গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। এর পুষ্টিমান অত্যন্ত বেশি এবং বহুবিদ খাদ্য তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বোরো ধান ও অন্যান্য শীতকালীন ফসলের তুলনায় গম আবাদ করা সুবিধাজনক, যেমন- পানি কম লাগে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম, পরিবেশবান্ধব ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে ৭০ লক্ষ টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১১.৫৩ লক্ষ টন। গমের বহুবিদ ব্যবহার ও মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর এ চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও কৃষক কর্তৃক গমের উচ্চফলনশীল নতুন জাত ও আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল গ্রহণের ফলে সম্প্রতি গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৭-১৮ মৌসুমে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৩.২৮ টনে উন্নিত হয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও, দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে সারা দেশে গমের উৎপাদনশীলতা আরও বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন পরিবর্তনশীল জলবায়ু সহনশীল আধুনিক জাত ও ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন।
জাত পরিচিতি
যে কোনো ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভালো জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গমের নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো সাধারণত পুরনো জাত অপেক্ষা অধিক ফলনশীল। উচ্চফলনশীলতার গুণ ছাড়াও গমের নতুন জাতগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো :
তাপ সহিষ্ণু : শীতের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কম হলেও ফলন তেমন হ্রাস পায় না। দেরিতে বপনেও আশানুরূপ ফলন দেয়। গমের পরিপক্বতা পর্যন্ত পাতা সবুজ থাকে ও পরিপুষ্ট দানা পাওয়া যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
শীষের সংখ্যা বেশি : গাছে কার্যকর কুশির পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রতি বর্গমিটারে শীষের সংখ্যা বেশি থাকে।
প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা বেশি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত গমের ৩৩টি জাতের মধ্যে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি যে ৯টি গমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে সেগুলো পরিবর্তিত আবহাওয়াতেও ভালো ফলন দিচ্ছে। তবে বারি গম ২৬ জাতটি গমের ব্লাস্ট রোগ সংবেদনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের ব্লাস্ট প্রবণ এলাকা বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আবাদ না করে বারি গম ৩০ (গমের ব্লাস্ট রোগ সহনশীল) ও বারি গম ৩৩ (গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী) জাতের আবাদ করা নিরাপদ ও উত্তম। তাছাড়া বারি গম ৩৩ জাতটি জিঙ্কসম্মৃদ্ধ (দানায় জিঙ্কের পরিমাণ ৫০-৫৫ মিগ্রা./কেজি) ও সহজে হেলে পড়ে না।
বীজ শোধন : বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স-২০০ ডব্লিউপি ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করে বীজ বপন করলে বীজবাহিত রোগজীবাণু দমন হবে এবং ফলনও বাড়বে। প্রদর্শনীর জন্য কীটের সাথে সরবরাহকৃত বীজ শোধন করেই দেয়া আছে।
জমি তৈরি ও বীজ বপন : পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দ্বারা চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও আগাছামুক্ত করে জমি তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের আগে নির্ধারিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করে একটি হালকা চাষ ও মই দিয়ে ২০ সেমি. (৮ ইঞ্চি) পর পর সারি করে বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১-১৫ অগ্রহায়ণ (১৫-৩০ নভেম্বর)। বীজের হার : ৫০-৬০ কেজি/একর।
সারের পরিমাণ (প্রতি একরে) : ইউরিয়া ঃ ৯০ কেজি (প্রাথমিক প্রয়োগ ৬০ কেজি ও উপরিপ্রয়োগ ৩০ কেজি), টিএসপি : ৫৫ কেজি, এমওপি : ৪০ কেজি, জিপসাম : ৪৫ কেজি, বরিক এসিড : ৩.০০ কেজি।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : নির্ধারিত ইউরিয়া সারের ২/৩ ভাগ ও অন্যান্য সব সার শেষ চাষের আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে এবং হালকা চাষ ও মই দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ১/৩ ভাগ ইউরিয়া প্রথম সেচের পর (বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে) উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি একরে ৩০০০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার চাষের শুরুতে প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
সেচ প্রয়োগ : মাটির প্রকারভেদে গম চাষে সাধারণত ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ : তিন পাতা অবস্থায় (বীজ বোনার ১৭-২১ দিনের মধ্যে) প্রথম সেচ দিতে হবে। জমিতে অতিরিক্ত রস থাকলে এ সেচটি কয়েক দিন পর দিতে হবে। দ্বিতীয় সেচ : শীষ বের হওয়ার আগে (বীজ বোনার ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।
তৃতীয় সেচ : দানা বাঁধার প্রাথমিক পর্যায়ে (বীজ বোনার ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে) তৃতীয় সেচ দিতে হবে। হালকা বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভালো ফলন পেতে হলে নির্ধারিত সেচ ছাড়াও অতিরিক্ত ১-২টি সেচের প্রয়োজন হতে পারে। সেচ কিংবা বৃষ্টির পানি জমলে অতি সত্বর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই বীজ বোনার পর পরই পানি নিষ্কাশনের জন্য জমির ঢাল বুঝে আনুমানিক ২০ ফুট অন্তর অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে যাতে সেচ বা বৃষ্টির পর পানি সহজে বের হয়ে যায়। কোনো অবস্থাতেই জমিতে পানি আটকিয়ে রাখা যাবে না।
আন্তঃচাষ পরিচর্যা : বপনের পর হতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত অবশ্যই পাখি তাড়াতে হবে কিন্তু পাখি মারা যাবে না। ভোর বেলা ও সন্ধ্যা বেলা পাখির উপদ্রব বেশি হয় তাই এই সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথম সেচের পর মাটিতে জোঁ এলে নিড়ানি/আগাছানাশক দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা যেমন বথুয়া, কাঁকড়ি, বিষকাঁটালি, শাকনটে, কাঁটানটে ইত্যাদি দমনের জন্য এফিনিটি (আগাছানাশক) ব্যবহার করা ভালো। প্রতি ২০ শতাংশ জমির জন্য ১০০ গ্রাম এফিনিটি পাউডার ৪০ লিটার পানিতে মিশিয়ে চারার ২৫-২৮ দিন বয়সে প্রয়োগ করলে আগাছা দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়। এফিনিটি মাত্রার বেশি প্রয়োগ করলে কিংবা গমের ২৫ দিন বয়সের আগে প্রয়োগ করলে গমের ক্ষতি হতে পারে। এফিনিটির মাত্রা কম হলে কিংবা ৩০ দিন বয়সের পর প্রয়োগ করলে আগাছা পুরাপুরি দমন হবে না।
গমের ব্লাস্ট এবং অন্যান্য রোগ দমনের জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং ১২-১৫ দিন পর আর একবার ৫ শতাংশ জমির জন্য ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউজি অথবা ১০ মিলি ফলিকুর ২৫০ ইসি বা এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ, মরিচা রোগ ইত্যাদিও দমন হবে। এতে গমের ফলন ও বীজের মান বৃদ্ধি পাবে। ইঁদুর গমের অন্যতম শত্রু এবং অতি চালাক প্রাণী। তাই বিষটোপ, ফাঁদ, গ্যাস ট্যাবলেট, গর্তে পানি ঢালাসহ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ইঁদুর অবশ্যই দমন করতে হবে।
বীজ সংরক্ষণ : গম মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের পর বীজ কয়েক দিন হালকা রোদে এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে দাঁত দিয়ে চিবালে কট করে শব্দ হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই পাকা চাতাল বা ফ্লোরে গমবীজ কড়া রোদে শুকানো ঠিক নয়, এতে বীজের গজানোর ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়। ভালোভাবে শুকানোর পর গরম বীজ ঠা-া করে পাত্রে রাখতে হবে। এরপর পুষ্ট বীজ চালুনি দিয়ে বাছাই করে নিতে হবে এবং পরিষ্কার, ছিদ্রমুক্ত ধাতব বা প্লাস্টিকের ড্রাম, টিনের পাত্র অথবা মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ দ্বারা পাত্র সম্পূর্ণরূপে ভর্তি করে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে। বীজের পাত্রে ফাঁকা জায়গা রাখা যাবে না। বীজের পরিমাণ কম থাকলে পাত্রের খালি জায়গা শুকনা পরিষ্কার বালু বা শুকনা তুষ অথবা শুকনা নিমপাতার গুঁড়া দিয়ে পাত্র পূর্ণ করে রাখতে হবে। বীজ ভর্তির পর পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে ভালোভাবে আটকাতে হবে যাতে বাতাস ঢুকতে না পারে। সে জন্য পাত্রের মুখ বন্ধ করার পর পলিথিন দিয়ে বেঁধে রাখা উচিত। পলিথিন ব্যাগে গম বীজ সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই শক্ত প্লাস্টিক বস্তার ভেতরে সমান সাইজের মোটা পলিথিন ব্যাগ ঢুকিয়ে বীজ ভর্তি করে মুখ বেঁধে নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে। বীজের পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা যাবে না। বীজের পাত্র মাচা, বিড়া অথবা তক্তার ওপর এবং ঘরের দেয়াল/বেড়া থেকে একটু দূরে রাখতে হবে। উপরোক্ত নিয়মে সংরক্ষিত গম বীজ পরবর্তীতে আর শুকানোর প্রয়োজন নেই।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, ০১৭১৭১৩৯১৩৯, ই-মেইল snabibari@gmail.com
চৈত্র বাংলা বছরের শেষ মাস। অর্থাৎ আমরা ১৪২৫ বঙ্গাব্দের শেষ অংশে চলে এসেছি। চৈত্র মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এক সাথে করতে হয় বলে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিতে আপনাদের শুভ কামনাসহ সংক্ষিপ্ত শিরোনামে জেনে নেই এ মাসে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশপ্রতি ২৫০ গ্রাম সালফার ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
দেরিতে বপন করা গম পেকে গেলে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বীজ ছায়ায় ঠা-া করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি ইত্যাদিতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব। শতাংশ প্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম। প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম সার দিতে হবে ।
পাট
চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৪, বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৬, বিজেআরআই দেশি পাট-৫, বিজেআরআই দেশি পাট-৬, বিজেআরআই দেশি পাট-৭, বিজেআরআই দেশি পাট-৮। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টিআলু, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন যদি এখনো মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। এ সময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমগাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন-সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভূতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর এক মাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও অ্যান্থাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কান্্জা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কলাবাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে। পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে। নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ বপন করতে পারেন। যাদের বাঁশঝাড় আছে তারা বাঁশঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈবসার প্রয়োগ করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
শীতকাল শেষ হয়ে গরম পড়ার সময়টিতে পোলট্রি খামারি ভাইদের বেশ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে এ সময় রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাই আগ থেকেই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিতে পারে। সেজন্য খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে। চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে, তাই গবাদিপশুর এ সময় বিশ্রাম দিতে হবে। আপনার গবাদিপশুকে ছায়ায় রাখতে হবে এবং বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে, সে সাথে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। গবাদিপশুর গলাফুলা, তড়কা, বাদলা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের আঁতুর পুকুর তৈরির কাজ এ মাসে শেষ করতে হবে। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষিকথায় কৃষি কাজের জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণী সম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এ ছাড়া কৃষিবিষয়ক যে কোনো সমস্যায় আপনার মোবাইল থেকে ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবা: ০১৯১১০১৯৬১০ ই-মেইল-ioag@ais.gov.bd
‘গাভীর মুখে দিলে ঘাস
দুধ পাবেন বারো মাস’
প্রবাদের কথা প্রবাদে সত্যি হলেও বাস্তবে আমাদের দেশের দুগ্ধবতী গাভীপালন ও দুধ উৎপাদনের মোক্ষম হাতিয়ার হলো সবুজ ঘাস; এ ঘাসের বড়ই সংকট। ফলে দেশীয় সংকর জাতের গাভী পর্যাপ্ত ঘাসের অভাবে কৌলিতাত্ত্বিক উচ্চমানসসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সঠিক পরিমাণে দুধ তৈরি করতে পারে না। তদুপরি ১৭ কোটির মানুষের অধ্যুষিত এ দেশে খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে কৃষি জমির ওপর আলাদা লম্বিক চাপ তৈরি হচ্ছে। দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে দুধ উৎপাদনকারী গাভীর দুধ উৎপাদনে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আধুনিক কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন গো-খাদ্য সংকট নিরসনে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। উপযুক্ত পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল মানসম্মত হলে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন করে দুধালো গাভীর সবুজ ঘাসের সংস্থান আমরা সহজেই করতে পারি।
হাইড্রোপনিক ঘাস কি ও কেনো : মাটি ছাড়া শুধু মাত্র পানি ব্যবহারকে ঘাস চাষ করাকে হাইড্রোনিক ঘাস বলে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অপরদিকে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতেও মেধাবী জাতি গঠনে প্রচুর পরিমাণ দুধ ও মাংস উৎপাদন করা প্রয়োজন। দুধ ও মাংস উৎপাদন করতে হলে গাভীর জন্য প্রচুর পরিমাণে কাঁচা ঘাসের প্রয়োজন। আমাদের দেশের অনেক খামারির ঘাস চাষের জমি নেই এবং আবার কিছু খামারি আবাদি জমিতে ঘাস চাষ করতে ও চান না। অথচ প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি ওজনের একটি গাভীকে দৈনিক ১৫ থেকে ২৫ কেজি কাঁচা ঘাস দিতে হবে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করতে জমির প্রয়োজন হয় না তাই ইচ্ছা করলেই সব খামারি খুব সহজেই এ পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করে গরুকে খাওয়াতে পারেন। এ ঘাস বাজারের দানাদার ও মাঠের সবুজ ঘাসের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। তাছাড়া উৎপাদন খরচও খুবই কম। (প্রতি কেজি ১.৫০-২.০০ টা.)
