কৃষির অগ্রযাত্রায় পরিবর্তিত জলবায়ুতে
টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা
মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল
মহান বিজয়ের মাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল শহিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
মুজিববর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উজ্জীবিত হয়ে ৫ ডিসেম্বর পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২১। কৃষি মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধানে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, সয়েল সাইন্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে দিবসটি উদ্যাপন হয়ে থাকে। এ বছরের প্রতিপাদ্য Halt soil salinization, boost soil productivity- লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি। যা পরিবর্তিত জলবায়ুতে মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ও মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কৃষি বিপ্লবসহ সব প্রস্তুতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমাদের উর্বর জমি, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা-সম্প্রসারণ কাজ সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সরকার শুরু থেকেই কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী নির্দেশনায় বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন কর্মপ্রচেষ্টায় আজ কৃষি ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শী ও যুগোপযোগী উদ্যোগের ফলে চলমান করোনাকালেও দেশের কৃষির উৎপাদন ও সরবরাহের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আজ পাট রপ্তানিতে ১ম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং সামগ্রিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের ১১তম স্থানে রয়েছে। সাফল্যের এই ধারায় বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যার মূলে রয়েছে আমাদের দেশের উর্বর মাটি।
মাটিই মানুষের অধিকাংশ মৌলিক চাহিদার জোগান দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান ০.৪৭ শতাংশের কম। সারা বিশ্বে কার্বন ও মিথেন নিঃসরণ বৃদ্ধিতে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। ঘটছে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, সমুদ্রের অম্লকরণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন প্রভৃতি। পরিবর্তিত জলবায়ুতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার অর্থনীতি ও মানুষের স্বাভাবিক জীবন হুমকির মুখে পড়বে। জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ভূমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। এতে কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষিকে এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সংস্থা সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।
মাটিকে সুস্থ, উৎপাদনক্ষম, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই রাখতে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ছয়টি মৃত্তিকা সম্পর্কিত। মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার ছয়টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সাথে সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের যুক্তিযুক্ত ও লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং মৃত্তিকা স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৮টি উপজেলার আধা-বিস্তারিত মৃত্তিকা জরিপ সম্পন্ন করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশের সবগুলো উপজেলার মাটির উর্বরতামান অনুযায়ী সুষম সার সুপারিশের লক্ষ্যে অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেমে ৫০টি উপজেলার তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে রবি ও খরিফ মৌসুমে ৫৬টি উপজেলায় সরেজমিন মাটি পরীক্ষা করে মোট ৫,৬০০ জন কৃষককে ফসলভিত্তিক সার সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের লবণাক্ত ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র, বটিয়াঘাটা, খুলনা কর্তৃক ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ডিবলিং এবং চারা রোপণ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ, টপ সয়েল কার্পেটিংয়ের মাধ্যমে চিংড়ি ঘেরের পাড়ে বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ করা হচ্ছে। মাদা ফসলের জন্য কলস সেচ ও দ্বিস্তর মালচিং পদ্ধতি, শ্যালো ফারো-রিজ সিস্টেম, ফ্লায়িং বেড এগ্রিকালচার ইত্যাদি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিভিন্ন মাদা ফসলের লবণাক্ততা সহনশীলতা নিরূপণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ইনস্টিটিউটের লবণাক্ততা মনিটরিং কার্যক্রমের আওতায় উপকূলীয় এলাকার মনিটরিং স্পট থেকে নিয়মিত লবণাক্ততার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এবং লবণাক্ত পরিবীক্ষণ তথ্য ব্যবহার করে উপকূলীয় এলাকার সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষক ভাইয়েরা মৃত্তিকা ও পানির লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল চাষের এলাকা সম্প্রসারণ, নিবিড়তা বৃদ্ধি ও অধিক ফসল আহরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ছাড়া টেকসই মৃত্তিকা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২,৫০০ জন কৃষক, কৃষিকর্মী ও ইউনিয়ন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার জন্য বেশকিছু সুপারিশমালা প্রদান করেছে। এর মধ্যে কনজারভেশন পদ্ধতিতে জমি চাষ, ফসল বিন্যাস, শস্য আবর্তন, লিগিউম ফসল চাষ, অধিক পরিমাণে ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে সংরক্ষণ, জৈবসারের প্রয়োগ বাড়ানো, সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ইত্যাদি অন্যতম। টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার জন্য এসব সুপারিশ অনুসরণ করে ফসল আবাদ একান্ত জরুরি। বাংলাদেশে কোনো একটি সীমিত এলাকার মধ্যেই মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ ও ভূমিরূপের ব্যাপক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়, তাই বাংলাদেশে ভূমি ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা একটি জটিল সমস্যা। সেক্ষেত্রে, স্থানভিত্তিক কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা সর্বশেষ মাটি ও ভূমি সম্পদের তথ্যভাণ্ডারের উপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
কৃষি বিজ্ঞানীরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে লবণাক্ত সহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু, জলমগ্নতা সহনশীল, উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল প্রতিকূল পরিবেশে চাষের উপযোগী ধান, গম, ভুট্টা, বার্লি, তরমুজ, ডাল, সূর্যমুখী, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ সম্প্রসারণে সহায়তা করছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত এলাকায় কৃষি বিপ্লব ঘটবে। এ লক্ষ্য অর্জনে রোডম্যাপ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ও অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন এবং ৭০০ কোটি টাকার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন। মুজিববর্ষ উদ্যাপনকালে সারা দেশে বৃক্ষরোপণ করেছেন। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে এবং কার্বন হ্রাসে তালগাছ রোপণসহ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন বা কপ২৬ অনুষ্ঠিত হয়। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা ১ নভেম্বর ২০২১ গ্লাসগোতে কপ২৬ সম্মেলনস্থলের কমনওয়েলথ প্যাভিলিয়নে ‘সিভিএফ-কমনওয়েলথ হাইলেভেল ডিসকাসন অন ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ শীর্ষক আলোচনায় সিভিএফ এবং কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। সে সাথে প্রধান গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলোকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের প্রচেষ্টায় সমর্থন করার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা’ পূরণ করার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
পরিশেষে পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাবগুলো মোকাবিলা করে সুস্থ বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলাই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের সফলতা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখি, দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করি।
লেখক : অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ), কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার সমস্যা ও উন্নয়ন সম্ভাবনা
কৃষিবিদ বিধান কুমার ভান্ডার
অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও ৫ ডিসেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২১’ উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। এবারের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি।’ বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা সমস্যা প্রকটভাবে বিদ্যমান। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য মাটির লবণাক্ততা সমস্যার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করবে-এ প্রত্যয় নিয়ে দিনটি পালিত হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর মাটির গুরুত্বের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রতি বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, কৃষক সবাইকে সচেতন করা বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী নদীবাহিত পললভূমি বেষ্টিত ১,৪৭,৬১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এ দেশ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাদেশ। এ দেশে ১৫টি ভূপ্রকৃতি ও ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল রয়েছে। ৪১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার আয়তন ২৮,৬০০ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের প্রায় ২০ ভাগ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার দৈর্ঘ্য বেড়ে ৭১০ কিলোমিটার হয়েছে, যা দেশের প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে গঙ্গা পললভূমি, গঙ্গার জোয়ার-ভাটা পললভূমি, মেঘনা মোহনা পললভূমি, চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী জোয়ার ভাটা পললভূমি ও পিট বেসিন নামক ৫টি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে। এ অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে প্রধানত স্থানীয় উন্নত জাতের ধানের আবাদ করা হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ জমি মৌসুমি পতিত থাকে; কারণ শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। তখন সেচের জন্য উপযোগী পানির অভাব দেখা দেয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ইকোসিস্টেমের এবং কৃষি পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাব দেখা যায়। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা কার্বন নির্গমনের ফলে ওজন স্তর হালকা হওয়া, পরিবেশগত ক্ষতি ও হুমকি দ্বারা বিপন্ন অঞ্চল। ধারণা করা হচ্ছে, আবহাওয়ার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে পৃথিবীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি (শস্য), মৎস্য ও জনবসতি সর্বাধিক হুমকির সম্মুখীন; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা অত্যন্ত সফলভাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের আবাদি জমির শতকরা ১০ ভাগের বেশি দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায়। এ দেশের উপকূলবর্তী এলাকার ২৮.৬০ লাখ হেক্টরের মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ১৯৭৩ সাল থেকেই উপকূলীয় এলাকার পানি ও মৃত্তিকার লবণাক্ততা পরিবীক্ষণ কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পরিচালনা করে আসছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। ১৯৭৩ সালে উপকূলীয় এলাকার ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর, ২০০০ সালে ১০ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর এবং ২০০৯ সালে ১০ লক্ষ ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে লবণাক্ততা লক্ষ করা যায়। জমিতে লবণাক্ততার কারণে এ এলাকায় বর্ষাকালে শুধু আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারা বছর পতিত থাকে, কারণ এলাকায় জমিতে জো আসে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে। শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানির অভাবের কারণে বোরো ধান আবাদ করা সম্ভব হয় না।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে বিভিন্ন কারণে। বাংলাদেশে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় দু’টি প্রাকৃতিক কারণে। এক- জোয়ারের সময় লবণযুক্ত পানি জমিতে প্লাবিত হয়ে; দুই- ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি কৈশিক রন্ধ্র দিয়ে মাটির উপরে চলে আসা। সাধারণত শুকনো মৌসুমে (মার্চ-মে) লবণাক্ত জোয়ারের পানিতে বহু জমি তলিয়ে যায়। তখন লবণাক্ত পানি জমিতে ছড়িয়ে যায়। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি লবণাক্ত হয়। অন্যদিকে বর্ষা শেষ হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস হতে মাটি শুকাতে শুরু করে। এর ফলে মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি হয়। যখন মাটির উপরে রোদ পড়ে তখন মাটির উপরিস্তর হতে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায় এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি ঐ ফাটল দিয়ে ভূমির উপরিস্তরে চলে আসে। তখন জমির উপরিস্তর লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। যেমন, উপকূলীয় অনেক এলাকায় মৎস্য চাষিরা লবণ পানির ঘের তৈরি করে চিংড়ি চাষ করে। এতে করে ঐসব ঘেরের মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ততার কারণে উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়, ফুলের সংখ্যা হ্রাস পায়, অনেক ক্ষেত্রে পরাগায়নও হয় না। ফলে ফসলের ফলন বিভিন্ন মাত্রায় কমে যায়। মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে মৃত্তিকা দ্রবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। তখন অল্প ঘনত্বের গাছের রস চলে যায় মাটিতে। ফলে গাছ পানিশূন্য হয়ে নেতিয়ে পড়ে। লবণাক্ত জমিতে দ্রবীভূত লবণের মাত্রা বা পরিমাণ বেশি থাকায় গাছ মাটি থেকে খাদ্য উপাদান ও পানি কোনটিই সহজে শোষণ করতে পারে না। প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় শোষিত উপাদানসমূহের আত্তীকরণেও।
এইসব প্রতিকূলতা ছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় আরও অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে। দুর্বল পোল্ডার ও স্লুইস গেট যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে সময়ে-অসময়ে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করে। এতে অনেক ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লবণ সহিষ্ণু ফসল ও জাতের অপ্রতুলতার কারণে কৃষকেরা অধিক লবণাক্ততার সময়ে ফসল চাষ করতে পারে না। লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার জন্য কারিগরি জ্ঞানের ও প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতার কারণে কৃষকেরা অধিক লবণাক্ততার সময়ে ফসল চাষ করতে পারে না। উপকূলীয় দক্ষিণ এলাকায় শীতকাল ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় লবণাক্ততা সহিষ্ণু গমের মতো সম্ভাবনাময় ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। উপকূলীয় অনেক এলাকার স্থানীয় রাস্তা নদীর পাড়ের বেড়ি বাঁধের উপর থাকার কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় কৃষি উপকরণ সংগ্রহ ও উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিপণনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই এলাকায় অনেক খাল প্রভাবশালী মহল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করে। ফলে শুকনো মৌসুমে (খরিপ ১) কৃষকরা সেই সকল খালের পানি ফসল চাষে ব্যবহার করতে পারে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রভাবশালীরা ফসলি জমিতে লবণ পানির ঘের তৈরি করে মাছ চাষ করছে। এতে করে এসব এলাকায় ফসল চাষ সম্ভব হচ্ছে না এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লবণাক্ত এলাকার কৃষিতে বিপ্লব আনয়ন সম্ভব। লবণ সহিষ্ণু ফসল ও জাতের উদ্ভাবন এবং আধুনিক চাষ প্রযুক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। ভুট্টা একটি লবণসহিষ্ণু ফসল। তাই, কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের ধানের পরিবর্তে স্বল্প মেয়াদি আধুনিক জাতের বা হাইব্রিড জাতের ভুট্টা আবাদ করা যেতে পারে। এতে করে আমন ধান কাটার পর জমি ভুট্টা চাষের জন্য ব্যবহার করা যাবে। যেহেতু উপকূলীয় এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি লবণাক্ত থাকে, তাই বর্ষাকালে খালে মিষ্টি পানি জমিয়ে রেখে ভুট্টা চাষ করা যেতে পারে। যেহেতু এই এলাকার খালগুলো ভরাট হওয়ায় পানি ধরে রাখা যায় না, তাই খালগুলো খননের মাধ্যমে পানি ধরে রাখতে পারলে শুকনো মৌসুমে ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পাবে। লবণাক্ত এলাকায় ‘খামার পুকুর প্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ফসল চাষ সম্ভব হবে। কারণ এই প্রযুক্তিতে মাটির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এতে আগাম ‘জো’ আসে এবং মিষ্টি পানির জোগান সম্ভব হয়। কলস সেচ প্রযুক্তি, ডিবলিং পদ্ধতি, দ্বিস্তর মালচিং প্রযুক্তি, টপ সয়েল কার্পেটিং/মালচিং, রিজ-ফারো পদ্ধতি, লবণাক্ততা সহনশীল জাত স্ক্রিনিং, ফ্লাইং বেড এগ্রিকালচার, জিরো টিলেজ ও বপনের সময় পরিবর্তন পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করলে মাটি ও পানির লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল চাষ সম্ভব হবে। যেসব জমিতে দেরিতে ‘জো’ আসে সেসব জমিতে পলিব্যাগ/ট্রে-তে উৎপাদিত চারা রোপণ করে খরিপ-১ মৌসুমে আগাম তরমুজ চাষ করা সম্ভব। এই লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ত সহনশীল ফসল যেমন সূর্যমুখী, রেড বিট, সয়াবিন ইত্যাদি চাষাবাদ করতে হবে। উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় প্রায় ২,৩০,০০০ মাছের ঘের রয়েছে। এর মধ্যে মিষ্টি পানিতে গলদা চিংড়ি চাষ হয় এবং লবণাক্ত পানিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট ছোট ঘেরের পাড়ে প্রায় সারা বছর সবজি ও তরমুজ চাষ করা যেতে পারে। আর বড় আকারের লিজ নেয়া ঘেরসমূহের পানি বর্ষাকালে লবণমুক্ত হয়ে যায়। তখন মাটি, সার ও পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্ষাকালে ঘেরের পাড়ে সবজি ও তরমুজ চাষ সম্ভব। উপকূলীয় এলাকার সকল খালের ইজারা প্রদান বন্ধ করে কৃষকদের জন্য পানি ব্যবহার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। জমি সমতল রাখতে হবে এবং সব সময় ফসল দ্বারা আচ্ছাদিত রাখার চেষ্টা করতে হবে, এতে কৌশিক ছিদ্র দিয়ে লবণ কম উঠবে। পলি মাল্চ পদ্ধতিতে চাষাবাদের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
সবশেষে বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের লবণাক্ত কবলিত জমির লবণাক্ততা কমাতে হলে লবণ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। পোল্ডার ব্যবস্থাপনাসহ স্লুইসগেট ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ করতে হবে। সর্বোপরি মাটি ও পানির লবণাক্ততা বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : মহাপরিচালক, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। ফোন : ০২৯১১৩৩৬৩, ই-মেইল : director@srdi.gov.bd
বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা
ড. জাহাঙ্গীর আলম
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এ দেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষকদের প্রতিকূলে। ফলে উৎপাদনে তাদের উৎসাহ ছিল কম। প্রতি ইউনিট উৎপাদন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের। ফলে এ দেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এ দেশে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষি উৎপাদন। প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে কৃষিপণ্যের চলাচল ও বাজারজাত দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলওয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে, সব শেষ করে দিয়ে গেছে ফেরাউনের দল।’ ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ধারণা উৎসাহিত করা হয়। সহজ ও সুলভ করা হয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ। পানি সেচ সম্প্রসারিত করা হয়। অনেকটা নিশ্চিত করা হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সংগত মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হয় কৃষকগণ। বেড়ে যায় কৃষির সার্বিক উৎপাদন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। পরনির্ভরতা খুবই কম। চাল উৎপাদনে এখন আমরা উদ্বৃত্ত। এক্ষেত্রে ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে আমাদের স্থান সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। ১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে চার কোটি টনেরও ওপরে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। এ সময় সারা বিশ্বের গড় উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে ওপরে। চিরকালের খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল উন্নয়ন। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু ওই নির্বাচনী জোটের অংশীদার ছিলেন। প্রার্থী হন কোটালিপাড়া-গোপালগঞ্জ আসনে। ওই জোটের ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে প্রধান ছয়টি দফাই ছিল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য নিবেদিত।
উল্লিখিত একুশ দফার ছয় দফার মধ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট কেইস রহিত করার অঙ্গীকার ছিল। বাংলার পাটচাষিদের বঞ্চনার কথা বিবেচনা করে পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। খাল খনন ও সেচের মাধ্যমে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। সর্বোপরি দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জোটের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওই নির্বাচন প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম একজন প্রণেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এর শরিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অতঃপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এভাবে তিনি পঞ্চাশের দশকে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষকদের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সুযোগ পান।
পাকিস্তান আমলে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলাপচারিতা ও বক্তৃতার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। তার ’৭০ সালের ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তিনি সেই চিত্রের কিছুটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলার বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। জনগণকে সেই অনাহার থেকে রক্ষা করতে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেক্ষেত্রে প্রতি মাসে মোটা চালের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সে চালের দাম ছিল গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম ছিল আড়াই টাকা, বাংলাদেশে তার দাম ছিল ৫ টাকা। এসব উদাহরণ টেনে তিনি বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামীণ মানুষের দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। সেই সঙ্গে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে সামন্ত প্রভুদের অফুরন্ত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং গরিব কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে। তারা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে।’ ওই ভাষণে তিনি ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ ও বকেয়া খাজনা মওকুফের অঙ্গীকার করেন। পাটচাষিদের সুরক্ষার জন্য তিনি পাট ব্যবসা জাতীয়করণ ও পাট গবেষণা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি কৃষি বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক বলে দিকনির্দেশনা দেন।
’৭০-এর ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। তারপর তিনি প্রদান করেন তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা। তাতে তিনি কৃষি ও কৃষকের স্বার্থের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। আইয়ুবি আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাসজমি বণ্টন করা হয়েছে ভূঁইওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে এদের কাছ থেকে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতে সব খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’
’৭০এর নির্বাচনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনায় আগ্রহী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের সাধারণ কৃষক, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের অভিপ্রায় ছিল তাঁর, কিন্তু পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকে তিনি তা করার সুযোগ পাননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি একের পর এক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেন। তন্মধ্যে দেশের কৃষিক্ষেত্রে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিল ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ’৯৬ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির সব খাজনা রহিত করেন। তাতে বছরে প্রায় ৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। রাষ্ট্রপতির ৯৮ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তাতে ৫ হাজার ৩৭১টি পরিবার থেকে ৭৬ হাজার ৭১২ একর জমি সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ওই জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তাছাড়া আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তুলেন গুচ্ছগ্রাম। নতুন জেগে ওঠা চর ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করেন বিনামূল্যে। গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের বাঁচানোর জন্য তাদের রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন।
বাংলাদেশের কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার কথা বঙ্গবন্ধু ভালোভাবে জানতেন। তাদের আর্থিক দুর্দশা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। তাই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পাকিস্তান আমলে নেয়া কৃষকদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। তাদের বিরুদ্ধে করা ১০ লক্ষ সার্টিফিকেট কেইস তিনি প্রত্যাহার করে নেন। উচ্চসুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এবং তাদের কাছে অবাধে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গ্রামবাংলার কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না।’ এ কৃষি বিপ্লবে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি কৃষি উপকরণের ওপর উদার সহায়তা প্রদান করেন। রাসায়নিক সার বিতরণের ব্যবস্থা করেন প্রায় অর্ধেক মূল্যে। ১৯৭২ সালে সের প্রতি (প্রতি কেজি প্রায়) ইউরিয়া সারের মূল্য ছিল আট আনা (২০ টাকা মণ), টিএসপি সারের মূল্য ছিল ৬ আনা (১৫ টাকা মণ) এবং এমওপি সারের মূল্য ছিল চার আনা (১০ টাকা মণ)। একটি গভীর নলকূপের দাম ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটি কৃষক সমবায়কে দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি ইউনিট পাওয়ার পাম্পের দাম ছিল প্রায় ২২ হাজার টাকা। সেটি ভাড়ায় দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকায়। আধুনিক বীজ সরবরাহ করা হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। পোকার ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় বিনা মূল্যে। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহ করেন। তাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ পড়ে কম। অন্যদিকে তিনি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। ধান, পাট, তামাক, আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে দেন। এভাবে তিনি কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলেন দেশের কৃষকদের জন্য।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সমাজে চাষীরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ তার এই অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে দেশের তৎকালীন বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা ছিল ২০ শতাংশ। তাঁর নেতৃত্বের প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিবেচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। এজন্য তিনি সর্বাগ্রে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি জোরদার করেন। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে জয়দেবপুরের বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রতিষ্ঠিত এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। তাছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠিত করেন আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সরকারের কৃষি গবেষণা বিভাগকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য তিনিই উদ্যোগ নেন এবং এ কাজে ড. কাজী এম বদরুদ্দোজাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে কৃষি গবেষণার সমন্বয় সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এস ডি চৌধুরীকে নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে নির্বাহী চেয়ারম্যান) করে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। সেই সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে পুনর্গঠিত ও সম্প্রসারিত করেন। তিনি উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, তুলা উন্নয়ন বোর্ডসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য। তিনি মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বিদ্যমান কার্যক্রম ও অবকাঠামো সম্প্রসারিত করেন। মৎস্য ও পশুসম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তাছাড়া দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাকে তরান্বিত করার জন্য গড়ে তোলেন মিল্ক ভিটা। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষকদের মাঝে ১ লাখ হালের বলদ ও ৫০ হাজার গাভী সরবরাহ করেন ভর্তুকি মূল্যে। গরিব কৃষকদের মাঝে তিনি সহজ শর্তে ১০ কোটি টাকার ঋণ ও ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বিতরণ করেন। তাছাড়া কৃষির সব উপখাতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষক পর্যায়ে তার সম্প্রসারণ এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। এরাই গবেষণা করবে এবং গবেষণার ফলাফল মাঠে পৌঁছে দেবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। সে কারণে কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ছুটে যান ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভাষণ দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এক সমাবেশে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য কারিগরি গ্র্যাজুয়েটদের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) অনুরূপ কৃষি গ্র্যাজুয়েটের চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা নিশ্চিত করেন। তাদেরকে টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভাতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তাতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কৃষিশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবেন। তিনি তাদের শিক্ষাজীবন শেষে মাঠে নেমে কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমাদের নজর গ্রামের দিকে দিতে হবে। কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের তিনি কৃষি বিপ্লব সফল করার আহ্বান জানান। কৃষি উন্নয়ন বলতে বঙ্গবন্ধু শস্য, মৎস্য, পশুপাখি ও বনসম্পদ অর্থাৎ সার্বিক কৃষি খাতের উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে।’ তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আমাদের উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, পশু-পাখি, মৎস্য, বনাঞ্চল ও পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। এসবের ওপর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে তিনি খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের নিদের্শনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।’ এর সঙ্গে তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অভিঘাত সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকের দারিদ্র্য এবং জমির খণ্ডবিখণ্ডতাকে উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই তিনি কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার ভাবনা ছিল প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে আধুনিক চাষাবাদ হবে। সম্ভব হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষিপণ্যের বাজারজাত সম্ভব হবে। তাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে। এর মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের কৃষকরা সব প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন। তাই তিনি সমবায়কে সংবিধানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে সমবায় মালিকানার স্পষ্টায়ন রয়েছে। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য সমবায়কে হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষি গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে।.. কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল ভোগের ন্যায্য অধিকার।’
বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য সংকট নিরসনের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি একর জমির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিন গুণ করতে পারব না? ...যদি ডাবল ফসলও করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না।’
বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তিনি লোকান্তরে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে সেই অভাব আর দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশের কৃষি উৎপাদন ডাবল, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি হয়েছে। আমাদের এখন খাদ্য সংকট নেই। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা এখন উদ্বৃত্ত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের জন্য তিনি উদার সহায়তা দিচ্ছেন। সব দুর্যোগে ও দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এ দেশের কৃষক এখন আর শোষিত ও বঞ্চিত নন। তারা সম্মানিত।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০
লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত কার্যক্রম
মোঃ আসাদুল্লাহ
লবণাক্ততা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি অন্যতম অন্তরায় হিসেবে সারা বিশ্বে বিবেচিত। শস্য উৎপাদন, খাদ্য চাহিদা মেটানো, পুষ্টিকর ফসল নিশ্চিতকরণহ কৃষি কাজের প্রধান বাধা হিসেবে মাটির লবণাক্ততা দিন দিন হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১২০টি দেশের ৯৫৩ মিলিয়ন হেক্টরেরও অধিক জমি ইতোমধ্যে লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায় ৭-৮% ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। বৈশ্বিক বিশ্লেষণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে লবণাক্ততার অথবা ক্ষারীয়তার কারণে অনাবাদি হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঘন ঘন খড়ার ফলে বিশ্বে দরিদ্রতা বাড়ছে এবং ক্ষূদ্র চাষিদের জীবিকার উপায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে প্রতি বছর ২৭.৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার মূল্যের ফসল নষ্ট হচ্ছে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে ২৩০ হেক্টর সেচ জমির মধ্যে ১৯.৫ শতাংশ জমি লবণাক্ততাপূর্ণ। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ২৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে শতাংশের হিসাবে প্রায় ৫৩%। প্রায় ৩০ শতাংশ আবাদি জমির মাটিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশব্যাপী প্রায় ১২ শতাংশ জমি এই লবণাক্ততার কবলে নিমজ্জিত।
বিশ্বব্যাপী মাটির লবণাক্ততা প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২১ উদ্যাপিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি।’
পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের বিরাট একটা অংশের মাটি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে যা উপকূলীয় এলাকায় ফসল চাষের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ক্যাটায়ন এবং ক্লোরিন ও সালফেট অ্যানায়ন মাটিতে দ্রবীভূত লবণ হিসেবে জমা থাকে।
লবণাক্ত মাটিতে গাছের বৃদ্ধির জন্য অনেক রকমের সমস্যা দেখা যায়। যেমন : লবণাক্ত মাটিতে গাছ ঢলে পড়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেশি। মাটির প্রয়োজনীয় আর্দ্রতার পরিমাণ কম। মাটিতে দ্রবীভূত অত্যধিক লবণ মাটির অভিস্রবণ ক্রিয়াকে গাছের কোষের মধ্যস্ত তরলের চেয়েও বাড়িয়ে দেয় ফলে রসের উৎস্রোতে ব্যাঘাত ঘটায়। মাটিতে উচ্চ লবণ জমা হওয়ার ফলে গাছের বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগত উপাদান সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হয়। মাটিতে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ বেড়ে গেলে সরাসরি গাছের মূলের ক্ষতি করে এবং বীজের অঙ্কুরোদগমে বাধা প্রদান করে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির পরিমাণ (মিলিয়ন হেক্টরে) সারণি দ্রষ্টব্য।
লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত কার্যক্রম
মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে, লবণাক্ত জমি ব্যবহারযোগ্য নয়। বছরের পর বছর গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে এখন লবণাক্ত জমিতে খুব ভালোভাবে ফসল ফলানো সম্ভব। লবণসহিষ্ণু জাত, নিয়মিত সেচ, পানি ব্যবস্থাপনা, উপযুক্ত মাত্রার সার প্রয়োগ ইত্যাদি সকল প্রযুক্তির সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমেই লবণাক্ত জমিকে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। লবণাক্ততার কারণে এই এলাকার শস্য নিবিড়তা মাত্র ১৩৩ শতাংশ। শুকনো মৌসুমে এই এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। কোনও কোনও এলাকায় সীমিত আকারে তিল বা মুগডালের চাষ হয়। আবার দেরিতে পানি অপসারণের কারণে সময়মতো তিল বা ডালের বপন করা সম্ভব হয় না। দেরিতে তিল, ডালের বপনের ফলে তিল, ডাল পরিপক্ব হওয়ার পূর্বেই বর্ষার পানিতে তা নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে এই এলাকায় শুকনো মৌসুমে নিরাপদ পানির (লবণমুক্ত) অভাবে আমন ধানের পরে বোরো ধান চাষও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
মাটির উপরিস্তরের লবণাক্ত স্তর ভালোভাবে চেঁচে ফেলতে হয়। জমিতে সেচ দিয়ে ও মাটির নিচে গভীর পয়ঃপ্রণালী কেটে সুষ্ঠু নিকাশ ব্যবস্থা করলে জমির লবণাক্ততা দূর করা সম্ভব। এ ছাড়া, বৃষ্টির জলের সাহায্যে নিঃসরণ পদ্ধতিতে বাড়তি লবণ দূর করা যায়। এই ধরনের মাটির সংস্কারে জিপসাম, সালফার, ফেরাস সালফেট, লাইম সালফার ব্যবহার করা দরকার। সে সাথে জৈব পদার্থ যেমন-সবুজ সার, খামারের সার এবং আবর্জনা সার প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। লবণাক্ত মাটিতে যে শস্য ভাল হয় তা চাষ করতে হবে। মিষ্টি বিট, তুলা, বার্লি অধিক লবণ সহনশীল। ধান, ভুট্টা, গম, সিম, সূর্যমুখী মাঝারি সহনশীল। অল্প সহনশীল হিসাবে মাঠ শিম চাষ করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে উপকূলবর্তী বিপুল এলাকার লবণাক্তজমিতে এসব ফসলের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি চাষিদের মধ্যে দ্রুত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সম্প্রতি ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় ঘেরের আইলে আগাম শিম চাষ, অফসিজন তরমুজ ও মরিচ চাষ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।
লবণাক্ত মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করার জন্য দ্রবণীয় লবণকে মাটি থেকে সরিয়ে দিতে হবে। লবণাক্ত মাটিকে পুনরুদ্ধার বা পরিশোধন করা যায় বিভিন্নভাবে যেমন : যদি জমির ওপর খুব বেশি লবণ জমে যায় তবে তা চেঁচে পরিষ্কার করলে লবণাক্ততা কমে যায়। অনেক সময় লবণ পরিষ্কার করার পর অন্যস্থান থেকে অলবণাক্ত মাটি এনে ভরাট করা হয়। পানির সাথে লবণ উঠে আসার ফলে কয়েক দিন পর জমি আবার লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এই পদ্ধতি সীমিত ছোট এলাকার জন্য প্রযোজ্য।
বাষ্পায়ন হ্রাস পেলে অন্তর্ভূমি হতে লবণ ভূত্বকে উঠে আসে না। এ জন্য মালচিং এবং বিভিন্ন ধরনের বাষ্পরোধক ব্যবহার করে মাটির লবণাক্ততা কমানো যায়।
ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা ৮-১০ ফুট নিচে থাকা উচিত। পানি নিষ্কাশনের দ্বারাই পানির উচ্চতাকে সুবিধাজনকভাবে নিচে রাখা প্রয়োজন। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টালি নালা, খোলা নালা, আবৃত নালা, কুয়া হতে বাষ্প করে পানি বের করে দেয়া যায়।
প্লাবন সেচের মাধ্যমে লবণজাতীয় পদার্থগুলোকে পানিতে দ্রবীভূত করা হয় এবং প্লাবনের মাধ্যমে এই দ্রবীভূত লবণগুলোকে ধুয়ে জমি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এরূপ জমিতে সমন্বিত রেখা বরাবর ছোট ছোটভাবে বিভক্ত করে নেয়া হয় এবং প্রত্যেক জমিতে আইল বেঁধে উঁচু করা হয়। এরপর ঢালের আড়াআড়িভাবে ভেলির মতো করে দেয়া হয়। এরপর পানি সেচ করে প্রতিটি জমি ভালোভাবে প্লাবিত করে দিতে হয়।
বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জমির লবণ হ্রাস করার পর লবণ সহ্য করতে পারে এমন ফসল (ধান:বিআর২৩, ব্রিধান৪০, ব্রিধান৪১, ব্রিধান৪৭, বিনাধান-৮, বিনাধান-১০, তিল, চীনাবাদাম প্রভৃতি) চাষ করতে হবে। এ ছাড়া জৈব ও সবুজ সার মাটিতে প্রয়োগ করলে তা থেকে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয় তা লবণাক্ততা কমাতে সাহায্য করে।
যেহেতু উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত পানি দ্বারা বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে তাই এর পরিবর্তে মিষ্টি পানির গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। এভাবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে লবণাক্ত মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলা যায়।
পরিশেষে, দেশের উপকূল অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছে সেই হারে প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
অঞ্চল | মোট এলাকা | লবণাক্ত মাটি | সোডিক | মাটি | |
মিলিয়ন হেক্টর | মিলিয়ন হেক্টর | শতকরা | মিলিয়ন হেক্টর | শতকরা | |
আফ্রিকা | ১৮৯৯ | ৩৯ | ২.০ | ৩৪ | ১.৮ |
এশিয়া পেসিফিক ও অস্টেলিয়া | ৩১০৭ | ১৯৫ | ৬.৩ | ২৪৯ | ৮ |
ইউরোপ | ২০১১ | ৭ | ০.৩ | ৭৩ | ৩.৬ |
লাটিন আমেরিকা | ২০৩৯ | ৬১ | ৩.০ | ৫১ | ২.৫ |
নেয়ার ইস্ট | ১৮০২ | ৯২ | ৫.১ | ১৪ | ০.৮ |
নর্থ আমেরিকা | ১৯২৪ | ৫ | ০.২ | ১৫ | ০.৮ |
মোট | ১২৭৮১ | ৩৯৭ | ৩.১% | ৪৩৪ | ৩.৪% |
এ লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। যত দ্রুত লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় ততই মঙ্গলজনক। সে সাথে বিশ^ মৃত্তিকা দিবস ২০২১ এর প্রতিপাদ্য স্বার্থক হবে।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ই-মেইল : dg@dae.gov.bd
লবণাক্ত মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের চাষ নিবিড়করণ
ড. দেবাশীষ সরকার১ ড. নির্মল চন্দ্র শীল২
মৃত্তিকা সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ যার উপর দেশের খাদ্য নিশ্চয়তা, দারিদ্র্যবিমোচন, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সর্বোপরি টেকসই কৃষি অর্জনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নির্ভরশীল। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও জীবসত্তার বেঁচে থাকার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে মাটি। মাটির গুরুত্ব আমাদের অস্তিত্ব, চেতনা ও অপরিহার্য গন্তব্যের সোপানে বিনির্মিত। এ ধরনের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্টু ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহার সুনিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। আর সে কারণে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপন মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করছে।
বাস্তবে প্রতি বছর ০.৭৩% হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বৈশ্বিক ঊষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টিজনিত প্লাবন ও অনাবৃষ্টিজনিত খরা, অত্যধিক গরম, অত্যাধিক শীতের কবল সেইসাথে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়াজনিত অভিঘাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কৃষি অতিশয় চ্যালেঞ্জে পর্যবসিত। এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ততা ও অম্লতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বছরপ্রতি ফসলের উৎপাদন যথাক্রমে ৪৪.২ ও ৯.০ লক্ষ টন হ্রাস পায়। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৫.৩-এ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ভূমি অবক্ষয় শূন্যের কোঠায় পৌঁছানোর টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে। তা ছাড়া আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ন্যূনতম ৫৫% বজায় রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম, ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বোনেট জাতীয় লবণ ও তাদের আয়নের উপস্থিতি মাটি ও পানিকে লবণাক্ত করে থাকে, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ, ফুল-ফল ধারণ ও ফলনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। নাব্যতা হ্রাস পাওয়া, শুষ্ক আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের সময় ও গতিধারায় পরিবর্তন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, শুষ্ক মৌসুমে মাটির পানি বাষ্পীভবনের ফলে মৃত্তিকা দ্রবণের লবণ মাটির উপরে চলে আসা, সমুদ্রের লোনাপানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ স্লুইসগেট ও পোল্ডার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয় মৃত্তিকার লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের ২.৮৬ মিলিয়ন হেক্টর জমির (দেশের মোট ভূমির প্রায় ৩০%) মধ্যে ১.০৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা কবলিত হয়ে পড়েছে এবং এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। সাধারণত লবণাক্ততার মান ৪ ডিএস/মিটার-এর বেশি হলে ফসলের বৃদ্ধি, বিকাশ ও ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাটির লবণাক্ততা ১৬ ডিএস/মিটারের বেশি হলে সেই মাটিতে চাষাবাদ অন্তত দুরূহ হয়ে পড়ে এবং ফসল ফলানো সম্ভব নাও হতে পারে। অপরদিকে সেচের পানির ইসি মান ১ ডিএস/মিটার বা ততোধিক হলে উক্ত পানি লবণাক্ততা কবলিত এবং সেচের কাজে ব্যবহার করলে ফসলহানির সম্ভাবনা থাকে।
লবণাক্ততা কবলিত উদ্ভিদের লক্ষণসমূহ: পাতার শীর্ষভাগ প্রথমে সাদা হয়ে যায় পরবর্তীতে পুড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে। শাখা প্রশাখা ও কুশি কমে যায়। দানাদার ফসলের শীষ অপুষ্ট হয়। শীষে কিংবা পডে বীজের সংখ্যা কমে যায়। বীজের ওজন হ্রাস পায়। পাতা মোড়ানো রূপ ধারণ করে। পাতায় সাদা সাদা দাগ দেখা যেতে পারে। শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায়। ফুলের সময়কাল পরিবর্তিত হতে পারে। পাতা, পল্লব ও কাণ্ডে সোডিয়াম ও ক্লোরিন বেশি জমা হয়। পটাশিয়াম, ফসফরাস ও জিংক পরিশোষণ কমে যায়।
মাটির লবণাক্ততা প্রতিরোধ করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতকরণের জন্য বিএআরআই দেশি-বিদেশি প্রকল্পের সহায়তায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশ কিছু লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ত মাটিতে ফসল ফলানো দুরূহ হলেও মধ্যম মাত্রার লবণাক্ত (৪-১২ ডিএস/মি) জমিতে গম, ভুট্টা, খেসারি, মুগডাল, ছোলা, তিসি, তিল, সূর্যমুখী, মরিচ, ধনিয়া, টমেটো, বাঁধাকপি, তরমুজ, খিরা, প্রভৃতি ফসল মৃত্তিকা ও ফসল ব্যবস্থাপনার টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লাভজনকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ফসল ধারা পরিবর্তন, আগাম ফসল বপন রোপণ, আন্তঃফসল, মিশ্রফসল চাষ, মালচিং, ড্রিপ সেচ, উঁচু বেড পদ্ধতি প্রভৃতি প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা আবশ্যক। তা ছাড়া বিভিন্ন ফসলের লবণাক্ততাসহনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা চাষ করার মাধ্যমে লবণাক্ত অঞ্চলে সাফল্যজনকভাবে ফসল চাষ করা সম্ভব। ফসলের লবণাক্ততা সহনশীল জাত সারণি দ্রষ্টব্য।
উঁচু বেড পদ্ধতি ও অধিক হারে পটাশিয়াম সার প্রয়োগে লবণাক্ত অঞ্চলে হাইব্রিড ভুট্টা উৎপাদন
লবণাক্ত অঞ্চলে (নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীর, খুলনা প্রভৃতি) ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য ১০-১২ ইঞ্চি উঁচু বেড তৈরি করে প্রচলিত সুপারিশের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগ অধিক পটাশিয়াম প্রয়োগ করে হাইব্রিড ভুট্টা (বারি হাইব্রিড মেইজ-৭) চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৮-১০ টন ফলন পাওয়া সম্ভব। সনাতনী পদ্ধতির ফলনের তুলনায় ৩৫-৪০% অধিক হয়। অধিক হারে পটাশিয়াম সার প্রয়োগ ও বেড উঁচু হওয়ার কারণে গাছের মূলাঞ্চলে ক্ষতিকর সোডিয়ামের কার্যকারিতা কমে যায় ও গাছ কর্তৃক পটাশিয়াম পরিশোষণ বৃদ্ধি পায়। ফলে গাছের জৈবিক ক্রিয়া, পানির প্রবাহ ও অন্যান্য অত্যাবশকীয় পুষ্টি উপাদানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। বিএআরআই নোয়াখালী (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১৮) ও পটুয়াখালী (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১৩) অঞ্চলে তিন বছর গবেষণা করে উক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
ফসলের নাম |
জাতের নাম
|
ধান | ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৭৩, বিনা ধান-৮, বিনা ধান-১০ |
গম | বারি গম-২৫, বারি গম-৩৩ |
ভুট্টা |
বারি ভুট্টা-৯, বারি ভুট্টা-১১, বারি ভুট্টা-১৬ |
বার্লি |
বারি বার্লি-৭, বারি বার্লি-৮, বারি বার্লি-৯ |
আলু |
বারি আলু-৭২, বারি আলু-৭৩, বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯ |
মিষ্টিআলু |
বারি মিষ্টিআলু-৭, বারি মিষ্টিআলু-৮ |
মুগডাল |
বারি মুগ-৬ |
তিল |
বারি তিল-৪ |
সূর্যমুখী |
বারি সূর্যমুখী-৩ |
সরিষা |
বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, বিনা সরিষা-৫ |
সয়াবিন |
বারি সয়াবিন-৬ |
টমেটো |
বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ (গ্রীষ্মকালীন), বারি টমেটো-১৪, বারি টমেটো-১৫ |
তরমুজ |
বারি তরমুজ-২ |
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
মৃত্তিকা পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অঞ্চলভেদে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ইউরিয়া ৬০০-৬৫০ কেজি, টিএসপি ২৮০-৩৪০ কেজি, এমওপি ২৫০-২৭৫ কেজি, জিপসাম ১৬০-১৮০ কেজি, জিংক সালফেট (মনো হাইড্রেট) ১০-১৫ কেজি এবং বরিক এসিড ৬-৮ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার সমান তিনভাগ করে এক-তৃতীয়াংশ বীজ গজানোর ৫ দিন পর, এক-তৃতীয়াংশ বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর এবং বাকি অংশ বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সমুদয় টিএসপি ও জিপসাম এবং দুই তৃতীয়াংশ এমওপি জমি তৈরির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট ও বরিক এসিড একটি প্লাস্টিকের বালতি বা গামলায় ঝুর ঝুরে মটির সাথে মিশ্রিত করে জমি প্রস্তুতের শেষ পর্যায়ে মটিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি এক- তৃতীয়াংশ এমওপি সার ২য় কিস্তি ইউরিয়া সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে লবণাক্ত অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ
ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে লবণাক্ত অঞ্চলে (সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী) সাফল্যজনকভাবে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করা সম্ভব। ড্রিপ সেচ পদ্ধতির সুবিধা হলো গাছের মূলাঞ্চলে ফোঁটা ফোঁটা আকারে প্রয়োজনীয় সার মিশ্রিত পানির দ্রবণ পড়তে থাকে বিধায় মৃত্তিকার লবণের তীব্রতা হ্রাস পায়। এ পদ্ধতিতে সারের ব্যবহার ৩০-৪০% হ্রাস করা যায়। তা ছাড়া সেচের পানি ৫০% কম প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ১৮০-২০০ কেজি ইউরিয়া, ২২৫-২৫০ কেজি টিএসপি, ১২০-১৫০ কেজি এমওপি, ১০০-১২০ কেজি জিপসাম, ৬-৮ কেজি বরিক এসিড, ৩-৬ কেজি জিংক সালফেট এবং ৩-৫ টন জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া এবং এমওপি ছাড়া অন্যান্য সার সুপারিশ অনুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া এবং এমওপি সার চারা রোপণের ১৫, ৩০, ৪৫ ও ৬০ দিন পর সমান ৪ (চার) ভাগে সেচের পানির সাথে মিশিয়ে ড্রিপ সেচের মাধ্যমে প্রয়োগ করা বিধেয়। ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৩০-৩৫ টন গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ফলন পাওয়া যায় যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ২৫-৩০% বেশি এবং নিট মুনাফা শীতকালীন টমেটোর তুলনায় ২-২.৫ গুণ পাওয়া সম্ভব।
মৃত্তিকা সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রকৃতির হাজার হাজার বছর প্রয়োজন হয়। পরিতাপের বিষয় মানুষের অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্তিকা তার নিজস¦ গুণাবলী হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ে। খাদ্য উৎপাদন টেকসইকরণ ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য লবণাক্ততা কবলিত উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রতিকূল পরিবেশে ফসল চাষ নিবিড়করণ একান্ত প্রয়োজন। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য লবণাক্ততাসহ অন্যান্য মাটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্তিকা সম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। আর তাই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার নিম্নরূপ ছন্দে ব্যক্ত হতে পারেÑ
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের অঙ্গীকার,
নিশ্চিত করি মৃত্তিকা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার।
মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে,
পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যে দেই দেশ ভরে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, বিএআরআই,২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল : nirmal_shil@yahoo.com
সহনশীল মৎস্য উৎপাদনে মাটি ও পানির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ কাজী শামস আফরোজ১ কৃষিবিদ ড. মোহাঃ সাইনার আলম২
প্রতিটি প্রাণীর সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য তাদের উপযোগী স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের প্রয়োজন। মাছের বাসস্থান হচ্ছে জলাশয় এবং জীবন ধারণের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে পানি। জলাশয়ের উৎপাদন ক্ষমতা প্রাথমিকভাবে মাটির বিভিন্ন গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে। পুকুরের মাটি ও পানির গুণাগুণ যথাযথ মাত্রায় না হলে মাছের উৎপাদন কম হবে। উর্বর মাটি ও পানি মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরিতে অধিক পরিমাণে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়। সুতরাং সফলভাবে মাছচাষে মাটি ও পানির গুণাগুণের গুরুত্ব অপরিসীম।
মৎস্যচাষে মাটির গুণাগুণ
মাটির গুণাগুণ পানির গুণাগুণকে (পানির পিএইচ, অম্লত্ব, ক্ষারত্ব ইত্যাদি) সরাসরি প্রভাবিত করে, তাই পুকুর বা খামারের স্থান নির্বাচনের সময় মাটির ধরন জেনে নেয়া প্রয়োজন। দো-আঁশ মাটি মাছ ও চিংড়ি চাষের জন্য উত্তম। মাটির পিএইচ ৬.৫ থেকে ৭.৫ থাকা বাঞ্ছনীয়। এসিড সালফেটযুক্ত মাটি মৎস্যচাষ ব্যবস্থাপনায় গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই স্থান নির্বাচনের সময় এরূপ এলাকা পরিহার করা উচিত। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে এসিড সালফেটযুক্ত মাটি উঠিয়ে ফেলে সেখানে ভাল মাটির উপযুক্ত স্তর তৈরি করতে হবে। পুকুরের উৎপাদনশীলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে তলদেশের উর্বর মাটির ওপর। সর্বোত্তম পুকুরের তলদেশের মাটিতে জৈব পদার্থসমূহের পচন তাড়াতাড়ি হয়, মাটি ও পানির আন্তঃক্রিয়া সার্বক্ষণিকভাবে চলে এবং তলদেশের মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকারক পদার্থসমূহ সহজেই পানিতে মুক্ত হয়। দো-আঁশ মাটিতে সার প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কাদা মাটির পানি ধারণক্ষমতা বেশি। তলদেশে ৪-৬ ইঞ্চি কাদাযুক্ত পুকুর বেশ উৎপাদনশীল। তবে জলাশয়ের কালো কাদায় অধিক জৈবিক পদার্থ থাকে, যা পানির অক্সিজেন চাহিদা বাড়ায় ও পানির গুণাগুণের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই অধিক কাদাযুক্ত পুকুর পরিহার করা উচিত। সার প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুরে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টিকারক পদার্থসমূহের সরবরাহের ফলে পুকুরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং মাছের অধিক উৎপাদনও পাওয়া যায়। পুকুরের তলদেশীয় মাটির রাসায়নিক গুণাবলি অনেকাংশে পার্শ্ববর্তী জমির মাটির সাথে পারস্পরিকভাবে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এবং পার্শ্ববর্তী জমি থেকে আসা পুষ্টি উপাদানের কারণে ঐ পুকুরের তলদেশের মাটিতে পুষ্টিকারক পদার্থের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।
মাছ চাষে পানির গুণাগুণ
জলাশয়ের পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ কর হয়, ক. ভৌত গুণাগুণ ও খ. রাসায়নিক গুণাগুণ। মাছচাষে এগুলোর প্রভাব ও প্রতিকারের ব্যবস্থা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
ক. ভৌত গুণাগুণ
আলো : পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে আলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সবুজ উদ্ভিদকণা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে গ্লুুকোজ, ফাইটোপ্লাঙ্কটনের (মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য) খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং উৎপাদিত অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত হয়ে জলজ জীবকুলের শ্বাসকার্যে ব্যবহৃত হয়। একটি পুকুরের পানিতে দিনের বেলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত সূর্যালোক পড়লে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
তাপমাত্রা : মাছের বৃদ্ধি, প্রজনন ও অন্যান্য জৈবিক কার্যক্রম তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে জলজপ্রাণীর বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়। এ অবস্থায় পানির পরিবেশ ভাল থাকলে মাছ বা চিংড়ি বেশি খায় এবং বাড়েও বেশি। পানির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেলে মাছের বিপাকীয় হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পানির তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে হলে মাছ খুব কম খায় এবং ৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে হলে মাছ খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
ঘোলাত্ব : পলি ও বালুকণাসহ পানিতে ভাসমান ও দ্রবীভূত নানা জৈব ও অজৈব পদার্থের উপস্থিতিজনিত কারণে পানি ঘোলা হয়। সকল জলাশয়ে পানি কিছু না কিছু ঘোলা থাকে। ঘোলা পানি সূর্যালোক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে পানির প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়, ফলে মাছ খাবি খায়। অতিরিক্ত ঘোলা পানিতে মাছের শ্বাস ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে, মাছের ফুলকা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি মাছ মারাও যেতে পারে। মাটির গঠন পরিবর্তন করে কাদা মাটির দ্বারা সৃষ্ট ঘোলাত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাছাড়া পুকুরে বাইরের পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে তথা পাড় উঁচু করে, পাড়ে ঘাসের আবরণ সৃষ্টি করে এবং জৈবসার ব্যবহার করে ঘোলাত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শতকে ১.৫-২.০ কেজি হারে পোড়া চুন বা জিপসাম বা ৫০-১০০ গ্রাম হারে ফিটকিরি পানিতে দ্রবণ তৈরি করে প্রয়োগ করলে ঘোলাত্ব দূর হয়। খসখসে পাতাবিশিষ্ট (খোকসা, শেওড়া, বাঁশ) গাছের ডাল বা কলাগাছ কেটে পানিতে দিলে অথবা ধানের খড় এক সপ্তাহ ডুবিয়ে রাখলেও ঘোলাত্ব নিবারণ হতে পারে।
স্বচ্ছতা : জলাশয়ে পানির স্বচ্ছতার উপর ফাইটোপ্লাংকটনের সালোকসংশ্লেষণ হার এবং বেনথোসের বিস্তার নির্ভর করে। পানির স্বচ্ছতার পরিমাপ ২০ সেমি. বা তার কম হলে পানিতে ফাইটোপ্লাংকটনের ব্লুম হয়, যা জলজ পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মাছের উৎপাদন কমে যায়। আর পানির স্বচ্ছতার পরিমাপ ৩০ সেমি.-এর বেশি হলে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ কম রয়েছে মর্মে বিবেচিত হয়, যা জলাশয়টির অনুর্বরতা নির্দেশ করে। সার প্রয়োগের মাধ্যমে পানির স্বচ্ছতা কমানো যায়।
খ. রাসায়নিক গুণাগুণ
দ্রবীভূত অক্সিজেন : পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উৎস মূলত বায়ুমণ্ডল এবং পানির ভিতরে সংঘটিত সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত অক্সিজেন, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, বায়ুচাপ ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার সঙ্গে পানিতে অক্সিজেন দ্রবণীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বেড়ে গেলে পানিতে অক্সিজেনের দ্রবণীয়তা কমে যায়। অক্সিজেন স্বল্পতা রোধে করণীয়সমূহ হচ্ছেÑ ১) পুকুরের পানি পরিবর্তন করে; ২) এরেটর বা অন্য উপায়ে পানিতে প্রচুর ঢেউ সৃষ্টি করে বাতাস ও পানির সংস্পর্শ বৃদ্ধি করে; এবং ৩) প্রখর রৌদ্রোজ্জ্বল সময়ে হররা টেনে তলদেশের বিষাক্ত গ্যাস বের করে।
সারণি ১ : পুকুরে পানির গুণাগুণের আলো ভাল বা উৎপাদন সহায়ক মান
প্যারামিটার |
গ্রহণযোগ্য মাত্রা | প্যারামিটার | গ্রহণযোগ্য মাত্রা |
দ্রবীভূত অক্সিজেন | ৫ - ৮ পিপিএম | ফসফরাস | ০.২ পিপিএম |
পিএইচ (অত্যানুকূল) | ৭.৫ - ৮.৫ | নাইট্রোজেন | ০.২ পিপিএম |
ক্ষারত্ব | ১০০ মিলিগ্রাম/লিটার | পটাশিয়াম | ১ পিপিএম |
খরতা | ৪০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার | নাইট্রাইট | ২.৪ পিপিএম এর কম |
দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড | ১-২ মিলিগ্রাম/লিটার | স্বচ্ছতা | ২৫ সেন্টিমিটার |
অ্যামোনিয়া (অ-আয়নিত) |
০.০২৫ মিলিগ্রাম/লিটার | তাপমাত্রা |
২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস |
হাইড্রোজেন সালফাইড | ০.০০২ পিপিএম এর কম | পানির গভীরতা | ৫.০-৭.০ ফুট |
কার্বন ডাই-অক্সাইড : মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে উদ্ভিদ কর্তৃক জলাশয়ে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়। এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায়। মাত্রাতিরিক্ত ফাইটোপ্লাংকটনের ব্লুুম ও অত্যাধিক জৈব বস্তুর পচনের ফলে মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি ঘটে। পুকুরে চুন প্রয়োগ করে অথবা মাছের মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করা যায়।
অ্যামোনিয়া : মাছ ও চিংড়ির বর্জ্য, অভুক্ত খাদ্য, বিভিন্ন নাইট্রোজেনজাত পদার্থের পচন এবং হঠাৎ করে ফাইটোপ্লাংকটন মারা গিয়ে পচনের ফলে পুকুরে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। পুকুরে অ্যামোনিয়া আয়োনাইজড (NH4) ও আন-আয়োনাইজ্ড (NH3) এই দু’রূপে থাকে। আন-আয়োনাইজ্ড অ্যামোনিয়া মাছ ও চিংড়ির জন্য খুব বিষাক্ত। তাপমাত্রা ও পিএইচ বেড়ে গেলে আন-আয়োনাইজ্ড অ্যামোনিয়া বেড়ে যায়। পুকুরে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বেড়ে গেলে পানির রং তামাটে অথবা কালচে হয়। ফলে মাছ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করার পাশাপাশি চক্রাকারে দ্রুত সাঁতার কাটতে থাকে। পুকুরে ভাল পানি সরবরাহ করে এবং মজুদ ঘনত্ব, সার ও খাদ্য প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পিএইচ : মাছ চাষে পানির পিএইচ ৬.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে থাকা সর্বোত্তম। পিএইচ এর মান ৪-এর নিচে এবং ১১-এর ওপরে হলে অধিকাংশ মাছের জন্য তা মারাত্মক। পানির পিএইচ বেড়ে গেলে মাছের ফুলকা নষ্ট হয়, চোখের কর্নিয়া ও লেন্স নষ্ট হয়, অসমোরেগুলেশন ক্ষমতা হ্রাস পায়, মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। সাধারণত চুন প্রয়োগ করে পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
খরতা : পানিতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মোট ঘনত্ব হচ্ছে খরতা, যা প্রকাশ করা হয় (CaCO3) এর পরিমাণ দিয়ে। মাছ ও চিংড়ি চাষের জন্য হালকা খর পানি সবচেয়ে ভাল। খরতার মান ২০ পিপিএমের কম অথবা বেশি হলে - ১) পানির বাফারিং ক্ষমতা কমে যায়, ফলে পিএইচ দ্রুত ওঠানামা করে; ২) পুকুরে সার দিলে তা কার্যকর হয় না; ৩) ক্ষারত্ব বেড়ে গেলে (>৩০০ মিলিগ্রাম/লিটার) পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদন হ্রাস পায়; এবং ৪) মাছ সহজেই অম্লতা ও অন্যান্য ধাতুর বিষক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। ক্ষারত্ব ও খরতা নিয়ন্ত্রণে পুকুরে নিয়মিত চুন অথবা জিপসাম প্রয়োগ এবং নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে।
সারণি-২ : চুন প্রয়োগের মাত্রা
মাটির পিএইচ | চুনের | পরিমাণ | কেজি/শতক | |
পোড়া চুন (CaO) |
কলি চুন [Ca(OH)2] |
পাথুরে চুন [Ca(OH)3] |
ডলোমাইট [Ca(Mg(Co3)2] |
|
৩-৫ (অম্লীয় মাটি) | ৪.০ | ৬.০ | ৮.০ | ৮.০-৯.০ |
৫-৬ (এটেল মাটি) | ২.০ | ৩.০ | ৪.০ | ৪.০-৬.০ |
৬-৭ (দে-আঁশ) | ১.০-২.০ | ১.৫ | ২.০ | ২.০-৩.০ |
মাটি ও পানির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চুনের ব্যবহার
চুন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অজৈব যৌগ যা এসিড মাধ্যমকে ক্ষারীয় বা নিরপেক্ষ করে। এছাড়াও মাটি ও পানির পিএইচ মাছ চাষের উপযোগী (৬.৫-৮.৫) রাখে; পানিতে খরতার পরিমাণ ২০ মিলিগ্রাম/লিটার-এর বেশি রাখতে সহায়তা করে; সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে; নার্সারি পুকুর প্রস্তুতকালীন চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পরজীবী ও রোগজীবাণু দূর করা যায় এবং পুকুরের তলায় অবস্থিত জৈব পদার্থের পচন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পদার্থের পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি করে। চুনের ক্যালসিয়াম নিজেই একটি গুুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান এবং কাদায় আবদ্ধ ফসফরাস মুক্ত করে ও ফাইটোপ্লাংকটন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। চুন প্রয়োগের ফলে শামুক-ঝিনুকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়; পানির ঘোলাত্ব কমায়; এবং পানির স্বচ্ছতা ও সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি করে। চুনের গুরুত্ব বলতে গেলে বলতে হয়- মাছ চাষে চুন যেমন, সব তরকারিতে নুন তেমন।
চুন প্রয়োগের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি : চুন প্রয়োগের মাত্রা সারণি ২ দ্রষ্টব্য। প্রথমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চুন পুকুর পাড়ে ব্যারেলে/মাটির গর্তে/মাটিতে পোঁতা হাড়িতে/পাকা চৌবাচ্চায় ৭-৮ ঘণ্টা ভেজাতে হবে। ঠাণ্ডা হওয়ার পর অধিক পরিমাণ পানিতে গুলিয়ে নেটের উপরে ফেলে ছেঁকে পুকুরের পাড়সহ সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে পুকুর বা চিংড়ি ঘেরের তলা প্রস্তুতির সময় চুনের পাশাপাশি চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন আগে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে চুনের সাথে ব্লিচিং পাউডার (৬৫% ক্লোরিন) ব্যবহারের মাত্রা প্রতি শতকে ১৫০ গ্রাম। দুপুর বেলা চুন প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। চুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
পানি আছে যেখানে, মাছ চাষ সেখানে- এ প্রতিপাদ্যকে ধারণ ও লালন করে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে আধুনিক ও উন্নত মৎস্যচাষ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সকল ধরনের জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যকর ও পরিবেশসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া আর কোন সহজ বিকল্প নেই। জলাশয়ের মাটি ও পানির যথাযথ ও কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মাছের রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। ফলশ্রুতিতে জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ মাছের উৎপাদন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হবে এবং টেকসই উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব হবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ (dg@fisheries.gov.bd), ২উপপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রংপুর বিভাগ, রংপুর (sainardof@yahoo.com)
লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলে চাষ উপযোগী চিনি ফসল
ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. গাজী মো. আকরাম হোসেন২
বাংলাদেশে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর সমুদ্র উপকূলীয় নিম্নভূমি রয়েছে যা সমুদ্র স্তরের ০.৯ থেকে ২.১ মিটার গভীরতার মধ্যে প্রায় ১.৫১ মিলিয়ন হেক্টর (৫৩%) লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০% জুড়ে রয়েছে। এই অঞ্চল উপকূল থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলগুলোতে কৃষিজমি ব্যবহার খুবই কম, যা দেশের গড় কৃষি জমি ব্যবহারের প্রায় ৫০%। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনসাধারণ তাদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল। এই অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ এবং বেশির ভাগ কৃষি পরিবার স্বল্প পরিমাণ জমিতে নিবিড়ভাবে চাষ করে, যার ফলে জমির উর্বরতা এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। বর্ষা ভেজা মৌসুম জুন থেকে অক্টোবর মাসে মাটি এবং নদীর লবণাক্ততা কম থাকে এবং তখন এই অঞ্চলে খরিপ ২ মৌসুমে ধান উৎপাদন সম্ভব হয়। তবে নভেম্বর হতে মে মাসের মধ্যে (রবি এবং খরিফ ১ মৌসুম) শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং সেই সময়ে কৃষি উৎপাদন সীমিত হয়ে যায়। বাংলাদেশে শুকনো মৌসুমে খরা এবং মাটির লবণাক্ততা প্রতিকূলতার কারণে কৃষি উৎপাদন খুবই কঠিন। বিভিন্ন চিনিফসল যেমন আখ, তাল, খেজুর, গোলপাতা ইত্যাদি লবণাক্তসহিষ্ণু ফসল। লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলে অনায়াসেই এ সকল চিনি ফসলের চাষ বৃদ্ধি করে জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং চিনি ও গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। নিম্নে লবণাক্ততা সহিষ্ণু চিনি ফসলসমূহ সম্পর্কে সম্যক আলোচনা করা হলো।
আখ : আখ একটি অন্যতম খাদ্য তথা শিল্পজাত ফসল। এটিকে দুর্যোগ সহনশীল ফসল বলা হয়। যা খরা, বন্যা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু। আখ ১৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত লবণাক্ত এলাকায় চাষ উপযোগী গুড় আখের জাতগুলো হলো: ঈশ্বরদী ৩৯, ঈশ্বরদী ৪০, বিএসআরআই আখ ৪৩, বিএসআরআই আখ ৪৪, বিএসআরআই আখ ৪৫, বিএসআরআই আখ ৪৬ এবং বিএসআরআই আখ ৪৮। চর এলাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা এবং উপকূলীয় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানিতে যখন সব ধরনের ফসল ভেসে যায় তখনও আখ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে দুর্যোগের ২-৩ দিন খাদ্যের অভাবে যখন মহামারি হয় তখন আখের রস তৎক্ষণাৎ শক্তিদায়ক খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে। কেননা আখের রস একটি পুষ্টিকর পানীয়। সাধারণত ১ গ্লাস আখের রস থেকে ২৭ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। আখের রসে মোট চিনির পরিমাণ ১৫ শতাংশ থাকে। রসের বাকি অংশ পানি যাহাতে প্রচুর ভিটামিন এবং মিনারেল দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। আখের রসে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, তামা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাংগানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং জিংক বিদ্যমান। এতে আরও থাকে আয়রন এবং বিভিন্ন ভিটামিন যেমন এ, সি, বি১, বি২, বি৩, বি৫ এবং বি৬ এর সাথে উচ্চ ঘনমাত্রায় ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট (ক্লোরোফিলসহ), এন্টিঅক্সিডেন্টস, প্রোটিন, দ্রবীভূত আঁশ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সহায়ক যৌগ। সক্রিয়ভাবে কাজ করার মাধ্যমে এই পুষ্টি উপাদানসমূহ ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সহায়ক খাদ্য সরবরাহে ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা যায়, উক্ত খাদ্য উপাদানগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধে, ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে, ওজন হ্রাসে, জ্বর সারাতে, কিডনি পরিষ্কারে, দাঁতের ক্ষয় রোধে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকারিতায় ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
খেজুর গাছ : খেজুর গাছ প্রকট খরা, বন্যা, লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতায় বেঁচে থাকতে পারে। তাছাড়া ফসলের মাঠে কৃষি বনায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে পতিত অনুর্বর জমিতে, বাঁধের ধারে, পুকুর পাড়ে, জমির আইলে, বাড়ি ও বাগানের চারদিকে, কাঁচা-পাকা রাস্তার দুই পাশে সারি করে খেজুর গাছ লাগানো হয়। প্রতিদিন খেজুরের রসের উৎপাদন গাছপ্রতি গড়ে ৫ লিটার। খেজুর রসে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে, প্রতি ১০ লিটার রসে এক কেজি গুড় হয়। একটা খেজুর গাছ থেকে বছরে প্রায় ২০-২৫ কেজি গুড় পাওয়া যায়। নভেম্বর মাস হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। খেজুর গাছ পরিবেশবান্ধব, স্থান সাশ্রয়ী একটি উদ্ভিদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধেও খেজুর গাছের ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া খেজুর গাছ মাটির পানির স্তর ধরে রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় খেজুর গাছ লাগানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
তালগাছ : তালগাছ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুগারক্রপ। তালগাছ প্রকট খরা, বন্যা, লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতায় বেঁচে থাকতে পারে। তালপাতার আগা সুচালো হওয়ায় বজ্রপাত রোধক গাছ হিসেবে এ ফলের আবাদ অতি জনপ্রিয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রতিকূল প্রভাব অহরহ লক্ষ্য করা যায়। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতের আধিক্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতের কারণে অনেক মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিকূলের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষ করে উপকূল এবং হাওড় এলাকায় তালসহ অন্য বয়স্ক বড় গাছের (বট, পেকুড়, তেঁতুল) অনুপস্থিতির কারণে তদাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এ অবস্থার উন্নয়নে সারাদেশে তালগাছ সম্প্রসারণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
গোলপাতা গাছ : গোলপাতা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ। এটি সুন্দরবন ছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলের নদীখালের ধারে জন্মাতে দেখা যায়। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় গোলপাতা গাছ দেখা যায়। গোলগাছের মঞ্জুরির দণ্ড হতে রস সংগ্রহ করা হয়। এই রসে শর্করার পরিমাণ প্রায় ১৮ ভাগ। যা গুড় তৈরিতে ও টনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও রস হতে ভিনেগার তৈরি হয়। গোলের ব্যবহার এখন সারা বিশ্বে ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে।
মাটির লবণাক্ততার কারণ ও প্রতিকার : মাটির লবণাক্ততা একটি মুখ্য পরিবেশগত প্রতিকূল অবস্থা যাহা ফসলের বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে ফলন কমিয়ে দেয়। সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCI) মাটির একটি মুখ্য লবণ দূষক, ইহা একটি ক্ষুদ্র অনু যখন পানিতে আয়নিত হয় তখন সোডিয়াম (Na+) এবং ক্লোরিন (CI-1) আয়ন তৈরি করে। এই বিষাক্ত আয়নগুলো গাছের কোষীয় স্তরে আয়নিক এবং অসমোটিক স্ট্রেস সৃষ্টি করে। লবণ প্রভাবিত জমির উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো কার্যকর উপায় রয়েছে যেমন- পানি চুয়ানো, রাসায়নিক প্রতিকার এবং ফাইটোরিমেডেশন। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে লবণ- প্রভাবিত মাটির প্রতিকার করা যায়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জিপসাম (CaSO4.2H20), ক্যালসাইট (CaCO3), ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCI2.2H2O), এবং জৈবপদার্থ ব্যবহার (খামারজাত সার, সবুজসার, জৈব সংশোধন এবং পৌর শুষ্ক বর্জ্য ব্যবহার)। যেগুলো সফল পদ্ধতি এবং সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এই পদ্ধতিগুলো কার্যকরী, খরচ কম এবং সহজ। লবণাক্ত মাটিতে জিপসাম প্রয়োগ অথবা জিপসাম ও জৈব দ্রব্য একসাথে প্রয়োগের ফলে দানাশস্য এবং তেলবীজ ফসলের ফলন বৃদ্ধির যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলে সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও সুপারিশকৃত মাত্রার ২৫% বেশি জিপসাম এবং জৈবসার (বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-৫৮, টিএসপি-৩০, এমওপি-৩২, জিপসাম-২৩, দস্তা-২, বোরন-২, গোবর/কম্পোস্ট-১৫০০ কেজি) প্রয়োগ করে আখ রোপণ করতে হবে এবং আখের জমিতে খড় বা আখের শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে দিলে জমির লবণাক্ততা রোধ করা যায় এবং ভাল ফলন পাওয়া যায়।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করে বর্তমান ও ভবিষ্যতে চিনি ও গুড়ের চাহিদা পূরণে আখসহ অন্যান্য সুগারক্রপ যেমন- খেজুর, তাল এবং গোলপাতা চাষ সম্প্রসারণে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভ্যান ডাই (Van Die) ১৯৭৪ সালে বলেছেন সঠিক পরিচর্যা এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রস আহরণ উপযোগী পাম প্রজাতিগুলো (খেজুর, তাল, গোলপাতা ইত্যাদি) থেকে ২০ টন/হেক্টর/ বছর চিনি উৎপাদন সম্ভব। যেখানে আখ থেকে চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৫ থেকে ১৫ টন/হেক্টর/বছর। খেজুর ও তালগাছ বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মাতে দেখা যায়। এ ফসলগুলোর চাষ সম্প্রসারণেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া সিডর-আইলা ও মহাসেন-এর মতো যে কোনো দুর্যোগে তাল এবং খেজুর গাছই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। তাছাড়া তালগাছ সবচেয়ে বেশি কার্বন গ্রহণ করে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে তাল গাছই সবচেয়ে বেশি সহায়তা প্রদান করতে পারে। আর গোলপাতা জন্মায় সবচেয়ে বেশি লবণাক্ত জমিতে বা নদী ও খালের পাড়ে, যেখানে জোয়ার-ভাটার কারণে লবণাক্ত পানি আসা-যাওয়া করে। অধিকাংশ সময় জমি পতিত থাকে। ফলে এ ফসলটি পতিত জমিতে চাষ করে। অথচ এ ফসলেরও রয়েছে অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনা। কারণ গোলগুড় স্বাদেও অনন্য, মানেও সেরা।
লেখক : ১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী, পাবনা। ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, মৃত্তিকা ও পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। ফোন : ০৭৩২৫৬৫৩৬২৮, ই-মেইল : dg-bsri.gov.bd
মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা : প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহার
প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
আমাদের মধ্যে অনেকে প্রায় বলে থাকেন একটি স্বাভাবিক উর্বর ও উৎপাদনশীল মাটিতে অন্তত শতকরা ৫ ভাগ জৈবপদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে আছে এক ভাগেরও কম। ব্যাখ্যা করা দরকার যে এ কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমাদের দেশে মৃত্তিকা গবেষণা ও শিক্ষার বয়স প্রায় ৮০ বছর। তবে দেশের উন্নয়নের প্রায়োগিকতায় পেছনে, বুঝা-পড়ায়ও ততটা আধুনিক কনসেপ্ট বহন করে না। রয়েছে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অসমন্বয়। তাই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসে মাটির প্রাকৃতিক ও প্রকৃত বিষয়াবলী স্মরণ করে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো। সম্প্রতি দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- প্রতি ইঞ্চি মাটি চাষের আওতায় আনতে হবে। যে স্থানে যে ফসল ভালো হবে সেখানে সেই ফসল চাষ করতে হবে। এজন্য মাটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ হতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি চাষের যথেষ্ট উপযোগী। সাধারণভাবে বলা হয়- বাংলাদেশের মাটি প্রায় দ্বিগুণ উর্বর ও উৎপাদনশীল।
মাটি সম্পর্কে ধারণা
মাটির ধারণা প্রকৃতপক্ষে মাটি ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। একজন নির্মাণ প্রকৌশলীর নিকট মাটি হচ্ছে নির্মাণের ভৌত ভিত্তি। একজন ভূতত্ত্ববিদের মতে খনিজের ধারক। কিন্তু একজন কৃষিবিদ মাটিকে ফসল, উদ্ভিদ, মাছ ও পশুখাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন। কৃষি বিবেচনায়, উদ্ভিদ ও জীব উৎপাদন সংক্রান্ত তথা উপযোগী ভূত্বকের উপরের নরম অংশকে মাটি বলা হয়। এ ধারণার ভিত্তিতে মাটির একাধিক সংজ্ঞা রয়েছে। যেমন-প্রবীণতম মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডকুচেভ (Dockuchaev) এর মতে: মাটি হচ্ছে খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ যা জীবকার্যের সমন্বয়ে গঠিত উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী পরিবর্তনশীল ভূউপরিস্থ একটি প্রাকৃতিক বস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ অনুসারে মাটি হচ্ছে প্রাকৃতিক বস্তুর সমষ্টি যা ভূপৃষ্ঠকে স্তরাকারে আবরিত করেছে, শিলা থেকে জলবায়ু ও জীবকার্যের সমন্বিত প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে, সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়ে অবস্থাভেদে বর্তমান রূপ লাভ করেছে এবং যেখানে গাছ জন্মায়। এসব সংজ্ঞার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে যে মাটির প্রধান ৪টি গঠন দ্রব্যের পরিমাণ। বায়ু ও পানি ৫০%, খনিজ দ্রব্য ৪৫% ও জৈব পদার্থ ৫% (চিএ-১ দ্রষ্টব্য)। মাটিকে আয়তন ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে এই পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে আমাদের সকল ল্যাবরেটরিতে মাটি বিশ্লেষণ করা হয় ওজনভিত্তিতে। যার ফলাফল ভিত্তি হলো বায়ু ও পানি ২২%, খনিজ দ্রব্য ৭৫% ও জৈব পদার্থ ৩% (চিএ-২ দ্রষ্টব্য)। ওজন ভিত্তিতে জৈবকার্বন নির্ধারণ করে তাকে জৈব পদার্থে রূপান্তর করা হয়। অতএব জৈব কার্বন ৫% এর স্থলে ৩% হতে পারে। প্রকৃত পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে যা বলা হয়- বাংলাদেশের মাটি এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উর্বর ও উৎপাদনশীল। তবে এই বিষয়টি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাই একাডেমিক ও মাঠ পর্যায়ে মাটি, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতার বিষয়গুলো পুনরায় একটু স্মরণ করা যেতে পারে।
মাটির উৎপাদন ক্ষমতা
নির্দিষ্ট কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি জলবায়ুতে চাষকৃত মাটির উর্বরতাভিত্তিক নির্দিষ্ট ফসলের ফলন মাত্রাকে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা (টন/হে/বছর) বলে। মাটির উৎপাদনক্ষমতা একটি অর্জিত গুণ। মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া, ফসল প্রযুক্তি, সার-সেচ, বালাই মুক্ততা ও কৃষি জলবায়ু সহযোগে মাটিতে ফসলের উচ্চফলন দিতে পারে তাদের সমন্বয়ে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারিত হয় (চিত্র-৩ দ্রষ্টব্য)। উর্বরতা, জলবায়ু, বালাইমুক্ততা, চাষ পদ্ধতি সমন্বয়ে প্রাপ্ত ফলন দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ফসল পরিচর্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফসল চাষদ্বারা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো যায়। ফসলের উৎপাদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়। উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে সার, ফসল পর্যায় ও বালাই দমন অন্তর্ভুক্ত থাকে। মাটির উৎপাদন ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক হলো মাটির উর্বরতা। উৎপাদনশীল মাটিকে অবশ্যই উর্বর হতে হবে।
মাটির উর্বরতা : যে মাটিতে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় সুষম পুষ্টি উপাদান থাকে তাকে উর্বর মাটি বলে। এটি একটি প্রাকৃতিক মৌলিক গুণ। পুষ্টির পরিমাণ ও সুষমতার ভিত্তিতে উর্বরতা প্রকাশ করা হয়। সকল উর্বর মাটি সমভাবে উৎপাদনশীল নাও হতে পারে। মৃত্তিকা পরিচর্যা দ্বারা উর্বরতা বাড়ানো যায়। মাটিতে পুষ্টির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে উর্বরতা জানা যায়। ঋতুভেদে তেমন পরিবর্তন হয় না। অম্লমান ও জৈবসার মাটির উর্বরতার প্রধান উপাদান।
মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা : উৎপাদনশীল মাটিকে প্রাথমিকভাবে উর্বর হতে হবে। বেশি উর্বর মাটি ফসলভেদে বেশি উৎপাদনশীল হতে পারে। সঠিকভাবে জমির উপযোগিতা ও আবহাওয়া বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করে উপযুক্ত ফসল পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। সুষম সার ও শুষ্ক এলাকায় পানি সেচ-নিকাশ করে অনুৎপাদনশীল মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। ফসলের উপযোগী জলবায়ুর উপস্থিতিতে উর্বর মাটি উৎপাদনশীল হয়ে থাকে। জমির ফসলের রোগ ও পোকা দমন, আগাছা দমন, গাছের গোড়া আলগা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, প্রভৃতি ফসলের ফলন বাড়ায়।
জাতীয়ভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মাটি, মাটির উর্বরতা ও সে মোতাবেক উৎপাদন ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে অন্তত কেপিইটির ১৩টি উপাদান বিবেচনা করা হয়। জমি, মাটি, কৃষি জলবায়ু ও হাইড্রোলজির এসব উপাদানের তথ্য সমন্বয় করে দেশে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল (এইজেড) ও ৮৯টি উপ-অঞ্চল গঠন করা হয়েছে (চিত্র-৪ দ্রষ্টব্য)। সারা দেশের কৃষিতে এইজেড ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, তবে তা আরো জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। দেশে পরিবেশ রক্ষা করে স্থায়ীভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রণয়নে কৃষি পরিবেশ অঞ্চল তথ্য ব্যবহার করা প্রয়োজন। দেশের মাটি, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। তবে উন্নয়নের স্থায়িত্ব রক্ষার্থে দেশে বিশ্বের সকল দেশের অনুরূপ সয়েল কনজারভেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন ও প্রতিপালন অত্যাবশ্যক।
লেখক : হাজী মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৯৮৮৮০২২৫৩, ই-মেইল :sadrulamin@gmail.com
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও অধিক ফলনের জন্য সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনা
ড. মসউদ ইকবাল১ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন২
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ জনগণ গ্রামে বাস করে এবং ৪৭.৫ শতাংশ জনশক্তি কৃষি কাজের সাথে সরাসরি জড়িত (বিএফএস ২০২০) ধান হলো এ দেশের ১৬.৮২ মিলিয়ন মানুষের প্রধান খাদ্য (অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১)। এ দেশের কৃষি জলবায়ু সারা বছরই ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ধান চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ও উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। এ দেশের মোট আবাদি জমির ৮২ শতাংশ জমিতেই ধানের আবাদ হয়ে থাকে। দেশের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশে প্রতি বছর ২ মিলিয়ন হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে এ দেশের জনসংখ্যা হবে ২৩৮ মিলিয়ন (রাইস ভিশন ২০১৫)। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে এবং এসব ধানের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ চাষযোগ্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম (রাইস ভিশন ২০১৫)। উচ্চফলনশীল ধানের জাতসমূহের ফলন আশানুরূপ রাখার জন্য বিভিন্ন অজৈব সার যেমন: ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অজৈব সারের পাশাপাশি বিভিন্ন কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে মাটির স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আসছে ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছেÑ লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি। মাটি লবণাক্ত ফসল উৎপাদনের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের লবণাক্তের মাত্রা বেশি দেখা যায় মূলত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি অঞ্চলে। এগুলো কৃষি পরিবেশ অঞ্চল ১৩এর আওতাভুক্ত। এসব অঞ্চলে ধান চাষের জন্য আমন মৌসুমে বিঘা প্রতি ২৬ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১৪ কেজি এমওপি, ৩ কেজি জিমসাম, ৩৫০ গ্রাম জিংক সালফেট বোরো মৌসুমে ৫২ কেজি ইউরিয়া, ১৬ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি এমওপি, ৩৩ কেজি জিপসাম, ১ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয় (ঋজএ, ২০১৮)। পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা বজায় রাখার জন্য সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।
সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনা
মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এককভাবে অজৈব সার অথবা জৈবসার ব্যবহারের পরিবর্তে সুষম মাত্রায় অজৈব সারের সাথে যথোপযুক্ত পরিমাণ জৈবসার ব্যবহার করাকে সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনা বুঝায়। সুষম উপায়ে সার ব্যবহার না করার ফলে মাটিতে নতুন নতুন পুষ্টি উপাদানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনায় অজৈব সারের সঙ্গে পচা গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, খামারজাত সার, খড়, সবুজসার (ধৈঞ্চা), বাদামি সার (মুগ ডালের গাছ), বায়োফার্টিলাইজার (অ্যাজোলা) ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এ দেশের কৃষকরা ধানের খড় পশুখাদ্য, বিভিন্ন শিল্প কারখানার উৎপাদিত পণ্যের বাহক হিসেবে ব্যবহার করে, এ ছাড়াও গোবর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো যায়; মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ এবং মাটিস্থ উপকারী জীবাণুর কর্মক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়; মাটিতে অজৈব সারের ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে সুষম সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণের উপরে শস্যের ফলন অনেকখানি নির্ভর করে। মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকলে মাটি সরস ও উর্বর হয়। ইহা মাটির গঠন, পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও গাছের খাদ্য উপাদান চুয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখে।
ধান উৎপাদনে সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা
মাটিতে গাছের খাদ্যোপাদান কম-বেশি মজুদ থাকে। কোন জমিতে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যোপাদান জমা থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর সার প্রয়োগ না করে ফসল উৎপাদনের ফলে সে জমিতে একসময় ফলন লক্ষণীয়ভাবে কমতে থাকে। মাটি পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী রাসায়নিক সার জমিতে প্রয়োগ করে ধানের ফলন বাড়ানো যেতে পারে। তবে ৫০ ভাগ অজৈব সারের সাথে যদি ২টন/হে: গোবর সার এবং ১ টন/হে: ছাই প্রয়োগ করা যায় সে ক্ষেত্রে ধানের ফলন বৃদ্ধির সাথে সাথে জমির উর্বরতা রক্ষা করা যায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ১২ বছর দীর্ঘ একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে বছরে দুটি অথবা তিনটি ফসল আবাদে ৫০ ভাগ অজৈব সারের সাথে ২টন/হে: গোবর সার এবং ১ টন/হে: ছাই প্রয়োগ করা আর এককভাবে মাটি পরীক্ষাভিত্তিক ১০০ ভাগ অজৈব সার প্রয়োগ করা প্লট সমান পরিমাণ ফলন পাওয়া গেছে। অধিকন্তু যে প্লটে অজৈব সারের সাথে জৈবসার প্রয়োগ করা হয়েছিল তার মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। সারণী-১ এ ফলাফল দ্রষ্টব্য।
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য সাধারণত গোবর, খড় ও সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা ব্যবহৃত হয়। হেক্টরপ্রতি ৫টন শুকনো খড়, গোবর বা ৪৫ দিনের ধৈঞ্চা গাছ আমন মৌসুমে প্রয়োগ করা হলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের চেয়ে ধানের ফলন বেশি পাওয়া যায়। আমন মৌসুমে হেক্টরপ্রতি একবার ৫ টন ধৈঞ্চা ও ৬০ কেজি নাইট্রোজেন সার এবং বোরো মৌসুমে মাত্র ৮০ কেজি নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে আমন ও বোরো মৌসুমে মিলে মোট ১১ টন ধান উৎপাদন সম্ভব।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে, যদি ২ টন মুরগির বিষ্ঠা মাটিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ধান চাষে প্রচলিত নিয়মমাফিক যে সার ব্যবহার করা হয় তার শতকরা ৫০ ভাগ নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম এবং পুরো মাত্রায় ফসফরাস ও সালফারের চাহিদা পূরণ হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, বোরো মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ২ টন বিষ্ঠা দিলে ৮০ কেজি নাইট্রোজেন (১৭৬ কেজি ইউরিয়া) সারের সমান কাজ করে (চিত্র দ্রষ্টব্য)। আবার ২ টন মুরগির বিষ্ঠার সাথে ৮৮ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়। আমন মৌসুমের পূর্বে মুরগির বিষ্ঠা দেওয়া জমিতে শুধু ৮৮ কেজি ইউরিয়া সার দিয়েও সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে।
পরিশেষে বলা যায় সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনা শুধু জমির উর্বরতা সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করে না, সাথে সাথে ধানের ফলন বৃদ্ধি করে থাকে। এ দেশের কৃষি জমিতে বিশেষ করে ধানী জমিতে প্রতি বছর রাসায়নিক সারের সাথে অন্তত একবার করে সহজলভ্য জৈব পদার্থ প্রয়োগ করা উচিত। বাংলাদেশ সরকার এ ক্ষেত্রে জৈবসার উৎপাদনে আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করতে পারে। সবশেষে বলা যায় মাটির উর্বরতা রক্ষা করে টেকসই ফলন পাওয়ার জন্য সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক : ১সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, ২ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৮২৮৩০৮৫৩০, ই-মেইল : ংসসড়সরহ৮০@মসধরষ.পড়স
আপডেট চলমান
লবণাক্ততা রোধ করে মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ
প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন সুমন১ এ.বি.এম মাসুদ হাসান২
বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৭,৯৬,৮৯২ হেক্টর। বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনে মাটির অবক্ষয়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কৃষি জমির অবক্ষয়ের অন্যতম একটি উপাদান মাটির লবণাক্ততা। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এ দেশের মোট উপকূলীয় জমির পরিমাণ ২৮.৬ লক্ষ হেক্টর। তার মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ত কবলিত জমির পরিমাণ ১০.৫৬ লক্ষ হেক্টর।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় মাটির লবণাক্ততা শুরু হয় মোটামুটি ডিসেম্বর মাস হতে এবং বেড়ে আস্তে আস্তে মে-জুন মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হবার আগ পর্যন্ত লবণাক্ততা বেড়ে চলে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হলে মাটির লবণাক্ততা কমতে শুরু করে। তাই বলা চলে, এই এলাকায় বর্ষা মৌসুমে (খরিফ-২) যখন মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা থাকে না তখন একটি মাত্র ফসল রোপা আমন চাষ হয়। শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে এই এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। এ এলাকায় প্রধান ফসলধারা হলো রোপা আমন-পতিত-পতিত। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনাবাদি মৌসুমি পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা বড় চ্যালেঞ্জ।
মাটি ও পানিতে সোডিয়াম (ঘধ+), ক্যালসিয়াম (ঈধ২+) ও ম্যাগনেসিয়াম (গম২+) ক্যাটায়ন এবং সালফেট (ঝঙ৪২-), বাইকার্বোনেট (ঐঈঙ৩-) ও ক্লোরিন (ঈষ-) অ্যানায়নের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিকে মাটি বা পানির লবণাক্ততা বলে। যদি মাটিতে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ ২ ডেসিসিমেন/মিটারের বেশি হয় তখন তাকে লবণাক্ত মাটি বলে। অন্যদিকে পানিতে যদি ০.৭৫ ডেসিসিমেন/মিটারের বেশি থাকে তখন তাকে লবণাক্ত পানি বলে। মাটির লবণাক্ততার শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ফসলের ওপর প্রভাব সারণি-১ এবং সেচ উপযোগিতা অনুসারে পানির লবণাক্ততার শ্রেণিবিভাগ সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
বাংলাদেশের লবণাক্ততা কবলিত এলাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৩ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮,৩৩,৪৫০ হেক্টর। যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ সালে ১০,২০,৭৫০ হেক্টর এবং ২০০৯ সালে ১০,৫৬,২৬০ হেক্টর হয়। লবণাক্ততার প্রধান কারণগুলো হলো- উজান হতে বয়ে আসা পানির স্বল্পতা; স্লুইসগেট ও পোল্ডার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি; অরক্ষিত এলাকায় নিয়মিত লবণযুক্ত জোয়ারের পানি প্রবেশ; চিংড়ি চাষের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে লবণযুক্ত পানির প্রবেশ; অনিয়মিত বৃষ্টিপাত; ভূপৃষ্ঠস্থ মিষ্টি পানির অভাব; অনেক নিচে ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানির অবস্থান; মাটিতে আর্দ্রতার অভাব; কৈশিক রন্ধ (মাটির ফাটল/ছিদ্র) দিয়ে লবণ পানির মাটির উপরিস্তরে উঠে আসা; পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ।
আমাদের সার্বিক কৃষি উন্নয়নে লবণাক্ত মৌসুমি পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনার জন্য উচ্চপর্যায় থেকে স্থানীয়পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে ল্যান্ড জোনিং আইন প্রণয়ন করে কৃষি জমি, চিংড়ি চাষের জমি, বনাঞ্চল, বসতবাড়ি, নগর, বাণিজ্যিক এলাকা ইত্যাদি বিভিন্ন অংশে ভাগ করে জমি ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। একইসাথে উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন রকম ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। বৃহৎ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে এই লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা করতে হবে। বৃহৎ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে- প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ স্থাপন, বাঁধের মধ্যে স্লুইস গেইট স্থাপন এবং স্লুইস গেটগুলো নিয়মিত পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। ক্ষুদ্র পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বলতে লবণাক্ততা মাটির ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কৌশলকে বুঝায়। লবণাক্ততা মাটির ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো হলো-
মাদা (ঢ়রঃ) পদ্ধতি : শুষ্ক মৌসুমে পানি কম গ্রহণকারী মাদা ফসল চাষ করতে হবে। ভালভাবে চাষকৃত জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে ৩০-৫০ সেমি. ব্যাসার্ধে মাদা করে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা হয়। পরে সমস্ত জমি নাড়া বা খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাদায় এভাবে তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া, শসা, করলা ইত্যাদি চাষ করা যায়। শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত এলাকায় মাদায় ফসল জন্মানোর মাধ্যমে একদিকে যেমন মিষ্টি পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয় অন্যদিকে মাটির লবণাক্ততা কমানো সম্ভব হয়।
মালচিং ও দ্বিস্তর মালচ পদ্ধতি : মাদা তৈরির সময় প্রথমে কর্ষণ তলের ওপর পর্যন্ত মাটি সরিয়ে পাশে রাখতে হবে। অতঃপর কর্ষণ তলের উপরে মালচ (যেমন-ধানের খড়, ধানের চিটা, শুকনো কচুরিপানা ইত্যাদি) প্রয়োগ করে পাশে রাখা মাটি দিয়ে মাদা ভরাট করে মাটির উপরে আবার মালচে প্রয়োগ করতে হবে। এইভাবে দ্বিস্তর মালচের মাদা প্রস্তুত হবে। মাটির উপরের মালচ হিসাবে যদি ধানের চিটা প্রয়োগ করা হয় তবে এই মাদাতেই মাদা ফসলের বীজ বপন করা যাবে। আর মাটির উপরে ধানের চিটা ছাড়া অন্য মালচ প্রয়োগ করতে চাইলে আগে বীজ বপন করতে হবে এবং চারা গজানোর ১০-১৫ দিন পরে মাটির ওপরে মালচ্ প্রয়োগ করতে হবে। লবণাক্ত এলাকার মাটিতে দ্বিস্তর মালচ্ প্রয়োগ করা হলে মাটির নিচের স্তর থেকে লবণযুক্ত পানি কৌশিক রন্ধ্র্র (মাটির ফাটল/ছিদ্র) দিয়ে উপরে আসতে প্রথমে নিচের স্তরের মালচ এবং পরে উপরের মালচ বাধা প্রদান করে। অধিকন্তু মাদায় ‘জো’ অবস্থা বজায় থাকার কারণে মাটির উপরে বাষ্পীভবনজনিত লবণ জমা হ্রাস পায়। মাদা ফসল যেমন-মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, বাঙ্গী, উচ্ছে, ঝিঙা, খিরা ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য এই প্রযুক্তি উপযোগী।
রিজ (জরফমব) এবং ফারো (ঋঁৎৎড়)ি পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন : যেসব এলাকায় জোয়ার অথবা হঠাৎ বৃষ্টিজনিত কারণে প্লাবিত হয়ে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেইসব জমিতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে ১৫-২০ সেমি. মাটি উঁচু করে ৫০ সেমি. প্রশস্ত রিজ (লম্বা বেড) প্রস্তুত করতে হবে। একটি আদর্শ বেডের দৈর্ঘ্য ৫-৬ মিটার। দুই বেডের মাঝে ৫০ সেমি. ফারো (ঋঁৎৎড়)ি/সমতল ভূমি রাখতে হবে। রিং বেড প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ১৫-২০ সেমি. মাটি উঁচু করে ৫০ সেমি. ব্যাসের মাদা প্রস্তুত করতে হবে। একটি রিং বেড থেকে আরেকটি রিং বেডের দূরত্ব ফসল ভেদে ১.২৫-২.০ মিটার হবে। দুই রিং বেডের মাঝের জমি সমতল রাখতে হবে। অতঃপর প্রস্তুতকৃত রিজের উপর ফসলের বীজ বপন করতে হবে। লবণাক্ত এলাকায় রিজ এবং ফারো প্রযুক্তি মাটির নিচের স্তর থেকে লবণযুক্ত পানি কৌশিক রন্ধ্র দিয়ে উপরে আসতে বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে পতিত জমিতে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে লবণাক্ততার মাত্রা কমিয়ে রেখে অনেক জমি ফসল চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সর্জন (ঝধৎলধহ) পদ্ধতির প্রচলন করা : লবণাক্ত এলাকার নিচু জমিতে সর্জন পদ্ধতি অবলম্বন করে বিভিন্ন সবজি ফসলের চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে ৪-৫ হাত চওড়া ও ৪-৫ হাত গভীর করে মাটি কেটে পাশে ৪-৫ হাত চওড়া জায়গায় রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে ৪-৫ হাত গভীর গর্ত এবং ৪-৫ হাত চওড়া উঁচু বেড তৈরি হয়। আর বেডের দৈর্ঘ্য ইচ্ছামত কম বা বেশি করা যায়। সর্জন পদ্ধতিতে বেডের ওপর লবণাক্ততার মাত্রা কম থাকে। ফলে এই পদ্ধতিতে গর্তে বর্ষাকালের মিষ্টি পানি (অলবণাক্ত পানি) সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে বেডের ওপর সহজে সবজি জাতীয় ফসল চাষ করা সম্ভব।
সংরক্ষিত অলবণাক্ত পানির ব্যবহার : বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি (অলবণাক্ত পানি) পুকুর/খাল/কুনিতে সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়াও রয়েছে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন, কলস সেচ পদ্ধতিতে চাষ, জৈবসার বেশি পরিমাণে প্রয়োগ করা, লবণ সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত নির্বাচন করে চাষ করতে হবে।
উল্লেখিতভাবে লবণাক্ততা রোধের মাধ্যমে লবণাক্ত এলাকায় ফসলের নিবিড়তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। য়
লেখক : মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। মোবাইল : ১৭১৮৩৮৬১৬১, ই-মেইল: যধনরনংড়.নফ@মসধরষ.পড়স
আপডেট চলমান
লবণাক্ততা ও কৃষি
ড. সুরজিত সাহা রায়
মাটি হচ্ছে একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের অসচেতনতার কারণে জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিশ^ মৃত্তিকা দিবস ২০২১ উদ্যাপন হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্যÑ লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের কৃষির চ্যালেঞ্জগুলো হলো- বন্যা, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, পাহাড়ি ঢল, অম্ল ও ক্ষারীয় মাটি, উপকূলীয় অঞ্চল, জোয়ারভাটা, লবণাক্ততা, ভূমিক্ষয়, জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া ইত্যাদি। দেশটি জনসংখ্যার চাপ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দুই লাখ কৃষক বাস্তুহারা হবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূল অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বেড়ে ধান চাষের অনুপযোগী হলে কৃষক এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বিশ^ব্যাংকের গবেষণাতেও। ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি নদীর পানি। নদীগুলো হলো- সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ; খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা; বাগেরহাট জেলার মংলা এবং পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা। এসব থানায় এখন ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে কোন কোন স্থানে তা ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে। এভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য। খাবার পানি, সেচের পানির সংকট দেখা দিবে, মারা যাবে স্বাদু পানির মাছ, চিংড়ি প্রজাতির বৈচিত্র্যে আসবে পরিবর্তন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মৎস্যজীবীসহ সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাঁধ ভেঙে বা বাঁধ উপচিয়ে লবণ পানি কৃষি জমিতে ঢুকে পড়ে কৃষি জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত করছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লক্ষ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লক্ষ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। ফলে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঐ সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫-৩০ ডিএস/মি পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। খালে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে ফসল চাষের জন্য স্বাদু পানির সংকট দেখা দেয় এবং পাশাপাশি সেচ নিষ্কাশনে সমস্যা হওয়ায় মাটির ‘জো’ আসতে দেরি হয়। ফলে শুকনো মৌসুমে এ এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। কোন কোন এলাকায় সীমিত আকারে তিল বা মুগডালের চাষ হয়। আবার দেরিতে পানি অপসারণের কারণে সময়মতো তিল বা ডালের বপন সম্ভব হয় না। দেরিতে তিল বা ডাল বপন করলে পাকার আগেই বর্ষার পানিতে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া লবণমুক্ত পানির অভাবে আমন ধানের পরে বোরো ধান চাষও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
লবণাক্ত অঞ্চলের মাটি কর্দমাক্ত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে মাটি শক্ত হয়ে যায়। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে শক্ত মাটির অভেদ্য স্তর (Plow pan) ভেঙে দিয়ে সেচ প্রয়োগ করলে মাটির উপরের স্তরের লবণ নিচের স্তরে জমা হয়। কাদা মাটিতে বালু মিশিয়ে মাটির গঠন পরিবর্তন করে লবণাক্ততা কমানো যায়। পর্যাপ্ত সেচ ও মালচিং করে উপরের স্তর ভেঙে দিলে লবণাক্ততা হ্রাস পায়। জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য বাঁধগুলো উঁচু ও মজবুত করতে হবে। খালে ড্রেজিং করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।
মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ৩টি প্রযুক্তি যেমন- কলস সেচ পদ্ধতি, খামার পুকুর পদ্ধতি ও দুই স্তর মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমে লবণাক্ত জমিতে ফসল আবাদ করা যায়। কলস সেচ প্রযুক্তি শুধু মাদা ফসল যেমন- কুমড়া, তরমুজ, উচ্ছে, ঝিঙা ইত্যাদির জন্য উপযোগী। সাধারণ আকারের মাটির কলসের নিচে ড্রিল মেশিন দিয়ে বল পয়েন্ট কলমের আকারে ছিদ্র করে ঐ ছিদ্রে দেড়-দুই হাত পাট শক্ত করে প্রবেশ করাতে হবে। পাটযুক্ত কলসি মাদার মাঝখানে এমনভাবে বসাতে হবে যেন ছিদ্রগুলো ও পাটের আঁশ মাটির নিচে থাকে। কলসের চারপাশে ৩-৪টি বীজ বপন করে কলসে পানি দিলে মাদা সবসময় ভেজা থাকবে, এতে লবণ উপরে উঠবে না। এভাবে ২.০-২.৫ ডিএস/এম পর্যন্ত লবণাক্ততা কমিয়ে আনা যায়।
খামার-পুকুর প্রযুক্তিতে একটি জমির অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে পাঁচ ভাগের একভাগ জমিতে মোটামুটি ৬-৭ হাত গভীরভাবে ১টি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। পুকুরের চারদিকে বাঁধ দিয়ে পানির আগমন ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাঁধের উচ্চতা দুই থেকে আড়াই হাত ও প্রস্থ তিন থেকে চার হাত হবে। ফলে পুকুরে মাছ চাষ করা যাবে এবং শুকনা মৌসুমে জমিতে সেচ দেয়া যাবে। জমির অতিরিক্ত পানি পুকুরে জমা হয়ে নিষ্কাশনে সুবিধা হবে।
দুই স্তর মালচিং পদ্ধতি স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব। কর্ষণ স্তরের নিচে ধানের খড় দিয়ে মালচ স্থাপন করতে হবে এবং উপরিভাগে সুষম সারমিশ্রিত মাটি দিতে হবে। এর উপরে সবজির চারা বা বীজ বপন বা রোপণ করে গাছপালার চারদিকে ধানের খড় দিয়ে মালচ স্থাপন করতে হবে। দুই স্তর মালচিং লবণের ঊর্ধ্বাভিমুখী আগমন প্রতিরোধ করে এবং উপরের স্তর গাছের শিকড় অঞ্চলের আর্দ্রতা সংরক্ষণ করে। এভাবে মাটির সার্বিক লবণাক্ততা কিছু অংশে কমে যায়।
দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকগণ লবণাক্ত ও সেচের পানির অভাবকে মোকাবিলা করেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য নিবিড়তায় পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটি যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। এসব এলাকার কৃষকগণ লবণাক্ততা সহনশীল উচ্চফলনশীল ধান, গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী, আলু, রসুন চাষ করছে। ঘেরে অসময়ে তরমুজ, শিমসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ করছে। ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদন ও সর্জন পদ্ধতিতে আমড়া, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো আবাদ করে কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত আবিষ্কার করেছে। এসব জাত দক্ষিণাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ব্রি ধান৬৭ জাতটি বোরো মৌসুমে ৮-১০ ডিএস/এম লবণাক্ততা সহ্য করে হেক্টরপ্রতি ৭ টন ফলন দিতে সক্ষম। ব্রি ধান৯৭ ও ব্রি ধান৯৯ ১৪-১৫ ডিএস/এম লবণাক্ততায় ভালো ফলন দিতে সক্ষম। এ ছাড়া বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ বেশ আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় জাত।
লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ, উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের তথা লবণাক্ত এলাকার কৃষি অনেকটাই এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
লেখক : প্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১৯৬৯৩১৮, ই-মেইল : surajitais@gmail.com
লবণাক্তপ্রবণ এলাকায় প্রাণিখাদ্যে ও দুগ্ধ উৎপাদনে নোনা সাপনা ঘাসের চাষপ্রযুক্তি
কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমান
প্রতি বছরের মতো এবারও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২১ উদযাপন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি।’ পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথাযথ। দেশের মোট ১২টি জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী জমির পরিমাণ প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর। এসব এলাকায় কৃষকের প্রাণিসম্পদ ও জীবিকায়নের উপর জমির লবণাক্ততার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উপকূলবর্তী জমিগুলোর মাটিতে লবণাক্ততা তৈরি এক দিনে হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময়ে সুপার সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির কারণে উপকূলবর্তী আবাদি জমিগুলো লবণাক্ততায় পরিণত হয়। অনেক সময় এসব জমি লবণাক্ত পানি দ্বারা জলাবদ্ধ থাকে। লবণাক্ততার কারণে প্রাণিসম্পদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সবুজ ঘাসের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। পতিত জমিগুলো লবণাক্ততার কারণে ঘাস উৎপাদন কমে যায়, সুুপেয় পানির অভাব হয়। এসব কারণে গো খাদ্যের সংকট তৈরি হয় যা, প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও পুনঃ উৎপাদন বৈশিষ্ট্যগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ঘাস চাষের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভী পালন করা সম্ভব। এসব অঞ্চল, বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ধানের জমি ও চারণ ভূমি শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে এবং ঘাসের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিসিডিবি লবণাক্তসহনশীল দেশীয় ঘাস চিহ্নিতকরণ ও চাষ প্রণালী বিষয়ক গবেষণা সম্পন্ন করেছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের স্যালাইন প্রবণ সাতক্ষীরা জেলার অধীনে গবাদিপ্রাণির সংখ্যা, দুধ উৎপাদন, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ঘাস চিহ্নিতকরণ এবং এর ঋতুভিত্তিক প্রাপ্যতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জানতে একটি জরিপ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলের (সাতক্ষীরা) অধীনে দুটি উপজেলার তিনটি পৃথক গ্রাম নির্বাচন করা হয়েছে। যথাঃ জাউয়াখালী, শামনগর, নরারচোক, দেবহাটা এবং পূর্বপাড়া, দেবহাটা। গবেষণা চলাকালীন সেসব এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আইলার প্রবল জোয়ারে জমি তলিয়ে গিয়েছিল। আইলার সময় সাগর থেকে জোয়ারের পানি এসে মূল ভূমিকে ডুবিয়ে দেয়। ফলে মাটির লবণাক্ততা (১০-১৮ পিপিএম) বৃদ্ধি পেয়েছিল। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বেশির ভাগ ফলমূল গাছ, ফডার ও বনজ গাছ ধ্বংসের ফলে ফসল ও প্রাকৃতিক ঘাসের উৎপাদন কমে যায় যা গবাদিপ্রাণি উৎপাদন ও খামারির জীবিকায়নকে প্রভাবিত করে। অধিকন্তু, চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জমিতে লবণাক্ত পানির প্রবেশ করানোর ফলে, ফসল ও গবাদিপ্রাণির উৎপাদনের ঝুঁকি আরও বেশি তৈরি করেছে। পূর্বে কৃষকরা তাদের পতিত জমিগুলোতেও ধান কাটার পর আবাদি জমিতে প্রাণী চরাতো। কিন্তু এখন দিন দিন পতিত ও চাষযোগ্য জমি চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অবস্থার কারণে এলাকায় প্রাণিখাদ্য ও চারণ ভূমির অভাব দেখা দেয়।
দুই-তিন দশক আগে, কৃষকরা জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রাকৃতিক চারণ ভূমিতে বা পতিত জমিতে প্রাণী চরাতো এবং বাকি ছয় মাস গবাদিপ্রাণি বাসাবাড়িতে আবদ্ধভাবে পালন করত। কিন্তু এই সময়ে কৃষকরা তাদের গবাদিপ্রাণির জন্য শুধু খড় এবং তুষ সরবরাহ করে যা স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। পূর্বে এখানে প্রচুর পরিমাণে গোখাদ্য ও গবাদিপ্রাণীর জন্য প্রাকৃতিক ঘাসের আধিক্য ছিল। ক্ষেত থেকেই প্রাণি প্রয়োজনীয় খাদ্য খেয়ে খামারে ফেরত আসত। তিন দশক আগে কেউ উচ্চফলনশীল (HYV) সবুজ ঘাস চাষ করেনি, কিন্তু এখন তারা সবুজ ঘাস চাষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। আইলার আগে, এলাকায় প্রাকৃতিক সবুজ ঘাসের অভাব ছিল না। পুকুর/বিলে বিভিন্ন ধরনের দেশি ঘাস জন্মাতো। আগে এ এলাকায় ধান চাষ হলেও এখন নোনা পানির পাশাপাশি মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল চাষে আগ্রহ কমে গেছে। তাই মানুষ এই জমিতে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করছে। গবাদিপ্রাণি এই লবণাক্ত পানি খায় না। সুদূর থেকে পানি এনে খাওয়ানো হয়। এসব পরিস্থিতি গবাদিপ্রাণীর পানীয় জলের পাশাপাশি সবুজ ঘাস ও গোখাদ্যের সংকট তৈরি করেছে। অনেক দূর থেকে খাদ্য বহনও ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এসব কিছুই বদলে দিয়েছে কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী প্রচলিত জীবিকায়ন পদ্ধতি।
গবেষণায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় ঘাস যেমন : দূর্বা, তেলি সাপনা, নোনা সাপনা, খুদ গেটি/খুদ কাছড়া এবং বাকসা ইত্যাদি বছরের সবসময় পাওয়া যেত কিন্তু অধিকতর পর্যবেক্ষণ অনুসারে নোনা সাপনা, তেলি সাপনা এবং বাকসা তুলনামূলক বেশি পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক ঘাসের অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় এই তিনটি প্রাকৃতিক ঘাস এই এলাকায় বেশি উপযোগী ছিল। অনেক খামারি অধিকভাবে অভিযোজিত নোনা সাপনা ঘাস গবাদিপ্রাণির জন্য চাষ করছিল। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, মোট শুষ্ক খাদ্য গ্রহণ (কেজি/প্রাণী/দিন), দুধ উৎপাদন (লিটার/প্রাণী/দিন), মোট মিথেন নির্গমন (গ্রাম/প্রাণী/দিন) এবং প্রতি ইউনিট দুধের জন্য মিথেন উৎপাদন (গ্রাম) ছিল যথাক্রমে ৪.৪৩±০.২০, ১.৮৩±০.১১, ১৫৩.৩৫±৭.১৪ এবং ৮৭.৫৮±৫.৯৭। ২-৩ দশক আগে মোট ৯১% কৃষক দেশি জাতের গবাদিপ্রাণি পালন করত কিন্তু কৃষকদের ২৭% এখন সংকর দুগ্ধজাত গবাদিপ্রাণি পালন করছে। ২-৩ দশক আগের তুলনায় বর্তমানে ৩৭ শতাংশ প্রাণী এবং ৫৩৯ শতাংশ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান এবং ২-৩ দশক আগে প্রাণী পালের গড় আকার (প্রাণীর সংখ্যা/বসতবাড়ি) এবং দুধ উৎপাদন (কেজি/বসতবাড়ি) যথাক্রমে ছিল ৫.০২±৪.৯২ ও ৭.১১±৩.৬৩ (p=০.০৫২); ৩.২৩± ৩.১৪ ও ২০.৬৫±১১.৩৯ (p=০.০০০)। সুতরাং গবেষণায় প্রমাণিত যে, গবাদিপ্রাণি উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছিল এবং কৃষকরা প্রাণিসম্পদ প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি প্রশমন কৌশল গ্রহণ করেছিল।
লবণাক্ততা সহনশীল দেশীয় জাতের ঘাস চাষ প্রযুক্তি
দুধালো গাভীর লালন-পালনের জন্য ঘাস চাষ অপরিহার্য। কিন্তু বছরের সবসময় ও সবজায়গায় প্রয়োজনীয় ঘাসের সংকট রয়েছে। ঘাস উৎপাদন সাধারণত ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। তাই জলবায়ু উপযোগী ঘাস চাষের মাধ্যমে দেশের সকল জলবায়ু ভঙ্গুর (Climatic vulnerable) এলাকায় ঘাস চাষ সম্ভব। যার মাধ্যমে এসব এলাকায় দুগ্ধ খামার গড়ে তুলে কর্মসংস্থান ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, নোনা সাপনা, তেলি সাপনা ও বাকসা বছরের সকল সময় পাওয়া গেলেও স্থানীয় কৃষক ও খামারিদের তথ্য মতে নোনা সাপনা ঘাসটি অধিকভাবে স্থানীয় পরিবেশে অভিযোজিত (এডাপ্টেড), তাই তারা এই ঘাসটি তাদের গবাদিপ্রাণির জন্য চাষ করে থাকেন এবং মাঝে মধ্যে পার্শ্ববর্তী খামারির কাছে বিক্রিও করে থাকেন। উক্ত গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে লবণাক্ততাসহনশীল ঘাস ‘নোনা সাপনা (Panicum sp)’ চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খামারির অভিজ্ঞতা ও মাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঘাসটির চাষ প্রণালী নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
নোনা সাপনা ঘাসের বৈশিষ্ট্য : ঘাসগুলো দ্রুত বর্ধনশীল। একবার লাগালে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ঘাস উৎপাদন করা যায়। বছরের যেকোনো সময় কাটিং নেয়া যায়। তাই বছরে ৮-১০ বার ঘাস কাটা যায়। লবণাক্ত পানিতে ও পুকুর পাড়/ঘেরের আইলে ভালো হয়। আগাছা দমনের প্রয়োজন হয় না। প্রতি কাটিং এর ৪০-৬০ দিন পর আবার কাটা যায়।
চাষ প্রণালী : বছরের সকল সময় নোনা সাপনা জাতের ঘাস চাষ করা সম্ভব। তবে বর্ষার সময় এর বৃদ্ধি বেশি হয়। এ জাতের ঘাস ডাল বা মুথা থেকে হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টরের জন্য ২০-২২ হাজার ডাল বা মুথা ৪৫০ বাঁকা করে লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি মুখার বা ডালের দূরত্ব ৩০-৩৫ সেমি. এবং লাইন হতে লাইনের দূরত্ব ৬০-৭০ সেমি. হতে হবে। জমি বা ঘেরের আইলে এ জাতের ঘাস চাষ করা যায়। প্রথম চাষের পর গোবর সার প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে এবং প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ৮০০ গ্রাম, ফসফেট (TSP) ৬০০ গ্রাম এবং পটাশ (MOP) ৪০০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। জমি সম্পূর্ণ প্রস্তুতের পরে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে এবং উপরোক্ত পদ্ধতিতে লাগাতে হবে। ঘাস লাগানোর ৫০-৬০ দিন পর প্রথম কাটিং সংগ্রহ করা যাবে। এই ভাবে প্রতি কাটিং এর ৭-১০ দিন পর সার প্রয়োগ করলে ঘাসের ফলন ভালো পাওয়া যাবে। প্রতি কাটিংয়ের ৪০-৬০ দিন পর আবার এ জাতের ঘাস কাটা যায়।
দুগ্ধ ও ঘাস উৎপাদনে খামারিরা প্রচলিত জ্ঞান এবং উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বন করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে এনেছে। উপরোক্ত পদ্ধতিতে উপকূলীয় খামারিগণ লবণাক্ততা সহনশীল জাতের নোনা সাপনা ঘাস বছরব্যাপী চাষ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে বছরব্যাপী গবাদিপ্রাণিকে কাঁচাঘাস সরবরাহের মাধ্যমে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন ৬০-৬৫% বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাছাড়া উন্নত পুষ্টির গ্রহণের মাধ্যমে, প্রাণী থেকে মিথেন নিঃসরণের হার কম হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করবে। উল্লেখিত ঘাস চাষ প্রণালী ও উৎপাদনের উপর ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। কৌলিক গবেষণার মাধ্যমে এর ফলন বৃদ্ধি করে লবণাক্ত সহনশীল দেশীয় নতুন সবুজ ঘাসের জাত উদ্ভাবিত হলে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের নতুন দিগন্ত তৈরি হবে।
লেখক : জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ, মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৯৬৯৭, ই-মেইল: smrajiurrahman@yahoo.com
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ব্যবহার করে
আগামীর খাদ্য উৎপাদন
মো. আখতারুজ্জামান
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যা রোবোটিক প্রযুক্তির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিকে বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে প্রসারিত করবে এবং স্মার্ট পর্যবেক্ষণের মধ্যে ফসলে নিখুঁত উৎপাদন কৌশলকে অনেক সহজ করে তুলবে। এ প্রযুক্তিটি সামান্য মানবিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের ডেটা থেকে রিয়েল-টাইম তথ্য পুনরুদ্ধার করে ফসল ব্যবস্থাপনাকে অনেক সহজ করে দেবে। যা মানুষের পক্ষে করা অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে গ্রহণ করার জন্য সেন্সর IoT নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং বড় তথ্যভাণ্ডার (Big Data) একত্র করে বিশ্লেষণপূর্বক নির্ভুলভাবে তা কৃষিতে প্রয়োগ করা হবে। ফলে কৃষি আবহাওয়ার তথ্য, ফসলে আগাম রোগ পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ণয় করা, মাটির পিএইচ, পুষ্টিগুণ ও আর্দ্রতা পরিমাপ করা, ফসলের পরিপক্বতার সময় নির্ণয় এবং ফসলের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এর পরে ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বর্তমানে শুরু হওয়া ডিজিটাল বিপ্লব। এটিকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবটিকে প্রচলিত উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপ্লবের বিপরীতে একটি ‘কৃষিবান্ধব’ বিপ্লব হিসেবে দেখা যেতে পারে। একই সাথে এটি অর্থনীতি, সমাজ এবং মানুষের জীবন জুড়ে বৃহত্তর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের দিকে বিশ^কে পরিচালিত করবে।
কৃষি নবজাগরণ ঘটবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত সফটওয়্যার, প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার (Pricision Agriculture), আবহাওয়ার পূর্ভাবাস এবং ডেটা এনালাইসিসসহ কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর সমন্বয় করে এটি ফসলের স্বাস্থ্য, আবহাওয়া এবং মাটির গুণমান, রোবোটিকস, স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা এবং ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন ভেলু চেইন প্ল্যাটফর্মের সকলের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে। ফলে উচ্চফলন এবং উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করবে। এ প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে নতুন এবং দক্ষ ব্যবস্থার সন্নিবেশ ঘটাবে, যা কৃষক/উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলবে। বায়ু, সৌর, বায়োমাস এবং জলতরঙ্গগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর নবায়নযোগ্য শক্তির বিকল্পগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে, তখন সেচের পানির ব্যবহার এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী অ্যাপ্লিকেশনগুলো সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধ, অভিযোজিতকরণ এবং ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমণ করে এবং মাটির ক্ষয় রোধকল্পে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি কৃষি জলবায়ুর উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
স্মার্ট ওয়াটার
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলো কৃষি ক্ষেত্রে খরার প্রভাবের কিছুটা কমিয়ে এনে পানি ব্যবহার যথাযথ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি পানি ব্যবহারে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, স্মার্ট ওয়াটার প্রযুক্তিগুলো আগামী দশকের মধ্যে সেচের পানির চাহিদা হ্রাস করতে খুবই ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট ওয়াটার প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রিমোট সেন্সিং, সেচের জন্য সৌরশক্তি, ইউএভি, মৌসুমি জলের প্রাপ্যতার পূর্বাভাস, বুদ্ধিমান সেচ এবং দূষিত পানি ট্রিটমেন্ট প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মাটির পিএইচ, মাটির ময়েশ্চার খামারের অবস্থান এবং মেঘভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেমের সাথে রিয়েল টাইমে ওয়্যারলেস সিস্টেমে সংযুক্ত থাকবে, যা ফসলের পানির চাহিদা শনাক্ত করতে এবং স্থানভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় সেচ প্রয়োগ করতে পারবে। সেন্সর মাটির আর্দ্রতা পরিস্থিতি
মূল্যায়ন এবং সিদ্ধান্ত নিতে ডাটা সরবরাহ করে এবং সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই প্রযুক্তিটি আরও সাশ্রয়ী করা যাবে।
ন্যানো প্রযুক্তি
ন্যানো প্রযুক্তি পদার্থকে পারমাণবিক বা আনবিক পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তিই ন্যানো টেকনোলজি। এটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রে পুষ্টির অপচয় হ্রাস এবং মাটি হতে ফসলের দেহে পুষ্টি পরিচালনার মাধ্যমে ফলন বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ইতোমধ্যে কিছু মাটির পুষ্টিবর্ধক পণ্য উৎপাদন, এমনকি জলের সুষ্ঠু বণ্টন, সঞ্চয় এবং জল সাশ্রয়ে এ প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সিনথেটিক বায়োলজি
সিনথেটিক বায়োলজি আসলে বায়োলজি আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সমন্বিত একটা বিষয়। এটি হলো জৈবিক সিস্টেম। কৃষি বিজ্ঞান, শিল্প-কারখানা ও পরিবেশ রক্ষায় এখন সিনথেটিক বায়োলজির ব্যবহার বেড়েছে। মূলত অণুজীব (Virus, Bacteria, Yeast) বা ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের কোষ অথবা উদ্ভিদ কোষ এখানে মূল গবেষণার বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে যেমন এদের স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিবর্তন করে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে, তেমনি আবার মানুষ, অন্য প্রাণীর বা উদ্ভিদের কার্যক্রম পরিবর্তনের জন্য এদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি পছন্দসই বৈশিষ্ট্যসহ (খরা-সহিষ্ণুতা এবং কীট-প্রতিরোধ) নতুন ফসল তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। নতুন জিন বিতরণ প্রযুক্তির বিকাশ একাধিক জিনগত বৈশিষ্ট্যসহ নতুন বীজ বা পণ্যগুলোর বিকাশ সম্ভব হবে। এটি নতুন ধরনের পরিবেশবান্ধব কীটনাশক বিকাশ করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
থ্রি-ডি প্রিন্টারের (3-D Printer) এর মাধ্যমে এসব কোডকে ডিসাইফার (Decipher) করে আবার নতুন প্রাণী বানানোর চেষ্টা চলছে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অণুজীব দ্বারা খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আসার। এ ছাড়াও প্রকৃতিবান্ধব জ্বালানি উৎপাদনের মাধ্যমে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কমিয়ে আনার। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক উৎপাদনের ফলে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে।
নবায়নযোগ্য শক্তি
খামারগুলোকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার সময় নবায়নযোগ্য শক্তি কৃষির পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে সহায়ক হবে। বর্জ্য হতে উৎপন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব হ্রাসে বড় ভূমিকা রাখবে। এটি ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ, বায়োমাস, সৌর, বায়ু, সমুদ্রের ঢেউ, তরঙ্গ এবং জলবিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত হতে পারে। ইতোমধ্যে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়োমাস, বায়ু এবং মাইক্রো হাইড্রো শক্তি, সৌর ফটো-ভোল্টাইক, সৌরতাপ এবং সৌরজল গরম করার ইনস্টলেশন।
স্বনিয়ন্ত্রিত ট্রাক্টর
স্বনিয়ন্ত্রিত ট্রাক্টরগুলো চব্বিশ ঘণ্টা মনুষ্যবিহীন কাজ করতে পারে এবং জিপিএস এবং সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজে নিজে প্রোগ্রামিং করা কাজ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম। আগামীতে কৃষক একটি স্মার্ট ফোন/ট্যাবলেট/যে কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে দূরবর্তী অবস্থান থেকে ট্রাক্টর নিরীক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। স্বনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে কৃষকরা মাটির/মাঠের সংযোগ হ্রাস করতে এবং শ্রমের ব্যয় হ্রাস করতে পারবে।
ইন্টারনেট অব থিংস
ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) বলতে যে কোনো বস্তু যা ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকে তাকে বোঝায়। ইন্টারনেট-সংযুক্ত জিনিসগুলো মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছাড়াই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এটি নেটওয়ার্ক এবং সেন্সরগুলোর একটি সত্যিকারের বিশাল বিন্যাস তৈরি করে, যা কৃষি পরিবেশে সরাসরি প্রয়োগ করে ফসলের পরিচর্যা যথাযথ করা সহজ হবে। খামারের মাটির উর্বরতা, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি, পানির প্রয়োজনীয়তা বালাইয়ের উপস্থিতিসহ করণীয় পরামর্শ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বিশে^র যে কোনো প্রান্তে বসে শুধু click করে real time picture পাওয়া সম্ভব। আবার ফসলের সংগ্রহোত্তর ও পরিবহনের পর গুণাগুণসহ সংরক্ষিত গুদামে আর্দ্রতা ও Co2 এর পরিমাণ জানা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কৃষি সরবরাহ চেইন পরিচালনায় এটি মুখ্য ভূমিকা নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
জেনেটিক্স
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে একটি জীবের জেনেটিক মেকআপ পরিবর্তন করে। কৃষি জেনেটিক্স হলো জেনেটিক পরিবর্তনের প্রভাব এবং নতুন জাত নির্বাচনের জন্য প্রাণী, ফসলে কাক্সিক্ষত এবং দরকারী বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। এটি কীট প্রতিরোধী ফসলের জাত তৈরি করতে, ফল পাকাতে বিলম্ব করতে, উন্নত পুষ্টিরমানসহ খাদ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য (জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টিস্যু কালচারসহ) ব্যবহার করা হয়।
কৃষিতে ব্লক চেইনের ব্যবহার
কৃষিতে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত খাদ্য পৌঁছাতে প্রতিটি ধাপের তথ্য একটি শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় রেকড বইয়ে (Powerful Automated Ledger) সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই ব্যবস্থায় উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের প্রতিটি পর্যায়ে artificial intelligence সমৃদ্ধ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা automated sensor I Tracking system বসানো থাকবে; যা প্রতি মুহূর্তে real time তথ্য সরবরাহ করবে। এতে একজন ভোক্তা তার খাদ্য পণ্য কেনা বা খাদ্য গ্রহণের আগে সেই পণ্যের বিস্তারিত তথ্য দেখতে পারবে। কৃষির ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের তথ্য থাকার কারণে বিশে^র যে কোনো স্থানে বসে পণ্যের উৎসের স্থান, উৎপাদন কৌশলের প্রতিটি ধাপের ছবিসহ তথ্য পাওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিসমূহ এমন একটি স্মার্ট কৃষি খামার ব্যবস্থা তৈরি করে থাকে, যা উন্নত করে তুলবে ফসলের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশল এবং কৃষিতে আনবে টেকসই পরিবর্তন।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৮১৯৭২৪৬৭০ ই-মেইল : ak.zaman@yahoo.com
দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত মাটির উৎপাদনশীলতা রক্ষায় ট্রাইকো কম্পোস্ট
কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মনি ১মোঃ গোলাম আরিফ২
কৃষির মূল মাধ্যম হলো মাটি। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উচ্চ তাপমাত্রা, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত পানি ফসলের জমিতে অনুপ্রবেশের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় ক্রমাগতভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে। এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের বেশির ভাগই মে-সেপ্টেম্বর মাসে আমন মৌসুমে হয়ে থাকে। নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না ফলে মাটির লবণাক্ততা মে মাস পর্যন্ত বাড়তে থাকে। শুকনো মৌসুমে মিষ্টি পানির অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আর এর থেকে পরিত্রাণের জন্য টেকসই কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে জৈবসার তথা ট্রাইকো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ মাটির জৈব পদার্থ এবং অণুজীবের সাথে লবণাক্ততার সম্পর্ক ঋণাত্মক। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বা অণুজীবের সংখ্যা বেশি থাকলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ে এবং কৈশিক প্রক্রিয়ায় লবণ মাটির উপরিস্তরে আসতে পারে না। তখন বীজের অঙ্কুরোদগম সহজ হয়। সহজে চারা গজানোর ফলে যে সকল জমি শুকনো মৌসুমে পতিত থাকতো তার অনেকাংশে আরেকটি ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়। এজন্য মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করে এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে টেকসই করতে ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি অতীব প্রয়োজন।
ট্রাইকো কম্পোস্ট
ট্রাইকো কম্পোস্ট হলো একটি বিশেষ জৈবসার যার মূল উপাদান ট্রাইকোডার্মা নামক এক ধরনের উপকারী ছত্রাক। গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, কচুরিপানা, কাঠের গুঁড়া, ভুট্টা ভাঙা, চিটাগুড়, নিমপাতা, মেহগনি ফল এবং ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকের অণুজীব (3x107 C.F.U) নির্দিষ্ট অনুপাতে একত্র মিশিয়ে তা বিশেষ উপায়ে হাউজে জাগ দিয়ে ৪০-৪৫ দিন রেখে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কম্পোস্ট তৈরি করা হয় তাই ট্রাইকো কম্পোস্ট।
ট্রাইকো কম্পোস্ট এর গুরুত্ব ও উপকারিতা
ট্রাইকো কম্পোস্ট অনুর্বর মাটিকে উর্বর করে এবং মাটির পুষ্টি উপাদানকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে এর উর্বরাশক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করার মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। ফলে মাটি পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়, মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়াও ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহারে ফসলের রয়েছে নানাবিধ উপকার। যেমন : ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহারে ফসলের অপুষ্টি দূর হয়, ফসলের গুণগতমান ভালো হয়। ট্রাইকো কম্পোস্ট উদ্ভিদের রোগবালাই এর উপদ্রব কমায় বা দমনে সহয়তা করে ফলে পরিপূর্ণ, পুষ্ট ও সতেজ ফসল পাওয়া যায়। ইহা মাটির গঠন ও বুনট উন্নত করে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, পানির অপচয় রোধ ও সেচ খরচ কম হওয়ার ফলে কৃষকের আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং মাটিতে অবাঞ্ছিত অজৈব পদার্থকে উদ্ভিদের খাদ্যে পরিণত করতে সহায়তা করে। ট্রাইকো কম্পোস্ট গাছের খাদ্যভান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় ১৭টি খাদ্য উপাদানের মধ্যে উদ্ভিদ মাটি থেকে ১৪টি উপাদান সংগ্রহ করে থাকে, ট্রাইকো কম্পোস্টে উক্ত ১৪টি উপাদানের সবগুলোই কমবেশি বিদ্যমান, ফলে রাসায়নিক সারের ৩০% সাশ্রয় হয় এবং চাষির উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে কমে আসে। এটি গন্ধক, দস্তা প্রভৃতির ঘাটতি পূরণ করে গাছের বৃদ্ধিকারক দ্রব্য যেমন হরমোনও সরবরাহ করে থাকে। জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের আধিক্যজনিত কোনো বিষক্রিয়া সৃষ্টি হলে ট্রাইকো কম্পোস্ট ঐ বিষাক্ততা কমাতে সাহায্য করে। ট্রাইকো কম্পোস্ট মাটির অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব মাত্রা সঠিক রাখতে সহায়তা করে।
মাটি ও ফসলের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার ফলে পরিবেশের উন্নতি ঘটে এবং বিষমুক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এটি মাটিতে বসবাসকারী উদ্ভিদের ক্ষতিকর জীবাণু যেমন-ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও নেমাটোডকে মেরে ফেলে। ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহারে লবণাক্ত জমিতে লবণাক্ততার প্রভাব কমে যায় এবং বীজের অঙ্কুরোদগম সহজ হয়। একই জমিতে বার বার ফসল উৎপাদনের কারণে জমির উপর চাপ পড়ছে, ফলে মাটির বিভিন্ন অজৈব উপাদানের পাশাপাশি ব্যাপক হারে জৈব পদার্থের ঘাটতি হচ্ছে। মাটিতে ন্যূনতম শতকরা ২-৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকতে হয়, জৈব পদার্থের উক্ত ঘাটতি পূরণে ট্রাইকো কম্পোস্ট সহায়তা করে থাকে। ফসলের উৎপাদন ও গুণগতমান বাড়িয়ে কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি
ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরির উপকরণসমূহ সারণি দ্রষ্টব্য। ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরির জন্য যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না এবং বাতাস চলাচলের সুবিধা আছে এমন ছায়াযুক্ত উঁচু স্থান বাছাই করতে হবে। উপরে একটি ছাউনি দিতে হবে। সিমেন্টের স্যানিটারি রিং বা পাকা চৌবাচ্চায় ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। এ সার তৈরির জন্য ১০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৫ ফুট প্রশস্ত ও ৪.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট হাউজ তৈরি করা যেতে পারে। সিমেন্টের স্যানিটারি রিংয়ে কম্পোস্ট তৈরির ক্ষেত্রে ২৪x২৪২৪ ইঞ্চি সাইজের নিচের দিকে ছিদ্রযুক্ত ৩টি রিং সংগ্রহ করে একদিকে ০.৫-১.০ ইঞ্চি নিচু করে ভালোভাবে বসাতে হবে যেন “লিসেট” সংগ্রহের সুবিধা হয়। কম্পোস্ট তৈরির সময় মূল উপাদানগুলো মেশানোর আগে কচুরিপানা ০.৫ ইঞ্চি সাইজে ছোট ছোট টুকরো করে এবং মেহগনি ফলগুলোকে থেঁতলে গুঁড়ো করে নিয়ে সকল উপাদানগুলোকে অবশ্যই আলাদা আলাদাভাবে পরিমাপ করতে হবে । প্রথমে হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে তার উপর কচুরিপানার স্তর বসাতে হবে। গোবর দিয়ে কচুরিপানাকে ভালোভাবে ঢেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য উপাদানসমূহ স্তরে স্তরে সাজাতে হবে। আলাদা একটি পাত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির সাথে চিটাগুড়/ঝোলাগুড় ও ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকের অণুবীজ মিশিয়ে ট্রাইকো কম্পোস্টের সমস্ত উপাদানসমূহের উপর ছিটিয়ে দিয়ে কোদালের সাহায্যে ভালোভাবে মিশ্রিত করে কাদা/পেস্টের মতো তৈরি করার পর সমান তিন ভাগে ৩টি রিং বা পাকা চৌবাচ্চায় রেখে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে এবং লিসেট সংগ্রহের জন্য রিংয়ের ছিদ্রের নিচে প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্র রাখতে হবে। স্যানিটারি রিং বা পাকা চৌবাচ্চায় ট্রাইকো কম্পোস্টের উপাদান দেয়ার পর যে রিং বা চৌবাচ্চা থেকে যতটুকু লিসেট পড়বে ৫ দিন পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর খেয়াল করে সেই পরিমাণ লিসেট একই রিং বা চৌবাচ্চায় পুনরায় ছিটিয়ে দিতে হবে। কোনক্রমেই এক রিংয়ের লিসেট অন্য রিংয়ে দেয়া যাবে না। ৫ দিন পর থেকে যতদিন পর্যন্ত লিসেট পড়বে তা ফসলে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। ২০-২৫ দিন পর কম্পোস্ট হাউজের উপাদানসমূহ ভালোভাবে উল্টিয়ে দিতে হবে। ৪৫-৫০ দিন পর হাউজ থেকে কম্পোস্ট বাহির করে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকাতে হবে। শুকানোর পর বিশেষ ধরনের চালুনির মাধ্যমে চেলে বা সরাসরি নিয়ে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার হিসেবে বস্তায় সংগ্রহ করতে হবে এবং ফসলের জমিতে ব্যবহার উপযোগী হবে।
সতর্কতা
ট্রাইকো কম্পোস্টের সকল উপাদানসমূহ একত্রে মিশ্রিত করে কাদা বা পেস্ট তৈরি করার সময় পানির পরিমাণ কোনক্রমেই বেশি দেয়া যাবে না। এজন্য ট্রাইকোডার্মা অণুবীজ এর কার্যকারিতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। লিসেট সংগ্রহের পর মোটা প্লাস্টিকের বোতল বা জারে রেখে অবশ্যই শক্ত করে মুখ আটকিয়ে রাখতে হবে।
পুষ্টিমান
ট্রাইকো কম্পোস্ট সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের মধ্যে ১৪টিই বিদ্যামান। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ১০০ গ্রাম আদর্শ ট্রাইকো কম্পোস্টে জৈবপদার্থ ২০.০%, নাইট্রোজেন ১.২%, ফসফরাস ১.৪১%, পটাশ ০.৯৩%, ক্যালসিয়াম ১.৭১%, ম্যাগনেসিয়াম ০.৪০%, সালফার ০.১-০.০৫%, কপার ০.০১%, আয়রন (লৌহ) ০.১২%, ম্যাংগানিজ ০.০২৬%, জিংক ০.০২%, বোরন ০.০১% এবং পিএইচ ৮.০০% রয়েছে। (উৎস : মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ঢাকা)।
ট্রাইকো কম্পোস্ট ও লিসেট এর প্রয়োগ মাত্রা প্রতি শতকে আলুর জন্য ৭ কেজি; সবজির জন্য ৫ কেজি; ভুট্টার জন্য ৮ কেজি; ধানের জন্য ৭ কেজি ‘লিসেট’ প্রতি ০১ লিটার পানির জন্য ৩০ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
দক্ষিণাঞ্চলের কৃষির বর্তমান বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাম্প্রতিককালে মাটির ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি। তাই ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করে কম খরচে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে এবং মাটির উৎপাদনশীলতা সংরক্ষণ করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি আধুনিক টেকসই কৃষি প্রযুক্তি।
লেখক : ১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। মোবাইল ০১৯১২১৫২৪২৪ ই-মেইল : monil1985@gmail.com 2 কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা। ই-মেইল : golamarifas@gmail.com
লবণাক্ত মাটিতে জীবন সাজাতে
আবু হেনা ইকবাল আহমেদ১
স্বাদ নষ্ট করে খাদ্যে অধিক লবণ।
মাটি লোনা হলে তাতে কমে উৎপাদন
গাছ মাছ পশুতে তা বিষক্রিয়া করে
অপূরণীয় রয়ে যায় যুগ যুগ ধরে।
লবণাক্ততায় হয় ধ্বংস উর্বরতা
কারবালা রূপ নেয় পানির খরতা।
খাদ্য বাস্তুতন্ত্র ভূমি বিনষ্ট তামাম
মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ছাড়ে প্রিয় গ্রাম।
জীবনে সাজিয়ে পুন গড়তে আবাস
উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে করা চাই চাষ।
বৃষ্টি ধরে সেচ আর মালচিং করায়
লবণাক্ত মাটি দেবে পুষ্টি পুনরায়
দেখা যাবে নুন-সহা আধুনিক ধান
ডাল তেলবীজ মাছ পশুর বাথান.. ..
মৃত্তিকা উর্বর
ড. নির্মল চন্দ্র শীল২
সৃজিলেন বিধাতা এই মাটির ভুবন।
দেখ চেয়ে এর মাঝে কত যে রতন!
শিলা, নুড়ি, পলি, বালু কর্দমের বাহার।
জল, তেল, গ্যাস, মণি, মুক্তা মানিকের আধার।
মাটি আবার নানা প্রকার রূপে গুণে বর্ণে।
বালু, পলি, কর্দম মিলে গঠিত ভিন্ন ধর্মে।
পৃথিবীর যত জীব, উদ্ভিদ আর প্রাণিকুলে।
নিবাস, আহার আর মমতা পায় মাটির কোলে।
মাটি হতে দেহ গড়ে আবার মাটিতে যায় মিশে।
পরম উদার হয়ে বিলায় বিত্ত নির্বিশে।
এসো সবে করি মাটির সযত্ন ব্যবহার।
দূষণ রুধিয়া করি মৃত্তিকা উর্বর।
নবান্ন ভোজ
হাবিবুর রহমান ভাবুক৩
নতুন ধানের সোঁদাল গন্ধে
বাতাস মাতোয়ারা
চাষার ঘরে অন্নপূর্ণা
ভরছে গোলা জালা।
নতুন আশায় ভালোবাসায়
ঝি-বৌ বাঁধে বুক
রঙিন পুঁতির মালা, কানে
সোনার দুলের সুখ!
চাষি বৌয়ের ভীষণ তাড়া
নেই তো চোখে ঘুম
ধান শালিকের নবান্ন ভোজ
তাক ধুমাধুম ধুম।
মহাজনের শুধবে দেনা
আর নেবে না সুদ
খাঁচার পাখি দানা পাবে
মাছের কুঁড়ো খুদ।
ঢেঁকিশালে নেই তো ঢেঁকি
বয়েই গেল তাতে?
কলের মিলে ধান ভানাবো
দেদার দিনে রাতে।
নাত নাতনী পোতা পুঁতনী
চড়ুইভাতি করে
চাষার মেয়ে নাইয়ার এলো
অনেক দিনের পরে!
ঘরে ঘরে পিঠা পুলি
ক্ষীর পায়েসের ধুম,
নবান্ন ভোজ জামাই মেয়ে
খুশিতে বাকবাকুম!!
লেখক : ১কৃষিবিদ। পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, কৃষি মন্ত্রণালয়। মোবাইল : ০১৬১৪৪৪৬১১১ ই-মেইল : ahiqbal.ahmed@yahoo.com, ঠিকানা: ‘কলমিলতা # ৪, এলেনবাড়ি গভ. অফিসার্স কোয়ার্টার্স, তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫। ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল :ncshil.bari@gmail.com৩উপসহকারী কৃষি অফিসার (অব:), পিসি কলেজ বাগেরহাট, মোবাইল : ০১৭৩১২৭৪৯৮৫
পৌষ মাসের কৃষি
(১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
পৌষ মাস ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীতের আগমন। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতের মাঝেও মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই এ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
বোরো ধান
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন যারা এখনও বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করেননি তাদের জন্য পরামর্শ- বীজতলায় ব্রি ধান২৮/স্বল্পমেয়াদি জাতের পরিবর্তে ব্রি ধান৮৮ এবং ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান১০০ চাষ করুন। তুলনামূলক অল্প সময়ে অধিক ফলন ঘরে তুলুন। এছাড়াও অতিরিক্ত ঠাণ্ডার সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায় এবং বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দেয়া যায়। সে সাথে প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখতে হয়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিলে সুফল পাওয়া যায়।
গম
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় এবং সেচ দিতে হয়। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো এলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে। গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে সেখান থেকে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দেয়া ভাল।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হয়।
আলু
চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে।
তুলা
তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজি নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। বিভিন্ন শাক যেমন- লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক একবার শেষ হয়ে গেলে আবার বীজ বুনে দিতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
শীতকালে পোলট্রিতে অপুষ্টি ও রোগবালাই প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি ও গবাদিপ্রাণির শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যায়, তাই মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়। এ সময় আগামী বর্ষায় রুইজাতীয় মাছকে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটাতে ইচ্ছুক চাষিগণ প্রজননক্ষম বয়ঃপ্রাপ্ত মাছ সংগ্রহ করে মজুদ পুকুরে রেখে দেয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল শুকনো মৌসুমে প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়াও যেকোনো প্রশ্নের সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা ও যে কোনো মোবাইল নাম্বার থেকে কল করতে পারেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল : editor@ais.gov.bd