Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

হাইব্রিড ভুট্টার জয় জয়কার
আমাদের দেশে ভুট্টার চাষ শুরু হয়েছিল ভুট্টার কম্পোজিট জাতের বীজ দিয়ে সেই ১৯৭৫ সনে। কয়েকটি উত্তম ইনব্রিড লাইনের মধ্যে মুক্ত পর-পরাগায়ন করে পাওয়া বীজ তখন ভুট্টার আবাদের জন্য ব্যবহার করা হতো। ফলে এসব বীজের মান উত্তম না হওয়ায় ভুট্টার ফলন কখনো উৎসাহব্যঞ্জক হয়নি। এ কারণে ভুট্টার আবাদি জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন দু’টিই যেমন কমেছে তেমনি কমেছে এর ফলনও। প্রচলিত ভুট্টা জাতের ব্যবহারের ফলে ১৯৬৭-৬৮ সন থেকে ১৯৮৬-৮৭ সন পর্যন্ত ভুট্টার আবাদি এলাকা, উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি ফলন তিনটিই শতকরা ২.১০ ভাগ, ৩.৫৯ ভাগ এবং ০.৬৯ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ভুট্টা চাষে সে সময় কৃষকদের মনোযোগও আকর্ষণ করা সম্ভব হয়নি। বিএআরআই ১৯৮৬ সনে তিন তিনটি ভুট্টার হাইব্রিড জাত আবাদের জন্য অবমুক্ত করে। অতঃপর ধীরে ধীরে প্রাইভেট বীজ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এ দেশে আসতে থাকে বিদেশি হাইব্রিড ভুট্টার নানা রকম জাতের বীজ। ১৯৯৩ সন থেকে এদেশে ভুট্টা চাষের জন্য হাইব্রিড ভুট্টা বীজের ব্যবহার মোটামুটি শুরু হয়ে যায়। বাড়তে থাকে ভুট্টার আবাদি জমি, বাড়তে থাকে মোট উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি ফলনও। ১৯৮৭-৮৮ সনের সাথে ২০০৩-০৪ সনের তুলনা করলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ভুট্টার আবাদি এলাকা, মোট উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি ফলন বেড়েছে যথাক্রমে ১৯.৮৩, ৩৪.৪০ এবং ১৪.৫৬ ভাগ।
 
দেশের ভুট্টা চাষের ইতিহাসটাই যেন পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। মাঠে ভুট্টা গাছ আর এর দানাসমৃদ্ধ হলদে মোচার দাপট দেখলে কে বলবে যে, সুদূর মেক্সিকোতে এর জন্মস্থান। এ দেশের জল-হাওয়া-মৃত্তিকায় চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে ভুট্টা। গত এক দশকে হাইব্রিড ভুট্টার আবাদি এলাকা, উৎপাদন ও হেক্টর প্রতি ফলন উল্লেখযোগ্য রকমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হেক্টর প্রতি ফলনের দিক থেকে ভুট্টার স্থান দানাশস্যগুলোর মধ্যে প্রথম, কিন্তু আবাদি এলাকা ও মোট উৎপাদনের দিক থেকে এটি ধান ও গমের পর এখন তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ২০০২-০৩ সনে এ দেশে মোট ভুট্টার উৎপাদন ছিল মাত্র ১.৭৫ লাখ টন। ২০১২-১৩ সনে সে ভুট্টার ফলন দাঁড়িয়েছে ২১.৭৮ লাখ টনে। গত দশ-এগার বছরে এ দেশে ভুট্টার ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ গুণেরও অধিক। ২০১৩ সনে বাংলাদেশের ৩.১২ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে, যা ২০১০ সনে ছিল ২.৮৩ লাখ হেক্টর। বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ভুট্টার ফল বেশ ভালো। যেখানে বিশ্বে ভুট্টার হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৪.৯ মেট্রিক টন, বাংলাদেশে তা ৫.৩৭ মেট্রিক টন।
 
এ তো গেল পরিসংখ্যানের নানা কথা। ভুট্টা হলো আমাদের দেশের একমাত্র ফসল যার প্রতিটি জাতই এখন হাইব্রিড। অর্থাৎ এ দেশের মাঠে ভুট্টার এখন শতকরা একশত ভাগই হাইব্রিড ভুট্টা জাতের আবাদ করা হচ্ছে। হাইব্রিড ফসল নিয়ে আমাদের নাক সিটকানোর দিন শেষ হয়েছে। ভুট্টা ছাড়াও বহু সবজি ফসলে এখন হাইব্রিড জাতের বীজই উৎপাদনের অন্যতম ভরসা। ভুট্টার ক্ষেত্রে হাইব্রিড জাতগুলো এতটাই সফল যে, দেশের কোন কোন এলাকার মানুষের কাছে হাইব্রিড ভুট্টা মহা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকার মানুষের জীবন ধারাই বদলে দিয়েছে হাইব্রিড ভুট্টার চাষ।
 
হাইব্রিডের বিপক্ষে যারা সোচ্চার তাদের জন্য বাস্তবে এর ফলন ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ভুট্টার হাইব্রিডের কি দারুণ প্রভাব তা পর্যবেক্ষণ করা বড় জরুরি বলে বিবেচনা করি। চরের ধূ ধূ বালুতে হাইব্রিড ভুট্টা কতটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনেছে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন। ভুট্টার চাষ এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় বহুমাত্রিক প্রভাব নিয়ে এসেছে। এর ফলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ভুট্টার দানা ভুট্টার প্রধান আকর্ষণ বটে তবে পাশপাশি ভুট্টা থেকে আলাদা করা মোচা ও ভুট্টার গাছ চাষিরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। নারী শ্রমিকেরাও এখানে ভুট্টা সংগ্রহ, মাড়াই, বাছাই ও শুকানোসহ নানা রকম কাজের সাথে জড়িত হয়েছে। ফলে নারীদেরও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
 
হাইব্রিড ভুট্টার আবাদ যুক্তরাষ্ট্রে এক নবযুগের সূচনা করেছে। মুক্তপরাগী ভুট্টার জাত নিয়ে যখন কিছুতেই আর ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছিল না তখন ভুট্টার হাইব্রিড জাত সৃষ্টি আমেরিকাতে এক নতুন মাত্রা নিয়ে যেন হাজির হয়। অল্প কিছু দিনের ভেতরই সেখানে হাইব্রিড এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে ১৯৩৪ সনে যেখানে মাত্র শতকরা এক ভাগ জমিতে ভুট্টার হাইব্রিড আবাদ করা হয় সেখানে চল্লিশের দশকে এসে তা শতকরা ৭৮ ভাগ জমি দখল করে নেয়। পঞ্চাশের দশকে এসে হাইব্রিড ভুট্টা যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ জমি দখল করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৯ শতাংশ জমিতেই আবাদ করা হচ্ছে নানা রকম হাইব্রিড ভুট্টা।

বাংলাদেশে মূলত হাঁস-মুরগির ও গোখাদ্য হিসেবে ভুট্টার দানা ব্যবহার করা হয়। মৎস্য খাদ্যেরও একটি অন্যতম উপকরণ হলো ভুট্টা দানার গুঁড়া। তবে এ দেশে এখন মানুষও ভুট্টা সেদ্ধ বা পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করেছে। মানুষের জন্য নানা রকমের খাবার তৈরি করা যায় ভুট্টা থেকে। রুটি, আটার সাথে মিশিয়ে রুটি, গোলআলুর সাথে মিশিয়ে রুটি, পুরি, ভুট্টার প্যানকেক, ভুট্টার বিস্কুট, ভুট্টা খিচুরি, ভুট্টা-চাল খিচুরি, ভুট্টা পোলাও, সবুজ ভুট্টার দানা, ভুট্টা সেদ্ধ, ভুট্টা পুড়িয়ে কতভাবেই না ভুট্টাকে মানুষের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়। ভুট্টার পপকর্ণ তো দিনে দিনে শহরাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভুট্টার খাদ্যমান বেশ ভালো। চালের তুলনায় ভুট্টার আমিষ, ফসফরাস ও চর্বির পরিমাণ অধিক। ভুট্টার বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৭-১২ ভাগ। ভুট্টার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে উত্তম। শিশু, গর্ভবতী মহিলা ও দুগ্ধপানকারী মায়ের জন্য ভুট্টার তেল উত্তম। তাছাড়া ভুট্টাতে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম এবং সালফার এসব গৌণ খনিজ উপাদান বেশ ভালোই রয়েছে।

 
বাংলাদেশে ভুট্টা আবাদে ব্যবহৃত হাইব্রিড জাতগুলোর মূল উৎস দু’টি। বিদেশ থেকে আমদানি করা ভুট্টা জাত হলো ভুট্টা বীজের প্রধান উৎস। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ভুট্টা হাইব্রিড জাত হলো ভুট্টা বীজের দ্বিতীয় উৎস। বাংলাদেশে বিদেশি জাতগুলোর চাহিদা বেশি দু-তিনটি কারণে। এ কারণগুলো হলো-
 
বিদেশি জাতগুলোর ভুট্টা গাছে ২-৩টা ভুট্টার মোচা তৈরি হয়, বাংলাদেশী জাতগুলোতে ১-২টা মোচা তৈরি হয়। মোচার সংখ্যা বেশি হলে মোচা ছোট হয় এবং দানার সংখ্যা কম হয়। তবে তিন মোচার ভুট্টা গাছে দুই মোচার ভুট্টা গাছ অপেক্ষা ফলন কিছুটা বেশি হয়।
 
বিদেশি জাতের বীজ পেতে সহজ হয়। কোম্পানিগুলো বিদেশি জাতের বীজ ও চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে কৃষকের দোড়গোড়ায় পৌঁছে যায়। দেশি জাতের বীজ এতটা সুলভ নয়, তাছাড়া এ নিয়ে প্রচার প্রচারণাও এত বেশি হয়।
 
বিদেশি কোনো কোনো হাইব্রিড ভুট্টার জাতের ফলন দেশি হাইব্রিড জাতগুলোর চেয়ে বেশি।
 
বিদেশি জাতগুলোর মধ্যে অঞ্চলভেদে কোনো কোনো জাতের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। এসব জাতের মধ্যে রয়েছে এনকে-৪০, এনকে-৪৬, এনকে-৪৮, এনকে-৬০, প্যাসেফিক-১১, প্যাসেফিক-৬০, ৯০০ এম, কনক, ৭১৭, বারি ভুট্টা-৫। আরো কিছু ভালো ভালো হাইব্রিড ভুট্টা জাত রয়েছে বাজারে। নতুন নতুন জাতও আসছে দিন দিন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের এটিই সুবিধা। হাইব্রিড ভুট্টা আসলে কি সে আলোচনা নিশ্চয়ই নিরর্থক মনে হবে না এখানে। বরং সেটি বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হবে বলেই মনে হয়। ভুট্টা একটি শতভাগ পর-পরাগী ফসল। আর শতভাগ পর-পরাগী না হয়ে এর উপায় নেই। ভুট্টার প্রতিটি গাছের মাথার শীর্ষে হলো পুরুষ ফুল আর গাছের কাণ্ডের মাঝামাঝি এলাকায় হলো এর স্ত্রী ফুলের অবস্থান। ফলে বীজ ধারণ করতে হলে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডকে পেতে হবে অবশ্যই পুরুষ ফুলের পরাগরেণুর পরশ। সে ব্যবস্থাও ভুট্টাতে বেশ উত্তম। প্রতিটি স্ত্রী ফুলের মাথায় অতি মোলায়েম রেশম  সূতার মত ছড়িয়ে থাকে অজস্র গর্ভমুণ্ড। সে কারণে বুঝি একে বলা হয় ‘সিল্ক’। তো এদের এভাবে ছড়িয়ে থাকার কারণই হলো উড়ে আসা পরাগরেণুকে বেঁধে ফেলা এবং বীজ তৈরির জন্য এদের অঙ্কুরিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। ভুট্টার পর-পরাগয়াণের এই স্বভাবই কাজে লাগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পর-পরাগী স্বভাব বলে ভুট্টার দু’টি উত্তম ইনব্রিড লাইনকে পাশাপাশি নির্দিষ্ট অনুপাতে সারিবদ্ধভাবে লাগিয়ে দিয়ে একটি ইনব্রিড লাইনের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে দেয়া হয়। অর্থাৎ এই লাইনটি অতঃপর কেবল বহন করে স্ত্রী ফুল। অন্য ইনব্রিড লাইন থেকে অতঃপর পরাগরেণু বাতাসের আন্দোলনে উড়ে এসে পড়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে। তৈরি হয় এর ফলে কেবলমাত্র হাইব্রিড বীজ। সে হাইব্রিড বীজ এরপর ব্যবহার করা হয় ভুট্টা চাষের জন্য।
 
দেশের অনেক এলাকাতেই হাইব্রিড ভুট্টার আবাদের বিস্তৃতি ঘটছে। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও কুষ্টিয়া ছাড়াও দেশের অনেক জেলাতে এখন এর আবাদ করা হচ্ছে। রাজশাহী, মানিকগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার ধানী জমিতে এখন ভুট্টার আবাদ শুরু হয়েছে। গম কোনো কোনো এলাকায় ধান আবাদের বদলে মানুষ ভুট্টা চাষ শুরু করেছে। ভুট্টার প্রতি কৃষকের বাড়তি আগ্রহের কারণ একাধিক। এ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে একই খরচে ভুট্টার ফলন গম ও ধানের চেয়ে অনেক বেশি।
 
হাঁস-মুরগি, গো-মহিষাদি এবং মৎস্যের খাবার হিসেবে ভুট্টার অনেক বেশি চাহিদা থাকায় ভুট্টা বিক্রয় করে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়।
 
ভুট্টা আবাদের জন্য হেক্টর প্রতি খরচ বেশ কম অথচ লাভ এতে বেশি। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, এক কেজি ভুট্টা আবাদ করতে খরচ হয় ৪.১২ টাকা অথচ এক কেজি ভুট্টা বিক্রি করে পাওয়া যায় ৭.৮০ টাকা।
 
কোনো বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটলে গমের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথচ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভুট্টা চাষ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
 
ভুট্টা চাষের বড় সুবিধা হলো রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম ঘটে এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের ফলে ক্ষতি কম হয়।
 
ভুট্টা আবাদ করতে কম সেচের প্রয়োজন হয় কিন্তু অধিক সারের প্রয়োজন হয়, যা বাজার থেকে কিনে নিয়ে প্রয়োগ করা সম্ভব।
 
বাজারে ভুট্টার চাহিদা অধিক হওয়ায় ভুট্টা বিক্রি করে কৃষকের হাতে নগদ অর্থ আসে এবং কৃষক সরাসরি লাভবান হয়।
 
আমাদের ভুট্টা গবেষণা ভালোই এগিয়েছে। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হাইব্রিড জাতগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আমাদের গবেষণার কৌশল খানিকটা পাল্টাতে হবে। বিভিন্ন উত্তম হাইব্রিড জাতগুলোর কয়েক বংশধর স্ব-পরাগায়ন করা হলে স্ব-পরাগায়িত বংশধর থেকে উত্তম ইনব্রিড লাইন বাছাই করা সম্ভব হতে পারে। এসব ইনব্রেড লাইনের সাথে আমাদের অন্যান্য ইনব্রিড লাইনের সংযুক্তি ক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে পাওয়া সম্ভব উত্তম মানের হাইব্রিড। আমাদের বিজ্ঞানীদের সৃষ্ট হাইব্রিড ভুট্টা বীজ ব্যবহার বাড়লে ভুট্টা ফসল উৎপাদনের খরচও খানিকটা হ্রাস পাবে বলে হাইব্রিড ভুট্টা চাষ আরো লাভজনক হয়ে উঠবে।
 
 
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া
* প্রফেসর, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লাণ্ট ব্রিডিং বিভাগ এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
 
বিস্তারিত
বালুকাময় চরে সবুজের প্রতিশ্রুত সমারোহ
বাংলাদেশের উত্তর জনপদ, কেউ বলেন উত্তরবঙ্গ। সব সময় একটু আলাদা। আমাদের কষ্ট জাগানিয়ার ভিন্নতর ইতিহাস গড়া অঞ্চল। কষ্টের করুণ পরিণতিতে মাঝে মধ্যে আমরা বাকস্তব্ধ হয়ে যেতাম ক’দিন আগেও। একটা সময় ছিল যখন প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং রংপুর জেলায় কর্মসংস্থান আর খাদ্যের অভাব দেখা দিত। ১৯৪৭ সাল উত্তর জনপদে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং তখন থেকেই এ সমস্যাটি প্রকট হয়। সে সময় কৃষকরা কর্মসংস্থানের অভাবে নিরুপায় হয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করত। ঘরে তিলতিল করে ঘামের ফসল সব সঞ্চয় জমা বিকিয়ে দুমুঠো ভাতের জোগান পাওয়ার জন্য চেষ্টা করত। একেই বলা হতো মঙ্গা। মঙ্গার লক্ষণ হলো ঘরে খাবার নেই, মাঠে কাজ নেই, গবাদিপশুর খাবার নেই, অনাহারে অর্ধাহারে জীবন চলত এলাকার অধিকাংশ মানুষের।
 