চাষের স্থান : ঘরের ছাদ, ঘরের ভেতরে, নেটহাউস, পানির টানেল, বারান্দা, খোলাজায়গায়, প্লাস্টিকের বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
ব্যবহৃত বীজ : ভুট্টা, গম, ছোলা, সয়াবিন, খেসারি, মাষকলাই এবং বার্লি।
চাষ পদ্ধতি
হাইড্রোপনিক ঘাসের উপকারিতা
এ প্রযুক্তি খুব সহজেই জেলা/উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা যাবে।
মো. ফজলুল করিম
পোলট্রি উন্নয়ন কর্মকর্তা, সরকারি হাঁস মুরগি খামার, রংপুর, মোবাইল : ০১৭২৪১৪১৬৬২ ই-মেইল : fk_ruba@yahoo.com
তেঁতুল (Tamarindus indica) ফলটি ঋধনধপবধব পরিবারের অর্ন্তভুক্ত তেঁতুলের নাম শুনতেই জিভে পানি এসে যায়। তেঁতুল পছন্দ করে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাহলে কী ছেলেরা এ তালিকায় নেই? তাও কী করে বলি! খেতে বসলে দেখা যায়, কোনো কোনো পুরুষ মেয়েদেরও হার মানায়। আসলে এ ফলটি সবার কাছে অন্য এক আকর্ষণ। দক্ষিণ আফ্রিকায় মূল্যবান খাবারের মধ্যে তেঁতুলের স্থান অন্যতম। অথচ গ্রামাঞ্চলের কেউ কেউ মনে করেন, তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায়; সে সাথে বুদ্ধিও কমে। এজন্য বাচ্চাদের তেঁতুল খেতে বারণ করা হয়। এগুলো নিছক কুসংস্কার। বাস্তবে ঠিক উল্টো। তেঁতুল রক্ত পরিষ্কার করে। মস্তিষ্কে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কাঁচা তেঁতুল খেতে টক, পাকা ফল টক-মিষ্টির এক ভিন্ন স্বাদ। তেঁতুল খাবারে স্বাদ বাড়ায়। এজন্য মাংসের রোস্ট, পোলাও, খিচুড়িতে ব্যবহার হয়। তেঁতুলের টক, ভর্তা, ডাল অনেকের প্রিয়। এছাড়া তৈরি করা যায় আচার, সস, জ্যাম, চাটনিসহ আরো খাবার। আছে অনেক পুষ্টি। ভেষজগুণেও টইটম্বুর। এর বীজ নকশি শিল্পে ব্যবহার হয়। এসব কারণে তেঁতুলকে বলা হয় বিস্ময়কর ফল। তাই এর পরিচিতি, গুণাগুণ এবং চাষাবাদ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার।
পরিচিতি : তেঁতুল লেবুজাতীয় ফল। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় তেতৈ আর নোয়াখালীতে বলে তেতি। আদিবাসীরাও বিভিন্ন নামে ডাকে। মারমাদের ভাষায় হাও মং এবং রাখাইনরা বলে তাতু। ইংরেজিতে ট্যামারিন্ড, বৈজ্ঞানিক নাম ট্যামারিন্ডুস ইন্ডিকা। হিন্দিতে ইমলি এবং শ্রীলঙ্কায় ইয়াম্বালা বলা হয়। এর আয়ুর্বেদিক নাম যমদূতিকা। তেঁতুল দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। কয়েকশত বছর ধরে বেঁচে থাকে। আকারেও বেশ বড় হয়। দেখতে খুবই সুন্দর। অধিক শাখা-প্রশাখা থাকায় প্রতিকূলতার সহ্য ক্ষমতা রয়েছে যথেষ্ঠ। গাছের উচ্চতা সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ ফুট হয়ে থাকে। এর আদি নিবাস আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল। তবে সুদান থেকে বীজের মাধ্যমে বাংলাদেশে বংশবিস্তার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ দেশের সব জেলাতে তেঁতুল গাছ থাকলেও রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া এবং গাজীপুরে বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে এমনিতেই জন্মে থাকা এবং অনাদরে বেড়ে ওঠা এ বৃক্ষটির অনুমোদিত জাত নেই। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৯ সালে পাহাড়ি এলাকায় চাষ উপযোগী বারি তেঁতুল-১ নামে একটি মিষ্টি তেঁতুলের জাত উদ্ভাবন করেছে। তেঁতুলগাছে মার্চ মাসে ফুল আসে। এর রঙ হালকা বাদামি। ফল পাকে পরের বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। ফুল থেকে ফল পরিপক্ব হতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হয় গাঢ় বাদামি। এর আকার ৬x৮ ইঞ্চি লম্বা। প্রতিফলে ৫x১২টি বিচি থাকে। বীজ দেখতে খয়েরি। কেউ কেউ এখনো বিশ^াস করেন, তেঁতুল গাছে ভূতের আড্ডাখানা। আর সে কারণে ঘরের পাশে এ গাছ রাখতে মানা। এগুলো অহেতুক ভয়। আসলে তেঁতুলগাছ বহু পাতাবিশিষ্ট বৃক্ষ হওয়াতে স্বাভাবিকভাবে রাতের বেলা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করে, একই সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। এ সময় গাছের নিচের চারপাশে অক্সিজেনের শূন্যতা দেখা দেয়। আর সে মুহূর্তে কোনো লোক যদি গাছের নিচে অবস্থান করে অথবা ঘুমিয়ে থাকে তাহলে অক্সিজেনের অভাবে অজ্ঞান কিংবা ঘাড় বাঁকা হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
পুষ্টিগুণ : তেঁতুলে আছে চোখ ধাঁধানো পুষ্টি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচাফলে (আহারোপযোগী) ক্যালসিয়াম আছে ২৪ মিলিগ্রাম এবং পাকাফলে রয়েছে ১৭০ মিলিগ্রাম। আয়রনের পরিমাণ কাঁচাফলে ১ মিলিগ্রাম এবং পাকাফলে আছে ১০.৯ মিলিগ্রাম করে। কাঁচাফলে অন্য পুষ্টি উপাদানগুলো হলো- ১.১ গ্রাম আমিষ, ১৩.৯ গ্রাম শর্করা, ০.২ গ্রাম চর্বি, ০.০১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১, ০.০২ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১.২ গ্রাম খনিজ লবণ এবং খাদ্যশক্তি আছে ৬২ কিলোক্যালরি। পাকা তেঁতুলে পুষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি। এর প্রতি ফলে ৩.১ গ্রাম আমিষ, ৬৪.৪ গ্রাম শর্করা, ০.১ গ্রাম চর্বি, ০.০৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই, ১১৩ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২৮ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৬২৮ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ৯২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ১.৩ মিলিগ্রাম সিলিনিয়াম, ০.১২ মিলিগ্রাম দস্তা, ০.৮৬ মিলিগ্রাম তামা এবং খাদ্যশক্তি আছে ২৮৩ কিলোক্যালরি।
ভেষজগুণ : ইউনানি, আয়ুর্বেদি, হোমিও এবং অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে তেঁতুল সমাদৃত। এর পাকা ফল হৃদরোগের জন্য উপকারী। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তেঁতুলের সাথে রসুন মিশিয়ে খেলে রক্তের কোলস্টেরল কমে। নিয়মিত তেঁতুল খেলে প্যারালাইসিস রোগীর অনুভূতি ফিরে আসে। টারটারিক অ্যাসিড থাকায় হজমশক্তি বাড়ায়। তাই পেটফাঁপা ও কাশি দূর করতে পুরোনো তেঁতুল গুলে; সে সাথে পরিমাণমতো পানি, লবণ, গুড় অথবা চিনি মিশিয়ে খেতে হবে। বুক ধড়ফড়, মাথা ঘুরানো, হাত-পা জ¦ালা, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয় ও ক্ষুধামন্দা নিরাময়ে বেশ কাজ করে। তেঁতুল অতিরিক্ত ফ্যাট বের করে প্রজননতন্ত্রের কাজ শক্তিশালী করে। ধুতরা, কচু এবং অ্যালকোহলের বিষাক্ততা নিরাময়ে তেঁতুলের শরবত বেশ কার্যকরী। গাছের পাতা ও ছাল অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল। তাই শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি হাঁপানি, চোখ জ্বালাপোড়া এবং দাঁতব্যথা সারিয়ে তুলে। নিয়মিত ঘণ্টাখানিক হেঁটে ২৫-৩০ গ্রাম তেঁতুল খেলে হৃদপি-ে ব্লক হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। গর্ভাবস্থায় মায়েদের বমিবমিভাব দূর করে। কাঁচা তেঁতুল গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা সেরে যায়। মুখে ঘা হলে পানির সাথে তেঁতুল মিশিয়ে কুলকুচা করলে আরাম পাওয়া যায়। নিরাময়েও কাজ হয়। কোনো কোনো এলাকার মানুষ তেঁতুলপাতা বেঁটে, মরিচ ও লবণ মিশিয়ে বড়া বানিয়ে পান্তাভাতের সাথে খান। এতে শরীরে অনেক উপকারে আসে। কচি পাতায় প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। পাতার রস সর্দি, কাশি, প্রস্রাবের যন্ত্রণা, পাইলস, কৃমি ও চোখওঠা সারাতে সহায়তা করে। তেঁতুলের বিচিতে এক ধরনের অ্যানজাইম আছে, যা রক্তের চিনির মাত্রা কমায়। এতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া এর গুঁড়া নিয়মিত খেলে পেটের আলসার ভালো হয়। তেঁতুলের তৈরি শরবত খেতে অন্যরকম স্বাদ। অনেক রোগের মহৌষধ। শরবত বানানোর জন্য আধাকাপ পরিমাণ পানিতে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হয়। এরপর ছাকুনি দিয়ে ছেঁকে, অন্য পাত্রে দেড় কাপ পানিতে পরিমাণমতো গুড় গুলিয়ে, সে মিশ্রণ মেশাতে হবে। সাথে থাকবে আয়োডিনযুক্ত লবণ। পরে আরো এক কাপ স্বাভাবিক কিংবা ঠাণ্ডা পানি। এভাবেই হয়ে যাবে ভেষজ শরবত। এরপর গ্লাসে ঢেলে রুচিমতো লেবুর রস দিয়ে নিজে খাওয়া এবং অন্যদের পরিবেশন। তেঁতুলের পাতা দিয়ে ভেষজ কীটনাশক তৈরি করা যায়। এজন্য একটি পাত্রে এক লিটার পানির সাথে ১০x১২ গ্রাম শুকনো পাতা এক সপ্তাহ ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এবার ঢাকনা সরিয়ে ২/৩ টুকরা রঙিন পলিথিন দিয়ে এমনভাবে মুখ বন্ধ করতে হবে যেন ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। এভাবে এক সপ্তাহ রেখে দিতে হয়। এবার ছাকুনির সাহায্যে ছেঁকে নিলেই হয়ে যাবে ফসলের ক্ষতিকর পোকা মারার কীটনাশক। ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার ভেষজ কীটনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
উৎপাদন ব্যবস্থাপনা : সাধারণত বীজ দিয়ে বংশ বিস্তার হয়। গুটি কলমের মাধ্যমেও করা সম্ভব। বীজ দিয়ে সহজেই চারা তৈরি করা যায়। বপনের আগে বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা দরকার। এরপর মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ পলিব্যাগে ভর্তি করে সেখানে বপন করতে হয়। এ কাজ অতিরিক্ত বর্ষা এবং প্রচ- শীত ব্যতীত অন্য যে কোনো সময় করা যেতে পারে। চারার বয়স ২/৩ মাস হলে মূল জমিতে লাগানো যায়। তেঁতুলের অনুর্বর মাটিও জন্মে। কিন্তু উর্বর মাটিতে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায়। বর্ষাকাল রোপণের উপযুক্ত সময়। চারা রোপণের জন্যে একটি উপযুক্ত গর্ত তৈরি করতে হয়। এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা হবে ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি করে। গাছ হতে গাছের দূরত্ব ২৫-২৬ ফুট। গর্তপ্রতি যেসব জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে তা হলো; গোবর ২০ কেজি, টিএসপি ২০০ গ্রাম এবং এমওপি ২৫০ গ্রাম করে। এসব সার দেয়ার ২৫-৩০ দিন পর চারা লাগাতে হবে। গাছ লাগানোর এক বছর পর গাছপ্রতি ১০-১৫ কেজি জৈব সার; রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া ও টিএসপি ২০০-৩০০ গ্রাম করে, সে সাথে ৩০০-৪০০ গ্রাম হিসেবে এমওপি প্রয়োগ করতে হয়। এসব সার দুইভাগ করে বছরে দুইবার; একবার বর্ষার আগে মার্চ মাসে, আরেকবার বর্ষার পর সেপ্টেম্বর মাসে দিতে হবে। দুপুরবেলায় মাটিতে গাছের ছায়া যতটুকু পড়ে ততোটুকু স্থানে ৬ ইঞ্চি গভীর করে ভালোভাবে কুপিয়ে সার দেয়া উত্তম। অথবা গাছের গোড়া হতে ২/৩ ফুট বাদ দিয়ে এরপর ৬/৭ ফুট পরিমাণ জমি বৃত্তাকারে অনুরূপভাবে কুপিয়ে দিলেও হবে। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হয়। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। তাই প্রতি বছর সারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। খরার কারণে রসের অভাব দেখা দিতে পারে। সেজন্য পরিমাণমতো সেচ দিতে হবে। আগাছা খাবারের ভাগ বসায়। এছাড়া ক্ষতিকর পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই গাছের গোড়ায় কিংবা আশপাশে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের মরা ডাল কিংবা অবাঞ্ছিত অংশ ছেঁটে দিতে হয়। ডালের সংখ্যা অতিরিক্ত হলে কিছু কেটে পাতলা করতে হবে যেন, পর্যাপ্ত আলো বাতাস পাওয়া যায়। ছাঁটাইয়ের কাজ শীত মৌসুমে করতে হয়। গরু-ছাগলের আক্রমণ হতে রেহাই পাওয়ার জন্য চারা অবস্থায় গাছের চারদিকে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তেঁতুলে সাধারণত রোগপোকা হয় না। তবে বার্ষাকালে কখনো কখনো ছত্রকের আক্রমণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে কোনো ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। বীজ হতে উৎপাদিত গাছ রোপণের ৭/৮ বছর পর হতে ফল দেয়া শুরু করে। কলমের গাছে সময় লাগে ২/৩ বছর। পরিণত বয়সে গাছপ্রতি গড় ফলন প্রায় ৩০০ কেজি।
তেঁতুলের ফল, বিচি, পাতা, ফুল, গাছের বাকল প্রতিটি মূল্যবান। এছাড়া গাছের গুঁড়ি মাংস কাটার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এর গুণের কথা উপলব্দি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অন্য ফলের পাশাপাশি তেঁতুলগাছ লাগানোর আহ্বান জানান। তাই আসুন প্রতিটি বসতবাড়িতে তেঁতুল গাছ রোপণ করি। ফল রপ্তানির মাধ্যমে অর্জন করি বড় অঙ্কের অর্থ।
নাহিদ বিন রফিক
টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর : ০১৭১৫৪৫২০২৬ ঃ tpnahid@gmail.com
একাঙ্গী (Kaempferia galanga L.) খ.) এটি জিনজিবারেসি (Zingiberaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ। একে অনেক সময় বাংলায় ভুঁই চম্পা বা সুরভি আদা বলা হয়। তবে বাংলাদেশে এপি একাঙ্গী/একানী নামে বেশি পরিচিত। এর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ চীন অথবা ভারত বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে এর চাষ করা হয়। এর পাতা পুরু, গোলাকৃতি এবং মাটির সঙ্গে লাগানো অবস্থায় থাকে। নতুন পাতা ক্ষুদ্র রাইজোম থেকে বের হয়ে। গ্রীষ্মকালে ১-২টি সাদা রঙের ফুল ফোটে। শীতকালে পাতা মরে যায় এবং রাইজোম সুপ্ত অবস্থায় চলে যায়। এর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ চীন অথবা ভারত বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে এর চাষ করা হয়। যেসব এলাকায় আদা ও হলুদ চাষ হয় সেসব এলাকায় একাঙ্গী চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাংলাদেশে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ ইত্যাদি এলাকাতে একাঙ্গীর চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াতে একাঙ্গীর চাষ হয়ে থাকে। এটি মসলা ফসল ও মাছের চার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটিতে বিদ্যমান এসেনসিয়াল অয়েল বিভিন্ন কারি (Curry) তৈরিতে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটিতে বিভিন্ন পারফিউম ও কসমেটিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। একাঙ্গী রক্ত পরিষ্কারক, পাকস্থলীর ঘা সারাতে ও ঠাণ্ডাজনিত রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন পানীয় (Soft Drink) জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরিতে এটি কাঁচামাল (Raw Materials) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মালয়েশিয়াতে মসলা ফসল হিসেবে চালের সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। থাইল্যান্ডেও এটি জনপ্রিয় মসলা হিসেবে স্যুপ ও বিভিন্ন (Curry) কারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সব এলাকা হতে শুকনো একাঙ্গী বাংলাদেশে বিভিন্ন ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহারসহ বিদেশে সীমিত আকারে রপ্তানি হয়। একাঙ্গীর উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা একাঙ্গীর বেশ কয়েকটি লাইনের ওপর গবেষণা চালিয়ে বারি একাঙ্গী-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যা কম বেশি সারা দেশে চাষ করা সম্ভব। জাতটি ২০১৭ সালে অবমুক্ত হয়। জাতটির বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন প্রযুক্তি নিম্নে বর্ণনা করা হলো। জাতের বৈশিষ্ট্য
বারি একাঙ্গী-১
এটি একটি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার। পাতার দৈর্ঘ্য ১২-১৫ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ১০-১২ সেন্টিমিটার। রাইজমের দৈর্ঘ্য ৫.৫-৬.৫ সেন্টিমিটার। প্রতিটি রাইজমে ফিঙ্গারের সংখ্যা ৬-৮টি। ইহা রোগ ও পোকা সহনশীল। ফলন ১২-১৫ টন/ হেক্টর।
উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি ও জলবায়ু : প্রায় সব ধরনের মাটিতেই একাঙ্গীর চাষ করা সম্ভব। তবে পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটি একাঙ্গী চাষের জন্য উত্তম। একাঙ্গী চাষের জন্য উপযোগী পিএইচ হলো ৬-৬.৫। বার্ষিক ২৫০০-৩০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত একাঙ্গী চাষের জন্য উত্তম। ৩০-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় একাঙ্গীর দৈহিক বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়। একাঙ্গী হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে চাষ করা যায়।
বীজ শোধন : ১০০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ অথবা অটোস্টিন মিশিয়ে বীজকে ৩০-৪৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে শোধন করতে হবে। ভিজানো বীজকে ছায়াযুক্ত জায়গায় শুকিয়ে তারপর জমিতে রোপণ করতে হবে।
মাটি শোধন : গভীরভাবে চাষ দিয়ে মাটি উল্টিয়ে রেখে দিলে রোগ জীবাণু ও পোকামাকড় সূর্যের তাপে নষ্ট হয়ে যায়। মাটির ওপর খড়কুটা দিয়ে পুরু স্তর তৈরি করে পুড়িয়ে অথবা জমিতে বিঘা প্রতি ১.৫-২.০ কেজি ফুরাডান বা নিম কেক (২ কেজি/শতকে) প্রয়োগের মাধ্যমেও মাটি শোধন করা যায়।
রোপণ সময় : এপ্রিলের ১ম সপ্তাহ থেকে মে মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত একাঙ্গী লাগানোর উপযুক্ত সময়। বিলম্বে রোপণ করলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হয়।
বীজের আকার ও হার : ২০-২৫ গ্রাম ওজনের রাইজোম রোপণের জন্য উত্তম। বীজের হার নির্ভর করে রাইজোমের আকার আকৃতির ওপর। বীজ হিসেবে মোথা উত্তম ও ফলন বেশি দেয়। তবে ছড়া (ঋরহমবৎ) ব্যবহার করলে কম পরিমাণে বীজের দরকার হয়। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১২০০-১৪০০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরি ও রোপণ দূরত্ব : জমি তৈরি করতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিতে হবে। সাধারণত একাঙ্গীর জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০-৫০ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার রাখা হয়। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত নালা রাখাতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যায়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : ভালো ফলন পাওয়ার জন্য জমিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈব রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। একাঙ্গী চাষের জন্য হেক্টর প্রতি নিম্নে উল্লেখিত পরিমাণে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক এবং অর্ধেক এমওপি সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক বীজ রোপণের ৬০ দিন পর পাশ্ব প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার দুই কিস্তিতে বীজ রোপণের ৯০ ও ১২০ দিন পর পাশর্^ প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় দুই দিক থেকে মাটি উঠিয়ে দিতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগের আগে জমি আগাছা মুক্ত করতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা : মাটিতে আর্দ্রতা কম থাকলে বীজ রোপণের পরপরই সেচ দিতে হবে। একাঙ্গীর সঠিক বৃদ্ধি ও পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। একাঙ্গীর গজানোর পর ফসলের সাথে আগাছার প্রতিযোগিতা রোধ করার জন্য জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এভাবে যতবার সম্ভব প্রয়োজন অনুসারে ফসলকে আগাছামুক্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হলে একাঙ্গীর জমিতে সেচ দিতে হবে। জমিতে এমনভাবে সেচ দিতে হবে যাতে জমিতে পরিমিত রস থাকে কিন্তু জমি অতিরিক্ত ভেজা/দাঁড়ানো পানি না থাকে।
আন্তঃফসল চাষ : একাঙ্গী হালকা ছায়া পছন্দ করে কাজেই একাঙ্গীর সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে মরিচ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, লালশাক, শিম, লাউ ইত্যাদি ফসল চাষ করা যায়। এ ছাড়া নতুন ফলের বাগানে সারি ফল গাছের মাঝে আন্তঃফসল/মিশ্র ফসল হিসেবে একাঙ্গীর চাষ করা যায়।
ফল সংগ্রহ : সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে একাঙ্গী ওঠানো হয়। একাঙ্গী রোপণের ৯-১০ মাস পর গাছের পাতা যখন হলুদ রঙ ধারণ করে শুকিয়ে যায় তখনই একাঙ্গী সংগ্রহের উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংগ্রহের পর একাঙ্গীতে লেগে থাকা মাটি, শিকড়, গাছের কা- ও পাতা পরিষ্কার করতে হবে।
সংরক্ষণ : সাধারণত একাঙ্গীর ক্ষেত্রে ছড়া (Finger) ও মোথাকে বীজ হিসেবে রাখা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মোথা হতে উৎপন্ন গাছ অপেক্ষাকৃত সবল হয়। এ ছাড়াও বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে তবে এক্ষেত্রে ফলন কম হয়। একাঙ্গীর রাইজোমকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পের জন্য ব্যবহার উপযোগী করা হয়। বাছাইকৃত রাইজোম বা ছড়া মাটির গর্তে রাখলে বেশি দিন পর্যন্ত ভালো রাখা যায়। ১x১x১ ঘনমিটার গর্ত করে তা বেশ কয়েক দিন খোলা রেখে শুকিয়ে নিতে হবে। গর্তের গভীরতা বেশি হলে অধিক আর্দ্রতার কারণে একাঙ্গীর শিকড় ও গজানোর পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। গর্ত একাঙ্গী দিয়ে ভর্তি করার পর ওপরে খড় বিছিয়ে মাটি চাপা দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিতে হবে। বীজ একাঙ্গী মাটির গর্তে রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে একাঙ্গীর আর্দ্রতা ধরে রাখা। কারণ খোলা বাতাসে থাকলে একাঙ্গীর সতেজতা ও ওজন কমে যায়।
ফলন : সাধারণত প্রতি হেক্টর ১২-১৫ টন একাঙ্গীর ফলন পাওয়া যায়।
রোগবালাই : একাঙ্গীতে রোগবালাই তুলনামূলকভাবে কম হয়। তবে মাঝে মধ্যে নেতিয়ে পড়া (Wilt) রাইজোম রুট ইত্যাদি রোগ দেখা যায়।
রাইজম রট/কন্দ পচা : কন্দ পচা রোগ একাঙ্গী ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং এ রোগে রাইজোম আংশিক থেকে সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বীজ, মাটি, ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতি ও পানির মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার ঘটে। পিথিয়াম এফানিডারমেটাম (Phythium aphanidermatum) নামক ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও রাইজোম ফ্লাই এ রোগের জন্য দায়ী।
রোগের লক্ষণ
১. গাছের গোড়ায় কন্দতে প্রথমে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। পরে ওই স্থানে পচন দেখা যায় এবং ক্রমান্বয়ে কন্দের বেশি অংশ পচে যায়।
২. আক্রান্ত গাছের শিকড়ও পচতে শুরু করে এবং গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে।
৩. আক্রান্ত কন্দ থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। এই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে রাইজোম ফ্লাই নামক পোকা রাইজোমে আক্রমণ করে।
৪. গাছের ওপরের অংশে পাতা হলুদ হয়ে যায়। পাতায় কোনো দাগ থাকে না।
৫. হলুদ ভাবটা পাতার কিনারা দিয়ে নিচে নামতে থাকে কিন্তু ভেতরটা তখনও সবুজ থেকে যায়।
৬. পরে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।
৭. রাইজোম পচে যাওয়ার ফলে ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
রোগের প্রতিকার :
১. আক্রান্ত গাছ মাটিসহ উঠিয়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
২. আক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩. রোগবিহীন কন্দ সংগ্রহ করে বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
৪. আক্রান্ত জমিতে শস্যপর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫. মাঠে যথাযথ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. রিডোমিল গোল্ড বা অটোস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ওই দ্রবণের মধ্যে বীজ আদা আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করে উঠিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
৭. অর্ধকাঁচা মুরগির বিষ্ঠা (৫ টন/ হেক্টর) একাঙ্গী রোপণের ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৮. রোগ দেখা দেওয়া মাত্রই রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে অথবা সিক্যুয়র প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড়
মাজরা পোকা : এ পোকার কীড়া কা- ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত কাণ্ডের ওপরের অংশ মরে যায়।
পাতা মোড়ানো পোকা : এ পোকার কীড়া পাতা মুড়িয়ে ভেতরে বাস করে এবং পাতা খেয়ে গাছের সমূহ ক্ষতি করে। মাঠে রাইজম থেকে রস চুষে খায়। সংরক্ষণের সময় এই পোকা রাইজমকে পচিয়ে ফেলে।
দমন
১. আক্রান্ত কাণ্ড/পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
২. নাইট্রো/রিপকর্ড/ক্যারাটে (১.০ মিলিলিটার/লিটার পানিতে) ৭ দিন পর পর পাতায় স্প্রে করতে হবে।
৩. দানাদার ইনসেকটিসাইড (ফুরাডান) প্রতি বিঘায় ৩-৪ হারে মাটিতেহ প্রয়োগ করতে হবে।
ড. মো. নুর আলম চৌধুরী
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, শিবগঞ্জ, বগুড়া, মোবাইল : ০১৭১১২৪৬৩৫২dmnalam@yahoo.com
বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভাতের পরই ডালের স্থান। ডাল প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য। এতে প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ। প্রোটিন ছাড়া অত্যধিক লাইসিন, পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা, চর্বি ও খনিজ রয়েছে। ডাল হিসেবে আমরা মূলত ছোলা, মটর, অড়হর, মাষকলাই, মসুরের বীজকে বুঝে থাকি। এ দেশে প্রায় সব রকমের ডালই চাষ করা হয়। এসবের মধ্যে মুগডাল অন্যতম। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি চাষ করেও ভালো দাম পাওয়া সম্ভব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুগডালের আবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল জেলায় আবাদ বেশি হয়।
জাত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক মুগের একাধিক উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বারি মুগ-২ (কান্তি), বারি মুগ-৩ (প্রগতি), বারি মুগ-৪ (রূপসা), বারি
মুগ-৫ (তাইওয়ানি), বারি মুগ-৬। এ ছাড়া বাংলাদেশে পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৬ ও বিনামুগ-৮।
জাতগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
বারি মুগ-২ (কান্তি) : গাছের উচ্চতা ৪০-৪৫ সেমি.। বীজের রঙ সবুজ। বীজের ত্বক মসৃণ। হাজার বীজের ওজন ৩০-৪০ গ্রাম। এ জাতটি দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ এবং রবি মৌসুমের শেষ দিকেও চাষ করা যায়। আমিষের পরিমাণ ২০-২৪%। জীবনকাল ৬০-৬৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ০.৯-১.১ টন। জাতটি সারকোস্পোরা দাগ ও হলদে মোজাইক রোগ সহনশীল।
বারি মুগ-৩ (প্রগতি) : দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি মৌসুমে বিলম্বে আবাদ করা যায়। আমিষের পরিমাণ ১৯-২১%। জীবনকাল ৬০-৬৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.০-১.১ টন। জাতটি সারকোস্পোরা দাগ ও হলদে মোজাইক ভাইরাস রোগ সহনশীল।
বারি মুগ-৪ (রূপসা) : এ জাত দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি মৌসুমে বিলম্বে বপন করা যায়। জাতটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি মুগ-৫ (তাইওয়ানি): গাছের পাতা, ফল ও বীজ আকারে বেশি বড়। বীজের রঙ গাঢ় সবুজ। হাজার বীজের ওজন ৪০-৪২ গ্রাম। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ফল একসাথে পাকে।
বারি মুগ-৬ : গাছের উচ্চতা ৪০-৪৫ সেমি.। একই সময়ে প্রায় সব শুঁটি পরিপক্ব হয়। পাতা ও বীজের রঙ গাঢ় সবুজ। দানার আকার বড়। প্রতি ১০০ বীজের ওজন ৫.১-৫.২ গ্রাম। গম কাটার পর এপ্রিলের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায়। এ ছাড়া খরিফ-২ ও রবি মৌসুমের শেষেও বপন করা যায়। হলুদ মোজাইক ভাইরাস এবং পাতায় দাগ রোগ সহনশীল। জীবনকাল ৫৫-৫৮ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৫ টন।
বিনামুগ-৫ : সব ফল প্রায় একই সাথে পাকে। এ জাতটি কান্তি অপেক্ষা ৭-১০ দিন আগে পাকে। বীজের আকার কান্তি অপেক্ষা বড় এবং রঙ উজ্জ্বল সবুজ। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৪ টন। পাতা হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সারকোস্পোরা রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।
বিনামুগ-৬ : সব ফল প্রায় একই সাথে পাকে। জীবনকাল ৬৪-৬৮ দিন। অনুমোদিত জাত কান্তি অপেক্ষা ১০-১২ দিন আগে পাকে। বীজের আকার কান্তি অপেক্ষা বড় এবং রঙ উজ্জ্বল সবুজ। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ১.৪ টন। পাতা হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সারকোস্পোরা রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।
বিনামুগ-৮ : গাছের উচ্চতা মাঝারি (৩৫-৪০ সে.মি)। জীবনকাল কম, বপন থেকে পরিপক্ব পর্যন্ত ৬৪-৬৭ দিন। বীজের আকার মাঝারি ও উজ্জ্বল। ১০০ বীজের গড় ওজন ৪.০ গ্রাম। গ্রীষ্মকালে চাষ উপযোগী, এটি দিন নিরপেক্ষ বিধায় শীতকালেও চাষাবাদ করা যায়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.৮ টন। ভালোভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ২.২টন ফলন পাওয়া সম্ভব।
উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি : বেলে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি মুগ চাষের জন্য উত্তম। জমিটি হতে হবে মাঝারি উঁচু। মুগের জন্য জলাবদ্ধতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি : জমিতে ‘জো’ আসার পর ভালোভাবে ৩-৪টি চাষ দিতে হবে এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম হার বেড়ে যায়। এছাড়া জমির সকল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
বপনের সময় : এলাকাভেদে মুগের বপন সময়ের তারতম্য দেখা যায়। খরিফ-১ মৌসুমে ফাল্গুন মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত (ফেব্রুয়ারির শেষ হতে মার্চের মধ্য ভাগ)। খরিফ-২ মৌসুমে শ্রাবণ-ভাদ্র মাস (আগস্টের প্রথম হতে সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগ)। রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলের জন্য বপনের উত্তম সময় হচ্ছে পৌষ-মাঘ মাস (জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ হতে ফেব্রুয়ারির মধ্য ভাগ)।
সতর্কতা : আষাঢ় মাসে (মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই) অবিরাম বৃষ্টিতে মুগের ফল পচে যায়। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে (মধ্য মার্চ) বীজ বপন সম্পন্ন করতে পারলে আষাঢ় মাসের আগেই ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং ফল পচনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে অনুমোদিত সময়ের আগে বীজ বপন করলে শীতের কারণে চারা মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বীজের হার : জাতভেদে মুগের বীজের হার ভিন্ন হয়ে থাকে। বারি মুগ-২, বারি মুগ-৩ ও বারি মুগ-৪ এর জন্য হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি। বারি মুগ-৫ এর জন্য ৪০-৪৫ কেজি বীজের প্রয়োজন। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ সামান্য বেশি দিতে হবে।
বপন পদ্ধতি : ছিটিয়ে ও সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করা যায়। তবে সারিবদ্ধভাবে বোনা উত্তম। এক্ষেত্রে সারি হতে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০-১৫ সেমি. হলে ভালো হয়। বীজের গভীরতা ৩-৪ সেমি. হলে অঙ্কুরোদগমতা বেশি হয়।
সারের পরিমাণ : জমিতে হেক্টরপ্রতি নি¤œরূপ সার প্রয়োগ করতে হয়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : শেষ চাষের সময় সমুদয় সার প্রয়োগ করতে হবে। অপ্রচলিত এলাকায় আবাদের জন্য সুনির্দিষ্ট অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম অনুজীব সার প্রয়োগ করলে ভালো হয়। অনুজীব সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : মুগডালের ভালো ফলন পেতে হলে ক্ষেতের আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ছিটানো পদ্ধতিতে আগাছা দমন কঠিন হলেও কাজটি যথাসময়ে করতে হবে। ভালো ফলন পেতে হলে বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। অতিবৃষ্টির ফলে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে না পারে সে জন্য অতিরিক্ত পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া খরিফ-১ মৌসুমে বৃষ্টি না হলে বপনের আগে বা পরে একটি সেচ দিতে হবে। সেচ দিলে চারা গজানোর পর মালচিং করে দিতে হবে।
রোগ ও পোকা
রোগ
মুগের পাতার দাগ রোগ দমন : সারকোস্পোরা ক্রোয়েন্টা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। পাতায় ছোট ছোট লালচে বাদামি বর্ণের গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। আক্রান্ত পাতা ছিদ্র হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়। পরিত্যক্ত ফসলের অংশ, বায়ু ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বেশি আর্দ্রতা (৮০%) এবং উচ্চ তাপে (২৮ ডিগ্রি সে.) এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার
১. ব্যাভিস্টিন নামক ছত্রাকনাশক ১ গ্রাম/লিটার পানি হারে ১২-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার (বারি মুগ-২, ৩ ৪ এবং ৫) করতে হবে।
মুগের পাউডারি মিলডিউ রোগ দমন : ওইডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগে পাতায় পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। সাধারণত শুল্ক মৌসুমে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার
১. বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. টিল্ট-২৫০ ইসি ১ মিলি/লিটার পানি বা থিওভিট ২ গ্রাম/লিটার পানি হারে ১০-১২ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মুগের হলদে মোজাইক রোগ দমন : মোজাইক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতার ওপর হলদে সবুজ দাগ পড়ে। সাধারণত কচি পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাদা মাছি নামক পোকা এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বিকল্প পোষক ও সাদা মাটির আধিক্য এ রোগ দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।
প্রতিকার
১. রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২. সাদা মাছি দমনের জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
৩. আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
পোকা : মুগের জমিতে বিছাপোকা ও শুটি ছিদ্রকারী পোকা দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ডেসিস ২.৫ ইসি বা সিমবুস ১০ ইসি ১ মিলি/লি পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ : মুগডাল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা খুবই কষ্টকর। তাছাড়া অনেক জাত রয়েছে যেগুলোর ফল একসাথে পাকে না তাই কয়েকবারে সংগ্রহ করতে হয়। অন্যদিকে যেসব জাতের ফল প্রায় একসাথে পাকে সেগুলো একবারেই সংগ্রহ করা যায়। এক্ষেত্রে ফল পরিপক্ব হলে কাঁচি দিয়ে গোড়া থেকে গাছগুলো কেটে নিতে হয়। এভাবে কাটা হলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অতঃপর গাছগুলো ভালোভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে মুগডাল সংগ্রহ করা হয়।
ফলন : বপন/রোপণ সময় এবং জাতের ভিন্নতার কারণে ফলনেরও ভিন্নতা হয়ে থাকে। সঠিক যতœ ও পরিচর্যার মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি গড়ে ১-১.৫ টন পর্যন্ত ফলন হতে পারে।
মো. শাহাদাত হোসেন
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল, মোবাইল : ০১৭১৮৪০১৭৩৬, ই-মেইল :barisal@ais.gov.bd
তেল জাতীয় ফসলগুলোর মধ্যে সূর্যমুখী পৃথিবীর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ দেশের মাটি ও জলবায়ু সূর্যমুখী চাষের জন্য খুবই উপযোগী। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে এর চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে এর চাষ করলে ফলন ভালো পাওয়া যায়।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে সূর্যমুখী তেলে কোনো কোলেস্টেরল নেই বললেই চলে এবং যথেষ্ঠ পরিমাণে লিনোলিক অ্যাসিড থাকায় এ তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। দেশীয় তেল নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করা যায়। সূর্যমুখীর পরিপক্ব বীজে ৪০-৪৫ ভাগ তেল সঞ্চিত থাকে।
তেল হিসেবে চাষ করলে একদিকে যেমন লাভবান হওয়া যায় তেমনি অন্যদিকে এর খৈল গবাদিপশু ও মাছের উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং গ্রামাঞ্চলে এর কাণ্ড জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। শুধু তেল হিসেবে নয়, ইদানীং অনেকেই বাসাবাড়ির গেট, ছাদ বা ছাদের কার্নিশ, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির ও মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠ এবং শৌখিন ঊর্ধ্বতন অফিস প্রধানদের বাংলোর সামনে শোভাবর্ধনের জন্য ব্যাপকভাবে সূর্যমুখীর চাষ করে থাকে।
সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে- দেশে ভোজ্যতেলের ঘাটতি রয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণে। তেলের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি সুস্থ-সবল ও নিরোগভাবে বেঁচে থাকলে হলে কোলেস্টেরল মুক্ত ভোজ্যতেল সূর্যমুখীর চাষ বাড়াতে হবে।
চাষ পদ্ধতি
মাটি : প্রায় সব ধরনের মাটিতে সূর্যমুখীর চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত মাঝারি উঁচু দোআঁশ মাটি সূর্যমুখী চাষের জন্য উপযোগী। ইদানীং সেচ সুবিধা বরেন্দ্র অঞ্চলসহ চরাঞ্চলের বেলে দোআঁশ ও উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত মাটিতেও ব্যাপকভাবে এর চাষ হচ্ছে।
জাত: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চাষ উপযোগী ২টি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাত দু’টো হচ্ছে- সূর্যমুখী কিরণী (ডিএস-১) এবং বারি সূর্যমুখী- ২।
বীজের পরিমাণ : বিঘা প্রতি সূর্যমুখী কিরণী (ডিএস-১) বীজ লাগে ১ - ১.৫ কেজি এবং বারি সূর্যমুখী-২ এর বিঘা প্রতি বীজ লাগে ১.৫ - ২ কেজি।
জমি তৈরি : বাণিজ্যিক ভাবে চাষের জন্য জমি গভীরভাবে ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে সমান করে নিতে হবে।
সার প্রয়োগ: জমি চাষের আগে বিঘাপ্রতি পচা গোবর বা আর্বজনা পচা সার ১-১.৫ টন ছিটিয়ে জমি চাষ করতে হবে। শেষ চাষে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া সার ৮-১০ কেজি, ট্রিপল সুপার ফসফেট ২০-২৫ কেজি, মিউরেট অব পটাশ ২০-২৫ কেজি. জিপসাম ১৫-২০ কেজি, জিংক সালফেট ২ কেজি ছিটিয়ে চাষের কাজ শেষ করতে হবে।
বীজ বপন : সূর্যমুখীর বীজ সারি করে লাগানো ভালো। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫-২ ফুট এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি।
উপরি সার প্রযোগ : ভালো ফলনের জন্য কমপক্ষে ২ বার কিছু পরিমাণ রাসায়নিক সার উপরি প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। বীজ থেকে চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর ১ম বার এবং বীজ থেকে চারা গজানোর ৪০-৪৫ দিন দ্বিতীয় বার বিঘাপ্রতি ইউরিয়া সার ৮-১০ কেজি এবং তার সাথে এমওপি সার ৪-৫ কেজি একত্রে মিশিয়ে চারার গোড়ার চারিধারে কিছুটা দূর দিয়ে ছিটিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে হালকাভাবে পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
গাছ পাতলাকরণ: অতিরিক্ত গাছ থাকলে গাছ সুস্থ-সবল ও গাছের বাড়-বাড়তি ভালো হয় না, তাই চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর প্রতি গোছায় ১টি সুস্থ-সবল নিরোগ চারা/গাছ রেখে বাকি গাছগুলো তুলে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আগাছা: আগাছা যে কোনো ফসলের প্রধান শত্রু। ক্ষেতে
আগাছা থাকলে ব্যবহার করা খাদ্যে ভাগ বসাই। গাছের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। গাছের বাড়-বাড়তি কমে যায়। গাছ দুর্বল হয় এবং ফলন কমে যায়। তাই ক্ষেতে আগাছা দেখা মাত্রই তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আগাছা দমনে নিড়ানি সাবধানে ব্যবহার করতে হবে যাতে নিড়ানির ধারালো আগায় গাছের শিকড় বা কা- কেটে বা ছিঁড়ে না যায়।
সেচ: সূর্যমুখী চাষের জন্য সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাণিজ্যিক চাষে ভালো ফলনের জন্য কমপক্ষে ৩ বার সেচ দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ১ম সেচ বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর অর্থাৎ গাছে ফুল আসার আগে, ২য় সেচ বীজ বপনের ৪৫-৫০ দিন পর পুষ্পস্তবক তৈরির সময় এবং ৩য় বার সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ৬৫-৭০ দিন পর অর্থাৎ বীজ পুষ্ট হওয়ার আগে।
রোগ-বালাই: সূর্যমুখী ক্ষেতে সাধারণত পাতা ঝলসানো ও শিকড় পচা রোগ হতে পারে। ক্ষেতে যাতে পানি না জমে সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে নিকটস্থ কৃষিকর্মীর পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফসল কর্তন ও ফলন : সূর্যমুখীর বীজ বোনার ৬৫-৭০ দিন
পর ফুলের বীজ পুষ্ট হওয়া শুরু হয়। সূর্যমুখী কাটার সময় হলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে আসে এবং পুষ্পস্তবকসহ (মাথা) গাছগুলো নুয়ে পড়ে। বীজ কালো রং ধারণ করে এবং দানাগুলো পুষ্ট ও শক্ত হয়। মৌসুম অনুসারে ফসল পরিপক্ব হতে ৯০-১১০ দিন সময় লাগে।
ফলন: মৌসুম অনুসারে বিঘাপ্রতি গড় ফলন ৬-৮ মণ পর্যন্ত হতে পারে।
তেল নিষ্কাশন: সূর্যমুখীর বীজ দেশীয় যন্ত্রে নিষ্কাশন করলে শতকরা ২৫ ভাগ এবং এক্সপোলারে নিষ্কাশন করলে শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত তেল পাওয়া যেতে পারে।
বীজ সংরক্ষণ : বীজ সংরক্ষণের পূর্বে অপরিপক্ব ও ভাঙা বীজগুলো বাছাই করে ফেলে দিতে হবে। সুস্থ-সবল নিরোগ ও ঝকঝকে পরিষ্কার বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে নিতে হবে। প্রতি ৩০ কেজি বীজের জন্য ২৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ ভেতরে পলিথিন দিয়ে চটের বস্তা, মোটা পলিথিন ব্যাগ বা টিনের ড্রামে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত পরামর্শের জন্য নিকটস্থ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উপজেলা কৃষি অফিস কিংবা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
তুষার কুমার সাহা
এ,আই, সিও, কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক কার্যালয়, রাজশাহী, মোবা : ০১৭১৬৪৩৯০৮৩,tushar521964@gmail.com
মিষ্টি আলু দেশের সর্বত্রই কিছু না কিছু চাষ হয়ে থাকে। এতে প্রচুর শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন এ বিদ্যমান। মিষ্টি আলুর চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিষ্টি আলু ফলন কম হওয়ার প্রধান কারণ বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ। মিষ্টি আলুর ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর রোগবালাই দমন অত্যাবশ্যকীয়। তাই নিম্নে মিষ্টি আলুর কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. রোগের নাম : পাতা, বোঁটা ও কাণ্ডে দাগ পড়া (Alternaria leaf, petiole and stem spot) রোগ
রোগের কারণ: অলটারনারিয়া ব্যাটাটিকোলা (Alternaria bataticola) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার :
আক্রান্ত লতা, বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বৃষ্টি, আর্দ্র ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া এ রোগ বৃদ্ধির সহায়ক। আক্রান্ত পাতার ওপর ছত্রাকের বীজ কণা সৃষ্টি হয় এবং পরে বাতাসের মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ :
এ রোগ সাধারণত পুরাতন ও পরিপক্ব পাতায় বেশি দেখা যায়।
রোগের আক্রমণে পাতার গায়ে বাদামি রঙের চক্রাকার দাগ দেখা যায় যা গোলাকার সীমারেখা দ্বারা আবৃত থাকে।
অনেক দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে।
দাগগুলো পুরাতন হয়ে গেলে পাতার আক্রান্ত স্থানের টিস্যু ভেঙে যায় ও পাতা ঝরে পড়ে।
দাগ কাণ্ড ও পাতার বোঁটায়ও দেখা যায়, দাগগুলো বড় হয়ে কাণ্ডকে ঘিরে ফেলে।
রোগের প্রতিকার :
ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে।
সুস্থ, সবল ও জীবাণুমুক্ত লতা ব্যবহার করতে হবে।
জমিতে শস্যপর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
পাতায় দাগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা ডাইফেনাকোনাজল + এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে ¯েপ্র করতে হবে।
২. রোগের নাম : নরম পচা (Soft rot) রোগ
রোগের কারণ : রাইজোপাস নিগ্রিক্যানস (Rhizopus nigricans) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার :
আক্রান্ত টিউবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ :
এ রোগের আক্রমণের ফলে আলুতে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
এই রোগ হলে আক্রান্ত স্থানের তন্তু খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
আক্রান্ত আলু দুইপ্রান্ত হতে দ্রুত নরম ও আর্দ্র হয়ে পচে যায়, যা হতে দুর্গন্ধ বের হয়।
আক্রান্ত আলুর উপরিভাগে সাদা মাইসেলিয়ামের পুরু স্তর দেখা যায়।
এছাড়া প্যাথোজেনের কালো বর্ণের ফ্রুটিং বডিও দেখা যা
রোগের প্রতিকার :
ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে।
জমি হতে টিউবার উত্তোলন, পরিবহন ও সংরক্ষণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে টিউবার আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
সংরক্ষণের আগে টিউবার ভালো করে কিউরিং করতে হবে।
এ রোগ কমানোর জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার
বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
আলু গুদামজাত করার পরে সে ঘরে বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
আলু অপেক্ষাকৃত ঠা-া ও শুষ্ক আবহাওয়ায় সংরক্ষণ করতে
হবে।
৩. রোগের নাম : কালচে বা ব্লাক রট/চারকোল রট (Black rot-Charcol rot) রোগ
রোগের কারণ : ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাজিওলিনা/ডিপ্লোডিয়া নাটালেনসিস (Macrophomina phaseolina/Diplodia natalensis) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
গাছের পরিত্যক্ত অংশে জীবাণু বেঁচে থাকে এবং বাতাস, পানি ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
এ রোগের আক্রমণে গাছ খর্বাকৃতির ও হলুদ রঙের হয়।
পরে আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে কাল হয়ে যায়।
গুদামজাত অবস্থায় টিউবারেও এ রোগ দেখা যায়।
টিউবারে এ রোগের আক্রমণে কাল দাগ পড়ে।
পরবর্তীতে পচন শুরু হয়ে পুরো টিউবারটি পচে নষ্ট হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার
রোগমুক্ত মিষ্টি আলুর লতা লাগাতে হবে।
শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে তার মধ্যে লতা ডুবিয়ে শোধন করে নিয়ে জমিতে লাগাতে হবে।
সংরক্ষিত টিউবারকে এ রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে টিউবারকে সংরক্ষণের পূর্বে ভালোভাবে কিউরিং করে নিতে হবে।
এ রোগ কমানের জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার
বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
ফসল উঠানোর পর মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-ডাইথেন এম ৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে টিউবারে স্প্রে করে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. রোগের নাম : পাতা কোঁকড়ানো বা লিফ কার্ল ভাইরাস (Leaf curl virus) রোগ
রোগের কারণ : লিফ কার্ল ভাইরাস (Leaf curl virus)-এর আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
এই রোগ সাদা মাছি পোকার মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
এ রোগে আলুর পাতা মারাত্মকভাবে ছোট হয়ে যায়।
মিষ্টি আলুর পাতা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়।
ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রোগের প্রতিকার
রোগমুক্ত লতা লাগাতে হবে।
জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
সাদা মাছি পোকা দমনের জন্য ডায়াফেনথিউরন গ্রুপের কীটনাশক (যেমন-পেগাসাস ৫০ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ড. কে এম খালেকুজ্জামান
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব) মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই শিবগঞ্জ, বগুড়া, মোবাইলঃ ০১৯১১-৭৬২৯৭৮, ইমেইলঃ zaman.path@gmail.com
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
শেফালি বেগম, গ্রাম: কেরাদারি, উপজেলা: রাজারহাট, জেলা: কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন: মসুরের গাছের পাতা, শাখা-প্রশাখা ও ফলে হলুদ বা মরিচা রঙের ফোসকা পড়ে এবং পরবর্তীতে গাছগুলো শুকিয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধানে কী করণীয়?
উত্তর: মসুরের এ রোগটি মসুরের মরিচা রোগ নামে পরিচিত। এ রোগ প্রতিকারে বারি মসুর-৪ ও বারি মসুর-৮ মরিচা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে প্রপিকোনাজল গ্রুপের যেমন- টিল্ট/রেমিডি/প্রাউড প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
সাইমন, গ্রাম: পিরোজপুর, উপজেলা: মেহেরপুর সদর, জেলা: মেহেরপুর
প্রশ্ন: ছোলার ফল আসা শুরু হলে ছোলা গাছের ভেতরের পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত পাতাগুলো শুকিয়ে ঝরে পড়ে। এ সমস্যায় এখন আমি কী করব জানাবেন?
উত্তর: ছোলা গাছের এ সমস্যাটিকে ছোলার বট্রাইটিস গ্রে মোল্ড রোগ বলে। এ রোগের আক্রমণ রোধে যেসব কর্মকা- করতে হয় তাহলো-গাছ ঘন হয়ে থাকলে পাতলা করে দিতে হয়; ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হয়; কার্বেনডাজিম গ্রুপের যেমন অটোস্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হয়। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী জাত বারি ছোলা-১০ এর চাষ করলে এ ধরনের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সাইফুল, গ্রাম: মৌতলা, উপজেলা: কালিগঞ্জ, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: সরিষা ক্ষেতে এক ধরনের আগাছার আক্রমণ যা সরিষার গাছের শিকড়ের সাথে যুক্ত। এখন আমি কি করব?
উত্তর: অরোবাংকি নামক পরজীবী উদ্ভিদ এর কারণে সরিষা ক্ষেতে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। বারবার একই জমিতে সরিষা ফসল চাষ করলে এ পরজীবী উদ্ভিদের বিস্তার হয়। এ সমস্যা দূরীকরণে ফুল আসার আগেই পরজীবী উদ্ভিদ জমি থেকে তুলে ধ্বংস করতে হবে। পরিমিত হারে টিএসপি সার ব্যবহার করতে হয়। এছাড়া পূর্বে আক্রান্ত জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে। আর সব শেষ ব্যবস্থা হিসেবে আগাছানাশক যেমন-২,৪-ডি ছিটিয়ে পরজীবী উদ্ভিদ দমন করা যায়। আশাকরি এসব পদক্ষেপ নিলে আপনি উপকার পাবেন।
আনজুআরা, গ্রাম: দক্ষিণ পাতাকাটা, উপজেলা: বরগুনা সদর, জেলা: বরগুনা
প্রশ্ন: সূর্যমুখীর পাতা ঝলসানো রোগ কীভাবে দমন করব জানাবেন?
উত্তর : আমাদের দেশে সূর্যমুখীর রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো অন্যতম। এ রোগের আক্রমণ হলে পাতায় প্রথমে ধূসর বা গাঢ় বাদামি বর্ণের অসম দাগ পড়ে। পরে দাগগুলো মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি হয়। পরে পুড়ো পাতা ঝলসে যায়। এজন্য এ সমস্যা সমাধানে রোগ সহনশীল বারি সূর্যমুখী-২ জাত চাষ করতে হবে। এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের যেমন রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার পাতায় স্প্রে করলে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়। এছাড়া ফসল কাটার পর পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেললে এ রোগের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।
আজাদ হোসেন, গ্রাম: তিনিশপুর, উপজেলা: নরসিংদী সদর, জেলা: নরসিংদী
প্রশ্ন: ভুট্টার কাণ্ড পচারোধে কী করতে হবে?
উত্তর: খরিফ মৌসুমে এ রোগ বেশি হয়। এছাড়া জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি ও পটাশের পরিমাণ কম হলে এ রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। এ রোগে কাণ্ডের নিচের দিকে নরম ও পানি ভেজা দাগ পড়ে পাশাপাশি রোগের আক্রমণে গাছের কা- পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙে পড়ে। সুস্থ ও সবল বীজ বপন এবং সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ মাত্রা বাড়লে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম গ্রুপের প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করলে এ রোগ দমন করা যায়। এছাড়া ডাইফেনোকোনাজল গ্রুপের স্কোর ২৫০ ইসি এক লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে আপনি সুফল পাবেন।
তাবরিজ, গ্রাম: বিষকা, উপজেলা: তারাকান্দা, জেলা: ময়মনসিংহ
প্রশ্ন: গ্লাডিওলাসের ঢলে পড়া রোগ দমনের সমাধান কী?
উত্তর: এ রোগটি কন্দ, পাতা ও শিকড় সর্বত্রই লক্ষণ দেখা যায় এবং মাটির তলায় কন্দে পচন শুরু হয়। প্রথমে পুরনো পাতা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে মরে যায়। পরবর্তীতে কন্দ পচে যায় ও আক্রান্ত গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়। রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করার পাশাপাশি শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। রোগমুক্ত বীজ কন্দ ব্যবহার করতে হবে। এরপরও যদি জমিতে রোগ দেখা দেয় তবে কার্বেনডাজিম গ্রুপের যেমন-অটোস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। তবেই আপনি সুফল পাবেন বলে আশা করি।
মৎস্য বিষয়ক
মো: হাবিব, গ্রাম: দক্ষিণ মহেশপুর, উপজেলা: ফুলবাড়ি, জেলা: দিনাজপুর
প্রশ্ন: পিজি তৈরি করার ডোজ জানতে চাই?
উত্তর: এক কেজি স্ত্রী ও ১ কেজি পুরুষ মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ইনজেকশন দিতে হবে। এক কেজি স্ত্রী মাছের জন্য ৭০ মিলি গ্রাম পিজি ৭ সিসি পানিতে মিশাতে হবে। সিরিঞ্জের প্রতি ১ সিসি তে ১০ দাগ আছে, সেই হিসাবে ১০০ গ্রাম মাছের জন্য ৭ মিলিগ্রাম=৭ দাগ পিজি প্রয়োগ করতে হবে। অনুরূপভাবে, ১ কেজি পুরুষ মাছের জন্য ৩০ মিলিগ্রাম পিজি প্রয়োজন। ৩০ মিলিগ্রাম পিজি ৩ সিসি পানিতে গুলতে হবে (প্রতি ১ সিসি=১০ দাগ)। ১০০ গ্রাম মাছের জন্য ৩ মিলিগ্রাম=৩ দাগ প্রয়োগ করতে হবে।
গোলাম মোস্তফা, গ্রাম: কল্যাণপুর, উপজেলা: সাপাহার, জেলা: নওগাঁ
প্রশ্ন: পুকুরে মাছের বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা যাচ্ছে। কী করব?
উত্তর: পোনার পুকুরে বিভিন্ন এককোষী বাহ্যিক পরজীবী, উকুন, ফুলকা পচা, পাখনা পচা ইত্যাদি রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে পুকুরে ১,২ গ্রাম/শতাংশ/৩০ সেমি পানি হারে ম্যালাকাইট গ্রিন এবং উকুন রোধে ১২ গ্রাম/শতাংশ/৩০ সেমি পানি হারে ডিপটারেক্স/সাইপারমেথ্যিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মো: ফারুক, গ্রাম: রনসিয়া, উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: আমার মুরগির বাচ্চার বয়স ১০-১৫ দিন। ঝিমাচ্ছে, মাথা ঝুলে পড়েছে। লাইটের নিচে জড়ো হয়ে আছে। বুকের চামড়ার নিচে ফুলে আছে। কী করব পরামর্শ চাই?
উত্তর: অ্যামোক্সিসিলিন অথবা মোক্সাসিলিন অথবা কলিস্টিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে। ফুসিড ট্যাবলেট ১টা ২ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১ দিন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন খাওয়াতে হবে। হ্যাচারির ইনকিউবেটরের মাধ্যমে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে রোগের প্রতিরোধ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
মোকসেদুর রহমান, গ্রাম: উমরগ্রাম, উপজেলা: গঙ্গাচরা, জেলা: রংপুর
প্রশ্ন: আমার টার্কির বাচ্চার বয়স ৪ সপ্তাহ। গায়ে জ্বর আছে, সাদা চুনের মতো ডায়রিয়া হচ্ছে। ঝিমাচ্ছে এবং এলোমেলোভাবে চলাফেরা করছে। কী করণীয়?
উত্তর: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যার নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে যেহেতু এই রোগের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অন্যান্য রোগের সংক্রমণ খুব সহজেই হয়, তাই নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
সিপ্রোফ্লক্সিন গ্রুপের ওষুধ ১ লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এছাড়াও ভিটামিন সি ৩ লিটার পানিতে ১ গ্রাম মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং কৃষি বিষয়ে সকাল ৭টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল নং ০১৭১১১১৬০৩২, ঃtaufiquedae25@gmail.com
ভালো ফলনের জন্য সুষম সারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সার প্রয়োগ করতে দুটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখা দরকার। প্রথমত. ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা। দ্বিতীয়ত. সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য কোন সার কখন ও কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ধারণ করা। সার ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াই সবার কাম্য। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারের মাত্রা নির্ণয় করা সর্বোত্তম। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় সার সুপারিশ গাইড অনুযায়ী কিংবা অনলাইনে সার সুপারিশ নির্দেশিকা সফটওয়্যার (FRS) ব্যবহার করেও সারের মাত্রা জানা যায়।
অনলাইনে সার সুপারিশ পাওয়ার জন্য www.frs-bd.com লিখে সার্চ দিয়ে সামান্য কিছু তথ্য পূরণ করলেই যে কেউই তার জমিতে নির্দিষ্ট ফসলে কাক্সিক্ষত সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি জানতে পারবেন। এজন্য সরকারি কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে বা কৃষক বন্ধু সেবার ৩৩৩১ নম্বরে কল করে, ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার, ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত ফিয়াক সেন্টার কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে যোগাযোগ করে হাতের কাছে সরাসরি সহযোগিতা পাওয়া যাবে। সাধারণভাবে ১৫০ দিনের নিচে স্বল্প মেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮ ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বা বিনা ধান-১০ এবং বিনা ধান-১৮ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৩৫ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম বা গন্ধক ১৫ কেজি, দস্তা (মনোহাইড্রেট) ১.৫ কেজি। ১৫০ দিনের বেশি দীর্ঘমেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮ বা ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৮৯ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১৩ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। হাওর অঞ্চলের জাতের ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ২৭ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। তবে টিএসপির বদলে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে।
টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে দস্তা ও টিএসপি একসাথে না মিশিয়ে পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে। দীর্ঘমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর অর্থাৎ গোছায় কুশি দেখা দিলে এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে। সার প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আরও কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারের সাথে রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও ভালো ফলন হয়। জমিতে বছরে একবার হলেও বিঘাপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। আমন মৌসুমে যে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হবে সে জমিতে বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সার নির্ধারিত মাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ কম ব্যবহার করতে হবে। টিএসটি ও এমওপি সার অর্ধেক মাত্রায় ব্যবহার করলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে। এছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১০-১২ ইঞ্চি ওপরে কেটে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে। দস্তা বা জিঙ্ক সালফেট সার ফসলচক্রের কোন একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী দুই ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে। বেলে মাটিতে চার কিস্তিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করাই ভালো। জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো ফলন আশা করা যায়। তীব্র শীতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না। ইউরিয়া সারের অপচয়রোধে এবং ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য এক মৌসুমে প্রতি চারটি গোছার জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি মেগাগুটি প্রয়োগ করলেই যথেষ্ঠ। যদি কোনো কারণে গন্ধক বা দস্তা ব্যবহার করা না হয় তাহলে গাছের গন্ধক বা দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ বুঝে সার দিতে হবে।
এবারে বোরো ধানে সেচের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা। মনে রাখতে হবে ধান গাছ কোনো জলজ উদ্ভিদ নয় তবে পানি বেশি পছন্দ করে। এজন্য সারাক্ষণ পানিতে ভাসিয়ে জমি টইটম্বুর করে রাখা ঠিক নয়। পানি বেশি হলে বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল/ফল ঝড়ে পড়ে ও দানা পুষ্ট হয় না। পরিশেষে ফলন কম হয়। আবার অন্যদিকে পানি কম হলে খাদ্য গ্রহণ বা পরিবহনে ব্যাহত হয়, খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যেতে পারে, ফুল-ফল দেরিতে আসে, আগাছা বেশি হয় এবং দানা পুষ্ট হয় না। ফলশ্রুতিতে ফলন কম হয়। ধানে বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ পানি লাগে তা জানিয়ে দিচ্ছি। চারা লাগানো সময় ছিপছিপে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি লাগে। এর কম বা বেশি হলে রোপণে অসুবিধা হয়। চারা লাগানোর থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। পানি কম হলে রোপণ ঝুঁকি সামলে উঠতে বেশি সময় লাগে আর বেশি হলে চারা হেলে পড়ে। চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত এক থেকে দেড় ইঞ্চি। এর কম বা বেশি হলে কুশি কম হয়। কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত দুই থেকে চার ইঞ্চি। এ সময় রসের ঘাটতি হলে দানা গঠন পুষ্ট হবে না, দানার সংখ্যা কম হবে। আর পানি বেশি হলে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ধানে দানা শক্ত ক্ষীর হলে অর্থাৎ ধান কাটার ১০-১২ দিন আগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে।
ধানের জমিতে সেচের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে লেদা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কাটুই পোকা, উড়চুঙ্গা আর রোগের মধ্যে ব্লাস্ট, বাদামি দাগ এবং অধিকাংশ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যদিকে নিষ্কাশন বা পানি সরিয়ে দেয়া মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে পাতা মাছি, চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সাদাপিঠ গাছফড়িং, রোগের মধ্যে বিভিন্ন ছত্রাক রোগ, পাতা পোড়া রোগ এবং আগাছার মধ্যে শেওলা, পানিকচু, কচুুরিপানা বা চেচড়া জাতীয় আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বোরো মৌসুমে ধান আবাদে খরচের অন্যতম প্রধান খাত হলো সেচ। আগামীতে সেচের খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। পানি সাশ্রয়ী একটি কার্যকর পদ্ধতির নাম পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি বা এডব্লিউডি। জমিতে একটি পর্যবেক্ষণ পাইপ বা চোঙ বসিয়ে সহজেই সেচ দেয়ার সময় নির্ধারণ করা যায়। গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণে করা হলে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অপচয় রোধ করা যায়, সময় শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে, উঁচু-নিচু জমিতে সহজেই পানি বিতরণ করা সম্ভব। এর ফলে সেচ এলাকা শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। নিশ্চিত বোরো মৌসুমকে ঘিরে সঠিকভাবে সার ও সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করুন এবং গোলা ভরা ফসল ঘরে তুলুন।
কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
পিএইচডি ফেলো, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর ও অতিরিক্ত উপপচিালক (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল-০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল : sayemdae@yahoo.com
প্রাচীনকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, উপকারী ও পরিশ্রমী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদের ‘সামাজিক পতঙ্গ’ বলা হয়। মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালন করাকেই মৌমাছি পালন বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সুরা আন নাহল ১৬:৬৮-৬৯-এ মৌমাছি সম্পর্কে উল্লেখ আছে। এরা আকারে মাঝারি ও শান্ত, তাই এদের বাক্সে লালন-পালন করা যায়। অন্ধকার স্থান যেমন- গাছের ফোকর, দেয়ালের ফাটল, আলমারি, ইটের স্তূপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাকপ্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। এ ছাড়াও পাহাড়ি ও ক্ষুদে মৌমাছি আছে, তবে এদের পালন করা যায় না। একটি মৌচাকে তিন শ্রেণীর মৌমাছি থাকে, যথা: (১) রাণী, (২) পুরুষ ও (৩) শ্রমিক মৌমাছি। রাণী মৌমাছি সবচেয়ে বড় প্রকৃতির। একটি চাকে একটি মাত্র রাণী মৌমাছি থাকে। এর একমাত্র কাজ ডিম পাড়া। পুরুষ মৌমাছি মধ্যম আকৃতির ও এদের চোখ বড়। কিন্তু এদের হুল নেই। এদের একমাত্র কাজ রাণীর সাথে মিলিত হওয়া। শ্রমিক মৌমাছি সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির। এদের চোখ ছোট, কিন্তু হুল আছে। রাণী ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সকল সদস্যই শ্রমিক মৌমাছি। এরা নানা দলে ভাগ হয়ে চাকের যাবতীয় কাজ (যথা- চাক নির্মাণ করা, ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করা, মধু তৈরি করা, চাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, চাকে বাতাস দেয়া চাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি) সম্পন্ন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেশি ও বিদেশি মিলে ৪ প্রজাতির মৌমাছি আছে। এপিস ফ্লোরিয়া, এপিস ডরসাটা, এপিস সেরেনা ও এপিস মেলিফেরা। ইউরোপীয় জাতের এপিস মেলিফেরা মৌমাছি শান্ত ধরনের হয়। বাংলাদেশে এর চাষ করা হয়। সাধারণত ৫০০ গ্রাম মধু তৈরি করতে মৌমাছির ২ মিলিয়ন ফুলের দরকার পড়ে।
মৌমাছি পালনের উপকারিতা
অধিক ফসল উৎপাদনে সহায়ক : মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায়। পরাগায়নে জন্য মৌচাষ এখন আধুনিক প্রযুক্তি। মৌমাছির মাধ্যমে সফল পরাগায়ন সম্ভব এটি সর্বজনস্বীকৃত। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ন ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ফল। বিভিন্ন মধুফুল মৌসুমে মৌমাছি দ্বারা পরাগায়িত ফসলের ১০ থেকে ১৫ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত বাড়তি ফসলের মূল্য মোট উৎপাদিত মধু ও মোমের মূল্যের ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি।
কুটির শিল্প ও বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা : মৌমাছি পালনকে কুটির শিল্প হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হবে ও বাড়তি আয় হবে । গ্রামের স্বল্পআয়ের পরিবারগুলোতে মৌমাছি পালন একটি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে।
বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে সহায়ক : এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধু রপ্তানি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রপ্তানি হয়, যা মোট রফতানির ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সুন্দরবনের মধু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার সৃষ্টি এবং মধু আহরণে সংশ্লিষ্ট মৌয়ালদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খাঁটি মধু আহরণের ব্যবস্থা করতে পারলে এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনে প্রকৃতিক মধু সংগ্রাহক মৌয়ালরা ছাড়াও বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া মৌ চাষির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার। এসব চাষির খামারে বছরে গড়ে পাঁচ হাজার টন মধু উৎপাদন হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে। এটি দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সহায়ক : দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ তবে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করতে হলে আমাদের এখনও কিছু করণীয় আছে। মধু এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য হলেও বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে। একে সব রোগের মহাষৌধ বলা হয়।
বিশুদ্ধ ও মানসম্মত মধু উৎপাদনের জন্য সহায়ক : সাধারণ নিয়মে মৌচাক চেপে মধু বের করা হয়। এতে চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যেমন সম্পূর্ণ হয় না তেমনি সেই মধুতে রয়ে যায় মোম, মৌমাছির ডিম ও বাচ্চা নিষ্পোষিত রস এবং অন্যান্য আবর্জনা। পালন করা মৌমাছির চাক থেকে যান্ত্রিক উপায়ে নিষ্কাশিত মধু যেমন বিশুদ্ধ, তেমনি নিষ্কাশনও হয় পুরোপুরি।
চাক নষ্ট না করে মৌমাছি উৎপাদনে সহায়ক : সাধারণ নিয়মে মধু সংগ্রহের সময় চাকটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়। এ কাজের সময় অনেক ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মৌমাছিও মারা পড়ে। এ ছাড়াও চাকে অবস্থিত ডিম ও বাচ্চা নষ্ট হয়। এর ফলে দিন দিন মৌমাছির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
খাঁটি মধু চেনার উপায়
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। খাঁটি মধু পানির গ্লাসে ড্রপ আকারে ছাড়লে তা সরাসরি ড্রপ অবস্থায়ই গ্লাসের নিচে চলে যায়। কয়েক ফোঁটা মধু একটি ব্লটিং পেপারে নিলে ব্লটিং পেপার কর্তৃক মধু শোষিত হবে না। ভেজাল মধু ব্লটিং পেপারকে আর্দ্র করে তোলে।
মধুর উপকারিতা
মধু ভালো শক্তি প্রদানকারী খাদ্য। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।
মধুতে যে শর্করা থাকে তা সহজেই হজম হয়। কারণ এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে।
মধু ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা চামচ খাঁটি মধু ভোরবেলা পান করলে কোষ্ঠবদ্ধতা এবং অম্লত্ব দূর হয়।
রক্তশূন্যতা কমাতে মধু সহায়ক। মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে। কারণ এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ।
হাঁপানি রোধে এবং ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে সহায়তাকারী।
মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুমে কাজ করে।
যৌন দুর্বলতায় মধু অত্যন্ত সহায়ক। এ ছাড়া হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশ্রিত মধু একটি প্রশান্তিদায়ক পানীয়। তারুণ্য বজায় রাখতেও মধুর ভূমিকা অপরিহার্য। মধু এন্টি অক্সিডেন্ট, যা ত্বকের রঙ ও ত্বক সুন্দর করে। ত্বকের ভাঁজ পড়া ও বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। শরীরের সামগ্রিক শক্তি বাড়ায় ও তারুণ্য বাড়ায়।
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু ব্যবহৃত হয়। এটা দাঁতের ওপর ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে এবং দাঁত পড়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করে। মধু মুখের ঘায়ের জন্য উপকারী এবং সেখানে পুঁজ জমতে দেয় না। মধু মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করলে মাড়ির প্রদাহ দূর হয়।
মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের গোলমাল দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক এসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয় বলে অরুচি, বমিভাব, বুক জ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।
শীতের ঠাণ্ডায় এটি দেহকে গরম রাখে। এক অথবা দুই চা চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে খেলে শরীর ঝরঝরে ও তাজা থাকে।
ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে দেহে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়।
মেয়েদের রূপচর্চার ক্ষেত্রে মাস্ক হিসেবে মধুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। মুখের ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধির জন্যও মধু ব্যবহৃত হয়।
মধুতে নেই কোনো চর্বি। মধু পেট পরিষ্কার করে, মধু ফ্যাট কমায়, ফলে ওজন কমে।
এক চামচ মৌরি গুঁড়ার সাথে এক বা দুই চামচ মধুর মিশ্রণ হৃদরোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এটা হৃদপেশিকে সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
শিশুদের ছয় মাস বয়সের পর থেকে অল্প করে (তিন চার ফোঁটা) মধু নিয়মিত খাওয়ানো উচিত। এতে তাদের পুরো দেহের বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ ভালো হবে।
মধুর দানাদার সমস্যা
অনেক সময় মধু দানাদার আকার ধারণ করে। যদি কোনো মধুতে গ্লুকোজের পরিমাণ ফ্রুক্টোজের চেয়ে বেশি থাকে তখন সে মধু অতি দ্রুত দানাদার হয়। যেমন- সরিষা ফুলের মধু। আবার মধুতে পর্যাপ্ত পোলেন, ধুলাবালু ও বুদবুদ থাকলে সে মধু সহজে দানাদার হয়। সাধারণত ১১ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মধু জমতে পারে। পানির পরিমাণ বেশি থাকলে মধুকে দানাদার হতে ত্বরান্বিত করবে। তবে দানাদার মধু খেতে কোনো সমস্যা নেই। এই দানাদার মধুকে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তরল করা যায়। তবে দানাদার মধু ছয় মাসের মধ্যে ব্যবহার করা উত্তম।
দেশে মধু উৎপাদনে সরাসরি জড়িত আছে প্রায় ১৮ হাজার মৌচাষি। আর উৎপাাদন প্রায় ৫ হাজার টনেরও বেশি। চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে মধু শিল্পে কর্মরত আছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। বর্তমানে ২ হাজার মৌ খামার ও ১ লাখ ২০ হাজারের অধিক মৌবাক্স রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করায় দেশে মধু উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌমাছি পালনের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে মৌমাছি পালনের বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এ ছাড়া মৌমাছি পালন সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতে হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করে থাকে।
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী, মোবা : ০১৮১৯৯২২৬১৩ rajshahi@ais.gov.bd