সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, হেমন্তের দ্বিতীয় মাসে সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। আবহমান বাংলার ঋতুচক্রের এ মাসে ধুম পড়ে যায় আমন ধান কাটার এবং কর্তন পরবর্তী কাজকর্মের। নতুন ধানের হরম ভাতের সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। নবান্নের উৎসবের সাথে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। কেননা এ মৌসুমটাই কৃষির জন্য তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত একটি মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় আমাদের করণীয় কাজগুলো।
ফসল / অবস্থা/বিবরণ / করণীয়
আমন ধান
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
বোরো ধান
বীজতলা তৈরি
আগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। প্রতি দুই বেডের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে।
জাত ও বীজ বপন
যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রিধান৫৫, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নেই এমন এলাকায় ব্রিধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রিধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রিধান৬০, ব্রি হাইব্রিড ধান১, ঠা-া প্রকোপ এলাকায় ব্রিধান৩৬, হাওড় এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রিধান৪৭, ব্রিধান৫৫, ব্রিধান৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এসময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
বীজ বপন
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ, বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।
সার প্রয়োগ ও সেচ
গমের ভাল ফলন পেতে হলে প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈব সার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০-৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০-৪০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ , ৪৫-৬০ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা
বীজ বপন
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১ এসব। এক হেক্টর জমিতে বীজ বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভুট্টা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে খই ভুট্টা বা হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজের মাত্রা এর অর্ধেক হবে। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি. রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ
মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ইউরিয়া ২৭৫-৩২৫ কেজি, টিএসপি ১৭৫-২২৫ কেজি, এমওপি ১০০-১৫০ কেজি, জিপসাম ১৫০-১৭৫ কেজি, দস্তা ১০-১৫ কেজি, বরিক এসিড ৫-৮ কেজি এবং ৪-৫ মেট্রিক টন জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
পরিচর্যা
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া রয়েছে তিল, তিসি সূর্যমুখী। আমাদের দেশে তেল ফসল অনেকটা অবহেলিত। তবে নিয়মিত যতœ নিলে তেল ফসলের ফলন বাড়ানো সম্ভব। সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে হেক্টরপ্রতি ৭০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
আলু
পরিচর্যা
এখন রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। এ সময় মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরি প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ডাল ফসল
পরিচর্যা
ডাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাস, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে। সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিষ্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সবকটি পরিচর্যা সময়মতো যথাযথভাবে করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
শাকসবজি
পরিচর্যা
মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।
অন্যান্য রবি ফসল
পরিচর্যা
মাঠে এখন মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসময় ভালোভাবে যতœ পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে আশাতীত ফলাফল বয়ে আনবে। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে।
গাছপালা
পরিচর্যা
গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ওষুধি বা বনজ গাছের চারার যত্ন নিতে হবে এখন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছের চারাকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। প্রয়োজনে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির যত্ন
হাঁস-মুরগীর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
গরু-বাছুরের যত্ন
এ সময় পশুখাদ্যের কোন অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। বুদ্ধিমানের কাজ হলো ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত পশুখাদ্য বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এসময় গবাদিপশুর ক্ষুরারোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপ্রাণিতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের যত্ন
মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবর/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। শীতকাল আসছে। পুকুরে রোদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায় এবং কার্প জাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিকথা উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। মনে রাখবেন কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