Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সূচিপত্র

নিবন্ধ
    
১.   ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ    ৩    
    এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
২.    ইঁদুর : কৃষি ব্যবস্থা ও জাতীয় উন্নয়নে হুমকি    ৬    
    মোঃ বেনজীর আলম
৩.   জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২    ৭    
    মো. ইউসুফ রানা মন্ডল
৪.    মিষ্টি ফসল চাষাবাদে ইঁদুরের মাধ্যমে ক্ষতি ও প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তি    ৯    
    ড. মো. আমজাদ হোসেন, ড. মো. আতাউর রহমান    
৫.    ধান ফসল রক্ষায় ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা    ১১
    মো: মোসাদ্দেক হোসেন, ড. শেখ শামিউল হক, ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন    
৬.   প্যাঁচা সংরক্ষণ : ইঁদুর দমনের একটি জৈবিক পদ্ধতি    ১৩
    ড. মোঃ শাহ আলম, ড. এ টি এম হাসানুজ্জামান    
৭.    প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকরী উপায়    ১৬    
    ড. হাবিবুর রহমান
৮.    প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি    ১৮
    কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
৯.    কৃষকের আর্থিক উন্নয়নে মজাপুকুরে সমন্বিত সবজি ও মাছ চাষ     ২০    
    ড. সত্যেন ম-ল, এবিএম মোস্তাফিজুর, বীর জাহাঙ্গীর সিরাজী

আগামীর কৃষি ভাবনা

১০.    বাংলাদেশে প্ল্যান্ট টিসু কালচার এর সম্ভাবনা    ২২
    ড. মো. সাইফুল ইসলাম, ড. শামীম আহমেদ
উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ
১১.   কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর ড্রাগন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি    ২৪
    ড. এম এ রহিম, মোঃ মনিরুজ্জামান
সফল কৃষকের গল্প

১২.    ইঁদুর নিধনে মাগুরার সফল বীর কৃষক মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা    ২৫
    কৃষিবিদ শারমিনা শামিম, মো: আবদুর রহমান
কবিতা/নাটিকা
১৩.    কথকথা : ইঁদুর    ২৭
    কৃষিবিদ আবু হেনা ইকবাল আহমেদ
নিয়মিত বিভাগ
১৪.    আশ্বিন মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি    ২৯    
    কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন    
১৫.    প্রশ্নোত্তর    ৩০
    কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
১৬.   কার্তিক মাসের কৃষি (১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর)    ৩১
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

 

বিস্তারিত
সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

আশি^ন মাস। শরতের পরিপূর্ণতার সুহৃদ। শুভ্র প্রকৃতির এ সময় মাঠঘাটে জলাবদ্ধতা থাকে। ফসলের মাঠ সবুজ শ্যামলিমায় ছেয়ে যায়। প্রকৃতির চমৎকার বৈচিত্র্যের পাশাপাশি রয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়া, পোকামাকড়, রোগবালাই ও ইঁদুরের উপদ্রব। ইঁদুর খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বিরাট হুমকি। আশি^ন মাস ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময়। ১৯৮৩ সাল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ইঁদুর নিধন অভিযান মাসব্যাপী সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করে আসছে। এবছরও সমন্বিতভাবে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ পরিচালিত হচ্ছে।  
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে কৃষিক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। বৈশি^ক রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ইঁদুরের উপদ্রব মোকাবিলা করাও সময়ের দাবি।
ইঁদুর একটি চতুর, সর্বভুক, নিশাচর ও নীরব ধ্বংসকারী প্রাণী। এটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। যেকোনো পরিবেশে যে কোনো খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর যে পরিমাণ খায় তার চেয়ে বেশি কেটেকুটে নষ্ট করে। শুধু ফসল নয়, ইঁদুর মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ সম্পদেরও ক্ষতি করে। ইকোসিস্টেম রক্ষা করে ইঁদুর প্রতিরোধে কোনো একক পদ্ধতি শতভাগ কার্যকর নয়। ইঁদুর সমস্যা একটি সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি  প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ।
ইঁদুর দমন অভিযান ২০২২ উপলক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এ সংখ্যায় ইকোসিস্টেম রক্ষা করে ইঁদুর নিধনের তথ্য-উপাত্তসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, সময়োপযোগী নিবন্ধ, নাটক ও নিয়মিত বিভাগের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আশা করি কৃষিকথা জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ স্বার্থক করে দেশ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সফলকাম হবে।

বিস্তারিত
ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ

ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ
এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
ইঁদুর খুবই পরিচিত একটি প্রাণী। মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইঁদুর ও ইঁদুরের উপদ্রব। মানুষের সাহিত্য, যুদ্ধ, দুর্যোগ, বিপর্যয়, রোগশোক, অভাব, পরিবেশ ইত্যাদি জুড়ে আছে ইঁদুর। সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য ঈশপের গল্পে যেমন আমরা ইঁদুর পাই, মধ্যযুগের জার্মান লোকসাহিত্যেও আমরা ইঁদুরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হ্যামিলন শহরের দেখা পাই। হ্যামিলনের ইঁদুর নিধনকারী সেই বাঁশিওয়ালা আমাদের ইঁদুরের কবল থেকে মুক্তি দিলেও, বাস্তবে মানুষ আজো ইঁদুরের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এই হাল আমলেও পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর নিউইয়র্কের অলিগলি ইঁদুরের দখলে। নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন হোক আর জাতীয় নির্বাচন হোক নির্বাচনী ইশতেহারে প্রার্থীরা ইঁদুর নিধনের প্রতিশ্রুতির কথা অবশ্যই  উল্লেখ করেন। ওয়ার্ল্ড ডিজনির মিকি মাউস চরিত্রটি শিশুদের নিকট খুবই পরিচিত। শিশু-কিশোর-বয়স্ক সবার নিকট জনপ্রিয় কার্টুন ‘টম এন্ড জেরি’তে ইঁদুর চরিত্রের জেরি প্রায় সবারই পছন্দ। কিন্তু বাস্তবের জেরিদের পছন্দ করে এমন মানুষ খুবই কম রয়েছে।
ফসল, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালির ক্ষতি করার জন্য ইঁদুর নিধনের চেষ্টাও মানুষের বহুকাল আগে থেকে। আর টিকে থাকার লড়াইয়ে ইঁদুরও জিততে চায়। মানুষের পুরো জাতিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য যেসব রোগ এসেছে প্লেগ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মানুষের জীবনবিধ্বংসী প্লেগ রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি ইঁদুর জড়িত। ইঁদুর স্তন্যপায়ী হওয়ায় এর দংশন জলাতঙ্ক রোগেরও কারণ। আবার, ফসল নষ্ট করার জন্য ইঁদুর ইতিহাসের সূচনা থেকেই উপদ্রব হিসেবে আলোচিত হয়। আধুনিককালে যখন পরিবেশবিদরা বাস্তুসংস্থানের গুরুত্ব বর্ণনা করেন সেই সময়ও ইঁদুর নিধনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয় না। কারণ, ইঁদুর প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের জীবন, খাদ্য, পোশাক ও বাসস্থানের ক্ষতিসাধন করে। তবে এটিও সত্য মানুষের প্রাণ রক্ষায় গবেষণাগারে গিনিপিগের পাশাপাশি ইঁদুরও প্রচুর ব্যবহৃত হয়। এ সত্ত্বেও ইঁদুর নিধন এখনো কার্যকর হওয়ার অন্যতম কারণ ইঁদুরের দ্রুতগতির প্রজনন সক্ষমতা এবং ইঁদুরনাশকের প্রতিরোধে অভিযোজিত হওয়ার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা। এ কারণেই জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ উপলক্ষ্যে ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ বিষয়েবিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
ইঁদুর (জধঃ) জড়ফবহঃরধ বর্গের গঁৎরফধব গোত্রের লম্বা লেজবিশিষ্ট একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর জধঃঃঁং  ও এর সমগোত্রীয় গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি। ইঁদুরের পরিবেশের সঙ্গে খাপখাওয়ানোর সক্ষমতা অধিক। এ কারণে এন্টার্কটিকা ছাড়া আর সব মহাদেশেই ইঁদুর দেখা যায়। সব ধরনের খাদ্যে অভ্যস্ততা এবং দ্রুত প্রজনন করার ক্ষমতার কারণে যেকোনো পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজন করতে পারে ইঁদুর। চোয়ালের পেশীবিন্যাস ও করোটির নানা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রোডেন্ট বর্গের প্রাণীরা তিনটি দলে বিভক্ত: কাঠবিড়ালীসদৃশ, ক্যাভিসদৃশ ও ইঁদুরসদৃশ। স্তন্যপায়ীদের সর্বমোট প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের বেশি তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত। গঁৎরফধব গোত্রের সহস্রাধিক প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে আছে প্রায় ১৮ প্রজাতির ইঁদুর। বাংলাদেশে প্রাপ্ত ইঁদুরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেংটি ইঁদুর (গঁং সঁংপঁষঁং), কালো ইঁদুর (জধঃঃঁং ৎধঃঃঁং), ধেঁড়ে ইঁদুর (ইধহফরপড়ড়ঃধ রহফরপধ), মেঠো ইঁদুর (ইধহফরপড়ড়ঃধ নবহমধষবহংরং) ইত্যাদি।
ইঁদুর বাংলাদেশের ফসলের মাঠ থেকে ঘরের কোণে, দপ্তরসমূহ থেকে দোকানপাট সর্বত্র বিরাজমান। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ইঁদুর পুরো পৃথিবীর ২০% পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি করতে সক্ষম। এ কারণে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ওজজও) শুকনো ও বর্ষা উভয় মৌসুমে ইঁদুর নিধনের জন্য ইঁদুরনাশক ব্যবহারের জন্য কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। যদিও ইরি অরাসায়নিক ইঁদুরনাশক ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয় তথাপি এত বিপুলসংখ্যক ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষের বিকল্প ভাবনার অন্ত নেই। বাংলাদেশেও প্রতি বছর ফসলের জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, বছরে বাংলাদেশের মোট ফসলের ৫-১২ শতাংশ ফসল নষ্ট করে ইঁদুর। ছোট্ট ভূখ-ে বাস করা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় এ পরিমাণ নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। এ কারণেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়। ২০১৫ সালে ‘দ্য ডেইলি সান’ এ প্রকাশিত ‘জধঃং ফবংঃৎড়ু ১২-১৫ ঢ়বৎপবহঃ পৎড়ঢ়ং ধহহঁধষষু: বীঢ়বৎঃং’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য ইঁদুরের ক্ষতিকর দিকটি তথ্য-উপাত্তসহকারে উল্লেখ করা হয়। এ প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে ৫-৭% আমন ধান, ৪-১২% গম, ৫-৭% আলু, ৬-৯% আনারস ও অন্যান্য ফল, ৪-৫% সবজি, ৮-৯% নারকেল, ৭-১০% সেচ পানি এবং ৩-৫% গুদামজাত শস্য বিনষ্ট বা ব্যবহার অনুপযোগী হয়। ইঁদুর এসব ফসল কেটে দেয় বা খেয়ে ফেলে।
ফসল নষ্টের পাশাপাশি ইঁদুর প্রায় ৬০ প্রকার রোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ। একজোড়া ইঁদুর বছরে প্রায় ২৫০০টি ইঁদুর জন্ম দিতে পারে এবং প্রতিটি ইঁদুর জন্মের মাত্র দুই মাসের মধ্যে প্রজননক্ষম হয়ে উঠতে পারে বলে মানুষ ও কৃষির জন্য ইঁদুর নিধন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় বলে পরিগণিত হয়।
বাংলাদেশ বিশে^র উর্বর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে স্বল্প জায়গায় অধিক মানুষ বাস করলেও বিএডিসিসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দপ্তর-সংস্থার তত্ত্বাবধানে এবং বাংলার                  কৃষকের নিরলস শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে বাংলাদেশ দানাশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা রক্ষার জন্যই ইঁদুর নিধনের প্রয়োজন অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশী কৃষকদের মধ্যে ইঁদুর নিধনের কৌশল হিসেবে বিষটোপ, গর্তে পানি দেওয়া, গর্তখোঁড়া, ফাঁদপাতা ও ধূ¤্রবিষ (ঋঁসরমধহঃ) জনপ্রিয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসতবাড়ি ও এর আশেপাশে, মাঠে বা বহু কৃষক বিষটোপ ব্যবহার করেন। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বিষটোপে ইঁদুর মারার পরিমাণ মোট কৌশলের ৭৪%। প্রাকৃতিকভাবে বর্ষাকালের বা অন্য যেকোনো সময়ের বন্যা ইঁদুরের উৎপাত ও বিস্তারকে সীমিত করলেও অল্প সময়ে বংশবৃদ্ধি করায় ইঁদুরের কবল থেকে স্থায়ী মুক্তি মেলে না। প্রবল বৃষ্টিপাতে মেঠো-ইঁদুরের গর্তগুলোতে পানি ঢুকলে ওদের বাচ্চাগুলো মারা যায়। বনবিড়াল, বাগডাস, শিয়াল, প্যাঁচা, বাজপাখি, সাপ, গুইসাপ ও বিড়ালের মতো বিভিন্ন শিকারি প্রাণী খাদ্য হিসেবে মৃত বা জীবিত ইঁদুর খেয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ইঁদুরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অভ্যাস রয়েছে। তবে এসবও ইঁদুরের নিয়ন্ত্রিত অস্তিত্বের জন্য টেকসই সমাধান আনেনি।
বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে বাঁচার কৌশল নিয়ে ভেবেছে। সীমিত জ্ঞান ও সাধ্যের মধ্যে নানা কৌশল ও ফাঁদের সাহায্যে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করেছে। কৃষকরা বেশ কয়েক প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে কাঁচিকল, কাঠের ফাঁদ, বাঁশের ফাঁদ, মাটির ফাঁদ ও খাঁচাফাঁদ উল্লেখযোগ্য। কৃষকদের বসতবাড়িতে সর্বাধিক ব্যবহৃত ফাঁদ হলো ‘কাঁচি কল’। স্থানীয় হাটবাজারে খুবই স্বল্প টাকায় এই ফাঁদ কিনতে পাওয়া যায়। আবার গ্রামের মানুষের কারিগরি দক্ষতার কারণে অনেকেই ঘরেই এ ধরনের ফাঁদ তৈরি করেন।
এর বাইরে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, পরীক্ষাগার ও গুদামে বিভিন্ন ধরনের ইঁদুর বিশেষ করে  নেংটি ইঁদুর নিধনের জন্য আঠাযুক্ত বোর্ড অত্যন্ত কার্যকর। কার্ডবোর্ড (৩০ী৩০ সেমি.), কাঠের তক্তা বা দস্তার প্রলেপযুক্ত লোহার পাতের টুকরায় ইঁদুর ধরার আঁঠা (জড়ফবহঃ মষঁব) লাগিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ইঁদুর চলাচলের পথে ফেলে রাখা হয়। আঁঠাযুক্ত বোর্ডের ওপর দিয়ে হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় ইঁদুর তাতে আটকা পড়ে। বহির্বিশে^ও এ পদ্ধতি জনপ্রিয়, বিশেষ করে এ পদ্ধতিতে ইঁদুর জীবিত ধরা যায় বলে অনেকের কাছে জনপ্রিয়।  
গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই নতুন গর্তে ধোঁয়া দিয়ে সেখান থেকে ইঁদুর বের করা হয়। এ ধোঁয়া তৈরির সময় বিশেষভাবে শুকনো মরিচ পোড়াও দেয়া হয়। ধোঁয়া ও মরিচের যৌথশক্তির নিকট পরাজিত ইঁদুর এক সময় গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে অথবা গর্তের অভ্যন্তরেই মরে যায়।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন কষ্টসাধ্য উপায়ে ইঁদুর নিধন থেকে বেরিয়ে রাসায়নিক নানা নিধনপণ্য ব্যবহার করে। যদিও পরিবেশবিদরা রাসায়নিক পদার্থ, বিষ ও বালাইনাশক দিয়ে ইঁদুর নিধনের বিরোধিতা করেন, তবুও তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে অনেকেই এই নিষেধকে গ্রাহ্য করেন না।
রাসায়নিক ইঁদুরনাশকের মধ্যে রয়েছে জিঙ্ক ফসফাইড, ব্রোডিফ্যাকোয়াম (ইৎড়ফরভধপড়ঁস), ব্রোমাডিওলোন (ইৎড়সধফরড়ষড়হব), ফ্লোকোমাফেন (ঋষড়পড়ঁসধভবহ) ও ইউসিডিয়ন (ণঁংরফরড়হ) ইত্যাদি ইঁদুরনাশকের  ব্যবহার। এগুলো বাংলাদেশে নিবন্ধিত ইঁদুরনাশক (জড়ফবহঃরপরফবং) এর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত। জিঙ্ক ফসফাইড সাধারণত ২-৩% মাত্রায় ব্যবহার্য। ইঁদুরনাশকগুলো সাধারণত জৈব বা অজৈব যৌগিক পদার্থ এবং প্রথাগতভাবে (কার্যকারিতার ভিত্তিতে) ৪ শ্রেণিতে বিভক্ত: তীব্র এককমাত্রা বা অ-তঞ্চনরোধক, ক্রনিক বা বহুমাত্রা বা তঞ্চনরোধক, ধূপনবিষ ও বন্ধ্যাকরণ রাসায়নিক।
বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে কোন নিবন্ধিত বন্ধ্যাকরণ রাসায়নিক নেই। গর্তে, জাহাজে, গুদামে ও অন্যান্য অনুরূপ স্থানে ইঁদুর নিধনের জন্য অবশ্য কিছু ধূপনবিষ ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যালসিয়াম সায়ানাইড, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ও কার্বন-মনোক্সাইড। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের ০.৬ গ্রাম দানা বা ৩.০ গ্রাম বড়ি পাওয়া যায়, যা বাতাসের আর্দ্রতা বা ভিজা মাটির স্পর্শে ফসফাইন গ্যাস অবমুক্ত করে। ধূসর গ্যাস উদগীরক গুঁড়া হিসেবে ব্যবহৃত সায়ানাইড থেকে একইভাবে হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাসও নির্গত হয়। প্রতিটি গর্তের মুখে ১-২টি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড দানা বা বড়ি রাখলেই চলে। এটি বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে নিবন্ধিত ও বিক্রয় হয় যেমন- অ্যাগ্রিফস (ধমৎরঢ়যড়ং) ৫৭%, গ্যাসট্রোক্সিন (মধংঃৎড়ীরহব) ৫৭%, সেলফস (ংবষঢ়যড়ং) ৫৭%, কুইকফস (য়ঁরপশঢ়যড়ং) ৪৭%, অ্যালামফস (ধষঁসঢ়যড়ং) ৫৭% ও কুইকফাম (য়ঁরপশঢ়যঁস) ৫৭% ইত্যাদি।
তবে এসব রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে বেশ প্রতিবাদী অবস্থায় রয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সক্রিয়তাকর্মীরা। কারণ, মরা ও জীবিত উভয় ইঁদুরই বাজ, চিল, কাক, বনবিড়াল, বাঘডাশাসহ নানা প্রাণীর খাদ্য। বাংলাদেশের অনেকেই খুবই সস্তায় ইঁদুর মারার ভয়ানক বিষ ব্যবহার করে। এই মৃত ইঁদুর আবার আশেপাশে ফেলে দেয় যেটি মুরগী, কুকুর বা পাখপাখালী খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার, মাটির নিচে ফেলে দিলে তা থেকে উদ্ভিদের মধ্যেও এ বিষ আসতে পারে। পানিতে ফেললে তা মিশে যেতে পারে ফসল ও খাদ্যদ্রব্যে। এসব থেকে আসতে পারে মানুষের দেহেও।
ইঁদুর যদি রাসায়নিক ইঁদুরনাশক খেয়ে মরে তবে ইঁদুরখেকো পাখি ও প্রাণীদের দেহেও এ রাসায়নিক আসতে পারে এবং এভাবে এতে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী ও পাখিও নিধন হতে পারে। ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ^খ্যাত ন্যাচার জার্নালে ‘করষষরহম ৎধঃং রং শরষষরহম নরৎফং’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে রিচার্ড লোভেট (জরপযধৎফ অ. খড়াবঃঃ) কানাডার ভ্যানকুভারে মৃত ১৩০টি পেচা ও বাজপাখির দেহে ইঁদুরনিধনে ব্যবহৃত ক্ষতিকর ডিডিটিসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান পাওয়ার কথা প্রকাশ করে ইঁদুরনিধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। ২০১৬ সালে ব্রিটেনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘ঊহারৎড়হসবহঃধষরংঃ ংববশং ঢ়ৎড়ঢ়বৎ ফরংঢ়ড়ংধষ ড়ভ ফবধফ ৎধঃং’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মৃত ইঁদুর যা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে নিধন করা হয়েছে তা নিরাপদে সংরক্ষণ না করলে পরিবেশের বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ এমন কী মানুষও আক্রান্ত হতে পারে বলে জানানো হয়। এ কারণে উন্নতবিশে^ ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়েও বন্ধ্যাত্বকরণকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে (শিবব্রত বর্মণের ‘মানুষ বনাম ইঁদুর’, বিজ্ঞানচিন্তা, ২০১৯)।
ইঁদুরের প্রতি সহমর্মী হওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। পরীক্ষাগারে মানুষের বিভিন্ন গবেষণায় যে পরিমাণ ইঁদুর প্রয়োজন তারচেয়ে কোটি গুণ বেশি ইঁদুর পৃথিবীতে রয়েছে। পশুপাখির খাদ্য হিসেবেও ইঁদুর হয়তো প্রয়োজনীয়, কিন্তু ইঁদুরের যে বংশবৃদ্ধির হার তাতে এসব প্রাণীর জন্যও ইঁদুর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে এসেছে,‘যখন তোমরা ঘুমাবে তখন বাতি নিভিয়ে দেবে। কারণ শয়তান ইঁদুর ইত্যাদির অনুরূপ প্রাণীকে এমন কাজে প্ররোচিত করে এবং তোমাদের (ঘরবাড়িতে) আগুন লাগায়।’ (জাগোনিউজ২৪, ২০২০)।
ইঁদুর নিধনের জরুরি আবশ্যকতা রয়েছে। তবে ইঁদুর নিধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব পদার্থ, ফাঁদ ইত্যাদি ব্যবহার করা সমীচীন। আবার, নিধনকৃত ইঁদুর প্রকৃতিতে এমনভাবে বিলীন করতে হবে যেন মাটি থেকে পানি, পশু থেকে পাখি, অণুজীব থেকে উদ্ভিদ-ফসল কেউই ইঁদুরের মাধ্যমে আক্রান্ত না হয়।
ইঁদুর নিধন অভিযানে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে কৃষি, কৃষক ও সাধারণ মানুষ সুরক্ষা পাক এই লক্ষ্যে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ সফল হোক।

লেখক : চেয়ারম্যান (গ্রেড-১), বিএডিসি, মোবাইল: ০১৯৯৮৭৭০০০১, ইমেইল : chairman@badc.gov.bd

বিস্তারিত
ইঁদুর : কৃষি ব্যবস্থা ও জাতীয় উন্নয়নে হুমকি

ইঁদুর : কৃষি ব্যবস্থা ও জাতীয় উন্নয়নে হুমকি
মোঃ বেনজীর আলম
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। কৃষি এখনও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি উল্লেখ করার মতো এবং বিশ্বের যে কোন উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদাহরণও বটে। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের কৃষি ভাবনার এক বাস্তব প্রতিফলন। বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন এবং স্বল্পমূল্যে জনসাধারণের মাঝে খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। দেশের ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং কৃষি জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য এরই মধ্যে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য দূর করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সর্বাত্মক প্রয়াস ও কৃষক ভাইদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ দেশে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- অকাল বন্যা, রোগবালাই, পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যতম অন্তরায়, যা একদিকে যেমন উৎপাদনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে অপরদিকে দেশের সার্বিক পরিবেশসহ কৃষিব্যবস্থা ও জাতীয় উন্নয়নকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তদুপরি রয়েছে ইঁদুরের উপদ্রব। প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মে. টন খাদ্যশস্য কেবল ইঁদুরই নষ্ট করে থাকে। মানুষের আশেপাশে থেকে এরা প্রতিনিয়ত সম্পদ ও শস্যের ক্ষতি করেই চলেছে। সার্বিকভাবে ইঁদুর বিভিন্ন প্রকার রোগের বাহক বিধায় জনস্বাস্থ্য ও নিরাপদ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইঁদুর খুব চতুর ও দ্রুত বংশ বিস্তারকারী প্রাণী।  কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, এক জোড়া ইঁদুর তার জীবদ্দশায় প্রায় তিন হাজার বংশধর সৃষ্টি করতে পারে।
কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধে ও দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য ইঁদুরকে একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সকল স্তরের জনগণকে ইঁদুর নিধন কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ইঁদুর নিধন অভিযান বাংলাদেশে নতুন নয়। বিগত ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছর এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবারও বিগত অভিযানের ন্যায় ‘জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২’ এর কর্মসূচি  গ্রহণ করেছে। আশা করি এ অভিযানে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে। কৃষক, সরকারি, বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন। ফলে ইঁদুর দ্বারা ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পাবে। আমি ‘জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২’ এর সার্বিক সফলতা কামনা করছি।

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ই-মেইল :dg@dae.gov.bd

বিস্তারিত
জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২

জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২
মো. ইউসুফ রানা মন্ডল
কৃষি আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে কৃষিখাত থেকে। সীমিত জমি থেকে জোগান দিতে হয় বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সম্ভার। তাই বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন। কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারনেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জ্বলোচ্ছ্বাস, খরা, পোকামাকড় ও রোগবালাই এসব পরিবেশগত বৈরিতার কারণে আমাদের কৃষকেরা বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। তা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তি ও সঠিক দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুকৌশলে বালাই সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে ফসল তোলাই কৃষকের মূল লক্ষ্য। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু মাঠ থেকে শুরু করে গোলাঘর পর্যন্ত, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের একটা বিরাট অংশ নষ্ট হচ্ছে ইঁদুরের ক্ষতির কারনে।  ইঁদুরের আক্রমণের ফলে ফসলের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এ ছাড়াও কৃষি জমির পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশ বিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশ বিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতও ইঁদুরের উপদ্রব বেশি পরিলক্ষিত হয়। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর ছেদন দন্ত সদা বর্ধিষ্ণু বিধায় উক্ত ছেদন দন্ত ছোট রাখার জন্য এরা প্রতিনিয়তই কাটাকুটি করে। যদি ইঁদুরের এ অভ্যাস বন্ধ রাখা হয়, তবে তার দাঁত অনেক বড় হয়ে যাবে। সুতরাং দাঁত ছোট রাখার জন্য তাকে প্রতিনিয়তই কাটাকুটি করতে হয়। এ কারণে দেখা গেছে যে, ইঁদুর যে পরিমাণ ভক্ষণ করে তার দশ গুণ সে কেটে নষ্ট করে। সারা পৃথিবীতে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর প্রায় ১৭০০টি প্রজাতি আছে। তন্মধ্যে প্রায় ১৮-২০ টি প্রজাতি আপদ/বালাই রুপে চিহ্নিত।
ইঁদুর একটি চতুর ও নীরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে পারে। প্রতিনিয়ত ইঁদুর আমাদের উৎপাদিত ফসলকে নষ্ট করছে। ক্রমবর্ধমান হারে খাদ্যের প্রয়োজনে দেশে বর্তমানে এক ফসলের পরিবর্তে বহুবিধ ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। এর ফলে ইঁদুর সর্বদা মাঠেই খাদ্য পাচ্ছে। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, আলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭ শতাংশ এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫ শতাংশ ক্ষতি করে।
ইঁদুর শুধু আমাদের খাদ্যশস্য খেয়ে ও কেটে কুটে নষ্ট করে না, এদের মলমূত্র, লোম খাদ্য দ্রব্যের সাথে মিশে টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগ ও ক্রিমিরোগসহ ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। প্লেগ নামক মারাত্মক রোগের বাহক হচ্ছে ইঁদুর। এরা মাঠের ও ঘরের শস্য নষ্ট ছাড়াও বৈদ্যুতিক তার, টেলিফোন তার ও কম্পিউটার যন্ত্র কেটে নষ্ট করে। এ ছাড়া বড় সড়ক, বাঁধ, রেললাইনে গর্ত করে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে বন্যার পানি ঢুকে এ সব অবকাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য এর ক্ষতির পরিমাণ পরিসংখ্যানগতভাবে নির্ণয় করা কঠিন। কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষতি রোধ, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের স্বার্থে ইঁদুর সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষেতখামার, বসতবাড়িসহ সর্বত্র ইঁদুরমুক্ত করার লক্ষ্যে ইঁদুর নিধনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিগত ৫ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে আমন ফসল রক্ষা পেয়েছে তার হিসেব সারণি দ্রষ্টব্য।
সূত্র : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বর্তমানে সারাবিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ এর উদ্দেশ্য : ইঁদুর প্রতিরোধে কখনও এককভাবে সম্ভব নয়। সকলের সমন্বয়ে সমন্বিতভাবে দমন ব্যবস্থা করতে হবে। ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ এর উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে-
কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম এসব ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা; ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাপনাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো; ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা; আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখা; গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা; রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা; ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা; সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের ব্যাপারে জোর দেয়া।
অভিযানের সময় ও উদ্বোধন
এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০২২ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করা হবে। গত বছরের অভিযানের কার‌্যাবলীর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদ/জেলা পরিষদ/প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান/ মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করা হয়ে থাকে। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/উপজেলা চেয়ারম্যান/তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করা হয়ে থাকে।
ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান    
জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২১ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়। অঞ্চলে অতিরিক্ত পরিচালকগণ নিজ অঞ্চলের পুরস্কার পাবার যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই বাছাইপূর্বক মনোনয়নের তালিকা সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে সদর দপ্তরে প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ও অঞ্চল পর্যায়ের পুরস্কারের প্রার্থীদের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রদান করা হয় যা জাতীয় কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধনকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ৫ (পাঁচ)টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হয়। যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়।
ইঁদুর অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং লাজুক প্রাণী বিধায় সাধারণ বিষটোপ এবং ফাঁদ ব্যবহার করে সহজে ইঁদুর দমন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এছাড়া ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে বিধায় এককভাবে ইঁদুর দমন কার্যকর হয় না। এ কারণে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে একযোগে দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়। ফসলের মাঠে ইঁদুর দমনের জন্য বিভিন্ন প্রকারের যান্ত্রিক ফাঁদ ও বিষটোপ এবং ঘর ও গুদামের ইঁদুর দমনের জন্য বিষটোপের পাশাপাশি আঠাযুক্ত ফাঁদ ব্যবহার করলে অধিকতর ফলপ্রসু হয়। তবে বিষটোপ গুদামজাত, পরিবহন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বদা এমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে বিষটোপগুলি মানুষ ও পশু খাদ্যের সংস্পর্শে এসে সেগুলিকে বিষাক্ত না করে এবং শিশুদের নাগালের বাহিরে থাকে।
ইঁদুর দমনের বিভিন্ন কলা কৌশল ও অন্যান্য বিষয় সবাই অবহিত করার জন্য এ প্রবন্ধে বিষয়গুলো সহজ তথা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে ডিএই তে কর্মরত প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি অফিসার কমপক্ষে ৬০০ অংশীজনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করবেন। আশা করা যায় এ সমন্বিত ইঁদুর দমন কার্যক্রম সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনে উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে ইঁদুর দমনকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করবে এবং আমাদের মাঠ ফসল, গুদামজাত শস্য, ঘরবাড়ি অন্যান্য সম্পদ ও অবকাঠামো রক্ষায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

লেখক : পরিচালক,চলতি দায়িত্ব উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। ফোন : ৯১৩১২৯৫, ই-মেইল :dppw@dae.gov.bd

বিস্তারিত
মিষ্টি ফসল চাষাবাদে ইঁদুরের মাধ্যমে

মিষ্টি ফসল চাষাবাদে ইঁদুরের মাধ্যমে
ক্ষতি ও প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তি
ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. মো. আতাউর রহমান২
প্রাচীনকাল থেকে আমাদের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের অবদান অসামান্য। এ দেশের কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে দেশের জনগণের দৈনন্দিন খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, শিল্পোৎপাদন, কর্মসংস্থানসহ কৃষি খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য এবং রপ্তানি বাণিজ্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল। উৎপাদনের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রোগবালাই ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণীর আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করা বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনিষ্টকারী মেরুদ-ি প্রাণী দমন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাঠের ফসল উৎপাদন ও গুদামজাত শস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইঁদুর এক বড় সমস্যা। ইঁদুর মাঠের শস্য কেটে নষ্ট করে খায় এবং গর্তে জমা করে। মিষ্টি ফসলও অনিষ্টকারী ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। বিভিন্ন মিষ্টি ফসলে ইঁদুরের মাধ্যমে ক্ষতির প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আখ
বঙ্গোপসাগরের মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে জুন-আগস্ট মাসে বৃষ্টি হলেই ইঁদুর আখের মাঠে কোন গর্ত না করে আখ খেয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। মাটির ঠিক উপর থেকে আখ খাওয়া শুরু করে। গোড়ার দিক থেকে কোন আখের পুরা গার্থ, অর্ধেক গার্থ অথবা একটু খেয়ে এভাবে আখের ব্যাপক ক্ষতি করে। বাতাস হলেই ইঁদুরে ক্ষতিগ্রস্ত আখগুলো ভেঙে পড়ে। আখের ফলন প্রায় ৮- ১০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।                                                                 
সুগারবিট
ইঁদুর সুগারবিটের চারা গাছ ও পরিপক্ব উভয় অবস্থায় ক্ষতি করে থাকে। সুগারবিটের ক্ষেত পাতায় ঢাকা থাকে যার ফলে ইঁদুর প্রচুর সংখ্যক গর্ত করে। মাঠের কালো ইঁদুর জমিতে গর্ত করে এবং চারা গাছ ও গাছের পাতা কেটে গর্তে নিয়ে জমা করে। আবার গর্তের মাটি উপরে এক জায়গায় জড়ো করে মাটির ঢিবি তৈরি করে সুগারবিটের চারা গাছ ঢেকে দিয়ে ক্ষতি করে। সুগারবিটের মূল একটু বড় হলেই তা কেটে দেয়। তারপর মূল যখন বড় হয় তখন ইঁদুর মাটির নিচে গর্ত করে খেয়ে ক্ষতি করে। অর্ধপরিপক্ব সুগারবিট কামড়িয়ে খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেও প্রচুর পরিমাণে সুগারবিট ক্ষতি করে থাকে। ফলে সুগারবিটের ফলন কমে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে এপ্রিল-মে মাসে সুগারবিট পরিপক্ব হলেই মাটির নিচ থেকে মূল খেয়ে ফেলে। উল্লেখ্য, মাঠে কালো ইঁদুরের ক্ষেত্রে মোট গর্তের সংখ্যাকে ৩.৭ কেজি দ্বারা গুণ করলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে বের করা যায়। ইঁদুর সুগারবিট মাঠে ফসলের ৫-৭% ক্ষতি করে থাকে।                                                                                                                                                                                                                                                                 
খেজুর
ইঁদুর খেজুরের বাগানে খেজুর গাছে ছিদ্র করে এবং সেচ নালায় গর্ত করার সময় খেজুর গাছের শিকড় কেটে ফেলে। খেজুর গাছে ফল আসা শুরু হলেই খেজুর খাওয়া শুরু করে। কচি থেকে শুরু করে খেজুর পাকা পর্যন্ত খেয়ে নষ্ট করে। খেজুরের ফলন ৩০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
নারিকেল
সাধারণত গেছো ইঁদুর নারিকেলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। একটি জরিপে দেখা ঘেছে, পরিপক্ব নারিকেলের চেয়ে কচি ডাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। ফলে ডাব ছিদ্র যুক্ত হয়ে যায় এবং গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। এতে নারিকেল পরিপক্ব হতে পারে না এবং ফলন অনেক কমে যায়। বাংলাদেশে দক্ষিণ অঞ্চল বরিশাল, খুলনায় নারিকেলের বেশি ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, গড়ে বছরে গাছপ্রতি ১৫-২০টি নারিকেল ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি বা নষ্ট হয়, যার আনুমানিক মূল্য ২৫০-৪০০ টাকা।
স্টেভিয়া
স্টেভিয়া পৃথিবীর এক অত্যাশ্চর্য মিষ্টি গুল্মজাতীয় ভেষজ গাছ। এ গাছ শত শত বছর ধরে প্যারাগুয়ের পাহাড়ি অঞ্চল  রিওমন্ড এলাকায় চাষাবাদ হতো। ১৮৮৭ সালে সুইজারল্যান্ডের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ড. এম এস বার্টনি স্টেভিয়াকে প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। আফ্রিকাতে এটি মধু পাতা বা চিনি পাতা নামে পরিচিত। বাংলাদেশে চাষাবাদ শুরু হয় ২০০১ সালে। মাঠে ইঁদুর স্টেভিয়ার চারা গাছের গোড়া কেটে ক্ষতি করে থাকে।                                                         
স্টেভিয়ার মাঠ পাতায় ঢাকা থাকে যার ফলে ইঁদুর প্রচুর সংখ্যক গর্ত করে। মাঠের কালো ইঁদুর জমিতে গর্ত করে এবং চারা গাছ ও গাছের পাতা কেটে গর্তে নিয়ে জমা করে। আবার গর্তের মাটি উপরে এক জায়গায় জড়ো করে মাটির ঢিবি তৈরি করে স্টেভিয়ার চারা গাছ ঢেকে দিয়ে ক্ষতি করে। ইঁদুর মাটিতে গর্ত করে শিকড় খেয়ে ক্ষতি করে। ফলে স্টেভিয়ার গাছ মারা যায়। এভাবে সুগারবিটের গাছ মারা যাওয়ার ফলে পাতার ফলন অনেক কমে যায়। উল্লেখ্য যে, মাঠে কালো ইঁদুরের ক্ষেত্রে মোট গর্তের সংখ্যাকে ৩.৭ কেজি দ্বারা গুণ করলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে বের করা যায়। ইঁদুর স্টেভিয়ার মাঠে পাতার ফলন ৭-১০% কমিয়ে দিয়ে থাকে।                                                                                                                                                                                                                                
সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা (ওহঃবমৎধঃবফ চবংঃ সধহধমবসবহঃ)
ইঁদুরের মৌলিক চাহিদা যেমন-খাদ্য, পানি ও বাসস্থান সীমিত করে ইঁদুরের সংখ্যা কমানো যায়। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। সমন্বিত ইঁদুর নিধন, সুফল পাবে জনগণ। এতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে- আখের জমিতে সেচ দেওয়ার দিন। আখের জমির চারপাশের আইল উঠায়ে দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বা রড দ্বারা আইল তৈরি করলে ইঁদুর বাসা বাঁধার জায়গা না পেয়ে সেখানে যাবে না। এভাবে আখের জমিতে ইঁদুরকে নিরুৎসাহিত করে আমাদেরকে কমিউনিটি ফারমিং গড়ে তুলতে হবে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : ১) পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন ২)  জৈবিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন ৩) রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন।
বিএসআরআই উদ্ভাবিত বাঁশের তৈরি ফাঁদ মাঠে ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো যায় (চিত্র-৫)। প্রতি ১০ মিটার পর পর ইঁদুর মারার ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। ফাঁদে টোপ হিসেবে নারিকেল, বিস্কুট এবং শুঁটকি মাছ ব্যবহার করা যেতে পারে। মাঠে একযোগে কাজটি করতে হবে। ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে এবং কারেন্ট মরিচের ধোঁয়া দিয়ে গর্ত থেকে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলতে হবে। সতেজ গর্তে কাঁচা গোবরের মিশ্রণ (২০-৩০%) দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়। আখের জমির চারিদিকে এক মিটার উচ্চতায় পলিথিন দ্বারা ঘিরে দিয়ে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
ইকোসিস্টেম রক্ষায় আখের মাঠে রাতে প্যাঁচা বসার জন্য টাওয়ারের ব্যবস্থা করে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো যায়। তাই প্রতিটি উপজেলাতে বা জেলাতে প্রচুর খাসজমি আছে। উক্ত জমিতে বায়োডাইভারসিটি কর্ণার তৈরি করে, যেখানে বন বিড়াল, শিয়াল, বেজি, প্যাঁচা, বাজপাখি, চিল ইত্যাদির অভয়ারণ্য তৈরি করে এদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এরা ইঁদুর খেয়ে (যেমন- একটি প্যাঁচা বছরে ৮০০টি ইঁদুর খায়) উপদ্রব কমিয়ে রাখে।
সুতরাং সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করেই ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

লেখক : ১মহাপরিচালক, বিএসআরআই, ২সিএসও, প্রধান কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিএসআরআই, ফোন: ৫৮৮৮৪৬৯১১, ই-মেইল:  dg-bsri@bsri.gov.bd

 

বিস্তারিত
ধান ফসল রক্ষায় ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা

ধান ফসল রক্ষায় ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
মো: মোসাদ্দেক হোসেন১ ড. শেখ শামিউল হক২ ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন৩
বর্তমান সময়ে বিশ^ব্যাপী খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ধান উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত। খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকে থাকলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালাইয়ের কারণে প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দানাদার ফসল উৎপাদন ও রক্ষার যাবতীয় কৌশল সুচারুভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ধান ফসল উৎপাদন ও রক্ষার বিষয় আলোচনা করতে হলে ইঁদুরকে বাদ রেখে সম্ভব নয়। কারণ উৎপাদন ও গুদামজাতকরণ উভয়ক্ষেত্রেই ইঁদুর খাদ্য প্রাপ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে রাখতে গিয়ে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো এবং অতিরিক্ত উৎপাদন উপকরণ ব্যবহারের ফলে অন্যান্য বালাইয়ের মতো ইঁদুরের প্রকোপও বেড়ে গেছে।
ধান উৎপাদনকারী এশিয়ার প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে গুরুত্ব¡পূর্ণ বালাই হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এসব দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তÍ হতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। গবেষণা থেকে জানা যায় তিন মাসের জন্য ধান গুদামে রাখা হলে ৫ খেকে ১০ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হতে পারে। ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব সঠিকভাবে বুঝে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইঁদুরের বংশ ও বাসস্থান
প্রতি ধান মৌসুমে একটি স্ত্রী ইঁদুর অনুকূল পরিবেশে প্রায় ২৪টি বাচ্চা দিতে পারে। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের মধ্যে কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত মাঠের ইঁদুর ও ছোট লেজযুক্ত ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। মাঠ ফসলের ক্ষতিসাধনকারী একটি কালো ইঁদুরের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আর বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিচু জমিতে বেশি আক্রমণ করে। মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর গ্রীষ্ম মৌসুমে সাধারণত ফসলের ক্ষেত ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গর্তে থাকে এবং গর্তের মুখ বন্ধ রাখে ও মাটি স্তূপ করে রাখে। একটি গর্তে একটি মাত্র ইঁদুর থাকে। বর্ষার সময় নিম্নভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়।  
ধান ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি ও দমনের সময়
 সাধারণত আগাম পরিপক্ব ধানের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। ইঁদুর ধান গাছের কুশি তেরছা কোণে (৪৫ ডিগ্রি) কেটে দেয়। গাছে শীষ বের হলে শীষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি ও পাকা শীষগুলো কেটে দেয়। ইঁদুর ধান ফসলে তিন মৌসুমেই আক্রমণ করতে পারে। তবে আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এসময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। ইঁদুরের প্রজনন শুরুর পূর্বেই ইঁদুর নিধন করা দরকার। তাই আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। কারণ এ সময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এসময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে না এবং  ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে (ধানে থোড় আসার পূর্বে) ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার এবং জমিতে প্রথম পানি ছাড়ার দিন গভীর ও অগভীর সেচের নালায় ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
 ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান-কাল-পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সবাই মিলে একযোগে বেশি জায়গার ইঁদুর নিধনে ফসল রক্ষা পায় ও ইঁদুরের সংখ্যা পরবর্তীতে আর বাড়তে পারে না। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  ২) রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন এবং ৩) জৈবিক পদ্ধতিতে দমন।  
অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  
অরাসায়নিক পদ্ধতি হলো ভৌত ও যান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুরের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যেমন- গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা । ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে এবং মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা। জমির আইল চিকন (যেমন ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি), আগাছা এবং আবর্জনা ময়লা মুক্ত রাখা।
বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা। যেমন- কেচিকলে (করষষ ঃৎধঢ়), বাঁশের কল, বাঁশের ফাঁদ, জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ, মাটির ফাঁদ, মাটির চিটাগুড়ের ফাঁদ। উক্ত ফাঁদগুলো আবার দুই ধরনের-জীবিত ও মৃত (¯œ্যাপ) ফাঁদ। জীবন্ত ফাঁদে আবার একক ইঁদুর বা বহু ইঁদুর জীবন্ত ধরার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদে খাবার দিতে হয়। খাবার হিসাবে ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈলের মিশ্রণ তৈরি করে নাইলন বা মশারির কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টোপ হিসাবে দিতে হয়। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছ, সামুকের মাংসল অংশ, পাকা কলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলাগাছের ভেলার উপর ফাঁদ স্থাপন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। যখন দলগত বা সামাজিকভাবে বৃহৎ এলাকায় জীবিত ফাঁদ ব্যবহার করা হয় তখন ইহা খুবই কার্যকরী হয় এবং রাসায়নিক ব্যবহারের তুলনায় সাশ্রয়ী হয়।
এছাড়াও একই এলাকার ধান ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এবং স্বল্প জীবনকালের ধান (যেমন ব্রি ধান৬২) চাষ করে এটি ফাঁদ ফসল (ঞৎধঢ় পৎড়ঢ়) হিসেবে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়।
ট্র্যাপ ব্যারিয়ার সিস্টেমে ধান এবং অন্য যেসব ফসলে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি সেখানে এ পদ্ধতি কৌশলে ব্যবহার করা যায়। একটি টোপ ফাঁদ ফসল (আগাম পাকে) চাষ করে ইঁদুর ঢুকতে না পারে এ রকম বেড়া দিয়ে এটাকে ঘিরে দিয়ে বেড়ার মাঝে মাঝে ফাঁক তৈরি করে ফাঁকের ভেতরের দিকে একসাথে অনেক ইঁদুর ধরা পরে এ রকম জীবন্ত ফাঁদ পেতে রাখতে হবে। এই পদ্ধতির সফলতা পেতে হলে কাছাকাছি  সময়ে (১৫ দিনের মধ্যে) আশেপাশের সকল কৃষককে জমি লাগাতে হবে এবং বেড়ার টোপ ফসল আগাম পাকতে হবে। একটি ফাঁদ বেড়া (টিবিএস) চারদিকের ২০০ মিটার ব্যাসার্ধের ধান ফসল (১০ হেক্টর) রক্ষা করতে পারে।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমনে তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- ১) একমাত্রা বিষটোপ ২) দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ এবং ৩) বিষ গ্যাসবড়ি ব্যবহার করা হয়।
একমাত্রা বিষটোপ
এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর একবার খেলেই সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। এরূপ সর্বাধিক পরিচিত বিষটোপ হচ্ছে গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড (<২%)। এটি ব্যবহারের কৌশল হলো জিংক ফসফাইড ছাড়া শুধু গম কয়েকদিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করা। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয়।
দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ   
এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে  মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছুদিন অর্থাৎ ২ থেকে ১৪ দিন পর দুর্বল হয়ে গর্তের মধ্যে মারা যায়। যেমন- ল্যানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‌্যাট ইত্যাদি। এখানে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। বিষটোপ ছোট পাত্রে বা মোটা কাগজের পোঁটলা তৈরি করে সচল গর্তের মুখে রাখতে হবে।
গ্যাসবড়ি
গ্যাসবড়ি বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন করার মাধ্যমে ইঁদুর মেরে ফেলে। ইঁদুরের গর্তে বিষাক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিলে ইঁদুর মারা যায়। এ জন্য ফারো সিস্টেমের নতুন সচল গর্তে গ্যাসবড়ি দিয়ে আশপাশের সকল গর্তের/নালার মুখ মাটি দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দিতে হবে। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ছাড়াও ফসটক্সিন ট্যাবলেট, হাইড্রোজেন/রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
রাসায়নিক রিপ্যালেন্ট
গুদামজাত বীজে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে তা রিপ্যালেন্ট হিসাবে কাজ করে। যেমন-গেছো ইঁদুর/ঘরের ইঁদুর ম্যালাথিয়ন ব্যবহারিত স্থান এড়িয়ে চলে। এছাড়া দেখা গিয়েছে যে, সাইক্লোহেক্সামাইড ব্যবহৃত এলাকায় ইঁদুরের উপস্থিতি একেবারেই কম।
জৈবিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
জৈবিক পদ্ধতি হলো ইঁদুর দমনে অন্য জীবের সাহায্য নেয়া। ইঁদুরভোজী প্রাণীদের রক্ষা এবং বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। প্যাঁচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুইসাপ ও বিড়াল জাতীয় প্রাণীর প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। এদের     প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রজনন ও প্রতিপালন কার্যক্রমকে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহিত করে এদের সংরক্ষণ ও বংশ বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হবে।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান, ৩মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর-১৭০১, মোবাইল : ০১৭১৫০১১৩৫১, ই-মেইল :shamiulent@gmail.com

বিস্তারিত
প্যাঁচা সংরক্ষণ : ইঁদুর দমনের একটি জৈবিক পদ্ধতি

প্যাঁচা সংরক্ষণ : ইঁদুর দমনের একটি জৈবিক পদ্ধতি
ড. মোঃ শাহ আলম১ ড. এ টি এম হাসানুজ্জামান২
ইঁদুর নামক প্রাণীটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। প্রাণীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।
ইঁদুর আমাদের বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে ইঁদুরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সময়ে সময়ে ইঁদুর ফসল ও কৃষকের প্রধান শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। জমির শস্য ও গোলার ফসল রক্ষার্থে ইঁদুর দমন করতে হয়। আমরা জানি ইঁদুরের প্রধান শত্রু প্যাঁচা, চিল, সাপ, বিড়াল প্রভৃতি। প্যাঁচা দিয়ে জৈবিক উপায়ে ইঁদুর দমন করা গেলে  প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। সেই সাথে কৃষকও স্বল্প খরচে ফসলি জমির ও গোলার শস্য ইঁদুরের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারবে।
ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন এ প্রক্রিয়ায় ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন জীবিত জীব যেমন প্যাঁচা, বেজি, বিড়াল, গুঁইসাপ এবং কুকুরের ব্যবহার অপরিসীম। বর্তমানে বেজি বা গুঁইসাপের পরিবেশ বিপন্ন। গুইসাপের চামড়া মূল্যবান হওয়ায় অবৈধ শিকারের ফলে এদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় বিড়াল এবং কুকুরের ব্যবহার অপর্যাপ্ত। কারণ বিড়াল বা কুকুরকে ইঁদুর শিকার করতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে ‘ওত পাততে বা এমবুশ করতে হয়। ফলে এদের ক্ষেত্রে ইঁদুর ধরার সফলতা কম। এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, প্যাঁচার খাদ্যাভাসে বা খাদ্য-শিকলে ইঁদুরের দেহাবশেষ সর্বোচ্চ, শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ অর্থাৎ খাদ্য-শিকলের ৯০ ভাগ ইঁদুরের দখলে। শুধু তাই নয়, ইঁদুরের আবাসস্থল খুঁজে প্যাঁচা শিকার করে বিধায় এর শিকার-সফলতাও অনেক বেশি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক লক্ষীপেচা প্রতিদিন ৩-৪টি ইঁদুর ভক্ষণ করে কিন্তু যখন বাসায় বাচ্চা থাকে তখন প্রায় প্রতিদিন ২৫টি ইঁদুর সংগ্রহ করে। কাজেই একটি ক্ষুধার্ত প্যাঁচা পরিবার বছরে প্রায় ৩০০০টি ইঁদুর ভক্ষণ করে থাকে। এছাড়া রাতে ইঁদুর ও প্যাঁচা দুটোই সক্রিয় হয় বলে মাঠের ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় প্যাঁচার শিকার কৌশল ইঁদুরের নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে।
প্যাঁচার প্রজাতি
এখন পর্যন্ত যেসব প্যাঁচার দেখা পাওয়া যায় তাদেরকে দুটো গোত্রে ভাগ করা হয়েছে: সাধারণ প্যাঁচা বা ঝঃৎরমরফধব এবং লক্ষ্মীপ্যাঁচা বা ঞুঃড়হরফধব। ভিন্ন প্রজাতির পেঁচার ডাক ভিন্ন রকম। ডাকের ভিন্নতা অনুযায়ী বাংলায় বিভিন্ন প্যাঁচার বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে। যেমন: হুতুম প্যাঁচা (ইঁনড় নবহমধষবহংরং), ভূতুম প্যাঁচা (কবঃঁঢ়ধ ুবুষড়হবহংরং), লক্ষ্মীপ্যাঁচা (ঞুঃড় ধষনধ), খুঁড়ুলে প্যাঁচা (অঃযবহব নৎধসধ), কুপোখ (ঘরহড়ী ংপঁঃঁষধঃধ), নিমপোখ (ঙঃঁং ষবঢ়রলর) ইত্যাদি। তবে আমাদের দেশে ফসলের ক্ষেতের আশপাশে গাছগাছালিতে সাধারণত দুই ধরনের প্যাঁচা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। লক্ষ্মীপ্যাঁচা এবং খুঁডুলে প্যাঁচা।
প্যাঁচার শিকার কৌশল
লক্ষèীপেচা খুবই দক্ষ শিকারি পাখি। ইঁদুর ও অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর অবস্থান ও শিকার দক্ষভাবে ধরতে পারে। লক্ষ্মীপ্যাঁচা শিকারের উদ্দেশ্যে উড়ার সময় ধীর গতি এবং মথের মতো দোদুল্যমান উড়ন্ত অবস্থা সম্পূর্ণ শব্দহীনভাবে উড়তে পারে যা তাদের উপস্থিতি ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বুঝতে পারে না ফলে প্যাঁচা তাদের শিকার ভালোভাবে খুঁজতে পারে এমনকি খচমচে শব্দও তারা শনাক্ত করতে পারে। অন্যান্য পাখির চেয়ে প্যাঁচার হালকা শরীর এবং অনেক লম্বা পাখা এবং তাদের পাখার ওজন খুবই কম যার জন্য ধীরে এবং নিঃশব্দে অনেক নিচ দিয়ে বেশি সময় ধরে উড়তে পারে। প্যাঁচার পাখা খুবই মসৃণ এবং পাখার প্রান্তে একসারি অতি সূক্ষ্ম হুকআকৃতির গঠন যা বাতাসকে আটকে রাখে ফলে পাখার কোন শব্দ হয় না। পাখার এই বিশেষ গঠনের জন্য এরা কম পরিশ্রমে বেশি জায়গা নিয়ে বেশি সময় ধরে নিঃশব্দে উড়তে পরে বিধায় এদের শিকার ধরা সহজ হয়। প্যাঁচার ঘাড়ের হাড় ঝ আকৃতির যার জন্য প্যাঁচা তার মাথাকে একদিকে ১৩৫ ডিগ্রি কোণে ঘোরাতে পারে। তাই দুই দিক মিলে এদের দৃষ্টিসীমা ২৭০ ডিগ্রি। ফলে এরা নিজের কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে দেখতে পায়।
এদের আছে বিশেষভাবে অভিযোজিত চক্ষু যা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং কালো কিন্তু দৃষ্টিশক্তি খুবই প্রখর, অন্ধকারেও প্যাঁচা যে কোন বস্তু স্পষ্ট দেখতে পারে। এমনকি বিশেষভাবে অন্ধকারে অভিযোজিত চক্ষু দিনের বেলাও মানুষের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়। অন্যটি হলো কানের ত্রিমাত্রিক শ্রবণ। প্যাঁচার মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ ত্রিমাত্রিকভাবে শোনার জন্য কাজ করে। এর ফলে সৃষ্ট শব্দ এবং তার অবস্থান, অন্য যে কোনো পাখির তুলনায় এরা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে ফলে ইঁদুরজাতীয় প্রাণী কর্তৃক সৃষ্ট কিচিরমিচির বা অন্য যে কোনো শব্দের শব্দতরঙ্গের অবস্থান অন্ধকারের মধ্যে প্রায় ৩০ মিটার দূর হতে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে। কানে শব্দ পৌঁছার সাথে সাথে প্যাঁচা সেদিকেই দৃষ্টি ফেরায়, ফলে শিকারটি মাথার সামনের দিকে অবস্থান করে বিধায় প্যাঁচা সহজেই শিকার ধরতে পারে। রাতে বিচরণকারী অন্যান্য প্যাঁচার তুলনায়, লক্ষী প্যাঁচার দুই কানেই এক সেট করে উন্নত অংশ রয়েছে, যার খোলা স্থানটি ভিন্ন ভিন্ন কোণে থাকায় ইঁদুর কর্তৃক উৎপন্ন উচ্চ বা নিম্ন তরঙ্গ দৈঘ্যের যে কোনো শব্দ, তা কোন দিক থেকে (ডান-বাম-ওপর-নিচ) এবং কতদূর থেকে আসছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা তা সঠিকভাবে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও নির্ণয় করতে পারে। বিশেষভাবে অভিযোজিত শ্রবণ শক্তি দিয়ে এরা দিনের বেলা এমনকি ঘন ফসলের ও ঝোপঝাড়ের ভেতরও শিকার ধরতে সক্ষম।
প্যাঁচার বিশেষায়িত লম্বা পা, তীক্ষè ও শক্তিশালী নখ বা টেলন যা গভীর ফসলি জমির ভেতরে শিকার ধরতে সক্ষম। নখ বা টেলন খুবই তীক্ষè যার মাধ্যমে শিকার দৃঢ়মুষ্টিতে আকড়িয়ে ধরে ঠোঁটের সাহায্য ছাড়াই মেরে ফেলতে পারে। অন্যান্য পাখির মতো প্যাঁচার পাখা পানিরোধী (ধিঃবৎ ঢ়ৎড়ড়ভ) নয়। এই জন্য প্যাঁচা সাধারণত বৃষ্টির সময় এবং শীতে শিকার ধরা এড়িয়ে চলে, কারণ পালক ভিজে গেলে শব্দ হয় এবং শিকার ধরার সক্ষমতা কমে যায়।
প্যাঁচার বিচরণ এলাকা
প্যাঁচার বিচরণ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণত এরা যখন যেখানে বা যে এলাকায় থাকে সেখানকার নেস্ট বক্স (ঘবংঃ নড়ী) ব্যবহার করে। এরা ডজন ডজন বা কলোনি করে গ্রুপে কোনো এলাকায় থাকতে পছন্দ করে। সেজন্য বলা হয় যে, কোনো ফার্মে/এলাকায় একটি প্যাঁচা রাখার চেয়ে কলোনি আকারে সংরক্ষণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এভাবে ইধৎহ ঙষি-এর একটি কলোনি কোনো এলাকার ইঁদুরের আক্রমণকে দারুণভাবে কমিয়ে দিতে পারে। এরা আক্রান্ত এলাকার সব ইঁদুরকে দমন করতে পারে না। প্যাঁচা সব ইঁদুর ধ্বংস না করে ভারসাম্য অবস্থায় ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত অনুপাতে সংরক্ষণ করে এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখে।
পৃথিবীর সর্বত্রই পেচাজাতীয় প্রাণীকে যেখানে ইঁদুরজাতীয় প্রাণীদের অবস্থান সেখানেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের কৃষক মাঠ ফসলের ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যাঁচাকে ব্যবহার করছে। প্যাঁচার বসবাসকে উৎসাহিত করার জন্য কৃষকের জমিতে প্যাঁচার ঘর (ঘবংঃ-নড়ী) এবং রাতে প্যাঁচা বসার জন্য টাওয়ারের ব্যবস্থা করছে এবং কাংক্ষিত মাত্রার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। এরই আলোকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগ মাঠ ফসলের গম, বার্লি, আলু, মিস্টি আলু বিভিন্ন সবজি ইঁদুরর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গবেষণা প্লটের ওপর দিয়ে ৫০ মিটার পরপর            ১০-১২ ফিট উচ্চতায় ঢ আকারের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এতে রাতে প্যাঁচা বসে এবং খুঁটিকে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (ডধঃপয ঞড়বিৎ) হিসেবে ব্যবহার করে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে রাতে প্যাঁচা বসে মাঠের ইঁদুর নীরবে নিঃশব্দে ধরে খায়। এরা ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের ইঁদুর বেশি পছন্দ করে। কারণ প্যাঁচা আস্তঃপুরো ইঁদুরটি গিলে ফেলতে বেশি আগ্রহী, তবে শিকারকৃত ইঁদুরের আকার বা তার ওজন বেশি হলে এরা প্রথমে ইঁদুরের মাথা এবং পরে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। ইঁদুরের হাড়, পশম, মাথার খুলি ইত্যাদি হজম হয় না। শিকার ধরার আগে প্যাঁচা এর আগে গৃহীত বা ভক্ষণকৃত ইঁদুরের অপাচিত অংশগুলো পিলেট (চবষষবঃ) আকারে বমি (জবমঁৎমরঃধঃবফ) করে। বমিকৃত পিলেট সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিয়ে ৮% নরমাল ঘধঙঐ দ্রবণে ভিজালে ইঁদুরের চামড়া, হাড় এবং মাথার খুলি পৃথক হয় এবং ইঁদুর প্রজাতির শনাক্তকরণ সম্ভব হয়। পিলেট বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে প্যাঁচার খাবারের ৮০-৯০ শতাংশই ইঁদুর ও চিকার হাড়, পশম ও মাথার খুলি এবং এতে বুঝা যায় যে প্যাঁচার প্রধান খাবার হলো ইঁদুর, সলুই, চিকা ইত্যাদি।  
তাই জৈব পদ্ধতির অংশ হিসেবে প্যাঁচা লালন-পালন বা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনা করা যায়। আমাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (ডধঃপয ঞড়বিৎ) স্থাপনকৃত এলাকার আশেপাশে ইঁদুরের সতেজ গর্ত (ধপঃরাব নঁৎৎড়ংি) ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (ডধঃপয ঞড়বিৎ) বিহীন এলাকা হতে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ কম। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে প্যাঁচার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই জৈব পদ্ধতির অংশ হিসেবে প্যাঁচা লালন-পালন বা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনা বা ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।
প্যাঁচা কমে যাওয়ার কারণ
বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্যাঁচার সংখ্যা কমে যাচ্ছে তার প্রধান কারণ হল প্যাঁচার অস্বাভাবিক মৃত্যু ও প্রজননের সুযোগ সুবিধা হ্রাস পাওয়া। এছাড়াও আবাসস্থল হারানো; ইঁদুর নাশকের যত্রতত্র ব্যবহার; প্যাঁচার বাসা ও বিশ্রামের স্থান কমে যাওয়া।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সংরক্ষণ করে প্যাঁচার সংখ্যা বৃদ্ধির উপায়
আবাসস্থল সংরক্ষণ : প্যাঁচা পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্যাঁচা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও ফুডচেইন এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতির পরিবেশে তাদের সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। নির্বিচারে বড় বড় গাছ না কেটে এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে প্যাঁচাই নয় অন্যান্য পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল হিসাবে ভূমিকা রাখবে।
ইঁদুর নাশকের যত্রতত্র ব্যবহারে সতর্কতা : ইঁদুরনাশক ব্যবহারের ফলে মারা যাওয়া ইঁদুর যেখানে সেখানে না ফেলে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে ইঁদুরনাশক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। গর্তের ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে গর্তের ভেতর বিষটোপ ব্যবহার করতে হবে যাতে ইঁদুর বিষটোপ খেয়ে গর্তের ভেতর মারা যায়। এতে সেকেন্ডারি বিষক্রিয়া এর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। ফলে ইঁদুরনাশকে মৃত ইঁদুর, ইঁদুরভোজী প্রাণীর সংস্পর্শে আসবে না এবং পরিবেশ দূষণ কম হবে ও প্যাঁচা সংরক্ষণে সহায়তা হবে।
প্যাঁচা ব্যবহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং প্যাঁচার জীবন-বৃত্তান্ত এবং তার পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার তথ্যাদি লিফলেট, বুকলেট বা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জ্ঞাত করা যে প্যাঁচা আমাদের কোন ক্ষতি করে না বরং এরা জমির ইঁদুর ও কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসল রক্ষা করে থাকে। রাতে ইঁদুর ও প্যাঁচা দুটিই সক্রিয় হয় এবং প্যাঁচা ইঁদুরের আবাসস্থল খুঁজে শিকার করে। তাই এর শিকার-সফলতা অনান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি। মাঠের ইঁদুর ব্যবস্থাপনায় প্যাঁচা নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে মাঠ ফসলের ইঁদুর ব্যবস্থাপনা হবে দূষণমুক্ত ও পরিবেশসম্মত, সাশ্রয়ী হবে কৃষি উৎপাদন এবং বিপুল অর্থসম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে।

লেখক :  ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগ, বাংলাদেশ  কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর -১৭০১, মোবাইল : ০১৯১১৮৫৭৫৮৬, ই-মেইল : alamvpd@gmail.com

বিস্তারিত
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকরী উপায়

প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইঁদুর ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকরী উপায়
ড. হাবিবুর রহমান
বিশ্বের অনিষ্টকর প্রাণীদের মাঝে ইঁদুরের অবস্থান সর্বাগ্রে। ইঁদুর গরীব ধনী চিনে না, তাই এমন কোনো স্থান নেই যেখানে ইঁদুরের যন্ত্রণা নেই। নতুন, পুরনো, মূল্যবান কিংবা সস্তা যাই হোক সব জিনিসই অচল করে দেয় ইঁদুর। সবচেয়ে বড় কথা একটি ইঁদুর মানুষের জন্য প্রায় ৬০ ধরণের রোগের জীবাণু বয়ে বেড়ায়। খাবার আর শখের পোশাক কাটাকাটিতে ওস্তাদ এ প্রাণিটির হাত থেকে রক্ষা পেতে কে না চায়।
প্রতিরোধ/প্রতিবন্ধক ব্যবস্থাপনা একটি পরিবেশ বান্ধব ইঁদুর দমন পদ্ধতি। সীমিত পরিসরে ফসলের জমিকে ইঁদুরজাতীয় বালাই থেকে  রক্ষা করার একটি কার্যকরী পদ্ধতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধান ক্ষেতে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে এটি বেশ সফল প্রমাণিত হয়েছে। অপরদিকে, ইঁদুরকে তাড়ানোর বা দূরে রাখার নানারকম কৌশল রয়েছে যার মাধ্যমে গুদামজাত ফসল এবং বসতবাড়ির ব্যবহার্য আসবাবপত্র/দ্রব্যাদি সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। ইঁদুর প্রতিরোধের কলাকৌশলের মধ্যে পরিবেশগত, উদ্ভিজ্জ, রাসায়নিক ও জৈবিক বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকরী উপায় ব্যবহার করে প্রতিরোধ করা যায়। এখানে পরিবেশগত ও উদ্ভিজ্জ প্রতিরোধের প্রযুক্তি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো-
পরিবেশগত প্রতিরোধ (ঊপড়ষড়মরপধষ নধৎৎরবৎ)
চাষাবাদ পদ্ধতি (ঈঁষঃঁৎধষ পড়হঃৎড়ষ) : জমি তৈরির সময় ন্যূনতম ১৮ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিয়ে, আইল ছেঁটে ছোট বা চিকন রেখে, আইলের সংখ্যা কমিয়ে, নিয়মিত আগাছা পরিস্কার করে, ইঁদুর-সৃষ্ট গর্ত দূর করে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ৬ ইঞ্চি উচ্চতা ও ৮ ইঞ্চি প্রশস্ততা বিশিষ্ট আইল তৈরি করলে ইঁদুর আইলে গর্ত করে বসবাস করতে পারে না। ইঁদুর আক্রমণপ্রবণ অঞ্চলে ‘শূন্য কর্ষণ (তবৎড় ঃরষষধমব)’ কিংবা ন্যূনতম কর্ষণ (গরহরসঁস ঃরষষধমব)’পরিহার করতে হবে। আখ লম্বা হয়ে বাতাসে ঢলে পড়লে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে। তাই আখ বা-ল বা গোছা করে বেঁধে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, আহার, বাসস্থান ও পানি এ তিনের যে কোন একটির অভাব হলে ইঁদুর স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়।
শস্যাবর্তন পদ্ধতি বা শস্যপর্যায় (ঈৎড়ঢ় ৎড়ঃধঃরড়হ) : গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ধান-আখ-গম শস্য-চক্র ইঁদুরের বিস্তার ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ ধান-গম শস্য ব্যবস্থায় ধান কর্তন শেষে ইঁদুর পার্শ্ববর্তী আখ ক্ষেতে গমন করে এবং আখ কর্তন শেষ হলে পুনরায় গম ক্ষেতে ফিরে এসে বাধাহীন জীবনচক্র চালিয়ে যায়। তাই ভিন্ন শস্য-পর্যায় অবলম্বন করলে ইঁদুরের স্বাভাবিক বিস্তার ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। ইঁদুর শুকনোর চেয়ে ভেজা মাটি অধিক পছন্দ করে বিধায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়ায় ধান কিংবা গমের স্থলে অন্য কোন উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যোগ করলে ইঁদুরের আক্রমণ হ্রাস পায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (ঈষবধহষরহবংং/ঐুমরবহব) : বসত-বাড়ি, রান্নাঘর, ভা-ার, খাদ্য গুদাম, বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর পাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীর পাড় ও জমির চারপাশের ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার, অবাঞ্ছিত আগাছা ও ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নির্মূল করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। খড়ের গাদা মাটি হতে ১৮-২৪ ইঞ্চি উঁচুতে মাচা তৈরি করে স্থাপন করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা হ্রাস পায়। মুরগির বিষ্ঠা মুরগির শেড থেকে দূরে রাখলে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমে যায়।
শস্যসূচি (ঈৎড়ঢ় ংপযবফঁষরহম) : মাঠে সবাই মিলে একসাথে ফসল রুয়ে, বুনে ও কেটে আনলে দীর্ঘদিন মাঠে খাবার না পেয়ে ইঁদুরের জন্মহার হ্রাস পেলে পরোক্ষভাবে তা ইঁদুর দমনে সহায়ক হবে। কারণ ইঁদুর আগাম বোনা ফসলে আহার্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে আগে আক্রমণ করে কিন্তু উক্ত ফসল কর্তন শেষে তদসংলগ্ন অন্য নাবি ফসলে স্থানান্তরিত হয়। তাই বিস্তৃত এলাকায় একই সাথে একই সময়ে পরিপক্ব হওয়া জাত বপন বা রোপণ করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা কমে (ফার্মস এন্ড ফার্মার. ২০২১)।
উদ্ভিজ্জ প্রতিরোধ (ইড়ঃধহরপধষ নধৎৎরবৎ)
পেপারমিন্ট তেল, তেতুল এবং লবঙ্গ : গন্ধের প্রতি ইঁদুর বেশ সংবেদনশীল। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী পেপারমিন্ট তেল, তেতুল এবং লবঙ্গ ইত্যাদি দ্রব্যাদির গন্ধ পছন্দ করেনা । এই সকল এক বা একাধিক মিশ্রিত দ্রব্যাদি কিছু তুলার বল অথবা গুঁড়া করে এমন জায়গাগুলিতে রেখে দেওয়া যেখানে ইঁদুরগুলো সাধারণত লুকায়িত থাকে (যেমন খাটের নীচে এবং ঘরের কোনায় কোনায়) (ঐধংধহুুঁধসধহ ্ অষধস,  ২০১৮; হক, ২০০২)।
পুদিনার পাতার ব্যবহার :  ইঁদুর পুদিনার পাতা ও পুদিনার তেল একদম সহ্য করতে পারে না। তাই ইঁদুরকে ঘর থেকে বাইরে রাখতে হলে ঘরের প্রতিটা কোনা ও ইঁদুর থাকার জায়গাগুলোতে পুদিনা পাতা রেখে দিন। বসতবাড়ির আশপাশে যাতে ইঁদুর  ঘোরাঘুরি করতে না পারে এর জন্য বাড়ির চারপাশে পুদিনা গাছ লাগান। ব্যবহার্য জিনিসপত্র ইঁদুর থেকে দূরে রাখতে পুদিনা পাতা বেঁটে লেপে দিয়ে অথবা পুদিনা তেল ব্যবহার করা উত্তম পদ্ধতি (হক, ২০০২)।
গোল মরিচের ব্যবহার : গোলমরিচের গন্ধ ইঁদুর একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ইঁদুর মারতে গোল মরিচের জুড়ি নেই। আপনার বাড়ির ইঁদুরের বাসস্থানে গোল মরিচ রেখে দেখুন ইঁদুর মরবেই। গোলমরিচের পানজেন্ট ধরণের ঘ্রাণ অর্থাৎ ঝাঁজপূর্ণ ঘ্রাণ ইঁদুরের ফুসফুসে গেলে শ্বাস নিতে পারে না ইঁদুর। আর এ কারণে খুব সহজেই মারা পড়ে। যে সকল স্থানে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি বা ইঁদুরের আবাস রয়েছে মনে করছেন সে সকল স্থানে গোলমরিচ গুঁড়া করে ছড়িয়ে রেখে দিলে ইঁদুর নির্বংশ হবে খুব সহজেই (কযধহ, ১৯৮৪, হক, ২০০২)।
পেঁয়াজের ব্যবহার : পেঁয়াজের উপাদান ইঁদুর হজম করতে পারে না। ইঁদুরের গর্তের মুখে পেঁয়াজ কেটে রেখে দিন আর এতেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু ইঁদুর খুব সহজেই পেঁয়াজে কামড় দিয়ে বসে। ইঁদুর যেখানে রয়েছে বলে মনে হয় সে সকল স্থানে পেঁয়াজ টুকরো করে রেখে দিলে কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুর আর দেখা যাবে না।
শুকনো গোবর ব্যবহার : শুনে হাসি আসলেও আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে ইঁদুর মারতে শুকনো গোবর খুব কাজের। কোনো ইঁদুর যদি শুকনো গোবর খেয়ে ফেলে তবে তার মৃত্যু ঠেকানো যাবে না (কযধহ, ১৯৮৪)।
তেজপাতার ব্যবহার : তেজপাতা খুবই উপকারী একটি মসলা যা প্রত্যেকের ঘরেই রয়েছে। এই উপকারী মসলাটিও ইঁদুরের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা যায় অনায়াসেই। তেজপাতাকে ইঁদুরেরা নিজেদের খাবার মনে করে। কিন্তু তেজপাতা খাওয়ার পর তারা এটি হজম করতে পারে না একেবারেই। তেজপাতা গুঁড়া করে ছড়িয়ে রাখুন উপদ্রবের স্থানগুলোতে কিছুদিনের মধ্যেই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন।
ইঁদুরের চলাচল প্রতিবন্ধকতার বিভিন্ন কৌশল
ফাঁদ ফসল রোপণ করে বেরিয়ার নির্মাণ : প্রতিটি মৌসুম বেরিয়ার নির্মাণের পরেই এর ভিতরে ফাঁদ ফসল রোপণ করতে হয়। ফাঁদের ভেতরে তিন সপ্তাহ পরে মূল ফসলের চারা রোপণ করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় ফসলে সকল প্রকার আন্তঃপরিচর্যা সম্পন্ন করতে হয়। বেরিয়ার নির্মাণের উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো এটি পরিবেশগতভাবে ফসলকে রক্ষা করে। কারণ পুরো ফসলটি পলিথিলিনের চাদরে আবৃত হয় এবং পলিথিনটি পর্যাপ্ত উচ্চতায় রাখা হয় (৯০-৯৫ সেমি.)। ১০দ্ধ১০ বর্গমিটার সাইজের একটি ফসলের জমির চারকোনায় বাঁশের খুঁটি পোতা হয়। খুঁটিসহ জমির চারপাশ এক মিটার প্রস্থের একটি পলিথিন সিট দ্বারা এমনভাবে আবৃত করা হয় যেন ৫-১০ সেমি পলিথিন মাটির গভীরে থাকে। লাইভ-মাল্টিপল-ক্যাপচারের খাঁচা ট্র্যাপগুলো (২৪০দ্ধ১৫০দ্ধ১৫০ মিমি) প্রতিটি কোণ থেকে প্রতি ২.৫ মি. অন্তর অন্তর স্থাপন করা হয়। প্রতি পার্শ্বে দুটি করে চারপাশে মোট আটটি করে ট্রাপ স্থাপন করা হয়। ট্র্যাপগুলি পলিথিন শিটের তৈরি গর্তের মুখোমুখি শক্তকরে স্থাপন করা হয় (গঁষঁহমঁ বঃ ধষ., ২০২০)। ফলে ইঁদুরগুলো লাইভ-মাল্টিপল-ক্যাপচারের খাঁচায় আটকা পড়ে ভেতরের ফসলকে রক্ষা করবে।
মাল্টি-ক্যাপচার ট্র্যাপগুলো থেকে সকালে ইদুরগুলি সাফ করা হয় এবং পুনরায় ফাঁদ স্থাপন করা। এভাবে ইঁদুর নিধন সমস্ত ফসল মৌসুম ধরে চলে (গঁষঁহমঁ বঃ ধষ., ২০২০)।
প্রবেশ প্রতিবন্ধকতা (ঊহঃৎু নধৎৎরবৎ/জধঃ ঢ়ৎড়ড়ভরহম) : দালানকোঠা, ঘরবাড়ি ও খাদ্যগুদামে দরজা-জানালা, গ্রিল, পাইপের খোলা মুখ ও অন্যান্য ইঁদুর প্রবেশ্য স্থানের ফাঁক-ফোকরে ধাতব পাত বা তারজালি লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং চলাচল প্রতিহত করা সম্ভব। পানির ট্যাপের ছিদ্র, ভাঙা  ড্রেন সর্বদা মেরামত করতে হবে যাতে ইঁদুরের জন্য পানি সহজলভ্য না হয়। ঘরে ড্রাম, মটকা, টিনের পাত্র ইত্যাদিতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্য-সামগ্রী সংরক্ষণ করলে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সম্ভব হলে শস্যাধারের মেঝে পাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ধাতব বা টিনের পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি : সাধারণত গেছো ইঁদুর ফল গাছের ক্ষতি করে থকে। এ ক্ষেত্রে টিনের পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইঁদুর আক্রমণ রোধ করা যায়। টিনের পাত লাগানোর পূর্বে ফলগাছকে ইঁদুরমুক্ত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মরা ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। অন্য গাছের সাথে লেগে থাকা ডালপালা ছেটে দিতে হবে যেন গাছ থেকে গাছের দূরত্ব দুই মিটার হয়। নারিকেল, তাল, সুপারিসহ অন্যান্য ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া থেকে দুই মিটার উপরে কা-ের চারিদিকে ৫০-৬০ সেমি প্রশস্ত টিনের পাত শক্ত করে আঁটকিয়ে দিতে হয়। ফলে ইঁদুর গাছের গোড়া থেকে উপরের দিকে উঠতে না পারে (কযধহ, ১৯৮৪)। পদ্ধতিটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী এবং লাভজনক। অরাসায়নিক হওয়ায় পরিবেশ থাকে নির্মল ও দূষণমুক্ত। এর বাড়তি সুবিধা হলে বেয়ে ওঠা পোকা (যেমনঃ রাইনোসেরোস বিটল) থেকেও ফলদবৃক্ষকে রক্ষা করে থাকে।

লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বশেমুরকৃবি, মোবাইল : ০১৭১৫২৯৬৪৫৬, ই-মেইল : hrahman@bsmrau.edu.bd

বিস্তারিত
প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি

প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি
কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
ইঁদুর হলো লম্বা দাঁতবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণি। কাঠবিড়ালী, সজারু একই বর্গের অন্তর্গত। ১৭০০ প্রজাতির ইঁদুর রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ১৮-২০টি প্রজাতি আপদবালাইরূপে পরিচিত। কাটাকাটি করা তাদের প্রকৃতিগত স্বভাব। ইঁদুর যে পরিমাণ খায় তারচেয়ে ১০ গুণ কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তার করে। স্ত্রী ইঁদুর ৩ মাস বয়সেই প্রথম বাচ্চা দেয়। প্রসবের ২ দিন পরেই গর্ভধারণ করে। গর্ভকাল ১৮-২২ দিন মাত্র। বছরে ৫-৭ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ৬-১০টি বাচ্চা প্রসব করে। জীবনকাল ২-৩ বছর।
গ্রীষ্মকালে ফসলের মাঠ ও বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে বাস করে। বর্ষাকালে পানির জন্য উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়-সড়ক, বাঁধ, পুরনো ও পতিত ঘরবাড়ি, প্রাণীর খামার যেমন: মুরগি, গাভী, হাঁস, ছাগল-ভেড়া, শুকুর, টার্কি, কোয়েল প্রভৃতি, পোল্ট্রি হ্যাচারি, মুরগি ও পশুর খাদ্যের দোকানে, ফিড মিলের স্টোররুমে, খড়ের গাদায়, শুঁটকি মাছের আড়তসহ বিভিন্ন স্থানে বাস করে বিভিন্নভাবে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি সাধন করে থাকে। সাধারণত ২ জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে। যেমন : বড় ইঁদুর (ইৎড়হি ৎধঃ, জধঃঃঁং হড়ৎাবমরপঁং = ১২০০-৮০০ গ্রাম) রাতে সচল থাকে। ছোট ইঁদুর (ঐড়ঁংব ৎধঃ, গঁং সঁংপঁষঁং = ১২-৩০ গ্রাম) দিন ও রাত সচল থাকে।
প্রাণিসম্পদ খাতে ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি
খড় কেটে ক্ষতি : বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুর মাঠের পাকা ধানগাছ কেটেকুটে গর্তে নিয়ে যায়, ফলে ধানের সাথে বিপুল পরিমাণ খড় নষ্ট করে থাকে। এ ছাড়াও কৃষকের সংরক্ষিত শুকনা খড়ের পালায় ইঁদুর প্রবেশ করে প্রচুর পরিমাণে খড় কেটে নষ্ট করে এবং মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলে। এ ক্ষতির পরিমাণ লাখ লাখ টাকা। দেশে গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত শুকনো খড় সংকটের কারণগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম কারণ।
বস্তা কেটে দানাদার পশুখাদ্য নষ্ট : পশু খাদ্য কারখানা, পশু খাদ্যের দোকান, শুঁটকি মাছের আড়ত ও খামারির স্টোররুমে রক্ষিত দানাদার খাদ্যের বস্তা কেটে খাদ্য খেয়ে ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য নষ্ট করে থাকে। যার মূল্য লাখ লাখ টাকা। আবার মুরগি, হাঁস ও কোয়েলের খামারে সন্ধ্যার পরে খাদ্যের পাত্র হতে ইঁদুর ওই খাদ্যে ভাগ বসায় ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে থাকে। এমনকি তারা পানির পাত্র হতে পানিও পান করে থাকে।
সাভার বাজারের ২০টি পশু খাদ্যের দোকানে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে বছরে ৪ লাখ টাকার ক্ষতি করে ইঁদুর। (সূত্র : প্রথম আলো)। বিশেষ করে রাতে মুরগির খামারে ইঁদুর প্রবেশের কারণে খাদ্য নষ্ট ছাড়াও ভয়ভীতি ও আতঙ্কের কারণে মুরগির ডিম উৎপাদন ব্যাহত হয়। বড় ইঁদুর ছোট মুরগির বাচ্চাকে মেরে ফেলে এবং মুরগির বাচ্চা ও ডিম খেয়ে থাকে।
ঘাস কেটে ক্ষতি : ইঁদুর মাঝে মাঝে ঘাসের জমিতে গর্ত করে ঘাসের চারা কেটে ঘাসের উৎপাদন ব্যাহত করে।
পশু-পাখিতে বিভিন্ন রোগ ছড়ানো : খড়ের পালা, খাদ্য কারখানা, পশু খাদ্যের দোকান ও গবাদিপশু পাখির খামারে ইঁদুর বসবাস করার কারণে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে থাকে।
ইঁদুরের মলমূত্র, লালা, বাসা তৈরির দ্রব্য ও ইঁদুরের মৃতদেহ দ্বারা যখন খামারে মেঝে, খাদ্য, বাতাস দূষিত হবে তখন খামারের পশুপাখি বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। আবার ইঁদুরের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে টিকটিকি ও মাছির মাধ্যমেও রোগ ছড়ায়। ইঁদুরের মলমূত্র দ্বারা দূষিত খাদ্য খেয়ে গরু খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং রোগে আক্রান্ত হয়, যা গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে।
ইঁদুরের মৃতদেহ মিশ্রিত খড়, সাইলেজ ও দানাদার খাদ্য খেয়ে গবাদিপশু বটুলিজম বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। অনেক সময় মরা ইঁদুর ফিডমিলে মিক্সার মেশিনের মাধ্যমে দানাদার খাদ্যে মিশে যায় এবং বটুলিজম বিষ ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য মাঝে মাঝে খড়ের পালা, দানাদার খাদ্যের ভা-ার পর্যক্ষেণ করতে হবে। ইঁদুর গবাদি প্রাণির যে সব সংক্রামক রোগ ছড়ায় তা নিম্নরূপ-
১. খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং - সকল গবাদিপশু, কুকুর, বিড়াল, শুকর।
২. ঝধষসড়হবষষড়ংরং - সকল গবাদিপশু, কুকুর, বিড়াল, শুকর ও পাখি।
৩. ঊথঈড়ষর - সকল গবাদিপশু ও পাখি, কুকুর, বিড়াল, শুকর, খরগোশ।
৪. ঞড়ীড়ঢ়ষধংসধ মড়হফর - সকল প্রাণি, শুকর, কুকুর, বিড়াল।
৫. ঝঃৎবঢ়ঃড়নধপরষষড়ংরং - সকল পশুপাখি।
৬. ঞৎরপভরহবষষধ - শুকর।
৭. খঁহম ড়িৎস - সকল গবাদিপশু কুকুর, বিড়াল।
৮. এরধৎফরধ - সকল গবাদিপশু, কুকুর, শুকর, বিড়াল।
৯. ঘবড়ংঢ়ড়ৎধ (চৎড়ঃড়ুড়ধ) - গবাদিপশু।
১০. ঞঁষধৎবসরধ - গবাদিপশু।
১১. এধহ এধহ ারৎঁং - গবাদিপশু।
১২. গধসসধৎু ঃঁসড়ঁৎ ারৎঁং - গবাদিপশু।
১৩. মিউরিন টাইফাস- গবাদিপশু।
কুকুর, বিড়াল সরাসরি ইঁদুরকে কামড়িয়ে বা খেয়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। ইঁদুরের প্রস্রাব দ্বারা দূষিত খাদ্য খেয়েও কুকুর, বিড়াল সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে চিকিৎসা করতে অনেক টাকা খরচ হয়ে থাকে। ইঁদুর মুরগি, হাঁস ও কোয়েলের খামারের প্লাস্টিক নেট, কাঠের দরজা, পলিথিন, চটের পর্দা ইত্যাদি কেটে আর্থিক ক্ষতি করে থাকে।
খামারে ইঁদুর দমন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা
ইঁদুর প্রতিরোধে ফসল ও প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে অনেকটা একই রকম।  দমন পদ্ধতিকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
১) অরাসায়নিক দমন : গর্ত খুঁড়ে দমন; গর্তে পানি ঢেলে দমন; গর্তে মরিচের ধোঁয়া প্রয়াগ; ফাঁদ ব্যবহার (বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ) করে দমন; গ্লুবোর্ড বা মেঝেতে গ্লু বা আঠা লাগিয়ে রাখা; প্রতিরোধক জাল ব্যবহার করা ও বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক ব্যবহার।
২) রাসায়নিক দমন : বিভিন্ন বিষটোপ খেলে দ্রুত মারা যায়; গ্যাসবড়ি গর্তে প্রয়োগ করতে হয়। রাসায়নিক দমন পদ্ধতি পশু-পাখির শেডের মধ্যে ব্যবহার না করাই উত্তম। শেডের বাইরে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩) জৈবিক দমন : শিয়াল, বেজি, প্যাঁচা, বনবিড়াল, সাপ, গুইসাপ, চিল ইত্যাদি কিন্তু এগুলো পশু-পাখির শেডের মধ্যে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
খামারের জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। খামারের চারপাশ, ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। রাতে মুরগির খাদ্যের পাত্র থেকে খাদ্য সরিয়ে নিতে হবে। রাতে কোন ডিম যেন না থাকে, ডিম ইঁদুরের প্রিয় খাদ্য। পানির পাত্র থেকে পানি সরিয়ে নিতে হবে। মুরগির খামার ও হ্যাচারি তৈরিতে প্লাস্টিক, কাঠ, রাবার ও গ্রিন সিমেন্ট ব্যবহার না করে শক্ত দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে। যেমন- কনক্রিট, গ্যালভানাইজড সিট (২৪ গজ), লোহার জালি ইত্যাদি।
মুরগির খামার ও হ্যাচারির দরজা এমনভাবে সেট করতে হবে যেন নিচ দিয়ে ইঁদুর প্রবেশ করতে না পারে (ডবষষ ংবধষবফ)। বিষটোপ ব্যবহার করার পর খেয়াল রাখতে হবে যেন মৃত ইঁদুর খেয়ে পশু-পাখি সেকেন্ডারি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত না হয়।
ইঁদুর প্রাণিসম্পদ খাতে বিভিন্নভাবে অনেক টাকার ক্ষতি করে থাকে। এ জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে ইঁদুর দমন করা প্রয়োজন।

লেখক : জেলা ভেটেরিনারি অফিসার, ঝিনাইদহ, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল : drmorogit66@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষকের আর্থিক উন্নয়নে মজাপুকুরে সমন্বিত সবজি ও মাছ চাষ

কৃষকের আর্থিক উন্নয়নে মজাপুকুরে সমন্বিত সবজি ও মাছ চাষ
ড. সত্যেন ম-ল১ এবিএম মোস্তাফিজুর২ বীর জাহাঙ্গীর সিরাজী৩
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নগরায়নের কারণে সবজি ও মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে কৃষি জমির রূপান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাবের কারণে খাদ্য সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। সুতরাং, একটি টেকসই বিকল্পের জরুরি প্রয়োজন। মজা পুকুরে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতি এমন একটি বিকল্প উৎপাদন প্রযুক্তি, যেখানে টেকসই উপায়ে জমি ও জলের যথাযথ ব্যবহার করে অধিক সবজি ও মাছ উৎপাদন করা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি পরিবেশগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায়, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, পরিবেশগত স্থায়িত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করে,  জীববৈচিত্র্য বজায় রাখা এবং মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে  এক অনন্য ভূমিকা পালন করে ।
বাংলাদেশে সমন্বিত ধান-মাছ চাষ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত  তবে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ প্রযুক্তির সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো অন্বেষণ করা প্রয়োজন। সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়, একটি জীবিকানির্ভর চাষ পদ্ধতি। শুধুমাত্র মাছচাষ বা শুধুমাত্র সবজি উৎপাদনের তুলনায় এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের পুষ্টির সংস্থানের পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো অপেক্ষাকৃত সহজ।
খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে শাকসবজি, ফলমূল ও মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ১৪ মিলিয়ন বসতবাড়ির প্রায় ৯০ ভাগ এর গড় আয়তন ৮১০ বর্গমিটার । বসতবাড়ির অনেক এলাকায় একটি পুকুর রয়েছে এবং বসতবাড়ির পুকুর পাড়ের চারপাশে যথেষ্ট পতিত জমি রয়েছে যা সবজি ও ফল উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেক পুকুর অগভীর হয়ে যায় এবং শুধুমাত্র বর্ষাকালে পানিতে ভরে যায়। এইসব অগভীর মজা পুকুরে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ করে, একটি প্রান্তিক বা ছোট পরিবার পর্যাপ্ত শাকসবজি এবং মাছ উৎপাদন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে ছোট পুকুরের পাড়ে সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বা ফল চাষ করা যায়। সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ পদ্ধতিতে একই সাথে বা পর্যায়ক্রমে মাছের সাথে পুকুরে কচু চাষ করা যায়, যা কিনা পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে অর্থনৈতিকভাবে যেকোন পরিবারকে সচ্ছল করতে সাহায্য করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসডিজি অর্জন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একই উৎপাদন পদ্ধতি থেকে সবজি ও মাছ উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। আমরা টেকসই পদ্ধতিতে সমন্বিত সবজি-মাছ চাষ এর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পুকুর পাড়ে সবজি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাসহ অন্তত একটি মৌসুমি বা পরিত্যক্ত পুকুর আছে এমন             কৃষকভাইদের এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে পারি। তাই ফসলের বহুমুখীকরণ এবং ফলন সর্বাধিক করার জন্য মিনিপুকুরে সবচেয়ে লাভজনক আধা জলজ চাষ পদ্ধতিতে এই প্রযুক্তিটি  সারা দেশে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য
প্রযুক্তিটি বসতবাড়ি সংলগ্ন মজা পুকুরের (১ মিটার গভীরতা) জন্য উপযোগী। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একজন কৃষক তার একখ- জমি থেকে সবজি, মাছ ও ফল উৎপাদন করতে পারে। পুকুরে পানিকচু+মাছের সমন্বিত চাষ করা হয় এবং একই সাথে পুকুরের পাড়ে পেঁপে ও মাচা করে সারা বছর সবজি চাষ করা হয়। বারি পানিকচু-৩ এবং মাছ হিসেবে তেলাপিয়া এই প্রযুক্তির জন্য খুব উপযোগী। প্রযুক্তিটি লাভজনক এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তির উপযোগিতা
এই প্রযুক্তিটি সমগ্র বাংলাদেশে যেখানে অগভীর (১ মিটার পর্যন্ত) মজা পুকুর পরিত্যক্ত অথবা স্বল্প ব্যবহৃত রয়েছে সেই সমস্ত এলাকার জন্য উপযোগী। প্রযুক্তিটি পরিত্যক্ত পুকুর খনন না করেও সর্বোচ্চ ব্যবহারের আওতায় আনা যায়। এ ছাড়া অনুরূপ অব্যবহৃত জলজ পতিত জমি এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে মজা পুকুরে বারি পানিকচু-৩ এর চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। চারা রোপণের আগে জমি তৈরির সময় প্রতি শতক জমিতে                    ৪০-১.২-০.৬-১.২-০.৪ কেজি হারে যথাক্রমে গোবর-ইউরিয়া-টিএসপি-জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। একই সময়ে পুকুরের পাড়ে মাদা করে পেঁপের চারা রোপণ করতে হবে। পানিকচু রোপণের প্রায় ৬০ দিন পরে  বৃষ্টির জমা পানিতে অথবা সেচ দিয়ে কচুর ভেতরে মাছের পোনা ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ২টি (শতাংশে ৮০টি) তেলাপিয়া মাছ ছাড়া হয়। তেলাপিয়া মাছের জন্য প্রায় এক মিটার পানির গভীরতাই যথেষ্ট, পানির গভীরতা বেশি হলে কচুর বৃদ্ধিতে অসুবিধা হয়। পুকুরের পাড়ে খরিফ (চিচিঙ্গা, ঝিঙা, করলা, চাল কুমড়া) ও রবি (লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, বরবরটি) মওসুমে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিটি সবজির জন্য মাদা তৈরি করে লতানো সবজির মাচা পুকুরের পানির পাড়ের পাশে তুলে দিতে হবে। সবজিতে সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যা প্রয়োজন মতো দিতে হবে। কচু রোপণের ৬০ দিন পর হতে পানিকচুর লতি  সংগ্রহ করা যায়। জুন মাস হতে পানিকচু সংগ্রহ করা যায় এবং আগস্ট মাসের মধ্যে সংগ্রহ সম্পন্ন হয়ে যায়। পুকুরের পানি কমে আসলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মাছ সংগ্রহ করা হয়। পুকুর রবি মওসুমে ব্যবহারের জন্য পুকুরের স্বল্প পানিকে কাজে লাগিয়ে ছালার বস্তায় মাটি ভরে রবি মওসুমের সবজি হিসেবে শিম ও লাউ চাষ করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে পুকুর থেকে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল সংগ্রহ করা হয়।  
প্রযুক্তি হতে ফলন/প্রাপ্তি
উক্ত প্রযুক্তি অনুসরণের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ (৬০০ বর্গমিটার) আয়তনের একটি মজা পুকুর থেকে প্রায় ৬০,৩০০/- টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। পতিত মজা পুকুরে কেবল তেলাপিয়া মাছ অথবা পাড়ে কেবল সবজি চাষ পদ্ধতির তুলনায় এই উন্নত প্রযুক্তিটি প্রায় ২৯৫ ভাগ অধিক মুনাফা অর্জনে সক্ষম। প্রযুক্তিটি সুষম খাদ্য সরবরাহ করে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
 
লেখক : ১সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল- ০১৭১২৪০৫১৪৯, ই-মেইল- satyen1981@gmail.com

বিস্তারিত
বাংলাদেশে প্ল্যান্ট টিসু কালচার এর সম্ভাবনা

বাংলাদেশে প্ল্যান্ট টিসু কালচার এর সম্ভাবনা
ড. মো. সাইফুল ইসলাম১ ড. শামীম আহমেদ২
উদ্ভিদের যেকোনো ক্ষুদ্রতম দৈহিক অংশ (somatic part) বা পৃথকীকৃত (isolated) কোনো কোষ (cell) টেস্টটিউবে বা যেকোনো পাত্রে কৃত্রিম মাধ্যমে (MSmedia) লালন (culture) করে মাতৃ উদ্ভিদের মতো অবিকল নতুন চারা উৎপন্ন করার এ কৌশলের নাম দেয়া হয় ক্ষুদ্র বংশবিস্তার (micro-propagation)। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এতে কিছু নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত করে পরে এর নাম দেওয়া টিসু কালচার।
জার্মান উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ববিদ হ্যাবারল্যান্ড কর্তৃক ১৯৯২ সনে প্রথম টিসু কালচারের জৈবিক মূলনীতিসমূহ (biological principles) বর্ণিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সনে তিনজন বিজ্ঞানী নোবকোর্ট, গেদার হাট এবং হোয়াট কৃত্রিম জীবাণুমুক্ত মাধ্যমে ক্যালাস কলাকে (callus tissue) স্বতন্ত্রভাবে লালন (culture) করতে সমর্থ হন।
কৃত্রিম বংশ বিস্তার (artificial propagation) বা টিসু কালচার প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য সুবিধাজনক দিকটি হল যেখানে একবীজপত্রী উদ্ভিদ (monocot) সাধারণত বীজ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বংশ বৃদ্ধি ঘটানো যায় না সেখানে এ পদ্ধতিতে খুব সহজেই এসব উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল খুব কম সময়ে এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণে চারা উৎপাদন করা যায়। স্ট্রবেরির মতো একটি ফল গাছের একটি একক কোষ (single cell) বা ক্ষুদ্রতম কোনো অংশ থেকে বছরে প্রায় দুই মিলিয়ন চারা পাওয়া সম্ভব।
তাছাড়া টিসু কালচার প্রক্রিয়া উৎপন্ন চারার আকারে খুব ছোটো হয়। স্বাভাবিক উৎপন্ন কলার চারার কথা বলা যায়। যেখানের এক হাজার কলার চারা পরিবহন করতে একটি বিশালাকার ট্রাকের প্রয়োজন, সেখানে টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন এক হাজার চারাকে বহন করতে ছোট আকারে রিকশা ভ্যানই যথেষ্ট। যার ফলে এ ধরনের চারা বহনে পরিবহন খাতে ব্যয় যথেষ্ট কম হয়। টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন চারা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় না। অপর পক্ষে এ প্রক্রিয়ার দ্বারা রোগ জীবাণু মুক্ত ও বীজ উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মাতৃ উদ্ভিদের শীর্ষস্থ (epical) ও পার্শ্বস্থ (lateral) মেরিস্টেমেটিক টিসু (Meristematic Tissue) হতে বীজ উৎপন্ন হয় বলে এতে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগ জীবাণুর আক্রমণ কম হয়। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এসব বীজ হতে চারা ও সুস্থ সবল উদ্ভিদ জন্মানো যায়। আমেরিকা মহাদেশ আজ ‘বিশ্বের রুটির ঝুড়ি  বলে খ্যাত যে কারণে তার প্রধান কারণ তাদের টিসু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন বীজের ব্যবহার। কেননা এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন গমের বীজ হতে প্রচ- নিম্ন তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে চারা ও পূর্ণাঙ্গ গাছ হয়।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ধরনের বীজ উৎপন্ন হলে তার মূল্যও কম হয়। তবে সেক্ষত্রে টিসু কালচার ল্যাব তৈরির খরচের পরিমাণ বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের একটি টিসু কালচার ল্যাব তৈরি করতে ১ কোটি হতে ১.৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। এসব ল্যাবে মূল কাজ পরিচালনা করার জন্য দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন যারা একটি সুস্থ সবল গাছের একটি অংশের মেরিস্টেমেটিক টিসু হতে কয়েক লক্ষ হতে কয়েক বিলিয়ন চারা উৎপন্ন করে। এ কাজ পরিচালনার পূর্বে প্রজননবিদদের প্রথমে সমস্ত দেহে জীবাণুনাশক মেখে নিতে হয়। প্রক্রিয়াটির চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ হতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।
বর্তমানে চীন, জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে বাণিজ্যিকভাবে টিসু কালচার ল্যাব হতে বীজ/চারা উৎপন্ন করা হচ্ছে। জাপান ও থাইল্যান্ড এশিয়ার এ দুটি দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত অর্কিড ও ফুল বিক্রি করে বিশ্ব বাজার হতে মোটা অংকের অর্থ নিজেদের ঘরে তুলছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড টিসু কালচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে আলুর বীজ উৎপন্ন করে তার প্রতিটির বীজের মূল্য পড়ে দশ পয়সা। এ স্বল্প মূল্যের বীজ হতে পরবর্তীতে তার সুস্থ সবল আলু গাছ হতে ফসলের সর্বোচ্চ ফলন পেয়ে থাকে। ১৯৫৪ সালে আলুর লেইট ব্লাইট রোগের কারণে আয়ারল্যান্ডে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে ৭-৮ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল এবং সেখান থেকে তার শিক্ষা নিয়েছিল যে রোগ জীবাণু মুক্ত বীজ হচ্ছে সন্তোষজনক ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। আর তখন থেকে তার টিসু কালচার প্রক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল এবং সফলও হয়েছে।
১৯৫৪ সালের দুর্ভিক্ষে শুধু আয়ারল্যান্ড-ই নয় গোটা উত্তর আমেরিকা সুস্থ বীজের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তখন থেকে টিসু কালচারের প্রতি গুরুত্ব সহকারে নজর দিয়েছেন। যার দরুন আজ তারা কৃষি প্রধান দেশ না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
আমাদের দেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে টিসু কালচার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদিত হলেও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে না। আশার কথা মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক টিসু কালচার ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে এবং বিগত দুই বছরে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখান থেকে প্রায় চার লক্ষ কলা চারা ও কয়েক হাজার জারবেরা ও অর্কিড চারা তৈরি করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে উক্ত ল্যাবরেটরিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর ব্যবস্থাপনায় কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান চলছে এবং এরকম আরও ছয়টি টিসু কালচার ল্যাবরেটরি তৈরির প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

লেখক : ১অতিরিক্ত পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, ২উপপরিচালক, গণযোগাযোগ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি মন্ত্রণালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫। ই-মেইল : ashamim.uni@gmail.com

 

বিস্তারিত
কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর ড্রাগন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি

কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর
ড্রাগন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. এম এ রহিম১ মোঃ মনিরুজ্জামান২
কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশে প্রভূত অগ্রগতি সাধন করলেও পুষ্টি নিরাপত্তায় এখনো কাক্সিক্ষত অবস্থানের পৌঁছাতে পারেনি। ফল সরাসরি ভক্ষণযোগ্য বলে পুষ্টির অধিকাংশ আমরা ফল থেকে পাই। সরকারের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা ও মানুষের পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফল চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশীয় ফলের আবাদের সাথে সাথে বিদেশ থেকে আনিত ফলের অভিযোজিতা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কিছু ফলের জাত আবিষ্কৃত হয়েছে। ড্রাগন ফল তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটি ড্রাগন ফল উৎপানের জন্য যথোপযোগী। ড্রাগন ফল সুস্বাদু, পুষ্টির দিক থেকে প্রচুর ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা কোলেস্টেরল কমায়, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, লাল-মাংসের জাতের ড্রাগন ফলে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান বিদ্যমান রয়েছে।
সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফল চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশীয় ফলের আবাদের সাথে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং উচ্চমূল্যের একটি ফসল যার নাম ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ সেই সঙ্গে ওষুধি গুণাগুণ থাকায় বিশ্ববাজারে ড্রাগন ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং বাংলাদেশেও ড্রাগন ফলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ড্রাগন ফল একটি গ্রীষ্মম-লীয় ফসল। বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের মৌসুম হল মে-অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলাদেশে ফলের পর্যপ্ততা প্র্ায় ৬০% কিন্তু শীতকালে ফলের প্রাপ্যতা থাকে ১৯%। শীতকালে ফলের প্রাপ্যতা বাড়ানোর জন্য কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর ড্রাগন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি নি¤েœাক্ত উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে।
পরীক্ষণ স্থাপন
শীতকালে অর্থাৎ নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে কম দিনের দৈর্ঘ্য ও ঠা-া আবহাওয়ার কারণে ড্রাগন ফলে কোন ফুল-ফল আসে না। সম্প্রতি ২০১৮-২০১৯ খ্রি. বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহে শীত মৌসুমে  রাতের বেলা বিভিন্ন লাইট জ¦ালিয়ে অ-মৌসুমে  ফল উৎপাদনের উপর একটি পরীক্ষা প্লট স্থাপন করা হয়।
কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির জন্য ড্রাগন ফলের গাছে লাইট স্থাপনের সময়  
নভেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত লাইট স্থাপন করা যাবে। সন্ধ্যা ৬টা-রাত ১২টা (ছয় ঘণ্টা) দু’মাসের জন্য লাইট জ¦ালিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষণ প্রণালী
বিভিন্ন মাত্রার লাইটগুলো হলো-  
করণীয় কাজ
সময়মতো লাইটগুলো জ¦ালিয়ে দেয়া এবং বন্ধ করা।তাপমাত্রা ও আলোক তীব্রতা পরিমাপ করা এবং সম্ভব হলে রাতে (১০টা-১১টা) ফুল ফোটা শেষ হলে পরাগায়ন ঘটিয়ে দিলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে।
পরীক্ষণ ফলাফল মূল্যায়ন
ফুল-ফল উৎপাদনে বিভিন্ন ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সব আলোতে ড্রাগন গাছে কমবেশী ফুল ফল এসেছে তবে ১০০ ওয়াট নরমাল বাল্বে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। ১০০ ওয়াট নরমাল বাল্বে ফুল আসতে ৪৮ দিন লাগল এবং প্রতিটি পিলারে ১৬টি ফল ধরে কিন্তু কন্ট্রোল পিলারে কোন ফল আসেনি। সর্বোচ্চ ফলের ওজন ৩০২ গ্রাম, প্রতিটি পিলারে ৫ কেজি এবং প্রতি হেক্টরে ৫ টন ফল পাওয়া যায় ১০০ ওয়াট নরমাল বাল্ব ট্রিটমেন্ট থেকে। ফলের ভক্ষণযোগ্য অংশ ৭১% ও টিএসএস ১৩.৮০%। সর্বোচ্চ খরচ ও লাভের অনুপাত ১:৩.০৯।
উদ্যান ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে, কৃত্রিমভাবে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সারা বছর ড্রাগন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণে সারা বছর ফল পাওয়া, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ কাক্সিক্ষত কৃষি প্রবৃদ্ধি অর্জন ত্বরান্বিত হবে তথা দেশের সামগ্রিক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ও কৃষক লাভবান হবে।   
 
লেখক :১অধ্যাপক, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ। ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম।
মোবাইল: ০১৭১১৮৫৯৪৭১, ই-মেইল:marahim1956@bau.yahoo.com

 

বিস্তারিত
ইঁদুর নিধনে মাগুরার সফল বীর কৃষক মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা

ইঁদুর নিধনে মাগুরার সফল বীর কৃষক
মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম১ মো: আবদুর রহমান২
বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে দেশ আজ দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে আমাদের  প্রতিনিয়ত উৎপাদানের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কৃষকের কষ্টার্জিত উৎপাদিত ফসলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইঁদুর কেটে-কুটে-খেয়ে নানাভাবে নষ্ট করে। নিজের উৎপাদিত ফসল চোখের সামনে এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে দিশেহারা অবস্থা হয় কৃষকের। ২০০৭ সালে এমনি দিশেহারা হয়েছিলেন মাগুরা সদর উপজেলার  মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী  গ্রামের কৃষক মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা। পেশায় তিনি একজন ভ্যান/রিক্সা তৈরীকারক। ছোটবেলা থেকে কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে কৃষিকাজের সাথে সরাসরি জড়িত। পেশায় কৃষি কাজের পাশাপাশি ভ্যান/রিক্সা তৈরী ও মেরামতসহ যে কর্মটি ব্রত হিসেবে নিয়েছেন সেটি হলো ইঁদুর নিধন। এ কাজে তিনি ইতোমধ্যে নিজ গ্রাম,ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ইঁদুর নিধন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তার ইঁদুর নিধনের কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাওয়ায় আঃ হান্নান মোল্যা বলেন,  ২০০৭ সালে আমি কিছু জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। উৎপাদিত ধান আমার বাড়ির বারান্দায় ও উঠানে রেখেছিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যে লক্ষ করলাম ইঁদুরে আমার অধিকাংশ ধান কেটে নষ্ট করেছে। দিশেহারা হয়ে মাগুরা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে যাই। তখন উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব সুব্রত কুমার চক্রবর্তী স্যারের পরামর্শমত ইঁদুর নিধনের কাজে নেমে পড়ি। সে সময়ে ২টি ইঁদুরের লেজে ১ কেজি গম দেয়া হতো। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি ইঁদুর মারার কাজ করে চলেছি।
ইঁদুর নিধনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের বিষয়ে হান্নান বলেন, তার একটা ভ্যান/রিক্সা তৈরীর কারখানা আছে। ২০০৭ সালে নিজেই কাঠের তৈরী ৫০০টি ইঁদুর মারার বাক্স তৈরী করেন। প্রথমে তার নিজের গ্রামসহ আশেপাশের ৩৬টি গ্রামে এসব বাক্স নিজে ভ্যান চালিয়ে বিভিন্ন মাঠে রেখে আসতেন। আবার পরদিন সকালে নিজেই ইঁদুরসহ সে সব বাক্সগুলি নিয়ে এসে কাটাখালী বাজারে এনে বাজার কমিটি ও অন্যান্য গন্যমান্য ব্যাক্তি বর্গের সামনে নিধনকৃত ইঁদুরের লেজ পুড়িয়ে ধ্বংস করতেন। এ বিষয়ে তিনি আরো জানান, ইঁদুর মারতে আমি ১১ প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করি। এগুলি হলো- ৩ ধরণের কাঠের যন্ত্র, বাঁশ কল, হাড়ি/পাতিল কল, খাঁচা কল, সাচি কল এসব। এছাড়া আমি নিজে ইঁদুর মারার এক ধরণের স্যলুশন তৈরী করেছি। এটি বেগুন আলু ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সাথে মিশিয়ে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় চিকন লোহার পেরেকের সাথে গেঁথে রেখে আসি। বৃষ্টি বা কুঁয়াশায় যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য  ঢাকনার ব্যবস্থা করি। মাঠের ইঁদুর এগুলি খেয়ে সাথে সাথে মারা যায়। তাছাড়া আমার তৈরীকৃত স্যল্যুশন ড্রামে সংরক্ষণ করি। নিজে ব্যবহার করি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এলাকার কৃষকদের মাঝে বিতরণ করি।
আঃ হান্নান শুধু মাঠের ইঁদুর মেরে ফসল রক্ষা করেন তা নয়, বসত বাড়ির সম্পদ রক্ষার্থেও ইঁদুর নিধন করে থাকেন। এছাড়াও মাগুরা, যশোর এমনকি রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন অফিস/আদালতসহ বিভিন্ন সরকারি - বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও  ইঁদুর নিধনের কাজ করেন। মাগুরা সদরের সাবেক উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সুব্রত কুমার চক্রবর্তীর মাধ্যমে উদ্ভুদ্ব হয়ে এখন পর্যন্ত সম্পদ রক্ষার্থে ইঁদুর নিধনের কাজ করে চলেছেন হান্নান। এ বিষয়ে বর্তমানে উপজেলা কৃষি অফিসার ও কৃষি অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ সবসময়ে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি। কৃষি সম্প্রসারণের অঞ্চল পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইঁদুর নিধনকারী হিসেবে ২০০৮ সালে যশোরে অতিরিক্ত পরিচালক মহোদয়ের নিকট থেকে পুরষ্কার পেয়েছেন।  এছাড়া মাগুরার জেলা প্রশাসক মহোদয় ও ডিএই উপপরিচালক মহোদয়ের নিকট থেকেও ইঁদুর নিধনের জন্য পুরষ্কার পেয়েছেন।
হান্নান জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ২০০টি ইঁদুর নিধন করেছেন। ইঁদুর নিধনের বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চাই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল ইঁদুর যাতে নষ্ট করতে না পারে। এজন্য সবাইকে এক যোগে ইঁদুর মারার আহবান জানাই। সেইসাথে আমার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সকল কৃষক ভাইদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই যাতে তারা সহজেই ইঁদুর নিধন করতে পারেন।
মাগুরা সদর উপজেলাধীন মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নান মোল্যার বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার  কৃষিবিদ মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, স্বল্প খরচে নিজ উদ্যোগে ইঁদুর নিধনে আত্মনিয়োগ করেছেন হান্নান। তাকে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকান্ডে সহয়তা দিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা কৃষি অফিস। হান্নান মাগুরাসহ দেশের গর্ব। ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষায় তার ব্যাক্তি উদ্যোগ দেশের কৃষক সমাজ গ্রহণ করলে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথ আরো সুগম হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২১ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পুরষ্কার দেয়া হবে। জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধনকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ০৫ (পাঁচ) টি ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার প্রদান করা হবে। ইঁদুর নিধন অভিযান-২০২১ এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কার প্রাপ্তদের তালিকা সারণি দ্রষ্টব্য। তালিকা অনুযায়ী মোঃ আব্দুল হান্নান মোল্যা কৃষক ক্যাটাগরীতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনিসহ জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কার প্রাপ্তদের জানাই অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা ।

লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার,, মোবা: ০১৭১৬-৭৬৮৮২১ ও কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা, মোবা: ০১৯৪৩-৫১৭৫০৬, ই-মেইল : khulna@ais.gov.bd

বিস্তারিত
কথকথা : ইঁদুর

কথকথা : ইঁদুর
কৃষিবিদ আবু হেনা ইকবাল আহমেদ
[ বাইরে কবিরের হাঁকডাক। ঘরের ভিতরে  রাশু চৌকিতে আধ শোয়া অবস্থায়]
কবির : রাশুভাই, ও রাশুভাই, বাড়ি আছো নাকি ?
রাশু: আছি। শরীরটা ভাল নাই। কেনো ডাকাডাকি?
  [কবিরের ঘরে প্রবেশ। রাশুর সাথে হাত মিলানো শেষে বসে কথপোকথন]
      বও। কোনখানে এই বিকাল বেলায় যাও?
      কও দেখি, দেশ গেরামের এখন কি ভাও?
কবির : চলছে এক রকম। কৃষিক্লাবে দাওয়াত, পাও নাই?
রাশু:  পাইছি। তয় একলা যামু কি না ভাবতাছিলাম তা ই।
কবির:  বাইরে দারুণ আবহাওয়ার যে দাপট
        ওঠো ঝটপট।
       যদি শুইয়া থাকো খাদায়
        ভুগবা বাতে-ব্যথায়।
রাশু:  ঠিকই কইছ। সঙ্গী যখন পাইছি তোমারে
      বাইরে যাইতে এইবার আঁটকায় কে আমারে!
       গত বারে যাইনাই ক্লাবে
       কি কথা হইছে, তা কওছে হাবে-ভাবে।
কবির: গতবারে যা কথা হইছে
       মাথার ভিতর এখনো এর রেশ বইছে।
রাশু : ওই বিষয়ে কিছু কও দেখি
      জানা না অজনা সে কি।
কবির: আন্ধার রাইতে গর্তের ভিতর
        শুইয়া বইসা একটা ইতর
        কটর মটর চিবায়
        নিদ নাই, ত-ঝিমায়।
           [ একটু সময় নিয়ে]
       কইলাম ধান্ধা আর কি।
       জবাব তার কি ?
রাশু:  শিয়াল। উত্তর সোজাসুজি।
কবির :  হয় নাই, বাবুজি।
         উত্তরযে বহুদূর
         আসলে তা ইন্দুর ।
রাশু:   বেজি, ছুঁচা আর গুইসাপওতো থাকে খাদায়
        সাপেও  সেখানে থাইকা চোখ পাকায়।                               

কবির: তা ঠিক। তয় কাটুস কুটুস! ইন্দুরের নিজস্ব স্বভাব
       আমাগর সম্পদ নষ্টকরণে তার লাভ।
       হাজার হাজার রকমের ইন্দুরের একটাই  কাম
       চোয়ালের জোড়া দাঁত শানানো অবিরাম।
       ওই দাঁত বাড়লে মুখ বিগরাইবো, আর শির শির তাড়নায়
       বাইচ্চারাতো দাঁত ওঠাকালে যা- ই পায় তাই কামড়ায়।
রাশু:  তাই  সারাক্ষণ ধইরা
       কাটায় কাটাছাঁটা কইরা।   
কবির:  যতো না খায়, কাইট্টা কুইট্টা সময় করে পার
         কারণ, ছেদন দাঁত চাই ছোট রাখা আর ধার।
         তোমার মতন বলা যায় তারে ভোজন রসিক
         রোজ যত খায়, তার বহুগুণ নষ্ট করা আরেক বাতিক।
রাশু : ওরে বাবা। একটাই এতোটা চাবায়
       পালে পালে থাকলে তার কি উপায়!
কবির: জন্মের মাস দুয়েক পরে একসাথে দুই হালির মতন ছানা   
        প্রসব করে তিন কি চার সপ্তাহ পরপর; ক’দিন রয় কানা।
        জুটি বছরে বারো শ’ পঞ্চাশটা বাচ্চা জন্ম দিতে পারে
        অনাহারে রোগা বাচ্চা খাইয়া বসতবাড়ি ছাড়ে।
        খাবার না থাকলে পেটে একদম
        ডিম্বাণু জন্মায় কম।  
রাশু : এ দুষ্টুর কথা আর কইয়ো না ভাই
       এর স্বাভাব কেবল খাই আর খাই।
কবির : যা না খায় তার বহুগুণ কাইট্টা কুইট্টা করে নাশ
      পুরাণ গর্তে না, নতুন মাটি খোঁড়া গর্তে করে বাস।
      এক এক গর্তে একটাই  বড় ইন্দুর থাকে
      খাবার দাবার কতকিছু তাতে জমা রাখে।
      তয় ওরা এলাকায় চলে
      মিলেমিশে দলে দলে।
রাশু : ইন্দুরের ভাই কি  ছুঁচায়.. .. ..
কবির: খান্দান, স্বভাবে কি জাতে ইন্দুরে ছুঁচার উঁচায়।
       দেখতে ছুঁচার মতো। তয়, এক জাতের না
       গায়ে গন্ধ ছুঁচার কি মারাত্বক, ইন্দুরে ময়লা চাটে না।          
রাশু:  ইন্দুরে নষ্ট করে ঘরে বাইরে, খেতে, নগরে -বন্দরে
       লতানো সবজি গাছ, নারিকেল, সুপারি গাছেও চড়ে।                            
কবির: খাবারের খোঁজে পানিতেও তৈরি করে ভাসমান ঘর
       ঢোলকলমি, কচুরিপানা, বোনাআমনের খড়কুটা করে ভর।
      এরা  ভয়ানক প্লেগসহ নানা  রোগবালাই ছড়ায়।
       যুদ্ধের চাইতে বেশিলোক ওসব অসুখে মারা যায়।

রাশু: ইন্দুর আছে বুঝি কেমনে?
কবির: অনেক কিছুই আছে তা জাননে।
      চেচামেচি, লোম, মল, দেয়ালে পাশে চলার পথ পরিষ্কার
       মাটি তোলা নয়া গর্ত,পায়ের ছাপসহ নানা কারবার.. ...
রাশু:  আমার ঘরে আর খেতে ছোট্ট-বড় ইন্দুরের বড্ড উৎপাত
কবির: নেংটি, গেছো, মাঠের বাদমি ইন্দুুরসহ  আছে নানা জাত।
       আমেরিকা, ইংলেন্ড, জার্মানি, ফ্রান্সসহ যারা বিশিষ্ট
       আফ্রিকা ও  মরুর সবে ইন্দুরের অত্যাচরে অতিষ্ঠ।
       খাবারের খোঁজে অতি বরফ শীতল স্থল কুমেরু ছাড়া
        সর্বস্থলে দলেবলে কখনো সাঁতরে সফরে যায় তারা।
       আইল- সড়ক-ঘর- বন -পাহাড় -পর্বত
       সবখানে এ যমের গতায়ত।
       প্রচুর খাবার যখন যেখানে থাকে
       সেখানেই বংশ বাড়ানোয় ব্যস্ত দেখা যায় তাকে।
রাশু: দেয়াল, সিলিং বা মেঝতে পাইলে কোনো ছোট ফাঁকফোকর                                                                                                                
     নরম শরীর নিয়া সহজে ঢুকে তার ভিতর।
কবির:  বিজলি তার বা পাতার ওপর চলে ছরছর করে
        তয়, ঘরের ভিতর চলে একপাশ ধরে।
রাশু:   পথ চিনলাম যখন
        চাই দুষ্টুরে দমন
কবির : ঠিক, ভাই।
        চলাপথে বিষ, আঠা, ফাঁদ দিবে বুঝেশুনে যা যা, তা -ই।
রাশু : শুনেছি চালাক ইন্দুরের আছে নানান বায়না
       বিষের গন্ধ টের পাইলে খায় না।
কবির : এরও আছে কিছু ব্যবস্থা
        অর্জন করা লাগবে ইন্দুরের আস্থা।
        নতুন জিনিসে আছে তার খুঁতখুঁতে ভাব তামাশা দেখার
        তারে কাজে লাগালে আছে আশা ইন্দুর মারার।
রাশু : কেমন?
কবির : এই যেমন-
        চলার পথে কোণা কাঞ্চিতে বিষ ছাড়াই দিতে হবে টোপ
        প্রিয় শুঁটকি, বিস্কুট, নারকেল এইসব নানারূপ।
        ইন্দুর ভাববে নতুন এইটা যেন কি!
        একটু কামড় দিয়া দেখি।
        কয়েক দিন পর মিশাবে
        ঠিকভাবে;
        শতকরা দুইভাগ জিঙ্ক ফসফাইড  সেই খাবারে
        রাইতে দিয়া, দিনে তুইলা নিবা তারে।                                  
                                                                
        যখন দেখবা  সবই রইছে তার             
       বুঝবা, পালাইছে বা সমূলে বংশ সাবাড়।
     বাড়িতে থাকলে একটা বিড়াল
       সীমানা ছাড়বে ইন্দুরের পাল।                   
রাশু:  মাঠেতো সম্ভব নয় তা
        এ বিষয়ে কি সে কথা।
 
কবির: এরা কোনাকুনি করে লতাপাতা, ধানগাছ কাটে
       তাইতে বুঝবা কার কাজ মাঠে।
       ইঁন্দুুর ভাদ্রমাসের শেষে
       বাসা বানায় আইল ঘেষে।
       গর্তে ফসটকসিন, ধোঁয়া, পানি দিয়া বা খুঁইড়া দলেবলে
       মারণ লাগবো অকুস্থলে।                                                
       অথবা মারতে তারে
       নানান ফাঁন্দ বা বিষটোপ দেওন লাগতে পারে।
       মাঠে কলাগাছ পুঁতলে রইতে বাজ-প্যাঁচা রাখবো নজরে
       শিয়াল, বিড়াল, সাপও সুযোগ মতো ইন্দুর শিকার করে।
   [ রাশু  চৌাকি থেকে ওঠে, ফতুয়া পড়ে এবং গামছা কোমরে বেঁধে নেয়।
উভয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে কথপোকথন চলবে]
রাশু : চলো ক্লাবে যাই।

কবির: চলো।  বেলা বেশি নাই।
              [উভয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে]
      শোন, কৃষি ক্লাবে যাইতে যাইতে সার কথা বলি
      ইঁন্দুুর নিয়া  শোনা  কবিতার কয়েক কলি-
“ইঁদুর বড়ই      চালাক চতুর প্রাণী
ছুঁচোর থেকেও   খুব বেশি খানদানি।
ছুঁচোর মতন      বাঁচাতে প্রাণ ভোমরা
ইঁদুর কখনো     ঘাটে না পচা কি নোংরা।
কাটুস কুটুস      কাটাকুটি আমরণ
ছেদন দাঁতকে    বশে আনার কারণ।
ছড়ায় সে রোগ   তার চেয়ে অতিশয়
কেটে করে নানা  সম্পদের অপচয়।
ঘর, মাঠ, গাছ,   মরু, বন  কি পাহাড়ে
খাবার জুটলে     পালে পালে বংশে বাড়ে।
নতুন খোঁড়ানো   গর্তে এরা থাকে একা
ধোঁয়া-পানি দিলে বের হয়ে দেয় দেখা।
পেঁচা, কাক, চিল, শিয়াল, বিড়াল, বিষ
কিংবা ফাঁদ পেতে  সদলে করো ফিনিস।”
                       [উভয়ে ঘর হতে প্রস্থান]

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক . বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, কৃষি মন্ত্রণালায়। সেল :০১৬১ ৪৪৪ ৬১১১। ই-মেইল :ahiqbal.ahmed@yahoo.com

বিস্তারিত
আশ্বিন মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি

আশ্বিন মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
আমন ধান
    আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করুন।
    সার প্রয়োগের আগে উইডারের সাহায্যে জমির আগাছা পরিষ্কার করুন এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখুন।
এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করুন। ফিতা পাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে পানির অপচয় অনেক কম হয়।
    এ সময় শিষ কাটা লেদা পোকা, মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করুন।
নাবি আমন রোপণ
    আমন সময় মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করুন।
    গুছিতে ৫-৭টি চারা দিন এবং অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করুন।
আখ
    আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন।
    সাধারণত বীজতলা পদ্ধতির পরিবর্তে পলিব্যাগে আখের চারা উৎপাদন করুন। এতে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়।  
    চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখুন।  
    চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করুন।
সরিষা
    যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি জাতের সরিষা যেমন বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০ চাষ করুন।
শাকসবজি
    আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জয়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার বিশেষ করে ইউরিয়া প্রয়োগ করে মুলা, লালশাক, পালংশাক, চীনাশাক, সরিষা প্রভৃতি শাক উৎপাদন করুন।
    সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করুন।
কলা
    অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়।
    ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি গভীর গর্তে ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর রোপণ করুন।
    কলা বাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করুন।
গাছপালা
    বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট সেখানে নতুন চারা রোপণ করুন।
    বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিন এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিন।
    মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিন।
    চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করুন। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন।
ইঁদুর দমন
আশ্বিন মাসে দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। নির্দিষ্ট এলাকায় সবাই মিলে এক সাথে ইঁদুর নিধন করুন। ইঁদুর নিধনের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণি যেমন- প্যাঁচা, গুইসাপ সংরক্ষণ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাসবড়ি ব্যবহার করুন।
বিবিধ
    উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন, অধিক লাভবান হন।
    স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
    শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল:manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মোঃ হোসেন মিঞা, উপজেলা : বিজয়নগর, জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রশ্ন : লাউ গাছের গোড়া থেকে কষ বের হয়, করণীয় কী?
উত্তর : এই রোগকে গামোসিস বা কষ বের হওয়া রোগ বলে। আক্রান্ত কা-ে বোর্দোপেস্ট (১০০ গ্রাম তুঁত + ১০০ গ্রাম চুন + ১ লিটার পানি) লাগানো যেতে পারে বা ১% বোর্দোমিকচার বা কপার অক্সিক্লোরাইড (০.৪%) স্প্রে করা যেতে পারে।
মোঃ শাহীন মাহমুদ, উপজেলা : দেওয়ানগঞ্জ, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : ভুট্টার চারার কচি পাতা এবং গোড়া কেটে দেয়, সমাধান কী?
উত্তর : ভুট্টার কাটুই পোকা এ ক্ষতি করে। এ জন্য ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে। দানাদার বালাইনাশক কারটাফ ৬ কেজি/ হেক্টর বা কার্বোফুরান ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ক্লোরপাইরিফস ৫ মিলি./লি. অথবা ল্যামডাসাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১.৫ মিলি./লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে/সন্ধ্যার পর গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম, উপজেলা : হাতিবান্ধা, জেলা : লালমনিরহাট
প্রশ্ন : ফুল কপির গোঁড়া পঁচা রোগ হচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২ গ্রাম ম্যানকোজেব মিশিয়ে গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মোঃ আবদুস সালাম, উপজেলা : বদলগাছী, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : লবণাক্ততা কিভাবে কমাতে হবে?
উত্তর : ধান চাষ করলে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে। বৃষ্টির পানি জমিতে আটকে রাখতে হবে। জমি একদিকে কিছুটা ঢাল করে রাখলে এবং উপর হতে সেচ দিলে ঢাল দিয়ে পানি বের করতে হবে।
জিপসাম সার ১০-১২ কেজি/বিঘা প্রতি প্রয়োগ করতে হবে।
মালচিং এবং সবুজ সার ব্যবহার করা ভালো। এছাড়াও সর্জান পদ্ধতিতে ফসল চাষ করা যেতে পারে।
মোঃ কফিল উদ্দিন, উপজেলা : বোচাগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : গৌরমতি আম সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : এই আম নাবি জাতের। এই আমে টোটাল সলিউবল সুগার প্রায় ২৫ শতাংশ। এই আম ল্যাংড়া ও আশ্বিনার  প্রাকৃতিক পরাগায়নে নতুন এ জাতটির উদ্ভব হয়েছে। এটা আগস্টের ২য় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত পাকে। প্রতিটি আমের ওজন প্রায় ৩৫০-৬০০ গ্রাম। সাধারণত ৩ বছর বয়সে গাছে ফল ধরে। এই আম স্বাদে, মিষ্টতায়, গন্ধে অতুলনীয়। এ সময় অন্য আম সহজলভ্য না হওয়ায় ৩৫০-৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।
মোছাঃ সালমা বেগম, উপজেলা : রাজপুর, জেলা : ঝালকাঠী
প্রশ্ন : কীটনাশক কখন ব্যবহার করবো?
উত্তর : সাধারণত সকাল ৯ টার পরে স্প্রে করতে হবে। অথবা শেষ বিকেলে। তবে কুয়াশা/শিশির ভেজা অবস্থায় দেয়া যাবে না। প্রচন্ড তাপ, গরমে স্প্রে করা যাবে না।
মোঃ নাজমুল হোসাইন, উপজেলা : উল্লাপাড়া, জেলা : সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন : ধানের জমিতে মরা ডিগ ও সাদা শীষ দেখা যাচ্ছে, এখন করণীয় কী?
উত্তর : ক্ষেতে ডাল বা কঞ্চি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা। হাত জাল দিয়ে মাজরা পোকা ধরে মেরে ফেলা। জমিতে বেশি পরিমাণে আক্রমণ হলে হেক্টর প্রতি ক্লোরপাইরিফস ১.৫ লি., কার্বোসালফার (মার্শাল) ১.১৫ লি., কারটাপ (সুুসিটাপ) ১.২০ লি. যে কোন একটি বালাইনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
মোঃ আশরাফ, উপজেলা : রংপুর সদর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : মরিচের জমিতে পাতা কুঁকড়ে যায়, করণীয় কী?
উত্তর : আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে নষ্ট করে ফেলা। ভাইরাসের বাহক পোকা সাদা মাছিকে বালাইনাশক দ্বারা দমন করা যেমন-ডায়াজিনন, সুমিথিয়ন, টাফগর, ইমিডাক্লোরপ্রিড (এভমায়ার, টিডো) ইত্যাদি ব্যবহার করা।
মোঃ তোফাজ্জল, উপজেলা: হোসেনপুর, জেলা : কিশোরগঞ্জ
প্রশ্ন : ডালিমের ফুল ঝড়ে পড়ার জন্য সমাধান কী?
উত্তর : সলিউর বোরন সার গাছে স্প্রে করে দিতে হবে যদি ফুল বা ফল শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে। তবে ফলের নিচের অংশে যদি পচন ধরে তারপর পড়ে যায় তাহলে রিডোমিল গোল্ড দিতে হবে।
মোঃ রেজাউল, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : পটলের কা- ও গায়ে সাদা সাদা থাইসেলিয়াম দেখা দেয়। তার পর গাছের গোড়া, শিকড় ও পটলে পানি ভেজা নরম পচা রোগ দেখা দিলে করণীয় কী?
উত্তর : পটলের শাখা কলম শোধন করে নিতে হবে। রোগের আক্রমন দেখা দিলে ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি. টিল্ট বা কমপ্যানিয়ন ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৪১০৪৮৫৩; ই-মেইল : iopp@ais.gov.bd

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি ১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর

কার্তিক মাসের কৃষি
১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
কার্তিক মাস। হেমন্ত ঋতুর আগমন। বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সময়। বাংলার মাঠ প্রান্তরে সোনালী নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে বীর কৃষকরাও ব্যস্ত থাকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। এসব কাজে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন: বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩, ডাব্লিউএমআরআই গম-১, ডাব্লিউএমআরআই গম-২, ডাব্লিউএমআরআই গম-৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি  ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য চাষে বেড প্লান্টার যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এই যন্ত্র ব্যবহার সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ন-১ এসব। খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩, ঝড় বাতাসে হেলে ও  ভেঙে পড়া প্রতিরোধী জাত ডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১ ডাব্লিউএমআরআই বেবি কর্ণ ১ আবাদ করতে পারেন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০, বিনা সরিষা-১১ ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৮, উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি,           ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত আগামজাত ও  উচ্চফলনশীল জাতগুলো নির্বাচন করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও খাবার উপযোগী জাত নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কমবেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টিআলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টিআলু ভালো ফলন দেয়। কমলা সুন্দরী,  বারি মিষ্টিআলু-১২, বারি মিষ্টিআলু-১৪   বারি মিষ্টিআলু-১৫ ও বারি মিষ্টি আলু-১৬ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশি-বিদেশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমেটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুঁটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস,
ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদি প্রাণীকে খড়ের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদি প্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদি প্রাণীকে বাইরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা না হলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদি প্রাণীকে এ সময়  কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি  ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশদারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন। এ ছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবকটি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব।  আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা।

লেখক :  সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন :০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল: editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত