Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০

কৃষিবিদ এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। কিন্তু ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি থেকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান বর্তমানে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগবালাই ছাড়াও ইঁদুর প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল এর মারাত্মক ক্ষতি করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প ২০২১ প্রণয়ন করেছেন। এ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী এই রূপকল্প বাস্তবায়নে বিশাল কর্মযজ্ঞের অন্যতম হলো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা। দেশের জিডিপিতে কৃষি   খাতের অবদান ১৪.৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের গৃহীত পরিবেশবান্ধব কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিক সাফল্যে দেশ আজ দানাশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টায় শস্যের নিবিড়তা বেড়েই চলেছে বিধায় জমিতে প্রায় সবসময় ফসল বিদ্যমান থাকে। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রয়োজন কৃষি উৎপাদনে আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে অধিক ফলন নিশ্চিত করা আর উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বালাইজনিত ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা।


ইঁদুর নামক চতুর প্রাণীটি মানুষের খাদ্যে ভাগ বসিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের অনবরত কাটাকাটির অভ্যাস বিদ্যমান। এর সদা বর্ধিষ্ণু দাঁত আছে। ক্ষয়ের মাধ্যমে দাঁতের এই বৃদ্ধিরোধ করার জন্য ইঁদুর সব সময় কাটাকাটি করে। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। এরা যা খায় তার ৪/৫ গুণ নষ্ট করে। শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপখির মধ্যে প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। ইঁদুর দ্বারা ফসলের যে ক্ষতি  হয় তা কমানো গেলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিত হবে আবার অন্যদিকে আয়ও বাড়বে।  ইঁদুরের হাত থেকে গুদামের ফসল রক্ষা এবং খাদ্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ বন্ধ করা গেলে স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগের বিস্তারও কমে যাবে। পোকামাকড়ের তুলনায় ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাত খুব কঠিন মনে হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমন করলে এদের সংখ্যা কার্যকরভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইঁদুর যে কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুক‚ল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বংশধর সৃষ্টি করতে পারে এবং প্রতিবারে ৪-১২টি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের  ৪২-৫০ দিন পরেই বাচ্চা ইঁদুর পূর্ণবয়স্ক হবার মাধ্যমে প্রজননে সক্ষমতা লাভ করে। এই দ্রুত বংশবিস্তারকারী স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ড প্রাণিটি আমাদের বিভিন্ন ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির মাঠে এবং গুদামে ক্ষতি করছে, আমাদের বাসা বাড়ির আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র এবং বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে। এর পাশাপশি বাঁধ, রেললাইন, জাহাজ, বন্দর, অফিস, মাতৃসদন, সেচের নালাসহ সর্বত্র ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। এক কথায় কোন সম্পদই ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পায় না। দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গবেষণা থেকে জানা যায় তিন মাসের জন্য ধান গুদামে রাখা হলে ৫ খেকে ১০ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। ইঁদুরের সমস্যা গ্রামের লোকজন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না, সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় কোন পদ্ধতিও পর্যাপ্ত নয়। তাই এই ক্ষতি স্বাভাবিক হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর ইঁদুর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা সঠিকভাবে বুঝে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত পাঁচ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান বাস্তবায়নের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া আমন ফসলের পরিমাণ, নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্রছাত্রী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীর সংখ্যা নিম্নে বর্ণিত হল।
সূত্র ঃ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বর্তমানে সারাবিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অমেরুদণ্ড প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০ এর উদ্দেশ্য
*কৃষক, কৃষানি, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাপনাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীগণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
*ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প কারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা।
*গভীর ও অগভীর নলক‚পের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা।
*রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
*সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপারে জোর দেয়া।

 

ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০ এর উদ্বোধন
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের দরুন প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণজনিত কারণে ইঁদুর নিধন অভিযানের জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন ৮ অক্টোবর জনসমাবেশ পরিহার করে ভার্চুয়ালভাবে সীমিত আকারে করা হবে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পোস্টার, লিফলেট, স্মরণিকা সদর দপ্তরের বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে প্রস্তুত করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় প্রেরণ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন পর্যায়ে কোন প্রকার উদ্বোধন অনুষ্ঠান, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান, র‌্যালি, আলোচনা সভা ইত্যাদি করা যাবে না।
দেশে করোনা পরিস্থিতিতে ইঁদুর নিধন অভিযান
*ভার্চুয়ালভাবে সীমিত পরিসরে মাননীয় মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের উপস্থিতিতে উদ্বোধন ঘোষণা।
*স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু প্রকাশনার কাজ যেমন বুকলেট/স্মরণিকা/পোস্টার/লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ, রেডিও/টিভিতে প্রচার প্রচারণা ইত্যাদি বাস্তবায়ন।
*জনসমাবেশ পরিহার করার জন্য ইঁদুর নিধন কর্মসূচির সকল ধরনের আনুষ্ঠানিকতা এ বছরের জন্য বন্ধ রাখা।
*এ বছর করোনাজনিত কারণে কোন পুরস্কার দেয়া হবে না।


ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইঁদুর চালাক প্রাণী এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যার কারণে রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের ফলাফল প্রায়ই ব্যর্থ হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ধারণার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মত আমাদের দেশেও পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জনপ্রিয় করা যেতে পারে। পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করলে দীর্ঘ মেয়াদে ইঁদুর দমনে অধিক সফলতা আসতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে একজোড়া প্যাঁচার চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০-৫০০০টি পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে। তাই প্যাঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালনে কৃষক  পর্যায়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগীর খামার, অফিস-আদালত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার বøকের কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এছাড়া উপজেলা ও জেলা ভিত্তিক মাউস হান্টার বা পেশাজীবী ইঁদুর নিধনকারীদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে তাদের মাধ্যমে এ অভিযানকে আরও কার্যকর করা যেতে পারে। এ কর্মসূচিতে ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে স্মরণিকায় সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলোন ও জিংক ফসফাইড গ্রæপের ইঁদুর নাশক (যেমনÑ ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, রেটক্স, জিংক ফসফাইড ইত্যাদি) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধ, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশের স্বার্থে ইঁদুরকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের সম্প্রসারণকর্মীগণ এলাকার চাষি, ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে একযোগে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে এই কর্মসূচি সফল করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১৩১২৯৫ ই-মেইল :  dppw@dae.gov.bd

 

বিস্তারিত
ইঁদুরের উপদ্রব : মৎস্যচাষে

ড. এস এম আতিকুল্লাহ

বলা হয় পরিবেশে সকল উদ্ভিদ ও প্রাণী পারস্পরিক দেয়া নেয়ার মাধ্যমে একটি জটিল এবং যুতসই খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি করে। ইঁদুর নামক প্রাণীটি তার ব্যতিক্রম। দেয়ার চেয়ে ক্ষতি করে অনেক বেশি। এটি পরিবেশবান্ধব সুবিধাজনক প্রাণী নয় বরং বিশট্লি, বদমাশ। এটি প্রাণীকুল তথা মানুষের এবং কৃষির সর্বাধিক ক্ষতি করে। প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এর বংশ বিস্তারের পথগুলো বন্ধ এবং যথাসম্ভব নিধন করা দরকার। আমার এক কৃষি বিজ্ঞানী বন্ধু এরশাদের সামরিক শাসন আমলে জনৈক সামরিক কর্মকর্তা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, বলেন তো কৃষির প্রধান সমস্যা কী? উত্তরে বললেন স্যার কৃষির প্রধান সমস্যা ইঁদুর। বলেন কী? তিনি হতবাক হলেন! স্যার, ইঁদুর যে পরিমাণ ধান খায় ও নষ্ট করে তা দ্বারা দেশের খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। তখন মৌখিক পরীক্ষা শেষে যারা বের হতো তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম কি কি প্রশ্ন করা হয়েছে? বন্ধুর এই রসাত্মক প্রশ্নোত্তর শুনে সকলেই হাসির খোরাক জুগিয়েছিলাম। বিষয়টি বাস্তব এবং প্রশ্নবোধক। পাশাপাশি, ইঁদুরের মাধ্যমে নানা রকমের মহামারী যেমন “প্লেগ”রোগ পৃথিবীতে সংক্রমিত ও বিস্তার লাভ করে। জানা যায় ভূমধ্যসাগরের উপক‚লে ইউরোপের নদী বন্দর থেকে জাহাজ এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে নোঙর করত সাথে ইঁদুরও পরিবাহিত হতো। এভাবে ইঁদুর এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে ইউরোপসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। “প্লেগ” রোগ ইঁদুরের মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছিল। পৃথিবীতে মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়েছিল যা আজও ইতিহাসকে আলোড়িত করে তাড়িয়ে বেরায় প্লেগের ভয়াবহতা। এমনকি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ না করলে পরিবেশ ও কৃষির বিশেষ ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করেছেন। প্রকৃতিতে ইঁদুর এটি ঘাতক। তাই এটির নিধন এবং পরিবেশ সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২০ যথাযথ এবং ফলপ্রসূ কর্মসূচি।


ইঁদুর কৃষি ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি সম্ভাবনাময় রুপালি মাছও  বেশ ক্ষতি করে। মাছের ঘেড়ের বিশেষ ক্ষতি করে। মাছ চাষের উত্তম সময়ে মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঘেরের চারদিকে গর্ত করে এবং গর্ত পর্যায়ক্রমে বড় হয়ে নদী-খাল বা অন্য জলাধারের সাথে সংযোগ তৈরি করে। এতে ঘেরে পানি কমে যায়, ঘেরের পাড় ভেঙে যায় এবং কৃষকের জন্য বাড়তি ঝামেলাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি ঘেরে মাছের খাদ্য খায় এবং মাছের খাদ্য নষ্ট করে। বর্ষকালে দরিদ্র কৃষক বাঁধের ধারে বিদ্যমান বড়ো-পিটে মাছ চাষ করে সাময়িক অর্থ রোজগার করে। সেখানে ইঁদুর চেলা/গর্ত তৈরি করে স্বল্পসময়ের জন্য তেলাপিয়া, পাংগাশ ও পুঁটি চাষ বিঘ্নিত করে।  


পুকুরের পাড়সমূহে গর্ত তৈরি করে। গর্ত পানির উঠানামায় বড় হতে থাকে এবং পুকুরপাড় ভেঙে যায়। পুরানো পুকুরের মাছ চাষ বেশি বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষক যাদের একমাত্র সম্বল একটি ছোট ডোবা বা পুকুর তারা ইঁদুরের নির্যাতনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে অদ্যাবিধ ইঁদুর নিধনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। এই কর্মসূচির চলমান গতানুগতিক ধারার সাথে নতুন মাত্রা যোগ করে আরও নতুন নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা বের করা দরকার। কৃষিতে ইঁদুর নিধন কর্মসূূচি একটি দীর্ঘমেয়াদি সংবেদনশীল বিষয়। এজন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যতিক্রমধর্মী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
ইঁদুরের সমস্যা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের একার নয়। এই সমস্যা কৃষি, মৎস, পশুসম্পদ,পরিবেশ, পাট ও খাদ্য ও প্রকৃতিক দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সমস্যা। তাই সকলে মিলে উপজেলাভিত্তিক সমন্বয় ও পদক্ষেপ  নেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে সরকারি গবেষণার পাশাপাশি বেসরকারি গবেষণায় মৎস্য ও পশুসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ এবং এর ব্যাপকতা নিয়ে নানা পেশার কৃষকের সমন্বয়ে গবেষণা কাজ হাতে নেয়া বিশেষ দরকার।


ইঁদুর সম্পর্কিত শেখ সাদীর একটি উপমা, ‘‘কোন দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে যদি কুকুর হয় তার প্রধান মন্ত্রদাতা, আর ইঁদুর হয় দেশের খাজাঞ্জি তবে দেশের অবস্থা কি কল্পনা করে নাও”। সুতরাং ইঁদুুরের কাছে বাংলার বিশাল শস্যভাÐার জমা রাখা ঠিক নয়। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগান্তি আনে, নতুন প্রজন্মের শিশুদের রোগাক্রান্ত করে। এ পর্যন্ত গবেষণায় দেখা যায় সমন্বিত ইঁদুর নিধন বেশ কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। সুতরাং, পাড়া প্রতিবেশী, ছাত্র, শিক্ষক, খামারি, গুদাম ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর (পাট, খাদ্য),সবাইকে সম্মিলিত ইঁদুর নিধন অভিযানে যোগ দিতে হবে, ইঁদুর নিধন করতে হবে । দেখা মাত্রই ইঁদুর ধরতে হবে এবং মারতে হবে।

এগ্রিকালচার স্পেশালিস্ট, জাতীয় ভূমি জোনিং প্রকল্প (পরিকল্পনাধীন), ভ‚মি ভবন কমপ্লেক্স, কাটাবন, ঢাকা, mdatikullah@yahoo.com,   মোবাইল : ০১৭১২ ৮৮৯৯২৭

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (আশ্বিন ১৪২৭)

প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন

কৃষিবিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।

 মো: আকবর আলী, গ্রাম: হরকাডাঙ্গা, উপজেলা: গোমস্তাপুর, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: পেঁপে গাছের পাতা ও পেঁপেতে সাদা পাউডারের মতো আবরণ পড়েছে। এখন এ সমস্যা দূরীকরণে কী করব। জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর:  পেঁপে গাছের এ ধরনের সমস্যা মিলিবাগ পোকা আক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। পরবর্তীতে শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়। এজন্য আক্রমণের শুরুতেই পোকাসহ পাতা ও পেঁপে নষ্ট করে ফেলতে হবে। তারপরও যদি আক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকে তখন আপনি এডমায়ার ২০০ এমএল ০.২৫ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার সঠিক নিয়মে স্প্রে করবেন। আশা করি আপনার উল্লেখিত পেঁপে গাছের সমস্যা দূর হবে।
মোছাঃ রোকসানা ইয়াছমীন, গ্রাম: এলাইগা,  উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: ডালিম একটু বড় হলে গায়ে দাগপড়ে ও পরে পচে যায়। আর ডালিম পাকার আগেই ঝরে পড়ে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: ছত্রাকজনিত রোগের কারণে এমনটি হয়ে থাকে। সাধারণত এ রোগটি বর্ষা কালে দেখা যায়। এ রোগের ফলে ডালিমের গায়ে হলুদ বা কালো দাগ পড়ে। এছাড়া ডালিম ফলের খোসা কুচকে যায় এবং পরবর্তীতে ডালিম ঝরে পড়ে। এ সমস্যা দূর করতে প্রতিলিটার পানিতে ১ গ্রাম কার্বেনডাজিম গ্রæপের যেমন অটোস্টিন মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ থেকে  ৪ বার ফলে ও গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই আপনি উপকার পাবেন।
মো. বদিউজ্জামান, গ্রাম: বেদের পুকুর, উপজেলা: কাহারোল, জেলা: দিনাজপুর
প্রশ্ন: করলার নিচের দিক থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে। পরে পুরো করলা নষ্ট হয়ে যায়। কী করলে উপকার পাবো?
উত্তর: এ ধরনের সমস্যা সঠিক পরাগায়ন ও ফলের মাছি পোকার আক্রমণজনিত কারণে হয়ে থাকে। এ কারণে করলার পুরুষ ফুলের মাধ্যমে হাত পরাগায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটি পুরুষ ফুল দ্বারা কয়েকটি স্ত্রী ফুলকে পরাগায়িত করতে হবে। আর গাছে খেয়াল করতে হবে ফলের মাছি পোকার আক্রমণ হচ্ছে কিনা। যদি হয়, তবে ফেরোমোন ট্র্যাপ বা বিষ ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। সাইপারমেথ্রিন ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি অবশ্যই উপকার পাবেন।
মোছাঃ শেফালী বেগম, গ্রাম: লখাইডাঙ্গা, উপজেলা: মণিরামপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন:  তেজপাতা গাছের পাতায় ছোপ ছোপ দাগপড়ে। পরবর্তীতে পুরো পাতা বাদামি হয়ে শুকিয়ে যায়। কী করবো?
উত্তর: পেস্টালোসিয়া নামক ছত্রাকের আক্রমণে এমনটি হয়ে থাকে। এ রোগের নাম পাতা ঝলসানো রোগ। এ সমস্যা দূরকরতে প্রাথমিকভাবে ঝলসানো পাতা ও ডালগুলো কেটে ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এছাড়া সুষম সার প্রয়োগ করাও প্রয়োজন। আর রোগের প্রকোপ কমানোর জন্য কার্বেনডাজিম গ্রæপের অটোস্টিন ১ গ্রাম বা প্রপিকোনাজল গ্রæপের টিল্ট ০.৫ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে ৭ থেকে ১০ দিন পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। আশা করি সুফল পাবেন।
মো. আল আমিন, গ্রাম: তাম্বুলখানা, উপজেলা: ফরিদপুর সদর, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন:  খিরাগাছের পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র ও পাতা কুঁকড়িয়ে যাচ্ছে। কী করণীয় ?
উত্তর: পাতা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র দেখা যায়। এ সমস্যা দূরীকরণে ম্যালাথিয়ন বা ফাইফানন জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিকনিয়মে স্প্রে করতে হবে। আরপাতা কোঁকড়ানো প্রতিকারে এবামেকটিন গ্রæপের যেমন ভার্টিমেক বা ওমাইট ২ মিলি  ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর ২ থেকে ৩ বার পাতাতে স্প্রে করলে কোঁকড়ানো সমস্যা দূর হবে।
রাবেয়া বেগম, গ্রাম: দৌলতপুর, উপজেলা: নড়াইল সদর, জেলা: নড়াইল
প্রশ্ন: আক্রান্ত বীজ আখ চিড়লে ভেতরে লালচে বা কালচে রং দেখা যায় এবং ঘ্রাণ নিলে পাকা আনারসের মতো গন্ধ পাওয়া যায়। সমস্যা থেকে কিভাবে রেহাই পাবো?
উত্তর: আপনার উল্লেখিত সমস্যাকে আখের পাইন আপেল রোগ বলে। আরএটি ঈবৎধঃড়পুংঃরং ঢ়ধৎধফড়ীধ ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। সমস্যারোধে রোগমুক্ত জমির অনুমোদিত বীজ আখ ব্যবহার করা দরকার। এছাড়া রোপণের পূর্বে ব্যাভিস্টিন/নোইন নামক ছত্রাকনাশক দ্রবণে ৩০ মিনিট  কালবীজ শোধন (১ ভাগ ছত্রাকনাশক ঃ ১০০০ ভাগ পানি) এবং অধিক ভিজা বা অধিক শুকনা মাটিতে ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় আখ রোপণ করা যাবে না। এসবের পাশাপাশি জমি ভাল ভাবে চাষ ও পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা সঠিক রাখাও প্রয়োজন। দ্রুত অঙ্কুরোদগম হয় এমন জাত নির্বাচন এবং অনুকূল আবহাওয়ায় আখ চাষ করাও রোগ থেকে বাঁচার উপায়। আর সব শেষে, বীজতলায় চারা তৈরি করে রোপা পদ্ধতিতে চাষ করলে আপনি উপকার পাবেন।
মৎস্য বিষয়ক
মো: আনছার আলী, গ্রাম: পিরোজপুর, উপজেলা:  দিনাজপুর সদর, জেলা: দিনাজপুর
প্রশ্ন: পুকুরে রেণুপোনা ছাড়া হয়েছে কীভাবে পরিচর্যা করবো?
উত্তর:  রেণু ছাড়ার ৫-৭ দিনের মধ্যে পুকুরে চট/গুজরি   জালটানায়াবে না। রেণু ভেসে উঠলে পানির ঝাপটা দিতে হবে। সম্ভব হলেন তুন পানি দিতে হবে। পুকুরের পানির রঙ লালচে সবুজ এবং সেকি ডিস্কের দৃশ্য মানতা ২০-৩০ সেন্টিমিটার এর মধ্যে থাকতে হবে। যে কোন ধরনের খাদ্য অত্যন্ত মিহি হতে হবে। পুকুরে হররা সূর্য উঠার ২-৩ ঘণ্টা পর টানতে হবে। মেঘলা দিনে সার ও খাদ্য দেয়া যাবে না। কুড়া ব্যবহার করলে তুষ পরিহার করতে হবে।
মোঃ আকতার হোসেন,  গ্রাম: সনগাঁও, উপজেলা: বালিয়াডাঙ্গি, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: পাঙ্গাশ মাছের লালচে রোগ হয়েছে কি করবো?।
উত্তর: পাঙ্গাস মাছের লালচে রোগ দেখা দিলে যে সব বিষয় করণীয় তা হলো- কমপক্ষে ৫০ ভাগ পানি পরিবর্তন করে প্রতিশতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া হররা টেনে পুকুরের তলদেশের কাদার গ্যাস বের করে দিতে হবে। এসবের পাশাপাশি মাছের দেহের ওজনের হিসাবে ৫০ মিলিগ্রাম টেট্রা সাইক্লিন খাবারের সাথে  মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। আর প্রতি শতকে ১০ গ্রাম হারে পটাশ ২ বার প্রয়োগ করলে এ সমস্যা দূর হবে।    
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মোছাঃ রাহেলা খাতুন, গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: গোবিন্দগঞ্জ, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: গরুর গা খসখসে এবং ঘা হচ্ছে। এ অবস্থায় কি করণীয়?
উত্তর: ইনজেকশন ভারমিক প্রতি ২৫ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ১সিসি ১বার চামড়ার নিচে পুশ করতে হবে। যদি সমস্যাটি বেশি হয় তবে ৭ দিন পর বুস্টার ডোজ আবারও  ১ বার দিতে হবে। এছাড়া ইনজেকশন অ্যাসটাভেট ১০০ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ৫সিসি. করে দৈনিক ১ বার ৩ থেকে ৫ দিন মাংসে পুশ করতে হবে এবং ইনজেকশন অ্যামক্সিভেট ১ ভায়েল করে রোজ ১বার ৩দিন মাংসে পুশ করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনার গরুর সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
মো. জয়নালউদ্দীন, গ্রাম: লক্ষীরপাড় উপজেলা: বিশ্বম্বপুর, জেলা: সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন: হাঁস দাঁড়াতে পারছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পালকগুলো এলোমেলো হয়ে আছে এবং ঝিমাচ্ছে। কী করবো? পরামর্শ চাই।  
উত্তর: হাঁসের প্লেগ রোগ হয়েছে। এ রোগ প্রতিরোধে ৩ সপ্তাহ বা তার বেশি বয়সের সুস্থ হাঁসকে ডাকপ্লেগের ভ্যাকসিন দিতে হয়। তাহলে আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ পাওয়ার জন্য সম্ভব হলে আপনার কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে পারেন। (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষিকল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)


উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ মোবাইল: ০১৭১১১১৬০৩২, ই-মেইল :taufiquedae25@gmail.com

 

বিস্তারিত
কবিতা কৃষিকথা (আশ্বিন- ১৪২৭)

ইঁদুর নিধন অভিযান
হাবিবুর রহমান ভাবুক

ইঁদুর মারো চাষি ভাই ইঁদুর করো শেষ
ইঁদুর মুক্ত করতে হবে সবুজ বাংলাদেশ।
মেঠো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, গৃহের নেংটি ইঁদুর
ফল, ফসল, ঘরের ক্ষতি করছে কাশেম, নিধুর।
খিদের জ্বালায় নয়তো শুধু বাড়বে ছেদন দাঁত
তাই, মরার ভয়ে কাটুস কুটুস কাটছে দিবসরাত!
কাটছে কাঁথা, দলিল, পুঁথি, ইলেকট্রিকের তার
জামা, কাপড়, ধানের গোলা; সব কিছু সাবাড়।
বিয়ের রাতে টোপর টাকে রাখলো তাকে ঘ্যানা
ওমা! সকাল বেলায় টোপর কোথা? নষ্ট দাঁতে ত্যানা।
শস্যহানি নয়তো কেবল আরো বাড়ায় বেগ
দুষ্টু ইঁদুর সুস্থ দেহে ছড়ায় ব্যাধি প্লেগ।
ব্যর্থ কন্ট্রোল জানে না তো, বিধির কী খেয়াল,
প্রসব শেষে তিন দিবসে আবার গর্ভকাল!
রক্তবীজের বংশধর অসুর যে রকম
আস্ত হারামজাদা, হতভাগা র‌্যাট সে রকম।
বাঁশকল, যাঁতাকল বিষটোপ ফেলে
ইঁদুর মারুন একযোগে গর্তে পানি ঢেলে।
এক গুণ খায় আর দশ গুণ নষ্ট করে যারা
(সেই) ইঁদুর নিধন অভিযানে সক্কলে দাওসাড়া।
হ্যামিলনের বংশীবাদক গল্পে শুধু মানায়
ইঁদুর করবে দেশ ছাড়া সেই আলামত জানায়।
তোমার আমার হালাল খাদ্যে ডাকু নিশাচর
আর কতকাল ভাগ বসাবে? মার ওদের ধর।
ইঁদুর ধরো, ইঁদুর মারো সুস্থ পরিবেশ
ইঁদুর মুক্ত গড়তে হবে সোনার বাংলাদেশ।

 

ইঁদুর নিপাত
পরিমল কুমার সাহা

কাটুস কুটুস শব্দ শুনলে কেমন মনে হয়,
সামনে শাপায় কাটে ইঁদুর কোন ক্ষমা নয়।
কাঠ কাটে কাগজ কাটে, কাটে গোলার ধান,
ক্ষেতে কাটে লাউ কুমড়া সুখে ধরে গান।
গাছে উঠে নারকেল কেটে করছে পয়মাল,
দিন দুপুরে ঘরে বসে কাটে চাষির জাল।
খাদ্যভাÐার মানে হলো ইঁদুরের রাজধানী,
যত খায় বেশি নষ্ট করে আমরা সবাই জানি।
পোলট্রি শিল্পে করে ইঁদুর ব্যাপক অত্যাচার,
খামারিদের ক্ষতি বাড়ছে পোলট্রি খাচ্ছে মার।
গ্রাম শহরে সবখানে তার সমান অত্যাচার,
কেটে কুটে প্রমাণ করে দাঁতে কত ধার।
মাঠে ঘাটে মাটির গর্তে ইঁদুর করে বাস,
হাইওয়ে আর বেড়িবাঁধের করছে সর্র্বনাশ।
সারা দেশের নষ্ট করে কোটি কোটি টাকার ফসল,
গরিব কৃষক সহ্য করে ক্ষতির পুরা ধকল।
বসতবাড়ি দালান কোঠা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ,
গর্তের ভেতর পেতে রাখুন ইঁদুর মারা ফাঁদ।
ইঁদুর ছড়ায় প্লেগ জন্ডিস অনেক রকম রোগ,
সচেতন না হলে বাড়ে জন মানুষের দুর্ভোগ।
ইঁদুর ধরুন ইঁদুর মারুন ইঁদুর করুন শেষ,
সফল হবে কর্মসূচি বদলে যাবে দেশ।

* উপসহকারী কৃষি অফিসার (অবঃ), পি. সি. কলেজ বাগেরহাট, মোবাইল- ০১৭৩১-২৭৪৯৮৫২হোল্ডিং-১১৭, লোহারগেট, চেয়ারম্যানবাড়ি, বানিয়াখামার, খুলনা, মোবাইল : ০১৭৩১৩৬৬৬২৫, ই-মেইল :sahaparimaI857@gmail.com
 

বিস্তারিত
কৃষিই সমৃদ্ধি : পাটবীজ সংরক্ষণ প্রযুক্তি

কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের ৫-৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এছাড়া পাট এখন শুধু চট, বস্তা বা কার্পেট বানানোর উপরই সীমাবদ্ধ নয়। পাটের হচ্ছে এখন বহুবিধ ব্যবহার। পাট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য  উপাদান হল পর্যাপ্ত পরিমাণ উন্নতমানের বীজ। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর উৎপাদন মৌসুমে প্রায় ৫০০০ থেকে ৬০০০ মেট্রিক টন পাট ও কেনাফ বীজ দরকার হয়। এই প্রয়োজনীয় বীজের মাত্র ৮-১০% বীজ বিএডিসি সরবরাহ করে থাকে। বাকি বীজ কৃষকরা স্থানীয় বাজার বা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বা নিজেদের উদ্যোগে উৎপাদন করে থাকেন। কৃষকের উৎপাদিত বীজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক মানসম্পন্ন থাকে না। কারণ কৃষকপর্যায়ে পাট বীজ ফসল কর্তনের সঠিক কৌশল ও সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রথাগতভাবে উন্নত নয়। কাজেই কৃষক ভাইয়েরা নিজেদের উদ্যোগে যে বীজ উৎপাদন করে থাকেন তা যদি উন্নত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদিত বীজের গুণগত মান খারাপ হবে অন্যদিকে বীজের অপচয় হওয়ারও আশংকা থাকে। তাই বীজ ফসল সঠিক সময়ে কাটার পর তা উন্নত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও গুদামজাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া- বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে সহজেই অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, রোগ পোকা মাকড় ও ইঁদুর সহজেই বীজকে নষ্ট করতে পারে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বীজ ফসল নষ্ট হয়ে গেলে আপৎকালীন মজুদ হিসাবে বীজ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।


সাধারণভাবে জমিতে পাট ও কেনাফ বীজ ফসল অতিরিক্ত পাকলে বিশেষ করে তোষা ফল ফেটে বীজ ঝড়ে যায়। আর কম পাকলে বীজ চিটা হওয়ার আশংকা থাকে। তাই বীজ ফসল কাটার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফল বাদামি রং ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, জমির এক এক অংশের রসের উপর নির্ভর করে গাছের ফলের পাকার সময়ও ভিন্ন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে দু’বার ফসল সংগ্রহ করলে সকল বীজই ভাল পাওয়া যায়। পাকা ফলসহ গাছ কাটার জন্য শুকনা দিন বেছে নিতে হবে। বৃষ্টি ভেজা দিনে পাকা ফলসহ গাছ না কাটাই উত্তম। বীজ ফসল কর্তনের সময় জমিতে মরা ও শুকনা গাছগুলো বাদ রেখে বীজ ফসল সংগ্রহ করতে হবে। মরা ও রোগাক্রান্ত গাছ একই সাথে কর্তন করলে সমস্ত বীজ রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। বীজ ফসলের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বীজ সংরক্ষণের পূর্বে সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের ডালপালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ পুষ্ট বা রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভাল করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।


গাছ থেকে বীজ মাড়াই করে, পর পর ৫/৬ দিন পূর্ণ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে তারপর পাট ও কেনাফ বীজ সংরক্ষণ করা উচিত। প্রতিদিনই বীজ গুলোকে ঠাণ্ডা করে পলিথিন, চট বা ত্রিপল দিয়ে ভালো করে রাতের বেলা ঢেকে রাখতে হবে যেন কুয়াশা বা বৃষ্টিতে না ভিজে। বীজ অবশ্যই ত্রিপল বা চটজাতীয় কোন কিছুর উপর শুকাতে হবে। অন্যথায় বীজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ ভ্রƒণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভালোভাবে শুকানোর পর শুকনো বীজকে দুই দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে যদি কট করে বীজটি ভেঙে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বীজ ভালোভাবে শুকানো হয়েছে। শুকানোর পর বীজের আর্দ্রতা সাধারণত শতকরা ৮-৯ এর কাছাকাছি থাকে। স্বল্পমূল্যে আর্দ্রতা মাপন যন্ত্র কিনে অথবা নিকটস্থ কৃষি অফিসে গিয়েও বীজের আর্দ্রতা মাপা যায়। আর্দ্রতা বেশি থাকলে বীজের সুপ্তাবস্থা কমে যাবে এবং সংরক্ষণ ব্যহত হবে ও বীজের গুণগত মান খারাপ হবে।

 
আমাদের দেশে মূলত ক্ষুদ্র চাষির সংখ্যাই বেশি, তাদের বীজের পরিমাণও কম। সে জন্য টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের ক্যান, প্লাস্টিক ড্রাম ইত্যাদি বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। একটি বিষয় সব সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন কোন ভাবেই পাট বীজ সংরক্ষণের পাত্রে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। পরিমাণে কম বীজ কখনও বড় কোন ড্রাম বা পাত্রে রাখা ঠিক হবে না। এতে পাত্রের খালি অংশের আর্দ্রতা বীজের গুণগত মান খারাপ করে দিতে পারে। বীজের পরিমাণ যদি বেশি হয় তবে প্লাস্টিক বা টিনের ড্রামে রাখা যেতে পারে। একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যাতে পাট বীজ সংরক্ষণের পাত্রে কোন ভাবেই বাতাস প্রবেশ করতে না পারে।
যদি বায়ুরোধী পাত্র না পাওয়া যায় তখন মাটির কলসি, হাঁড়ি বা মটকায় বীজ রাখা যেতে পারে। তবে এসব পাত্রে বীজ রাখার আগে মাটির কলসি, হাড়ি বা মটকায় আলকাতরা বা রঙের প্রলেপ দিতে হবে অথবা বীজ রাখার পুর্বে মোটা পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঐ পাত্র মুড়ে দিতে হবে যাতে মাটির পাত্রটি বায়ুরোধী হয়।


সঠিক আর্দ্রতায়, সাধারণ তাপমাত্রায় লেমোফয়েল ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করলে ৩ বছর পর্যন্ত তা ভালো থাকে। বায়ুরোধী প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণকৃত বীজ ২ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। আর অন্যান্য পাত্র যেমন- পাতলা পলিথিন ব্যাগ, কাপড়/ছালা বা কাগজের ব্যাগ অথবা সরাসরি মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করলে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।


ইঁদুর যে কোনো ফসলেরই মহাশত্রæ। যে কোনো ফসলই যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হয় তা ইঁদুরের উপদ্রবে সহজেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। পাট ও কেনাফ বীজও এর ব্যতিক্রম নয়। পাট ও কেনাফ বীজ সংরক্ষণের সময় একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বীজ কোন খোলা পাত্রে রাখা না হয় এতে ইঁদুর বীজ ভর্তি পলিথিন ব্যাগ, কাপড়/ছালা বা কাগজের প্যাকেট কেটে নষ্ট করে ফেলতে পারে। এছাড়া এতে বীজের পাত্রটি ছিদ্র হওয়ায় বাতাস প্রবেশ করে ও বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বা বীজ গজানোর শতকরা হার কমে যাবে। দুর যে শুধু পাট বীজের ক্ষতি সাধন করে তা নয় পাটের আঁশও যদি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা না হয় তবে ইঁদুর অনায়াসে কেটে কেটে আঁশ নষ্ট করে ফেলতে পারে।


পরিশেষে বলা যায়, পাট বীজে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ন হতে হলে চাষি পর্যায়ে “নিজের বীজ নিজে করি” স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষিদের পাট বীজ উৎপাদনে নিজেদের উদ্যোগী হতে হবে এবং সঠিক নিয়মে তা সংরক্ষণ করতে হবে। নতুবা ভালো বীজের অভাবে অবৈধ বীজ চোরাকারবারি ও বিদেশীদের কাছে চাষিদের জিম্মি থাকতে হবে দিনের পর দিন। এ ক্ষতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পাট বীজ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ  গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ভালো বীজ মানেই ভালো ফসল, আর বীজের মান ভালো হওয়া বা  নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেকাংশেই নির্ভর করে তা সঠিকভাবে সংরক্ষণের ওপর। তাই চাষি ভাইদের সর্বদা পাট ও কেনাফ বীজ সঠিক নিয়মে সংক্ষণের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষনা ইনস্টিটিউট, ঢাকা, মোবাইল : ০১৫৫২৯৯৯১৪৯, ই-মেইল :tanny jannat92@gmail.com

বিস্তারিত
উদ্ভিদ সংগনিরোধ : কৃষি পণ্য বহিঃদেশীয় বালাই নিয়ন্ত্রণে

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার

বাংলাদেশ পৃথিবীর কৃষি প্রধান একটি দেশ। বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি জোগানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট শ্রম শক্তির শতকরা ৪৫.৬ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত।  ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৫.৩৩% (অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৬)। দেশের মোট জনসংখ্যা ইতোমধ্যেই ১৬ কোটি অতিক্রম করেছে। প্রতি বছর এই জনসংখ্যার সাথে ২০ লক্ষ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ মেট্রিক টন অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজন। তাই ক্ষুদ্র দেশের বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরি। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু কৃষি জমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া, প্রতি বছর আমদানিকৃত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্যের সাথে বা বিভিন্ন উপায়ে বালাই প্রবেশ করে ফসল বিনষ্ট হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে।    ২০১২-১৩ সালে যেখানে উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৫ লক্ষ মেট্রিক টনের মতো সেখানে বর্তমান ২০১৭-১৮ তে  আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ মেট্রিক টন  অপরদিকে একই সময়ে যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ লক্ষ মেট্রিক টন সেখানে গত ৬ বছরে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ২ লক্ষ টন বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টনের মত (৯.৯৫ লক্ষ মে.টন)।   


কৃষি খাদ্য আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ফসল ফলাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সাথে সাথে ব্যবহার করতে হবে লাগসই প্রযুক্তি। আর ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করতে হবে সার, সেচ, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি। সরকারি নির্দেশনা মেনে সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিটি অফিসের পতিত জমি কৃষি কাজে লাগানোর কার্যকরি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। আগামী দিনের কৃষিতে করোনার মতো অজানা রোগ জীবাণু সংক্রমণ ঘটলে খাদ্য সমস্যা হতে পারে।


বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির এখনও প্রাণশক্তি। সীমিত কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, শস্য চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেও বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানের ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে গত অর্থবছরে এক কোটি  ছিয়াশি লক্ষ মেট্রিক টন উদ্ভিদ ও উদ্ভিজাত পণ্য আমদানি করতে হয়েছে যা পাঁচ বছর পূর্বেও ছিল মাত্র এর অর্ধেকেরও কম। এভাবে উদ্ভিদ ও উদ্ভিজাত পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে আমরা অন্য সেক্টর থেকে যে  বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্ত হই তা দিয়েও খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা কষ্টকর। তাছাড়া যে পরিমাণে আমরা পণ্য আমদানি করি তার মাধ্যমে যেকোন পণ্য দিয়ে বা যেকোন ভাবে বিদেশ থেকে ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বালাই দেশে প্রবেশ করে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত করতে পারে যেমন বর্তমানে গমের ব্লাষ্টের কারণে গত তিন বছরে আমাদের উৎপাদন কমেছে প্রায় তিন লক্ষ মেট্রিক টন আবার গত বছর ভুট্টার ফল অর্মি ওয়ার্ম  প্রবেশের মাধ্যমে আশানুরূপ ভুট্টার ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে বিদেশী বালাই প্রবেশরোধের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে রক্ষা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে এবং উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে ও দারিদ্র্য বিমোচনে ধপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।


বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধবনীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রপ্তানির এক বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এখনো অর্গানিক ফার্মিং/কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রথাগতভাবে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক, সার ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। আর কনট্রাক্ট ফার্মিং ছাড়াই কৃষিজাত এই সব পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত তাতে কী কী ইনপুট (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) কী মাত্রায়, কখন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শাকসবজি সংগ্রহ করে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ধপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু না থাকায় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য এম.আর.এল অথবা একসেপটেবল ডেইলি ইনটেক (এডিআই) মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।


বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোন ধপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু নাই। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ (ওচচঈ) এ স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশের কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডঞঙ-ঝচঝ অমৎববসবহঃ এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ (ওচচঈ) এর বিধিবিধান অনুসরণ করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। ডঞঙ-ঝচঝ অমৎববসবহঃ এবং ওচচঈ এর বিধি-বিধান অনুসরণ করার জন্য পৃথিবীর সকল দেশই আলাদাভাবে স্বতন্ত্র স্বাধীন সংস্থা সৃষ্টি করেছে, যা বাংলাদেশে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়নি। ফলে বাংলাদেশে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রম গতি লাভ করছে না। ওচচঈ এর বিধান অনুসারে উদ্ভিদ সংগনিরোধের যে সংস্থা থাকবে তার অফসরহরংঃৎধঃরাব, খবমরংষধঃরাব ধহফ ঋরহধহপরধষ ক্ষমতা থাকতে হবে। বর্তমান সরকার ২০১১ সালে উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন পাস করেছে ।


উদ্ভিদ সংগনিরোধ একটি পুরোপরি কারিগরি ও আইনি বিষয়। দেশের কৃষিকে রক্ষা করার জন্য যেমন আমদানিকৃত পণ্যে বিদেশী কোন বালাই আছে কি না তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষান্তে নিশ্চিত হতে হয়, ঠিক তেমনি রপ্তানিকৃত পণ্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মতে আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা তাও মাঠপর্যায়ে এবং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষান্তে নিশ্চিত হতে হয়। যারা নিয়মিত এ কাজগুলো করবেন তারা দক্ষতা অর্জন করবেন কিন্তু তারা যদি না থাকেন তা হলে আমদানিকারক দেশের আমদানি চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না ঠিক তেমনি আমদানিকৃত পণ্যের সাথে বিদেশী ধ্বংসাত্মক বালাই প্রবেশ করে দেশের কৃষিকেও ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাবেনা।


বর্তমান সরকার  উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন, ২০১১ অনুযায়ী আলাদা করে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ তৈরি করার কাজ শুরু করেছে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য জনবলসহ রপ্তানিযোগ্য আলু, শাকসবজি ও ফলমূল  এবং  আমদানিকারক দেশের আমদানি চাহিদা পূরণের জন্য কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে রপ্তানি পূর্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ধপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। অপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু জনবলকে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি), ফাইটোস্যানিটারি ইনসপেকশন, স্যাম্পলিং, উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান, ট্রেড ফেসিলিটেশন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
বহিঃদেশে গধৎশবঃ অপপবংং সৃষ্টি হবে এবং দেশের উৎপাদিত পণ্যের শাকসবজি এবং ফল ডঞঙ-ঝচঝ অমৎববসবহঃ এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ (ওচচঈ) এর বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে নিরাপদভাবে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে। এশিয়া, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে আলু, পান, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি এবং ফলের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে তালমিলিয়ে চলা সম্ভব হবে ফলে রপ্তানিকৃত পণ্যের ইন্টারসেপশন কম হবে। আমদানিকৃত পণ্যের ওহাধংরাব অষরবহ ঝঢ়বপরং (ওঅঝ)/ছঁধৎধহঃরহব চবংঃ বা জবমঁষধঃবফ ঘড়হ ছঁধৎধহঃরহব চবংঃ প্রবেশে বাধা প্রদানের মাধ্যমে দেশের  কৃষিকে বহিঃদেশীয় ধ্বংসাত্মক বালাই থেকে রক্ষা করা হয়।


আগামী দিনের বিশ্ব পরিস্থিতি কী হবে আর আমাদের জন্যই বা কী অপেক্ষা করছে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। এরই মধ্যে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে মর্মে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছেন। কৃষি মন্ত্রালয়ের দায়িত্বে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী করোনা কালীন সময়ে, খাদ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী দিনের কৃষিতেও করোনার মতো অজানা রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয়াল থাবায় খাদ্য সমস্যা প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কৃষি পণ্য আমদানি রপ্তানির জন্য নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করা জরুরি। এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধির এখনই প্রকৃত সময়। প্রয়োজনে এই সংক্রান্ত সেল গঠন করে দেশওয়ারী পণ্যের চাহিদা এবং ফাইটোসেনিটারি শর্তসমূহ সংগ্রহ করে আমাদের দেশ হতে কিভাবে শর্ত পূরণ করে আরো অধিকতর কৃষিজ পণ্য রপ্তানি করা যায় এই ব্যাপারে বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত কর্মাশিয়াল কাউন্সলরগণ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। বাংলাদেশি দূতাবাসে নিযুক্ত কানাডা, আমেরিকান কমার্শিয়াল কাউন্সলর মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশি স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় করেন যেন তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।
বিধায় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ  ও প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন ল্যাবরেটরি (ধপপৎবফরঃবফ ষধনড়ৎধঃড়ৎু) সৃষ্টি করা হলে বহিঃদেশে গধৎশবঃ অপপবংং সৃষ্টি হবে এবং দেশের উৎপাদিত পণ্যের শাকসবজি এবং ফল ডঞঙ-ঝচঝ অমৎববসবহঃ এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ (ওচচঈ) এর বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে নিরাপদভাবে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।


উপপরিচালক (এল.আর), সংযুক্ত- উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৬০০৪৪০০ ইমেইল :  jagot_mala@yahoo.com

বিস্তারিত
বন্যাপরবর্তী সবজি চাষে কৃষানিদের করণীয়

কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
কথায় আছে
Agriculture is the pioneer of all culture and women is the pioneer of agriculture. আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় লিখেছেন- “সাম্যের গান গাই-আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই”, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। দেশে বর্তমান জনসংখ্যার অনুপাত পুরুষ:মহিলা হলো ১০৬ঃ১০০। মাত্র ১৫% নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। জমির মালিকানায় নারীর মাত্র ১৯%। নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা, নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরির কথা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে দুই লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হচ্ছেন। আসলেই এদেশের নারীরা খরা বন্যা সহ যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরুষের কাধে কাধ মিলিয়ে সমান তালে মোকাবেলা করে যাচ্ছে।


ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছরই দেশের কোথাও না কোথাও কম বেশি বন্যা দেখা দেয়। কখনও কখনও আগাম বন্যার কারণে মাঠের বোরো, আউশ, পাট, রোপা আমন বীজতলা, বোনা আমন ও শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার কখনও দেখা দেয় ঢল বন্যা আবার কখনও নাবি বন্যা। হঠাৎ বন্যা মারাত্মক আকার ধারণ করলে মাঠ ফসল ছাড়াও ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিরোধ-প্রতিকার করা সম্ভব না হলেও কিছু বিশেষ প্রযুক্তি পদ্ধতি অনুসরণ করলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেয়া যায়। কৃষি মন্ত্রণালয় বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।


আজকাল হৃদরোগ, চর্মরোগ ও বহুমূত্র রোগের মতো নানা ধরনের রোগীকে ওষুধের পরিবর্তে পথ্য হিসেবে বেশি করে শাকসবজি খাবার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তারেরাও। আমরা আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দামি বা সস্তা যে ধরনের খাবারই খাই না কেন তার মধ্যে শাকসবজির গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খেয়ে থাকি। কেননা শাকসবজিতে সব ধরনেরই খাদ্য উপাদান আছে। তার মধ্যে ভিটামিন ও খনিজ লবণ উল্লেখযোগ্য যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেহে ভিটামিন ও খনিজ লবণের যে চাহিদা তার সবটুকুই প্রায় শাকসবজি থেকেই পূরণ হয়। আবার চোখের সমস্যার জন্য সবুজ বা রঙিন শাকসবজি অত্যন্ত উপকারী। তাহলে শুধু খাবার হিসেবেই নয়, ওষুধ, পথ্য, পুষ্টি ও সুষম খাদ্যের জন্য আমাদের প্রতিদিনই হরেক রকম শাকসবজি খাওয়ার জন্য কিছু না কিছু শাকসবজি উৎপাদন করা প্রয়োজন। এতে আমাদের পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারবে।


রবি বা শীতকালের জন্য যেসব সবজির চারা তৈরি করতে হবে সেগুলো সাধারণত ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন ও লাউ এসব। উন্নত জাতের সবজি চারার অভাবে অনেকেই সবজি চাষ করতে পারেন না অথচ একটু পরিশ্রম করলে নিজের চারা নিজেই তৈরি করা যায়। শাকসবজি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ফসল। সেজন্য একটু যতেœর সাথে এর চাষ করতে হয়। সবজির জমি খুব মিহি ও ঝুরঝুরেভাবে তৈরি করতে হবে। জমি সমতলভাবে সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিয়ে ‘জো‘ এলে তারপর চাষ মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বুনতে হবে। আবার অনেক রকমের সবজি মাদাতে লাগাতে হয়। এগুলোর প্যাকেটে চারা তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাদা তৈরি করে চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে  বাউনি বা মাচা তৈরি করে দিতে হয়। তবে মাদাতে চারা লাগানোর আগে পরিমাণ মতো সুষম হারে অন্যান্য রাসায়নিক সারও দিতে হবে।


ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা এসবের জন্য  বিঘা প্রতি গোবর ১ টন, ইউরিয়া ৫০ কেজি, টিএসপি ৩৫ কেজি, এমওপি ৪০ কেজি। আর এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সার এবং ইউরিয়া ও এমওপি অর্ধেক জমি তৈরির সময় এবং বাকি সার ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে।


চারা তৈরির জন্য আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে-
*প্রথমে চারা তৈরির জন্য স্থান নির্বাচন করে নিতে হবে।
*সূর্যের আলো-বাতাস পায় এবং পানি সেচ-নিকাশের সু-ব্যবস্থা আছে এমন জায়গা নির্বাচন করে নিতে হবে।
*বীজতলার জন্য মাটি দোঁ-আশ ও বেলে দোঁ-আশ হলে চারা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হবে।
*আধুনিক পদ্ধতির জন্য বেড তৈরি করে নিতে হবে।
*প্রতিটি বেডের মাপ হবে ৫মিটার ১ মিটার, তবে জমির প্রকার ভেদে শুধুমাত্র প্রস্থের মাপ ১ মিটার রেখে দৈর্ঘ্য প্রয়োজনমত কম/বেশি করতে পারেন।
*প্রতিটি বেডের চারপাশে ৮-১০ ইঞ্চি চওড়া নালা রাখতে হবে। এতে পানি সেচ-নিকাশ ছাড়াও যত্ন-পরিচর্যা কাজ সুবিধে হবে।
*প্রতি বেডে ২০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা সার, ৫ কেজি ছাই, টিএসপি ২০০ গ্রাম ও ১০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে।
এবার ৫মিটার ১ মিটার মাপের একটি আদর্শ বীজতলায় ফুলকপি ও বাঁধাকপির জন্য ১০ গ্রাম, ওলকপির জন্য - ১০ গ্রাম, টমেটোর জন্য- ৫ গ্রাম, বেগুনের জন্য- ১০ গ্রাম বীজ লাগবে। এছাড়া অন্যান্য শীতকালীন সবজির জন্য সাধারণত ৫-১০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।


চারা গজানোর পর করণীয়
*বৃষ্টির পানি যাতে বীজতলায় জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বীজতলার চারা দুপুর বেলায় অতিরিক্ত রোদ থেকে রক্ষার জন্য বাঁশের চাটাই বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
*বীজতলায় প্রয়োজনে হালকাভাবে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। সেচ দেয়ার পর মাটির উপর চটা পড়লে চটাগুলো ভেঙে দিতে হবে। এতে আলো-বাতাস ঠিকমত চলাচল করবে, চারার শিকড় মজবুত ও শক্ত হবে।
*বীজতলা সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। আগাছা বের হলে তা দ্রæত পরিষ্কার করে দিতে হবে। চারা অবস্থায় সবজির কাণ্ড ও শিকড় খুবই নরম থাকে। আগাছা পরিষ্কারের সময় সাবধানে নিড়ানি ব্যবহার করতে হবে যাতে নিড়ানির আঘাতে কাণ্ড ও শিকড় ছিঁড়ে না যায়। আগাছা থাকলে রোগ ও পোকার আক্রমণ বেশি হয়। রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হলে তা  দ্রæত দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
*চারার বয়স ২৫-৩০ দিন হলে যত্ন সহকারে চারা উঠাতে হবে। চারা উঠানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে চারার শিকড় ও কাণ্ড ছিঁড়ে না যায়। দুপুর বেলা সবজির চারা উঠানো এবং লাগানো ঠিক নয়।

 

বন্যা মোকাবেলায় বন্যা পরবর্তী সময়ে বিশেষ বিশেষ করণীয়
*যাদের শীতকালীন সবজির চারা নষ্ট হয়েছে তাদেরকে আবার চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
*যারা আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করেছিলেন তাদের সবজি সম্পূর্ণ নষ্ট না হয়ে থাকলে জমিতে জো আসার পর ছাই ছিটিয়ে হালকাভাবে নিড়িয়ে উপরি সার প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।
*দ্রুত বর্ধনশীল সবজি নির্বাচনে মুলা, লালশাক, ধনেপাতা, শর্ষেশাক, পালংশাক এবং লাউ ও কুমড়া (ঘন করে মাদা তৈরি করে বীজ বপন করে) উৎপাদন করে শাক হিসেবে বাজারে বিক্রি করে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব।
*পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পাতাজাতীয় সবজি যেমন গিমা কলমি, লালশাক, ডাঁটাশাক, পালংশাক, এ সবের চাষ করা যেতে পারে।
*বন্যায় শীতকালীন সবজি ক্ষেতসহ প্রচুর পরিমাণে বীজতলার চারা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাড়ির আঙ্গিনায় বাঁধের ধারে বা অন্য কোন উঁচু জায়গায় সবজির চারা উৎপাদন করতে পারেন।  শুকনো জায়গা না থাকলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের ব্ক্সা, কাটা ড্রাম ও পুরনো টিনে কিছু মাটিসহ জৈব সার  মিশিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ এ সবের বীজ বুনে চারা উৎপাদন করা যায়।
*ভাসমান কচুরিপানার স্তূপ কলার ভেলার ওপর সামান্য মাটি দিয়ে লাউ, শিম, এর বীজ বপন করা যেতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার পর ওই স্তূপটি পছন্দ মতো জায়গায় বসিয়ে মাচা করে দিতে হবে।
*আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যায়।
*বন্যার পানি সহনশীল লতিরাজ কচুর চাষ করা যায়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে শুকনা ছাই মিশিয়ে প্রয়োজনে অল্প মাত্রায় ইউরিয়া ও পটাশ প্রয়োগ করা যায়;
*এসব এলাকায় খেসারি ডাল চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে তাই বীজ সংগ্রহ করে প্রস্তুত থাকতে হবে যাতে উপযুক্ত সময়ে বপন করা যায়।
*এসব এলাকায় ভুট্টা চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাই   আমন ধান কাটার পর ভুট্টা ফসল চাষ করা সম্ভব ।
*তরমুজ, ফুটি, মুগ চাষের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে কোন জমি পতিত না থাকে।
*চরা অঞ্চলসহ অন্যান্য উপযুক্ত এলকায় মিষ্টি আলু, তরমুজ, বাঙ্গি, চীনা বাদাম, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করুন। চর অঞ্চলে স্থানীয় বোরো চাষের লক্ষ্যে আগাম প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্তমানে এ ক্ষেত্রে মহিলাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়ার ফলে কৃষি কাজে নেমে অনেক মহিলাই সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যাদের অনেকেরই খবর আমরা রেডিও,  টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছি। শুধু তাই নয় এ ধরনের কাজ করে অনেক মা-বোনই জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। আমাদের দেশের মা-বোনেরা যদি একটু উদ্যোগ ও প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কৃষি কাজে এগিয়ে আসেন, তবে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক দুর্যোগসমুহ মোকাবেলা করে তারা তাদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবেন।

আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী, মোবাইল : ০১৮১৯৯২২৬১৩, ই-মেইল : rajshahi@ais.gov.bd

বিস্তারিত
চীনাবাদামের আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি

ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল

চীনাবাদাম বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। তবে বাংলাদেশে চীনাবাদাম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে যা চীনাবাদাম উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু উচ্চফলনশীল বাদামের জাত উদ্ভাবন করেছেন যা প্রচলিত জাত থেকে ফলন বেশি এবং জীবনকাল প্রচলিত জাতের চেয়ে কম। নি¤েœ উচ্চফলনশীল বাদামের জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো যাতে কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের   কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী অঞ্চল ভেদে সঠিক বাদামের জাতটি বেছে নিতে পারে।
 

বারি চীনাবাদাম-৫ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি.)। গাছ খাড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৪৮-৫০ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৫১% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে  জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন এবং ফলন ২.২৫ টন/হেক্টর।
 

বারি চীনাবাদাম-৮ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪২ সেমি.)। গাছ খাড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। বাদামের খোসা মসৃণ ও কিছুটা সাদাটে। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১২৫-১৪০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-৪ : প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৯% এবং আমিষের পরিমাণ ২৭.৫%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.৪০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-৯ : লবণ সহিষ্ণু (৮ ডিএস/মি.)। দানা মাঝারি এবং গাঢ় লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৮% এবং আমিষের পরিমাণ ২৪%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং ফলন ২.১০ টন/হেক্টর।
 

বিনা চীনাবাদাম-১০ : গাছ একটু লম্বাটে (৬৫-৭৬ সেমি.) এবং পাতার রং ফ্যাকাশে সবুজ রঙের। প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি এবং তামাটে লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০.৫% এবং আমিষের পরিমাণ ২৮%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
 

বপন সময় : খরিফ-২ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (আষাঢ়-আশ্বিন) পর্যন্ত বীজ বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
 

চাষ উপযোগী জমি : বেলে, বেলে, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে অধিক ফলন পাওয়া যায়। শুষ্ক জমি বাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী ।
 

জমি তৈরি, বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ : তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি.) রাখতে হবে। বীজগুলো ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নীচে পুতে দিতে হবে। হেক্টর প্রতি ১৪০-১৫০ কেজি (বিঘা প্রতি ১৮-২০ কেজি) বীজের প্রয়োজন হয়।
 

বীজ শোধন : বীজ শোধন করে নিয়ে বপন করলে ভাল হয়। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/অটোস্টিন/ নোয়িন নামক বীজ শোধনকারী ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। শোধনকারী বীজ জমিতে বপন করলে চারা গজানোর হার বেড়ে যায়।


সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি ইউরিয়া (একরপ্রতি ১৭-১৮ কেজি), ১০০-১৩০ কেজি টিএসপি,  এমওপি ও জিপসাম (একর প্রতি ৩৫-৪০ কেজি) এবং ৩-৪ কেজি  (একরপ্রতি ১.২-২.৫ গ্রাম) দস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বেলে মাটির ক্ষেত্রে বোরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজি প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং দ¯তা সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। সকল প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটেয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে জীবাণূসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন নাই (জীবাণুসার একর প্রতি ৩০০ গ্রাম)।


জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলী : (ক) সুস্থ সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণমত চিটাগুড় মিশিয়ে নিতে হবে। যাতে বীজগুলো আঠালো মনে হয় (চিটগুড়ের অভাবে ঠাণ্ডা ভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করা যায়)। (খ) আঠালো বীজগুলোর সংগে জীবাণুসার ভালভাবে মিশিয়ে নিবেন। যাতে প্রতিটি বীজে কালো পলেপ পড়ে যায়। (গ) কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিলে বীজগুলো গায়ে গায়ে লেগে থাকবে না। (ঘ) জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলো মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে। (ঙ) ঠাÐা, শুষ্ক, রোদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে। জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা  উত্তম।


আগাছা দমন : চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন  পর নিড়ানী দিয়ে সতর্কতার সাথে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে। শিকড়ে যেন কোন প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
পানি সেচ : খরিফ-২ মৌসুমে চীনাবাদাম চাষে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।  


পোকামাকড় দমন : জমিতে বাদাম লাগানোর পরপর পিপিঁলিকা আক্রমণ করে রোপিত বাদামের দানা খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্য বাদাম লাগানো শেষ হলেই ক্ষেতের চারিদিকে সেভিন ডাস্ট ৬০ ডবিøউপি ছিটিয়ি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেতের চারিদিকে লাইন টেনে কেরোসিন তেল দিয়েও পিপিঁলিকা দমন করা য়ায়। অনুরুপভাবে, উইপোকা চীনাবাদাম গাছের এবং বাদামের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এরা বাদাম গাছের প্রধান শিকড় কেটে দেয় অথবা শিকড়ের ভিতর গর্ত তৈরি করে। ফলে গাছ মারা যায়। উইপোকা মাটির নিচের বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। পানির সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উইপোকা জমি ত্যাগ করে। অথবা উইপোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন-১০ জি/বাসুডিন-১০ জি/ডারসবান-১০ জি যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১৫, ১৪ ও ৭.৫ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিছাপোকার আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পাতার নীচে দলবদ্ধ বিছাগুলোকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কোন কিছু দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।


রোগ দমন : চীনাবাদামের পাতার দাগ এবং মরিচা রোগ বেশি হলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-৫০ ডবিøউপি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে বিকালে স্প্রে করতে হবে। বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/অটোস্টিন/নোয়িন দ্বারা প্রতি কেজি বীজ শোধন করলে রোগের আত্রমণ কম হবে। মরিচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুলার নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।


ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ : ভালো বীজ বা গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে উঠাতে হবে। ফসল সঠিক সময় তোলার জন্য ফসলের পরিপক্কতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। চীনাবাদাম বীজ খুবই স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ক হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ক হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রং ধারণ করে নিচের পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙ্গার পর খোসার ভিতরে সাদা কালচে রং ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। পরিপক্ক হবার আগে বাদাম উঠালে তা ফল ও তেল কম হবে। আবার দেরীতে উঠালে বীজের সুপ্ততা না থাকার দরুন জমিতেই অংকুরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।


ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা মাটি বা বালু পরিষ্কার করতে হবে। তারপর আটিগুলো উপুর করে অর্থাৎ বাদামগুলো উপরের দিকে রেখে গাছের মাথা শুকনো মাটিতে বসিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝড়ে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। এভাবে শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠাÐা করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার উপর সংরক্ষণ করতে হবে।
 

সতর্কতা : ১। এলাকায় উপযোগী জাত বাছাই করা। ২। বপনের আগেই বীজের গজানোর হার পরীক্ষা করা। ৩। একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা।  প্রয়োজনে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি কর্মীর সাথে যোগযোগ করা।

চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল: ০১৭১৬৭৪৯৪২৯, ই-মেইল : mmamondal@gmail.com

বিস্তারিত
পোলট্রি খামারে ইদুরের প্রভাব ও দমন ব্যবস্থাপনা

মোঃ ফজলুল করিম

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করার জন্য বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে মুরগির উৎপাদন দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মুরগির কম মূল্য ও আয় বৃদ্ধির কারণে জনপ্রতি মুরগির মাংস গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে নিম্ন মধ্যম আয়ের কৃষক মুরগির খামারকে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এ শিল্প আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে উঠছে। প্রতি বছর ২-৩ শতাংশ হারে এ শিল্পের প্রসার ঘটছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ডিম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৭৫.৪০ মিলিয়ন টন এবং এশিয়ার ডিম উৎপাদনের পরিমাণ ৪৩.৩০ মিলিয়ন টন। ২০১৮-১৯ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৭৩৬ মে. টন ডিম উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প জিডিপিতে ১.৪৭ শতাংশ এবং প্রায় ১ কোটি লোক এ শিল্পের সাথে জড়িত। ২০১৩ সালে মুরগির খামারের পরিমাণ মাত্র ৬৬,০০০ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৩)। ৫৫,০০০ মুরগির খামার বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে কারণে কমে গেছে। (ডেইলি স্টার ২০১৩)। এত বড় পোলট্রি শিল্পের মুরগির জন্য নিবিড় পরিচর্যা করা প্রয়োজন যাতে ডিম ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যায়। মুরগির খামারের আশপাশে ময়লা আবর্জনা, বিষ্টা, মৃত মুরগি এসব থাকে যা ইঁদুর ও অন্যান্য বালাইয়ের প্রধান আবাসস্থল।


পরজীবী ও মাটি উপরে অবস্থানকারী উভয় ধরনের বালাই পোলট্রি পরিবেশে দেখা যায়। বহিঃপরজীবী জীব হলো মাইট, লাইস, ফ্লি ও টিকস এবং বহিভাগে অবস্থানকারী জীব হলো বিটল, ফ্লাইস, মথ, তেলেপোকা ও ইঁদুর। মুরগির খামারের কাঁচা ভিটি, নোংরা পরিবেশ, নিকটস্থ ফসলের মাঠ ইত্যাদির কারণে এসব জীব মুরগীর খামারের স্থানান্তরিত হয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে থাকে। এসব বালাইয়ের মধ্যে ইঁদুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।


মুরগির খামারে আক্রান্ত ইঁদুরের প্রজাতি
কার্যকরী দমন ব্যবস্থা গ্রহণ বা পরিকল্পনা করা যায় যদি ইঁদুরের প্রজাতি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়। মুরগির খামারে তিন প্রজাতির ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা হলো মাঠের কালো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর ও নেংটি ইঁদুর।
ছোট ব্যান্ডিকুট ইঁদুর/ছোট কালো ইঁদুর : ছোট ব্যান্ডিকুট/কালো ইঁদুর ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু শহরের সব এলাকায় এদের দেখা যায়। এরা মোটাসোটা আকারের ইঁদুর। এদের বিভিন্ন পরিবেশ দেখা যায়। ব্যান্ডিকুট নিশাচর এবং গর্ত খননে পটু। এরা তাদের নিজস¦ তৈরি গর্তে বাস করে এবং মুরগির খামারে  প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি করে।

গেছো ইঁদুর : গেছো ইঁদুর ছোট আকারের ইঁদুর। এরা সাধারণত   বসতবাড়ির ওপরের অংশে বাস করে অনেক সময় পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপেও এরা বাস করে। এদের কালো ইঁদুর, ঘরের ইঁদুর বা জাহাজের ইঁদুরও বলা হয়। এরা নিশাচর প্রাণী। বেশির ভাগ সময় এদের রাতে চলাচল করতে দেখা যায় এবং এদের চলাচল ৩০ মিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে।


ঘরের নেংটি ইঁদুর: নেংটি ইঁদুর ছোট আকারের ইঁদুর। নেংটি ইঁদুর দালান কোটা ও বাসাবাড়িতে দেখা যায়। এরা দেয়ালে, কুঠরি পুরাতন আসবাবপত্র ও গুদামে বাসা তৈরি করে। এরা মুরগির খামারে খাবার খেয়ে, ডিম নষ্ট করে এবং বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। এরা ৩ থেকে ১০ মিটার দূরত্বের মধ্যে চলাচল করে থাকে।   


মুরগির খামারের ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি
ক. মুরগির খাবারের ক্ষতি : ইঁদুর মুরগির  খাবার খায় এবং খাবার নষ্ট করে এবং যে পরিমাণ খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে থাকে। ইঁদুর তার শরীরের ওজনের তুলনায় ১০ শতাংশ খাবার খায় এবং প্রতিদিন ২৫ গ্রাম এবং বছরের ৯.১ কেজি খাবার খায়, গড়ে প্রতিদিন একটি মুরগির খামারে ৮.৬ গ্রাম মুরগি খাবার খেয়ে থাকে। বিভিন্ন  পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে যে, মুরগির খামারে প্রতিদিন প্রায় ২-৫০ কেজি খাবার খেয়ে এবং খাবারে ব্যাগ কেটে নষ্ট করে থাকে। ইঁদুরের মলমূত্র ও পশমের মাধ্যমে মুরগির খাবার  দূষিত করে এবং এর পরিমাণ প্রায় ০.৪- ৩.৩%। ইঁদুর দ্বারা মুরগির খাবার নষ্ট একটি অর্থনৈতিক ক্ষতি যার পরিমাণ চলমান খরচের প্রায় ৫০-৭৫%।


খ. মুরগি, বাচ্চা ও ডিমের ক্ষতি : বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, ইঁদুর দ্বারা ডিমের ক্ষতির পরিমাণ ০৫% এবং তা ১০% পর্যন্ত হতে পারে যদি সংরক্ষণের অবস্থা দুর্বল থাকে। ডিমের  প্লাস্টিক ট্রে ও ইঁদুর কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর প্রায়ই ৩০ দিন বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে আক্রমণ করে এবং প্রায় একটি খামারে ৫.৯% বাচ্চাকে মেরে ফেলে। ইঁদুর প্রায়ই মুরগিকে ভয় দেখায় ও কামড় দিয়ে থাকে এবং মুরগির ডিম পাড়া,      বৃদ্ধি ও খাদ্য গ্রহণে প্রভাব ফেলে থাকে। বাংলাদেশে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি মুরগির খামারে মাসে প্রায় ২৫০ টাকার ডিম নষ্ট করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রতিটি মুরগীর খামারে প্রায় ১৮,০০০ টাকার ক্ষতি করে থাকে।


গ. অবকাঠামোর ক্ষতি: খামারের ঘর ও যন্ত্রপাতির নষ্ট করার মাধ্যমে বাস্তবিক পক্ষে ক্ষতি অনেক ব্যয়বহুল। ইঁদুরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সবসময় কাটাকুটি করা। ইঁদুরের ওপরের অংশের ছেদন দন্ত  প্রতি দিন প্রায় ০.৪ মিমি. হারে বৃদ্ধি পায়। এই দাঁতের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য ইঁদুর প্রতিদিন কিছু না কিছু কেটে থাকে, এর ফল হিসেবে খাদ্য ছাড়া অন্য দ্রব্যাদিও কেটে থাকে। ইঁদুরের কাটাকুটি  স্বভাবের জন্য মুরগির ঘর ও দেয়াল দুর্বল হতে পারে। তারা খাবারের পাত্র, পানির পাত্র কেটে নষ্ট করে। মুরগির খামারের মেঝেতে প্রচুর গর্ত তৈরি করে যা বর্ষাকালে ঘরে পানি ঢুকে এবং অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পরে। ইউএসএইডের হিসাব মতে, প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা নষ্ট খাবার ঘর ও যন্ত্রপাতির ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ ইউএস ডলার (দুই হাজার টাকা)। ইঁদুর বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর ও তার কেটে শর্টসার্কিট সৃষ্টির মাধ্যমে খামারের ক্ষতি করে থাকে।     


ঘ. বিভিন্ন রোগের বাহক ও সংরক্ষক: ইঁদুর বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বাহক ও সংরক্ষক হিসাবে কাজ করে । ইঁদুর প্রাথমিকভাবে মলমূত্র ও পশমের মাধ্যমে মুরগির খাবার সংক্রমিত হয়। ইঁদুর প্রায় ৬০ ধরনের বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে থাকে যা দ্বারা মুরগির ও খামার কর্মী আক্রান্ত হয়ে থাকে। ইঁদুর বিভিন্ন মুরগির রোগ যেমন- সালমোনেলোসিস, কলিব্যক্সিলোসিস, মাইকোপ্লাজমেসিস ইত্যাদি, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত রোগগুলো হলো লেপটোসপাইরোস, টিউবারকোলোসিস, ফাউল কলেরা, ফাউল টাইফয়েড, এভিয়ান প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল ডিজিজ, ক্যাটল ডিজিজ, এবং প্রটোজোয়ান  সংক্রমণ যেমন টক্সোপ্লাজমোসিস, কক্সিডোসিস এসব রোগ ছড়িয়ে থাকে। সবগুলো রোগ মুরগির ডিম, মাংস উৎপাদনের মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে এ রোগ গুলোর মধ্যে সালমোনেলা ও ফাউল কলেরা মুরগির খামার উৎপাদনকারীদের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ। ইঁদুর বিভিন্ন পরজীবী যেমন লাইস, ফ্লি এবং মাইটসের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে থাকে। সালমোনেলা এমন একটি  ক্ষতিকর রোগ যা মুরগির এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকার রোগের আক্রমণের ফলে প্রায়ই মুরগি মারা যায়। মুরগির খাবারে খাওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং বাজারে আক্রান্ত মুরগির বাজার মূল্য কমে যায়। কাজেই ইঁদুর দ্বারা খাবার সংক্রমণ হওয়া কমানো এবং ইঁদুরের সংখ্যা কমানোই হল মুরগির খামারির প্রধান কৌশল।


ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনায় মুরগির খামারের অবস্থা পরিদর্শন: প্রথম ধাপ হলো প্রত্যক্ষভাবে খামারের অবস্থা পরিদর্শন করা। এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হলো এখানে কোনো ইঁদুরের উৎপাত আছে কিনা যার মাধ্যমে ইঁদুরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্ষতি করতে পারে। ইঁদুরের উপস্থিতি বা ক্ষতির মাত্রা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যাচাই করা যায়। যেমন-১. প্রত্যক্ষ দর্শন, ২. ট্রেপিং ইনডেক্স, ৩. ইঁদুরের পায়ের চিহ্ন, ৪. সতেজ গর্ত পর্যবেক্ষণ।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: ইঁদুর পরিষ্কার পরিবেশ পছন্দ করে না । খামারের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার রাখা, আগাছা, আবর্জনার স্তুপ পরিষ্কার করে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো যায়। খামারের আশপাশে গাছ ও গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ইঁদুর বাসা তৈরি করতে না পারে।


প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা: সমতল টিনের শিট ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে ইঁদুরের চলাচল বন্ধ করা যায়। খামারে মেঝে ইটের কনক্রিট দিয়ে তৈরি করতে হবে দেয়াল এবং দরজার বড় ছিদ্র ও ফাঁকা বন্ধ করতে হবে। খামারের বাহিরের অংশ ঢালু রাখতে হবে যাতে ইঁদুর উঠতে না পারে।


ইঁদুরের প্রতিবন্ধকতা সব সময় কার্যকর নয়। দমনে অন্যান্য পদ্ধতি  বিবেচনায় আনতে হবে যেমন ফাঁদ ও রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। মুরগির খামারে জৈবিক পদ্ধতি বা আলট্রাসনিক সাউন্ড পদ্ধতি খুব একটা কার্যকরি হবে না।
ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হলে সম্ভাব্য সব রকম দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেই ইঁদুর দমন করা উচিত। ইঁদুর দমনের জন্য কোন একটি একক পদ্ধতি খুব বেশি কার্যকর নয়,  এক্ষেত্রে একাধিক বা সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
ইঁদুর একটি সামাজিক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সামাজিকভাবেই করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা সরকারের পক্ষে স্থায়ীভাবে সমাধান করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা মডেল সব জেলায় গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে গ্রামবাসীরা দলীয়ভাবে ইঁদুর নিধনে উদ্বুদ্ধ হবেন। খামারীদের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে খামার ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ জীবাণু রোধ, পরিবেশের দূষণ কমানো এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। ইঁদুর দমন প্রযুক্তি উন্নয়নের আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, কারণ ইঁদুর দমন প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই ব্যবস্থাপনা হতে সম্পূর্ণ বিভন্ন রকমের। ইঁদুর দমন অভিযান বা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।             

                                                                                                                                                 
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা, মোবাইলনং-০১৭২৪-১৪১৬৬২, ই-মেইল : fazlurahi@gmail.com

বিস্তারিত
ইঁদুরের বংশবিস্তার ও জনস্বাস্থ্যে সচেতনতা

কৃষিবিদ সাবিহা সুলতানা

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। তাই কৃষির মধ্যেই মিশে রয়েছে আমাদের গ্রাম বাংলার হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস। আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৃষি ও     কৃষকের অবস্থান বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নির্বিঘেœ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রোগ বালাই ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আমাদের লড়াই করতে হয়। বাংলাদেশের কৃষকের মতে এক নম্বর বালাই হচ্ছে পোকামাকড় এবং দুই নম্বর বালাই হচ্ছে ইঁদুর। প্রাকৃতিক পরিবেশের বৃহৎ একটি অংশ ইঁদুর দখল করে আছে। মানুষের কৃষি জমি, গ্রাম-শহর, রাস্তা-ঘাট, বাঁধ, সেচের নালা, হাস-মুরগীর খামার, বনজঙ্গল এবং সর্বোপরি যেখানে লোকবসতি রয়েছে সেখানে ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন এবং গুদামজাত করে তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এরা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এরা শুধুমাত্র শস্য খেয়েই ক্ষান্ত হয় না এবং তা কেটেকুটে নষ্ট করে এবং লোম মিশিয়ে থাকে। মানুষ ও গবাদি পশুতে রোগবালাই সংক্রমণ করে এবং সবশেষে বলা যায় এরা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায় যে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশ বিস্তারকারী এলাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপক‚লীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণ ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য অনুক‚ল। সারা পৃথিবীতে সর্বমোট ১৭০০ টি ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে ১২ টির অধিক ক্ষতিকর প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে।


ইঁদুরের শ্রেণীবিন্যাস : ইঁদুর বিভিন্ন প্রজাতির হতে পারে। বসবাসের স্থানের ভিত্তিতে সাধারণত ইঁদুরের ভাগ করা যেতে পারে। যথা-(ক) মাঠে বসবাসকারী ইঁদুর। (খ) বাসাবাড়িতে বসবাসকারী ইঁদুর।
(ক) মাঠে বসবাসকারী ইঁদুর
(১) মাঠের ছোট কালো ইঁদুর : এদের দ্বারা মাঠ ফসলের সবচাইতে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এরা লম্বায় প্রায় ৭.৫-৩০ সেমি. ও ওজন প্রায় ১৫০-৩৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। দেখতে কালো ধুসর রঙের। শরীরের তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। প্রায় সবজাতীয় কৃষি ফসলে এরা আক্রমণ করে থাকে।
(২) মাঠের বড় কালো ইঁদুর : এরা দেখতে প্রায় মাঠের ছোট কালো ইঁদুরের মত। পার্থক্য হল এদের ওজন ৩৫০-১০০০ গ্রাম, আকারে বেশ বড়, মুখ সামান্য সরু। এরা সাতার পটু। গায়ের রং কালচে ধুসর বা তামাটে। এদের পেছনের পা বেশ বড় এবং কালো বর্ণের। ধান ফসলের বেশিরভাগ ক্ষতি এদের দ্বারা হয়ে থাকে। সাধারণত নিচু এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়।
(খ) বাসাবাড়িতে বসবাসকারী ইঁদুর
(১) ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর: এদের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭-২২ সেমি.। লেজের দৈর্ঘ্য  ৫-২৩ সেমি. এবং মাথা ও শরীরের তুলনায় লেজ লম্বা হয়ে থাকে। এদের দেহ লম্বাটে এবং রং বাদামি দেহের নিচের দিকটা সাদাটে। এরা ঘরে অবস্থান করে এবং ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, গুদামজাত শস্য ইত্যাদির ক্ষতি করে। এদের সাধারণত বাসাবাড়িতে অথবা বাড়ির আশেপাশে বা গাছে বেশি দেখা যায় এবং এদের মাঠে কম দেখা যায়।
(২) নেংটি ইঁদুর : এরা আকারে ছোট, মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩-১০ সেমি. এবং ওজন প্রায় ১৪-২০ গ্রাম হয়ে থাকে। এদের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন, বাত্বি ইঁদুর বা শইল্লা ইঁদুর। গায়ের রং ছাই না তামাটে এবং পেটের রং হালকা ধূসর বর্ণের। এরা বাসাবাড়িতে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে যেমন খাদ্যশস্য, কাপড়-চোপড় কাটা থেকে শুরু করে বিদ্যুতের তার পর্যন্ত কেটে ফেলে।

 

ইদুরের বংশবিস্তার
উপযুক্ত এবং অনুক‚ল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর থেকে এক বছরে ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি পেয়ে ২০০০- ৩০০০টি হতে পারে। একটি স্ত্রী ইঁদুরের বয়স ৩ মাস পূর্ণ হলে বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। বাচ্চা প্রসবের পর ২ দিনের মধ্যেই স্ত্রী ইঁদুর পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারে। এদের গর্ভধারণ কাল প্রজাতিভেদে ১৮-২২ দিন হয়। সারা বছরই বাচ্চা দিতে পারে তবে বছরে ৫-৭ বার এবং প্রতিবারে ৬-১০টি বাচ্চা জন্ম দিয়ে থাকে। মা ইঁদুর এদের যতœ বা লালন পালন করে থাকে। এদের ১৪-১৮ দিনে চোখ ফোটে। চার (৪) সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে এবং ৩ (তিন) সপ্তাহ পর থেকে শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে। পাঁচ ( ৫) সপ্তাহ পর থেকে এরা মা এর সঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে যায়। একটি ইঁদুরের জীবনকাল ২-৩ বছর হয়ে থাকে।


ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণসমূহ  
কর্তনের শব্দ, নখের দ্বারা আঁচড়ানোর শব্দ, কোনো কিছু বেয়ে ওঠার অথবা নামার শব্দ, ক্ষণস্থায়ী চিচি শব্দ, চলাচলের রাস্তায় মল, নোংরা দাগ, পায়ের ছাপ, ইঁদুর যাতায়াত পথের সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি দ্বারা ইঁদুরের উপস্থিতি অনুমান করা যায়। ইঁদুরের বাসা ও তার আশপাশে ছড়ানো ছিটানো খাবার, ইঁদুরের গন্ধ এবং পোষা প্রাণীর লাফ ঝাঁপ বা অদ্ভুত আচরণ বা উত্তেজনা ইঁদুরের উপস্থিতি নির্দেশ করে। গুদামের ক্ষতির চিহ্ন দেখে এর আক্রমণের লক্ষণ বোঝা যায়। এ ছাড়াও আক্রান্ত ফসল, গম রাখার বস্তা কাটা দেখে, ইঁদুরের খাওয়া ধানের তুষ দেখে এদের উপস্থিতি বোঝা যায়। ঘরে বা তার পাশে ইঁদুরের নতুন মাটি অথবা গর্ত, ফসলের মাঠে, আইলে ও জমিতে,  বাঁধ, পুল ইত্যাদির পাশে গর্ত দেখে ইঁদুরের উপস্থিতি বোঝা যায়। ইঁদুর বিভিন্ন ফসলে বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে থাকে।


বিশে^র অনেক দেশ ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর উপদ্রবে অতীষ্ঠ । এর ক্ষতিকর প্রভাব জনস্বাস্থ্যে ও এমনকি প্রাণী স্বাস্থ্যে ফেলছে। ইঁদুর ৬০টির বেশি রোগের জীবাণু বহন, সংরক্ষণ ও বিস্তার করে থাকে। অনেক ধরনের জুনোটিক রোগ, নানা প্রকার চর্মরোগ, কৃমিরোগ, ইঁদুর কামড়ানো জ্বর, জন্ডিস রোগের    জীবাণু ইঁদুর দ্বারা বিস্তার ঘটে। ইঁদুরের মলমূত্র, লোমের মাধ্যমে এসব রোগের জীবাণু বিস্তার ঘটে।
 

ইঁদুর বাহিত রোগ ও তার লক্ষণ
মিউরিন টাইফাস (জরপশবঃঃংরধ ঃুঢ়যর) : সাধারণত এর প্রাদুর্ভাবের রিপোর্ট সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে রয়েছে। ফ্লি (ঋষবধ) পোকার কামড়ে অথবা আক্রান্ত মলের অথবা     দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ফ্লির মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার ঘটে। যদিও এ রোগের কারণে মানুষের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে রোগের লক্ষণ দেখা দেয় কিন্তু মানুষ মৃত্যু হার অনেক কম।
টিক টাইফাস (জরশবঃঃংরধ পড়হড়ৎরর) : কুকুর এ রোগের জন্য প্রধান বাহক, কিন্তু ইঁদুরও গুরুত্বপূর্ণ বাহক হিসাবে কাজ করে। এ রোগে আক্রান্ত টিকে (এক প্রকার কীট) কামড়ানোর ফলে মানুষে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। টিক সমস্ত এশিয়া মহাদেশে এ রোগের বিস্তারে জড়িত।


স্ক্রাব টাইফাস (ঙৎরবহঃরধ  ঃংঁঃংঁমধসঁংযর) :  নানা রকম ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা (রোডেন্ট) সমস্ত এশিয়াজুড়ে এ রোগের প্রধান বাহক বা আধার। ‘চিগার’ (ঈযরমমবৎং) যা বিভিন্ন প্রকার মাকড়ের শূককীট নামে পরিচিত,  ট্রম্বিকিউলিড গণভুক্ত। তাদের কামড়ে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমিত হয়। যদি প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা হয় তাহলে মানুষের মৃত্যু হার কম হবে।
হানট্যান (ঐধহঃধধহ) ভাইরাস বা রক্তক্ষরা জ¦র : হানট্যান ভাইরাস পৃথিবীর অনেক শহরে ইঁদুরের দেহে শনাক্ত করা হয়েছে। এ ভাইরাস সাধারণত পোষক হতে পোষকে আক্রান্ত লালা, মূত্র এবং মলের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে থাকে। কিছু স্ট্রেইনের মানুষের ওপর অল্প-বিস্তর প্রভাব রয়েছে।


কুইন্সল্যান্ড টিক টাইফাস অথবা স্পটেড জ¦র (জরপশবঃঃংরধ ধঁংঃৎধষরং) : এ রোগ সাধারণত অস্ট্রেলিয়া পূর্ব উপক‚ল ধরে নি¤œ অবস্থান পর্যন্ত দেখা যায় এবং এ রোগ ওীড়ফরফ টিকস বহন করে। মারসুপাইয়াল মাইস, ব্যান্ডিকোটস, পুশাম (চড়ংংঁসং),  ইঁদুর এবং মাইস (সরপব) এ রোগ জীবাণুর প্রাকৃতিক বাহক । যদিও এ রোগের কারণে মানুষের মাঝে ব্যাপক লক্ষণ দেখা যায় কিন্তু মৃত্যু হার কম।
লেপটোস্পাইরোসিস (খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং): খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎধ গণভুক্ত নানা রকম স্পাইরোকিটস (ঝঢ়রৎড়পযধবঃবং) জুনোটিক রোগের জীবাণু মাঠের কালো ইঁদুর বহন ও বিস্তার করে। এর রোগের পোষক হিসাবে প্রায় সকল ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর প্রজাতিরা কাজ করে। মানুষ যদি খোলা স্থানে ইঁদুরের প্রস্রাব দ্বারা দূষিত পানি, আর্দ্র মাটি অথবা উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে তাহলে মানুষে সংক্রমণ ঘটে। অধিকাংশ প্রজাতির মৃত্যু হার কম হয়। সাধারণত এ রোগের লক্ষণ ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের অনুরূপ হয় এবং কয়েক দিন হতে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত টিকে থাকে। অনেকে এ রোগের লক্ষণকে আবার ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু জ¦র ভেবে ভুল করে। এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে যারা রোপণকৃত গাছপালা অথবা মাঠে কাজ করে তাদের।


ইঁদুর কামড়ানো জ¦র বা র‌্যাট বাইট ফিভার (ঝঢ়রৎরষষঁস সরহঁং) : এ রোগের বিস্তার সাধরণত ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর কামড়ানোর দ্বারা ঘটে থাকে। স্পাইটোকিটসের (ঝঢ়রৎড়পযধবঃব) কারণে এ রোগ হয়। সমগ্র পৃথিবীতে এ রোগ দেখা যায়। এ রোগ মানব দেহে অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত সুপ্তবস্থায় থাকে এবং ক্ষত সেরে ওঠার/শুকানোর পর উপসর্গ সাধারণত দেখা যায়।
প্লেগ (ণবৎংরহরধ ঢ়বংঃরং) : এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায়।
টক্সোপ্লাজমোসিস (ঞড়ীড়ঢ়ষধংসড়ংরং) : ঈড়পপরফরধহ বর্গের ঞড়ীড়ঢ়ষধংসধ মড়হফর প্রজাতি এ রোগের কারণ । গৃহপালিত বিড়াল এ রোগের প্রাথমিক পোষক । এ রোগের মধ্যবর্তী পোষক ইঁদুর ও মাইসসহ (সরপব) অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী।
সালমোনেলোসিস (ঝধষসড়হবষষড়ংরং): সালমোনেলা (ঝধষসড়হবষষধ) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পৃথিবীব্যাপী মানুষে সংক্রমণ হয়। সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত ইঁদুর ও মাইসের মল দ্বারা দূষিত পানি অথবা খাদ্য গলাধঃকরণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু  এরূপ খাদ্য যা সঠিকভাবে প্রস্তুত নহে তার দ্বারা এ রোগ হতে পারে। অনেক প্রজাতির বিভিন্ন রকমের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।
লাসা জ¦র (খধংংধ ঋবাবৎ) : ১৯৬৯  সালে নাইজেরিয়ার বোর্নো প্রদেশের লাসা শহরে লাসা জ¦র সর্বপ্রথম আবিষ্কার হয়। এ রোগটি লাসা ভাইরাসের এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে হয় । মানুষ লাসার ভাইরাসে আক্রান্ত হয় যদি কোনোভাবে ন্যাটাল মাল্টিম্যামেট ইঁদুরের মলমূত্রের সংস্পর্শে আসে। এছাড়াও  ফাটা বা ক্ষত হওয়া ত্বক অথবা শ্লেষা নিঃসরক ঝিল্লির মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে লাসা জ¦রের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। প্রায় ৯০ জনের অধিক লোক মারা যায় ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ায় প্রাণঘাতী লাসা জ¦রে ।
অন্যদিকে ইঁদুর তিন ধরনের কৃমি বহন করে যেমন- নেমাটোড (কেঁচো কৃমি), ট্রিমাটোড (চ্যাপ্টা কৃমি) এবং সিসটোড (ফিতাকৃমি)। এসব কৃমি বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়, যেমন- অহমরড়ংঃৎড়হমুষঁং পধহঃড়হবহংরং ও ঈধষধফরঁস নবঢ়ধঃরপঁস রোগ। শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হলে মানসিক ভারসাম্যহীন বা হাবাগোবা হয়।

 

বাসাবাড়িতে ইঁদুর দমনে করণীয়
ইঁদুর যেহেতু ময়লা আবর্জনা পছন্দ করে তাই আবর্জনা ফেলার বিন পরিষ্কার রাখতে হবে এবং ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং বাড়িতে ইঁদুরের প্রবেশপথ বন্ধ রাখতে হবে এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। খাদ্যদ্রব্য ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। খাবার তৈরি, খাওয়া ও পানীয় পানের পূর্বে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে এবং খাবার প্লেট ও ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। কোন নির্দিষ্ট স্থানে ইঁদুর কামড় দেয় তাহলে অতি দ্রæত আক্রান্ত স্থান সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে। বাসাবাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে এদের দমন করা যেতে পারে। শহরাঞ্চলগুলোতে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। কারণ ডাস্টবিনগুলো ইঁদুরের বছরব্যাপী খাদ্য ও পানীয় এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। প্রতি বছর মশা নিধন কর্মসূচির মতো ইঁদুর নিধন কর্মসূচী সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে নেয়া যেতে পারে।


একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের কৃষক সমাজের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বর্তমান সরকারের সময় উপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের জনগণের দৈনন্দিন খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পরও উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভবময় হচ্ছে। এর পাশাপাশি শিল্পোৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানী বাণিজ্যে কৃষি খাতের অবদান অনস্বীকার্য। ইঁদুরের সমস্যা এমন একটি সমস্যা যেখানে একজন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরোপুরি দমন সম্ভব নয়। ইঁদুর গর্তে বসবাস করে তাই ইঁদুরের দমনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন যৌথভাবে সমন্বিত এবং সম্মিলিত চেষ্টা এবং পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান   প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযু্িক্ত উদ্ভাবন করে চলেছে যা ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ফলপ্রসূ। আর তাহলে আমরা আশা করতে পারি ইঁদুরের মাধ্যমে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণে ক্ষতি হয়ে থাকে তা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।


কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, মিরপুর, কুষ্টিয়া, মোইল নম্বর- ০১৭৬৮৪৩৬৪৯৩, ই-মেইল : uaomirkush@gmail.com

বিস্তারিত
ভাসমান বেডে ফসল চাষে অন্তরায় ও উত্তরণের প্রযুক্তি

ড. মোঃ শাহ আলম

বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রধান  জনবহুল দেশ। ক্রমবর্ধমান এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, প্রতি বছর শতকরা ১ ভাগ হারে চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়া। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚লীয় অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধ থাকে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে, বন্যা এবং জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের  কৃষির একটি সাধারণ সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের একটি কার্যকরী উপায় হতে পারে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ।


বাংলাদেশে ভাসমান চাষাবাদের ইতিহাস ৩০০ থেকে ৪০০ বছরের পুরনো। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হচ্ছে পিরোজপুর। বঙ্গপোসাগরের পানির লেবেল বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের অনেক নিম্ন এলাকার মতো পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী দোবড়া এবং কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলো জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই এলাকার কৃষকগণ জলাবদ্ধ ও নিম্নাঞ্চলের পানির উপর ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা ও সবজি উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে বিল্পব ঘটিয়েছে। আগে এই এলাকায় গেলে দেখা যেত মাইলের পর মাইল এলাকায় শুধু পানি আর পানি। আর এখন এই এলাকায় গেলে দেখা যাবে পানির উপর ভাসছে বিভিন্ন ধরনের সবজির বাগান। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈরী পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে এই এলাকার কৃষকরা নিজেদের কৌশলে পানির ওপর গড়ে তুলেছেন ভাসমান সবজির বাগান ও বীজতলা। এখানে ২০০ হেক্টর জমিতে এই ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ করা হয়। পানির উপর ভাসমান বাগানগুলোতে কৃষকরা বর্ষার সময় শসা, ঢেড়স, লালশাক ও ডাঁটা শাক উৎপাদন করে থাকে। আর শীতকালে চাষ করে লাউ, শিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শসা, মরমা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ ইত্যাদি শাকসবজি ও মসলার চারা।


সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে লাভজনক ভাসমান চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের বিলঝিল ও বর্ষাকালে সারা দেশের জলাবদ্ধ অঞ্চলগুলোতে এটি বিকল্প চাষাবাদের লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে দেশে দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জলাভূমিতে ভাসমান চাষাবাদ করা হচ্ছে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাভূমি রয়েছে যার ৫০ হাজার হেক্টর এলাকা সফলভাবে ভাসমান চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।


ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষের ক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যা বা অসুবিধার মধ্যে রয়েছে; কচুরিপানার অভাব ও ভাসমান বেডের জন্য এখনও কোনো নির্দিষ্ট আকার নির্ধারণ করা হয়নি, মানসম্মত চারার অভাব, রোপণ বা বপন, ফসল বিন্যাস ও সার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতিতে অনুন্নত কৃষি তাত্তি¡ক পরিচর্যা, ফসলের স্থানীয় ও কম ফলনশীল জাতের বীজের ব্যবহার এবং মানসম্মত চারার অভাব, অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার প্রভৃতি। সেই সঙ্গে রয়েছে ইঁদুর, কার্পজাতীয় মাছ ও রোগবালাই এর আক্রমণসহ নানা সীমাবদ্ধতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা না গেলে দেশ বিদেশে সাড়া জাগানো ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ পদ্ধতি টেকসই হবে না। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং আশা করা যাচ্ছে উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। পাশাপাশি ইঁদুরের উপদ্রব থেকেও ফসল রক্ষা পাবে।


ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষতিকারক প্রাণী যা ফসল বপন থেকে শুরু  করে ফসল কাঁটা ও সংগ্রহ পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে খুব দ্রæত বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। ইঁদুর শুধু ভাসমান বেডে ফসলেরই ক্ষতি করেনা ভাসমানবেডেরও মারাত্ত¡ক ক্ষতি করে থাকে। ভাসমান বেডে কি পরিমান ক্ষতি করে তার সঠিক তথ্য এখনও জানা যায়নি। ভাসমান বেডে বিভিন্ন সবজি ও চারা গাছের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। তাছাড়া ইঁদুর জাতীয় প্রাণী বিভিন্ন রোগের বাহক/ সংরক্ষক হিসাবেও কাজ করে, যেমন- প্লেগ, মিউরিন টাইফাস, লেপটোস্পারোসিস, সালমোনেলোসিস, ইঁদুর কমড়ানো জ¦র, ইত্যাদি। ভাসমান বেডে দুই থেকে তিনটি প্রজাতির ইঁদুর ফসলের বেশী ক্ষতি করে যেমন- মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর ও ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর ।


মাঠের কালো ইঁদুর বা ছোট ব্যান্ডিকুট ইঁদুর
সব রকমের কৃষিজাত ফসলেই এদের পাওয়া যায়। এছাড়া শহর এলাকা, ঘরবাড়ি এবং গুদামেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মাঠের কালো ইঁদুর মাঠ ফসলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির, ওজন প্রায়   ১৫০-৩৫০ গ্রাম, পশম কালো ধুসর রঙের। মাথাও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। এরা সাতারে পটু। লম্বায় ৭.৫-২৫ সেমি.। এরা গর্ত তৈরী করে বসবাস করে। গর্ত ৮-১০ মিটার লম্বা ৭০ সেমি. পর্যন্ত গভীর এবং ৭-৮ সেমি. ব্যাস বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এই ইঁদুর ভাসমানবেডে ফসল কেটে, খেয়ে ও ভাসমানবেড কেটে নষ্ট করে থাকে।


মাঠের বড় কালো ইঁদুর বা বড় ব্যান্ডিকুট ইঁদুর
মাঠের বড় কালো ইঁদুর দেখতে মাঠের কাল ইঁদুরের ন্যায়। কিন্তু তাদের চেয়ে আকারে বেশ বড়, মুখাকৃতি সরু, ৩৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পিছনের পা বেশ বড় এবং কাল হয় বলে সহজেই চেনা যায়। মাথা ও দেহের দৈর্ঘ্য ১৫-৩০ সেমি.। এ ইঁদুরের রং কালচে ধুসর বা তামাটে বর্ণের। মাথা ও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। লেজ বেশ মোটা, লেজের রিং গুলো স্পষ্ট, পিছনের পা বড়, চওড়া ও পায়ের পাতার  নিচের দিকে কালো। বাংলাদেশের সব নিচু এলাকায় এদের পাওয়া যায়।এই ইঁদুর ভাসমানবেডে ফসল কেটে, খেয়ে ও ভাসমানবেড কেটে নষ্ট করে থাকে।


গেছো ইঁদুর/ঘরের ইঁদুর
গেছো ইঁদুর সাধারণত: মাঝারি ধরনের, লম্বাটে, লালচে বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় এদের ওজন প্রায়   ১০০- ১৫০ গ্রাম। শরীরের নিচের দিকটা সাদাটে বা হালকা বর্ণের। দেহের দৈর্ঘ্য ৭-২২ সেমি. মাথা ও শরীরে মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ লম্বা। লেজের দৈর্ঘ্য ৫-২৩ সেমি.। এরা মাটিতে গর্ত না করে ঘরের মাঁচায় বা গুপ্ত স্থানে গাছে বাসা তৈরি করে বংশ বৃদ্ধি করে। এদেরকে সাধারণত মাঠে কম দেখা যায়, তবে বাড়ির আশেপাশে, উচুঁ এলাকায়, নারিকেল ও  বিভিন্ন ফল জাতীয় গাছে বেশি দেখা যায়। এরা ভাসমান বেডের বিভিন্ন সবজি যেমন- লাউ, মিস্টিকুমড়া, চালকুমড়া, শসা এবং চারা গাছের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।


সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা  
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, ইঁদুর দমন একটি পরিবেশগত কৌশল যে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু কোন প্রজাতিকে ধ্বংস করা নয়। ইঁদুর দমনের সবচেয়ে ভাল উপায় হলো, ইঁদুরের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য ও বাসস্থান সম্পর্কে জানা এবং এই সব উপাদানগুলো সীমিত করা যা ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে ইঁদুর দমনের কর্মকৌশল নিজেদের নির্ধারণ করতে হবে এবং নিজেদেরকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতিসমূহকে আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। (ক) পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিক পদ্ধতি (খ) বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুুর দমন ।


ক) পরিবেশ সম্মতভাবে দমন : কোন রকম বিষ ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিকপদ্ধতি।   বিভিন্নভাবে এটা করা যায়। যেমন-


পরিদর্শন ও সজাগ দৃষ্টির মাধ্যমে : ইঁদুর দমনের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ সমস্যা সমন্ধে সর্বদা সজাগ থাকা যার অর্থ হচ্ছে ঘর বাড়িতে বা ক্ষেত খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি, গতিবিধি এবং আক্রমণের তীব্রতার উপর সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং নিয়মিত পরিদর্শন করা। ইঁদুরের উপস্থিতির কোন চিহ্ন দেখা মাত্র তাকে খুঁজে বের করে যে কোন উপায়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা উচিত। এ পরিদর্শন কোন এক এলাকার ইঁদুর দমন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


আশ্রয়স্থল কমানো/বাসস্থান ব্যবস্থাপনা : ভাসমানবেডে অগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে, কারণ ইঁদুর ঝোপলো জায়গা পছন্দ করে।
 

প্রতিবন্ধকতা : ভাসমানবেডে উপযুক্ত পদ্ধতিতে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করা ইঁদুর দমন একটি প্রধান উপায়। ভাসমান বেডের চারপাশে প্রতিবন্ধকতার কৌশল অবলম্বন করে ইঁদুরের ক্ষতি কমানো যায়। যেমন : ক. ভাসমানবেডের চারপাশে পলিথিন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। খ. পানির উপড়ে কাঠের এবং বাঁশের তৈরি স্থাপনার ধাতব পাত বা পলিথিন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে।
 

জৈব নিয়ন্ত্রণ বা পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে ইঁদুর দমন : অন্যান্য প্রাণীর মত ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরও পরভোজী প্রাণী আছে, তন্মধ্যে বিড়াল, বনবিড়াল, কুকুর, খেকশিয়াল, পাতিশিয়াল, বাজপাখী, চিল, প্যাঁচা, বেজি, সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি প্রাণী  ইঁদুর খায়। এ সমস্ত উপকারী পরভোজী প্রাণী মেরে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্যাঁচা ইঁদুরের একটা বড় শত্রæ। ইঁদুরের ক্ষতি করে বলতে প্যাঁচা ইঁদুর খেয়ে বেচে থাকে। আমরা যদি ভাসমান বেডের আশেপাশে বাঁশ দিয়ে প্যাঁচা বসার  ব্যবস্থা করে দেই, তাহলে প্যাঁচা রাতের বেলা বসে ইঁদুর কে খাবে ও ফসলের ক্ষতি কম হবে।


নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতার মাধ্যমে  ইঁদুর দমন : নিবিড়ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরন ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। ফাঁদে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সহজে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন খাদ্যই টোপ হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ শুঁটকি মাছ, বিস্কুট, আলু, পাউরুটি ইত্যাদি। প্রতিদিন নতুন টোপ ব্যবহার করতে হবে।


(খ) রাসায়নিক দমন বা ইঁদুরনাশক দিয়ে দমন : রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহু যুগ ধরে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন চলে আসছে। বিষ ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, (ক) তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (খ) বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ।


ক. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ : যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায় তাদেরকে তীব্র  বিষ বলা হয় যেমন- জিংক ফসফাইড। বিষটোপ তৈরিও খুব সহজ। তাই অতি সহজে কৃষক ভাইরা জিংক ফসফাইড বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে পারে। এই বিষ থেকে তৈরি বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর সাথে সাথেই মারা যায়। এই বিষ ভাসমান বেডের উপর বাঁশের বা প্লাস্টিকের  তৈরি বেইট স্টেশনের পাইপের ভেতর প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এই বিষটোপের প্রধান অসুবিধা হলো বিষটোপ লাজুকতা। বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে ২-৩ দিন    বিষহীন টোপ ব্যবহার করে ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নিলে ইঁদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেড়ে যায়। তবে কোনো ক্রমেই পর পর দু’ তিন রাত বিষটোপ ব্যবহারের পর ঐ স্থানে এক মাস আর এ বিষ ব্যবহার না করাই ভালো।


(খ) দীর্ঘমেয়াদি বিষ : যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না গেলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ২-১৪ দিনের মধ্যে মারা যায় তাদেরকে  দীর্ঘমেয়াদি বিষ বলা হয়। এ ধরনের বিষ খেলে সহসা কোনো আক্রান্ত লক্ষণ ধরা পড়ে না বিধায় পরিবারের অন্যান্য ইঁদুররাও এ ধরনের বিষটোপ খেতে কোনো কুণ্ঠা/দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। ফলে একসাথে অনেক ইঁদুর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের বিষটোপে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। এদেশে ল্যানিরটি,  ক্লেরাট, ব্রোমাপয়েন্ট নামে বিভিন্ন কীটনশকের দোকানে পাওয়া যায়।


ইঁদুর সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তাই এদের সংখ্যা কমিয়ে মূল্যবান ফসল রক্ষা করে খাদ্যাভাব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। কোন  নির্দিষ্ট  একক  পদ্ধতি  ইঁদুর  দমনের  জন্য  যথেষ্ট নয়। ইঁদুর  দমনের  সফলতা  নির্ভর  করে  সকলের  সম্মিলিত  প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের উপর। অতএব সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই ভাসমান বেডে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব। য়
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদন্ডী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৯১১৮৫৭৫৮৬, ই-মেইল :  alamvpd@gmail.com

বিস্তারিত
ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে বাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ

ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে বাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ

ড. সন্তোষ কুমার সরকার
বন্যা দ্ইু রকমের হয়।  পানির বন্যা ও ইঁদুর বন্যা । পানি বেশি হলে অর্থাৎ বর্ষার  সময় অতিরিক্ত পানিতে যখন ফসলের মাঠ, রাস্তাঘাট, তলিয়ে যায়, ঘরবাড়িতে পানি ওঠে তখন বন্যা বলা হয়। সময় ও তীব্রতা ভেদে বন্যার নামকরণ করা হয়। আগাম বন্যা, বিলম্বিত বন্যা, ভয়াবহ বন্যা ইত্যাদি। যখন কোনো এলাকায়  বিপুল সংখ্যক ইঁদুরের উপস্থিতি হয় এবং রাতারাতি ফসল ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি করে তখন ইঁদুর বন্যা হিসাবে অভিহিত   করা হয়। বাংলাদেশে রাঙ্গামাটি, বান্দবান জেলায় ২০-২৫ বছর পর ইঁদুর বন্যা হয়। এ অঞ্চলে যে বছর মলি বাঁশে ফুল ও ফল হয় সেই বছর ইঁদুর বন্যা হয়। মলি বাঁশে ২০-২৫ বছর পরপর  ফুল ও ফল হয়। সব পাহাড়ে বাঁশে ফুল এক সময়ে আসে না। এক পাহাড়ে বাঁশে ফুল ও ফল হওয়া শুরু হয়, এর বেশ কিছু দিন পড়ে  পাশের পাহাড়ে ফুল ও ফল হয়, যা ইঁদুরের  পর্যাপ্ত খাদ্য অনেক দিন ধরে বিদ্যমান থাকে। ইঁদুরের বংশ বিস্তার ঘটাতে পারে। বাঁশের ফুল ও ফল ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। যে বছর ইঁদুর বন্যা হয় সে বছর ঝুম ফসল ও সম্পদের পঙ্গপালের মতো ক্ষতি (৩০-৪০%) করে। বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রতি বছর কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। বর্ষার পানি যখন মাঠের ফসল  ক্ষেতে প্রবেশ করে তখন ইঁদুর বাঁধে, উঁচু জায়গায়, কচুরীপানার দলে, গাছে  এবং   ঘরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ বছরও অনেকগুলো জেলায় বন্যা হয়েছে।
বাংলাদেশে দুই ধরনের ইঁদুরের  সংখ্যা মাঠে বেশি। মাঠের বড় কালো ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর। এরা উভয়ে গর্তে বাস করে। গর্তের মুখের আকার দেখে কোন ইঁদুরের উপস্থিতি রয়েছে তা সহজেই বুঝা যায়। মাঠের বড় কালো ইঁদুরে গর্তের মুখের আকার বড় এবং মাঠের কালো ইঁদুরের গর্তের মুখের আকার অপেক্ষাকৃত ছোট। মাঠের কালো ইঁদুর সাধারণত ঘরবাড়িতে যায় না। এরা বাঁধ, বেড়িবাঁধ, মাঠের উঁচু পতিত ভিটা, উঁচু স্থান, কচুরিপানার দলে, পুকুরের পাড়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে। জোয়ারভাটার এলাকার জোয়ারে সময় গাছে উঁচু ভূমিতে আশ্রয় নিয়ে থাকে। বন্যা হলে বাঁধে, সড়ক-মহাসড়কে আশ্রয় গ্রহণ করে। পানি না কমা পর্যন্ত বাঁধে থাকে। মাঠের বড় কালো ইঁদুর যেখানে অবস্থান করে বা আশ্রয় নিয়ে থাকে সেখানে মাঠের কালো ইঁদুর থাকে না। কারণ মাঠে বড় কালো ইঁদুর মাঠের কালো ইঁদুরকে মেরে খেয়ে ফেলে।
বাঁধ, বেড়িবাঁধ, সড়ক, মহাসড়কে কমবেশি সারা বছরই ইঁদুরের কিছু পপুলেশন থাকে। কিন্তু পপুলেশন সংখ্যা কত এ বিষয়ে কোন গবেষণা তথ্য নেই। তবে জরিপ করে দেখা গেছে বর্ষার সময় প্রতি কিমি. সড়কে ১৫০ সক্রিয় গর্ত আছে। বেড়িবাঁধে ২০০ ইঁদুরের গর্ত রয়েছে। দশমিনা বীজ বর্ধন খামারে খালের পাড়ে উঁচু রাস্তায় দুই পাশে হাফ কিমি. মধ্যে ২৫০ ইঁদুরের সক্রিয় গর্ত জরিপ করে পাওয়া গেছে।
উভয় প্রজাতির ইঁদুর একটি গর্তে একটি থাকে। বাঁধ, সড়কে গর্ত খুঁড়ার ফলে সহজে বাঁধ, সড়কের ভেতর পানি প্রবেশ করে থাকে। বন্যা হলে বাঁধ, সড়ক সহজে ভেঙে যায়। এতে কোটি কোটি টাকার বাঁধ, সড়ক নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষার পানিতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসাবে ইঁদুরকে দোষারোপ করা হয়েছিল। কিন্তু বাঁধ ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত বিভাগের ইঁদুর দমনের কোনো কর্মসূচি নেই। বাঁধের বর্ষার বা বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে ও ইঁদুরের গর্তে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে থাকে। সরকারি বাঁধ ও সড়ক বলে কৃষকগণও এসব স্থানের ইঁদুর মারে না। বর্ষা চলে গেলে এসব স্থানের ইঁদুর আমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে। বাঁধ ও মহাসড়কে ইঁদুর দমনের কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে প্রতি বছর কোটিকোটি টাকার বাঁধ ও মহাসড়ক  বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম থাকবে।
ইঁদুরের তিনটি মৌলিক চাহিদা আছে যথা- বাসস্থান, খাদ্য ও পানি। বন্যার সময় এদের উত্তম বাসস্থান হচ্ছে বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক। মাঠে যখন পানি আসে  ইঁদুর প্রথমে বাঁধের দুই পাশে নিচের অংশে গর্ত খুঁড়ে বাস করে। মাঠে পানি বেশি হলে গর্ত খুঁড়ে  উপরের অংশে যায়। দিনের বেলায় সাধারণত গর্তের মুখ বন্ধ রাখে। মাঠের বড় কালো ইঁদুর পানিতে ডুব দিয়ে নানা রকম খাদ্য যেমন- বিভিন্ন  মাছ, শামুক, পোকামাকড়, কাঁকড়া, জলজ উদ্ভিদ (শাপলা, শালুক)  সংগ্রহ করে। কাজেই খাদ্যের অভাব হয় না। মাঠের কালো ইঁদুরও পানি থেকে ও সড়কের পোকামাকড়, কেঁচো খেয়ে বেঁচে থাকে। এসময় বংশ বিস্তার কম করে। বন্যা বা বর্ষাকাল ইঁদুরের জন্য খুবই খারাপ সময়। কারণ এ সময় প্রাকৃতিকভাবে অনেক ইঁদুর মারা পড়ে।
বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করার জন্য সারা বছরই ইঁদুর মারা কার্যক্রম চালু রাখা প্রয়োজন। কারণ যখন অল্প সংখ্যক ইঁদুর ও গর্ত থাকে, এ সময় বাঁধের  ইঁদুর মারা হলে বৃষ্টির পানি ইঁদুরের গর্তে প্রবেশ করে বাঁধ বা সড়কের ক্ষয়ক্ষতি কম  হবে। বাঁধে ইঁদুর দমনের উত্তম সময় হচ্ছে মাঠে পানি আসার সময়। তবে বর্ষার সময় সব মাসই সপ্তাহে একদিন ইঁদুর মারতে হবে, যে পর্যন্ত মাঠের পানি কমে না যায়।
বাঁধের এত বড় এলাকা ফাঁদ ও গর্ত খুঁড়ে বাস্তবে  ইঁদুর দমন করা সম্ভব হবে না। বিষটোপ এবং গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করে ইঁদুর মারতে হবে। জিংক ফসফাইডেরে  ২% বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। এটির পরীক্ষামূলক উদাহারণ হচ্ছে-বিএডিসির দশমিনা বীজবর্ধন খামারে ২% জিংক ফসফাইড চিংড়ি মাছের সাথে মিশিয়ে প্রতি গর্তে একটি করে বিষ মিশ্রিত চিংড়ি প্রয়োগে  ৮০% ইঁদুর দমন করা হয়েছিল। বিষটোপ প্রয়োগের পরদিন সকালে শতশত কাক ইঁদুর খেয়েছিল। ইঁদুর খেয়ে কাক মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে একটি কাকও মারা যাই নাই। কারণ কাক ইঁদুর খাওয়ার সময় প্রথমে পেটের নাড়িভূড়ি বেড় করে খেয়েছে। ইঁদুরের পেট ছিদ্র করার পর ফসফিন গ্যাস বেড় হয়ে বাতাসের সাথে মিশে গিয়েছিল। শামুকে  ও কাঁকড়ায় জিংক ফসফাইড মিশিয়ে প্রতি গর্তে একটি করে প্রয়োগের অনেক ইঁদুর দমন করা হয়েছিল। চাউল ও গমের সাথে ২% জিংক ফসফাইড প্রয়োগে ২০-৩০% ইঁদুর দমন করা হয়েছে। প্রতিগর্তে একটি করে অ্যালমুনিয়াম  ফসফাইড গ্যাস বড়ি প্রয়োগে ৯০% ইঁদুর দমন সম্ভব হয়েছে।  সক্রিয় ইঁদুরের গর্তে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করে গর্তের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। অর্থাৎ যেকোনো স্থানের গর্তের ইঁদুর মারা কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করা। গ্যাসবড়ি প্রয়োগের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বাঁধ, বেড়িবাঁধ, সড়ক, মহাসড়কের ইঁদুরের পপুলেশন ও ক্ষয়ক্ষতি এবং দমন ব্যবস্থার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।  বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে ও সড়ক ও জনপথ বিভাগে ইঁদুর দমন কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাঁধ ও মহাসড়কের পাশের কৃষকদের ইঁদুর নিধনে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে ইঁদুর উপদ্রবে বাঁধ ও আমন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে। য়

রূƒপায়নলোটাস ৬বি, ১৩ তোপখানা রোড, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭, ই-মেইল : santoshsarker10@gmail.com

 

বিস্তারিত
খাদ্য নিরাপত্তায় সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা

মো: মোসাদ্দেক হোসেন১, ড. শেখ শামিউল হক২ ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন৩

বর্তমান সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিশ^ব্যাপী একটি আলোচ্য বিষয়। কারণ কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে বিশ^ব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ বছর খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রির প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে দ্রæত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম রয়েছে সবার উপরে। বিশেষ করে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে মনে করে সংস্থাটি। বাংলাদেশে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদিত হলেও ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দানাদার ফসল উৎপাদন ও রক্ষার যাবতীয় কৌশল সুচারুভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ফসল উৎপাদন ও রক্ষার বিষয় আলোচনা করতে হলে ইঁদুরকে বাদ রেখে সম্ভব নয়। কারণ উৎপাদন ও গুদামজাতকরণ উভয়ক্ষেত্রেই ইঁদুর খাদ্য প্রাপ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে । উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে রাখতে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো এবং অতিরিক্ত উৎপাদন উপকরণ ব্যবহারের ফলে অন্যান্য বালাইয়ের মতো ইঁদুরের প্রকোপও বেড়ে গেছে।
ইঁদুর একটি পরিচিত বৈশ্বিক প্রাণী, যা মানুষের খাদ্যে ভাগ বসিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় বিঘœ সৃষ্টি করে। ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের অনবরত কাটাকাটির অভ্যাস বিদ্যমান। এর সদা বর্ধিষ্ণু দাঁত আছে। ক্ষয়ের মাধ্যমে দাঁতের এই বৃদ্ধিরোধ করার জন্য ইঁদুর সব সময় কাটাকাটি করে। ইঁদুর খুব চতুর এবং যে কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিয়ে দ্রæত বংশ বিস্তার করতে পারে। এই স্তন্যপায়ী মেরুদÐী প্রাণিটি আমাদের বিভিন্ন ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির ক্ষতি করছে, গুদামজাত শস্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ করছে, আমাদের বাসা বাড়ির আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র এবং বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে, পাশাপশি বাঁধ, রেললাইন, জাহাজ, বন্দর, মাতৃসদন, এরোপ্লেন, সেচের নালাসহ সর্বত্র ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। এক কথায় কোন সম্পদই ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পায় না। প্রায় সমস্ত কৃষি ফসলই ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইঁদুর মানুষ ও গবাদিপশুতে ৬০ ধরনেরও বেশি রোগ ছড়ায়। আমাদের দেশে ইঁদুরের দ্বারা সৃষ্ট ফসলের ক্ষতির নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান যেমন পাওয়া কঠিন তেমন ইঁদুরবাহিত রোগেরও কোন তথ্য পাওয়া যায় না। গুদামে রাখাশস্যে ইঁদুর এর ক্ষতি বা মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণের তথ্যও সংগ্রহ করা হয় না। ইঁদুর দ্বারা ফসলের যে ক্ষতি  হয় তা কমানো গেলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিত হবে আবার অন্যদিকে আয়ও বাড়বে।  ইঁদুরের হাত থেকে গুদামের ফসল রক্ষা এবং খাদ্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ বন্ধ করা গেলে স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগের বিস্তারও কমে যাবে। পোকামাকড়ের তুলনায় ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাত খুব কঠিন মনে হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইহার সংখ্যা লাগসই ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। অনেক সময় আমাদের দেশে ইঁদুরের সমস্যা সমাধানের জন্য কোন চাহিদাও থাকে না। ইঁদুরের সমস্যা গ্রামের লোকজন সঠিকভাবে বুঝতে পারে না, সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় কোন পদ্ধতিও পর্যাপ্ত নয়। তাই এই ক্ষতি স্বাভাবিক হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর ইঁদুর কী পরিমাণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা সঠিকভাবে বুঝে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ধান উৎপাদনকারী এশিয়ার প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে গুরুত্ব¡পূর্ণ বালাই হিসেবে বিবেচনা করে। এসব দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তÍ হতে পারে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। গবেষণা থেকে জানা যায় তিন মাসের জন্য ধান গুদামে রাখা হলে ৫ থেকে ১০ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি কৃষক পরিবারে প্রতি বছরে ২০০ কেজি ধান ইঁদুরের দ্বারা নষ্ট হয়। বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে।  ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। ইরির ২০১৩ সালের এক গবেষণা  মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল ক্ষেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অমেরুদÐী প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। ইঁদুরের দ্বারা বাসা বাড়ির অন্যান্য ক্ষতি, শহর-গ্রামের দোকান, কারখানা, রাস্তাঘাট, সেচনালা, জমির আইলের যে ক্ষতি হয় তা      বেশির ভাগ সময় বিবেচনা করা হয় না। ইঁদুর বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গর্ত করে এবং মাটি সরিয়ে বাঁধ দুর্বল করে ফেলে। ফলে বাঁধ ভেঙে পানি দ্বারা প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর, ফসলাদি ও গবাদিপশুর যে ক্ষতি সাধন করে তার আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যাবে।
ধান ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি
সাধারণত আগাম পরিপক্ব ধানের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। ইঁদুর ধান গাছের কুশি তেঁরছা কোণে (৪৫ ডিগ্রি) কেটে দেয়। গাছে শীষ বের হলে শীষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি ও পাকা শীষগুলো কেটে দেয়। ইঁদুর ধান ফসলে তিন মৌসুমেই আক্রমণ করতে পারে। তবে আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় এসময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। ইঁদুরের প্রজনন শুরুর পূর্বেই ইঁদুর নিধন করা দরকার। তাই আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। কারণ এসময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এসময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি কম হয় এবং  ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। তবে ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। এককভাবে ইঁদুর  দমন খুব বেশি কার্যকরি হয় না। সবাই মিলে একযোগে বেশি জায়গার ইঁদুর মারলে ফসল রক্ষা পায় ও ইঁদুরের সংখ্যা পরবর্তীতে বাড়তে পারে না। এজন্যই প্রতি বছর সরকারিভাবে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। সচেতনতা বাড়িয়ে এটাকে সামাজিকভাবে আরো অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। গ্রামে, শহরে, জমিতে সর্বত্রই একযোগে ইঁদুর  নিধন করতে হবে। ইঁদুর যেহেতু নোংরা স্থান পছন্দ করে, সেহেতু ফসলের মাঠ, বাঁধ, বাড়িঘরসহ ইঁদুরের বংশবিস্তারের সব স্থান পরিষ্কার পরিছন্ন রাখলে বংশবৃদ্ধি কমে আসে। এ ছাড়া ফাঁদ পেতেও ইঁদুর নিধন করা যায়। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  ২) রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন এবং ৩) জৈবিক পদ্ধতিতে দমন।  
অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  
অরাসায়নিক পদ্ধতি হলো ভৌত ও যান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুরের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যেমন-
ি গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা। ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে এবং মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা। জমির আইল চিকন (যেমন ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি), আগাছা এবং আবর্জনা ময়লা মুক্ত রাখা।
ি বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা। যেমন- কেঁচিকল (করষষ ঃৎধঢ়), বাঁশের কল, বাঁশের ফাঁদ, জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ, মাটির ফাঁদ, মাটির চিটাগুড়ের ফাঁদ, তারের ফাঁদ। উক্ত ফাঁদগুলো আবার দুই ধরণের-জীবিত ও মৃত (¯œ্যাপ) ফাঁদ। জীবন্ত ফাঁদে আবার একক ইঁদুর বা বহু ইঁদুর জীবন্ত ধরার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদে খাবার দিতে হয়। খাবার হিসাবে ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈলের মিশ্রণ তৈরি করে নাইলন বা মশারির কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টোপ হিসেবে দিতে হয়। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছ, শামুকের মাংসল অংশ, পাকা কলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলাগাছের ভেলার উপর ফাঁদ স্থাপন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। যখন দলগত বা সামাজিকভাবে বৃহৎ এলাকায় ফাঁদ ব্যবহার করা হয় তখন ইহা খুবই কার্যকরি হয়। কেঁচিকল দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং রাসায়নিক ব্যবহারের তুলনায় সাশ্রয়ী।
ি গাছে ধাতব পাত ব্যবহার করা। গাছের কাÐে পিচ্ছিল ধাতব পেঁচিয়ে রাখলে ইঁদুর গাছে উঠতে পারে না বিধায় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ি গøুবোর্ড ব্যবহার করা। বেডে বা মেঝেতে ইঁদুরের খাবার রেখে চতুর্দিকে গøু বা আঠা লাগিয়ে রাখা। এক্ষেত্রে ইঁদুর খাওয়ার জন্য গøু-এর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আটকে যায়, আটকে পড়া ইঁদুরকে সহজেই মেরে ফেলা যায়।
ি খাদ্য ও তার অবশিষ্টাংশ ঢেকে রাখা। একই এলাকার ধান ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করা।
ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়। বাড়ি-ঘর ও ক্ষেতের আশেপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার রাখা। প্রতিরোধক জাল ব্যবহার করা।
ি ধান ক্ষেতের চারদিকে এক মিটার উচ্চতায় পলিথিন দ্বারা ঘিরে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা।  
ি আগে পাকে এমন স্বল্প জীবনকালের ধান (যেমন ব্রি ধান৬২) চাষ করে ইহাকে ফাঁদ ফসল (ঞৎধঢ় পৎড়ঢ়) হিসেবে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা।
ি বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক (রিপেলেন্ট) যেমন-ভিডিও ফ্লিম টানিয়ে, মানুষের প্রতিকৃতি অথবা আলট্রা শব্দ সৃষ্টি করে জমি থেকে ইঁদুরকে সাময়িক সরিয়ে রাখা যায়। এর কার্যকারিতা তেমন নয় কারণ এতে ইঁদুরের সংখ্যা কমে না বরং দীর্ঘদিন ব্যবহারে এই সমস্ত ডিভাইসের প্রতি ইঁদুর অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমনে তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- ১) একমাত্রা বিষটোপ ২) দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ এবং ৩) বিষ গ্যাস বড়ি ব্যবহার করা হয়।
একমাত্রা বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর একবার খেলেই সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। এরূপ সর্বাধিক পরিচিত বিষটোপ হচ্ছে গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড (২%)। এটি ব্যবহারের কৌশল হলো জিংক ফসফাইড ছাড়া শুধু গম কয়েকদিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করা। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয়। বিষটোপ লাজুকতা হলো-  বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর মরে পড়ে আছে, এটা দেখে জীবিত ইঁদুরের ঐ বিষটোপের প্রতি খাওয়ার অনীহা ।
দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে  মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছুদিন অর্থাৎ ২ থেকে ১৪ দিন পর মারা যায়। যেমন- ল্যানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‌্যাট ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে ইঁদুরের দেহে সৃষ্ট বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ ক্ষতের জন্য অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ইঁদুর দুর্বল হয়ে গর্তের মধ্যে মারা যায়। এখানে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। এই বিষটোপগুলোকে আবার একমাত্রা এবং বহুমাত্রা এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় অর্থাৎ বিষটোপ  ইঁদুরের দেহে কার্যকরি হওয়ার জন্য একমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে একবার এবং বিহুমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে কয়েক বার খেতে হয়। একমাত্রা দীর্ঘ মেয়াদি বিষের মধ্যে, তীব্র বিষক্রিয়া গুণাগুণ বিদ্যামন। তবে এই বিষ একবার খেলে  ২-৩ দিন পরে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটে। এক্ষেত্রে বিষটি কার্যকর হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বার বার প্রয়োগ করতে হয়। যেমন-ডাইফেনাকাম, ব্রোডিফেকাম, ব্রোমাডিওলন ইত্যাদি। বহুমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষের বেলায় বিষ টোপ বার বার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রদান করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ হয়। এ ধরণের বিষটোপ হলো ওয়ারফেরিন, ফিউমারিন, ক্যালসিফেরন এর ০.০২৫-০.০৩৭৫% ঘনমাত্রার কার্যকরি উপাদান। আমাদের দেশের  কৃষক একমাত্রা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষের পার্থক্য সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমাত্রা বিষ প্রয়োগ করে এবং ইঁদুর মরা অবস্থায় দেখতে চায়। আবার একমাত্রা বিষ প্রয়োগের কারণে ইঁদুরের যে আচরণগত পরিবর্তন  (যেমন- বিষটোপ লাজুকতা) হয় সে বিষয়ে তাদের ধারণা কম।
গ্যাস/বড়ি : গ্যাস বড়ি বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন করার মাধ্যমে ইঁদুর মেরে ফেলে। ইঁদুরের গর্তে বিষাক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ ভাল করে বন্ধ করে দিলে ইঁদুর মারা যায়। এ জন্য বারো সিস্টেমের নতুন সচল গর্তে গ্যাস বড়ি দিয়ে আশপাশের সকল গর্তের/নালার মুখ মাটি দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দিতে হবে। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ছাড়াও ফসটক্সিন ট্যাবলেট, হাইড্রোজেন/রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিষটোপ প্রয়োগের স্থান
ইঁদুর নতুন মাটি বের করেছে এধরনের সচল গর্তের ভেতরে বিষটোপ দিতে হবে। একটি গর্তে অনেকগুলো মুখ থাকতে পারে, তবে যে গর্তের মুখে নতুন মাটি পাওয়া যাবে শুধু সেই গর্তের ভেতর বিষটোপ  দিতে হবে। একটি গর্তে জিংক ফসফাইড বিষটোপের একটি টুকরা (কেক) অথবা বড়ি প্রয়োগের পর গর্তের সকল মুখ ভালভাবে বন্ধ করতে হবে। ল্যানির‌্যাট ছোট পাত্রে বা মোটা কাগজের পোটলা তৈরি করে সচল গর্তের মুখে রাখতে হবে।
রাসায়নিক রিপলেন্ট
গুদামজাত বীজে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে তা রিপলেন্ট হিসাবে কাজ করে। যেমন-গেছু ইঁদুর/ঘরের ইঁদুর ম্যালাথিয়ন ব্যবহারিত স্থান এড়িয়ে চলে। এছাড়া দেখা গিয়েছে যে, সাইক্লোহেক্সামাইড ব্যবহৃত এলাকায় ইঁদুরের উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য।
ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময়
১. যে কোন ফসলের থোড় আসার পূর্বে। এ সময় মাঠে ইঁদুরের খাবার কম থাকে বিধায় ইঁদুর বিষটোপ সহজে খেয়ে থাকে। ২. ঘর বাড়িতে সারা বছরব্যাপী ও বর্ষার সময়। ৩. বর্ষার সময় রাস্তাঘাট ও বাঁধে (যখন মাঠে পানি থাকে)। ৪. গভীর ও অগভীর সেচের নালায় প্রথম পানি ছাড়ার দিন।
জৈবিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
জৈবিক পদ্ধতি হলো ইঁদুর দমনে অন্য জীবের সাহায্য নেয়া। ইঁদুরভোজী প্রাণীদের রক্ষা এবং বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। প্যাঁচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, বিড়াল জাতীয় প্রাণীর প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও হাঙ্গেরী মাঠ ফসলের ইঁদুর দমনে প্যাঁচার ব্যবহার করছে। এজন্য তারা প্যাঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালন কার্যক্রমকে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহিত করছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, একজোড়া প্যাঁচা চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চার লালন-পালনে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্যাঁচার প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কোন এলাকায় কোন প্রজাতির প্যাঁচা বেশি তার সঠিক তথ্য জানা নেই। অনেকে প্যাঁচাকে অলক্ষণের প্রতীক মনে করে। কিন্তু প্যাঁচা মানুষের কোন ক্ষতি করে না বরং নীরবে-নিভৃতে ইঁদুর দমন করে মাঠের ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। তাই জন সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এদের সংরক্ষণ ও বংশ বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হবে।
পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা (ঊপড়ষড়মরপধষষু-নধংবফ জড়ফবহঃ গধহধমবসবহঃ, ঊইজগ)
এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ধারণার ওপর ভিত্তি করে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা, আর্থিক লাভ এবং স্থায়ী দমন ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের দেশে ইঁদুর দমনের জন্য মূলত বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার কারণে ইঁদুর দমন কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয় না। প্রাথমিকভাবে রাসায়নিক বিষকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় । রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের ফলাফল প্রায়ই ব্যর্থ হয়। সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার না করা এবং রাসায়নিক বিষে ইঁদুর প্রতিরোধী হয়ে যাওয়াও ইহার অন্যতম কারণ। ফাঁদ ও রাসায়নিক বিষের সাথে সাথে অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারলে আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা টেকসই হবে। জৈবিক পদ্ধতিকে ইঁদুর দমনকে বর্তমান সময়ে ইবিআরএম এর একটি আকর্ষণীয় এবং ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনায় জৈবিক দমন পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করলে দীর্ঘমেয়াদে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে ইহা মূল্যবান কৌশল হিসাবে কাজ করবে। সমকালীন চাষাবাদ, মাঠ এবং বাড়ি ঘরের আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, আইলের প্রশস্ততা ৩০ সেমি. এর কম রাখা এবং সবাই মিলে একত্রে দমন কৌশল গ্রহণ করার মাধ্যমে পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমকে জোরদার করা সম্ভব। য়  
১-৩প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর-১৭০১, মোবা: ০১৭১৫০১১৩৫১, ইমেইল : shamiulent@gmail.com

 

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি (আশ্বিন ১৪২৭)

কার্তিক মাসের কৃষি
১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর

কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

কার্তিক মাসে  প্রকৃতিতে রোদের তেজ কমে গরমের  তীব্রতা কমতে শুরু করে। সোনালী ধানের সম্ভার সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষক মেতে ওঠে ঘাম ঝরানো সোনালী ফসল কেটে মাড়াইঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে। সাথে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠাÐা করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম-২৫, বারি       গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি       গম-৩২, বারি গম-৩৩, ডাবিøউএমআরআই গম-১ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত   ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ণ-১ এসব। খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ আবাদ করতে পারেন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি      সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ইত্যাদি, মধ্যমেয়াদি বারি সরিষা-১৮ এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬ উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি     জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। আগামজাত ও ভালো ফলনের জন্য যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৪১, বারি আলু-৭৪ (বারসেলোনা) বারি আলু-৭৫, বারি আলু-৮৩,বারি আলু-৮৬, বারি আলু-৮৮ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও খাবার উপযোগী হিসেবে বারি আলু-২৫, বারি আলু-২৮,            বারি আলু-৩৫, বারি আলু-৩৬, বারি আলু-৪৬, বারি       আলু-৭৬, বারি আলু-৭৭, বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯, বারি আলু-৮৩, বারি আলু-৮৪, বারি আলু-৮৬, বারি       আলু-৮৭, বারি আলু-৮৯, বারি আলু-৯০, বারি আলু-৯১ ইত্যাদি এসব। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কমবেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টি আলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভালো ফলন দেয়। কমলা সুন্দরী, বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি   আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২, বারি মিষ্টি আলু-১৪   বারি মিষ্টি আলু-১৫ ও বারি মিষ্টি আলু-১৬ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খÐ লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমেটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুঁটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদি প্রাণীকে খরের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদি প্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদি প্রাণীকে বাইরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা না হলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদি প্রাণীকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি  ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশদারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন। এ ছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মৌসুম। শুকনো মৌসুম বলে এ সময় মাটিতে রস কম থাকে। তাই ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে আপনার জমির ফলন অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সব কটি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব।     কৃষির যে কোন সমস্যায় ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা। য়

সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন :০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল: fardousi30@gmail.com

বিস্তারিত