Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

উত্তরাঞ্চলে সুুুগন্ধি ধানের সম্ভাবনা ও চাষ পদ্ধতি

বিশেষ জাতের ধান থেকে সুগন্ধি চাল তৈরি হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে আমন ও বোরো মৌসুমে সুগন্ধি ধান চাষ করা সম্ভব। উত্তরাঞ্চলে প্রধানত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ,  রাজশাহী জেলায় সুগন্ধি ধান উৎপাদিত হয়। কাটারিভোগ ধানের আতপ চালের পোলাও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাটারিভোগ ধানের চিঁড়া হয় হালকা ধবধবে সাদা ও এতে আছে মিষ্টি সুগন্ধ। আদিকাল থেকে সুগন্ধি চাল অভিজাত শ্রেণির আচার অনুষ্ঠানে স্থান পায়। আজও দিনাজপুরের কাটারিভোগ সুগন্ধি চাল দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে সুনাম বজায় রেখেছে। সুগন্ধি চালের পোলাও ছাড়া পিঠা-পুলি, বিরিয়ানি, জর্দা, পায়েশ ও ফিরনি বেশ চমৎকার ও সুস্বাদু-যা জিভে জল আনে। এখনও দিনাজপুরের কৃষকরা মসজিদে মিলাদে এবং লক্ষ্মী-নারায়ণ পূজায় এ চাল ব্যবহার করে থাকে।

 

জাত : আমাদের দেশে আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৮০ ও বিনাধান-১৩ এবং স্থানীয় জাতের মধ্যে কাটারিভোগ, কালিজিরা, চিনিগুড়া, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, তুলসীমালা উল্লেখযোগ্য। ব্রি ধান৩৪ স্থানীয় সুগন্ধি জাতের ধান চিনিগুড়া বা কালিজিরার মতোই অথচ ফলন প্রায় দ্বিগুণ। কৃষকেরা এ ধানের আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। তাছাড়া আলোক সংবেদনশীল হওয়ায় আমনে বন্যাপ্রবণ এলাকায় নাবিতে রোপণ উপযোগী। ব্রি ধান৭০ ও ৮০ আমন মৌসুমে ব্রি কর্তৃক সর্বশেষ উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ধান এবং আলোক অসংবেদনশীল। গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫.০ মেট্রিক টন যা কাটারিভোগ ধানের চেয়ে দ্বিগুণ। ব্রি ধান৭০ ধানের চাল দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগের চাইতে আরও বেশি লম্বা। আর ব্রি ধান৮০ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় জেসমিন ধানের মতো, সুগন্ধিযুক্ত এবং খেতেও সুস্বাদু। অপরদিকে বোরো মৌসুমে সুগন্ধিযুক্ত আধুনিক জাত হচ্ছে ব্রি ধান৫০ (বাংলামতি)। এ জাতের চালের মান বাসমতির মতোই। হেক্টর প্রতি ফলন ৬ মেট্রিক টন। তবে চাল তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।


মাটি ও জলবায়ু : ফুল আসা থেকে পরিপক্বতা পর্যন্ত যথাযথ সুগন্ধি শস্য দানার জন্য প্রয়োজন সামান্য আর্দ্রতা, মৃদু বাতাস, শীতল রাত্রি  অর্থাৎ ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং রৌদ্রোজ্জ¦ল আলোকিত দিন অর্থাৎ ২৫-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। সব ধরনের মাটিতেই সুগন্ধি ধানের চাষ করা যায় তবে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি উত্তম।


বীজ বপনের সময় : বোরো মৌসুমে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ এবং রোপা আমন মৌসুমে ১৫ জুন থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে জুলাইয়ের ২য়-৩য় সপ্তাহ বপন করার উত্তম সময়।
 

সার ব্যবস্থাপনা : সুগন্ধি ধানের জমিতে প্রতি বিঘা বা ৩৩ শতকে আমনে আধুনিক জাত বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ৩৭, ৩৮, ৭০, ৮০ বা বিনাধান-১৩ এর ক্ষেত্রে ইউরিয়া ১৮-২০ কেজি, টিএসপি ১০-১২ কেজি, এমওপি ৯-১০ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১ কেজি  হারে প্রয়োগ করতে হয়। আমনে স্থানীয় জাত যেমন-কাটারিভোগ, কালিজিরা ইত্যাদি জাতের ক্ষেত্রে ইউরিয়া ১০ কেজি, টিএসপি ৬ কেজি, এমওপি ৬ কেজি, জিপসাম ৩ কেজি, দস্তা আধা কেজি  হারে প্রয়োগ করতে হয়। আর বোরো মৌসুমে ব্রি ধান৫০ জাতের ক্ষেত্রে ইউরিয়া ৩০-৩৫ কেজি, টিএসপি ৭-১০ কেজি, এমওপি ৯-১০ কেজি, জিপসাম ৮-১০ কেজি, দস্তা ১ কেজি  হারে প্রয়োগ করতে হয়। মাটির উর্বরতাভেদে সার ও তার পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।
তবে শুধু রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করলে আধুনিক জাতে স্থানীয় জাতের ধানের মতো সুগন্ধিযুক্ত হয় না। তাই প্রচুর জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সুগন্ধি চাল তার নিজস্ব সুঘ্রাণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এজন্য শতক প্রতি ৪ কেজি ভার্মি কস্পোস্ট সার ব্যবহার করতে পারেন।


রোগ ব্যবস্থাপনা : বোরো ও আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের জাতগুলো সাধারণত ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সেজন্য আগাম সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সুগন্ধি ধানের জাতে ব্লাস্ট রোগ হোক বা না হোক শীষ বের হওয়ার আগে ট্রাইসাইকা¬জল/স্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় শেষ বিকেলে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া বীজতলায় বীজ ফেলা থেকে শুরু করে ঘরে ধান তোলা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিচর্যা স্বাভাবিক ধান চাষের মতোই।


ফসল সংগ্রহ : ধান পরিপক্ব হলে অর্থাৎ অধিকাংশ ধানের ছড়ায় শতকরা ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ধান কাটতে হবে। মাড়াইয়ের পর ধান কয়েক বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে যেন আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। লম্বা আকারের সুগন্ধি ধান থেকে আস্ত চাল পেতে হলে রাবার হলার মেশিন ব্যবহার করা প্রয়োজন।


শেষকথা : অনেক ক্ষেত্রে এ দেশি অতি উন্নতমানের সুগন্ধি চালের জাতগুলো সম্পর্কে ধারণা ও প্রচারণার অভাব থাকায় নামি-দামি হোটেলে আমাদের জনপ্রিয় সুগন্ধি ধানের পরিবর্তে বিদেশি বাসমতি জাতের চাল ব্যবহার প্রচলন দেখা যায়। বর্তমান সরকার সুগন্ধি ধান রপ্তানিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে বিশে^ও প্রায় ১৩৬টি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হচ্ছে। সুগন্ধি চালের দেশীয় বাজার চাহিদা বাড়ালে কৃষকের সুগন্ধি চালের উৎপাদন ও এর ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উচ্চ ফলন ও যথোপযুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সুগন্ধি চাল রপ্তানি আরো অধিক লাভজনক করা যেতে পারে।

 

কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম১
কৃষিবিদ মোহাম্মদ গোলাম মাওলা২

১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস এর আঞ্চলিক কার্যালয়, রংপুর, ০১৭১৯৫৪৭১৭৯; ২বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, ০১৭১৬৮০৬১৭১

 

বিস্তারিত
বারি পেয়ারা-৪ বীজমুক্ত পেয়ারার উন্নত জাত

পেয়ারা বাংলাদেশের ফল না হলেও এদেশের ফলের বাজারে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে। বহুবিধ গুণাগুণের সমন্বয়ের জন্য পেয়ারাকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের আপেল বলা হয়ে থাকে। পেয়ারা এমন একটি ফল যা প্রচুর পুষ্টি সম্ভারে ভরপুর। বাংলাদেশে যত প্রকার ফল আছে তার মধ্যে একমাত্র আমলকী ছাড়া অন্য কোনো ফলে ভিটামিন “সি” এর পরিমাণ পেয়ারার চেয়ে বেশি নেই। ফলটি স্বাদে মধুর, ভিটামিন “সি” ও শর্করা তথা পেকটিনে সমৃদ্ধ। খুব অল্প যতেœ এ গাছটি জন্মাতে পারে এবং তাড়াতাড়ি বেড়ে ফল দিতে পারে। দেশের প্রায় সব গৃহস্থের বাড়িতেই দু-একটি পেয়ারা গাছ রয়েছে। তবে ইতোপূর্বে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি, চট্টগ্রাম জেলার কাঞ্চন নগর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার মুকুন্দপুরসহ প্রভৃতি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত জাত যেমন- কাজী পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২, ৩ উদ্ভাবিত হবার পর দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রাইখালী একটি চমকপ্রদ পেয়ারার জাত উদ্ভাবন করেছে, যা সম্পূর্ণ বীজমুক্ত, খেতে সুস্বাদু, মিষ্টি (টি.এস.এস. ৮.৫%), কচকচে ও নাবি জাত। বারি পেয়ারা-৪ নামে এই জাতটি ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত হয়েছে। পেয়ারার জগতে এটি একটি আশ্চর্যজনক সংযোজন। এ জাতটি জুন-জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন ধাপে ফল দেয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পেয়ারাগুলো আকারে বড় ও খেতে অত্যধিক মিষ্টি হয়।


পেয়ারার উৎপত্তি ও বিস্তার : আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন উষ্ণ অঞ্চল, বিশেষ করে মেক্সিকো হতে পেরুর যে কোনো স্থান পেয়ারার আদি নিবাস। ২০০০ বছরের পূর্বে এটি চাষাবাদের আওতায় আসে এবং পরবর্তীতে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজদের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহে ব্যাপক হারে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। প্রাকৃতিক তারতম্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় নানান জাতের পেয়ারার চাষ হতে দেখা যায়।
 

বাংলাদেশে পেয়ারা চাষ : বাংলাদেশে পেয়ারা চাষ বর্তমানে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। পেয়ারা চষে ব্যবহৃত জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ৬৪৫০ একর ও ৯১৪৬ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৭৯৪ একর ও ২,১৪,৩০৮ মেট্রিক টন। পেয়ারা উৎপাদনের দিক দিয়ে ২০১১ সালের তথ্য মতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর পেয়ারার জাতগুলো বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বত্র চাষ হচ্ছে। বীজবিহীন পেয়ারার নতুন জাত “বারি পেয়ারা-৪” সমতল ভূূমি ছাড়াও পাহাড়ের জন্য বিশেষ উপযোগী।


পেয়ারার উদ্ভিদতত্ত্ব : পেয়ারা Myrtiflorae বিভাগের Myrtaceae পরিবারের সদস্য। Myrtiflorae বিভাগে আরও ১২টি পরিবার রয়েছে। এই ১২টি পরিবারের ৭৩টি গণের মধ্যে Psidium (সিজিয়াম) গণে পেয়ারার অবস্থান। Psidium (সিজিয়াম) গণে পেয়ারার প্রায় ১৫০টি প্রজাতি রয়েছে।


পেয়ারার পুষ্টি মূল্য ও ব্যবহার : পেয়ারা ভিটামিন “সি” ও পেকটিনের একটি ভালো উৎস।
প্রতি ১১ গ্রামে ২৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন “সি” রয়েছে।
ফলে ৮২.৫০ ভাগ পানি, ২.৪৫ ভাগ অম্ল, ১১.২ ভাগ শ্বেতসার থাকে। ভক্ষণযোগ্য অংশের প্রতি ১০০ গ্রামে পেকটিন রয়েছে ০.৯৯ ভাগ, খনিজ পদার্থ ০.৬৬ ভাগ, আঁশ ৩.৮ ভাগ, ভিটামিন “এ” ২৫০ আইইউ, থায়ামিন ০.০৫ মিলিগ্রাম, রাইবোফ্লাবিন ০.০৩ মিলিগ্রাম, নায়াসিন ১.১৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৭ ভাগ এবং ৫০ কিলোক্যালরি বিদ্যমান।
প্রচুর পরিমাণ পেকটিন থাকার কারণে পেয়ারা জেলি তৈরির জন্য উপযোগী।

 

পরিণত পেয়ারা কাঁচা বা পাকা উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। এছাড়া সালাদ, পুডিং, শরবত, আইসক্রিম প্রভৃতি সুস্বাদু খাবার তৈরি করে খাওয়া যায়।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে পেয়ারাকে বলকারক, স্নিগ্ধকর, তৃষ্ণা ও দাহনাশকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পেয়ারা গাছের কচি পাতা ভালোভাবে সিদ্ধ করে তা দিয়ে সপ্তাহ খানেক কুলি করলে পায়োরিয়া ও দাঁতের অন্যান্য রোগের উপশম হয়।


বারি পেয়ারা-৪ এর বৈশিষ্ট্য : এটি উচ্চ ফলনশীল এবং পেয়ারার একটি অমৌসুমি নাবি জাত। গাছ ঝোপালো এবং প্রচুর সবুজ পাতা বিদ্যমান যা অধিক ফলনে সহায়তা করে। ফল সম্পূর্ণ বীজমুক্ত, কচকচে ও মিষ্টি এবং আকৃতি লম্বাটে। ফলের আকার ৭.১৪ থেকে ১০.১৪ সেমি। গড় ওজন ২৫০ গ্রাম, টি.এস.এস. ৯.৫-১০%। ফলের গাত্র অমসৃণ, পাকা অবস্থায় হলুদাভ সবুজ, পেটের দিকে বাঁকানো, শাঁস সাদা এবং খেতে সুস্বাদু। কম বেশি সারা বছর ফল পওয়া যায় তবে সর্বাধিক ফল আহরণ করা হয় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ্যানথ্রাকনোজ ও ঢোলে পড়া রোগের প্রতি সংবেদনশীল নয়। দেশের সর্বত্র চাষ করা যায়। ফলটি সাধারণ তাপমাত্রায় ৮-১০ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
 

মাটি : বারি পেয়ারা-৪ গাছটি বেশ সহনশীল তাই মোটামুটিভাবে সব রকম মাটিতেই চাষ করা যেতে পারে। তবে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটি থেকে ভারী এঁটেল মাটি যেখানে পানি নিষ্কাশনের বিশেষ সুবিধা আছে সেখানে বারি পেয়ারা-৪ ভালো জন্মে। পেয়ারার শিকড় বেশির ভাগ মাটির ০-২০ সেন্টিমিটার গভীরে থাকে তাই মাটির উপরিস্তর উর্বর থাকা বাঞ্ছনীয়। মাটির pH ৪.৫-৮.২ হলে পেয়ারা চাষের জন্য উপযুক্ত। পেয়ারা কিছু মাত্রার (৮-৯ ds.m-2) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তুলনামূলক বিচারে সাদা পেয়ারার তুলনায় লাল পেয়ারার লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতা বেশি। তবে লবণাক্ত মাটিতে পেয়ারার আকার, ওজন ও ভিটামিন ‘সি’ কমে যেতে পারে।


জলবায়ু : উষ্ণ ও আর্দ্র  জলবায়ু পেয়ারা চাষের জন্য উপযুক্ত যা আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে খুবই মিলে যায়। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৫০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত পেয়ারার চাষ করা যেতে পারে। পেয়ারা চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৩০-২৮০সেঃ। একটি নির্দিষ্ট  শীতের ঋতু পেয়ারার গুণগতমান উন্নয়ন করে। তবে তুষারপাতে পেয়ারা গাছ ডাইব্যাক রোগে মারা যেতে পারে। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১০০-২০০ মিলিমিটার আদর্শ।   


ফসল সংগ্রহ : চারা গাছে সাধারণত ৪-৫ বছরের মধ্যেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে বারি পেয়ারা-৪ যেহেতু কলমের গাছ তাই চারা রোপণের পরের বছর থেকেই গাছে ফল ধরবে। তবে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি সঠিক রাখতে প্রথম বছর ফল না রাখাই ভালো, দ্বিতীয় বছর অল্প সংখ্যক ফল রাখা যেতে পারে। এভাবে পর্যায়ক্রমে গাছের অবস্থা বিবেচনা করে ফল রাখতে হবে। এপ্রিল-মে  এবং জুন-জুলাই মাসে বারি পেয়ারা-৪ এর গাছে ফুল আসে। এছাড়া অক্টোবর-নভেম্বর মাসেও কিছু অমৌসুমি ফুল আসে। ফুল আসার তিন-চার মাসের মধ্যেই ফল সংগ্রহ করা যায়। বারি পেয়ারা-৪ যখন সবুজ থেকে হলদে সবুজ রং ধারণ করে তখন ফল আহরণ করা হয়। পুরোপুরি পাকা ফলের চাইতে পোক্ত বা অর্ধ-পাকা ফল খেতে বেশি সুস্বাদু। পরিপক্ব পেয়ারা বোঁটা বা দু-একটি পাতাসহ কেটে বাজারে আনা হলে বেশি মূল্যে বিক্রি করা যায়। বৃষ্টির সময় পেয়ারা সংগ্রহ করা ঠিক নয় এসময় ফলের মিষ্টতা কিছুটা কমে যায়।


ফলন : তিন বছরের একটি কলমের গাছে ৭০ থেকে ৮০ কেজি ফল পাওয়া যায়। সে হিসেবে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০-৫০ টন। তবে গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলন বাড়তে থাকে।

 

১এসও, মোবাইল : ০১৯১৮৫৪৫৪১৪, ই-মেইল:- mohidul@bari.gov.bd ২এসও, ৩পিএসও, পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রাইখালী, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা

বিস্তারিত
পুষ্টিমান অক্ষুণ্ন রেখে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ

প্রক্রিয়াজাতকরণ হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান, যার মাধ্যমে পুষ্টি ও অন্যান্য গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে খাদ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত (fit condition) পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের গুণগতমান নির্ভর করে মূলত প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া শুরু করার সময় তাদের গুণগতমান কেমন ছিল তার উপর (Kader and Barret 2005)। পুষ্টিমান হলো একটি ফলে কি পরিমাণ ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, আঁশ, শর্করা, প্রোটিন এবং এন্টি অক্সিডেন্ট ফাইটোক্যামিক্যালস (ক্যারটিনয়েড, ফ্ল্যাভানয়েড এবং অন্যান্য ফিনোলিক দ্রব্য) আছে তার উপর নির্ভর করে। প্রক্রিয়াজাত পণ্য তথা ফলে ফাইটোক্যামিক্যাল এর পরিমাণ প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ফাইটোক্যামিক্যাল এর স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে, যা মূলত পণ্যের জারণ (oxidation) ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সংবেদনশীলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত (Leong and Oey 2012) । পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন যেমন- ভিটামিন-সি, বি১, বি২, বি৬ এবং ফলিক এসিড তাপ সংবেদনশীল কিন্তু চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনসমূহ তুলনামূলকভাবে তাপসহনশীল। ফলে উপস্থিত খনিজ পদার্থসমূহ প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ততটা প্রভাবিত হয় না।
 

প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন প্রয়োজন?
অধিকাংশ ভোক্তাই সবচেয়ে তাজা ফল এবং সবজি পেতে ও খেতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সকল বিচিত্র রকমের ফল ও সবজি বছরব্যাপী উৎপাদন করা যায় না। কিছু ফল আছে নির্দিষ্ট অঞ্চলে জন্মায়, আবার অনেক সুস্বাদু ফল স্বল্প সময়ের জন্য জন্মায় এবং সে সময়টি পার হওয়ার পর আর সে ফলগুলো পাওয়া যায় না। এ সমস্ত কারণে নির্দিষ্ট সময়ের পর তাজা  ফলের স্বাদ গ্রহণের জন্য ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি আদর্শ বিকল্প
(alternative) । প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ফলের ক) প্রাপ্যতা সময় বৃদ্ধি পায়, খ) ফল সংরক্ষণের সময় কম নষ্ট হয় এবং সংরক্ষণ সময় বৃদ্ধি পায়, গ) খাদ্যের অনুজৈবিক এবং রাসায়নিক নিরাপত্তা বাড়ে এবং ঘ) খাদ্যেও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে জাত নির্বাচন এবং ফলের পরিপক্বতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, ফল তাজা, ফ্রোজেন এবং প্রক্রিয়াজাত (canned) যে অবস্থায়ই খাওয়া  হোক না কেনো, তা বর্ণ, গন্ধ, গ্রহণযোগ্যতা এবং পুষ্টিমানের দিক দিয়ে একই রকম, যদিও তা শস্য সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়ার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।


প্রক্রিয়াজাতকরণ (পাত্রে সংরক্ষণ বা ক্যানিং, শুষ্ককরণ বা ড্রাইং, নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ বা ফ্রিজিং এবং জুস, জ্যাম ও জেলি তৈরিকরণ) ফলের ভক্ষণোপযোগী সময় (shelf life) বৃদ্ধি করে। প্রক্রিয়াজাতকরণের ধাপসমূহ হলো; মূল উপাদানসমূহ তৈরি (preparation of raw material) যেমন- পরিষ্কারকরণ, অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেঁটে ফেলা ও খোসা ছাড়ানো, এবং পরবর্তীতে রন্ধন, ক্যানিং অথবা ফ্রিজিং। প্রক্রিয়াজাতকরণ স্বল্প ও দীর্ঘ সময়ের জন্য করা যায়। নিম্নে বিভিন্ন ফলের কিছু প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যের বিবরণ দেয়া হলো:


আচার : আচার অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই আচার খুব লোভনীয় ও আকর্ষণীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। যে ফল বা সবজি থেকে আচার তৈরি করা হয় তার উপর আচারের পুষ্টিমান নির্ভর করে। আচারে ভিটামিন সি এবং খনিজ পদার্থ থাকে যা আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। আচার খাবারে রুচি বৃদ্ধি করে।


আচারে তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ থাকে যা তাপ শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। যথাযথ নিয়মে তৈরি করলে ফল বা সবজির প্রায় সকল গুণই আচারে অক্ষুণœ থাকে। অল্প মূলধনেই আচার তৈরি করা যায়। আচার তৈরি ও বাজারজাত করে সহজেই একজন ব্যক্তি আয় বর্ধনের ব্যবস্থা করতে পারে।


আমের আচার : আমের প্রাপ্যতা সময় মাত্র কয়েক মাস। আবার আম ছোট থাকা অবস্থায় অনেক সময় ঝড়ে অধিকাংশ বা সমস্ত আম পড়ে যায়। ঝড়ে পড়া আম দিয়ে সুস্বাদু আচার তৈরি করে সারা বছর ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অপচয় রোধ করে পারিবারিক আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।     


প্রস্তুত প্রণালি
১। আমের আচারের জন্য ভালো কাঁচা আম বেছে নিতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
২। আমগুলো লম্বালম্বিভাবে ৬-৮ ভাগ করে কেটে নিতে হবে।
৩। এক কেজি আমের টুকরার সাথে ৪০ গ্রাম লবণ মাখিয়ে ১০-১৫ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
৪। অতঃপর টুকরাগুলো উঠিয়ে ৫ গ্রাম হলুদ মিশিয়ে বাঁশের চালুনি বা ট্রেতে ৫-৬ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
৫। ওজন করা টুকরাগুলো তেলের মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৬। আদা এবং রসুনের খোসা ছাড়িয়ে ১০০ মিলিলিটার ১% অ্যাসেটিক এসিড দ্রবণ সহযোগে পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে।
৭। শুকনো মরিচের গুঁড়া ও হলুদের গুঁড়া আদা রসুনের পেস্টের সঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণটি আম ভেজে নেয়ার পর কড়াইয়ে অবশিষ্ট তেলের মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৮। ভাজা চলাকালীন ভাজা আমের টুকরা, চিনি, মেথি, জিরার গুঁড়া ও সরিষার গুঁড়া একে একে যোগ করতে হবে। অবশেষে লবণ এবং অবশিষ্ট অ্যাসেটিক এসিড অর্থাৎ ১০ মিলিলিটার গ্লাসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে কম তাপে ৩-৫ মিনিট জ্বাল দিতে হবে।
৯। অতঃপর চুলা থেকে নামানোর পর গরম অবস্থায় জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভরে ছিপি এঁটে দিতে হবে।

 

জলপাই এর আচার : কাঁচা এবং পাকা উভয় অবস্থাতেই জলপাই খাওয়া যায়। জলপাইয়ে প্রচুর পুষ্টি উপাদান আছে। জলপাই এর আচার খুবই উপাদেয় এবং সহজেই তৈরি করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে জলপাই আচার তৈরির মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
 

প্রস্তুত প্রণালি
১। জলপাই এর জন্য ভালো জলপাই বেছে নিতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
২। জলপাইগুলো লম্বালম্বি ৩ ভাগ করে কেটে নিতে হবে।
৩। এক কেজি জলপাই টুকরার সাথে ৪০ গ্রাম লবণ মাখিয়ে ১০-১৫ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
৪। অতঃপর জলপাইগুলো উঠিয়ে ৫ গ্রাম হলুদ মিশিয়ে বাঁশের চালনি বা ট্রেতে ২-৩ ঘণ্টা রৌদে শুকাতে হবে।
৫। ওজন করা টুকরাগুলো তেলের মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৬। আদা এবং রসুনের খোসা ছাড়িয়ে ১০০ মিলি লিটার ১% অ্যাসেটিক এসিড দ্রবণ সহযোগে পেস্ট তৈরি করতে হবে।
৭। শুকনো মরিচের গুঁড়া ও হলুদের গুঁড়া আদা রসুনের পেস্টের সঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণটি জলপাই ভেজে নেয়ার পর অবশিষ্ট তেলে মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৮। ভাজা চলাকালীন ভাজা জলপাই টুকরো, চিনি, মেথি, জিরার গুঁড়া ও সরিষার গুঁড়া একে একে যোগ করতে হবে। অবশেষে লবণ এবং অবশিষ্ট অ্যাসেটিক এসিড অর্থাৎ ১০ মিলি লিটারগ্লেসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে কম তাপে ৩-৫ মিনিট জ্বাল দিতে হবে।
৯। অতঃপর চুলা থেকে নামানোর পর গরম অবস্থায় জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভরে ছিপি এঁটে দিতে হবে।
আমড়ার আচার : আমড়া খেতে খুব সুস্বাদু। ভিটামিন-সি ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ এ ফলটি দিয়ে উন্নত মানের আচার ও চাটনি তৈরি করা যায়।

 

প্রস্তুত প্রণালি
১। আমড়ার আচার এর জন্য ভালো আমড়া বেছে নিতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে বঁটি বা চাকু দিয়ে আমড়ার উপরের ছাল বা ত্বক ছিলে ফেলে দিতে হবে।
২। আমড়াগুলো লম্বালম্বি ৬-৮ ভাগ করে কেটে নিতে হবে।
৩। এক কেজি আমড়ার সাথে ৪০ গ্রাম লবণ মাখিয়ে ১০-১৫ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
৪। অতঃপর আমড়াগুলো উঠিয়ে ৫ গ্রাম হলুদ মিশিয়ে বাঁশের চালনি বা ট্রেতে ২-৩ ঘণ্টা রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে।
৫। ওজন করা টুকরাগুলো তেলের মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৬। আদা এবং রসুনের খোসা ছাড়িয়ে ১০০ মিলিলিটার ১% অ্যাসেটিক এসিড দ্রবণ সহযোগে পেস্ট তৈরি করতে হবে।
৭। শুকনো মরিচ ও হলুদের গুঁড়া আদা রসুনের পেস্টের সঙ্গে মিশিয়ে আমড়া ভেজে নেয়ার পর কড়াইয়ে অবশিষ্ট তেলের মধ্যে ভেজে নিতে হবে।
৮। ভাজা চলাকালীন সময়ে ভাজা আমড়ার টুকরা, চিনি, মেথি, জিরার গুঁড়া ও সরিষার গুঁড়া একে একে যোগ করতে হবে। অবশেষে লবণ এবং অবশিষ্ট অ্যাসেটিক এসিড অর্থাৎ ১৪ মিলিলিটারগ্লেসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে কম তাপে ৩-৫ মিনিট জ্বাল দিতে হবে।
৯। অতঃপর চুলা থেকে নামানোর পর গরম অবস্থায় জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভরে ছিপি এঁটে দিতে হবে।

 

তেঁতুলের সস :
প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য তেঁতুলের ১৭-৩৫ গ্রাম পানি, ২-৩ গ্রাম আমিষ, ০.৬ গ্রাম চর্বি, ৪১-৬১ গ্রাম শর্করা, ২.৯ গ্রাম আঁশ, ৩৪-৯৪ মিগ্রা ক্যালসিয়াম, ৩৪-৭৮ মিগ্রা ফসফরাস এবং ৪৪ মিগ্রা ভিটামিন সি থাকে। পেটের বায়ু ও হাত-পা জ্বালায় তেঁতুলের শরবত উপকারী। তেঁতুলে টারটারিক এসিড থাকে যা হজমে সাহায্য করে। তেঁতুলের শরবত ব্যবহারে মাথা ব্যাথা এবং ধুতুরা, কচু ও অ্যালকোহলের বিষাক্ততা নিরাময় হয়। এটা ব্যাবহারে প্যারালাইসিস অঙ্গের অনুভূতি ফিরে আসে।


তেঁতুলের সস উপাদেয় একটি খাবার। অতি সহজেই এটা তৈরি করা যায়।           

 
প্রস্তুত প্রণালি
১। তেঁতুল (বীজসহ) তার দ্বিগুণ পরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে চটকিয়ে পাল্প/ম- তৈরি করতে হবে। দ্রুত করার জন্য গরম পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।
২। পাল্প তৈরি হলে ছাকনি দিয়ে ছেকে বীজ থেকে পাল্প আলাদা করতে হবে।
৩। তেঁতুলের পাল্প এর সাথে চিনি ও লবণ মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। এর সাথে মরিচ গুঁড়া মিশাতে হবে।
৪। মসলাগুলো ভেজে গুঁড়া করে নিয়ে পেঁয়াজ ঐ রসুন কুঁচি করে মসলার সাথে একত্রে পাতলা করে কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে মিশ্রণে ছেড়ে দিতে হবে।
৫। জ্বাল চলাকালীন ঘন ঘন নাড়তে হবে এবং হাতা দিয়ে মাঝে মাঝে চেপে পুটলির রস সসের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
৬। ২০-২৫ মিনিট জ্বাল হলে এবং কাক্সিক্ষত ঘনত্বে এলে (টিএসএস ৪৫০ ব্রিক্রা হলে) সামান্য পানিতে সোডিয়াম বেনজয়েট গুলিয়ে সসের সাথে মিশাতে হবে।
৭। জীবাণুমুক্ত বোতলে সস গরম অবস্থাতেই ঢেলে ফেলতে হবে। ছিপি ভালভাবে বন্ধ করার পর বোতলটি কাত করে রাখতে হবে। পরে কাপড় দিয়ে মুখে বোতলগুলো সোজা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

 

কুলের চাটনি :
কুল বাংলাদেশের একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ফল। এর ফল এবং পাতা বাটা বাতের জন্য উপকারী। কুল রক্ত শোধন, রক্ত পরিষ্কার ও হজমে সাহায্য করে। কুল থেকে উৎকৃষ্ট মানের চাটনি তৈরি করা যায়।

 

প্রস্তুত প্রণালি
১। ভালো কুল বেছে নিয়ে বোঁটা ছাড়িয়ে পানিতে ধুয়ে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
২। প্রয়োজনমতো নরম না হলে ভিজিয়ে রাখা পানি থেকে অল্প পরিমাণ পানি দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে।
৩। ঠাণ্ডা হলে কাঠের হাতল/হাত দিয়ে কচলিয়ে ম- করতে হবে।
৪। সকল মসলা ভেজে গুঁড়া করতে হবে।
৫। চিনি ও মন্ড এক সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে।
৬। কিছুটা ঘন হলে (টিএসএস ৫৫০ ব্রিক্রা) সকল মসলা ও লবণ মিশিয়ে দিতে হবে।
৭। আরও ঘন (টিএসএস ৫৮০ ব্রিক্রা) হলে অ্যাসিটিক এসিড যোগ করতে হবে।
৮। অন্য একটি পাত্রে সরিষার তেল গরম করে চাটনিতে মিশাতে হবে।
৯। পুরোপুরি ঘন (টিএসএস ৬০০ ব্রিক্রা) হলে সামান্য পানিতে সোডিয়াম বেনজয়েট গুলিয়ে চাটনিতে মিশাতে হবে।
১০। জীবাণুমুক্ত বোতলে ভরে ঠা-া হলে উপরে মোমের প্রলেপ দিয়ে ছিপি এঁটে সংরক্ষণ করতে হবে। (উপকরণ ও পরিমাণ ছক-১ দেখানো হয়েছে)

 

চালতার চাটনি:  চালতার চাটনি সবার কাছেই খুবই মুখরোচক ও স্বুস্বাদু খাবার। শিশু, কিশোর এবং মহিলাদের কাছে এর চাহিদা অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় চালতা বুনো গাছ হিসেবে জন্মে থাকে। চালতাতে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। কচি ফল পেটের গ্যাস, কফ, বাত ও পিত্ত নাশক। পাকা ফলের রস চিনিসহ পান করলে সর্দিজ্বর উপশম হয়। চালতা চাটনি তৈরির মাধ্যমে নিজের চাহিদা মিটিয়েও বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।     
প্রস্তুত প্রণালি
১। পরিপক্ব চালতা নিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
২। আঙ্গুলের মতো টুকরা করে নিতে হবে।
৩। গর্ভাশয়, বীজ এবং অন্যান্য বর্জ্য ফেলে দিতে হবে।
৪। টুকরোগুলো ধুয়ে কড়াইতে সমপরিমাণ পানি দিয়ে জ্বাল দিতে হবে।
৫। চালতা ঠাণ্ডা করে হাত দিয়ে কচলিয়ে গলিয়ে নিতে হবে।
৬। অধিকাংশ আঁশ (৮০% এর বেশি) ফেলে দিতে হবে।
৭। মসলাগুলো আলাদাভাবে ভেজে নিয়ে গুঁড়া করে চালতার পরিমাণ অনুযায়ী মেপে নিতে হবে।
৮। কচলানো চালতার পাল্পের সাথে পরিমাণমতো চিনি মিশিয়ে রান্না করতে হবে এবং ঘন ঘন নাড়তে হবে।
৯। যখন পাল্প ঘন হয়ে (টিএসএস ৫৬০ ব্রিক্রা) আসে তখন লবণ এবং গুঁড়া করা মসলা দিয়ে নাড়তে হবে।
১০। তারপর অ্যাসিটিক এসিড যোগ করতে হবে।
১১। যখন জ্বাল দেয়া পাল্প ঘন হয়ে (টি এস এস ৬২০ ব্রিক্রা) আসে তখন সামান্য পানির সাথে গুলিয়ে প্রিজারভেটিভ হিসেবে সোডিয়াম বেনজয়েট মিশিয়ে এবং ১-২ মিনিট পর জ্বাল বন্ধ করতে হবে।
১২। জীবাণুমুক্ত বোতলে ভরে ছিপি হালকাভাবে লাগিয়ে রাখতে হবে।
১৩। পরের দিন চাটনির উপর মোমের প্রলেপ দিয়ে ছিপি শক্তভাবে লাগিয়ে শুষ্ক ও ঠা-া জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। (উপকরণ ও পরিমাণ ছক-২ দেখানো হয়েছে)
আনারসের জেলি : আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি এবং সি থাকে। উৎপাদন মৌসুমে অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হওয়ায় এবং পচনশীল বিধায় এর মূল্য কমে যায় এবং প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হয়। কিন্তু যদি আনারস প্রক্রিয়াজাত করা যায় তাহলে এর সংরক্ষণ কাল বেড়ে যায় বহুগুণে। যেমন আনারস থেকে উন্নতমানের জেলি তৈরি করা যায়। জেলি খুবই সুস্বাদু ও দেখতে আকর্ষণীয়।

 

প্রস্তুত প্রণালি
১। পাকা আনারস ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
২। খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করতে হবে।
৩। টুকরোগুলো হাত দিয়ে চাপ দিয়ে পাল্প আলাদা করে নিতে হবে।
৪। পরিমাণ অনুযায়ী সকল উপকরণ নিতে হবে।
৫। পেকটিনের দ্বিগুণ পরিমাণ চিনি মেপে নিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে।
৬। একটি সসপ্যানে পাল্প ও চিনি একত্রে মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে।
৭। কিছু ঘন হয়ে আসলে (টিএসএস ৫৫০ ব্রিক্রা) পেকটিন অবশিষ্ট চিনির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে পাত্রে যোগ করে ভালোভাবে নাড়তে হবে।
৮। আরো ঘন হলে (টিএসএস ৫৮০ ব্রিক্রা) সাইট্রিক এসিড যোগ করতে হবে।
৯। জেলি তৈরি হয়ে আসলে (টিএসএস ৬৫০ ব্রিক্রা) সামান্য পরিমাণ পানির সাথে সোডিয়াম বেনজয়েট গুলিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
১০। জীবাণুমুক্ত বোতলে গরম অবস্থাতেই ঢালতে হবে। ঠাণ্ডাহয়ে আসলে উপরে মোমের প্রলেপ দিয়ে ছিপি এঁটে সংরক্ষণ করতে হবে। (উপকরণ ও পরিমাণ ছক-৩ দেখানো হয়েছে)

 

ড. বাবুল চন্দ্র সরকার১ ড. মদন গোপাল সাহা২ ড. মো: আতিকুর রহমান৩  

১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৭১৬০০৯৩১৯ ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৫৫২৪৫০১৬২ ৩ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৭৪৩১৩৪৫৮৪, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর

বিস্তারিত
দেশে তাল চাষ সম্প্রসারণ প্রযুক্তি

তাল বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত একটি ফল। একক লম্বা কা- তার আগায় সুন্দরভাবে একক গুচ্ছ পাতার সমারোহে সুশোভিত পরিবেশকে সুন্দর করে। দূর থেকে তাকালে পাহাড়ের উপরে ভাসছে যেন দ্বীপনালা, নারিকেল, খেজুর, তাল একই পামী পরিবারভুক্ত। এ ধরনের উদ্ভিদ এক দল বীজ পত্র দলীয় এবং এগাছের শিকড় গুচ্ছমূল বিশিষ্ট। তাল গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছে না। তবে এর হাজার হাজার শিকড় মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। যতো ঝড়-ঝাপ্টা, সাইক্লোন আসুক না কেনো গাছকে ক্ষয় করতে পরে না। অথচ এটি ৭০ থেকে ৯০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের আগায় ৩৫ থেকে ৫৫টি করে পাতা থাকে। পাতার আগা সুচের মতো ধারালো বিধায় এটি বজ্রপাতরোধক গাছ হিসাবে অতিপরিচিত। গাছপালা প্রাণিসম্পদকে রক্ষা করার জন্য তাল চাষকে অনেক দেশেই প্রাধান্য দেয়া হয়। একই গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৬ থেকে ২০১৭ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১০ লাখ তালের চারা রোপণ করেছে। ২০১৭ সালে ডিএই ২ লাখ তাল বীজের চারা রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে।


পুষ্টি : তাল অতি পুষ্টিকর ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ ফল। সব ধরনের ফলে দেহের জন্য উপযোগী বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ হলেও তালে এর বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। অন্য সকল ফলের তুলনায় এ ফলে ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালোরি বেশি। আখের গুড়ের চেয়ে তালের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেলস বেশি থাকে।


ঔষধি গুণাগুণ : তালের রস আমাশয় নিরাময়, মূত্র প্রবাহ বৃদ্ধিকারক এবং পেটের পীড়া/প্রদাহ, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে সহায়ক। এ ফলের রস সেবনে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে, ক্লান্তি দূর করে, দেহে শক্তি যোগায় এবং অনিদ্রা দূর করে। তালের রস থেকে মিছরি তৈরি করা হয়, যা শিশুদের সর্দি-কাশি ভালো করে। শিশু ও বয়স্কদের মহৌষধ হিসাবে কাজ করে। যকৃতের পীড়া ও পিত্ত পাথর ক্ষয়রোধ করে নিয়ন্ত্রণ করে।


উপকারিতা : কাঁচা পাকা তাল প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য জনজীবনে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটা তাল গাছ কমপক্ষে ৬০-৭০ বছর বেঁচে থাকে। গাছ পরিপক্বতা পেলে কাঠের ব্যবহারও এ থেকে  হয়ে থাকে। বাঁশ কাঠের বিপরীতে দরিদ্র পরিবারগুলো তালের গাছের পাতা ও কা-কে ঘরবাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করতে পারে। বন্যা ও বর্ষার সময় ডিঙি নৌকা বানিয়ে পথ পারাপার হয়। জ্বালানি হিসাবে ১ নম্বর লাকড়ি ধরে গ্রামগঞ্জে বেশি ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন কালে যখন কাগজের ব্যবহার ছিল না তখন তালের পাতাকে কাগজ হিসাবে ব্যবহার করে লেখাপড়া শিখতো মানুষ। তালের পাতা দিয়ে হাত পাখা তৈরি করলে তা ৩ বছর স্থায়ীভাবে ব্যবহার করা যায়। মহিলারা নকশার কাজে তাল পাতা ব্যবহার করে। তালের ফুল ও কচি ফল থেকে যে রস পাওয়া যায় তা অত্যন্ত সুস্বাদু পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তালের রস থেকে গুড় তৈরি করা হয়। এই গুড়ের চাহিদা বাজারে ব্যাপক। পুরুষ স্ত্রী উভয় প্রকার গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। এই রস গাছিরা ৪০ থেকে ৮০ টাকা লিটার বিক্রি করে থাকেন। তালের রস শীতকালে একমাত্র পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মৌসুমে একটা তাল গাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লিটার রস পাওয়া যায়। তালের রস আহার্য অংশ অতি সুস্বাদু। কচি তাল বাজারের অলিগলিতে ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয়। তালের ঘন রস অর্থাৎ পাকা তালের রস হরেক রকম পিঠা, পায়েশ, হালুয়ার কাজে এবং বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তালের বীজ মাটিতে ফেলে রাখলে ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে শাঁস তৈরি হয়। এই শাঁস সকল মানুষের প্রিয় খাদ্য। বৃহত্তর ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, শেরপুর, জামালপুর সব জেলাতেই এর উৎপাদন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এবার বজ্রপাতে ২৬০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। সব অঞ্চলে তালের গাছ থাকলে বজ্রপাত ও মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হতো। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাল চাষের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাল গাছ সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। অনুর্বর মাটি হলেও চাষ করা যায়।
 

জাত : দেশ-বিদেশে তালের কোনো সুর্নিদিষ্ট জাত কম দেখা যায়। তালের বড় আকারের ফল হলে তাকে হালকা বাদামি তাল বলা হয়। এছাড়া বারমাসি তাল রয়েছে।
 

বংশ বিস্তার : আগস্ট মাসে অর্থাৎ বাংলা ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তালের ভরা মৌসুম। এই মৌসুমে পাকা তাল খেয়ে তার বীজ ১০ ফুট লম্বা ৩ ফুট চওড়া বীজতলায় ১০০০ হাজার তালের বীজ বসানো যায়। চারাগুলো সরিয়ে আলাদাভাবে ১০-১২ ফুট অন্তর অন্তর রোপণ করলে বংশ বিস্তার বৃদ্ধি পায়।
 

বীজ চারা রোপণ : রাস্তা, বাঁধ, রেললাইনের পাশে, মাছের খামারের পাড়ে, স্কুল, কলেজ মাদরাসা, গোরস্থান, শশান, ঈদগা ময়দান, কমিউনিটি মাঠে, অফিসের পতিত জায়গায় সরাসরি তালের চারা রোপণ করা যায়। সামান্য পরিমাণ সার দিয়ে চারা রোপণ করলে তা বংশ বিস্তারে শক্তিদায়ক হয়ে উঠে এবং তাড়াতাড়ি বড় হয়। আগে বাপ-দাদার আমলে শুনতাম যে তাল গাছ রোপণ করে সে খেতে পারে না। এটা সত্য নয় ২০-২৫ বছর পরই তালের ফল পাওয়া যায়। পদ্ধতিগতভাবে আবাদ করলে ৮-১০ বছরে ফল পাওয়া যায়।


পোকামাকড় রোগ বালাই: পোকামাকড় রোগ বালাই তালের গাছে আক্রমণ করতে পারে না। কারণ তার পাতার প্রান্তগুলো সূঁচের মতো ধারালো। নরম জাতীয় পোকা বসলে তারা শরীরে ব্যথা পায়। এজন্য আক্রমণ করার আগেই ভয়ে তারা দূরে থাকে।
 

ফল সংগ্রহ : এখন জুন-জুলাই মাস কচি তাল পাওয়ার উপযুক্ত সময়। প্রতিটা গাছেই ২০০-৩০০ কাঁচা পাকা তাল ধরে। এই তাল বাজারে বিক্রি করেও প্রতিটি গাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকার তাল বিক্রি করা যায়। সমগোত্রীয় একটি নারকেল ও সুপারি গাছ থেকে মাত্র হাজার টাকার ফল আসে। সেই হিসাবে  ৫টি নারকেল গাছ, ৫টি সুপারি গাছ রোপণ করার চেয়ে ১টি তাল গাছ রোপণ করা অনেকাংশে ভালো। একটা পাকা তাল ৬০-৭০ টাকা বিক্রি করা যায়। প্রতি গাছ থেকে ১ হাজার লিটার রস সংগ্রহ করা যায়। আপনি একাধারে তাল গাছ রোপণ করুন। কারণ সেখানে স্ত্রী পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। পুরুষ তাল গাছ থেকেও সমপরিমাণ রস পাওয়া যায়। তাল গাছের কাঠ আসবাবপত্র  চেয়ারের পায়া, চৌকির পায়া, দোকানের রেলিং ও ঘরবাড়ি নির্মাণে ব্যবহার হয়। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই বাবুই পাখির বাসা। তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। তাই পাখিরা নিরাপদ মনে করে সেখানে বাসা বাঁধে। ঘর নির্মাণ করলে তাল গাছের কাঠ শত বছর স্থায়ী হয়।

 

ইউসুফ আলী মণ্ডল

সাংবাদিক, নকলা, শেরপুর ০১৮১৪৮৪১৭৩৮

 

বিস্তারিত
সোনালি আঁশের সোনালি ব্যাগ : পাটের নতুন দিগন্ত

পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয় এটি পরিবেশে রাখে বিরাট অবদান এবং দেশের কৃষি ও বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে। মাটির গুণাগুণ ও জলবায়ুগত কারণে অন্যান্য  দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভালো। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট ও পাটজাতীয় ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে পালিত হওয়ায় এবং উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিমতন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন।


বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ একশ বছরেও পচবে না ও মাটির সঙ্গে মিশবে না, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০০২ সালে দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। দামে সস্তা ও অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় নানা সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বর্জ্য পদার্থ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান শহরগুলোতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। কেননা শহরের নর্দমা ও বর্জ্য নির্গমনের পথগুলো পলিথিন দ্বারা পূর্ণ। পলিথিনের কারণে পানি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। ব্যবহৃত পলিথিন গলিয়ে আবার ব্যবহার করায় এতে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কাজী মুহাম্মদ শীশ এর তথ্য মতে শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতিমাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক আঁশের তৈরি ব্যাগের প্রয়োজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে।


গঠনগত দিক থেকে পাট জটিল পলিমারের সমন্বয়ে গঠিত যাতে প্রধানত সেলুলোজ ৭৫ ভাগ, হেমিসেলুলোজ ১৫ ভাগ এবং লিগনিন ১২ ভাগ রয়েছে। এছাড়া স্বল্প পরিমাণে ফ্যাট, মোম, নাইট্টোজেনাস ম্যাটার, বিটাক্যারোটিন ও জ্যানথোফেলাস থাকায় পাটপণ্য পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশনের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ড. মুবারক আহমদ খান। সম্পূর্ণরূপে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব এ ব্যাগ পানিতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে তারপর ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে, ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যাল এতে ব্যবহার না করায় পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না, সৃষ্টি করবে না জলাবদ্ধতা। দেখতে বাজারের সাধারণ পলিথিন ব্যাগের মতো হলেও পলিইথিলিন ব্যাগের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ টেকসই ও মজবুত পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ। প্যাকেজিং মেটেরিয়াল বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মোড়ক হিসেবে এবং খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণেও এ ব্যাগ ব্যবহার করা যায়। গত বছর ১২ মে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পাটের সোনালি ব্যাগ তৈরির পাইলট প্লান্ট উদ্বোধনের পর সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণে তৈরি হচ্ছে এ ব্যাগ। কিন্তু এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকেও এ ব্যাগের ব্যাপক চাহিদা পাওয়া গিয়াছে। প্রতিদিন ১০ টন সোনালি ব্যাগের চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে এ মিল থেকে উৎপাদিত হচ্ছে তিন হাজার পিস। পাটকলে ফেলে দেয়া পাটের আঁশ থেকে প্রথমে সূক্ষ্ম সেলুলোজ আহরণ (এক্সট্রাকশন) করে আলাদা করে নেয়া হয়। পানিতে অদ্রবণীয় এই সেলুলোজকে পরে রাসয়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) করা হয়। দ্রবণীয় সেলুলোজের সাথে ক্রসলিঙ্কার মেশানো হয়। বিশেষ তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবণটি ড্রায়ার মেশিনের ভেতরে পরিচালিত হয়। তাতে তা শুকিয়ে প্লাস্টিকের শিটের আকারে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে। পরে শিট কেটে চাহিদামতো পলিব্যাগের আকার দেয়া হয়। এক কেজি পাট দিয়ে এক কেজি পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদিত ব্যাগে ৫০ শতাংশের বেশি সেলুলোজ বিদ্যমান। পানি নিরোধক এই পলিব্যাগের প্রতি কেজির দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে এ ব্যাগ বাজারজাত করা হলে এর দাম আরও কমবে।


পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাবে। আড়ং, স্বপ্ন, আগোরাসহ দেশীয় চেইনশপগুলো এই সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদা পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ শহরকে পলিথিনমুক্ত রাখতে এই ব্যাগ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং দুবাইয়ে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মাসে ২৫ হাজার পলিব্যাগ কেনার ফরমাশ দিয়েছে। বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে হবে। সোনালি ব্যাগ দামে সাশ্রয়ী হলে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, তার পুরোটা এ খাতে বিনিয়োগ করলে তা বিশ্ব চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ পূরণ করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণভাবে পাট আঁশের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পাটের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি পতিত জমিও পাট চাষের আওতায় এনে পাট খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব হবে, আমরা পারব উন্নতির সোপান পাড়ি দিয়ে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে।


পাটনীতি প্রণয়ন, পাটকল করপোরেশন সংস্কার এবং পণ্যের ব্যবহার পলিথিনের ওপর ইকোট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ প্রণীত হয়েছে। সরকারি/বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরির কাঁচামাল জোগান দিতে পদ্মার ওপারে ২০০ একর জমির ওপর দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাট পল্লী প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দৈনিক ২৫ হাজার পিস সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন। ফলে বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের ভবিষ্যৎ। উন্মোচিত হতে পারে পাট নিয়ে নতুন শিল্প সম্ভাবনার দুয়ার। আর এ পাটের হাত ধরেই চিরতরে বিদায় নিতে পারে পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন।


বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারাবিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলত পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। এদেশের মান্ধাতার আমলের পাটকলগুলোকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে। সেজন্য সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাটের মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাট একটি শিল্পজাত পণ্য হওয়ায় এর উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্পে ব্যবহার, পণ্য উৎপাদন, বিপণন, রপ্তানি ইত্যাদি কার্যক্রমে বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/মন্ত্রণালয় জড়িত। সুতরাং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সোনালি ব্যাগের কাঁচামাল পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে অন্তঃ ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় অপরিহার্য।


দেশের পাট শিল্প ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে পাটের পলিথিন উৎপাদন করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রতি বছর যে বিশাল অঙ্কের টাকা জলাবদ্ধতা নিরসন ও পয়ঃনিষ্কাশনে ব্যয় করে তার অর্ধেক টাকা দিয়ে সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের প্রকল্প নিলে সারাজীবনের জন্য এ সঙ্কটের হাত থেকে বেঁচে যাবে নগরবাসী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পরিবাশবান্ধব, পচনশীল ও সহজলভ্য সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার বিদেশ থেকে মেশিনারিজ ক্রয়ের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি এ ব্যাগ একদিকে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে প্রতি বছর পলিথিন ও এর কাঁচামাল আমদানি করতে যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হতো তা সাশ্রয় হবে। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগিয়ে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে আগামীতে ব্যবহারিক ও পরিবেশ রক্ষায় বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে সোনালি আঁশ পাট ডায়মন্ড তন্তু হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হবে।

 

কৃষিবিদ মোঃ আল-মামুন

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা; মোবাইল : ০১৭১১১৮৬০৫১ ই-মেইল : almamunbjri@gmail.com

 

 

বিস্তারিত
বীজ : ভালো বীজের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য

বীজ কি : কৃষির মূল উপকরণ হচ্ছে বীজ। বীজ উদ্ভিদ জগতের ধারক ও বাহক। বীজই ফসল উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সাধারণত আমাদের দেশের চাষিরা নিজ নিজ ফসলের অপেক্ষাকৃত ভালো অংশ পরবর্তী ফসলের বীজ হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু একই বীজ থেকে বার বার চাষ করলে ফসলের ফলন অনেক হ্রাস পায়। তাই প্রায় ২-৩ বছর পর পর বীজ পরিবর্তন (Seed replacement) খুবই জরুরি।  


বীজের সংজ্ঞা : বীজ বলতে আসলে অনেক কিছুই বোঝায়। ফসলের যে কোনো অংশ, দানা অথবা অঙ্গ যেটি অনুরূপ একটি ফসল পুনঃ উৎপাদনে সক্ষম তাকেই বীজ বলে অভিহিত করা যায়। বীজ উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বৈশিষ্টাবলি এবং কৃষি কাজের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার অনুসারে বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, উদ্ভিদতত্ত্বানুসারে ফুলের পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত হবার পর পরিপক্ব ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন : ধান, গম, পেঁপে বীজ। দ্বিতীয়ত, কৃষিতত্ত্বানুসারে গাছের যে অংশ বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয় তাকেই বীজ বলে। যেমন- আলুর টিউবার, মিষ্টিআলুর লতা, কলার সাকার, কুলের  কুঁড়ি, পাথরকুচির পাতা, বিভিন্ন ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি।


বীজ বিধিমালা ভিত্তিক শ্রেণি বিভাগ : বাংলাদেশের বীজ বিধিমালা ১৯৯৮ (The Seed Rules,1998) মোতাবেক বীজের ৪ (চার) টি শ্রেণি বিভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-প্রজননবিদের বীজ (Breeder Seed) : গবেষণাগারে বীজ প্রজননবিদের (Breeder) এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত জাতের বীজের মূল বীজ (Nucleus Seeds) গবেষণা কেন্দ্রের বীজ ব্যাংক (Germplasm Bank) থেকে সংগ্রহপূর্বক পরিবর্ধন করে এই বীজ উৎপাদন করা হয়। এই বীজ খুবই অল্প পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং তা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। এই বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা যায়।


ভিত্তি বীজ (Foundation Seed) : প্রজননবিদের বীজের পরবর্তী স্তর ভিত্তি বীজ যা বীজ প্রযুক্তিবিদদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশে মূলত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশন তাদের নির্ধারিত খামারে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে। তবে গত কয়েক বছর ধরে কিছু বেসরকারি বীজ কোম্পানি এবং সংস্থাকে সরকারি বিধি বিধান পালন সাপেক্ষে ভিত্তি বীজ উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তারাও গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রজননবিদের বীজ সংগ্রহ করে বীজতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করছেন। ভিত্তি বীজ জাতীয় বীজ অনুমোদন সংস্থা কর্তৃক অবশ্যই প্রত্যয়িত হয়ে থাকে।


প্রত্যয়িত বীজ (Certified Seed) : ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। বিএডিসির নিজস্ব খামার সমূহে এবং কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোন সমূহে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদিত হয়। জাতীয় বীজ নীতি অনুযায়ী প্রত্যয়িত বীজ সরকারি বীজ অনুমোদন সংস্থা কর্তৃক প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক নয়। তবে বেসরকারি খাতের বীজ ব্যবসায়ীগণ বীজের মান নিয়ন্ত্রণকল্পে বীজ অনুমোদন সংস্থার মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত বীজ পরীক্ষা করিয়ে প্রত্যয়ন পত্র নিতে পারেন।  


মান ঘোষিত বীজ (Truthfully Labelled Seed) : ভিত্তি বীজ বা প্রত্যয়িত বীজ থেকে মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন করা হয়। বিএডিসি কৃষক পর্যায়ে  বিপণনের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বীজ উৎপাদন করে তা এই শ্রেণির। বেসরকারি খাতের ছোট বড় কোম্পানিগুলো আজকাল মানঘোষিত বীজ উৎপাদন করে বিপণন করে থাকে। এসব বীজ উৎপাদনে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। তবে বীজের গুণগত মান নিশ্চিত কল্পে এবং কৃষদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের যে কোনো পর্যায়ে বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির পরিদর্শকগণ বীজ পরীক্ষা করতে পারেন। নির্ধারিত মান লঙ্ঘিত হলে সরকারি আইন অনুযায়ী জরিমানা ও শাস্তির বিধান রয়েছে।  


উন্নত মানের বীজের বৈশিষ্ট্য : আমাদের দেশের বীজ শিল্পের বহুল প্রচলিত স্লোগান হচ্ছে, ‘ভালো বীজ ভালো ফসল’। ভালো বীজ মানে উন্নতমানের বীজ। মান সম্পন্ন বীজ বিভিন্ন শ্রেণির  হতে পারে যেমন- মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ, উন্নত মানের বীজ, হাইব্রিড বীজ ইত্যাদি।


মান সম্পন্ন বীজ :  মান  সম্পন্ন বীজের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নরূপ
বিশুদ্ধ বীজ (কম পক্ষে ৯৪% বিশুদ্ধতা)।
উজ্জ্বল, সুন্দর, সতেজ, স্বাভাবিক রঙ এর বীজ।
পুষ্ট, বড় দানা সম্পন্ন বীজ।
পোকা ও রোগ মুক্ত বীজ।
বীজের আর্দ্রতা সর্বোচ্চ ১২% (ধান, গম) অন্যান্য ফসল ১০%।
গজানোর ক্ষমতা ৭০-৮৫% এর উপরে।
উন্নতমানের বীজের বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নরূপ : মান সম্পন্ন ও উন্নতমানের বীজের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো ঃ -
বাহ্যিক চেহারা হবে উজ্জ্বল,  সুন্দর, আকার, আয়তন ও জৌলুস ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।  
বীজে কোন নিষ্ক্রিয় পদার্থ
(Inert Material) বালি, পাথর, ছোট মাটি, ভাঙ্গা বীজ, বীজের খোসা ইত্যাদি থাকবে না।  
বীজে হতে হবে বিশুদ্ধ
(Pure Seed)
বীজের ক্ষতিকর আগাছার বীজ
(Obnoxious weed seed) থাকবে না।  
বীজ হতে হবে পুষ্ট। আকার, আয়তন, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ওজন, জাত অনুযায়ী নির্দিষ্ট থাকতে হবে।  
বীজের আর্দ্রতা নির্ধারিত মাত্রায় থাকতে হবে। (ধান, গম, ভুট্টার বেলায় ১২%, ডালজাতীয় শস্যের বেলায় ৯%, পাট ৯%, সরিষা ৮%, সূর্যমুখী ৯% , ফুলকপি ৭%)।
বীজ ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত ও নীরোগ হতে হবে।  
প্রয়োজনে বীজের সুপ্তাবস্থা
(Seed Dormancy) কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য কৃষকদের নিকট অবশ্যই সুপ্তাবস্থা কাটানো বীজ যা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা যায় তা সরবরাহ করতে হবে।
সর্বোপরি বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নির্ধারিত মানের হতে হবে। (সর্বনিম্ন ধান ৮০%, গম ৮৫%, ডালশস্যা ৭৫-৮৫%, শাক-সজবি ৭০-৭৫%।)

বীজ ও খাদ্যশস্য :  আমরা বীজ, ভালো বীজ, মান সম্পন্ন বীজের বৈশিষ্ট্য, বীজের শ্রেণি বিভাগ ইত্যাদি সম্পর্কে জানলাম। এবার বীজ ও খাদ্যশস্যের দশটি মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করব।  
 

বীজ খাদ্য শস্য : বীজ জীবিত। পরিমিত আলো, বাতাস, পানি পেলে অনুভূতি প্রবণ হয়। খাদ্যশস্য জীবিত অথবা মৃত উভয়ই হতে পারে। অনুকূল পরিবেশে অনুভূতি প্রবণ নাও হতে পারে।     
পাট বীজ ছাড়া বেশির ভাগ বীজ খাদ্যশস্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। খাদ্যশস্য বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।    
বীজের মধ্যে সক্রিয় জীবনী শক্তি থাকা প্রয়োজন। খাদ্যশস্যের জীবনী শক্তি নাও থাকতে পারে। বীজ থেকে সুস্থ ও সবল চারার  জন্ম হবে। খাদ্যশস্য থেকে দুর্বল চারা জন্মানোর আশঙ্কাই বেশি- চারা নাও জন্মাতে পারে।
বীজ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। খাদ্যশস্য গড় উচ্চতায় বা স্বাভাবিক তাপমাত্রা সংরক্ষণ করা হয়। তাপমাত্রা পরিবর্তনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় না।    
বীজ গুদাম জাতকরণে সঠিক আর্দ্রতা প্রয়োজন। সংরক্ষণে আর্দ্রতা জরুরি নয়।    


বীজ সংরক্ষণে আপেক্ষিক আর্দ্রতা (Relative Humdity) খুবই গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক আর্দ্রতার বৃদ্ধিতে রোগ পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে।      
বীজ নির্দিষ্ট সময় কাল অবধি সংরক্ষণ করা যায়। শুষ্ক পরিবেশে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায।    
যে কোনো পরিবেশে বীজ উৎপাদন করা যায় না। ক্ষেত্র বিশেষে অঞ্চলের আবহাওয়া অনুযায়ী খাদ্য শস্য উৎপাদন করা যায়।    
বীজ উৎপাদনের জন্য কৃষি বা বীজ প্রযুক্তিবিদদের তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। কৃষক সমাজই খাদ্য শস্য উৎপাদনে সক্ষম।     

বীজের মান হ্রাস : ভালো ও বিশ্বস্ত বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে মান সম্পন্ন ভালো বীজ ক্রয় করে চাষাবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু ওই বীজ দিয়ে ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর চাষের ফলে নির্দিষ্ট সময় অবধি ভালো ফলন দেয়ার পর আর আশানুরূপ ভালো ফলন পাওয়া যায় না, বরং ধীরে ধীরে ফলন কমে যায়। আমাদের দেশের  পরিবেশে একই বীজ দুই/ তিন বছর ভালো ফলন দেয়। এরপর নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু, সুর্যালোকের স্থায়িত্ব, তাপমাত্রা, পরিচর্যা ও পোকামাকড় প্রতিকূল আবহাওয়া ফসলের ফলন ও গুণগত মানে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ধারাবাহিক চাষে বাজার মান হ্রাস পাওয়ার বীজ পরিবর্তনের (Seed Replacement) প্রয়োজন হয়। তাই ২/৩ বছর পর পর বীজ পরিবর্তন তথা নতুন বীজ ক্রয় করাই উত্তম।

 

মাহমুদ হোসেন

মহাব্যবস্থাপক (অব.) বিএডিসি, ঢাকা; মোবাইল : ০১৮৩৭৩৫৩৯৭০

 

বিস্তারিত
পুষ্টি চাহিদা পূরণে দেশি ফলের গুরুত্ব (ভাদ্র ১৪২৫)

ফলদবৃক্ষ রোপণ পক্ষ ২০১৮ উপলক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক আয়োজিত
রচনা প্রতিযোতগিতায় ‘ক’ গ্রুপের প্রথমস্থান অধিকারী

অবন্তী নাথ তিথী
ভূমিকা : ‘আমাদের দেশ
একটি সোনার ছবি
যে দেশের কথা
কবিতা ও গানে
লিখেছেন অনেক কবি ॥’
প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই বাংলাদেশ। বিচিত্র রূপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। পাহাড়, নদী, ফুল, ফল, সমতলভূমি, সবুজ অরণ্য সবকিছু মিলিয়ে সত্যিই আশ্চর্য সুন্দর আমাদের এ বাংলার প্রকৃতি। ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানা সাজে। এদেশে বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফলের সমাবেশ ঘটে, যেগুলো দেশীয় ফল নামে পরিচিত। এগুলো কোনোটি মিষ্টি, কোনোটি টক আবার কোনোটি অপূর্ব স্বাদযুক্ত। চির সবুজ দেশ হিসেবে সারাবিশে^ পরিচিত আমাদের বাংলাদেশ। যেসব প্রাকৃতিক উপাদান এ দেশকে সৌন্দর্যম-িত করেছে তার মধ্যে দেশীয় ফল অন্যতম। প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজের সমারোহে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যোগ করেছে বাংলাদেশের বিচিত্র সব ফল। ফল সবারই প্রিয় খাদ্য। ফল আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে নানা রকমের ফল পাওয়া যায়। কখনো কম আর কখনো বেশি। যেমন- গ্রীষ্মকালে সব থেকে বেশি ফল পাওয়া যায়। এজন্যই গ্রীষ্মকে মধুমাস বলে। এই মধুমাস ছাড়াও অন্যান্য সময়ে যে ফল পাওয়া যায় তাতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণে ভরপুর। আমাদের দেশে পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমরা বলতে পারি যে,
    ‘অর্থ পুষ্টি স্বাস্থ্য চান
    দেশি ফলের গাছ লাগান।’
পুষ্টি কি? : জীব মাত্রই খাদ্য গ্রহণ করে, কারণ জীবের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। জীবের পুষ্টির জন্য বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োজন হয়। জীব তার বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টির জন্য কতগুলো উপাদান যেমন- ভাত, মাছ, ডাল, শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ইত্যাদি গ্রহণ করে। এ উপাদানগুলোর অভাবে জীব সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারেনা। এ উপাদান গুলোকে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান বলে। জীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিগুণে ভরপুর খাদ্যের একান্ত প্রয়োজন।
পুষ্টি উপাদানের উৎস : জীবনধারণের জন্য খাদ্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য প্রয়োজন। এই খাদ্যই জীবকোষে জারিত হয়ে দেহে তাপ এবং শক্তি তৈরি করে। জীব এর পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে দেশীয় ফল বিরাট ভূমিকা পালন করে। নানা ধরনের ফলগুলো পুষ্টি উপাদানের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অধিকাংশ ফল একাধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
    ‘রোপণ করলে ফলের চারা
    আসবে সুখের জীবন ধারা’।
দেশি ফলের প্রকারভেদ : বাংলাদেশে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের ফল দেখা যায়। ফল দুই রকম। যেমন- সরস ফল ও নীরস ফল।
সরস ফল : আম, জাম, কমলালেবু, লিচু, ডালিম ইত্যাদি। নীরস ফল : বাদাম, সুপারি, নারিকেল ইত্যাদি।
দেশি ফলের নাম : আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, শরিফা, চালতা, সাতকরা, ডুমুর, করমচা, লটকন, বেল, কদবেল, গাব, তেঁতুল, তাল, ডালিম, অড়বরই, আঁশফল, জলপাই, খেঁজুর, জামরুল, কাউফল, আমলকী, তৈকর, পানিফল, ফলসা, বাঙ্গি, তরমুজ, বিলিম্বি, কমলা, শানতোল, জাবটিকাবা, স্ট্রবেরি, প্যাসন ফল, অ্যাভোকেডো, ড্রাগন ফল, রুটিফল, তেঁতুল, নাশপাতি, মাল্টা, বেতফল, তুঁতফল, লুকলুকি ইত্যাদি।
দেশি ফলের পুষ্টিগুণসহ বিবরণ : প্রত্যেকটি জীবের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন। পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ দেশিফল গুলো বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। যা জীব দেহের পুষ্টিসাধন, দেহের ক্ষয়পূরণ, দেহের রোগ প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদন এবং কর্মশক্তি ও তাপ উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা রাখে। নিচে বিভিন্ন ধরনের দেশি ফলের পুষ্টিগুণসহ বিবরণ দেয়া হলো :
কাঁঠাল : আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। কাঁঠাল একটি জনপ্রিয় ফল। আমাদের দেশের প্রায় সর্বত্র এটি পাওয়া যায়। এটি স্বাদে গন্ধে অনন্য। পুষ্টির দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি কাঁঠালের এমন কোনো অংশ নেই যা অপ্রয়োজনীয়। কাঁঠালে প্রচুর এনার্জি। কাঁঠালে শর্করার পরিমাণ বেশি। কাঁঠাল গ্রীষ্মকালের ফল। পাকা কাঁঠালের ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ কিলোক্যালরি এবং খনিজ লবণের পরিমাণ প্রায় ০.৯ গ্রাম। কাঁচা কাঁঠালের ফাইবারের পরিমাণ পাকা কাঁঠালের বেশ কয়েক গুণ বেশি। তাই ডায়বেটিক মানুষের জন্য কাঁচা কাঁঠাল উপকারী। রক্তের চিনির মাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য কাঁচা কাঁঠালের জুড়ি নেই। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে মাছ অথবা মাংসের মজাদার রেসিপি তৈরি করা হয় যা একদিকে যেমন মুখরোচক তেমনি অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর। কাঁঠাল পুষ্টি সমৃদ্ধ। এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী। কাঁঠালের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। এছাড়া উচ্চরক্তচাপের উপশম হয়। কাঁঠাল সর্বত্র পাওয়া যায় তবে আশুলিয়ায় বেশি উৎপন্ন হয়।
আম : ‘রাজা নাই, শাহ নাই, রাজশাহী নাম।
    হাতি- ঘোড়া কিছু নাই, আছে শুধু আম।’
সর্বত্র আম উৎপন্ন হয় তবে রাজশাহীতে বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আমের নানা ধরনের জাত আছে। যেমন- গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, মিয়ার চারা, লখনা, ফজলি, আশি^না, দুধসর, ফনিয়ার চারা, কাঁচামিঠা, জালিবান্ধা, কুয়া পাহাড়ি, কুমড়া জালি, মোহনভোগ, পাটনায় গোপালভোগ, রাণী প্রসাদী, ভাদ্রি, রাজভোগ, ল্যাংড়া। আয়রন ও সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণে বেশ কার্যকরী আম। আম রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ডায়বেটিসের সঙ্গে লড়াই করে। ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে উচ্চ পরিমাণ প্রোটিন যা জীবাণু থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়। আমে রয়েছে ভিটামিন এ, যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। চোখের চারপাশের শুষ্কভাবও দূর করে। পাকা আমে কাঁচা আমের তুলনায় শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। কাঁচা আম দেহের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। লিভারের সমস্যায় কাঁচা আম খাওয়া উপকারী। এটি বাইল এসিড নিঃসরণ বাড়ায়। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পরিষ্কার করে। দেহে নতুন রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। খনিজ পদার্থ আয়রনের ভালো উৎস আম। প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও সোডিয়াম বিদ্যমান। এছাড়া খনিজ লবণ, ভিটামিন বি, ই, সেলেনিয়াম, এনজাইম, ম্যালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, টারটারিক অ্যাসিড বিদ্যমান। এজন্যই আমকে বলা হয় ফলের রাজা। অর্থাৎ ঞযব শরহম ড়ভ গধহমড়বং. কেবল স্বাদে মিষ্টি বা ত্বককে ভালো রাখাই নয়। এর মধ্যে রয়েছে এমন অনেক পুষ্টিগুণ যা শরীরকে ভালো রাখে।
পেঁপে : পেঁপের অনেক পুষ্টিগুণ। কাঁচা ও পাকা দুই ধরনের পেঁপেই শরীরের জন্য উপকারী। কাঁচা পেঁপেতে রয়েছে প্যাপেইন ও কাইমোপ্যাপেইন নামের প্রচুর প্রোটিওলাইটিক এনজাইম। এ উপাদান আমিষ ভাঙতে সাহায্য করে। প্রায়ই সর্বত্রই পেঁপে পাওয়া যায়।
আঙ্গুর : আঙ্গুরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। এছাড়া ফাইটো কেমিক্যাল ও ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট রয়েছে যা আমাদের ত্বকের সুরক্ষায় বিশেষ কাজ করে। এছাড়া ভিটামিন সি, টরোস্টেলবেন, তামা, লোহা, ম্যাংগানিজ ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।
কলা : কলা একটি অতি পরিচিত দেশি ফল। এ ফলটি কম বেশি সারা বছরই পাওয়া যায়। এটা সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। কলার বেশ কয়েকটি জাত আছে। কলাতে আমাদের শরীরের শক্তি বর্ধনকারী সুকরোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্লুকোজ এবং ফাইবার রয়েছে। গবেষণায় জানা যায়, মাত্র দুইটি কলা প্রায় ৯০ মিনিট পূর্ণোদ্যমে কাজ করার মতো শক্তি জোগায়। কলাতে ট্রিপ্টোফ্যান নামক রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। এছাড়া ভিটামিন বি-৬, আয়রন, পটাসিয়াম, ফাইবার, ভিটামিন-বি-১২, ম্যাগনেসিয়াম বিদ্যমান। কলা প্রাকৃতিক এন্টাসিড হিসেবে কাজ করে।
    ‘আম জাম তাল বেল কাঁঠাল কলা লিচু
    পুষ্টি গুণে স্বাদে ভরা আরো কত কিছু।’
ছফেদা : গ্রীষ্মকালীয় দেশগুলোতে এ ফলটি ভীষণ জনপ্রিয়। শুধু স্বাদে নয়, গুণেও অনন্য এ ফলটি। নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ছফেদা। শক্তির উৎস এ ফলটি শরীরে  নবশক্তি সঞ্চারের মাধ্যমে শরীর মনকে চাঙ্গা ও পুনরুজ্জীবিত করে। বিভিন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান, ভিটামিন এ, সি ও ই এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, কপার ও আয়রনসহ অপরিহার্য বহু পুষ্টি উপাদান রয়েছে ফলটিতে।
শরিফা : ক্যারোটিন, ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল।
চালতা : চালতায় ক্যালসিয়াম ও শর্করা বিদ্যমান।
সাতকরা : ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ।
ডুমুর : ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও ক্যালরি রয়েছে প্রচুর।
করমচা : প্রচুর পরিমাণে পটাশ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও ভিটামিন ‘সি’ বিদ্যমান।
লটকন : লটকন একটি ভিটামিন বি২ সমৃদ্ধ ফল।
বেল : বেল একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে শে^তসার, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম ও লৌহ রয়েছে।
কদবেল : প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং স্বল্প পরিমাণে লৌহ বিদ্যমান।
গাব : প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে।
তেঁতুল : শর্করা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে।
তাল : ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার।
ডালিম : ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার।
অড়বরই : ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল।
আঁশফল : এটি একটি আমিষ ও চিনি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল।
জলপাই : ভিটামিন ‘সি’, ক্যালসিয়াম, লৌহ বিদ্যমান।
খেঁজুর : ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল।
জামরুল : ক্যারোটিন ও ভিটামিন বি-২ সমৃদ্ধ ফল।
আমলকী : প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল।
পানিফল : পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল।
বাঙ্গি : শর্করা, ক্যারোটিন ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
তরমুজ : ক্যালসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান।
কমলা : আমিষ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
তেঁতুল : প্রচুর পরিমাণে শর্করা, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, টারটারিক এসিড, অক্সালিক এসিড, ইনর্ভাট সুগার, পেকটিন পলি স্যাকারাইড বিদ্যমান।
তুঁতফল : এ ফলে সব ধরনের পুষ্টিগুণ বিদ্যমান, তবে সবচেয়ে বেশি আছে ক্যালসিয়াম ও ক্যারোটিন।
    ‘হরেক রকম দেশি ফল পুষ্টি গুণে ভরা
    প্রতিদিন খেলে পরে শেষ হবে সব রোগ।’
দেশিয় ফলের ঔষধিগুণ : পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য আমাদের উচিত বেশি বেশি করে ফলের চারা রোপণ করা। দেশীয় ফল শুধুমাত্র পুষ্টিগুণ দিক থেকে নয় গুরুত্বপূর্ণ তাছাড়াও দেশি ফলের গাছের ঔষুধিগুণ আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় বিরাট ভূমিকা রাখে। নিচে কয়েকটি দেশীয় ফলের ঔষুধিগুণ সম্পর্কে বিবরণ দেয়া হলো :
কাঁঠাল : এটি ডায়েবেটিক মানুষের জন্য কাঁচা কাঁঠাল উপকারী। এছাড়া রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং উচ্চরক্তচাপ এর উপশম ঘটায়।
আম : ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। রক্ত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এছাড়া দেহের শক্তি বৃদ্ধিতে ও কাঁচা আম লিভারের সমস্যার উপশম ঘটায়।
শরিফা : পাকা ফল বলকারক, বাত ও পিত্তনাশক, তৃষ্ণা, শান্তিকারক, বমননাশক, রক্তবৃদ্ধিকারক ও মাংস বৃদ্ধিকারক। আতার শিকড় রক্ত আমাশয় রোগে হিতকর।
চালতা : কচি ফল গ্যাস, কফ, বাত ও পিত্তনাশক। পাকা ফলের রস চিনিসহ পান করলে সর্দিজ¦র উপশম হয়।
ডুমুর : ডুমুর ফল টিউমার ও অন্যান্য অস্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি নিবারণে ব্যবহৃত হয়। পাতা চূর্ণ, বহুমূত্র, বৃক্ক ও যকৃতের পাথর নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। ডুমুর সবজি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
লটকন : লটকন অম্ল মধুর ফল। ফল খেলে বমিভাব দূর হয় ও তৃষ্ণা নিবারণ হয়। শুকনো গুঁড়া পাতা খেলে ডায়রিয়া ও মানসিক চাপ কমায়।
বেল : বেল কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, জন্ডিস দূর করে। এছাড়া হজম শক্তি বাড়ায়, বলবর্ধক বৃদ্ধি করে এবং চোখের ছানি ও জ্বালা উপশম করে।
করমচা : কাঁচা করমচা গায়ের ত্বক ও রক্তনালী শক্ত ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। পালাজ¦র নিরাময় করে। শিকরের রস গায়ের চুলকানি ও কৃমি দমনে সাহায্য করে।
তাল : তালের রস শ্লেষ্মানাশক, মূত্র বৃদ্ধি করে, প্রদাহ ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিবারণ করে। রস থেকে তৈরি তালমিছরি সর্দি কাশির মহৌষধ। যকৃতের দোষ নিবারক ও পিত্তনাশক।
জামরুল : এটি বহুমূত্র রোগীর তৃষ্ণা নিবারণে উপকারি।
পানিফল : অ্যালার্জি ও হাত ফোলা, পা ফোলা উপশম হয়। পিত্তপ্রদাহ, উদরাময় ও তলপেটের ব্যাথা উপশম হয়।
তরমুজ : পাকা ফল মূত্র নিবারক; দেহকে শীতল রাখে, অর্শ লাঘব করে। আমাশয়, বীর্জহীনতা ও প্রসাবের জ¦ালা পোড়া বন্ধ করে। আমাদের সবারই উচিত বেশি বেশি বেশি করে দেশীয় ফলের চারা রোপণ করা। তাহলে একদিকে যেমন পুষ্টির চাহিদা মেটবে তেমনি অন্যদিকে বিভিন্ন রোগের উপশম ঘটবে। যদি আমরা রোগমুক্ত জীবন চাই তাহলে অবশ্যই বেশি করে দেশীয় ফলের চারা রোপণ করতে হবে।
    রোগমুক্ত জীবন চান
    ফল ঔষধির চাষ বাড়ান।
দেশিয় ফলের পুষ্টিমান : আমে জলীয় অংশ ৭৮.৬ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৯০ কিলোক্যালরি, আমিষ ১ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, শর্করা ২০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৬ গ্রাম, লৌহ ১.৩ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ৪১ মিলিগ্রাম বিদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে।
কাঁঠালে খাদ্যশক্তি ৪৮ কিলোক্যালরি, আমিষ ১.৮ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, শর্করা ৯.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৫ মিলিগ্রাম। ক্যারোটিন ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ২১ মিলিগ্রাম বিদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে।
পেঁপে তে খাদ্যশক্তি ৪২ কিলোক্যালরি, আমিষ ১.৯ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, শর্করা ৮.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩১ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন সি ৫৭ মিলিগ্রাম বিদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে।
লিচুতে শর্করা ১৩.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ বিদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে।
আনারস এ খাদ্যশক্তি ৩০ কিলোক্যালরি, ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, শর্করা ৬.২ গ্রাম, ক্যারোটিন ১৮৩০, ভিটামিন ‘সি’ ২১ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ গ্রামে বিদ্যমান।
সুতরাং, আমাদের পুষ্টিমান যুক্ত খাদ্য গ্রহণে দেশীয় ফল বিরাট ভূমিকা পালন করে।
    ‘ফল বৃক্ষের অশেষ দান
    অর্থ বিত্তে বাড়ায় মান।’
দেশি ফলের গাছ লাগানোর কারণ : ফল সবাই পছন্দ করে খেতে। ফলের যেমন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তেমনি আরও অনেক গুণ রয়েছে। নিচে দেশি ফল গাছ লাগানোর কয়েকটি কারণ দেয়া হলো :
১. দেশি ফল গাছ মানুষের খাদ্য জোগান দেয়।
২. পুষ্টির অভাব মেটায়।
৩. পশুপাখির খাবারেরও উৎস।
৪. উৎকৃষ্ট কাঠ ও জ¦ালানি পাওয়া যায়।
৫. আসবাবপত্র, যানবাহন, কুটির শিল্পের উপকরণ পাওয়া যায়।
    ‘রোপণ করে ফলের চারা যে জন পায় সুখ
    জানিও সে আদর্শ মানুষ থাকে না তার দুখ।’
৬. বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং পথ্য হিসেবে ফলের অবদান যথেষ্ট।
৭. ফল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়।
৮. বিদেশি ফলের আমদানি কমিয়ে অর্থের সাশ্রয় করা যায়।
৯. ফল থেকে উন্নতমানের জুস, জ্যাম, জেলি, আচার, মোরব্বা তৈরি করা যায় ও এসব প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ হতে পারে।
১০. নিবিড় ফল চাষের মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করে বেকারত্ব দূর করা যায়।
    ‘পাকা ফলে তুষ্ট মন
     যোগায় পুষ্টি বাড়ায় ধন’
১১. ফলের চারা/কলমের নার্সারি করে কৃষি শিল্প গড়ে তোলা যায়।
১২. মাটির ক্ষয়রোধ ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
১৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে।
১৪. জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সরবরাহ করে।
১৫. খাদ্য নিরাপত্তা।
    ‘ফল খান দেশি
    বল পাবেন বেশি।’
১৬. উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে চাষ করে সামাজিক ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা।
১৭. গাছ ছায়া দেয়।
সুতরাং, দেশি ফল গাছ রোপণের গুরুত্ব অপরিসীম।
পুষ্টির অভাবজনিত রোগ : পুষ্টির অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগের আবির্ভাব ঘটে। যেমন- আয়োডিনের অভাবে গলগ- রোগ হয়। ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে রিকেটস রোগ হয়। লৌহ, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি-১২ ইত্যাদির অভাবে রক্তশূন্যতা ঘটে।
তাই এসব পুষ্টির অভাবজনিত রোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে আমাদের দেশীয় ফলের চাষ বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে দেশীয় ফল খেতে হবে। কারণ দেশীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, শর্করা, ভিটামিন ডি, লৌহ, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান থাকে।
দেশীয় ফল বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন : আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়। যদি দেশিয় ফল বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হলে, দেশে দেশিয় ফলের অভাব মিটবে, মানুষ আর পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না। কারণ পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফরমালিন মুক্ত দেশি ফলের গুরুত্ব : আমাদের দেশে বিজ্ঞানের আবির্ভাবে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। তার কিছু ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। যেমন- বর্তমানে নির্দিষ্ট আম সময়ের আগে বাজারে মিলছে মানেই তাতে কার্বাইড ও ফরমালিনসহ ক্ষতিকর সব রাসায়নিক মিশানো আছে।
    ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ
    কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’
কিন্তু এদেশের মানুষরা ভেবে দেখে না যে সময়ের আগে মৌসুমি ফল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। তাই আমাদের উচিত দেশিয় ফলে এই বিষ প্রয়োগ বন্ধ করা।
    ‘বিশ^ পরিবেশ দিবস সফল হোক
    দেশের গাছ আর দেশের ফল রক্ষা করুন
    বিশ প্রয়োগ বন্ধ করুন।’
পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব : সব জীবকে সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে হলে অবশ্যই সুস্থ দেহের অধিকারী হতে হবে। দেহে রোগবালাই যদি লেগেই থাকে, তাহলে কোনো প্রাণী সুস্থ থাকে না। এসব রোগ সাধারণত পুষ্টির অভাবে হয়ে থাকে। তাই আমাদের পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন। আমরা খুব সহজেই এসব পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারি দেশি ফলের চাষের মাধ্যমে। দেশি ফল যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিমান।
    ‘দেশি ফলের রস গুণ নেই তুলনা তার
    স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টিমান কত রঙের বাহার।’
পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি করে দেশি ফলের চারা রোপণ করা। আমরা চাইলে আমাদের বাড়ির ছাদে ফলের চারা রোপণ করে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারি।
    ‘বাড়ির ছাদে ফলের চাষ
    পাবেন ফল মিটবে আশ।’
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পুষ্টির চাহিদা জোগানে দেশি ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আমাদেরকে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনায় দেশি ফল চাষের প্রতি আরো যতœশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। দেশি ফলে যেসব উপাদান বিদ্যমান থাকে, একমাত্র সেসব উপাদানই পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে এবং পুষ্টিজনিত রোগ থেকে মুক্ত রাখতে পারে।
    ‘দেশি ফলের চারা রোপণ করুন
    পুষ্টির অভাব দূর করুন।’

 

বি আর আর আই উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রেণি : নবম, মোবাইল : ০১৭৪৮৫৭৩৭০০

বিস্তারিত
দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল

বেঞ্চমার্ক ১৯৭১। চরম সংকটের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। দেশে খাদ্য ঘাটতি চাহিদার প্রায় একতৃতীয়াংশ। প্রাণিজাত প্রোটিন দুধ মাংস ডিমের ঘাটতি আরো বেশি। আজ বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ, তারপরও বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একইভাবে দুধ ডিম উৎপাদনে সামান্য ঘাটতি থাকলেও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেছে। এই অভূতপূর্ব অর্জন সম্ভব হয়েছে কৃষি বিজ্ঞানীদের নব নব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ দক্ষতা এবং কৃষকগণের প্রযুক্তি গ্রহণের এবং প্রয়োগের সক্ষমতার কারণে। ভিশন ২০২১  এ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ এ উন্নত দেশে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন মেধাবী ও স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠী যার জন্য চাই পর্যাপ্ত দুধ মাংস ও ডিমের সরবরাহ।


দুধ উৎপাদন ২টি প্রধান নিয়ামকের উপর নির্ভরশীল। (১) উন্নত জাত (২) উন্নত যতœ। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভালো জাতের বিকল্প নাই। আমাদের দেশি গাভী যেখানে দৈনিক গড়ে ২ লিটার দুধ দেয় উন্নত জাত তথা ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের গাভী দৈনিক গড়ে ১০ লিটার দুধ দেয়। আবার দেশি বকনার বয়ঃসন্ধিকাল অর্থাৎ প্রজনন সক্ষমতা অর্জনের বয়স যেখানে ৩০ মাস সেখানে সংকর জাতের বকনার ১৮ মাস। সে হিসেবে গড়ে দেশি বকনা প্রথম বাছুর প্রসব করে প্রায় ৪০ মাস বয়সে, সংকর জাতের বকনা প্রথম বাছুর প্রসব করে ২৮ মাস বয়সে।


গাভীর জাত উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। উন্নত জাতের ষাঁড় বাছাই, সংগ্রহ, পালন, সিমেন সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের দোরগোড়ায় প্রশিক্ষিত কর্মী দ্বারা গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন করানোর মাধ্যমে গরুর জাত উন্নয়নে কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার গাভী গরম হলে দেশি বা স্থানীয় ষাঁড় দ্বারা পাল না দিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন সহকারী অথবা ইউনিয়ন কৃত্রিম প্রজনন প্রকর্মী (এআই টেকনিশিয়ান) সাহায্যে কৃত্রিম প্রজনন করিয়ে নিন। গাভীর একটু ভালো যতœ নিলে নয় মাস দশ দিন পর আপনি পেয়ে যাবেন উন্নত জাতের সংকর বাছুর। প্রতিটি বকনা বাছুর ২০ লিটার দুধ দেবার সক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিবে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কীভাবে উন্নত জাত ও উৎপাদন বৃদ্ধি হয় নিচের টেবিলে দেখানো হলো।


উপরোক্ত সারণী থেকে প্রতীয়মান হয় যে ১ম প্রজন্মের ৫০% সংকর জাতের বকনা তার মায়ের চেয়ে ১০.৫গুন বেশি দুধ দেয়। ২য় প্রজন্মে ৭৫% সংকর জাতের বকনা পাওয়া গেলেও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় মাত্র ১.৪৫ গুন। অর্থাৎ ১ম প্রজন্মের জাত বৃদ্ধি ও দুধ বৃদ্ধির অনুপাত পরবর্তী প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি। আমরা জানি জাত বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিচর্যা ব্যয় ও শ্রম বৃদ্ধি পায়। ২য় প্রজন্মে গাভীর পরিচর্যার শ্রম ও ব্যয় ১ম প্রজন্মের তুলনায় যে পরিমান বেশি সে তুলনায় দুধ উৎপাদন বেশি নয়। তাই আমাদের গ্রামীন পরিবেশে পারিবারিক এবং ছোট খামারে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশের ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের গাভী পালন করা সবচেয়ে লাভজনক।
(উন্নত যত্ন সম্পর্কে আগামী সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে)।

 

ডা. শাহ মোঃ বায়েজীদ রব্বানী বাহালুল

সহকারী পরিচালক, এনইটিপি প্রকল্প-২, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, মোবা : ০১৮১৬০২৪১১৫ ইমেইল : bahalulvet@gmail com.

 

বিস্তারিত
নরম খোলসের কাঁকড়ার উন্নত চাষ কৌশল

ভূমিকা : মৎস্য সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান দখল করেছে। কিন্তু অবহেলিত রয়ে গিয়েছে সামুদ্রিক বিশাল জলরাশি। মৎস্য  সেক্টরের উন্নয়নে সময় এসেছে সামুদ্রিক নীল-অর্থনীতির (Blue-Economy) দিকে গুরত্ব দেওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা সম্পন্ন মৎস্য এবং মাৎস্যজাত পণ্য যেমন- সামুদ্রিক আগাছা, কাঁকড়া, সবুজ ঝিনুক, স্কুইড ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সক্ষম হবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় বিশাল অঞ্চলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং গলদা ও বাগদা চিংড়ির ঘেরে পরিণত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমানে কাঁকড়া চাষিদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। এ প্রেক্ষিতে নরম খোলসের কাঁকড়ার উন্নত চাষ প্রযুক্তি সুদীর্ঘ ৭১১ কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যবহার করে বদলে দিতে পারে লাখো মানুষের ভাগ্য।


চার প্রজাতির শিলা কাঁকড়ার মধ্যে (Scylla serrata, Scylla tranquebarica, Scylla paramamosain IScyllaolivacea) বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৯০% ভাগই Scylla olivacea এবং ১০% Scylla tranquebarica. কাঁকড়া আর্থ্রােপোডা পর্বের ক্রাস্টাসিয়া প্রাণি। খোলস শক্ত থাকা অবস্থায় খাবার গ্রহণের প্রকৃতি ও পরিমাণের উপর কাঁকড়ার শারীরিক বৃদ্ধি অনেকাংশ নির্ভর করে। চলাফেরা ও খাবার গ্রহণের সুবিধার্থে কাঁকড়ার ১০টি পা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সাঁড়াশির মতো পা গুলোকে চিলেপেড/চেলাযুক্ত পাবলা হয়। চিলেপেডের সাহায্যে কাঁকড়া আত্মরক্ষা করে এবং শিকার ধরে। এছাড়া মাটিতে চলাফেরার জন্য তিন জোড়াহাঁটার পা দিয়ে কাঁকড়া যে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে এবং পিছনের সাঁতার পায়ের সাহায্যে কাঁকড়া সাঁতার কাটতে পারে।        


উন্নত চাষ পদ্ধতির ধাপসমূহ :
ক. পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতকরণ :  
আধা নিবিড় পদ্ধতিতে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে পুকুরের আয়তন খুব বেশি প্রভাব না ফেললেও পানির গভীরতা অনেকাংশে প্রভাব রাখে। এজন্য পুকুরের আয়তন ০.৫-১.০ একর এবং পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট হওয়া বাঞ্ছনীয়। আধা লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানো সম্ভব এমন স্থানে পুকুর নির্বাচন করে তলদেশ সমতল করতে হবে।

 

খ. কাঠের ব্রিজ তৈরি : নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে দৈনিক অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৬-৮ বার পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কাঁকড়ার খাবার প্রয়োগ ও খোলস পরিবর্তনের অবস্থা সহজে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পুকুরের মাঝে একটি শক্ত ও টেকসই কাঠের ব্রিজ তৈরি করতে হবে। ব্রিজের উপরে ছাউনি এবং নিচে নাইলনের সুতা টানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন তীব্র জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে ব্রিজ ভেঙে না যায় এবং বাক্সগুলোকে দুর্যোগময় পরিবেশে হারিয়ে না যায়।
 

গ. ভাসমান কাঠামো ও বাক্স স্থাপন : বাক্স পানিতে ভেসে থাকার জন্য ভাসমান কাঠামো তৈরি করতে হবে। কাঠামো তৈরিতে ৫টি সমান দৈর্ঘ্যরে পিভিসি পাইপ পাশাপাশি নিয়ে কাঁকড়ার বাক্সের দৈর্ঘ্যরে সমান দুরত্ব ফাঁকা রেখে বাঁশ দ্বারা বেঁধে দিতে হবে। কাঠামো পুকুরের দৈর্র্ঘ্যরে অর্ধেক হলে ভালো।
 

ঘ. কাঁকড়া সংগ্রহ ও পরিবহন : সারাবছর নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ করা যায়। এজন্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া সংগ্রহ করতে হবে। কেননা এই আকারের অপ্রাপ্ত বয়সের কাঁকড়া দ্রুত খোলস পরিবর্তন করে থাকে। প্রকৃতিগতভাবে কাঁকড়া খুবই আক্রমণাত্মক প্রাণী। তাই সংগৃহীত কাঁকড়া পরিবহনে মূলত ২টি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে-
১। কাঁকড়ার চিলেপেড ২টি বাঁধা থাকতে হবে।
২। বাতাস থেকে কাঁকড়ার অক্সিজেন গ্রহণের ব্যবস্থা এবং আর্দ্র থাকার জন্য কাঁকড়ার শরীরে কাঁদা মাখতে হবে। এতে কাঁকড়ার মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়।

 

ঙ. চিলেপেড ফেলে দেওয়ার পদ্বতি : কাঁকড়াকে বরফ ও পানির মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখলেও কাঁকড়া নিজের থেকে চিলেপেড ছেড়ে দেয়। নিজ থেকে চিলেপেড ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতিকে বলে অটোনোমাইজেশন। চিলেপেড ও শরীরের জোড়ার কিছুটা আগে চাপ দিতে হবে। প্রথমে হালকাভাবে চাপ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে হবে অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত কাঁকড়া নিজ থেকে চিলেপেড না ছাড়ছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে চাপের প্রেক্ষিতে চিলেপেড যেন টেনে আনা না হয়। কাঁকড়ার বাহু পুনঃগঠনের বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে খোলস পরিবতর্নের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অঙ্গের পুনরায় আবির্ভাব ঘটে। খোলস পরিবর্তন কাঁকড়ার নিয়মতান্ত্রিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিবার ২০-৪০ গ্রাম দৈহিক বৃদ্ধি হয়ে থাকে। সদ্য খোলস পরিবর্তনকারী কাঁকড়াকে নরম খোলস কাঁকড়া (Soft shell crab) বলে।
 

চ. কাঁকড়া মজুদ, খাদ্য প্রয়োগ এবং পুকুর ব্যবস্থাপনা : বর্তমানে ১টি বাক্সে ১টি কাঁকড়া রেখে বাণিজ্যিকভাবে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চিলেপেড ফেলে দিয়ে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে একই বাক্সে একের অধিক কাঁকড়া মজুদ করা সম্ভব। কাঁকড়া চাষে খাদ্য হিসেবে উচ্ছিষ্ট মাছ সর্বোত্তম। কাঁকড়ার ওজনের ৫-১০% হারে প্রতি দুইদিন অন্তর অন্তর খাদ্য সরবারহ করতে হবে। নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের জন্য পানির লবণাক্ত ১৫-১৮ পিপিটি, পি.এইচ ৬.৫-৮.০ এবং ক্ষারত্ব ৮০ এর উপরে থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্ষারত্ব কমে গেলে দ্রুত পানি পরিবর্তন অথবা চুন প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রতি মাসে একবার প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা উত্তম। এজন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
 

ছ. পর্যবেক্ষণ ও সংরক্ষণ : নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে প্রতি ৩ ঘণ্টা অন্তর অন্তর দিনে রাতে পর্যবেক্ষণ করে নরম এবং মৃত কাঁকড়াগুলোকে দ্রুত তুলে ফেলতে হবে। নরম কাঁকড়া চেনার সহজ উপায় হচ্ছে বাক্সে পরিত্যাক্ত খোলসের কারণে মজুদকৃত কাঁকড়ার চেয়ে বেশি সংখ্যক কাঁকড়া দেখা যাবে। নরম খোলসের কাঁকড়া ৩-৪ ঘণ্টা আধা লবণাক্ত (১৫-২০ পিপিটি) পানিতে থাকলে খোলস পুনরায় শক্ত হয়ে যায়। এজন্য নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে আহরণের পূর্বে খোলস পরিবর্তনের পর খোলস শক্ত না হওয়ার জন্য দ্রুত লবণ পানি থেকে তুলে মিঠা পানিতে কয়েক ঘণ্টা সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। সংগৃহীত নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়াকে আর্দ্র রাখার জন্য ট্রেতে সাজিয়ে রেখে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত সংগৃহীত নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়াগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পাঠাতে হবে।                             
 

জ. কাঁকড়ার পুকুরে মাছ চাষ : কাঁকড়া চাষে পুকুরের পানির উপরিস্তর ব্যবহৃত হয়। ফলে অব্যবহৃত থাকে পানির নিচের স্তর। পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাঁকড়ার পাশাপাশি লবণাক্ততা সহ্যক্ষম ভেটকি ও তেলাপিয়া মাছ চাষ করলে পানির গুণাগুণ ঠিক থাকে। ভেটকি মাংশাসি প্রজাতির হওয়ায় কাঁকড়ার জন্য ব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট মাছের উদ্বৃত্ত অংশ, মৃত কাঁকড়া ভেটকি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তেলাপিয়া মাছ পুকুরের জৈবিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।  


ঞ. ফলাফল : কাঁকড়া নিজেদের বাচ্চা এমনকি নিজের সমান আকারের অন্য কাঁকড়াকেও খেয়ে ফেলতে পারে। ফলে শক্তি অপচয়ের পাশাপাশি মৃত্যুহার অনেকাংশে বেড়ে যায়। কাঁকড়ার চিলেপেড ২টি ফেলে দিলে আক্রমণাত্মক মনোভাব সম্পূর্ণভাবে কমে যায় এবং দ্রুত খোলস পরিবর্তনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া বিচরণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন চিলেপেড তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ পদ্ধতিতে চিলেপেড ফেলে দিলে কাঁকড়া অপেক্ষাকৃত কম সময়ে খোলস পরিবর্তন করে, উল্লেখযোগ্য হারে মৃত্যু হ্রাস পায় এবং  বৃদ্ধি হার বেড়ে যায়। এই পদ্ধতিতে চাষ করে এক ফসলে অর্থাৎ প্রতি ২ মাসে প্রতি একর পুকুর থেকে ২৫০০-২৬০০ কেজি নরম খোলসের কাঁকড়া উৎপাদন করা সম্ভব। নিম্ন ছকেমাঠ পর্যায়ের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হলো

 

ড. ডুরিন আখতার জাহান১ মোহাম্মদ রেদোয়ানুর রহমান২
ড. মো: আসাদুজ্জমান৩ নূর-এ-রওশন৪

১প্রকল্প পরিচালক, বামগই, মোবাইল-০১৭১২৬১১১৮৫ durin_bfri@yahoo.com; ২প্রভাষক, সিভাসু, মোবাইল-০১৭১৭৪১২০৪৯; ৩সহকারী অধ্যাপক, সিভাসু; ৪বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বামগই

 

বিস্তারিত
কবিতা ( ভাদ্র ১৪২৫)

ভাদ্রের তালের কথা
মো. জন্নুন আলী প্রামাণিক১

ভাদ্রের রোদে পাকা তালে সুবাস দূরে ছড়ায়,
ঝুলিয়ে থাকা রাঙা রঙে সুরভি ভারি চূড়ায়।
বাবুই ধন্য নিজ নীড়ে কোকিল পাখি উড়ায়,
তালের ছালে ব্যর্থ ঠোঁট ঠোক্কর মেরে ফিরায়।
আঁশের পালা ফল জুড়ে রসের পাত্র ভরায়,
সুগন্ধি রস চিপে নিলে রুচির কাজে সহায়।
তালের পিঠা ভাদ্র এলে স্বাদের রসে বানায়,
নরম স্বাদে গুণে অতি খাইলে ভরে হৃদয়।
গাছের রসে তৈরি করা মিছরি রোগ তাড়ায়,
কোমল শাঁস কচি তালে সখের খাদ্য বেজায়।
তালের গাছ শক্ত লম্বা ভীষণ মূর্তি দেখায়,
তুফান তারে ভয় করে আটকা পরে পাতায়।
শ্রোতের বেগ দ্রুত হলে সাহস রাখে সদায়,
বায়ুর সাথে লড়ে তীব্র বিরাট শক্তি মাথায়।
ভাঙন রোধে তাল মস্ত বীরের মতো দাঁড়ায়,
সারিতে রোপা গাছ দেখে ভাঙন দৈত্য পলায়।
মূলের জালে ঘিরে খেলা মাটিকে ধরে মায়ায়,
মাটির নিচে ছড়ে পড়ে শিকড় যত গোড়ায়।
তালের পাখা নক্সি আঁকা গরমে ক্লান্তি মিটায়,
ভাদ্রের তীব্র তাপে শান্তি তাপিত প্রাণ জুড়ায়।
খেলনা নিয়ে শিশু ছোটে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়,
পাতার ঘড়ি হাতে পরে গর্বের কথা শোনায়।
তালের পাতে বানা ঝুড়ি মনের মতো সাজায়,
পাতায় তৈরি বাঁশি শিশু মুখের ফুঁকে বাজায়।
নদীর তীরে সারি সারি তালের গাছ যেথায়,
ভাঙন রোধে মাটি রক্ষা বায়ুর বেগ কমায়।

 

কৃষক পথিকের কথা
সুরুজ্জামান শ্রীপুরী২


ফসলের মাঠে চাষির ছেলের মুখে শুনি মধুর গান
গানের তালে নাচে কৃষক আনন্দে ভরে প্রাণ।

এমন সময় একজন পথিক ফসলের ক্ষেতে যায়,
মনটা কৃষকের এতই খুশি, দেখতে পথিক পায়।

পথিক এত সুখের গান ধরেছ? কি আনন্দ লয়ে
এই গানের মর্ম কৃষক আমায় দাওনা কয়ে?
কৃষক, এক বিঘা জমি মোর চাষ করি মাঠে
অভাব মোচনের ফসল আমার, এখান থেকে জুটে।

এই ফসলের সফলতায়, মোর জীবন পাই
মনের সুখে গান ধরছি, সবুজ শ্যামল গাঁয়।

পথিক, জমি আছে অনেক আমার, ফসল নাহি পাই
কাজ করিতে লজ্জা লাগে, করি কি উপায়?
লেখাপড়া করেছি আমি কেমনে করি কাজ
ধনী ঘরের ছেলে আমি অট্টালিকায় বাস।

কৃষক লেখাপড়া অমূল্য ধন, আছে তোমার জানা
কাজ করিতে লজ্জা কিসের, কে করেছে মানা?

বিশে^ যারা ছিলেন জ্ঞানী, ছিলেন মহাগুণী
কাজ করেছেন গভীর চিত্তে, দিচ্ছেন সদা বাণী।

যথাসাধ্য কাজ কর ভাই লজ্জা করতে নাই
কাজ করিলে ভাগ্য ফিরবে, বিজ্ঞের মুখে পাই।

পথিক, যে উপদেশ দিলা কৃষক শোনলাম তোমার কথা
এখন মাঠে কাজ করিতে করব না আর দ্বিধা
রোদ বাদলে করব কাজ ক্ষেতখামারে গিয়ে
কাজের শেষে ফিরব আমি দুধাল গাভী নিয়ে।

১গ্রাম-বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা-ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম; মোবাইল : ০১৭৩৫২০২৭৯৮ ২গ্রাম-শ্রীপুর, পো: শ্রীপুর নতুন বাজার, থানা ও জেলা : জামালপুর

 

 

বিস্তারিত
আশ্বিন মাসের কৃষি (১৪২৫)

ঋতুর পরিবর্তণের ধারায় এখন শরৎকাল চলছে। শুভ্র কাশফুল, দিগন্ত জোড়া সবুজ আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ায় চিলতে সাদা মেঘ। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। বর্ষা মৌসুমের সবটুকু ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে কার্যকরী প্রস্তুতি নেবার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।


আমন ধান : আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিতা পাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে পানির অপচয় অনেক কম হয়। শিষ কাটা লেদা পোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পরা রোগ দেখা দিতে পারে। সঠিক রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।


নাবি আমন রোপণ : কোনো কারণে আমন সময় মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।


আখ : আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়।  চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।  চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।


বিনা চাষে ফসল আবাদ : মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বিনা চাষে লাভজনকভাবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্প মেয়াদি টরি-৭ ও কল্যাণী জাতের সরিষা চাষ করতে পারেন।


শাক-সবজি : আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জায়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার বিশেষ করে ইউরিয়া প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায়। শাকের মধ্যে মুলা, লালশাক, পালংশাক, চিনা শাক, সরিষা শাক অনায়াসে করা যায়। সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করা যায়।


কলা : অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার (৬.৫ থেকে ৮ ফুট) দূরত্বে ৬০ সেমি. (২ ফুট) চওড়া এবং ৬০ (২ ফুট) সেমি (২ ফুট) গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। কলা বাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোনো রবি ফসল চাষ করা যায়।


গাছপালা : বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট হলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে। বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।


প্রাণিসম্পদ : হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগীর বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেয়া যাবে না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।


আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদি পশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভিতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো গোখাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খরের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভী, সদ্য ভুমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যতœ নিতে হবে। এ সময় গবাদি প্রাণীর মড়ক দেখা দিকে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।


মৎস্যসম্পদ : বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেধে দিতে হবে। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।


আশ্বিন মাসে নিয়মিত কৃষি কাজের পাশাপাশি সারা দেশ জুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অভিযান। এককভাবে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোনো লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সকল মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেঁচা, গুইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাস বড়ি ব্যবহার করা। আসুন সবাই একসাথে ইঁদুর দমন করি। সবাই ভালো থাকবেন।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন

তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবা : ০১৯১১০১৯৬১০ ই-মেইল-ioag@ais.gov.bd

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (ভাদ্র-১৪২৫)

রহিমা বেগম, গ্রাম: মৌতলা, উপজেলা: কালিগঞ্জ, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: হলুদ গাছে এক ধরনের পোকার আক্রমণে হলুদ গাছের কাণ্ডের উপরের অংশ মরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করণীয়?  

উত্তর: আপনার হলুদ গাছে মাজরা পোকার আক্রমণ হয়েছে। এ পোকার আক্রমণে কাণ্ডের উপরের অংশ মরে যায়। এমনকি সাদা ডিগ পাতাও দেখা যায়। এ পোকার আক্রমণ রোধে প্রতি লিটার পানিতে ফেনথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক ১.৫ মিলি প্রতি লিটার ভালোভাবে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাবেন। এছাড়া ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার রাখা এবং হলুদ চাষের জমি তৈরির সময় দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করলে অনেক বেশি উপকার পাবেন।   


মো. বনী আদম, গ্রাম: সরফরাজপুর, উপজেলা: চৌগাছা, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: কাঁঠাল গাছে এক ধরনের পোকার আক্রমণে কাঁঠাল গাছের শিকড় ও গুড়ি খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। এখন আমি কি করব?

উত্তর: কাঁঠাল গাছে উঁইপোকা আক্রমণ করলে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এ সমস্যা রোধে গাছের কা- ও গুড়ি থেকে উঁইপোকার ঢিবি ধ্বংস ও মাটি পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। তারপর ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার মিশিয়ে গাছের গোড়া ও কাণ্ডে স্প্রে করতে হবে। তাহলে আপনি আপনার কাঁঠাল গাছের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।  


মো. জয়নুল ইসলাম, গ্রাম: তাম্বুলখানা, উপজেলা: ফরিদপুর সদর, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন:  নতুন লিচু গাছ লাগালে অনেকে বলে পুরাতন গাছের নিচের মাটি এনে নতুন গাছের গোড়ায় দিতে। এর কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে?

উত্তর: নতুন লিচু কলমের চারা লাগালে পুরাতন গাছের গোড়া থেকে মাটি এনে নতুন গাছের গোড়াতে দিলে উপকার হয়। কারণ পুরাতন লিচু গাছের গোড়ার মাটিতে মাইকোরাইজা নামে এক ধরনের ছত্রাক থাকে। এরা লিচু গাছের শিকড়ের সাথে যুক্ত হয়ে মিথোজীবিতার মাধ্যমে মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে শিকড়ের মাধ্যমে লিচু গাছে সরবরাহ করে। মাটিতে মাইকোরাইজা থাকলে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। এসব বৈজ্ঞানিক কারণেই পুরাতন গাছের গোড়ার মাটি নতুন লাগানো লিচু গাছের গোড়াতে দিতে হয়।  

 

মো. ফেরদৌসি বেগম, গ্রাম: পিরোজপুর, উপজেলা: মেহেরপুর সদর, জেলা: মেহেরপুর
প্রশ্ন: আমার খিরা গাছে এক রকমের পোকার কারণে খিরা গাছের কচি পাতা ও ডগার অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমার কি করণীয়?  

উত্তর: খিরা গাছের পাতার এ সমস্যার প্রতিকারে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়। বিশেষ করে আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে আপনি উপকার পাবেন। কিন্তু রাসায়নিক দমন ছাড়াও আপনি হাত জাল দিয়ে পোকা ধরতে ও মেরে ফেলতে পারেন। আবার চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ সমস্যা কম হয়। ক্ষেতের আশপাশের আগাছা নষ্ট করার পাশাপাশি পাতার উপর ছাই ছিটিয়ে সাময়িকভাবে দমন করা যায়। আশা করি এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কাক্সিক্ষত উপকার পাবেন।   

 

কাদের বেপারি, গ্রাম: বাগমারা, উপজেলা: হোমনা, জেলা: কুমিল্লা
প্রশ্ন: টমেটো গাছের উপরের অংশ কুঁকড়িয়ে পাতা মুড়িয়ে যায়। এছাড়া পাতাগুলো কেমন জানি মোটা মোটা মনে হয়। এ সমস্যার সমাধান জানাবেন?

উত্তর: লিফ হপার পোকার দ্বারা ভাইরাস টমেটো গাছকে আক্রমণ করলে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। এ সমস্যা হলে পাতা মুড়িয়ে চামড়ার মতো মনে হয়। গাছ আকারে ছোট হয়। এজন্য এ রোগে আক্রান্ত গাছ দেখামাত্রই তুলে ফেলতে হবে। ভাইরাসের বাহক পোকা দমন করতে পারলে এ ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। এজন্য ভাইরাসের বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক নিয়মমাফিক ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া ভবিষ্যতে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়।   


রেজাউল শেখ, গ্রাম: বামনডাঙ্গা, উপজেলা: আশাশুনি, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: চিনাবাদামের পাতার উপরে হলদে রেখা বেষ্টিত বাদামি রঙের দাগ পড়ছে। দাগগুলো আবার কালো হয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে পাতা ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করলে উপকার পাব ?

উত্তর: চিনাবাদামের এ রোগটিকে চিনাবাদামের টিক্কা রোগ বলে। আসলে এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া রোগ সহনশীল জাত এর চাষ করা ভালো। ফসল কাটার পর আগাছা পুড়ে ফেলা এবং আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। এতে করে চিনা বাদামের পাতায় এ ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আর থাকে না।     


মো.ইব্রাহিম, গ্রাম: দৌলতপুর, উপজেলা: নড়াইল সদর, জেলা: নড়াইল
প্রশ্ন: থাই কৈ মাছ চাষে সম্পূরক খাদ্য তৈরি সম্পর্কে জানালে উপকৃত হব?  

উত্তর: থাই কৈ মাছ চাষে সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে করে মাছ চাষে লাভের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। থাই কৈ মাছের আমিষ চাহিদা বিশেষ করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা কার্প বা রুইজাতীয় মাছের চাইতে বেশি। থাই কৈ মাছের আমিষের চাহিদা ৩০%। সহজলভ্য মৎস্য খাদ্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে ১০০ কেজি খাদ্যে চালের কুড়া ২৫ কেজি, সরিষার খৈল ১০ কেজি, গমের ভুষি ২৫ কেজি, ফিশ মিল ১৮ কেজি, মিট ও বোনমিল ১৭ কেজি, ভিটামিন ও খনিজ লবণ ১ কেজি থাকতে হবে। এভাবে সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা যায়।


করিম মৃধা, গ্রাম: সনগাঁও, উপজেলা: বালিয়াডাঙ্গি, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: পাঙ্গাস মাছের লালচে রোগ হয়েছে কি করব?

উত্তর: পাঙ্গাস মাছের লালচে রোগ দেখা দিলে যে সব বিষয় করণীয় তাহলো- কমপক্ষে ৫০ ভাগ পানি পরিবর্তন করে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া হররা টেনে পুকুরের তলদেশের কাদার গ্যাস বের করে দিতে হবে। এসবের পাশাপাশি মাছের দেহের ওজনের হিসাবে ৫০ মিলিগ্রাম টেট্রাসাইক্লিন খাবারের সাথে  মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। আর প্রতি শতকে ১০ গ্রাম হারে পটাশ ২ বার প্রয়োগ করলে এ সমস্যা দূর হবে।    

 

আসমাউল হুসনা, গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: গোবিন্দগঞ্জ, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: আমার ছাগলের শরীরের তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঠোঁট, মুখ ও বাঁটে বসন্তের গুটির মতো বের হয়েছে?

উত্তর: আক্রান্ত ছাগলকে সুস্থ ছাগল থেকে পৃথক রাখতে হবে। গুটিগুলো সমপরিমাণ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও উষ্ণ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। অন্যান্য জীবাণু দ্বারা যাতে আক্রান্ত না হয় সেজন্য অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, জেন্টামাইসিন, অ্যাম্পিসিলিন ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য আগে থেকে গোট পক্স এর টিকা দিতে হবে।   

 

মো. করিমন বেওয়া, গ্রাম: পীড়ানচর, উপজেলা: শিবগঞ্জ, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: আমার বাড়ির মুরগিগুলোর পায়ুস্থানে ময়লা লেগে থাকছে। পালকগুলো কুঁচকে আছে, ডায়রিয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় কি করণীয়। পরামর্শ চাই।  

উত্তর:  আপনার মুরগিগুলোর গামবোরো রোগ হয়েছে। এই রোগ যাতে না হয় সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১০ থেকে ২১ দিনে বয়সে গামবোরোর টিকা প্রদান করতে হয়। আর রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য এনফ্লক্স ভেট সলিউশন অথবা কট্টা ভেট পাউডার এবং সাথে ইলেকট্রোমিন পাউডার খাওয়াতে হবে।  


কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে  কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

 

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন

উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫,  মোবাইল নং ০১৭১১১১৬০৩২, ঃtaufiquedae25@gmail.com

 

বিস্তারিত