সংশ্লিষ্টরা বলেন শুধু আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মসংস্থান/বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে উদ্ভূত পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বছরব্যাপী স্থায়ী কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বার্ষিক নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম এবং আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা। মঙ্গা বিনাশি ধান বিনা ৭, বিনা ১৪, ব্রিধান ৩৩, ব্রিধান ৩৯, ব্রিধান ৬২ আমাদের মঙ্গাকে জাদুঘরে নিয়ে গেছে। এসব জাতের ধানের আগাম ফলন, উৎপাদন মঙ্গাকে গুডবাই জানিয়েছে কতদিন আগেই। বর্তমানে সেখানকার পুরুষ মহিলাদের কর্মচাঞ্চল্যতা প্রমাণ করে মন আছে প্রাণ আছে প্রাণোশক্তি আছে। যে কারণে উত্তরবঙ্গের জনপদ এখন প্রাণের উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর। ধানসহ অন্যান্য ফসলের পর সেখানে চিবিয়ে খাওয়া এবং গুড় তৈরির উপযোগী আখের জাত চাষ করে আপদকালীন সময়ে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হয়েছে। এ আগাম শ্রম বিক্রি রোধে আগাম পরিপক্ব আখ চাষাবাদের ফলে চারা তৈরি ও বিক্রি, ফাঁকা জায়গা পূরণ, মাটি আলগা করে দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, সারের উপরিপ্রয়োগ, আখ বাঁধাই, গোড়ায় মাটি দেয়া, আখ কাটা, পরিবহন, গুড় তৈরি, বিক্রয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা এ অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসনে স্থায়ীভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমরা জানি আখ বারো মাসের ফসল। আবার বারো মাস আখক্ষেতে টুকটাক কাজ করতেই হয়। সে কারণে সেখানে এখন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তে দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি পরম মমতায় নিবিড়ভাবে শ্রম বিনিয়োগে ব্যস্ত থাকে চরের গহীন সীমাহীন চত্বরে।
 
চরাঞ্চলে কৃষি পণ্য ধান, পাট, আখ, আলু সবজি, ভুট্টা খুব সীমিত আকারে চাষাবাদ হয়। অধিকাংশ জমিই পতিত থাকে এবং বন্যাকালীন সময়ে চাষকৃত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আখই হচ্ছে প্রধান ফসল যার সাথে সাথীফসল হিসেবে অন্যান্য ফসলের চাষ করে পতিত জমির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। সে কারণেই আবাদযোগ্য জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য ও সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রচলিত ফসল বিন্যাসের সাথে আখ ও সাথী ফসলের আবাদ সমন্বয়ের মাধ্যমে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এসব চর অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসনে আরো বেশি কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন। এমনিতেই আমাদের নদীগুলো মমতার পরশে আমাদের জরাজীর্ণতা থেকে আমাদের ধুয়ে মুছে শূচি শুদ্ধ করে নেয়। উপরন্তু মিহি পলির পরশে আমাদের জমিনগুলোকে উর্বর যৌবনা করে দেয়। বিশেষ করে নদীর বুকে জেগে উঠা চরে শুধুই বালু আর বালুর মাঝে এ পলির আশাতীত পলি স্তরের কারণে অভাবনীয় গাত্রবৃদ্ধিতে বিভিন্ন ফসলের আবাদ অনায়াসে হয়। আখ এমন একটি ফসল যা চরাঞ্চলের পতিত জমিতেও ভালো ফলন দেয় এবং চাষিকে খরা, বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে ফসলহানির আশঙ্কা নিশ্চিতভাবে দূর করে। বিশেষ করে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা যখন বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে তা ঘরে তুলতে পারে না, সেখানে আখ প্রায় ১২-১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যাসহিষ্ণু জাত চাষাবাদের মাধ্যমে তা বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আর আখচাষিরা আখ বড় হলে কয়েকটি আখের পাতা দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ করে আখ বেঁধে বন্যা বাতাস ঝড়ের কবল থেকে দারুণভাবে রক্ষা করে।
 
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মত অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি বছরে ১৩ কেজি চিনি খাওয়ার প্রয়োজন। মানুষের ব্রেনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য রক্তে পরিমাণ মতো চিনির উপস্থিতি দরকার। আমাদের দেশে এ পরিমাণ একসময় স্বপ্ন ছিল। এখন তা চলমান বাস্তবতার আলোকিত অংশ। যা বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিরলস অবদানের জন্য। আখ শুধু আমাদের মিষ্টি ফসলই না। আখের আছে বহুমুখী ব্যবহার এবং সক্ষমতা। আখ থেকে আসে চিনি, গুড়, চিটাগুড়, ছোবড়া, ভিনেগার, জুস প্রোটিন জ্বালানি, পশুখাদ্য, মোম, চিবিয়ে খাওয়া রস, ওষুধের পথ্য, ঘরের চাল আচ্ছাদন এসব। আমাদের দেশের উৎপাদিত আখ থেকে গুড় হয় ৫৭%, চিনি হয় ২৭%, চিবিয়ে খাওয়া রস ১০%, বীজ হিসেবে রাখা হয় ৬%। বর্তমানে চিনি কল এলাকায় ৯৯% এবং গুড় উৎপাদনকারী এলাকায় ৬০% আখ বিএসআরআই উদ্ভাবিত জাত আবাদ হচ্ছে। আখের গড় ফলন কম বেশি ১০০ টনের মতো। এ যাবত ৪৩-৪৪টি আধুনিক কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে সাধারণ আধুনিক জাত উদ্ভাবনের সাথে বন্যা খরা লবণাক্ত জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এগোতে পারলে আখ দিয়ে আমরা আমাদের কৃষি সমৃদ্ধিকে আরো বেগবান করতে পারবো।
 
বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আখ চাষ প্রকল্পের মাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা যায় বালুময় পতিত যে চরে বিঘাপ্রতি ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকার ধইঞ্চা হতো, ধইঞ্চা ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না, সে চরেও এবার ৫০ হাজার টাকার আখ বিক্রি করেছেন চাষিরা। ফলে প্রাথমিক লাভ পাচ্ছেন জমির মালিকগণ। আর আখ আবাদের ফলে দ্বিতীয় সুবিধাভোগীরা হচ্ছেন মাঠের শ্রমিক। কেননা আখ বারোমাসী ফসল বলে শ্রমিকরা সারা বছর তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। অন্যদিকে কাজের সুযোগ পেয়ে লাভ করেছেন আরো দুটি শ্রেণি ০১. গুড় উৎপাদনকারী এবং ০২. গুড় ব্যবসায়ী। চর এলাকার উৎপাদিত এসব বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত নির্ভেজাল গুড় চলে আসছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। প্রতি কেজি গুড় কমপক্ষে ৫০ টাকা হারে বিক্রি হয়। এলাকার মানুষের নিত্যদিন ব্যবহারের জন্য শতভাগ বিশুদ্ধ গুড়তো রয়েছেই। এছাড়া আখের ছোবড়া জৈবসার ও জ্বালানি এবং আখ পাতা জ্বালানির উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে অভাবণীয় কাজ করে।
 
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার এ চরটিতে ধইঞ্চা ছাড়া অন্যকোন ফসল দেখা যায়নি। সেখানে প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে আখ চাষ হয়েছে এর মধ্যে প্রদর্শনী আখক্ষেত রয়েছে মাত্র ৬টি। বাকিগুলো চাষিরা নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়ে আখ রোপণ করেছেন। চাষিরা বলেন, ধইঞ্চার চেয়ে আখ অনেক লাভজনক এটা তাদের কাছে সহজেই বোধগম্য হয়েছে। তারা আগামী বছর এ চরের অধিকাংশ জমিতে আখের আবাদ করবেন। এখন পর্যন্ত যে সব এলাকায় কাজ করা হয়েছে সর্বত্রই সারা বছর আখক্ষেতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চরের বালুময় পতিত জমিতে যেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না সেখানেও হতদরিদ্র চাষিরা আখ আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। আরো বিস্তৃত এলাকার কর্মসূচির আওতায় আনা দরকার; চর এলাকায় এখন আর আগের মতো আগাম শ্রম বিক্রি হয় না। এ এলাকায় শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। তারা উন্নত খাবার গ্রহণ করছে এবং উন্নতমানের পোশাক ব্যবহার করছে। মোটকথা জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
 
গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এরা আখ চাষিদের কাছ থেকে আখ কিনে গুড় তৈরি করছে এবং তা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া আখের চারা বিক্রির মাধ্যমেও অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। যে চরে শরতের কাশ ছাড়া আর কোনো ফসল হতো না সেখানেও আখ চাষ করে চাষিরা উর্ব্বর জমির  লাভবান হচ্ছেন কাশের অতনু ছোঁয়ার পাশে। এতে আবাদি জমির সাথে সাথে সামগ্রিক ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে। অনেক মহিলা এখন আখ ক্ষেতে কাজের মাধ্যমে ভালো রোজগার করছেন। এতে তাদের অভাব দূর হয়েছে। তারা নিজেদের তৈরি গুড় পরিবারের সদস্যদের খাওয়াতে পারছেন। তাছাড়া পুষ্টিকর খাবারের ওপর তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ায় তারা এখন স্থানীয় কম মূল্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করছেন। নিজেদের পরিবারের ব্যবহারের পর থেকে যাওয়া আখের গুড় তারা অন্তত ৫০ টাকা দামে বিক্রি করছেন।
 
বৃহত্তর রংপুরের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদীর শাখাপ্রশাখা চার দিকে সৃষ্টি করেছে ধু ধু বালুচর ও চরাঞ্চল এলাকা। এ চরাঞ্চল এলাকার অনাবাদি জমি কৃষি চাষের আওতায় এনে সেখানে আখ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় ধান চাষের পাশাপাশি আখ চাষের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টিসহ দেশে গুড় শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে আখ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কৌশলগত পরিকল্পনা শীর্ষক কর্মশালার এক রিপোর্টে বলা হয়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় মাত্র ২১ হেক্টর জমিতে গুড় উৎপাদন উপযোগী আখ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজিবপুর উপজেলায় ১০ একর, রৌমারী উপজেলায় ১০০ হেক্টরের বেশি ও নাগেশ্বরী উপজেলায় মাত্র ১৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ আছে যার বেশির ভাগ গুড় উৎপাদন উপযোগী এবং অল্প কিছু চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী।
 
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত প্রকল্পের মাধ্যমে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এলাকা ২০১১-২০১২ রোপণ মৌসুম থেকে আখ চাষের আওতায় আনা হয়েছে। দানাদার গুড় উৎপাদনের জন্য ঈশ্বরদী-৪০ জাতটি চাষ করে সে এলাকায় কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বর্তমানে এ অঞ্চলগুলোতে বৃহত্তর রংপুরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আখ চাষ প্রকল্প এর মাধ্যমে বেশ কিছু জমিতে আখ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন জাতের আখ চাষ করে কৃষকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করেছে। চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন জাতের আখ চাষ করে ১ বিঘা জমি থেকে বছরে ১ লাখেরও বেশি টাকা লাভ করা যায়। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বদলে যাচ্ছে এলাকার জীবনযাত্রার মান, বদলে যাচ্ছে ভাগ্যের চাকা। কৃষকরা আখ চাষের পাশাপাশি একই জমিতে একই সময়ে সাথীফসল চাষ করে লাভের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারছে। আখের সঙ্গে সাথীফসল হিসেবে তারা পেঁয়াজ, রসুন, আলু চাষ করছে, যা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী থেকে আখচাষিদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয়। এ ছাড়াও বৃহত্তর রংপুর এলাকায় অবস্থিত ৫টি প্রকল্প অফিস থেকে আখচাষিদের সার্বক্ষণিক তদারকি ও সহযোগিতা করা হয়। কৃষকরা ভালো জাতের আখের বীজ এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
 
বৃহত্তর রংপুরের চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইক্ষু চাষ প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ০১.০৭.২০১১ শেষ হবে ৩০.০৬.২০১৫। পুরো কার্যক্রম সীমাবদ্ধ আছে নীলফামারী জেলার ৩টি উপজেলা ডোমার, ডিমলা, জলঢাকাতে। এখানে উল্লেখযোগ্য এলাকা হলো  রামডাঙ্গা, বালাপাড়া। লালমনিরহাট জেলার ৩টি উপজেলা সদর, আদিতমারি, হাতিবান্ধা। আর এখানকার প্রকল্পভুক্ত এলাকা হলো বাদিয়ার চর, চর কুলাঘাট, চর মহিষখোচা, চর দক্ষিণ সিন্দুর্না। কুড়িগ্রাম জেলার ৪টি উপজেলা সদর, রৌমারি, রাজিকপুর, নাগেশ্বরী। এসব উপজেলার প্রকল্পভুক্ত এলাকা হলো পাছগাছি, খামর হলোখানা, নারায়ণপুর, কাউয়ারচর, দই খাওয়ার চর, চর সোনাপুর, চরধনতলা। রংপুর জেলার ২টি উপজেলা গঙ্গাছড়া ও কাউনিয়া উপজেলার এলাকাগুলো চর খোলাবাড়িয়া, নলছিয়ার চর, চরদীঘলকান্দা, চরপাতিলাবাড়ি, চর এরেন্দাবাড়ি। গাইবান্ধার উপজেলার ৪টি উপজেলা হলো সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ। এসব এলাকাতে এখন আখ চাষের ধুম লেগেছে। প্রকল্প লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার একর যা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। মোট ১শ’ ২৫টি প্রদর্শনী। এর মধ্যে প্রতি উপজেলায় ২৫টি করে। সব ক‘টি সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। ২ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২৫০ টন মানসম্মত আধুনিক বীজ আখ বিতরণ করা হয়েছে। এখানে শুধু আখ চাষই মুখ্য নয়। এর সাথে প্রশিক্ষণ মিশ্র সাথী ফসলের।
 
অতীতে দেখা যেত, আমন ধান রোপণের পর এবং কাটার আগে কৃষি শ্রমিকদের হাতে তেমন কোনো কাজকর্ম প্রায় থাকত না বললেই চলে। আখ চাষ করে বেকার কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে। তাছাড়া চরাঞ্চলের বালুময় পতিত জমিতে যেখানে ফসল হয় না বললেই চলে। এমন জমিতেও আখ চাষ করে কৃষকের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত চর লাঠিয়ালডাঙ্গার আখ বা গেণ্ডারি রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হচ্ছে। প্রতিদিন রাজিবপুর ও রৌমারী সদর থেকে প্রায় ১শ’ জন ব্যাপারী জাদুর চর ইউনিয়নের চরলাঠিয়ালডাঙ্গা গ্রামে এসে আখ পাইকারি ক্রয়ের জন্য ক্ষেতে ক্ষেতে ভিড় জমায়।
 
ভোরবেলায় মুখরিত হয়ে ওঠে চরলাঠিয়ালডাঙ্গার রাস্তাঘাট। কার আগে কে যাবে আখের ক্ষেতে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রতিদিন ব্যাপারীদের মধ্যে। সরেজমিন এলাকায় গিয়ে কথা হয় আখচাষিদের সাথে। তারা জানান, গত বছর ৩ বারের বন্যায় রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় কোনো কৃষকের আবাদ হয়নি। বারবার ক্ষতি হওয়ার ফলে শাকসবজি ও ধানের আবাদ বাদ দিয়ে এবার ১ বিঘা (৬০) শতাংশ জমিতে আখের চাষ করে। আরো জানান, আখ চাষে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফসলের চেয়ে খরচ ও পরিশ্রম কম হয়। তার ১ বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে লাগানো, নিড়ানি, সার, কীটনাশক সবকিছু মিলে ৩৫ হাজার টাকা। আর আয় হয়েছে ১ লাখ টাকা। নিট লাভ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ঢাকা জেলার আখের ব্যাপারী জানান, আখের চাহিদা ঢাকাসহ সারা দেশেই আছে। কারণ অন্য আখের চেয়ে চরলাঠিয়ালডাঙ্গার মাটি অনেক ভালো। ভারতের লালমাটির ঘোলা পানি পেয়ে এ আখ অনেক রস ও মিষ্টি হয়। কিন্তু কেনার পর সরাসরি যানবাহন না চলাতে বিভিন্নভাবে টানাটানি করে কর্তিমারী বাজারে ও রাজিবপুর বাজারে এনে ট্রাকে নিতেই খরচ ও সময় দুটোই বেড়ে যায়। ফলে আমাদের আগ্রহ খুব থাকলেও যোগাযোগের সমস্যার জন্য আগ্রহ কমে যায়
 
রাজিবপুর উপজেলার জহিরম-লপাড়া গ্রামের আখের ব্যাপারী জানান, সরাসরি ক্ষেত থেকে আখ কিনে রাজিবপুর বর্ডার হাটে বিক্রি করি। তাতেও আমার প্রতি হাটে হাজার টাকা লাভ হয়। ভারতের গারোরা এ আখ খুব খায়। ওই হাটে আখের চাহিদা ভারতের লোকের কাছে খুব বেশি। চরলাঠিয়ালডাঙ্গা গ্রামটি রৌমারী উপজেলার জাদুরচর ইউনিয়নের ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। চারপাশেই নদী মাঝখানে এ দ্বীপচরটিতে এবার প্রায় ১শ’ বিঘা জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। যদি রৌমারীর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকতো তাহলে কৃষকরা আরো বেশি দরে আখ বিক্রি করতে পারতেন বলে জানান। এ বিষয়ে রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, রৌমারী উপজেলায় এ বছর ১৪৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আখ চাষে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে।
 
যে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ আমাদের অনেক দূরের বাতিঘরে নিয়ে যায়। তার হাজারো প্রমাণ আছে আমাদের বৃহত্তর কৃষিতে। এর মধ্যে চরাঞ্চলে আখ চাষ একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। যেখানে মঙ্গা আজ স্মৃতির কণিকা। এটিকে আরো বেগবান করতে সংশ্লিষ্ট সবাই কার্যকরভাবে ভাববেন এবং এগিয়ে নিয়ে যাবেন এ সুন্দরের উপমাকে আরো দূরে বহু দূরে। তখন আমরাই গর্ব করে বলতে পারব নদীর বুকে জেগে ওঠা চর শুধু ধু ধু বালিকায়ময় না এখানে সম্ভব সবুজ সোনালী মিষ্টি ছোয়ার প্রতিশ্রুত সমারোহ।
 
 
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা
 
বিস্তারিত
উদ্যান ফসলের পরিপক্বতার নিয়ামক ও ফসল সংগ্রহ
ফল সবজির দৈহিক বর্ধন তার যোজনা হতে পূর্ণ বৃদ্ধি হতে স্বাভাবিক নিয়মে কয়েক সপ্তাহ সময় নিয়ে থাকে। আর ফল সবজির সর্বোচ্চ দৈহিক বর্ধন পর্যায়ে পৌঁছার পরপরই পরিপক্বতা শুরু হয় এবং পরিপক্বতা কতগুলো বৈশিষ্ট্যদ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে পরিপক্বতা কিছু কিছু প্রভাবক দ্বারা আগাম বা বিলম্বিত হতে পারে। যেমন- পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা কমে যাওয়া, হরমোন বা রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে/ প্রয়োগ করা, একটানা শুষ্ক বাতাস প্রবাহিত হওয়া প্রভৃতি।
 
পরিপক্বতা হচ্ছে ফসলকে তোলার একটি বিশেষ মুহূর্ত বা অবস্থার নিয়ামক। ফসল সংগ্রহের এই বিশেষ অবস্থাটি ফসলের গুরুত্বপূর্ণ গুণাগুণ সংরক্ষণ করে। সঠিক পরিপক্বতায় ফসল সংগ্রহ করলে ফসলের মান ভালো পাওয়া যায়। ফল সঠিক পরিপক্বতার আগে সংগ্রহ করলে ভালোভাবে পাকবে না এবং সুবাসিত হবে না অপর পক্ষে সঠিক পরিপক্বতার পরে সংগ্রহ করলে ফলের জীবনকাল কমে যাবে এবং তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। একইভাবে শাকসবজি সময়ের আগে সংগ্রহ করলে অনেক সময় ধরে সবুজ থাকবে কিন্তু পণ্য হবে নিম্নমানের। আবার দেরিতে সংগ্রহ করলে নষ্ট হওয়ার সময় কমে যাবে এবং মান ও বাজারমূল্য কমে যাবে। ফল ও শাকসবজি সঠিক পরিপক্বতায় সংগ্রহ করলে উন্নত গঠন, ভালোস্বাদ, গন্ধ, সঠিক ওজন ও দর্শনীয় রঙ হয়।
 
পরিপক্বতার প্রকার
পরিপক্বতা দুই প্রকার
স্বাভাবিক পরিপক্বতা (Physiological Maturity): ফল ধরার পর বাড়বাড়তির শেষ অবস্থার দৈহিক কিছু পরিবর্তন (রঙ ত্বকের মসৃণতা, উজ্জ্বলতা, শুষ্কতা হওয়াকে স্বাভাবিক পরিপক্বতা বলে। ফল নিয়মতান্ত্রিকভাবেই এ স্বাভাবিক পাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এ সময় সহজে দৃশ্যমান ফলের বাইরের এবং শরীরবৃত্তীয় ভেতরের এমন অবস্থা হবে যাতে স্বাভাবিকভাবে ফল পেকে যায়।
 
ব্যবসায়িক বা উদ্যানতান্ত্রিক পরিপক্বতা (Commercial or Horticuitural Maturity) : ভোক্তা বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের বাড়বাড়তির যে কোনো অবস্থাকে ব্যবসায়িক বা উদ্যানতান্ত্রিক পরিপক্বতা বলে। যেমন পেঁপের সর্বোচ্চ বাড়বাড়তির সবুজ অবস্থাকে সবজি হিসেবে ব্যবহারের জন্য উপযোগী আবার পাকা ফল হিসেবে খেতে চাইলে ফলের একটু হলুদ রঙ ধারণ করলেই খাওয়ার উপযোগী হয়। ব্যবসায়িক পরিপক্বতায় অনেকসময় সামষ্টিক উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়।
 
পরিপক্বতার নিয়ামক
পরিপক্বতার নিয়মক হচ্ছে কতকগুলো চিহ্ন বা নির্দেশনা যাহা ফসল সংগ্রহের সময়কে (অবস্থা) বোঝায়। এটি ফসল সংগ্রহের তারিখ নির্ধারণ করে।
 
ভালো নিয়ামকের বিষয়সমূহ : ফসল সংগ্রহের ভালো নিয়ামক গুণ হচ্ছে যার দ্বারা সহজেই নির্ভরশীলতার সাথে পরিপক্ব হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায় এবং তা সময় এবং অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল নয়।

নিয়ামকের প্রকারভেদ
সাধারণ জ্ঞানের ব্যবহার যেমন চোখে দেখে হতে পারে বা হাতে নিয়ে নির্ধারণ করা যায়। যেমন-
(ক) দেখে নির্ণয়- সাইজ, রঙ কাঠামো ইত্যাদি।
(খ) অনুভব করে-গন্ধ (সুবাস), ছুয়ে (খসখসে, মসৃণ, নরম, শক্ত), স্বাদ (মিষ্টি, টক, ঝাঝালো, লবণাক্ত, তিতা), শুনে (আংগুল দিয়ে বাজিয়ে শব্দ শুনে)।
(২) মেপে নির্ণয় করা। এটা একটি জটিল বিষয় এবং সময়ক্ষেপণ হয়, কখন ফসলটি সংগ্রহ করা হবে তা সহজে নির্ণয় করা যায় না।
(ক) সময়- ফুল থেকে সংগ্রহ পর্যন্ত  যোজনা হতে পূর্ণবৃদ্ধি হওয় পর্যন্ত)
(খ) পারিপাশ্বিক আবহাওয়া- ফসল বাড়বাড়তির সময়ের তাপমাত্রা, বাতাসের শুষ্কতা ও প্রবাহতা।
(গ) রাসায়নিক দ্রবাদির পরিমাপ-টিএএস, চিনি ও এসিডের অনুপাত।
(ঘ) জৈব-রাসায়নিক বিষয়- শ্বসনের হার ও ইথিলিন উৎপাদনের পরিমাণ নির্ণয়।

প্রধান কয়েকটি ফলের পরিপক্বতার নিয়ামক
ফলের নাম
আম : আমের কাঁধে (বোঁটার কাছে) যখন হালকা রঙ হয় (২) ২/১টি স্বাভাবিক পাকা আম গাছ থেকে মাটিতে পড়ে (৩) ফলের স্পেসিফিক গ্রাভিটি যখন ১.০১ ও ১.০২ হয় (৪) জাত ও আবহাওয়ার অবস্থাভেদে ফল পরিপক্ব হতে একটা নির্দিষ্ট সময় যেমন এক পরীক্ষায় দেখা গেছে ফল ধারণের ৮২, ৮৬, ৯৯ ও ১১৪ দিন পর গোপালভোগ খিরসাপাতি, ল্যাংড়া এবং ফজলি জাতের আম পরিপক্ব হয়।
 
কাঁঠাল : ফল পরিপক্ব হলে ফলের উপরের কাটাগুলো মোটা, চ্যাপটা ও উপরের অংশ কালচে হবে। হাতের আংগুল দিয়ে চাপ দিয়ে পরিপক্ব কি না বোঝা যায়। গাছে একটি ফল পাকা পাওয়া গেলে কাঠি দিয়ে আঘাত করলে ড্যাব ড্যাব শব্দ হলে পরিপক্ব হয়েছে বোঝা যায়। পাকার মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। সাধারণত ফল ধরার ১২০-১৫০ দিনের মধ্যে কাঁঠাল পরিপক্ব হয়। তরকারির জন্য কাঁঠালের বিচি শক্ত হলে সংগ্রহ করা যায়।
 
পেঁপে: ফলের গায়ে সামান হলুদ রঙ হলে। ফলের দুধ পাতলা হয়ে পানির মতো হলে।
 
কলা: ফলের শির যখন কনিক্যাল থেকে গোলাকার হয়ে এবং হালকা ক্রিম রঙ হলে। আবহাওয়া ও জাতভেদে পুষ্প মঞ্জুরি বের হওয়ার ৯০-১১০ দিন পর কলা সংগ্রহের উপযোগী হয়। (শীতকালে ১১০ দিন এবং গ্রীষ্মকালে ৯০ দিন)।
 
লিচু : ফল সম্পূর্ণ লাল রঙ হলে, ফলের কাটাগুলো মোটা ও কাটার গোড়া ছড়ায়ে গেলে এবং মিষ্টতা এলেই সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। সাধারণত ফল আসার ৫৫-৬৫ দিন পর (জাত ও আবহাওয়ার তারতম্য অনুযায়ী) ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
 
পেয়ারা : সবুজাভ ক্রিম/ ঘিয়া রঙ হলে, ত্বক পাতলা উজ্জ্বল হয়।
 
কুল : ফল আসার ৪-৫ মাস (জাত ওয়ারী) পর ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। ফল নরম এবং রঙ সবুজাভ হলুদ বা সোনালি হলুদ রঙ হলেই সংগ্রহ করতে হয়।  
 
আনারস : স্থানীয় বাজারের জন্য ফল সম্পূর্ণ পাকলেই সংগ্রহ করা হয়। বিদেশে রফতানির জন্য সবুজ অবস্থায় বা হালকা লালচে বা হলুদাভ রঙ হলে সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ব জায়েন্টকিউ জাতে নিচের চোখগুলো কমলা থেকে হলুদাভ কমলা রঙ হয় এবং চোখগুলো মাঝখানে চ্যাপ্টা ও পার্শে মোটা হয়। হানিকুইন জাত সংগ্রহ করা হয়- এম১: ফলের গোড়ার দিক হলুদ হলে এম২: ফলের অর্ধেক পর্যন্ত রঙিন হলে অর্থাৎ ফলের শতকরা ১৫-৫০ ভাগ হলুদ রঙ হলে এবং এম৩: ফল যখন অর্ধেকের বেশি রঙিন হয় অর্থাৎ শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হলুদ হলে। স্থানীয় বাজারের জন্য এম২: অবস্থায় এবং দূরবর্তী রফতানির জন্য বাজারের জন্য গ্রাহকের চাহিদার ভিত্তিতে সাধারণত এম১ এবং এম২ অবস্থায় ফল সংগ্রহ করা হয়।
 
নারিকেল : নারিকেল সাধারণত ফুল আসার ১২-১৩ মাস পর পরিপক্ব হয়। যখন নারিকেলের খোসা খড়ের মতো রঙ ধারণ করে (ঝুনা নারিকেল), তখন সম্পূর্ণ পরিপক্ব হয়। পরিপক্ব নারিকেলে অল্প পরিমাণে পানি থাকে, যা ঝাকানি দিলে বোঝা যায়। পানির জন্য ৫-৬ মাস বয়সের ফল সংগ্রহ করা যায়।
 
লেবু : লেবু জাতীয় ফল সাধারণ পরিপূর্ণ বাড়বাড়তি হলে এবং ত্বকের রঙ উজ্জ্বল বা চকচকে সবুজ অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়।
 
তরমুজ : বাড়ি দিলে ড্যাব ড্যাব  বা ফাপা শব্দ হবে, পাতা শুকিয়ে যাবে এবং সবুজাভ মাখন রঙ হলে এবং আঁকড়া শুকিয়ে গেলে।
 
শাকসবজির পরিপক্বতার নিয়মক
শাকসবজির নাম
বাঁধাকপি : বাঁধাকপির বল যখন শক্ত বা দৃঢ় হবে এর ভেতরের কোনো জায়গা ফাঁকা থাকবে না। বাঁধাকপির উপরে চাপ দিলেই বোঝা যাবে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে কি? না।
 
ফুলকপি : ফুল শক্ত হলে এবং সাদা মাখন রঙ হলে, ফুলগুলো আঁটসাঁট এবং দৃঢ় হলে।
 
আলু : পাতা স্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেলে এবং আলুর চামড়া সহজে ছাড়ান না গেলে।

টমেটো : নিকটবর্তী বাজারের জন্য ত্বকের/ গায়ের রঙ সামান্য হলুদাভ হলে এবং দূরবর্তী বাজারের জন্য গা টান টান অবস্থায় মাখন সবুজ রঙ হলে সংগ্রহ করতে হবে।

পেঁয়াজ : গাছ শুকয়ে যাবে ও ৫০-৭৫% পাতা নেতিয়ে পড়ে যাবে এবং ঘাড় ছোট হলে। কন্দের গলার কোষ/ কলা নরম হলে। সাধারণত লাগানোর ৯০-১০০ দিন পর সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।

রসুন : গাছের পাতা যখন হলুদ ও পরে বাদামি রঙ হবে, পাতা ভেঙে পড়বে এবং বাহু যখন আর বাড়বে না তখন সংগ্রহরে উপযুক্ত সময়।
 
বেগুন: জাত অনুযায়ী নির্দিষ্ট আকার ধারণ করলে এবং শক্ত হওয়ার আগেই সংগ্রহ করতে হবে। চামড়া উজ্জ্বল এবং চকচকে ভাব থাকবে। বেশি পরিপক্ব বেগুন এর রঙ খারাপ হবে, শাঁস এবং বীজ শক্ত হবে।
 
ঢেঁড়স: কচি অবস্থায় সর্বোচ্চ বাড়বাড়তির সময় আগায় চাপ দিলে সহজেই ভেঙ্গে গেলে খাওয়ার উপযুক্ত থাকে।

মরিচ : কাঁচা মরিচের জন্য রঙ ধারণের আগে সর্বোচ্চ বড় হলে এবং শুকনা করার জন্য মরিচ সম্পূর্ণ লাল রঙ হলে।
 
পটোল : সম্পূর্ণ পরিপক্ব হওয়ার আগেই পটোল সংগ্রহ করতে হবে। ফলকে চাপ দিলে ভরাট মনে হবে।

শসা : হলুদ রঙ শুরু হওয়ার আগেই গায়ে লোমশ থাকা অবস্থায় ফল সংগ্রহ করতে হবে।

ফ্রেঞ্চবিন : বীজ বপনের ৪৫-৬০ দিন পর বা ফুল আসার ১৫ দিন পর সংগ্রহ করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ
ফসল সংগ্রহ হচ্ছে পণ্যকে গাছ থেকে নিয়মানুযায়ী উদ্দেশ্যভিত্তিক তোলা। ফল ও শাকসবজির মান

সংরক্ষণের জন্য ফসল
সংগ্রহ ও স্থানান্তরের সময় যত নেয়া জরুরি নিয়ম অনুযায়ী ফসল সংগ্রহ ও স্থানান্তর না করলে পণ্যের মান ও বাজারমূল্য কমে যায়। পণ্য ঘষা খেলে বা ক্ষত হলে বা থেতলে গেলে বাদামি ও কাল দাগ হয়ে উজ্জ্বলতা হারায়। ক্ষত হলে বিনষ্টকারী জীবাণু অনুপ্রবেশের সুবিধা হয়, যা পণ্যকে পচাতে ত্বরান্বিত করে। এসব কারণে পণ্যের শ্বসনের হার বেশি বেড়ে যায় এবং সংরক্ষণের সময়কাল কমে যায়। ফসল সংগ্রহ ও হস্তান্তর বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকলে ফল ও শাকসবজির যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
 
ফসল সংগ্রহের সময়
ফসল সংগ্রহের সময় ( মৌসুমের আগে বা দেরিতে) নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর যেমন- ফসলের বাজারমূল্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস বা পরিবর্তন, পণ্যের ধরন (ক্লাইম্যাকটেরিক বা নন-ক্লাইম্যাকটেরিক), ভোক্তার চাহিদা, ব্যবহারের পদ্ধতি এবং বাজারের দূরত্ব অনুযায়ী। এর পরও এটা নির্ভর করবে ফসলের পরিপক্বতা, সর্বনিম্ন পুষ্টিগত মান এবং ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী।
 
ফসল সংগ্রহের পদ্ধতি
হাতের সাহায্যে সংগ্রহ : বেশিরভাগ উদ্যানতান্ত্রিক ফসল টাটকা খাওয়া ও বাজারজাত করার জন্য হাত দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। হাত দিয়ে সংগ্রহ করলে পণ্যের ক্ষতি অনেক কম হয়। এর পরও এ পদ্ধতি ব্যয় বহুল ও ধীরগতিসম্পন্ন এবং অনেক সময় শ্রমিকের অভাব হয়। হাত দ্বারা নির্দিষ্ট পণ্যকে চাহিদা মোতাবেক অনেকবার তোলা যায়।
 
সহায়ক সংগ্রহ : এই পদ্ধতিতে অনেক যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয় যেমন-চাকু ও ফসল তোলার যন্ত্র। সাধারণ যন্ত্রপাতির মধ্যে মই, ফসল তোলার ঝুড়ি, ফল পাড়ার লম্বা বাঁশ, মোটরচালিত ফসল সংগ্রহের প্লাটফর্ম ইত্যাদির ব্যবহার হয়।
 
মেকানিক্যাল সংগ্রহ : উন্নত বিশ্বে মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহ করা হয় সাধারণত টিনজাত, হিমায়িতকরণ, শুকান ও জুস তৈরিতে ব্যবহারের জন্য।
 
এই পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহ করলে সাধারণ ক্ষতি হয় এবং তাড়াতাড়ি পচে যায় ও খচর বেশি হয়। মেকানিক্যাল পদ্ধতি একবারে ফসল তোলা হয় এর ফলে সংগৃহীত ফসলের মধ্যে সমতা থাকে না (পাকা, সাইজ, রঙ ইত্যাদি)
 
ফল ও সবজির সংগ্রহ পদ্ধতি
ফল ও শাকসবজির গঠনগত পার্থক্যের কারণে সংগ্রহের পদ্ধতির তারতম্য হয়। আবার বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি সংগ্রহের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। তথাপিও কিছু ফল ও শাকসবজির সংগ্রহ পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
 
(১) কলা : কলার কাণ্ডটিকে এমনভাবে কাটতে হবে, যাতে কলার কাঁদিটি মাটিতে না স্পর্শ করে বরং ঝুলে যায়। এরপর কলার সর্বশেষ ছড়া হতে কাঁদিটি ৩০ সেমি. রেখে কেটে নিতে হবে, যাতে সহজেই হাতে বহন করা যায়।
 
(২) কাঁঠাল : ফল যদি হাতের নাগালের মধ্যে হয় তাহলে বোঁটাটি চাকু দিয়ে বা মোচড়াইয়া পাছ থেকে আলাদা হলে নামানো হয়। যদি গাছটি লম্বা হয় তাহলে ফলটিকে একটি বস্তা বা দড়ি দিয়ে বেধে বোঁটা কেটে ধীরে ধীরে মাটিতে নামানো হয়।
 
(৩) লিচু : ফলে থোকাগুলো পাতা ও ডালের কিছু অংশসহ কেটে নিতে হয়। আলাদা করে একটি করে লিচু সংগ্রহ করা যায় না, কারণ এত ফল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সহজেই পচন ধরে এবং বাজারমূল্য কমে যায়।
 
(৪) আম : যত বেশি সম্ভব আম হাত দিয়ে গাছ থেকে পাড়া। বড় গাছের জন্য বাঁশের লম্বা পোল ব্যবহার করা হয় যার আগায় একটি দড়ির ঝুড়ি লাগানো থাকে (চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঠুসি বলে)। অনেক সময় বড় গাছে আম সংগ্রহকারীরা গাছে উঠে আম পেড়ে দড়ির ঝুড়িতে ভরে মোটা লম্বা রশিতে বেঁধে নিচে নামায়। যার ফলে আমে কোন ঘষা লাগে না এবং ক্ষত হয় না।
 
(৫) পেঁপে : পেঁপে সাধারণত টান দিয়ে বা মোচড়াইয়া গাছ থেকে আলাদা করে সংগ্রহ করা হয়। ল¤া^ গাছের জন্য সাধারণত মই ব্যবহার করা হয়। লম্বা পোল ব্যবহার করে ফল সংগ্রহ করলে ফল ক্ষত হয়ে যায়, যার ফলে সহজেই পচন ধরে।
 
(৬) আনারস : আনারস উত্তোলনকারী হাতে গোবস লাগিয়ে ফলটির মুকুট ধরে নিচে চাপ দিয়ে বা একটি ধারাল চাকু দিয়ে আধা সেমি. ফলের সংগে কান্ড রেখে কেটে নিতে হয়।
 
(৭) মুলা ও গাজর : মুলা ও গাজর তোলার উপযুক্ত হলে সম্পূর্ণ গাছকে মাটি থেকে তুলে নিতে হয়। এগুলো পাতাসহ বা পাতা ছাড়া বাজারজাত করা যায়।
 
(৮) আলু : আলু সংগ্রহের সময় ক্ষতি কমানোর জন্য আলুর ভেতরের রস কমাতে হয়। আলু সংগ্রহের এক সপ্তাহ আগে আলু গাছগুলো কেটে দিতে হয়। এর পর কোদাল বা ছোট লাঙল দিয়ে আলু মাটির উপরে উঠিয়ে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে ১৫ থেকে ৬০ মিনিট রেখে দিতে হয়।
 
(৯) বাঁধাকপি : একটি বড় চাকু দিয়ে বাঁধাকপিটিকে গোড়া থেকে পুরাতন পাতা ২-৩টি রেখে কেটে আলাদা করতে হয়। তবে কোন কোন সময় সম্পূর্ণ গাছই টান দিয়ে উঠানো হয়।
 
(১০) ফুলকপি : নিচের দিকে কিছু পাতা রেখে চাকু দ্বারা সাবধানে নিচের কাণ্ডটি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। ফুল যেনক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ফুলের উপরে পাতা জড়াইয়া দিতে হয়।
 
(১১) ব্রোকলি : বড় পাতাগুলো সরায়ে দিতে হবে এবং ফুলের ২০-২৫ সেমি. নিচে চাকু দ্বারা কেটে সংগ্রহ করতে হবে।
 
(১২) শিম : শিম কৃষকেরা হাতের সাহায্যে উত্তোলন করেন।
 
(১৩) শসা : ফলগুলো গাছের লতা থেকে আলাদা করা হয় বা উত্তম হলো বোঁটাকে চাকু দিয়ে কেটে আলাদা করা, কোন অবস্থায় ফলের গায়ে হাত না দেয়া।
 
(১৪) বেগুন : ফলকে ধারাল চাকু দিয়ে বোঁটার গোড়া থেকে কেটে সংগ্রহ করতে হবে।

(১৫) ঢেঁড়স :  ঢেঁড়স সংগ্রহের সময় গোবস বা কাপড় পরতে হবে, যাতে ধারাল শুংগুলো শরীরে ক্ষতি না হয়।
বোঁটাগুলো ধারাল চাকু দিয়ে কেটে আলাদা করে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখতে হয়, যেন কোনো ক্ষতের সৃষ্টি না হয়।

(১৬) টমেটো : ফল ধরে অর্ধ মোচড়াইয়া বা সম্পূর্ণ মোচড়াইয়া ফল সংগ্রহ করতে হয়। যখন টমেটো পরিপক্ব হয় তখন সহজেই গাছ থেকে আলাদা করা যায়।
 
(১৭) তরমুজ : বোঁটার কিছু অংশ রেখে ফলটিকে কেটে সংগ্রহ করতে হয়।

ফসল সংগ্রহের সময় করণীয়

ক) মেকানিক্যাল ক্ষত কম করা :
১) সনাতন পদ্ধতিতে না ভাঙা পর্যন্ত টানা, মোচড়ানো, ঝাঁকানো, বাঁকানোর পরিবর্তে ক্লিপারের সাহায্যে ফসল সংগ্রহ করা উত্তম।
২) লম্বা বাঁশের পরিবর্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো ঠুসি ব্যবহার করা উচিত।
৩) প্রয়োজনবোধে হাতে গ্লোবস ব্যবহার করা যদি ফসলটি ধারাল কাটা যুক্ত হয়।
৪) পরিবহন পাত্র শক্ত, অমসৃণ বা তীক্ষè হলে তা পরিহার করা উচিত।
৫) পরিবহনে যেন ঝাঁকি না লাগে তা বিবেচনায় আনতে হবে।

খ) অধিক তাপ পরিহার করা :
১) মাঠের তাপ কমানোর জন্য দিনের ঠাণ্ডা সময়ে (খুব সকালে বা দেরিতে) ফসল সংগ্রহ করা উচিত।
২) সংগৃহীত ফসল পরিবহন, প্যাকিং হাউজ বা শীতলীকরণ হাউজে না নেয়া পর্যন্ত ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করা।
গ) মাটির সংস্পর্শে কম যায় সেদিকে খেয়াল রাখা।
ঘ) আম এবং কলাকে আঁঠাল ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।
ঙ) কম খরচ এবং সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করা।
 

ড. মো. ইত্তেফাকুল আজাদ*
* সাবেক উপপরিচালক, ডিএই, ৪৯১/পদ্মা আবাসিক এলাকা, রোড নং-১০, রাজশাহী। মোবাইল : ০১৭১৫১৭১০৫০
 
বিস্তারিত
বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধানের চাষ

বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি দিন দিন কমছে এবং লোকসংখ্যা বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে হাইব্রিড ধান চাষের বিকল্প নেই। উফশী জাতের তুলনায়  হাইব্রিড ধান চাষে ৩০-৪০% ফলন বৃদ্ধি হয়। তাই হাইব্রিড ধান চাষাবাদ সময়ের দাবি।
 

হাইব্রিড ধান উৎপাদন পদ্ধতি উফশী ধানচাষ পদ্ধতির মতোই; তবে হাইব্রিড ধানচাষের ক্ষেত্রে বীজতলার জন্য বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। হাইব্রিড ধান চাষের উল্লেখযোগ্য দিক হলো।
হাইব্রিড ধানের জন্য প্রতি হেক্টরে মাত্র ২০ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়।
 
বীজতলার জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি গোবর বা পচা আবর্জনা সার প্রয়োগ করতে হবে।
৪০০ বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি বা প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৫০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে।
 
প্রতি গুছিতে মাত্র একটি বা দুটি চারা রোপণ করতে হবে।
প্রত্যেক মৌসুমের জন্য নতুন হাইব্রিড বীজের প্রয়োজন হয়।
 
হাইব্রিড ধানের জাত :- এসএল ৮এইচ, ব্রি-হাইব্রিড ধান ১,২,৩,হিরা,তেজ,এসিআই-২, সাথী, লাল তীর, মধুমতি, আলোড়ন, জাগরণ, জাগরণ-৩, রূপসী বাংলা-১, রূপালী, সচ্ছল ইত্যাদি।
 
বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন :
উফশী ধানের বীজতলা তৈরি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। উপরন্ত বীজতলায় জৈবসার প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক। বীজতলার প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি পচা গোবর বা পচা আবর্জনা সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া চারা সুস্থ ও সবল রাখতে জমি তৈরির সময় প্রতি বর্গমিটারে ৪ গ্রাম টিএসপি, ৭ গ্রাম এমপি এবং বীজ বোনার ১০ দিন পরে ৭ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
 
১মিটার চওড়া ও জমি অনুযায়ী সুবিধা মতো লম্বা করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। দুটি বীজতলার মাঝে ২৫-৩০ সে. মিটার নালা রাখতে হবে।
 
৩০ সেমি. নালা ফাঁকা রাখা জায়গা থেকে ১৫ সেমি. গভীর করে মাটি তুলে দুই ধারের বীজতলায় দিতে হবে। এতে দুই বীজতলার মাঝের নালা দিয়ে সেচ বা পানি নিষ্কাশন ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার পরিচর্যা করাও সহজ হবে। ১৫ নভেম্বর হতে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে হাইব্রিড ধানের বীজ বপন করতে হবে।
 
জমি তৈরি :
উর্বর জমি, পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ও সেচের সুবিধা রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। চারা রোপণের জন্য উত্তমরূপে চাষ ও মই দিয়ে মাটি কাদাময় করে নিতে হবে। শেষ চাষ ও মই দেয়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন জমিটা যথেষ্ট সমতল হয় এবং অনুমোদিত হারে সার ও প্রয়োগ করতে হবে।
 
চারা রোপণ : রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে এবং গোছা প্রতি ১ বা ২টি করে সুস্থ ও সবল চারা রোপণ করতে হবে। ৩০-৩৫ দিনের চারা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে রোপণ করতে হবে। সারিতে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি)। রোপণের ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে মরে যাওয়া চারার স্থলে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করতে হবে।
 
সার ব্যবস্থাপনা : হাইব্রিড ধান থেকে প্রত্যাশিত ফলন পেতে জমিতে প্রয়োজনমতো জৈবসার, যেমন- গোবর ও পচা আবর্জনা, ধইঞ্চা বা ডাল জাতীয় ফসল ব্যবহার করা উচিত। চারা রোপণের জন্য জমি তৈরির শেষ চাষের সময় টিএসপি/ডিএপি,জিপসাম ও জিংক সালফেট এবং ২/৩ অংশ এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষে কিছু ইউরিয়া সারও প্রয়োগ করতে হবে।
 
হাইব্রিড ধানের চাষাবাদে অনুমোদিত সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি     
যদি কোনো কৃষক তাঁর জমিতে টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ২৭০ কেজির স্থলে ২১০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করবেন এবং তা তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগকালে জমিতে অতিরিক্ত পানি থাকলে তা বের করে দিতে হবে এবং সার প্রয়োগের ২-৩ দিন পর জমিতে পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে।
 
হাইব্রিড ধানের আগাছা দমন ও পানি ব্যবস্থাপনা : সার উপরিপ্রয়োগের আগে অবশ্যই জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর তা মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। হাত দিয়ে বা উইডার দিয়ে অথবা আগাছানাশক প্রয়োগে আগাছা দমন করা যেতে পারে। চারা রোপণের পর থেকে জমিতে ৫-৭ সেন্টিমিটার (২-৩ ইঞ্চি) পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ধানগাছ যখন কাইচথোড় আসা শুরু করে তখন পানির পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো উচিত। এ অবস্থায় খরায় পড়লে ধানে চিটার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
 
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন : পরের পৃষ্ঠায় দেখুন।
ফসল কর্তন : ধানের ছড়ায় শতকরা ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ধান কাটতে হবে। যত্ন সহকারে আবাদ করলে বিঘাপ্রতি ৩০-৪০ মন ধানের ফলন পাওয়া যায়।
 
সারের নাম  পরিমাণ(কেজি/হেক্টর) প্রয়োগের সময়
ইউরিয়া      ২৭০ কেজি ১/৪ অংশ শেষ চাষের সময়। ১/৪ অংশ চারা রোপণের 
১৫-২০  দিন পর ১/৪ অংশ, ৩৫/৪০ দিন পর
এবং অবশিষ্ট ১/৪ কাইচথোড় আসার সময়।
টিএসপি বা ডিএপি     ১৩০ কেজি    শেষ চাষের সময় ।
এমপি      ১২০ কেজি     ২/৩ অংশ শেষ চাষের সময় এবং
১/৩ ,অংশ দ্বিতীয় উপরিপ্রয়োগের সময় ।
জিপসাম     ৭০ কেজি    শেষ চাষের সময় ।
দস্তা/জিংক সালফেট     ১০ কেজি    শেষ চাষের সময় ।
 
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
পোকা/রোগের নাম
 ক্ষতির ধরন   
প্রতিকার
মাজরা পোকা মরা ডিগ ও মরা শিষ দেখা যায় বাসুডিন ১০ জি. বিঘায় ২.৫ কেজি হারে কাইচথোড় আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে।
গান্ধি পোকা কচি ধানের দুধ চুষে খায়,ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। ডায়াজিনন ৬০ ইসি. ১.৫ মিলি/ লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে, অথবা কার্বোসালফার অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাতা পোড়া (বিএলবি) পাতার কিনারা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়  ক্ষেতের পানি ৭-১০ দিনের জন্য শুকিয়ে ফেলা এবং বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার ছিপছিপে পানিতে প্রয়োগ করা।
খোল পচা রোগ পাতার খোল পচে যায় টিলট্ ২৫০ ইসি. ১ মিলি/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
টুংরো গাছের পাতা হলদে/ কমলা রঙ ধারণ করে ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসিঃ ১.৫ মিলি/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
ব্লাস্ট পাতায় চোখের আকৃতির মতো দাগ সৃষ্টি হয় ট্রপার বিঘায় ৫০ গ্রাম ট্রপার ১ গ্রাম/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
 
ফসল সংরক্ষণ : অন্যান্য উফশী জাতের মতোই ধান মাড়াই-ঝাড়াই করে রোদে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।

 
সতর্কতা : হাইব্রিড ধানের বীজ থেকে উৎপাদিত ধান পুনরায় বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এতে ফলন আগের মতো পাওয়া যাবে না। আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য হাইব্রিড ধানের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
 
তাহলেই জাতি দানাদার জাতীয় খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে পারবে।
 
 
কৃষিবিদ শাহ্ মোহা. আকরামুল হক*
কৃষিবিদ এম এম আব্দুর রাজ্জাক**
* উপ-পরিচালক,কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঝিনাইদহ ** আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস,খুলনা।
 
বিস্তারিত
বিষ দেয়া সবজি থেকে সাবধান
শাক সবজি চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই বড় বাধা। বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে সবিজ ফসলকে রক্ষার জন্য সবজি চাষিরা তাই প্রথমেই সাধারণত বিষাক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু এমন কেনো বালাইনাশক নেই, যা মানভ দেহের জন্য কম বেশি বিষাক্ত নয়। এ দেশে সাধারণত যথেচ্ছভাবে মাত্রাহীন পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে সবচে বেশি মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে শাকসবজিতে। শাকসবজিতে কোনো প্রকার অপেক্ষমাণ কাল না মেনেই সেসব শাকসবজি তোলা ও খাওয়া হয়। অথচ প্রায় প্রতিটি কীটনাশকেরই রয়েছে কম বেশি অবশিষ্টাংশের প্রভাব। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে যেমন তেমন, কিন্তু শাকসবজি, ফল, পান ইত্যাদি ফসলের ক্ষেত্রে বালাইনাশক ব্যবহার প্রতিদিন আমাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। কেননা এসব ফসলের অধিকাংশ আমরা কাঁচা বা সরাসরি খাই অথবা অল্প রান্না করে খাই। তা না হলে আবার এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পেটের বিভিন্ন পীড়া এর অন্যতম কারণ।
 
কোনো কোনো বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের প্রভাব এত বেশি দিন থাকে যে তা একবার আমাদের দেহে ঢুকলে তা সহজে সম্পূর্ণ রূপে যায় না। বরং এ জাতীয় বালাইনাশকের কণা দেহে ক্রমসঞ্চিত হতে হতে আমাদের বিকলাঙ্গ বা বন্ধ্যা করে তোলে। নিয়মনীতিহীন বালাইনাশকের ব্যবহার এ পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তুলেছে। আর পরিবেশ দূষণ  তো রয়েছেই। এক দিকে বালাইনাশক ব্যবহার করে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে পরাগায়নে সাহায্যকারী বিভিন্ন পোকামাকড়কে আর ক্ষেতে দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে ফলনও মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। আর এসব কীটনাশক ব্যবহারের সময় যে সতর্কতা বা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত তার কিছুই আমাদের দেশে মানা হয় না। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে কৃষকেরা বিষাক্ততায় আক্রান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো চাষিরা কেন জীবনের এত ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত অর্থনাশ করে বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ফসলে ব্যবহার করেছেন? প্রথমত সব চাষিই চান সহজে ও দ্রুত ক্ষেতের পোকামাকড় ধ্বংস করতে। এ দেশের চাষিরা বিষ প্রয়োগের দ্বারা পোকামাকড় ও রোগ দমনব্যবস্থাই সর্বপ্রথম ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শাকসবজিতে বালাইনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ বা দূষণীয় নয়। কিন্তু সবজিতে তা প্রয়োগের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপক্ষো করলে সেসব বিষের বিষাক্ততা কেটে যায় বা অনেক কমে যায়। ফলে তখন সেসব সবজি গ্রহণ অনেকটা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত হয়। তাই শাকসবজির ক্ষেত্রে বালাইনাশক ব্যবহারে এই অপেক্ষমাণকাল একটি শুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাশং শাকসবজি একই সময়ে পরিণত হয় না বা একসাথে ফসল তোলা হয় না। কোনোটি হলো পাতাজাতীয় সবজি কোনো হলো মূল বা কন্দজাতীয় সবজি আবার কোনোটি জলজাতীয়। এ জন্য বালাইনাশকের ব্যবহারও হয় বিভিন্ন রকম। বিভিন্ন বালাইনাশকের অপেক্ষমাণকাল বিভিন্ন। কোনোটি প্রয়োগের ১ দিন পরই সবজি তোলা যায় আবার কোনোটি প্রয়োগ করার ২১ দিন পর ঐ ক্ষেত থেকে সবজি তুলতে হয়। কিন্তু মুশকিলটা হলো সেখানেই। সবজিচাষিরা বিকেলে বিশ দিয়েই সকালে ক্ষেতের সবজি তুলে বাজারে নিয়ে আসেন বেচতে। যারা কেনেন, তারা তো আর জানেন না যে সেই সবজিতে কতদিন আগে বিষ দেয়া হয়েছে। ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
 
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশে কোনো সবজিচাষিই বিষাক্ত বালাইনাশক ক্ষেতে ছিটানোর পর নিয়মমতো ফসল তোলার জন্য অপেক্ষা করেন না। কাজেই ক্ষতি যা হওয়ার তা এসব সবজি যারা খায় তাদেরই হয়। মানবদেহে প্রয়োগকৃত কীটনাশকের এক কণাও যেন প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিশে^র অনেক দেশেই কঠোরভাবে অপেক্ষা মান কাল মানা হয়। যেহেতু আমাদের দেশে তা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করা হয়না সে জন্য ভোক্তাকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অধিক সচেতন হতে হবে। সবচেয়ে ভালো, নিজেরাই বসতবাড়িতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে খাওয়া। কিন্তু সে সুযোগ সময় সবার কোথায়? তাই বাজার থেকে সবজি কিনতেই হয়। সেসব সবজির সাথে বিষও আসে। সেই বিষের বিষক্রিয়া থেকে বাঁচা দরকার। না হলে যে পুষ্টির জন্য শাকসবজি খাই, সেই পুষ্টি নিতে শেষে গুষ্ঠী উজাড় হয়ে যেতে পারে।  সেজন্য বাজার থেকে সবজি কেনার পরই সরাসরি কড়াইতে চাপানো আগে কিছু নিয়ম কানুন মানতে হবে। এসব নিয়ম মানলে শাকসবজিতে দেয়া বিষের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ ও ক্ষতি অনেকটাই কমানো যাবে। এজন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি নেয়া যেতে পারে-
 
তেঁতুল দ্রবণে শোধন- বাজার থেকে সবজি কেনার পর বাড়িতে এনে সেসব শাকসবজি লবণ বা তেঁতুলগোলা পানিতে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখবেন। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম লবণ বা তেঁতুল মিশিয়ে এ দ্রবণ তৈরি করা যায়। এভাবে ভিজালে ৪০-৬০% বিষ দ্রবণে গুলে শাকসবজি থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে বিষাক্ততা কমে যায়। এরপর সেসব সবজি আবার পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে নেবেন। এরপর রান্না করলে তাপে বাকি বিষটুকুর অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে শোধনের ফলে বিষাক্ত শাকসবজির বিষাক্ততা প্রায় ৭০-৮০% কমে যায়।
 
লবণ বা তেঁতুল জলে শাকসবজি এভাবে শোধন করা সম্ভব না হলে পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিলেও কিছুটা উপকার হয়।
 
রান্নার ঠিক আগে শাকসবজি ঠাণ্ডা জলের চেয়ে হালকা গরম পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে পারলে বিষের ক্রিয়া অনেকটা নষ্ট হয়।
আজকাল বাজারে অনেক হাইব্রিড জাতের সবজি পাওয়া যাচ্ছে। এসব সবজি বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ে তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রান্ত হয়। এজন্য হাইব্রিড জাতের সবজিতে বেশি বালাইনাশক তথা বিষ দেয়ার প্রয়োজন হয়। এজন্য পারতপক্ষে বাজার থেকে যথাসম্ভব হাইব্রিড জাতের সবজি বিশেষ করে বড় বড় বরবটি, ঝিঙ্গে, ধুন্দুল, শসা, চিচিঙা, করলা, বেগুন ইত্যাদি না কেনা উচিত। কিনলে অবশ্যই তা রান্নার আগে ভালো করে ধুয়ে বা শোধন করে নেয়া উচিত।

 
অসময়ে ফলে এমন সবজিতে সাধারণত বেশি বিষ দেয়া হয়। কেননা, সময়ে ফলানোর চেয়ে অসময়ে ফলানো শাকসবজিতে বেশি রোগপোকা আক্রমণ করে। তাই, অমৌসুমের  কোনো সবজি কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত। কিনলে অবশ্যই শোধন করে নিতে হবে।
ঝকঝকে, তেলতেলে, চকচকে ও দেখতে খুব সুন্দর শাকসবজি বাজার থেকে না কেনা উচিত। কেননা, ওগুলো নিশ্চিত বিষ দেয়া। না হলে সবজিগুলো রোগপোকায় আক্রান্ত থাকত এবং তার ক্ষতির নমুনাও থাকত। চেহারা খারাপ দেখাত। তাই এসব সবজি কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত। বরং পারলে পোকা ফুটো বেগুন কিনে ক্ষতটা বাদ দিয়ে খাওয়াও ওর চেয়ে নিরাপদ। চেহারা মলিন হলে দোষ নেই, তাতে স্বাদও কিছু কমবে না। কিন্তু বিষ দেয়া সবজির স্বাদ নষ্ট তো হবেই, সেই সাথে ওটা নানান অসুখ টেনে আনবে।

 
রঙ দেয়া সবজি আদৌ কেনা ঠিক নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, কি করে বুঝবেন যে ওতে রঙ দেয়া আছে। ইদানীং পটোলজাতীয় সবজি সবুজ রাখার জন্য তুঁতে গোলা জলে ডোবানো হচ্ছে। তুঁতে শরীরের জন্য এক মারাত্মক বিষ। সেটাই তো আমরা খাচ্ছি ওই রঙ দেয়া সবজির সাথে। আবার কিছু পাতাজাতীয় সবজি যাতে ঢলে না যায় সেজন্য কাপড় কাচা সোডা গোলা পানিতে ডুবিয়ে তোলা হচ্ছে। ফুলকপির ফুল বেশি সাদা করার জন্য ক্ষেতে থাকা অবস্থায় ফুলে ব্লিচিং পাউডার পানিতে গুলে স্প্রে করা হচ্ছে। তাহলেই বুঝুন ব্যাপারটা, আমরা শাকসবজির নামে কি খাচ্ছি?
 
গাঢ় সবুজ সবজি কম কিনবেন- বরবটি, বাঁধাকপি, শিম ইত্যাদি সবজি বেশি সবুজ রাখার জন্য অনেক সময় চাষিরা তোলার আগে জলে ইউরিয়া গুলে সরাসরি ওসব সবজিতে স্প্রে করেন। ফলে সবজির গা বেশি সবুজ দেখায়। ইউরেয়া থেকে নাইট্রোজেন শরীরের মধ্যে যায়। সেই নাইট্রোজেন খাদ্যনালীতে থাকা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে নাইট্রেটে পরিণত হয়। নাইট্রেট রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে হিমোগ্লোবিনে পরিণত হয়, যা কোনো অক্সিজেন বইতে পারে না। ফলে আমাদের দেহের কোষে কোষে হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছানো কমে যায়। এত কোষের বিপাক ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং শরীরের নানা অসুখ বাসা বাঁধে। আবার নাইট্রেট শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্যও দায়ী। যেসব শাকসবজিতে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ করা হয়, সেসব সবজির মধ্যে সেই রাসায়নিক সারের কিছু না কিছু অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। তাই সেসব সবজি খাওয়াও সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু জৈবসার দিয়ে উৎপাদিত সবজিতে এই ঝুঁকি নেই।
 
বর্ষার শাকসবজি  নিরাপদ নয়- শাক পাতা, বিশেষ করে বর্ষাকালের শাকপাতায় বিভিন্ন রোগের জীবাণু বাসা বাঁধে। বর্ষাকালে শাকপাতা অনেক সময় পানিতে ডোবা থাকে। কাজেই বর্ষাকালের শাকপাতা পরিহার করা ভালো।
 
সালাদের সবজি বেশি বিপজ্জনক- সালাদের সবজি বিশেষ করে টমেটো ও শসা আমরা কাঁচা খাই। আর বিপদের ঝুঁকিটাও সেখানে। সেসব সবজিতে দেয়া বিষ রান্নার তাপে বিনষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই, এমনকি সেসব সবজি ভালো করে না ধুয়েই আমরা তাতে কামড় বসিয়ে দিই। এটা আদৌ উচিত নয়। খাওয়ার আগে অবশ্যই সালাদের সবজি ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। অনেক চাষি কাঁচা টমেটো পাকাতে বিভিন্ন হরমোন নির্বিচারে ব্যবহার করে থাকেন। এটাও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
 
বিষবিহীন বা কম বিষ দেয়া সবজি খাওয়া- শাকসবজির বিষ দেয়া হয় বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগের হাত থেকে সবজিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সব শাকসবজিতে বিষ সমানভাবে দেয়া হয় না। কোনো কোনো সবজিতে বিষ খুব বেশি দেয়া হয়, কোনোটাতে কম। বিষ দেয়ার পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর সবজি তুলে খেলে সেসব বিষে তেমন ক্ষতি হয় না। কেননা, সেই সময় পর তার বিষক্রিয়া প্রায় কেটে যায়। কিন্তু মুশকিলটা হলো, বিষের অবশিষ্টাংশ বা ক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই আমরা সেসব শাকসবজি খাই। ক্ষতিটা সে জন্যই হয়। তাই যেসব শাকসবজিতে সাধারণত বেশি বিষ ব্যবহার করা হয় সেসব শাকসবজি না খেলে তার বিষাক্ততা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। অন্য দিকে, যেসব শাকসবজিতে সাধারণত বিষ মোটেই দেয়া হয় না সেগুলো নিশ্চিন্তে খাওয়া যেতে পারে। এ দেশে বিভিন্ন সবজি ক্ষেত্রে বিষ ব্যবহারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে মাঠ জরিপের তথ্যানুসারে বিভিন্ন সবজিকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যেতে পারে-
 
ক) বেশি বিষ দেয়া সবজি- এসব সবজিতে বেশি বিষ ও অধিক বিষাক্ততার বিষ ব্যবহার করা হয় এবং সেসব শাকসবজিতে বিষের অবশিষ্টাংশও বেশি থাকে। যেমন : বেগুন, হাইব্রিড টমেটো, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, শিম, বরবটি, লালশাক, ফ্রেঞ্চবিন, গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি, উচ্ছে, করলা, ঢ়েঁড়স, ক্যাপসিকাম মরিচ ইত্যাদি।
 
খ) মধ্যম বিষ দেয়া সবজি- শসা, বরবটি, ফুলকপি, কাঁকরোল, পটোল, ঝিঙা, মরিচ, পেঁয়াজকলি, চিচিঙা, ধুন্দুল, ব্রোকলি ইত্যাদি।
 
গ) কম বিষ দেয়া সবজি- লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, পুঁই, ডাটা, মিষ্টি আলু, আলু, মুলা, গাজর, শালগম, ওলকপি, গিমা কলমি, পেঁপে, বিট, ধনে পাতা ওলকচু, লতিকচু, মুখিকচু ইত্যাদি।
 
ঘ) বিষ না দেয়া সবজি- এসব শাকসবজি সাধারণত বসতবাড়ির আশপাশে জন্মে এবং কোন বিষ দেয়া হয় না। কাঁচকলা, লতিকচু, মেটে আলু, সজনে, ডুমুর, থানকুনি, কলার মোচা, কলার থোড়, কচুশাক, হেলেঞ্চা শাক, সজনে পাতা, শাপলা ইত্যাদি।
 
 
মৃত্যুঞ্জয় রায়
* আঞ্চলিক আইএফএমসি কো-অর্ডিনেটর, আইএফএমসি প্রকল্প, বরিশাল অঞ্চল
বিস্তারিত
কেন ফুলের চাষ করেন খন্দকার পারভীন সুলতানা
ফুলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই ফুলের চাষ করে যাচ্ছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কান্দিরা গ্রামের গৃহবধূ খন্দকার পারভীন সুলতানা। ফুলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা না থাকলে কেউ ফুল চাষ করতে এগিয়ে আসেনা এটাই সত্য। গৃহবধূ খন্দকার পারভীন সুলতানা শুধু গৃহবধূই নন তিনি একজন শিক্ষিকা ও একজন পরিশ্রমী আদর্শ নারী। ফুলের প্রতি ভালোবাসায় বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে স্বামীর স্মৃতি। তার স্বামী শুরু করেছিলেন গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের চাষ। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন পারভীন সুলতানা। পারভীন সুলতানার স্বামী খন্দকার মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুই পারভীন সুলতানার দায়িত্ব এসে যায় সংসারের ও মরহুম মাহবুবুর রহমানের ফুলচাষ কার্যক্রম। মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুকালে ২ ছেলে এক মেয়ের দায়িত্ব রেখে যায় পারভীন সুলতানের ওপর। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারাযান মাহবুবুর রহমান খান। শিশু কন্যাও পুত্রের দায়িত্ব, গোলাপ বাগানের দায়িত্ব, গোলাপ সমিতির র্কাযক্রম পরিচালনা এসব নিয়ে গৃহবধূ পারভীর সুলতানা হয়ে পরেন দিশেহারা। কান্দিলা গ্রামের খন্দকার বাড়ীর গৃহবধূ পারভীন সুলতানা স্কুলের শিক্ষিকাও বটে। স্বামী হারা পারভীন সুলতানা তিন সন্তানের জননী। নিজেকে দাঁড়াতে হবে, সংসার পরীক্ষায় পাস করে সমাজের অন্যদের মতো বেঁচে থাকতে হবে। মনের একনিষ্ঠ দৃঢ়তাকে পুঁজিকরে সংসারের হাল ধরেন পারভীন সুলতানা। ছেলেমেযের লেখাপড়া ভরণপোষণ ও সংসার পরিচালনায় উপার্জনশীল ব্যক্তি একাই পারভীন সুলতানা। কোনো দায়িত্বই ছোট করে দেখার  অবকাশ নাই তার। তাই স্বামীর চলমান ফুল বাগান পরিচর্যা ও যত্নের মাধ্যমে ফুলে ফুলে খুঁজে পান স্বামীর সাহচর্য। প্রতিদিন নানা ফুল ফোটে মাহবুবুর রহমানের ফুলের বাগানে। সকাল-সন্ধা-ফুল বাগানে ঘুরে ঘুরে স্বামীর স্মৃতি, সুখ আনন্দ, বেদনাকে পুঁজি করে মনের দিক থেকে সুদৃঢ়ভাবে ফুল ও বাগানকে বেছে নেন স্বামীর অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেও অবসর সময় সংসার ও সন্তানদের দেখাশোনা আর ফুলবাগান ও ফুলচাষ নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার নতুন কর্মজীবন। স্বামী মাহবুবুর রহমানকে ফুলচাষ,গোলাপ বাগানও গোলাপ প্রদর্শনী, পুষ্প মেলা উদযাপনে সব সময় সহযোগিতা করতেন  পারভীন সুলতানা। উৎসাহ দিতেন স্বামীকে ফুলচর্চায়। পারভীন সুলতানা ও স্বামী মাহবুবুর রহমান কয়েকবারই টাঙ্গাইলসহ ঢাকা পর্যন্ত পুষ্প মেলায় অংশগ্রহণ করতেন একত্রে একে অপরের সহযোগী হিসেবে। স্বামী মাহবুবুর রহমান ছিলেন একজন পুষ্পপ্রেমিক উদ্যোগী মানুষ। দীর্ঘদিন গোলাপফুল নিয়ে নিজ নার্সারিতে গোলাপচাষ করতেন। অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রচুর। মাহবুবুর রহমান এক সময় পরিচিত ছিলেন ফুল মাহবুব হিসেবে। তার নিজ বাগান কান্দিলাতে ছিল প্রায় শতাধিক জাতের গোলাপফুল। তিনি নিজে বাগানে কাজ করতেন কলম করতেন, চারা উৎপাদন করতেন এবং ফুলচাষ সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে প্রচেষ্টা চালাতেন। টাঙ্গাইল জেলায় কয়েকবার করেছেন গোলাপ প্রদর্শনী ও পুষ্প প্রদর্শনী। মাহবুবুর রহমান জীবিতকালে টাঙ্গাইলে গড়েছিলেন গোলাপ সমিতি। ফুলচাষ ও নার্সারিকে কেন্দ্র করেই তার সাথে গড়ে উঠে আমার সখ্যতা। আমি ১৯৮৭ হতে ১৯৯২ পর্যন্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলে উদ্যান বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। মাহবুবুরের নার্সারিকে কেন্দ্রকরেই তার বাড়ি যাওয়া, পরিবারের সাথে পরিচিতি, আমাদের বাসায় যাতায়াত  এ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে থেকেছে মাহবুবুর রহমান। আমিও মহিবুবের বাসায় থেকেছি অনেক সময়। সেই সূত্রেই পারভীন সুলতানা ভাবীর সাথে আমার পরিচিয়। সুদীর্ঘদিন বিভিন্ন স্থানে চাকুরির সুবাদে ভাবীর সাথে আর সাক্ষাৎ হয়নি আমার। মাঝে মধ্যে কথা হয় ফোনে। কৃষি বিপ্লব ১-১৫ বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যায় পারভীন সুলতানার ছবিসহ কে এস রহমান শফি টাঙ্গাইল কর্তৃক লিখিত জারবেরা ফুলের চাষ করেন খন্দকার পারভীন। এই প্রতিবেদনটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। পারভীন ভাবীর ছবিটি দেখে ও প্রতিবেদনটি পড়ে আমি মুগ্ধ হই। তাই আমি টাঙ্গাইলে গিয়ে ভাবী পারভীন সুলতানার সাথে সাক্ষাত করি এবং বর্তমান ফুল চাষ পর্যবেক্ষণ করি। কেন ফুল নিয়ে পারভীন সুলতানা আজও নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। কারণ-
 
ফুল পবিত্র। ফুল শুভ্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। তাই ফুলের প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরন্তন। জর্জ বার্নাডশ বলেছেন, ‘ঈশ্বর খোঁজার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে বাগানের মধ্যে তাকে খোঁজা। তুমি সেখানে তার জন্য মাটি খুঁড়ে তাকে খুঁজতে পারো’। ফুল যুগে যুগে পৃথিবীতে মানুষের নিত্য সঙ্গী। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে সৌরভ ছড়ায়। আবার ঝরে পড়ে। সুরভি ছড়ানোই যেন ফুলের সার্থকতা। সুরভি ছড়াতে ছড়াতে ঝড়ে পড়া এ যেন ফুলের মহান আদর্শ। আর ফুলের সুঘ্রাণের প্রতি মানুষের রয়েছে এক তীব্র আকর্ষণ। পুষ্পপ্রীতি আমাদের সংস্কৃতিরই অঙ্গ। ফুলের জলশায় মনের উন্নতি ও সংষ্কৃতি রোধের বিস্তার ঘটালে সমাজ থেকে অবক্ষয় ও হতাশা দূর হবে। ফুল হচ্ছে পৃথিবীর হাসি। এ হাসির উৎকর্ষ নিবারণের জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত। পৃথিবীর বহুদেশে গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের গবেষণা ও প্রসার হয়েছে। বিচিত্র রঙের মনোলোতা ফুল ও হৃদয়গ্রাহী সুঘ্রাণ পুষ্পপ্রেমিকদের মনের চাহিদা মেটায় যুগে যুগে। ফুল আজ শিল্পে পরিণত হচ্ছে। অর্থকরী ফসল হিসেবেও ফুলের চাষ ও ফুল নিয়ে ভাবনার দিন এসেছে।
 
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন, ‘যেখানে ফুল বিলপ্তি হতে থাকে, সেখানে মানুষ বাস করতে পারে না।” আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় ফুল চাষের উপযোগী। কিন্তু পরিশ্রম করে বাগান করার অভ্যাস আজও সীমিতপর্যায়ে রয়েছে। রয়েছে মানুষের মনের সঙ্কির্ণতা। আজও অনেকের হৃদয়ে ফুল স্ফুটিত হয় নি। ফুল ফুটেনি মনের বাগানে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাগজের মালা ব্যবহার ও ড্রইং রুমে ফুলদানীতে কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানোর ঘটনা প্রায়ই চোখে পড়ে অনেকের বাড়িতে। বিদেশ থেকে কৃত্রিম ফুল এসেছে ও আসছে, যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কৃত্রিম ফুল সুভাস ছড়াতে পারে না, এ ফুল মন ভরাতে পারে না। এ যেন নিজের মনের সাথেই প্রতারণা করা হচ্ছে।
 
গোলাপসহ বিভিন্ন ফুল অতীতের বহু সভ্যতার সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে। ফুলকে জীবনের নামান্তরে নানা রূপে রহস্যের প্রতীকরূপে কবি ও সাহিত্যিকগণ ব্যবহার করে এসেছেন। বিভিন্ন দেশের লোকজ সংস্কৃতিতেও শুভ, অশুভ ফুলের নিদর্শন পাওয়া যায়। পদ্ম, গোলাপ, ডালিয়া, ভায়োলেটস, পপি প্রভৃতি ফুলকে কেন্দ্র করে নানা কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়েছে। ওয়াটার লিলি বা শালুক ও পদ্ম প্রাচীন রোম শহরের রাজশক্তির প্রতীক রুপে রূপায়িত। ভারতে জবা, আকন্দ ও অপরাজিতা যথাক্রমে কালী, শিব ও দূর্গার প্রতীক। হিন্দু, বৌদ্ধদের কাছে পদ্মফুল পরম পবিত্র।
 
গাঁদা বা মেরিগোল্ড ক্যাকটাস ফুল প্রেম ও আনুগত্যের প্রতীক। অপর দিকে ভারতীয়দের কাছে কমলা ও মেহেদী ফুল মিলন এবং বিবাহ পরবর্তী সুখী ও দাম্পত্য জীবনের প্রতীক। জাপানিদের কাছে চন্দ্রমল্লিকা সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রাচ্যে অতসী ফুল পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। গ্রিকদের কাছে মোরগ ফুল অমরতার স্মারক। চীন ও গ্রিসদেশে হায়াসিন্থ বিষণ্নতার এবং সাইপ্রেসফুল মৃত্যু ও শোকের প্রতীক। বাসন্তিফুল দেশে বিদেশে নবীন যৌবনের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ক্যামেলিয়া অসুস্থতার প্রতীক রূপে নিন্দিত। ড্যাফোডিলস ব্যর্থ প্রেমিকদের প্রতীক বলে মানুষের বিশ্বাস। ডেইজীফুল গ্র্রাম্য সরলতার প্রতীক টিউলিপফুল হল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক। এই ফুল সাহসের প্রতীক। সূর্যমুখী ভক্তি ও নিষ্ঠার প্রতীক। রজনীগন্ধা বাংলাদেশে অভ্যর্থনার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত।
 
ফরগেটমিনট ফুলটি একটি প্রেমের প্রতীক। প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগ থেকে সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে ফুল একটি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। খ্রিষ্টের জন্মের আড়াইহাজার বছর আগে সিন্দু সভ্যতার পরিচয়বাহী মৃৎপাত্রে ফুটন্ত ফুলের নক্সা রয়েছে। সম্ম্রাট নিরোর আমলে রাজপ্রাসাদের চারপাশে নিবিড়ভাবে গোলাপের চাষ হতো। মিসরের মক্ষীরাণী ক্লিউপেট্টা গোলাপের খুবই ভক্ত ছিলেন। মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গোলাপ পাপড়ী থেকে আতর তৈরির সূত্র সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন। গ্রিক কবি স্যাফো তার কবিতায় গোলাপকে প্রথম “ফুলের রাণী” বলে বর্ণনা করেন। গোলাপ এমন একটি ফুল যা অতীতের সভ্যতার সঙ্গে নিজকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। হিন্দু পুরানে ব্রহ্মা পদ্ম ফুলকে শ্রেষ্ঠ ফুল হিসেবে জানতেন কিন্তু বিষ্ণুর আমন্ত্রণে বৈকণ্ঠে এসে হালকা রঙের সুগন্ধি গোলাপকে সৃষ্টির সেরা ফুল হিসেবে স্বীকার করেছেন।
 
তাহলে দেখা যায় প্রাগ-ঐতিহাসিককাল থেকেই ফুলের সামাজিক আধ্যাতিক এমনকি অর্থনৈতিক পরিব্যপ্তির কারণে ফুল সবার কাছে সমাদৃত।
 
আজও আমরা আমাদের আঙ্গিনায় ও বাগানে ফুলের চাষ করে মনকে তৃপ্ত করে তুলতে পারি। ফুলের সুবাসে ভরিয়ে দিতে পারি আমাদের পরিবেশকে। এ জন্য শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের। টমাস উইলসন বলেছেন, “ফুলের আয় কত স্বল্প কিন্তু সেই স্বল্প আয়ই জীবন পরিধি কত মহিমাময়।”
প্রমথ চৌধুরী তার কবিতায় বলে ছিলেন- ‘মোর পাশে ফুটো তুমি হে- রজনীগন্ধা।
তাই আসুন নানা বর্ণের ফুল ফুটাতে কুসুম বাগে বাগে
 
বনের ফুলকে মনের মাঝে ফুটাই সবার আগে’
বর্তমানে খন্দকার পারভীন সুলতানা জারবেরা ফুল চাষ করে টাঙ্গাইলে আজ সমাদৃত। তিনি আমাকে জানান ফুল চাষ লাভজনক ব্যবসায় হলেও টাঙ্গাইলে ভালো বিক্রয় হয় না। উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন ঢাকা পাঠাতে হয়। ফুল পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও বাগান পরিচর্যাসহ উৎপাদন খরচ দ্রুত বাড়ছে। তবুও এ ফুল চাষে তিনি আনন্দ পান মরহুম স্বামী মাহবুবুর রহমানকে স্মৃতিতে স্মরণ রাখতে। তিনি জারবেরাসহ গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা ও অন্যান্য ফুল চাষ করে আনন্দে সংসার পরিচালনা করছেন। তিনি বড় মেয়েকে সুপাত্রে বিবাহ দিয়েছেন। বড় ছেলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকুরিরত রয়েছে। ছোট ছেলেকে সুশিক্ষিত করাই তার বর্তমান দায়িত্ব। তাই তার বাড়ির পাশেই বিভিন্ন বাগানে নানা ফুলের চাষ সমৃদ্ধ করে নিজেকে পরিচালনা করতে চান মরহুম স্বামী খন্দকার মাহবুবুর রহমান সাহেবকে স্মৃতির অনুভূতিতে জীবিত রাখতে।

 
 
দুলাল চন্দ্র সরকার*
* কৃষি পরামর্শক (সজাগ) ও প্রাক্তন পরিচালক (ডিএই), খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৫৮১৪৩০৯
 
বিস্তারিত
ফুল রফতানি : সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
ফুল সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক। এর পাঁপড়ির বিন্যাস, রঙের বৈচিত্র্য ও গন্ধের মাধুর্যে আমাদের মন এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠে। জন্মদিন পালন, বিবাহ, মৃতের আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, গৃহ সজ্জা, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও শহীদ দিবসসহ সব অনুষ্ঠানেই ফুলের প্রয়োজন হয়। ফুলের সৌরভ এক দিকে যেমন মানুষকে বিমোহিত করে তেমনি এর সৌন্দর্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে করে তোলে আকর্ষণীয়। এ ছাড়া ফুলের স্বর্গীয় সৌন্দর্য প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে শ্রান্ত ও ক্লান্ত মানুষের মনে ক্ষণিকের জন্য হলেও পরম তৃপ্তি ও অনাবিল শান্তি দেয়। তাই তো কবি বলেছেন- ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দু’টি যদি জোটে তবে অর্ধেক/ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী/বাজারে বিকায় ফল-তন্ডুল/সে শুধু  মিটায় দেহের ক্ষুধা/হৃদয় প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল/ দুনিয়ার মাঝে সেইতো সুধা’।
 
আধুনিক যুগে নগরায়ন ও সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে তালমিলিয়ে দেশ-বিদেশে ফুলের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল এখন আর শুধু সৌন্দর্য ও সৌখিনতার সামগ্রীই নয়, বরং ফুল এখন দেশের জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ, বিপণন ও ব্যবহার করছে। থাইল্যান্ড, সিংঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ অর্কিড রফতানি করে এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ফুল রফতানিকারক দেশ নেদারল্যান্ড টিউলিপ ফুল বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভাবে অর্থকরী ফসল হিসেবে ফুল বিশেষ করে রজনীগন্ধা ও গোলাপ উৎপাদন ও বিদেশে রফতানি শুরু হয়েছে।
 
বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছা, শার্শা, চৌগাছা ও যশোর সদর উপজেলা এবং কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রজনীগন্ধার চাষ হচ্ছে। তা ছাড়া সাতক্ষীরা, জয়দেবপুর, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামেও অল্পবিস্তার রজনীগন্ধার চাষ হয়। ইদানীং খুলনা জেলায়ও কিছু কিছু রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। তা ছাড়া ঢাকা জেলার সাভার, গাজীপুর, কালিয়াকৈর এবং যশোরে গোলাপ ফুলের ব্যাপক চাষ হয়। বিশ্বজুড়ে চলছে এখন ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে টাটা ও বিরলার মতো বড় মাপের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করছে। ভারতে ফুল চাষকে উৎসাহিত করার জন্য ভর্তুকি ব্যবস্থা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ভর্তুকির পরিমাণ ৫০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারতের মতো আমাদের দেশেও ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজন।
 
এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে, এমন কি কোনো কোনো উপজেলা সদরেও তাজা ফুলের স্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকানগুলোতে ঋতু বৈচিত্র্যের ফুলের পাশাপাশি বারো মাস রজনীগন্ধা, গোলাপ, ও গাঁদা ফুল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতীয় উৎসবগুলোতে এসব দোকানে ফুল ক্রয়ের জন্য ক্রেতা সাধারণের প্রচুর ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এসব দোকানে ফুলের বিকিকিনি ভালো হয় বলে জানা যায়। এটি নিঃসন্দেহে দেশে ফুলের সমাদরের পরিচয়। বিদেশে বাংলাদেশের ফুলের বিশেষ করে রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। অতি সম্প্রতি লন্ডন, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, হল্যান্ড এবং আবুধাবিতে বাংলাদেশ থেকে ফুল রফতানি করা হচ্ছে। কাজেই এ কথা বলা যায় যে, আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষ করে তা বিদেশে রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
 
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। গোলাপ, রজনীগন্ধা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ও গাঁদা এ দেশের  কয়েকটি জনপ্রিয় ফুল। এ দেশে নানা প্রকার মৌসুমি ফুল জন্মে থাকে। শীতকালীন মৌসুমি ফুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এস্টার, এলিসাম, ক্যালেন্ডুলা, কসমস, কার্নেশান, কর্ন ফ্লাওয়ার, চন্দ্র মল্লিকা, ডেইজী, ডায়ান্থাস, ডালিয়া, লার্কস্পার, গাঁদা, হলিহক, ন্যাস্টারসিয়াম, লুপিন, পপি, পর্টুলেকা, ভারবেনা, ফ্যান্সী, জিনিয়া, এন্টিরিনাম, সুইট পী, ফ্লক্স প্রভৃতি। মোরগজবা, বোতাম ফুল, দোপাটী, ক্লিওম, গাইলারডিয়া, মর্নিং গ্লোরী, পর্টুলেকা, অপরাজিতা, জিনিয়া, সন্ধ্যামনি, , গন্ধরাজ, টগর ইত্যাদি গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন উল্লেখযোগ্য মৌসুমি ফুল। দীর্ঘজীবী ফুলের মধ্যে গোলাপ, সর্বজয়া, স্বর্ণচাপা, করবী, শেফালী, রংগন, মাধবী, টগর, মালতি অপরাজিতা, জবা, বাগান বিলাস, পাতাবাহার, চামেলী বেলী, জুঁই, রজনীগন্ধা, মল্লিকা, গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা, টগর, কামিনী, হাসনাহেনা, শিউলী, মুসান্ডা, বকুল, নয়নতারা প্রভৃতি অন্যতম।
 
আন্তর্জাতিক বাজারে ফুলের চাহিদা ব্যাপক এবং প্রতি বছর ফুলের চাহিদা বাড়ছে। সে তুলনায় সরবরাহ কম। এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে আড়াই হাজার কোটি ডলার মূল্যের ফুল বেচাকেনা হয়। ফুল রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইল ফুল রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় যে পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর আয় করে থাকে, তা বহু উন্নয়নশীল দেশের রফতানি বাণিজ্যের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বছর ফুল রফতানি করে কোটি কোটি রূপী আয় করছে। তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারও বিশাল। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফুলের আকার, রঙ, গন্ধ স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য আপেক্ষাকৃত উন্নত। তাই বিদেশে বাংলাদেশের ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একটু চেষ্টা করলেই বিশ্ববাজারে এ দেশের উৎপাদিত ফুল স্থান করে নিতে পারে। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই প্রয়োজন।
 
ফুলের বাণিজ্যিক চাষ ও ফুল রফতানি বাংলাদেশেল রফতানি আয়কে উজ্জীবিত করতে পারে। কাজেই আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ফুল উৎপাদন করে তা বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা আরো জোরদার করা আবশ্যক। এতে এক দিকে যেমন দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে, অপর দিকে বিপুল বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আয়ের পথ সুগম হবে। যা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে এক বিরাট অবদান রাখবে।
 
মো. আবদুর রহমান*
* উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা
বিস্তারিত
শীতে পোলট্রি খামারীদের করণীয়
বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমায় আগমন ঘটে শীতের। মানুষের ওপর শীতের প্রভাব ঘটে, হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রেও তেমনি প্রভাব পরে। তাই শীতের সময় খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে খামারি ভাইদের বিশেষ নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। শীতের তীব্রতায় তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে ডিম পাড়া মুরগীর ডিম উৎপাদনের হার যেমন কমে যায়, তেমনিভাবে কতগুলো রোগের কারণে বাচ্চা মুরগিও মারা যেতে পারে। এ ছাড়া শীতের সময় ডিম দেয়া মুরগীর শরীরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য হতে প্রাপ্ত এনার্জি বেশি ব্যয় করে থাকে। শীতের সময় ঠাণ্ডার কারণে বিভিন্ন বয়সের মুরগির পীড়ন বেশি হয়। খামারে হাঁস-মুরগির অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য শীতকালে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে হবে এবং অবস্থাভেদে বিভিন্ন শেডের তাপমাত্রা ৬০০-৭০০  ফারেনহাইট বজায় রাখতে হয়।
 
*শীতের প্রারম্ভেই পোলট্রি শেডের যাবতীয় মেরামত কাজ করতে হবে। যেমন ঘরের জানলায় চটের পর্দা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে মুরগিকে রক্ষা করা যায়।
 
*হাঁস-মুরগি পালনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোলট্রি শেডের/ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য লিটার ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। যদি পুরা ৩ লিটার থাকে তাহলে পরিবর্তন করে দেয়া ভালো। লিটারের উচ্চতা বাড়িয়ে ৭-৮ ইঞ্চি পুর করে দিতে হবে। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকার কারণে পোলট্রি শেডে ধুলোবালি বেশি পরিমাণে জমা হয়। লিটারের আর্দ্রতা শতকরা ২৫% ভাগের চেয়ে নিচে নেমে গেলে লিটার থেকে ধুলা উড়তে থাকে; এতে শেডের পাখির ধকল বেড়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সর্বোপরি শেডে সার্বিক তাপমাত্রা রক্ষা করা।
 
*শীতকালে দিনের সময় কাল কম থাকায় সূর্যের স্বাভাবিক আলো প্রাপ্তির সময় কম হয়। বিশেষ করে ডিম পাড়া মুরগীর ক্ষেত্রে দিনের আলো হিসাব করে রাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
 
*পোলট্রি শেডের আশপাশে ডালপালাযুক্ত গাছ থাকলে শীতকালে তা কেটে/ছেঁটে ফেলাই ভালো।
 
*পোলট্রি ব্যবস্থাপনায় লেয়ার/ব্রয়লার পালনের ক্ষেত্রে খাবার নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক মান অনুযায়ী সুষম খাদ্যের ফর্মুলা তৈরি করে সরবরাহ করতে হবে। অথবা কোনো উন্নত খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে। শীতকালে মুরগির দেহে অধিক শক্তি যোগানোর জন্য উপাদানে পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্যে এনার্জির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে এবং রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। লিটার পুরাতন হলে গুণগত মান ঠিক আছে কিনা সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
 
*খামারের বিভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুরগিকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো কৌশল হলো “অল ইন আউট” বা “একত্র প্রবেশ একত্রে বাহির” পদ্ধতি অনুসরণ করা।
 
*খামারের প্রতিটি মুরগির জন্য পরিমাণমতো জায়গা রাখতে হবে এবং কম জায়গায় যেন বেশি মুরগি না থাকে সেদিকে খামারীদের লক্ষ রাখতে হবে।
 
*মুরগির ঘরে শীতের মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।
 
*মুরগির শেডে/ঘরে সর্বত্র বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা। যথাযথ মাত্রায় আর্দ্রতা রক্ষা করা।
 
*শেডের থেকে এমোনিয়া ও কার্বন ডাই অক্সাইডসহ খারাপ গন্ধ দূর করা।
 
*গরমের দিনের তুলনায় একটু বেশি খাবার সরবরাহ করতে হবে।
 
*খাদ্য দেয়ার পরপরই খুব তীক্ষè দৃষ্টিতে একনজরে সকল মুরগিকে শেডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অবলোকন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অসুস্থ মুরগি থাকলে চিহ্নিত করে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
*“পানির অপর নাম জীবন” খামারে বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনোক্রমেই পুকুর, পাতকুয়ার পানি মুরগিকে খাওয়ানো যাবে না বা খাদ্য ও পানির পাত্র ও অন্যান্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এ সব উৎসের পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। পানির পাত্র কমপক্ষে দিনে দু’বার পরিষ্কার করতে হবে।
 
*খামারের মুরগিকে যথাযথভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে টিকা প্রদান করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রার/খাতায় টিকা দানের তারিখ, শেডের নম্বর, বাচ্চার সংখ্যা, টিকার নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে।
 
*খামারে কোন মুরগির রোগব্যাধি দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ভাবে সেগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে। প্রকৃত রোগ শনাক্ত করে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
 
*মৃত মুরগিকে যেখানে, সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
 
*খামারে দর্শনার্থী ও বাইরের লোকজন যাতায়াত বন্ধ করতে হবে।
 
*খামারের প্রতিদিনের কাজের রেকর্ড রাখতে হবে। খাদ্য প্রদান, তাপমাত্রা, ভ্যাকসিনেশন ও রোগের প্রার্দুভাবের রেকর্ডসহ কখন কোন ঔষধ/টিকা প্রদান করা হলো তার রেকর্ড রাখতে হবে।

*প্রতিদিন মুরগির শেড/ঘরে আলগা ময়লা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলে রোগ জীবাণু সহজে প্রবেশ করতে পারবে না।
 
*প্রতিটি শেড/ঘরের সম্মুখে জীবাণুনাশক পাত্র রাখতে হবে এবং ঘরে প্রবেশের পূর্বে পরিচর্যাকারীকে তা ব্যবহার করতে হবে।
 
*পরিচর্যাকারী মুরগির শেডে প্রবেশের পূর্বে যেন তার পরিধেয় পোশাক পরিবর্তন করে নেয় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
 
*মুরগির শেডে/ঘরে যেন কোনো রকম পাখি, ইঁদুর ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে অবশ্যই খামারিকে খেয়াল রাখতে হবে।
 
*শীতে মুরগির দেহে পরজীবীর আবির্ভাব বেশি ঘটে, সে কারণে পরজীবী প্রতিরোধের আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
*মুরগির ঝাঁক/দলের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ, ডিম উৎপাদনে অক্ষম, কম ডিম উৎপাদনশীল ও বিকৃত মুরগিকে সবসময় বাঁছাই/ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
*হাঁস/মুরগি পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা/জেলা পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারেন।
 
 
বিমল চন্দ্র সরকার*
* সাবেক সহকারী তথ্য অফিসার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, আঞ্চলিক অফিস, বরিশাল
বিস্তারিত
কবিতা মাঘ-১৪২১
ম্যাজিক বুলেট গুটি ইউরিয়া
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
 
ম্যাজিক বুলেট করলোরে মাত কৃষির দুনিয়া
গুঁড়া ইউরিয়ার বিকল্প এলো গুটি ইউরিয়া॥
গুঁড়া লাগে দশ যেখানে গুটি লাগে ছয়
বারে বারে না একবারে মৌসুমে দিতে হয়।
জমির নিচে দিলে তা যে যায় না উড়িয়া॥
পৌনে দুই গ্রাম ওজন হারে আউশ আমনে
দুই দশমিক সাত গ্রামের গুটি বোরোয় তেমনে
গর্তে পুঁতে দিয়ে তারে হাতড়ে দিবে মুদিয়া॥
লাইনে রোপা ধান ক্ষেতের চার গোছারই মাঝে
পরে, একটি লাইন বাদে বা এক হাত মুঠ ভাজে
ধানের জমির গুটি দিও ভাইরে মর্ম বুঝিয়া॥
কেহ যদি প্রশ্ন করে রোপার কয়দিন পরে
সপ্তাহ’র মাঝে পুঁতবে গুটি জবাব তারই তরে
জমির কাদা থাকতে নরম না যায় শুকাইয়া॥
রাখতে হবে জমি ভিজা; নয় বেশি বা কমে
গুটি দিয়ে নামলে মাঠে পিছু নিবে যে যমে
প্রয়োজনে নামলে নেমো; গুটি ছাড়া লাইন দিয়া॥
কেউ ব্যবহার করেন গুটি ধানের জমি ছাড়াও
ভালোই বাড়ে সবজি, ভুট্টা, আখ ও কচুর চারাও
ফলের গাছের চারিপাশে গুটি দেয় কেহ খুঁড়িয়া।
জমির ভিতর গুটি দেয়ায় আগাছা রয় উপাস
রোগ ও পোকার একই দশা তারাও হয় যে হতাশ
আগাছা বালাই না থাকাতে বাড়ে ফসল হাসিয়া॥
ধানের ভিতর, খরের ভিতর, আমিষ বাড়ে যেমনি
যায় না উড়ে, জলে না মিশে অপচয় কমে তেমনি
তাই, গুঁড়া থুইয়া গুটি কিনিও হাট-বাজারে যাইয়া॥
গুটি পুঁতে টাটানো ব্যথায় কোমরে আর নখে
ভাটাপরে কিষান-কিষাণীর গুটি পোঁতার ঝোঁকে
দূর হয়েছে এসব এখন গুটি পোঁতাযন্ত্র আসিয়া॥
মাঠের ফসল, ফলের গাছ পার হয়ে তা এবারে
মাছের চাষেও গুটি ইউরিয়া দিতেছে চাষি দেদারে
লাগছে কম, ব্যয়েও কম, আয় যা যে বাড়িয়া॥
গ্রিন হাউজ গ্যাস কমিয়ে পরিবেশ ভালো রাখে
কম লাগাতে প্রাকৃতিক গ্যাস বেশি জমা থাকে
পরিবেশবান্ধব এ প্রযুক্তি তাই যায় আগাইয়া॥
এখন দেশে নাইরে অভাব ভরা গোলা ধানে
অল্প হলেও মানতে হবে গুটির অবদানে
গুটির খবর ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশকে ছাড়িয়া॥
 
সঠিক নিয়মে কৃষি
মো. জুন্নুন আলী প্রামানিক**
 
আগ্রহী মন যথেষ্ট পুঁজি চাষের নিয়ম মেনে,
মাধ্যম মাটি উন্নত বীজ অধিক ফলন দানে।
সঠিক শ্রম উত্তম সার সেচের জোয়ারে কৃষি,
সজাগ দৃষ্টি সেবার হাত নয়ন জুড়ায় বেশি।
ফসল বিজে ঘুমন্ত কলি সেবায় বেড়িয়ে আসে,
বয়স কম যত্নের ফলে শিশুর মতন হাসে।
কৌশল জেনে সময় মতো ফসল চাষের খেলা,
বিভিন্ন দিকে কাজের চাপে যান্ত্রিক সুবিধা মেলা।
দুইটি পাতা চারটি পাতা শোভায় মাঠটি ভরে,
শৈশব কাল কৈশর কাল যৌবন বার্ধক্য ঘিরে।
মাটির সাথে বাড়ন্ত গতি নিখুঁত নিয়মে চলে,
যেমন মাটি তেমন বৃদ্ধি আলোয় বাতাসে দুলে।
বিপদ আছে আগাছা আছে সুযোগে লাগায় ভাব,
নিয়ম মতো সঠিক ভাবে নির্মূল করলে লাভ।
পোকার জন্য ঔষধ আছে বিপদ আপদ কাটে,
ভেষজ মতে শান্তির পথ পাখিরা খেলেও মেটে।
শৈশব কালে খাদ্যের মাত্রা বয়সমাফিক পেলে,
গ্রহণ শক্তি বর্জন শক্তি মিলবে বাড়ার তালে।
কৈশরে ক্ষুধা অনেক বেশি দুরন্ত গতির শ্রোতে,
আদর করে আহার দিলে সহায় সম্বল তাতে।
যৌবনে ফলে দেহের বলে ফলন দুয়ার খোলা,
প্রয়োগ নীতি মানলে ভালো নইলে ক্ষতির পালা।
সবুজসার জৈবিকসার লাগলে কৃত্রিমসার,
গাছের বৃদ্ধি সাধনে সঙ্গি আধিক্যে পোকার ঘর।
যৌবনকাল পেরিয়ে গেলে ফসল পাকার মেলা,
সুযোগ বুঝে ইদুঁরগুলো বানায় জমিতে গোলা।
ইঁদুর মারা জরুরি তাই ঔষধ প্রয়োগ করে,
অথবা তারা পালায় দূরে বিড়াল ঘুরলে ধারে।
যখন যাহা লাগলে তাহা ফসল সেবার সাথে,
দূষণমুক্ত ফসল জোটে নিয়ম মানার পথে।
 
* পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, গাজীপুর  ** গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাক ও উপ: ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম
 
বিস্তারিত
প্রথিতযশা কৃষি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম আর নেই
পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম আর নেই। ২১ ডিসেম্বর ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের  হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। তার ছোট ভাই জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের পরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, মাকসুদুল আলম লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। শেষ দিকে লিভারের সঙ্গে তার ফুসফুসও ঠিকমতো কাজ করছিল না। ম্যানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের অধীনে কলেজ অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে জিনোমিকস, প্রোটিওমিকস ও বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন তিনি। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হাওয়াই মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রিতে মাকসুদুল আলমের লাশ দাফন করা হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
 
মাকসুদুল আলমের মৃত্যুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গত ৫ জানুয়ারি, ২০১৫ কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিএআরসি অডিটোরিয়ামে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ মাহফিলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, কৃষি সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলামসহ মরহুমের আত্মীয়স্বজন এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন।
 
নিবিষ্ট বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল : বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করে আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছরের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি গুরুত্ব পায়।
 
প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
 
গত বছরের ১৮ আগস্ট মাকসুদুলকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় সাফল্যের খবর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আসে দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর।
 
জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। গবেষণাগারে এই জিনবিন্যাস অদলবদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব।
 
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী এর নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম পানি লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব-জাল্বানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
 
এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের এই গবেষক। পেঁপে নিয়ে তার কাজের বিষয়ে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে।
 
বর্ণাঢ্য জীবন : ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্ম নেয়া মাকসুদুল আলমের বাবা দলিলউদ্দন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। স্বামীকে হারিয়ে চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয় মাকসুদুলের মা লিরিয়ান আহমেদকে। তবে তার চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মাকসুদুল রাশিয়ায় চলে যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন। 
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর কৃষিকথা-১৪২১
দিপংকর রায়
ঠাকুরগাঁও সদর, ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : বীজতলার ধানের চারা  গাছ হলুদ হয়ে যায়। কুশির বাড়-বাড়তি কমে যাচ্ছে। কী করণীয়।
উত্তর : বোরো মৌসুমে চারা অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ হলে কুশির  বাড়-বাড়তি কমে যায় ও গাছ হলুদ হয়ে যায়।
 
তীব্র শীতে করণীয় : ১। ঠাণ্ডা থেকে ধানের বীজতলা রক্ষা করার জন্য সকাল ১০ টা থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত স্বচ্ছ পলিথিন ছাউনি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে যাতে বীজতলার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
 
২। তীব্র শীতের সময় গভীর নলকূপের পানি গরম থাকায় বীজতলায় চারার গোড়ায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখলে চারা মারা যাবার সম্ভাবনা কম থাকে।
৩। বীজতলায় শীতের সকালে দুইপাশে দড়ি ধরে বীজতলায় চারার ওপর দিয়ে হালকা ধরে টেনে পাতার শিশির সরিয়ে দিলে সূর্যের আলো পাতায় সরাসরি পড়ায় চারা কিছুটা সতেজ থাকে।
৪। রোপণের জন্য কমপক্ষে  ৩৫-৪৫ দিনের চারা ব্যবহার করতে  হবে।
 
ইযেবুল হক
খানসামা, দিনাজপুর
প্রশ্ন : রসুনের পাতার ডগা শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিকার কী?
উত্তর : পাতা ঝলসানো রোগের ফলে পাতার উপর ছোট ছোট সাদাটে গোল দাগ দেখা যায়। এসব রোগ দমনের জন্য বর্দোমিশ্রণ (তুঁতে: চুন : পানি=১:১:১) বা ডাইথেন এম-৪৫ অথবা রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি  লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর স্প্রে করতে হবে। অনেক সময় পটাসিয়ামের অভাবে রসুনের ডগার পাতা শুকিয়ে  যায়।
 
শ্যামল চন্দ্র রায়
দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়
প্রশ্ন :আলু গাছের পাতা, ডগা ও কাণ্ড বাদামি বর্ণ ধারণ করছে, গাছ হলদে হয়ে মরে যাচ্ছে। প্রতিকার জানাবেন।
উত্তর : এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে আলু গাছে এ রোগ হয়ে থাকে।
সুষম সার প্রয়োগ  করতে  হবে এবং সময়মত সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে ৭-১০ দিন  পর পর স্প্রে করতে হবে। আক্রমণের পূর্বে ডাইথেন এম-৪৫ ০.২% হারে স্প্রে করলে এ রোগের আক্রমণ  থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আগাম জাতের আলু চাষ করতে হবে।
 
নাজমুল হোসেন
যশোর
প্রশ্ন : সরিষার পাতা হলুদ হয়ে ঝলসে যায়। ভালো হওয়ার উপায় কী?
উত্তর : প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নিচে বয়স্ক পাতায় এ রোগের রক্ষণ দেখা যায়।

প্রতিকার : ১। রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
২। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের সরিষার চাষ করতে হবে। বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮ ইত্যাদি জাত কিছুটা পাতা ঝলসানো রোগ সহনশীল।
 
৩। বীজ বপনের পূর্বে (প্রোভেক্স-২০০ অথবা ক্যাপ্টান (২-৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক/ কেজি বীজ) দিয়ে বীজ  শোধন করে বপন করতে হবে।
 
এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি ০.২% হারে (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম) পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
 
সবুজ মাহমুদ
যশোর
প্রশ্ন : আম গাছের শোষক পোকা দমনের উপায় কী ?
উত্তর : শোষক পোকা অন্য সব পোকার চেয়ে আমের বেশি ক্ষতি করে থাকে। সারা বছর আম গাছে এই পোকাগুলো দেখা যায়।
 
১। আম বাগান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

২। গাছের ডালপালা যদি খুব ঘন থাকে তবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ছাঁটাই করতে হবে যাতে গাছের মধ্যে প্রচুর আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।

৩। আমের মুকুল যখন ৮/১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয় তখন একবার এবং আম মটরদানার মতো হলে আর একবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
 
৪। আমের হপার পোকার কারণে শুটিমোল্ড রোগের আক্রমণ অনেক সময় ঘটে তাই শুটিমোল্ড দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে সালফার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার্য কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
 
মোস্তাক রহমান
গ্রাম: সানি ডুবুরি, ইউনিয়ন: সাতনেড়া, জেলা+ উপজেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : কী ধরনের খাবার খাওয়ালে মাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।
উত্তর : মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মাছকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্পূরক খাবার দেয়ার পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যেন পুকুরে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক খাবার বিদ্যমান থাকে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ৫-৬ কেজি গোবর, ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-৭৫ গ্রাম  টিএসপি সার ব্যবহার করতে হবে। ১০-১৫ দিন অন্তর পানিতে প্রাকৃতিক খাবারের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে।
 
এ ছাড়াও সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কুড়া, সরিষার খৈল, ভুট্টার গুঁড়া, শুঁটকি মাছের গুঁড়া ইত্যাদি মিশ্রণের ব্যবহার করা যেতে পারে। মাছকে প্রতিদিন দুই বেলা (সকাল ও বিকেল) মাছের দেহের ওজনের ৩৫% হারে এই খাবার দিতে হবে। নিয়মিত মাছের বৃদ্ধি পরীক্ষা করতে হবে।

সৈয়দ মশিউর রহমান
গ্রাম : বারড়া, ইউনিয়ন: নূরুল্লাহগঞ্জ, উপজেলা: ভাঙ্গা, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন : শীতকালে মাছের খাবার দেয়া বন্ধ করে দেয়া কি ঠিক?
উত্তর : শীতকালে মাছ স্বাভাবিক ভাবেই খাবার গ্রহণ করা কিছুটা কমিয়ে দেয়। এতে তার দেহের বৃদ্ধি কিছুটা কম হয়। তাই বলে খাবার খাওয়া কিন্তু বন্ধ করে দেয় না। তাই খাবার বন্ধ করে দেয়া কখনোই উচিত নয়। তবে এ সময় নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে মাছের খাবার সরবরাহের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে। নয়ত অতিরিক্ত খাবার পুকুরের পানিকে দূষিত করবে। শীতের সময় যেহেতু মাছের রোগবালাই একটু বেশি হয় তাই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন  করতে হবে এবং পুকুরের পানি ও পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
 
মোহাম্মদ হাফিজ
জামালপুর
প্রশ্ন : গরুর আঁচিল হয়েছে। কী করণীয় ?
উত্তর : অটোজেনাস ভ্যাকসিন এ রোগের চিকিৎসায় বেশ কার্যকর।
ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি: ত্বকের আঁচিল ও তার চারপাশ পরিষ্কার করে ৫ গ্রাম আঁচিল কোষ কেটে নিয়ে সাথে ১০ মিলিলিটার সাধারণ স্যালাইন মিশিয়ে মর্টারে ভালোভাবে পিষিয়ে নিতে হবে এবং ফিল্টার পেপারে ছেঁকে নিয়ে ১ ফোঁটা ফরমালিন দিতে হবে। পরবর্তীতে এন্টিবায়োটিক (যেমন-০.৫ গ্রাম স্ট্রেপটোপেন) নিয়ে সাথে ১০ মিলিলিটার পরিশ্রুত পানি মিশিয়ে ৭ দিন পর পর চামড়ার নিচে ৩ বার ইনজেকশন দিতে হবে।
 
পাশাপাশি অটোহিমোথেরাপি করলে এ রোগ দ্রুত ভালো হয়।

পদ্ধতি : আক্রান্ত পশুর নিজের রক্ত ১৫ মিলিলিটার ৪৮ ঘণ্টা পর পর ৪-৬ বার শিরায় ইঞ্জেকশন করতে হবে।
 
মজিদুল হাসান
ফরিদপুর
প্রশ্ন : গরুর গলা ফুলে গেছে। কী করণীয়?
উত্তর : সালফোনামাইডস প্রথম দিন ডবল ডোজ শিরায় এবং পরের দিন থেকে অর্ধেক ডোজ করে ৩-৪ দিন মাংসপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে। যে কোনো একটি অ্যান্টিহিস্টামিনিক ওষুধ মাংসপেশীতে দিতে  হবে। নরমাল স্যালাইন দেয়া যেতে পারে।
 
জামাল হোসেন
দিনাজপুর
প্রশ্ন : গরুর এলার্জি হয়েছে। কী করণীয় ?
উত্তর : ভাই জামাল হোসেন আপনার গরুর এলার্জি হয়েছে এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্থানীয় পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আর এলার্জি হয়েছে বলে যদি নিশ্চিত হন তা হলে অ্যান্টিহিস্টামিনিক ওষুধ মাংসপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে।
 
আক্রান্ত পশু দুর্বল থাকলে ভিটামিন মিনারেল ইনজেকশন দিতে হবে অথবা প্রিমিক্স খাদ্যের সাথে দিতে হবে।
 
 
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৫৫২৪৩৫৬৯১
 
বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি-১৪২১

গাছে গাছে নতুন পল্লবে সজ্জিত হয়ে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে আমাদের মাঝে। শীতের পাতা ঝড়ানোর দিনগুলো পেছনে ফেলে ফাল্গুন মাস প্রকৃতির জীবনে নিয়ে আসে নানা রঙের ছোঁয়া। ঘনকুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকৃতিকে নতুনভাবে সাজাতে, বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ফাল্গুন আসে নতুনভাবে নতুন রূপে। নতুন প্রাণের উদ্যমতা আর অনুপ্রেরণা প্রকৃতির সাথে আমাদের কৃষিকেও দোলা দিয়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন ফাল্গুনের শুরুতেই আসুন সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বৃহত্তর কৃষি ভুবনে করণীয় দিকগুলো ।

 

বোরো ধান

এখন ধানের বাড়ন্ত অবস্থা। ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তবে সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। অবশ্য আপনার ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। মনে রাখতে হবে ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩-৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এতে বালাইনাশক লাগবে কম, লাভ হবে বেশি এবং পরিবেশ থাকবে স্বাস্থ্যসম্মত। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোনো কৃমিনাশক যেমন ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং হেক্টরপ্রতি ৪০০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। আর টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।

গম

এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শিষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। মাঠে অবস্থিত গম ফসল বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কাটার আগে মাঠে যে জাত আছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাত মিশ্রণ হতে পারে। বীজ ফসলের জন্য বিজাত বাছাই খুবই  জরুরি। সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই-ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

ভুট্টা (রবি)

জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে আবার অনেকে টিনের চালে বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করে থাকেন। তবে যেভাবেই শুকানো হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। ভুট্টার দানা মোচা থেকে ছাড়ানো অনেক কষ্টের কাজ। অনেকে এ কাজটি হাত দিয়ে করে থাকেন। খুব অল্প খরচে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র কিনে অনায়াসে মোচা থেকে ভুট্টা ছাড়াতে পারেন।

ভুট্টা (খরিফ)

খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।

পাট

ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪। স্থানীয় বীজ ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময় ৪০০ গ্রাম জিপসার ও ২০ গ্রাম দস্তা সার দিতে হবে। চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।   

শাকসবজি

এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।

গাছপালা

এ মাসে আম গাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল  আসার পরপরই এ মুকুল বিভিন্ন প্রকার রোগ এবং পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আমের এ্যানথ্রাকনোজ রোগ। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটরদানার মতো হলে গাছে ২য়বার স্প্রে করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর এক মাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। এ রোগের হাত থেকে মুচি বাঁচাতে হলে কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার বোদ্র্রোমিশ্রণ বা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে। যেকোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। এ সময় বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করা যায়। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে। এ কাজে নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য নিয়ে গাছের জাত উন্নয়ন ও ফলনে অন্যরকম আলোড়ন তৈরি করতে পারেন। কলা, পেঁপে বাগানে পরিচর্যা বা যত্নের প্রয়োজন হলে দেরি না করে এখনই সম্পন্ন করে ফেলুন।

প্রাণিসম্পদ

শীতকাল শেষ হয়ে এখন গরম পড়ছে। এ সময়টা পোল্ট্রি খামারি ভাইদের বেশ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে  মোরগ-মুরগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব ও দেখা দিতে পারে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার কারণে বিরূপ আবহাওয়ায় মোরগ-মুরগীর খাবার গ্রহণেও অনীহা দেখা দেয়। এসব সমস্যা সমাধানে টিকা প্রদান, ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে। সবচে ভালো হয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের ভেটেরিনারি সার্জন এবং উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেয়া।

গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমন-সবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এসব। আর যেকোনো সমস্যা সমাধান করেত উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

মৎস্যসম্পদ

মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে। শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছ যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে প্রতি শতাংশ হিসেবে ১ কেজি করে পাথুরে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপরও যদি না কমে তাহলে ২ সপ্তাহ পর পর আরো ২-১ বার দিতে হবে।

সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষিকথায় কৃষির সব ক‘টি শাখার জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়ে থাকে। প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক সীমাবদ্ধতার জন্য প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব হয়না। শুধু আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় কী কী কাজ করতে হবে। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন

* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
সম্পাদকীয় মাঘ-১৪২১
মাঘ মাস। ইংরেজি মাস হিসেবে জানুয়ারি ও বছরের শুরু। প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে প্রচণ্ড শীতের মাস। তবে এ বছর পৌষ মাসেও দেশের উত্তরাঞ্চলসহ অনেক অঞ্চলে প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। শীতে বাণিজ্যিক খামার কিংবা গৃহস্থের হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু এমনকি মাঠের ফসলের বাড়-বাড়তিতে বিঘ্ন ঘটে। এ ছাড়া বোরো বীজতলার চারা শীতে মারা যায়। শীতের কারণে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের দারুণ অসুবিধা হয়। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। ঋতুবৈচিত্র্যের প্রতিকূল প্রভাব এবং জলবায়ু ও আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ায় বিভিন্ন ফসলের সময়োপযোগী জাত ও তার উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন যেমন প্রয়োজন তেমনি মাঠপর্যায়ে সেসব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। কৃষি তথ্য সার্ভিসসহ দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত কৃষিবিষয়ক তথ্য ও প্রযুক্তি অনুসরণ করে কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখা আমাদের সবার একান্ত কর্তব্য।
 
সুপ্রিয় চাষি ভাইয়েরা, এ সময় বোরোসহ বিভিন্ন শীতকালীন ফসলের রোপণ, বপন ও পরিচর্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের যত্ন-পরিচর্যাও সমানতালে করতে হয়। কারণ, যে কোন কাজে সাফল্য লাভ করতে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তবে এ পরিচর্যা হতে হবে সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে। ইদানীং কৃষিতে হাইব্রিড জাতের প্রচলন হয়েছে। এ সব জাত ব্যবহার করে সঠিকভাবে যতœ-পরিচর্যা করতে পারলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। বোরো মৌসুমের উপযোগী ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের জাতগুলো ব্যবহার করলে ধানের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ধানের পাশাপাশি  হাইব্রিড ভুট্টার চাষ করেও অধিক ফলন পাওয়া যায়। এতে পোল্ট্রি ফিডের চাহিদা পূরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সহজতর হবে। দানাজাতীয় ফসলের সঙ্গে তালমিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের চাষাবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, খাদ্যপুষ্টির ক্ষেত্রে শাকসবজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ সময় আলুর আগাম ধসা কিংবা নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগে আক্রমণের ফলে আলুর ফলন ও গুণগতমান অনেক কমে যায়। তাই এ রোগ থেকে আলু ফসল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সজাগ থাকতে হবে।
 
শীতের জড়তা কাটিয়ে গ্রীষ্মের আবাহন সবার জীবনে বয়ে আনুক সুখ, সমৃদ্ধি, শান্তি ও প্রগতি এ কামনায় সবাইকে শুভেচ্ছা।
 
বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon