মৃত্যুঞ্জয় রায়
বাংলাদেশের দক্ষিণে সাগর সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হয় উপক‚লীয় অঞ্চল। এ দেশের আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূমি এই এলাকায়। মোট আবাদি জমির প্রায় ৩০ শতাংশ রয়েছে উপক‚লীয় অঞ্চলে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বা লোনাবন সুন্দরবনের অবস্থান এ অঞ্চলে। সাগর, সুন্দরবন, সৈকত, প্রবাল পাথর, দ্বীপ, অসংখ্য নদী-খাল, জোয়ার-ভাটা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ¡াস, ঘূর্ণিঝড়, জলাভ‚মি, জলমগ্নতা ইত্যাদি বৈচিত্র্য উপক‚লীয় অঞ্চলকে দিয়েছে বৈচিত্র্যময় কৃষি পরিবেশ। সাগরের লোনাপানির জোয়ার ভাটায় প্লাবিত এ অঞ্চলের মাটি ও ভ‚মি লবণাক্ত বিধায় সেখানে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বহু রকমের ফসল ও ফল চাষ করা যায় না। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নি¤œ অববাহিকায় অবস্থিত এ অঞ্চল নানা রকম প্রাকৃতি দুর্যোগে মোকাবিলা করে টিকে আছে ও ফসল উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। দেশের আগামী দিনের কৃষিতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে উপক‚লীয় অঞ্চল। এ অঞ্চলের উপযোগী কিছু ফলচাষের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। বিশেষ করে পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, সফেদা, কুল, জাম্বুরা, মাল্টা প্রভৃতি ফল অনেক চাষির ভাগ্য বদলে সহায়ক হয়েছে।
এ অঞ্চলের প্রায় সব বাড়িতে গেলেই দেখা যায় বাড়ির আঙিনাগুলোর অধিকাংশই চম্বল, শিরিষ, মেহগিনি, লম্বু ইত্যাদি বিভিন্ন কাঠের গাছে ভরা। এত ঘন করে গাছগুলো লাগানো যে বাড়িতে রোদ পড়া কঠিন। পিরোজপুর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশালে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। ফলগাছ বলতে এসব বসতবাড়িতে বিলাতি গাব, নারিকেল, পেয়ারা, সুপারি ইত্যাদি গাছের প্রাচুর্য দেখা যায়। অথচ উপক‚লীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা সহ্য করে দামি ফল সফেদা ভালো হয়, সম্প্রতি মাল্টাও ভালো ফলন দিচ্ছে। তাই এ অঞ্চলের বসতবাড়ির জন্য উপযুক্ত ফলগাছ নির্বাচন করে আধুনিক নিয়মে চাষ করতে পারলে বহু রকমের ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। উপকূলীয় অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সুগম নয়। তাই ফলের মতো দ্রæত পচনশীল পণ্য সুদূর উত্তরবঙ্গের শিবগঞ্জ থেকে মনপুরার সাকুচিয়া বা স›দ্বীপের লোকদের খাওয়ানো সহজ নয়। এজন্য এ অঞ্চলে যেসব ফল ভালো হয়, স্থানীয়ভাবে সেসব ফলের পরিকল্পিত চাষের ওপর গুরুত্ব অবশ্যই দিতে হবে।
এ দেশের প্রায় ২৮% মানুষ উপক‚লীয় অঞ্চলে বসবাস করে। এসব মানুষদের অধিকাংশই দরিদ্র। পেশায় প্রধানত কৃষক, জেলে ও শ্রমিক। জমি থাকলেও সেসব জমিতে লবণাক্ততার প্রভাবে সারা বছর বহুমুখী ফসল চাষ করা কঠিন, বিশেষ করে ফল। প্রধান ফসল আমন ধান ছাড়া অন্য ফসল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হয় না। লবণাক্ততা ও নিচু জমির কারণে ফলচাষ করা কঠিন। তাই ফল উৎপাদনের প্রধান সুযোগ বা উৎস হলো এ অঞ্চলের বসতবাড়ির আঙিনাসমূহ। ফল উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য প্রথমে বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে ফলচাষের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর নিচু জমিগুলোর যেসব স্থান মাছের ঘের গড়ে উঠেছে, সেসব ঘেরের পাড়ে কুল, পেয়ারা, কলা, নারিকেল ইত্যাদি ফলের বাগান করে ফল উৎপাদন বাড়াতে হবে। এরপর কাঠের গাছ লাগানো হচ্ছে যেসব জমিতে- সেখানে কাঠের গাছের সাথে ফলের গাছ লাগিয়ে এগ্রো ফরেস্ট্রি করতে হবে। এমনকি মাঝারি নিচু ধানের জমিতেও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে পিরামিড রেইজড বেড পদ্ধতিতে ক্ষেতের মাঝে মাঝে মাটির ঢিবি তৈরি করে সেখানে ফলগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নিচু জমি, যেখানে প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটা চলে সেখানে নালা কেটে তার মাটি পাশে স্ত‚প করে উঁচু বেড করে সর্জন পদ্ধতিতে ফলগাছের নার্সারি ও ফলবাগান করা যেতে পারে। তবে এসব উদ্যোগ নেয়ার আগে দেখতে হবে যে উপক‚লীয় অঞ্চলে আসলে কোন কোন ফল ভালো হয়।
উপক‚লীয় অঞ্চলের ফল
উপক‚লীয় অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুতে এখন অনেক ফলই ভালো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, লতাচাপালী, ভোলার চর ফ্যাশন ইত্যাদি স্থানে এখন প্রচুর পরিমাণে তরমুজের চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে কি কি ফল ভালো হয় তা এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি ও ঘেরগুলো ঘুরে একটু জরিপ চালালেই বুঝা যায়। এর জন্য খুব বেশি গবেষণার দরকার হয় না। তারপরও নতুন ফল বা নতুন জাতের ফল চাষ সম্প্রসারণে অবশ্যই স্থান উপযোগী বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি গবেষক মোঃ ওহিউল ইসলাম ও তাঁর সাথীরা ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার বসতবাড়ি সমূহের ওপর এক গবেষণা কর্মসম্পাদন করে তার চমৎকার ফলাফল তুলে ধরেছেন তাদের গবেষণাপত্রে। তারা এ তিনটি জেলার বসতবাড়িসমূহে মোট ৩২ প্রজাতির ফলগাছ দেখতে পেয়েছেন। এসব ফলগাছসমূহ হলো নারিকেল, সুপারি, বিলাতিগাব, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম্বুরা, তাল, আমড়া, তেঁতুল, বরই/কুল, জামরুল, কামরাঙা, লেবু, খেজুর, কালোজাম, ডেউয়া, চালতা, লিচু, জলপাই, আমলকী, আতা, কাউফল, বেল, সফেদা ডালিম, শরিফা, গাব, কমলা, মাল্টা, কদবেল ও গোলাপজাম। দ্বীপসমূহের বসতবাড়িতে ফলগাছ কম রয়েছে। যেমন স›দ্বীপের বসতবাড়িসমূহে ১৯ প্রজাতির ফলগাছ রয়েছে। দ্বীপসমূহে নারিকেলগাছের প্রাধান্য বেশি। এ তালিকার বাইরেও কিছু ফল উপক‚লীয় অঞ্চলের বসতবাড়িসমূহে চাষ হচ্ছে বা চাষ করা যেতে পারে, যেমন- পেঁপে, স্ট্রবেরি, কলা, অরবরই বা নোয়াল, বিলিম্বি, জংলিবাদাম, পানিফল, আমরুল, বৈঁচি, লুকলুকি, বাঙ্গি, মরমা ইত্যাদি। ঘেরের পাড়ে কুল, কলা ও আ¤্রপালি আম চাষে বেশ সাফল্য দেখা যাচ্ছে। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার ঘেরগুলোর পাড়ে নারিকেল চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে। কক্সবাজার, বাগেরহাট, নোয়াখালী, বাগেরহাটে সুপারি খুব ভালো হচ্ছে। পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠিতে বিলাতি গাব ভালো হচ্ছে। খুলনায় নোয়াল ও বিলিম্বি চাষে ভালো ফল দেখা গেছে। পিরোজপুরে মাল্টার বাণিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে। সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে এখন পানিফলের চাষ হচ্ছে।
এ অঞ্চলে সুন্দরবনের কিছু গাছ আছে যেগুলোর ফল খাওয়া যায়। এমনকি বনজ সেসব ফল থেকে আচার তৈরি করা যায়। বিশেষ করে কেওড়া ও গোলপাতা গাছ। এ দুটি গাছের ফল খাওয়া যায়। সুন্দরবনের আর একটি বুনোফল মামাকলা। এ গাছও বসতবাড়ির জঙ্গলে হয়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এটি একটি জনপ্রিয় ফল।
বিস্ময়কর হলেও সত্য ৯৭.৩৩% বাড়িতে গবেষকরা আমগাছ দেখতে পেয়েছেন। উপক‚লীয় অঞ্চল আমচাষের জন্য উপযোগী নয়, এমন ধারণাই এতকাল ছিল। বিশেষ করে জলমগ্নতা, জোয়ারভাটার প্লাবন, লবণাক্ততা, আমের মুকুল আসার সময় গরম আবহাওয়া, অধিক ঝড়বাতাস, আমের পোকা ইত্যাদি কারণে উপক‚লীয় অঞ্চলে অতীতে আম উৎপাদন ভালো হতো না। কিন্তু এখন কিছু কিছু জাতের আম বিশেষ প্রযুক্তি মেনে চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরার আম এখন ইউরোপের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। সেখানকার গোবিন্দভোগ, বোম্বাই, আ¤্রপালি, লতাবোম্বাই, নীলাম্বরী ইত্যাদি জাতগুলো বেশ ভালো ফলন দিচ্ছে। উপক‚লের বসতবাড়িসমূহে ইতোমধ্যে আ¤্রপালি জাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ও ভালো ফল দিচ্ছে। বারি আম ৪ জাতটিও এ অঞ্চলে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৯০% ও ৯২% বাড়িতে যথাক্রমে জাম্বুরা ও পেয়ারাগাছ রয়েছে, আমড়া আছে ৭২% বাড়িতে। এ তিনটি জেলার ৪২% বাড়িতে লিচুগাছ থাকলেও ফল ভালো হয় না। থাই পেয়ারা চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে পুকুরপাড়ে থাই পেয়ারা, পেঁপে, ডোয়ার্ফ নারিকেল ইত্যাদি চাষ করা যায়। সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক ফল সফেদা আছে মাত্র ৩০% ও কদবেল আছে ১২% বাড়িতে। এ দুটি ফলকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বসতবাড়িতে চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি বিভাগের গবেষকবৃন্দ লবণাক্ততা সইতে পারে পেয়ারা, কাঁঠাল, স্যাপোডিলা বা সফেদা, কুল, জাম্বুরা- এই পাঁচটি ফল নিয়ে গবেষণা করে এসব ফলের কিছু নতুন জাত উদ্ভাবনের পথে রয়েছেন। লবণাক্ততা শুধু এসব ফল চাষের অন্তরায় নয়, এসব ফলের স্বাদও লবণাক্ততার প্রভাবে কমে যায়। তারা আশা করছেন, হয়তো আগামী তিন বছরের মধ্যে উপক‚লীয় অঞ্চলের কৃষকরা এসব নতুন জাতের ফল চাষ শুরু করতে পারবেন। সেসব ফলের স্বাদও যাতে ভালো হয় সেজন্য তাঁরা গবেষণায় সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
উপক‚লীয় অঞ্চলে ফল চাষ সম্প্রসারণে করণীয়
*উপক‚লীয় অঞ্চলে ফল উৎপাদনে বসতবাড়ির আঙিনাকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। প্রতিটি বসতবাড়ির বাগান থেকে শুধু সুপারি নয়, বারো মাস পাওয়া যায় এমন ফলগাছ নির্বাচন করতে হবে।
*যে ফলের যে জাত এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে ভালো হয় সেসব জাত নির্বাচন করতে হবে।
*পরীক্ষামূলকভাবে কিছু নতুন ফল নিয়ে এ অঞ্চলে সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে গবেষণা করা যেতে পারে। যেমন ড্রাগন ফল।
*এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে কাঠ ও ফলগাছের বর্তমান গড় অনুপাত ৫ঃ১। অর্থাৎ এখনো এ অঞ্চলের মানুষ ফলের চেয়ে কাঠের গাছ লাগাতেই বেশি আগ্রহী। অনেকেরই ধারণা, কাঠের গাছ ঝড়-ঝাপটা থেকে বাড়িকে রক্ষা করবে। এ ধারণা থেকে তাদের বের করে আনতে হবে ও ফলগাছ রোপণের বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিয়ে হলেও ফলগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
*বহুস্তরী ফলগাছ মডেল বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
*এগ্রো ফরেস্ট্রি বা ফসলের জমিতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে কিছু ফলগাছ লাগাতে হবে।
*ফলচাষের কিছু বিশেষ কৌশলের প্রবর্তন বা সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে নিচু জমিতে সর্জন পদ্ধতিতে ফল চাষ, ডোয়ার্ফ হাইব্রিড নারিকেল চাষ, পিরামিড বেডে ফল চাষ, ঘেরের পাড়ে ফল চাষ, রাস্তার ধারে নারিকেল, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া ইত্যাদি ফল চাষ করার কথা ভাবতে হবে।
*এ অঞ্চলের কোনো বসতবাড়ির ফলগাছে সাধারণত কোনো পরিচর্যা করা হয় না, সার- সেচ দেয়া হয় না। বসতবাড়িতে বিদ্যমান ফল গাছসমূহের সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।
*কিছু কিছু ফলকে বাণিজ্যিক গুরুত্ব দিয়ে চাষের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন- কুল, সফেদা, পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, মাল্টা, আম ইত্যাদি। সম্ভব হলে ছোট আকারে এসব ফলের প্রদর্শনী স্থাপন করে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
*উপকূলীয় অঞ্চলে ফলগাছে ও ফলে উত্তরাঞ্চলের চেয়ে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। সেজন্য কৃষক প্রশিক্ষণসহ সেসব বালাই ব্যবস্থাপনার কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপক‚লীয় অঞ্চলে ফলচাষ সম্প্রসারণে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত চারাকলমের উৎপাদন করা দরকার। ফলের চারা কলম উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চলে কিছু উপজেলায় ইতোমধ্যে নার্সারি ব্যবসা রীতিমতো শিল্পে রূপ নিয়েছে (স্বরূপকাঠি দৃষ্টান্ত)। তবে সেখানে মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নার্সারি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারসমূহে মাতৃবাগান করে সেখান থেকে উন্নত জাতের সায়ন বা কলমদ্রব্য স্থানীয় নার্সারি কর্মীদের কাছে সরবরাহ করা যেতে পারে।
ি ফলভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে এ অঞ্চলের মানুষের আয় বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে নারিকেলভিত্তিক বহুমুখী শিল্প (পিরোজপুরের নেছারাবাদের দৃষ্টান্ত), পেয়ারার জ্যাম-জেলি, অরবরই, বরই, কেওড়া, কাউফল ইত্যাদির আচার তৈরির কারখানা স্থাপন করা যায়।
সর্বোপরি উপক‚লীয় অঞ্চলে চাষের উপযোগী ফলগাছ বাছাই ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফলের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই আমাদের দেশের মতো উপক‚লীয় অঞ্চল রয়েছে। সমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় সেসব দেশে উপক‚লীয় অঞ্চলে ফলচাষের অগ্রসরমান অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। য়
উপপরিচালক (এলআর), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। ঔষধি গাছ (১ম ও ২য় খÐ), ডাল, তেল ও মসলা ফসল চাষ, ফলের রোগ, ধানের রোগ, শাকসবজির পোকামাকড় ইত্যাদি বইয়ের লেখক। মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭ মোবাইল : kbdmrityun@yahoo.com
কৃষিবিদ মীর নূরুল আলম
খাদ্য ও পুষ্টির অন্যতম উৎস হলো ফল। ফল আবাদের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু খুবই উপযোগী। বাংলাদেশের ফল স¦াদে, গন্ধে, বর্ণে ও পুষ্টিমানে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়। ফলদবৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস হিসাবে কাজ করে। তাছাড়া ফলের ভেষজ গুণাবলিও অনেক। আমাদের খাদ্য, পুষ্টি, ভিটামিনের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধে ফলের ভ‚মিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে ফলের প্রায় ১৩০ প্রজাতি রয়েছে যার মধ্যে ৭০টি ফলের চাষ হয়। পুষ্টিবিদদের মতে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মাথাপিছু দৈনিক ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে ফলের প্রাপ্যতা মাত্র ৭৮ গ্রাম/প্রতিদিন/প্রতিজন। ফল আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির একটি অন্যতম উৎস। বছরব্যাপী পুষ্টির নিশ্চয়তার জন্য সারা বছর সুষমভাবে ফল উৎপাদন হওয়া দরকার । জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফলের প্রাপ্যতা শতকরা ১৯ ভাগ, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ফলের প্রাপ্যতা শতকরা ৬০ ভাগ এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফলের প্রাপ্যতা শতকরা ২১ ভাগ। শীতকালে ফল প্রাপ্তির পরিমাণ কম। এই সময়ে ফল খাওয়ার সুযোগের অভাবে মানুষের বিশেষ করে দেশের গ্রামীণ মা ও শিশুদের অপুষ্টি জনিত রোগ লক্ষ্য করা যায়। তাই বিকল্প খাদ্য হিসাবে ও সুষম খাবার গ্রহণে ফলের অবদান অতুলনীয়।
ফলই বল। প্রতিটি মানুষের সুস্থ সবল থাকার জন্য ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিশেষত ভিটামিন, খনিজ এর অন্যতম উৎস ফল। এছাড়াও আমিষ, শর্করা, চর্বি, পানি এর সহজ উৎস হলো ফল। ফল আমরা কাঁচাপাকা অবস্থায় সরাসরি খেয়ে থাকি। ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের অপচয় কম হয়। রান্না করতে হয় না বলে ভিটামিন সি বিনষ্ট হয় না। তাই পুষ্টির নিশ্চয়তায় ফলই উত্তম। ফলে বিদ্যমান জৈব এসিড ও এনজাইম হজমে সাহায্য করে। লেবু জাতীয় ফলে সাইট্রিক এসিড, তেঁতুলে টারটারিক এসিড থাকে। ফলে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার খনিজ উপাদান ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস দেহের বিপাক কার্যাবলি স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ফলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এতে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। ১ হেক্টর জমিতে ফল উৎপাদনের জন্য বার্ষিক দিনে ৮৬০ জন লোকের দরকার হয়। ২০০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৩০০৪.৪৯৯ মেট্রিক টন ফল বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ফলের আওতাধীন জমির পরিমাণ (বাণিজ্যিক ফল বাগান ও বসতবাড়ি বাগানসহ) ছিল ৭.২৪ লাখ হেক্টর এবং তা থেকে ১২১.১৩ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। (বাংলাদেশের ফল উৎপাদনের তথ্যাবলি ছকে দেয়া হয়েছে।)
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি)-২ তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মান উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। টেকসই উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়নের আর একটি প্রধান লক্ষ্য। খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য্য উপাদান হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন। তাই নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সাধারণত ফল গাছ লাগানোর ২-৪ বছর পর ফল পাওয়া যায়। উৎকৃষ্ট মানের ফল পেতে আমাদের যে বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তা হচ্ছে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার, বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে উন্নত মানের উৎকৃষ্ট জাতের সুস্থ সবল চারা কলম সংগ্রহ করা, সঠিকভাবে গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ, সময়মতো ও সঠিক দূরত্বে রোপণ, খুঁটি এবং খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করা, রোপণকৃত চারার যথাযথ যতœ নেয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, প্রয়োজনে চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, সুষম মাত্রায় জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার, প্রয়োজনীয় সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করা, এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎব চৎধপঃরপবং (এঅচ) পদ্ধতি অনুসরণ করা ইত্যাদি।
সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে অনন্য ভ‚মিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম, বিশেষ করে আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত আমের পরিমাণ ছিল ১২.৮৮ লাখ মেট্রিক টন। বসতবাড়িতে ফলবাগান স্থাপন, নগরীতে ছাদবাগান স্থাপন বর্তমানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সারা দেশে নারিকেল, তাল ও খেজুর চাষ বৃদ্ধিও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দেশি প্রচলিত, অপ্রচলিত ফলচাষে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে ও বিদেশি ফল চাষে উৎসাহ অব্যাহত রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের দপ্তর ও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যানতাত্তি¡ক ফসলের উৎপাদন বাড়াতে যে সকল কাজ করা হচ্ছে-
১. ফল গাছের উন্নত মানের চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ;
২. জাতীয় পর্যায়ে ফল, সবজি, মধু মেলার আয়োজনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা;
৩. জেলা, উপজেলা পর্যায়ে বৃক্ষ মেলা ও বৃক্ষ রোপণ পক্ষ পালনের মাধ্যমে বৃক্ষ রোপণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
৪. প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করে চাষিদের দক্ষ করে গড়ে তোলা;
৫. প্রকল্পের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফল বাগান সৃজন ও উচ্চমূল্যের সবজি উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করা;
৬. নতুন ফল ও ফলের নতুন নতুন জাত সম্প্রসারণ ( যেমন-ড্রাগনফ্রুট, জাবাটিকাবা, রাম্বুটান, এভোকেডো);
৭. খাটো জাতের নারিকেল সম্প্রসারণ;
৮. পাহাড়ে ফল বাগান সৃজন;
৯. বসতবাড়িতে ব্যাপক ফল গাছ রোপণ;
১০. ছাদে বাগান;
১১. সৌদি খেজুরসহ রাস্তার দু’পাশে ধারে তাল-খেজুর গাছ রোপণ।
পরিকল্পিত ফল চাষ যোগাবে পুষ্টি সম্মত খাবার। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ফল উৎপাদন ও সম্প্রসারণের জন্য কতিপয় বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন । তা হলো বছরব্যাপী ফলের প্রয়োজনীয় প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, বানিজ্যিক ফল বাগান করার সময় আগাম, মধ্যম ও নাবী জাতের বিষয়গুলি বিবেচনা করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল গ্রহণে সাধারন জনগণকে সচেতন করা, ফল সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ফল সম্প্রসারণে ভবিষ্যতে যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে তা হলো- হাইব্রিডাইজেশনের মাধ্যমে নারিকেল চারা হর্টিকালচার সেন্টারে উৎপাদন; টিস্যুকালচার ল্যাব স্থাপন ও পেঁপে, কলা, আনারস চারা উৎপাদন; আম ও পেয়ারা রপ্তানির উদ্দেশ্যে উৎপাদন; ফল আমদানি কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা; ফলের মৌসুম বৃদ্ধি করা যেমন-মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আম উৎপাদনের ব্যবস্থা করা, লিচুর মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করা; ফ্রুট জোনিং করা; পাহাড়ি এলাকাকে ফল চাষের আওতায় নিয়ে আসা; ফলের নতুন নতুন উন্নত জাত সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ ফল উৎপাদনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, ফেরোমন ফাঁদ, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (ওহঃবমৎধঃবফ চবংঃ গধহধমবসবহঃ (ওচগ), সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (ওহঃবমৎধঃবফ ঈৎড়ঢ় গধহধমবসবহঃ (ওঈগ), উত্তম কৃষি পদ্ধতি (এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎব চৎধপঃরপবং (এঅচ) ইত্যাদি ব্যবহার করে যথাসম্ভব বালাইনাশকের ব্যবহার মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নিরাপদ ফল উৎপাদন ও তার সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে সম্ভাবনাময় দেশ হিসাবে ভ‚মিকা রাখতে পারে। য়
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১৪০৮৫০, মেইল : dg@dae.gov.bd
মো. মনজুরুল হান্নান
কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। খাদ্য শস্য, উদ্যান ফসল, পাট, চা, পোলট্রি, ডেইরি, ফিশারিজ, বনজবৃক্ষ, মধু ইত্যাদির সমন্বয়ে এদেশের কৃষি খাত। বাংলাদেশে কৃষিপণ্য এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ কৃষিনির্ভর শিল্পের সম্ভাবনা ব্যাপক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে চলছে। যার কারণে মানুষের খাদ্যোভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ এখন প্রক্রিয়াজাত কৃষিজ খাদ্যসামগ্রীর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। একইভাবে উন্নত বিশ^ এমন কি উন্নয়নশীল দেশসমূহে জবধফু ঃড় ঊধঃ এবং জবধফু ঃড় ঈড়ড়শ পর্যায়ের খাদ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক খাদ্য পণ্য, জবধফু ঃড় ঈড়ড়শ এবং জবধফু ঃড় ঊধঃ পর্যায়ে খাদ্য সামগ্রী উৎপাদনে ছোট বড় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
কৃষিজ খাদ্যের নতুন নতুন আইটেম তৈরি ও পরিবেশবান্ধব প্যাকেটজাত করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডের কৃষিজ খাদ্য পণ্য।
কৃষিজ খাদ্যের নতুন নতুন আইটেম তৈরি ও পরিবেশবান্ধব প্যাকেটজাত করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডের কৃষিজ খাদ্য পণ্য রপ্তানিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের তালিকা ছক-১-এ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য শিল্পের কাঁচামাল জোগানদানে সক্ষম। প্রাথমিক কৃষি পণ্যের মূল্য ও বিপণন নিশ্চিয়তা প্রদান করা হলে খাদ্য শিল্পের মূল কাঁচামালের জোগান নিয়ে তেমন কোন সমস্যা হবে না। দেশের এ সক্ষমতার কারণেই খাদ্য শিল্প বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক কৃষি পণ্যের মান নির্ধারণ করা জরুরি। এজন্য কৃষি পণ্য উৎপাদনে এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎব চৎধপঃরপব এবং ঈড়হঃৎধপঃ ঋধৎসরহম প্রবর্তন সময়ের দাবি। বিএসটিআই কর্তৃক বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের ইউঝ ঝঃধহফধৎফ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে খাদ্যের নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষণ ল্যাব অ্যাক্রিডিটেশনকরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ইন্সটিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এর ল্যাবরেটরিসমূহের জনবল ও পরীক্ষা যন্ত্রপাতির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ চলমান। বাংলাদেশে খাদ্য শিল্পের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিনিয়োগ বোর্ড, বিডা, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিসিক, বিএসটিআই, এফএসটিআই, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে চলেছে।
বাংলাদেশ হতে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র ১১৮টি দেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশি খাদ্য পণ্য ঊঃযহরপ মার্কেট এর পাশাপাশি টঢ় ঝঃৎবধস মার্কেটে প্রবেশে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশে কম্পোজিট ফুড ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশি কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের প্রধান প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে ইউএই, সৌদিআরব, কাতার, ইউএসএ, কানাডা, ইউকে ইত্যাদি দেশ।
হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৃষিপণ্য রপ্তানিতে প্রযুক্তি গত ও বিশেষায়িত পরামর্শমূলক সেবা দিয়ে চলেছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো গুণগত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তাজা, প্রক্রিয়া জাতকৃত ও হিমায়িত শাকসবিজ, ফলমূল, আলু ও অন্যান্য কৃষিপণ্য সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা এবং বাজারজাতকরণে কৃষক, উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের দক্ষতাউন্নয়ন, পরামর্শ, বাজার তথ্য ও প্রযুক্তিগত সহায়তা সেবা প্রদান করা। এর মাধ্যমে আগামী দিনে দেশে এবং বিদেশে কৃষি পণ্যের বাজার বিকশিত এবং স্থিতিশীল হয়ে বাণিজ্যিক কৃষি স্থায়িত্ব রূপ পাবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সেচ ভবন, মানিকমিয়া এভিনিউ, ঢাকা। ফোন : ৯১২৫১৮১, ই-মেইল : hortex@hortex.org
তৌহিদ মোঃ রাশেদ খান
ফল আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির একটি অন্যতম উৎস। প্রতি বছর সঠিক সংরক্ষণের অভাবে আমাদের দেশে প্রচুর ফল নষ্ট হয়। ফল সংরক্ষণ করার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং। প্রক্রিয়াকরণ এবং সঠিক প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে ফল সংরক্ষণ করে বছরব্যাপী ফলের পুষ্টিগুণ গ্রহণ করা সম্ভব। এ ছাড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং পণ্যের গুণগত মান এবং মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে। আর এভাবে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং করার সহজ নামই ফ্রেশকাট।
ফ্রেশকাট ফল কি : সতেজভাবে এবং স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান বজায় রেখে তাজা ফলকে ব্যবহার উপযোগী টুকরা করে কোন প্যাকেট বা মোড়কে সুসজ্জিত অবস্থায় ভোক্তার নিকট উপস্থাপনকেই বলা হয় ফ্রেশকাট।
ফ্রেশকাট ফলের প্রধান বৈশিষ্ট্য
ফলগুলো অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে; প্রয়োজন মতো খোসা ছাড়াতে হবে; সুবিধাজনক আকারে কাটা ও বাছাই করতে হবে; নিশ্চিত খাওয়ার উপযোগী হতে হবে; আধুনিক মোড়কীকরণকৃত হতে হবে।
বিভিন্ন ফলের পুষ্টি ও ঔষধিগুণ
ফলে রয়েছে নানা রকম ভিটামিন ও মিনারেল। যা আমাদের পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শারীরিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই আমাদের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় কিছু ফল রাখা দরকার। ফলের দেশ বাংলাদেশ। প্রতিটি দেশীয় ফলেরই রয়েছে অনেক পুষ্টিমান ও বহুমুখী ব্যবহার। পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল নিয়মিত গ্রহণ না করে আমরা একদিকে যেমন শরীরের ক্ষতি করছি তেমনি ফল উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারছি না। অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ফল উৎপাদন ও ভোগ ব্যবহারের চিত্র ছকে দেয়া হয়েছে।
ফ্রেশকাট ফলের প্রয়োজনীয়তা ও সুবিধা : ফ্রেশকাট ফলের প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে এটি কর্মব্যস্ত জীবনে কাটাকুটির ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি খাওয়ার উপযোগী, সহজ সংরক্ষণ, অপচয় হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব। তাছাড়া এর সুবিধাসমূহ হলো এটি পরিমাণ মতো ক্রয় করা যায় ফলে অর্থ সাশ্রয় ও অপচয় কম হয়, গুণাগুণ অক্ষুণœ থাকে, রেডি টু ফুড, বাছাইকৃত ও কাটাকুটির ঝামেলামুক্ত এবং সহজে বহনযোগ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্রেশকাট ফল বিপণনের অবস্থা : ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে স্বল্প পরিসরে ফ্রেশকাট ফল বিপণন শুরু হয়েছে। ৪-৫ বছর পূর্ব থেকে ঢাকায় অবস্থিত সুপার শপগুলো সীমিত আকারে ফ্রেশকাট ফল বিক্রি করলেও তেমনভাবে বাজার স¤প্রসারণ হয়নি। তবে প্রাচীনকাল থেকেই আমড়া, পেয়ারা, বড়ই, বাতাবি লেবু, কাঁচা আম, কালোজাম পথেঘাটে কেটে, সুস্বাদু উপায়ে মসলা যুক্ত করে বিক্রির প্রচলন আছে। কিন্তু এই খাবারের ফ্রেশনেস বা সতেজতা, স্বাস্থ্যগত দিক এবং সর্বোপরি পুষ্টিমান নিয়ে সচেতন মহলে মতভিন্নতা আছে। ফ্রেশকাট ফল বিপণন জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দীর্ঘদিন থেকে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ধারাবাহিকতায় অধিদপ্তর জুলাই, ২০১৬ হতে জুন, ২০১৯ পর্যন্ত ৩ বছর মেয়াদে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে- যা ঢাকা, খুলনা, কুমিল্লা, রংপুর ও নরসিংদী জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফ্রেশকাট ফল ও সবজি বিপণনে কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
এলাকায় মার্কেটিং গ্রæপ গঠন করা। মার্কেট লিংকেজ স্থাপনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কৃষক গ্রæপ সদস্য, সুপারশপ প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ইত্যাদিগণের সমন্বয়ে ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাতকরণ কলাকৌশল ব্যবস্থাপনা, মূল্য সংযোজন কার্যক্রম, কৃষি ব্যবসা উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান। গ্রæপ ভুক্ত কৃষকদের সমন্বয়ে ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম। ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূলের ব্যবহার ও জনসচেনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস, জনসমাগমপূর্ণ উল্লেখযোগ্য স্থানে স্টল স্থাপন করে খাদ্য প্রদর্শনীর আয়োজন।
কর্মসূচি এলাকার প্রতিটি গ্রæপ হতে স্থানীয় সদস্য, বাজারকারবারী ও ব্যবসায়ী সদস্যদের সমন্বয়ে মোটিভেশনাল ট্যুরের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বাজার স¤প্রসারণ ও উৎপাদিত পণ্য লাভজনক উপায়ে বিক্রয়ের কলাকৌশল সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
গঠিত গ্রæপ সদস্যগণকে ব্যবসায় সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষায়িত কুল ভ্যান, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রসেসিং যন্ত্রপাতি ও প্যাকেজিং সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান।
ফ্রেশকাট ফল বিপণনের ভবিষ্যৎ :
বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবনে ফ্রেশকাট ফল একটি যুগোপযোগী ধারণা। প্রতিনিয়ত এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফ্রেশকাট ফল থাকার কারণেই আজ শহুরে জীবনে অভ্যস্ত ছোট পরিবারগুলো অপচয় রোধ ও সাশ্রয়ী অর্থে বড় বড় ফল যেমন-কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফল প্রয়োজনমতো ক্রয় করতে পারছে। ফ্রেশকাট ফল ও জুসের স্বাস্থ্যসম্মত আকর্ষণীয় প্যাকেজিংয়ের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে ফ্রেশকাট ফলের বিপণন বৃদ্ধি ও জনপ্রিয় করার জন্য কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন, সেগুলো হচ্ছেÑ ফ্রেশকাট পণ্য বিক্রি করার জন্য ব্যবহৃত প্যাকেজিং সামগ্রি সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী/ প্রক্রিয়াজাতকারীদের সরবরাহ করা। ফ্রেশকাট পণ্য বিক্রয়ে ব্যবহৃত প্যাকেজিংসামগ্রী তৈরির জন্য আলাদা শিল্প এলাকা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ফ্রেশকাট প্রক্রিয়াজাতকারী/উদ্যোক্তাদের সাথে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অফিসসমূহের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফ্রেশকাট পণ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যান্টিনে ফ্রেশকাট ফলের কর্নার স্থাপন করা। য়
কর্মসূচি পরিচালক ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৭০৫৫১২৩৭, ই-মেইল : rkshahu@gmail.com
ফলের রসে মিষ্টিমুখ
মো: জুন্নুন আলী প্রামাণিক১
জ্যৈষ্ঠের ফলে ভরপুর গাছ মৌসুমের কৃপা বলে,
সুবাস ভারী মানুষের ভিড়ে সুখবর, দিতে চলে।
অনেক জাতে অফুরন্ত ফল সৌন্দর্যের নেই শেষ,
আকৃষ্ট প্রাণে সুদিনের দোলা নানাফলে ভরা দেশ।
আমের নানা আকারের মাঝে প্রকারের নাম বেশি,
সুন্দর রূপে পুষ্টতার দৃশ্য আহারের কালে খুশি।
স্বাদের কথা সকলের জানা তৃপিকর পাকা আম,
বিশুদ্ধ ফলে রোগব্যাধি নাই গুণাগুণে ন্যায্য দাম।
গাছের পাকা কাঁঠালের বাসে মুখরিত হয় মন,
আজব পাতা দিবারাত নড়ে ভরপুর সাড়া বন।
ফলের মাসে নানাফল হাসে রূপেগুণে অতি সেরা,
বাড়ির গাছে গাছপাকা ফল ফুলেফলে বাড়ি ঘেরা।
পেয়ারা পেঁপে নারিকেল কলা জলপাই বেল তাল,
ডালিম লিচু আমলকী আতা ফলভারে কষ্টে ডাল।
আমড়া জাম তরমুজ বাঙ্গি সুগন্ধের থলে খোলে,
আকৃষ্ট করে মানুষের মন সেবাদানে গাছে ঝোলে।
জাম্বির লেবু আনারসে রস মিষ্টিমুখে চাষি হাসে,
যুগের শ্রোতে আজকের দিনে আগেকার স্মৃতি ভাসে।
মৌসুম শেষে মৌসুমের যাত্রা কতরূপ ফুলে ফলে,
ফুলের গন্ধে পরিপুষ্ট প্রাণ সুস্থতায় হেঁটে চলে।
সৃষ্টির সুখে ফুলফল শোভে শান্তিময় ছবি আঁকে,
বিচিত্র স্বাদে পরিপূর্ণ মুখ রুচিময় ফল দেখে।
উজাড় হচ্ছে ফলবান গাছ প্রকৃতির বুক থেকে,
রোপণ করা দরকার অতি অবহেলা দূরে রেখে।
মানুষ খায় পশুপাখি খায় সকলের প্রিয় ফল,
পুষ্টিতে ভরে প্রাণবন্ত দেহ রোগেশোকে পায় বল।
বৃক্ষ মেলার জারি
মো: মাজাহারুল ইসলাম২
শুনেন শুনেন দেশবাসী, শুনেন বলি সবজনা
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা-ও ভাই করি বর্ণনা \
খোদার সেরা দান বৃক্ষ, জুড়ায় মোদের বক্ষ
বাঁচতে হলে বৃক্ষের সাথে, করতে হবে সখ্য।
সবাই মিলে গাছ লাগাবো, এ হউক মোদের প্রেরণাÑ
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা\
অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, সবই বৃক্ষের অবদান
ধরায় বৃক্ষ না থাকিলে, বাঁচতো না তো মোদের জান।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে, এর তুলনা হয় না-
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা\
সবুজ বৃক্ষ সবুজ দেশ, লাল সবুজের বাংলাদেশ
বনজ ঔষধি কম লাগিয়ে, ফল বৃক্ষে গড়বো দেশ।
২৫% বনভ‚মি না থাকিলে চলবে নাÑ
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা\
মোদের শ^াসের অক্সিজেন, গাছ থেকে মোরা পাই
প্রশ^াসের কার্বন-ডাই অক্সাইড, গাছে গ্রহণ করে ভাই।
অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি গাছ এ কথাটি মিথ্যা না-
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা।
ফল খাই বল পাই, আসুন ফলের গাছ লাগাই
বসতবাড়িতে গাছ লাগিয়ে, বিষমুক্ত ফল খাই।
ফল কখনও যায় না বিফল, এ কথা কি জনো না-
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা\
বৃক্ষ মেলা দেখে যাও, পছন্দের গাছ কিনে নাও\
দু’টি করে গাছ লাগানো, এ হউক সবার বাসনা-
বৃক্ষ মেলার গুণের কথা করি বর্ণনা, ও ভাই করি বর্ণনা\ য়
১গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম, মোবাইল নম্বর : ০১৭৩৫২০২৭৯৮। ২ উপসহকারী কৃষি অফিসার, মুরাদনগর, কুমিল্লা
ফারজানা রহমান ভূঞা
শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম করে তোলার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। শরীরের কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে খাদ্যকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- ক) তাপ ও শক্তিদায়ক খাদ্য; খ) শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরক খাদ্য; এবং গ) রোগ প্রতিরোধক খাদ্য। ফল একটি পুষ্টিকর খাদ্য। মূলত ফলমূলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ ফলমূলই হলো ভিটামিন ও খনিজ লবণসমূহের ভাÐার, যা আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে।
পুষ্টিবিদগণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করার সুপারিশ করলেও বর্তমানে আমরা গড়ে দৈনিক চাহিদার অর্ধেকেরও কম ফল গ্রহণ করছি। যার ফলে ভিটামিন ও খনিজ লবণের অভাবজনিত অপুষ্টি যেমন- রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, গলগÐ, স্কার্ভি, বেরিবেরি প্রভৃতি রোগসমূহে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ফলের পুষ্টিগত উপাদান ফলের প্রকৃতি, পরিপক্বতা, উৎপাদন কৌশল, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়া আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে ফল রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুরো ভিটামিন ও খনিজ লবণই অটুট থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
টাটকা ফলের প্রধান অংশ হচ্ছে পানি (৮০-৯৫%)। ফলে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে কম থাকে, দ্রবণীয় শর্করা ও পেকটিন বাদে ফলের পুষ্টিমান প্রধানত খনিজ ও ভিটামিনের উপর নির্ভরশীল, এজন্য ফলকে দেহ রক্ষাকারী খাদ্য বলা হয়, ফলের উল্লেখযোগ্য ভিটামিন হচ্ছেÑ
ক্যারোটিন : দেশি হলুদ রঙের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। আম, পেঁপে, কাঁঠাল, কমলা, লেবু, আমড়া প্রভৃতি ফলে প্রচুর ক্যারোটিন পাওয়া যায়, যেমনÑ প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা কাঁঠালে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন থাকে, এ ক্যারোটিনের প্রায় ৬ ভাগের এক ভাগ রেটিনল সমতুল্য বা ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে কাজে লাগে। প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ও বাচ্চাদের ৩৭৫ থেকে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ হয়। দেশীয় অন্যান্য ফলে অল্প পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ থাকে। ভিটামিন ‘এ’ শরীরের চাহিদামতো গ্রহণ করলে রাতকানা রোগ ও অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বি-ভিটামিন : ফলে কিছু পরিমাণ ‘বি’ ভিটামিন বিশেষ করে থায়ামিন (ভিটামিন বি১) এবং রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২) থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা আম, কাঁঠাল, বাঙ্গি, আনারস, আমড়াতে ০.১০ থেকে ০.২৮ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম থায়ামিন থাকে। থায়ামিন খাদ্যদ্রব্যকে ক্যালরিতে রূপান্তর, হজম পেশিগুলোকে সবল ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা কাঁঠাল ও আতাফলে যথাক্রমে ০.১৫ মিলিগ্রাম ও ০.১৪ মিলিগ্রাম এবং অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম রিবোফ্লাভিন থাকে, এর অভাবে মুখের কোণায় ও ঠোঁটে ঘা, ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট ও নাকের দুই পাশে চর্মরোগ হয়।
ভিটামিন ‘সি’: ভিটামিন ‘সি’ এর প্রধান উৎস লেবুজাতীয় ফল। দেশীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ থাকে। এই ভিটামিন মাঢ়িকে মজবুত, ত্বককে মসৃণ, সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমলকী ফলে প্রতি ১০০ গ্রামে ৪৬৩ মিলি গ্রাম ভিটামিন সি আছে। পুষ্টিবিদগণ একজন বয়স্ক লোকের দৈনিক ৪৫ মিলিগ্রাম ও শিশুদের ৩৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। দেশীয় ফল রান্না করে খেতে হয় না বলে, এ সব ফলের পুরো ভিটামিন ‘সি’ আমাদের শরীরে শোষিত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে।
খনিজ লবণ : ফলে সকল পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, যার পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম তরমুজে ৭.৯ মিলিগ্রাম, জামে ৪.৩ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ১.৫ মিলিগ্রামের কম লৌহ থাকে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে। পাকা কলায় শ্বেতসার ছাড়াও প্রায় ২৫০-৫৭০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে।
ফলের খনিজ উপাদান মুক্ত জৈব এসিড বা এদের লবণরূপে থাকে এবং দেহরসের ক্ষারত্ব রক্ষা করে। আনারসে ভিটামিন ‘সি’ ছাড়াও ব্রোমেলিন নামক এক প্রকার প্রোটিন পরিপাককারী এনজাইম থাকে, কাঁচা পেঁপের আঠায় প্যাপাইন নামক এনজাইম আছে, যা মাংসকে নরম করতে সাহায্য করে।
ফলের খোসায় বেশির ভাগ সেলুলোজ থাকে। কাঁচা ফলের শ্বেতসারই প্রধান কার্বোহাইড্রেট। পাকার সময়ে শ্বেতসার গøুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং সুক্রোজে পরিণত হয়। যার ফলে পাকা ফল মিষ্টি লাগে। উদ্বায়ী ও অনুদ্বায়ী জৈব এসিড, যেমন- সাইট্রিক, মেলিক, টারটারিক প্রভৃতির জন্য কাঁচা ফল টক হয় এবং পাকার সময় গøুকোজ, ফ্রুক্টোজের সাথে মিলে ফলের নিজস্ব গন্ধের সৃষ্টি করে। ফল পাকলে এসিডের পরিমাণ কমে যায় এবং চিনির পরিমাণ বাড়ে। কাঁচা কালোজামে মোট শর্করার পরিমাণ ৫.৮%, কিন্তু পাকা জামে ১২.৪% শর্করা থাকে। ফলের মধ্যস্থ এনজাইম ফল পাকাতে প্রভাবিত করে, ফল পরিপক্ব হওয়ার সময়ে এনজাইম ক্রিয়া পেকটিনোজেন পেকটিনে পরিণত হয়। পেকটিন সমৃদ্ধ ফল হতে ভালো জেলি তৈরি হয়। আপেল, পেয়ারা, লেবুজাতীয় ফল, আনারস প্রভৃতিতে পেকটিন বেশি থাকে, ফলের পেকটিন ডায়রিয়া, আমাশয়ে খুব উপকারী।
ফলের মতো ফলের রসেও সমান পরিমাণ গুণাগুণ বিদ্যমান। ফলের রসের পুষ্টি উপাদানগুলো শরীর দ্রæত শোষণ করে নিতে পারে। তবে ফলের রস পান ফল গ্রহণের মতো খুব একটা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়। এ ছাড়া প্যাকেটজাত ফলের রস, ফলের প্রাকৃতিক উপকারী দিকসমূহ বিনষ্ট করে দেয়। এই সব রসে ফলের আঁশ থাকে না এবং উচ্চমাত্রায় চিনি থাকে। প্যাকেটজাত ও বোতলে সংরক্ষিত ফলের রসে প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ফল থেকে তৈরি করা ফলের রসে থাকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমূহ। তবে ফলের রস তৈরির ফল ও ফলের খোসার আঁশ একেবারেই বাদ পড়ে যায়। আঁশ খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে, রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষতিকর কোলস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্য ফলের রস এড়িয়ে যাওয়া উত্তম। ফলের রস খাওয়ার সময় অবশ্যই প্রস্তুত করার সাথে সাথে পান করা উচিত। প্রস্তুতির পর দীর্ঘ সময় ফেলে রাখলে ফলের রসে বিদ্যমান বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
প্রায় সবার মাঝেই একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, ফল যেকোনো সময় কেটে খাওয়া যায়। কিন্তু ফল গ্রহণের সুনির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করা না হলে ফল থেকে অপকারই বেশি হয়। তাই ফল গ্রহণের সঠিক সময় সম্পর্কে জানা দরকার।
১। ভরা পেটে- খাওয়ার পরপরই ফল খেলে তা হজম হতে অনেক সময় লাগে। ফল হজম না হয়ে অনেকক্ষণ পেটে থাকলে বুক জ্বালা, ঢেঁকুরের সমস্যা দেখা দেয়।
২। সকালে উঠে- সকালে উঠে এক গøাস পানি খাওয়ার পর ফল খাওয়া উচিত। তবে সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন- কমলা, আঙ্গুর, বাতাবিলেবু, এগুলো খেলে অ্যাসিডিটি বাড়তে পারে। অন্যান্য মিষ্টি ফল যেমন- আপেল, কলা, নাশপাতি, আম ইত্যাদি খালি পেটে খেলে তা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করে, শরীরে শক্তি জোগায় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৩। খাওয়ার মাঝে- ফল খাওয়ার আসল নিয়ম খাওয়ার আগে ও পরে। সাধারণত আমরা দিনে তিন বার (ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার) ভরপেট খেয়ে থাকি। ফল খেতে হলে ভরপেট খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা দু’ঘণ্টার পর খেতে হবে। তবে খাবারের পরিমাণের উপর ফল খাওয়ার সময়ও নির্ভর করে। যদি খুব ভারী খাবার খাওয়া হয় তাহলে অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা পর ফল খেতে হবে। আর যদি সালাদ বা হালকা কোনো খাবার খাওয়া হয় তবে দেড় ঘণ্টার পরই ফল খাওয়া যেতে পারে।
৪। শোয়ার আগে- ঘুমোতে যাওয়ার আগেও ফল খাওয়া সঠিক নয়। ফলের মধ্যে থাকা শর্করা এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেয় এবং ঘুমাতে বাধা দেয়। এজন্য ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত তিন ঘণ্টা আগে ফল খেতে হবে।
ফল গ্রহণের কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে তা থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টি পাওয়া যায়। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিয়ম নিচে দেওয়া হলো :
ক্স প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত;
ক্স একই সময়ে অনেক ধরনের ফলের সমাহার খাবারে রুচি বৃদ্ধি করবে;
ক্স সাধারণত ফল গ্রহণের এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ক্ষুধা নিবৃত্ত থাকে;
ক্স এসিডিটি বা পরিপাকজনিত অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ফলকে দই বা অল্প লবণের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়;
ক্স দুধের সাথে সাইট্রাস (টক) জাতীয় ফল খাওয়া উচিত নয়;
ক্স ফলকে বড় টুকরা করে কেটে সালাদের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়;
ক্স ফল খাওয়ার পর পরই পানি পান করা সঠিক নয়। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারটান, সেচ ভবন, ঢাকা, মোবাইল : ০১৮৩২২৭২১৪২, ই-মেইল : farjanarb@yahoo.com
খালেদা খাতুন
‘বৃক্ষ তোর নাম কি, ফলে পরিচয়’-ফলের খাওয়ার উপযোগী অংশ নানা রকম স্বাদ, গন্ধ, রঙ, আকৃতি, জমিন এবং সর্বোপরি আমাদের শরীরের চাহিদা পূরণকারী গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান বহন করে।
খাদ্য হিসেবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ ফলমূলই সুস্বাদু, পুষ্টিকর, মুখরোচক এবং তৃপ্তিদায়ক। ফলে শর্করা, আমিষ, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেলস এবং পানি থাকে। আর এই ফলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখা। আমার কাঁচা ও পাকা অবস্থায় ফল সরাসরি খাই বলে বেশীর ভাগ পুষ্টি উপাদান শরীরের কাজে লাগে। শাকসবজি প্রক্রিয়া জাত করার সময় পানিতে ভিটামিন ‘বি’ ও ‘সি’ এর অনেক অপচয় হয়। তাই এই ভিটামিনগুলোর ঘাটতি পূরণের জন্য ফলের উপর নির্ভর করতে হয়। এই জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কোন না কোন ফল থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা, ২০১৫ তে বলা হয়েছে। প্রতিদিন ১-৩ সার্ভিং পর্যন্ত মৌসুমি ফল খেতে হবে। এছাড়া ও খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বৃদ্ধির জন্য টক জাতীয় ফল, যেমনÑ আমলকী, আমরা, পেয়ারা, জাম্বুরা, কাঁচা আম, লেবু ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফল নিরাপদ কি না এ নিয়ে অনেকেরই দ্বিধা থাকে। কারণ মিষ্টি ফল রক্তে গøুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অসবৎরপধহ উরধনবঃরপ অংংড়পরধঃরড়হ এর মতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফল খাওয়া ভালো, যদি তার নির্দিষ্ট কোন ফলে এলার্জি না থাকে। ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন ক্ষুধা পায়। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীকে ‘টাইম ডিজিজ’ বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে সারা দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প করে খেতে হয় এবং প্রতিবারেই কিছু কিছু আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো। যেহেতু ফলমূল রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় তাই এর আঁশ পুরোপুরি কাজে লাগে। আর এই আঁশের কারণেই মিষ্টি ফলের গøাইসেমিক ইনডেক্স (এও) অন্যান শর্করা জাতীয় খাবারের চেয়ে কম থাকে। তাই মধ্য সকাল বা বিকেলে মাঝে মধ্যে খোসাসহ ফল খাওয়া যেতে পারে। তবে তাজা ফল প্রসেস করা ফলের চেয়ে ভালো। কারণ প্রসেস করা ফল দ্রæত শোষণ হয়ে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া বেশি পাকা ফলেও রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই বেশি পাকা ফলের চেয়ে আধাপাকা ফল খাওয়া ভালো ডায়াবেটিস রোগীদের। ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ডায়াবেটিস রোগীর আর একটি প্রধান লক্ষণ। বেশির ভাগ ফলেই ৯০-৯৫ ভাগ পানি ধারণ করে। তাই পিপাসা মেটানোর জন্য ডায়াবেটিস রোগীরা ফল খেয়ে পানির চাহিদা মিটাতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক চাপের কারণে অনেক সময় ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই চাপ প্রতিরোধের জন্য শরীরে এন্টিঅক্সিডেন্ট প্রয়োজন। ফলে বিভিন্ন প্রকার ফ্লেভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড ও ভিটামিন ‘সি’ থাকে যা শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট। এই এন্টিঅক্সিডেন্ট শুধুমাত্র চাপই প্রতিরোধ করে না, এটি অকাল বার্ধক্য, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ইত্যাদি রোগের ঝুঁকিও কমায়। বেশির ভাগ ফলমূলেই কম পরিমাণ সোডিয়াম ও বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মিনারেলস উচ্চরক্ত চাপ ও হার্টের কার্যক্রম অক্ষুণœ রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে যদি পটাশিয়াম বেশি থাকে তবে সে ক্ষেত্রে ফল খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইৎরঃরংয গবফরপধষ ঔড়ঁহধষ, ২০১৪-এ প্রকাশিত হয়েছে যাদে খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফল থাকে তাদের ঞুঢ়ব-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
‘ডায়াবেটিস কোনো মরণব্যাধি নয়
যদি নিয়মিত নিরাপদ ফল খাওয়া হয়
নিরাপদ ফল যদি পেতে চান
বাড়ির আঙ্গিনা অথবা ছাদে
কয়েক প্রকার ফলের গাছ লাগান। য়
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম, শাহবাগ, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭০৩৭৯৬২৬৯, ই-মেইল : birdem@yahoo.com
ড. মীর শরফ উদ্দিন আহমেদ১ ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান২
ভালো বীজ ভালো ফলনের ভিত্তি। অপরদিকে বীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদন উপাদান, যা ব্যতীত ফলন আশা করা যায় না। এছাড়াও জাতের বিশুদ্ধতা প্রত্যক্ষভাবে ফলনের উপর প্রভাব ফেলে। জাতের কৌলিক বিশুদ্ধতা ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে করা গেলে বীজ ভালো থাকে এবং তা থেকে ফলন ১০% বা তারও বেশি বৃদ্ধি পায়। তাই জাতের উচ্চ কৌলিক বিশুদ্ধতা বীজ উৎপাদনের একটি ǻরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। কারণ বীজ যে শুধু সংশ্লিষ্ট জাতের ধান গাছের মধ্যে স্ব-পরাগায়নের ফলে উৎপাদিত হয়েছে, তা শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরি। কাজেই উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বীজ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সর্তকতা অবলম্বন করা প্রযোজন, যাতে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদিত হয়।
প্রকৃত জাত : প্রকৃত জাত বলতে সেই জাতের প্রজননবিদ সংরক্ষিত নিউক্লিয়াস বীজ ও গাছের সকল বৈশিষ্ট্যসমূহকে বোঝায়। তাই যখন কোনো জাতের বীজ ও গাছ সেই জাতের নিউক্লিয়াস বীজের গাছের মতো একই ধরনের হয় এবং নিউক্লিয়াস বীজের সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ ও প্রকাশ করে, তখন সেই বীজ ও গাছসমূহকেও বিশুদ্ধ বা প্রকৃত জাত বলা যায়। এখানে প্রকৃত বলতে ‘জেনুইন’, ‘অথ্নেটিক’, ‘একই ধরনের’ বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, একটি জাতের পরিচায়ক গুণসম্পন্ন গাছসমূহকেই প্রকৃত জাত বোঝায়, যা সেই গাছসমূহকে ওই ফসলের অন্য সকল জাত থেকে স্বতন্ত্র (ফরংঃরহপঃ), সমরূপ (ঁহরভড়ৎস) এবং স্থিতিশীল (ংঃধনষব) বৈশিষ্ট্য প্রদান করে (চিত্র ১)।
নিউক্লিয়াস বীজ প্রকৃত জাত অনুরূপ (ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব) চিত্র ১। নিউক্লিয়াস বীজ হতে প্রকৃত জাত ও ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব ধান গাছ।
প্রকৃত জাত সংরক্ষণের গুҺত্ব
জাতের বিশুদ্ধতা কমে গেলে একই হারে ফলনও কমে যায়। কারণ ফসলের বীজের প্রতি ১ শতাংশ অবিশুদ্ধতার জন্য ফসলের হেক্টর প্রতি ফলন ১০০ কেজি পর্যন্ত কমে যেতে পারে (গধড় বঃ ধষ., ১৯৯৬)। তাই সঠিকভাবে জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসমূহ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ।
বীজ উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা পর-পরাগায়নের মাধ্যমে অথবা বীজ প্রέিয়াজাতকরণের έটিজনিত কারণে বিনষ্ট হয়। ধান বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রংড়ষধঃরড়হ ফরংঃধহপব কঠোরভাবে মেনে চলা দরকার। তাই প্রকৃত জাতকে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি গুҺত্বের সংগে বিবেচনায় নিতে হয়।
এছাড়াও জাতীয় বীজনীতিতে উল্লেখিত বিভিন্ন মানসম্পন্ন শ্রেণির বীজ উৎপাদনের জন্যও জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসমূহ সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রকৃত জাত সংরক্ষণ পদ্ধতি
ধান গাছের প্রতিটি জাতের প্রকৃত সকল বৈশিষ্ট্য ‘শীষ থেকে সারি’ (যবধফ ঃড় ৎড়)ি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। শীষ থেকে সারি পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো প্রথম বছর বিশুদ্ধ বা প্রকৃত জাত হতে সুস্থ সবল, পোকা ও রোগমুক্ত এবং জাতের অনুরূপ (ঞৎঁব ঃড় ঃুঢ়ব) শীষ সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ শীষটি মাড়াই ছাড়াই রোদে ৫/৬ দিন ভালোভাবে শুকাতে হয়। ধানের শীষগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করে এমন কক্ষে এবং মোটা পলি ব্যাগ বা প্লাস্টিকের বোতল বা বায়ুরোধী টিনের পাত্রে মাটি থেকে উঁচু স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। দ্বিতীয় বছর একইভাবে মাড়াই ছাড়াই সম্পূর্ণ শীষটি শোধন ও জাগ দেয়ার পর বীজতলায় বপন করা হয় (চিত্র ২)। ধানের চারা রোপণের সময় একইভাবে একটি সম্পূর্ণ শীষ হতে গজানো সকল চারাকে একটি সারিতে রোপণ করা হয় (চিত্র ৩)।
চিত্র ৩। মূল জমিতে একটি সম্পূর্ণ শীষ হতে গজানো সকল চারাকে একটি সারিতে রোপণ করা।
ফলে এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিটি বীজকে ǻছি ও শীষ (চিত্র ৪) এবং তারপর একটি শীষের এক সারির চারা ও এক সারির পূর্ণাঙ্গ গাছ (চিত্র ৫) হিসাবে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর জাতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একই ধরনের (যড়সড়মবহড়ঁং) সারির গাছসমূহ যেগুলো প্রকৃত জাতের অনুরূপ, সেগুলো সংরক্ষণ করা হয় এবং ভিন্নরূপের (ংবমৎবমধহঃং) গাছসমূহের সারিগুলো কেটে ফেলা হয়।
চিত্র ৪। বীজতলায় শীষ থেকে সারি পদ্ধতি।
বিজাতীয় গাছ বাছাই : জাতের বৈশিষ্ট্য এবং বীজের বিশুদ্ধতা অক্ষুণœ রাখতে হলে বীজ ফসলের মাঠ থেকে বিজাতীয় গাছ বাছাই করতে হবে। ফলে পর-পরাগায়নের মাধ্যমে বীজের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। একই জাতের ধান গাছের মাঝে কিছুটা ভিন্ন ধরনের (ফবারধঃবফ) ধান গাছকে সংশ্লিষ্ট জাতের বিজাতীয় গাছ বলে। অন্যকথায় যেসব গাছের উচ্চতা, পাতা বা খোলের রঙ, থোড় আসার সময়, ফ্ল্যাগ লীফের কৌণিক বিস্তার, শীষের বিস্তার আকৃতি ধরন ও রł এবং বীজের আকার-আকৃতি রł ও ậłের উপস্থিতি জমির অধিকাংশ গাছ থেকে একটু আলাদা সেগুলোই বিজাতীয় গাছ। অন্যদিকে মিশ্রণ বলতে দুটি ভিন্ন জাতের ধান গাছকে বোঝায়। আবার, বীজ উৎপাদনের জমিতে সংশ্লিষ্ট জাতের ধান গাছ ছাড়া বিজাতীয় এবং পোকা ও রোগাক্রান্ত সকল ধান গাছ উঠিয়ে ফেলাকেও বিজাতীয় গাছ বাছাই বলে।
উপসংহার : খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনাসহ সঠিক জাত নির্বাচন ও মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে ধান চাষে ফলন ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ চাষাবাদ প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ফলে ভালো ফসল বা ফলন পেতে পরিপুষ্ট, মিশ্রণমুক্ত, পোকার আέমণ ও রোগমুক্ত এবং কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা প্রয়োজন, যা থেকে সুস্থ-সবল চারা পাওয়া যাবে। সুতরাং সঠিক বীজ উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
সূত্র : বিজাতীয় গাছ শনাক্তকরণ ও বাছাই। ২০১৯। কৌলি সম্পদ ও বীজ বিভাগ। মুদ্রণ তত্ত¡াবধানে প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগ। ব্রি প্রকাশনা নম্বর ২৭০। মার্চ ২০১৯। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। গাজীপুর-১৭০১। য়
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জিনেটিক রির্সোস এন্ড সিড ডিভিশন, ব্রি, গাজীপুর।
ড. মুহাম্মদ মহী উদ্দীন চৌধুরী
“বীজ হলো কৃষির প্রাণ”। চিরন্তন শুনে আসছি,‘ সুবীজে সুফসল’, ‘সুবংশে সুসন্তান’। বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য উপকরণ ঠিক রেখে শুধুমাত্র উন্নতমানের ভালো বীজ ব্যবহারে ২০-২৫ % ফলন বৃদ্ধি পায়। তাহলে একটি প্রশ্ন, ভালো বীজই কি মান সম্মত বীজ? হ্যাঁ, এখানে ভালো বীজকে মানসম্মত বীজ বলা হয়েছে। বীজের উদ্ভিদতাত্তি¡ক ও কৃষিতাত্তি¡ক সংজ্ঞা রয়েছে। কৃষিতাত্তি¡ক দিক হতে উদ্ভিদ বা শস্যের যে কোন অংশ যা তার বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম সেটিকে বলা হয় বীজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঃ আখের কান্ড, পাথরকুচির পাতা, লেবুর কাÐ, মিষ্টিআলুর লতা বা মূল ইত্যাদি। ফসল উৎপাদনের কথা মুখে আনলে যে উপকরণটির একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে-তার নাম হলো বীজ। এজন্য বলা হয়, “বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ”। তাই ভালো ফসল পেতে হলে ভাল বীজ প্রয়োজন। কৃষিজ উৎপাদনে যে কয়টি উপকরণ ব্যবহার হয় তার মধ্যে বীজ ব্যতিক্রম ধর্মী উপকরণ। সার, কীটনাশক, বালাইনাশক, পাওয়ার টিলার, স্প্রে মেশিন, কমবাইন্ড হারভেস্টারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি কারখানায় প্রস্তুত করা হয় অর্থাৎ এগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট। কিন্তু বীজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট নয়। বীজ কৃষকের দ্বারা মাঠেই উৎপাদন করে নিতে হয়। বিগত এক দশক যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাংলার কৃষক ‘হাইব্রিড’ নামক বীজের জন্য জান পরাণ। চাই সে যে কোন ফসলের বীজ হোক না কেন। কারণ, কৃষকের মনে এ ধারণা বিদ্ধ হয়েছে যে, হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়ে। কৃষকের এই ‘পজিটিভ এ্যাটিচিউড’ কে কাজে লাগিয়ে “বৃহৎ পরিসরে মান সম্মত বীজ উৎপাদনকারি চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি করা”। বিভিন্ন বীজের মোট চাহিদার শতকরা মাত্র ৮-১০ ভাগ উন্নতমানের বীজ বিভিন্ন বীজ উৎপাদনকারী বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি সংস্থা হিসাবে বিএডিসির সক্ষমতা শতকরা ৫-৬ ভাগ থেকে ১০-১২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এটা অনেকটা হতাশার মাঝে আশার আলো। অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের নিজস্ব সনাতনী পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে যার গুণগত মান নিশ্চিত নয়। যেহেতু শতকরা ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষকের উপর নির্ভরশীল, তাই মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ব্যাপারে কৃষি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরো ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে আইসোলেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
আইসোলেশন : বীজের জন্য উৎপাদিত ফসলকে একই ফসলের অন্য জাত থেকে ন্যূনতম দূরত্বে ভিন্ন মাঠে/একই মাঠে আবাদ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আইসোলেশন বা পৃথকীকরণ পদ্ধতি। এই আইসোলেশন পদ্ধতি বা দূরত্ব বিভিন্ন ফসলের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
আইসোলেশনের প্রয়োজনীয়তা : (১) জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে অনাকাক্সিক্ষত পরাগরেণুর মাধ্যমে পর-পরাগায়ন এবং মুক্ত পর-পরাগায়ন ফসলের পরাগায়ন প্রক্রিয়াতে বাধা সৃষ্টি করা। (২) স্ব-পরাগায়িত জাতসমূহে পর-পরাগায়ন প্রক্রিয়া সৃষ্টির সুযোগ এবং যান্ত্রিক মিশ্রণকে (গবপযধহরপধষ গরীঃঁৎব) নিয়ন্ত্রণ করা।(৩) পরাগায়ন দূষণ (চড়ষষবহ ঈড়হঃধসরহধঃরড়হ) প্রক্রিয়া বন্ধ করা। সর্বপরি বলা যায়, আইসোলেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করা। নি¤েœ বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশন (নোটিফাইড ফসল) দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
তালিকায় প্রজনন বীজের দূরত্ব উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, প্রজনন বীজ বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় উৎপাদন করা হয়।
বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে নন-নোটিফাইড ফসলের ন্যূনতম আইসোলেশন দূরত্ব বর্ণিত হলো ঃ
এখানে উল্লেখ্য যে, আইসোলেশনের ন্যূনতম দূরত্ব ভিত্তি বীজের ক্ষেত্রে প্রত্যায়িত বীজ অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি। আবার স্ব-পরাগায়িত বীজের আইসোলেশান দূরত্ব পর-পরাগায়িত/মুক্ত পর-পরাগায়িত বীজের তুলনায় অতি সামান্য।
আইসোলেশন নিয়ে কৃষক পর্যায়ে বিরাজিত সমস্যা ও করণীয় :
বর্তমানে বিএডিসি, কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর, এনজিও এবং বীজ ব্যবসায়ীদের বহুবিধ বীজ উৎপাদনমূলক কর্মকাÐ দৃশ্যমান। আইসোলেশনের দূরত্ব বজায় রেখে মাঠ পর্যায়ে কৃষক বীজ উৎপাদনের বেলায় জমি ছাড় দিতে রাজী হয় না। আইসোলেশান গ্যাপে কোন ফসল উৎপাদনে হয় নিরৎসাহিত। আইসোলেশন বিষয়ের উপর কৃষক প্রশিক্ষণে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষককে ঐ সমপরিমাণ জমির জন্য ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর জনবল বৃদ্ধি করত তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অসাধু বীজ ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতারোধে বীজ আইন ১৯৯৮ ও ২০১৬ কে কার্যকর করতে হবে। য়
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী, মোবাইল : ০১৮২৭-৮৬৫৮৬০,
ই-মেইল-psoofrdbari@gmail.com
কৃষিবিদ মো: শরিফুল ইসলাম
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। আমাদের জাতীয় আয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ আসে কৃষি হতে। অথচ দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.০৬ হেক্টর। এই সামান্য জমি হতে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট মাটিতে নির্দিষ্ট ফসল আবাদের গুরুত্ব দেয়া হয়। অন্য ভাবে বলা যায় যে, যে মাটির যেরূপ গুণ সেই মাটিতে সেইরূপ ফসলের আবাদ করা দরকার। আর মাটির এ গুণাগুণ মাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায় এবং মাটির উপযোগী ফসল চাষ করে মানসম্পন্ন বীজ ও ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়।
মাটি পরীক্ষার আগে জানা দরকার মাটি কি? মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম ও দানাদার আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট দানাদার কণা এবং জৈব পদার্থ মিশ্রিত হয়ে গঠিত হয় মাটি। সারা পৃথিবী জুড়ে এই মাটির উপরে বীজ ও ফসল ফলে থাকে। তবে পৃথিবীর সর্বত্র মাটি একরকম নয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি মুখ্য পুষ্টি উপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার ও ম্যানেসিয়াম এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান যেমন-দস্তা ও বোরনের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে মানসম্পন্ন বীজ ও ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের লভ্যতা এবং মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। কোন বাসাকে তখনই ‘খাদ্য নিরাপদ’ বলে মনে করা হয়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করেন না কিংবা খাদ্যাভাবে উপবাসের কোন আশঙ্কা করেন না।
মাটি ব্যবস্থাপনার সাথে খাদ্য নিরাপত্তা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কারণ বাংলাদেশের বেশি ভাগ এলাকায় মাটিতে বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এইসব মাটির যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কারা যায়, তাহলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বছর বছর ফসলের জন্ম দিয়ে দিয়ে মাটির উর্বরতা অনেকাংশে কমে গেছে বা যাচ্ছে। তাই জমিতে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হলে ফসলি জমির ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে তাতে প্রয়োজনে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। এজন্য আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আছে। সেখানে যোগাযোগ করে কৃষি বিভাগের পরামর্শকদের মাধ্যমে এদেশের সকল অঞ্চলের কৃষকরা তাদের জমির মাটি পরীক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, সুষম সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং ফলন ২০-২৫% বৃদ্ধি পায়। তাই, সার প্রয়োগেরে আগে মাটি পরীক্ষা করানো উচিত।
মাটি পরীক্ষা করলেই মাটিতে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ জানা যায়। জানা যায়, কোন্ পুষ্টি উপাদানের অভাব রয়েছে। এর মাধ্যমে মাটিতে কোন্ পুষ্টি উপাদান এবং কোন্ সার কি পরিমাণ সরবারহ করতে হবে তা নির্ণয় করা যায়। মাটির উর্বরতার পরিমাণ ও কি পরিমাণ জৈব পদার্থ আছে তাও জানা যায়। মাটির অম্লত্ব/ক্ষারত্ব/লবণাক্ততা জানা যায়। জানা যায়, মাটিতে উপস্থিত ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ, মাটিতে ডলোমাইট লাইম (ডলোচুন) প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা ও পরিমাণ । মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। সার প্রয়োগ করা যায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী। এটাই মাটির পরিচর্যা কিংবা সুরক্ষার উপায়। অতএব, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই মাটির স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি বলা যেতে পারে, মাটি পরীক্ষা করে সুষম জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে একদিকে যেমন মানসম্পন্ন বীজ পাওয়া যাবে অন্যদিকে তেমনি ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে এবং এত করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
মানুষের সর্বপ্রথম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জীবন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টিকে পৃথিবী জুড়েই একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দরকার মানসম্পন্ন বীজ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষককে সর্বোচ্চ প্রণোদনা ( বীজ, সার ইত্যাদি ) ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা তথা মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) কৃষককে সরাসরি প্রণোদনা দিতে না পারলেও কৃষক যাতে টেকসই ও লাভজনকভাবে মাটির ব্যবহার নিশ্চত করে মানসম্পন্ন বীজ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপৃত থাকতে পারেন সে লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সচ্ছল ও সুখী মানুষের দেশে পরিণত হবে। য়
পাবলিকেশন এন্ড লিয়াজোঁ অফিসার, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৬-৫০৬০৮০ ই-মেইল : ংsharifulplo@gmail.com
কৃষিবিদ মো. রেজাউল ইসলাম
বিপুল সম্ভাবনার এই দেশ বাংলাদেশ। কৃষিবান্ধব এই সরকারের নিপুণ ছোঁয়ায় কৃষিতে সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিগত বছরগুলোতে ফল উৎপাদনে অনেক এগিয়েছে দেশ। প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের ফলের নতুন নতুন বাগান সৃজন হচ্ছে। ফলের রোগ এবং পোকা ফল উৎপাদনের অন্যতম প্রধান বাধা। অন্যান্য ফসলের মতো আধুনিক সার, পানি ব্যবস্থাপনা ও বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। পোকা ও রোগের জন্য অনুক‚ল অবস্থাগুলো যাতে না হয় সেদিকে যতœবান হলে রোগ ও পোকা ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। ফলের বালাই দমনে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ও রোগনাশক ব্যবহৃত হয় । এর কারণে ফলও আর নিরাপদ থাকছে না। নিরাপদ ফল ও ফলের অধিক উৎপাদনে তাই সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি।
ফল উৎপাদনে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা : ফসল উৎপাদনে পোকামাকড় ব্যবস্থাপনায় একটিমাত্র পদ্ধতি কার্যকর নাও হতে পারে। সফলভাবে বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য বালাই দমনের বিভিন্ন পদ্ধতি সমন্বিতভাবে এবং পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। নিচে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো।
১. পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করে ফলের পোকা ব্যবস্থাপনা
আম সংগ্রহের পর গাছের সকল পরগাছা ও পরজীবী উদ্ভিদ ধ্বংস করতে হবে। বর্ষা মৌসুম শেষে বিশেষত জুলাই-আগস্ট মাসে আম গাছের অপ্রয়োজনীয় মৃত ও অর্ধ-মৃত ডালপালা ছাঁটাই করে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করলে হপারের প্রাদুর্ভাব ৩০-৪০ শতাংশ কমে যায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে ঝরে যাওয়া আক্রান্ত কচি আম মাটি থেকে সংগ্রহ করে ধ্বংস করলে আমের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কমে যায়। মাছি পোকাক্রান্ত আমগুলো সংগ্রহপূর্বক মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। আমের ফলের উইভিল বা ভোমরা পোকা দমনের জন্য-জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসে প্রতিটি আম গাছের চারদিকে ৪ মিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তের মধ্যের সকল আগাছা পরিষ্কার করে ভালোভাবে মাটি কুপিয়ে উল্টে দিলে মাটিতে থাকা উইভিলগুলো ধ্বংস হবে। আমের ছাতরা পোকা দমনের জন্য আম বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মাটিতে পড়ে থাকা নতুন কাটা পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করলে আমের পাতা কাটা উইভিল পোকার সংখ্যা কমিয়ে ফেলা সম্ভব। আম সংগ্রহের পর (জুলাই-আগস্ট মাসে) গল আক্রান্ত পাতার শাখাসমূহ কেটে বাগান থেকে যত শিগগির সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে। প্রতি বছর আম বাগানের পরিচর্যা ভালো থাকলে পাতায় গল সৃষ্টিকারী পোকার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে কমে যাবে। কাঁঠালের এবং পেয়ারার ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত কাঁঠাল ও পেয়ারা মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। লিচু পাতার লাল ক্ষুদ্র মাকড় দ্বারা আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে আগুনে পুড়ে ফেলতে হবে। লাল ক্ষুদ্র মাকড় দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত গাছের অগ্রভাগ জুন-আগস্ট মাসে এবং কম আক্রান্ত গাছের অগ্রভাগ আগস্ট মাসে ছাঁটাই করে আগুনে পুড়ে ধ্বংস করা উচিত। এ ব্যবস্থা ২-৩ বছর অবলম্বন করে লিচুর মাকড় দমন করা সম্ভব। বর্ষা মৌসুমের শেষে বছরে একবার পূর্ণ বয়স্ক লিচু গাছের অপ্রয়োজনীয় মৃত, অর্ধমৃত ডালপালা ছাঁটাই করে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করলে লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকার প্রাদুর্ভাব কমে যায়। কলার উইভিল পোকা দমনের জন্য ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ ও কুলগাছের অসময়ের ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলে কুলের ফল ছিদ্রকারী উইভিল দমন করা যায় । কুলের টিউব স্পিটল বাগ দমনের জন্য পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে, শাখা প্রশাখা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। ডালিমের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য ছিদ্রযুক্ত ফল সংগ্রহ করে মাটি চাপা দিতে হবে।
২. ফল ব্যাগিং করে পোকা ব্যবস্থাপনা
ফল সংগ্রহের এক মাস পূর্বে প্রতিটি আমকে কাগজের ব্যাগ
(বাঁশ পাতার তৈরি) দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমের মাছি পোকার
আক্রমণ সম্পূর্ণভাবে রোধ করা যায়। খাট জাতের আম গাছে মাছি পোকা দমনে এ পদ্ধতিটি অত্যন্ত কার্যকর। ছিদ্রযুক্ত পলিব্যাগ দ্বারা পেয়ারা ব্যাগিং করে সফলতার সাথে পেয়ারার মাছি পোকা ও পেয়ারার ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করা যায়। লিচু ফল সবুজ থেকে বাদামি রঙ ধারণ করার সময় ১০০-১৫০টি ফল এক সাথে করে মশারির নেট দিয়ে তৈরি ব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করলে লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হবে না এবং বাদুড়ের আক্রমণও কমে যাবে। কলার মোচা বের হওয়ার সাথে সাথে এবং ছড়িতে কলা বের হওয়ার পূর্বেই ৪২ ইঞ্চি ল¤¦া ও ৩০ ইঞ্চি প্রস্থের দু’মুখো খোলা একটি পলিথিন ব্যাগের একমুখ মোচার ভেতর ঢুকিয়ে বেঁধে দিলে কলার পাতা ও ফলের বিট্ল পোকা সহজেই দমন করা যায়। নার্সারিতে নতুন বের হওয়া পাতা সমেত ডগাকে মশারির নেট দিয়ে ঢেকে দিলে পাতা কাটা উইভিল পোকার আক্রমণ কম হয়। ডালিমের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য ফল মার্বেল আকারের হলে ব্যাগিং করতে হবে।
৩. ফলের মাছি পোকা দমনের জন্য আকর্ষণ ও মেরে ফেলা পদ্ধতির ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকার স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই মেরে ফেলা
স্ত্রী মাছি পোকাকে আকৃষ্ট করে মেরে ফেলার জন্য ফাঁদ ক্ষেতের ভেতরের দিকের গাছে / ডালে / খুঁটিতে ১০-১২ মিটার দূরে দূরে ঝুলিয়ে দিতে হবে। গাছ বড় হলে একই গাছে একাধিক ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। টিউবের মধ্যকার জৈব বালাইনাশক মিশ্রিত জেল বা পেস্টের মতো পদার্থ ক্ষেতের সীমানা লাইনে অবস্থিত গাছে বা ডালে বা খুঁটিতে মাটি হতে ৪-৫ ফুট উপরে ১০-১২ মিটার বা ৩৫-৪০ ফুট দূরে দূরে অল্প পরিমাণ লাগিয়ে দিতে হবে।
৪. ফলের মাছি পোকা দমনের জন্য সেক্স ফেরোমোনের ব্যবহার : ফল বহনকারী ডালে সময়মতো মিথাইল ইউজিনল ফেরোমন ট্রাপ স্থাপন করে সফলতার সাথে ফলের মাছি পোকা দমন করা যায়। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ১২ মিটার দূরে দূরে জমিতে স্থাপন করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ফাঁদে খেয়াল রাখতে হবে যেন ফাঁদের তলায় সাবান পানি থাকে।
৫. জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে নিমতেল (প্রতি লিটার পানিতে ১০.০ মিলিলিটার হারে) + ট্রিক্স (প্রতি লিটার পানিতে ৫.০ মিলিলিটার হারে) মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। অর্ধ ভাঙ্গা নিমের বীজ (প্রতি কেজি ২০ লিটার পানিতে) পানির মধ্যে ১২ ঘণ্টা যাবৎ ভিজিয়ে রাখার পর উক্ত পানি আক্রান্ত গাছে ৭ দিন পর পর ¯েপ্র করে পেয়ারার সাদা মাছি পোকা দমন করা যায়। পেয়ারার সাদা মাছি পোকা ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতায় সাবান মিশ্রিত পানি (৫.০ গ্রাম সাবানের গুঁড়া প্রতি লিটার পানিতে) স্প্রে করে ভালো ফল লাভ করা যায়।
ফল গাছে মিলিবাগ বা ছাতরা পোকা বা সাদা মাছির আক্রমণ হলে পটাসিয়াম সল্ট অব ফ্যাটি এসিড (ফাইটোক্লিন বা অন্য নামের) নামক জৈব বালাইনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১০.০ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৬.যান্ত্রিক দমন
ফল গাছের মিলিবাগ বা ছাতরা পোকা ব্যবস্থাপনার জন্য অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গাছের গোড়া থেকে ২-৩ ফুট উপরে কাÐে প্যাকেজিং টেপ দ্বারা ব্যান্ডিং করতে হবে, যাতে করে মিলিবাগ বা ছাতরা পোকার সদ্য প্রস্ফুটিত নিম্ফগুলো গাছে উঠতে না পারে। প্রয়োজনে ব্যান্ডিং এর নিচে জমা হওয়া নিম্ফগুলো পটাশিয়াম সল্ট অব ফ্যাটি এসিড (ফাইটোক্লিন বা অন্য নামের) নামক জৈব বালাইনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১০.০ মিলিলিটার হারে অথবা কার্বারিল (সেভিন বা অন্য নামের) ৮৫ এসপি নামক কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে ছাতরা পোকার আক্রমণ কমানো সম্ভব হবে।
৭. রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করলে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নাও হতে পারে। রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে ফসল সংগ্রহের অপেক্ষমাণ সময় অনুসরণ করে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে অবশ্যই ফুল ফুটে যাবার আগে ১মবার এবং এর ৪-৫ সপ্তাহ পর আম মটরদানা আকৃতির হলে ২য়বার প্রতি লিটার পানির সাথে ইমিডাক্লোপ্রিড (কনফিডর বা অন্য নামের) ৭০ ডবিøউজি নামক কীটনাশক ০.২ গ্রাম হারে অথবা সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড বা অন্য নামের) ১০ ইসি নামক কীটনাশক ১.০ মিলিলিটার হারে অথবা ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন (ক্যারাটে বা অন্য নামের) ২.৫ ইসি নামক কীটনাশক ১.০ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে আম গাছের কাÐ, শাখা-প্রশাখা, পাতা ও মুকুল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করলে আমের হপার পোকা ভালোভাবে দমন করা সম্ভব হবে।
কীটনাশক প্রয়োগ করে আমের ফলের উইভিল বা ভোমরা পোকা দমন করা বেশ ব্যয়সাধ্য। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে উইভিলগুলো গাছে উঠা শুরু করে। এ সময় প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিলিটার হারে ফেনিট্রোথিয়ন (সুমিথিয়ন বা অন্য নামের) ৫০ ইসি নামক কীটনাশক মিশিয়ে গাছের কাÐ, শাখা-প্রশাখা ও পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে।
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকার ব্যাপক আক্রমণ হলে ডাইমিথোয়েট জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিলিটার হারে) ফুট পাম্পের সাহায্যে ¯েপ্র করতে হবে। লিচু পাতার ক্ষুদ্র মাকড় আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে মাকড়নাশক ওমাইট (প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিলিটার হারে) বা এবামেকটিন ১.৮ ইসি (প্রতি লিটার পানিতে ১.২ মিলিলিটার হারে) ¯েপ্র করে মাকড় দমন করা যায়। লিচু গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে একবার এবং একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলিলিটার হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড বা অন্য নামের) ১০ ইসি মিশিয়ে লিচু গাছের কাÐ, শাখা-প্রশাখা, পাতা এবং মুকুল ভালোভাবে ¯েপ্র করে লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করা সম্ভব।
উইভিল আক্রান্ত কলা গাছের গোড়ায় হেক্টর প্রতি ২০ কেজি হারে কার্বফুরান (ফুরাডান) ৩জি নামক দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। পেয়ারার সাদা মাছি পোকার আক্রমণের হার বেশি হলে এডমায়ার ২০০ এমএল (প্রতি লিটার পানিতে ০.২৫ মিলিলিটার) অথবা কোরোনডা (এসিফেট ও ফেনভেলারেট মিশ্রণ) প্রতি লিটার পানিতে ০.৭৫ মিলি মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর আক্রান্ত গাছে ¯েপ্র করতে হবে।
ফলের রোগের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
ফল গাছের জীবাণুজনিত এবং অপুষ্টিজনিত রোগের কারণেও ফল উৎপাদন ব্যাহত হয়। সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই দূর করা সম্ভব।
ফল সংগ্রহ শেষ হলে ডাল ও ফলের বোঁটা ছাঁটাই করে দিতে হবে, রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে ফেলতে হবে এবং কাটা অংশে বোর্দোপেস্ট লাগাতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছে বোর্দোমিক্সার (১০০ গ্রাম চুন, ১০০ গ্রাম তুতে ও ১০ লিটার পানি অথবা ১০০ গ্রাম চুন, ১০০ গ্রাম তুতে ও ৫ লিটার পানি অনুপাত) তৈরি করে স্প্রে করতে হবে।
গাছের নিচের পরিত্যক্ত ফল ও গাছের আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ ধ্বংস করতে হবে। আমের ক্ষেত্রে গাছে মুকুল আসার পর একবার ও ফল মার্বেল আকৃতির হলে আর একবার টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা ডাইথেন এম -৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এতে ফল পচা রোগ মুকুল সাদা হয়ে ঝরে যাওয়া রোগ দমন হবে।
কাঁঠালের মুচি পচা রোগ দমনের জন্য ডাইথেন এম -৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
অনুমোদিত দূরত্বে গাছ লাগাতে হবে। গাছে আলোবাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে এবং প্রয়োজনে অনুমোদিত বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। ফল গাছে বছরে দুইবার অনুমোদিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল ঝরা ও ফল ফাটা রোধের জন্য অন্যান্য সারের সাথে বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করলে বালাইনাশকের অপেক্ষমাণ সময় মেনে ফল সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলমান রেখেছে। কৃষি গবেষণা কর্তৃক উদ্ভাবিত জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক বালাই ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করছে। জৈব বালাইনাশক প্রযুক্তি ও রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ফল উৎপাদন গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলমান থাকলে ফলের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি ভোক্তার কাছে নিরাপদ ফল সরবরাহ নিশ্চিত হবে। য়
উপপ্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশ শাকসবজি, ফল ও পান ফসলের পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ৯১৩৩৬২৩ ই-মেইল : ddipm@dae.gov.bd
ড. মোহাম্মদ আলী১ ও মোঃ আহছানউল্যা২
চযুঃড় শব্দের অর্থ হচ্ছে উদ্ভিদ এবং ংধহরঃধৎু শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বাস্থ্য, অর্থাৎ চযুঃড়ংধহরঃধৎু শব্দের অর্থ হচ্ছে উদ্ভিদের স্বাস্থ্য। আর উদ্ভিদ সংগনিরোধ বা চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব হচ্ছে- যার মাধ্যমে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পণ্যের সংগে বা মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে দেশে বা বিদেশি বালাই প্রবেশ করতে না পারে অর্থাৎ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসম্মত উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পণ্য প্রবেশ করতে পারে। ফলে দেশের উদ্ভিদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে এবং দেশে ফসল উৎপাদনের কোন ধরনের বিপর্যয় ঘটবে না।
সেই আদিকাল থেকে মানুষ তার প্রয়োজনে পৃথিবীর এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। মানুষ যখন স্থানান্তরিত হয় তখন তার সাথে গরু ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফল-মূল, বীজ, গাছপালা ইত্যাদি বহন করেছে ফলে পৃথিবীর এক এলাকার পোকামাকড়, রোগ-বালাই অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে তবে তখনকার সময়ে রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের পরিমাণ কম থাকায় তখন ক্ষতির পরিমাণ ধর্তব্যের মধ্যে আসেনি আর দুর্বল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এ সকল রোগ-বালাই-পোকা-মাকড়ও তেমন ভাবে বিস্তার লাভ করেনি। কিন্তু বর্তমানে যাতায়ত ব্যবস্থার প্রভ‚ত উন্নতির ফলে পৃথিবীর এক এলাকার পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্যে ও মাধ্যমে বাহিত হয়ে অন্য এলাকায় বা দেশে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে, যেমনÑ গমের বøাষ্ট রোগ ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার রোগ হলেও বাংলাদেশে ব্রাজিল থেকে গম আমদানিতে যথাযথ উদ্ভিদ সংগনিরোধ বা ফাইটোস্যানিটারি ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে এ রোগ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ২০১৬ সালে। বর্তমানে রোগটি দেশের প্রায় ২৬টি জেলায় বিস্তার লাভ করেছে বলে জানা যায়। তা ছাড়া বর্তমানে আগের তুলনায় গমের উৎপাদন কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এদিকে ২০১৮ সালে ভুট্টার সব চেয়ে বিনষ্টকারী পোকা ফল আর্মিওয়ার্ম দেশে প্রবেশ করেছে যার ফলে ভবিষ্যতে যেমন ভুট্টা উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে ঠিক তেমনি উৎপাদন বৃদ্ধি করাও কষ্টকর হয়ে যাবে। অতীতে যে পোকাটিকে শুধু আমরা ধানের ছাতরা পোকা হিসেবে জেনেছি বর্তমানে বলা চলে এমন কোন শস্য নাই যাতে ছাতরা পোকার আক্রমণ হয় না। অনিয়ন্ত্রিত আমদানি এবং জনগণের সচেতনার অভাবে বর্তমানে মিলিবাগ বা ছাতরা পোকার বহু প্রজাতি দেশে প্রবেশ করেছে।
ইউরোপে ইঁনড়হরপ চষধমঁব বা ইষধপশ উবধঃয রোগ প্রবেশ প্রতিরোধ কল্পে ১৩৭৭ সালে আইনটি ছিল ভ্রমণকারীরা বন্দরে প্রবেশের পূর্বে ৪০ দিন সমুদ্রে আলাদা থাকবে, যাতে কেউ রোগ বহন করে নিয়ে আসলেও তা ৪০ দিনের মধ্যে প্রকাশ পাবে এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ফলে দেশে রোগটি প্রবেশ করতে পারবে না। এটিই ছিল ছঁধৎধহঃরহব, যা ইটালিয়ান শব্দ ছঁধৎধহঃধ বা ঋড়ৎঃু থেকে উৎপত্তি লাভ করে। মানুষের এই ছঁধৎধহঃরহব ধারণাটি উদ্ভিদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও শুরু হয় গমের ঝঃবস ৎঁংঃ প্রবেশ রোধকল্পে ফ্রান্সে প্রথম ১৬৬০ সালে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশ আলাদা আলাদাভাবে উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এই ধরনের আইন চালু করতে থাকে। তবে ১৮৪৫-১৮৫৪ সালে আইরিশ আলু এবং কাছাকাছি সময়ে ইউরোপে আঙুর উৎপাদন বিপর্যয়ের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং দেশান্তরী হওয়ার পর থেকে বিশ্বনেতারা উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন বা ফাইটোস্যানিটারি ব্যবস্থা-এর উপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সৃষ্টির পরপরই এর অধীনে এক দেশ হতে অন্য দেশে বালাই প্রবেশ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ সংস্থা বা ওচচঈ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঈড়হাবহঃরড়হ) এর সৃষ্টি করেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যখন এবহবৎধষ অমৎববসবহঃ ড়হ ঞধৎরভভং ধহফ ঞৎধফব (এঅঞঞ) এর সৃষ্টি হয় তখন এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আমদানি-রপ্তানিতে করারোপ বিষয়ে কিন্তু এঅঞঞ পুনরায় ডঞঙ (ডড়ৎষফ ঞৎধফব ঙৎমধহরুধঃরড়হ) তে রূপান্তর হওয়ার সময় এর ৮ম রাউন্ডের আলোচনায় ঝচঝ কে ডঞঙ এর সাথে জুড়ে দেন ফলে যখন ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি ডঞঙ এর বাস্তবায়ন শুরু হলে বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ঞযব অমৎববসবহঃ ড়হ ঃযব অঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ ড়ভ ঝধহরঃধৎু ধহফ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং বা সংক্ষেপে ঝচঝ গবধংঁৎবং (যেখানে ঝ= ঝধহরঃধৎু এবং চঝ = চযুঃড়ংধহরঃধৎু) এর কার্যক্রম শুরু হয়।
অর্থাৎ ওচচঈ, ডঞঙ এর ঝঃধহফধৎফ ঝবঃঃরহম বডি হিসেবে শুধু উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কি ধরনের এবং কিভাবে চযুঃড়ংধহরঃধৎু কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে তা অনুসরণ করার জন্য সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে এবং বিশ্বের সকল দেশের সাথে ঐধৎসড়হরুব করার জন্য কাজ করে, যাতে কোন দেশের বালাই পণ্যের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে অন্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে। ওচচঈ এ যাবৎ ৪৩টি স্ট্যান্ডার্ড বা ওঝচগং (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃধহফধৎফং ভড়ৎ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং) অফড়ঢ়ঃ করেছে, যা অনুসরণ করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশের ফল আমদানি-রপ্তানির চিত্র তুলনা করলে দেখা যায় যে, ফল আমদানির পাল্লাই বেশি ভারি। বিগত ৫ বছরের ফল আমদানি ও রপ্তানির নি¤েœর চিত্রটিই আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
সূত্র : উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
উপরের চিত্রানুযায়ী আমাদের আমদানি ৫৩১৪৫৬ এর বিপরীতে রপ্তানি মাত্র ২৯৭৫ মে.টন।
ফল বলতে সাধারণত : তাজা, শুকনো এবং প্রসেস এবং ক্যানিং ফলকে বুঝানো হয়। ক্যানিং ফল ব্যতীত সকল প্রকার ফলের মাধ্যমেই পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই বাহিত হয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় বিস্তার লাভ করতে পারে এ জন্য এই ধরনের সকল প্রকার ফলের জন্য উদ্ভিদ সংগনিরোধ বা ফাইটোস্যানিটারি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ফলের সকল প্রকার অবস্থার মধ্যে তাজা ফলই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই বহন করে।
নি¤েœ আমদানি ও রপ্তানিকৃত কতিপয় ফল কি কি ধরনের বালাই পরিবাহিত করে এবং কি কি ধরনের ফাইটোস্যানিটারি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয় তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলোÑ
সাইট্রাল বা লেবুজাতীয় ফল : বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কমলা জাতীয় ফল আমদানি করে। কিন্তু লেবু বা কমলা জাতীয় এই ফলে সকল দেশে একই ধরনের রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড় থাকে না, যেমনÑ অস্ট্রেলিয়ার কমলাজাতীয় ফলে যে ধ্বংসাত্মক মাছি পোকা গবফরঃবৎৎধহবধহ ভৎঁরঃ ভষু বা ঈবৎধঃরঃরং পধঢ়রঃধঃধ রয়েছে তা বাংলাদেশে নাই। আবার আফ্রিকা অঞ্চলে রয়েছে অন্য প্রজাতির মাছি পোকা অহধংঃৎবঢ়যধ ংঢ়ঢ়. এবং এঁরমহধৎফরধ পরঃৎরপধৎঢ়ধ বা ঈরঃৎঁং ইষধপশ ঝঢ়ড়ঃ রোগ যা বাংলাদেশে নাই বলে ধারণা করা হচ্ছে ফলে লেবু জাতীয় এ সকল ফল আমদানির জন্য ফাইটোস্যানিটারি কার্যক্রম হচ্ছেÑ ১. আমদানি অনুমতি পত্রের শর্তে থাকতে হবে রপ্তানিকারক দেশের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ রপ্তানিকৃত ফলটি যেন চবংঃ ঋৎবব অৎবধ (চঋঅ) বা অৎবধ ড়ভ খড়ি চবংঃ চৎবাধষবহপব (অখচচ) থেকে সরবরাহ করে এবং রপ্তানির পূর্বে পণ্যটি ০০ঈক্ট ১-২০ঈ তাপমাত্রায় রাখে বা জাহাজের কনটেইনারে ঐ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। রপ্তানিকারক দেশ বিষয়টি স্পষ্ট করে উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সনদে উল্লেখ করবেন।
আমদানিকারক দেশের উদ্ভিদ সংগনিরোধ পরিদর্শক প্রথমেই পণ্যের কনটেইনারের তাপমাত্রার চেকলিস্ট দেখবেন এবং নোট করবেন এর পর কনটেইনার খুলে আইএসপিএম-৩১ মতে স্যাম্পল গ্রহণ করবেন এবং ফলগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, রোগ বা পোকার আক্রমণের কোন নমুনা পাওয়া যায় কিনা এবং পরবর্তীতে ফলগুলো কেটে কেটে দেখবেন পোকার কোন কীড়া বা পোকা থাকার কোন নমুনা রয়েছে কিনা তারপর পরিদর্শক নিশ্চিত হয়ে পণ্যটি ছাড়পত্র প্রদানের বা কনসাইনমেন্ট ফেরত পাঠানো বা ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যবস্থা নেবেন।
এবার লেবু জাতীয় ফল রপ্তানি বিষয়ে বলতে হয় এক সময় বাংলাদেশ থেকে জারা লেবু, আদালেবু, জামির, কাগজিলেবু, বীজশূন্য লেবু রপ্তানি করা হত। বর্তমানে শুধু জারা লেবুই রপ্তানি করা যায়, লেবুর মারাত্মক ক্যাংকার রোগের কারণে অন্য জাতের লেবু রপ্তানি করা যাচ্ছে না। জারা লেবু কিছুটা ক্যাংকার সহিষ্ণু এবং কোন কোন এলাকায় নতুন নতুন বাগান হওয়াতে এটি এখনও রপ্তানি করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ অদ্যাবধি লেবুর চবংঃ ঋৎবব অৎবধ (চঋঅ) বা অৎবধ ড়ভ খড়ি চবংঃ চৎবাধষবহপব (অখচচ) তৈরির বা ঘোষণা দেয়ার চেষ্টা করে নাই এমনকি এ বিষয়ে বড় ধরনের কোন গবেষণাপত্রও পাওয়া যায় না। ফলে লেবুর ক্যাংকার চঋঅ বা অখচচ অনুসরণ বা বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আমরা জারা লেবু ব্যতীত অন্য লেবু ইউরোপে রপ্তানি করতে সক্ষম হবো।
আম : বিশ্বে ৯০টির বেশি দেশ আম উৎপাদন করে এবং বিশ্বে আম উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করলেও রপ্তানির শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। কারণ আমদানিকারক দেশের চযুঃড়ংধহরঃধৎু ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎবসবহঃং হচ্ছে ফলের মাছি পোকা ইধপঃড়পবৎধ ফড়ংধষরং, ঝঃড়হব ডববারষ এবং চঁষঢ় ডববারষ এবং রোগ অহঃযধপহড়ংব মুক্ত আম। বর্তমানে বাংলাদেশে সীমিত পর্যায়ে এই আমদানি শর্ত পূরণের চেষ্টা চলছে কিন্তু কোন সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় এর অগ্রগতি কমই বলা চলে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কোন বছরে ১০০০ মে. টন আম রপ্তানি করতে পারেনি শুধুমাত্র চযুঃড়ংধহরঃধৎু ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎবসবহঃং পূরণ করতে না পারার কারণে। অথচ পূরণ করতে পারলে বছরে ২০,০০০ মে.টন আম রপ্তানি করা সম্ভব।
লেবু জাতীয় ফল আমদানিতে যে সমস্যা বিদ্যমান আম আমদানিতেও একই সমস্যা বিদ্যমান অর্থাৎ বালাই একই তবে এখানে ট্রিটমেন্ট ভিন্ন। আমদানি অনুমতি পত্রে মূলত ফলের মাছি পোকা মুক্ত এলাকা অথবা কম মাছি যুক্ত এলাকা থেকে আম সংগ্রহ এবং ট্রিটমেন্ট হিসেবে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বা ভ্যাপর হিট ট্রিটমেন্ট উল্লেখ থাকতে হবে এবং পণ্যের ছাড় পত্র প্রদান পদ্ধতি লেবু জাতীয় ফলের ছাড়পত্র পদ্ধতি প্রদানের মতো।
পেয়ার, কুল/বরই : পেয়ার এবং কুল বা বরই রপ্তানি এবং আমদানিতে মূল সমস্যা ফলের মাছি পোকা তবে এর সাথে মিলিবাগ বা ছাতরা পোকার উপস্থিতি একটি বড় বিষয়। মাছি পোকা দমন করতে না পারায় বর্তমানে ইউরোপে কুল রপ্তানি বন্ধ।
রাম্বুতান, ড্রাগন ফ্রুট, পেঁপে ইত্যাদি : রাম্বুতান, ড্রাগন ফ্রুট এবং পেঁপে ইত্যাদি ফলের মাধ্যমেই জায়ান্ট মিলিবাগ ব্যতীত অন্যান্য জাতের মিলিবাগ বা ছাতরা পোকা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ জাতীয় ফল আমদানিতে মিলিবাগ, থ্রিপ্স মুক্ত করে পাঠাতে হবে মর্মে শর্ত দিতে হবে এবং আমদানিকৃত পণ্য যথাযথভাবে ইনসপেকশন করে ছাড়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যে এ সকল পোকার উপস্থিতি থাকলে এবং দেশে মুক্ত করা না গেলে কনসাইনমেন্ট ধ্বংস করতে হবে বা ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কাঁঠাল : কাঁঠাল রপ্তানিতে এখনও জোরালো কোন সমস্যা আসেনি। তবে বর্তমানে কাঁঠাল গাছে মিলিবাগের আক্রমণ যে কোন সময়ে ফলটি রপ্তানি সমস্যায় ফেলতে পারে। কাঁঠালের আরেকটি সমস্যা ফলের মাছি পোকা যদিও এ পর্যন্ত এর একবার মাত্র ইন্টারসেপশন হয়েছে। এ ফলের আরেকটি সমস্যা রয়েছে ফল রপ্তানিতে ফলটির কোন ইউনিফরমিটির ব্যবস্থা করা যায় না, যা অন্য দেশ করে থাকে। বর্তমানে কাঁঠাল ফলটি ধুয়ে এবং যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে রপ্তানি করা হচ্ছে।
আপেল : বাংলাদেশে আপেল উৎপাদন হয় না, অতএব আপেল বাংলাদেশে আমদানি করতে হয়। আপেল আমদানিতে মূল সমস্যা হচ্ছে আপেলে মোট তিন ধরনের বালাই হয়ে থাকে তার মধ্যে ২টি পোকা এবং একটি রোগ। পোকা ২টি হচ্ছে- ফলের মাছি পোকা ও কডলিং মথ এবং রোগ হচ্ছে আপেলের ফায়ার বøাইট।
ফলের যে মাছি পোকা তা হচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে উপস্থিত মাছি পোকা থেকে ভিন্ন জাতের, অতএব ফলের মাছি পোকা যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কডলিং মথ এবং ফায়ার বøাইট বাংলাদেশে উপস্থিত আছে বলে কোন প্রমাণ নাই এবং গবেষণাপত্রও নাই তবে এর হোস্ট প্ল্যান্ট বাংলাদেশে উপস্থিত থাকায় এ ধরনের বালাই থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঝচঝ গবধংঁৎবং এবং ওচচঈ এর নির্দেশনা অনুসরণ করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারলে ধীরে ধীরে আমাদের আমদানির পরিমাণ বাড়তে থাকবে এবং বহিঃ বিশ্বে বাজার এক সময় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে মার্কেট একসেস ধরে রাখাসহ বাজার সৃষ্টিতে এবং বৃদ্ধিতে জরুরি ভিত্তিতে চঈঊ (চযুঃড়ংধহরঃধৎু ঈধঢ়ধপরঃু ঊাধষঁধঃরড়হ) বাস্তবায়ন করতে হবে। য়
১প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশে ফাইটোস্যানিটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ২অতিরিক্ত পরিচালক (এল আর), ফল আমদানি-রপ্তানিতে ফাইটোস্যানিটারি কার্যক্রম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১৭০১৪৯৬, ই-মেইল : m.alidau87@yahoo.com
কৃষিবিদ মোঃ আবদুল্লাহ-হিল-কাফি
খেজুর হলো পৃথিবীর প্রথম চাষকৃত ফল । আজ থেকে প্রায় ৯০০০ বছর পূর্বে প্রথম খেজুর গাছ রোপণ করার রেকর্ড রয়েছে। প্রায় ৫৫০০ বছর পূর্ব থেকে ডালিম, ডুমুর, জলপাই ইত্যাদি ফল খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফল জন্মে, যার মধ্যে ৭০ রকমের ফল চাষ করা হয়। এছাড়া কিছু অপ্রচলিত ফল আছে যেমন সাতকরা, কুল, লটকন, লেবু এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। প্রচলিত ফলের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়, আম, লিচু, পেয়ারা, কলা, কাঁঠাল, আনারস, শরিফা, পেঁপে, কুল, নারিকেল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ।
এ দেশে ফল উৎপাদন বছরব্যাপী সুষমভাবে বণ্টিত নয়। বেশিরভাগ ফলই উৎপাদিত হয় মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। বাংলাদেশে যে ফল উৎপন্ন হয় তার ৪০ শতাংশই কলা। এজন্য গ্রীষ্মকালকে বলা হয় মধুঋতু ও জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলা হয় মধুমাস। প্রতিদিন আমাদের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ভিটামিন সি-এর দরকার হয় মাত্র ৩৮ মিলিগ্রাম। অথচ ১০০ গ্রাম কাগজিলেবুর মধ্যেই আছে ৬৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং আমে জাতভেদে গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিগ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের মধ্যে ক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ আছে প্রায় ৪৬০০ আন্তর্জাতিক একক। অথচ সেখানে আঙুরে আছে মাত্র ১০০ ও আপেলে আছে ৯৮ আন্তর্জাতিক একক। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলসায় ক্যালসিয়াম আছে ১২৯ মিলিগ্রাম, অথচ ওই পরিমাণ আপেলে আছে মাত্র ১১ মিলিগ্রাম। ভারতে এ ফলটাই এখন অনেক চাষি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন, ফলসার সিরাপ তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তেঁতুলেও যথেষ্ট ক্যালসিয়াম রয়েছে। আমাদের পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ১০০-১১০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু ভিন্নতর দৈন্যতায় আমরা খেতে পারছি মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম।
ফল নিরাপদ কিনা তাই নিয়ে অনেক সময় আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তবে এ সকল দিক বিবেচনা করে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার অনেক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গত ১০ অক্টোবর ২০১৩ দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ অনুমোদন করেছে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদান এবং নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে গত ২ ফেব্রæয়ারি ২০১৫ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। আইনের আলোকে এবং গৃহীত উৎকৃষ্ট পন্থায় খাবার সব সময় এবং সকলের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষায় ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পৌঁছানোর জন্য বর্তমানে এই কর্তৃপক্ষের কাজ করে যাচ্ছে।
আমারা ফল খাওয়ার সময় অনেকেই কার্বাইড আতংকে থাকি। ‘ক্যালসিয়াম কার্বাইড’ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এর ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে আমসহ অন্যান্য ফল সহজে পাকানো যায়। এটি খুবই শক্ত এক ধরনের যৌগ। যা বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে এলেই উৎপন্ন করে এসিটিলিন গ্যাস। এটি ফলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানলে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, ক্যান্সারসহ গর্ভবতী মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরা। যার ফলে বিষাক্ত খাদ্য নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে।
কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল চেনার উপায়
১. মৌসুমের আগে বাজারে আসা কোন ফল কিনে খাওয়া উচিত নয়। তাহলে টাকা দিয়ে বিষ কেনা হবে। কেননা ওই সময়ের সব ফল কৃত্রিম উপায়ে কার্বাইড দিয়ে চকচকে রঙের ফল পাকানো হয়ে থাকে। যা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
২. যেসব ফলের গায়ের রঙ সর্বত্রই একই রকমের, দেখতে অনেকটা টকটকে কাঁচা হলুদ রঙের মতো। বুঝতে হবে তা কৃত্রিম উপায়ে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল।
৩. কৃত্রিম উপায়ে কলা পাকানো হলে কলার রঙ হলুদ এবং কলার বোঁটা, কাঁদি গাঢ় সবুজ থেকে যাবে। টমেটোর রঙ ও চামড়া সমানভাবে টকটকে গাঢ় লাল হয়ে যাবে। আম ও পেঁপের রঙ কমলার মতো রঙ হয়ে যাবে। ধরে নিতে হবে তা কার্বাইড দিয়ে পাকানো। সুতরাং ফল কিনতে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ফল খেতে সতর্কতা ও সাবধানতা
১. মৌসুমের আগে বাজারে সরবরাহকৃত ফল না খেয়ে মৌসুম শুরু হলে ফল খাওয়া উচিত। যদি আমের কথায় বলি তবে সাধারণত বিভিন্ন জাতের আম ধারণ থেকে পরিপক্ব হতে যে সময় প্রয়োজন তা ছকের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হলো।
সাধারণত ফজলি ১১২ -১২০ দিন, গোপালভোগ ৮৪- ৯১ দিন, ল্যাংড়া ৯৫-১০৫, খিরসাপাত ৮৭-৯৫ এবং ‘বারি আম -১ এর জন্য ৮৫-৯৩ দিন প্রয়োজন হয়। এ গুলি বিষয় প্রচার ও সচেতনতা প্রয়োজন।
২. ফল খাওয়ার আগে অন্তত ৩০ মিনিট ফল বিশুদ্ধ খাওয়ার পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
৩. টেপের নিচে রেখে কয়েক মিনিট পানিতে ধৌত করে ফল খেতে হবে।
৪. ফল কামড়িয়ে না খেয়ে টুকরা টুকরা করে, চামড়া ছিলে খাওয়া উচিত।
নিরাপদ উপাদান দিয়ে ও ফল পাকানো সহজ
ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ বা ইথাইলিন গ্যাসের মাধ্যমে ফল পাকানো কিছুটা নিরাপদ বলে অভিহিত করা হয়। ইথ্রেল বা ইথেফোন ফলের মধ্যে ঢুকে ইথাইলিনে রূপান্তরিত হয় বলে ফল পেকে যায়। এ পদ্ধতিতে ফল পাকলে বিপদের ঝুঁকি কম থাকে। ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপাদান ব্যবহার না করেও প্রাকৃতিক উপায়ে পরিপক্ব কাচা ফল পাকানো পদ্ধতি অতি পরিচিত ও আদিম পদ্ধতি। যা স্বাস্থ্যসম্মত বলে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। কয়েকটি ছোট ছিদ্রযুক্ত বাদামি রঙের কাগজের থলেতে ভরে-তাতে ২/১টি আপেল ভরে মুখ বন্ধ করে দিয়ে খড় বা গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। আপেলে সাধারণত বিপুল পরিমাণে ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে যা ফল পাকাতে সাহায্য করে । ফলে ভেজাল দূরীকরণে যে সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো-
ক. জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার,
খ. বাগানি, কৃষক, ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, আড়তদার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
গ. মোবাইল টিমের মাধ্যমে মূল উৎস খুঁজে তাতে হানা দেয়া।
ঘ. গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ মনিটরিং সেল গঠন করা ।
ঙ. ভেজাল পণ্য মনিটরিং, ভেজাল এবং মূল উৎস খুঁজে তাতে তাৎক্ষণিক মোবাইল টিমের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে দÐ ও জরিমানার মাত্রা বৃদ্ধি করে প্রয়োগ করা।
চ. ভেজালরোধী টিমে কার্বাইড, ফর্মালিন, বিষাক্ত কেমিক্যাল, কীটনাশকের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য আধুনিক প্রয়োজনীয় কীট বক্স সরবরাহ।
স্বল্প সময়ের মধ্যে ফলদানে সক্ষম কয়েকটি ফল আবাদ করে সহজেই লাভবান হওয়া যায় যেমন:
কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কুল, আম, আমড়া, লিচু- এসব আবাদকরে দ্রæত লাভবান হওয়া যায়। সবরি, সাগর এবং রঙিন মেহের সাগর এ তিন জাতের কলা চাষ বেশ লাভজনক। রেড লেডি ও কহিনুর নামক বিদেশি জাত দুটি বাগান আকার আবাদ লাভজনক। এ জাত দুটি উভলিঙ্গিক (বাইসেকসুয়াল) তাই প্রতি মাদায় এ জাতের মাত্র একটি করে চারা রোপণ করতে হয়। এখন সারা বছরব্যাপী আম পেতে বারি আম-১১ চাষ করা যেতে পারে। আর অতি ঘন পদ্ধতিতে আম চাষের জন্য বারি আম-৪ খুব উপযোগী।
অত্যাধিক তাপমাত্রা, বাগানের মাটিতে রসের অভাব, জলাবদ্ধতা, অতিমাত্রায় সার প্রয়োগ, খাদ্য ও হরমোন ঘাটতি, রোগ-পোকার আক্রমণ এবং সময় উপযোগী পরিচর্যার অভাবই ফল কম ধরা ও ঝরার প্রধান কারণ। এ ছাড়া অনুখাদ্য ও হরমোনের ঘাটতির কারণে ফুল-ফল ঝরে। ফল আবাদে ফল ধরা একটি মারাত্মক সমস্যা তাই এটি দূরীকরণে যা দরকার তা হলো-
কাজেই ঝরা রোধে গাছে ফুল আসার ৩ সপ্তাহ আগে প্রতি লিটার পানিতে ফ্লোরা ২ মিলি, ডেসিস-১ মিলি, গোল্ডাজিম ১ মিলি/ব্যাবিস্টিন-১ গ্রাম এবং লিবরেল বোরন ১.৫ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুস্থ ফুল ধরতে সহায়ক হয়।
ফুল (কুঁড়ি) বের হওয়া মাত্র প্রতি লিটার পানিতে ইমিটাফ ০.৫ মিলি, ডেসিস ১ মিলি, ক্যাবরিয়টফ১ গ্রাম, ফ্লোরা ২ মিলি এবং বোরন ১.৫ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুস্থ ফুল-ফল ধরবে।
কচি ফল আশা মাত্র প্রতি লিটার পানিতে ইমিটাফ ০.৫ মিলি, লিটোসেন ১ মিলি এবং ক্যাবরিয়টফ ১ গ্রাম মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর দুইবার স্প্রে করা দরকার।
পরে ফল একটু বড় হলে প্রতি লিটার পানিতে ডেসিস ১ মিলি, সিকিউর ২ গ্রাম এবং নাফা ২.৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করলে কচি ফল ঝরা বন্ধ হবে এবং ফলের গুণাগতমান বাড়বে।
প্রতি বছর দেশব্যাপী ফল মেলার আয়োজন ও প্রচারণার কারনে ফল সম্পর্কে জনসাধারণের উৎসাহ বৃদ্ধি ও চাষাবাদের আগ্রহ বেড়েছে। এর কারণে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্যিক ফল চাষ ও প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠছে। তবে দেশি ফলে দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের আধুনিক মানসম্মত নার্সারি, মানসম্মত মাতৃগাছের বাগান স্থাপন, দেশি ফলের মিশ্র বাগান প্রতিষ্ঠা, বহুস্তরী বাগান প্রতিষ্ঠা, অতি ঘন উপয়ে আম বাগান প্রতিষ্ঠা, বাজার বা বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ এগুলির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমরা আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, মোট ফলের উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম এসব গৌরবের পরিসংখ্যানের আরো উন্নতি করতে পারব। য়
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, রাজশাহী, ০৭২১৭৭৩২৭৭ ই-মেইল :rajshahi@yahoo.com
ঢাকা শহরে কমপক্ষে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ছাদ রয়েছে (সাড়ে চার হাজার হেক্টরের বেশি) যা দেশের কোন একটি উপজেলার সমান বা বেশি। যেখানে বাসস্থান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ব্যাংক, শপিং মল, কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি বেশি। বিল্ডিং কোডে ২০% সবুজ থাকার কথা থাকলেও মানার বিষয়টি আশাব্যঞ্জক নয়। শহরবাসীর পুষ্টির বিষয়টি মাথায় নিলে ফল চাষ অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলেও সবজি, ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ-পালা লাগানোর পরিমাণ শহরে তুলনামূলক বেশি। এটিও আশার বিষয় যে, নগরে সবুজের পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু এর সাথে সাথে পুষ্টি পাওয়ার বিষয়টি গুরুত¦ সহকারে ভাবতে হবে এবং তা এখনই করার উপযুক্ত সময়। তাই নগরে ফল ও সবজি চাষের জন্য ছাদ-বাগানসহ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নগরে টেকসই ও জনপ্রিয় করতে হবে। একটি গবেষণায় জানা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন উন্নত দেশে ৭০% এবং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে ১০০% বাড়াতে হবে। আর নগর কৃষি বললে উলম্ব বা ভার্টিক্যাল ফার্মিং সমার্থকভাবেই চলে আসে।
নগর কৃষি ও বাণিজ্যিক উলম্ব (Commercial vertical urban farming) নগর চাষাবাদ
একবিংশ শতাব্দীতে আরো দ্রুত নগরায়ণের এবং জনসংখ্যা ২০৫০ সালে ৮.৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে পৃথিবীর ৩৮% স্থল প্রায় ৮০০ মিলিয়ন হেক্টর ফার্মিং এর আওতায় এবং অতিরিক্ত জনগণকে খাওয়ানোর জন্য এখনকার কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করলে আরো ১০০ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু এই পরিমান কৃষি জমি অবশিষ্ট নাই যার ফলে বাণিজ্যিক ভার্টিক্যাল চাষাবাদ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই যা অবশ্যই নগর কৃষির অন্তর্গত। গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী, সুউচ্চ ৩০তলা ভবনে ২৭,৮০০০,০০০ বর্গমিটার ভার্টিক্যাল ফার্ম স্থাপন করা যায় যা দিয়ে ৫০,০০০ মানুষকে খাওয়ানো যাবে যেখান থেকে প্রত্যেক জনকে ২০০০ ক্যালরি প্রতিদিন দেয়া সম্ভব। সুতরাং, বলাই যায়, ভবিষ্যৎ এর জন্য একমাত্র মাধ্যম হবে নগর ভার্টিক্যাল কৃষি ফার্ম। আরো উল্লেখ্য যে, বর্তমান ভূমি কৃষির যে সকল সমস্যা যেমন- পরিবহন সমস্যা, সংরক্ষণ সমস্যার মতো কোন সমস্যা নগর কৃষিতে থাকবে না কারণ নগর কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের ফলে প্রত্যেক ফার্ম থেকে ফ্রেশ ফল বা সবজি সরাসরি বাজারজাত করা যাবে যেখানে ডিজাইনার, প্রকৌশলী, পুষ্টিবিদসহ অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং এতে একদল দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে।
বাণিজ্যিক নগর কৃষি আরো টেকসই করা সম্ভব কারণ এতে সেচের পানির অপচয় ৪০-৬০% কমিয়ে এনে ৩-৪গুণ ফলন বাড়ানো যায় যেখানে হাইড্রোপনিক্যালি পুষ্টিউপাদানসমৃদ্ধ পানিকে অটোমেটিক এবং জলবায়ুনিয়ন্ত্রিত বিল্ডিং এ সংরক্ষন করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। যদিও আধুনিক এই প্রযুক্তির ইনডোর ভার্টিক্যাল ফার্মিং এ আর্টিফিসিয়াল খঊউ ষরমযঃ, ধৎঃরভরপরধষ রহঃবষষরমবহপব (অও), ধঁঃড়-রৎৎরমধঃরড়হ রিঃয ংড়ষঁঃরড়হ ব্যবহারের কারণে এককালীন খরচ বেশি হবে বিধায় স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে এর খরচ কমিয়ে আনাটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই জায়গাটিতে সহযোগিতা করতে পারে শেকৃবি ও বাকৃবিতে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাব-ল্যাব ও প্রকৌশল বিভাগগুলো; এছাড়াও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে কাজ করলে বাণিজ্যিক নগর ফার্মিং টেকসই ও লাভজনক করা সম্ভব।
আধুনিক নগর চাষাবাদ : বাণিজ্যিক নগর ভার্টিক্যাল ডিভাইস (ঈড়সসবৎপরধষ ঁৎনধহ াবৎঃরপধষ ভধৎসরহম ফবারপব রিঃয খঊউ ষরমযঃরহম), গ্রিনহাউজ হাইড্রোপনিক (এৎববহযড়ঁংব যুফৎড়ঢ়ড়হরপং), ইকুয়াপনিক্স (অয়ঁধঢ়ড়হরপং) ছাড়াও স্মার্ট ফার্মিং ডিভাইস (ঝগঅজঞ ভধৎসরহম ফবারপব), গ্রিন স্ক্রিন (এৎববহ ঝপৎববহ রিঃয ধঁঃড়- রৎৎরমধঃরড়হ), স্বয়ংক্রিয় সেচসমৃদ্ধ ভার্টিক্যাল লাইন ডিভাইস (ঠবৎঃরপধষ ভধৎসরহম ফবারপব রিঃয ধঁঃড়-রৎৎরমধঃরড়হ), স্বয়ংক্রিয় ছাদ-বাগান ঠা-াকরণ ডিভাইস (জড়ড়ভঃড়ঢ় পড়ড়ষরহম রিঃয ভড়মমরহম ংুংঃবস) ইত্যাদি এখন আমাদের দেশেই সম্ভব এবং তা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে একদল উদ্যমী নন-কৃষিবিদ যাদের সাথে মিলে কৃষিবিদগণ কাজ করলে দেশে বাণিজ্যিক নগর চাষে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রাইভেট কোম্পানি সাফল্যজনকভাবে কাজ করছে মাইশা গ্রুপ (গ্রিনহাউজ-নেট মেলন চাষ), প্যারামাউন্ট গ্রুপ (গ্রিনহাউজ হাইড্রোপনিক-লেটুস, নেট মেলন, টমেটো), পারটেক্স গ্রুপ ইত্যাদি।
যে সকল ফল বেশি জনপ্রিয় : ধারণা ছিল নগরে বা ছাদে একটু ছোট জাতের, ঝোপালো ফল-সবজি গাছ লাগানো ভালো, এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে ১৫-২০ বছর যাবত ছাদ-বাগান করে আশা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো। নগরে এবং ছাদে কি হয় না, সব হয়-ছোট জাতের ভিয়েতনামিজ নারিকেল, সব জাতের আম, আমড়া, কামরাঙা, জাম, জামরুল, কদবেল, থাই ও মিসরীয় ডুমুর, আনার, ডালিম, লটকন, থাই লিচু, সিন্দুরী পেয়ারা আম, জাম, হলুদ এবং সাদা ড্রাগন ফল, বারোমাসি আম, বীজহীন লেবু, লাল স্ট্রবেরি পেয়ারা, লাল ইক্ষু, কমলা, বারি মাল্টা, অ্যাভোকেডো, রাম্বুটান ছাড়াও গতানুগতিক সব দেশি ফলতো এখন সাধারণ বিষয়। বীজ থেকে যে সকল ফল নগরবাসী গতানুগতিক চাষ করে তার মধ্যে করমচা, শরিফা, বিলিম্বি ইত্যাদি কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবই কলমের ফল গাছ। আসলে এখন ছাদ-কৃষির কল্যাণে নগরবাসী সব ধরনের ফল গাছই চাষ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
গবেষণার হালচাল : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) সবজি নিয়ে কাজের সাথে সাথে স্ট্রবেরি ফল নিয়ে কাজ করছে। এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কজন ছোট ছোট পরিসরে ভার্টিক্যাল চাষাবাদ করছে। বীজবিহীন জাম, গ্রাফটেড কাঁঠালও চাষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক নগর কৃষক। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে অনেকেই বীজ, চারা এনে অনলাইনে বিক্রি করছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। বেশিরভাগ নগর কৃষক কৃষিবিদ নন কিন্তু নিজ আগ্রহ ও নেশা থেকে অনেক নগর কৃষক অপ্রচলিত এবং ভিন্নরকমের, স্বাদের, রংয়ের ফল বীজ ও চারা বিক্রি পেশা হিসেবে নিয়েছেন যার মধ্যে একটি বড় অংশ নারী-কৃষক গবেষণায় আরো বেশি মনোযোগ দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
নিরাপদ ও কোয়ালিটি ফল চাষে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জেনে রাখা ভালো-
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও জৈব চাষাবাদ : ট্রাইকোডার্মা মিশ্রিত সার, বায়োচার, জীবাণুমুক্ত কোকোডাস্ট ইত্যাদি মাটির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে মাটি শোধনের পাশাপাশি গ্রোয়িং মিডিয়ার গুণাগুণ ভালো থাকবে এবং ভালো ফল-সবজি হবে। ভার্মি কম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার, চা-কম্পোস্ট, ডিম খোসা ভাঙ্গা মিশানো, নতুন মাশরুম কম্পোস্ট (পটাশ ও ফসফরাস আধিক্য), নিম খৈল, সরিষা খৈল, ইত্যাদি ছাড়াও যে কোন বায়োলজিক্যাল কম্পোস্ট ব্যবহার করুন।
রোগ-পোকামাকড় দমন : নিয়ম মেনে রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করতে হবে; ফল ও ফল-জাতীয় সবজি চাষে ফল আহরনের কমপক্ষে ২০ দিন আগে থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করা। পোকা দমনে ফ্লাইং ইনসেক্ট এর জন্য ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ (কারিগরি সহায়তার জন্য অওঝ, উঅঊ, ঋঅই খঅই-শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করতে পারেন), আঠালো (ঝঃরপশু ঃৎধঢ়) ট্রাপ, পেয়াজ পাতার ও ছোলা পেস্ট বা নির্যাস, রসুনের, গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকার (সর্বাধিক কার্যকরী-ফুলের দোকানে ফেলে দেয়া ফুল) ফুলের নির্যাস ভালো কাজ করবে।
মিশ্র-ফসল : একই সাথে একটি বেডে ফল গাছের ড্রামে বা প্লেন্টার বক্সে ফল গাছের সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি, ঔষধি ও গাদা চাষ করা। আমাদের দেশে সকল মৌসুমে সকল স্থানে সকল ফল চাষ করা সম্ভব প্লাস্টিক বোতল না ফেলে যে কোন -ফল-ফসলের বীজ চারা লাগিয়ে, নিজেই নিজের অক্সিজেন ফ্যাক্টরি স্থাপন করা যায়।
নগর কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ছাদ-বাগান ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা গবেষণায় জানা যায়, ঢাকা শহরের ৭৬% ছাদ-বাগানী প্রশিক্ষন নিতে চায়। প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার জন্য আপনার নিকটস্থ কৃষি অফিস হর্টিকালচার সেন্টার ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগসহ ফেসবুক গ্রুপগুলো পরামর্শ স্বতঃস্ফূতভাবে প্রদান করে। অনলাইন পোর্টাল করে, ফেসবুকে গ্রুপ করে নিজেদের ফল-ফসল আদান-প্রদান করা। নিরাপদ নগর কৃষির তথ্য ও চাষাবাদের সকল উপাদানের উৎস ও উপাদান আদান-প্রদান করা। সঠিকভাবে ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং শহুরে কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে ছাদ-বাগান করলে ছাদের ক্ষতি তো হয়ই না বরং টেকসই সবুজ আচ্ছাদন অক্সিজেন সরবরাহ করে বাসস্থান-অফিস ও প্রতিষ্ঠানকে আরো আরামদায়ক ও শান্তিময় রাখবে। ছাদ-কার্নিশ বা ব্যালকনিতে পটে বা টবে আবাদে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে বিল্ডিং বা এপার্টমেন্টের নিচ দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারী দুর্ঘটনার শিকার না হন।
নগর-কৃষি প্রচারণা : সম্প্রতি উঅঊ নগর কৃষি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় শুরুতে ঢাকা শহরে প্রায় ৬০০ ছাদ-বাগান টার্গেট করে কাজ শুরু করেছে। এতে থাকবে প্রচুর প্রশিক্ষণ, হাতে-কলমে শিক্ষা ছাড়াও আরো ছাদ-বাগান প্রতিষ্ঠা করা। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার, কৃষি মন্ত্রণালয় নগর কৃষিকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এখন সবচেয়ে জরুরি যারা ১৫-২০ বছর ছাদ-বাগান বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরই প্রচেষ্ট্য়া নগর আজ সবুজ ও ফুল-ফল-সবজিময় হচ্ছে, তাদের সাথে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করলে নগর কৃষি বিষয়ক কার্যক্রম সফলতা লাভ করবে।
চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বাণিজ্যিক নগর ভার্টিক্যাল চাষাবাদকৃত ফল-ফসল বাজারজাত করছে সাফল্যজনকভাবে। অথচ আমরা নগর কৃষি বলতে এখনও ছাদ-কৃষিকেই বুঝাই এবং তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। হ্যাঁ, এটা ঠিক শহরে চাষাবাদের একটি বৃহৎ প্লেস ছাদ এবং এ দিয়ে প্রচুর পরিবারের ফল-ফসলের চাহিদা মিটছে কিন্তু এর পাশাপাশি এখনই ভাবতে হবে বাণিজ্যিক নগর ভার্টিক্যাল ও ইনডোর চাষাবাদ নিয়ে যা দেশের কৃষি সেক্টরে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে যা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে এশিয়ার বেশ কটি দেশ। আমাদের এখনই সময় আধুনিক নগর কৃষি নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা, প্রকল্প নিয়ে কাজ করা। নতুন নতুন সৃজনশীল (ওহহড়াধঃরাব) পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণার সাথে সাথে নতুন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা এবং নগর কৃষি বাজার অনলাইন শপ তৈরির মাধ্যমে নগর কৃষি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার এখনই সময়।
ড. এ এইচ. এম. সোলায়মান
সহযোগী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি, বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭ ও ফ্যাব ল্যাব ম্যানেজার, ফ্যাব ল্যাব শেকৃবি, মোবাইল : ০১৭১১০৫৪২১৫, ই-মেইল : solaimansau@gmail.com
মানুষের পুষ্টি ও সুষম খাবারের জন্য ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং একটি সুস্থ জাতি বিনির্মাণে ফল চাষ সম্প্রসারণ তথা ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। ফল পুষ্টি উপাদানের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এবং আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, আঁশ এবং প্রচুর উপকারী হরমোন ও ফাইটোকেমিক্যালস প্রদান করে শরীরকে বিভিন্ন রোগবালাই থেকে সুরক্ষা প্রদান করে, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ফল ঔষধি গুণাগুণে সমৃদ্ধ বিধায় একে ‘রোগ প্রতিরোধী খাদ্যও’ বলা হয়। ফলের অধিক উৎপাদন এবং এর প্রক্রিয়াজাতকৃত দ্রব্য যেমন একদিকে অধিক মুনাফা উপার্জনে সহায়তা করে অপরদিকে দানাজাতীয় খাদ্য শস্যের গ্রহণকেও (intake) পর্যাপ্ত পরিমাণে হ্রাস করে, যা বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করছে। প্রায় ৭০ প্রজাতির ফল এদেশে জন্মে এবং যার অধিকাংশই উচ্চমাত্রায় পরপরাগায়িত (cross pollinated)। প্রতিটি প্রজাতিতে আবার রয়েছে প্রচুর ভিন্নতা (variability)। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে কিছু কিছু প্রজাতি ইতোমধ্যে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জার্মপ্লাজম থেকেই উন্নতমানের জাত উদ্ভাবন তথা ফলের উন্নয়ন সম্ভব। ফলের উন্নয়নের জন্য সচরাচর ব্যবহৃত পদ্ধতিসমূহ সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হলো।
প্রবর্তন (Introduction)
প্রবর্তন বলতে সচরাচর বুঝায় একই বা ভিন্ন মহাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত অন্য কোন দেশ থেকে ফল গাছ এনে স্থানীয় পরিবর্তিত আবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানো। এমনকি এটি একই দেশের ভিন্ন জেলায় বা প্রদেশেও হতে পারে। এটি দুইভাবে হতে পারে-
সরাসরি প্রবর্তন : প্রবর্তিত গাছ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়নের মাধ্যমে সরাসরি জাত হিসেবে মুক্তায়ন।
সেকেন্ডারি প্রবর্তন : এক্ষেত্রে প্রবর্তিত গাছ থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা সংকরায়নের পর পুনরায় মূল্যায়নের মাধ্যমে জাত হিসেবে মুক্তায়ন।
নির্বাচন (Selection)
প্রকৃতিতে জন্মানো অতি উত্তম গুণাবলিসম্পন্ন চারা চাহিদানুযায়ী বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সংগ্রহ করে যথাযথভােেব বৈশিষ্ট্যকরণ (characterization) এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্বাচিত জার্মপ্লাজমকে জাত হিসেবে মুক্তায়নই হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জাত উদ্ভাবনের জন্য উত্তম প্রজনন স্টক অপরিহার্য।
১। প্রকৃতিতে যে সকল অতি উত্তম গুণাবলি সম্পন্ন চারা (chance seedling) দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো নির্বাচন করা।
২। সবচেয়ে ভালো নির্বাচিত জার্মপ্লাজম /জাতসমূহের অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা।
৩। নির্বাচিত জাতগুলোর আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি যা তাদের ফলন ও অন্যান্য গুণাবলি বৃদ্ধি করবে তার উদ্ভাবন তথা উন্নয়ন করা।
৪। সবচেয়ে ভালো নির্বাচনগুলোর মধ্যে সংকরায়ন করা এবংপুনরায় উত্তম প্রজন্মকে (offspring) জাত হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্বাচন (selection) করা এবং পরবর্তীতে মাতৃ (parent) গাছ হিসেবে ব্যবহার করা এবং এই প্রক্রিয়া পুনঃ পুনঃঅনুসরণ করা।
ফলের প্রজনন স্টকের (breeding stock) (বিভিন্ন ক্রস থেকে পাওয়া পরিবারসমূহ) পরিমাণগত জেনেটিক্স (quantitative genetics) থেকে জানা যায় যে, ফলের উন্নয়নের জন্য এতে প্রচুর জেনেটিক পটেনশিয়াল (potential) রয়েছে এবং এক্ষেত্রে নির্বাচন হচ্ছে ফলের জাত উন্নয়নের জন্য একটি সবচেয়ে দক্ষ পদ্ধতি। অনেক প্রাচীন দেশীয় ফলের জাত রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জিন বহন করে। সে সমস্ত জিনকে প্রচলিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় সংবেদনশীল (susceptible) জাতে স্থানান্তর করে ফলের রোগ পোকা-মাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
সংকরায়ন (hybridization)
দুটি মাতৃগাছের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উৎপন্ন স্বতন্ত্র উদ্ভিদগোষ্ঠীর চারা থেকে উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য উন্নতমানের ফলগাছ পাওয়া যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে উচ্চফলনশীল, উন্নত গুণগতমানসম্পন্ন, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং প্রতিকূল পরিবেশ (বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা) সহনশীল ফলের জাত হিসেবে মুক্তায়ন করা সম্ভব হবে। ফুলের বায়োলজি, সংশ্লিষ্ট ফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা, আবহাওয়াগত কারণ (যেমন- তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, সূর্যকীরণের তীব্রতা, বাতাস), মৃত্তিকাজনিত কারণ (ভূমির ধরন, মাটির প্রকৃতি ইত্যাদি), রোগবালাই, পোকামাকড় ইত্যাদির ওপর সংকরায়নের সাফল্য নির্ভরশীল। ফলের গুণগতমান বা অন্যান্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সংকরায়নের মাধ্যমে পরবর্তী বংশধরে (offspring) স্থানান্তর করা হয়। যে সমস্ত গুণাবলি পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর করতে হবে সে সমস্ত গুণাবলিসম্পন্ন মাতৃগাছ নির্বাচন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সংকরায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বারি আম-৪ নামক হাইব্রিড জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
মিউটেশন ব্রিডিং (Mutation breeding)
জেনেটিক মেটেরিয়াল এর কোন বৈশিষ্ট্যে হঠাৎ বংশানুক্রমিক স্থানান্তরযোগ্য পরিবর্তন ঘটানোকে মিউটেশন বলে। ফলের প্রজননবিদগণ প্রধানত জিন ও ক্রোমোসোম মিউটেশন বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু ফল গাছে জিনোম ও সাইটোপ্লাজমিক মিউটেশন ও ঘটে থাকে। কোন একটি প্লান্ট পপুলেশনে মিউটেশনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য/বিভিন্নতা (variation) সৃষ্টি করা হয় যা নির্বাচনের একটি অন্যতম ভিত্তি। কিছু কিছু ফলে প্রচলিত (conventional) প্রজনন প্রক্রিয়া প্রযোজ্য নয়। এছাড়া যে সমস্ত ফল গাছ বন্ধ্যা ফল তথা জাইগোটিক ভ্রণসহ বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম নয় সে সমস্ত ফলের জাত উন্নয়নের একমাত্র পদ্ধতি হলো মিউটেশন প্রজনন। লেবুজাতীয় ফলের কিছু জাত এ এপোমিক্রিস প্রধানত দেখা যায়।
ফলের প্রচলিত প্রজনন পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে মিউটেশন প্রজনন কাজ করতে পারে-
১। প্রকৃতিতে ফলের কোন প্রজাতির যদি কম বৈচিত্র্য (variability) থাকে, ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে জাত উন্নয়নের সুযোগ কম থাকে, তখন বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য;
২। কোন নতুন বৈশিষ্ট্য যেমন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কাক্সিক্ষত বৃদ্ধির ধরন অথবা স্ব-অসামঞ্জস্যতা (self-incompatibility) ঘটানোর (induce) জন্য;
৩। অংগজ বংশবিস্তারের মাধ্যমে উৎপন্ন ও সংরক্ষণ করা;
৪। কোন অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে স্থাপিত সংযোগ ভেঙে দেয়ার জন্য;
৫। দূরবর্তী সম্পর্কযুক্ত মাতৃগাছ (parent) এর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দূর করার জন্য এবং
৬। হ্যাপলয়েড তৈরি করার জন্য।
অধিকাংশ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যেমন- বৃদ্ধি, ফলন, ফলের আগাম পরিপক্বতা ইত্যাদি একাধিক জিন (polygenic) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে নির্বাচনের দক্ষতা কার্যকারিতা কম কিন্তু মিউটেশনের কার্যকারিতা (efficiency) বেশি। প্রকৃতিগতভাবে ফল গাছে মিউটেশন ঘটে থাকে এবং এর ফলে ফলের বেশ কিছু বাণিজ্যিক জাত বিশেষত লেবুজাতীয় ফলে সৃষ্টি হয়েছে, যা পূর্ববর্তী জাতকে সম্পূর্ণভাবে স্থানান্তরিত করেছে। এটি ফলের উন্নয়নে মিউটেশন ব্রিডিংয়ের গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাই মিউটেশন পরবর্তীতে ফলের মিউটেন্ট নির্বাচন ফলের জাত উন্নয়নের একটি শক্তিশালী টুল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
টিস্যু কালচার
কোন একটি উপযোগী মাধ্যমে (culture medium) (in vitro) টিস্যু এর বৃদ্ধিকে টিস্যু কালচার বলে। এটির ফলের উন্নয়নে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ আছে যেমন- হেপ্লয়েড তৈরি, এমব্রায়ো রেসকিউ (embryo rescue), রোগবালাই, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদি প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
এ পদ্ধতিতে উদ্ভিদ এ জিন পৃথকীকরণ এবং প্রবর্তন করা হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফলের রোগবালাই, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদি প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
ফলের কৌলিসম্পদ (genetic resources) সংরক্ষণ
সারাবিশ্বে গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যে সমস্ত ফলগাছ সংগ্রহ করে থাকে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। এই সংগ্রহসমূহ সচরাচর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় বাণিজ্যিক জাত হিসেবে মুক্তায়নের লক্ষ্যে যথাযথভাবে পরীক্ষা করার জন্য অথবা সংকরায়নে ব্যবহারের জন্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ বলতে প্রধানত যে সমস্ত প্রজাতির চাষ হচ্ছে সেগুলোকে সংগ্রহ করা বুঝায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত প্রজাতিগুলোর পাশাপাশি অতি প্রাচীন (primitive) প্রজাতিগুলোও সুষ্ঠুভাবে রক্ষা করা দরকার। এছাড়া আলাদাভাবে প্রতিটি জেনোটাইপ সংরক্ষণের চেয়ে জিন পুল সংরক্ষণ করা উত্তম। দেশীয় ফলের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য আমাদের বর্তমানে যে সমস্ত জার্মপ্লাজমের বৈচিত্র্য রয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ যেমন- পোকা ও রোগবালাই প্রতিরোধী, বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা প্রতিরোধী ফলের জাত উন্নয়নে, আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে এমন ফলসমূহে বন্য প্রজাতিসমূহ যাতে কৌলিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য রয়েছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে।
আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি
ফলের উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আধুনিক জাত ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি এর ভূমিকা অপরিসীম। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর উষ্ণ এবং অবউষ্ণম-লীয় ফলের উপর নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করে আসছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি ৩৪টি ফল প্রজাতি যেমন- আম-১১টি, কাঁঠাল-৩টি, কলা-৫টি, পেঁপে-১টি, লিচু-৫টি, পেয়ারা-৪, লেবু-৫টি, কাগজিলেবু-১টি, জারালেবু-১টি, বাতাবিলেবু-৬টি, মাল্টা-২টি, কমলালেবু-৩টি, সাতকরা-১টি, কুল-৫টি, সফেদা-৩টি, নারিকেল-২টি, আমড়া-২টি, কতবেল-১টি, কামরাঙা-২টি, লটকন-১টি, জামরুল-৩টি, আঁশফল-২টি, আমলকী-১টি, বিলাতিগাব-১টি, তৈকর-১টি, জলপাই-১টি, বেল-১টি, নাশপাতি-১টি, প্যাশনফল-১টি, মিষ্টি তেঁতুল-১টি, মিষ্টি লেবু-১টি, রাম্বুটান-১টি, স্ট্রবেরি-৩ টি, ড্রাগনফল-১টি, আ্যাভোকেডো-১টি এর সর্বমোট ৮৪টি জাত ও ১২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যার অধিকাংশই সারা দেশে এবং কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য উপযোগী। বারি আম-৪ সংকরায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত আমের একটি হাইব্রিড নাবী জাত। ইতোমধ্যে বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত কিছু জাত যেমন- বারি মাল্টা-১, বারি আম-৪, বারি পেয়ারা-২ সারাদেশে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত ও কৃষক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। আমাদের দেশে সারা বছর প্রয়োজনীয় ফলের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন এখনও অনেক কম এবং এ ঘাটতি বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে মিটানো হয়। ফলের বিদ্যমান ঘাটতি মেটানো এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে প্রয়োজন উচ্চফলনশীল জাত, উৎপাদন প্রযুক্তি এবং সঠিক পরিকল্পনা। তাই ফল গবেষণায় অধিক গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন। ফলের কম উৎপাদনশীলতার অন্যতম কারণসমূহ হলো-
* উন্নত জাতের পরিবর্তে স্থানীয় (কম উৎপাদনশীল) জাতসমূহের অধিক ব্যবহার (অধিকাংশ বীজের গাছ)
* আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি এর ব্যবহার খুবই কম এবং
* উন্নত জাতের গুণগত মানসম্পন্ন চারা/কলমের অপ্রতুল উৎপাদন ও বিতরণ।
পরিশেষে বলা যায়, ফলের উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বারি উদ্ভাবিত আধুনিক জাত ও এদের উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কৃষকদের মাঠে প্রদর্শনী বাগান স্থাপন, প্রদর্শনী বাগান এবং গবেষণা কেন্দ্রে মাঠ দিবসের আয়োজন এবং ফলের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কিত ফ্যাক্টশিট/লিফলেট/ ফোল্ডার/বুকলেট ফল চাষিদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরে বারি কর্তৃক ‘আম উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি’ শীর্ষক একটি ফ্যাক্টশিট প্রস্তুতপূর্বক আম উৎপাদন এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষক এবং মাঠ পর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের মাঝে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতি বছর স্থানীয় জাতের পরিবর্তে (কম উৎপাদনশীল) উন্নত জাতের পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন কলমের চারার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ফলশ্রুতিতে, দেশে গুণগত মানসম্পন্ন ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা মানুষের পুষ্টিচাহিদা মিটানোর পাশাপাশি, বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (অ. দা.), ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর ও সাবেক ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার (পোস্ট ডক্টরেট, ইউএসএ)। মোবাইল : ০১৭১৬০০৯৩১৯
দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় মোট জমির পরিমাণ ১৮,১৭,১৭২.০ হেক্টর তন্মধ্যে পাহাড়ি ও উঁচু ভূমি ১৬,৭১,৭৯৮.০ হেক্টর (৯২%)। পার্বত্য এলাকায় মোট জমির পরিমাণ ১২,১৫,৫০০.০ হেক্টর। এর মধ্যে মাঝারি উঁচু, মাঝারি নিচু, নদী, খাল ও বসতবাড়ি এলাকা বাদ দিলে মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১১,১৮,৩০০.০ হেক্টর (৮%)। পাহাড়ি এলাকায় মোট চাষযোগ্য জমির মধ্যে রাবার ও বনভূমি ইত্যাদি ২৫% অর্থাৎ ২, ৭৯,৫৭৫.০ হেক্টর বাদ দিলে ৮, ৩৮,৭২৫.০ হেক্টর জমি ফল চাষের আওতায় আনা যেতে পারে।
দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বছরব্যাপী ফল চাষের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড়ি জমি ফল চাষের আওতায় আনা হলে তা থেকে উৎপাদিত ফল এ দেশের সকল মানুষের ফলের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি ফল বিদেশে রপ্তানি করে হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে। ফল সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থিক ও পুষ্টির চাহিদা উন্নয়নে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প ফল চাষ সম্প্রসারণে এ অঞ্চলকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকায় বছরব্যাপী ফল চাষ সম্প্রসারণ কর্মকা- বেগবান করার লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. কষ্টসহিষ্ণু ফলের বাগান সৃষ্টিকরণ
পার্বত্য জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের কারণে ফল বাগানে সেচ দিয়ে গাছকে সফলভাবে বাড়তে দিয়ে গাছকে বেশি ফলদানে সক্ষম করে তোলা কষ্ট কর। এ জন্য প্রতিকূল অবস্থায় ফলদানে সক্ষম এমন ফল গাছ রোপণে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। ফল চাষকে লাভজনক করতে হলে এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি তিন স্তর (Multi-layered fruit garden) বিশিষ্ট ফল গাছের সমন্বয়ে মিশ্র ফল বাগান সৃষ্টি করার প্রাধান্য দিতে হবে।
(ক) কষ্ট সহিষ্ণু দীর্ঘমেয়াদি ফল গাছ : কষ্টসহিষ্ণু দীর্ঘমেয়াদি ফল গাছের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কুল (দেশি টক কুল), লিচু, বেল, কদবেল, বীজবিহীন বিলাতি গাব, কাজু বাদাম, তেঁতুল (বেশি টক), বরিশালের আমড়া অন্যতম।
(খ) মধ্যমেয়াদি অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতা বিশিষ্ট ফল : কষ্ট সহিষ্ণু দীর্ঘমেয়াদি ফল গাছগুলোর প্রকার ভেদ ৫-৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কা- তৈরি করে নিয়ে মধ্যমেয়াদি ফল গাছ রোপণ উপযোগী করা যেতে পারে। এতে মধ্য মেয়াদি, দ্বিতীয় স্তরে রোপিত গাছ আলো-বাতাস পেতে সহায়ক হবে। কমলা, মাল্টা, বিভিন্ন প্রজাতির কাগজি, লেমন (বীজবিহীন কাগজি, এলাচি, জারা/কলম্বো), বাতাবি, পেয়ারা, বারোমাসী আমড়া, ডালিম, বিলিম্বি, তেজপাতা, ড্রাগন ফল অন্যতম।
(গ) স্বল্পমেয়াদি ফল/সবজি আবাদ ব্যবস্থা : ফল বাগান সৃষ্টির প্রথম ৩-৫ বছর পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ফল ও এলাকা উপযোগী বিভিন্ন মৌসুমি ফল ও সবজি আবাদের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ফলের মধ্যে ট্রি পেঁপে অতি লাভজনক। এ গাছ থেকে বারোমাস ধরে ৩ বছর পর্যন্ত একাধারে ফল প্রাপ্তি সুবিধা আছে। এছাড়াও তরমুজ, বাঙি, বিভিন্ন প্রকার মেলন, ক্ষীরা, সবজির মধ্যে প্রচলিত সবজি, (বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স) মসলার মধ্যে মরিচ, আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, বিলাতি ধনে প্রধান। বাগানের বর্ডারে ঘন করে (৩ ফুট দূরত্বে) উপযোগী জাতের লেবু লাগিয়ে ন্যাচারাল বেড়ার ব্যবস্থা করা যায়। বর্ডারে বারোমাসি সজিনা, তরকারি/বীচি কলা এবং বাংলা কলা রোপণ করেও বাড়তি আয় করা যায়। লম্বা কা- বিশিষ্ট গাছে (কাঁঠাল, বারোমাসি আমড়া) গোল মরিচ, পান, চুঁই ঝাল রোপণ করে বাড়তি আয় করা সহজ।
(ঘ) কলম রোপণ : বেল, কদবেল, তেঁতুল, এ ধরনের ফল গাছের চারা রোপণ করা হলে তা থেকে ফল পেতে ৮-১০ বছর সময় লেগে যায়। অথচ এ সব ফলের কলম রোপণ করা হলে ২-৩ বছর থেকেই ফল পাওয়া সম্ভব এবং ফলের মাতৃগুণাগুণ বজায় রাখা যায়। কদবেল, তেঁতুল, জাম, কাঁঠাল, টক কুল, আম (অতি নাবি/আগাম, বারোমাসি) ইত্যাদি ফলের কলম করে ভালো পটিং মিডিয়া দিয়ে কলম বড় করে নিয়ে মে-জুন মাসের মধ্যে রোপণ করার কাজ সমাধা করা হলে বর্ষা কালের মধ্যেই গাছগুলোর শিকড় মাটির ভিতর দ্রুত ছড়াবে, শুকনা মৌসুমে রোপিত গাছ বেশি বৃদ্ধি পাবে। কিছু গাছের বীজ সরাসরি লাগিয়ে চারা র্৩-র্৪ ফুট লম্বা হলে তার ওপর ইনসিটো গ্রাফটিং করা হলে প্রতিকূল পরিবেশে শিকড় গভীরে ছড়ালে গাছের ভালো বৃদ্ধি ও ফলদান ক্ষমতা বাড়ে। বিশেষ করে কাজু বাদামের ক্ষেত্রে সরাসরি মাদায় বীজ রোপন করা অত্যাবশ্যক। কাঁঠালসহ অন্যান্য ফলের চারা/কলম করা গাছ লাগিয়ে কাক্সিক্ষত জাতের আগাম ফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়।
২.বসতবাড়ির আঙিনায় ফল ও অন্য গাছ রোপণ : পারিবারিক ফল বাগান থেকে ফল-ফলাদির মাধ্যমে পুষ্টি আহরণ আমাদের ঐতিহ্য । বসতবাড়ির আশপাশে পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের লাভজনক ফল বাগান সৃষ্টিতে সহায়তা করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বসতবাড়ির আকার ভেদে সেখানে বাগান সৃষ্টিতে উপযুক্ততা পরিস্থিতি বিবেচনায় কয়েকটা মডেল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নেয়া। পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থায় ফল ও অন্যান্য ফসল আবাদ নিশ্চিত করতে হবে। বসতবাড়িতে মিশ্র ফল বাগান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। স্বল্প মেয়াদি ফল (ট্রি পেঁপে, কলা, আনারস ইত্যাদি) ছাড়াও আয় বৃদ্ধিকারক অন্য ফসল (বারোমাসি সজিনা, চুকুর ইত্যাদি) যা পাহাড়ি পরিবারের নিত্যদিনের প্রয়োজন আসে এবং পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি আয় হয় এমন ফসল আবাদ প্রধান্য দেয়া। সম্ভব হলে কিছু সংখ্যক পরিবারকে অন্য ভাবে (বায়োগ্যাস, সোলার প্লান্ট, রেইন ওয়াটার হারভেস্ট) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া। বসতবাড়ির আশপাশের রাস্তার ধারে তাল, খেজুর, বীচি কলা/বাংলা কলা, বারোমাসি সজিনা ইত্যাদি রোপণে উদ্বুদ্ধ করা।
৩. কমিউনিটি প্লান্টেশন : রাস্তার ধার, ঈদগাহ, গোরস্থান, স্কুল, মাদ্রাসা, বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি ধরনের কমিউনিটি স্থান চিহ্নিত করে ফল চাষের উদ্যোগ নেয়া ।
৪. বিদ্যমান ফল গাছগুলোর ফল দান ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ ব্যবস্থা নেয়া : ইতোমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় স্থাপিত ফল বাগান থেকে পরিমিত উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনার অভাবে। পুরানো ফলন্ত গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা গ্রহণের মাধ্যমে বেশি ফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর আর্থিক উন্নয়ন ও ফল চাষকে লাভজনক স্তরে নেয়া যেতে পারে। গাছগুলোকে ট্রেনিং-প্রুনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অফলন্ত ডাল অপসারণ করে আলো-বাতাস চলাচল সুবিধা করা, বাগানে গাছের অপ্রয়োজনীয় গাছের ডালপালা ছাঁটাই/অপসারণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাগানকে আগাছা, লতা-পাতা মুক্ত করা, সার প্রয়োগ, রোগ-পোকা দমন, মালচিং দেয়া, সুবিধা থাকলে সেচ দেয়া । ক্ষেত্র বিশেষে রিজুভিনেশন পদ্ধতি অবলম্বনে অনুন্নত গাছকে উন্নত জাতে রূপান্তর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
৫.হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দান : দলীয় আলোচনা, মাঠ দিবস, ফলচাষিদের সমাবেশে কলম করা, গাছ রোপণ ও পরিচর্যা, মালচিং দেয়া, ট্রেনিং-প্রুনিং, টেরাসিং, হাফমুন টেরাস পদ্ধতি এসব প্রযুক্তিগুলো হাতে-কলমে ফিল্ড ভিজিট কালে প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা হলে ফল চাষে সফলতা আসতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় মহিলারা অতি কর্মঠ ও নতুন প্রযুক্তি শিখতে ও প্রয়োগ করতে সক্রিয় হয়। এজন্য ফিল্ড ভিজিটকালে মহিলা দলকে চিহ্নিত করে কলম করা ও ফল বাগান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করা। এ ছাড়া মহিলা দলকে সহজ স্থানীয়ভাবে উপযোগী (ডিহাইড্রেশন/রোদে শুকানো) পদ্ধতি অবলম্বনে বা আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে অমৌসুমে ফল প্রাপ্তিতে ব্যবস্থা নেয়া ।
৬. জাত নির্বাচন, কলম তৈরিতে সক্ষমতা আনয়ন : ফল চাষে উৎসাহী চাষিদের এলাকাতে উন্নত দেশি-বিদেশি জাত নির্বাচন করা এবং সেগুলোর কলম তৈরি করা ও বাড়তি কলম বিপণনে অনুপ্রেরণা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া। বিশেষ করে কাটিং, গুটিকলম ও ক্লেপ্ট/ভিনিয়ার গ্রাফটিং করণে সক্ষম করে তোলা। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দান কাজ ফরমালি/ইনফরমালি দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হলে ফল চাষ সম্প্রসারণে সুফল বয়ে আনবে। এতে স্থানীয় মহিলাদের সম্পৃক্ত করা যুক্তিসঙ্গত হবে ।
৭.দেশি-বিদেশি হাইভ্যালু ফল বাগান সৃষ্টির ব্যবস্থা নেয়া : পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রায় ৪০-৭০ বছর আগের পুরনো জাতগুলো নতুন বাগান সৃষ্টিতে এবং বসতবাড়িতে রোপণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমের ক্ষেত্রে প্রধানত আম্রপারপালি ও র্যাঙ্গুয়াই ছাড়া বিভিন্ন স্থানীয় পুরাতন জাত ও বীজ থেকে উৎপাদিত অনুন্নত জাত দিয়ে বাগান সৃষ্টিতে সাধারণ বাগানীরা এখনও তৎপর আছে।
বড় বড় কিছু চাষি হাইভ্যালু দেশি-বিদেশি ফল চাষে সফল হচ্ছে। বিশেষ করে ড্রাগন চাষে কিছুসংখ্যক বাগানির অবদানে অনেকেই আকর্ষিত করছে। পার্বত্য জেলাগুলো রাম্বুটান চাষে অতি উপযোগী। এ অবস্থায় রাম্বুটান, বিদেশি কাঁঠাল, বিদেশি উন্নত জাতের সফেদা, ম্যাংগোস্টিন, পার্সিমন, কাজু বাদামের আধুনিক উন্নত জাত দিয়ে বড় আগ্রহী বাগানীকে দিয়ে এ সব বিদেশি জাতের ফলের চারা/কলম সংগ্রহ ও বাগান সৃষ্টিতে প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা দেয়ার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। থাই শরিফা, নতুন উন্নত জাতের মাল্টা, কমলা, কাগজি লেবু, বাতাবি লেবু, বারোমাসি কাঁঠালসহ অনুরূপ উন্নত জাতের দেশি-বিদেশি বাগান সৃষ্টিতে চাষিকে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।
৮. পার্বত্য অঞ্চলের হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও কলম তৈরিতে করণীয় : পার্বত্য জেলার উপযোগী বিভিন্ন জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে তা মাতৃগাছ হিসাবে রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ করা ও তা থেকে চারা/কলম তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বীজ দিয়ে কাঁঠাল চারা তৈরির চেয়ে কলম করার প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন। কাঁঠালের Vegetable meat হিসাবে খাওয়ার প্রচলন বাড়াতে হবে।
৯. কেন্দ্রীয়ভাবে উন্নত জাতের চারা/কলম সরবরাহের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা ঃ সমতল ভূমির অগ্রগামী হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সম্ভাবনাময়ী ফলের চারা/কলম অত্র এলাকায় সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
১০. কাজু বাদাম চাষ : ইন সিটো পদ্ধতিতে কাজুবাদাম চাষ একটি নতুন প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ২ বছর বয়সের গাছে ফুল-ফল ধরা শুরু হয়। উন্নত কাজুবাদামের জাত যেমন-Giant/Jumbo সংগ্রহ করে বড় ও মাঝারি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ৩-৪ বছর আগে ইনসিটো পদ্ধতিতে বপনকৃত হর্টিকালচার সেন্টার রামু, কক্সবাজারের কাজুবাদাম গাছ হতে বীজ সংগ্রহের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ২০০ কেজি বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে জুন-জুলাই/১৯ মাসে সম্ভাব্য ১০০০ কেজি বীজের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ একর জমিতে বীজ বপন করার কার্যক্রম বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১২ ফুট এবং সারি থেকে সারি দূরত্ব ১২ ফুট হিসেবে পার্বত্য এলাকায় প্রায় ১ লক্ষ গাছের আবাদ করা সম্ভব হবে।
ড. মোঃ মেহেদী মাসুদ
প্রকল্প পরিচালক, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। ফোন : +৮৮০২-৫৫০২৮৩৪৮, ই-মেইল : pdyrfp@gmail.com
ফল হলো নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বাধার। অন্য কথায় ফল বলতে আমরা অনেকেই বুঝি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। অনাদিকাল ধরে যেসব ফল এদেশে চাষ হয়ে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশি ফল। এ পর্যন্ত এ দেশে মোট ১৩০টি দেশি ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। তবে সেসব ফলও যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। বাকি ৭০টি ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, লিচু, কুল, লেবু, আনারাস, কলা ও পেঁপে এই ১০টি এ দেশের প্রধান দেশি ফল।
কিন্তু বিদেশি ফল কোনগুলো? সহজে উত্তর হলো- যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভূখণ্ডে বা এ অঞ্চলে নয়, বিদেশেই সেসব ফলের উৎপত্তি ও বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করা হয়, সেসব ফলকে আমরা বিদেশি ফল বলতে পারি। তর্কটা সেখানেই, ফল তো দেশ চেনে না। তার উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি যেখানে, সেখানে সে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে, সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর পূর্বে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। আবার এমন অনেক বিদেশি ফল আছে যেগুলো বাংলাদেশে সার্থকভাবে চাষ করা সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এ ফলগুলোর পরিবেশিক চাহিদার সাথে বাংলাদেশের জলবায়ুর কোন মিল নেই কিন্তু সৌভাগ্যবশত এ ফলগুলোর এমন অনেক জাত আছে যা বাংলাদেশের জলবায়ুতে সাফল্যের সাথে জন্মানো সম্ভব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিদেশি ফল প্রবর্তন করা হয়েছে। তারমধ্যে অ্যাভোকেডো, ম্যাঙ্গোস্টিন, স্ট্রবেরি, কিউই, রাম্বুটান, লংগান, ল্যাংসাট, জাবাটিকাবা, শান্তল, আপেল, পিচফল, আলুবোখারা, পার্সিমন, এগ ফ্রুট, সাওয়ার সপ, নাশপাতী, প্যসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট এবং ডুরিয়ান অন্যতম। এদের মধ্যে কিউই, আপেল ও ডুরিয়ান ছাড়া প্রায় সব ফলই এদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোত কমবেশি হচ্ছে এবং কোন কোনটা থেকে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। যা দেখে অনেকে কিছু কিছু ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু করেছে এবং কিছু ফলের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার চিন্তা-ভাবনা করছে। এ দেশে প্রবর্তনকৃত কিছু বিদেশি ফলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
ড্রাগন ফল : ড্রাগন ফলের (Hylocereus sp.) উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। বাংলাদেশে এ ফল ২০০৭ সালে প্রথম প্রর্বতন করেন। এ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম এ ফলের জাত নিয়ে আসেন থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে। ড্রাগন ফল এ দেশের জলবায়ু ও মাটিতে দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এখন এ সেন্টার থেকে এ ফলটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বংশ বিস্তার করা হচ্ছে। এ সেন্টার থেকে ড্রাগন ফলের ৪টি জাত (বাউ ড্রাগন ফল-১; বাউ ড্রাগন ফল-২; বাউ ড্রাগন ফল-৩ ও বাউ ড্রাগন ফল-৪) জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে নিবন্ধন করেছে এবং সেখান থেকে তারা চারা তৈরি ও সম্প্রসারণ করছেন। সম্প্রসারণের কাজ গুলো বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসংখ্য বংশানুক্রমিক (PEDIGREE) মাতৃগাছ কৃষকের দোরগোড়ায় সম্প্রসারণ করছে। বংশীয় মাতৃগাছের ক্ষেত্রে এ সেন্টরটি এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত, অনন্য। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে নিবিড়ভাবে গবেষণার ফলে বারি ড্রাগন ফল -১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। ড্রাগন ফলের বেশ কিছু জার্মপ্লাজম জনাব কামরুজ্জামান, সাবেক বছরব্যাপী ফল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর মাধ্যমে নাটোরের মডার্ন হর্টিকালচার সেন্টারে সংগ্রহ করেছে এবং সেখান থেকে তারা চারা তৈরি ও সম্প্রসারণ করছেন।
স্ট্রবেরি : স্ট্রবেরি মূলত যেখানে শীতকাল মৃদুভাবাপন্ন ও গ্রীষ্মকাল শুষ্ক সেখানে স্ট্রবেরি ভালো জন্মে। কিন্তু বর্তমানে অনেক উষ্ণম-লীয় জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ ও উষ্ণম-লেও এর চাষ হচ্ছে। উষ্ণম-লীয় জাতগুলি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সাফল্যজনকভাবে জন্মানো সম্ভব। প্রাথমিক পরীক্ষায় বাংলাদেশে এর চাষ সফল হয়েছে। স্ট্রবেরির ফল দেখতে কিছুটা লিচুর মতোই কিন্তু আকারে ছোট। স্ট্রবেরির কিছু জাত এ দেশের জলবায়ু ও মাটিতে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাবি স্ট্রবেরি-১; রাবি স্ট্রবেরি-২ ও রাবি স্ট্রবেরি-৩ নামে ৩টি জাত নিবন্ধন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণার ফলে বারি স্ট্রবেরি-১ নামে ১টি জাত ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ স্ট্রবেরি-১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। উক্ত জাতগুলো এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হচ্ছে।
রাম্বুটান : রাম্বুটান দক্ষিণ-পূর্র্ব এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান ফল। একে অনেকে Hairy Litchi আবার অনেকে queen of fruits বলে থাকেন। ফলটি দেখতে লিচুর মতোই কিন্তু খোসার উপর খয়েরি রঙের লম্বা লম্বা লোম থাকে। ইহা একটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক ফল। রাম্বুটানের আদি জন্মস্থান সম্ভবত মালয়দ্বীপ অথবা থাইল্যান্ডে। শীতকালে মৃদু শীত অথবা প্রায় সারা বছরই উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিদ্যমান এমন স্থানে রাম্বুটান সবচেয়ে ভালো জন্মে। বাংলাদেশের জলবায়ুতে সার্থকভাবে রাম্বুটানের চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ রাম্বুটান-১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। উক্ত জাতটি এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার জন্য বীজ, গুটিকলম, জোড়কলম ও কুঁড়ি সংযোজনের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে। কিছু ব্যক্তিগত নার্সারিতে ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ ফলের সংগ্রহ কাজ চলছে। এ ছাড়া ধোবাউড়া উপজেলায় ডা. ওসমান সাহেবের বাড়িতে একশটি বড় রাম্বুটানের গাছ আছে সে গাছ থেকে ফল ও হচ্ছে। তবে সে ফলের বীজ বড় ও ফলের আকার ছোট।
অ্যাভোকেডো : অ্যাভোকেডো একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। এ ফলটির বিশেষ আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে শর্করার পরিমাণ কম অথচ তেলের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই অনেকে একে মাখন ফল বলে থাকেন। পুষ্টি সমস্যা নিরসনেএ ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। এ ফলে প্রায় ৮৮% চর্বি থাকে কিন্তু কোলেস্টেরল মুক্ত। মধ্য আমেরিকা অ্যাভোকেডোর আদি জন্মস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশে অ্যাভোকেডোর গাছ প্রথম প্রবর্তন হয় মধুপুরের জলছত্র মিশনের তৎকালীন একজন ফাদারের মাধ্যমে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সীমিত আকারে এর চাষ হচ্ছে।
কাজুবাদাম : কাজুবাদাম একটি ‘নাট’ জাতীয় ফল। অনেকে এটিকে ফল না বলে বাদাম বলতে অধিক পছন্দ করেন। আসলে বাদামও এ ধরনের নীরস ফল। বর্তমানে এ ফলটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু অঞ্চলে সীমিত আকারে উৎপাদিত হচ্ছে। কাজুবাদামকে একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বৃক্ষ জাতীয় ফলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) কাজুবাদামের আদি জন্মস্থান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ কাজুবাদাম -১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ভালো জাত অবমুক্ত করার জন্য নিবিড়ভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে ।
আঙ্গুর : আঙ্গুর পৃথিবীর প্রাচীনতম ফলসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বেশিরভাগ মদ তৈরি করা হয় আঙ্গুর থেকে। আঙ্গুর ফল সবার কাছেই সুপরিচিত এবং সমাদৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সীমিত আকারে নি¤œ মানের আঙ্গুর উৎপন্ন হয়ে থাকে। নওগাঁ জেলায় একজন কৃষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আঙ্গুর চাষ শুরু করেছে। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উষ্ণম-লের দেশেই উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর উৎপন্ন হচ্ছে। সে দিক থেকে বাংলাদেশে উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর চাষের প্রচুর সম্ভাবনা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও কোন আঙ্গুরের জাত নেই।
ম্যাঙ্গোস্টিন : ম্যাঙ্গোস্টিন এমন একটি ফল যা স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একে অনেকে ফলের রানী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ম্যাঙ্গোস্টিনের আদি জন্মস্থান হচ্ছে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশে সাফল্যজনকভাবে এর চাষ করা সম্ভব। সুনিষ্কাশিত গভীর দোঁআশ মাটি এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী, তবে যেকোন মাটিতেই ম্যাঙ্গোস্টিন চাষ করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে একটি গাছে এই বছর সর্ব প্রথম ফল ধরেছে। শীতের শেষে ফুল ফোটে ও বর্ষাকালে ফল পাকে। ফল গোলাকার, দেখতে দেশি গাবের মত। পাকা ফলে সাদা রসাল কোয়া থাকে এবং সহজেই ফল থেকে খোসা ছাড়ানো যায়। ফলের ভক্ষণযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রামে ২১ কিলোক্যালরি শক্তি, ১.৩ ভাগ আমিষ, ৪.৮ ভাগ শর্করা, ০.৩ ভাগ খনিজ লবণ, ১২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও সামান্য পরিমাণ ভিটামিন সিও ক্যারোটিন থাকে।
ডুরিয়ান : ডুরিয়ানের বৈজ্ঞানিক নাম Durio zibethinus Murr। ইহা Bombacaceae পরিবারভুক্ত। ইহা মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ। ফল দেখতে অবিকল একটি ক্ষুদ্রকার কাঁঠালের মতো, কিন্তু ফলের কাঁটা দীর্ঘ ও খুবই শক্ত। পাকা ফলে চাপ দিলে খোসা লম্বালম্বি পাঁচটি খণ্ডে আলাদা হয়ে যায়। ভেতরে মাত্র কয়েকটি বড় কোয়া থাকে। সাধারণত বীজ দিয়ে ইহার বংশবিস্তার করা হয়, তবে অঙ্গ (ইনাচিং) ও কুড়ি (ফর্কাট) সংযোজন করেও চারা তৈরি করা যায়। বীজের চারা রোপণের ৮-১০ বছর পর ফল ধারণ করে। কোন কোন গাছ পরাগায়নের ব্যাপারে স্ব-অসঙ্গত, এজন্য এক সাথে একাধিক জাতের গাছ লাগানো উচিত। বাংলাদেশে ডুরিয়ান নিয়ে গবেষণা চলছে কিন্তু এখনও কোন সফলতা আসেনি।
নাশপাতি : শীত প্রধান জলবায়ুর ফল। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অতি সীমিত আকারে ইহার চাষ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে নাশপাতি জন্মানো সম্ভব হয়েছে যদিও ইহার ফলন বা ফলের মান খুব সন্তোষজনক হয়নি। সিলেটে যে জাতের চাষ হয় তা সম্ভাবত P. khasiana প্রজাতির, ইহা অনেকটাা বুনো ধরণের, ফল নাশপাতি আকৃতির।
পার্সিমন : জাপানের দক্ষিণাঞ্চল ও চীন পার্সিমনের উৎপত্তিস্থান। ইহা জাপানের অন্যতম প্রধান ফল। আমাদের দেশের গাব একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পার্সিমনের গাছ একটি পত্রমোচক মাঝারি আকারের বৃক্ষ, ফল দেখতে টমেটোর মতো, পাকা অবস্থায় হলুদ বা কমলা, ফুলের বৃত্তি স্থায়ীভাবে ফলের সাথে সংযুক্ত থাকে। ইহার কোন কোন জাতের গাছ কেবলমাত্র স্ত্রীফুল (pistillate constants)। কোন কোনটা কেবলমাত্র পুরুষ ফুল (staminate constants) এবং অন্যান্যগুলো পুরুষ ও স্ত্রী (staminate sporadics) উভয় প্রকার ফুল উৎপাদন করে। সব জাতেই বিশেষ ধরনের আবহাওয়ায় বীজ হীন ফল উৎপাদন করে। বাংলাদেশে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফল পাকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ৩টি বড় গাছ আছে,যা থেকে ২০১০ সাল থেকে ফল দিচ্ছে।
প্যাশন ফল : গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গাই এখন শৌখিন ফলচাষি টবে, বাড়িতে ও নার্সারির মালিকরা সীমিত আকারে প্যাশন ফলের চাষ করছেন। পাকা ফল কেটে পানি-চিনিতে শরবত করে খাওয়া যায়। প্যাশন ফলের শরবতের স্বাদ ‘ট্যাং’ ড্রিংকসের মতো। সেজন্য প্যাশন ফল এ দেশে ধীরে ধীরে ‘ট্যাং ফল’ অর্থাৎ শরবতি ফল নামে
পরিচিত হয়ে উপ্যাশন ফল : গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গাই এখন শৌখিন ফলচাষি টবে, বাড়িতে ও নার্সারির মালিকরা সীমিত আকারে প্যাশন ফলের চাষ করছেন। পারুটিফল : লংগান :শানতোল :টক আতা :জাবটিকাবা : ঠেছে। লতানো বর্ষজীবী এ গাছটি তার অবলম্বনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে, তার জন্য বিজ্ঞানীরা এ ফলের নাম দিয়েছেন ‘প্যাশন ফল’। এ ফলের উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে, বিশেষ করে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উত্তর আর্জেন্টিনাতে এর ফলের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়।
রুটিফল : ব্রেড ফ্রুট (Bread fruit) ফলের বাংলা নাম দেয়া হয়েছে রুটি ফল। আঠারো শতকের শেষ দিকে বৃটিশ নাবিকেরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপ থেকে রুটি ফলকে এ উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। তাহিতির লোকেরা তখন রুটিফলকেই প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এখনো বেশ কিছু দেশে রুটি ফল প্রধান খাদ্য। এ ফল থেকে রুটি তৈরি করে খাওয়া হয় বলেই এরূপ নাম। ১৯৮২ সালে সার্ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দেয়ার সময় শ্রীলংকার কৃষিমন্ত্রী শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে রুটি ফলের কয়েকটি চারা এ দেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চত্বরে সেগুলো লাগানো হয়েছিল। এখন সেসব গাছে দিব্যি ফল ধরছে। রুটি ফলের আর একটি বড় গাছ আছে আসাদগেটে, হর্টিকালচার সেন্টারে। সে গাছেও নিয়মিত ফল ধরেছে। কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে অবস্থিত বার্ড এ ব্রেডফ্রুট এর ফল পাওয়া যাচ্ছে। রুটি ফলের গাছ বড় বৃক্ষ, ফলের ব্যাস ১০-৩০ সেন্টিমিটার। ফলের গায়ে কাঁঠালের মতো কাঁটা কাঁটা আছে। ফল বীজবিহীন ও বীজধারী, দুই রকমই আছে।
লংগান : লিচুর সহোদর এ ফলটি লিচু যখন ফুরিয়ে যায় তখন তার তেষ্টা মেটায়। বিভিন্ন দেশে ফলটি রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন ও সম্প্রতি তাইওয়ানে লংগানের চাষ হচ্ছে। লংগান শব্দটি এসেছে ‘লংইয়ান’ চীনা শব্দটি থেকে। যার অর্থ হল ‘ড্রাগনের চোখ’। ভারত আর বাংলাদেশের বাঙ্গালিদের কাছে এটি ‘আঁশফল’। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় এর নাম কাঠলিচু। বরিশালে এর নাম নাড়িয়া লিচু। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ লংগান -১ও বাউ লংগান -২ নামে ২টি জাত নিবন্ধন করেছে।
শানতোল : শানতোল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি পরিচিত ফল। শানতোলকে কেউ কেউ বুনো ম্যাংগোস্টিন বলেও ডাকেন। বাংলাদেশে এ ফলের চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ও হর্টিকালচার সেন্টার, কল্যাণপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারে বেশ কয়েকটি শানতোলের গাছে সফলভাবে ফল ধরছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও চাষ সম্ভব। শানতোল ফলের আলাদা একটা সুগন্ধ আছে। যা প্রথমেই যে কোন ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে। তাই নতুন ধরনের এ ফলটির বাজার ভালো পাওয়া যেতে পারে এবং বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। শানতোলের শাঁস সিরাপে সংরক্ষণ করা যায়, জ্যাম বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। এ হিসেবে শানতোল ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে উঠতে পারে।
আলুবোখরার গাছ ও ফল : আলুবোখরা পিচ ও চেরি ফলের নিকট আত্মীয়। আলুবোখরা আদি জন্মস্থান উত্তর আমেরিকা ও জাপান। বড় গাছ ঠাণ্ডা সইতে পারে। গ্রীষ্মকালে (জুন মাসে) ফল পাকে। আলু বোখরার গাছ বড় হতে একটু সময় নেয়। একটু বেশি বয়স না হলে গাছে ফল ধরে না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে। কিছু ব্যক্তিগত নার্সারিতে ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ ফলের গাছ সংগ্রহ কারতে দেখা গেছে।
টক আতা : টক আতা দেখতে মোটেই আতা বা শরিফার মতো নয়। গায়েু গোটা গোটা দাগ নেই, আছে ফলের গা ভর্তি ক্ষুদে ক্ষুদে কাঁটা। ফল পাকলে অবশ্য কাঁটার অনেকটাই মিলিয়ে যায়। ফলটি সারা বিশ্বেই কম বেশি পরিচিত এর ক্রিমের মতো সাদা নরম রসাল সুস্বাদু শাঁসের জন্য। শাঁস সুগন্ধযুক্ত ও টক স্বাদের। শ^াসে প্রচুর ভিটামিন সমৃদ্ধ।
এ দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় তথা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে টক আতার গাছ আছে। কেউ চাষে করে না, জঙ্গলে হয়। টক আতার আদি বাসভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে।
জাবটিকাবা : জাবটিকাবার আদি নিবাস ব্রাজিল। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে বর্তমান হর্টিকালচার সেন্টার কল্যাণপুর ছিল বিএডিসি ফার্ম। তৎকালে প্রায় ১০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ ফার্মের কোয়ার্টার সংলগ্ন এলাকায় পথের ধারে তিনটি জাবটিকার চারা রোপণ করেন তৎকালীন ফার্মের জনৈক উদ্যানতত্ত্ববিদ জনাব আঃ সামাদ। কোথা থেকে কিভাবে তিনি এ চারা সংগ্রহ করেছিলেন তা কেউ আর এখন বলতে পারেন না। এখন আর শুধু কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেই নয়, জাবাটিকার গাছ ফল দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের জার্মপ্লাজম সেন্টারে,কল্যাণপুর হর্চিকালচার সেন্টারের ফলবাগানে ও দেশে আরও অনেক শৌখিন ফল প্রেমিকদের বাগানে।
সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এই বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে অন্তত একটি ফলের চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই দেশের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিদেশি ফলের প্রবর্তন, গবেষণা, উন্নয়ন, উৎপাদন ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। সুতরাং স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর বর্ণিল বিদেশি ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর বাড়িয়ে তুলতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরো প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে আরো মজবুত ও গতিশীল, দেশবাসী পাবে খাদ্যে পুষ্টিমানসম্পন্ন একটি ভবিষ্যৎ।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম১ ড. মোঃ শামছুল আলম (মিঠু)২
১উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও পরিচালক, জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ। ২সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা মোবাইল : ০১৭১১১২৪৭২২, mithuhort@yahoo.com
বিভিন্ন ধরনের ফল বিভিন্ন সময়ে পাওয়া যায়। যেমন বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে অধিক পরিমাণে ফল পাওয়া যায়। ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ফল সংরক্ষণ করতে পারলে সারা বছরই ফলের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব। ফল দ্রুত পচনশীল হওয়ায় বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে ২০-৫০% নষ্ট হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ১০০% ফল নষ্ট হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। তাই ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বলতে বুঝায় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল বিভিন্ন অপচয় ও নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে ফলের পুষ্টি গুণাগুণ বজায় রেখে তা সংরক্ষণের সময় বৃদ্ধি করা। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফলের আকৃতি, প্রকৃতি, অবয়ব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে ফলের গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটে না, শুধু আকৃতি ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ফল সংরক্ষণ করা হয়।
যে সকল কারণে ফল নষ্ট হয়ে যায়
মেটাবলিক পরিবর্তন, জলীয় অংশ কমে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়, তোলার সময় বা পরে আঘাতজনিত ক্ষত, সঠিক পদ্ধতি না মেনে ফল পরিবহন ও সংরক্ষণ করা, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ (মোল্ড, ইস্ট, ব্যাকটেরিয়া)।
উল্লিখিত কারণগুলো রোধ করা হয় ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে।
ফলসংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্য
১. ফলের অপচয় রোধ ও সংরক্ষণ সময় বৃদ্ধি করা।
২. পুষ্টি ও গুণগত মান বজায় রাখা।
৩. অর্থনৈতিক অপচয় রোধ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদনকে লাভজনক করা।
৫. আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়।
৬. মূল্য সংযোজন করার মাধ্যমে উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরি করা।
৮. কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করা।
১০. অমৌসুমে ফলের প্রাপ্তি ও গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে মূল্য সংযোজন করা।
১১. সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে ফলের মূল্য স্থিতিশীল রাখা।
ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি : স্বল্প ব্যয়ে ও পরিসরে পারিবারিক পর্যায়ে কিছু ফলের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিতে ফলকে আমরা ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারি।
ক্যানিং বা টিনজাত করে সংরক্ষণ : আম, আনারস, লিচু প্রভৃতি ফলকে টিনজাত করে রাখা যায়। প্রথমে ফলকে স্টেরিলাইজড বা পাস্তুরীকরণ করে নেয়া হয় এবং ফুড প্রিজারভেটিভ যোগ করে সুবিধামতো আকারের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। পাত্রটিকেও স্টেরিলাইজড করে নিতে হবে এবং ফল রাখার পর বায়ুরোধী করে রাখতে হবে। টিনজাত করার পর ডিপ ফ্রিজেও রাখা যায়।
রস হিসেবে ফল সংরক্ষণ : যে কোন রসালো ফল থেকে রস তৈরি করা যায়। ফলের রস সংরক্ষণ করতে হলে টিনের কৌটায় ভরে দ্রুত পাস্তুরীকরণ করে অথবা ৭৫০-৮৫০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কৌটা সিদ্ধ করে রাখতে হয়। কৌটা অবশ্যই বায়ুরোধী করে রাখতে হবে। অন্যথায় রস নষ্ট হয়ে যাবে। রসের সাথে খাদ্য সংরক্ষণকারী রাসায়নিক সংরক্ষক দ্রব্য যোগ করতে হবে। বাড়িতে রস তৈরি করে বোতলে রাখা যেতে পারে। কিন্তু তাতে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা থাকে না। ফলের রসের সাথে চিনি বা সিরাপ মিশিয়ে স্কোয়াশ, ফ্রুট-সিরাপ ও কর্ডিয়াল তৈরি করা হয়। রসে যদি ফলের টুকরা না থাকে তখন তাকে কর্ডিয়াল বলা হয়। স্কোয়াশে কমপক্ষে ১০% ফলের রস থাকতে হবে। ভালো স্কোয়াশে ২৫% পর্যন্ত ফলের রস থাকে।
শুকিয়ে ফল সংরক্ষণ : এমন অনেক ফল আছে যেগুলোকে শুকিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। জলবায়ু শুষ্ক থাকলে রোদেও শুকানো যায়। তাছাড়া ওভেন বা ডিহাইড্রেটর যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই শুকানো কাজ সম্পন্ন করা যায়। এ প্রক্রিয়াকে ডিহাইড্রেশন বলে। এ প্রক্রিয়ায় সব ফলকে শুকানো যায় না। কারণ কোন কোন ফলের বুনট, গঠন, বর্ণ ও খাদ্যাংশের এত পরিবর্তন ঘটে যে খাদ্য হিসেবে প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলের মধ্যে সাধারণত কুল, আঙ্গুর (কিসমিস), খুবানী (ধঢ়ৎরপড়ঃ), ডুমুর, নাসপাতি ও খেজুর শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। রোদে শুকাতে হলে এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য শুকানোর পূর্বে ফলকে ফুটন্ত পানিতে কয়েক মিনিট সিদ্ধ করে নিতে হবে। অন্যথায় শুকানোর সময় ফল বিবর্ণ হয়ে যায়। মেশিনে শুকালে সিদ্ধ করতে হবে না। আমাদের দেশে প্রায় সারাবছরই বাতাসের আর্দ্রতা অনেক বেশি থাকে বিধায় ভালোভাবে ফল শুকানো যায় না। শুকানোর পর বায়ুরোধী পাত্রে বা পলিথিনের ব্যাগে ফল সংরক্ষণ করতে হবে।
চিনির দ্রবণে ফল সংরক্ষণ : চিনির দ্রবণে সংরক্ষণ করলে ফলের স্বাদ ও সুগন্ধ বৃদ্ধি পায়। সাধারণত আনারস, লিচু, পিচ, আম, পেঁপে, কমলা, আঙ্গুর, নাসপাতি, মাল্টা প্রভৃতি এভাবে সরংক্ষণ করা যায়। একাধিক ফল একসাথে সংরক্ষণ করে ফ্রুট ককটেল তৈরি করা যায়। কোন কোন সময় চিনির দ্রবণে গ্লুকোজ যোগ করা হয়। ফল সংরক্ষণের জন্য সিরাপের ঘনত্ব কমপক্ষে ৬০% হতে হবে। সাধারণত প্রতি কেজি ফলের জন্য ০.২৫ কেজি চিনি দরকার হয়। তবে ফলের মিষ্টতা অনুযায়ী এর কম বেশিও হতে পারে। সংরক্ষণের জন্য প্রথমে পাকা ফল সুবিধামতো টুকরা ও পরিষ্কার করে নিয়ে পাতলা সিরাপের সাথে জ্বাল দিয়ে সিরাপের ঘনত্ব ৬৫-৭৫% করতে হবে। সিদ্ধ করার সময় ফলের টুকরা যেন গলে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছোট আকারের ফল যথা লিচু, চেরি, কমলার কোয়া ইত্যাদি আস্ত ব্যবহার করতে হবে। ঠিকমতো সিদ্ধ করার পর ফল ও সিরাপ টিনে রেখে বায়ুরোধী ছিপি দ্বারা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে।
চিনির সিরার প্রলেপ দিয়ে ফল সংরক্ষণ : আম, আনারস এবং কাঁঠাল এর স্লাইস করে ৩০-৪০% চিনির দ্রবণের প্রলেপ দিয়ে প্রায় ১ বছর সংরক্ষণ করা যায়।
লবণের দ্রবণে সবুজ ফল সংরক্ষণ : এই পদ্ধতিতে কাঁচা আম, আমড়া ও জলপাই ৬-৮ মাস ভলো অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায় এবং পরে আচার ও চাটনি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে ফল সংরক্ষণ করতে প্রথমে পরিপুষ্ট কাঁচা ফল পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর ফলের আকার অনুযায়ী দুই বা চার টুকরায় কেটে নিতে হবে এবং ছোট হলে গোটা ফল নেওয়া যায়। ফলগুলো ৬০-৮০০ সে. তাপমাত্রায় ২-৩ মিনিট ব্লাঞ্চিং করতে হবে এবং ফলগুলো ঠাণ্ডা পানিতে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। শতকরা ১০ ভাগ লবণের দ্রবণ তৈরি করে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে ও ওজন করা অ্যাসিটিক এসিড এবং কেএমএস যোগ করতে হবে। প্লাস্টিক ড্রাম/কনটেইনার ভালোভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে এবং পরে গরম (৮০-৯০০ সে. তাপমাত্রায় পানি) পানিতে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। তারপর ফল/ফলের টুকরো পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত ড্রাম এবং কনটেইনারে রেখে লবণের দ্রবণ যোগ করতে হবে। এবার পাত্রের মুখে ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে সংযোগস্থলের উপর দিয়ে আঠাযুক্ত টেপ বা মোম গলিয়ে ভালোভাবে লাগিয়ে দিতে হবে যাতে পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বাযুরোধী হয়। পাত্রগুলো পরিষ্কার জায়গায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যবহারের পূর্বে দ্রবণে সংরক্ষিত ফল/ফলের টুকরাগুলো পানিতে ধুয়ে গরম পানিতে ডুবিয়ে ৩ মিনিট হালকাভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে।
আচার তৈরির মাধ্যমে ফল সংরক্ষণ : আচার অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই আচার খুব লোভনীয় ও আকর্ষণীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। যে ফল বা সবজি থেকে আচার তৈরি করা হয় তার উপর আচারের পুষ্টিমান নির্ভর করে। আচারে বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ থাকে, যা আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। আচার খাবারে স্বাদ বৃদ্ধি করে। আচারে তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ থাকে, যা তাপ শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। যথাযথ নিয়মে তৈরি করলে ফলের প্রায় সব গুণই আচারে অক্ষুণ্ন থাকে।
মিশ্রফলের শুকনো পাল্প : কাঁঠাল, আনারস ও আমের পাল্প ২৫:২৮:৭৫ অনুপাতে মিশিয়ে পাতলা শিটের মতো করে কোন পাত্রে রেখে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে এবং পলিথিনে মুড়িয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যাতে ধুলাবালু না পড়ে সেজন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
জ্যাম ও জেলি তৈরির মাধ্যমে ফল সংরক্ষণ : ফলের পাল্প নিয়ে যখন সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় তখন সেটি জ্যাম এবং ফলের থেকে পরিশ্রুত রস নিয়ে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় তখন তাকে জেলি বলে।
ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ জনপ্রিয় কিছু ফল হতে জ্যাম ও জেলি তৈরির পদ্ধতি
পেয়ারার জেলি : ভিটামিন সি সমৃদ্ধ দেশি পেয়ারা জেলি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী। পরিপুষ্ট কিন্তু বেশি পাকা নয় এমন পেয়ারাগুলো জেলির জন্য বাছাই করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নেওয়া হয়। ফলগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে সমপরিমাণ পানিতে সিদ্ধ করা হয়। তারপর পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে রস আলাদা করে নেওয়া হয়।
জেলি তৈরির জন্য ১ কেজি রসের সাথে ৬৫০ গ্রাম চিনি, ৭ গ্রাম সাইট্রিক এসিড এবং ০.৭৫ গ্রাম সোডিয়াম বেনজয়েট প্রয়োজন হয়। রসের সাথে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। মিশ্রণটি মোটামুটি গাঢ় হয়ে আসলে রিফ্রাক্টোমিটার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং মিশ্রণটিকে ৬৫% টিএসএস পর্যন্ত রান্না করা হয়। রিফ্রাক্টোমিটারের অনুপস্থিতিতে শিটিং পরীক্ষার মাধ্যমে জেলি হয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব। মিশ্রণটি মোটামুটি গাঢ়ত্বে আসলে শিটিং পরীক্ষা করা হয়। টিএসএস ৬৪% হলে সাইট্রিক এসিড যোগ করা হয় এবং সামান্য জ্বাল দিয়ে পানিতে সোডিয়াম বেনজয়েট গলিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে ফেলা হয়। জেলি জীবাণুুমুক্ত বোতলে ঢেলে ছিপি এঁটে দেওয়া হয়। ঠা-া হওয়ার পর জেলির উপরে মোম গলিয়ে দেওয়া হয়।
আমড়ার জেলি : দেশজ এই ফলটি প্রক্রিয়াজাত করে নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা যায়। আমড়া দিয়ে খুবই উন্নতমানের জেলি প্রস্তুত করা সম্ভব। আমড়াগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কেটে টুকরো করে সামান্য পরিমাণ সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ করার সময় কাঠের হাতল দিয়ে টুকরাগুলো নাড়াচাড়া করা হয়। পাতলা কাপড়ে ছেঁকে রস আলাদা করে নেওয়া হয়। জেলি তৈরির জন্য ১ কেজি রসের সাথে ৭০০ গ্রাম চিনি, ৬ গ্রাম সাইট্রিক এসিড, ০.৮ গ্রাম সোডিয়াম বেনজয়েট দরকার। রসের সাথে চিনি যোগ করে জ্বাল দেওয়া হয়। রান্নার মাঝামাঝি পর্যায়ে পেকটিন যোগ করা হয়। কাক্সিক্ষত গাঢ়ত্বে না আসা পর্যন্ত রান্না চালিয়ে যাওয়া হয়। আমড়ার জেলি তৈরির পরবর্তী ধাপগুলো পেয়ারার জেলি তৈরির অনুরূপ।
আনারসের জেলি : গ্রীষ্মকালে এ ফলের প্রাপ্র্যতা অনেক বেশি। আনারসের জেলি তৈরির জন্য আনারস কুচি একটি, চিনি দুই কাপ, ফুড কালার সামান্য, পানি আধা কাপ ও লেবুর রস এক চা চামচ প্রয়োজন। প্রথমে একটি ব্লেন্ডারে আনারস কুচির সঙ্গে আধা কাপ পানি মিশিয়ে ভালো করে ব্লেন্ড করতে হবে। এবার ঘন মিশ্রণটি একটি প্যানে নিয়ে ১০ মিনিট নাড়তে হবে।
এখন এতে চিনি দিয়ে আরো ২০ থেকে ৩০ মিনিট নাড়তে হবে। এবার এতে ফুড কালার (হলুদ) ও লেবুর রস দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। ঘন হয়ে এলে একটি বোতলে ভরে ঠা-া করে ফ্রিজে রেখে দিলে তৈরি হবে আনারসের জ্যাম।
আনারস জ্যাম : আনারসের পাল্প ৩ কাপ, অ্যাগার অ্যাগার দেড় চা-চামচ, সাইট্রিক অ্যাসিড আধা চা-চামচ, আদাবাটা ১ চা-চামচ, চিনি সাড়ে তিন কাপ, সোডিয়াম বেনজয়েট সিকি চা-চামচ, আনারস এসেন্স ১ চা-চামচ, লবণ আধা চা-চামচ।
আনারস দুই ভাগ করে কাঁটা চামচ দিয়ে কেচে নিতে হয় অথবা ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এবার চিনিসহ চুলায় সেদ্ধ করতে হবে। এরপর এর সঙ্গে আদা ও লবণ দিয়ে মিশ্রিত করতে হবে। অ্যাগার অ্যাগার গরম পানি দিয়ে ১০ মিনিট ভিজিয়ে আনারসের মিশ্রণে ঢেলে দিতে হবে। আনারস যখন ঘন থকথকে হয়ে আসবে, তখন চুলা থেকে নামিয়ে সোডিয়াম বেনজোয়েট, সাইট্রিক অ্যাসিড ও পাইনঅ্যাপল এসেন্স দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। এবার নামিয়ে বয়ামে ঢেলে সংরক্ষণ করতে হবে।
মিশ্রফলের জ্যাম : দেশীয় বিভিন্ন ফলের সংমিশ্রণে উন্নতমানের জ্যাম তৈরি করা যায়। পেয়ারা ও আমড়া ধুয়ে কেটে টুকরো করে সমপরিমাণ পানিতে আধ ঘণ্টা ফুটানো হয়। পরে তা ঠা-া করে নিয়ে মশারির কাপড়ে ছেঁকে পাল্প বা ম- আলাদা করে নেওয়া হয়। পাকা পেঁপের খোসা ছাড়িয়ে পেঁপের ওজনের অর্ধেক পরিমাণ পানি মিশিয়ে ও জ্বাল দিয়ে পাল্প তৈরি করা হয়। মিশ্র ফলের জ্যাম প্রস্তুত করতে উপকরণের অনুপাত হবে; পেয়ারার পাল্প ১ কেজি, আমড়ার পাল্প ১ কেজি, পেঁপের পাল্প ১ কেজি, চিনি ২.৫ কেজি, সাইট্রিক এসিড ২৫ গ্রাম এবং সোডিয়াম বেনজয়েট ৩ গ্রাম।
ফলের পাল্পসমূহ একত্রে মিশিয়ে তার সাথে চিনি যোগ করে জ্বাল দেওয়া হয়। কাক্সিক্ষত গাঢ়ত্বে না আসা পর্যন্ত রান্না চালিয়ে যেতে হয়। মিশ্রণটি মোটামুটি গাঢ়ত্বে এলে শিটিং পরীক্ষা করা হয় এবং তালের জ্যাম তৈরির পদ্ধতির ন্যায় পরবর্তী ধাপগুলো সম্পন্ন করে এই জ্যাম প্রস্তুত করা হয়।
তালের জ্যাম : তাল থেকে উৎকৃষ্ট মানের জ্যাম তৈরি করা যায়। পাকা তাল থেকে আঁটি আলাদা করে নিয়ে আঁটির ওজনের এক-তৃতীয়াংশ পানি যোগ করে চটকিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। তালের জ্যাম তৈরির জন্য ১ কেজি মণ্ডের সাথে ১ কেজি চিনি, ১১.৫ গ্রাম পেকটিন, ১২.৫ গ্রাম সাইট্রিক এসিড এবং ১ গ্রাম সোডিয়াম বেনজয়েট প্রয়োজন হয়।
মণ্ডের সাথে চিনি যোগ করে জ্বাল দেওয়া হয়। রান্নার মাঝামাঝি পর্যায়ে পেকটিন যোগ করা হয় এবং কাক্সিক্ষত গাঢ়ত্বে না আসা পর্যন্ত রান্না চালিয়ে যেতে হয়। মিশ্রণটি মোটামুটি কাক্সিক্ষত গাঢ়ত্বে এলে শিটিং পরীক্ষা করা হয়। শিটিং পরীক্ষার পদ্ধতি হলো-মিশ্রণের মধ্যে চামচ ডুবানো এবং ঠাণ্ডা করে চামচ বেয়ে মিশ্রণটিকে পড়তে দেওয়া। যদি এটা একাধারে না পড়ে শিটের আকারে পড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে জ্যাম তৈরি হয়ে গেছে। শিটিং পরীক্ষায় জ্যাম প্রস্তুত হওয়ার কাছাকাছি বুঝা গেলে সাইট্রিক এসিড পাউডার ক্ষীণধারে মিশ্রণের সাথে যোগ করে সামান্য একটু জ্বাল দেওয়া হয়। তারপর অল্প পরিমাণ পানিতে সোডিয়াম বেনজয়েট যোগ করে চুলা থেকে নামানো হয়। জ্যাম জীবাণুমুক্ত বোতলে ঢেলে ছিপি এঁটে দেওয়া হয়। ঠাণ্ডা হওয়ার পর বোতলের ওপরে মোম গলিয়ে দেওয়া হয়।
ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আমরা এর অপচয় রোধ করে অধিক মানুষের পুষ্টি সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারি এবং সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারি।
চন্ডী দাস কু-১ শাহ্ মোহাঃ আকরামুল হক২
মো. আহসানুল হক চৌধুরী৩
১পরিচালক, ২অতিরিক্ত পরিচালক, ৩অতিরিক্ত উপপরিচালক হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৬৪৮৯৯১৯, ই-মেইল : dhw@dae.gov.bd