Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ব্রি ধান৬২ : জিঙ্কসমৃদ্ধ স্বল্প জীবনকালীন আমন ধানের জাত

জিঙ্ক মানবদেহের একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তাসহ নানাবিধ শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ার জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। মানবদেহের ২০০-এর অধিক এনজাইমের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য জিঙ্ক একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। এর অভাবে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি যেমন-ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিণামে শিশুদের অকাল মৃত্যুসহ বুদ্ধিমত্তা হ্রাসের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি বিনির্মাণে বিরাট অন্তরায়।  


আমাদের দেশের শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মানুষ বিশেষ করে শিশু ও নারীদের জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। আর্থসামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশের বহু দরিদ্র মানুষ দৈনন্দিন পুষ্টির জন্য একমাত্র ভাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভাতে অন্যান্য খনিজ উপাদানের মতো জিঙ্কের পরিমাণও কম থাকে। প্রচলিত উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে জিঙ্কের গড়পড়তা পরিমাণ ১৫-১৬ মিলিগ্রাম। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভাতে জিঙ্কের পরিমাণ যদি এর গড় মাত্রা থেকে মাত্র ৮ মিলিগ্রাম বাড়িয়ে ২৪ মিলিগ্রাম করা যায়, তবে আমাদের মতো দেশগুলোর দরিদ্র মানুষের দৈনিক জিঙ্ক চাহিদার কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব।


এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ২০০২ সন থেকে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। এ ক্ষেত্রে ব্রি ধান৬২ আমাদের প্রথম সাফল্য। এতে প্রতি কেজি চালে জিঙ্ক রয়েছে ১৯ মিলিগ্রাম। এটি আমন মৌসুমের উপযোগী আগাম জাত। সঠিক পরিচর্যায় এ জাতটি মাত্র ১০০ দিনে হেক্টরপ্রতি ৪.৫ টনের অধিক ফলন দিতে পারে। যেসব এলাকায় কৃষক আমন ধান কেটে একই জমিতে আগাম আলু বা শীতকালীন সবজি আবাদ করে অধিক লাভবান হতে চান সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি বিশেষ উপযোগী। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের ধান অবমুক্ত করেছে।


আমাদের দেশের স্থানীয় জাত জিরাকাটারী ধানের সাথে ব্রি ধান৩৯ এর সঙ্করায়ন করে চিরায়ত প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি ইনব্রিড বা স্বপরাগী জাত বিধায় ফসল উৎপাদনে  কৃষক নিজেদের সংরক্ষিত বীজ নিজেরা ব্যবহার করতে পারবেন, অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না।


২. শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৮ সেমি.।
গড় জীবনকাল ১০০ দিন।
ডিগ পাতা খাড়া ও  গাঢ় সবুজ রঙের।
১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৪ গ্রাম।
চালের আকার আকৃতি লম্বা, সরু এবং রঙ সাদা।
এ জাতের প্রতি কেজি চালে ১৯.৬ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে শতকরা ৯ ভাগ প্রোটিন।
হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৫ টন

 

৩. প্রচলিত জাতের তুলনায় এর উৎকর্ষতা
এ যাবতকালে অবমুক্ত আমন ধানের সর্বনিম্ন জীবন কালীন জাত।
ব্রি ধান৫৭ এর  চেয়ে ব্রি ধান৬২ সাত দিন এবং ব্রি ধান৩৩ ও বিনা ধান৭ এর চেয়ে  ১০-১৫ দিন আগে পাকে বিধায় আমন ধান কেটে একই জমিতে অনায়াসে আগাম গোল আলু বা রবিশস্য লাগানো সম্ভব।
এ ছাড়াও স্বল্প জীবনকাল হওয়ার এ জাতটি সহজেই খরা এড়িয়ে যেতে পারে।
প্রচলিত জাতের চেয়ে উচ্চমাত্রায় জিঙ্ক ও প্রোটিন থাকায় এ ধানের ভাত নিয়মিত গ্রহণে অসচ্ছল ও গরিব জনগোষ্ঠীর জিঙ্কজনিত অপুষ্টি দূরীকরণে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

 

৪. চাষাবাদ পদ্ধতি
এ ধানের চাষাবাদ অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। মাঝারি উঁচু থেকে উঁচু জমি এ ধান চাষের জন্য উপযুক্ত। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ৫ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই অর্থাৎ ২১ আষাঢ় থেকে ৩০ আষাঢ়।

 

বীজ বাছাই ও জাগ দেয়া এবং বীজ হার
রোগ, পোকা ও দাগ মুক্ত এবং পরিপুষ্ট বীজ হাত দিয়ে বেছে নিলে ভালো হয়। বীজ বাছাইয়ের কাজটি পরিবারের সবাই মিলে অবসর সময়ে করা যেতে পারে। বাছাইকৃত সুস্থ-সবল বীজ থেকে উৎপাদিত চারা গুণগত মানসম্পন্ন হবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে।
বাছাইকৃত বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে নিয়ে চটের ব্যাগ কিংবা ছালায় জড়িয়ে জাগ দিয়ে গজিয়ে নিতে হবে। ব্যাগ বা চট শুকিয়ে গেলে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।
শতকরা ৮০ ভাগ গজানোর ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ পাতলা করে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ গ্রাম বা শতকে ২ কেজি হারে বীজতলায় ফেলতে হবে। এতে সবল, সতেজ ও মোটাতাজা চারা উৎপন্ন হবে ।


বীজতলা তৈরি, সার প্রয়োগ ও চারা উৎপাদন

ভালো মানের চারা পেতে আদর্শ বীজতলা তৈরি করা প্রয়োজন। আদর্শ বীজতলা তৈরি করার জন্য নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

সেচ সুবিধাযুক্ত এবং প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন স্থান বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।

 

বীজতলার জমিতে এক সপ্তাহ আগে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে ঘাস ও খড়-কুটা পচিয়ে নিতে হবে। অতঃপর ভালোভাবে জমি চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। সুস্থ-সবল ও মোটা তাজা চারার জন্য শেষ চাষের সময় নিম্নোক্তহারে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে-


সারের নাম    প্রতি শতাংশে    প্রতি বর্গমিটারে
গোবর    ৪০ কেজি    ১ কেজি
ইউরিয়া    ৫২৮ গ্রাম    ১৩ গ্রাম
টিএসপি    ২৫৩ গ্রাম    ৬ গ্রাম
দস্তা    ৮০ গ্রাম    ২ গ্রাম
ফুরাডান    ৪০ গ্রাম    ১ গ্রাম


জমির একপাশ থেকে ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) চওড়া করে লম্বালম্বিভাবে বীজতলা তৈরি করতে হবে।


দুই বীজতলার মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার (১৯.৬৯ ইঞ্চি) জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে এবং এ ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে দুই পাশের বীজতলাকে একটু উঁচু করতে হবে। এতে ফাঁকা জায়গায় নালার সৃষ্টি হবে। এ নালা দিয়ে প্রয়োজনে পানি সেচ দেয়া যাবে বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া যাবে এবং নালায় প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখা যাবে।


বীজ বপনের আগে বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে বীজতলাকে ভালোভাবে সমান করে নিতে হবে।
গজানো বীজ পাতলা করে সমহারে বীজতলায় ফেলতে হবে।

 

 

জমি তৈরি ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ

চারা রোপণের দুই সপ্তাহ আগে জমিতে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা ও খড়-কুটা পচিয়ে নিতে হবে।

 

ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে এবং শেষ চাষের আগে  প্রাথমিক সার  ছকে উল্লিখিত হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

সারের নাম    কেজি-হেক্টর    কেজি-বিঘা    গ্রাম-শতাংশ
টিএসপি       ৫২.৫    ৭    ২১২
এমপি         ৮২.৫    ১১   ৩৩৪
জিপসাম      ৬০    ৮      ২৪৩

দস্তা           ১০   ১.৩    ৪০
 

সর্বশেষ জমি প্রস্তুতের সময় সবটুকু টিএসপি, এমপি সার, অর্ধেক জিপসাম এবং অর্ধেক জিঙ্ক সালফেট সার একসাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক এমপি সার ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক জিংক সালফেট ১ম কিস্তি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হলে জিপসাম ইউরিয়ার মতো উপরিপ্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

রোপণ দূরত্ব ও চারার বয়স
প্রতি গোছায় ২ থেকে ৩টি ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত ১৫ সেমি. রাখতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে প্রত্যেক গাছ সমানভাবে আলো, বাতাস ও সার গ্রহণের সুবিধা পাবে, এর ফলে ফলনও বেশি হবে। জমির উর্বরতাভেদে রোপণ দূরত্ব কম বেশি করা যেতে পারে


সার উপরিপ্রয়োগ
ধান লাগানোর ১০ দিন পর জমি আগাছামুক্ত করে প্রথম কিস্তি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি হেক্টরে ৮৫ কেজি (শতকে ৩৪০ গ্রাম) ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার গোছায় ৪-৫টি কুশি দেখা দিলে (প্রথম কিস্তির ১৫-২০ দিন পর) প্রতি হেক্টরে আরও ৮৫ কেজি (শতকে ৩৪০ গ্রাম) ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ভালো ফলন পেতে ইউরিয়া সারের পরিবর্তে প্রতি চার গোছার মাঝে ২টি করে গুটি ইউরিয়া (১.৮ গ্রাম) প্রয়োগ করা যেতে পারে।


অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
সাধারণত ধানগাছ যত দিন মাঠে থাকে তার তিন ভাগের প্রথম এক ভাগ সময় আগাছামুক্ত রাখলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত প্রতি কিস্তি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের পর পরই আগাছা পরিষ্কার করে মাটির ভেতর পুঁতে দিলে জমির আগাছাও যেমন নির্মূল হবে তেমনি তা পচে গিয়ে জৈবসারের কাজ করে। জমিতে ১০-১৫ সেমি. পানি রাখতে পারলে আগাছার উপদ্রব কম দেখা দিবে। প্রয়োজনে আগাছানাশক কমিট ৪০০ মিলি ১০ কেজি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রতি একর জমিতে ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।


পানি সেচ
রোপণের পর থেকে কাঁইচ থোড়-ফুল আসা এবং দুধ আসা পর্যন্ত জমিতে পানি থাকা জরুরি। এ সময় খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য ধানের দানা বাঁধা অবস্থা পর্যন্ত সেচ দেয়া প্রয়োজন।


ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালই দমন
অন্যান্য আমন ধানের মতোই এ জাতের ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। পোকা বা রোগাক্রান্ত হলে তা দমনে সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রধান ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করে এ ধানের ফলন শতকরা ২৫ ভাগ বাড়ানো যায়।

জমিতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা করে মাজরা পোকা সহজেই দমন করা যায়। এ ছাড়াও ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি হেক্টর ৭৫ গ্রাম বা প্রতি বিঘা জমির জন্য ১০ গ্রামের ১ প্যাকেট ভিরতাকো ব্যবহার করা যেতে পারে ।

প্রয়োজনে অন্য কীটনাশক যেমন কুরাটার-ভিটাফুরান ৫জি, মার্শাল ২০ ইসি, সানটাপ ৫০ এসপি, ডায়াজিনন ৬০ ইসি ইত্যাদি পোকাভেদে অনুমোদিত হারে স্প্রে করে দমন করা যেতে হবে।

জমিতে পাতাপোড়া রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হবে। জমি থেকে পানি সরিয়ে শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিয়ে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি এমপি সার গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করলে পাতাপোড়া রোগের প্রকোপ কিছুটা কম হবে।

জমিতে খোলপচা রোগের প্রকোপ হলে ছত্রাকনাশক ফলিকুর (টেবুকোনাজল) ১০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়াও কনটাফ (হেক্সাকোনাজল) বা টিল্ট (প্রপিকোনাজল) স্প্রে করা যেতে পারে। প্রথম স্প্রে করার ৭ দিন পর  আর একবার স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।


ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ  
শিষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ দানা সোনালি রঙ ধারণ করলেই ফসল কেটে মাড়াই করতে হবে এবং অন্তত  ৪-৫ বার রোদ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ধানের বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শীষের শতকরা ৯০-১০০ ভাগ পাকার পর জমি থেকে আগাছা এবং অন্য ধানের জাত সরিয়ে ফেলে ফসল কাটতে হবে এবং আলাদাভাবে মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালোভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে যাতে আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে।

 

ড. পার্থ সারথী বিশ্বাস*

* প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১

বিস্তারিত
বন্যাকবলিত এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয়

প্রায় প্রতি বছরই আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা হয়ে থাকে এর কারণ স্বল্প সময়ে অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা মৌসুমে বন্যা, আকস্মিক বন্যা,  উপকূলীয় বন্যা এবং উজানের দেশ ভারত, ভুটান ও চীন হতে ঢল হিসেবে আসা পানি। সুনামগঞ্জ, সিলেট নেত্রকোনা, নিলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুরর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলো এ জলাবদ্ধতা লক্ষণীয় মাত্রায় চোখে পরে। বন্যা ও জলাবদ্ধতার ব্যাপকতার ওপর ক্ষতির ধরন ও পরিমাণ নির্ভর করে। দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি আকস্মিক বন্যা ও জলাবদ্ধগ্রস্ত। দেশের এ জলাবদ্ধ স্থানগুলো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করে এবং এই সময়টা ভাসমান ফসল চাষের আওতায় এনে দেশে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।


বাংলাদেশের এর বিশাল অঞ্চল সমুদ্র লেবেল প্রায় ২ মি. নিচে অবস্থতি এবং জোয়া-ভাটার প্রতি খবুই স্পর্শকাতর। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তন এ সমস্যাকে আরও অধিকতর মন্দ করেছে। এর ফল স্বরূপ দেশ শস্য উৎপাদন কমছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে এর সাথে জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বয়রা (Baira) ফসল চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করছে।


বিভিন্ন এনজিও যেমন, Bangladesh, Centre for Advanced Studies (BCAS) এবং তার সহযোগী স্থানীয় সংগঠন বন্যা কবলিত ও জলাবদ্ধ উপকূল ও লবণাক্ত এলাকায় (Floating vegetable bed cultivation) ভাসমান সবজি চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ করছেন। যাহা স্থানীয় জনগণ ও সম্পৃক্ত কৃষক পরিবারের কর্মসংস্থান, আয়, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অধিকন্তু এর মাধ্যমে উপকূলীয় বন্যাকবলিত এলাকার জনগোষ্ঠীর বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে চলার অভিজোযন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

স্বল্প পরিশরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু গ্রামের কৃষকরা করে আসছে। এটা মূলত পানির উপর মাটিবিহীন ভেলা, জলজ উদ্ভিদ যেমন কচুরিপানা, হেলঞ্চা ইত্যাদি, গোবর ও কম্পোস্টের মিশ্রণের ওপর সবজি চাষ যাকে ভাসমান বাগান বলে (Floating gander) স্থানীয়ভাবে এর নাম বয়রা (Baira)
এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত উদ্ভিদ ভেলার উপর কম্পোস্ট ও পানি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। বন্যা ও জলাবদ্ধ অবস্থায় ক্ষেতের ফসল পানিতে পচে যায় কিন্তু ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে ফসল সার্বিকভাবে বেড়ে উঠতে সক্ষম।


এ প্রচলিত পদ্ধতিকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও গবেষণার সহায়তার আরও উন্নয়ন ও টেকসই করতে হবে। প্রযুক্তির ছোয়া পেলে বেশি মজবুত ও  দীর্ঘস্থায়ী বেড তৈরি সবজি চাষে বৈচিত্র্য ও শস্য আবর্তন সম্ভব।


ভাসমান বেড (Baira) তৈরির উপকরণ
   # কচুরিপানা
(Water hyacinth)
   # গভীর পানির ধানের খর (Deep water rice straw)
   # বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ
◊  kochuripana (Eichhornia crassipes)

◊  Khudipana (Lemna trinulca)

◊   Kutipana (Azolla pinnata)

◊   Shayala (Bluxa japonica)
 # কিছু বাঁশের খণ্ড (Pieces of bamboo)


ভাসমান বেড (Baira) তৈরির পদ্ধতি
পানির উপর ভাসমান কচুরিপানার স্তূপ করে বাঁশের ভেলা স্থাপন করতে হবে। এর ওপর জলাবদ্ধতার স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে ঘন করে কচুরিপানার স্তূপ করতে হবে যাতে পুরো জলাবদ্ধতার সময় এটি ভাসমান থাকে। এর ওপর গোবর ও কম্পোস্টের স্তর দিয়ে ১০-১৫ দিন পর সবজির বীজ ছিটিয়ে বা চারা রোপণ করতে হবে। যেহেতু বয়রা
(Baira) পানিতে সঞ্চালন সক্ষম সেহেতু সুবিধাজনক ব্যবস্থাপনার স্থানে বয়রাকে স্থাপন করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে স্থায়ী করে দিতে হবে। এভাবে সবজি চাষে কৃষকরা প্রতি বছরে একটি বয়রা (Baira) থেকে ২-৩ বার ফসল সংগ্রহ করতে পারে।


ভাসমান বেডের জন্য শস্য ও সবজি নির্বাচন
ফসল চাষ আসলে মৌসুমের ওপর নির্ভর করে তথাপিও দেশে বিভিন্ন স্থানে ২০টিরও বেশি সবজি জাত এ ভাসমান বেডে চাষ করা যায়। দেশে বিভিন্ন স্থানে সবজি যেমন-
লালশাক 
(Red amaranth)
পুঁইশাক (Jadian spinach)
ধনেপাতা (Coriander leaves)
ফুলকপি (Cauliflower)
বাঁধাকপি (Cabbage)
টমেটো (Tomato)
বরবটি (Lady`s fingure)
শসা (Cucumber)
করলা (Bitter gourd)
লাউ  (Bottle gourd)
চিচিঙ্গা (Snake gourd)      
চালকুমড়া (Ash gourd)
মিষ্টিকুমড়া (Sweet pumpkin)
শিম (Bean)
ঢেঁড়স (Radish)
বেগুন (Egg plant)
আলু  (Potato)
মসলা : মরিচ (Chilli), পিয়াজ (Onion), রসুন (Garlic), আদা (Turmeric) এবং সরিষা (Mustard)


ভাসমান বেডের জন্য শস্য ও সবজি চাষ এর সুবিধা
◊ দেশের নিম্ন অঞ্চল দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা ও জলাবদ্ধ থাকার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের মাঠে কোনো ফসল বা সবজি চাষ করা সম্ভব নয় ফলে তারা আর্থিক অসচ্ছলতার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পুষ্টিহীনতায় ভুগেন। এক্ষেত্রে প্রধানত বয়রায় সবজি ও ফসল চাষের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
◊ পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর কচুরিপানা ও কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়।
◊ বন্যার সময় গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
◊ বন্যার সময় অথবা জলাবদ্ধ স্থানে বয়রার  ফসল বা সবজি চাষের মাধ্যমে পরিবারে দৈনিক পুষ্টি ও আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে  অবদান রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

 

কৃষিবিদ মো. মাহমুদুল হাসান খান*
* বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ প্রজনন), বি.এ.আর.আই, গাজীপুর। ই-মেইল:
mhasan.bari12@gmail.com

বিস্তারিত
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমভিত্তিক সংস্কৃতি

আমের উৎপত্তি স্থান : আম পৃথিবীর সেরা ফল, সব ফলের রাজা। আমের উৎপত্তি স্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত উপমহাদেশে। তবে চাঁপাইবাসীর ধারণা শিবগঞ্জের গৌড় এলাকা আমের উৎপত্তি স্থান। এ জেলায় কয়েক শত বছরের পুরনো আম গাছ এখনও অহরহ চোখে পড়ে। এছাড়া এ জেলায় শতাধিক বছরের পুরনো প্রচুর বট, পেকুড়, তেঁতুল, শিমুল, তালগাছ ছিল যা পরবর্তীতে নিধন করা হয়েছে তবে আম অনুরাগীরা অনেক বড় বড় পুরনো আম গাছ এখনও লালন করে যাচ্ছে।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : আম বাগানকে কেন্দ্র করে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। এককালে ১৭৫৭ সনে ২৩ জুন নবাব সিরাজ উদ দৌলা স্বাধীনতা হারায় পলাশীর আম্রকাননে। আর লর্ড ক্লাইভ ও মীর জাফরের সরকার উৎখাত গোপন ষড়যন্ত্র সভাটিও আয়োজিত হয় মেহেপুরের আমঝুপিতে।  সর্বোপরি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী সভার প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ১৯৭১ সনের ১৭ এপ্রিল আয়োজিত হয় বৈদ্যনাথের ২০০ বিঘার আম বাগানে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেও আমের প্রাধান্য, ‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায়রে...।’


আমের পুষ্টিমান : নানা আকার ও রঙের বাহারি কাঁচা-পাকা আম অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিতে ভরপুর। আমে রয়েছে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান, বিশেষ করে এতে ভিটামিনস ও মিনারেলসের পরিমাণ খুব বেশি। দিনে ২-৩টা পাকা আম আহার করলে প্রতিজনের দেহের দৈনিক সব পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসাধারণ মৌসুমে ৩-৪ মাস ধরে প্রচুর কাঁচা-পাকা আম খাওয়ার সুযোগ পান। এ সময় বেশি আম খাওয়ার প্রভাবে তারা চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী হন। তাদের ভাত আহার প্রবণতা অনেক কমে যায়। এছাড়া এ সময় গরু-ছাগল, কুকুর, শিয়ালসহ সব প্রাণী কাঁচা-পাকা আম খেয়ে সুস্বাস্থ ফিরে পায়।  


ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাগানে মুকুল আসার সাথে সাথে মৌমাছির আনাগোনা বেশি দেখা যায়। মধু আহরণের সুযোগ বাড়ে ও ফুলে পরাগয়ান বৃদ্ধি পায়। বাদুড়, কাক, ঘুঘু, কবুতর, ফিঙে, বুলবুল, দোয়েল, কোয়েল, কোকিল, টিয়া, শালিক, সাতভায়াসহ হরেকরকম রঙ-বেরঙের পাখির সুমিষ্ট কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত হয়। মাকড়সা, প্রজাপতি, লাল পিঁপড়া, মৌচাক বাগানে প্রচুর দেখা যায়। এ সময় লাল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে মৌসুমে ছেলেমেয়েরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ উপভোগ করে।


প্রচলিত জাত : বৃহত্তর রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও রংপুর জেলায়  উন্নত জাতের আম চাষ হয়। এসব এলাকায় প্রধানত ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাতি, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, কিষাণভোগ, মিসরিভোগ, সূর্যপুরী, তোতাপুরী, বোম্বাই, বৃন্দাবন, কুয়াপাহাড়ী, আশ্বিনা ও কাঁচামিঠাসহ কয়েক শত জাতের আম উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে জলবায়ু ও মাটির গুণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দেশের সেরা আমের ভাণ্ডার বলে সবার কাছে এখনও সুপরিচিত। বাংলাদেশের অন্য প্রান্তের আম অনুরাগীরা জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ মধুর মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বৈচিত্র্য স্বাদ আহরণের প্রতীক্ষায় দিন গুনে।


আমভিত্তিক সংস্কৃতি : ঈদ, পূজা-পার্বণসহ নানা উৎসব উপলক্ষে আম বাগানে সুশীতল ছায়ায় মনোরম পরিবেশে নানা ধরনের মেলার আয়োজন হয়। এসব মেলার মধ্যে তত্ত্বিপুর, মহারাজপুর, কানসাট, ভুজনীতলা, বানেশ্বরে আয়োজিত মেলা অন্যতম। মেলাকে কেন্দ্র করে এখানে আলকাপ, যাত্রা, পুতুলনাচ, কবিগান, বাউল গান ইত্যাদি নানা বিনোদনের সুযোগ থাকে।  আম বাগানে আয়োজন হয় গম্ভীরা গানের আসর। এলাকা ও দেশের নানা সমস্যা উঠে আসে নানা নাতির হাস্যরসে। এখানে আম কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, কামার, কুমার, চামার, ছুতার, কৃষাণ, কৃষাণীর তৈরি হরেকরকম দ্রব্যাদি ও নকশিকাঁথা এ মেলায় প্রচুর বেচা কেনা হয়। হাডুডু, লাঠিখেলা, ডাংগুলি, কাবাডি, বাঘ-বকরী, লুকোচুরি, লুডুসহ নানা  রকম খেলায় ছায়াঘেরা আম বাগানে ছেলে, মেয়ে, বড়রা সবাই মেতে ওঠেন। প্রচণ্ড খরায় মাইচা, মোড়া, খাটলায় আম বাগানে বসে বিশ্রাম নেয়াসহ গল্পগুজব, বিনোদন ও আয়বৃদ্ধিকারক কাজ সমাধা করে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারা দিন আম বাগানে ঘুরে ঘুরে আম কুড়ায়। ছড়া কাটে ‘আইরে বাতাস লইড়া, হাতির উপর চইড়া, ঝড়ি এলে কড়ি দিব, আম পড়লে টাকা দিব’। ঝড়/ বাতাসের সম্ভাবনা দেখলে বাগান মালিক/ ক্রেতার যখন বুক দুরু দুরু করে তখন ছেলে মেয়েরা এমনকি বড়রাও ডালি, ধামা, আড়হি, গাইনঞ্জা  নিয়ে পরম আনন্দে আম বাগানে আম কুড়াতে ছুটেন। প্রচলিত আছে ‘ফাগুনে আগুন, চৈতে কাটিকুটি, বৈশাখে আঁটি, জ্যৈষ্ঠেতে চুষি’। মুকুলসহ ছোট-বড় আম ঝরলেও বাগানিরা হতাশ হয় না। কেননা তারা বিশ্বাস করে ‘আমের আনা, মাছের পাই, যদি থাকে কেবা খায়’।


আমফল পাড়া ও পাহারা : চাঁপাইবাসী তাদের প্রিয় আম হাত দিয়ে পরম যতেœ অথবা ঠুঁসি দিয়ে পাড়ে। আম যাতে আঘাত প্রাপ্ত না হয় সেদিকে অতি সচেতন । মৌসুমে ছোট বড় গাছ আমের ভারে নুয়ে  আম মাটি স্পর্শ করার অপূর্ব দৃশ্য অহরহ দেখা যায়। এলাকাবাসী কেউ কারও গাছের আম ছিঁড়বে না। ঝড়-বাতাসে ঝরে পড়লে তা কুড়িয়ে খাবে এটাই প্রচলন, যা অন্য জেলায় বিরল ঘটনা। গরু-ছাগল যেন কোনো বাগানের আম নষ্ট করতে না পারে সেদিকে সবাই সামাজিকভাবে সচেতন। কাজেই এলাকায় আম পাহারার জন্য কাউকে বাড়তি খরচ বহন করতে হয় না যা অনত্র বিরল।


খাদ্য তালিকায় আমের বিচিত্রময় ব্যবহার :  বাগানে বসে লবণ, মরিচ, কাসুন্দি দিয়ে কচি আম কেটে, বেটে, ঘুটে খাওয়ার মজাই আলাদা। মাসকলাই ডালে আম, আম-বড়ি-বেগুনের তরকারি,আম দিয়ে সজিনা রান্না, আম মাছের চড়চড়ি, আমের ভর্তা, আম দুধ, আম চিতাই, পান্তা ভাতে পাকা আম এবং ছাতু দিয়ে আমের লাহারিসহ অনুরূপ নানভাবে আম আহার করে চাঁপাইবাসী  তৃপ্তি পান। ‘হাঁজি মামু ! ডাইলে কি আমচুর দিয়াছিলা? ‘নারেবা দিইনি, তবে হামি কি চুষনু,‘ আমচুর ভেবে উছুঙ্গা খাওয়ার রসালো গল্প অন্য জেলার মানুষের কাছে কতবার যে শুনতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ সময় বেহাই ও আত্মীয়ের বাড়িতে নানা রঙের আম, আটা, বাতাসা পাঠানোর উৎসব চলে। বাইরের জেলাগুলোতে কেবল কাঁচা আম বিপণন করা হয়। পাকা আমগুলো স্থানীয়ভাবে খুব সস্তায় বিক্রি করা হয়। তাই ধনী-দরিদ্র, সবার তিন বেলা পাকা আম খাওয়ার প্রচুর সুযোগ হয়। শিশুদের আস্ত পাকা আম চুষে খাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে।


আম বাগান সৃষ্টি ও পরিবেশের প্রভাব :  চাঁপাইনবাবগঞ্জে এককালে শত শত বছরের পুরনো প্রচুর বড় বড় বট, পাকুড়, তেঁতুল, তাল, শিমুল গাছ দেখা যেত। ইটের ভাটার চাহিদা মেটাতে এ জাতীয় সম্পদ কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে গেছে। উন্নয়নের  ছোয়ায় রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে শত বছরের পুরনো আম গাছগুলো নিধন করা হয়েছে। তথাপি শতাধিক বছরের অনেক বয়স্ক আম গাছ এখনও নিজ মহিমায় বাগানেটিকে আছে। পাশাপাশি বরেন্দ্র প্রকল্পের অনুকূল প্রভাবে এক ফসলা জমি, দু-তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তথায় গাছপালায় ভরপুর সবুজ মনোরম বেষ্টনীর সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে প্রচণ্ড খরার প্রভাবে কেবল সাঁওতাল ছাড়া সেখানে অন্য কোনো মানুষ বাস করার চিন্তা করত না। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, খরার প্রভাব কেটেছে, লু হাওয়া আর তেমন বইতে দেখা যায় না। এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে। পানির স্তর নিচে নামার প্রবণতা কমেছে। এখানে প্রচুর স্থানীয় ও অতিথি পাখিদের  আশ্রয়, খাদ্য ও প্রজনন ক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাখির কলকাকলি, গান ও বিচরণে এলাকায় পরিবেশে অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। এ জেলায় হাট-বাজার, রাস্তাঘাট অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, ঈদগাহ, শ্মশানে, আমগাছ রোপণ চর্চা চলে আসছে, যা অন্যত্র বিরল দৃষ্টান্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সৃষ্ট আম বাগানের বনায়ন, এলাকা ও দেশের জন্য আশীর্বাদ। বড় বড় আম বাগান থেকে প্রতি বছর কত হাজার টন যে অক্সিজেন অবমুক্ত হচ্ছে এবং আমগাছ কত হাজার টন কার্বনডাইঅক্সাইড নামক বর্জ্য চুষে নিয়ে প্রাণিকুলের প্রাণ বাঁচাচ্ছে সে হিসাব কোনো দিন প্রকাশিত হয়নি।


আমের অর্থনৈতিক প্রভাব : চাঁপাইনবাবগঞ্জে মৌসুমে ৩-৪ মাসব্যাপী আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট কাজে, সব শ্রেণী ও বয়সের ছেলেমেয়ে, পুরুষ, মহিলা প্রচুর কাজের সুযোগ পান, আয় বাড়ে, পারিবারিক সচ্ছলতা আসে। স্থানীয় পরিবহন (গরু-মহিষের গাড়ি, রিকশা, বাইসাইকেল, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, মিনিট্রাক/পিকআপ) সংশ্লিষ্ট সবাই এ সময় লাভবান হয়। এছাড়া আন্তঃজেলা পরিবহনে (বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, কুরিয়ার সার্ভিসের) সঙ্গে জড়িত সবারই প্রচুর আয় বৃদ্ধি পায়। আম পাড়া, আমের টুকরি, ঝুড়ি তৈরি, ঝুড়ি/কার্টুনে আম ভর্তিসহ নানা কাজে এলাকার দরিদ্র পুরুষ-মহিলাদের প্রচুর কাজের সুযোগ হয়। আম মৌসুমে তারা দিন-রাত কাজ করে যথেষ্ট আয় করে। এলাকায় প্রবাদ আছে ‘আম কালে ডোম রাজা’। এ মৌসুমে প্রচুর হোটেল, রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে সেখান থেকে আমের ব্যাপারী, আড়তদার সবার জন্য এলাকার বাহারি মাসকলাইয়ের রুটির বিপণন বাড়ে। ভ্রাম্যমাণ খাবার সরবরাহকারী দরিদ্র পুরুষ মহিলাদের এ সময়  বাড়তি আয়ের সুযোগ হয়। এলাকার ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা, রেশমি কাপড়, পিতল কাঁসার বাসন, তিলের খাজা, মাসকলাইয়ের বড়ি  বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।


আম সম্প্রসারণ পরিস্থিতি : বিগত ১৯৯৬  থেকে ২০০০ সন পর্যন্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আ¤্রপালি জাতের আমটি সারা দেশে ছড়ানোর এক বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আম্রপালি আম সম্প্রসারণের সুফল দেশের উত্তরাঞ্চল ছাড়া আজ বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও বরিশাল জেলাবাসী পাচ্ছে নিজের উৎপাদিত আমের স্বাদ গ্রহণ করছে এবং বাড়তি আম বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। কোন প্রকল্প সহায়তা ছাড়া এ নীরব বিপ্লবের স্বীকৃতি বা প্রচারণার তেমন প্রাধান্য নেই। এ জাতের আম সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে বাজারে আম্রপালি আম ক্রেতা-বিক্রেতা সবারই কাছে অতি সমাদৃত। চলতি মৌসুমে যে পরিমাণ আম বাজারজাত হচ্ছে তার শতকরা ৫০ ভাগই আম্রপালি আম। উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর কাছে এ জাতের গ্রহণযোগ্যতা প্রথমে কম ছিল, এখন আগ্রহ যথেষ্ট বেড়েছে। সুবিধামতো সবখানেই বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে আম্রপালি আম বাগান সৃষ্টির হিড়িক পড়েছে। বর্তমানে আম্রপালির পাশাপাশি যেসব জাত সম্প্রসারণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তার মধ্যে ঠাকুরগাঁয়ের বান্দিগুড়ি, দিনাজপুরের সূর্যপুরী, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌড়মতি, বার্মার রাঙ্গুয়াই, ভারতের পালমার, থাইল্যান্ডের নামডকমাই, বারি-৪, বাউ-১৪ এবং নানা প্রকার কাঁচামিঠা অন্যতম।


আম ও আম গাছের বহুবিধ ব্যবহার গুণাগুণ কারও অজানা নেই। কাজেই অতি উপকারী এ বৃক্ষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে সুফল আহরণ ও ‘সদকায়ে জারিয়ার মতো সওয়াব হাসিল’ করতে আন্তরিক প্রচেষ্টা  সবারই একান্ত কাম্য।
 

এম এনামুল হক*

* সাবেক ডিজি, ডিএই, ঢাকা

বিস্তারিত
ভাত খাবো তবে খানিকটা কম খাবো

ভাত খেকো মানুষ হিসেবে আমাদের বেশ নাম ডাক রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাত আর মাছ এই দুইয়ে মিলে এক সময় ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বলেই আমাদের চিহ্নিত করা হতো। বাঙলার প্রতি গৃহস্থের ঘরেই এক সময় লালন করা হতো দুগ্ধবতী গাভী। ফলে দুধ আর ভাত মিলে ‘দুধে ভাতে বাঙালি’ এরকম একটি অবস্থাও এদেশে বিরাজ করছিল এক সময়। পরে অবশ্য মাছের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় ‘ডালে ভাতে বাঙালি’ এরকম একটা প্রবাদ প্রায় চালু হতে না হতে ডালের মূল্যবৃদ্ধি তা আর বেশি দূর এগোতে দেয়নি। এসব আলোচনার মূল কারণ এই যে, সময়ে সময়ে আমাদের খাদ্যাভ্যাস খানিক পরিবর্তন যে এসেছে তা তুলে ধরা। আবার এটিও স্পষ্ট করা যে, ভাতের সহযোগী অন্যান্য খাদ্যে খানিক পরিবর্তন এলেও ভাত সেই প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির প্রধান খাদ্য হিসেবে তার স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছে। সে কারণে ধান আমাদের প্রাণ আর ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য।


বলা বাহুল্য ভাত আমাদের একমাত্র খাদ্য নয়, প্রধান খাদ্য। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমাদের ভাত খাওয়াটা নির্বিঘা করার জন্য সাথে কিছু তরকারির প্রয়োজন হয়। সেসব তরকারি তেল মশলা দিয়ে এমনভাবে রান্না করা হয় যেন তা ভাত খাওয়াটাকে সহজতর ও আনন্দদায়ক  করে তুলে। অনেক সময় মশলার বাহুল্য তরকারিতে এতটাই থাকে যে তাতে কম তরকারি দিয়ে খানিক বেশি ভাত খাওয়া যায়। লক্ষ্য আসলে আমাদের ভাতটা খাওয়া। এতে শর্করা, আমিষ, তেল বা চর্বি, ভিটামিন আর খনিজ দ্রব্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে পেটপূর্তির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করাও যে একান্ত আবশ্যক সেটি প্রায়ই আমরা ভুলে থাকি। সে জন্যই যুগ যুগ ধরে ভাতকে প্রধান ধরে অন্য যত খাবারের আয়োজন। সত্যি সত্যিই সে কারণে আমরা ‘ভেতো বাঙালি’ হয়ে উঠেছি।

ভাত যে আমাদের কত প্রিয় তার আরেক প্রমাণ হলো এদেশে হাজার হাজার রকম ধান জাত বাছাই করে নেয়া আর এসব জাত আবাদ করা। এলাকা ভিত্তিতে কৃষকরা তাদের মতো করে বাছাই করে নিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন রকম সব ধান জাত। স্বাদে গন্ধে বর্ণে আকার-আকৃতিতে এসব জাত একটা আরেকটা থেকে ছিল ভিন্ন রকম। নানা রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল এসব জাত। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, এদেশে ধান জাতের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার। ভাতের প্রতি কি গভীর মমতা থাকলে পরে এত সংখ্যক জাত সংরক্ষণ করে আসছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘকাল ধরে তা সহজেই অনুমেয়।


আসলে বিষয়টি তো ভাত আর গমের মধ্যকার কোনো দ্বন্দ্ব নয়। নয় এমনকি ভাত, গম আর আলুর মধ্যেও। বিষয়টা হলো একজন মানুষের প্রতিদিন কতটুকু শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত সেটি। একথা সত্য যে, ভাত কেবল শর্করাই সরবরাহ করে না পাশাপাশি আমিষও সরবরাহ করে। পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষকে শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন শূন্য দশমিক আট গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হয়। সে হিসেবে একজন ৬০ কেজি ওজনের মানুষকে গ্রহণ করতে হয় (৬০×০.৮) গ্রাম অর্থাৎ ৪৮ গ্রাম আমিষ। এখন আমরা যে চাল খাই তাতে গড়পড়তা আমিষ থাকে কত ভাগ সেটি জানা দরকার। অধিকাংশ কলে ছাঁটা সাদা চালে আমিষ থাকে গড়পড়তা শতকরা ৬.৮ ভাগ। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে যদি ৬.৮ গ্রাম আমিষ ধরা হয় তবে ৪৮ গ্রাম আমিষ পেতে হলে লাগে ৭০৫ গ্রামের বেশি চাল। ২০১০ এর FAO এর গবেষণা মতে আমরা গড়ে প্রতিদিন দানাশস্য গ্রহণ করছি ৪৬৪ গ্রাম যার ৪১৬ গ্রামই চাল। চাল হতে তাহলে আমরা পাচ্ছি প্রায় ২৮ গ্রাম আমিষ। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী গড়ে চাল থেকে আমরা পাচ্ছি শতকরা ৫৮ ভাগ প্রতিদিনের আমিষ। ব্যক্তিবিশেষে ভাত খাবার ওপর নির্ভর করে এর রকমফের তো হতেই পারে। এ হিসাবের অর্থ ভাত আমাদের শর্করা এবং আমিষ দুটোই সরবরাহ করছে।
 

সারণি-১ : কলেছাঁটা চাল ও ঢেঁকিছাঁটা চালে আমিষ, আয়রন, জিংক ও আঁশের মাত্রা

চালের প্রকার

আমিষ (মিলি গ্রা./১০০ গ্রা.)

আয়রন

জিংক

আঁশ (মিলি গ্রা./১০০ গ্রা.)

সাদা মসৃণ

৬.৮

(মিলি গ্রা./১০০ গ্রা.) 

(মিলি গ্রা./১০০ গ্রা.)

০.৬

বাদামি

৭.৯

 ১.২

০.৫

২.৮

 

আমরা জানি আমিষ তৈরি হয় নানা রকম এমিনো এসিডের সংযোগে। কমপক্ষে ২০ রকম এমিনো এসিড কম বেশি থাকে আমিষে। এর মধ্যে ৯টি এমিনো এসিড যেমন- হিস্টিডিন, আইসোলিউসিন, লিউসিন, লাইসিন, মিথিওনিন, ফ্যানাইল এলানিন, থ্রিওনিন, ট্রিপটোফ্যান আর ভ্যালিন হলো অত্যাবশ্যক এমিনো এসিড। আর বাকি এগারটি হলো অত্যাবশ্যক এমিনো এসিড। অত্যাবশ্যক এমিনো এসিড মানুষের দেহে উৎপন্ন হয় না। এদের খাবারের সাথে অত্যাবশ্যকভাবে গ্রহণ করতে হয়। চালের আমিষ এই ৮টি এমিনো এসিডে সমপরিমাণে নেই। বরং চালে লাইসিন এবং থ্রিওনিন প্রাণিজ আমিষের তুলনায় বেশ খানিকটা কম পরিমাণে রয়েছে। ভাত হোক গম হোক দুটির ক্ষেত্রেই একথা সত্য। এর অর্থ হলো দানাশস্যের শর্করাজাত ভাত, রুটি গ্রহণ করে এ ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। এর জন্য অবশ্যই প্রাণিজ খাদ্যের পরিমাণ খানিকটা বাড়াতেই হবে।


অনেকের যুক্তি হলো আগের দিনের মানুষ কি থালা ভরা ভাত খায়নি? তারা কি বেশি দিন বাঁচেনি? তারা কি স্বাস্থ্যবান ছিল না? এটি আসলে কোনো যুক্তিই হতে পারে না। আগের দিনে কেউ কেউ যে অনেক দিন বাঁচেনি তা হয়তো নয়। তারা তো আর কেবল ভাতই খায়নি। সচ্ছল মানুষ আগের দিনে মাছ খেয়েছে, দুধ খেয়েছে, ডাল খেয়েছে, শাকসবজি ফলমূল সবই খেয়েছে। বৈচিত্র্যময় খাবার যে খাবে সে তো কেবল পেট ভরার জন্য ভাতই খেলোনা। দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টিও তো তার পূরণ হলো। তার উপর তখন শাকসবজি ফলমূল সবই ছিল বিষ মুক্ত আর সতেজ। ফলে গড়পড়তা মানুষের চেয়ে যাদের সচ্ছলতা খানিক বেশি ছিল তাদের পুষ্টি নিয়ে তাই ভাবতে হতো না।


সবার জন্যই বৈচিত্র্যময় খাবার গ্রহণের সুযোগ কিন্তু সমান ছিল না। দিন এনে দিন খায় তেমন মানুষই এ দেশে বেশি ছিল। ছিল খাদ্যাভাবও। কত দুর্ভিক্ষ আর দুর্ভোগ এ দেশের মানুষের এক সময় ভোগ করতে হয়েছে সে ইতিহাস অনেকের জানা থাকার কথা। ফলে দুবেলা দু’মুঠো ভাত আহার হিসেবে যোগাড় করতেই বহু মানুষের প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হয়েছে। ফলে আগের দিনে লোকে পান্তা ভাত খেয়ে ভালো ছিল আর স্বাস্থ্য বড় সুন্দর ছিল এটি কেবল গল্পের মতোই শোনায়। বাস্তবতা তখন তা ছিল না। ফলে ভাতের গুণকীর্তন করে আর এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স দেখিয়ে বেশি করে ভাত খেতে হবে বিজ্ঞান তা স্বীকার করে না। পৃথিবীর কোনো পুষ্টিবিদ এ কথা সমর্থন করবে তা আমার একদম বিশ্বাস হয় না।


পুষ্টির হিসাব নিকাশ খানিকটা এখন দেখা যেতে পারে। কে না জানে যে খাদ্য হিসেবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে শর্করা, আমিষ, চর্বি বা তেল, ভিটামিন, খনিজ দ্রব্য আর পানি। এই ছয়টি খাদ্য উপাদানের কোনটি কতটুকু গ্রহণ করতে হবে এক দিনে সেসব আজ হিসাব-নিকাশ করে বেড় করা হয়েছে। মানুষের বয়স আর ওজনকে ভিত্তি করে দেশে দেশে এখন দেহের সঠিক পুষ্টি জোগানোর জন্য চলেছে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা। আমাদের দেশের জন্যও সুষম খাদ্যের লক্ষ্যে কোন খাদ্য উপাদান কতটুকু গ্রহণ করা হচ্ছে আর কতটুকু গ্রহণ দরকার তাও হিসাব-নিকাশ করে বেড় করা হয়েছে। সে হিসাবটাই বরং দেখি (সারণি- ২)।
            
সারণি-২: বাংলাদেশী মানুষের খাদ্য গ্রহণের গতিধারা (প্রতিদিন মাথাপিছু, গ্রাম)

 

খাদ্য

২০০০

২০০৫

২০১০

কাক্ষিত

দানাশস্য

৪৮৭ 

৪৬৯

৪৬৪

৩৭৫

চাল

৪৫৯

৪৪০

৪১৬

৩৫০

ফলমূল

১৬৯

১৯০

২১১

 ৪০০*

শাকসবজি

৫৫

৬৩

 ৭০

৬০

গোলআলু

১৬

১৪

১৪

৬০

শিম্ব শস্যদানা

৮৭ 

৯৫

১০৯

১৮০

প্রাণিজাতখাদ্য (ডিম দুধ সহ)

১৩

১৭

২১

৪০

ভোজ্যতেল

 ৮

 ১৮

চিনি

৫০

৫৩

৬৬

২০


* জাতিসংঘের WHO/FAO এর হিসাব মতে যে পরিমাণ চাল আমাদের গ্রহণ করা উচিত


২০০০ সনের সাথে ২০১০ সনের খাদ্য গ্রহণের গতিধারা পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, দানাশস্যজাত খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ গত দশ বা পাঁচ বছরে খানিকটা কমেছে। চালের ক্ষেত্রে তা কমেছে আরেকটু বেশি। খানিকটা বেড়েছে কিন্তু ফলমূল শাকসবজি গ্রহণের মাত্রা। বেড়েছে গোলআলু গ্রহণের মাত্রাও খানিকটা যা আরেকটুখানি কমলেই বরং ভালো। আশার কথা প্রাণিজাত খাদ্য গ্রহণ খানিকটা বেড়েছে। বেড়েছে ভোজ্যতেল গ্রহণও। চালের ওপর আরেকটু চাপ কমাতে হবে আমাদের নানাবিধ কারণে। সেসব কারণের মধ্যে রয়েছে-

*দৈহিক একজন সুস্থ সবল বয়স্ক মানুষের যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ প্রয়োজন তার শতকরা ৬০-৭০ ভাগ আসতে হবে শর্করা জাতীয় খাদ্য থেকে। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা মহাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটি বহুবিধ পুষ্টি গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যজাত নির্ধারিত পরিমাণ। ফলে এ মাত্রা রক্ষা করার জন্য সচেতন হলে তা আমাদের জন্য দুই দিক থেকে লাভজনক হবে। এক, তাতে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান সহজ হবে এবং দুই, আমরা তাতে ক্রমশ সুষম খাবার গ্রহণ করার দিকে এগোতে থাকব। জাতিসংঘের WHO/FAO এর হিসেব অনুযায়ী আমাদের ভাত গ্রহণ করা উচিত ৪০০ গ্রাম। বাকি ক্যালরি আসবে গম, গোলআলু এবং অন্যান্য খাবার থেকে।


*ভাতের পরিমাণ খানিকটা কমালে এবং তা দিয়ে মাছ মাংস বা ফলমূল খাওয়া খানিকটা বাড়ালে একদিকে যেমন অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ঘাটতি হ্রাস পাবে অন্যদিকে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির তাতে সংস্থান হবে।


*ভাত গ্রহণের পরিমাণ কমলে ধানের আবাদ খানিকটা কমাতে পারলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন খানিকটা হ্রাস করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে কোন কোন ধানের জমিতে ডাল-তেল-শাকসবজি বা ফলমূল আবাদ করে এদের ঘাটতি খানিকটা হ্রাস করা সম্ভব হতে পারে।


আগের দিনে এ দেশের মানুষ ঢেঁকিছাঁটা চালই খেতেন। ঢেঁকিছাঁটা চাল মানে চালের আবরণীসহ বাদামি চাল। বাদামি চালে বরাবরই ঢেঁকিছাঁটা চালের তুলনায় বেশি আয়রন, বেশি থায়ামিন, রিবোফ্ল্যাভিন, নিয়াসিন, পাইরিডক্সিন, ফলিক এসিড এবং খাদ্য আঁশও থাকত বেশি পরিমাণে। বাদামি চালের ভিটামিনের পরিমাণের সাথে মসৃণ চালের ভিটামিনের পরিমাণ তুলনা করলে বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মসৃণ চালের চেয়ে বাদামি চালে থায়ামিনের পরিমাণ প্রায় ৫ গুণ বেশি। রিবোফ্ল্যাভিন এবং নিয়াসিনের পরিমাণ সাদা চাল অপেক্ষা বাদামি চালে যথাক্রমে প্রায় ২ এবং ৩ গুণ বেশি। ভিটামিন বি৬-এর পরিমাণ মসৃণ চালের চেয়ে বাদামি চালে ১৫ গুণ বেশি। ফলিক এসিডের ক্ষেত্রে বাদামি চালে তা প্রায় দেড়গুণ বেশি (সারণি-৩)।

 

সারণি-৩ : ঢেঁকিছাঁটা ও কলেছাঁটা চালে ভিটামিনের মাত্রা
চালের প্রকার            থায়ামিন (বি১)    রিবোফ্ল্যাভিন (বি২)    নিয়াসিন (বি৩)    পাইরিডোক্সিন (বি৬)    ফলিক এসিড
ঢেঁকিছাঁটা বাদামি       ০.৩৪    ০.০৫    ৪.৭        ০.৬২    
কলেছাঁটা মসৃণ          ০.০৭    ০.০৩    ১.৬        ০.০৪    ২০

 

চালের লাল আবরণীতে ফ্যাটি এসিড থাকে যা চাল তৈরির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেলে দেয়া হয়। চালের আবরণীতে বিদ্যমান ফ্যাটি এসিড অসম্পৃক্ত প্রকৃতির বলে এগুলো দেহের কোলস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া চালের আবরণীতে টোকোফেরল, টোকোটেরিনল এবং অরাইজানল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও বিদ্যমান। ফলে কলেছাঁটা মসৃণ চাল এখন সত্যি সত্যিই অনেক কম পুষ্টিসমৃদ্ধ। এ চালের ভাত আসলেই বেশি খেয়ে লাভ নেই। বরং এ চালের ভাত খানিক কম খেয়ে অন্য অনেক উৎস থেকে পাওয়া সম্ভব দেহের জন্য বাকি শর্করা।


ভাত আমাদের ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কোনো যুক্তি দেখিয়ে ভাত বেশি গ্রহণ করারও কোনো মানে নেই। বরং দেহের জন্য পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হলে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে খানিকটা পরিবর্তন আনাই দরকার। একদিনে তা হবে তা নয়, একদিনে হওয়ার প্রয়োজনও নেই। ভেবেচিন্তে সচেতনভাবে আমাদের বৈচিত্র্যময় উৎসজাত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। কেবল যা মন চায় তা নয় বরং যুক্তিসঙ্গতভাবে যা করা প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও পুষ্টির স্বার্থে আমাদের তাই করা উচিত। আর শিক্ষিত মানুষের জন্য এ কাজটি করা যে বেশ জরুরি আমার কাছে সব সময় তা মনে হয়।

 

ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*

* প্রফেসর, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭

বিস্তারিত
খাদ্যে বিষ : ঠিক যেন নীরবে গণহত্যা

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সেই আদিকাল থেকেই কৃষিকে সযত্নে লালন করে আসছে। জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বছরে একশতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকের সীমিত জ্ঞান প্রভৃতি প্রতিবন্ধক থাকা সত্ত্বেও বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক অভূতপূর্ব সাফল্যে বাংলাদেশ সম্প্রতি খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করার পাশাপাশি রপ্তানি করতেও সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমাদের এই অর্জনকে ধূলোয় মিশিয়ে জীবনের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে খাদ্যে বিষক্রিয়া।

আজকাল খাবারে ভেজাল কথাটা যেন প্রভাতে সূর্য উদয়ের মতোই সত্য। ব্যবসায় অধিক লাভের আশায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব খুইয়ে ফেলছেন, দিনকে দিন। খাদ্যশস্য, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি উৎপাদনে রাসায়নিকের ব্যবহার, মাঠ থেকে উত্তোলন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আবার খাবার তৈরির সময়ও তাতে থাকছে ভেজালের স্পর্শ। এভাবে পুরো খাবারে ভেজালের ভাগটাই হয়ে যাচ্ছে বেশি। লোকমুখে গল্প শুনেছি, এক লোক মনের দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুরো এক বোতল বিষ খেয়েও তিনি মারা গেলেন না। পরে জানা গেল ওই বিষের মধ্যেও ভেজাল ছিল। বস্তুত ভেজালের জালে বন্দী বাংলাদেশ, সময়মতো মুক্তি না পেলে হয়ে যাবে সব শেষ। ভেজালের এই মহোৎসবের পেছনে রয়েছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যারা সাধারণ মানুষকে বলি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বলা যায়, এ একরকম নীরব মানবহত্যা।


ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড কি এবং এর বৈধ ব্যবহার
ফরমালিন হচ্ছে বর্ণহীন গন্ধযুক্ত ফরমালডিহাইড। ফরমালিন হল একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দেখতে সাদা প্রিজারভেটিভ। ফরমালিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংক্রমিত হতে না দেয়া। অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাককে মেরে ফেলতে পারে। মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকারক এই পদার্থ নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, ল্যাবরেটরি, ইনডাস্ট্রি ইত্যাদিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও বিশেষ কিছু বিধি নিষেধ আছে। ফরমালিন হল ননফুড গ্রেডের প্রিজারভেটিভ তাই খাদ্যদ্রব্যতে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ। ক্যালসিয়াম কার্বাইড (CaC2) ধূসর কালো দানাদার রসুনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয় ইস্পাত কারখানায়, ধাতব বস্তু কাটাকাটিতে বা ওয়েল্ডিং ইত্যাদি কাজে। অ্যাসিটিলিন গ্যাস ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরির জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়। বলতে পারেন এটি পলিথিন তৈরিরও কাঁচামাল।


বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্যদ্রব্য দেখে চেনার সহজ উপায়
দুধওয়ালা ফ্লাটে নিয়মিত দুধ দিয়ে যায়। অভিযোগ দুধ ফেটে যাচ্ছে। শিশুদের দুধ খাওয়াতে পারছেন না। পরের দিন দুধওয়ালা দেরিতে দুধ দিলেও দুধ ফাটছে না। আবার মামী মাছ কাটতে বসলেন। সংবাদ এলো তার দাদা মারা গেছেন। ঐ অবস্থায় রেখে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তিন দিন পর ফেরত এসে দুর্গন্ধের ভয়ে মুখে রুমাল দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা কোথাও কোন দুর্গন্ধের বালাই নেই। রহস্য একটাই অতি  মুনাফালোভীদের দ্বারা সাধারণ জনগণের জন্য খাদ্যে বিষ ভক্ষণ পলিসি গ্রহণ।

 

দ্রব্যের নাম

কি ক্ষতিকর বস্তু মেশানো হচ্ছে ?                 

ভেজালদ্রব্য চেনার সহজ উপায়

মাছ

ফরমালিন  

মাছি পড়বে না, মাছের চোখ নিচে দেবে যাবে, আঁইশ তুলনামূলক ধূসর বর্ণের হয়, শরীরে আঁশটে গন্ধ কম পাওয়া যায়, দেহ তুলনামূলক শক্ত হয়। অন্যদিকে ফরমালিনবিহীন মাছের ফুলকা উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয়, চোখ ও আঁইশ উজ্জ্বল হয়, শরীরে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়, মাছের দেহ নরম হয়, ত্বকের আঁশ পিচ্ছিল থাকে।

মাছ

ফুলকাতে রঙ মেশানো   

ফুলকা হাত দিয়ে নেড়ে দেখতে হবে। হাতে রঙ লেগে যাবে।

মুড়ি

ইউরিয়া 

মুড়ি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফুলবে এবং মুড়ির গায়ে ছিদ্র ছিদ্র দেখা যাবে।

 চানাচুর, জিলাপি

পোড়া মবিল, ট্রান্সফর্মারের তেল

স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মচমচে হবে এবং অনেকক্ষণ মচমচে থাকবে।

দুধ

ফরমালিন, আটা, গুঁড়া দুধ, ময়দা, চালের গুঁড়া, পামঅয়েল

ছানা তৈরি হবে না। ফরমালিন থাকলে সামান্য পরিমাণ দুধ নিয়ে দু’তিন ফোঁটা লেবুর রস দিলেই বোঝা যাবে অর্থাৎ ছানা হবে না। দুই চামচ দুধ একটি কাপে নিন। এতে দুই ফোঁটা টিংচার আয়োডিন মিশিয়ে দিন। দুধের রঙ হালকা নীল হলে বুঝবেন এতে ভেজাল হিসেবে আটা বা ময়দা মেশানো রয়েছে। পামঅয়েল মিশিয়ে দুধের নকল ননি তৈরি করা হয়।

ঘি/মাখন

বনস্পতি বা ডালডা

এক চামচ ঘি বা মাখন গলিয়ে একটি স্বচ্ছ কাঁচের বোতলে রাখুন। এতে একই পরিমাণ মিউরিঅ্যাটিক অ্যাসিড ও সামান্য চিনি মিশিয়ে মুখ বন্ধ করে খুব জোরে জোরে ঝাঁকান। কিছুক্ষণ পর পাত্রটি স্থির অবস্থায় রেখে দিলে নিচে লাল রঙের আস্তরণ পড়বে।

মিষ্টি    

ফরমালিন

মাছি বসবে না, স্বাভাবিক পরিবেশে রাখার পরেও টক হবে না।

আখের গুড়

হাইড্রোজ

স্বাভাবিক রঙের চেয়ে বেশি সাদা ও পরিষ্কার হবে।

কলা

কৃত্রিম হরমোন

সম্পূর্ণ কলা হলুদ হলেও বোঁটা সবুজ থাকবে। ফলের বোঁটার অংশটি নাকের কাছে ধরেন। যদি প্রাকৃতিক গন্ধ না পান বা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগে তাহলে নিশ্চিতভাবেই এতে ফরমালিন মেশানো হয়েছে।

বিভিন্ন ফল

ফরমালিন, কার্বাইড

ফরমালিন যুক্ত ফলে প্রাকৃতিক সুবাসের পরিবর্তে ঝাঁঝালো এক প্রকার গন্ধ থাকে। ফলের বোঁটার অংশটি নাকের কাছে ধরেন। যদি প্রাকৃতিক গন্ধ না পান বা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগে তাহলে নিশ্চিতভাবেই এতে ফরমালিন মেশানো হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলের স্বাদ সম্পূর্ণটাই মিষ্টি হবে। কিন্তু রাসায়নিকভাবে পাকানো ফলের কিছু অংশ মিষ্টি এবং কিছু অংশের স্বাদ টক হবে।

আপেল

ফরমালিন

মাছি বসবে না, আপেল কাটার পর খণ্ডিত অংশ লাল হবে না।

আঙ্গুর

ফরমালিন

মাছি বসবে না, স্বাভাবিক পরিবেশে রাখার পরেও পচবে না।

চাল

ইউরিয়া

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিষ্কার ও সাদা হবে।

দই

টিস্যু পেপার

দেখে চেনা সম্ভব নয় (দইয়ের উপরের সরটুকু সরিয়ে খেতে হবে)

পটোল, আলু

কৃত্রিম রঙ

হাত দিয়ে নেড়ে দেখতে হবে। হাতে রঙ লেগে যাবে।    

শুঁটকি

কীটনাশক

শুঁটকির যে উটকো গন্ধ সেটা থাকবে না।

চিনি

ফরমালিন/ কেমিক্যাল

একটি কাগজে এক চামচ চিনি নিয়ে যে স্থানে পিঁপড়া ঘোরাফেরা করে সেখানে রেখে দিন। চিনির গন্ধে যদি পিঁপড়া ছুটে আসে তাহলে বুঝবেন ওই চিনিই আসল। আর যদি পিঁপড়া না আসে তাহলে বুঝবেন তা ভেজাল।

লিচু

ফরমালিন/সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল 

লিচুর রং কাঁচা অবস্থায় হবে সবুজ, পেকে গেলে ইট রঙের। এখন গাছে থাকা অবস্থায় কেমিক্যাল দেয়ার কারণে তার রঙ হয়ে যায় ম্যাজেন্টা। এই ধরনের লিচু দেখতে ভালো দেখায়, কিন্তু খেতে নয়। ওষুধ দেয়া লিচুতে স্বাভাবিক স্বাদ বা গন্ধ থাকে না। কেমন যেন বিশ্রী ঝাঁঝালো ভাব থাকবে, আর রসালো হবে না। চেহারা দেখে ফল কিনবেন না।

আম, পেঁপে, টমেটো 

কৃত্রিম হরমোন বা বৃদ্ধি সহায়ক, ক্যালসিয়াম কার্বাইড (CaC2) 

ফল দেখতে চেহারা উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় লাগবে। টক বা মিষ্টি কোনো স্বাদই নেই বরং পানসা, শক্ত ও তেঁতো স্বাদযুক্ত মনে হবে। সম্পূর্ণ ফলের রঙ এক ধরনের দেখাবে, অথচ কার্বাইড দিয়ে না পাকালে ফলের গোড়া বা অন্যান্য অংশে সাদাকালো বা কসের দাগ থাকবেই। একটি গাছের ফল কোন সময় সমানভাবে পাকে না। সাধারণত আম একসাথে সম্পূর্ণ পাকে না, কিছু অংশ সবুজ কিছু অংশ হলুদ ছোপ ছোপ আকৃতিতে পাকে।

আনারস

কৃত্রিম হরমোন বৃদ্ধি সহায়ক, ক্যালসিয়াম কার্বাইড

আমের মতোই একটি আনারস একসাথে সম্পূর্ণ অংশ পাকে বা হলুদ হয় না, কিছু অংশ সবুজ কিছু অংশ হলুদ ছোপ ছোপ আকৃতিতে পাকে। যদি স্তূপের সবগুলো আনারস একসাথে পাকে অর্থাৎ সম্পূর্ণ হলুদ হয় তবে ভেজাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ফুলকপি

ব্লিচিং পাউডার স্প্রে

সম্পূর্ণ অংশ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সাদা হবে। সাধারণত পরিপক্ব হলে হালকা ঘিয়ে বা ক্রিম রঙ ধারণ করে।

 

ফরমালিন দূর করতে হলে যা যা করতে পারেন
পরীক্ষায় দেখা গেছে পানিতে প্রায় ১ ঘণ্টা মাছ ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিনের মাত্রা শতকরা ৬১ ভাগ কমে যায়। লবণাক্ত পানিতে ফরমালিন দেওয়া মাছ ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ফরমালিনের মাত্রা কমে যায় বলে মনে করা হয়। প্রথমে চাল ধোয়া পানিতে ও পরে সাধারণ পানিতে ফরমালিন যুক্ত মাছ ধুলে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ফরমালিন দূর হয়। সবচাইতে ভালো পদ্ধতি হল ভিনেগার ও পানির মিশ্রণে (পানিতে ১০% আয়তন অনুযায়ী) ১৫ মিনিট মাছ ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ ফরমালিনই দূর হয়। এক লিটার পানিতে এক কাপ ভিনেগার মিশিয়ে শাকসবজি, ফলমূল কিংবা মাছ ১৫ মিনিট রাখুন। এরপর ধুয়ে নিবেন ভালো করে এবং এই পদ্ধতি অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে অনেকটা ভালো। ঠিক সেভাবে ফলমূল ও শাকসবজির বেলায়ও করতে হবে বলে জানানো হয়েছে।

 

মানবদেহে ফরমালিন, কার্বাইডসহ বিভিন্ন ভেজালযুক্ত খাবারের ক্ষতিকর প্রভাব
পৃথিবীর ১৩টি দেশে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন জাতীয় কেমিক্যাল পদার্থ মিশানো হয়ে থাকে তার মধ্যে বাংলাদেশসহ চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, পাকিস্তানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাঠক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে ভোগছে। মুশকিল হলো ভেজাল খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় খুব ধীরে ধীরে। ভেজাল খাবারে নিজের অজান্তেই দেহে বাসা বাঁধছে যেসব মরণব্যাধি তা নিম্নে সংক্ষেপে দেয়া হলো।

 

*ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট, হাঁচি, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, অরুচি, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, আলসার, লিভার সিরোসিস, অন্ধত্ব, ত্বক-চোখের জ্বালাপোড়া হয়।

*রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি, রক্তশূন্যতা, পাকস্থলী, ফুসফুস, শ্বাসনালিতে ক্যান্সার ও ব্লাড ক্যান্সার।

*রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিসহ মস্তিষ্কের বিকাশও থেমে যায়। এমনকি মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার আশষ্কা থাকে।

 

খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন
সুখের কথা আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন আছে। ১৯৫৯ সনের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা হতে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ছয় মাস হতে তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- প্রদান করা যাবে। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সাত বছর কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজার মেয়াদ বেড়ে হবে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৪ বছর। এখানে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বিশেষ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, শুধু বাজারে গিয়ে রাস্তার পাশের দরিদ্র ফল বিক্রেতার আমগুলো ধ্বংস করে এবং সামান্য জেল জরিমানা করেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু এই চুনোপুঁটিদের শাস্তি দিলেই চলবে না, বরং যারা এই অনৈতিক কাজের মূল কারবারি, সেই রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।


ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে আপনি লিখিত বা কল করে অভিযোগ করতে পারেন

*“মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১ কারওয়ান বাজার (টিসিবি ভবন-৮ম তলা), ঢাকা”; ই-মেইল: dncrp@yahoo.com বা
ফোন/ফ্যাক্স : ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮, ৮৮-০২-৮১৮৯৪২৫, ৮৮-০২-৮১৮৯০৪৫

*সকল জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট

 

খাদ্যে ভেজাল রোধে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের (এআইসিসি) ভূমিকা
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে (২০২১) বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করতে “ডিজিটাল কৃষি তথ্যের প্রচলন ও গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়ন” প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৪টি জেলার ১৫০টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক ওঈঞ ভিত্তিক ২৪৫টি “কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র” (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। যে কেন্দ্রগুলো কৃষি ও কৃষককে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনতে নতুন নতুন প্রযুক্তিসহ সকল পর্যায়ের তথ্য সেবা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ করছে। তাই এআইসিসি-ই পারে বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদন, বিপণন এবং গ্রহণে সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে দেশব্যাপী জোরাল গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে।


ভেজাল খাবার রোধের জন্য মানুষের সচেতনতা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সচেতন মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভেজালের ব্যাপ্তি ও পরিণতি ব্যাখ্যা করতে হবে, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার পথও দেখাতে হবে। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিরোধ করার যত ব্যবস্থা তা নিতে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে রোগব্যাধির সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং তার চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক দৈন্যসহ নানামুখী চাপে মানুষ হিমশিম খাবে। রোগব্যাধি যেমন বাড়বে, তেমনি তৈরি হবে মেধাশূন্য জাতি, যা দেশের জন্য এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে।

 

মো. আরিফুর রহমান*
* জেলা কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, গোপালগঞ্জ

বিস্তারিত
পুষ্টিহীন এক শিশুর আত্মকথা

আমি শিশু রিমা। আমার বয়স ১০ বছর। খুলনা জেলার রূপসা উপজেলাধীন তালিমপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমরা ২ ভাই ও ২ বোন এবং পিতা-মাতা অর্থাৎ ৬ সদস্যের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। আমার বাবা স্বল্প বেতনভুক্ত একজন সরকারি কর্মচারী এবং মা গৃহিণী। আমি গ্রামের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি।


আমার মা বলেছেন, বুকে পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন না হওয়ার কারণে জন্মের পর আমি মায়ের বুকের দুধ খেতে পাইনি। শিশুকালেই কৌটার গুঁড়া দুধ এবং মাঝে মাঝে গরুর দুধ খেয়েছি। মা আরও বলেন, জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু দুধ খেয়েছি এবং পাঁচ মাস পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে নরম ভাত, সুজি, সামান্য মাছ, ডাল ও শাকসবজি খেতে হয়েছে। পিতার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে দুই বছর বয়সের পর থেকেই ভাত, ডাল, কখনও কখনও সামান্য মাছ বা মাংস এবং স্বল্প পরিমাণে শাকসবজি আর ফলমূল খেয়ে বেড়ে ওঠেছি। পর্যাপ্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ এবং যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল এবং মায়ের বুকের দুধ খেতে পাইনি। এর  ফলে আমি অপুষ্টির শিকার হয়ে স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠেছি। শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হয়নি। অপুষ্টির কারণে প্রায়ই নানা প্রকার রোগে ভুগে থাকি। খাবারে অরুচি হয় ও পড়াশোনায় মন বসে না এবং পড়া বেশিক্ষণ মনে থাকে না। এজন্য পরীক্ষায় ভালো ফলও করতে পারি না। অথচ মা-বাবার ইচ্ছা আমাকে লেখাপড়া শেখাবেন। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়, আমাদের স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। তবে  ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি অপুষ্টির শিকার।


আমরা শিশু। সুস্বাস্থ্য নিয়ে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা আমাদের অধিকার। এজন্য আমাদের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে। আমাদের স্কুলের বিজ্ঞান বিষয়ের স্যার, আমার বাবা ও মা এবং এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে পুষ্টি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে। তারা বলেন, পুষ্টিকর খাবার মানেই দামি খাবার নয়। অনেক কম খরচেও পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়। সুতরাং স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য  প্রতিদিন আমরা পুষ্টিকর খাবার খাবো। তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। আরও জানা যায়, শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ পৃথিবীর সেরা পুষ্টিকর খাদ্য। প্রকৃতির দান এ মায়ের দুধ আমাদের অধিকার। তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই আমাদের মায়ের বুকের প্রথম দুধ (শালদুধ) খেতে দিতে হবে। শালদুধ খুবই পুষ্টিকর, নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধক। জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে আমাদেরও অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কারণ, মায়ের দুধে রয়েছে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান। জানা গেছে, মায়ের দুধ খেয়েছে এমন শিশুরা সুস্থ, সবল ও মেধাবী হয়ে বেড়ে উঠে এবং লেখাপড়ায় ভালো ফল করে।


আরও জানা যায়, পাঁচ মাস বয়স পূর্ণ হলে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ আমাদের দেহের পুষ্টি চাহিদা মেটে না। এজন্য পাঁচ মাস পূর্ণ হলে শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মায়ের দুধের  পাশাপাশি আমাদের অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারও খেতে দিতে হবে। এ সময় নরম ভাত, রান্না করা সুজি, নরম খিচুড়ি, নরম করে সিদ্ধ ডাল, মাছ, মাংস ও ডিম, গাঢ় সবুজ হলুদ রঙের শাকসবজি, পাকা কলা ও পেঁপে ফলের রস প্রভৃতি খেতে দেয়া উচিত। চাল, ডাল, শাকসবজি এবং অল্প তেল দিয়ে রান্না করা নরম খিচুড়ি আমাদের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা মেটানো একান্ত আবশ্যক। দুধ ছাড়া মাছ, মাংস ডিম, ডাল, শিমের বিচি এসব খাবার থেকে আমরা প্রোটিন পেতে পারি। এছাড়া খাদ্যে শর্করা স্নেহ জাতীয় খাবার ও থাকা দরকার। এজন্য আমাদের খাদ্য ভাত, ডাল, শিমের বিচি এসব খাবার থেকে আমরা প্রোটিন পেতে পারি। এছাড়া খাদ্যে শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাবারও থাকা দরকার। এজন্য আমাদের খাদ্যে ভাত, রুটি আলু, সুজি, ঘি মাখন ইত্যাদি থাকতে হবে। ভিটামিন রোগ প্রতিরোধে করে দেহকে সুস্থ রাখে। নানা রকমের ভিটামিন আছে। আমাদের চোখের সুস্থতার জন্য ভিটামিন ‘এ’  খুবই প্রয়োজন। জানা যায়, শরীরে ভিটামিন ‘এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায় এবং ১০ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। আমরা শিশুরা রাতকানা রোগের হাত থেকে বাঁচতে চাই। এজন্য আমাদের খাওয়াতে হবে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার যেমন- গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙের শাকসবজি এবং ফলমূল বিশেষ করে পাকা পেঁপে, আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, কচুশাক, ডাঁটাশাক, পাটশাক, লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, গাজর, টমেটো, মিষ্টিকুমড়া এবং ডিমের কুসুম, কলিজা, মলা ও ঢেলা মাছ ইত্যাদি।


আমাদের দেহকে রোগমুক্ত রাখার জন্য প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার যেমন- আমলকী, পেয়ারা, কাগজিলেবু, পাতিলেবু, কামরাঙা, কুল ও বাতাবিলেবুর রস খেতে দিতে হবে। এছাড়া সহজলভ্য মৌসুমি ফলমূল ও গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি থেকেও ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। ভিটামিন বি-২ (রাইবোফ্লেবিন) এর অভাবে আমাদের মধ্যে প্রায়ই মুখের দুই কোণে ঘা হয়। মুখের দুই কোণে যাতে ঘা না হয়, সেজন্য আমাদের ভিটামিন বি-২ ও লৌহ সমৃদ্ধ খাবার যেমন- কলিজা, ডিমের কুসুম, দুধ, মাছ, মাংস, ডাল, শিম, আটার রুটি, ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত, গুঁড়া, কাঁচকলা, কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুইশাক, এবং অন্যান্য সবুজ রঙের শাকসবজি ও টাটকা ফলমূল ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে দিতে হবে। হাড় ও দাঁতের স্বাভাবিক গঠন ও সুস্থতার জন্য আমাদের খাদ্যে ভিটামিন ‘ডি’ ও ক্যালসিয়াম থাকা খুবই প্রয়োজন। তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, মাখন ও চর্বিযুক্ত খাদ্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও সূর্যালোক ভিটামিন ‘ডি’ এর অন্যতম উৎস। মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, দুধ, কলিজা, ডাল, সবুজ-শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। তাই আমাদের প্রতিদিন এসব খাবার খাওয়া দরকার। খাবারে লৌহের অভাবে আমাদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের রক্তশূন্যতা দেখা যায়। কলিজা, ডিমের কুসুম, মাছ, মাংস, কচুশাক, ডাঁটাশাক, লালশাক, ধনেপাতা, কাঁচকলা, গুড়, ডাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে লৌহ পাওয়া যায়। আয়োডিনের অভাবে শারীরিক বিকলাঙ্গ এবং দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল ছাড়াও শাকসবজি ও তাজা ফলমূলে প্রচুর আয়োডিন থাকে। তাছাড়া বর্তমানে বাজারে  আয়োডিনযুক্ত লবণ পাওয়া যায়। এজন্য আমাদেরও সব ধরনের খাবার তৈরি করার সময় আয়োডিন মিশ্রিত লবণ ব্যবহার কারা উচিত। দেহের প্রধান উপাদান পানি। পানি ছাড়া দেহে কোনো কাজ ভালোভাবে চলে না। খাবার হজম করতেও পানি দরকার। পানির সাহায্যে দেহের দূষিত পদার্থ মলমূত্র ও ঘামের আকারে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। পানি কম পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তাই প্রতিদিন আমাদের অন্তত ৬ থেকে ৭ গ্লাস নিরাপদ পানি পান করা উচিত। আমরা ‘এমন খাবার পানি চাই, যে পানিতে আর্সেনিক ও রোগ-জীবাণু নেই’।


পুষ্টি  চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে মানসিক বিকাশের জন্যও আমাদের উপযুক্ত যত্ন নিতে হবে। এর জন্য মা ও বাবাসহ আমরা পরিবারের সবার বিশেষ করে বড়দের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা চাই। আর ছোটবেলা থেকেই আমরা কন্যাশিশুরা একটু আলাদাভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা পেতে চাই। এর ফলে আমরা শিশুরা ভবিষ্যতের জন্য সুস্থ, সবল কর্মক্ষম ও মেধাবী হয়ে বেড়ে ওঠে সমাজ এবং দেশকে আলোকিত করে তুলতে সক্ষম হবো।
তাই আমাদের সবার শিশুর আজকের স্লোগান হলো-


‘অপুষ্টির সম শত্রু নাই,
সব শিশুর জন্য পুষ্টি চাই।
পুষ্টিকর খাবার খাব,
সুস্থ জীবন গড়ব।’

 

মো. আবদুর রহমান*
* উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা

বিস্তারিত
বদলে যাচ্ছে কৃষিজ সংস্কৃতি

সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ সংস্কার, উন্নয়ন, অনুশীলন ইত্যাদি। আবার সংস্কৃতির সুন্দর সমার্থক শব্দ হচ্ছে কৃষ্টি, কর্ষণ। মোট কথা সংস্কৃতিকে যদি সোজাসাপটাভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হলে বলতে হবে যাপিত জীবনের প্রাকৃতিক বা সামাজিক পরিবেশ, যা আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয় বা এ দুইয়ের মধ্যে বাস করে আমরা যা করছি সেটাই আমাদের সংস্কৃতি।


আবার যে পরিবারে বাস করছি সে পরিবারে সাধারণ কিছু কৃষ্টি কালচার থাকে, যা ওই পরিবারের সংস্কৃতি। এভাবে সমাজ, অঞ্চল,  রাষ্ট্রে, ধর্মে-কর্মে এবং জাতিভেদে সংস্কৃতির ভিন্নতা দেখা যায়। দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন। মানুষ এগিয়ে চলে সামনের দিকে, জন্ম নেয় নতুন কৃষ্টির নতুন সভ্যতার। কাজেই পয়লা বৈশাখে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা বা রমনা বটমূল থেকে যদি বলা হয় আমরা বাঙালি সংস্কৃতির উদযাপন করছি, তাহলে বলব কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। আসলে এটি হচ্ছে ফেলে আসা সংস্কৃতির আংশিক স্মৃতিচারণ মাত্র। কেননা সংস্কৃতি হচ্ছে বহতা নদীর মতো বহমান।
সে যা হোক। সংস্কৃতির বিবর্তন আমার বিষয় নয়। বিষয়টা হচ্ছে আমাদের কৃষিজ সংস্কৃতি তথা গ্রামীণ সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কৃষিই কৃষ্টি’। রবীন্দ্র যুগের এমন উক্তি সত্যই খাঁটি। কারণ তখনও প্রসার লাভ করেনি শহুরে সংস্কৃতি, ছোঁয়া লাগেনি আধুনিক কৃষির। কিন্তু কালক্রমে আধুনিকতার ছোঁয়া তথা বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষি ও কৃষক সমাজে এসেছে পরিবর্তন। জন্ম নিয়েছে নতুন সংস্কৃতির, নতুন সভ্যতা।


ধরা যাক খাদ্য সংস্কৃতির কথা। যেই কৃষক সকালের নাশতায় পান্তা ভাত আর কাঁচামরিচ জঠরে ঢুকিয়ে ছুটে যেত তার প্রিয় কর্মস্থল আবাদ ভূমিতে। এখন কৃষক সমাজে তেমনটি আর খুব দেখা যায় না। গ্রামীণ তথা কৃষক সমাজে শীতকালের পিঠে পায়েস থেকে আরম্ভ করে সব রকমের মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, খেজুরের রস বা খেজুরের পাটালি গুড়। আজকাল এ অকৃত্রিম খাদ্য সংস্কৃতির ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। কারণ বহুবিধ তার মধ্যে জ্বালানি ও গাছির অভাব অন্যতম। ফলে নতুন করে আর খেজুর গাছ রোপিত হচ্ছে না। যাও আছে তার থেকে যতটুকু গুড় আসে তাও ভেজাল। বেশির ভাগ জায়গায়ই ১ ভাগ খেজুরের গুড়ের সাথে ৩ ভাগ চিনি মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল গুড়। তাছাড়া নগর সংস্কৃতির ঢেউ গ্রামীণ জীবনেও লাগতে শুরু  করেছে। ফলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস, চা ইত্যাদি। অথচ কী স্বকীয়তাই না ছিল আমাদের গ্রামীণ তথা কৃষক সমাজের খাদ্য সংস্কৃতিতে। আমাদের লোকজ কবির পঙ্ক্তিমালায় ফুটে উঠত চিরায়ত খাদ্য সংস্কৃতির কথা।

‘আমার বাড়ী যাইও বন্ধু বসতে দেব পীড়ে
জল পান করিতে দেব শাইলী ধানের চিঁড়ে।
 শাইলী ধানের চিরে নয় বিন্নী ধানের খই
সংগে আছে কালো গরুর গামছা পাতা দই।’
কৃষাণ বধূর গয়নাতে এসেছে পরিবর্তন। এক সময় কৃষাণ বধূ/মেয়েদের পায়ে রুপার নূপুর বা খারু, কোমরে রুপার বিছা, হাতে রেশমি চুড়ি, হাতের একদম উপরে রুপার বাগ, গলায় পুতির মালা বা রুপার মালা বা হাঁসুলি, নাকে নথ ইত্যাদি। কপালে লাল টিপ আর বাহারি গয়নায় কৃষাণ বধূরা যখন গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে চলে যেত বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর গৃহে কিংবা স্বামীর গৃহ থেকে বাবার বাড়ি তখন নূপুরের ছন্দে কবি খুঁজে পেত কাব্যিক ছন্দ। জসিমউদ্দীন তার নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যে যৌবনবতী এক গ্রাম্য মেয়ের পায়ের গয়নার এক বড় অনুষঙ্গ নূপুরের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
‘কেউ বা বলে আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসী
 এ পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ঐ গাঁয়ে
ও গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর পরা পায়ে।’
কবি তার কবর কবিতায় কৃষাণ বধূর পুতির মালা এবং নাকের নথ নামক গয়নার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
‘শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ি
এক ছড়া পুতির মালা নিতে কখনও হতো না দেরি।
  দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া ঘাটে
 সন্ধ্যে বেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুর বাড়ীর বাটে।
হেসো না হেসো না শোন! দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে
 দাদু যে তোমার কত খুশী হতো দেখতিস যদি চেয়ে।
 নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া এতদিন পরে এলে
আমি যে হেথায় পথ পানে চেয়ে কেদে মরি আঁখি জলে।’


গয়না সংস্কৃতির পরিবর্তনের ফলে উল্লিখিত গয়নার তেমন প্রচলন আর দেখা যায় না। ক্রমবর্ধমান দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কুসুম ফুল, গুজিতিল, তিসি, চিনা কাউন, বোনা আমন, বোনাআউশ এ জাতীয় শস্যের আবাদ আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছে। আবার এদের মধ্যে কোনো কোনো ফসলের আবাদের বিলুপ্তি ঘটেছে। অথচ এসব ফসলে যখন মাঠ ভরে থাকতো তখন প্রকৃতি সাজতো অপরূপ সাজে। গ্রীষ্মের দামাল বাতাস যখন বয়ে যেত বিস্তীর্ণ শস্যের ওপর দিয়ে তখন মনে হতো ধান কাউনের শস্যের জমি যেন ঢেউ খেলানো পানিবিহীন অনবদ্য প্রসারিত নদী। মাঠের পরে মাঠ শস্যের এ যে সমাহার তা দেখে কবির মনকে নাড়া দিয়েছিল। কবি লিখেছেন,


“এই এক গাঁও ঐ এক গাঁও মধ্যে ধু-ধু মাঠ
ধান কাউনের লিখন লিখা করছে সদা পাঠ।”
ঠিক একই চিত্র ডালজাতীয় শস্যের ক্ষেত্রেও। তার মধ্যে মটরশুঁটির আবাদ এখন আর উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। অথচ আমাদের পল্লী কবি মটরশুঁটির কথা উল্লেখ করে তার শহুরে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছে এভাবে,
‘তুমি যদি যাও দেখিবে সেথায় মটর লতার সনে
শীম আর শীম হাত বাড়ালেই মুঠি মুঠি ভরে সেই ক্ষণে
তুমি যদি চাও সে সব কুড়ায়ে
নারার আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে
খাব আর যত গেয়ো চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে’
কৃষক সমাজে চাষাবাদের যে হাতিয়ার সেই কৃষি যন্ত্রপাতিতেও এসেছে পরিবর্তন। আমাদের পল্লী কবি জসিমউদদীনের কবিতায় চির চেনা প্রধানতম যন্ত্রটির কথা উঠে এসেছে এভাবে,
‘সোনালী উষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙ্গল লয়ে ক্ষেতে ছুটিতাম গায়েরও পথ ধরি’


আধুনিক যন্ত্রপাতির ভিড়ে চিরচেনা সেই লাঙল জোয়াল আর দেখা যায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে জীবন, জীবিকা ও সংস্কৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। অথচ নানাবিধ কারণে তার ব্যত্যয় ঘটছে। যেমন- ধরা যাক আমাদের উল্লেখযোগ্য ঋতু বর্ষার কথা। উজানের পানি প্রত্যাহার, নদীর তলদেশ ভরাট, বিভিন্ন প্রকার অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থার ফলে বর্ষা তার চিরন্তন রূপ হারিয়ে ফেলেছে। বর্ষা হয় না, হলেও তা রূপ নেয় সর্বগ্রাসী বন্যায়। অথচ নদীমাতৃক এই দেশে বর্ষার প্রভাব গ্রামীণ তথা কৃষক সমাজকে ভিন্ন মাত্রা যোগ করত। মহাজনী ধান-পাটের পাল তোলা নৌকা, নায়রির এক মাল্লাইয়া ছৈওয়ালা নৌকা, আষাঢ়ের খরস্রোতা নদী, আউশ ধানসহ চিত্র বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ হতো। ছুঁয়ে যেত কবি মনকেও। বর্ষার যে উচ্ছ্বল যৌবন প্লাবি সুন্দর একটি রূপ আছে তা ফুটে উঠেছে আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাপ্তি গল্পে- ঠিক এভাবে,
“অপূর্ব কৃষ্ণ বি,এ পাশ করিয়া কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিয়া আসিতেছিল। নদীটি ক্ষুদ্র বর্ষার অন্তে শুকাইয়া যায়। এখন শ্রাবণের শেষে জলে ভরিয়া উঠিয়া একে বারে গ্রামের বেড়া ও বাঁশ ঝাড়ের তলদেশ চুম্বন করিয়া চলিয়াছে। বহুদিন ঘন বর্ষার পরে আজ মেঘ মুক্ত আকাশে রৌদ্র দেখা দিয়াছে। নৌকায় আসীন অপূর্ব কৃষ্ণের মনের ভিতরকার ছবি যদি দেখিতে পাইতাম, তন্দ্রে দেখিতাম সেখানেও এই যুবকের মানস নদী নববর্ষার কুলে ভরিয়া আলোকে জ্বল জ্বল বাতাসে ছলছল করিয়া উঠিতেছে।”
কবি গুরু অন্যত্র আষাঢ় ও আউশ ক্ষেতের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
‘সারা দিন ঝরে ঝর ঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভরে ভর।’
আগেই বলেছি উফশী জাত প্রবর্তনের ফলে আমাদের স্থানীয় জাতের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ আমাদের স্থানীয় জাতের আউশ ধান। অথচ আষাঢ় এবং আউশ ধান ছিল স্বভাব কবির মানস পটের মনোমুগ্ধকর ছবি। যৌবনবতী আষাঢ়ের পানি প্রবেশ করত ফসলি জমিতে। সারা পড়ে যেত আউশ ধান কাটার। কখনও থেমে থেমে কখনও বা অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরত সারা দিন ধরে। কৃষক বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথাল মাথায় ধান কাটতো আপন মনে। জলজ পাখি পানকৌড়ি নিরন্তর ডেকে যেত টুব্ টুব্ করে। কৃষাণের কণ্ঠে ভেসে উঠত ধুয়া, মুর্শিদী, ভাটিয়ালিসহ আরও কত গানের সুর। জলজ পাখির ডাক আর কৃষকের প্রাণ খোলা গানের মূর্ছনা ছড়িয়ে যেত দিগন্ত জুড়ে। সব মিলিয়ে এ যে কাব্যিক মুহূর্ত, এই যে কাব্যময়তার অন্তর প্লাবি আবেগ তা কবির মন হকচকিত করে দিত।
যেহেতু জীবন বহতা নদীর মতো বয়ে চলা এক নদী। এর বাঁকে বাঁকে সৃষ্টি হয় কত আখ্যান। মন পবনের নাও ভাসিয়ে ফিরে যেতে চায় ফেলে আসা বাঁকের আখ্যানে। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ জীবন চলে জীবনের নিয়মে।

 

মো. আনোয়ার হোসেন*

* উপসহকারী কৃষি অফিসার, মানিকগঞ্জ সদর, মোবাইল : ০১৭১৩৫২৯৭০৭

বিস্তারিত
পরিবেশ দূষণরোধে বৃক্ষের ভূমিকা ও আমাদের করণীয়

অজীব উপাদান, যেমন- মাটি, পানি, আলো, বাতাস, জলাশয়, হাওর, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, হিমবাহ, মরুভূমি, বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল, মেঘমালা, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি এবং সজীব উপাদান, যেমন- উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ইত্যাদির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এগুলোর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। এ পরিবেশের মধ্যে বিরাজ করছে মানব কর্তৃক সৃষ্ট পরিবেশ, যেমন- ঘরবাড়ি, গ্রাম-শহর, সুউচ্চ ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, মোটরযান, রেলওয়ে, উড়োজাহাজ, রকেট, স্টিমার, ইটভাটা, বিদ্যুৎ, শিল্পকারখানা, ইন্টারনেট, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, জাহাজ-শিল্প, অস্ত্র-কারখানা, পারমাণবিক চুল্লি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় পরিবেশের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এ সুন্দর পরিবেশ। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য অজীব ও জীব প্রতিটি উপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারণে এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোনো একটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ হয়। মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- গ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুম-লের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৫০%, মিথেন ২০%, সিএফসি ১০%, নাইট্রাস অক্সাইড ১০% এবং অবশিষ্ট ১০% কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন পারঅক্সাইড ও কিছু অন্যান্য গ্যাস থাকে। গ্রিন হাউস হলো পুরু কাঁচের প্রাচীর দ্বারা নির্মিত একটি কাঁচঘর। শীত প্রধান এবং মরুর দেশে এ কাঁচের ঘর তৈরি করে কৃত্রিমভাবে তাপ, আলো ও জলীয়বাষ্প নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষি গবেষণা/ফসল উৎপাদন করা হয়। ঠিক এ গ্রিন হাউসের কাঁচের প্রাচীরের মতো পৃথিবীকে ঘিরে বিদ্যমান গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো সূর্যের পতিত তাপ বিকিরণে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে বায়ুম-লের তাপ বৃদ্ধি করে। বায়ুম-লের তাপ বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়াই হলো গ্রিন হাউস ইফেক্ট। বিজ্ঞানীদের ধারণা গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণীর বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃর্থিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ও প্রকট খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিথিন, প্লাস্টিক ও রঙ তৈরির কারখানা থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস নির্গত হয়। এ গ্যাস বায়ুম-লের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। এক অণু সিএফসি প্রায় দুই হাজার ওজোন অণুকে ধ্বংস করতে পারে। এ গ্যাস বৃদ্ধির কারণে ওজোন স্তরের অনেক স্থান পাতলা ও কোথাও কোথাও ছিদ্রও হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। ওজোন স্তর ছিদ্র হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি এবং কসমিক রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রথমে ফাইটোপ্লাংটনসহ বিভিন্ন অণুজীব ও পরে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণিকুলের মারাত্মক ক্ষতি করবে। এতে ক্যান্সার ও বিভিন্ন প্রকার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে। সমগ্র বিশ্বে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শিল্পকারখানা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গমণের কারণে বাতাসে এ গ্যাসের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এসব CO2 সূর্যের বিকিরিত তাপের একটা অংশ আটকে রেখে বৈষ্ণয়িক উষ্ণায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানীরা ৮টি শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী খাত চিহ্নিত করেছেন, যেমন- বিদ্যুৎ কেন্দ্র- ২১.৩%, শিল্প-কারখানা- ১৬.৮%, পরিবহন- ১৪%, কৃষি উপজাত- ১২.৫%, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন- ১১.৩%, আবাসিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম- ১০.৩%, ভূমি ব্যবহার ও জৈব জ্বালানি- ১০% এবং বর্জ্য নিষ্কাশন ও পরিশোধন- ৩.৪%। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি CO2 নির্গমনকারী দেশগুলো হচ্ছে চীন, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ। চীন ও আমেরিকার কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মোট নির্গমনের প্রায় ৫০ শতাংশ।


বিভিন্ন প্রকার যানবাহন থেকে নির্গত এগজোস্ট গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ গ্যাস তেলজাতীয় জ্বালানির দহন ক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয় এবং এতে সিসা, তামা, ক্যালসিয়াম, জিংকের ভারি ধাতু, CO, SO2, H2S, HCl I N - অক্সাইডগুলো থাকে। অপরদিকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্পকারখানা থেকে নির্গত নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইড গ্যাস বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নাইট্রিক ও সালফিউরিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে ভূপৃষ্ঠে এসিড বৃষ্টি ঘটায়। এসিড বৃষ্টি উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতি করে। মাটি ও পানির পিএইচ কমায়। পরিবেশ দূষণকারী উপাদানগুলো উৎপাদনে বাংলাদেশের ভূমিকা অতি নগণ্য। তবুও পরিবেশ দূষণের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর বেশি পড়ছে। এ কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে এবং নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে চরমভাবাপন্ন দেশে পরিণত হচ্ছে। ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্য ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, খরা, প্রচণ্ড তাপ, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি, বন্যা, নদী ভাঙন, ভূমিধস, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে। বৈষ্ণয়িক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে প্রতি বছর সুনামি, সিডর, আইলা, মহাসেন ও নার্গিসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হওয়ায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষ, গবাদিপশু, বন্যপ্রাণী, জলজপ্রাণী, মাঠের ফসল, পুকুর, হ্যাচারি, বাঁধসহ বিভিন্ন প্রকার স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ নিম্নে বর্ণিত হলো-


বায়ু দূষণ : বাতাসে অক্সিজেন ব্যতীত অন্যান্য গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বায়ু দূষিত হয়। পৃথিবীর সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। অপর দিকে বৃক্ষরাজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার কারণে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। তাই পরিবেশের সবটুকু CO2 বৃক্ষরাজি শোষণ করতে পারছে না। ফলে বাতাসে CO2 এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও শিল্প-কারখানা, ইট ভাটার চিমনি এবং মোটরযান হতে নির্গত- ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, বর্জ্য, এগজোস্ট গ্যাস, গ্রিন হাউস গ্যাস ইত্যাদি দ্বারা বায়ু দূষিত হচ্ছে। মানুষের শ্বাস গ্রহণের সময় দূষিত বায়ু দেহের মধ্যে প্রবেশ করে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে যকৃত, অগ্নাশয় ও বৃক্কে ক্রমান্বয়ে জমা হয়। এর ফলে বমি, মাথাব্যথা, বুকব্যথা, নাক-মুখ জ্বালা, এজমা, এলার্জি, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মানসিক অস্থিরতা, ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।


পানি দূষণ : পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শহর, হাট-বাজার, বাসাবাড়ির ময়লা-আর্বজনা, বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র, খাল, বিল ও নদীতে পড়ে পানি দূিষত হচ্ছে। প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক। জাহাজ ভাঙা শিল্পের বর্জ্য ও খনি হতে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ পানি দূষণের একটি কারণ। ফসলের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ও আগাছা নাশক, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য, হাওর, নদী এবং সাগরে চলাচলরত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমারের তেল নিঃসরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও বিস্ফোরণের কারণেও সাগরের পানি দূষিত হচ্ছে। দূষিত পানি ব্যাকটেরিয়া, ক্ষুদে জীব, কেঁচো, সাপ, ব্যাঙ, বিভিন্ন উপকারী প্রাণী, মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদির মৃত্যু ঘটায় এবং কলেরা, টাইফয়েড, ডিসেন্ট্রি ও চর্ম রোগ ছড়ায়। বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বহনকারী ফসল এবং মাছ খেলে বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি, স্নায়ু-বৈকল্য, ক্লোন রেক্টাল, কিডনি সমস্যা, প্রষ্টেট, যকৃৎ, ফুসফুস, পাকস্থলী ক্যান্সার ও লিউকোমিয়া রোগ হয়। আর্সেনিকযুক্ত পানি চামড়া, লিভার ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে।


মাটি দূষণ : ট্যানারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য, এসিড, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য- খাল, বিল ও নদীর পানির সাথে ফসলি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে মাটি দূষিত হচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির কারণে অবকাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে কৃষি জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মাটি দূষিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত মাটিতে চাষযোগ্য লবণ সহিষ্ণু ফসলের জাত তেমন না থাকার কারণে শস্য উৎপাদনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষ করা সম্ভব হলেও বাকি মৌসুমগুলোতে হাজার হাজার হেক্টর জমি লবনাক্ততার কারণে পতিত থাকছে। শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ থেকে ২০ ডিএস/মি. পর্যন্ত অবস্থান করছে। অধিক লবণাক্ততার জন্য মিঠা পানি সঙ্কটের কারণে ফসলের জমিতে সেচ কার্যক্রম সম্ভব হচ্ছে না।


শব্দ দূষণ : বাস-ট্রাক, রেলগাড়ি, লঞ্চ-স্টিমারের হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ, বিমানের বিকট শব্দ, শিল্পকারখানার শব্দ, ইট-পাথর ভাঙার শব্দ, মাইকের শব্দ, পটকার শব্দ, হাটবাজার, যানজট, জনসভায় মানুষের কোলাহলের শব্দ, ঢাক-ঢোলের শব্দ, ঝড়-তুফান, সাইক্লোন, বজ্রপাত ও সমুদ্রের গর্জন শব্দ দূষণের উন্নতম কারণ। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস, মাথাব্যথা, হৃদরোগ, স্নায়ুবিক বৈকল্য, শিশুর মানসিক বিপর্যয়, অনিদ্রা, বিরক্তিভাব, মনোযোগ নষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।


কৃষি ক্ষেত্রে দূষণের প্রভাব : ফসলের উৎপাদন নির্ভর করে মাটি, বায়ু, পানি, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও আলোর প্রখরতার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সামগ্রিক কৃষি পরিবেশের ওপর পড়ছে। এ কারণে আগাম বন্যায় বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসল পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। বন্যার স্থায়িত্বকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণে আমন ধানসহ আন্যান্য ফসল চাষে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, তরমুজ, টমেটো প্রভৃতি ফসলের ফুল ঝরে যাচ্ছে এবং শাকসবজি, আলু, সরিষা, পানের বরজ, বোরো ধানের চারাসহ বিভিন্ন প্রকার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। নারিকেল, সুপারি ও কলাগাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে ছোট গাছগুলো মারা যাচ্ছে। মাঠের ফসল নানা ধরনের রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড তাপের কারণে আম এবং লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে ও খোসা ফেটে পচন ধরে নষ্ট হচ্ছে। বিপন্ন আবহাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত ও ফলন হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।


ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য : উদ্ভিদ ও প্রাণী ওতোপ্রতভাবে জড়িত এবং এদের সমাবেশই হলো জীববৈচিত্র্য। ভূপৃষ্টে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ও এদের জড় পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গতিময় পদ্ধতি হলো ইকোসিস্টেম বা পরিবেশতন্ত্র। মানুষসহ অধিকাংশ প্রাণীর খাদ্যের প্রধান উৎস বৃক্ষ। বৃক্ষ পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও অণুজীবের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বিচারে বন নিধন এবং প্রাণী শিকারের কারণে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও পশুপাখি বিলুপ্তির পথে। অতি সাধারণ প্রাণী, যেমন- শিয়াল, বেজি, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, বানর, হনুমান, চিল, শকুন, ডাহুক, বাবুই, চড়–ইসহ আরও অনেক পশুপাখি আগের মতো দেখা যায় না। বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ফাইটোপ্লাংক্টন, জুওপ্লাংক্টন, শৈবাল, ক্ষুদিপনা, টোপাপানা ইত্যাদি খায় এবং বড় বড় মাছ, কুমির ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ছোট মাছগুলোকে খেয়ে বাঁচে। পানি দূষণ, জলাশয় সমস্যা এবং অবাধে শিকারের কারণে বহু ছোট-বড় নানা জাতের দেশি মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। মৌমাছিসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ফুল থেকে মধু আহরণকালে পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অণুজীবগুলো মরা বৃক্ষ ও প্রাণীর কোষের জৈবপদার্থ খেয়ে বাঁচে এবং এসব মাটির সাথে পচিয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে। বিভিন্ন জীবস্তরের মধ্য দিয়ে খাদ্যশক্তির এ প্রবাহকে খাদ্য শৃঙ্খল বা ফুড চেইন বলে। খাদ্য শৃঙ্খল ইকোসিস্টেমের গতিশীলতা বজায় রাখে।


বৃক্ষের ভূমিকা : খাদ্যের উৎস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকার ফল, মিষ্টি রস, ভেষজ দ্রব্য, কাঠখড়িসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ পাই। বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদনে বৃক্ষের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফল শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা বিকাশ লাভে সহায়তা করে। বিভিন্ন প্রকার কাঠের ওপর ভিত্তি করে দেশে আসবাবপত্র তৈরির বৃহৎ শিল্প, যেমন- বনজ শিল্প, হাতিল, আকিজ, নাভানা, অটোবি ইত্যাদি এবং কাঠমিস্ত্রিদের দ্বারা ক্ষুদ্র ফার্নিচার শিল্প গড়ে ওঠেছে। সমগ্র বিশ্বে বৃক্ষভিত্তিক বৃহৎ শিল্প, যেমন- কাগজ, রাবার, রেয়ন, হার্ডবোর্ড, রেশম, চা, পামঅয়েল, কোকো ইত্যাদি এবং কুটির শিল্প, যেমন- আগর, রেজিন, লাক্ষ্মা, খয়ের, মধু, বাঁশ-বেত শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। তাল-খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়। এ রসের ওপর ভিত্তি করে যশোর, ফরিদপুর, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলে গুড়ভিত্তিক গ্রামীণ শিল্পের প্রসার ঘটেছে। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে গদি, জাজিম, পাপস, রশি, ব্রাশ, ঝাড়– এবং তাল-খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি, থলে, বেড়া, ঘরের ছাউনি ও কাণ্ড ঘরের বর্গা-খুুঁটি তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। শিমুলগাছের তুলা দ্বারা লেপ, তোষক, বালিশ, সুতা ইত্যাদি তৈরি হয়। বৃক্ষের ডালপালা ও পাতা জ্বালানির প্রধান উৎস। দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে। ভেষজ বৃক্ষের শেকড়, ছাল-বাকল, পাতা, ফুল, বীজ ও বিভিন্ন প্রকার ফল, যেমন- আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, নিম ইত্যাদি আয়ুর্বেদিক/হারবাল/ইউনানি ওষুধ তৈরির প্রধান উপাদান। হেকিম ও কবিরাজরা ভেষজ ওষুধ দ্বারা সর্দি-কাশি, জ্বর, ব্যথা, হাড়ভাঙ্গা, আমাশয়, কৃমি, বাত, সাদা শ্রাব, সুতিকা, মেহ-প্রমেহ, ডায়াবেটিস, প্রেসার, জন্ডিস, পাইলস, একজিমা, দুধবাহারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন। ভেষজ ওষুধ দ্বারা গবাদি-পশুরও চিকিৎসা হয়। দেশে হামদর্দ, সাধনা, শক্তি, এপি, কুণ্ডেশ্বরীসহ বহু আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প গড়ে উঠেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় মানুষের এসব ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। হারবাল প্রসাধনীর প্রধান উৎস বৃক্ষ। অনেক গাছের পাতা-ছাল-শেকড়-বীজ দ্বারা জৈব বালাইনাশক তৈরি হয়। বহু মূল্যবান ঔষধি বৃক্ষ বিলুপ্তির কারণে ভেষজ পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই ঔষধি বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যেগ একান্ত প্রয়োজন। বৃক্ষরাজি বাতাস থেকে CO2 শোষণ এবং অক্সিজেন (O2) ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় ১০০ গ্যালন পানি নির্গত করে পরিবেশ ঠা-া রাখে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। সর্বোপরি সবুজ বৃক্ষের মনোরম দৃশ্য ও নির্মল বাতাস সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ সব মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কোনো দেশের ২৫% ভূমিতে বনজঙ্গল থাকা দরকার। বর্তমানে দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারিভাবে ১৭% উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে বাস্তবে রয়েছে ৮-১০% ভাগ। প্রতি বছর দেশে ১.৪৭% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতি স্থাপন এবং শিল্পায়নের ফলে ১% হারে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস ও ৩.৩% হারে বন নিধন হচ্ছে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিম্নের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা মানব সম্প্রদায়েরই করণীয়-


১. সড়কপথ, রেলপথের দু-ধার, পাহাড়, টিলা, উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা, নদ-নদী, খাল-বিলের পাড়, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, হাটবাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রচুর পরিমাণে ফলদবৃক্ষ, যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কুল, আমড়া, জলপাই, পেয়ারা, আতা, সফেদা, কমলা, লেবু, বেল, কদবেল, ডাউয়া, করমচা, চালতা, জাম্বুরা, জামরুল, শরিফা, কামরাঙা, গোলাপজাম, তেতুল, সজনা, নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর, পামঅয়েল, গোলপাতা ইত্যাদি, বনজবৃক্ষ, যেমন- সেগুন, মেহগণি, আকাশমণি, কড়ই, রেইনট্রি, বাবলা, গর্জন, শাল, চিকরাশি, শিশু, গামার, জারুল, দেবদারু, শিমুল, বট, পাকুর, খয়ের, হিজল, তরুল, চন্দন, কদম, ঘোড়ানিম, ছাতিয়ান ইত্যাদি ভেষজবৃক্ষ, যেমন- আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, জাতনিম, নিশিন্দা, বাসক, শতমূল, অ্যালোভেরা, নয়নতারা, কালমেঘ, সর্পগন্ধা ইত্যাদি ও মসলাজাতীয় বৃক্ষ, যেমন- তেজপাতা, দারচিনি, গোলমরিচ, জায়ফল, আলুবোখারা, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম ইত্যাদি রোপণ করে বাগান ও সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। ২. নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ এবং বৃক্ষ কর্তনের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। অবাধে পাহাড় কাটা, নদী ভরাট এবং বালু উত্তোলন রোধ ও আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। ৩. কাঠের ফার্নিচারের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি ফার্নিচার ব্যবহার করতে হবে। খড়ির বিকল্প হিসেবে চারকোল, গ্যাস, কয়লা ও ঘুটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত চুলায় কম ধোঁয়া নির্গমন ও অল্প খড়ির প্রয়োজন হয়। তাই এ চুলার ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে। ৪. যানবাহনে সীসামুক্ত জ্বালানি ও সিএনজি ব্যবহার করতে হবে। শিল্পকারখানা এবং ইটভাটার চিমনি অনেক উঁচু করে তৈরি ও ধোঁয়া নির্গমণ হ্রাস করতে হবে। বিষাক্ত বর্জ্য ও ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসাবে পাটজাত ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে হবে। দূষণরোধে পলিথিন, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য রিসাইক্লিনিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। ৫. শিল্পকারখানার বর্জ্য খাল, বিল ও নদীতে না ফেলে ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ডাস্টবিনের ময়লা-আর্বজনা এবং জৈব বর্জ্য দ্বারা বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করতে হবে। বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির সাহায্যে সুপার ফানশনাল ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন করে বর্জ্য বা আবর্জনাকে দ্রুত পচনশীল করার মাধ্যমে সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ৬. উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ, বেড়িবাঁধ, স্লুইস গেট এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলো মজবুত করে তৈরি করতে হবে যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লবণাক্ত পানি সহজে নিষ্কাশনের জন্য এক মিটার গভীর করে ড্রেন ও সাব ড্রেন তৈরি করতে হবে। জলাশয় তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যেন এ পানি শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়। ৭. কৃষি গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ফসলের শীত, তাপ, বন্যা ও লবণসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন এবং বালাইনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।


পাশাপাশি জৈব কৃষির ওপর অধিক জোর দিতে হবে। ৮. নির্বিচারে বন্য ও জলজ প্রাণী শিকার বন্ধ করতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পদকে সংরক্ষণের জন্য অভয়ারণ্য, উদ্ভিদ উদ্যান, অভয়াশ্রম, শিকার সংরক্ষিত এলাকা ইত্যাদি সৃষ্টি এবং বন-জঙ্গল, জলাশয়, নদী, সাগর দূষণমুক্ত রাখতে হবে। ৯. পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও বিস্ফোরণ ঘটানো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ১০. শব্দ দূষণরোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন হওয়া শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ১১. শিল্পকারখানার সঙ্গে ইটিপি না থাকা দ-নীয় অপরাধ। তাই যেসব শিল্পকারখানার সঙ্গে ইটিপি নেই, সেগুলোর ওপর পরিবেশ দূষণের জন্য গ্রিনট্যাক্স বা দূষণকর আরোপ ও ইটিপি স্থাপনে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। ১২. নিয়মিত Air Monitoring এর মাধ্যমে বায়ুদূষণের উপাদানগুলোর পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। ১৩. বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোই বেশি দায়ী।


তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ দেশগুলোর ওপর গ্রিনট্যাক্স, কার্বনট্যাক্স কার্যকর করে একটি অর্থ তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবেশ উন্নয়নে ওই অর্থ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে অন্তত একটি বৃক্ষ চারা রোপণ ও পরিচর্যা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সর্বোপরি শিল্পায়ন বিশ্বকে করেছে অনেক উন্নত ও আধুনিক। তাই শিল্পায়নের অগ্রগতি বজায় রেখেই বিশ্ববাসীকে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে উদ্বুদ্ধ এবং পরিবেশবাদী সংগঠন ও মিডিয়াগুলোকে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

কৃষিবিদ এস. এইচ. এম গোলাম সরওয়ার*

* ডেপুটি চিফ ফার্ম সুপারিনটেনডেন্ট (পিএইচ. ডি স্টুডেন্ট), খামার বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর- ০১৭১৩১৬৩৩৬৫

 

বিস্তারিত
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি অভিযোজন

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও খুলনা এলাকায় মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর বিস্তীর্ণ জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। এসব জমিতে যব চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। যব অত্যন্ত খরা এবং লবণ সহনশীল বলে উপকূলীয় বৈরী আবহাওয়া, উচ্চ তাপমাত্রার সাথে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে সক্ষম। শুষ্ক মৌসুমে জমি অনাবাদি ফেলে রাখলে লবণ ধুলায় জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় যব চাষের ফলে মাটি আবৃত থাকাতে  জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং জমির উন্নয়ন ঘটে। শুষ্ক মৌসুমে গোখাদ্যের তীব্র অভাব থাকে। এ সময় যব চাষ করে ঘাস হিসেবে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যায়। যবের খর জ্বালানি ও ঘরের চালা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।

 

আইলা দুর্গত কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কৃষক আইয়ুব আলী সরদার (৫৫) গত বছর তার বাড়ির সামনে পতিত জমিতে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের সহায়তায় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও সরবরাহকৃত বীজ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যব চাষ করেন। যব চাষে স্থানীয় উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ সহায়তা দেন।


নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে জমি উত্তমরূপে চাষ করে জো অবস্থায় বীজ বপন করা হয়। এ সময় জমির  সংগৃহীত মাটির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায়  লবণাক্ততা ছিল ৬ ডিএস/মি. এবং পরবর্তীতে ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত লবণাক্ততা আরও বৃদ্ধি পেলেও ফসলের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। যব চাষের জন্য তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না এবং সেচেরও প্রয়োজন হয় না তবে খুব বেশি খরা দেখা দিলে হালকা একটি ছিটিয়ে সেচ দিতে হয় এবং জমিতে যেন পানি না জমে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হয়। মার্চ মাসের শেষ দিকে ফসল কর্তন করা হয় এবং গড়ে প্রায় ২.৫ টন/হেক্টর ফলন পাওয়া  যায়।


আইলার পরে প্রায় ৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও উপযুক্ত ফসল ও প্রযুক্তির অভাবে মানুষ যখন জমি ফেলে রাখছে তখন যব চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। ভালোবীজ ও কারিগরি সহায়তা পেলে আরও বেশি পরিমাণ জমি যব চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
 

যব উৎপাদন প্রযুক্তি

মাটি : পানি জমে না এমন বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি যব চাষের জন্য উপযুক্ত। জমিতে ‘জো’ আসার পর মাটির প্রকার ভেদে ৩-৪টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হয়।
 

বপনের সময় : মধ্য-কার্তিক থেকে অগ্রাহায়ণ মাস (নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।
 

বীজহার: যব ছিটিয়ে ও সারিতে বপন করা যায়। ছিটিয়ে বুনলে হেক্টরপ্রতি ১২০ কেজি এবং সারিতে বুনলে ১০০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। সারিতে বুনলে ২ সারির মাঝে দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. রাখতে হবে। লাঙল দিয়ে ৩.৫ সেমি. গভীর নালা টেনে তাতে বীজ বুনে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
 

আগাছা দমন : চারা গজানোর পর ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ৮-১০ সেমি. দূরত্বে একটি চারা রেখে বাকি চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে দমন করতে হবে।
 

সারের পরিমাণ : সাধারণত অনুর্বর জমিতে যব চাষ করা হলেও সুপারিশমতো সার প্রয়োগে এর ফলন বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে প্রতি শতকে ইউরিয়া ৬৮০ গ্রাম, টিএসপি ৪৬০ গ্রাম এবং এমপি ৩০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়।
 

সার প্রয়োগ পদ্ধতি : সেচের ব্যবস্থা থাকলে শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু টিএসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ২ কিস্তিতে বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ বপনের ৫৫-৬০ দিন পর (সেচের পর) প্রয়োগ করতে হবে।
 

পানি সেচ : রবি মৌসুমে খরা দেখা দিলে ১-২টি হালকা সেচের ব্যবস্থা করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।
 

ফসল সংগ্রহ : শিষ, খড় ও পাতার রঙ বাদামি হয়ে এলে বুঝতে হবে ফসল পেকেছে। সাধারণত চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য সপ্তাহ (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ) সময়ে যব সংগ্রহ করা যায়।


সূত্র : কৃষি প্রযুক্তি হাতবই, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি অভিযোজনবিষয়ক এ পাতাটি ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশের সৌজন্যে প্রকাশিত। এ পাতাটিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন সম্পর্কিত প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিষয়ে যে কেউ লেখা দিতে পারেন। ইসলামিক রিলিফ, হাউজ ১০, রোড ১০, ব্লক কে, বারিধারা, ঢাকা, বাংলাদেশ।

বিস্তারিত
গবাদিপশুর ক্ষুরারোগ

গবাদিপশুর যেসব রোগ মারাত্মক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে তার মধ্যে ক্ষুরারোগ অন্যতম একটি। ফুট অ্যান্ড মাউথ (Foot And Mouth Disease) বা এফ এম ডি এটা সাধারনত ক্ষুরারোগ নামে পরিচিত। দ্বিবিভক্ত পশুর ক্ষুরে এই রোগ বেশি হয় বলে তার নাম ক্ষুরারোগ। মুখে ও ক্ষুরে ক্ষত, প্রচণ্ড জর, লালা ঝরা আর খেতে না পারা ইত্যাদি বৈশিষ্ট ধারণ করে।
 

কারণতত্ত্ব
এটা ভাইরাস দ্বারা গঠিত রোগ। এ্যাপথা (
Apthas) নামক আর এন এ (RNA) ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি পিকরনাভিরিডি (picornaviridae) গোত্রের একটি উল্লেখ্যযোগ্য ভাইরাস। এ ভাইরাসের অনেক সেরোটাইপ আছে। প্রায় ৭টি সেরোটাইপ A, O, C, Sat-1,Sat-2,sat-3 এর মধ্যে O টাইপ প্রকট আকারে রোগ সৃষ্টি করে এবং C B তুলনামূলক অনেক কম ক্ষতিকর। আর এক স্ট্রেন রোগ সৃষ্টি হয়ে অন্য স্ট্রেন এ পরিবর্তিন হয়ে যেতে পারে। তাই শুধু ভ্যাকসিন (টিকা) প্রয়োগ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। এই ভাইরাস অধিক তাপমাত্রায় (৫০ সেলসিয়াস) ধ্বংস হয়। আর শীতল অবস্থায় ও ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে অনেক দিন থাকতে পারে।


এই ভাইরাস কে কিছু রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা নিষ্ক্রিয় করা হয়, যেমন সেডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (২%), সোডিয়াম কার্বোনেট (৪%), এবং সাইট্রিক এসিড (২%)। এছাড়া এ রোগের ভাইরাসকে ১ থেকে ২% ফরমালিনে রাখলে সহজেই ১-২ মিনিটেই মারা যায়।


বাংলাদেশে ক্ষুরারোগ
বাংলাদেশে শীতকালে ও বর্ষাকালে এ রোগ বেশি হলেও প্রায় সব ঋতুতে দেখা যায়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা ও পরিবেশ গত কারণে এ রোগের প্রকট অনেক বেশি। এ ক্ষুরা রোগের কারণে ডেইরি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হয় প্রতি বছর। বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৭২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

 

রোগ ছড়ায় যেভাবে
ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত পশুর শরীরে ফোস্কার অভ্যন্তরে তরলের মধ্যে ভাইরাস বিকাশ লাভ করে। আর পশুর লালা, প্রস্রাব, গোবর, চামড়া, দুধ, ফোস্কা মধ্যস্ত তরল, শ্বাস ত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্গত হয়। খাবারের মাধ্যমে ও সংস্পর্শের মাধ্যমে অসুস্থ পশু থেকে সুস্থ পশুতে ছড়ায়।
পাখি এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করে, সংক্রমিত গরুর দ্বারা সংবেদনশীল গরুর প্রজনন বা নিষিক্তকরণের সময়। এ ভাইরাস আক্রান্ত পশু হতে বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে শরিরে প্রবেশ করে। প্রায়ই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পূর্বেই যে কোনো নিঃসরণে এবং শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভাইরাস বের হয়।

 

রোগের সুপ্তাবস্থা
ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর লক্ষণ প্রকাশ নির্ভর করে সেরোটাইপের ওপর। আর তা কমপক্ষে ২-৩ দিন ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে, খুব বেশি হলে ১০-১৪ দিনের মধ্যে বায়ু বাহিত হয়ে পশু সংক্রমিত হয়। তবে পরিক্ষামূলক ভাবে দেখা যায় ১৮-২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যেও লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। ভাইরাস মাটিতে প্রায় ২৮ দিন, পানিতে প্রায় ৫০ দিন এবং খড় ও ঘাস জাতীয় জিনিসের মধ্যে প্রায় ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।


ক্ষুরারোগের লক্ষণ
গরু মহিষের ক্ষেত্রে

১. শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জ্বর (১০৪-১০৬ ফারেনহাইট)
২. কাপুনি
৩. খুঁড়িয়ে চলা
৪. ফেনাযুক্ত আঠালো লালা ঝরা
৫. পায়ে, মুখে বা জিহ্বায় এবং ওলানের বাটে ফোস্কা ও ক্ষত
৬. বাছুরের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই বাছুর মারা যায়।
৭. গর্ভবতী পশুর গর্ভপাত হয়ে যায়
৮. খাবারে অনীহা

 

ছাগল ভেড়ার ক্ষেত্রে
হঠাৎ বিশেষভাবে খোঁড়াতে থাকে, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুয়ে থাকে, পায়ের ক্ষুরে ও মুখে ফোস্কা। ফোস্কাগুলো চিহ্নিত করা খুব কঠিন, ভেড়ির বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে অনীহা। ইত্যাদি

 

চিকিৎসা
ভাইরাসজনিত রোগ তাই এর বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ভালোভাবে পরিচর্যাসহ কিছু ব্যবস্থা নিতে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রথমে আক্রান্ত পশুকে আলাদা করে পরিষ্কার ও শুষ্ক স্থানে রাখতে হবে।
মুখে ঘা হলে ২% এলাম বা ০.০১% পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দিয়ে মুখ ধুয়ে দিতে হবে দিনে ২-৩ বার। মশা মাছির উপদ্রব কমানোর জন্য এবং পায়ের ক্ষুরে ক্ষত হলে ০.০১% পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্বারা পরিষ্কার রাখতে হবে দিনে ২-৩ বার। এ ক্ষেত্রে এফ ওম ডি কিউর (
FMD CURE)সহ অন্যান্য নামে তরল পদার্থ বেশ উপকারী ব্যবহারে। এতে ভাইরাস নিষ্ক্রিয়ও হয়ে থাকে।
 

প্রচুর লালা ঝরলে পশু দুর্বল হয়ে যায় সেক্ষেত্রে ৫% ডেক্সটোজ স্যালাইন (০.৯% Nacl) শিরায় পুশ করতে হবে। ১০০০ সিসি/৫০-১০০ কেজি ওজনের পশুকে ২-৩ দিন। পরবর্তী ইনফেকশন না হওয়ার জন্য অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ান এর পরামর্শ মতো অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। সেই সময় মুখে ঘা গাকায় শক্ত খাদ্য পরিহার করে নরম, তরল জাতীয় খাদ্য খেতে দিতে হবে।
 

নিয়ন্ত্রণের উপায়
ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন দিতে হয়। আর এ রোগের পরিবর্তিত সেরোটাইপের জন্য ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শুধু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিছু ব্যবস্থা গত নিয়ম ও পরিচর্যা নিতে হবে। আর তা হলো-

 

১. নজরদারির ব্যবস্থা ২। খামার সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখা, মাঝে মাঝে জীবাণুনাশক দ্বারা মেঝে পরিষ্কার করা।
২. খামারে সবার প্রবেশ এ নিয়ন্ত্রণ আনা। বাইরে প্রবেশ নিষেধ এমন বোর্ড লাগানো।
৩. যানবাহন যতদূর সম্ভব প্রবেশ করতে না দেয়া খামারে।
৪. নতুন গরু কিনার পর কিছু দিন আলাদা ঘরে রেখে ভালোভাবে দেখতে হবে ক্ষুরারোগ আছে কিনা আর থাকলে তার ভালো মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে ৫। গোয়ালঘর ও রুগ্ণ পশুর ব্যবহত দ্রব্যাদি ১-২% সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা ফরমালডিহাইড অথবা ৪% সোডিয়াম কার্বনেট সলুশন দ্বারা পরিষ্কার রাখতে হবে।
৬. ক্ষুরারোগে মৃত পশুকে ৬ ফুট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে যেন ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে না পারে। কোনো কারণেই খোলা অবস্থাতে রাখা ঠিক নয়।
৭. এ রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে খরচ অনেক কম হয়।
৮. চারণভূমি, ফাঁকামাঠ, নদীরপাড়, ঝোপ বা রাস্তার ধারে বিভিন্ন শ্রেণীর গবাদিপশুদের যতটুকু সম্ভব আলাদা রাখা।
৯. সাধারণত রোগ প্রতিরোধের জন্য ৪-৬ মাস বয়সে প্রথম টিকা এবং ২১ দিন পর বুস্টার টিকা এবং বছরে ২ বার ভ্যাকসিন প্রয়োগ কলেরা রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে বহুযোগী (
Polyvalent) ভ্যাকসিন বেশ উপকারী।
১০. দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সংবেদনশীল সব পশুকে ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করা দরকার।
১১. গর্ভবতী পশুকে সতর্কতার সাথে টিকা দেয়া।

 

মো. মোস্তাফিজুর রহমান*

* শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৭২৩-৭৮৬৮৭৭

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (ভাদ্র-১৪২২)

মো. আলমগীর হোসেন
নীলফামারী

প্রশ্ন : আদার কন্দ পচা রোগে করণীয় কী?
উত্তর : কন্দ পচা রোগ আদা ফসলের একটি মারাত্মক রোগ। এটি মাটি ও বীজবাহিত ছত্রাকজনিত রোগ।

 

প্রতিকার :
১. আক্রান্ত গাছ রাইজমসহ সম্পূর্ণরূপে তুলে ধ্বংস করতে হবে।

২. রোপণের আগে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড বা ১ গ্রাম ব্যাভিস্টিন মিশ্রিত দ্রবণে বীজকন্দ ৩০ মিনিট ডুবিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে রোপণ করতে হবে এবং একই পদ্ধতিতে  মাতৃকন্দ শোধন করে বীজকন্দ সংরক্ষণ করতে হবে।

৩. রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন আক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন সঙ্গে সঙ্গে রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে মাটির সংযোগস্থলে ১৫-২০ দিন পর পর গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
 

নারায়ণ চন্দ্র
পঞ্চগড়
প্রশ্ন : ধান গাছের এক ধরনের পোকা পাতা খেয়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলে। কিভাবে দমন করব?

উত্তর : ধানের লম্বাশুঁড় উড়চুঙ্গা পোকা ধানের পাতার কিনারা ও শিরাগুলো বাদে পাতা এমনভাবে খায় যে পাতাগুলো ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। এ পোকা দমন করার জন্য যা করা দরকার তাহলো-
০ জমিতে ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করা।
০ আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা ধরার ব্যবস্থা করা।
০ জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কুইনালফস জাতীয় কীটনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করা।

 

মো. শুকুর আলী
সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন : আগাম ফুলকপি, বাঁধাকপি বীজ বপনের সময় কখন জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর : আগস্টের শেষ হতে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত ফুলকপি, বাঁধাকপি বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আগাম চাষের জন্য বর্ষা শেষ হওয়ার আগেই চারা উৎপাদন করতে হয়। এ সময়ে ঘরের বারান্দায়, টবে বা গামলায় বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে।
মো. আবদুল মোতালেব

 

নীলফামারী
প্রশ্ন : পটোল গাছের কাণ্ড ও পটোলের গায়ে পানি ভেজা নরম পচন দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : পটোল গাছের কাণ্ড ও পটোলের গায়ে সাদা সাদা মাইসেলিয়াম দেখা যায়। এটা পটোলের ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগে গাছের গোড়া, শিকড় ও পটোলে পানি ভেজা নরম পচা রোগ দেখা যায়। পরবর্তীতে পটোল গাছসহ পটোল নষ্ট হয়ে যায়।

 

প্রতিকার :
-আক্রান্ত গাছ পটোলগুলো সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে।
-রোগ সহনশীল জাত বারি পটোল-১, বারি পটোল-২ ব্যবহার করতে হবে।
-প্রতি বছর একই জমিতে পটোল চাষ না করে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
-পটোলের শাখা কলম (কাটিং) শোধন করে লাগাতে হবে।
-অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
-সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
-রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতিলিটার পানিতে ১ গ্রাম ম্যানকোজেব+মেটালোক্সিল ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

 

মনিরুল
পাবনা
প্রশ্ন : গরু খায় না শুকিয়ে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : প্রথমেই আপনাকে কৃমির ওষুধ দিতে হবে; যদি ৩ মাসের বেশি সময় কৃমির ওষুধ না দিয়ে থাকেন। কৃমির ওষুধ দেয়ার সাতদিন পর আপনি যে দানাদার খাবারগুলো খাওয়াচ্ছেন তার সাথে ভিটামিন মিশিয়ে দিবেন। সুষম দানাদার খাবার খাওয়াবেন।

 

আহমেদ আলী
জামালপুর

 

প্রশ্ন : গরুর চামড়া উঠে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : অনেক সময় বহিঃপরজীবী জনিত কারণে এমন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইভারমেকটিন গ্রুপের ইনজেকশন চামড়ার নিচে দিতে হবে।
০ জিংক সমৃদ্ধ সিরাপ খাওয়াতে হবে।
০ এন্টিহিস্টামিনিক ওষুধ দিতে হবে।

 

শাহজাহান
কুমিল্লা

 

প্রশ্ন : হাঁস হাঁটতে পারছে না। প্যারালাইসিসের মতো হয়ে যাচ্ছে। কী করব?
উত্তর : সাধারণত ডাক প্লেগ হলে এমনটি হতে পারে। এক্ষেত্রে সময়মতো ডাক প্লেগের টিকা দিয়ে নিতে হয়। যেগুলো আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোকে আপাতত সুস্থ হাঁসগুলো থেকে আলাদা রাখবেন। টেরামাইসিন ক্যাপসুল সকালে অর্ধেক বিকালে অর্ধেক এভাবে তিন দিন খাওয়াবেন।

 

রতন
দিনাজপুর
প্রশ্ন : হাঁস-মুরগিকে প্রতিমাসে/বছরে কি কি টিকা দিতে হয়।

উত্তর : বয়সভেদে হাঁস-মুরগিকে নিচের ছকে বর্ণিত নিয়মে টিকা দিতে হবে।

বয়স

 রোগ

টিকার ব্যবহার

টিকা ব্যবহার পদ্ধতি

১ দিন

ম্যারেকস রোগ

ম্যারেকস টিকা

ঘাড়ের চামড়ার নিচে

৭ দিন ও ২১ দিন

গামবোরো রোগ

গামবোরো লাইভ টিকা

চোখে দুই ফোঁটা

১ দিন/৭ দিন

রানীক্ষেত রোগ

বিসিআর ডিভি

১ চোখে ১ ফোঁটা

১ মাস

বসন্ত রোগ

বসন্তরোগের টিকা

পালকবিহীন স্থানে ছিদ্র করে

২ মাস, ৬ মাস পরপর

রানীক্ষেত রোগ

আরডিভি

মাংসে ১ মিলি. ইনজেকশন

১ মাসে ৬ মাস পরপর

ডাকপ্লেগ রোগ

ডাকপ্লেগ রোগ

রানের মাংসে ইনকেশন

৭৫ দিন পরে ৬ মাস পরপর

কলেরা

কলেরার ঠিকা

রানের মাংস ১ মিলি. ইনজেকশন

 

মো. রুবেল
ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : পুকুরের পানি নষ্ট (পানির রঙ নষ্ট হওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত পানি) হলে বা ঘোলা হলে কী করতে হবে।
উত্তর : পুকুরের পানি নষ্ট বা দূষিত হয়ে গেলে শতকপ্রতি মাছ থাকা অবস্থায় ০.৫ কেজি চুন, মাছ না থাকা অবস্থায় ১ কেজি চুন গুলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। চুন গুলানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে। চুন গুলানোর পর ঠাণ্ডা করে নিতে হবে। পুকুরের পাড়ে অধিক গাছপালা থাকলে তার ডালগুলো ছেঁটে দিতে হবে যাতে পাতা পুকুরে না পড়ে।

 

মো. ইমরান করিম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 

প্রশ্ন : মাছ বড় হচ্ছে না কী করা যায়?
উত্তর : হ্যাচারি বা যে কোনো উৎস থেকে অপরিপক্ব বা পুষ্টিহীন অথবা খারাপ মানের পোনা পুকুরে বেশি ঘনত্বে ছাড়লে এ সমস্যা হতে পারে। তাই পোনা সংগ্রহের আগে পোনার গুণগতমান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে বিশ্বস্ত কোনো হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করুন।


তবে দৈনিক সম্পূরক খাদ্য (মানসম্পন্ন খাবার) দিলে, সার প্রয়োগ করলে এবং পানি ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারলে এ সমস্যার নিরসন হয়।
মাছের ঘনত্ব বেশি থাকলে কমিয়ে দিতে হবে। শতকপ্রতি ৪০ থেকে ৫০টি মাছ (মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সিলভার কার্প, কাতল/ বিগহেড শতকপ্রতি ২০টি রুই ১২টি; মৃগেল/মিরর কার্প/কার্পিও ১০টি; গ্রাসকার্প ২টি, সরপুঁটি ৬টি) পুকুরে ছাড়তে হবে। পুকুরস্থ মাছের মোট ওজনের ৩%-৫% হারে সম্পূরক সুষম খাদ্য প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানি ঘোলা হলে শতকপ্রতি চুন ০.৫ কেজি এবং ইউরিয়া সার শতকপ্রতি ১০০ গ্রাম হারে দিতে হবে।

 

আনোয়ারুল ইসলাম
টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : বন্যার পর পুকুরের পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কতটুকু আছে তা জানার উপায় কী?
উত্তর : হাতের তালু পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে বা সেক্কি ডিস্ক (
Secchi dish) নামক যন্ত্রের সাহায্যে এ পরীক্ষা করা যায়। হাত কনুই পর্যন্ত ডুবিয়ে যদি হাতের তালু পরিষ্কার দেখা যায় তাহলে পুকুরে মাছের খাবার খুবই কম আছে বলে ধরে নিতে হবে। আর যদি না দেখা যায় এবং পানির রঙ সবুজ থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে পুকুরের পানিতে পর্যাপ্ত খাবার আছে। একইভাবে সেক্কি ডিস্ক যন্ত্রটি ১ থেকে ২ ফুট পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে এ পরীক্ষা করা যায়।


কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*

* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
আশ্বিন মাসের কৃষি

কাশফুলের শুভ্রতা, দিগন্ত জোড়া সবুজ আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ানো চিলতে সাদা মেঘ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্ষার শেষে আনন্দের বার্তা নিয়ে শরৎ এসেছে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। বর্ষা মৌসুমের সবটুকু ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর চলতি মৌসুমের পুরো পাওনা আদায় করতে কার্যকরী প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের  করণীয় বিষয়গুলো।
 

আমন ধান
আমন ধানের বাড়ন্ত পর্যায় এখন। ধান গাছের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সেজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। নিচু এলাকায় আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থানীয় উন্নত জাতের শাইল ধানের চারা রোপণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে।


এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। এতে ফলন অনেক কমে যায়। সুতরাং খরা দেখা দিলে সম্পূরক সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী, পুকুর, খাল-বিল, ডোবা যেখানেই পানি পাওয়া যাবে সেখান থেকে পাম্প, নলকূপ, দোন, সেঁওতি দিয়ে সেচ দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে সম্পূরক সেচ আমনের ফলন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।


শিষ কাটা লেদাপোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগপড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।


কোনো কারণে আমন সময় মতো চাষ করতে না পারলে আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর২২, বিআর২৩, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। সেসাথে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।


আখ
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। তবে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়।  চারা তৈরি করে বাড়ির আঙিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।  চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।


বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। এ সময় ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল বিনা চাষে লাভজনকভাবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। জমির জো বুঝে এবং আবহাওয়ার কথা খেয়াল রেখে বিনা চাষে ফসল করলে খরচ খুব কম হয় এবং দ্রুত একটি ফসল পাওয়া যায়।

 

শাকসবজি
জমির মাটি এখনো ভেজা এবং স্যাঁতসেঁতে। আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জয়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার বিশেষ করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায়। শাকের মধ্যে মুলা, লালশাক, পালংশাক, চিনাশাক, সরিষাশাক অনায়াসে করা যায়। তাছাড়া সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যত্নে আবাদ করা যায়।


কলা
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলাবাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়। এতে একটি অতিরিক্ত ফসলের এবং সে সাথে অর্থও পাওয়া যায়।

 

গাছপালা
গাছের চারা রোপণের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে রোপণ করা চারা কোনো কারণে মারা গেলে সেখানে নতুন চারা রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। রোপণ করা চারার যত্ন নিতে হবে এখন। যেমন বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে । চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছের জাত ও বয়সের কারণে সারের মাত্রাও বিভিন্ন হয়।

 

প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেয়া যাবে না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।


আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদিপশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো পশুখাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খরের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি, বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভী, সদ্য ভূমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এ সময় গবাদিপ্রাণির মড়ক দেখা দিকে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।


মৎস্যসম্পদ
বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেঁধে দিতে হবে। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । এ সময় সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।


সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আশ্বিন মাসে সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। আমন ধান রক্ষাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য এ অভিযান চলে। এককভাবে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোনো লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সব মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সব পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেঁচা, গুঁইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাস বড়ি ব্যবহার  করা। আসুন সবাই একসাথে অতিচালাক আমাদের এ পরমশত্রুটিকে দমন করি। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। আল্লাহ হাফেজ।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
সম্পাদকীয় (ভাদ্র-১৪২২)

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশের কৃষি ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ঋতু পরিক্রমায় আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও ইদানীং আষাঢ় মাসে তেমন একটা বর্ষার দেখা মেলে না। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এমনকি আশ্বিন মাসেও অনেক সময় বন্যা দেখা দেয়। প্রকৃতির এ পরিবর্তন কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। আগাম বন্যা কিংবা নাবি বন্যার কারণে কৃষিতে অনেক সময় বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন-আগাম বন্যায় হাওর এলাকার পাকা কিংবা আধাপাকা ধান পানিতে ডুবে কৃষকের ঘাম ঝরানো শ্রম ও অর্থের ব্যাপক ক্ষতি করে। আবার নাবি বন্যার কারণে রবি ফসলের চাষাবাদ পিছিয়ে যায়। এসব কারণে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে যেসব ফসল চাষাবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং সময়মতো ঘরে তোলা যায়, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা দেশের কৃষি গবেষক, কৃষি বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ সবাই মিলে অব্যাহত রেখে চলেছেন। এ কথা সত্যি যে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা যেহেতু ক্রমবর্ধমান সেহেতু প্রতি বছর খাদ্যের চাহিদা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের খাদ্যফসলের উৎপাদন সমানুপাতে বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। আর একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শুধু দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই চলবে না, পুষ্টির দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এজন্য শাকসবজি, ফলমূল চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আমরা আশা করি এ ব্যাপারে সবাই সচেতন হবেন।


প্রিয় চাষি ভাইয়েরা, ভাদ্র মাসে কৃষি কাজের ব্যাপকতা কম থাকলেও বাড়িঘর ও মাঠের অনেক টুকিটাকি এমন সব কাজ থাকে, যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব কাজ সময়মতো সম্পন্ন করে রাখলে সারা বছর স্বাচ্ছন্দ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা চাই সুপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর ও মাঠের কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে নিজের জীবনমান ও কৃষির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখুন, দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

 

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon