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি রয়েছে ২৮ কিলোক্যালরি। আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়েরা গর্ভাবস্থায় এবং শিশুদের দুধ খাওয়ানোর সময় রক্ত স্বল্পতায় ভুগেন। এ সমস্যা এড়াতে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি তাদের বেশি  করে করলা খাওয়া উচিত। পেটে গুঁড়া কৃমি হলে করলাপাতার রস ছেঁচে এর সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে বড়দের দুইচা-চামচ এবং শিশুদের আধা চা-চামচ খাওয়াতে হবে। এভাবে ২/৩ দিন সকাল-বিকাল খাওয়ালে দেখবেন কৃমির উপদ্রব একদম নেই। করলা মুখে রুচি বাড়ায়, বাত, এলার্জি, পেটের পীড়াসহ অন্যান্য রোগের জন্য  উপকারী।

 

ঢেঁড়স
ঢেঁড়স সব মৌসুমের অন্যতম প্রধান সবজি। এর অভ্যন্তরে এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ থাকায় কেউ কেউ ঢেঁড়স খেতে চান না। তবে গ্রামের চেয়ে শহরের লোকের কাছে এর জনপ্রিয়তা বেশি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে আহারোপযোগী  ভিটামিন-এ ১৬৭০ মাইক্রোগ্রাম এবং ক্যালসিয়াম আছে ১১৬ মিলিগ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৮.৭ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, লৌহ ১.৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.২০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ১০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ও রয়েছে ৪৩ কিলোক্যালরি। মানবদেহে ভিটামিন এবং ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে যতই শক্তিদায়ক খাবার খাওয়া হোক না কেন,  অসুস্থ  অবধারিত। এজন্য ভিটামিন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঢেঁড়স খেতে পারেন। এ সবজি ভেজে কিংবা যে কোন মাছ এমনকি গোশতের সাথে রেধেও খাওয়া যায়। নিয়মিত ঢেঁড়স খেলে শরীরের  হাড় শক্ত হয়, দাঁতের গঠন ঠিক থাকে। এ ছাড়া হজমশক্তি বৃদ্ধিসহ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এতে আয়োডিন থাকায় গলাফোলা রোগ হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।

 

আলু
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আলুতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ রয়েছে। এছাড়া শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি তো আছেই। একজন পূর্ণবয়স্ক লোক দৈনিক ২০০-২৫০ গ্রাম করে আলু খেলে তাতেই ভিটামিন-সি’র চাহিদাপূরণ হয়ে যায়। গোলআলু একমাত্র সবজি, যা বিভিন্ন ধরনের মাছ গোশত রান্নায় তরকারি হিসেবে ব্যবহার হয়। আলু ভর্তা, ভাজি, চাটনি,  লাবড়া এসব নিরামিষভোজীদের অতি প্রিয়। এ ছাড়া এ দিয়ে তৈরি করা যায় চপ, সিঙ্গারা, পুরি, চটপটি এবং চিপসের মতো স্বাদের খাবার। আলু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হৃদরোগীরাও আলু খেতে পারেন।

 

মিষ্টিআলু
মিষ্টিআলু এক প্রকার সবজি বিশেষ। একে বলা হয় ‘গরিবের খাদ্য’। কয়েকটি দেশে চাল এবং গমের পরিবর্তে মিষ্টিআলু ব্যবহার হচ্ছে। মূল জাতীয় শস্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন করে মিষ্টি আলু। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিআলুতে শর্করার  পরিমাণ ২৮.২ গ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, চর্বি ০.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৫৬৫ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ১২০ কিলোক্যালরি। সাদা ও লাল দুই বর্ণের  এ আলু সাধারণত সিদ্ধ, ভর্তা, আগুনে পুড়ে এবং মাছ-গোশতের সাথে রান্ন করে খাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে কাঁচাও খেতে পারেন। মিষ্টিআলু নিয়ে হালুয়া, চিপস, পায়েশ এবং আটার সংমিশ্রণে এর গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় বিস্কুট, রুটি, পাউরুটি, পেস্ট্রি, হরেক রকম পিঠা, কেক এসব মুখরোচক খাবার। প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা যায় শিশুদের বিকল্প খাদ্য। এর আছে আরও গুণ। গ্লুকোজ, চিনি, সিরাপ, স্টার্চ, পেপটিন এবং এ্যালকোহলের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মিষ্টিআলু। এর কচিপাতা ও ডগা খুব পুষ্টিকর।

 

কাঁচকলা
সারাবছর পাওয়া যায় কাঁচকলা কেউ কেউ আনাজি কলাও বলে থাকেন। সবজি হিসেবে কাঁচকলা এদেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচকলা হচ্ছে মধুরস, যা খেলে মুখে রুচি বাড়ে। তাই রোগীর পথ্য হিসেবে এর জুড়ি নেই। এর প্রতি ১০০ গ্রামে (আহারোপযোগী) শর্করা ১৭.৩ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, চর্বি ০.৪ গ্রাম, খনিজ লবণ ১ গ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৮৩ কিলোক্যালরি। আয়ুর্বেদীয়  মতে, অন্যান্য কলার মতো এর শিকড়, কন্দ, পাতা, ফুল, ফল, থোড় ও বীজ ঔষধিগুণে ভরপুর। কাঁচকলা আর থানকুনিপাতা বেটে এক সাথে খেলে আমাশয় সেরে যায়। তবে রক্ত আমাশয় এবং জন্ডিস হলে কাঁচকলা সিদ্ধ করে গরম ভাত দিয়ে খেতে হবে। কলার থোড় উচ্চরক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর তৃষ্ণা নিবারণে এবং রক্তবমি বন্ধে সহায়তা করে। কেঁচোকৃমি হলে বয়স অনুযায়ী ৩/৪ চা-চামচ কলাগাছের শিকড়ের রস সকালে খালিপেটে খেতে হবে।  এভাবে কয়েক দিন নিয়মিত খেলে কৃমির উপদ্রব কমে যাবে।

 

পাটশাক
পাটের প্রধান ফসল আঁশ হলেও এর পাতার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশি পাটশাক সামান্য তিতা তবে তোষা বা বগী পাটশাক খেতে বেশ সুস্বাদু। পুষ্টির দিক থেকে দেশী পাটশাক কিছুটা এগিয়ে। ডালের সঙ্গে কচি পাটশাক খেতে দারুণ। এ ছাড়া ভাজি, ছোট মাছ দিয়ে রান্না করেও খাওয়া যায়। এতে ভিটামিন-সির পরিমাণ কম থাকলেও ক্যারোটিন আছে প্রচুর। এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা ১২.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, চর্বি ০.০১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ ১১৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১৯ মিলিগ্রাম এবং  খাদ্যশক্তি রয়েছে ৬২ কিলোক্যালরি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং শিশুদের জন্য কমপক্ষে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ দরকার, যা পাটশাক হতে অনায়াসেই পেতে পারি।


কলমিশাক
কলমি গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি শাকের নাম। এক ধরনের  কলমির ডাঁটা লাল আর অন্যটির ডাঁটা দেখতে সাদা-সুবজ। এর প্রতি ১০০ গ্রাম (আহারোপযোগী) শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৯.৪ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০৭ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৫৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৪৬ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ লাখ শিশু রাতকানায় আক্রান্ত হচ্ছে। একই কারণে প্রতিদিন গড়ে ১০০ এবং বছরে ৩০ হাজার শিশু একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। অথচ ক্যারোটিনসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি কলমিশাক খেলে এ জাতীয় রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। শিশুরা যেন পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেতে পারে এজন্য মায়েদের কলমিশাক খাওয়া বাঞ্ছনীয়। বোলতা, ভিমরুল বা মৌমাছিতে কামড়ালে  কিংবা শিং, ট্যাংরা মাছের কাটা ফুটলে     কলমিশাকের পাতা ও ডাঁটা বেটে  আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণা কমে যায়।


অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি প্রতি বেলায় আমাদের শাকসবজি খাওয়া আবশ্যক। তবে তা হতে হবে অবশ্যই বিষক্রিয়ামুক্ত। এ বিষয়ে কৃষকদের যতটুকু আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি দরকার সবজি বিক্রেতাদেরও। তাই আসুন, এ ব্যাপারে নিজে সচেতন হই; অপরকেও করি উৎসাহিত।

 

নাহিদ বিন রফিক*

* টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; ০১৭১৫৪৫২০২৬

বিস্তারিত
গবাদি পশুপাখির শীতকালীন রোগবালাই ও প্রতিকার

আসছে শীতকাল। এ সময় গরু ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য গবাদি পশুপাখির নানা রকমের রোগবালাই হয়ে থাকে। গবাদি পশুপাখির শীতকালীন কিছু কমন রোগ হয়। একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।


গামবোরো  রোগ
গামবোরো একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে ব্রয়লার, কক, সোনালি ও লেয়ার মুরগি মারা যায়। তাই এ রোগের মুরগির মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্ত ফ্লক ইম্যুনোসাপ্রেশনে ভোগে। আর তাই এ রোগকে মুরগির এইডস বলা হয়। আর এ ধরনের ফ্লক থেকে কখনই আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। গামবোরো রোগের কিছু কমন লক্ষণ হলো পানি না খাওয়া, খাদ্য না খাওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া এসব। এর চিকিৎসা ও প্রতিকার হলো অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন ১০% ব্যবহার করা যায়। এটি রক্তে তাড়াতাড়ি মিশে আর শরীরে থাকেও দীর্ঘক্ষণ। ফলে দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যায়। ১ লিটার পানিতে ১ মিলি পরপর ৩-৫ দিন সব সময়ের জন্য পানিতে দিতে হবে। যে কোনো ভালো অর্গানিক এসিড কোম্পানি নির্দেশিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্গানিক এসিডগুলো কিডনি হতে ইউরেট দূর করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে ভিনেগার ব্যবহার করা যায়।

 

গলাফুলা রোগ
এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে আছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি বেশি দেখা যায়। গলাফুলা একটি তীব্র প্রকৃতির রোগ যা গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা
Pasteurella multocida দ্বারা সংঘটিত হয়। এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি। পশুর শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় এ রোগের জীবাণু থাকে। কোনো কারণে যদি পশু ধকল যেমন ঠা অধিক গরম, ভ্রমণজনিত দুর্বলতা এসবের সম্মুখীন হয় তখনই এ রোগ বেশি দেখা দেয়। গলাফুলা রোগের প্রচলিত নাম ব্যাংগা, ঘটু, গলগটু, গলবেরা এসব।  রোগের লক্ষণ হলো- এ রোগ অতি তীব্র ও তীব্র এ দুইভাবে হতে পারে। অতি তীব্র প্রকৃতির রোগে হঠাৎ জ্বর হয়ে মুখ ও নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে। পশু অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটে। তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত পশু ২৪ ঘণ্টার অধিক বেঁচে থাকে। এ সময় পশুর এডিমা দেখা দেয় যা প্রথমে গলার নিচে, পরে চোয়াল, তলপেট এবং নাক, মুখ, মাথা ও কানের অংশে বিস্তৃৃত হয়। গলায় স্ফীতি থাকলে গলার ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হয়, যা অনেক সময় দূর থেকে শোনা যায়। প্রদাহযুক্ত ফোলা স্থানে ব্যথা থাকে এবং হাত দিলে গরম ও শক্ত অনুভূত হয়। মুচ দিয়ে ছিদ্র করলে সে স্থান হতে হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ বের হয়ে আসে। অনেক সময় কাশি হয় এবং চোখে পিচুটি দেখা যায়। নাক দিয়ে ঘন সাদা শ্লেষ্মা পড়তে দেখা যায়। সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আক্রান্ত পশু মারা যায়।


আক্রান্ত পশুর চিকিৎসায় বিলম্ব হলে সুফল পাওয়া যাবে না। তাই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ রোগের চিকিৎসায় Ampicillin, Tetracycline, Erythromycin, Sulphonamide জাতীয় ইনজেকশন গভীর মাংসে দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ রোগ উচ্ছেদ করা অসম্ভব কারণ এ রোগের জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থায় পশুর দেহে থাকে। রোগ প্রতিরোধ করতে রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে সুস্থ পশুকে টিকা দিতে হবে। মড়কের সময় পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পশুর পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।


ক্ষুরারোগ
এটি ভাইরাসজনিত একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। দুই ক্ষুরওয়ালা সব প্রাণীই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া এ রোগের শিকার হয় বেশি। বাতাসের সাহায্যে এ রোগের ভাইরাস দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগের লক্ষণ হলো- প্রথম অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে এবং লালা ফেনার মতো হয়। পশু খেতে পারে না এবং ওজন অনেক কমে যায়। দুগ্ধবতী পশুতে দুধ অনেক কমে যায়। বাছুরের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা  দেয়ার আগেই বাছুর মারা যেতে পারে। চিকিৎসা ও প্রতিকার হলো আক্রান্ত প্রাণীর মুখ ও পায়ের ঘা পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট  মেশানো পানি বা খাওয়ার সোডা মেশানো পানি দিয়ে দিনে ৩-৪ বার ধুয়ে দিতে হবে। ওষুধ মেশানো পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধোয়ার পরে সালফা নিলামাইড বা এ ধরনের পাউডার লাগাতে হবে। চার ভাগ নারিকেল তেলের সাথে ১ ভাগ তারপিন তেল মিশিয়ে লাগালে ক্ষতস্থানে মাছি পড়বে না।


গরুর বাদলা রোগ
বাদলা রোগ গরুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। ক্লস্ট্রিডিয়াম শোভিয়াই নামক ব্যাকটিরিয়া জীবাণু এ রোগের প্রধান কারণ-
রোগের লক্ষণ তীব্র রোগে প্রথমে জ্বর হয় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পেছনের অংশে মাংসপেশি ফুলে যায়। ফোলা জায়গায় চাপ দিলে পচ পচ শব্দ হয়। আক্রান্ত অংশ কালচে হয়ে যায় ও পচন ধরে। রোগাক্রান্ত প্রাণী দুর্বল হয়ে মারা যায়।


চিকিৎসা ও প্রতিকার অ্যান্টিব্লাকলেগ সিরাম প্রতিটি আক্রান্ত পশুর শিরা বা ত্বকের নিচে ১০০-২০০ মিলিলিটার ইনজেকশন দিতে হবে। অ্যান্টিহিসটামিনিক জাতীয় ইনজেকশন হিস্টাভেট, ডিলারজেন, ফ্লুগান এসব দৈনিক ৬ সিসি করে ৩ দিন মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত ক্ষতস্থান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পরিষ্কার করে টিংচার আয়োডিন গজ প্রয়োগ করতে হবে। আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত পশুকে মাটির নিচে কলিচুন সহযোগে পুঁতে ফেলতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে গোয়ালঘর পরিষ্কার করতে হবে।


ফ্যাসিওলিয়াসিস রোগ
গবাদিপশুর যকৃতে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা ও ফ্যাসিওলা হেপাটিকা নামক পাতাকৃমি দ্বারা সৃষ্ট পশুর রোগকে ফ্যাসিওলিওসিস বলে। রক্তস্বল্পতা, ম্যান্ডিবুলের নিচে পানি জমা, যা দেখতে বোতলের মতো, ডায়রিয়া এবং ধীরে ধীরে কৃশকায় অবস্থায় পরিণত হওয়াই এ রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে প্রায় ২১ ভাগ গরুতে এবং সিলেট অঞ্চলে প্রায় ২১.৫৪ ভাগ ছাগলে ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা পাতাকৃমিতে হয়। রোগের লক্ষণআক্রান্ত পশুর যকৃতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কৃমির মাইগ্রেশনের ফলে যকৃত কলা ধ্বংস হয় এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ কমে যায়। এতে পশুর হাইপোপ্রিটিনিমিয়া তথা বটল জ্বর হয়। বদহজম ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা ও দুর্বলতা দেখা যায়। চোখের কনজাংটিভা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তীব্র যকৃত প্রদাহ এবং রক্তক্ষরণের ফলে লক্ষণ প্রকাশের আগেই পশুর হঠাৎ মৃত্যু ঘটে। চিকিৎসা ও প্রতিকার ট্রাইক্লেবেন্ডাজল বোলাস প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম করে আক্রান্ত পশুকে খাওয়ালে ৯০ থেকে ১০০ ভাগ সুফল পাওয়া যায়। নাইট্রোক্সিলিন ইনজেকশন প্রতি ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.৫ মিলিলিটার হিসেবে গরু, মহিষ ও ছাগলের ত্বকের নিচে প্রয়োগ করে কার্যকরী ফল পাওয়া যায়। সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দুর্বলতা ও রক্তস্বল্পতার জন্য ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ইনজেকশন দেয়া এবং মিনারেল মিকচার খাওয়ানো ভালো। পশুকে সন্দেহজনক স্থান যেমন নিচু জায়গা বা ড্রেনের পাশে ঘাস খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে।


তড়কা রোগ
তড়কা গবাদিপশুর একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। গবাদিপশু থেকে এ রোগে মানুষেও ছাড়ায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত খাদ্য খেয়ে বিশেষ করে নদী-নালার পানি ও জলাবদ্ধ জায়গার ঘাস খেয়ে গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়। রোগের লক্ষণ দেহের লোম খাড়া হয়। দেহের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। নাক, মুখ ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পাতলা ও কালো পায়খানা হয়। লক্ষণ প্রকাশের ১-৩ দিনের মধ্যে পশু ঢলে পড়ে মারা যায়। চিকিৎসা ও প্রতিরোধ রপনিসিলিন/বাইপেন, ভেট/জেনাসিনভেট/এম্পিসিনভেট ইনজেকশন দেয়া যায়। এ ছাড়াও স্ট্রেপটোমাইসিন/অ্যান্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দেয়া যায়। সুস্থ পশুকে পৃথক রাখতে হবে। মৃত পশুর মল, রক্ত ও মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।


আবহাওয়াজনিত কারণে আরও অনেক রোগ সমস্যা দেখা দেয়। শীতের শুরুতে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযাগ করে কাজ করলে এসব সম্যসা থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক বেশি কার্যকর।

 

কৃষিবিদ ডা. সিফাই-ই-রাকিব তিতাস*
*সাভার, ঢাকা

 

বিস্তারিত
মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি

মাছ পচনশীল বলে খুব দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করতে হয়। সচেতনতার অভাবে অনেক মাছ প্রতি বছর পচে যায়। এজন্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অর্থাৎ নিরাপদভাবে মাছ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ফরমালিন ও রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ উচিত নয়। ফরমালিনযুক্ত মাছ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অর্থাৎ নিরাপদভাবে মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলো-
ক. সনাতন পদ্ধতি ১. শুঁটকীকরণ, ২. লবণজাতকরণ।
খ. আধুনিক পদ্ধতি ১. বরফজাতকরণ, ২. হিমায়িত, ৩. টিনজাতকরণ বা ক্যানিং, ৪. ধূমায়িতকরণ।

 

১. শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ বা শুঁটকীকরণ
মাছের দেহ থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিয়ে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় ৮০-৮৫ শতাংশ পানি মাছের দেহ থেকে অপসারণ করা হয়। শুকনো মাছে জীবাণু সংক্রমণ ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। রোদ, সোলার ড্রায়ার ও ওভেনে মাছ শুকানো হয়। শুঁটকি মাছ কয়েক বছর সংরক্ষণ থাকে। সব ধরনের মাছ শুঁটকি করা যায়।


পদ্ধতি : ছোট মাছ যেমন- পুঁটি, মলা, চান্দা, চেলা, ঢেলা, কাচকি ইত্যাদি শুঁটকি করা সহজ। প্রথমে মাছগুলোর মধ্যে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা। মাছগুলো পানিতে ধুয়ে পেটে আঙুল দিয়ে টিপে নাড়িভুঁড়ি বের করতে হয়। এরপর আবার পানিতে ধুয়ে ১০ শতাংশ লবণ পানিতে ১৫-২০ মিনিট রাখা হয় যাতে জীবাণু আক্রমণ না করে। মাছগুলো রোদে চাটাই বা টিনের ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে। দিনে ২-৩ বার উল্টিয়ে দিতে হয়। সাধারণত কড়া রোদে ৪-৫ দিনে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করার উপযোগী হয়।


বড় মাছ শুঁটকীকরণের জন্য প্রথমে মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন- আঁইশ, লেজ, পাখনা, নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা ইত্যাদি অপসারণ করতে হবে। এরপর মাছ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে চাকু দিয়ে মাথার পর থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত আড়াআড়ি শুধু মাংসপেশি কাটতে হয়। এ কাঁচা মাছগুলো প্রথমে চাটাই বা টিনের ওপর রোদে ৩-৪ দিন শুকাতে হয়। এরপর ঝুলিয়ে শুকাতে হয়। এভাবে বড় মাছ শুকাতে ৮-১০ দিন সময় লাগে।


২. লবণজাতকরণ
লবণ জীবাণুনাশক ও জীবাণু প্রতিরোধের কাজ করে। শুষ্ক লবণায়ন পদ্ধতিতে- প্রথমে মাছের আঁইশ ও পাখনা দেহ থেকে সরানো হয়। এরপর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে পানিতে ধুতে হয়। তারপর মাছটির পিঠের দিক থেকে বুক পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে কয়েকটি টুকরায় ভাগ করতে হয়। কিন্তু টুকরাগুলো পেটের দিকে কাটা যাবে না সংযোজন থাকবে। কাটা মাছের দেহের বাইরে ও ভেতরে হাত দিয়ে কয়েকবার ঘসে ভালোভাবে লবণ মাখিয়ে দিতে হয়।


আঙুল দিয়ে চেপে চোখ ও ফুলকার ভেতরে লবণ ঢুকিয়ে দিতে হবে। শতকরা ২৫ ভাগ লবণ দিয়ে মাছ লবণজাত করা হয়। লবণ মিশ্রিত মাছগুলো বাঁশের ঝুড়ি বা কাঠের পাটাতনের ওপর স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হয়। প্রতি স্তরে হালকা লবণের ছিটা দিতে হয়। এরপর মাছগুলো মাদুর বা গোলপাতার চাটাই দিয়ে ঢেকে ১০-১৫ দিন রাখতে হয়। একে রাইপেনিং বলে। পানি ঝরে গেলে লবণজাত মাছগুলো টিনের কৌটায় রেখে গুদামজাত করা হয়। সাধারণত ইলিশ মাছ লবণজাত করে সংরক্ষণ করা হয়।


আর্দ্র বা ভিজা লবণায়ন পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণের জন্য প্রথমে মাছের আঁইশ, ফুলকা ও নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে পানি দিয়ে ধুতে হয়। এরপর মাছের দেহ আড়াআড়ি করে তীর্যকভাবে কাটতে হয়। মাছের টুকরাগুলো ঘষে ভালো করে লবণ মাখিয়ে দেয়া হয়। লবণ মাখানো মাছগুলো টিনের পাত্রে এমনভাবে ভরতে হবে যাতে একটু জায়গা ফাঁকা থাকে। লবণ মাছের দেহে প্রবেশ করে এবং দেহ থেকে পানি বের হয়ে টিনের পাত্রের ফাঁকা জায়গায় জমা হয়। মাছ লবণজাত হতে ১৫-২০ দিন সময় লাগে।


৩. বরফজাতকরণ
বরফের সাহায্যে মাছ সংরক্ষণ হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত মাছের স্বাদ ও গন্ধ টাটকা মাছের মতো থাকে। বরফ দিয়ে মাছ দেহের তাপমাত্রা ০-৩ ডিগ্রি সে. করা হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। বরফ বাক্সে বা কোনো পাত্রে বরফ দিয়ে মাছ রাখা হয়। বরফ গলা না পর্যন্ত মাছ ভালো থাকে। বরফ যাতে না গলে এজন্য বরফ বাক্স তৈরি হয়েছে। শীতকালে মাছের অর্ধেক পরিমাণ বরফ এবং গ্রীষ্মকালে বরফ ও মাছ সমান পরিমাণ করে দিতে হয়।


বরফ বাক্সে মাছ সংরক্ষণের জন্য ৩০ x ২৪ x১৮ ঘন ইঞ্চি আকারের বরফ বাক্স ব্যবহার করা হয়। এতে বরফসহ প্রায় ৪০-৫০ কেজি মাছ ধরে। বাক্সটির বাহির ও ভেতরের দেয়াল জিআই সিট দিয়ে তৈরি। তাপ অপরিবাহী করার জন্য বাহির ও ভেতরের দেয়ালের মাঝখানে ১ ইঞ্চি পুরু কর্কসিট বসানো থাকে। ওপরের ঢাকনাটিও একইভাবে তৈরি। প্রথমে বাক্সের নিচে বরফের ছোট খণ্ডের স্তর দিয়ে মাছ রাখা হয়। এভাবে এক স্তর মাছ একস্তর বরফ দিয়ে বাক্স ভর্তি করে ঢাকনা আটকিয়ে দিতে হয়। এ পদ্ধতিতে সব ধরনের মাছ ১০-১৫ দিন সংরক্ষণ করা যায়।

বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের ঝুড়ি বা অন্য কোনো পাত্রে একস্তর বরফ ও একস্তর মাছ সাজিয়ে মুখ আটকিয়ে দেয়া হয়। এতে মাছ ২-৩ দিন সংরক্ষণ থাকে।
 

৪. হিমায়িতকরণ
এ পদ্ধতিতে মাছের দেহের ভেতরে পানি ও মাংসপেশিকে বরফে পরিণত করে সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত ১৮ ডিগ্রি সে. বা এর নিচে হিমায়িত যন্ত্রের সাহায্যে হিমায়িত করা হয়। সব ধরনের মাছ হিমায়িত করা যায়।
প্রথমে মাছের নাড়িভুঁড়ি, আঁইশ, পাখনা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানিতে ধুতে হবে। এরপর ২০-৮০ ভাগ ক্লোরিন পানিতে মাছগুলো ডুবিয়ে রাখতে হবে। মাছ বেশি বড় হলে ছোট টুকরা করা যেতে পারে। টুকরাগুলো ১০-১২ ভাগ সোডিয়াম ট্রাইফসফেট দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর পানি ঝরিয়ে মাছগুলো ফ্রিজের ব্লক্সের মধ্যে রাখা হয়। হিমাগার বা ফ্রিজের তাপমাত্রা -৩৫ ডিগ্রি থেকে -৪০ ডিগ্রি সে. রাখতে হয়। মাছ ফ্রিজিং হতে সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা।


৫. ধূমায়িতকরণ
কাঠ পোড়ানো ধোঁয়া দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। কাঠ পোড়ানো ধোঁয়ার তাপমাত্রা ও ধোঁয়ার কণা একত্রে মাছের দেহ থেকে পানি শুকিয়ে দেয়। মাছে অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন-আঁইশ, পাখনা, লেজ, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। এরপর বড় মাছ টুকরা করে ৬০-৭০ শতাংশ লবণ দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরিয়ে মাছগুলো ধূম্র ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। চিমনির মেঝেতে কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করা হয়। চিমনির বহির্গমন পথ বন্ধ থাকায় সব ধোঁয়া ঘরের মধ্যে জমা হবে। এতে ঘরে তাপমাত্রা ও ধোঁয়া বাড়ে। এভাবে ১০-১২ ঘণ্টা ধূমায়িত করলে মাছের দেহের পানির পরিমাণ ৮০-৮৫ শতাংশ কমে। এরপর ঘর থেকে মাছ বের করে ঠাণ্ডা করে প্যাকিং করা হয়। এ মাছ ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।


৬. ক্যানিং বা টিনজাত পদ্ধতি
মাছ প্রক্রিয়াজাত করে বায়ুশূন্য পাত্রে সংরক্ষণ করাই হচ্ছে ক্যানিং। এ পদ্ধতিতে তিন বছর পর্যন্ত  মাছ সংরক্ষণ করা যায়। প্রথমে মাছের মাথা, পাখনা, আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। মাছ টুকরা করা হয়। টুকরা মাছ লবণ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। পুনরায় পরিষ্কার পানিতে ধোয়া হয়। লবণ দ্রবণে মাছের টুকরাগুলোকে সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। এ সিদ্ধ মাছগুলো জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টিনের কৌটায় স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রতি স্তরে বিভিন্ন রকম মসলা, তেল, সস, লবণ ইত্যাদি দিতে হয়। এভাবে টিনের কৌটা ভর্তি করতে হবে যাতে কোথাও ফাঁকা না থাকে। তবে টিনের কৌটার ওপরে ঢাকনার নিচে একটু ফাঁকা রাখতে হবে। মেশিনের সাহায্যে কৌটাকে বায়ুশূন্য করে মুখ বন্ধ করতে হবে। কৌটার বহির্ভাগের ময়লা সোডিয়াম ফসফেট মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে ধুতে হয়। এরপর উচ্চতাপ দিয়ে কৌটার ভেতরে মাছকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এখানে ১২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৫০-৬০ মিনিট উত্তপ্ত করা হয়। তাপ দেয়া শেষ হলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে কৌটা ঠাণ্ডা করতে হবে। এরপর টিনের কৌটার গায়ে লেবেলিং করা হয়। লেবেলিং কাগজে মাছের জাত, ওজন, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোউর্ত্তীণের তারিখ, কোম্পানির নাম, মাছ ছাড়া অন্যান্য দ্রব্যের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ থাকে।

 

কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ*
*কৃষি প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল; ০১৭১১-৯৫৪১৪৩

বিস্তারিত
কবিতা (অগ্রহায়ণ ১৪২৪)

অগ্রহায়ণে ব্যস্ত চাষি
মো. জন্নুন আলী প্রামাণিক*

শীতের শীতল আবেশ নিয়ে জলবায়ুর যাত্রা,
স্বভাব বদলে ভীষণ দক্ষ রূপরাশির বার্তা।
দুইটি মাসের ভেতর তার মৌসুমচিত্র ফোটে,
শীতের সোহাগ স্নেহের ধারা শাকসবজি মাঠে।
ঋতুর বাঁধনে নিজেকে গড়ে বাংলাদেশে তাই,
এরূপ নিয়ম এখানে শুধু অন্য কোথাও নাই,
আজব ব্যাপার অবাক করা চাল চলনে সদা,
বিগড়ে যাওয়া ব্যাপার হলে নানা প্রকার বাধা।
চাষির শীতের ফসল যত অনুকূলতা পেলে,
কোমল রোদের ছোঁয়ায় মেতে যথানিয়মে ফলে।
আলুর ক্ষেতের সবুজ পাতা হেলে দুলিয়ে থাকে,
মাটির বুকের আহার খেয়ে ফলনশক্তি বুকে।
সুষম সারের সেচের জোরে নানাপ্রকার শস্য,
বিশুদ্ধ সকল সবজি শাকে মন মাতানো দৃশ্য।
বিচিত্র জাতের ক্ষেতের শোভা সুচারুরূপে বাড়ে,
রাতের শিশির ভিজায় অঙ্গঁ সোহাগমাখা ঘোরে।
সরিষা কলাই গমের কচি ক্ষেত খামারে রূপ,
শীতের নিঝুম রাতের ঘুমে পাখপাখালি চুপ।
খেজুর গুড়ের সুঘ্রাণ ছোটে এলোপাতারি চলে,
গাছের আজব দানের কথা প্রতিনিয়ত বলে।
আগাম বপন চলতি চাষে প্রস্তুতিসব সেরে,
আমন তোলার সাথেই জমি আবাদযোগ্য করে।
কলের লাঙ্গল চালায় জোরে আবহাওয়া দেখে,
কোমল আলোয় শুকায় মাটি চঞ্চলতার চোখে।
সারের জোগান আগের থেকে জৈবসারটি বেশি।
সবুজ সারের প্রয়োগ দিলে বুকজুড়ানো হাসি।
বপন রোপণ সময় বুঝে অগ্রহায়ণ জুড়ে।
কৃষাণ-কৃষাণী সারাটি দিন দেখাশোনায় ঘুরে।

 

আইএফএম মাঠ দিবস
মো. মাজেদুল ইসলাম (মিন্টু)**

চলো ভাই, আইএফএম এর মাঠ দিবসে যাই,        
উন্নয়নের জোয়ার উঠেছে, আইরে চাষি ভাই।
বসতবাড়িতে খামার প্রযুক্তি প্রদর্শিত হয়,
খামারে কখন কি করণীয় এফএমএ-তা কয়।
খামার উপাদান ফল, সবজি, ধান, মাছের চাষ,
হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের, আদর্শ ঘরে বাস।
একটির সাথে অন্যটির আন্তঃসম্পর্ক আছে,
লাল নীল রশি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে।
ধান চাষের সমন্বিত কৌশল, পূর্বের সাথে তুল না,
সমন্বিত কৌশলে ফলন বেশি, একথাটি ভুল না।
ধান ফসলের বন্ধুপোকা করো সংরক্ষণ,
সমন্বিতভাবে শক্রপোকা মারো সর্বক্ষণ।
মুরগি পালন উন্নত হাজলে, পানি খাবার দেশি,
মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকে বাচ্চা ফুটে বেশি।
কম সময়ে অধিক ডিম, বাচ্চা পৃথক হলে,
নেট দিয়ে দ্বিতল ঘর বানাও সবাই মিলে।
আদর্শ ঘর বানাও সবাই, পরিকল্পনা করে,
সুষম খাদ্য দাও পশুকে দুপুর সন্ধ্যা ভোরে।
মাংস বেশি, দুধ বেশি, পশু থেকে পাবে,
রোগ হলে চিকিৎসা করো, সম্মিলিত ভাবে।
বসত বাড়ির পতিত জায়গয় ফল-ফলাদির চাষ,
নিয়মিত ফল পেয়ে, মিটবে মনের আশ।
রৌদ্রজ্জ্বল ফাঁকা জায়গায়, শাকসবজির চারা,
অপুষ্টি দূর হবে, টাটকা সবজি দ্বারা।
মাছ চাষে অধিক লাভ, খাদ্য পুষ্টি মিলে,
আদর্শ পুকুরে সঠিক মাত্রায় খাদ্য, চুন, দিলে।
আইএফএম-এর যুক্তি নিয়ে করো সমিতি,
কাজ করো মিলে মিশে, হবেই উন্নতি।

*গ্রাম-বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা-ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম **উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, পাবনা সদর, পাবনা, মোবাইল : ০১৭১৭৪৬৬৯৯৮                                

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (অগ্রহায়ণ ১৪২৪)

সবিতা রায়, গ্রাম : মৌতলা, উপজেলা : কালীগঞ্জ, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : নারিকেলের ছোট ফলগুলো ঝরে পড়ছে। ঝরা ফলগুলোর মুখ কালো। কী করব?
উত্তর : নারিকেল গাছের ফল ঝরে পড়ে যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমওপি বা পটাশ সারের অভাবে। সে কারণে নারিকেল গাছের বয়স জেনে সুষম মাত্রার সার প্রয়োগ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ১-৪ বছর বয়সী গাছের জন্য গোবর ১০ কেজি, ইউরিয়া ২০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪০ গ্রাম, বরিক এসিড ১০ গ্রাম গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ৩ ফুট বাদ দিয়ে মাটি কুপিয়ে ৮-১২ ইঞ্চি মাটির গভীরে সারগুলো প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ করতে হয় দুই কিস্তিতে। প্রথম কিস্তিতে অর্ধেক সার মধ্য  বৈশাখ থেকে মধ্য  জ্যৈষ্ঠ (মে) এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে বাকি অর্ধেক সার মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাসে। নারিকেল গাছের বয়স ৫-৭ বছর ও ৮-১০ বছর বয়স হলে ১-৪ বছর বয়সী নারিকেল গাছের সারের মাত্রাকে ২ ও ৩ গুণ করে নিয়মমাফিক প্রয়োগ করলেই কাক্সিক্ষত ফলন পাবেন। নারিকেল গাছের ঝরা ফলগুলো কালো হয় মাকড় বা মাইটের কারণে। সেজন্য ভালো হয় এবামেকটিন গ্রুপের যে কোনো ভালো মানের মাকড়নাশক আক্রান্ত নারিকেল গাছে সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করা।


মো. সিদ্দিক হায়দার, গ্রাম : বাহুগুলপুর, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া
প্রশ্ন : পটোল গাছের কাণ্ড ও পাতা বাদামি-কালো হচ্ছে, শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কী করব ?

উত্তর : পটোল গাছের কা- ও পাতা বাদামি-কালো হয়ে যায় অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণে। সেজন্য এ রোগ দমনে প্রপিকোনাজল গ্রুপের যেমন টিল্ট নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে বিকাল বেলায় পুরো পটোল গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করা। এভাবে ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলেই আপনি সুফল পাবেন।  


সুজিত কুমার বিশ্বাস, গ্রাম : করোলিয়া, উপজেলা : তেরখাঁদা, জেলা : খুলনা
প্রশ্ন : আমার পানের বরোজে পান গাছের লতা পচে যাচ্ছে। প্রতিকারের উপায় কী ?

উত্তর : পানের বরোজে লতা/কাণ্ড পচা বা ভাইন রট হয় ফিউজিরিয়াম নামক ছত্রাকের আক্রমণে। এ রোগ দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থায় রোগাক্রান্ত লতা/কা-গুলো পানের বরোজ থেকে উঠিয়ে দূরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। এছাড়া পানের বরজে পানের লতায় রোদ সরাসরি পড়তে না দেয়া। কিন্তু রোগটি বেশি পরিমাণে দেখা দিলে টেবুকোনাজল ও ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন গ্রুপের নাটিভো প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৮ গ্রাম কিংবা সানভিট/ ব্লিটক্স প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে রোগাক্রান্ত পান গাছে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তবেই আপনি কাক্সিক্ষত পানের ফলন পাবেন।


মো. ফজলুর রহমান, গ্রাম : সরফরাজপুর, উপজেলা : চৌগাছা, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : পেয়ারা গাছের পাতা ও ডাল শুকিয়ে পাতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এভাবে গাছটি মারা যাচ্ছে। কিভাবে প্রতিকার করব?

উত্তর : পেয়ারা গাছের এ সমস্যাটি ফিউজিরিয়াম নামক ছত্রাকের আক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। একে পেয়ারার উইল্ট বা ঢলে পড়া রোগ বলে। এ রোগটি যে কোনো বয়সে হতে পারে। রোগের শুরুতেই সানভিট/ ব্লিটক্স প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে রোগাক্রান্ত  পেয়ারা গাছে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। এ রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটি হলো পেয়ারা বাগানে পানি জমতে না দেয়া। পানি জমার সাথে সাথেই তা নিকাশ করা। আর আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে জিপসাম বা চুন প্রয়োগ করা।


আরিফুর ইসলাম, গ্রাম : কেরাদারি, উপজেলা : রাজারহাট, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : গরুর মুখ এ ঘা হয়েছে এবং লালার মতো পড়ছে। পায়ের ক্ষুরেও ঘা হয়েছে। তাপমাত্রা বেশি এবং কিছু খেতে চাচ্ছে না। এর প্রতিকার কী?

উত্তর : গরুর মুখের ঘা ও পায়ের ক্ষুরের সমস্যাগুলো দূর করার জন্য এফ এমডি কিউর দিয়ে মুখ ও পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করতে হবে দিনে ২-৩ বার। এছাড়া এপথোকেয়ার পাউডার মুখের ক্ষতে লাগাতে হবে ২৫ গ্রাম করে ৫-৭ দিন পর্যন্ত। বাইপেন ভেট ইনজেকশন দিতে হবে। সাথে এইস ভেট বোলাস খাওয়াতে হবে।  


মো. ওয়াহিদ, গ্রাম : ফিংড়ি, উপজেলা : সাতক্ষীরা সদর, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : গাভীর ওলান ফুলে গেছে। ওই জায়গাটা গরম হয়ে রয়েছে। বাট শক্ত হয়ে গিয়েছে। কী করব ?

উত্তর : এমপিসিন ভেট ইনজেকশন দিতে হবে ৩-৫ দিন মাংসে। অ্যান্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন মাংসে দিতে হবে ৩-৫ দিন পর্যন্ত। কপভেট ইনজেকশন মাংসে প্রয়োগ করতে হবে ৩ দিন পর্যন্ত। ম্যাস্টিকেয়ার প্লাস পাউডার খাওয়াতে হবে ৩০ গ্রাম ওষুধ ২ বেলা করে ৩-৫ দিন।

 

রকিবুল ইসলাম, গ্রাম : পাটগা মুন্সীপাড়া, উপজেলা : রানীশঙ্কর, জেলা : ঠাকুরগাঁও

প্রশ্ন : কবুতরের মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে। টোনা শক্ত হয়ে আছে। কিছু খায় না। কী করণীয়?
উত্তর : অ্যামোডিস ভেট অথবা মেট্রো ভেট পাঁচ ভাগের এক ভাগ করে পানিতে গুলে ড্রপ দিয়ে ৩/৪ ফোঁটা করে দিনে ২ বার খাওয়াতে হবে। তাহলে আপনার কবুতরের সমস্যাটি দূর হয়ে যাবে।

 

মো. ফেরদৌস আলম, গ্রাম : রানীগঞ্জ, উপজেলা : দিনাজপুর সদর, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : পানির রঙ গাঢ় সবুজ, মাছ মরে যাচ্ছে। কী করব?

উত্তর : অতিরিক্ত প্লাংকটন তৈরি হওয়ার কারণে এবং অক্সিজেনের অভাব হলে এমনটি হয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য চুন ১ কেজি/শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। খাবার ও রাসায়নিক সার সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে এবং পানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। তুঁতে ১২-১৪ গ্রাম/ শতক হারে ছোট পোটলায় বেঁধে ওপর থেকে ১০-১৫ সেন্টিমিটার নিচে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখলে ভালো হয়। সিলভার কার্প মাছ ছাড়তে হবে।

 

মো. বদরুল হোসেন, গ্রাম : সাকোয়া  উপজেলা : বোদা, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : মাছের ফুলকা পচা রোগ হয়েছে, কী করব?

উত্তর : ট্রাইকোডিনা নামক এককোষী পরজীবী দ্বারা এ রোগ হয়। বড় মাছের চেয়ে পোনা মাছের ক্ষেত্রে এ রোগ বেশি হয়। ফুলকার রক্তক্ষরণ স্থান ফুলে যায়। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়। আক্রান্ত মাছ দ্রুত মারা যায়। এ সমস্যার সমাধানে চুন ১ কেজি/শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ডাইরেক্স প্রতি বিঘায় ২০০ গ্রাম করে ২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। ঘা যুক্ত মাছগুলোকে পুকুর থেকে তুলে ২০ লিটার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। তারপর পটাশিয়াম প্যারম্যাঙ্গাটের দ্রবণে ৫ মিনিট রাখতে হবে। প্রতি কেজি খাবারের সাথে টেরামাইসিন ট্যাবলেট একটি করে এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।


মো. সাইফুল ইসলাম, গ্রাম : শ্রীপুর কুমারিয়া, উপজেলা : জামালপুর সদর, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : ছাদ বাগানে লাগানোর জন্য কোনো ধরনের লেবুর জাত উপযোগী? পরিচর্যা বিষয়েও জানাবেন।

উত্তর : ছাদ বাগানের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি লেবু-২ ও ৩ জাতের চারা লাগাতে পারেন। এ দুইটি লেবুর গাছ থেকে আপনি সারা বছরই ফলন পাবেন। তবে বারি লেবু-৩ এর ফলন বর্ষাকালে ভালো হয়। লেবুর চারা লাগানোর আগে টিনের হাফ ড্রামে ১০ থেকে ১৫ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম এমওপি সার ভালো করে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। সার মেশানোর ১৫ দিন পর আপনি আপনার কাক্সিক্ষত জাতের লেবুর কলমের চারা লাগাবেন। লেবুর চারাটি ড্রামের মাঝখানে গর্ত করে সোজাভাবে লাগাবেন। এ কাজটি বিকেল বেলা করবেন। তারপর হালকা সেচ দিয়ে দিতে হবে। লেবুর চারাটি অবশ্যই একটি শক্ত খুঁটি দিয়ে আলগা করে বেঁধে দিবেন। লেবু গাছে সার প্রয়োগ করতে হয় বছরে তিনবার। সেক্ষেত্রে প্রথম কিস্তি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন মাসে। গাছভেদে সার প্রয়োগমাত্রা ভিন্ন হয়। সেজন্য ১-২ বছর বয়সী গাছের ক্ষেত্রে লেবুর চারা গাছ লাগানোর মাত্র মতো দিলেই হবে। কিন্তু ৩-৫ বছর বয়সী লেবুর গাছের জন্য উল্লিখিত মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ করতে হবে। আর যদি গাছের বয়স ৬ বছরের বেশি হয় তবে পচা গোবর ২৫ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম ও এমওপি ৪০০ গ্রাম তিনভাগে ভাগ করে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। গাছের গোড়া থেকে শোষক শাখা বের হলে অবশ্যই তা কেটে দিতে হবে। নাহলে গাছের বাড়বাড়তি ও ফলন ভালো হবে না। ভালো ফলনের জন্য লেবু গাছে ছাটাইয়ের প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাস। আশা করি, এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি ছাদ বাগানে লেবুর ভালো ফলন পাবেন।


কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতিত যে  কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুল সহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
*উপজেলা কৃষি অফিসার এলআর, সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা 
suman_arefin@yahoo.com

 

 

বিস্তারিত
পৌষ মাসের কৃষি (অগ্রহায়ণ ১৪২৪)

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শীতের শুভেচ্ছা। হেমন্ত শেষে ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে শীত এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝে। বাংলার মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় লেপের উষ্ণতাকে ছুড়ে ফেলে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
 

বোরো ধান
অতিরিক্ত ঠাণ্ডার সময় রাতের বেলা বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনের বেলা তুলে ফেলতে হবে। এতে চারার ভালোভাবে বেড়ে ওঠে;
চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিতে হবে;
মূল জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে;
জমিতে জৈব সার দিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে দিতে হবে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার;
চারার বয়স ৩০-৪০ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ শুরু করতে পারেন;
ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।

 

গম
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে;
চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গম ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে;
সেচ দেয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে;
গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।

 

ভুট্টা
ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে;
গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হবে ;
গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে;
ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।

 

আলু
চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে।  ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে।
আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে।  মড়ক রোগ দমনে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে।  
আলু  গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির  সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে।
আলু তোলার পর  ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

তুলা
তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০ শতাংশ বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০ শতাংশ পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে;
রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়;
ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।

 

ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন;
সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে;
আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।

 

শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে।
টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবিকইন ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
টমেটো সংগ্রহ করে বাসায় ৪-৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করার জন্য আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলো পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।


শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদা মাফিক নিয়মিত সেচ দিতে হবে;
এছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।

 

গাছপালা
গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা কাঠ গাছের যত্ন নিতে হবে।
গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।
রোগাক্রান্ত গাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে।
গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে।

 

প্রাণিসম্পদ
শীতকালে পোলট্রিতে অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব সমস্যা দেখা যায়। তাই প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে;
মোরগ-মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড খাওয়াতে হবে।
শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে;


এ সময় হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো- হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ  রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে;
গাভীর জন্য শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি;  


শীতকালে ছাগলের নিউমোনিয়া রোগটি খুব বেশি হয়। যদি ৫ দিনের বেশি কাশি ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় তবে বুঝতে হবে প্যারাসাইটের জন্য নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়াতে সেফটিয়াক্সোন ও টাইলোসিন ব্যবহারে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

মৎস্যসম্পদ
শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়;
শীতের সময় কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। এ রোগ প্রতিরোধে মাছের ক্ষত রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে।


সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন অনেকখানি বেড়ে যাবে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ 
manjur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon