Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ উন্নয়নে পারিবারিক কৃষি
এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পারিবারিক কৃষি : প্রকৃতির সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য’ এর যথার্থতা  হলো এ রকম যে, পরিপূর্ণ পারিবারিক সম্পৃক্ততায় কৃষির সব শাখায় উন্নত পদ্ধতি চর্চার মাধ্যমে পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখে পণ্য উৎপাদন ও বিশ্ব চাহিদা পূরণ করা। কৃষিভিত্তিক সব শাখা বলতে ফসল, মাৎস্য, প্রাণিসম্পদ, ফলজ ও বনজসহ সবকিছুকেই বুঝানো হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০১৪ সনকে International Year of Family Farming (IYFF) ঘোষণা করা হয়েছে। স্লোগানটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মানানসই ও বাস্তবায়নযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট করণীয় আছে।

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। সরকারের তাই প্রধান লক্ষ্য মানুষের এ মৌলিক চাহিদা যেন নিশ্চিত হয়। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার দেশের জনগণের এ মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে এবং এ তৎপরতা অব্যাহত আছে। গত কয়েক দশকে দেশের জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তার সমহারে বিপরীতমুখী প্রবণতায় কৃষি জমি কমে গেছে। এ ছাড়াও কৃষি উৎপাদনে ঋণাত্মক ভূমিকার প্রভাবকগুলো যেমন আবহাওয়া পরিবর্তন, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পোকামাকড়ের উপদ্রব ইত্যাদির কারণে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে তালমিলিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত আছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। তখন মানুষ ছিল সাড়ে ৭ কোটি। দেশে এখন মানুষ প্রায় ১৬ কোটি। মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আবাদি জমি প্রায় ৩০ শতাংশ (স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) কমে যাওয়ার পরও খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিনগুণেরও বেশি। খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর গতিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তালিকায় এখন বাংলাদেশ। হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এখন বাংলাদেশ অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। একই জমিতে দুই বা ততোধিকবার চাষ তো হচ্ছেই। ক্ষেত্র বিশেষে চারবারও কোনো কোনো জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নেও বাংলাদেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে। ক্ষুধা সূচকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে। ২০১৩ সনের ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (IFPRI) প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র এক বছরেই এ সূচকে ১১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। দেশে এখন আর চাল আমদানি করতে হয় না। পর্যাপ্ত মজুদ রেখে বর্তমানে চাল রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল (IPCC) তাদের চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলেছিল, চলতি শতকের মধ্যে বাংলাদেশের ধান ও গমের উৎপাদন যথাক্রমে ২০ ও ৩০ শতাংশ কমবে। কিন্তু উৎপাদন কমেনি বরং তাদের ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে গত পাঁচ বছরে ধান ও গমের উৎপাদন গড়ে ২.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ হারে বেড়েছে।

এক্ষেত্রে কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের কর্মীরা কৃষকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নেপথ্যে গবেষণাগারের কর্মীরা প্রতিনিয়ত কৃষক ও দেশের চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন বৃদ্ধির প্রযুক্তি এবং কলাকৌশল সরবরাহ করে আসছেন। এসব তৎপরতার পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন কৃষক সমাজের একান্ত আপনজন বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, এমপি। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, কৃষকরত্ন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এজন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন ১৯৯৬ অনুযায়ী ‘খাদ্য নিরাপত্তা তখনই আছে বলে মনে করা হয় যখন প্রত্যেক নাগরিকের সব সময়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকে যা তাদের সক্রিয় ও সুস্থ জীবন নিশ্চিতকরণের জন্য সঠিক পরিমাণ খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে’। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন ১৯৯৬ এ গৃহীত এ সংজ্ঞা প্রায় সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশে হচ্ছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাদ্য আছে ঠিকই; কিন্তু দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ অর্থাভাব কিংবা অজ্ঞতার কারণে এখনও অপুষ্টির শিকার। এ পুষ্টি চাহিদা পূরণ সহজেই সম্ভব যদি Family Farming এর মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালানো যায়। অধিক উৎপাদন ও বিপণনকে উৎসাহিত করতে সরকার কৃষি খাতে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করেছে। গত বছরের চেয়ে ১১১ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য। উৎপাদনশীল কার্যক্রম গ্রহণ করলে আমার ধারণা, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার যে কোনো সম্ভাবনাময় পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ বরাদ্দ দিতে পারে। পাশাপাশি কৃষকদের উপকরণ সহায়তা দিয়ে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহী করা হচ্ছে। কৃষি ঋণ সহজে পেতে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। Family Farming ধারণায় গড়ে ওঠা কৃষি উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণদান যে কোনো ব্যাংকের জন্য অনেক সহজ। সেক্ষেত্রে ওই ধারণার  আলোকে অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, জনসাধারণের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিবেশনায় পুষ্টির বিভিন্ন উপাদানের ঘাটতি বাংলাদেশে সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। ফলে এরা দৈহিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সমগ্র পরিবার, সমাজ ও দেশ এজন্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।  পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের যথেষ্ট প্রযুক্তি ও কলাকৌশল আমাদের হাতে আছে। শিশুরা যেন পরিপূর্ণ পুষ্টি নিয়ে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে সেজন্য এ চাহিদা মোকাবিলায় সরকার ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, কৃষির আদি মাতা হলো নারী। আর একজন নারীকে কেন্দ্র করেই একটি পরিবার গড়ে ওঠে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা নারীদের কৃষি ও কৃষি কাজের উন্নত কলাকৌশল বাস্তবায়নের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকে দূরে রাখি। এটা Family Farming ধারণার বিপরীত। আমাদের গ্রামীণ জনপদে এখনও পর্যন্ত  একটি পরিবার যে পরিমাণ জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে তা ওই পরিবারের পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। Family Farming ধারণাকে অনুসরণ করে যদি বাড়ির আঙিনায় বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহার করে শাকসবজি, ফল, ফুল, ঔষধি গাছ, মাছ চাষ ও সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগল লালন পালন করা যায়; তবে একটি পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণে কৃষি পণ্য কিনতে বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে খণ্ডিত কৃষি জমি একটি বড় প্রতিবন্ধক। একটি নির্দিষ্ট এলাকার উপযোগী নির্দিষ্ট ফসল চাষে community approach এর মাধ্যমে চাষিদের Family Farming ধারণায় ক্রপ জোনিং করে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে যদি কৃষি পণ্য উৎপাদন করা যায় তবে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মধ্যম ও বড় সব ধরনের চাষির উৎপাদনে একটি বাজার ব্যবস্থা সেখানে গড়ে উঠতে পারে। এর ফলে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ খরচ কম হবে এবং সবাই বাজারে পণ্য কেনাবেচার মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন।
বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ। যদি ১ কোটি পরিবারে একটি করে গাভী থাকে তবে তা থেকে কমপক্ষে ২০ কোটি লিটার দুধ পাওয়া যেতে পারে। জনপ্রতি প্রতিদিন ২৫০ মিলি হিসেবে সবার প্রয়োজনে দুধের চাহিদা হতে পারে ৪ কোটি লিটার।  কিন্তু বর্তমানে চাহিদার মাত্র ২২% দুধ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। সে হিসেবে আমরা জনপ্রতি দিনে মাত্র ৯১ মিলি দুধ পাচ্ছি। শিশু খাদ্য হিসেবে দুধের চাহিদার সিংহভাগই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আনতে হচ্ছে। গোখাদ্যের অভাব দেশে হওয়ার কথা না। অধিক উৎপাদনক্ষম প্রজাতির গরু এবং তাদের খাদ্য উন্নতজাতের ঘাস দেশেই আছে। খাল, বিল, নদী নালার পাড়, রাস্তার ধারে ও অন্যান্য পরিত্যক্ত জমিতে পরিকল্পনামাফিক ঘাস উৎপাদন করে গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। গরু, ছাগল, দুধ এবং ঘাস বিক্রি করে গ্রামীণ মহিলারাও স্বাবলম্বী হতে পারেন।

খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের প্রাপ্যতা  ও মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। কোনো বাসস্থানকে তখনই ‘খাদ্য নিরাপদ’ বলা যায়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করেন না। বাংলাদেশে এখন একটি লোকও পাওয়া যাবে না যে না খেয়ে রাত্রি যাপন করে।  বাংলাদেশে  এখন পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে। বর্তমান সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দানা শস্য উৎপাদনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করায় খাদ্য নিরাপত্তা আরও  নিশ্চিত হয়েছে। খাদ্যের ভাণ্ডার হাওর অঞ্চলে রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামো বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে, এলাকা উন্নয়নের আরও  পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সে অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ও  ছোটখাট  শিল্প স্থাপনের জন্য  সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ, এসএমই ঋণের সম্প্রসারণসহ অনেক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন; যা এ অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন ও উৎপাদনে ভূমিকা রাখবে।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন
যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খাদ্য উৎপাদন করছেন তারা শুধু অর্থের কথা, লাভের কথা চিন্তা করেই পণ্য উৎপাদন করছেন। পণ্যটি ভোক্তাকে কতটুকু সন্তুষ্ট করবে এটা তাদের মাথায় থাকে না।  যে কারণে কৃষি পণ্যে নির্বিচারে বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে তার বাহ্যিক রূপটি শুধু সুন্দর রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বেশি-লাভের আশায় অপরিপক্ব ফসল তুলে রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশে যদি পুরো পরিবার কোনো পণ্য উৎপাদনে জড়িত থাকে এবং পরিবারের সব সদস্যদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ‘নিজেরা খাব এবং বাজারে বিক্রি করব’ এ ধারণায় পণ্য উৎপাদন করে তাহলে উৎপাদিত পণ্যের গুণমান অব্যশ্যই ভালো থাকবে। জাতি এক্ষেত্রে বিষাক্ত খাবার ভক্ষণের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে, বাপ দাদা বা তারও পূর্বপুরুষদের সময়ে লাগানো গাছপালা থেকে তেমন ভালো উৎপাদন হচ্ছে না। এগুলো দীর্ঘদিন একই পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তা হয়ে  থাকে রোগ প্রতিরোধী। এগুলোকে উৎপাদনমুখী করার জন্যও আছে প্রযুক্তি যা ‘টপ ওয়ার্কিং’ নামে পরিচিত। অনাবাদি ফলগাছগুলোকে সার ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া দিয়ে উৎপাদনের ধারায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হলো একটি পরিবার। কাজেই পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ হলে সভ্যতার ক্রমবিকাশও সহজ হয়। পুষ্টির অভাবে মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার বিকাশ ব্যাহত হয়। মানুষকে স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্যে ফিরিয়ে আনতে সুস্থ মানুষের প্রয়োজন। এ সুস্থ মানুষ সৃষ্টির জন্য পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ জরুরি। যা ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ ধারণার বাস্তবায়ন থেকে সহজ প্রাপ্য। একটি বাড়ি বা খামারের আকার কী হবে এটা চিন্তা না করে তার প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায় এবং বাড়তি আয় রোজগারের মাধ্যমে উন্নত মননশীলতার চর্চায় সে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। আকার আকৃতি বিবেচনায় না এনে আলোক চাহিদা, মাটি ও বেড়ে ওঠার প্রকৃতিকে বিশ্লেষণপূর্বক স্থান ও সময়ানুযায়ী ডিজাইন করে শাকসবজি, ফল, ফুল, ঔষধি গাছ, মাছ চাষ ও সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগি, কোয়েল পাখি, কবুতর এবং গরু-ছাগল, খরগোশ ও মৌমাছি লালন পালনসহ বাড়তি কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প, মাশরুম চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করা, সেলাই, মুড়ি, খৈ, চিড়া, দই ও আচার তৈরি ইত্যাদি কাজকর্মগুলো করা যেতে পারে। এভাবে গ্রাম বাংলার খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ ও সংস্কৃতি প্রবাহের মূল স্রোতধারা হতে পারে পারিবারিক কৃষি।
 
 
কৃষিবিদ মো. আব্বাস আলী*
* মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বিস্তারিত
পারিবারিক খামার : খাদ্য অর্থ পুষ্টি বারো মাস
গাঢ় সবুজে লাল বৃত্তে খচিত বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত একটি দেশ বাংলাদেশ। ১,৪৭,৫৬৯ বর্গকিলোমিটারের এ ক্ষুদ্র বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬০ মিলিয়ন যা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৭%  অর্থাৎ প্রতি বছর যোগ হচ্ছে প্রায় ২ মিলিয়ন নতুন মুখ। আগামী ২০২০ সনে জনসংখ্যা হবে ১৭৩ মিলিয়ন এবং ২০৩০ সনে হবে ১৯৬ মিলিয়ন। এ দেশের মোট জনসংখ্যা শতকরা ৩১.৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যার ৫০% চরম দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য নিরাপত্তার শিকার। বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম বা খর্বাকৃতি, ১৬ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় রুগ্ণ ও বয়সের তুলনায় ওজন কম ৩৬ শতাংশ শিশুর। প্রায় পাঁচ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার ২০১১ সালে তীব্র অপুষ্টির শিকার শিশু ছিল ১৬%, ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮%। শুধু ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে দেশে প্রতি বছর ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং কয়েক লাখ লোক রাতকানা রোগে ভুগছে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অভাবে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগ- ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের খাদ্য তালিকায় বেশি স্থান জুড়ে আছে দানাদার খাদ্যশস্য। প্রতিদিন একজন মানুষের যেখানে ২২০ গ্রাম শাকসবজির খাওয়া প্রয়োজন সেখানে আমরা খাই মাত্র ৮০ গ্রাম। প্রয়োজনীয় পরিমাণ শাকসবজি না খাওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এবং এর নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের ৮০% গ্রামে বসবাস করে যার বেশিরভাগই হচ্ছে কৃষক। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার গ্রামে ৭৩% বাস করে। মোট ২৮.৬ মিলিয়ন পরিবারের মধ্যে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১৫.১ মিলিয়ন (৫৩%)। গ্রামীণ জনসংখ্যার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর কৃষকের হার শতকরা ৮০ ভাগ। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৮.৭% প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.০৩ আর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২.১৭% অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি গুরুত্ব অনস¦ীকার্য। আমাদের মোট আবাদযোগ্য জামির ২ থেকে ৩ শতাংশ ছাড়া বাকিটুকু বর্তমানে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। মোট আবাদি জমির শতকরা প্রায় পাঁচ ভাগের মতো বসতবাড়ির আওতায় রয়েছে। কিন্তু এসব বসতবাড়ির আঙিনার সুষ্ঠু ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে হচ্ছে না। জমির অপর্যাপ্ততা, ক্ষুদ্র কৃষকের আধিক্য সত্ত্বেও গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বসতভিটার এক টুকরা জায়গাকে পরিকল্পিত উপায়ে আবাদের দ্বারা সারা বছরই শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সর্ববৃহৎ বহুবিধ ফসলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দানা, কন্দাল, তেল, ডাল, সবজি, ফল, ফুল, মসলা ইত্যাদি উচ্চফলনশীল জাত এবং এসব জাতের উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে তা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে। ফসলের পরিচর্যা, রোগ ও পোকামাকড়ের দমন ব্যবস্থা, মৃত্তিকা ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি যন্ত্রপাতি, উন্নত ফসল বিন্যাস ও খামার পদ্ধতির উন্নয়ন, জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ করে কাক্ষিত জাত উদ্ভাবন, শস্য সংগ্রহেরও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণার আওতাভুক্ত। এ প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৪১৭টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৪৪২টি ফসল উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে। উদ্যানতত্ত্ব ফসলের ওপর গবেষণা করে শাকসবজি ও ফল উৎপাদনে বিশেষ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার (স্বর্ণপদক) ১৪১৭ এবং সম্প্রতি গবেষণা ও প্রশিক্ষণের স্বীকৃতিস্বরূপ বেসামরিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৪ লাভ করেছে। বিটি বেগুনের জাত উদ্ভাবন ও চাষ করে বিশ্বের ২৯তম জিএমও ফসল আবাদকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। খাদ্যশস্যে উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছলেও ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে আমরা অনেক দূরে। আমাদের দেশে মাথাপিছু শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৫৩ গ্রাম, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে উৎপন্ন হয় ১৬৮ গ্রাম অর্থাৎ আমাদের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি। দৈনিক মাথাপিছু ৮৫ ভাগ ফল খাওয়ার সুপারিশ থাকলেও আমরা খেয়ে থাকি ৬০ গ্রাম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অঞ্চলভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে শাকসবজি উৎপাদন মডেল অনুসরণ করে সারা বছর শাকসবজি উৎপাদন সম্ভব। বসতবাড়িতে সবজি ও ফল চাষের মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের শ্রম উৎপাদন কাজে ব্যবহার এবং মহিলা ও ছেলেমেয়েদের অলস সময় সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়।

মডেলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
লক্ষ্য
প্রতিটি চাষির বাড়িতে পরিকল্পিত সবজি বাগান তৈরি করে খাদ্য, পুষ্টি ও আয় বৃদ্ধিসহ পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করা।
উদ্দেশ্য
বসতবাড়িতে পরিকল্পিত লাগসই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলদ, মসলা,  ঔষধি ও সবজির বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক খাদ্য, পুষ্টি ও আয় বৃদ্ধি করা।
পরিবারের সব সদস্যের শ্রম উৎপাদন কাজে লগিয়ে স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জাতির বেকার সমস্যার সমাধান করা।  বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষমতায়ন করা।
বসতবাড়ির বিদ্যমান সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা।
বসতবাড়িতে পরিকল্পিত গাছপালা লাগানো ও পরিচর্যার মাধ্যমে ফল-ফলাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

অঞ্চলভিত্তিক সবজি চাষের বিভিন্ন মডেলগুলো
 ক. গয়েশপুর মডেল, পাবনা (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১১, ১২)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ কর্তৃক বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের জন্য ‘কালিকাপুর মডেল’ প্রথম উদ্ভাবন করা হয়। পরবর্তীতে খামার পদ্ধতি গবেষণা সাইট, পাবনা জেলার সদর উপজেলার গয়েশপুরে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়ে একটি নতুন বসতবাড়ির মডেল উদ্ভাবন করা হয় যার নামকরণ করা হয় ‘গয়েশপুর মডেল’।

এ মডেলের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পুরো বসতবাড়িটিতে ব্যবহারযোগ্য শাকসবজি, ফল ও কিছু মসলাজাতীয় ফসল আবাদ করা। এতে যেমন পরিবারের পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়, তেমনি বাড়ির গৃহিণী এবং স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা অবসর সময়ে বসতবাড়ির বাগানে কাজ করতে পারে। (মডেল পরের পৃষ্ঠায় দেখুন)।

খ.  সৈয়দপুর মডেল, রংপুর (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-২, ৩ এবং ২৭)
গ্রামীণ মহিলাদের জন্য বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ একটি লাভজনক প্রযুক্তি। সঠিক পদ্ধতিতে নিয়মিতভাবে চাষ করলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব। এর ভিত্তিতে সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, রংপুর খামার পদ্ধতি গবেষণা সাইট, সৈয়দপুরে গবেষণা চালিয়ে বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ মডেল উদ্ভাবন করা হয়।

গ. আটকপালিয়া মডেল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১৭, ১৮)
নোয়াখালী জেলার চরজব্বার এবং চরজুবিলী চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় রবি মৌসুমে লবণাক্তার পরিমাণ ২-৮ ডিএস/মি. আবহাওয়া, মাটির গুণাগুণ, চাষির চাহিদা এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন মৌসুমে ১৪টি সবজি নির্বাচন করে সারা বছর বসতবাড়িতে চাষ করা যায়।

ঘ. পালিমা মডেল, টাঙ্গাইল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-৮, ৯)
টাঙ্গাইলে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বসতবাড়ির আয়তন কম। কারণ এ এলাকার বসতবাড়ির ভিটা অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে উঁচু করে তৈরি করা হয় বলে তা আকারে ছোট হয়ে থাকে। পালিমা, টাঙ্গাইলে কয়েক বছর গবেষণা করার সবজি মডেল উদ্ভাবন করা হয়।

ঙ. নারিকেলি মডেল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল- ৯)
জামালপুর জেলার নারিকেলি এলাকায় খামার পদ্ধতি এলাকায় গবেষণা করে সারা বছরব্যাপী শাকসবজি ও ফলমূল চাষের মডেল উদ্ভাবন করা হয় যা বৃহত্তর ময়মনসিংহয়ের অধিকাংশ এলাকার জন্য প্রযোজ্য।

চ. লেবুখালী মডেল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল- ১৩)
পটুয়াখালী এলাকায় অধিকাংশ সময় জমির জোয়ারের পানিতে ডুবে থাবে সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সবজির চাহিদা পূরণ ও পারিবারিক পুষ্টির উন্নয়নকল্পে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে এ মডেলটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

ছ. ঈশান গোপালপুর মডেল, ফরিদপুর (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১১, ১২)
ঈশান গোপালপুর, ফরিদপুর, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সবজি মডেল অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সুপারিশ করা হয়। এ মডেলে উন্মুক্ত জমিতে অনেকগুলো বেড (৭ থেকে ৮) করা হয়। এছাড়া মাচা, ঘরের চাল, অফলা গাছ, ছায়ামুক্ত ও স্যাঁতসেঁতে জায়গা, বাড়ির চারপাশ এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।

জ. বরেন্দ্র মডেল, রাজশাহী (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-৫, ৬ ও ২৬)
বরেন্দ্র অঞ্চলের মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনী পরিবার ছাড়া অধিকাংশই গরিব যাদের বসতি ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কোনো ফসলি জমি নেই। তার ওপর মাটির বিরূপ গঠন, খরা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সাথী। এ পরিপ্রেক্ষিতে বরেন্দ্র মডেলটি ব্যবহার করে খরাপ্রবণ এলাকার কৃষকদের সবজির ও পুষ্টির চাহিদা এবং আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।

ঝ. গোলাপগঞ্জ মডেল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল- ২০)
বৃহত্তর সিলেট দেশের একটি বৃষ্টি বহুল অঞ্চল। এ অঞ্চলে পাহাড়, টিলা, পাহাড়ের পাদভূমি ও সমতল ভূমি রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সিলেটের গোলাপগঞ্জে উদ্ভবিত এ মডেলের দ্বারা সারা বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন সম্ভব হবে।

ঞ. খাগড়াছড়ি মডেল (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল- ২৯)
 দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ পাহাড়ি এলাকা। সমতল থেকে ভিন্নতর এবং পানির দুষ্প্রাপ্যতা সত্ত্বেও এ এলাকার আবহাওয়া ফলমূল ও শাকসবজি চাষের বেশ উপযোগী। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়িতে ২০০৯ সন থেকে বেশ কয়েক বছর গবেষণা করে এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়।

বসতবাড়ির অব্যবহৃত রৌদ্রোজ্জ্বল উন্মুক্ত সুনিষ্কাশিত উঁচু জায়গা নিবিড় সবজি চাষ করার উপযোগী। উন্মুক্ত স্থান নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যে বড় কোনো গাছের ডাল এ জায়গার ছায়া সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য ডাল পালা ছেঁটে দিতে হবে। ৫ মিটার দীর্ঘ, ১ মিটার প্রস্থ এবং ৩০ সেমি. দূরত্ব আকারে পাশাপাশি কয়েকটি বেড তৈরি করতে হবে। উন্মুক্ত স্থানের বেডের সবজি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ বেড়ার ভেতরে চারপাশে ২ মিটার অন্তর অন্তর মাদা তৈরি করতে হবে যাতে বর্ষাকালে পানি না জমে। মাদাতে প্রয়োজনীয় সার দিয়ে বীজ বা চারা রোপণ করা যায়। বসতবাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ঘর যেমন থাকার ঘর, রান্নাঘর, গোয়াল ঘর ইত্যাদি ঘরের চালাতে সবাজি চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের আশপাশের ফাঁকা জায়গা ও পুকুর পাড় যেখানে পর্যাপ্ত রৌদ্র পড়ে এমন জায়গায় বাঁশ, পাটখড়ি ও জিআই তার দিয়ে মাঁচা তৈরি করা যেতে পারে। বসতবাড়িতে বিদ্যমান বিভিন্ন অফলা গাছ যেমন জিগা, বাবলা, মাদার ইত্যাদি বিভিন্ন সবজির বাউনি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সাধারণত গাছের নিচে বা ঘরের পেছনে যেখানে ভালোভাবে সূর্যের পূর্ণ আলো পৌঁছায় না সেখানে সফলভাবে বিভিন্ন ধরনের ছায়া সহনশীল সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল যেমন- ওল কচু, মৌলভি কচু, মানকচু, আদা, হলুদ ও বহুবর্ষী মরিচ ইত্যাদি উৎপাদন করা যায়। বাড়ির চারদিকে সীমানা বরাবর স্বল্প মেয়াদি ফলের চাষ করা যায়। বাড়ির পেছনে পরিত্যক্ত জায়গায় বড় আকারের সবজি গাছ যেমন- সজিনা, লাইজনা, কাঁচকলা ইত্যাদির চাষ করা যায়। সবজি বাগানে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ দেখা দিলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। জমিতে পর্যাপ্ত পানি সেচ এবং বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী এবং সময়মতো সার ও আগাছা  দমন করা জরুরি। বসতবাড়িতে যদি পর্যাপ্ত জায়গা না তাকে তাহলে সবজি ও ফলের নার্সারি স্থাপন করেও বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে। তবে নার্সারি তৈরির কলাকৌশল সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকতে হবে।

বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের সুবিধা
* অল্প পরিমাণ জমিতে অনেক ধরনের সবজি ও ফল আবাদ  করা যায়।
* সবজি আবাদে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে। একই জমিতে বছরে কয়েকবার সবজি চাষ করা সম্ভব।
* পুষ্টির দিক থেকে প্রায় সব শাকসবজি উন্নত মান সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে বছরব্যাপী উপযুক্ত পরিমাণ সবজি খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা এবং রোগমুক্ত থাকা সম্ভব হয়।
* পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়।
* বসতবাড়ির আঙিনায় পরিবারের মহিলা ও ছেলেমেয়েদের অবসর সময়ে সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
রহমান এবং অন্যদের (২০০৮) গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, কৃষি গবেষণা কর্তৃক উদ্ভাবিত মডেল অনুসরণের ফলে প্রতি পরিবারে শাকসবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫৬% এবং ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ৬৮%। সুপারিশকৃত মাত্রায় (Recommended Dietary Allowance) ভিটামিন-এ, ভিটামিন সি এবং আয়রনের শতভাগ, ক্যালসিয়ামের ৮৭% এবং প্রোটিনের ৪৭% এ মডেল অনুসরণের ফলে পূরণ করা যায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বসতবাড়িতে সবজি চাষে মহিলা ও ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ৩২% থেকে ৪২% এবং ৭% থেকে ১২%। খান এবং তার সহযোগীরা (২০০৯) এক গবেষণায় দেখতে পান, পালিমা মডেল অনুসরণ করার ফলে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের পুষ্টির চাহিদার ৭৩% প্রোটিন, ১১৫% ভিটামিন এ, ১৭৯% ভিটামিন সি, ১২০% ক্যালসিয়াম এবং ১২১% আয়রনের চাহিদা পূরণ করা যায় অর্থাৎ প্রোটিন ছাড়া অন্যান্য পুষ্টির ক্ষেত্রে তা চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত থাকে। ২.৫ শতক জমিতে খরচ বাদে লাভ হয় ১৭২৯ টাকা এবং আয় ব্যয়ের অনুপাত ২.৭ যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পুরুষরা জমি তৈরি, রোপণ, জাবড়া প্রয়োগ, বেড়া দেয়া, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি এবং মহিলারা সেচ, আগাছা দমন, বালাইদমন, ফসল সংগ্রহ ইত্যাদিতে বেশি অংশগ্রহণ করে থাকে। বাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাদের অভিভাবকদের কাজে সহায়তা প্রদান করে থাকে। আসাদুজ্জামান এবং তার সহযোগীরা (২০১১) ও তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে অনুরূপ ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে সবজি চাষ অপেক্ষা উন্নত পদ্ধতিতে সবজি চাষে পরিবারে ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিকভাবে ও লাভবান হওয়া যায়। এ পদ্ধতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মনোন্নয়নে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় সুলভ প্রযুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।

এ প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে উন্নত জাতের বীজ ও চারা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পানি  সেচের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষাণ ও কৃষাণি উভয়কেই সবজি উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বসতবাড়িতে সবজি চাষ পারিবারিক খামারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ বাগান থেকে ৪ থেকে ৫ সদস্যের পরিবারের পুষ্টি উপাদান সরবরাহে অনেকাংশে মেটানো সম্ভব। দরিদ্র কৃষকদের উদ্বৃত্ত সবজি বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা থাকে। আত্মীয়স¦জন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের উপহার দেয়ার ফলে সামাজিক সৌহার্দ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, আয়বৃদ্ধি তথা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বসতবাড়িতে সবজি চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। তদুপরি এসব মডেল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ কর্মসূচির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও কাজ করে আসছে। জাতিসংঘ ঘোষিত পারিবারিক কৃষি বছর ২০১৪ এর একটি মডেল হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তাসহ পারিবারিক আয় নিশ্চিন্তে কাজের সহায়ক হবে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল*
ড. মো. কামরুল হাসান**
* মহাপরিচালক, **এসএসও, জীব প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
বিস্তারিত
বসতবাড়িতে পরিকল্পিত কৃষি বনায়ন : খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার এক শক্তিশালী হাতিয়ার
বাংলাদেশ একটি জনবহুল কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ৯০,৯৪,০০০ হেক্টর এবং দিন দিন তা বিভিন্ন কারণে কমে (বছরে প্রায় ১.৬ ভাগ হারে) যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবাদযোগ্য জমির অন্য কোনো কাজে (যেমন নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণ ইত্যাদি) ব্যবহার হচ্ছে এর মূল কারণ। আবার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং সেসঙ্গে কমে যাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। কোনো অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বনভূমির পরিমাণ ২৫% এর কম হলে আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য বিঘ্নিত হয়। সরকারি হিসাবে এ দেশে যদিও বনের আয়তন ১৫ থেকে ১৬% কিন্তু বেসরকারি হিসাবে ও বাস্তবতার নিরিখে ১০% এরও কম বলে মনে হয়। এতে দেখা দিচ্ছে অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রভৃতি রকমের প্রতিকূলতা। ফলে এ মুহূর্তে প্রয়োজন খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি। আর এ ক্ষেত্রে বসতবাড়িতে পরিকল্পিত কৃষি বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কৃষি বনায়ন কী?
কৃষি বনায়ন হচ্ছে এমন একটি টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা, যা ভূমির সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি করে; যুগপৎ বা পর্যায়ক্রমিকভাবে কৃষিজাত ফসল, বৃক্ষজাত ফসল ও বনজ উদ্ভিদ অথবা পশুপাখিকে একত্র-সমন্বিত করে এবং সেসব পরিচর্যা পদ্ধতি অবলম্বন করে, যা ওই নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আবার অনেকের মতে, কৃষি বনায়ন হচ্ছে একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে বৃক্ষ, ফসল এবং পশুপাখিকে এমনভাবে সমন্বয়-একত্র করা হয় যেটা বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত হয়, পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, ব্যবহারিক দিক থেকে সম্ভাব্য হয় এবং সামাজিক দিক থেকে কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
উপরে বর্ণিত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-
ক. কৃষি বনায়নে দুই বা ততোধিক ফসল থাকবে যার মধ্যে অন্তত একটি ফসল হতে হবে বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ।
খ. কৃষি বনায়ন ধারা থেকে দুই বা ততোধিক উৎপাদন অথবা উপকারিতা বেরিয়ে আসবে।
গ. কৃষি বনায়ন ধারা পরিবেশগত (কাঠামো এবং কার্যকারিতার দিক থেকে) এবং অর্থনৈতিকভাবে একক চাষাবাদ অপেক্ষা অধিকতর জটিল এবং লাভজনক।

কৃষি বনায়ন নিম্নের তিনটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে
১. বৃক্ষ ও অন্যান্য বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ।
২. মৌসুমি অথবা একবর্ষজীবী কৃষিজাত উদ্ভিদ ফসল।
৩. পশুপাখি ও মৎস্য।

উপরোক্ত তিনটি উপাদানের সব ক’টি অথবা যে কোনো দুটি উপাদানের সংমিশ্রণে-সমন্বয়ে একটি কৃষি বনায়ন ধারা গড়ে উঠতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে কোনো কৃষি বনায়ন ধারার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে বৃক্ষ বা কাষ্ঠল বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ যা বহুবিধ ব্যবহারযোগ্য।

উপকারিতা
১. কৃষি বনায়নে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
২. একই জমি থেকে একই সঙ্গে ফসল, শাকসবজি, পশুখাদ্য, জৈবসার, কাঠ, ফল, মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ইত্যাদি উৎপাদন সম্ভব।
৩. কৃষি বনায়নের ফলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণ উন্নত হয়।
৪. একক চাষাবাদ এর শস্যহানির ঝুঁকি কমে যায়।
৫. ফসল, বৃক্ষ, পশুপাখি ও মাছের আন্তঃক্রিয়ায় পরস্পর উপকৃত হয়।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ঘরবাড়ি ও ফসল রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭. বেকারত্ব দূরীকরণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়।
৮. সর্বোপরি বসতবাড়ির প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর হয় এবং পরিবেশ উন্নত হয়।

সীমাবদ্ধতা
১. অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ ও ফসল একসঙ্গে চাষাবাদ করলে এদের মধ্যে স্থান, সূর্যরশ্মি, পানি ও পুষ্টি নিয়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে এবং এতে ফলন কম হবে। তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এনে বৃক্ষ ও ফসল নির্বাচন করতে হবে।
২. বৃক্ষ ও ফসলের রোগবালাই পরস্পরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৩. সেচের পরিমাণ বেশি লাগবে।
৪. গাছ কাটার সময় ফসল এবং অন্যান্য উদ্ভিদের ক্ষতি সাধন হতে পারে।
৫. জমি চাষ ও ফসল পরিচর্যায় অসুবিধা হয়।
৬. শ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
৭. পরিকল্পিত কৃষি বনায়নে জনগণের জ্ঞান বৃদ্ধি এক বড় চ্যালেঞ্জ।

বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন
বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন হলো কৃষি বনায়নের একটি ধারা, যেখানে বসতবাড়ির নির্দিষ্ট ভূখ-ে বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ, অন্যান্য উদ্ভিদ, বৃক্ষ ফসল, উদ্ভিদ ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বয়ে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠে যা কৃষি বনায়নের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যম-িত এবং প্রাচীন উদাহরণ। এটি আবার জীবন নির্বাহ কৃষি বনায়ন ধারাও বটে। এ ধারার মূল লক্ষ্য হতে পারে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা। সাধারণত ক্ষুদ্র ও দরিদ্র বা স্বল্প সামর্থ্যযুক্ত পরিবারগুলো পারিবারিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ধারা হতে বেশি উপকৃত হতে পারে।

একটি আদর্শ বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন ধারার গঠন
প্রায় প্রতিটি বসতবাড়িতে কৃষি বনায়নের অস্তিত্ব থাকলেও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে তা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ফলে ধারণাটি পুরনো হলেও মানুষ এটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। অথচ পরিকল্পনা মাফিক বসতবাড়িতে কৃষি বনায়নের মাধ্যমে একটি পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব। একটি আদর্শ বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন ধারা গড়ে তোলার জন্য নিম্নলিখিত প্রধান দিকগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে-

১. বসতবাড়ির চারপাশের সীমানায় বেড়া হিসেবে মান্দার, ভেরেন্ডা, পলাশ, জিগা ইত্যাদি উদ্ভিদ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বসতবাড়ির সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও সুরক্ষার কাজও করবে।
২. বাড়ির আঙিনায় শাকসবজির চাষ করতে হবে।
৩. বসতবাড়ির আঙিনার ফাঁকা স্থানে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বেল, পেঁপে, নিম, বহেড়া, হরীতকী, তুলসী, সজিনা, নারিকেল, সুপারি, বকুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।
৪. বসতবাড়ির সীমানায় পুকুর থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছের চাষ করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপণ (নারিকেল, সুপারি, ইপিল-ইপিল, মেহগণি, খেজুর, কড়ই ইত্যাদি) করতে হবে। এতে গরমের সময় মাছের উপকার হয়। এখানে বেশি শিকড় বিশিষ্ট গাছ লাগালে পুকুরের পাড়ের মাটি ভাঙবে না।
৫. বিভিন্ন ছায়াসহ্যকারী উদ্ভিদ যেমন- আদা, হলুদ ইত্যাদি দুই বৃক্ষের মাঝে লাগতে হবে।
৬. বসতবাড়িতে যতটুকু সম্ভব গবাদিপশু-পাখি (হাঁস-মুরগি, কোয়েল, কবুতর, গরু, ছাগল, মৌমাছি ইত্যাদি) পালন করতে হবে।
৭. সর্বোপরি স্থান-অবস্থান, উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা, সামর্থ্য, সহজ প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিবেচনা করে বসতবাড়ির কৃষি বনায়ন ধারার উপাদানগুলো নির্বাচন করতে হবে এবং যথাযথ নিয়মে এর পরিচর্যা করতে হবে।

বসতবাড়িতে পরিকল্পিত কৃষি বনায়নের প্রয়োজনীয়তা
কিন্তু এদশের অধিকাংশ জনগণই অত্যন্ত গরিব, অনেকের শুধু বসতবাড়ি ছাড়া আর কোনো কৃষি জমি নেই। অথচ এদেশের গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়িগুলো হচ্ছে সনাতন কৃষি বনায়ন ধারা তথা বহুমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাচীন উদাহরণ। কৃষাণ-কৃষাণিরা বহু পূর্বকাল থেকেই একই আঙিনায় নিজেরা বসবাস করা ছাড়াও শাকসবজি চাষ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, হরেক রকমের ফলদ, বনজ এবং শোভাবর্ধনকারী গাছপালা একই সঙ্গে উৎপাদন ও পালন করে আসছেন। বাংলাদেশে বসতবাড়ির বাগান থেকেই অধিকাংশ ফল, কাঠ, জ্বালানি, পশুখাদ্য ইত্যাদি উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয়। দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থালি জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশ জোগান বসতবাড়ি এবং পাশের জমি থেকেই আসে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকায় বসতবাড়িভিত্তিক এ উৎপাদন ব্যবস্থার ফলন তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বসতবাড়ি এখনও প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যবহৃত। ভৌত অবস্থান, কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পদ ভিত্তি ইত্যাদিকে বিবেচনায় রেখে কৃষি বনায়ন তথা একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সেটা হবে আগামী শতকের প্রধান অবলম্বন, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বহু বছর ধরে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদি জোগান দেবে।

এ ছাড়া গাছ বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করবে ও ঝড়-বাতাস থেকে ঘরবাড়িকে রক্ষা করবে। কৃষি বনায়ন আয়েরও একটি ভালো উৎস হতে পারে। তাই সুপরিকল্পিতভাবে কৃষি বনায়ন ধারা অনুসরণ করে বসতবাড়ির আঙিনা ও তার আশেপাশের জমি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল, শাকসবজি, ফল, কাঠ, জ্বালানি, পশু খাদ্য, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি উৎপাদন করা একান্তই প্রয়োজন। এজন্য দ্রুত বর্ধনশীল ফলজ এবং বনজ বৃক্ষের সমন্বয়ে একটি বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য বসতবাড়ি বাগান গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে করে খাদ্যের চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং সে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
 
ড. মো. শহিদুল ইসলাম*
কৃষিবিদ জহিরুল ইসলাম খান**
* মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এবং সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ** নির্বাহী সম্পাদক, উর্বরা
বিস্তারিত
পারিবারিক খামার : পরিবেশসম্মত খাদ্য জোগান ও সমৃদ্ধির মূল সোপান
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৪ সনকে পারিবারিক খামার বছর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সে প্রেক্ষিতে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পারিবারিক কৃষি : প্রকৃতির সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য’। পারিবারিক খামার থেকে একটি পরিবার তার প্রয়োজনে নিজের সম্পদ সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের প্রয়োজন আর চাহিদা মাফিক খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করে। এর সঙ্গে উদ্বৃত্ত অংশ পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনকে বিলিয়ে দেয়া আর অতিরিক্ত অংশকে বাজারে বিক্রি করে দু’পয়সা আয় করে। এভাবে তৃতীয় বিশ্ব আর উন্নয়নশীল দেশের খামারিরা তাদের খাদ্যের জোগান মোটামুটি নিশ্চিত করে। পারিবারিক খামারে দানাদার, অর্থকরী, তেল, ডাল, শাকসবজি, ফলমূল, মসলা, ঔষধি, বাহারি সব ধরনের উৎপাদনের জোগানকেই বুঝায়। সঙ্গে মাছ, গবাদিপশু-পাখিতো আছেই। কৃষকরা মাঠের জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেল, ফসল, মশলা আবাদ করে, পারিবারিক বাগানে শাকসবজি, ফলমূল ভেষজ, মসলা আবাদ করে, মাছ চাষ করে, গবাদিপশু পালন করে, ফসল তোলে প্রক্রিয়াজাত করে চলমান প্রয়োজন মেটায় আর অতিরিক্ত অংশ সংরক্ষণ করে রেখে দেয় সুখময় আগামীর জন্য। এভাবেই তারা পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী কেউ খুব ভালো থাকে কেউ মোটামুটি ভালো আর কেউ নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থায় বিরাজ করছে। তবুও তাদের জীবন গতিময় থাকে কেটে যায় যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। এটা ঠিক কৃষি উৎপাদন আর উন্নয়নের মহানায়ক অধিকাংশ কৃষক গরিব, ক্ষুদ্র, মাঝারি, নিম্নবিত্ত বলে তাদের প্রয়োজনটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার সঙ্গে কিংবা আরও বিশুদ্ধভাবে যদি বলি আধুনিক পরিকল্পনার সঙ্গে ততটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সব কাজে আমাদের মনে রাখতে হবে জমির মালিকরা কৃষক না, আবার যারা কৃষক তাদের জমি নেই। সেকথা ভেবে আমাদের পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে।

ঘরের পাশে কিংবা বাড়ির পাশে পতিত জায়গায় বা এজমালি পতিত জায়গার বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে খাওয়া, ঘরের চালে আঙিনায় বারো মাসে কোনো না কোনো শাকসবজি আবাদ তাদের নিত্য বহমান প্রতিচ্ছবি। এখান থেকেই তাদের খাদ্য পুষ্টি আসে দিনের পর দিন। প্রয়োজন এদের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক কৌশল শিক্ষা দেয়া এবং এগুলোকে তাদের কাজ কর্মের অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন করা। প্রাসঙ্গিকভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের কথা বিশেষভাবে বলা দরকার। আমরা প্রায় সবাই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে হাজারো কথা বলি, পরামর্শ দেই ও পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করি। কিন্তু ভাবি কী হাজার মেট্রিক টন খাদ্য যদি উৎপাদিত হয় এবং সেগুলো যদি নিরাপদ না হয়, বিষাক্ত বা কাক্সিক্ষত মানের না হয় তাহলো এসব লাখ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য আমাদের কী কাজে লাগবে? সুতরাং খাদ্য নিরাপত্তার কথা বললে আমরা যেন সর্বপ্রথম আবশ্যকীয়ভাবে নিরাপদ খাদ্যের কথা ভাবি এবং সেভাবে কাজ করি। আর জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারকে খাদ্য নিরাপত্তার কথা নিশ্চিত করাতে পারলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা এমনিতেই চলে আসবে। পারিবারিক কৃষি খামার পরিবার এবং ছোটখাটো কৃষি খামার বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত; কৃষি খামার প্রচলিত খাদ্য উৎপাদনকে সংরক্ষণ করে যেটা সুষম খাদ্য খেতে বা পেতে দারুণ সহায়তা করে; এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে পারিবারিক কৃষি খামার স্থানীয় কৃষি, কমিউনিটি বা আর্থসামাজিক নীতি প্রশাসন আর উন্নয়ন সমৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পারিবারিক খামারকে এবার বিশ্ব খাদ্য দিবসে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কারণ অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদকে যুক্তিযুক্তভাবে ব্যবহার করে বিশ্ব ক্ষুধা আর দারিদ্র্যকে দূর করে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টিকে নিশ্চিত করে জীবন যাত্রার মানকে কাক্সিক্ষত সীমানার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়ার জন্য। পারিবারিক কৃষি মানে পরিবারভিত্তিক কার্যক্রম এবং এটি গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পারিবারিক কৃষি মানে মাঠের কৃষি, কৃষি বনায়ন, মৎস্য, গোচারণ ভূমি, গবাদিপশু লালন পালন এসব। আর এগুলো পরিবারের পুরুষ মহিলা সব সদস্য মিলে সম্মিলিত শ্রম বিনিয়োগ করে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো পারিবারিক কৃষি কাজ উৎপাদন ও সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তবে পারিবারিক কৃষির মাহাত্ম্য আর অবদান যাই থাক না কেন এর সঙ্গে জাতীয় অনেক কিছুর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে আছে জাতীয় কৃষি পরিবেশ অবস্থা, ভূ-প্রকৃতি, ভৌগলিক অবস্থান, রাষ্ট্রীয় নীতি, বাজার নীতি, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, তথ্যপ্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার, সম্প্রসারণ কর্মকা-, জনসংখ্যা, আর্থসামজিক অবস্থা, শিক্ষা এসব। এগুলো যে দেশের যত সুন্দর সুষ্ঠু আর সমৃদ্ধ সেদেশের পারিবারিক কৃষিও তত উন্নত ও সমৃদ্ধ।

প্রায় দেড় লাখ বর্গকিলোমিটারের বাংলাদেশের জনসংখ্যা দেড় লাখ মিলিয়নের বেশি যা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অষ্টম দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এদেশে প্রায় দেড় শতাংশ হারে জনসংখ্যা বেড়ে প্রতি বছর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রায় ২ মিলিয়ন মানব শিশু। জনসংখ্যা আগামী ২০৩০ সনে তা দাঁড়াবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন। মোট জনসংখ্যা শতকরা ৩২ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যার অর্ধেক চরম দারিদ্র্য, পুুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য নিরাপত্তার শিকার। অর্ধেকের চেয়ে একটু কম ভাগ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম বা খর্বাকৃতি, আমাদের আদুরে শিশুরা উচ্চতার তুলনায় রুগ্ণ ও বয়সের তুলায় কম ওজনের। প্রায় ৫ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। শুধু ভিটামিন ‘এ’র অভাবে দেশে প্রতি বছর ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং কয়েক লাখ লোক রাতকানা রোগে ভুগছে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অভাবে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগ- রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশ আর প্রকৃতিগতভাবে আমাদের খাদ্য তালিকায় বেশি স্থানজুড়ে আছে দানাদার খাদ্যশস্য। প্রতিদিন একজন মানুষের ২২০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন হলেও আমরা খাই মাত্র ৮০ গ্রাম অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় অনেক কম। প্রয়োজনীয় পরিমাণ শাকসবজি না খাওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এবং এর নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

জনবহুল কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৯০ লাখ হেক্টরের সামান্য বেশি হলেও বিভিন্ন কারণে বছরে প্রায় দেড় ভাগ হারে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যার বাড় বাড়তি, কৃষি জমি নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণ মানে অকৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং সে সঙ্গে কমে যাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। পরিবেশবিদদের মতে জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যতটুকু বন থাকা দরকার আমাদের তা নেই। বনভূমির পরিমাণ এর কম হলে আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য বিঘিœত হয়। সে কারণে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঝড়, আইলা, সিডর, শেফালি, নার্গিস, মহাসেনের মতো প্রাকৃতি দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বেড়ে যাওয়া, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা দেখা দিচ্ছে। কৃষি বনায়ন আর খাদ্য উৎপাদনকে সমন্বয় করতে পারলে আমরা আরও বেশি ভালো থাকব।

বর্তমান বিশ্বে হতদরিদ্র বেশির ভাগ কৃষক যা ৮০% গ্রামে বসবাস করে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার গ্রামে ৭৩% বাস করে। গ্রামীণ জনসংখ্যার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর কৃষকের হার শতকরা ৮০ ভাগ। জিডিপিতে কৃষির আবদান ১৯% এর মতো। প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ এর একটু বেশি আর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২.১৭% অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মোট আবাদযোগ্য জমির সিংগভাগ বর্তমানে চাষের আওতায় এসেছে। মোট আবাদি জমির ৫% বসতবাড়ির আওতায় থাকলেও এসব বসতবাড়ির আঙিনার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। দানাদার শস্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছলেও ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে আমরা এখনও অনেক দূরে। আমাদের দেশে মাথাপিছু শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে মাত্র অর্ধশত গ্রাম, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে উৎপন্ন হয় আমাদের ৩ গুণ। দৈনিক মাথাপিছু ৮৫ ভাগ ফল খাওয়ার সুপারিশ থাকলেও আমরা খাচ্ছি তার অর্ধেক। কৃষি গবেষণার শাকসবজি উৎপাদন মডেল অনুসরণ করে সারা বছর শাকসবজি উৎপাদন সম্ভব। বসতবাড়িতে সবজি ও ফল চাষের মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের উৎপাদনে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়।

বসতবাড়ির আশপাশের অব্যবহৃত খোলা রৌদ্রোজ্জ্বল সুনিষ্কাশিত উঁচু জায়গা নিবিড়ভাবে অনেক ফসলের চাষ করা যায়। স্থান নির্বাচন করে উপযোগী নকশা করে পাশাপাশি কয়েকটি বেড-মাদা তৈরি করে রকমারি ফসল আবাদ করা যায়। খামারের ফসল পশুপাখি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম সার ব্যবহার করে বীজ বপন-চারা রোপণ করতে হবে। থাকার ঘর, রান্নাঘর, গোয়াল ঘরের চালাকে সবাজি চাষের জন্য ব্যবহার করা যায়। ঘরের আশপাশের ফাঁকা জায়গা ও পুকুর পাড় যেখানে পর্যাপ্ত রোদ পড়ে এমন জায়গায় বাঁশ, পাটখড়ি ও জিআই তার দিয়ে মাঁচা তৈরি করে কিংবা বসতবাড়িতে থাকা জিগা, বাবলা, মাদার সবজির বাউনি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সাধারণত গাছের নিচে বা ঘরের পেছনে যেখানে ভালোভাবে সূর্যের আলো পড়ে না সেখানে বিভিন্ন ধরনের ছায়াসহনশীল সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করা যায়। বাড়ির চারদিকে সীমানায় স্বল্পমেয়াদি দ্রুত বাড়ে এমন ফলের চাষ করা যায়। বাড়ির পেছনে পরিত্যক্ত জায়গায় বড় বহুবর্ষজীবী সবজি চাষ করা যায়। পারিবারিক খামারে বালাইয়ের আক্রমণ হলে জৈব ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। গাছের উৎপাদন কৌশলে প্রয়োজন অনুযায়ী এবং সময়মতো সব ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত রাখতে হবে। তাছাড়া বাড়তি সুবিধা নিয়ে সবজি ও ফলের নার্সারি স্থাপন করা যায়।

পারিবারিক খামারে পরিবারের চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ; অপেক্ষাকৃত কম সময়ে চাষ; বছরে কয়েকবার সবজি চাষ; পুষ্টির দিক থেকে উন্নত মানের শাকসবজি হয়; বছরব্যাপী অনুমোদিত পরিমাণ সবজি খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করে রোগমুক্ত থাকা; পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সংস্থান করা; পরিবারের সব সদস্যদের অবসর সময়ে সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন পরিবেশসম্মত একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং তার কার্যকর বাস্তবায়ন। চলমান ধারায় আমাদের প্রতি পরিবারে শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে অর্ধ শতকের বেশি এবং ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে প্রায় ৭০ ভাগের মতো। পুষ্টি সুপারিশ মাত্রায় ভিটামিন-এ, সি এবং আয়রনের শত ভাগ, ক্যালসিয়ামের ৮৭% এবং প্রোটিনের ৪৭% অনায়াসে পূরণ করা যায় গবেষণা পরীক্ষিত মডেল অনুসরণ করে। পরিবারের সদস্যরা মিলে জমি তৈরি, রোপণ, জাবড়া প্রয়োগ, বেড়া দেয়া, সেচ, আগাছা দমন, বালাইদমন, বাজারজাতকরণ, ফসল সংগ্রহ কার্যক্রমে লিপ্ত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে সবজি চাষে পরিবারে ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা বাড়ে এবং অর্থনৈতিকভাবে ও লাভবান হওয়া যায়।

খামারভিত্তিক কার্যক্রমে প্যাকেজ প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে উন্নত জাতের মানসম্মত বীজ-চারা ব্যবহার, সময় মতো বপন রোপণ, সেচ ব্যবস্থাপনা, বালাই ব্যবস্থাপনা, আন্তঃপরিচর্যা, কর্তন উত্তর কৌশল এসবই বিজ্ঞানসম্মতভাবে লাগসই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে করতে হবে। একটি পারিবারিক বাগান থেকে ৪ থেকে ৫ সদস্যে বিশিষ্ট পরিবারের বছরের পুষ্টি উপাদান সরবরাহে অনেকাংশে মেটানো সম্ভব। খামারিদের উদ্বৃত্ত সবজি বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা থাকে। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বিতরণের ফলে সামাজিক সৌহার্দ সম্প্রীতি বাড়ে। বাংলাদেশের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, আয় বাড়া, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বসতবাড়িতে সবজি চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচি বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৪ এর এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে। পারিবারিক খামার ব্যবস্থাপনায় কৃষি বনায়ন পুরনো ধারণা হলেও নতুনভাবে কাজে লাগানো যায় সুন্দরভাবে। কৃষি বনায়ন এমন একটি টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা যা ভূমির সার্বিক উৎপাদন বাড়ায়; পর্যায়ক্রমিকভাবে কৃষিজাত ফসল, বৃক্ষজাত ফসল ও বনজ উদ্ভিদ অথবা পশুপাখিকে একত্রিত-সমন্বিত করে এবং সেসব পরিচর্যা পদ্ধতি অবলম্বন করে যা নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবার কৃষি বনায়ন হচ্ছে একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে বৃক্ষ, ফসল এবং পশুপাখিকে এমনভাবে সমন্বয়-একত্রিত করা হয় যেটা বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত হয়, পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, ব্যবহারিক দিক থেকে সম্ভাব্য হয় এবং সামাজিক দিক থেকে কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

কৃষি বনায়ন ১. বৃক্ষ ও অন্যান্য বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ; ২. মৌসুমি অথবা একবর্ষজীবী কৃষিজাত উদ্ভিদ-ফসল; ৩. পশুপাখি ও মৎস্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। এসব উপাদানের সমন্বয়ে পারিবারিক কৃষি বনায়ন ধারা গড়ে উঠতে পারে। কৃষি বনায়নে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়; একই জমি থেকে একই সঙ্গে ফসল, শাকসবজি, পশুখাদ্য, জৈবসার, কাঠ, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদন সম্ভব; মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণ উন্নত হয়; একক চাষাবাদের শস্যহানির ঝুঁকি কমে যায়; ফসল, বৃক্ষ, পশুপাখি ও মাছের সমন্বয়ে পরস্পর উপকৃত হয়; প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে; বেকারত্ব দূর হয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়; বসতবাড়ির প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর হয় এবং পরিবেশ উন্নত হয়। আবার অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ ও ফসল এক সঙ্গে চাষাবাদ করলে স্থান, সূর্যরশ্মি, পানি ও পুষ্টি নিয়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে ফলন কম হয়। তাই বিবেচনায় এনে বৃক্ষ ও ফসল নির্বাচন করে প্রয়োজনীয় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে এটাই কৃষি বনায়নে জনগণের সুখ সমৃদ্ধির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পারিবারিক কৃষি বনায়নে বসতবাড়ির খামারে বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ, অন্যান্য উদ্ভিদ, বৃক্ষ ফসল, উদ্ভিদ ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, মাছ এসবের সমন্বয়ে সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। পারিবারিক খামারের কৃষি বনায়নে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার প্রতিশ্রুতি থাকে। সাধারণত ক্ষুদ্র ও দরিদ্র বা স্বল্প সামর্থ্য যুক্ত পরিবারগুলো পারিবারিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ধারা হতে বেশি উপকৃত হতে পারে। পারিবারিক খামারে কৃষি বনায়নের অস্তিত্ব থাকলেও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে তা থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। পরিকল্পনা মাফিক পারিবারিক খামারে কৃষি বনায়নের মাধ্যমে একটি পরিবারের সার্বিক চাহিদা মেটানো সম্ভব। পারিবারিক খামারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা,  খামারের নকশা, জীবন্ত বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনীয় সব ধরনের ফসল নির্বাচন করে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত আবাদ বৃক্ষরোপণ; পুকুরে মাছ চাষ, আঙিনায় সমন্বিত সব ধরনের গবাদিপশু ও পাখি পালন যথাযথ যত্ন-আত্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই পরিবেশসম্মত ফলন পাব নামে ও দামে।

এদেশের অধিকাংশ জনগণই অত্যন্ত গরিব, অনেকের শুধু বসতবাড়ি ছাড়া আর কোনো কৃষি জমি নেই। অথচ গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়িগুলো সনাতন পারিবারিক খামার ব্যবস্থাপনার বিশেষ ধারার বহুমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাচীন উদাহরণ।  আামদের গ্রামীণ জনগণ বহুকাল থেকেই একই আঙিনায় নিজেরা বসবাস করা ছাড়াও শাকসবজি চাষ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, ফলদ, বনজ এবং শোভাবর্ধনকারী গাছপালা একই সঙ্গে উৎপাদন করে আসছেন। বাংলাদেশে বসতবাড়ির বাগান থেকেই অধিকাংশ ফল, কাঠ, জ্বালানি, পশুখাদ্য উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থালি জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশ জোগান বসতবাড়ি এবং পাশের জমি থেকেই আসে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা ভালো হলে কাক্সিক্ষত উৎপাদন ফলন আসবে অনায়াসেই। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বসতবাড়ি এখন প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যবহৃত। ভৌত অবস্থান, কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পদভিত্তিক বিবেচনায় রেখে কৃষি বনায়ন তথা একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।

বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বর্তমানে পুরো বিশ্বে ৮৪২ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। আবার অনেক মানুষ সংস্থা এ বিশ্ব ক্ষুধা নিবারণের জন্য সর্বোতভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীতে ৫১৭ মিলিয়ন পরিবারের মধ্যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন কৃষি পরিবার আছে যা পুরো কৃষির ৯৮% ভুবনকে প্রতিনিধিত্ব করে। তারা পৃথিবীর ৫৬% জমি থেকে ৫৬% কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করছে। একথা ঠিক পারিবারিক কৃষি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরিবারের বা কৃষি খামারের প্রধান তার বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে অনেক সতর্ক সহনশীলতা আর যত্নের সঙ্গে তার সীমিত সম্পদ জমিজমা পুঁজিকে সম্বল করে এগিয়ে যায় প্রথমত পরিবারের আবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তাকে মেটানোর জন্য। আর বাড়তি আয়ের অংশ সে তো সৌভাগ্যের প্রসূতি।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে যুগে যুগে দেশে পারিবারিক কৃষি খামার পুরো বিশ্বের সুষম খাবারের জোগান, কৃষি জীববৈচিত্র্যতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল অবস্থায় বিরাট ভূমিকা রেখে চলছে। শুধু তাই নয় পারিবারিক কৃষি বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের কৃষি অর্থনীতিকে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে। তারা তাদের সীমিত পুরনো প্রচলিত জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যতটুকু পারে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এখানেই প্রশ্ন এসে হাজির হয় আমরা কী তাদের এসব প্রচলিত ধ্যান ধারণা আর জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে আরও শানিত করে আধুনিক করতে পারি না? যা আমাদের কৃষিভিত্তিক পারিবারিক কৃষি খামার বা ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করে পুরো অর্থনীতি আর সামাজিক জীবনযাত্রার মানকে সুসমৃদ্ধ করবে। পারিবারিক খামার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে অসম্মান করে কোনো দেশের অর্থনীতি দাঁড়াতে পারবে না। বরং আসল কাজ হলো কীভাবে এ চলমান কার্যক্রম আর কর্মসূচিকে আরও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত করে খরচ সাশ্রয়ী করে পরিবেশসম্মতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূরের বাতিঘরে। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের অগণিত কৃষি খামার শ্রমিক আর কৃষক-কিষাণিদের কথা। তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বস্ত্র, সেফটি, সঞ্চয় বীমা এগুলোকে যত দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সম্মান মর্যাদা দিয়ে আগলে রাখা না যাবে ততদিন কোনো ধরনের দৈন্যতা কমবে না, শেষ হবে না। আমাদের মূল আয়োজন আর সমৃদ্ধির উৎসকে আন্তরিকতা পরম ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত মনজিলে মকসুদে পৌঁছতে পারব অনায়াসে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৪কে পারিবারিক কৃষি বছর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণায় খাদ্য নিরাপত্তাসহ পারিবারিক আয় নিশ্চিতে অনেকটুকু সহায়ক হবে। এবারে আমাদের প্রতিশ্রুতি হোক আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা হোক পারিবারিক খামারে আমরা বিনিয়োগ করব আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করব, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সব কাজ করব, জৈব কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে সবুজ সতেজ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করব এবং নিজেদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে নিবেদিত থাকব, চাহিদা প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সার্বিকতাকে নিশ্চিত করব। তখন আমাদের ক্ষুধা মিটবে, পুষ্টি আসবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে পরিবেশসম্মতভাবে সুনির্মল পৃথিবীতে বেঁচে থাকব আমাদের মতো করে। সুপরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব সমন্বিত বা পারিবারিক কৃষি খামার আমাদের জীবনে নতুন আশা আর সফলতার সুবাতাস বয়ে আনবে। আমরাও সুখ সমৃদ্ধির মায়াজালে জড়িয়ে গিয়ে আত্মতৃপ্তির সঙ্গে বলব সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশ।
 
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
দ্বিস্তর সমবায় ও কৃষি
আলোচ্য প্রবন্ধটির রয়েছে তিনটি অংশ। প্রথম অংশে বিআরডিবির শুরু থেকে হাতে নেয়া গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে যে অর্জন পাওয়া গেছে তার একটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মূলত কৃষি সেক্টরে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তার দৃশ্যমান পরিবর্তনটাকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অংশে অর্জন প্রাপ্তির পরবর্তীকালে সংস্থাটির ক্রান্তিকালের একটি চিত্রসহ পরিবেশের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করার চেষ্টা নেয়া হয়েছে। অর্জনের সুফলগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে পল্লীর জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায়  পৌঁছে দেয়া এবং যথাযথ যধহফষব করতে ব্যর্থ হওয়ার একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তৃতীয় অংশে সংস্থাটির অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তার সুপারিশ করা হয়েছে। আলোচনাটি মূলত গুণগত ও বিশ্লেষণাত্মক পর্যায়েই রাখা হয়েছে।

 বিআরডিবি হচ্ছে একমাত্র সরকারি সংস্থা যেটা গ্রামীণ দারিদ্র্যবিমোচন এবং সমন্বিত গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিআরডিবি সাধারণত গ্রামীণ ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের সমবায় সমিতি গঠনের মধ্য দিয়ে একত্রিত করে তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠন সৃষ্টি এবং উন্নত চাষ পদ্ধতির কলাকৌশলগুলো কৃষকদের মাঝে হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করে আসছে। পাশাপাশি গ্রামের বিত্তহীন পুরুষ ও দুস্থ মহিলাদের সমবায় সমিতি-অপ্রাতিষ্ঠানিক  দলে  সংগঠিত করে আয়বর্ধনমূলক কর্মকা- পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে অবদান রেখে আসছে।

১৯৭১ সন থেকে তদানীন্তন ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’র মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৮২ সনে বোর্ডে উত্তোরণের মধ্য দিয়ে বিআরডিবি আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ঋণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে গ্রামের অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খুব কাছাকাছি থেকে গ্রামীণ দরিদ্রতা কমিয়ে আনার কাজ সম্প্রসারিত করেছে।

পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি : যেভাবে আসল
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না। এ যাবত পল্লী উন্নয়ন সেক্টরে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে এবং এখনও পরিবর্তন ঘটে যাছে তার সবই হচ্ছে দ্বিস্তর সমবায়ের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রভাব থেকে বা অভিজ্ঞতা থেকে। এ অর্জনটা কিন্তু  জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেখা অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীকে (বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া) খাওয়াতে হলে এমন সব পদক্ষেপ নিতে হবে যার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে।  তাই ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা অর্জনের পর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পল্লীর জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনি দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন।

প্রথমত কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকুরিতে তিনি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়ে গেছেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন বর্ধিত জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। এর জন্য দক্ষ কৃষি বিজ্ঞানী গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং কৃষি গ্রাজুয়েটদের মর্যাদার আসনে না বসালে এ সেক্টরে মেধার সমাবেশ ঘটবে না। আর মেধার সমাবেশ না ঘটাতে পারলে উন্নত প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন সম্ভব হবে না। বর্তমানে উন্নত জাতের ধান বীজসহ বিভিন্ন ধরনের প্রধান ও অপ্রধান শস্যের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। উন্নত ফসল উৎপাদন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে এর সবই বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের ফসল।

দ্বিতীয়ত কৃষকদের মাঝে এসব উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তিগুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য তৎকালীন সময়ে কৃষি বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত সম্প্রসারণ কৌশল (টিঅ্যান্ডভি পদ্ধতি) কাজ হচ্ছিল না বিধায় তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠন গড়ে তুলে উদ্বুদ্ধকরণসহ নতুন প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের কৌশল পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কুমিল্লা মডেলের সর্বশেষ কম্পোনেন্ট অর্থাৎ দ্বিস্তর সমবায় পদ্ধতির বাস্তবায়নের জন্য আইআরডিপি অর্থাৎ সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এ কর্মসূচির মাধ্যমেই  পল্লী উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কর্মসূচিটি যেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল
প্রথম ধাপে আইআরডিপির মাধ্যমে গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠিত করে গ্রাম পর্যায়ে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়।

দ্বিতীয় ধাপে সংগঠিত সমবায় সমিতিগুলোকে সমবায বিভাগ কর্তৃক নিবন্ধন করার মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠনগুলো সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়।
তৃতীয় ধাপে নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলো থানা-উপজেলা পর্যায়ে তাদের কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গঠন করে। এ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির অফিসে প্রতি মাসে প্রাথমিক সমবায় সমিতির প্রতিনিধিরা (সভাপতি-ম্যানেজার-আদর্শ কৃষক) একত্রিত হয়ে এবং নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। যাকে মাসিক প্রশিক্ষণ বলা হতো। কৃষি বিভাগসহ থানা-উপজেলা দপ্তরের অন্যান্য জাতি গঠনমূলক সংস্থাগুলো মাসিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে উদ্ভাবিত-নতুন প্রযুক্তিগুলো নিয়ে হাজির হতো এবং ব্যবহারের কলাকৌশল শিখিয়ে দিত।

চতুর্থ ধাপে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন উন্নত প্রযুক্তিগুলো সংগ্রহ-বিদেশ থেকে আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে সমবায়ী কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করত।

পঞ্চম ধাপে সমবায় সমিতিগুলো কর্তৃক চাহিদাকৃত প্রযুক্তি সংগ্রহের অর্থের জোগান দিত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এ পদ্ধতিতে অর্থাৎ সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে ৮০’র দশকের শেষ দিকে এসে দেশ marginally খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়।
কর্মসূচির অর্জন ভালো দিক
শুরু থেকেই বিআরডিবি (তদানীন্তন আইআরডিপি) পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন-বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে এবং এখনও তাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ সংস্থাটি এরই মধ্যে প্রায় ১০৩টি গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং বর্তমানে ৭টি পল্লী উন্নয়ন ও আইজিএ ভিত্তিক দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প চলমান আছে। বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো থেকে জাতি যে অর্জনগুলো প্রাপ্ত হয়েছে-

ক. বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ ও বিদ্যমান খাদ্য ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে উন্নত চাষ পদ্ধতির প্রচলন অর্থাৎ উচ্চফলনশীল জাতের বীজ, সার ও কীটনাশক এর ব্যবহার, এক ফসলি জমিগুলোকে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দো-ফসলি বা তিন-ফসলি জমিতে উত্তোরণের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ঘাটতি দূর করার মতো সফলতা দেখিয়েছে। ফলে আজ-

সার উৎপাদনসহ বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থা প্রাাইভেটাইজেশন হয়েছে।
উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা প্রাইভেটাইজেশন হয়েছে এবং কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শস্য ক্ষেতে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
সেচ যন্ত্র তৈরি ও বিতরণ ব্যবস্থাতেও প্রাইভেটাইজেশন হয়েছে।

খ. উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ ও সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণের ফলে আজ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। গ্রামীণ জনগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পাওয়ার জন্য শহরের বাজারগুলোতে নিয়ে আসছে। ছোট ও মাঝারি আকারের হাঁস-মুরগরি খামার গড়ে তুলে নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন কৌশল শিখেছে এবং বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ করছে।

এভাবে কৃষকদের যেমন আয় বৃদ্ধি পেয়েছে পাশাপাশি তাদের উৎপাদনের উপকরণের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গড়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান উপকরণ সরবরাহসহ উৎপাদনের জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছে। একদিকে যেমন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্ব-কর্ম  সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি বেসরকারি সংস্থাগুলোতে গ্রামীণ শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে কাজ করে আয় রোজগার করছে। গ্রামীণ বেকারত্ব দূর হচ্ছে। তবে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।

দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য ব্যবসায়িরাও বাণিজ্যিকভাবে হাঁস-মুরগির খামার ও মৎস্য খামার গড়ে তুলেছে। গ্রামে গ্রামে কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটে চলেছে। হাঁস-মুরগির ও মাছের খাবার চাহিদা মিটানোর জন্য খাদ্য তৈরির কারখানাও গড়ে উঠছে। অর্থাৎ গোটা অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে আর্থিক কর্মকাণ্ড (Economic Activities) সৃষ্টি হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রে Value Chain এবং Value addtion এর মতো বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটে চলেছে।

অর্জন : বিপরিত দিক
পরবর্তী সময়ে দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে কখনও কৃষি উপকরণের বিভিন্ন উপ খাতগুলো থেকে ক্রমে ভর্তুকি কমিয়ে সহজ ঋণ আবার কখনও ব্যক্তি মালিকানায় সেচ যন্ত্রের সুবিধা প্রদান সব মিলিয়ে এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি দুর্বলতাগুলোকে পুঁজি করে বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের পরিধি বাড়াতে থাকে। ফলে কৃষির উপকরণসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আমদানিসহ  এগুলোর উৎপাদন ও বিতরণ মুক্তবাজার পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়ার ফলে এবং সর্বোপরি কৃষকদেরও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা নিজেরাই সীমাবদ্ধতার মধ্যে না থেকে আরও উন্নত কৃষি উপকরণ ও উৎপাদন কৌশল খুঁজতে থাকে। ফলে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি উপকরণ ও কৌশল আমদানিসহ স্থানীয় বাজারে বিক্রির ব্যবসা গড়ে তুলে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। দারিদ্র্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতির সেই পুরনো কথা-পুঁজি সেখানেই বেশি বিনিয়োগ হবে যেখানে মুনাফা বেশি হবে।

কিন্তু কৃষির উপকরণ ও কৌশল আমদানি স্থানীয় বাজারে বিপণন এবং রাসায়নিক সারসহ কীটনাশকের অবাধ প্রাপ্যতা এবং অবাধ ব্যবহার, সেচ যন্ত্রপাতি অবাধে বাজারে আনয়ন, সেচযন্ত্র বসানোর নীতিমালার কোনো প্রয়োগ ও কার্যকারিতা না থাকা এবং সেচের পানি ব্যবহারের কোনো জাতীয় সেচ নীতি না থাকার কারণে কৃষি ব্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। এসব কারণে যেমন-

বর্তমান কৃষি ব্যবস্থাকে আর পরিবেশবান্ধব বলা সম্ভব হচ্ছে না।

কৃষি খাত থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা বা তুলে নেয়া এবং উপকরণ আমদানি, উৎপাদন privatization  এর ফলে লাভটাকে  মুখ্য দেখা হচ্ছে। পরিবেশের বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্যিকিকরণের ফলে লাভটা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। Subsistance কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পুষ্টিমানসহ শরীর-স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাবটা কোনোমতেই বিবেচনায় আনা হচ্ছে না।

হাইব্রিড জাত বিদেশ থেকে আমদানিসহ দেশে অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কর্তৃক হাইব্রিড জাতের বীজ উৎপাদনের ফলে গ্রামীণ বীজ শিল্প ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে। ফলে ব্যবসায়িরা অধিক মুনাফার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করে উপকরণের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে কিন্তু কৃষকরা উৎপাদিত মূল্যের যথাযথ মূল্য না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে বর্ধিত উৎপাদনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় কৃষকরা পণ্যের দাম এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

কী করা উচিত
একটু দেরি হয়ে গেছে। কারণ বিআরডিবি কর্তৃক গৃহীত দারিদ্র্যবিমোচনের মিশন-প্রচেষ্টাগুলো fulfil করতে হলে তার Organizational Strategy তে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজির ধার্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের জন্য নতুন organizational Action Plan তৈরি করতে হবে অথবা বিদ্যমান organizational Action Plan টাকে redesign করতে হবে।
দ্বিস্তর সমবায়ের মাধ্যমে বিআরডিবির ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে বাস্তবমুখী প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
কৃষকদের তথা সমবায়ী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য ‘সমবায় বাজারজাতকরণ’ কর্মসূচির ওপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ‘মার্কেটিং সমবায় সমিতি’ গঠন করে  উৎপাদন ও বিতরণ-মার্কেটিংয়ের মধ্যে একটি Chain সৃষ্টি করা উচিত হবে। বাড়তি উৎপাদন সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিআরডিবি-উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিগুলোর বিদ্যমান গোডউনগুলোকে কোল্ডস্টোরেজে রূপান্তর করার উদ্যেগ নেয়া যেতে পারে।

দ্বিস্তর সমবায় ব্যবস্থাকে বর্তমান কৃষি-পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনবান্ধব কর্মসূচির উপযোগী করার লক্ষ্যে কুমিল্লা মডেলটাতে কিছু  Adjustment আনা যেতে পারে। এতে দ্বিস্তর সমবায় ব্যবস্থার মূল theme এর কোনো বিকৃতি ঘটবে না।

সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষিঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ (Micro Investment) কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষিবান্ধব পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচন পদক্ষেপ বা কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।

বিআরডিবিকে জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি এবং রূপকল্প-২০২১ এর আলোকে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করে যেতে হবে।

পরিবর্তিত গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে সদর দপ্তরের কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগী করে তুলতে হবে।

কেবল কর্মকর্তা না হয়ে Process Facilitator এর ভূমিকা পালনের মানসিকতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ও গতানুগতিক তথ্য প্রবাহ ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করতে হবে।

জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উন্নয়ন কর্মকা-গুলোকে অতি দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও সমাধান দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

শেষ কথা
এ প্রবন্ধে যে Adjustment এর কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ‘কুমিল্লা মডেল’ এর পল্লী উন্নয়ন কৌশলের  দ্বিস্তর সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে Group Approach এর কথা বলা হয়েছে তার ওপর। কুমিল্লা মডেলের এ শিক্ষাটাকে ধারণ করে এবং কিছু Adjust করে (অর্থাৎ সমবায়টাকে পাশ কাটিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক দল গঠনের মাধ্যমে) এনজিওগুলো ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তবে এনজিওরা যে সফল হয়েছে সে কথাও বলা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের কাজের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

আবার আমি এটাও বলতে চাচ্ছি না যে, কুমিল্লা  মডেলের দ্বিস্তর সমবায় ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিস্তর সমবায় ব্যবস্থা সফল হয়েছে এবং একটা সময় পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেগুলো বিবেচনায় অবশ্যই আনতে হবে। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে পরিবেশের বিপর্যয়টাকে আমার বিবেচনায় আনার প্রস্তাব।

সুতরাং আমার প্রস্তাবটা হচ্ছে ষাটের দশকে উদ্ভাবিত পল্লী উন্নয়ন মডেলটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুক কার্যকরভাবে কাজ করছে? কোনো সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। সমন্বয়ের প্রয়োজন থাকলে কোনো কোনো ইস্যুতে সমন্বয় ঘটাতে হবে হতে পারে এগুলো চিহ্নিত করে জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজির দারিদ্র্যবিমোচন টার্গেটগুলো  এবং রূপকল্প-২০২১ এর আলোকে Action Plan তৈরি এবং জাতীয় অর্জনে কতটুকু অবদান রাখা সম্ভব হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে স্থির করে কাজ করে যাওয়া।
 
কৃষিবিদ খুরশীদ আলম*
* যুগ্ম পরিচালক (আরইএম), বিআরডিবি, ঢাকা
বিস্তারিত
দেহের জন্য আমিষের গুরুত্ব ১৪২১
আমিষ আমাদের খাদ্যের ছয়টি উপাদনের একটি। এটি হলো সব জীবের মুখ্য উপাদান। ২০টি বিভিন্ন রকম এমিনো এসিডের নানা রকম সমন্বয়ে গঠিত হয় এক একটি আমিষ। অধিকাংশ আমিষে ১০০ থেকে ১০০০টি এমিনো এসিড থাকে। এর অর্থ হলো ২০টি এমিনো এসিডের বহু রকম সংযোগ তৈরির সুযোগ আমিষে থাকে। আমাদের খাদ্যে আমিষ এবং গুণমান সম্পন্ন আমিষের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আমিষ ঘাটতির কারণ একাধিক। আমিষ প্রধান খাদ্যের দাম অধিক হওয়ায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বা ডাল জাতীয় দানা শস্য তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। ফলে খাদ্যে আমিষ ঘাটতি হওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ভাত, আটা এসব শর্করা প্রধান খাদ্য থেকে আমাদের শতকরা ৬০ ভাগেরও অধিক আমিষ গ্রহণ করতে হয়। এদের প্রতিটির আমিষে এক বা একাধিক এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকায় এরা শতভাগ পরিপূর্ণ গুণমান সম্পন্ন আমিষ নয়। ফলে একদিকে আমাদের খাদ্যে যেমন আমিষের ঘাটতি রয়েছে অন্যদিকে আমাদের খাদ্যের মাধ্যমে গৃহীত আমিষে অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকায় সুষম আমিষ গ্রহণ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

আমাদের দেহে আমিষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলো হলো
আমিষ এনজাইমে রূপান্তরিত হয় আর এনজাইম কোষে সংঘটিত সব বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে
আমিষ কোষের গাঠনিক উপাদান
আমিষ DNA ও RNA তৈরির জন্য এমিনো এসিড সরবরাহ করে
কোষের নানা রকম কার্যাবলির নিয়ন্ত্রক
দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আবশ্যিক উপাদান
রক্ত ধারায় প্রবাহিত অক্সিজেনের বাহক
কখনও কখনও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে
আমিষ দেহের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়।

গাছ গাছালি স্বভোজী জীব হিসেবে সালোকসংশ্লেষণের সময় ধারণকৃত কার্বন এবং মাটি থেকে গৃহীত নাইট্রোজেন এবং সালফারকে কাজে লাগিয়ে আমিষ তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সব এমিনো এসিড তৈরি করতে সক্ষম। মানুষ নিজ দেহে তৈরি করতে পারে মাত্র ১১টি এমিনো এসিড। তার সঙ্গে মানুষকে খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয় ৯টি এমিনো এসিড (সারণি-১)। অবশ্য হিস্টিডিন শিশুদের জন্য এক অত্যাবশ্যক এমিনো এসিড। এ ৯টি এমিনো এসিড তাই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক । দৈনিক অত্যাবশ্যকীয় আমিষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয় লিউসিন আর ফ্যানাইল এলানিন। প্রতি কেজি ওজনের জন্য এদের প্রয়োজন ১৬ মি.গ্রা. করে। এরপরই হলো ভ্যালিন, আইসোলিউসিন আর লাইসিনের স্থান। প্রতি কেজি ওজনের জন্য থ্রিওনিনের চাহিদা হলো ৮ মি.গ্রা. আর ট্রিপটোফ্যানের চাহিদা মাত্র ৩ মি.গ্রা.।


সারণি-১: অত্যাবশ্যক ও অনত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের তালিকা

অত্যাবশ্যক        প্রতিদিন প্রতি কেজি        অনত্যাবশ্যক
এমিনো এসিড     ওজনের জন্য (মি.গ্রা.)     এমিনো এসিড
হিস্টিডিন                     এলানিন
আইসোলিউসিন   ১২   এস্পারজিন
লিউসিন           ১৬    এস্পারটিক এসিড
লাইসিন            ১২    আর্জিনিন
মিথিওনিন         ১০    সিস্টিন
ফ্যানাইল এলানিন  ১৬   গ্লুটামিক এসিড
থ্রিওনিন             ৮    গ্লুটামাইন
ট্রিপটোফ্যান        ৩    গ্লাইসিন
ভ্যালিন             ১৪   প্রোলিন
                            সেরিন
                            টাইরোসিন
খাদ্যের আমিষের প্রধান উৎস হলো দানাশস্য, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ। এদের মধ্যে আমিষের মাত্রার তারতম্য রয়েছে। দানা শস্যের আমিষের পরিমাণ শতকরা ৬-১২ ভাগ যা ডাল শস্যে ২০-২৫ ভাগ। মাছ, মাংস, ডিম ও দুধে আমিষের পরিমাণ যথাক্রমে শতকরা ১৮-২৫, ১৬-২৫, ১০-১৪ এবং ৩-৪ ভাগ (সারণি-২)। সাধারণ ভাবে আমিষের উৎস হিসেবে প্রাণিজ আমিষ উদ্ভিজ্জ আমিষের চেয়ে উৎকৃষ্ট। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ফসলের কোনো কোনোটাতে কোন কোন অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ঘাটতি রয়েছে। কোন কোন ফসলে আবার কোন কোন অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের প্রাচুর্যতাও রয়েছে।

উদ্ভিদজাত খাদ্যে আমিষের পরিমাণ বেশ ভালো। তৈল বীজে আমিষের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগের অধিক। এদের আমিষে কোন কোন এমিনো এসিডের অনেক কমতি থাকায় এরা আমিষের উত্তম উৎস নয়। মাছ মাংসে আমিষের পরিমাণ শতকরা ১৬-২৫ ভাগ। কিন্তু এদের আমিষে সব রকম এমিনো এসিডই বেশি পরিমাণে থাকায় এরা আমিষের উত্তম উৎস।

সারণি-২: বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ খাদ্যে আমিষের পরিমাণ

উদ্ভিদজাত    আমিষ (%)    প্রাণিজাত     আমিষ (%)
দানাশস্য       ৭-১৫              ননীযুক্ত দুধ     ৩-৪
ডাল বীজ      ২০-২৫             ডিম            ১০-১৪
তৈল বীজ      ৪৫-৫৫             মাংস (লাল)   ১৬-১২
(চর্বি বিযুক্ত)   
গাঢ় তৈল       ৬০-৮০           মাছ            ১৮-২৫
(সয়, তুলা বীজ)   
বিশ্লিষ্ট তৈল      ৯০-৯৫         মাংস (মুরগি)   ২০-২৫
(সয়, গম)   
পত্রল সবজি       ১-২        চর্বিযুক্ত শুকনো দুধ   ৩৬

অধিকাংশ দানাদার খাদ্যে এক বা একাধিক অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ঘাটতি রয়েছে। ভুট্টাতে যেমন আইসোলিউসিন এবং লাইসিনের ঘাটতি রয়েছে অন্যদিকে এদের মধ্যে প্রচুর রয়েছে মিথিওনিন এবং ট্রিপটোফ্যান। সয়াবিনের দানায় আবার প্রচুর আইসোলিউসিন আর লাইসিন রয়েছে কিন্তু এদের দানায় ঘাটতি রয়েছে ট্রিপটোফ্যান এবং মিথিওনিন। প্রাণীজ আমিষেও কোন কোন এমিনো এসিডের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও সবগুলো এমিনো এসিডই মোটামুটি ভালো পরিমাণে বিদ্যমান থাকে বলে মাছ, মাংস, ডিম এসব আমিষের উত্তম উৎস (সারণি-৩)। যদিও এমনকি দুধ, মাছ এবং মাংসেও কোন কোন এমিনো এসিডের কমতি রয়েছে। দুধে মিথিওনিন আর সিস্টিনের কমতি রয়েছে। অন্যদিকে মাছে কমতি রয়েছে ট্রিপটোফ্যানের। মাংসে আবার দুধের মতোই খানিকটা কমতি রয়েছে মিথিওনিন ও সিস্টিনের (সারণি-৪)।

উদ্ভিজ্জ আমিষে এক বা একাধিক অত্যাবশ্যকীয় এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকায় এদের আমিষ মান উন্নত নয়। পুষ্টিবিদরা বিভিন্ন উৎসের আমিষের মধ্যে তুলনা করে একটি আমিষ মান নির্ধারণ করেছেন। মুরগির ডিমে বিদ্যমান রয়েছে সবগুলো অত্যাবশ্যকীয় এমিনো এসিড এমন মাত্রায় যা মানুষের সব প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম বলে এর মান নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০। যেসব আমিষ উৎসের মান ৭০ এর নিচে এরা স্ব স্ব আমিষ দিয়ে মানুষের সব প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। যেসব মানুষ দানা শস্যজাত খাদ্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল এবং তাদের খাদ্যে যদি বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে খাদ্য যোগ না হয় তবে তাদের মধ্যে কোন না কোন এমিনো এসিডের ঘাটতি থাকা খুবই স্বাভাবিক। ফলে উদ্ভিজ্জ খাদ্যের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের অবশ্যই নানা উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। দানা শস্যজাত খাদ্যের সঙ্গে তাদের মেশাতে হবে অবশ্যই ডাল শস্যজাত খাবার। যত ভিন্ন রকম উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করা সম্ভব হবে তত তা দেহের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। ডিম ছাড়া এমনকি এমিনো এসিডের কমতি রয়েছে দুধ, মাছ এবং মাংসেও (সারণি-৪)।

আমিষের পুষ্টিমান নির্ভর করে অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের ওপর। যে আমিষে অত্যাবশ্যক এমিনো এসিডের মাত্রা মানুষের দেহের চাহিদার যত কাছাকাছি সে আমিষের পুষ্টি মূল্য তত বেশি। আমিষের জৈব মান দিয়ে এর পুষ্টি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কোন আমিষ থেকে দেহ বিশোষিত নাইট্রোজেনের যতভাগ কাজে লাগতে পারে সেটি হলো এর জৈবিক মান। যে আমিষের জৈবিক মান ১০০ সে আমিষকে আদর্শ আমিষ বলা হয়। সাধারণভাবে উদ্ভিজ্জ আমিষের তুলনায় প্রাণিজ আমিষের জৈবিক মান বেশি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক আমিষের অনুমোদিত মাত্রা হলো ৩৩-৬৬ গ্রাম। সহজ হিসেবে প্রতি ১ কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল পরিণত মানুষের জন্য ০.৮-১.০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করা উচিত। গর্ভবতী মহিলা আর দুগ্ধদানকারী মায়েদের কিছুটা বাড়তি আমিষ চাহিদা পূরণ করতে হয়। গর্ভবতী মহিলার জন্য এবং ৭-১২ মাস বয়সী শিশুর মায়ের জন্য স্বাভাবিক আমিষের সঙ্গে বাড়তি দৈনিক ১৩-১৪ গ্রাম আমিষ যোগ করতে হয়। তবে শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মূলত মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় বলে মায়ের জন্য বাড়তি দৈনিক ১৯ গ্রাম আমিষ যোগ করতে হয়।

দেহের ওজন ভেদে আমিষের চাহিদা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সহজ হিসেবে প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮৩ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করা উচিত। এফএও কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা মতে এদেশের শতকরা ৬৬ ভাগেরও অধিক মানুষ প্রতিদিন ৫০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করে। তবে এখানে শতকরা ১০ ভাগ মনুষ ৪০ গ্রামের কম আমিষ গ্রহণ করে। গড়ে এদেশের মানুষের আমিষ গ্রহণের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার বেশ কাছাকাছি। তবে সমস্যা এ যে, আমাদের দেশে শতকরা ৭৫ ভাগ আমিষ মানুষ গ্রহণ করে ফসলজাত খাদ্য থেকে। দানা শস্যজাত আমিষের তত উন্নত নয় বলে মানুষের অত্যাবশ্যকীয় এমিনো এসিডের ঘাটতি ঘটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ডাল গ্রহণের মাত্রা কিছুটা বাড়লে ঘাটতি বেশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন এদেশে ডাল গ্রহণের দৈনিক মাত্রা মাত্র ১৪ গ্রাম যা কেবল চাল থেকে গৃহীত শতকরা ২৫ ভাগ আমিষের গুণমান বৃদ্ধি করে থাকে।

ইদানীংকালে পরিচালিত গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, গর্ভবতী মহিলা যদি প্রয়োজনীয় পরিমাণ আমিষ গ্রহণ না করতে পারে তবে সন্তানের ধীমান বেশ ধীরে বিকশিত হয়। শিশু জন্ম নেয়ার পর যতদিন দুগ্ধ পান করে ততদিন মায়ের খাদ্যের আমিষ সরবরাহ করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হয় শিশুটির স্বার্থেই। সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় কেবল বাড়তি আমিষ নয় বরং গর্ভবতী মহিলাকে বাড়তি ক্যালরি, অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন আর খনিজ দ্রব্যও সরবরাহ করতে হয়।

খাদ্যে আমিষের ঘাটতিজনিত কারণে শিশুদের এক রকম রোগ হয়। একে গা ফোলা রোগ বা কোয়াশিওরকর রোগ বলা হয়। বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ হওয়ার পর একাধারে স্টার্চ প্রধান খাবার খাওয়ানোর ফলশ্রুতিতে এ রোগ দেখা দেয়। গোড়ার দিকে এ ধরনের রোগীর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও ওজন হ্রাস পায়। হাত-পায়ের গিঁট বা সম্পূর্ণ দেহ ফুলে যেতে পারে। চেহারায় পা-ুরতা ফুটে ওঠে এবং হিমোগ্লোবিন উৎপাদন হ্রাস পায়। এ ধরনের রোগীর পাতলা পায়খানা হতে পারে এবং বদহজম দেখা দিতে পারে। মলের সঙ্গে আধা হজম খাদ্যও বের হয়ে আসতে পারে। এসব রোগীর অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে। ক্ষুধামন্দা, চুল বিবর্ণ হওয়া, চুল আলগা হয়ে যাওয়া, ত্বকে বাদামি কালো বর্ণের দাগ ইত্যাদি লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে পায়ের পাতা ফোলা এবং বমি অন্যতম প্রধান লক্ষণ। আমিষের অভাবে শিশুদের মস্তিষ্ক  ঠিকমতো বিকাশ লাভ করতে পারে না। অবস্থা খারাপ হলে শিরার ভেতর দিয়ে স্যালাইন দিয়ে এর নিরাময়ের কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। অবশ্য মুখ দিয়ে স্যালাইন খাবার উপযোগী হলে তা মুখে খাওয়ানোই উত্তম। আমিষের ঘাটতির কারণে এ রোগ দেখা দেয় বলে সহজে হজম করতে পারে তেমন তরল খাবার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রথমে পানি মেশানো দুধ এবং আস্তে আস্তে পানির পরিমাণ কমাতে কমাতে স্বাভাবিক দুধ পান করতে দিতে হবে। রোগীর হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে কঠিন খাবার যেমন- ডিম, নরম মাংস, দানা জাত খাদ্য, সবজি, ফল বা ফলের রস খাওয়ানো যেতে পারে। ডাল-ভাত মিশিয়ে খেলে আমিষের ঘাটতি সহজেই পূরণ হতে পারে। বেশ কিছুদিন এভাবে খাওয়ালে আর যত্ন নিলে ধীরে ধীরে এ রোগের উপশম হয়ে থাকে।

ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া
* প্রফেসর, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭
বিস্তারিত
পারিবারিক পুষ্টির জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য অপরিহার্য
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে খাদ্যের গুরুত্ব সর্বাধিক। খাদ্য আমাদের ক্ষুধা  নিবৃত্তি, পুষ্টিসাধন ও স্বাস্থ্য রক্ষা করে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রকৃতির পরিচর্যা এবং সবার জন্য খাদ্য’। এ দেশে প্রত্যেকটি পরিবারে শিশু, কিশোর, গর্ভবতী-স্তন্যদানকারী মা ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ বাস করে। তাদের প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে সুষম খাদ্যের প্রয়োজন হয়। পরিবারের পুরুষরা উপার্জনের জন্য বাড়ির বাহিরে বিভিন্ন কাজ করেন এবং মহিলারা সবার জন্য খাদ্য তৈরি ও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। গ্রামীণ মহিলাদের বাড়ির বাইরে উপার্জনের সুযোগ খুব কম। তাই পারিবারিক পুষ্টি উন্নয়নের জন্য মহিলারা সাংসারিক কাজের ফাঁকে পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির আশপাশে সবজি-ফল বাগান ও হাঁস-মুরগি পালন করে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এতে পারিবারিক পুষ্টির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বাড়বে, সারা বছর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনের ফলে পরিবারের সদস্যদের ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদানের চাহিদা পূরণ হবে ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধি  পাবে। তাদের উৎপাদনের বাড়তি অংশ বিক্রি করে পরিবারের জন্য প্রধানতম খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ দেশের মানুষের পুষ্টির জন্য যেসব খাদ্য উৎপাদন করা হয় তার সবটাই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত এবং বাজারজাতের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে বিষমুক্ত ও ভেজালমুক্ত খাদ্য সহজলভ্য করা সম্ভব হয় না। বর্তমানে সর্বোচ্চ পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন এবং খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহƒত হয়। প্রায় ৭৫% ভাগ খাদ্য উৎপাদনের সময় মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক এবং মাত্র ২৫% ভাগ খাদ্য সংরক্ষণ, বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ফরমালিন ও অন্যান্য বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। ধান, শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য ফসলের পোকা-রোগ দমনে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক এবং কাঁচা ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোপেন ও রাইপেন ব্যবহার হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সবজি-ফল মাঠে থাকা অবস্থায় পোকা-রোগ দমনে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক, সংগ্রহোত্তর পাকার জন্য কার্বাইড এবং পচনরোধের জন্য ফরমালিন ব্যবহারের কারণে এসব ফসল বিষটোপে পরিণত হয়। তাই এগুলো খাওয়ার সঙ্গে কিছু পরিমাণ বিষ খাওয়া হয়। জৈব কৃষিকে অবহেলা করে রাসায়নিক কৃষির ওপর অধিক জোর দেয়ার কারণে খাদ্যের বিষাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসায়নিক পদ্ধতিতে ফসল চাষের সময় কৃষকের অজ্ঞতার কারণে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে খাদ্যের মধ্যে কিছু বিষাক্ত পদার্থ থেকে যায় যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা অধিকাংশ ফল টাটকা এবং কিছু সবজি কাঁচা অবস্থায় সালাদ হিসেবে ও সব ধরনের শাকসবজি অল্প আঁচে রান্না করে খাই। এ কারণে বালাইনাশক প্রভাবের ঝুঁকি অনেক বেশি। অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে মাটিদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও খাদ্যদূষণ হচ্ছে। এছাড়াও মাটির  অভ্যন্তরের অনুজীবের কার্যাবলি লোপ পাচ্ছে। উপকারী  পোকামাকড়, কেঁচো, ব্যাঙ, গুইসাপসহ নানা ধরনের জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। এতে কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে স্বল্পস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। স্বল্পস্থায়ী প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, অরুচি, বমিভাব, মাথাধরা ও শরীর দুর্বল ইত্যাদি লক্ষণ এবং মাস বা বছর পরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে চর্ম রোগ, বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি, স্নায়ু-বৈকল্য, ক্লোন রেক্টাল, কিডনিজনিত সমস্যা, প্রস্টেট, যকৃত, ফুসফুস ও পাকস্থলী ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবারের শিশু ও ছোট ছেলেমেয়েরা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ফসলে ব্যবহারের জন্য স্বল্পস্থায়ী, মধ্যস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের বিভিন্ন গ্রুপের বালাইনাশক রয়েছে। এগুলো ফসলের ধরন, জীবনকাল ও পারিপার্শি¦ক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকদের বালাইনাশক এবং এর বিষক্রিয়া প্রভাব সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকার কারণে তারা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কীটনাশকগুলো এলোপাতাড়িভাবে শাকসবজি ও ফলে স্প্রে করে যা ঠিক নয়। তারা প্রয়োজনের তুলনায় ততধিকবার অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ বার স্প্রে করে। অনেক সময় দেখা যায়, স্প্রে করার কয়েক ঘণ্টা পর বাজারে বিক্রয় করে। এসব কারণে খাদ্য বিষাক্ত হয়। ভোক্তারা না জেনে এসব বিষাক্ত পণ্য ক্রয় করে এবং খাওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। কৃষকের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার খেসারত ভোক্তাকে দিতে হয়। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে এর অপব্যবহার রোধ করা হয়তোবা সম্ভব হবে। কিন্তু ফসলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার রোধের উপায় কী? এ বিষয়ে সবার চিন্তাভাবনা করা উচিত। প্রতি বছর ফসলে ব্যবহারের জন্য প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়। এ বিশাল পরিমাণ কীটনাশক পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত চালের মান নিয়ে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির একটি গবেষণা প্রতিবেদন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের চালের মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি অতিমাত্রায় রয়েছে। এ বিষাক্ত রাসায়নিক ক্যাডমিয়াম মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান যেমন- কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের ক্ষতি করে। বাংলাদেশের চাল ছাড়াও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের মধ্যেও ক্যাডমিয়ামসহ অন্যান্য উপাদান রয়েছে যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রতি বছর প্রায় ২৭০ থেকে ২৮০ টন ফরমালিন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ১০০ টন ফরমালিন বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা, ট্যানারি, প্লাস্টিক, ফরমিকা শিল্প, হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারে এবং অবশিষ্ট প্রায় ১৮০ টন খাদ্যসামগ্রীর পচনরোধে ব্যবহৃত হয়। ফরমালিন ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে অমদানি অনেকটা কমেছে। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য সহজলভ্য করার বিষয় সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হলো-  

ক. জৈব ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন
১. জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার : জৈব সার তৈরির জন্য বাড়ির পাশে একাধিক গর্ত তৈরি করে রৌদ্র ও বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য উপরে চালা দিতে হবে। এসব গর্তে গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ছাই, লতাপাতা, সবুজ সার, কচুরিপানা, ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ, রান্নাঘরের আবর্জনা ইত্যাদি স্তরে স্তরে জমা করে ভালোভাবে পচাতে হবে। তারপর ফসলের জমি তৈরির সময় জৈব সারগুলো ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে রোগবালাই মুক্ত উন্নতমানের বীজ-চারা সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগাতে হবে। শোধনকৃত বীজ ও নিঃরোগ, সুস্থ-সবল চারা লাগাতে হবে। সাধারণ জৈব সারের পাশাপাশি ভার্মি কম্পোস্ট ও  ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করে ফসলের ফলন আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। বিশেষ প্রজাতির লাল রঙের কেঁচোকে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে গোবর-জৈব বর্জ্যরে মধ্যে লালন পালন করে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। কেঁচোগুলো গোবর-বর্জ্য থেকে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে থাকে এবং অল্প সময়ে বংশ বিস্তার ও প্রচুর মল ত্যাগ করে। কেঁচোর এ মলগুলোই মূলত ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট। ট্রাইকো কম্পোস্ট এক ধরনের অনুজীব দ্বারা বিশেষ প্রক্রিয়ায় গোবর পচিয়ে তৈরি করা যায়। এ অনুজীবগুলো গোবর থেকে খাদ্য গ্রহণ ও পচনক্রিয়ার মাধ্যমে কম্পোস্ট তৈরি করে। অধিক হারে জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার কম লাগে, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়।

২. ফসলের পোকামাকড় দমন : প্রথম গভীর চাষের মাধ্যমে জমির মাটি উলট-পালট করে ভেতরের পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু ধ্বংসের জন্য কয়েক দিন রৌদ্রে শুকিয়ে অথবা সম্ভব হলে খড়-কুটা দ্বারা আগুন জ্বালিয়ে শোধন করতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে বালাই সহনশীল জাতের ফসল চাষাবাদ করতে হবে। পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল ধবংসের জন্য ফসলের মাঠ-বাগানের ভেতর ও চারপাশের অবাঞ্ছিত আগাছা, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। পোকা আক্রান্ত পাতা, শাখা-প্রশাখা ও ফল মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। পোকা, লার্ভা ও ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। ফসলের মাঠ বা বাগানের কিছু দূরে ফাঁকা স্থানে রাত্রি বেলায় বাতি জ্বালিয়ে নিচে কেরোসিন মিশ্রিত পানি রেখে দিলে পোকামাকড় বাতির পাশে আসবে ও কেরোসিন মিশ্রিত পানিতে পড়ে মারা যাবে। ফলের মাছি পোকা দমনের জন্য একটি মাটির পাত্রে ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টিকুমড়া পিষিয়ে ২ গ্রাম ডিপটেরেক্স বা কয়েক ফোঁটা নগস মিশিয়ে বিষ টোপের পাত্রটি একটি খুঁটির মাথায় আটকিয়ে বাগানের এক পাশে স্থাপন করতে হবে। এতে বিষ টোপের ফাঁদে মাছি আকৃষ্ট হয়ে মারা যাবে। প্রয়োজনে হাত জাল-মশারি দিয়ে পোকা দমন করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে সফলভাবে পোকা দমন করা যায়। উপকারী পোকা-প্রাণী, যেমন- লেডি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, মাকড়সা, পিঁপড়া, বোলতা, প্রেইং-মেন্টিড, মিরিড বাগ, ড্যামসেল ফড়িং, ট্রাইকোগামা, ব্যাঙ, গুইসাপ, সাপ ও ব্যাঙ ক্ষেতের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। এরা ক্ষতিকারক পোকার ডিম, পুত্তলি, কীড়া ইত্যাদি খেয়ে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করবে। পাখিরা পোকা খায় তাই বাগানের বিভিন্ন স্থানে পাখি বসার জন্য বাঁশের কঞ্চি-ডাল পুঁতে দিতে হবে। বোলতা পোকা খায় তাই বাগানের বিভিন্ন স্থানে বোলতা প্রতিপালনের জন্য বাঁশের বুস্টার স্থাপন করতে হবে। এভাবে পোকার উপদ্রব অনেক হ্রাস পাবে। উল্লিখিত পদ্ধতিতে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে বিভিন্ন ধরনের জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, যেমন- জাব পোকা ও পিঁপড়া দমনের জন্য ১ ভাগ আতা পাতা-বীজ ভালোভাবে পিষে ৫ ভাগ (১:৫) পানির সহিত মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে, তারপর কাপড় দ্বারা ছেঁকে নির্যাস তৈরি করে সঙ্গে সঙ্গে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। বিটল, মাছি, কীড়া ও বিছাপোকা দমনের জন্য ১/২ কেজি দেশি নিম বীজ-পাতা মিহি গুঁড়া করে ২ লিটার পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পর দিন কাপড় দ্বারা ছেঁকে নির্যাস তৈরি করে, তারপর ওই দ্রবণের সঙ্গে আরও ১০ লিটার পানি মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। মাজরা পোকা, জাব পোকা, কীড়া, উঁইপোকা ও পাতা ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য ২৫০ গ্রাম তামাক পাতা-ডাঁটা ৪ লিটার পানিতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সিদ্ধ করে (৩ থেকে ৪ দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে) ছেঁকে নিয়ে আরও ৪ লিটার পানি মিশিয়ে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের মাছি, কীড়া ও জাব পোকা  দমনের জন্য ১ কেজি বিষকাটালি পাতা-কাণ্ড পিষে ১০ লিটার পানিতে কিছু সময় রেখে কাপড় দ্বারা ছেঁকে নির্যাস তৈরি করে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। পিঁপড়া ও জাব পোকা দমনের জন্য ১০ গ্রাম মরিচ গুঁড়া ১ লিটার পানিতে গুলিয়ে এক রাত রেখে কাপড় দ্বারা ছেঁকে আরও ৫ লিটার সাবানের ফেনাযুক্ত পানি মিশিয়ে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। জাবপোকা, মিলিবাগ, কীড়া, মোজাইক ভাইরাস দমনের জন্য গোচনা সংগ্রহ করে পাত্রে রেখে মুখ বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস প্রবেশ না করে এভাবে ২ সপ্তাহ রেখে ১ ভাগ গোচোনা ১ থেকে ২ ভাগ পানির সঙ্গে মিশিয়ে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে পোকা দমন হবে। পামরি পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, বাদামি ঘাস ফড়িং ও সবুজ পাতা ফড়িং দমনের জন্য ৩% নিম তেল, বিষকাটালি, ধুতুরা, বনকলমি পাতার নির্যাস বা বীজের গুঁড়া ১:১০ অনুপাতে মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। গুদামজাত শস্যের পোকা দমনের জন্য বিষকাটালি, নিম ও নিসিন্দার শুকনো পাতার গুঁড়া মিশিয়ে দিতে হবে।

৩. ফসলের রোগ দমন : ছত্রাকজনিত রোগ দমনের জন্য মাটির পাত্রে ১২ গ্রাম কপার সালফেট ৪০০ মিলি লিটার পানির সহিত ভালোভাবে মিশিয়ে অন্য আরেকটি মাটির পাত্রে ১২ গ্রাম চুন ৪০০ মিলি লিটার পানির সহিত ভালোভাবে মিশাতে হবে। তার পর উভয় পাত্রের মিশ্রন তৃতীয় একটি পাত্রে একত্রিত করে আরও ২০০ মিলিলিটার পানি মিশিয়ে ১ লিটার দ্রবণ তৈরি করে ফসলের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

উপরোল্লিখিত পদ্ধতিগুলোর সাহায্যে ক্ষতিকারক পোকামাকড় এবং রোগের আক্রমণ দমিয়ে রাখা যদি সম্ভব না হয় তখন সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে আক্রান্ত জমিতে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। স্প্রে করার পর বালাইনাশকের প্রভাব বা বিষক্রিয়া শেষ হলে তবে মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে, যেন খাওয়ার পর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি না হয়।
 
খ. খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণ : দই-মিষ্টি, আইসক্রিম, চকোলেট, সেমাই, ঘি ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য রঙিন করার জন্য ফুড কালারের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে বস্ত্র শিল্পের রঙ। মুড়ি সাদা ও বড় করার জন্য ইউরিয়া-হাইড্রোজের ব্যবহার এবং নিম্নমানের পণ্য দ্বারা ভেজাল সেমাই ও  ঘি তৈরি হচ্ছে। ভোজ্যতেল, মসলা-হলুদ-মরিচের গুঁড়ায় ভেজাল মিশ্রণ, কিছু সবজিতে রঙ এবং মাছ, মাংস, দুধ ও ফলমূলে ফরমালিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও দেশের অধিকাংশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং বেকারিগুলোতে ভেজাল, পচা-বাসি ও নিম্নমানের খাদ্য বিক্রয়ের কারণে লাখ লাখ পরিবারের মানুষ পেটের পীড়া, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, আমাশয়, ডায়রিয়া, ফুডপয়জনিং, কলেরা, জন্ডিস ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত সাতটি কারণে খাদ্য বিষাক্ত হচ্ছে- ১. ফসলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার। ২. কাঁচা  ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড, ইথোফেন, রাইপেন ব্যবহার। ৩. খাদ্যের পচনরোধে ফরমালিন ব্যবহার। ৪. খাদ্য রঙিন ও আকর্ষণীয় করার জন্য টেক্সটাইল-ট্যানারির রঙ ব্যবহার। ৫. হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং বেকারিগুলোতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাদ্য তৈরি। ৬. ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য দিয়ে  খাদ্য তৈরি ৭. পচা-বাসি ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বাজারজাত। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোনো ধরনের পচা-বাসি, মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্য নীরব ঘাতক। খাদ্যের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি জানার জন্য ডিজিটাল মেশিন ও কীট বক্স রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, বণিক সমিতি ও সমগ্র দেশের হাটবাজার কমিটির কাছে এ মেশিন সরবরাহ করে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 
     
গ. নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য সহজলভ্য করার উপায় :
১. জৈব উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ না করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের  উৎসাহী করতে হবে। ২. পারিবারিক এবং বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে গোবর-বিষ্ঠা উৎপাদন ও ফসলের জমিতে ব্যবহার করে রাসায়নিক সারের ওপর চাপ কমাতে হবে। ৩. প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে সাধারণ/ভার্মি-ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও জমিতে ব্যবহার করতে হবে। ৪. জৈব বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহারের জন্য কৃষকদের আগ্রহী করতে হবে। ৫. বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের আইপিএম প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ এবং কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ৬. ফসল উৎপাদনের সময় এবং সংগ্রহোত্তর ধাপ, যেমন- প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, পরিবহন, বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য তৈরিসহ প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিষমুক্ত করতে হবে। ৭. খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে বাজার মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট বসাতে হবে। ৮. ভেজাল প্রদানকারী অপরাধীকে প্রচলিত আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৯. খাদ্যের কেমিক্যাল শনাক্তকরণ মেশিন স্বল্প মূল্যে বাজারজাত, মেশিন ক্রয়ে ভ্যাট প্রত্যাহার ও ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ১০. ফরমালিন আমদানি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রণীত আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ১১. খুচরা বাজারে ফরমালিন বেচা-কেনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ১২. বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যগুলো চোরা পথে দেশের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্ত পথে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে ১৩. খাদ্যের নমুনা পরীক্ষার জন্য ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করতে হবে। ১৪. বিষাক্ত কেমিক্যালের ক্ষতিকারক দিকগুলোর ওপর ভিত্তি করে ডকুমেন্টারি ফ্লিম তৈরি করে রেডিও ও টিভি চ্যানেল প্রচার করতে হবে। ১৫. ভোক্তা সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব) শক্তিশালী করার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ১৬. সরকারের একার পক্ষে ভেজালবিরোধী অভিযান সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বিধায় জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার জন্য সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মাঠ দিবস ইত্যাদি আয়োজন করতে হবে। ১৭. হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাদ্য তৈরি এবং ধূলা-বালি, মাছি, রোগ-জীবাণু ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষার জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও পচা-বাসি, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বাজারজাত বন্ধের লক্ষ্যে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৮. বাজার থেকে ক্রয়কৃত সবজি ফল বিশুদ্ধ পানিতে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে বা বেসিনে রেখে ট্যাপের পানি ছেড়ে দিলে বিষাক্ত কেমিক্যাল অপসারণ হয়। ফল খাওয়ার আগে স্বল্পমাত্রা গরম পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে বা ছাল ছাড়িয়ে খেলে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ঝুঁকি কমে যায়।
 

কৃষিবিদ এসএইচএম গোলাম সরওয়ার
* লেখক : ফার্ম সুপারিনটেনডেন্ট (পিএইচডি ফেলো), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর, ফোন-০১৭১৩১৬৩৩৬৫
বিস্তারিত
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে পারিবারিক খামার
১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে পারিবারিক কৃষি : প্রকৃতি সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য (Family Farming: Feeding the world, caring for the earth.) অর্থাৎ পৃথিবীকে যত্নে রেখে পারিবারিক খামারের মাধ্যমে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন। এ প্রতিপাদ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক খামারে শাকসবজি, ফলমূল, ফসল, গৃহপালিত পাখি, গৃহপালিত পশু, মাছ ইত্যাদি কৃষি পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা। তবে শর্ত হচ্ছে পৃথিবীর পরিবেশ যেমন- মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি সুস্থ রাখতে হবে। মূল বিষয় হচ্ছে- পারিবারিক অর্গানিক ফার্মিংয়ের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০১৪ সনকে পারিবারিক খামার বর্ষ ঘোষণা করেছে। ক্ষুধামুক্ত ও সুস্থ মানুষ দিয়ে বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে (FAO) এর জন্মকাল ১৯৪৫ সন থেকে ১৬ অক্টোবরকে স্মরণ করে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করছে। বিশ্বের সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতার  মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্রতি বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে। বাংলাদেশেও কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে।
 
খাদ্য নিরাপত্তা
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (১৯৯৬) মতে, খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে- সব মানুষের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার বিপরীতে পছন্দমতো পর্যাপ্ত নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির বাস্তব ও আর্থিক ক্ষমতা থাকা। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে কি না বোঝার উপায় হচ্ছে- জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ থাকবে, সময় ও অঞ্চলভেদে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে, সবাই খাদ্য ক্রয় বা সংগ্রহ করতে পারবে, পুষ্টিকর ও নিরাপদ স্বাস্থ্যকর খাদ্য সহজলভ্য থাকবে। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তার মূল বিষয় তিনটি ১. খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতা।  ২. খাদ্যের লভ্যতা।  ৩. স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য। (FAO) এর খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা থেকে দূরে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা দ্রুত নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ১৭টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য করণীয় হচ্ছে ১. ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো। ২. খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। ৩. আবাদি জমি বাড়ানো। ৪.প্রাকৃতিক দুর্যোগসহনশীল জাত উদ্ভাবন। ৫. জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন। ৬. আন্তঃফসল, মিশ্র ফসল, রিলেফসল, রেটুন ফসল চাষ করা। ৭. সেচের জমি বৃদ্ধি করা। ৮. উফশী ও হাইব্রিড ফসল চাষ করা। ৯. শস্য বহুমুখীকরণ করা। ১০. জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও প্রচুর চারা উৎপাদন করা। ১১. রোগবালাই দমন করা। ১২. প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করা। ১৩. ধানক্ষেতে মাছ চাষ, পুকুরে মাছ-মুরগি-হাঁসের সমন্বিত চাষ করা। ১৪. রোগ ও পোকা দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা। ১৫. সহজশর্তে ঋণ দেয়া। ১৬. পশুপাখির জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৭. ভর্তুকি বাড়ানো। ১৮. সংরক্ষণাগার বাড়ানো। ১৯. কৃষি উপকরণ সরবরাহ। ২০. শস্যবীমা চালু করা। ২১. পতিত জলাশয়ে মাছ চাষ করা ইত্যাদি। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা কঠিন কাজ, কারও একার পক্ষে সম্ভব না। কৃষক, শ্রমিক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষিকর্মী, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাই একত্রে কৃষি সমবায় গঠন করে কাজ করলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি
বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবী এখন সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে আছে। কারণ পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। অপরদিকে, আবাদি জমি কমছে, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি উপকরণ সংকটসহ হাজারো সমস্যার জন্য কৃষি উৎপাদন কাক্ষিত পর্যায়ে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ঋঅঙ এর হিসাবে পৃথিবীতে বর্তমানে ২২টি দেশ বেশি খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সূচকের তালিকায় ১৯৬টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭, পাকিস্তানের ২২, ভারতের ৫১ ও চীন ১২৫তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বে ক্ষুধা নামক নীরব ঘাতকের হাতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। ৮৫২ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার্ত থাকে। ৮৮টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭০তম। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৫০ শতাংশ পরিবার বছরের কোনো না কোনো সময় খাদ্য সংকটে থাকে, ২৫ শতাংশ নিয়মিতভাবে সারা বছর খাদ্য পায় না, ১৫ শতাংশ পরিবার সবসময় পরের বেলা খাবার নিয়ে চিন্তিত থাকে এবং ৭ শতাংশ মানুষ কখনোই তিন বেলা খেতে পায় না। বর্তমানে দেশের ৪০% মানুষ অতিদরিদ্র। প্রায় ২৮% মানুষ এক ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করছে। বিশ্বে প্রতিদিন না খেয়ে থাকে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ। উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্য অপচয় হয় ২২ কোটি টন।

দেশের খাদ্য উৎপাদন
দেশে প্রায় ১.৪৭% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২ থেকে ২.৫% হারে (৩.৫ লাখ টন) খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন চাল প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ তথা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন- কৃষকদের উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান; আউশ ধান নেরিকা ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষে প্রণোদনা; বিনামূল্যে ফসলের বীজ ও সার প্রদান; প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনে সহায়তা প্রদান; বিএডিসি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মানসম্মত বীজ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধিকরণ; জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় কৃষিক্ষেত্রে লাগসই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ; ই-কৃষি বা ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তির প্রসার; মানসম্মত বীজের সরবরাহ; প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা; বাজার ব্যবস্থাপনা ও সেচের পরিধি বৃদ্ধিকরণ; ইলিশের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে ডিম ছাড়ার মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকরণ এবং জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদান; কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে ইউনিয়ন ও ব্লকপর্যায়ে কৃষি তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যেই এসব কর্মসূচির সুফল পাওয়ায় দেশের খাদ্যভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে।

পারিবারিক খামারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন
যে স্থানে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হয় সে স্থানকে খামার বলে। প্রতিটি পরিবারেই খামার করার সুযোগ রয়েছে। কারণ যার জায়গা জমি কিছুই নেই শুধু একটি ঘর আছে। সেও ঘরের চালে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক, ধুন্দুল, চিচিঙ্গাসহ বিভিন্ন লতালো শাকসবজি চাষ করতে পারে। বাংলাদেশে মোট পরিবারের সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি। এর মধ্যে কৃষি পরিবার হচ্ছে ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩টি। এসব প্রতিটি পরিবারেই একটি করে খামার গড়ে তুলতে পারে। এ পরিবারগুলো অকৃষি খাতে জীবন নির্বাহ করা ১ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৫৮০টি পরিবারের খাদ্যের জোগান দেয়। প্রতিটি কৃষি পরিবারের বাড়ির আঙিনায় শীতকালে পালংশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, শিম, লাউ, বরবটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, লেটুস, ধনিয়া ইত্যাদি চাষ করা যায়। গ্রীষ্মকালে- চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শসা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, কলমিশাক এবং বর্ষাকালে- কচু, ডাঁটাশাক, লালশাক, কলমিশাক ইত্যাদি চাষ করা যায়। প্রতিটি কৃষি পরিবারের আনাচে কানাচে- লেবু, পেয়ারা, বরই, পেঁপে, ডালিম ইত্যাদি ফল চাষ করা যায়। এছাড়াও প্রতিটি কৃষি পরিবারেই হাঁস, মুরগি, কবুতর, কোয়েল, গরু, ছাগল, ভেড়া পালন করার সুযোগ রয়েছে। বাড়ির কাছে ডোবা বা পুকুর থাকলে মাছ চাষ করা যায়। বাড়ির ও গোয়াল ঘরের ময়লা আবর্জনা, গোবর ইত্যাদি পচিয়ে জৈবসার তৈরি করে গাছে দেয়া যায়। এগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে এবং অতিরিক্ত কৃষিপণ্য বিক্রি করে আয়-রোজগার করা যায়। এতে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনে কাজে লাগবে।
দেশে আবাদি জমি ১% হারে কমছে, জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৪৭% হারে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে পারিবারিক খামারের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হবে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১৮ লাখ বসতভিটা আছে। পরিবারের খাদ্যশস্য, শাকসবজি ও ফলমূলের চাহিদা মিটানোর জন্য প্রতিটি বসতবাড়িকে খামারে রূপান্তর করতে হবে। বর্তমান সরকারের কৃষিক্ষেত্রে একটি বড় কর্মসূচি হচ্ছে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। এজন্য এবার বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এ কর্মসূচিতে প্রতিটি পরিবারেই খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, ডিম, গোশত, দুধ ইত্যাদি খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ থাকবে।

পৃথিবীর পরিবেশ সুস্থ রেখে খাদ্য উৎপাদন
পৃথিবীর  মাটি, বায়ু ও পানি বিশুদ্ধ রেখে খাদ্য উৎপাদনের জন্য জৈব পদ্ধতিতে অর্থাৎ অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। অর্গানিক ফুড বা জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। অর্গানিক ফার্মিং থেকেই অর্গানিক ফুড বা জৈব খাদ্য তৈরি হয়। রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈবসার ও জৈব কীটনাশক দিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করাই হচ্ছে অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি। রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফসল উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈবসার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশসম্মত ও উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত। বাংলাদেশে শাকসবজি উৎপাদনে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় ইউরোপের দেশগুলো এদেশ থেকে শাকসবজি ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে। জৈব উপায়ে খাদ্যশস্য ও শাকসবজি উৎপাদন করচ কম অথচ বেশি দামে দেশে ও বিদেশে বিক্রির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।

রাসায়নিক সার পরিমাণে কম লাগে, সহজলভ্য ও দ্রুত কাজ করে। মাটির উর্বরতা সাময়িক বাড়লেও পরে ক্ষতি করে। রাসায়নিক সারে খরচ বেশি, মাটি, পানি ও বাতাস দূষিত করে এবং মাটির জীবাণু ও কেঁচো মারা যায়। মাটিতে জটিল যৌগ সৃষ্টি করে যা গাছ গ্রহণ করতে পারে না। গাছে  বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। একটু বেশি হলে গাছ মারা যায়। ঝুঁকি বেশি। প্রয়োগ পদ্ধতি সঠিক না হলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়। একটি সারে ২ থেকে ৩টি পুষ্টি উপাদান থাকে। একটি জৈবসারে ৮ থেকে ১০টি পুষ্টি উপাদান থাকে। রাসায়নিক সার জমিতে অল্প কিছু দিন স্থায়ী  হয় এবং প্রয়োগের পর অপচয় বেশি হয়। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। যা পরিবেশকে দূষণ করছে। রাসায়নিক সার উৎপাদনে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান লাগছে, যা পরিবেশ দূষণ করছে। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পরিবেশ দূূষণের কথা চিন্তা করে রাসায়নিক সার উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। অথচ দেশে প্রতি বছর শতকরা ২০ভাগ রাসায়নিক সারের ব্যবহার রাড়ছে।

জৈবসার মাটিতে পানি ও পুষ্টি ধারণক্ষমতা বাড়ায়, মাটিকে উর্বর করে, মাটির কণাগুলো ফসলের উপযোগী করে, মাটির ছিদ্র বাড়ায় ফলে বায়ু ও পানি চলাচলে সুবিধা হয়। জৈবসার মাটির তাপমাত্রা ও অম্লত্ব-ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। জৈবসার গাছে পুষ্টি পরিশোষণে সহায়তা করে, মাটির লবণাক্ততা হ্রাস করে। বেলেমাটিকে দো-আঁশ মাটিতে রূপান্তরিত করে। মাটিতে অনুজীব ও কেঁচোর সংখ্যা বাড়ায়। জটিল যৌগকে সরল দ্রব্যে পরিণত করে। পারিবারিক খামারে বিষমুক্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন করে বিশ্বের সব মানুষের ক্ষুধা নিবারণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের প্রচেষ্টা বিশ্ব খাদ্য দিবসের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সফল হোক এটাই আমাদের কাম্য।
 
কৃষিবিদ মো. ফরহাদ হোসেন
* সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভুঞাপুর, টাঙ্গাইল। মোবাইল : ০১৭১১-৯৫৪১৪৩
বিস্তারিত
বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য অর্জনে কৃষি ক্লাবের গুরুত্ব
বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন শুরু হয় ১৯৮১ সনে প্রথম আনুষ্ঠানিকতা আর প্রতিপাদ্য নিয়ে। ১৯৪৫ সনের ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO (Food and Agricultural Organisation) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে  FAO  তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ পৃথিবীর প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে এখন প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের অভাবে দরিদ্রের কষাঘাতে ধুঁকে মরছে। তাইতো FAO চেষ্টা  চালাচ্ছে ২০১৫  সনের মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে, খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি , দরিদ্রতা, অসম খাদ্য বণ্টন ইত্যাদির কারণে এটি ২১৫০ সালের আগে অর্জিত হবে না বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান জানান।

মানুষ এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে খাদ্যের অধিকার নিয়ে। আর এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে। তবে খাদ্যের সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটি  অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, যদি কৃষিকে বাদ রেখে আমরা খাদ্যের কথা বলি তবে বিষয়টি হবে অযৌক্তিক। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্যÑ পাবিবারিক কৃষি : প্রকৃতির সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য বিষয়টি খুবই যথার্থ ও সময় উপযোগী। এবারের প্রতিপাদ্য বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর প্রতিপাদ্যে সবার জন্য খাদ্য বিষয়টি অন্তর্নিহিত রয়েছে।
কৃষি প্রধান এ দেশে ১ কোটির ওপর বসতবাড়ি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বসতবাড়িগুলো শুধুই আবাসস্থল নয় বরং একেকটি কৃষি, মৎস্য, পশু, হস্ত ও কুটির শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের দেশের আবাসস্থলগুলোতেই মূলত শাকসবজি, মসলাজাতীয় ফসল, ভেষজ, ঔষধি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, মৎস্য প্রকৃতি চাষাবাদ হয়ে থাকে। কৃষকদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে এসব সম্পদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার কার্যক্রম সফল করা সম্ভব যদি কৃষকদের ধ্যান ধারণা চিন্তার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করে এসব বসতভিটা কার্যকরী তথ্য নির্ভর জ্ঞান দ্বারা পরিচর্যা করা যায়। এ কার্যক্রম সফল হলে দেশের পুষ্টি ঘাটতি দূরীকরণ সম্ভব সঙ্গে সঙ্গে কুটির শিল্পের বিকাশে সহায়ক হবে। এতে কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নসহ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষক পরিবার হবে স্বাবলম্বী। দেশের পতিত জায়গার সুষ্ঠু ব্যবহার করে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ দেশের কৃষি ক্লাবগুলো জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে নানা নামে কৃষি ক্লাব গড়ে উঠেছে। কৃষি ক্লাবগুলো মূলত কৃষি সম্প্রসারণ এবং আয়বর্ধনমূলক কাজ করে থাকে। এগুলো গড়ে ওঠার মূল কারণ উদ্ভাবিত প্রযুক্তি, তথ্য বা সেবা যথাসময়ে সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বাংলাদেশের কৃষিকে ডিজিটাল কৃষি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের  কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক পরিচালিত কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র নামে সক্রিয় কৃষি ক্লাব গঠিত  হয়েছে। যেখানে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ওয়েব ক্যাম, মোবাইল সেট ও সিম, মডেম ও ইন্টারনেট সিমসহ আরও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

পারিবারিক কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণে কৃষি ক্লাবের গুরুত্ব
১. যেহেতু  দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার প্রধান পেশা কৃষি। তাই কৃষি প্রযুক্তিগুলোর কাক্সিক্ষত সম্প্রসারণ সেবা প্রচলিত সম্প্রসারণ পদ্ধতি দ্বারা সম্ভব নয়। তাই কৃষি ক্লাবগুলো সম্প্রসারণ সেবার ইউনিট হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া  কৃষকদের সমবায় জ্ঞান না থাকা এবং কৃষি সমবায় ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধক। আইলের কারণে কৃষকের জমি বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো থাকে। তাই ইচ্ছা থাকলেও মূলধনের অভাবে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি বা উপকরণ কোনোটিই কাজে লাগাতে পারে না। কৃষি ক্লাব যেহেতু উন্নত কৃষি কলাকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু সেহেতু সদস্যদের সমবায়ভিত্তিক কৃষি কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা সহজ হবে ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে।

২. আমাদের দেশে অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। তাই প্রচলিত সম্প্রসারণ কার্যক্রম দ্বারা তাদের শিক্ষিত করা দূরূহ। যেহেতু কৃষি ক্লাবের সদস্যরা স্থানীয় সেহেতু তারা তাদের প্রকৃত সমস্যা যেমন তুলে ধরতে পারবে তেমনি তথ্য সহজে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কৃষকদের বোঝাতে সক্ষম হবে।

৩. মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রাদুর্ভাব কমাতে, সময়মতো কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি) প্রাপ্যতার তথ্য প্রদানে, পণ্য পরিবহন জ্ঞানের উন্নয়নে, কৃষি বাজার সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞান উন্নয়নে কৃষি ক্লাব ভূমিকা রাখতে পারে।

৪. দেশে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ব্যবস্থা এখন ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। যেহেতু কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে উৎপাদন প্রচলিত চাষ পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি। এ কারণে কৃষি ক্লাব সদস্যদের যদি আমরা এ সম্পর্কে বুঝাতে পারি তবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং গ্রহণ ও প্রচারণায় তাদের কাজে লাগানো যাবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা যেমন বাড়বে সঙ্গে সঙ্গে কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে এবং শিল্পের কাঁচামাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত  হবে।

৫. কৃষকের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও খুব কম বিধায় ক্লাব সদস্যরা তা দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে কৃষক সমাজের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে যা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সহায়ক। তাছাড়া বেকার জনগণের বিকল্প কাজের সংস্থান হবে এর ফলে কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। যেহেতু সদস্যরা এখান থেকে কম সুদে ঋণ নিতে পারে ফলে তারা তাদের সুবিধামতো ফসল ফলাতে পারবে এবং কৃষি উপকরণ সময় মতো কিনতে পারবে। ফলে অধিক উৎপাদন যেমন হবে তেমনি খাদ্য নিরাপত্তাও বাড়বে।

৬. ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কৃষকদের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি ক্লাবের প্রশিক্ষিত সদস্যরা প্রশিক্ষণ দেবে যাতে ফসলের উৎপাদন বাড়তে পারে। এর ফলে কৃষকের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে হলে গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত দেশের বিভিন্ন এলাকার জন্য বিভিন্ন স্ট্রেস টলারেন্স  ফসলের জাত যেমন- খরা, বন্যা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণে সদস্যরা ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ একটি জাত অতি সহজে সম্প্রসারণ করা যায় না। কৃষি ক্লাব সদস্যরা যেহেতু স্থানীয় কৃষক তাই গবেষণালব্ধ এসব জাত সাধারণ জনগণের হাতের কাছে পৌঁছাতে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

৭. বসতবাড়ির পরিমাণ বাংলাদেশে প্রায় ১৮৪৯০০০ একর। এত বড় কৃষি ইউনিটকে যদি কার্যকরী করতে চাই তবে দরকার উন্নত কৃষি জ্ঞান আর তা সম্প্রসারণের জন্য আমরা কৃষি ক্লাবকে কাজে লাগাতে পারি। আন্তঃকৃষি ক্লাব যোগাযোগ করে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে এক জায়গার ভালো প্রযুক্তি অন্য জায়গায় বিস্তার ঘটবে, ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে।

খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে আর এজন্য উষ্ণ আবহাওয়াসহিষ্ণু যেমন- ভুট্টা, বাজরা, জোয়ার, ইত্যাদি ফসলের আবাদ করতে হবে। এ ফসল সম্প্রসারণে কৃষি ক্লাব কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞানের দিক থেকে কৃষি ক্লাব সদস্যরা এগিয়ে থাকে। আর শস্য বহুমুখীকরণ কার্যক্রমে মন্থরতা দূর করতে সহায়ক হবে।

৯. কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্র্তৃক নির্মিত যুগোপযোগী কৃষি তথ্যভিত্তিক বিনোদনমূলক ডকুড্রামা প্রচারণায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। এর ফলে সরকারি কৃষিবিষয়ক তথ্য দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটবে। এর ফলে কৃষক উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে এগিয়ে আসবে এবং অধিক খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হবে।

১০. খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে হলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। শুধু ধানের ওপর নির্ভরশীল থাকলে কখনও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন হবে না। এজন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ভুট্টা, গম ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রচারণা চালিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি ক্লাব ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষিবিষয়ক তথ্য সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং রেডিওতে প্রচার হয় কিন্তু কৃষক তার বিভিন্ন সমস্যার জন্য তা দেখতে বা তথ্য ভালোভাবে বুঝতে পারেননা। এগুলো প্রচার করে কৃষি ক্লাব কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। এছাড়া স্কুল, মাদরাসা ও কলেজের শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম অর্থাৎ স্থানীয় গণ্যমান্য মানুষ কৃষি সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রযুক্তি এখান থেকে পেতে পারেন এবং তারা কৃষি উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারবেন। কারণ দেশের সব মানুষের সহযোগিতায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।

একটি কথা অনস্বীকার্য, কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন হলে দারিদ্র্যবিমোচন হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ খাদ্য নিয়ে বেশ সচেষ্ট। খাদ্যাভাবের কারণে সরকার পতনের নজির আমেরিকা মহাদেশের হাইতিতে দেখা গেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে ধান গম ছাড়াও অতিরিক্ত ১ কোটি ৪০ লাখ টন মাছ, মাংস, ডিম, ফল-মূল, শাকসবজি জাতীয় খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। এ ভয়াবহ পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যাচ্ছে প্রচলিত কৃষি বাদেও আমাদের আরও কিছু করতে হবে। এজন্য শুধু মাঠ ফসলের দিকে তাকিয়ে না থেকে পারিবারিক কৃষির দিকেও নজর দিতে হবে।
 
কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
* আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, রাজশাহী
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর কার্তিক-১৪২১

ইমরান

রাজশাহী
প্রশ্ন : টমেটোর নাবি ধসা  (লেইট ব্লাইট) হলে তার প্রতিকার কী?
উত্তর : ১.সুস্থ টমেটো ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন জাতের টমেটো চাষ করতে হবে।
৩. রোগ দেখা মাত্র সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
৪. পেনকোজেব ৮০ ডব্লিউপি অথবা রিডোমিল ৭২ এমজেড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

আনিসুর রহমান
সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন : আগাছা দমনের কার্যকর পদ্ধতি কোনটি।
উত্তর :বিভিন্ন ধানের জাত ও মৌসুম ভেদে আগাছার সঙ্গে ধান গাছের প্রতিযোগিতার ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। সাধারণত ধান গাছ যত দিন মাঠে থাকে তার তিন ভাগের প্রথম ভাগ সময় জমি আগাছামুক্ত রাখলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে, আগাছানাশক ব্যবহার করে এবং জৈবিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন করা যায়। আগাছা দমনে নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি ততটা কার্যকর না হওয়াই স্বাভাবিক। যখন যেখানে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করার উপযোগী এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক সেখানে সেই পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। এ কারণে সমন্বিত পদ্ধতিতে আগাছা দমন বর্তমানে খুবই কার্যকর। সমন্বিত পদ্ধতিতে আগাছা ব্যবস্থাপনা হলো-

আগাছামুক্ত পরিষ্কার বীজ ব্যবহার করতে হবে। তাহলে আগাছার পরিমাণ কম হবে।

জমিতে ভালোভাবে প্রস্তুত করলে আগাছার পরিমাণ কম হবে।
জমিতে অনেক সময় আগাছানাশক ছিটানোর পরও কিছু আগাছা থেকে যায়। এক্ষেত্রে একবার হাত নিড়ানি দিয়ে জমি আগাছামুক্ত করা যায়।
ব্রি উইডার দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি রাখলে আগাছার পরিমাণ কম হয়।

শাহাদাৎ
কক্সবাজার
প্রশ্ন :  বেগুন-টমেটোর ঢলে পড়া রোগের প্রতিকার কী?
উত্তর : ঢলে পড়া রোগটি টমেটো, আলু ও বেগুনে বেশি দেখা দেয়। গাছ বৃদ্ধির যে কোনো সময় এ রোগ হতে পারে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে।

প্রতিকার : ১. গাছের পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট করতে হবে।
২. রোগাক্রান্ত গাছ দেখামাত্র মাটিসহ তুলে নিয়ে নষ্ট করা ও সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখা।
৩. রোগ সহনশীল জাত চাষ করা।
৪. সুস্থ চারা সংগ্রহ করা।
৫. শস্য পর্যায়ক্রম অনুসরণ করে দানা জাতীয় ফসল যেমন গম ও ভুট্টার চাষ করা।
৬. মাটি শোধন করা। জমি কাদা করে সপ্তাহ খানেক পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলে মাটি শোধন হয়।
৭. হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি স্টেবল ব্লিচিং পাউডার শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করা।

মহিদুল ইসলাম
চকোরিয়া
প্রশ্ন :  নারিকেল কচি অবস্থায় ঝরে যায় কেন?
উত্তর : বাগানের মাটিতে রসের অভাব, রোগ-পোকার আক্রমণ, সময় উপযোগী পরিচর্যার অভাব, খাদ্য ও হরমোন ঘাটতির ফলে ফল ঝরে যায়। নারিকেল ফল ঝরা রোধের জন্য গাছের গোড়ায় সুষম মাত্রায়  জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। পূর্ণ বয়স্ক অর্থাৎ ১০ বছরের অধিক বয়সের নারিকেল গাছে প্রতি বছর গোবর সার ২৫ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২ কেজি, জিপসাম ৩৫০ গ্রাম, জিংক সালফেট ১০০ গ্রাম এবং বরিক এসিড ৩০ গ্রাম দিতে হবে। সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তিতে অর্ধেক সার মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ  (মে) এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে বাকি অর্ধেক সার মধ্য ভার্দ্র থেকে মধ্য আশি^ন (সেপ্টেম্বর) মাসে গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ১ মিটার জায়গা বাদ দিয়ে ১ থেকে ২.৫ মিটার দূর পর্যন্ত মাটিতে ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার গভীরে প্রয়োগ করতে হবে।

সুমন
নওগাঁ
প্রশ্ন : বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা কীভাবে দমন করা যায়?
উত্তর : বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দমন করতে বেগুনের ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার পোকা আক্রান্ত ডগা ও ফল বাছাই করে বিনষ্ট করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকার আক্রমণ ও বংশ বিস্তার রোধ করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড) ১ মিলিলিটার, ডায়াজিনন বা সুমিথিয়ন ১.৫ থেকে ২ মিলি. হারে মিশিয়ে জমিতে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।  

মজিবর রহমান
রংপুর
প্রশ্ন : মাছের পেট ফোলা রোগ হয় এবং মারা যায়, এর প্রতিকার কী?
উত্তর : সাধারণত পুকুরের পানি দূষিত হলে মাছ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মূলত পুকুরের নিচে খুব বেশি কাদা থাকলে, তলদেশে কিছু পচলে বা বাইরে থেকে দূষিত পানি প্রবেশ করলে পানি দূষিত হয়ে থাকে ও মাছের এ ধরনের রোগ হয়। এ ক্ষেত্রে সিরিঞ্জ দিয়ে পেট থেকে পানি বের করে দিতে হবে। আক্রান্ত মাছ আলাদা করতে হবে। মাছের খাবারের সঙ্গে টেরামাইসিন ক্যাপসুলের গুঁড়া (১ গ্রাম-১ কেজি) মিশাতে হবে। অক্সিজেনে অভাবে এ রোগ হয়। ঘনত্ব কমিয়ে, চুন প্রয়োগ ও জাল টেনে বা হররা টেনে অক্সিজেন তৈরি করে প্রতিরোধ করা যায়। লক্ষণ : মাছের পেটে গ্যাস জমে যায়, পানির পিএইচ বেড়ে গেলে মাছ খেতে পারে না। রোগাক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ২ বার ৭ দিন অন্তর অন্তর দিতে হবে।

মো. আশরাফুল
কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন :  মাছে লেজ ও পাখনা পচা রোগ হয়েছে- কী করা যায় ?
উত্তর : এটি মাছের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। পুকুরের পানি ও পরিবেশ নোংরা হলে এ ধরনের রোগ হয়। তাছাড়া পানির ক্ষার স্বল্পতা ও পিএইচ ঘাটতি দেখা দিলেও এ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ২৫ থেকে ৩৫ গ্রাম প্রতি শতাংশে এবং তুঁতে ৬ গ্রাম প্রতি শতাংশে ১ ফুট গভীরতার জন্য দিতে হবে। অথবা ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে পোনাগুলোকে গোসল করাতে হবে।

তুঁতে ১ গ্রাম-১ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে উহাতে আক্রান্ত মাছ কে কিছুক্ষণ রেখে তারপর পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।

চুন আধা কেজি প্রতি শতকে অথবা জিওলাইট ১০ কেজি প্রতি একরে প্রয়োগ করতে হবে।

মাকসুদুর রহমান
রংপুর
প্রশ্ন : গাভী হিটে আসছে না কী করণীয়?
উত্তর : সাধারণত হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। ভিটা এভিই ১০০ সিসি বোতলে পাওয়া যায়, ১০০ কেজি ওজনের জন্য ২০ মিলি করে প্রতি সপ্তাহে ১ বার করে ১ মাস খাওয়াতে হবে। কৃমির ট্যাবলেট দিতে হবে।

ফার্টাজাইল ইনজেকশন প্রতি গাভীকে ৫ মিলিলিটার হিসেবে মাংসপেশিতে ইনজেকশন দিতে হয়। ফলে গাভী ১৭ দিন পরই গরম হবে।

মো. আহাদ
গাজীপুর
প্রশ্ন :    গরু পায়ে আঘাত পেয়েছে কী করণীয়?
উত্তর : ইনজেকশন ট্রাইজনভেট ৫০ কেজি গরুর দৈহিক ওজনের জন্য ৫ সিসি এক বার মাংসে পুশ করতে হবে। এভাবে ৩ দিন প্রদান করতে হবে।
 
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৫৫২৪৩৫৬৯১
বিস্তারিত
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি-১৪২১
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, হেমন্তের দ্বিতীয় মাসে সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। আবহমান বাংলার ঋতুচক্রের এ মাসে ধুম পড়ে যায় আমন ধান কাটার এবং কর্তন পরবর্তী কাজকর্মের। নতুন ধানের হরম ভাতের সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। নবান্নের উৎসবের সাথে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। কেননা এ মৌসুমটাই কৃষির জন্য তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত একটি মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় আমাদের করণীয় কাজগুলো।
 
ফসল / অবস্থা/বিবরণ / করণীয়  

আমন ধান
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ        
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।    
 
বোরো ধান
বীজতলা তৈরি
আগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। প্রতি দুই বেডের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে।
 
জাত ও বীজ বপন    
যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রিধান৫৫, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নেই এমন এলাকায় ব্রিধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রিধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রিধান৬০, ব্রি হাইব্রিড ধান১, ঠা-া প্রকোপ এলাকায় ব্রিধান৩৬, হাওড় এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রিধান৪৭, ব্রিধান৫৫, ব্রিধান৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এসময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
 
গম    
বীজ বপন     
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ, বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।
 
সার প্রয়োগ ও সেচ    
গমের ভাল ফলন পেতে হলে প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈব সার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০-৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০-৪০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ , ৪৫-৬০ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিতে হবে।
 
ভুট্টা    
বীজ বপন    
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১ এসব। এক হেক্টর জমিতে বীজ বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভুট্টা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে খই ভুট্টা বা হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজের মাত্রা এর অর্ধেক হবে। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি. রাখতে হবে।  
 
সার প্রয়োগ    
মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ইউরিয়া ২৭৫-৩২৫ কেজি, টিএসপি ১৭৫-২২৫ কেজি, এমওপি ১০০-১৫০ কেজি, জিপসাম ১৫০-১৭৫ কেজি, দস্তা ১০-১৫ কেজি, বরিক এসিড ৫-৮ কেজি এবং ৪-৫ মেট্রিক টন জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
 
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
পরিচর্যা    
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া রয়েছে তিল, তিসি সূর্যমুখী। আমাদের দেশে তেল ফসল অনেকটা অবহেলিত। তবে নিয়মিত যতœ নিলে তেল ফসলের ফলন বাড়ানো সম্ভব। সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে হেক্টরপ্রতি ৭০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
 
আলু    
পরিচর্যা    
এখন রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। এ সময় মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরি প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
 
ডাল ফসল    
পরিচর্যা    
ডাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাস, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে। সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিষ্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সবকটি পরিচর্যা সময়মতো যথাযথভাবে করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
 
শাকসবজি    
পরিচর্যা    
মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।
 
অন্যান্য রবি ফসল
পরিচর্যা    
মাঠে এখন মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসময় ভালোভাবে যতœ পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে আশাতীত ফলাফল বয়ে আনবে। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে।
 
গাছপালা    
পরিচর্যা    
গত বর্ষায় রোপণ করা ফল, ওষুধি বা বনজ গাছের চারার যত্ন নিতে হবে এখন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছের চারাকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। প্রয়োজনে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না। 
   
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির যত্ন  
হাঁস-মুরগীর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন।  তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
 
গরু-বাছুরের যত্ন   
এ সময় পশুখাদ্যের কোন অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। বুদ্ধিমানের কাজ হলো ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত পশুখাদ্য বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এসময় গবাদিপশুর ক্ষুরারোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপ্রাণিতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
মৎস্যসম্পদ
মাছের যত্ন
মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবর/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের  সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। শীতকাল আসছে। পুকুরে রোদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায় এবং কার্প জাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
 
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিকথা উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
 
একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। মনে রাখবেন কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা।
 
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
সম্পাদকীয় কার্তিক-১৪২১
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে সংস্থাভুক্ত সবগুলো দেশে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয় ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘সবার জন্য খাদ্য’ নিশ্চিত করে বিশ্বকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত রাখা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রতি বছর সময়োপযোগী প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- পারিবারিক কৃষি : প্রকৃতির সুরক্ষা, সবার জন্য খাদ্য।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে ২০১৪ সনকে পারিবারিক কৃষি বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্যটি খুবই যথার্থ ও সময়োপযোগী হয়েছে। কারণ, খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সুসম উৎপাদন, বণ্টন ও ভেজালমুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তার ওপর। পারিবারিক কৃষির মাধ্যমে এসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। পারিবারিক কৃষি বা ফ্যামিলি ফার্মিংয়ের একটি বড় সুবিধা হলো এতে পরিবারের সাধ্যমতো সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায়সহ প্রতিটি পণ্যের খাদ্যমান অটুট রেখে উৎপাদন করা যায়। অধিকন্তু উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় লাভ বেশি হয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। তাই বর্তমান সরকার দেশের মানুষের এ মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের আলোকে গৃহীতব্য বিভিন্ন কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

প্রিয় পাঠক, দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতি বছরের মতো এবারও বর্ণাঢ্য র‌্যালি, বিশেষ টক শো, সেমিনার, খাদ্য প্রদর্শনীসহ পোস্টার, জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র ও কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি এসবই বিশ্ব খাদ্য দিবসের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব খাদ্য দিবস সফল হোক, সার্থক হোক এ কামনায় সবাইকে শুভেচ্ছা।
বিস্তারিত