কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত, জিডিপিতে যার অবদান ১৮.৭ শতাংশ (বিবিএস, ২০১২-১৩)। এ খাত এখনো শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশে আশংকাজনক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (বাৎসরিক ১.৩৭ শতাংশ) দৈনন্দিন পুষ্ঠি চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিকূলতা হিসেবে বিবেচিত। এই বিশাল জনসংখ্যার ভরণ পোষণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষির টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে কৃষি জমির হ্রাস (বাৎসরিক ১.০ শতাংশ হারে) এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ুর প্রভাব খাদ্য উৎপাদনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্দিষ্ট হারে খাদ্য সরবরাহ একাšত প্রয়োজন। এ যখন বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র, ঠিক সে সময়ে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে ‘‘গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি” বিষয়টি গৃহীত হয়েছে। এ প্রতিপাদ্যের মূল তিনটি উপাদান- (১) গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন, (২) সামাজিক সুরক্ষা এবং (৩) কৃষি। অর্থাৎ গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় কৃষি কী ভূমিকা পালন করছে এবং করতে পারে তা অনুধাবন করা। বিশ্ব পরিসরে এ প্রতিপাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপাদান তিনটি কেবলই পারস্পারিকভাবে সম্পর্কযুক্তই নয়, পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীলও বটে। সামাজিক সুরক্ষা না থাকলে কেবল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সফলতা অর্জনের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন খুবই দুরূহ কাজ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষি উৎপাদন, উন্নয়ন ও সফল বিপণনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দূরদর্শী উপলব্ধি ছিল- ‘কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষিই এর আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তি, কৃষিই কৃষ্টির মূল’। কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ঘটানোর উদ্দেশ্যে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আর্থিক দায়বদ্ধতা লাঘব, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের চিন্তা মাথায় রেখে তিনি কৃষকদের জন্য নিয়ে ছিলেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর সরকার প্রণীত প্রথম দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় তিনি কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কৃষিবিষয়ক জ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করার জন্য তিনি সরকারি চাকুরিতে কৃষি পেশাজীবীদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই বলা চলে, ২০১৫ সনে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সুর বঙ্গবন্ধুর প্রাণে বেজেছিল আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য, যা মোট দানাশস্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ চাহিদা মিটায় এবং জনগণের পুষ্টির প্রায় ৭০ শতাংশ এর বেশি ক্যালরী সরবরাহ করে। ইহা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরে দেশে মোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১.০ কোটি মে. টন, যা ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩.৪৭ কোটি মে. টন। সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ৩.৩৩ কোটি মে. টন, সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৮৫ কোটি মে. টনে। ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে যেখানে আলু ও সবজির উৎপাদন হয়েছিল যথাক্রমে ৬৭.৪৬ ও ১০৬.২২ লাখ মে. টন, সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৩.২৮ ও ১৪২.৩৭ লাখ মে. টনে। সুতরাং দেখা যায় যে, সরকারের সঠিক কৃষি নীতি প্রণয়ন, সঠিক মূল্যে সময় মতো উপকরণ সরবরাহ ও কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রসরতার কারণে জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও বিগত ৪৪ বছরে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মাত্র ১০ টাকা দিয়ে ৯৬ লাখ কৃষকের ব্যাংক একাউন্ট খোলা, এক কোটি ৪০ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উপকরণ প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং ডাল, তেল, মসলা ইত্যাদি ফসল চাষের জন্য মাত্র ৪ শতাংশ হার সুদে কৃষি ঋণ প্রদান, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কৃষক পর্যায়ে সুষম সারের চাহিদা দূরীভূত করতে সরকার কর্তৃক সার বিতরণ ও মনিটরিং জোরদার করে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়ার মাধ্যমে চার দফা রাসায়নিক সারের মূল্য কমানো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দ্বারা সেচ প্রদানে স্মার্ট কার্ড প্রচলন করা হয়েছে। এছাড়া, ৩০ শতাংশ ভর্তুকিতে খামার যন্ত্র সরবরাহের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং বন্যা, পাহাড়িঢলসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন ও আউশ ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের কৃষকদেরকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উপকরণ সহায়তা প্রদানের মতো জনবান্ধব কাজ করেছে সরকার । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খরিফ-১/২০১৫-১৬ মৌসুমে উফশী আউশ ধান ও বোনা আউশ ধান (নেরিকা) চাষে প্রণোদনার লক্ষ্যে সর্বমোট ২,১০,০০০ কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের গভীরতা ও তীব্রতা উভয়ই উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ, তা কমে বর্তমানে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ২৪ শতাংশ, এর মধ্যে গ্রামীণ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ৩১.৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিগত এক দশকে অর্থাৎ ২০০১-১০ মেয়াদে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় দেড় কোটি। অথচ এর ঠিক আগের দশকে অর্থাৎ ১৯৯০-২০০০ সনের মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছিল মাত্র ২৩ লাখ। এ সফলতা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত দেশের সব নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে এদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা। এক্ষেত্রে দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পেছনে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম, বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ এবং একই সঙ্গে সামাজিক উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ায় মানব উন্নয়ন সূচকেও লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। Human Development Report ২০১৩ অনুযায়ী ২০১২ সনে বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মধ্যে মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।
বাংলাদেশের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। ১৯৭৩ সন থেকে ২০১৫ সন পর্যন্ত ৬টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং একটি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন। এ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমূহের ফলে বাংলাদেশ আয় ও মানব দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ২০১৭ সনের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং ২০৩০ সনের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনের ধারাবাহিকতায় সরকার কর্তৃক দ্বিতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশল পত্রের সময়োপযোগী সংশোধন (জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র-২, ২০০৯-২০১১: দিন বদলের পদক্ষেপ) করা হয়েছে। বাংলদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প হিসেবে ‘‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১)” শীর্ষক দলিল প্রণয়ন করা হয়। এ রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১১-১৫ মেয়াদের জন্য ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ পরিকল্পনায় দারিদ্র্য নিরসনকল্পে কৃষি খাতের যে ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে তা হলো: দরিদ্র অঞ্চলে উপার্জনক্ষম লোকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি; কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অকৃষি খাতে কর্মসৃজন; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও পুষ্টি খাতে সরকারি ব্যয়ে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ; খাস জমি বিতরণ, সার, বীজ, সেচ, বিদ্যুৎ এবং গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান সহায়ক বিষয়সমূহে দরিদ্রদের অগ্রাধিকার নিশ্চিতকরণ; শহরবাসী দরিদ্রদের জন্য নাগরিক সুবিধা প্রদান করা। দারিদ্র্য নিরসনের অঙ্গীকার নিয়ে ২০১৬-২০ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। এসব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন তথা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং ২০২১ সনের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা।
জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতির আলোকে গৃহীত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কর্তৃক দলগত পদ্ধতিতে (Group approach) সম্প্রসারণ সেবাদানের বর্তমান কৌশল “গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি” এর এক সুন্দর সমন্বয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ যেমন- সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের আওতায় গঠিত হচ্ছে গ্রাম সংগঠন, উক্ত সংগঠনগুলোকে কেন্দ্র করে উপকরণ বিতরণ, উন্নত প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তার মাধ্যমে গড়ে উঠছে সামাজিক সুরক্ষার দৃঢ়মূল বেষ্টনী যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ ধরনের উদ্যোগের নানা দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যেই বিপুল অবদান রাখতে শুরু করেছে। ময়মনসিংহ - শেরপুর প্রকল্পের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে ভিলেজ বেজড্ অর্গানাইজেশন বা ভিবিও। ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার ৪৮টি গ্রামে ভিবিও গঠন করা হয়েছে। কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা, ন্যায্য মূল্যে কৃষি উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের সুবিধা তৈরির জন্য প্রকল্প এলাকায় স্থাপিত হয়েছে ৫টি পল্লী বাজার। ঘঅঞচ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫টি জেলায় ১৩,৪৫০টি সিআইজি এবং এসসিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে ২৭টি জেলায় ১২,০০০টি ক্ষুদ্র কৃষক দল গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আইএফএমসি প্রকল্পের মাধ্যমে ৬টি জেলার ১৫৩টি কৃষক সংগঠন (FO) এবং আইপিএম প্রকল্পের মাধ্যমেও গঠিত হয়েছে ৩,০৭৩ আইপিএম ক্লাব। সংগঠিত এসব সমিতির পুঁজি গঠনের জন্য শেয়ার ক্রয়, সঞ্চয় জমাদান ও বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে উল্লিখিত কৃষক সংগঠনগুলোর প্রণীত পরিকল্পনার আলোকে অথবা দলীয় চাহিদার ভিত্তিতে তাদেরকে আয় বর্ধনমূলক কর্মকা-, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাঠ ফসল চাষাবাদ, ফল বাগান স্থাপন, পশুপালন, মৎস্য চাষ, বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ ইত্যাদি কার্যক্রমের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এসব কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফলে প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠছে স্বনির্ভরতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এসব গ্রামে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে দ্রুত দারিদ্র্যের অবসান ঘটছে। আই পিএম ক্লাব, আইসিএম ক্লাব, সিআইজি, ফিয়াক ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষি সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে সামাজিক সুরক্ষা এবং কৃষি উন্নয়নে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছে যা গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে অর্জিত এক একটি সফলতার উদাহরণগুলোকে মাথায় রেখে আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে উপকরণের সহজপ্রাপ্তি এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। পাশাপাশি সঞ্চয়কে উৎসাহিতকরণ ও সহজ প্রাপ্য ঋণ প্রবাহের কারণে গ্রামীণ কৃষকদের পারিবারিক আয় বেড়েছে ৩৩ শতাংশ ( তথ্য সূত্র : Rural poverty wikipidea,case study, Bangladesh) । কৃষক সংগঠন তৈরি তথা টেকসই সমাজকাঠামো, গ্রামীণ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে তিনভাবে সাহায্য করতে পারে যেমন- (১) উৎপন্ন দ্রব্যের বাজারজাতকরণসহ ঋণ ও উপকরণ সরবরাহকারীর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন (২) কৃষকের উৎপন্ন দ্রব্যের সঠিক মূল্য পাওয়া এবং (৩) সদস্যদের অতিরিক্ত আয়, যা লাভের অংশ থেকে প্রাপ্ত, তা আবার কৃষি ব্যবসায় বিনিয়োগ।
বিশ্ব খাদ্য শীর্ষ সম্মেলন (১৯৯৬) অনুসারে, “খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজ করে যখন সকল লোকের, সব সময়, শারীরিক ও আর্থিক ভাবে পর্যাপ্ত এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের সামর্থ্য থাকে, যা খাদ্য চাহিদা মিঠানো এবং সুস্থ জীবন যাপনে সহায়তা করে”। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য সংগ্রহ ও ব্যক্তির পছন্দ মতো পুষ্টিসম্মত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা পর্যস্ত বিষয়গুলো খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় পড়ে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৯৯১-৯২ সনে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ ছিল যেখানে ৩৫ শতাংশ, ২০০২-২০০৪ সনে তা কমে হয়েছে ৩০ শতাংশ। ১৯৮৪ সনে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে একজন ব্যক্তির দৈনিক গড়ে চাল, গম, সবজি, ডাল, ফল, মাছ, মাংস ও ডিম এবং দুধ গ্রহণের পরিমাণের সঙ্গে ২০১০ সনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সবজি ও ফল খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশ। এছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে মাংস ও ডিম খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে এক-তৃতীয়াংশ এবং শহরে বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ২০১১-১২ সনের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ৬৩.২ শতাংশ পরিবারের মধ্যে প্রতিজন দৈনিক গড়ে ২,১২২ কি.ক্যালরী গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া, ৬৪.৭ শতাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী পর্যাপ্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে সক্ষম। ১৯৯০ সনের দিকে যেখানে এক জন শ্রমিক তার মজুরি দিয়ে দৈনিক গড়ে ৩.৫০ কেজি চাল কিনতে সক্ষম হতো, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০.০ কেজি। কম ওজনের শিশুর জন্ম হার ১৯৯০ সনের ৬০ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে ৩৬ শতাংশ নেমে এসেছে। অপুষ্টির চরম নিদর্শন, খর্বাকৃতি ২০০৭ সন থেকে ২০১১ সনে ২ শতাংশ পয়েন্ট কমে এসেছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে চরম অপুষ্টির হার ১৯৯৭ সনের ৫২ শতাংশ থেকে কমে ২০১১ সনে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টিরস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন’। সুতরাং, ভবিষ্যতে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প পন্থা আমাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। আর এ জন্য আমরা যা উৎপাদন করি তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের কৃষি এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই অর্জন ও সাফল্য ধরে রেখে ২০৩০ সনের মধ্যে পৃথিবীকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করাসহ অর্জিত উন্নয়নকে টেকসই করতে এখন আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হবে। সে সঙ্গে অর্জন করতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪১ সনের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য। এসব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে তাই সংগত ভাবেই নিম্নবর্ণিত কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
১. টেকসই কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশীদারিত্ব জোরদারকরণ;
২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার লক্ষ্যে সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (আইসিএম), সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা (আইএনএম), সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (আইডিএম), ভূউপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি এবং সৌরশক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ;
৩. কৃষি সংশ্লিষ্ট সবার (কৃষক, ব্যবসায়ী, উপকরণ সরবরাহকারী, উদ্যোক্তা, প্রশিক্ষক, গবেষক, নারী) দক্ষতা উন্নয়ন;
৪. গবেষণা - সম্প্রসারণ - কৃষক - বাজার সম্পর্ক জোরদারকরণ;
৫. শস্য উৎপাদন বাড়াতে, বহুমুখীকরণ, নিবিড়করণ কার্যক্রম জোরদারকরণ ;
৬. কৃষিতে আইসিটি ও জিআইএস এর ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ;
৭. কৃষক দলের মাধ্যমে প্রযুক্তি সম্প্রসারণ;
৮. জবিবৈচিত্র্য সংরক্ষণ (উদ্ভিজ, প্রাণীজ)
৯. খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং খাদ্যাভ্যাসের বহুমুখীকরণ;
১০. খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্পৃক্তকরণ;
১১. বৃষ্টি-নির্ভর চাষাবাদকে উৎসাহিতকরণ;
১২. প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা (ভূমি, পানি ও জীববৈচিত্র্য);
১৩. চাষাবাদ পদ্ধতির অর্থনৈতিক সক্ষমতা টেকসইকরণ;
১৪. প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নের জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা।
আমরা গভীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরাধ্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রয়াসকে সাফল্য মণ্ডিত করে তুলব। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখ অম্লান থাকবে উজ্জ্বল হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলতে হবে।
কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং দরিদ্রতা নিরসনে প্রাণিসম্পদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সাথে উপযুক্ত প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ প্রাণিসম্পদ খাতকে আজ কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের একটি অন্যতম প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠী এবং নারীরা প্রাণিসম্পদ পালনে সম্পৃক্ত হয়ে আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছে। দেশের বহু পরিবার আজ কেবল দুটি উন্নত জাতের গাভী অথবা স্বল্প পরিসরে ব্রয়লার/লেয়ার মুরগি পালন করে স্বাবলম্বিতার মুখ দেখেছে। এ ছাড়াও প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রাণিসম্পদ খাত বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রাণিসম্পদ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
স্থিরমূল্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৭৩% ও প্রবৃদ্ধির হার ৩.১০%। মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১৪.০৯%. তা ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদিত কাঁচা ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৪৩১৭.৮৬ কোটি টাকা (সূত্র : এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, ২০১৪-১৫)। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% সরাসরি ও ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভিশন হচ্ছে দেশে দুধ, গোশত ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণপূর্বক মেধাবী, স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিদীপ্ত জাতি গঠন করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আধুনিক-লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণ সম্পর্কিত কাজ করে যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ ও পুষ্টি নিরাপত্তা
মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষ তথা দুধ, মাংস ও ডিমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে দুধ, গোশত ও ডিমের উৎপাদন এবং জনপ্রতি প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দুধ, গোশত ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২২.৭০ লাখ টন, ১১.৩০ লাখ টন, ৫৪২.২০ কোটি টি। বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং ভিশন ২০২১ এর আলোকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক কার্যকর ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে দুধ, গোশত ও ডিমের উৎপাদন বেড়ে যথাক্রমে ৬৯.৭০ লাখ টন, ৫৮.৬০ লাখ টন, ১০৯৯.৫২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে গত ৯ বছরে দুধ, গোশত ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৩.০৭ গুণ, ৫.১৯ গুণ এবং ২.০৩ গুণ ও জনপ্রতি প্রাপ্যতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২২.০০ মিলি/দিন, ১০২.৬২ গ্রাম/দিন ও ৭০.২৬ টি/বছর।
দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি গুরুত্বপর্ণ কাজ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর লাখ লাখ বেকার যুবক, যুব মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৫০.১৭ লাখ (বেকার যুবক, যুব মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক) কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে, যা বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের ব্যাপক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
দারিদ্র্য বিমোচন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ
(ক) স্বাস্থ্যসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ : এ দেশে সাধারণত ষাঁড় বা বলদ হালচাষ, গাড়ি টানা প্রভৃতি শক্তি উৎপাদন সম্পর্কিত কাজে ব্যবহৃত হয় এবং খাদ্যাভাবে দুর্বল থাকে। ফলে গোশত উৎপাদন আশানুরূপ হয় না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাভজনকভাবে গোশত উৎপাদনকে লক্ষ রেখে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্যাকেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গরু নির্বাচন, কৃমিমুক্তকরণ, পুষ্টি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাত্র ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অধিক গোশতবিশিষ্ট গরু বাজারজাত করে দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানো হচ্ছে এবং খামারিরা অধিক লাভবান হচ্ছেন।
(খ) ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার পালন মডেল : প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় ক্ষুদ্র খামারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার পালন মডেল অনুযায়ী মুরগি পালন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ অর্থনৈতিক লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়াও অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত এক দশকে পোলট্রি সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক ১৪০০ টন মুরগির গোশত ও ১ কোটি ৫০ লাখ পিস ডিম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার ১০০% পূরণ করার জন্য যথেষ্ট (সূত্র : সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি)।
(গ) স্ল্যাট/স্টল পদ্ধতিতে ছাগল পালন বাংলাদেশে সাধারণত উন্মুক্ত অবস্থায় ছাগল পালন করা হয়ে থাকে এবং ছাগলের জন্য বিশেষ কোনো ঘর তৈরি করা হয় না। এর ফলে ছাগল প্রায়ই নিউমোনিয়া ও বিভিন্ন প্যারাসাইটিক রোগে আক্রান্ত হয়, ফলে উৎপাদন মারাত্মক হারে ব্যাহত হয়। এসব সমস্যা রোধে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক স্ল্যাট পদ্ধতিতে বাসস্থান ও সম্পূর্ণ আবদ্ধাবস্থায় স্টলফিডিং প্রযুক্তির সম্প্রসারণে অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।
(ঘ) গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস পালন প্রযুক্তি নদীমাতৃক কৃষিনির্ভর এ দেশে প্রাচীনকাল থেকেই পারিবারিকভাবে হাঁস পালন হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিতে বছরব্যাপী আবদ্ধ বা অর্ধআবদ্ধ অবস্থায় উন্নত জাতের খাকি ক্যাম্পবেল, জিন্ডিং, ইন্ডিয়ান রানার প্রভৃতি হাঁস আদর্শ ব্রুডিং ও সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পালনে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পালিত হাঁস মাত্র ১৮-২০ সপ্তাহ থেকে ডিম পাড়া আরম্ভ করে এবং গড়ে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম পাওয়া যায়।
(ঙ) পারিবারিক পর্যায়ে কোয়েল/ককরেল/ খরগোশ পালন প্রযুক্তি : জনবহুল এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে প্রয়োজন খাদ্যের বৈচিত্র্যময়তা। এ লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন সংযোজন হয়েছে খরগোশ, ককরেল ও কোয়েল পালন। দ্রুত বর্ধনশীল, স্বল্প পুঁজি ও অধিক লাভজনক হওয়ায় এ সেক্টর দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে
(চ) প্রাণিসম্পদের চিকিৎসা উন্নয়নে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ
গবাদিপশুর কৃমিরোগ দমন মডেল।
পিপিআর রোগের সমন্বিত চিকিৎসা।
ELISA ভিত্তিক ক্ষুরারোগ নির্ণয় পদ্ধতি।
পিপিআর ও রিন্ডারপেস্ট রোগ নির্ণয়ে EISA পদ্ধতি।
বাণিজ্যিক খামারে মুরগির জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা।
পিপিআর ও সালমোনেলা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও ব্যবহার ইত্যাদি।
এ ছাড়াও অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর এবং জেলা প্রাণী হাসপাতালগুলো থেকে কৃষক ও খামারিদের রুগ্ণ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা, টিকা প্রদান এবং বিভিন্ন পরামর্শ সেবা দেয়া হয়। এ সেবা কার্যক্রম সেবাকর্মীদের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৭ কোটি ৭৫ লাখ রুগ্ণ পশু-পাখিকে চিকিৎসা সেবা ও ১৯ কোটি ২৩ লাখ পশু-পাখি রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৭ প্রকারের টিকা দেয়া হয়।
(ছ) মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার : ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে ৫ বছরমেয়াদি ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষ থেকে শুরু হয়েছে। এই কলেজে প্রতি শিক্ষা বর্ষে ৬০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে এবং তাদের শিক্ষাকার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে। সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ভেটেরিনারি শিক্ষার প্রসারে নতুন একটি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়াও প্রাণিসম্পদ খাতে সাব-প্রফেশনাল জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘এসটাবলিসমেন্ট অব ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি প্রজেক্ট’ প্রকল্পের আওতায় ৫টি প্রাণিসম্পদ ডিপ্লোমা ইনাস্টিটিউট স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি শিক্ষা বর্ষে ২০০ জন ছাত্রছাত্রী প্রাণিসম্পদের ওপর ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়ন করতে পারবে।
(জ) প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বেকার যুবক ও যুব মহিলা, দুস্থ পরিবার, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের (১ম পর্যায়) মাধ্যমে ২৫.০৪ কোটি টাকা ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের (২য় পর্যায়) মাধ্যমে ৮.৬৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের (ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি) কর্মসূচির মাধ্যমে ৪৪০টি উপজেলায় ৩২.৯৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। নতুন প্রণীত কার্যনির্দেশিকা-২০১১ অনুসারে পুনঃক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। বর্তমানে দুগ্ধ খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ২০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠিত হয়েছে। অচিরেই এই ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চালু হবে।
(ঝ) উন্নয়ন প্রকল্প : প্রাণিসম্পদের সার্বিক উন্নয়নে অধিদপ্তর কর্তৃক বর্তমানে ১৫টি প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাণিজ পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উপসংহার : প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রণীত ভিশন-২০২১ এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৮৫ শতাংশ নাগরিকের মানসম্পন্ন পুষ্টি চাহিদা পূরণের নিমিত্তে দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা যথাক্রমে দৈনিক ১৫০ মিলি, দৈনিক ১১০ গ্রাম ও বছরে ১০৪টিতে উন্নীত করা এবং প্রাণিসম্পদ খাতে প্রত্যক্ষভাবে ১১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাণিসম্পদের অগ্রযাত্রার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের অবসান ঘটানোই আমাদের অঙ্গীকার।
অজয় কুমার রায়*
* মহাপরিচালক (অ. দা.), প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ঢাকা-১২১৫
বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাপনের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত জনগোষ্ঠী কিছু নাগরিক সুবিধা ভোগ করে, যা গ্রামের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিদ্যুৎ, পাইপলাইনের মাধ্যমে রান্নার জন্য গ্যাস, ক্যাবল টিভির সম্প্রচার, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সেবার বেশির ভাগ থেকেই গ্রামের মানুষ বঞ্চিত থাকে। অন্যদিকে গ্রামের মানুষ সবুজ প্রকৃতি, বিশুদ্ধ বাতাস, উন্মুক্ত খেলার মাঠ, তাজা শাকসবজি এবং দূষণমুক্ত পরিবেশের সুবিধা পেলেও শহরে বসবাসকারী নাগরিকগোষ্ঠী তা থেকে বঞ্চিত হয়। জীবন যাপনের এই ব্যতিক্রমধর্মী বৈচিত্র্য থাকলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের সঙ্গী হচ্ছে দারিদ্র্য। গ্রামের মানুষ নানামুখী দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের দারিদ্র্য, শিক্ষার দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত দারিদ্র্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য, মানবাধিকার ও আয় বৈষম্যজনিত দারিদ্র্যসহ নানামুখী প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় গ্রামের মানুষকে।
নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার নগর ও গ্রামীণ জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমবায় নীতি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘লোভের উত্তেজনা, শক্তি উপাসনা, যে অবস্থায় সমাজে কোন কারণে অসংযত হয়ে দেখা দেয় সে অবস্থায় মানুষ আপন সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্ব সাধনার দিকে মন দিতে পারে না; সে প্রবল হতে চায়, পরিপূর্ণ হতে চায় না। এই রকম অবস্থাতেই নগরের আধিপত্য হয় অপরিমিত, আর গ্রামগুলি উপেক্ষিত হতে থাকে। তখন যত কিছু সুবিধা সুযোগ, যত-কিছু ভোগের আয়োজন, সমস্ত নগরেই পুঞ্জিত হয়। গ্রামগুলি দাসের মতো অন্ন জোগায় এবং তার পরিবর্তে কোন রকম জীবনধারণ করে মাত্র। তাতে সমাজের মধ্যে এমন একটা ভাগ হয় যাতে এক দিকে পড়ে তীব্র আলো, আর-এক দিকে গভীর অন্ধকার।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই প্রবন্ধে আরো উল্লেখ করেন যে, “নগরগুলি দেশের শক্তির ক্ষেত্র, গ্রামগুলি প্রাণের ক্ষেত্র। সামাজিকতা হল লোকালয়ের প্রাণ। এই সামাজিকতা কখনোই নগরে জমাট বাঁধতে পারে না। তার একটা কারণ এই যে, নগর আয়তনে বড়ো হওয়াতে মানুষের সামাজিক সম্বন্ধ সেখানে স্বভাবতই আলগা হয়ে থাকে। আর-একটা কারণ এই যে, নগরে ব্যবসায় ও অন্যান্য বিশেষ প্রয়োজন ও সুযোগের অনুরোধে জনসংখ্যা অত্যন্ত মস্ত হয়ে উঠে। সেখানে মুখ্যত মানুষ নিজের আবশ্যককে চায়, পরস্পরকে চায় না। দেখতে দেখতে গত ৫০ বছরের মধ্যে নগর একান্ত নগর হয়ে উঠল, তার খিড়কির দরজা দিয়েও গ্রামের আনাগোনার পথ রইল না। একেই বলে ‘ঘর হইতে আঙিনা বিদেশ’; গ্রামগুলি শহরকে চারিদিকেই ঘিরে আছে, তবু শত যোজন দূরে।”
বাংলাদেশের চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর একটি অন্যতম রূপ হচ্ছে সংঘবদ্ধ থাকা। পরিবার প্রথা ভিত্তিক গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল শক্তি হচ্ছে সম্মিলিত উদ্যোগ, সামাজিক বন্ধন এবং সমষ্টিগত উন্নয়ন। গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সমবায় দর্শন বেশ টেকসই এবং কার্যকরী হাতিয়ার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিচ্ছিন্নভাবে সমবায় ব্যবস্থা প্রায় শতাধিক বছর যাবৎ গ্রামীণ দারিদ্র্য লাঘবে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তিন-স্তর বিশিষ্ট সমবায় বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন পেশার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করে সমবায়ের মাধ্যমে এগিয়ে চলার পথ দেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষক সমবায়, জেলে সমবায়, তাঁতী সমবায়সহ নানা ধরনের পেশাভিত্তিক সমবায় সংগঠন গড়ে উঠে। এসব সমবায় সমিতির যেমন সাফল্য ছিল তেমনি নানামুখী দুর্বলতা/ব্যর্থতাও কম ছিল না। ষাটের দশকে তিন-স্তর বিশিষ্ট সমবায়ের পাশাপাশি দ্বিস্তর সমবায়ের যাত্রা শুরু হয়। মূলত আখতার হামিদ খান দ্বিস্তর বিশিষ্ট সমবায়ের প্রবর্তন করেন। এ ধরনের সমবায় মডেলের আওতায় গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর সমন্বয়ে উপজেলা পর্যায়ের কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আশির দশকের শুরুর দিকে এ ধরনের দ্বিস্তর সমবায়ের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলেও বিংশ শতকের শুরুর দিকে সমবায়ের এ ধারাটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯০৪ সন থেকে শুরু হয়ে ২০০৪ সন পর্যন্ত সমবায় পদ্ধতির নানামুখী প্রয়োগ লক্ষ করা গেলেও কার্যত টেকসই সমবায় মডেল গড়ে উঠেনি। সমবায় সেক্টরে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও জাতীয়ভাবে টেকসই গ্রাম উন্নয়নের কার্যকর পদ্ধতি লক্ষ করা যায়নি। অথচ বিশ্বব্যাপী সমবায় একটি স্বীকৃত উন্নয়ন কৌশল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানার অন্যতম খাত হিসেবে সমবায়কে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েই সমবায়কে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং শোষিত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশলিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে সমবায়কে বেছে নেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), কুমিল্লায় সমবায় ভিত্তিক সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি শীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে এ গবেষণার সফল পরিসমাপ্তি শেষে ২০০৫ সনে যখন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কাছে জাতীয় ভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়নের জন্য হস্তান্তর করা হয় তখন বাংলাদেশে সমবায়ের সাফল্য ব্যর্থতার ১০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ রকম একটি সময়ে দেশের ২১টি উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে জাতীয়ভাবে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়ে ২০০৯ সনে ২য় পর্যায়ে দেশের ৬৪টি জেলার ৬৬টি উপজেলায় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের মধ্যে রয়েছে-
উদ্দেশ্য
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি গ্রামের সব শ্রেণী ও পেশায় নিয়োজিত গ্রামবাসীদের গ্রামভিত্তিক একটি সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির আওতায় এনে স্বচেষ্টা ও আত্মনির্ভশীলতার ভিত্তিতে সব পরিবারের যুব-কিশোর, মহিলা ও পুরুষদের যোগ্যতা ও ঝোঁক অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে আয়-উপার্জন বৃদ্ধিকল্পে আত্মকর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচন।
সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো হলো
১। প্রতিটি গ্রামে একটি সমন্বিত (Comprehensive) গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি গঠন করা। বয়স, লিঙ্গ, পেশা এবং শ্রেণিভেদে সবার জন্য এই সমবায় সমিতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
২। গ্রামবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির আওতায় গ্রামের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা।
৩। বেইজ লাইন সমীক্ষার মাধ্যমে Village Information Book (গ্রাম তথ্য বই) তৈরি করা এবং সে ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা যা বাস্তবায়নে গ্রামবাসী সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে।
৪। প্রতিটি সমিতিতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষিত গ্রাম উন্নয়ন কর্মী তৈরি করা যারা গ্রাম ও সরকারি সেবা সরবরাহকারী দপ্তরের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করবে। একইভাবে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি সরকারের জাতিগঠনমূলক দপ্তর সমূহের উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমের প্লাটফর্ম হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
৫। ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৬। সমবায় সমিতির আওতায় গৃহস্থালি কাজে সোলার প্যানেল ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ করে সৌরশক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
৭। গ্রামকে উন্নয়নের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
বাস্তবায়ন কর্মকৌশল
১। প্রতিটি সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি পারিবারিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সার্বিক গ্রাম তথ্য বই প্রণয়ন করবে।
২। গ্রাম তথ্য বই এর ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বার্ষিক গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে (অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন)। এই পরিকল্পনাটি Bottom up Planning এর প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কাজ করে। মূলত এর মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
৩। গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বিত হবে কেন্দ্রীয় সমিতিতে এবং সামাজিক ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদে প্রেরণ করবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সমিতি ব্যাংকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করবে।
৪। সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মী থাকবে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে (যেমন- কৃষি, মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু, স্বাস্থ্য-পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, মহিলা, যুব, পরিবেশ, সেলাই ও হস্তশিল্প, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স, প্লাম্বিং অ্যান্ড পাইপ ফিটিংস ইত্যাদি) প্রশিক্ষিত হবে। তাঁদের মাধ্যমে ও সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সরাসরি তত্ত্বাবধানে সব ধরনের সরকারি সেবা ও উন্নয়ন উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
৫। গ্রাম পর্যায়ে মহিলা, পুরুষ এবং ক্ষুদে সমবায়ীগণ প্রতি সপ্তাহে পৃথকভাবে সভা করে তাঁদের কাজ কর্মের অগ্রগতি পর্যালোচনার মাধ্যমে পরিবীক্ষণ করবে। বিভিন্ন বিষয় বা দলভিত্তিক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করে সমিতির কাজ-কর্ম সমন্বিতভাবে পরিচালিত হবে।
৬। প্রতিটি সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতিতে একজন করে গ্রামকর্মী নিয়োজিত থাকবে। গ্রামকর্মীর মূল দায়িত্ব হচ্ছে সমবায় সমিতির সাপ্তাহিক সভা (উঠোন বৈঠক), মাসিক সভা আহ্বান ও পরিচালনা করা। তাছাড়াও সদস্য অন্তর্ভুক্তি, শেয়ার-সঞ্চয় সংগ্রহ, বিনিয়োগ, ব্যাংক হিসাব রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় সাচিবিক দায়িত্ব পালন করা গ্রামকর্মীর অন্যতম দায়িত্ব। গ্রামকর্মী হচ্ছে সিভিডিপি সমবায় সমিতির মূল Focal Person.
৭। একটি উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ সমবায় সমিতি নিয়ে এক একটি গুচ্ছ (Cluster) গঠিত হয়। প্রতি মাসে এই Cluster এর আওতায় প্রতি সমিতি হতে ০৩ (তিন) জন করে সমবায়ী একটি যৌথসভায় মিলিত হবে। সভায় উপস্থিত সমবায়ীরা নিজ নিজ সমবায় সমিতির বিগত মাসের কার্যক্রম মূল্যায়ন করবে এবং আগামী মাসের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এর ফলে সমবায়ীদের সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং পরিকল্পিতভাবে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নে সুযোগ লাভ করে।
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি শীর্ষক প্রকল্পের আওতাভুক্ত গ্রামগুলোতে গঠিত সিভিডিপি সমবায় সমিতিতে সরকারি-বেসরকারি সেবা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা এবং প্রকল্প দপ্তর থেকে প্রদত্ত সেবা সমন্বিত হয়। ফলে গ্রামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশসহ সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। এ ধরনের সেবা চলাচলের আন্তঃপ্রবাহ নিম্নবর্ণিত ছকে দেখানো যেতে পারে-
গ্রামের মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জনসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, সংগঠিত হয়ে সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা, স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, সরকারি এবং বেসরকারি সেবাগুলো তৃণমূল মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতিগুলো কাজ করে যাচ্ছে। নিরন্তরভাবে পরিচালিত এ কার্যক্রম গ্রামের মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতির সূচকগুলোকে উর্ধ্বমুখী রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ এবং উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান থাকায় সিভিডিপিভুক্ত গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের তুলনায় অধিক সচেতন, এসব গ্রামের তরুণরা অধিকতর আত্মপ্রত্যয়ী এবং উদ্যোমী, নারীরা সাহসী হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে। সিভিডিপি পরিবারের ক্ষুদে সদস্যরা একদিকে সঞ্চয়ী হওয়ার দীক্ষা পাচ্ছে পাশাপাশি সামাজিক নেতৃত্বের কলাকৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হচ্ছে।
সিভিডিপির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠা ‘সমবায় শক্তি’ পারে গ্রামের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়ে সমৃদ্ধ এবং আলোকিত গ্রাম প্রতিষ্ঠা করতে, যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মো. মফিজুল ইসলাম*
* নিবন্ধক ও মহাপরিচালক, সমবায় অধিদপ্তর, ঢাকা
ইক্ষু একটি অন্যতম খাদ্য তথা শিল্পজাত ফসল। এটিকে দুর্যোগ সহনশীল ফসল বলা হয়, যা খরা, বন্যা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু। বাংলাদেশে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ১২টিতে মোট ০.১৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ইক্ষু ভালো হয়। তবে সারা দেশেই চিবিয়ে খাওয়া ও গুড় উৎপাদনকারী আখের জাত চাষ করা হয়। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের সুষ্ঠু বিকাশে প্রতি মিনিটে ১০০ গ্রাম ব্রেনের জন্য ৭৭.০ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ প্রয়োজন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সুপারিশ মতে প্রতি বছর ন্যূনতম ১০ কেজি চিনি ও ৩ কেজি গুড় খাওয়া প্রয়োজন। এ হিসাবে বর্তমানে ১৬ কোটি লোকের জন্য প্রায় ২১ লাখ টন চিনি ও গুড় প্রয়োজন। কিন্তু দেশে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে চিনি ১.৫ লাখ টন ও গুড় ৬ লাখ টন। তাহলে ঘাটতির পরিমাণ হলো প্রায় ১৪ লাখ টন। যদিও বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধিত আকারে দেশের চাহিদার জোগান দিয়ে থাকে। এতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লাখ চাষি ইক্ষু চাষ করে থাকে এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ইক্ষু চাষের ওপর নির্ভরশীল। এতে প্রতি বছর ৬.৬ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে ইক্ষুর অবদান প্রায় ০.৭৪%, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১৫২২ কোটি টাকা আর ফসল উপখাতে ইক্ষু আবাদি জমির অবদান ২.০৫% কিন্তু কৃষি জিডিপিতে এর অবদান ৫.৫২%।
এ দেশে সব ধরনের জমিতে ইক্ষু চাষ হয় তবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ইক্ষু চাষের জন্য উপযোগী। তবে চরের বালুময় পতিত জমি, পাহাড়ি বন্ধুর জমি ও লবণাক্ত জমি যেখানে অন্যান্য ফসল চাষ করা কষ্টসাধ্য সেসব এলাকায় সফলভাবে ইক্ষু চাষ করা হচ্ছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাড়ির আঙ্গিনায় ইক্ষু চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কৃষকের বসতবাড়ির ভিটায় (২.৫ শতাংশ জমিতে) ২২০টি চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী ইক্ষু চারা থাকে এবং প্রতিটি ইক্ষু চারা থেকে গড়ে ৬টি মাড়াইযোগ্য ইক্ষু হিসেবে ২২০x৬ = ১৩২০টি বিক্রয়যোগ্য ইক্ষু পাওয়া যায়, যা আশ্বিন-কার্তিক (অর্থনৈতিক মন্দা মাস) মাসে ১০ টাকা হিসেবে বিক্রয় করলে ১৩২০x১০=১৩২০০ টাকা বাড়তি আয় হবে, যা তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সহায়ক। আর উপকূলীয় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানিতে যখন সব ধরনের ফসল ভেসে যায় তখনও ইক্ষু মাথা উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে দুর্যোগের ২-৩ দিন খাদ্যের অভাবে যখন মহামারী হয় তখন ইক্ষুর রস তৎক্ষণাৎ খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে। কেননা ইক্ষু রস একটি পুষ্টিকর পানীয়। সাধারণত ১ গ্লাস ইক্ষুর রস থেকে ২৭ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়।
ইক্ষু এমন একটি ফসল যার কোনো অংশ ফেলে দেয়া হয় না। ইক্ষু থেকে আমরা চিনি, গুড়, মোলাসেস (নালি), ব্যাগাসী (ছোবড়া) ও প্রেসমাড পেয়ে থাকি। সুতরাং ইক্ষু একমাত্র ফসল, যা ভারী শিল্প ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের দেশে উৎপাদিত কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখ টন গুড় উৎপন্ন হয়। গুড় এ দেশের একটি গ্রামীণ শিল্প। বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন থাকার কারণে গুড় চিনির চেয়ে অধিকতর পুষ্টি মানের। এছাড়া আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গুড়ের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপরন্তু গুড়ের একটি বিশেষ ভোক্তা শ্রেণী রয়েছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে তাল, খেজুর ও ইক্ষুর গুড়ই একমাত্র মিষ্টান্ন তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসাগুড়, দানাদার গুড়, পাটা গুড়, পাটা চিনি ও খাঞ্জেশ্বরী গুড় এ দেশেরই ঐতিহ্য। প্রাকৃতিক নানাবিধ উপাদান গুড়ের সঙ্গে মিশে থাকায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমানে উন্নত ও সাদা চিনির চেয়ে অধিকতর নিরাপদ। পূর্বে বলা হতো গুড় আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে গ্লোবাল ভিলেজ আমাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে খাঞ্জেশ্বরী গুড় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য রপ্তানি করছে।
খাবার হিসেবে ইক্ষুর কাণ্ড সরাসরি চিবিয়ে রস পান করা হয়। ইন্দোনেশীয়ায় ইক্ষু কাণ্ড থেকে স্যুপ তৈরি করা হয়। এছাড়া ইক্ষু থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। কলোম্বিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকায় ইক্ষুর রস থেকে তৈরি পেনেলা নামের জনপ্রিয় খাবার প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইক্ষু থেকে চকোলেট, ক্যান্ডি ও ইক্ষুর রস কোমল পানীয় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর ইক্ষু থেকে চিনি তৈরি হয়, যা বিশ্বে সার্বজনীন মিষ্টি দ্রব্য হিসেবে সমাদৃত ও মিষ্টিজাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইক্ষুর উপজাতসমূহের অর্থনৈতিক বহুমুখী ব্যবহারকল্পে ইক্ষু থেকে যে মোলাসেস তৈরি হয় তা থেকে ইথানল পাওয়া যায় যা বায়োফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্রাজিলে মোটর গাড়ি চালনার জন্য ইথানলকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে ইথানল ব্যবহারের মাধ্যমে গাড়ি চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর যেমন চাপ কমবে, অন্যদিকে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় তা সাশ্রয় হবে। ইক্ষুর উপজাত ব্যাগাসী থেকে বিদ্যুৎ, কাগজ তৈরির পাল্প এবং বায়োগ্যাস পাওয়া যায়। মরিশাসে ১ টন ব্যাগাসী থেকে ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ইক্ষুর ছোবড়া বা ব্যাগাসী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে যা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায়। এ ছাড়া প্রেসমাডকে জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে প্রায় ২০% জৈব পদার্থ থাকে। জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। আমাদের দেশের মাটির জৈব পদার্থ দিন দিন কমে যাচ্ছে। একটি ভালো কৃষি জমির ফসল ফলানোর জন্য ২% এর উপরে জৈব পদার্থ থাকতে হয়। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মাটিতে ১.৫% এর নিচে জৈব পদার্থ আছে। কাজেই মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাটিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পচানো প্রেসমাড প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং কারখানায় প্রেসমাড থেকে জৈবসার তৈরি করে বাজারজাত করা যেতে পারে।
চিনিকলগুলোতে চিনি তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো ইক্ষু। তবে চিনিকলগুলোর বর্তমান মাড়াই অবস্থা ভালো নয়। চিনিকলগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২.১ লাখ টন। আর বর্তমানে বাংলাদেশে চিনি ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ টন। পরিকল্পিত নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে চিনিকলগুলোর প্রভূত উন্নতি করে একদিকে যেমন চিনি ঘাটতির পরিমাণ কমানো যায় অন্যদিকে তেমনি ইক্ষুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। উপসংহারে এ কথা বলা যায়, ইক্ষু হলো এমন একটি অর্থকরী ফসল যার সব অংশ ব্যবহার যোগ্য। এটি যেমন খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় তেমনি কুটির শিল্পের ও ভারী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর ইক্ষুর উপজাতসমূহের বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
ড. খন্দকার মহিউল আলম*
ড. মু. খলিলুর রহমান**
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা ও পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী-৬৬২০, পাবনা
** মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী-৬৬২০, পাবনা
বছর ঘুরে আবার এলো বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য আমাদের বিশেষ বিষয়ের ওপর কিছুদিন বিশেষভাবে ভাবায়। আমরা চেষ্টা করি সে প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে দেশ জাতি সমাজ এবং গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং তার ফলশ্রুতিতে একটু সুন্দর সাবলীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, সহায়তা করতে। যার পরিণামে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার কিছু কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আশা করা যায়, আমরা আশাবাদী হই। এভাবেই চলে বিশ্ব খাদ্য দিবসের সালতামামি। ১৯৪৫ সনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জন্ম হলেও মূলত প্রতিপাদ্যভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১৯৮১ থেকে। সে সময় ১৯৮১/৮২ দুই বছর একই প্রতিপাদ্য ছিল। পরবর্তীতে প্রতি বছর আলাদা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ নির্বাচন করে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপনের রেওয়াজ চালু হয়ে আসছে। তাছাড়া ১৯৯৪/৯৫ থেকে টেলিফুড নামে নতুন আরেকটি কার্যক্রম কর্মসূচি বিশ্বখাদ্য দিবসের সাথে চালু হয়েছে। টেলিফুডের মূল উদ্দেশ্য ছিল টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্বের সেলিব্রেটিদের দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য বিভিন্ন ব্যঞ্জরিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের আহ্বান অনুরোধ জানানো। যেন ক্ষুধা দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো ক্ষুধা থেকে মুক্তি পায়, পুষ্টির ঘাটতি থেকে পরিত্রাণ পায়। গণমানুষ যেন দুমুঠো ভাত খেয়ে প্রয়োজনীয় বস্ত্র পরিধান করে সামান্য মাথা গোজার ঠাঁই নিয়ে আশ্রয়টুকু খুঁজে পায়। আর অসুখে বিসুখে প্রয়োজনীয় ওষুধ পথ্য পায়। অবশ্য টেলিফুড কার্যক্রমটি বেশি দিন স্থায়ী থাকেনি। ২০০৪/০৫ সনের পরে বন্ধ হয়ে গেছে। সেখান থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য দিবস বেশ আড়ম্বর আর অনাড়ম্বরের মধ্যে পালিত হয় জাতিসংঘের সবক’টি সদস্য দেশের মধ্যে। বিবেচনার জন্য বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যভিত্তিক দিবস পালনের শুরু থেকে এ যাবৎকাল পর্যন্ত প্রতি বছরের প্রতিপাদ্যের ওপর একনজরে চোখ বুলানো যাক।
১৯৮১/৮২ সনে প্রতিপাদ্য ছিল সবার আগে খাদ্য, ১৯৮৩ সনে খাদ্য নিরাপত্তা, ১৯৮৪তে কৃষিতে নারী, ১৯৮৫এ গ্রামীণ দরিদ্রতা, ১৯৮৬তে জেলে ও জেলে সম্প্রদায়, ১৯৮৭তে ক্ষুদ্র কৃষক, ১৯৮৮তে গ্রামীণ যুবক, ১৯৮৯ খাদ্য ও পরিবেশ, ১৯৯০ সনে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য, ১৯৯১ জীবনের জন্য গাছ, ১৯৯২ খাদ্য ও পুষ্টি, ১৯৯৩ মানবকল্যাণে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সমাহার, ১৯৯৪ জীবনের জন্য পানি, ১৯৯৫ সবার জন্য খাদ্য, ১৯৯৬ ক্ষুধা ও পুষ্টির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ১৯৯৭ খাদ্য নিরাপত্তায় বিনিয়োগ, ১৯৯৮ অন্ন জোগায় নারী, ১৯৯৯ ক্ষুধা জয়ে তারুণ্য, ২০০০ ক্ষুধামুক্ত সহস্রাব্দ, ২০০১ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুধামুক্তির সংগ্রাম, ২০০২ পানি খাদ্য নিরাপত্তার উৎস, ২০০৩ ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি, ২০০৪ খাদ্য নিরাপত্তায় জীববৈচিত্র্য, ২০০৫ কৃষি ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ, ২০০৬ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ, ২০০৭ খাদ্যের অধিকার, ২০০৮ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জলবায়ুর পরিবর্তন ও জৈবশক্তি; ২০০৯ সনে সংকটকালীন খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন; ২০১০ ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐক্য; ২০১১ সংকট নিরসনে সহনশীল খাদ্যমূল্য নির্ধারণ; ২০১২ কৃষি সমবায় : ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার উপায়, ২০১৩ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির জন্য টেকসই খাদ্য কৌশল, ২০১৪ পারিবারিক খামার : পরিবেশসম্মত প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগান ও সমৃদ্ধির মূল উৎস। আর এবার ২০১৫ নির্ধারিত হয়েছে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি।
মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন। এজন্য প্রথম এবং প্রধান ধাপ হলো সবার আগে খাদ্য। আর নিরাপদ খাদ্য দিয়ে যদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে মানব জীবনই বৃথা। কৃষিতে নারী একথা আর নতুন করে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। কেননা সব সংস্কৃতির আদি সংস্কৃতি কৃষি। আর কৃষি সংস্কৃতির অগ্রদূত নারী। পুরো পৃথিবী একটা বড় গ্রাম। আর গ্রামের দরিদ্রতা পৃথিবীকে টলটলায়মান করে ভঙ্গুর করে নড়বড়ে করে। সুতরাং গ্রামীণ দরিদ্রতার যাতাকল থেকে মুক্তি পাওয়ার সব ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে। জেলে কিংবা জেলে সম্প্রদায় আমাদের গ্রামীণ তথা দেশে অর্থনীতি এবং পুষ্টির বিরাট অংশের জিম্মাদার। ক্ষুদ্র কৃষকতো কৃষির মূলভিত্তি। গ্রামীণ যুবকের ধনাত্মক উচ্ছ্বাসে গ্রামগুলো প্রাণবন্ত হয়। আমাদের খাদ্য আর পরিবেশ যদি সুসম্মত না হয় তাহলে আমাদের বাঁচা দায় হয়ে যায়। খাদ্য ছাড়া আমাদের জীবন চলে না। কিন্তু এর মাঝেও ভবিষ্যতের খাদ্যের জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা থাকতে হবে। গাছ আমাদের জীবনের জন্য এক বড় আমানত এবং নিয়ামত। সুতরাং জীবনের জন্য গাছ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। খাদ্য শুধু খেলেই চলবে না। খাদ্য ও পুষ্টির সমন্বয়ে আমাদের খাদ্য তালিকা সুনিশ্চিত সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের প্রকৃতি আমাদের কল্যাণে ব্যঞ্জরিতভাবে বিস্তৃত আছে বিশ্বময়। পানির অপর নাম জীবন, সুতরাং জীবনের জন্য পানি অপরিহার্য। এক দল বা এক এলাকার জন্য খাদ্য নিশ্চিত হলে হবে না। খাদ্য হতে হবে সার্বজনীন সবার জন্য পরিমাণমতো পরিমিত। আর সে কারণে আমরা ক্ষুধা আর পুষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এজন্যইতো খাদ্য নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বিবেচনা করে করতে হবে। নারী শুধু কন্যা জায়া জননী নয় অন্ন জোগানে নারী অনন্য। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা দিয়েই আমরা বিশ্বক্ষুধাকে জয় করব। আর সেজন্য আমাদের আকাক্সক্ষা ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর ক্ষুধামুক্ত সহ¯্রাব্দের। প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুধা মুক্তির সংগ্রাম চলছেই। আমাদের সংগ্রাম চলবেই। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই পানি খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস। ক্ষুধার বিরুদ্ধে যদি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ না পায় তাহলে বিশ্ব ক্ষুধা নির্মূল হবে না। জীব বৈচিত্র্যকে যত বেশি লালন করা যাবে খাদ্য নিরাপত্তা তত অর্থবহ হবে। পৃথিবীর সার্বিক সমৃদ্ধিতে কৃষি ও আন্তঃসংস্কৃতির সংলাপ আবশ্যকীয়ভাবে জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে অধিক পরিমাণে। খাদ্য অধিকার আমাদের সবার সব সময় সবখানে। জলবায়ুর পরিবর্তন আর জৈবশক্তির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সেজন্য সংকটকালীন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যকীয়। এটা সম্ভব শুধু ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐকমত্য প্রকাশ করে। যে কোন সংকট নিরসনে সহনশীল খাদ্য মূল্য নির্ধারণ একাকি বা এক জাতির কাজ না এটি আমাদের সবার। কৃষি সমবায়ই পারে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে। একথাতো আমরা জানি খাদ্য নিরাপত্তা আর পুষ্টির জন্য টেকসই খাদ্য কৌশল কত প্রয়োজনীয়। আমাদের পারিবারিক খামার আর সমন্বিত খামার পরিবেশসম্মত খাদ্য জোগান আর সমৃদ্ধির মূল উৎস হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ দারিদ্র্যর দুষ্ট চক্রকে নির্মূল না করতে পারলে আমাদের সামাজিক বন্ধন আর আবশ্যকীয় কৃষিকে মানসম্মত আর আলোর পথে নিয়ে যাওয়া যাবে না কখনো।
এবার বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি। এর মূল কারণ গ্রামীণ দরিদ্রতা দূর করে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগান ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। আর সামাজিক নিরাপত্তা বা সুরক্ষা মানে সমাজে বসবাসরত সবাইকে তাদের মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোকে আকাক্সক্ষা অনুযায়ী নিশ্চিত করা। এরা একে অপরের সাথে সম্পৃক্তযুক্ত। সমাজের বিভিন্ন কাজে সুযোগ সৃষ্টি, খাদ্য উৎপাদন, নিরাপদ খাদ্য দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থ এবং সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহ যা সমাজের মানুষকে তার ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে পরিত্রাণ রাখবে। একটি সুখী সুন্দর জীবন যাপনের পথ সুগম করবে। প্রতিপাদ্যভিত্তিক বিশ্লেষণে গেলে প্রথমই আসে কেন সামাজিক সুরক্ষা জরুরি? সামাজিক কারণে যখন কোন পরিবারের প্রয়োজনীয় আয় করা সম্ভব হয় না, তারা দুঃখ কষ্ট যাতনার মধ্যে জীবন যাপন করে, ক্ষুধায় অন্ন পায় না, শীতে বস্ত্র পায় না, অসুখে ওষুধ পায় না, তখন সে সমাজ আক্ষরিক আর বাস্তব অর্থে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সামাজিক নিরাপত্তা মানে বুঝায় কিছু নীতি আইন কানুন, কর্মসূচি যার মাধ্যমে যারা অন্ন বস্ত্র আশ্রয় থেকে বঞ্চিত তাদের সামান্য কল্যাণে প্রয়োজনীয় সব কিছু করা। সামাজিক নিরাপত্তা মানে বৃহত্তর কল্যাণে সমন্বিত কার্যক্রম, গরিবদের সাহায্য সহযোগিতা সহমর্মিতা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার কিছু সমন্বিত কার্যক্রম। সমাজের মানুষের জন্য কিছু করা মানে আর্থিক সহযোগিতা কিংবা সরাসরি কিছু দেয়া। কখনো উপকরণ কখনো আর্থিক সহযোগিতা। অন্ন বস্ত্র আশ্রয় শিক্ষা স্বাস্থ্য এসবই সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে। শিক্ষা জাতির মেরুদ- এ কথাকে প্রমাণ করার জন্য পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষাকে সার্বিকভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিনামূল্যে বই খাতা কলম পেন্সিল বিতরণ শিক্ষাভাতা স্কুলে টিফিনের ব্যবস্থাসহ আরো অন্যান্য কাজগুলো থেকে পিছিয়ে পড়া সমাজে লেখা পড়ার প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ আরো বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।
সামাজিক নিরাপত্তা আসলে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এর মানে এই নয় যে সমাজের মানুষকে শুধু ক্ষুধা দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখবে। এটি অবশ্যই আরো অনেক কিছু। এটি সমাজের মানুষকে তাদের খাদ্য উৎপাদনকে বাড়াবে, খাদ্য গ্রহণ আর প্রাসঙ্গিকতাকে আরো নিরাপদ আর নিশ্চিত করে। সামাজিক নিরাপত্তা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ২০১৩ সনে পৃথিবীব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তার ম্যাধমে ১৫০ মিলিয়ন মানুষকে পরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হয়েছে। আমরাতো জানি উন্নয়নশীল দেশের ৭৫% বেশি মানুষ কাক্সিক্ষত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত। তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি পায় না। এ অপুষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কৃষিই তাদের জীবন ধারণের মূল উপদান। এ কারণেই কৃষক এবং কৃষির সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে আছে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, সেবা এসব। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে সেখানকার পরিকল্পনা উৎপাদন বিপণন সব কিছুই বাধাগ্রস্ত হয়, থমকে দাঁড়ায়। খাদ্য নিরাপত্তা মানে শুধু খাদ্যে পর্যাপ্ততা-ই নয় বরং খাদ্য উৎপাদন আর খাদ্য গ্রহণও বুঝায়। সামাজিক নিরাপত্তা আমাদের সুখ শান্তি আর কল্যাণময় বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়। এখানে মানুষের মৌলিক অধিকার আর প্রাপ্তিগুলোকে আরো বিশুদ্ধভাবে সংজ্ঞায়িত করে। পারস্পরিক বন্ধনকে আরো অটুট সুদৃঢ় করে।
ব্যক্তিগত বন্ধন থেকে পারিবারিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন থেকে সামাজিক বন্ধন আর সামাজিক বন্ধন থেকে জাতি বন্ধন সৃষ্টি হয়। তবে সামাজিক বন্ধনের মূল্য ব্যাপ্তি গভীরতা সব কিছুর চেয়ে বেশি। কেননা আমাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না বিপদ আপদ সব কিছুতে আমারা পরস্পরের কাছে অলিখিতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কোন প্রয়োজনে সমাজ এগিয়ে আসে আপন দায়ে আপন মহিমার দায়িত্বে। সামাজিক আচার আচরণে এখনো অনেক অনন্য সুন্দর গেঁথে আছে আমাদের জীবনে। ঈদ পূর্জা পার্বণ মেলা বিয়ে আমরা সবাই এখনো সম্মিলিত কাজে বিশ্বাসী। আর এখানকার কৃষি আরো সুদৃঢ় বন্ধনে আটকা পড়ে আছে। একজনের বীজ অন্যের জমিতে একজনের সার অন্যের জমিতে। এক জনের গরু দিয়ে অন্যের জমি চাষ করা, একজনের কাজের লোড বেশি হলে অন্য সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে বৃহৎ কলেবরের কাজকে সহজ আর সরল করে দেয়ার রীতি এখনো প্রমাণ করে এ সমাজ অনেক সুন্দর সম্মিলিত।
এবার সামজিক বন্ধন আর কৃষির মেল বন্ধনের সমন্বয়ের সূত্রটুকু বের করতে পারলেই এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য আবশ্যকীয়তার দিক থেকে সুপ্রমাণিত হবে। কৃষি আমাদের অন্ন বস্ত্র আশ্রয় আর ওষুধের জোগান দেয়। আমাদের জীবন ধারণের সুন্দর স্বপ্নপানে টেনে নিয়ে যায়। আবার সমাজ এ সুন্দরকে পুঁজি করে আমাদের সুখ সমৃদ্ধি আর প্রগতিকে আরো বেগবান করে কাক্সিক্ষত বাতিঘরে পৌঁছে দেয়। আমরা তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বগতোক্তিতে বলি সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশে।
বাংলাদেশ সরকার সাংবিধানিকভাবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করতে দায়বদ্ধ। অধিকাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে এবং কৃষি তাদের প্রধান জীবিকা। সকলের মৌলিক চাহিদা পূরণের সাথে সাথে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে কৃষক তার সামাজিক ও পরিবেশের বাধাগুলো আরো দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে, যা উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, কৃষিতে কর্মসংস্থান, কৃষির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরিকরণে বিশেষ অবদান রাখবে। কেননা কৃষকরাই হচ্ছে গ্রামীণ উন্নয়নের একমাত্র শক্তি এবং দারিদ্র্য চক্র ভাঙার শক্তিশালী হাতিয়ার। গ্রামীণ জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প সুদে এবং সহজে কৃষি ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা, কৃষি ভর্তুকি প্রদান, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্বোধন ও কৃষকের মাঝে বিস্তার, কৃষিতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, খামার যান্ত্রিকীকরণ, সঠিক সময়ে তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, সচেতনতা বৃদ্ধি করা উল্লেখযোগ্য। সরকারের দক্ষ পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে গ্রামীণ জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার সাথে সাথে সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন ও মাছ চাষের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে সিংহভাগ সাফল্য এসেছে এদেশের কৃষক ও কৃষিজীবীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য কৃষিজ উন্নতি অত্যাবশ্যক। এর মাধ্যমেই আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি পাবে এবং সমাজের উন্নয়ন সাধিত হবে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সুষ্ঠু উন্নয়নই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা তথা দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রের অবসান ঘটাতে।
বিশ্ব খাদ্য দিবস বার বার আসবে নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে। আমাদের উচিত নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের ওপরভিত্তি করে কার্যকরভাবে কাজ করে যাওয়া। তা না হলে বারবার প্রতিপাদ্য আসবে চাকচিক্যের দিবস পালন করা হবে। ইতিহাসের স্মৃতিতে কিছু ছবি কিছু কাজ থেকে যাবে। আসল বাস্তবায়ন তখন প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়াবে। আমরা চাই আমাদের চাহিদা হলো প্রতিটি প্রতিপাদ্যের ওপর যথাযথভাবে কাজ হবে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। আমাদের সামাজিক কৃষিভিত্তিক নিরাপত্তা যত বেশি নিরাপদ নিশ্চিত হবে আমাদের গ্রামীণ দারিদ্র্যমুক্ত সুন্দর সাবলীল জীবন যাপন তত সুখকর হবে। গ্রামের অভাব অনটন কমে গিয়ে একটি উন্নতর ও কাক্সিক্ষত কল্যাণময় সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন হবে।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
সন্দেহ নেই কৃষিতে আমাদের তাৎপর্যময় সাফল্য রয়েছে। ফসল কৃষিতে সে সাফল্য মূলত আমাদের দানাশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যতটা, অতটা নয় অনেক ফসলের ক্ষেত্রেই। সবজি ও ফলমূলের উৎপাদনও বেড়েছে বটে তবে এখনো চাহিদার তুলনায় বেশ কম। ডাল, তেল ও মসলা ফসলে উৎপাদন খানিক বাড়লেও আমরা এসব ক্ষেত্রে বেশ পরনির্ভরশীল। ডালজাতীয় ফসলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আরো বহুদূর। মসলা ফসলের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তেল ফসলের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা খানিক কমলেও এখনও আমদানি করতে হয় প্রচুর পরিমাণ তেল। তাছাড়া সরষের তেলের গুণমান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বেশ পিছিয়ে রয়েছি আমরা। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে যথেষ্ট, বেড়েছে আমাদের আলুর উৎপাদনও। তবে আলুর উৎপাদন খানিক কমলেও ক্ষতি নেই বরং সেখানে আবাদ করা সম্ভব হবে অন্যান্য কিছু ফসল।
আমাদের জনসংখ্যা এখনও স্থিতিশীল নয়। এটি বাড়ছে শতকরা বার্ষিক ১.৪৭ ভাগ হারে। আমাদের আবাদি জমিও স্থিতিশীল নয়। এটি বরং উল্টো কমছে প্রতি বছর। কমছে তা ন্যূনতম শতকরা ০.৫০ ভাগ হারে। এ দুটো আমাদের জন্য আসলেই বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে যত বলছি তত মানছি না, যত মানছি তত বাস্তবে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অনেকটা যেন দেখেও না দেখার ভান করা। এসবের বাইরেও কৃষির অন্যান্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে কত। আমাদের জমির জৈব বস্তুর পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অনেক আবাদি জমিতে জৈব বস্তুর পরিমাণ শতকরা ৫ ভাগ থাকার কথা থাকলেও তা নেমে গেছে শতকরা ১ ভাগে। অনিবার্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে জমির উর্বরতা। উপর্যুপরি জমি চাষের ফলে জমির নিজস্ব খাদ্য উপাদান সরবরাহ করার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কেবল মুখ্য উপাদান নয় এমনকি গৌণ খাদ্য উপাদান বিশেষ করে জিংক, বোরন এসবের জন্য ক্রমে একটি সংকটময় অবস্থায় চলে যাচ্ছে আমাদের অনেক আবাদি জমি। অনেকেই আধুনিক কৃষির কুফল বলেই ভাবছে এটাকে। ফসলের আধুনিক জাত ফলন দিচ্ছে বেশি, ফলে সে মাটি থেকে টেনেও নিচ্ছে খাবার বেশি। অন্যদিকে আবার একই জমি আবাদ করা হচ্ছে বারবার। এক ফসলি জমি দুই ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে, দুই ফসলি জমি রূপান্তরিত হয়েছে তিন ফসলি জমিতে। কোন কোন জমি আবার যাচ্ছে এখন বছরের চার ফসলের আওতায়ও। বলা বাহুল্য, এখন আমাদের দেশে ফসলের নিবিড়তা হলো শতকরা ১৯২ ভাগ। সব কিছু মিলে জমির গুণাগুণই যাচ্ছে পাল্টে। টেকসই কৃষির জন্য তা এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ আমাদের নিতেই হবে। মাটিতে জৈবসার প্রয়োগ করে তা করা সম্ভব বটে, তবে সে পরিমাণ জৈবসার তৈরির উদ্যোগ তো আমাদের নেই। আগের দিনে প্রতি গৃহস্থের বাড়িতে গরু-ছাগল এবং মুরগি পালনের রীতি প্রচলিত ছিল বলে প্রতি কৃষকের বাড়িতে পাওয়া যেত গোবর এবং বিষ্ঠা। এসব এক একটি গর্তে জমা করে কৃষক পেতেন জমিতে দেয়ার জৈবসার। আজ বহু গৃহস্থের বাড়িতে গরু, ছাগল বা মহিষ এবং এমনকি হাঁস-মুরগি পালনের কোন আয়োজন নেই। ফলে সহজে জৈবসার পাওয়ার উৎসটা হ্রাস পেয়েছে। আজ তাই উচ্ছিষ্ট জৈব বস্তু পচিয়ে বা কেঁচো চাষ করে কেঁচো সার তৈরি করে মাটিতে প্রয়োগ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এগিয়ে আসতে হবে এ কাজে সরকারকে, কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী প্রাইভেট কোম্পানি এবং বেসরকারি সংস্থাকে এ কাজে যুক্ত করতে হবে। আর আবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে কৃষক সম্প্রদায়কে। জৈবসার উৎপাদনের এক বড় পরিকল্পনা নিতে হবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায়। বাজেটে পিপিপিতে রাখা বরাদ্দ থেকে একাজে জোগান দিতে হবে খানিক অর্থ। জৈবসার প্রয়োগের পাশাপাশি সুষম সার প্রয়োগের বিষয়টিতে আরো সচেতনতা বাড়াতে হবে। মাটিতে যেহেতু অনুপুষ্টির অভাব বাড়ছে দিন দিন কৃষি বিশেজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জমিভেদে প্রয়োগ করতে হবে নানা রকম অনুপুষ্টিসমৃদ্ধ সারও।
চ্যালেঞ্জ আমাদের পানি নিয়েও। সেটি যেমন ভূগর্ভস্থ পানির সমস্যা সেটি আমাদের ভূউপরিস্থিত পানির সমস্যাও। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ যেখানে কঠিন হয়ে পড়ছে সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি সেচের পানি হিসেবে ব্যবহার করা কতটা যৌক্তিক তা খুব দ্রুতই ভেবে নেয়ার সময় এসেছে। তাছাড়া ধানের মতো পানিখোর ফসলে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যয় করব না পানি সাশ্রয়ী সবজি বা ফল ফসলে তা ব্যবহার করব সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে অবশ্যই। দেশের নদী-নালার অনেক এলাকায় বর্ষাকালেও পানির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টির পানি শুকনো মৌসুমে ব্যবহার করার জন্য পানি যে ধরে রাখব জলাশয়ে সে ব্যবস্থা আমাদের কোথায়? আর বৃষ্টিনির্ভর কৃষির জন্য আমাদের প্রস্তুতিও তেমন বড় কিছু নেই। বরং বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধান এক সময়ের প্রধান ফসল হলেও আজ তা গৌণ ধান ফসলে রূপ নিয়েছে। অথচ যথাযথ পরিকল্পনা ও ফসল উন্নয়ন কার্যক্রম নিতে পারলে বর্ষাকালের প্রধান ফসল হয়ে উঠতে পারে আমাদের আউশ ধান। প্রয়োজন সে উপযোগী উন্নত জাত তৈরি করা। প্রয়োজন সে অনুযায়ী আমাদের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রযুক্তিকে শানিয়ে নেয়া। তাহলে পরে ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর বোরো ধান উৎপাদন খানিক কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারও বেশ জরুরি। ‘পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো’ পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে ধান চাষে পানির ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। ভাতের ওপর খানিক চাপ আমাদের কমাতে পারলে লাভ হবে দুইভাবে। গম, গোলআলু, মিষ্টিআলুর পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় খাবার খানিক বাড়াতে পারলে কমবে ভাতের ওপর চাপ। এতে ধান চাষের কিছু জমিতে রবি মৌসুমে ফলানো যাবে অন্য ফসল। তাছাড়া খাবারের বৈচিত্র্য বাড়লে বাড়বে আমাদের পুষ্টির জোগান। সেটিও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফসলের বৈচিত্র্য যত বাড়বে আমাদের মাঠে বাড়বে তত বৈচিত্র্যময় খাদ্যের জোগান। সে কারণেই জমি তো ছাড়তে হবে তেল, ডাল আর মসলার জন্যও। না হলে তো বিশাল অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে এসব আমদানি করতে গিয়ে। অথচ দেশে এখন চমৎকার সব সরষে, বাদাম আর সয়াবিন জাত রয়েছে। ছোলা, মসুর এসব শিম্বি ফসলের বেশ স্বল্পমেয়াদি আর গুণগতমান সম্পন্ন জাতও কিছু রয়েছে আমাদের। পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে হলে খানিক বাড়তি জমি তো ছাড়তে হবে এর আবাদেও। সে পরিকল্পনা আমাদের তো করতে হবে কৃষিজ পণ্যে আমাদের স্বয়ম্ভরতা বাড়াবার জন্যই।
কৃষির আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের জীব বৈচিত্র্য হ্রাস। সে যেমন ফসলের, সে তেমনি মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদেরও। ফসলের আধুনিক জাতের প্রচার ও প্রসার মাঠ থেকে বিদায় করছে আমাদের চেনা জানা সব স্থানীয় জাতগুলোকে। ইতোমধ্যে এর অনেকেই বিলুপ্ত হয়েছে, অনেকে এখন বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়ে বেড়ে বর্তে ওঠা বহু মৎস্য প্রজাতি। প্রাকৃতিক নিয়মেই যারা সেরে নিত প্রজনন কর্মকাণ্ড আজ জলাশয় ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এর জন্য তৈরি করছে এক বৈরী পরিবেশ। আমাদের হাঁস-মুরগি আর চেনা জানা স্থানীয় গো-মহিষাদির লালন পালনও হ্রাস পেয়েছে। বিদেশি ব্রিডের প্রচার প্রসার আর যত্নআত্তি বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশি ব্রিড আর এদের নানা প্রকরণকে। আমাদের এসব মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করার জন্য যে অপ্রতুল ব্যবস্থা রয়েছে তাকে বাড়াতে হবে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করার স্বার্থেই। এরা আমাদের বৈচিত্র্যময় খাদ্যের অন্যতম উৎস। এরা আমাদের নতুন নতুন জাত আর ব্রিড তৈরিরও অন্যতম কাঁচামাল। মাঠ পর্যায়ে এসব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার বাড়াতে হলে নিতে হবে নানা রকম সমন্বিত কার্যক্রম। চাষি ভাইদের কার্যকর অংশগ্রহণের পাশাপাশি গবেষকদেরও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে আগামী দিনের কৃষির কথা ভেবেই। এসব মহামূল্যবান কৃষিজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার মাধ্যমে কৃষিতে সত্যিকার সাফল্য লাভ করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেও।
সন্দেহ নেই আমাদের কৃষির আরেক চ্যালেঞ্জ হলো খরা, লবণাক্ততা, আকস্মিক বন্যা। এসব ছাড়াও রয়েছে ঝড় ও সাইক্লোনের মতো নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের জমি অনেক বেশি লবণাক্ততার হাতে পড়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় ৭টি জেলায় ২-১২ ডিএস/মি. মাত্রার লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক মিলিয়ন হেক্টর। লবণাক্ততা সইয়ে নিয়ে ভালো ফলন দেবে তেমন ফসলের জাতের এখনও ঘাটতি রয়েছে। দু-চারটি ধানের জাত অবশ্য এ দেশে অবমুক্ত করেছে আমাদের বিজ্ঞানীরা। লবণাক্ত সহিষ্ণু ব্রি-উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৬৭ এবং ব্রি ধান৭৩। এসব জাত খানিক লবণসহিষ্ণু বটে। সমস্যা দাঁড়িয়েছে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার মাত্রা নিয়ে। আর বিশাল দক্ষিণাঞ্চলে ধানের পাশাপাশি জন্মাতে হবে কিছু অন্য ফসলও। সেসব ফসলের লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত সৃষ্টির কর্মকা- বড় শ্লথ। বলা যায় কোন কোন ফসলে তা একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে এ দিকে আমাদের যে ভীষণ মনোযোগ দেয়া দরকার তা বলাইবাহুল্য। দেশের উত্তরাঞ্চলের এক বড় অংশ নানা মাত্রায় খরা আক্রান্ত। বাংলাদেশের ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর ধান আবাদি এলাকা নানা মাত্রার খরা প্রবণ। বাংলাদেশে স্বল্প বৃষ্টি নির্ভর অবমুক্ত ধানের খরা সহিষ্ণু জাতের মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৬৫ এবং ব্রি ধান৭১। বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যায় জলমগ্ন হয় সে রকম আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ মিলিয়ন হেক্টর। প্রতি বছর আকস্মিক বন্যা ফসলের বেশ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ রকম বন্যা সহনশীল অবমুক্ত ধান জাতের মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২। আমাদের বৈরী পরিবেশ সহনশীল আরো জাত উদ্ভাবন করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিজ্ঞানীদের এ কাজে অর্থায়ন করতে হবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে আর দিতে হবে যথাযথ প্রণোদনা। ঘাত প্রতিরোধী জাত সৃষ্টির কর্ম পরিকল্পনাটাকেও খানিকটা শানিয়ে নিতে হবে।
আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ চাষিই হলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। এদের নিজস্ব আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ০.০৫ একর বা তার কিছু বেশি। নিজের জমি চাষের পাশাপাশি অন্যের জমি ভাগে বা বর্গায় চাষ করেন তারা। আমাদের কৃষির এক বড় নিয়ামক শক্তি তারা। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে উন্নত বীজ সংগ্রহ আর সময়মতো কৃষি উপকরণ কেনা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। সহজ শর্তে তাদের কাছে ঋণ সুবিধা পৌঁছে দিতে পারলে নিঃসন্দেহে বাড়বে আমাদের কৃষিজ উৎপাদন। আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা আমাদের মূল্যবান জনশক্তি। তাদের কাছে উৎপাদন প্রযুক্তি ও উত্তম বীজ পৌঁছে দেয়া আগামী দিনের কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকা- হতে পারে। তাছাড়া তারা যেন সঠিক মূল্যে সঠিক সার ও সঠিক কীটনাশকসহ অন্য বালাইনাশক পান সেটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল সার, ভেজাল ওষুধ কেবল কৃষকের অর্থের বিনাশ ঘটায়, উৎপাদনে এর প্রভাব হয় নেতিবাচক। ফলে আমাদের কৃষিজ পণ্য চাহিদা মেটাতে হলে এসব কৃষককে সঠিক উপকরণ সহায়তা প্রদান করে কৃষি উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা নিজেদের শ্রম ও বিনিয়োগ করে তাদের নিজের কিংবা বর্গা জমিতে। তাদের ঘামে শ্রমে উৎপাদিত হয় নানা কৃষিজ পণ্য। প্রায়ই এসব পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হন তারা। পচনশীল শাকসবজি ও ফলমূলের দাম কম হলেও তারা বেচে দিতে বাধ্য হন। এসব দরিদ্র কৃষক তাদের শাকসবজি ও ফলমূল দু-একদিনের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারে সে ব্যবস্থাও গড়ে উঠেনি দেশে। কৃষিজ পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এখনও আমাদের দেশে অবহেলিতই রয়ে গেছে। উদয়াস্ত কাজ করে যারা এসব ফলায় তাদের চেয়ে কত অল্প শ্রমে বেশি মুনাফা লাভ করে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা। সরাসরি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য যেন ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়া যায় সে ব্যবস্থা নিতে পারলে লাভবান হবেন এসব কৃষক।
বোঝাই যাচ্ছে আমাদের আগামী দিনের কৃষির সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে চাঙা করে তুলতে হবে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে এরতো কোন বিকল্প নেই। শুধু একথাটি মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের কৃষি কর্মকা- যেন আমাদের মাটি, পানি আর ফসলের বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট না করে দেয়। যেন তা বেধড়ক বিনাশ না ঘটায় আমাদের মূল্যবান কৃষি জীববৈচিত্র্যের। এরাই আসলে আমাদের কৃষির মূল ভিত্তি সম্পদ হিসেবে কাজ করছে। এর যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেই আমাদের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। টেকসই কৃষির জন্য এটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*
* প্রফেসর, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ এবং প্রোভাইস-চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭
আমরা জানি, দারিদ্র্য হচ্ছে এমন একটি দুষ্টচক্র, যা বছরের পর বছর, বংশানুক্রমে আবর্তিত হতে থাকে যদি না কোনবহিঃশক্তি প্রয়োগ করে এর অবসান না করা হয়। স্বাধীনতার পর নবজাতক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার এক বিরাট বোঝা নিয়ে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ছিল বিশ্ব পরিম-লেও। তবে বাংলাদেশের সোনালী ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন একজন, বালাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভাবলেন, ভৌগোলিক ও ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি প্রধান বাংলাদেশে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের স্থবির শৃঙ্খল ভাঙতে হলে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপের কোন বিকল্পনেই। গ্রামীণ দরিদ্র কৃষককে এবং কৃষিকে সুরক্ষার জন্য নেয়া হলো নানামুখী পদক্ষেপ। সেখান থেকে যাত্রা শুরু। আজ চারদশক পর দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২৯ শতাংশের নিচে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু এখন কৃষকের ঘরে খাবার সংকট নেই। কৃষক এখন শুধু পরিবারের খাদ্যের জোগান দেয়ার জন্য চাষ করে না, সে মাঠে ফসল উৎপাদন করে আর্থিক লাভের জন্যও। এ উত্তরণ সম্ভব হয়েছে প্রধানত আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। কৃষক ও কৃষির সুরক্ষার জন্য চলছে অবিরাম গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সম্প্রসারণ ও প্রণোদনা। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে কৃষি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন খাতভিত্তিক অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট অন্যতম।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ভূমি ও মাটির গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে মাটির শ্রেণিবিন্যাস এবং এ সমস্ত উপাত্ত সম্বলিত মানচিত্র প্রণয়ন ও সরবরাহ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান কাজ। গবেষণা ও সম্প্রসারণধর্মী এ প্রতিষ্ঠানটি ভূমি, মৃত্তিকা, সার ও সেচের পানির সুষ্ঠু ব্যবহার বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ কর্মীগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি মাটির ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়, সেচের পানির দূষণ, ভূমির অপব্যবহার, মাটিতে ফসলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি, ভূমির নিষ্কাশন জটিলতা বিষয়ে নিয়মিত পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও সমস্যা সমাধানকল্পে গবেষণামূলক কাজ করে থাকে। ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪১৮ লাভ করে।
এ প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের ক্রমহ্রাসমান ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদের যৌক্তিক, লাভজনক টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সহায়তা করা। এর ফলে কৃষক যেমন টেকসই ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে, পাশাপাশি নিশ্চিত হয়েছে পেশাগত সুরক্ষা। সামগ্রিকভাবে তারা দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠান কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের যৌক্তিক, লাভজনক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার নিশ্চিতকরণ তথা কৃষকদের সুবিধা প্রদানের নিমিত্ত দেশের প্রতিটি উপজেলায় আধা-বিস্তারিত মৃত্তিকা ও ভূমি জরিপের (Semi-Detailed Soil Survey) মাধ্যমে সব উপজেলার জন্য আলাদা আলাদাভাবে ‘ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ নির্দেশিকায় উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ নির্দেশিকায় মাটি, ভূমি ও কৃষি জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে কোথায় কোন ফসল চাষ করা যাবে, উক্ত ফসলে বিভিন্ন জাতওয়ারী কতটুকু সার প্রয়োগ করতে হবে, উক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদনের প্রতিবন্ধকতা ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে মৃত্তিকা ও ভূমি পুন: জরিপের মাধ্যমে এ নির্দেশিকার তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২০টি নবায়নকৃত ‘উপজলো ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা’প্রকাশ করা হয়ছে।
উপজেলা ‘ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকায়’ সন্নিবেশিত মৃত্তিকা উর্বরতা বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্যে রূপান্তর করা হয়েছে। এ বিশাল তথ্য-উপাত্তকে ভিত্তি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্যাটালিস্টের সহযোগিতায় ‘অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম’ নামক একটি সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে এবং ইনফরমেশন কমিউনিকেশন টেকনোলজি ব্যবহার করে ২৭ জুলাই ২০০৯ ‘অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সার্ভিস’ চালু করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৩০টি উপজেলার জন্য এ সেবা চালু করা হয়। বর্তমানে এ সেবা কার্যক্রম দেশের সব উপজেলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র অথবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশের যে কোন প্রান্তের একজন কৃষক শুধুমাত্র তার ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার নাম এবং সাধারণ বর্ষায় জমিতে কতটুকু পানি দাঁড়ায় এ তথ্য দিয়ে মৃত্তিকা উর্বরতা মানের ভিত্তিতে তার চাহিদামতো ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ পেতে পারেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাংলাদেশ সরকারের ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ‘মাইলফলক’। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ‘অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম’ চালুর জন্য ইবংঃ ওঞ টংবৎ-২০১০ অধিৎফ লাভ করে।
মৃত্তিকা উর্বরতা মানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ফসলের চাহিদা অনুসারে সুষম সার ব্যবহারের লক্ষ্যে এসআরডিআই-এর বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে ১৬টি মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে ২০০৯-২০১০ থেকে এ পর্যন্ত ২০১৪ সময়ে মাটি পরীক্ষা করে প্রায় ১,১০,০০০ কৃষককে ফসলভিত্তিক সুষম সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে ফসল উৎপাদন ১৫-২৫% বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ ৫-১০% কম হচ্ছে, মৃত্তিকা অবক্ষয় রোধ হচ্ছে এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাঠ পর্যায়ে ভেজাল সার শনাক্তকরণের কৃষকবান্ধব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সারা দেশের কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মী, সার ডিলার এবং এনজিও কর্মী রাসায়নিক বিশ্লেষণ না করেই সহজ পদ্ধতিতে ভেজাল সার শনাক্ত করতে পারেন।
১০টি ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে প্রতি বছর ১১২টি উপজেলায় সরেজমিন ৫,৬০০ কৃষকের মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করে সুষম সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়।
ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানভিত্তিক সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মৃত্তিকা অবক্ষয় রোধের জন্য সব ইউনিয়নের জন্য ইউনিয়ন ভূমি, মাটি ও সার সুপারিশ সহায়িকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমের আওতায় ইতোমধ্যে ৪৫০টি ইউনিয়নের ইউনিয়ন সহায়িকা প্রকাশ করা হয়েছে। এ সহায়িকা ব্যবহার করে ইউনিয়নভিত্তিক মাটির উর্বরতামান অনুসারে সুপারিশকৃত সার প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ইউনিয়ন ফেস্টুন ব্যবহার করে ইউনিয়নভিত্তিক মাটির উর্বরতামান অনুসারে নির্দিষ্ট ফসলের জন্য সার সুপারিশ প্রয়োগ করা যায়। ইতোমধ্যে ২৫০টি ইউনিয়নের মৃত্তিকার উর্বরতামান অনুসারে প্রধান প্রধান ফসলের জন্য সার সুপারিশ ফেস্টুন তৈরি করে দর্শনীয় ও জনসমাগমের স্থানসমূহে টানানো হয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট উপকূলীয় এলাকার সমস্যাক্লিস্ট লবণাক্ত মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার জন্য টেকসই ও কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। ইনস্টিটিউট দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ত মাটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইতোমধ্যে তিনটি প্রযুক্তি যথাক্রমে- গ্রীষ্মকালীন সবজি ফসলে সেচের জন্য খামার- পুকুর প্রযুক্তি এবং মাদা ফসলের জন্য কলসি-সেচ ও দ্বি-স্তর মালচিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া, ইনস্টিটিউটের লবণাক্ততা মনিটরিং কার্যক্রমের আওতায় উপকূলীয় এলাকার মনিটরিং স্পট থেকে নিয়মিত লবণাক্ততার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এবং লবণাক্ত পরিবীক্ষণ তথ্য ব্যবহার করে উপকূলীয় এলাকার কৃষক ভাইয়েরা মৃত্তিকা, পানি ও লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল চাষের এলাকাসম্প্রসারণ, নিবিড়তা বৃদ্ধি ও অধিক ফলন আহরণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
পার্বত্য এলাকার ভূমি ও মাটি সংরক্ষণ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বান্দরবানে “মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজিকা ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এ গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকার ভূমিক্ষয় ও ভূমি ধস রোধে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যেমন-
ক) ভূমিক্ষয় রোধ ও ফসল চাষের জন্য হেজ-রো (Hedge-Row) প্রযুক্তি
খ) ভূমি ধস রোধ ও পুনরুদ্ধারের জন্য জিও-জুট টেক্সটাইল প্রযুক্তি
গ) নালা ক্ষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য গেবিয়নচেক ড্যাম প্রযুক্তি।
ঘ) পাহাড়ি ঢালে শস্য উৎপাদনের জন্য বেঞ্চ টেরাস প্রযুক্তি।
এছাড়া কন্টুর ক্রপিং, উন্নত জুম চাষ প্রযুক্তি ও এগ্রো-সিলভি কালচার ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্রযুক্তিসমূহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকদের মাঝে বিস্তারের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ি এলাকা বিশেষ করে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি এলাকার কৃষক ভাইয়েরা মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ করে অধিকতর এলাকা ফসল চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বিস্তারিত, আধা-বিস্তারিত ও রিকোনাইস্যান্স জরিপ ও অন্যান্য কার্যক্রমকালে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এবং এরিয়াল ফটোগ্রাফ, ইমেজারি ও জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমি ব্যবহার, সমস্যাক্লিস্ট মাটি, মৃত্তিকা পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি, ফসলবিন্যাসসহ মৃত্তিকা সংক্রান্ত অসংখ্য মানচিত্র প্রণয়ন করেছে। এসব মানচিত্র পরিকল্পনাবিদ, নীতি প্রণয়নকারী এবং গবেষকগণ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ব্যবহার করছেন।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক বিভিন্ন কারিগরি প্রতিবেদন যথা- কৃষি প্রযুক্তির হাতবই, Saline Soils of Bangladesh -২০১০, Land and Soil Appraisal of Bangladesh, Keys to Soil Series, Physiography of Bangladesh, সরেজমিন ভেজাল সার শনাক্তকরণ, সারের নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি, মৃত্তিকা বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে সুষম সার সুপারিশ ম্যানুয়েল, Agricultural Land Availability in Bangladesh নামক পুস্তিকাসমূহ প্রকাশ করেছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ১,০৫০ জন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, ব্লক পর্যায়ের ৩,৬০০ জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং ৭০,০০০ জন কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদে ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা, মাটির নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি, মাটির উর্বরতার ভিত্তিতে সুষম সার প্রয়োগ, সরেজমিন ভেজাল সার শনাক্তকরণ, লবণাক্ত ও পাহাড়ি ভূমি ব্যবস্থাপনা, জৈবসার তৈরি এবং মাটির উর্বরতামান বৃদ্ধিতে সহায়ক বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
মানুষের সর্বপ্রথম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জীবনব্যবস্থার আধুনিকায়ন পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টিকে পৃথিবী জুড়েই একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দরকার অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষককে সর্বোচ্চ প্রণোদনা ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। এসআরডিআই কৃষককে সরাসরি প্রণোদনা না দিলেও কৃষক যাতে টেকসই ও লাভজনকভাবে মাটির ব্যবহার নিশ্চিত করে অধিক খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপৃত থাকতে পারেন সে লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আর এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে নিরসন হবে এবং বাংলাদেশ পরিণত হবে সচ্ছল ও সুখী মানুষের দেশে।
ড. মো. আলতাফ হোসেন*
* প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জরিপ শাখা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ঢাকা
কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক কৃষিকথা ১ বৈশাখ-১৪২২ ৭৫তম বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৪১ সনে মাসিক কৃষিকথার জন্ম। জন্মলগ্ন থেকেই চাষের কথা, চাষির কথা, কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তির কথা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে এই কৃষিকথা। কৃষিকথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের একমাত্র মুখপত্র। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশের জনপ্রিয় অন্যতম প্রাচীন কৃষি ম্যাগাজিন হিসেবেও কৃষিকথার পরিচিতি রয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী ম্যাগাজিনটিকে বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সুসজ্জিত করা হয়েছে। এ ম্যাগাজিনটির গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ম্যাগাজিনটি এখন প্রিন্টিংয়ের পাশাপাশি ওয়েবসাইট, ই-বুকসহ নানা ধরনের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে।
কৃষিকথার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধারক, বাহক, শুভানুধ্যায়ী, পৃষ্ঠপোষক, রূপবৈচিত্র্য সব কিছুকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াসে এ বছর ১০ মে (২৭ বৈশাখ, রোববার) কৃষিকথার ৭৫তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকালের দিকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা ছিল। একটু গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। পরে অনুষ্ঠান বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই সম্পন্ন হলো। অনুষ্ঠানের কর্মসূচির মধ্যে ছিল ‘কৃষি উন্নয়নে কৃষিকথার অবদান’ শীর্ষক সেমিনার, র্যালি, ‘আমাদের কৃষিকথা’ নামে প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন, কৃষিকথা, বৈশাখ-১৪২২ সংখ্যাটিকে বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ, কৃষিকথাকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন স্লোগানসমৃদ্ধ ব্যানার, ফেস্টুন প্রভৃতি। যেসব স্লোগান ছিল সেগুলো হলো- স্বাগতম স্বাগতম কৃষিকথা স্বাগতম/ শুভ হোক শুভ হোক পঁচাত্তরে পদার্পণ; চাষের কথা চাষির কথা/ পাবেন পড়লে কৃষিকথা; কৃষিকথা ঘরে ঘরে/ কৃষক শ্রমিক সবাই পড়ে; দিন বদলের হাতিয়ার/ জুড়ি নাই কৃষিকথার; কৃষি প্রযুক্তি জানতে চাই/ কৃষিকথা পড়ি তাই।
কৃষিকথার ৭৫তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রস্তাবে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের সম্মতি পাওয়ার খবর পাওয়ামাত্র কৃষি তথ্য সার্ভিসের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। মূল প্রস্তাবক হিসেবে আমার অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও পরিচালক স্যার ধৈর্যের সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করে অনুষ্ঠানটিকে সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হন। প্রসঙ্গত, এ কথাটি সত্যি যে, অনুষ্ঠানের সর্বশেষ আয়োজন অর্থাৎ লাঞ্চ প্যাকেট বিতরণ খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সবাই খুশি হন। তাছাড়া প্যাকেটি ছিল বেশ ভারী। এক্ষেত্রে ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার’ কথাটি যথার্থভাবেই প্রযোজ্য বলা যায়।
তথ্য অফিসার (পিপি) কৃষিবিদ জনাব জাকির হাসনাৎ-এর সহযোগিতায় জনাব বাদল চন্দ্র সরকার ‘পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায়’ নামে একটি ডিসপ্লে বোর্ড তৈরি করে। এতে কৃষিকথা প্রকাশনার ধারাবাহিক পর্যায়গুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়। এ বোর্ডটি আ.কা.মু. গিয়াস উদ্দিন মিল্কী অডিটরিয়ামের বারান্দায় প্রদর্শিত হয়। এছাড়া জনাব মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, জনাব মো. নূর ইসলাম ও জনাব রত্নেশ্বর কর্তৃক ডিজাইনকৃত ছোট বড় হরেক রকমের ফেস্টুন ও ব্যানার অডিটরিয়ামের ভেতর ও বাইরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ করে খামারবাড়ি মূল ভবনে ৬০ ফুট লম্বা দুইটি ফেস্টুন কৃষিকথার ৭৫তম বছরে পদার্পণের বার্তা নিয়ে কয়েকদিন ধরে দাঁড়িয়েছিল। এসব ফেস্টুন, ব্যানার দেখে দর্শকরা অভিভূত হন।
বর্তমান কৃষি সচিব জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। এছাড়া বিশেষ অতিথি ও সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি জনাব মো. মকবুল হোসেন এমপি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক জনাব শেখ হেমায়েত হোসেন। উল্লেখ্য, এ সময় মহাপরিচালক এ জেড এম মমতাজুল করিম পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বলেন, ৭৫তম বছরে পদার্পণ কৃষিকথাকে আরও পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করবে। তিনি বলেন, কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি সহজ সরল ভাষায় কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে দেশের কৃষি, কৃষক তথা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে ‘কৃষিকথা’র অবদান অপরিসীম। তিনি বলেন, বর্তমানে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে দেশে অনেক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের কৃষিকথাকে আরও বিস্তৃতির লক্ষ্যে ডিজিটালাইজড ই-বুকের মাধ্যমে প্রকাশের জন্য মাননীয় কৃষিমন্ত্রী আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি জনাব মো. মকবুল হোসেন এমপি বলেন, মাত্র পাঁচ টাকার বিনিময়ে ‘কৃষিকথা’ কৃষির অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রযুক্তি কৃষকের কাছে সরবরাহ করছে। তিনি সহজ সরল ভাষায় গল্প, রম্যরচনা কিংবা লোকজ ভাবধারায় কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় কৃষকের কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
সম্মানিত অতিথি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক জনাব হেমায়েত হোসেন বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সবসময়ই কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকাণ্ডে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে, কৃষক সংগঠনে কৃষিকথা পৌঁছে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে যাবে।
সভাপতির বক্তব্যে কৃষি সচিব জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কৃষি উন্নয়নে গৃহীত কার্যকর বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই দেশ আজ দানাদার খাদ্যে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, বরং বাংলাদেশ আজ খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উৎপাদনের ধারাকে অব্যাহত রেখে টেকসই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন লাগসই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের। কৃষিকথা ম্যাগাজিনটি আপামর কৃষিজীবী মানুষের তথ্য চাহিদা পূরণে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
সেমিনারে ‘কৃষি উন্নয়নে কৃষিকথার অবদান’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ জনাব মিজানুর রহমান। তিনি কৃষিকথার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাসহ কৃষিতে কৃষিকথার ইতিবাচক অবদানের কথা তুলে ধরেন।
উন্মুক্ত আলোচনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক কৃষিবিদ এম. এনামুল হক, কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রাক্তন পরিচালক কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম ও প্রাক্তন উপপরিচালক (গণযোগাযোগ) কৃষিবিদ মো. মঈন উদ্দিন আহমেদ এবং কৃষক মো. হুমায়ুন কবির বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান তথ্য অফিসার কৃষিবিদ জনাব মোহম্মদ আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে কৃষিকথার সার্বিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাক্তন পরিচালকবৃন্দ, প্রাক্তন সম্পাদক মো. সিরাজউদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন অডিও ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট জনাব প্রাণেশ কুমার ম-লের পক্ষে তার মেয়ে সুমনা এবং সর্বোচ্চ গ্রাহক সংগ্রহের স্বীকৃতি হিসেবে কৃষি তথ্য সার্ভিস আঞ্চলিক অফিস, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের টিপি নাহিদ বিন রফিককে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
এছাড়া উপস্থিত সম্মানিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সম্মানিত অতিথি ও সভাপতি মহোদয়কেও সম্মাননা প্রদান করা হয়।
সময়ের স্বল্পতার কারণে অনেক বিশিষ্টজন কৃষিকথা ও কৃষি তথ্য সার্ভিস সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সুযোগ পাননি। এতে তাঁরা সবাই একটু বিব্রত বোধ করেছেন বৈ কি! ব্যক্তিগতভাবে আমিও চেয়েছিলাম আর একটু বিস্তারিতভাবে কৃষিকথার ইতিবৃত্ত নিয়ে আলোচনা হোক। আমরা আশা করি ১৪৪৬ বঙ্গাব্দ/২০৩৯ খ্রিস্টাব্দে যখন শতবর্ষে পদার্পণ কিংবা শতবর্ষ পূর্তি হবে তখন বেশি সময় নিয়ে বেশি বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করে সুন্দর একটি স্মরণীয় ইতিহাস রচনা করবেন কৃষিকথার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তবে এটিও সত্যি যে, এ মহতী অনুষ্ঠানে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথিবৃন্দ উপস্থিত হয়ে মূল্যবান বক্তব্য রেখে কৃষিকথার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক দিকনির্দেশনা দিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন সার্থক করেন। কৃষিকথার পৃষ্ঠপোষকরা বক্তাদের আশা-আকাক্সক্ষার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হলে ভবিষ্যতের কৃষিকথা আরও আকর্ষণীয়, মানসম্পন্ন ও পাঠকনন্দিত হতে সক্ষম হবে। আশার কথা, কৃষি তথ্য সার্ভিস ইতোমধ্যেই কৃষিমন্ত্রী মহোদয় ও অন্যদের বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধিপূর্বক ই-বুক হিসেবে কৃষিকথা আপলোড করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি ও লেখার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ৭ জুলাই ২০১৫ বর্তমান মহাপরিচালক, ডিএই কৃষিবিদ জনাব মো. হামিদুর রহমান কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় কৃষিকথার মান উন্নয়ন, সম্প্রসারণ এবং গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। আমরা আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন তথা দেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার হিসেবে মাসিক কৃষিকথা ১৯৪১ সন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ম্যাগাজিনটি এখন ৭৫তম বর্ষ অতিক্রম করছে। কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি সহজ সরল ভাষায় কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নই এ ম্যাগাজিনটির মূল লক্ষ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্ব খাদ্য দিবস, ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ ও ইঁদুর নিধন অভিযানসহ বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৃষিকথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষিকথায় সাধারণত বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কিত লেখা; হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, পরিবেশ ও বন, প্রশ্নোত্তর, আগামী মাসের কৃষি, সাক্ষাৎকার, গল্প, কবিতা, নাটিকা, রম্য রচনা, বই পরিচিতি প্রভৃতি বিষয়ের লেখা ছাপানো হয়ে থাকে। কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, কৃষিবিদ, সম্প্রসারণবিদ, কৃষিকর্মী, কবি, সাহিত্যিক, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-কৃষাণী সবাই এতে লেখা পাঠাতে পারেন। লেখা বাছাই কমিটি কর্তৃক মনোনীত লেখা নির্দিষ্ট সংখ্যায় ছাপানো হয়। প্রকাশিত লেখার জন্য বর্তমানে সর্বনিম্ন ৫০০.০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০০.০০ টাকা সম্মানী দেয়া হয়। ম্যাগাজিনটির নগদ বিক্রয় মূল্য প্রতি সংখ্যা মাত্র ৫.০০ টাকা। বছরের যে কোন সময় এটির গ্রাহক হওয়া যায়। বার্ষিক গ্রাহক চাঁদা মাত্র ৫০.০০ টাকা। এছাড়া একসঙ্গে ২০ কপি বা তার বেশি সংখ্যার গ্রাহক হলে প্রতি কপি বার্ষিক মাত্র ৪২.০০ টাকা হারে পাওয়া যায়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিবিষয়ক একমাত্র মুখপত্র ‘মাসিক কৃষিকথা’ কৃষক, কৃষিকর্মী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, কৃষিবিদ, লেখক, গ্রাহক, পাঠক সবার অন্তরে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত করুক এবং সবার সুখে-দুখে সম অংশীদার হয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক এটাই কামনা করি।
মো. মতিয়ার রহমান*
*সহকারী সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
হাওরে মিষ্টি কুমড়ার চাষ
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে হাওর। সুনামগঞ্জের শাল্লা, হাওর বেষ্টিত একটি উপজেলা। এখানে বছরে একবার শুধু বোরো মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ ধান জন্মানো হয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় সব জমি জলাবদ্ধ থাকে। বছরে একটি মাত্র ফসল ধান; মার্চ-এপ্রিল মাসের আকস্মিক বন্যা, সেচের পানির অভাব, ঝড়ো হাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টি, তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তন, পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি কারণে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা হাওরবাসীর জীবনযাত্রাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। হাওরের কিছু জমি আছে যা সাধারণত বন্যার পানিতে অপেক্ষাকৃত দেরিতে ডুবে আবার আগে জাগে। এমন জমিকে স্থানীয় লোকেরা ‘কান্দা’ জমি বলে। এসব কান্দা জমিতে সেচ প্রয়োগ করে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না বলে অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। এরকম কান্দা জমিতে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মুলা, মিষ্টি কুমড়া, গম, সরিষা ইত্যাদি চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশের সহায়তায় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরামর্শে আনন্দপুর গ্রামের কৃষক বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস গত বছর তার ২৮ শতক জমিতে মুলা ও মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেন। তার ক্ষেতের প্রতিটি কুমড়ার ওজন হয় গড়ে ১২ কেজি। এ সব মিষ্টি কুমড়া তিনি স্থানীয় বাজারে গড়ে ১০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করে প্রায় ৭০ হাজার টাকা নিট লাভ করেন। অক্টোবর মাসে কান্দা জমি জেগে উঠার পর জো আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চাষ দিয়ে জমিতে ফালি ফালি করে বেড তৈরি করেন। প্রতিটি বেডের উচ্চতা ১৫-২০ সেমি. এবং প্রস্থ ২.৫ মি., পাশাপাশি ২ বেডের মাঝখানে ৬০ সেমি. ব্যাসের সেচ ও নিকাশ নালা রাখেন। প্রতিটি বেডে ৫০ সেমি. ব্যাস, ৫০ সেমি. গভীর করে গর্ত করেন। সারি বরাবর একটি গর্তের কেন্দ্র থেকে অপর গর্তের কেন্দ্রের দূরত্ব ২ মিটার রাখেন। স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ ও অন্যান্য পরিচর্যা নিশ্চিত করেন। তিনি নিম্নের ছকে বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করেন।
স্থানীয় অন্যান্য কৃষকের মাঝে প্রযুক্তিটি ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। ভালো বীজ, পরামর্শ আর আর্থিক সহায়তা পেলে এ অঞ্চলে কুমড়া চাষের মাধ্যমে কৃষকদের ঝুঁকি কমানোর সঙ্গে সঙ্গে ফসলের বৈচিত্র্যতা আনা সম্ভব।
সার |
মোট সার /শতাংশ |
জমি তৈরির সময় প্রয়োগ |
প্রতি মাদায় |
|||
বীজ বপনের ৭-১০ দিন পূর্বে |
বীজ বপনের ১০-১৬ দিন পর |
বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর |
বীজ বপনের ৭০-৭৫ দিন পর |
|||
পচা গোবর |
৮০ কেজি |
২০ কেজি |
১০ কেজি |
- |
- |
- |
টিএসপি |
৭০০ গ্রাম |
৩৫০ গ্রাম |
৬০ গ্রাম |
- |
- |
- |
ইউরিয়া |
৭০০ গ্রাম |
২০০ গ্রাম |
- |
৩০ গ্রাম |
৩০ গ্রাম |
৩০ গ্রাম |
এমপি |
৬০০ গ্রাম |
২০০ গ্রাম |
৫০ গ্রাম |
২৫ গ্রাম |
- |
- |
জিপসাম |
৪০০ গ্রাম |
৪০০ গ্রাম |
- |
- |
- |
- |
দস্তা |
৫০ গ্রাম |
৫০ গ্রাম |
- |
- |
- |
- |
বোরাক্স |
৪০ গ্রাম |
৪০ গ্রাম |
- |
- |
- |
- |
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি অভিযোজনবিষয়ক এ পাতাটি ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশের সৌজন্যে প্রকাশিত। এ পাতাটিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন সম্পর্কিত প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিষয়ে যে কেউ লেখা দিতে পারেন। ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশ, হাউজ ১০, রোড ১০, ব্লক কে, বারিধারা, ঢাকা।
কৃষি মোর অলংকার-কৃষি মোর অহংকার
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
...ক...
‘ কৃষি মোর অলংকার আছে সারা গায়
ভোর থেকে সাঁজতক মাঠে পড়ে থাকি
বাতি জ্বেলে রাতে করি যত কাজ বাকি
মাথা থেকে পায়ে ভরা মাঠের ধুলায় ’।
গোথানে গরুর ‘হাম্বা; নাতি ডাকে ‘নানা ’...
বউ কয় ‘মরে যাই শাড়িখানা ছেঁড়া’
জোছনায় উকি মারে পেয়ে ভাঙ্গা বেড়া
আমারে সবাই বলে ‘দিতে হবে খানা ’।
বলি, ‘সবে ধৈর্য ধর মাঠ ভরা ধান
লাগায়েছি যত্ন করে হরেক ফসল
সারাবেলা মাঠে খাটি বানাতে সম্বল
বিধাতা দিবেন জানি এর প্রতিদান’।
‘কৃষি মোর অহংকার, অন্ন বস্ত্র ঘর
ভরে দেয় শ্রমে ঘামে বিস্তীর্ণ প্রান্তর’।
...খ...
এখন আমাকে তুমি দেখবে কিভাবে ?
কিছু হলে গালি দাও ‘তুই বেটা চাষা’
আমার বুলিতে ঝরে প্রিয় মাতৃভাষা
আপাদমস্তক দেখে বাঁকা চোখে চাবে!
নিজের ফসল বেচে শোধ করি ঋণ
ছেলেরা কামাই করে সুদূর বিদেশে
মেয়েটাও কাজ করে গার্মেন্টসে এসে
আমাদের পরিশ্রমে এসেছে সুদিন।
দেশের সমৃদ্ধি আর উচ্চতর ধাপ
করেছি সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হাতে।
এখন দু’বেলা পেট ভরা থাকে ভাতে
দেখা হলে লোকে বলে ‘অমুকের বাপ’।
গ্রামীণ দারিদ্র্য ঘুচে সমাজ এবার
পেয়েছে সুরক্ষা প্রিয় দেশটি আমার।
... গ...
কৃষিকর্ম করি যারা খেয়েগেছি গালি
আচার ও আচরণে হদ্দ গেঁয় চাষা,
বস্ত্র কেউ দিত যদি তাও জোড়াতালি
এখন দেখলে বলে গাঁ সম্পর্কে চাচা।
উচ্চারণে ত্রুটি ধরে উঁচু হতো হাসা
শীত গ্রীষ্মে মাঠে গেলে রইতো গা খালি,
ঘষেমেজে বলা হতো চাষাদের ভাষা
আজ কথা বলে পাই জোরে হাততালি।
আগে ছিল ভাঙ্গাচালা মাচাঙ্গে শুতাম
এখন করেছি ঘর কাঠ কেওয়ারি,
ফতুয়া গতরে ছিল ছিল না বুতাম
আজ গায়ে নয়া জামা তার রাঙা শাড়ি,
ভরা থাকে বারো মাস ধানের গুদাম
প্রতিদিন ভিড় করে কতেক বেপারি।
... ঘ...
পরিবারে সবে এক হয়ে মিলেমিশে
যত্ন করে গড়ে তুলি জৈবিক খামার।
পৈতৃক পুকুরে মাছ হাঁসের সাঁতার
পাড়ে ফলমূল মাঠ ভরা ধান শিষে।
সোনালী আঁশের দিন হয়ে গেছে সারা
নদী গেছে মরে পানি নাই শুধুু বালু
সেখানে ফলাই ভুট্টা সবজি ও আলু
মনে বল নিয়ে করি বিপদেরে তাড়া।
আশ্বিনের মঙ্গা আর অনাহারি দিন
অতীত দিনের স্মৃতি হলো চিরতরে
ধান চালে রয় ভরা প্রতি গোলাঘরে
ঘাটতি কথারে ঝেঁটে করেছি বিলীন।
নিজেরা দাঁড়িয়ে গেছি নিজ নিজ পায়ে
কৃষিরে বাঁচিয়ে রাখি জীবনের দায়ে।
* পরিচালক (অব), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী। সেল:০১৫৫৮ ৩০১ ৯০৮ ahiqbal.ahmed@yahoo.com
আমিনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : কোন কোন গাছে ক্ল্যাফট গ্রাফটিং করা যায়? গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময় কখন?
উত্তর : গাছের বংশবিস্তারের জন্য কলম তৈরির কৌশলকেই গ্রাফটিং বলা হয়। গ্রাফটিংয়ের উদ্দেশ্য হলো ফল গাছের উন্নত জাতে বংশবিস্তার। আম, কাঁঠাল, জাম, জলপাই, কামরাঙা এসব ফলগাছে সফলভাবে ক্ল্যাফট গ্রাফটিং করা যেতে পারে।
সারা বছরই ক্ল্যাফট গ্রাফটিং করা যায়। তবে বর্ষার শেষ দিকে অর্থাৎ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এ ধরনের কলম করা ভালো। কেননা এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে যা কলম জোড়া লাগার জন্য সহায়ক।
মো. দেলওয়ার হোসেন
নীলফামারী
প্রশ্ন : ধান গাছের খোল পোড়া রোগের প্রতিকার কী?
উত্তর : খোল পোড়া ধান গাছের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগে খোল দেখতে কিছুটা গোখরা সাপের চামড়ার দাগের মতো দেখায়।
ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার করলে, আবহাওয়া গরম ও স্যাঁতসেঁতে হলে এবং রোগ জীবাণু জমিতে থাকলে রোগ ছড়ায়।
* রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাত ব্যবহার করা যথা-বিআর-১০, ২২, ২৩ এবং ব্রিধান ২৯, ৩২, ৩৯, ৪১।
* ফসল কাটার পর ক্ষেতের নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
* রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন রাখার পর আবার সেচ দেয়া।
* সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা এবং ইউরিয়া ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করা।
* পটাশ সার সমান দুই কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা।
* প্রয়োজনে ছত্রাশনাশক ব্যবহার করা। নেটিভো, ফলিকুর, কনটাফ, হেক্সাকোনাজল খোলপোড়া রোগ দমনে কার্যকর ছত্রাকনাশক।
মো. মোস্তফা
কুমিল্লা
প্রশ্ন: কুমড়া পাতায় পানি ভেজা দাগের মতো ছোট ছোট ক্ষত হয়েছে। পরে আক্রান্ত পাতাগুলো শুকিয়ে যায়। কি করলে উপকার পাওয়া যাবে?
উত্তর : এটি কুমড়ার পাতার দাগ রোগ। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। প্রথমত, আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা। রোগ দেখা দিলে কার্বেনডাজিম (ব্যাভিস্টিন) ১ গ্রাম বা মেনকোজেব (ডাইথেন এম-৪৫) ২.৫ গ্রাম বা রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আবুল কালাম আজাদ
গাইবান্ধা
প্রশ্ন : বরবটি গাছের চারা হঠাৎ করে নেতিয়ে পড়ে, পরে গাছ মারা যায়। কী করলে উপকার পাওয়া যাবে?
উত্তর : এটা বরবটির ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ জমিতে দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
০ বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করা (প্রোভেক্স ২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম/কেজি বীজ)।
০ চারা গজানোর পর অতিরিক্ত সেচ না দেয়া।
০ মাদার মাটি শোধন করা (ফরমালিন)।
০ মাদার ট্রাইকোডারমা ভিড়িডি (উপকারী পরজীবী) ৩০ গ্রাম ৫০০ গ্রাম গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা।
০ এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন ব্যবহার করতে হবে।
নবাব
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : আমাদের দেশের গবাদিপশু সাধারণত খড় খেয়ে জীবনধারণ করে। শুধু খড় থেকে প্রয়োজনীয় আমিষ, শর্করা ও খনিজ পাওয়া যায় না। ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক বা ইউএমবি একটি শক্তিশালী এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ জমাট খাদ্য এর মধ্যে প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিন থাকে। খড়ের সঙ্গে পরিপূরক খাদ্য হিসেবে ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া বর্ষাকালে ও অন্যান্য দুর্যোগপূর্ণ সময়ে গোখাদ্যের সংকটে এটি মজুদ খাদ্য হিসেবে কাজ করে।
পদ্ধতি
১০ কেজি ব্লকের মধ্যে ৫-৬ কেজি মোলাসেস বা চিটাগুড়, ২.৫-২.৬ কেজি গমের ভুসি, ৮০-৯০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০০-৬০০ গ্রাম চুনা (খাবার চুন) দেয়া থাকে। ১ কেজির ১টি ব্লকে সাধারণত ৯ মেগাজুলস শক্তি ও ২৪০ গ্রাম প্রোটিন থাকে।
১. প্রথমে ৫-৬ কেজি চিটাগুড় একটি পাত্রে নিয়ে তাপ দিতে হবে। তাপাধারটি লোহার কড়াই বা ড্রামের অর্ধাংশ বা এ জাতীয় শক্ত পাত্র হলে ভালো হয়।
২. ২.৫-৩ কেজি গমের ভুসি মেপে নিতে হবে।
৩. এবার ৩৫ গ্রাম লবণ (ডিবি ভিটামিনসহ) মেপে নিন।
৪. ৮০-৯০ গ্রাম ইউরিয়া আলাদা মেপে নিন।
৫. ওজনকৃত চুনের গুঁড়া, ইউরিয়া ও লবণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৬. এবার কড়াইটি তাপাধার থেকে নামিয়ে নিন এবং ভালোভাবে নাড়াচাড়া করুন যতক্ষণ না নালি বা চিটাগুড়ের আঠালো জমাট ভাব আসে।
৭. ৫ নম্বরে বর্ণিত মিশ্রণটি ফুটন্ত নালি বা চিটাগুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে নিন এবং পরে ওজনকৃত গমের ভুসি ঢেলে দিন ও একটি শক্ত কাঠি বা হাতলের সাহায্যে নাড়াচাড়া করে ভুসি ও ৫ নম্বরে বর্ণিত মিশ্রণ সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে নিন।
৮. নালি ভুসি, চুনা, ইউরিয়া ও খনিজ দ্রব্য মিশ্রিত মিশ্রণ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ (ছাঁচের আকার ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী) নিয়ে ব্লক তৈরি করুন।
৯. মিশ্রণটি ৮ নম্বরে বর্ণিত ছাঁচে ঢালার পরে ছাঁচের মাপ অনুযায়ী ঢাকনা উপরে রেখে চাপ দিতে থাকুন যেন মিশ্রণটি শক্ত জমাট বাঁধা একটি ব্লকে পরিণত হয়।
১০. সাবধানতার সঙ্গে ব্লকটিকে ছাঁচ থেকে তুলে ৩০ মিনিট পর্যন্ত বাইরে রেখে দিলে ব্লকটি শক্ত হয়ে যায়।
১১. এক সঙ্গে অনেক ব্লক বানানোর প্রয়োজন হলে সদ্য প্রস্তুতকৃত ব্লকটি পলিথিনের মোড়কে আচ্ছাদিত করুন।
খাওয়ানোর নিয়ম
১. ইউএমবি একটি শক্তিশালী ও প্রোটিন সমৃদ্ধ জমাট খাদ্য যাতে প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিন দেয়া আছে।
২. ব্লক খাওয়ালে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার দৈহিক ওজন বৃদ্ধি, শক্তি ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৩. ব্লক খাওয়ালে খড়জাতীয় পশুখাদ্যের পাচ্যতা এবং গ্রহণক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও ওই খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৪. ইউরিয়া মোলাসেস ব্লকের ওপরে মোড়ানো পলিথিন সম্পূর্ণভাবে খুলে দেখুন। ব্লকটিকে ১টি শুকনো পাত্রে বা শুকনো কাঠের ছাঁচে রেখে গবাদিপশুকে খেতে দিন। ব্লকটিকে অক্ষত অবস্থায় খেতে দিতে হবে এবং গরু মহিষের বেলায় দৈনিক ৩০০ গ্রাম ও ছাগলের বা ভেড়ার ক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম খেতে দিতে হবে। এই পরিমাণের বেশি দেয়া উচিত নয়। প্রথম প্রথম ব্লক খেতে না চাইলে ব্লকের ওপর লবণ বা ভুসি ছিটিয়ে দিন এবং প্রতিদিন যতœসহকারে খাওয়াতে অভ্যাস করুন। ব্লক খাওয়ানোর পাশাপাশি গবাদিপশুকে অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার খেতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ইউএমবি পানিতে গুলে বা গুঁড়া করে দেয়া যাবে না।
ছাঁচের মাপ
২ কেজি ওজনের ব্লক তৈরিতে ব্যবহৃত ছাঁচের মাপ দৈর্ঘ্য ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪.৫-৫ ইঞ্চি উচ্চতা ৪ ইঞ্চি।
বি:দ্র: ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক খাওয়ানোর ১ ঘণ্টা আগে বা পরে পশুকে কোনো পানি পান করতে দেয়া যাবে না।
প্রদীপ কুমার
দিনাজপুর
প্রশ্ন : পুকুরের পানিতে লাল সর সমস্যায় কী করব?
উত্তর : খড়ের রশি বানিয়ে কাপড় দিয়ে সর টেনে উঠিয়ে দিতে হবে। ৩-৫ দিন পর আবারও খড় দিয়ে টেনে একপাশে আনা সরের ওপর আধা কেজি ইউরিয়া ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ছাড়তে হবে।
জাহিদ হাসান
রংপুর
প্রশ্ন : সিলভার কার্প ও কাতলা মাছের মাথা মোটা এবং লেজ চিকন হয়ে আসে, করণীয় কী?
উত্তর : পুকুরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব হলে এমন হয়। প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য গোবর-২০০ গ্রাম / শতক দিন, ইউরিয়া-৫ গ্রাম/শতক দিন, টিএসপি-৩ গ্রাম/ শতক দিন হারে ৭ দিনেরটা একবারে দেয়া হয়। পাশাপাশি প্রতিদিন সম্পূরক খাদ্য হিসেবে চালের কুঁড়া, খৈল, ভুসি, ভিটামিন ইত্যাদি একত্রে মিশ্রিত করে মাছের ওজনের ৫% হারে সকালে ও বিকালে নির্দিষ্ট হারে খাদ্য দিতে হবে।
বেলাল হোসেন
চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : পুকুরে বুদবুদ ওঠে, গ্যাস হয়, কী করব?
উত্তর : এমোনিয়া, নাইট্রাইট, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাসের কারণে বুদবুদ ওঠে। পুকুরের মাটিতে মাঝে মধ্যে হররা টানতে হয়, গাছের পাতা যাতে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। চাষকৃত পুকুরের জন্য পুকুর প্রস্তুতি এবং প্লাঙ্কটন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে পোনা মজুদের আগে এবং চাষের প্রতি দুই মাস বিরতিতে পুকুরের পানির গভীরতার ওপর নির্ভর করে ০.৫০-১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। আবহমান বাংলার ঋতুচক্রের এ মাসে ধুম পড়ে যায় আমন ধান কাটার এবং কর্তন পরবর্তী কাজ কর্মের। নতুন ধানের গরম ভাতের সৃঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর, সেসঙ্গে চলে কৃষকের ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব। নবান্নের উৎসবের সঙ্গে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। কেননা এ মৌসুমটাই কৃষির জন্য তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত একটি মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সঙ্গে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
বোরো ধান
অগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈবসার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে।
যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রি ধান৫৫, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নাই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০, ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ঠাণ্ডা প্রকোপ এলাকায় ব্রি ধান৩৬, হাওর এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব, বারি গম-২৫, বারি গম-২৬ এসব বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।
গমের ভালো ফলন পেতে হলে প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০-৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০-৪০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ , ৪৫-৬০ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে তৃতীয় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। এক হেক্টর জমিতে বীজ বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভুট্টা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে খই ভুট্টা বা হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজের মাত্রা এর অর্ধেক হবে। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি. রাখতে হবে।
মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ১-১.৫ কেজি, টিএসপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০-৬০০ গ্রাম, জিপসাম ৬০০-৭০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া রয়েছে তিল, তিসি সূর্যমুখী। আমাদের দেশে তেল ফসল অনেকটা অবহেলিত। তবে নিয়মিত যত্ন নিলে তেল ফসলের ফলন বাড়ানো সম্ভব। সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
আলু
রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ডাল ফসল
ডাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাষ, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে। সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিষ্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সব ক‘টি পরিচর্যা সময়মতো যথাযথভাবে করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
শাকসবজি
মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এ সব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ভালো থাকবে। প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে।
অন্যান্য রবি ফসল
মাঠে এখন মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসময় ভালোভাবে যত্ন পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে আশাতীত ফলাফল বয়ে আনবে। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ওষুধি বা বনজ গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ মাসে পশুখাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। বুদ্ধিমানের কাজ হলো ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত পশুখাদ্য বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমনÑ ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এ সময় গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপ্রাণিতে রোগ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবর/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। শীতকাল আসছে। পুকুরে রৌদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে।
প্রতি বছরের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও ১৬ অক্টোবর, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৫ উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি’ সবার মৌলিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে কৃষক তার সামাজিক ও পরিবেশের বাধাগুলো আরো দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে, যা আমাদের গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশেষ অবদান রাখবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিকথা উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। মনে রাখবেন আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
১৬ অক্টোবর। বিশ্ব খাদ্য দিবস। বাংলাদেশে প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি’। প্রতিপাদ্যটির আলোকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য নিরসন ও কৃষির উন্নয়নই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। তাই দেশের উন্নয়ন করতে হলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়ন ও কৃষির সার্বিক উন্নয়ন আবশ্যক। আমরা জানি, শস্য উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হলো শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করা। শস্য উৎপাদন বাড়াতে যেসব সমস্যা নিরসনে তৎপরতা চালাতে হবে সেগুলো হলো-আবাদি জমি সংরক্ষণ, চাষাবাদের জন্য উপকরণ সহজলভ্যকরণ, কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতাজনিত কারণে প্রযুক্তির বিকাশ নিশ্চিতকরণ, মানসম্মত বীজ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, রাসায়নিক ও জৈবসারের সরবরাহ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, শস্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার, শস্য প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ। এসব সমস্যা সমাধানে সাফল্য শস্য উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই সমস্যা নিরসনের জন্য গবেষণা ক্ষেত্রে তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে গ্রামীণ দুষ্ট-চক্রের অবসান ঘটাতে হবে। কারণ একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি সব সময়ই সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- কৃষি উপকরণে ভেজাল দেয়া, কৃষি ঋণ প্রদানে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া, অতিরিক্ত মুনাফায় দাদন ব্যবসায় কৃষি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে একচেটিয়া কারবার এসবই সামাজিক দুষ্ট-চক্রের কাজ।
প্রিয় পাঠক ও চাষি ভাইয়েরা, বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে কৃষিকথার চলতি সংখ্যাটিকে বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। সংখ্যাটিতে প্রতিপাদ্যের আলোকে বেশ কিছু তথ্যবহুল দিকনির্দেশনামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা আশা করি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে লেখাগুলো বিশেষভাবে অবদান রাখবে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও লেখা দিয়ে যারা সংখ্যাটির মান উন্নয়নে সহায়তা করেছেন তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
বিশ্ব খাদ্য দিবসে গৃহীত কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।