Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

বাংলাদেশের ফল ও এর উন্নয়ন

ফলের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফলের সন্ধান রয়েছে। তার মধ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭০টি ফলের চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশের ফল স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময়। ফল শরীরের ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস এবং ভেষজ বা ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়। ফলদ গাছ অক্সিজেন দেয়, কাঠ দেয়, ছায়া দেয় ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফল গাছ পাখি ও প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয়স্থল। তাছাড়া সৌন্দর্যবর্ধন ও পর্যটন আকর্ষণে ফল বাগান অনন্য ভূমিকা পালন করে।  
 

এখন ফলের মৌসুম। উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০% বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ এ চার মাসেই পাওয়া যায়। এ সময়কে মধুমাস বলা হয়। বিভিন্ন রকম দেশীয় ফল যেমনÑ আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, বাঙ্গি, তরমুজ, ডালিম, আনারসের সমারোহ এ সময় লক্ষণীয়। এর সাথে আরও পাওয়া যায় আমলকী, আতা, করমচা, জামরুল, বেল, গাব, কাঁচা তাল ইত্যাদি। আর বাকি ৪০% ফল পাওয়া যায় অবশিষ্ট ৮ মাসে।
 

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় প্রায় অর্ধেক। অধিকন্তু মধুমাসের চার মাস অর্থাৎ জুন-সেপ্টেম্বর মাসে ফল বেশি উৎপন্ন হয়। শীত মৌসুমে ফল প্রাপ্তি তুলনামূলকভাবে কম। এফএও প্রকাশিত একটি Country Nutrition Paper (FAO 2014) এ দেখা যায়, ২০১০ সালে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ দৈনিক ৪৪.৮ গ্রাম যেখানে দৈনিক কমপক্ষে প্রয়োজন ১০০ গ্রাম। যদিও ফল গ্রহণের পরিমাণ এখন অনেক বেড়েছে তবুও চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। চাহিদা অনুযায়ী ফলের জোগান নিশ্চিত করতে হলে  ফলের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
 

বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৫ অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩.২৩ লাখ একর জমিতে মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে ৪৬.৯৭ লাখ মে. টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যা ৪৩.৬ লাখ মে. টন ছিল। এ তথ্য অনুযায়ী ফলের বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৭%।
 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক নাগরিককে একটি করে ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর দূরদর্শী পরামর্শে সরকারিভাবে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র উষ্ণ ও অবউষ্ণ ম-লীয় ফলের ওপর নিবিড় গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে অদ্যাবধি ৩২টি বিভিন্ন ফলের ৭৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে এবং ৭১টি টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ইতোমধ্যে বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত মাল্টা, আম, পেয়ারা, কুল, লিচু, কলা, পেঁপে, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল ইত্যাদি দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত ও কৃষক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার আম, পেয়ারা ও কুলের বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে ।
 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) প্রতি বছর প্রায় এক কোটিরও বেশি ফলদ বৃক্ষ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। শুধু গাছ লাগানোই নয়, গাছ লাগানোর পর তার পরিচর্যার মাধ্যমে কিভাবে মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন, আহরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা যায় তার প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। ডিএইর আওতায় বাস্তবায়নাধীন ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’সহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ফল উৎপাদন ও পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডিএই’র আওতায় সারা দেশে ৭৩টি হর্টিকালচার সেন্টার থেকে প্রতি বছর মানসম্পন্ন চারা/কলম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়। এসব সেন্টার থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৭.৫২ লাখ ফলের চারা ও ৬.৬৩ লাখ ফলের কলম উৎপাদন করা হয়েছে।  
 

ফল উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিএডিসিও কাজ করে যাচ্ছে। বিএডিসির উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ এবং এগ্রো সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে ২৩টি প্রদর্শনী খামার এবং প্রদর্শনী খামার প্রকল্প এলাকার মাধ্যমে ফল উৎপাদন করে আসছে। এছাড়া বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বন বিভাগও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফল গাছ রোপণ করছে।
সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ এবং কৃষি বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ ও ফল চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। আর মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বের ২৮তম স্থানে রয়েছে।

 

বাংলাদেশে ফল চাষে বৈচিত্র্য এসেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিদেশি ফল বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী করে দেশে প্রবর্তন করছে।  ফলশ্রুতিতে বর্তমানে বাণিজ্যিক উপায়ে ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, আঙুর, মাল্টা, কমলা ইত্যাদি ফল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মাঠে অস্থায়ীভাবে খাটো জাতের আম এবং পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় ভিয়েতনাম থেকে খাটো জাতের নারিকেল গ্রাম অঞ্চলের জন্য এবং ভারতের কেরালা থেকে উচ্চফলনশীল নারিকেল শহর অঞ্চলের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে সারা বছর দেশে উৎপাদিত বিদেশি ফলসহ  হরেক রকম ফল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
 

ফল সরাসরি খাওয়া যায় যা পুষ্টির উপাদানে ভরপুর এবং সুস্বাদু। অথচ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক ফলে ফরমালিন, কার্বাইড বা অন্য রাসায়নিক পদার্থ মিশানোর কারণে কয়েক বছর আগেও খাদ্য তালিকায় ফল রাখতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়েছিল। ফলে ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় জনগণের আস্থা ফিরে এসেছে। বর্তমান সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ এবং ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫’ প্রণয়ন ও কার্যকর করেছে। ভোক্তা অধিকার আইনসহ এসব নতুন প্রণীত আইন ও তার সঠিক প্রয়োগের ফলে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি থেকে জনগণ পরিত্রাণ পেতে শুরু করেছে।
 

সরকার ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও পুষ্টি সম্পর্কিত গবেষণার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ‘বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ (বারটান) প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যাতে জনগণ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে সুষম ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ‘নার্সারি গাইড লাইনস-২০০৮’ প্রণয়ন করে নার্সারি শিল্পের মানোন্নয়ন করা হয়েছে এবং নিয়মিত ফল মেলার আয়োজন করে ফল বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও বাজার সংযোগ স্থাপনের সহায়তা করা হচ্ছে।
 

শরীরের চাহিদামতো নিয়মিত পুষ্টি সরবরাহ করতে হলে ফল উৎপাদন, আহরণ, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদিত ফলের এক বিরাট অংশ সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে উৎপাদিত ফল ও সবজির ২৫ থেকে ৪০ ভাগই সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়। আবার ভরা মৌসুমে অধিক সরবরাহের ফলে দাম অনেক কমে যায়, ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ফল সংগ্রহের পর যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করা হলে একদিকে অপচয় কমবে, অপরদিকে  উৎপাদনকারীর ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করে সবার জন্য বছরব্যাপী পুষ্টি নিশ্চিত করা যাবে। উন্নত প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে বেশি দিন ফল সংরক্ষণ, আকর্ষণীয় বাজার মূল্য প্রাপ্তি এবং বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ডিএই’র তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশে ৫,৭৯৭ মে. টন ফল রপ্তানি হয়েছে। এ পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে।
 

বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমনÑ প্রাণ, আকিজ, স্কয়ার, এসিআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত ফল জাতীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন উন্নত প্যাকেজিংয়ের লক্ষ্যে সরকারের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে। চেইন শপগুলোও ফল বিপণনে ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে, ভোক্তার নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং কৃষক ফলের ন্যায্যমূল্য পাবে। পারিবারিক পর্যায়ে ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ জনপ্রিয় করা গেলে পরিবারের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে, পরিবারের নারীরা স্বাবলম্বী হবে। আবার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি মাধ্যমে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের পরিসর আরও বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে।
 

ফলের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন এর চাষাবাদ সম্প্রসারণ। বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পতিত জমি রয়েছে। যেখানে অনায়াসেই উন্নত জাতের দেশি ফলের আবাদ করা যেতে পারে। দেশে ফল চাষ উপযোগী রয়েছে প্রায় ২ কোটি বসতবাড়ির উঁচু জমি। এসব বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষ করা যায়। বসতবাড়ি ছাড়াও গ্রামীণ রাস্তা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, স্কুল, কলেজ, অফিস আদালতের অব্যবহৃত জায়গা ও রেললাইনের দুই ধারে এবং নগরের ভবনের ছাদে দেশি জাতের ফল গাছ রোপণ করে ফলের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া উন্নত পদ্ধতিতে ফল চাষের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উৎপাদিত ফলের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফল প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকারখানা গড়ে তোলারও রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। ফল চাষকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার নার্সারি। এসব নার্সারি থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার চারা ও কলম বিক্রি হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
 

বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ফল চাষসহ কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশের ফল দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বের বাজারে আরও বেশি স্থান করে নিতে পারে এজন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির নিমিত্ত প্রদর্শনী, প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে কৃষি মন্ত্রণালয় এখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে যে কৃষক তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদবৃষ্টির ধকল কাটিয়ে ফল উৎপাদনে ব্যস্ত থাকে সে যেন প্রয়োজনমতো সব কৃষি উপকরণ পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদিত ফলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় তার যাবতীয় ব্যবস্থার জন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

 

মো. মোশারফ হোসেন*
*অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক, বারটান, ঢাকা

 

 

বিস্তারিত
মুড়ি ধান (Ratoon Rice)

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অকাল বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে মুড়ি ধান চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কারণ খাদ্য নিরাপত্তায় মুড়ি ধান একটি গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্য বিন্যাসে এ মুড়ি ধান চাষ করে মূল ফসলের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।
 

বোরো মৌসুমের আগাম জাতে জমির মূল ধান কাটার পর ধান গাছের নাড়া থেকে নতুন কুশি জন্মায়। এ কুশি থেকে আমরা যে ধান পাই তাকেই মুড়ি ধান বলে। আগাম জাত মুড়ি ধান চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। মুড়ি ধান উৎপাদন নতুন কোনো ধারণা নয়। আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশের মধ্যম উঁচু অঞ্চলের কৃষক জমিতে মুড়ি/নাড়া রেখে ধান উৎপাদন করত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতির ব্যবহার রয়েছে।
 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮৭ সাল থেকে মুড়ি ধানের ওপর গবেষণা শুরু করে। মাঠ পরীক্ষণে দেখা গেছে, বিআর১৭ জাত চাষ করে মূল ফসলে প্রতি বিঘায় ০.৮০ টন এবং মুড়ি ধান থেকে প্রতি বিঘায় ০.২০ টন ফলন পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে মুড়ি ধান উৎপাদনের জন্য জমিতে মূল ফসল কাটার ২০ দিন আগে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া ২০০৪-০৫ এবং ২০০৫-০৬ সালে ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭ এবং ব্রি ধান৩৮ এ মুড়ি চাষ করে দেখা গেছে, হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ২.২১ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া গেছে।
গত বোরো মৌসুমে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় মুড়ি ধানের চাষাবাদ পদ্ধতি এবং ফলন পর্যবেক্ষণ করে বিআর২৬ এবং ব্রি ধান২৮ এ মুড়ি ধানের ভালো ফলন পাওয়া গেছে। যেসব কৃষক ১২-১৮ ইঞ্চি নাড়া রেখে বোরো ধান কেটেছেন তাদের জমিতে মুড়ি ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি মুড়ি ধানের ফলন পেয়েছেন ১-১.৫ টন। কিছু কিছু কৃষক মুড়ি ধানের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করেছেন এবং আগে থেকেই গরু, ছাগল এসবের ক্ষতি থেকে মুড়ি সংরক্ষণ করেছেন। বর্তমান বাজারদরে মুড়ি ধান মাড়াই-ঝাড়াই ও শুকানো বাবদ আনুমানিক খরচ একরপ্রতি ৪ হাজার-৫ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রতি একরে ৮ হাজার-১০ হাজার টাকা, যা বেশ লাভজনক। অন্তত ৫ হাজার টাকা লাভ হয়।

 

চাষ পদ্ধতি
 বোরো মৌসুমের আগাম জাত বিআর২৬ ও ব্রি ধান২৮ মুড়ি ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। এ পদ্ধতিতে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ জাতগুলোর পাকা ধান কা- সবুজ থাকা অবস্থায় কাটতে হবে;
সাধারণত বোরো মৌসুমে মধ্যম উঁচু জমিতে মুড়ি ধান চাষ করা যায়;
মুড়ি ধান চাষের জন্য মূল ফসল কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ২০-৩৫ সেন্টিমিটার নাড়া বা ২-৩টি নোড বা পর্ব রেখে ফসল কাটতে হবে;
মূল ফসল কাটার ৫-৭ দিন পর বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া ও ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করলে বিঘাপ্রতি ৫-৬ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়;
 বোরো-পতিত-রোপা আমন এ শস্য বিন্যাস মুড়ি ধান চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী;
মুড়ি ধান চাষে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি রাখতে হবে যেন নাড়া থেকে কুশি জন্মাতে পারে এবং নতুন কুশি মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে;
মুড়ি ধান চাষের জন্য এমন জাতের ধান নির্বাচন করতে হবে যার কুশি উৎপাদন ক্ষমতা বেশি এবং বাতাসে সহজে ঢলে পড়ে না;
মুড়ি ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

 

মুড়ি ধান চাষের সুবিধা
এ পদ্ধতিতে একবার জমি চাষ করেই দুইবার ফসল পাওয়া যায় এবং মূল ফসলের অতিরিক্ত প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফলন হতে পারে;
এ পদ্ধতিতে বীজ ধান, বীজতলা ও জমি তৈরি এবং রোপণ খরচ লাগে না বিধায় এটি ব্যয় সাশ্রয়ী প্রযুক্তি;
মূল ফসলের চেয়ে মুড়ি ধান পাকতে ৬৫ ভাগ কম সময় লাগে;
মুড়ি ধানের জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ করতে হয় না এবং সেচ, সার ও শ্রমিক খরচ ৫০-৬০ ভাগ কম লাগে;
একবার চাষ করে একই জমি থেকে দুইবার ফলন পাওয়ায় শস্যের নিবিড়তাও বাড়ে।

 

মুড়ি ধান চাষে সতর্কতা
মুড়ি ধান পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্লোরোপাইরিফস (২০ তরল) এবং ফেনিট্রোথিয়ন (৫০ তরল) হেক্টরপ্রতি ১ লিটার হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে;
মুড়ি ধান চাষের সফলতা মূল ফসলের আন্তঃপরিচর্যার ওপর নির্ভর করে;
মুড়ি ধান চাষে পরবর্তী মৌসুমের জমি তৈরি ও ফসল চাষে দেরি হতে পারে। আগাম জাত নির্বাচন মুড়ি ধান ফসলের জন্য ভালো।
মুড়ি ধান চাষের সময় জমিতে ১-১.৫ ইঞ্চি পানি রাখলে ফলন ভালো হয়।

 

ড. মো. শাহজাহান কবীর* ড. মো. আনছার আলী** ড. ভাগ্য রানী বণিক***
*পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা); **পরিচালক (গবেষণা) এবং ***মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর

বিস্তারিত
পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ অর্থকরী ফসল বিলাতি ধনিয়া

বিলাতি ধনিয়া বিলাত থেকে এসেছে কিনা কেউ জানে না। হয়তো আসতে পারে সে কোন কালে। তবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের একটি অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ওয়াগগা, বেতবুনিয়া, কাউখালী, খগড়া এলাকায় ব্যাপকভাবে এবং খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার কিছু কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে এ ফসলটির চাষ হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সিলেটে ঢুলা নামে পরিচিত। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার বাহিরে এর পরিচিতি কম এবং ইংরেজি কোনো সুনির্দিষ্ট নামও নেই। তবে  কোথায়ও কোথাও এটাকে False Coriander নামে অভিহিত করা হয়। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটাকে Eryngium বলা হয়। শ্রীলংকায় এটি আগাছা হিসেবে বিবেচিত। বহুকাল পূর্ব থেকেই এদেশের দক্ষিণ পূর্ব  পার্বত্য অঞ্চলে এর চাষ করা যায়। এজন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মামুনুর রশিদ তাঁর  সবজির চাষ বইটিতে এটিকে বাংলা ধানিয়া নামে অভিহিত করছেন। এ ফসলটির উন্নয়ন ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য কৃষি গবেষণা  উপকেন্দ্র রাইখালীতে ব্যাপক গবেষণা চলছে।
 

উৎপত্তি ও বিস্তার : বিশ্বের অন্যান্য প্রধান ফসলের তুলনায় কম বিস্তৃত এবং এ ব্যাপারে তেমন অনুসন্ধান না হওয়ায় বিলাতি ধনিয়ার উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে  স্পষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। প্রাপ্যতা ও বিস্তৃতির  ধরন দেখে আসাম, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের  পূর্বাঞ্চলই এ প্রজাতিটির উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয়। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, দক্ষিণ আমেরিকাই  এর উৎপত্তিস্থল যা ক্রমান্বয়ে  পাক-ভারত উপমহাদেশসহ গ্রীষ্মম-লীয় বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে। ভিয়েতনাম এবং ওয়েস্টইন্ডিজের ত্রিনিদাদ ও টোবাগো থেকে কুলিনারি হার্ব বা সালাদ জাতীয় অর্থকরী ফসল হিসেবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা হয়। অবশ্য Eryngium yuccifolium নামে এর অন্য একটি প্রজাতি অল্প পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রে চাষ করা হয়। এছাড়াও আর্জেন্টিনাতে Eryngium paniculatum Cav তুরস্কে Eryngium giganteum এবং জর্ডানে Eryngium creticum নামক প্রজাতির চাষ হয়। শীতপ্রধান দেশের মধ্য জার্মানিতে গ্রীষ্মকালে  Eryngium maritimum প্রজাতির চাষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিয়ানমারের কিয়দংশে এর চাষাবাদের সম্প্রসারণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
 

উদ্ভিদতত্ত্ব : Eryngium, Apiaceae or Umbelliferae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এ উদ্ভিদটির  বৈজ্ঞানিক নাম ঊৎুহমরঁস ভড়বঃরফঁস এটি একটি  ক্ষুদ্রাকার দীর্ঘজীবী  বিরুৎ। কাণ্ড অস্পষ্ট ও ভূসংলগ্ন। কিন্তু  ফুল আসার সময় উপরদিকে  বাড়ে এবং কা- ফাঁপা হয়ে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়। পাতা দৈর্ঘ্যে ১৫-২০ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ২-৩  সেন্টিমিটার  এবং পত্রফলকের কিনারা সামান্য খাঁজযুক্ত ও অগ্রভাগ ছোট ছোট সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত হয়। এটি একটি ছায়াপ্রিয় উদ্ভিদ। ফুল ক্ষুদ্রাকৃতির বৃন্তবিহীন এবং মঞ্জুরি দণ্ডে ঘন সন্নিবেশিত থাকে। বীজ দ্বিবীজপত্রী, অমসৃণ, ক্ষুদ্রাকৃতির বৃন্তবিহীন এবং মঞ্জুরি দণ্ডে ঘন সন্নিবেশিত থাকে। এ উদ্ভিদটির পরাগায়ন বা অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় বিষয় সম্পর্কে তেমন গবেষণা না হওয়ায় এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। সাধারণত বীজ এবং পার্শ্ব সাকার থেকে এর বংশবিস্তার হয়ে থাকে। তবে বিএআরআই এ নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছে।
 

আবহাওয়া ও মাটি : বিলাতি ধনিয়া প্রধানত খরিফ মৌসুমের ফসল। রবি মৌসুমে বাড়বাড়তি মোটেই সন্তোষজনক নয়। নাতিশীতোষ্ণ থেকে  উষ্ণ ও আর্র্দ্র আবহাওয়া  বিলাতি ধনিয়া চাষের জন্য উপযোগী। অত্যধিক শীতল আবহাওয়ায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিলাতি ধনিয়ার বৃদ্ধি একেবারেই কমে যায়। বিলাতি ধনিয়া প্রখর সূর্যালোকের চেয়ে ছায়াতে বা হালকা বিক্ষিপ্ত আলোতে ভালো পাতা উৎপাদন করে। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বিলাতি ধনিয়া জন্মে। বিলাতি ধনিয়া চাষের জন্য প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। ভালো ফলনের জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন আবার দাঁড়ানো পানিও সহ্য করতে পারে না। এজন্য প্লাবন সেচের চেয়ে ঝর্ণা সেচ ধনিয়া চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পাহাড়ি অঞ্চলে সাধারণত পাহাড়ের পাদদেশীয় সমতলে এর চাষ এবং ঢালে ও সমতলে বীজ উৎপাদন করা হয়।  তবে এদেশের সমতল ভূমিতেও সাফল্যজনকভাবে এর চাষ করা যায়।  


জমি তৈরি : বিলাতি ধনিয়া চাষের জন্য খুব ভালোভাবে জমি প্রস্তুত করা প্রয়োজন। ৫/৬টি চাষ ও উপর্যুপরি মই দিয়ে মাটির ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরা করা প্রয়োজন। কেননা বিলাতি ধনিয়ার বীজ খুব ক্ষুদ্রাকৃতির বালির দানার মতো ছোট হওয়ায় বড় আকারের ঢেলার মধ্যে গজানো সম্ভব  নয়। এজন্য মটরদানা বা  মার্বেলের চেয়ে বড় আকারে ঢেলা থাকা ঠিক না। বীজ বপনের আগে মাটিতে প্রয়োজনীয় রস বা জো অবস্থা থাকা খুব প্রয়োজন। প্রয়োজনে বপনের আগে একবার হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। তবে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকে। এক মিটার চওড়া বেড, জমির সমান লম্বা এবং ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা  রাখা প্রয়োজন। এ নালার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা, পানি সেচ ও নিষ্কাশনের কাজ সহজ হয়।
 

বীজ বপন : নভেম্বর থেকে জানুয়ারি বা অগ্রহায়ণ-পৌষ  মাস বিলাতি ধনিয়ার বীজ বপনের উত্তম সময়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে বীজ বপনের পরেও অন্তত ২০-২৫ দিন কম তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন। কেননা বিলাতি ধনিয়া বীজের অঙ্কুরোদগমের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ১০-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে এর গজানো হার কমে আসে। বিলাতি ধনিয়ার বীজে এক মাসের বেশি সাধারণ অবস্থায় অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকে না। এজন্য বীজ সংগ্রহের পর যত শিগগির সম্ভব হালকাভাবে ছায়াতে শুকিয়ে বপন করা উচিত। বিলাতি ধনিয়ার ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ সমানভাবে বোনা বেশ কষ্টকর এবং বিশেষ দক্ষতারও প্রয়োজন। তাই বালির সাথে মিশিয়ে বীজ বোনা ভালো।  ১০-১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে অথবা ছিটিয়ে বীজ বপন করা য়ায় । গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টরে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি হারে বা প্রতি বর্গমিটারে ৪ গ্রাম অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬০ গ্রাম বীজ বপন করে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজ বপনের পর মাটি ওপরের স্তরের ১-১.৫ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। লাইনে বপন করলে ১.৫-২.৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা করে নালাতে লাইন করে বীজ ছিটিয়ে  দুই পাশে মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হবে। অতি ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ হলেও প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ১৬০ গ্রাম বীজ আপাত দৃষ্টিতে অনেক বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সব বীজ এক সাথে গজায় না। কয়েক মাস পর্যন্ত বীজ ক্রমান্বয়ে গজাতে থাকে। একই দিনে বোনা বীজ গজাতে ১৫-১২০ দিন পর্যন্ত সময় নেয়।  ফলে একবার বীজ বপন করেও কৃষক অনেক বার মানে অন্তত ৮-১২ বার ফসল তুলতে পারেন।
 

সার প্রয়োগ : বিলতি ধনিয়া পাতাজাতীয় ফসল হওয়ায় এর জন্য ইউরিয়া ও  পটাশ জাতীয় সার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বীজ বপনের আগে শতাংশপ্রতি ৮০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার কম্পোস্ট, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৮০০ গ্রাম টিএসপি ও ৮০০-১০০০ গ্রাম এমওপি শেষ চাষের সময় বীজ বপনের ৩/৪ দিন পূর্বে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। চারা গজানো পর থেকে ১ মাস  পর অথবা প্রতি দুইবার ফসল সংগ্রহের পর প্রতি শতাংশে ২০০  গ্রাম হারে  ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে মোট ২০ টন কম্পোস্ট, ৩০০-৪০০  কেজি ইউরিয়া ২০০ কেজি টিএসপি এবং ২০০-২৫০ কেজি এমওপি সারের প্রয়োজন হবে।
 

ছাউনি দেয়া : বিলাতি ধনিয়ার পাতা নরম, চওড়া ও মসৃণ হওয়ায় জন্য জমিতে ছাউনি দেয়া একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে প্রখর সূর্যালোকে পাতা শক্ত হয়, কাঁটাযুক্ত হয়ে যায়, বাজার মূল্য একেবারে কমে যায়। আবার সম্পূর্ণ আলোক বিবর্জিত হলেও ফলন ভালো হয় না । কৃষি গবেষণায় দেখা গেছে, মাচায় ব্যবহৃত ছাউনির দ্রব্যের ওপর বিলাতি ধনিয়ার ফলন নির্ভর করে না। শুধু ছাউনির ঘনত্বের বা আলো প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর এর গুণাগুণ ও ফলন নির্ভর করে। মোট সূর্যালোকের শতকরা ২০-৪০ ভাগ বিক্ষিপ্ত আকারে পেলেই  বিলাতি ধনিয়ার জন্য যথেষ্ট। এজন্য যে বাঁশের  তৈরি মাচায় নারিকেল পাতা, ছন, ধৈঞ্চা, কলাপাতা দিয়ে ছাউনি তৈরি করা যায়। আবার হালকা মাচার ওপর কুমড়া বা লতাজাতীয়  গাছ তুলে দিয়ে তা থেকে বেশ কিছু বাড়তি ফলন পাওয়া যায়।  মাচার পাশ দিয়ে সরাসরি যাতে সূর্যালোক না পড়ে সেজন্য বেড়া দেয়ারও প্রয়োজন।
 

সেচ ও নিকাশ : বিলাতি ধনিয়ার জন্য সব সময় পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে আবার গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেয়া যাবে না। এজন্য ঝর্ণা পদ্ধতিতে মাটির অবস্থা বুঝে ৪-৭ দিন পরপর হালকা সেচ দেয়া ভালো। বেডের পাশের নালা দিয়ে বৃষ্টি সময়ে অতিরক্ত পানি বের করে দেয়ার সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
 

অন্যান্য পরিচর্যা : বিলাতি ধনিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু আগাছা। বীজ বপনের পরে চারা গজানো পূর্ব থেকে ফসল তোলা শেষ পর্যায় পর্যন্ত জমিকে সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। মাঝে মাঝে বিলাতি ধনিয়ার গাছে পুষ্পদ- দেখা দিলে তা গোড়া থেকে ভেঙে দিতে হবে। তা না হলে পাতা উৎপাদন ব্যহত হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে। তবে আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে গাছ পাতলা করে এগুলো রেখে দিলে পরবর্তী বছরের জন্য বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
 

 রোগবালাই দমন : বিলাতি ধনিয়াতে রোগ বালাই খুব একটা বেশি হয় না। তবে গোড়ায় পানি জমলে বা মাটি বেশি স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলে কচি চারা গাছের ক্ষেত্রে গোড়া পচা অথবা ড্যাম্পিং অফ রোগ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। এজন্য জমিতে কোনোভাবেই যেন পানি  জমে না থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে এবং জমি সব সময়  সুনিষ্কাশিত রাখতে হবে। তারপরও এ রোগ দেখা দিলে  প্রতি বর্গমিটারে ১ লিটার হারে ১% বোর্দোমিশ্রণ (১০০:১:১-পানি:তুতে:চুন) অথবা নোইন নামক ছত্রাকনাশকের ০.০৩% দ্রবণ একই হারে গাছের গোড়ায় ও মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
 

ফসল তোলা : সাধারণত বিলাতি ধনিয়ার সম্পূর্ণ গাছ তুলে সংগ্রহ করা হয়। ১৫-২৫ সেন্টিমিটারের  মতো পাতাসহ লম্বা গাছগুলো তুলে নেয়া হয়। মরা বা পুরনো পাতা অপসারণ করে পানিতে ধুয়ে ১ কেজি বা আধা কেজির আঁটি বেঁধে বাজারজাত করা হয়। বড় চারাগুলো তুলে নেয়ার পর ইউরিয়া সার প্রয়োগ ও আগাছা বাছাই করার পর অবশিষ্ট গাছগুলো বড় হতে থাকে এবং ১৫-২০ দিনের মধ্যে পুনরায় আহরণযোগ্য হয়। এভাবে ৮-১২ বারে প্রতি হেক্টর জমি থকে সর্বমোট ৩০ থেকে ৫০ টন (প্রতি শতাংশে ১২০-২০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়ায় যায়। কিচেন গার্ডেনের ছোট প্লটে লাগানো গাছ থেকে গৃহিণীরা সরাসরি পাতা তুলে ও  ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে একবার রোপণ করা গাছ থেকে বহুবছর পর্যন্ত পাতা সংগ্রহ করা যায়।


বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ : বিলাতি ধনিয়ার বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে। পার্বত্য এলাকার কৃষকগণ কখনও কখনও পাহাড়ের ঢালে বীজ বপন করে ছাউনিবিহীন ফসল আবাদ করে সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করেন। আবার পূর্ববর্তী ফসলে অবশিষ্টাংশ থেকে উৎপাদন পুষ্পদ- থেকেও  বীজ সংগ্রহ  করা হয়। সাধারণত ফুল ফোটা বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ : বিলাতি ধনিয়ার বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে। পার্বত্য এলাকার কৃষকগণ কখনও কখনও পাহাড়ের ঢালে বীজ বপন ব্যবহার :উপযোগিতা ও ভবিষ্যৎ : থেকে বীজ পরিপক্ব হতে দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। শতাংশপ্রতি ২-৪ কেজি বা হেক্টরপ্রতি ৫০০ থেকে ১০০০ কেজি পর্যন্ত বীজ পাওয়া  যায় বলে পাহাড়ি চাষিরা তথ্য দিয়েছেন। রিক্যালসিট্র্যান্ট স্বভাবের জন্য বিলাতি ধনিয়ার বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়। ছায়াযুক্ত স্থানে হালকাভাবে বিছিয়ে শুকিয়ে সাধারণ তাপমাত্রায় বায়ু চলাচলযুক্ত মাটির পাত্রে বা ছিদ্রযুক্ত প্যাকেটে (কাগজ, ব্রাউন পেপার ব্যাগ, সুতি কাপড়, প্লাস্টিকের পাত্র) এক থেকে দুই মাস এবং রেফ্রিজারেটরে নিম্ন তাপমাত্রায় (২-৫ ডিগ্রি সে.) সংরক্ষণ করলে আরও বেশি দিন পর্যন্ত এর গ্রহণযোগ্য (৫০%) অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় রাখা যায় । প্রখর রৌদ্রে বেশি শুকিয়ে গেলে এর তেজ এবং অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়। সেজন্য মোলায়েম রোদে শুকালে বেশি ভালো হয়।
 

ব্যবহার : বিলাতি ধনিয়ার পাতা ও কচি পুষ্পদণ্ড একাধারে সবজি, সালাদ এবং মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রান্নার কাজে তরকারিতে, ডাল, ভাজি ও নিরামিষে সুগন্ধি বাড়ায়। সালাদ হিসেবে অন্যান্য সালাদের সাথে মিশ্রণে সবজি হিসেবে এবং ভর্তা করেও খাওয়া যায়। এছাড়াও বেসন দিয়ে বিলাতি ধনিয়া পাতার বড়া তৈরিতে, পেঁয়াজুতে, সিঙ্গাড়ায় এবং ভেজিটেবল রোলে সুগন্ধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ফসলটির পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কিত তথ্যর জন্য জরুরি অনুসন্ধান প্রয়োজন। বিলাতি ধনিয়ার ঔষধি গুণাগুণ ও রয়েছে। এর পাতা, কাণ্ড ও ফুলে বিভিন্ন উদ্বায়ী সুগন্ধি তেলজাতীয় পদার্থ এবং ডোডেসিনোয়িক এসিড (১৫.৫%) এবং ই-২ ডোডেসিনোয়িক এসিড (৪৫.৫%) রয়েছে যা এ সুগন্ধির কারণ। এসব  উদ্বায়ী সুগন্ধি তেলজাতীয় পদার্থ এবং এসিড জাতীয় উপাদন এক্সট্রাক্ট করে উচ্চমূলের সুগন্ধি ও ভেষজ ওষধ তৈরি করা যায়। এর কোন কোন প্রজাতি যেমন Eryngium creticum জর্ডানে স্করপিওন ভেনমের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্য একটি প্রজাতি Eryngium maritimum জার্মানিতে ফ্লাভেনয়েড স্পেক্ট্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
 

উপযোগিতা ও ভবিষ্যৎ :  বেশি উৎপাদন খরচ হেক্টরপ্রতি ২-২.৫ লাখ টাকা  সত্ত্বেও দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, উচ্চ বাজার মূল্য এবং একক পরিমাণ জমিতে অধিক আয় প্রতি হেক্টরে ৬-১০ লাখ টাকা এ ফসলটিকে পার্বত্যাঞ্চলের কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দিয়েছে। আর তাই এ ফসলটিকে ঘিরে পাইকারি ক্রেতা, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের মাঝে আগ্রহ লক্ষ্য করার মতো। বিলাতি ধনিয়া চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিরও যথেষ্ট সুযোগ  রয়েছে। বিশেষ করে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বাঙালি হোটেলগুলোতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ ফসলটির উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি জন্য ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে তেমনি গবেষণালব্ধ ফলাফলের ব্যাপক প্রচার, কৃষকদের  প্রশিক্ষণ প্রদান ও চাষবাদের জন্য মূলধনের ব্যবস্থা (ব্যাংক ঋণ) করা দরকার। অনেক সময় ফড়িয়া ও পাইকারি ক্রেতাদের কারসাজিতে বাজারে যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন এলাকায় এর দাম কমিয়ে দেয়। ফলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ এবং সঠিক মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণও অত্যন্ত প্রয়োজন।  তখন এ বিলাতি ধনিয়া দিয়ে কৃষির বিশেষ সমৃদ্ধি অনায়াসে আনা যাবে।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা;  dirais@ais.gov.bd

বিস্তারিত
পাট পচানোর রিবন রেটিং পদ্ধতি

বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাটের স্থান শীর্ষে। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে সোনালি আঁশ বলে অভিহিত করা হয়। এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পাট রফতানি হতো, অর্জিত হতো মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমান সরকার দেশের পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে দেশবাসীকে উৎসাহিত করায় পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। এ দেশে মূলত তোষা এবং দেশী এ দুই ধরনের পাট চাষ করা হয়ে থাকে। আট থেকে দশ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এছাড়াও হাজার হাজার লোক পাট গবেষণা, প্রক্রিয়াকরণ, পাট পণ্য  উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সাথে জড়িত। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৫-৬% আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে।
 

বাংলাদেশে ৯০ দশকে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট হতো। মাঝে প্রায় ৩০-৪০ বছর পাটের এলাকা কমতে কমতে ৪.০-৪.৫ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির সাথে সাথে গত ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত এর বৃদ্ধি প্রায় ৭-৮ লাখ হেক্টরে পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পূর্বের ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য তখন ১২ লাখ হেক্টর থেকে প্রায় ৬৫-৭০ লাখ বেল পাট পাওয়া যেতো আর সম্প্রতিকালে মাত্র ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৮২ লাখ বেল।
 

পাটের পচন বা রেটিং পাট উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পাট আঁশের গুণাগুণ পাট পচনের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সর্বত্র পাট পচন ব্যবস্থা ও সমস্যা এক রকম নয়। পাট পচন পানির প্রাপ্যতা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা/সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে এলাকাভিত্তিক পাট পচন ব্যবস্থারও তারতম্য হয়। অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে পাটের মূল্য এর মানের ওপর নির্ভর করে। মান বিবেচনায় বিশ্ববাজারে সমাদৃত বাংলাদেশের পাট এক সময় সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে ক্রমাগত পাট আঁশের মান খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় পাট আঁশের মান নিম্ন হওয়ার কারণে কৃষকগণও এর আশানুরূপ মূল্য পাচ্ছেন না। যেহেতু জমির শস্যপর্যায়িক চাহিদা, কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও নানাবিধ প্রয়োজনে বাংলাদেশে পাট চাষ অব্যাহত থাকবে, তাই কৃষক ও দেশের সার্বিক স্বার্থেই উন্নত পাট পচন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত মানের আঁশ উৎপাদন করে কৃষক  তথা দেশের আয় ও সুনাম বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে সাধারণত দুইভাবে পাট পচানো হয়। প্রচুর পানি অঞ্চল ও স্বল্প পানি অঞ্চলে পাট পচানো। প্রচুর পানি অঞ্চলে প্রচলিত পদ্ধতিতে পাট পচানো সম্ভব। কিন্তু যেখানে পানির স্বল্পতা আছে সেসব অঞ্চলে রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতির মাধ্যমে পাট পচাতে হয়। পদ্ধতিগুলোর বিবরন নিম্নে দেয়া হলো।
 

ক.  প্রচলিত পাট পচন ব্যবস্থাপনা
পাট গাছে যখন ফুলের কুঁড়ি আসে তার অগেই পাট কাটা উচিত। এ সময় পাট কাটলে আঁশের মান ও ফলন ভালো হয়, গোড়ায় তেমন কাটিংস বা শক্ত অংশ থাকে না। তবে আমাদের দেশের পাটের জাতগুলো মোটামুটি ১১০-১২০ দিন বয়সে কাটতে হবে। যেহেতু চিকন পাট পচতে সময় কম এবং মোটা পাট পচতে সময় বেশি লাগে, তাই চিকন ও মোটা পাট আলাদা ভাবে আঁটি বেঁধে  আলাদাভাবে জাগ দিতে হবে। পাটের জমি শুকনো থাকলে জমিতেই অথবা জমিতে সামান্য পানি থাকলে পাট কেটে আঁটিগুলো নিকটস্থ শুকনো জায়গায় সম্ভব মতো ৩-৪ দিন স্তূপ করে রেখে পাতা ঝরাতে হবে এবং এরপর পাটের  গোড়ার দেড় ফুট পরিমাণ অংশ ৩-৪ দিন পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে পাতা পচে পচন পানি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয় না এবং গোড়ায় কাটিংসের পরিমাণ কম হয়। তবে পাটের জমিতে প্রচুর পানি থাকলে পাটের পাতা ঝরানো বা গোড়া ডুবানোর প্রয়োজন নেই। সে ক্ষেত্রে পাট কেটে সরাসরি জমিতেই জাগ দিতে হবে। যথাসম্ভব পরিষ্কার এবং অল্প স্রোতযুক্ত পানিতে পাট পচানো উচিত। পাটের আঁটিগুলো প্রথম সারিতে লম্বালম্বিভাবে, দ্বিতীয় সারিতে আড়াআড়িভাবে এবং পুনরায় লম্বালম্বিভাবে সাজাতে হবে। এতে জাগের মধ্যে পাট পচন জীবাণু সহজে চলাফেরা করতে পারে এবং পচন তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়। পাটের জাগে সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সারগুলো পানিতে ছিটিয়ে দিলে পচন প্রক্রিয়া তাড়াতাড়ি হয়। জাগ ডুবানো/ঢাকার জন্য জলজ উদ্ভিদ, কংক্রিটের স্ল্যাব বা বাঁশ ব্যবহার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কখনও মাটি বা কলাগাছ ব্যবহার করা যাবে না। পচন সমাপ্তি নির্নয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই জাগ দেয়ার ১০-১২ দিন পর থেকে ২-১টা পচা পাট গাছ বের করে ধুয়ে দেখতে হবে যে, আঁশগুলো পচে পরস্পর পৃথক হয়েছে কিনা। পৃথক হলে বুঝতে হবে, পচন শেষ হয়েছে এবং সাথে সাথে সব পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ফেলতে হবে। পাট একটু বেশি পচানোর চেয়ে একটু কম পচানো ভালো। আঁশ ছাড়ানোর পূর্বে পাটের গোড়ার অংশ হাত দিয়ে চিপে টেনে ফেলে দিয়ে বা বাঁশ-কাঠের হাতুড়ি দিয়ে থেতলে নিয়ে আঁশ ছাড়ালে আঁশের গোড়ায় শক্ত অংশ বা কাটিংসের পরিমাণ কম হয়। যথাসম্ভব পরিষ্কার পানিতে আঁশ ধোয়া উচিত। আঁশ মাটিতে না শুকিয়ে বাঁশের আড়ায় বা ঘরের চালে বা গাছের ডালে বা ব্রিজের রেলিংয়ে বিছিয়ে দিয়ে ভালোভাবে শুকানো উচিত। লক্ষ্য রাখতে হবে আঁশে যেন ময়লা বা ধুলাবালি লেগে না থাকে। এভাবে পচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পাট আঁশ ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত করা হয়। ভিজা আঁশ কখনও গুদামজাত করা উচিত নয়। কারণ এতে আঁশের মান নষ্ট হয়ে যায়।

 

খ. স্বল্প পানি অঞ্চলে পাট পচন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের অনেক অঞ্চেলে অনেক পাট জন্মে, কিন্তু পাট পচনের প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত পানির অভাবে ওইসব এলাকায় উৎপাদিত পাট আঁশের অধিকাংশই অত্যন্ত নিম্নমানের হয়। আমরা জানি যে, আঁশের গুণাগুণের ওপর পাটের মূল্য নির্ভর করে। কি কারণে পাট আঁশের গুণাগুণ খারাপ হয়, এ ব্যাপারে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। দেখা গেছে, বিশেষ করে পাট পচন পদ্ধতির তারতম্যের কারণেই পাট আঁশের গুণাগুণের তারতম্য হয়। যেহেতু পাট পচন প্রক্রিয়া পানিতে সম্পন্ন হয়, তাই পাট পচন ও আঁশের গুণাগুণ মূলত পচন পানির ওপর নির্ভরশীল। দেশের বিভিন্ন পাট উৎপাদনকারী এলাকার পাট পচন সমস্যা বিভিন্ন। তাই সেসব এলাকায় প্রচুর পাট উৎপন্ন হয়, অথচ প্রয়োজনীয় পচন পানির অভাবে চাষি ভাইয়েরা পাট সঠিকভাবে পচাতে পারছেন না, ফলে উৎপাদিত আঁশের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হচ্ছে- সেসব এলাকার পাট পচন সমস্যার সমাধানকল্পে দীর্ঘদিন গবেষণার পর বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে ওইসব এলাকার চাষি ভাইদের জন্য বাঁশের হুকের সাহায্যে ‘পাটের ছালকরণ (রিবনিং) ও ছাল পচন (রিবন রেটিং) পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছে। বিজেআরআই এ পাটের রিবনিং করার জন্য পরবর্তীকালে ১. ‘সিংগেল রোলার’, ২. ‘ডাবল রোলার রিবনার’ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। কারিগরি দিক বিবেচনায় রিবনিংয়ের জন্য ‘ডাবল রোলার রিবনার’ অত্যন্ত সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে পুরো পাট গাছ না পচিয়ে কাঁচা গাছ থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে ছাল পচাতে হয়, ফলে পচানোর জন্য পানি কম লাগে, পচনের জায়গা ও সময় কম লাগে, বহন খরচ কম লাগে, আঁশে কোনো কাটিংস থাকে না এবং আঁশের মান অত্যন্ত ভালো হয়, ফলে আঁশের মূল্য বেশি পাওয়া যায়।

 

বাঁশের হুকের সাহায্যে ছাল ছাড়ানোর পদ্ধতি
প্রথমে ৫ ফুট বা প্রায় ১৫২ সেমি. লম্বা এক খণ্ড বোরাক বাঁশ নিয়ে একপ্রান্ত আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে, যাতে বাঁশের প্রান্তটির দুইদিক ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো দেখায়। এটাকে বাঁশের হুক বলা হয়। এবার বাঁশ খ-টির অপর প্রান্ত আনুমানিক ১ হতে ১.৫ ফুট সুবিধা অনুযায়ী মাটির মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দিতে হবে। পাশাপাশি ৩-৪ ফুট দূরে দূরে প্রয়োজনমতো এমন কয়েকটি বাঁশের হুক সারিবদ্ধভাবে মাটিতে বসাতে হবে। এখন ওই বাঁশের হুকগুলোর সঙ্গে একটি মুরুলি বাঁশ দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে আড়া বাঁধতে হবে যার ওপর পাট গাছ দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে। পাট গাছগুলো আড়ার ওপর দাঁড় করানোর পূর্র্বে যথা সম্ভব গাছের পাতা হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গাছির গোড়ার ৩-৪ ইঞ্চি (৮-১০ সেমি.) একটি শক্ত কাঠের/বাঁশের হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে নিতে হবে। এবার গাছের থেঁতলানো গোড়া বাঁশের হুকের মধ্যে রেখে ছালগুলোকে হাত দিয়ে হুকের দুইদিকে দুই ভাগ করে দুই হাতে নিজের দিকে সজোরে টান দিতে হবে। দেখা যাবে পাটের ছালগুলো সহজেই পাট খড়ি হতে আলাদা হয়ে গেছে এবং পাট খড়িগুলো সামনের দিকে চলে গেছে। এভাবে ৪-৫টি পাট গাছের ছাল একসঙ্গে বের করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে বোরাক বাঁশের যে কোনো প্রান্ত ধারালো দায়ের সাহায্যে কোনাকোনিভাবে কেটে বাঁশের হুক তৈরি করে পাট ছাল পৃথককরণ করা হলে এ ছালগুলোকে স্বল্প পানিতে বা পৃথক করা বাকলগুলাকে দুইভাবে পচানো যায়- ১. বড় মাটির চারিতে বাকল জাগ গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চারিটি ভরে দিতে হয়। একটি বড় চারিতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল বা বাকল পচনো যায়। ২. যদি আশপাশে ছোট ডোবা বা পুকুর বা খাল কম গভীরতা সম্পন্ন জলাশয় থাকে তবে ছালগুলো গোলাকার মোড়া বেঁধে একটি লম্বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে পচানো যায়। এভাবে অল্প পানিতে খুব কম সময়ে পচন প্রক্রিয়াসম্পন্ন হয়। পচন সময় কমানের জন্য ১০০০ কেজি কাঁচা ছালে জন্য ১ সের বা প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া সার পচন পানিতে মিশিয়ে দিয়ে অথবা একটি ছোট বালতি বা হাঁড়িতে দুই একটি পাট গাছ ছোট ছোট টুকরা করে আগেই পচিয়ে নিয়ে পরে ছাল পচানোর সময় ওই পানি মিশিয়ে দিতে হয়। বাঁশের হুকের পরিবর্তে সিংগেল-ডাবল রোলার রিবনারের সাহায্যে একই ভাবে পাটের রিবনিং করা যায়। পরে ছালগুলোকে পরিমাণ সাইজের গোলাকার মোড়া বাঁধতে হবে এবং পাট খড়িগুলো শুকিয়ে নিতে হবে। তবে ‘ডাবল রোলার রিবনারের’ সাহায্যে ছাল ছাড়ানো বেশি সুবিধাজনক।

 

দেশী পাটের বয়স ১০৫-১১০ দিন হলে পাট কাটতে হবে। তোষা পাটের বয়স ১০০-১০৫ দিন হলে পাট কাটতে হবে। পাট কাটার পরে পাতা ঝরায়ে পাট গাছের গোড়ার অংশে ৩-৪ ইঞ্চি পরিমাণ একটি কাঠ-বাঁশের হাতুড়ি বা মুগুর দিয়ে থেঁতলিয়ে নিতে হবে। থেঁতলানো কয়েকটি গাছ (৪-৫টি) রিবনারের ২ রোলারে মাঝখানে রেখে থেঁতলানো ছালগুলোকে ২ ভাগ করে রোলারেরর সামনের দিকে থেকে বাকিয়ে নিয়ে পেছনের দিক থেকে টান দিতে হবে। এত পাট কাঠি সামনের দিকে চলে যাবে এবং পাট গাছের ছালগুলো হাতে থেকে যাবে। ছালগুলোকে একত্রিত করে বান্ডিল/মোড়া বাঁধতে হবে যেন পাট ধোয়ার সময় সহজে খোলা যায়। বান্ডিল/মোড়াগুলোকে একত্রিত করে পূর্বে তৈরিকৃত গর্ত বা মাটির চাড়িতে জাগ দিতে হবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিবন পদ্ধতির গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১ একরে উৎপাদিত পাটের রিবন পচাতে ১৬,০০০ গ্যালনের মতো পানি প্রয়োজন হয়।
 

পাট ছালের মোড়া ভিজানোর জন্য গর্ত তৈরির পদ্ধতি
প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে উৎপাদিত পাট ছালের পরিমাণ প্রায় ৩০০০-৩৫০০ কেজি। প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদিত পাটের ছাল পচানোর জন্য ৬ মি.২মি.১মি.-দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা মাপের ১টি গর্ত করতে হবে। গর্তটির নিচে ও চারিপাশে ১টি পলিথিন কাগজ বিছিয়ে দিতে হবে, যেন পানি চলে না য়ায়। এ গর্তটিতে খাল বা বিলের ৮০০০-৮৫০০ লিটার পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। পাট ছালে বান্ডিল-মোড়াগুলো গর্তের পানিতে ডুবিয়ে জাগ দিতে হবে। কচুরিপানা বা খড় বা চট দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে, যেন রৌদ্র ছালগুলো শুকিয়ে না যায়। প্রতি বিঘার পাট ছালের (৩০০০-৩৫০০ কেজি) জন্য ৩০০-৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু বাছ পাট নিয়ে মাটির চাড়ি বা গামলায় পানিতে পচিয়ে, সেই পচা পানি তৈরি করা গর্তে দেয়া যেতে পারে। জাগ সম্পন্ন হলে আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে বা মাটির চাড়িতে ধুয়ে বাঁশের আড়ায় ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে। প্রতি কেজি ছালের জন্য ২.৫০-৩.৩০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত পানি দেয়া যেতে পারে।

 

এ প্রযুক্তি শুধুমাত্র যে এলাকায় পাট পচনের পানির অভাব রয়েছে সেই এলাকার জন্য প্রযোজ্য। পানির অভাবজনিত কারণে পাট পচনের জন্য বহু দূরে পাট গাছ বহনের চেয়ে জমির আইলের পাশে গর্ত করে এ পদ্ধতিতে পাট পচানো লাভজনক। পাট কাটার সঙ্গে সঙ্গে ‘ছালকরণ’ করতে হবে। রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ‘ছালকরণ’ সমস্যা হবে। সম্ভব হলে মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে এ কাজ করতে হবে। পাট কাটার ১২-১৫ দিন পূর্বে গর্ত করে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে। গর্তের চারপাশে মাটি দিয়ে উঁচু করতে হবে যাতে বাহিরের ময়লা পানি যেন গর্তে প্রবেশ না করে। অতি বৃষ্টিতে গর্তের পানি যাতে উপচে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
 

ছালকরণের জন্য পাট কাটার সময় : ছালকরণের জন্য সাধারণভাবে পাট জাগ দেয়ার কয়েক দিন পূর্বে পাট কাটতে হবে। এ পদ্ধতিতে দেশী পাটের বয়স ১০৫  থেকে ১১০ দিন এবং তোষা বা বগী পাটের বয়স ১০০ থেকে ১০৫ দিন হলেই পাট কাটতে হবে।
 

পচন সময় নির্ধারণ : মনে রাখতে হবে যে, ছাল পচতে খুব কম সময় লাগে। কাজেই ছাল পানিতে ডুবানোর ৭-৮ দিন পর থেকে পচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা উচিত। এ উদ্দেশ্যে দু-একটা ছাল পানি থেকে তুলে ভালো করে ধুয়ে দেখা উচিত এবং পচন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছালগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে আঁশ সংগ্রহ করতে হবে।
রিবন রেটিং পদ্ধিতির সুবিধা হলো : অল্প পানিতে অধিক পাট পচানো যায়; পাট পচানের জন্য পরিমিত পানির অভাব হলে এ পদ্ধতি সহজে ব্যবহার করা যায় ও পচানোর জন্য কম পানি লাগে; পচানোর জন্য জায়গা ও সময় কম লাগে; পাট পচানের জন্য পরিবহন খরচ কম লাগে; এ পচন পদ্ধতি স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশেবান্ধব; কাটিংসমুক্ত উন্নতমানের আঁশ পাওয়া যায়; ভালো আঁশে বেশি মূল্য পাওয়া যায় ও পাটখড়িগুলো শক্ত থাকে, জ্বালানি হিসেবে বিভিন্ন কাজের ব্যবহারে সুবিধাজনক ও টেকসই হয়।   

 

স্বল্প পানি অঞ্চলগুলো পাট পচন সমস্যা ও সমাধান
বাংলাদেশের শুষ্ক অঞ্চলগুলো বিশেষ করে বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের কিছু অংশে উন্নতমানের পাট গাছ উৎপন্ন হয় কিন্তু উৎপাদিত আঁশের মান খুবই খারাপ। সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাট পচন পানির অপর্যাপ্ততা ও প্রয়োজনীয় পানির অভাবেই পাট-চাষি ভাইরা খাল/ডোবায়/পুকুরে অতি অল্প পানিতেই কাদা মাটি ঢাকা দিয়ে পাট পচনের কাজটি সমাধান করেন। ফলে স্বভাবতই উৎপাদিত আঁশের মান অতিনি¤œ মানের হয়। গবেষণার ফলাফলে প্রমাণিত হয়, সেসব এলাকায় অল্প পানিতে পাট পচানের কলাকৌশল উদ্ভাবন  এবং স্থান বিশেষে পাট পচনের প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে উল্লিখিত এলাকার উৎপাদিত পাটের আঁশের মান উন্নত করা সম্ভব।

 

পাটের আঁশ থাকে পাট গাছের বাকলে বা ছালে। কাজেই পুরো পাট গাছ পাট কাঠিসহ না পচিয়ে কাঁচা অবস্থায় গাছের ছাল উঠিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র ছাল পচালে পচন পানির প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। পাটের ছাল পচালে শুধু যে কম পানিতে পাট পচানো সম্ভব তাই নয় বরং আরও অনেক বিশেষ সুবিধা রয়েছে, যেমন- কম পানিতে অনেক পাট পচানো যায়; কাটিংসবিহীন উন্নতমানের আঁশ উৎপাদিত হয়; গোটা পাট পচাতে যত সময়ের প্রয়োজন তার অর্ধেক সময়ে পাট পচানো সম্ভব হয়; পচন স্থানে নেয়ার জন্য পরিবহন খরচ কম লাগে। অল্প পরিমাণ স্থানে বেশি পাট পচানো সম্ভব; যেহেতু কাঁচা অবস্থায় পাট কাঠি আলাদা করা এবং এসব পাট কাঠি পচনকালে পানির সংস্পর্শে আসে না ফলে স্বভাবতই এ পাট কাঠি অপেক্ষাকৃত শক্ত থাকে। বাংলাদেশে পাট কাঠির ব্যবহারিক মূল্য অনেক।
 

বর্তমানে চাষি পর্যায়ে উৎপাদিত প্রায় ৩০-৪০ লাখ বেল (এক বেল= প্রায় ৫ মণ= ১৮০ কেজি) অতি নিম্নমানের ছাল ও অত্যাধিক কাটিংযুক্ত আঁশ বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পাটকলে ও গুদামে অব্যবহৃত অবস্থায় মজুদ আছে। এসব আঁশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশের বাজারে কোনোই চাহিদা নেই এবং কলে ব্যবহার করাও সম্ভব নয়। এসব আঁশগুলোকে বিভিন্ন জীবাণু তাত্ত্বিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানোন্নয়ন করে কলকারখানায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে বহুমুখী গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে এবং যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে।

 

কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম*
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭

বিস্তারিত
পরিবর্তিত জলবায়ুতে পরিবেশ রক্ষায় পাট ও পাটজাত পণ্য

বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছে পাট। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাট ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয় এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিম তন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে The International Year of Natural Fibers হিসেবে ঘোষিত ও পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার আরও উৎসাহিত হয়েছে।
 

পাটজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার : পরিবেশ রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য উন্নত হাইড্রোকার্বন মুক্ত জুট ব্লেচিং অয়েল উন্নয়ন, জুট ফাইবারকে বিশেষ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নিরোধী পাটজাত বস্ত্র উৎপাদন, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প স্বল্পব্যয়ে পাটের ব্যাগ তৈরি এবং দেশের নার্সারিগুলোতে গাছের চারা সংরক্ষণে পাটের ব্যাগ (নার্সারি পট) উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া পাট কাটিংস ও নি¤œমানের পাটের সাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল। জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭শ’ কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, রেল, সড়কসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অবকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে জিওটেক্সটাইলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে নানা কাজে ‘মেটাল নেটিং’ বা পলিমার থেকে তৈরি সিনথেটিক জিওটেক্সটাইলের পরিবর্তে পরিবেশ উপযোগী ও উৎকৃষ্ট জুট জিওটেক্সটাইলের কদর বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার এন্ড পাম্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপের বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্চ, ওডি ফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের জিএম মটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্পানিসহ নামিদামি সব গাড়ি কোম্পানিই তাদের গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডব্লিউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশ সম্মত ‘গ্রিন কার’, যার চাহিদা এখন প্রচুর।   
 

জমির উর্বরতা বৃদ্ধি : মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম। পাট ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির ওপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলি ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর জমিতে যে পাটগাছের গোড়াসহ শিকড় থেকে যায় তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার যোগ করে, এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। প্রতি বছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাট পাতা ও ৪২৩.৪০ হাজার টন পাটগাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। এ কারণে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়।
 

বায়ুম-লকে শুদ্ধিকরণ : পরিবেশবিদদের মতে, প্রতিটি দেশেই মোট ভূমির তুলনায় ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পাট একটি আঁশ উৎপাদনকারী মাঠ ফসল যা বনভূমির মতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ভূমিকা রাখতে পারে। সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৪৭.৬৮ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ পাটগাছ উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৫.৭২ মিলিয়ন টন কাঁচাপাতা এবং ২১.৯৩ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ কা-। বর্তমান বিশ্বে পাট আঁশের উৎপাদন প্রায় ২.৯৮ মিলিয়ন টন। আঁশের সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে ১.৪৩ মিলিয়ন টন শুকনা পাতা ও ৬.২০ মিলিয়ন টন শুকনা পাটকাঠি বায়োমাস হিসেবে উৎপাদিত হয়। পাট ফসলের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম/বর্গমিটার/সেকেন্ড। পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। আবার অন্যদিকে, প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। বনের গাছ কেটে ম- তৈরি করে কাগজ তৈরি হয়। এক টন কাগজ তৈরি করতে ১৭টি পরিণত গাছ কাটতে হয়। পরিবেশ সুরক্ষার দিক চিন্তা করে পাটকাঠি দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়। পাটকাঠি জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ও পেপার পাল্প তৈরিতে ব্যবহৃত হাওয়ায় বন উজাড়ের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিবেশ রক্ষা পায়।
 

বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম তন্তু বর্জন : পৃথিবী জুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এ বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈববিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড মেশে। এসব ক্ষতিকারক বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিাভন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশক অন্যান্য উপাদানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ইতালি। অথচ তারা ছিল পৃথিবীর সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারকারী দেশ। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশের মধ্যে আছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্য। এ তালিকা প্রতি বছরই বাড়ছে। ওয়ালমার্ট, টেসকোর মতো বৃহৎ চেইন শপগুলো পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতি মাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক আঁশের তৈরি ব্যাগের প্রয়েজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে ১ লাখ পাটের ব্যাগ রপ্তানি করা হয়। সম্প্রতি পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েয় হিসাব মতে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার ১০ লাখেরও বেশি পাখি এবং  লক্ষাধিক জলজপ্রাণী।
 

সরকারি উদ্যোগ : বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পাটের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি, চাষ সম্প্রসারণ, গুণগতমান উন্নয়ন এবং পাট শিল্পকে সুরক্ষা দিতে অনুধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রেখে পাট আইন-২০১৭ মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর ফলে পাটজাত পন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকার বস্তা ব্যবহৃত হয়েছে। সম্প্রতি সরকার ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি ও সারের সঙ্গে আরও ১১টি পণ্যের সরবরাহ ও বিতরণে কৃত্রিম মোড়কের ব্যবহারজনিত কারণে সৃষ্টি পরিবেশ দূষণরোধকল্পে বাধ্যতামূলকভাবে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নিত হবে। এতে ৫,৩৯,২০০ টন পাটের আঁশের প্রয়োজন হবে যা দেশের মোট পাট উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ।
 

ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলত পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এ আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। এদেশের মান্ধাতার আমলের পাটকলগুলো আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলো সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে। পাট চাষ থেকে পাটপন্য উৎপাদন, বিক্রয় ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। সেজন্য সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাটের মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

কৃষিবিদ মো. আল-মামুন*
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭; ০১৭১১১৮৬০৫১,
almamunbjri@gmail.com

বিস্তারিত
ছাগলের পিপিআর রোগ

পিপিআর হচ্ছে ছাগলের একটি জীবনঘাতী রোগ। Peste des Petits Ruminants (PPR) নামক ভাইরাসের কারণে এ রোগ হয়। এ রোগ হলে অসুস্থ প্রাণীর জ্বর, মুখে ঘা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। অনেক সময় অসুস্থ প্রাণীটি মারাও যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এটি একটি মরবিলি ভাইরাস (Morbillivirus) যার ফ্যামিলি হলো প্যারমিক্সো ভাইরাস(Paramyxovirus)। এ রোগটি বিভিন্ন গবাদিপশু ও কিছু কিছু বন্যপ্রাণীতে হতে পারে। তবে এ রোগটি সচরাচর দেখা যায় ছাগল এবং ভেড়াতে।  এ রোগটি প্রথম দেখা যায়, আইভরিকোস্টে ১৯৪২ সালে। তারা এ রোগকে কাটা (kata) বলত। ১৯৮৭ সালে আরব আমিরাতে চিড়িয়াখানার প্রাণী আক্রান্ত হয় । এটি প্রথম ছাগল ভেড়া ছাড়া অন্য প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড। ওই চিড়িয়াখানায় গজলা হরিণ (gazelle), বুনো  ছাগল (রনবী), গেমস বকের (gemsbok) দেহে এ রোগ শনাক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে চীনে সর্বপ্রথম এ রোগ রিপোর্ট করা হয়। ২০০৮ সালে মরোক্কোতে এ   রোগ প্রথম শনাক্ত করা হয়।
 

কিভাবে  এ রোগ ছড়ায়?
১. অসুস্থ প্রাণীর চোখ, নাক, মুখ থেকে  নিঃসৃত তরল, পায়খানা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে।
২. যেসব প্রাণী অসুস্থ প্রাণীর সংস্পর্শে থাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সে রোগ সুস্থ প্রাণীকে আক্রান্ত করতে পারে।
৩. অসুস্থ প্রাণীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও এ রোগ সুস্থ প্রাণীকে আক্রান্ত করতে পারে।
৪. পানি, খাদ্য পাত্র এবং অসুস্থ প্রাণীর ব্যবহৃত    আসবাবপত্র দিয়েও এ রোগ ছড়াতে পারে।
৫. যে প্রাণীর শরীরে জীবাণু আছে কিন্তু এখনও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি  সেসব প্রাণীর মাধ্যমে রোগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়  স্থানান্তর হতে পারে।
৬. তবে আশার কথা হলো, দেহের বাইরে এ রোগের জীবাণু  বেশিক্ষণ টিকে থাকতে  পারে না।

 

এ রোগের লক্ষণ কি কি?
১. সাধারণ পিপিআর রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৩-৬ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
২. শরীরের তাপমাত্র হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যেতে পারে। এ তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি থেকে ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
৩. ছাগলের নাক, মুখ, চোখ দিয়ে প্রথমে পাতলা তরল পদার্থ বের হয়। পরবর্তীতে তা ঘন ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। ধীরে ধীরে তা আরও শুকিয়ে নাকের ছিদ্র বন্ধ করে দিতে পারে । ফলে প্রাণীটির শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
৪. অসুস্থ পশুটির চোখও এ রোগের আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে, ছাগলের চোখের পাতা ফুলে যেতে পারে। অনেক সময় ঘন দানাদার পদার্থ নিঃসৃত হয়ে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৫. রোগের এক পর্যায়ে মুখ ফুলে যেতে পারে। মুখের ভেতরে নরম টিস্যুগুলো আক্রান্ত হতে পারে। দাঁতের গোড়ার মাংস পেশিতে ঘা হতে পারে। তাছাড়া দাঁতের মাঝখানে ফাঁকে ফাঁকে, মুখের ভেতরে তালুতে, ঠোঁটে, জিহ্বায় ক্ষত তৈরি হতে পারে।
৬. অনেক সময় অসুস্থ প্রাণীটির মধ্যে মারাত্মক রকমের ডাইরিয়া দেখা দিতে পারে। ডাইরিয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণ তরল শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ফলে প্রাণীটি প্রচ- রকমের পানি শূন্যতায় ভোগেন। এ পানি শূন্যতার কারণেও প্রাণীটি মারা যেতে পারে।
৭. অসুস্থ প্রাণীটির ওজন হ্রাস পায়। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থেকে প্রাণীটি।
৮. পিপিআর আক্রান্ত ছাগলে, অসুস্থ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
৯. অসুস্থ হওয়ার পাঁচ থেকে দশ দিনের মধ্যে   প্রাণীটি মারা যেতে পারে।
১০. আক্রান্ত ছাগলটি যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে গর্ভপাতের সম্ভবনা থাকে।
১১. অল্প বয়স্ক পশুগুলো এ রোগে  অধিক আক্রান্ত হয়।
১২. ভেড়ার চেয়ে ছাগলের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

 

রোগ হয়ে গেলে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
১. অসুস্থ প্রাণীকে আলাদা করে চিকিৎসা করাতে হবে।     ২.  অসুস্থ প্রাণীর নাক, মুখ, চোখ দিয়ে নিসৃত তরল যাতে অন্য প্রাণীর শরীরে না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. ছাগলের থাকার ঘর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

 

চিকিৎসা
১. পিপিআর রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ২য় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার এবং পরজীবী সংক্রমণ রোধ করে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায়।
২. শ্বাসতন্ত্রের ২য় পর্যায়ের সংক্রমণ রোধে অক্সিটেট্রাসাক্লিন ও ক্লোর টেট্রাসাইক্লিন খুব কার্যকর।
৩. গবেষণায় দেখা গেছে, ফুড থেরাপি এবং জীবাণুরোধী ওষুধ যেমন- ইনরোফ্লোক্সাসিন, সেফটিফোর নির্দিষ্ট ডোজে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৪. ৫% বরো-গ্লিসারিন দিয়ে মুখ ধুয়ে দিলে মুখের ক্ষত অনেক ভালো হয়ে যায়।
৫. তবে চোখের চারপাশে, নাক, মুখ পরিষ্কার কাপড় এবং কটন টিউব দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে  দিনে   ২-৩ বার করে।
৬. অসুস্থ ছাগলকে যত দ্রুত সম্ভব আলাদা করে ফেলতে হবে।
৭. অতি দ্রুত নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৮. অসুস্থ প্রাণীটি মারা গেলে অবশ্য ভালোভাবে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

 

প্রতিরোধ
১. পিপিআর রোগের প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো ছাগল এবং ভেড়াকে নিয়মিত টিকা প্রদান করা।
এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে সরকারিভাবে পিপিআর রোগের টিকা সরবরাহ করা হয়। আগ্রহী খামারিরা ওই দপ্তর থেকে পিপিআর টিকা সংগ্রহ করতে পারেন।

 

২. টিকা প্রদান পদ্ধতি  
ক. উৎপাদন কেন্দ্র বা সরবরাহ  কেন্দ্র থেকে কুল ভ্যান/ফ্লাক্সে পর্যাপ্ত বরফ দিয়ে টিকা বহন করতে হবে।
খ. ডিসপোসেবল সিরিঞ্জ  দিয়ে টিকা প্রদান করতে হবে এবং সব রকম জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. টিকা দেয়ার পূর্বে ১০০ মিলি ডাইলুয়েন্টের বোতল কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা+৪ ডিগ্রি থেকে+৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেখে ব্যবহার করতে হবে।
ঘ. ডাইলুয়েন্ট মিশ্রিত টিকা ১-২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।
ঙ.  টিকা প্রয়োগের মাত্রা প্রতি ছাগল বা ভেড়ার জন্য ১ মিলি. মাত্রা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হবে।
চ. বাচ্চার বয়স ৪ মাস হলেই এ টিকা প্রয়োগ  করা যায়।       ২ মাস বয়সের বাচ্চাকেও এ টিকা দেয়া যায়।
ছ. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ১ বছর পর পুনরায় (বুস্টার) টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
জ. প্রসবের ১৫ দিন আগে গর্ভবতী ছাগল/ভেড়াকে এ টিকা প্রয়োগ করা যাবে না।
ঝ. পুষ্টিহীন প্রাণিকে এ টিকা প্রয়োগ না করাই উত্তম।
ঞ. টিকা প্রয়োগের ১৫ দিন আগে কৃমিনাশক খাওয়ানো গেলে টিকার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
ট. খামারে নতুন ছাগল/ভেড়া আনলে ১০ দিন পর টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
ঠ. আক্রান্ত ছাগল/ভেড়াকে এ টিকা প্রয়োগ করা যাবে না।
ড. ব্যবহৃত টিকার বোতল বা অবশিষ্ট টিকা যথাযথভাবে নষ্ট করে ফেলতে হবে।

 

কৃষিবিদ ডা. সুচয়ন চৌধুরী*
*ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর, রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি

 

বিস্তারিত
বছরব্যাপী মানসম্মত পেয়ারা উৎপাদন

পেয়ারাকে অনেকে গরিবের আপেল বলে থাকেন। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয় এবং এর মোট উৎপাদন ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। আর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের কাছে পেয়ারা এখন স্বপ্নের বীজ বপনের মতো একটি বিষয়। পেয়ারা উৎপাদনে যেভাবে কৃষক সাড়া দিচ্ছে তা অকল্পনীয়। পেয়ারার গুণাগুণ আপেলের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। পেয়ারাতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা মানবদেহের গঠন ও বৃদ্ধিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পেয়ারার গুণের শেষ নেই। এতে আছে ভেষজ গুণ। পেয়ারার শিকড়, গাছের বাকল, পাতা এবং অপরিপক্ব ফল এগুলো কলেরা, আমাশয় ও অন্যান্য পেটের পীড়া নিরাময়ে ভালো কাজ করে। এছাড়া ক্ষত বা ঘা জাতীয় জায়গায় থেঁতলানো পাতার প্রলেপ দিলে খুব উপকার পাওয়া যায়। পেয়ারা পাতা চিবালে দাঁতের ব্যথা দূর হয়। পেয়ারা থেকে জ্যাম, জেলি, আচার, আইসক্রিম প্রভৃতি তৈরি হয়। পেয়ারার পাতা থেকে চা তৈরি করা যায় যা স্বাস্থের জন্য খুব ভালো।
 

সাধারণত বছরে দুইবার পেয়ারা হয়, একবার বর্ষাকালে, আরেকবার শীতকালে। বর্ষাকালে পেয়ারার উৎপাদন শীতকালের চেয়ে বেশি হয়। তবে বর্ষার সময় আবহাওয়াতে জলীয়ভাব বেশি থাকার জন্য মিষ্টতা কম থাকে। তাছড়াও জলীয় ভাব বেশি থাকার দরুন পাকা ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে বাজারে তেমন দর পাওয়া যায় না। সব জাতের পেয়ারার ক্ষেত্রেই শীতকালে গুণাগুণ বেড়ে যায়, ফলের আকৃতি ও রঙ ভালো হয়, রোগ এবং পোকার আক্রমণ কম হয়, ফলে বাজারদর খুব ভালো থাকে। তবে উন্নত কিছু কৌশল বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেয়ারার মান সম্মত উৎপাদন করা সম্ভব। পেয়ারাতে ব্যাগিং করে, জোড় কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করে এবং নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ করে এর ফলন কাক্সিক্ষত সময়ে করানো যায় এবং সহজে বাজারজাত করে লাভ বেশি পাওয়া যায়।
 

পলিব্যাগ ব্যবহার বা পেয়ারাতে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার
পলিব্যাগ ব্যবহার করে মানসম্মত পেয়ারা উৎপাদন করা যায় এবং পেয়ারা চাষে সেসব সমস্যা থাকে সে সমস্যা দূর করা যায়। প্রযুক্তিটি হচ্ছে পেয়ারা ফল পলিথিনের প্যাকেট দিয়ে প্রথমে ঢেকে দিতে হয়। এতে ফল পোকার আক্রমণ থেকে বেঁচে যাবে এবং ফলের রঙ, মান ও বাজার মূল্য বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে পলিথিনের ব্যাগটি ফলের বোঁটার সাথে হালকা করে বেঁধে দিতে হবে এবং ফলের নিচের দিকে পলিথিনের মুখটি খোলা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি সতর্কতা আছে সেটি হলো পলিথিনের নিচে কয়েকটি ছিদ্র করে দিতে হবে যেন পলিথিনের ভেতরে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং জমাকৃত পানি বের হয়ে যেতে পারে। কারণ পেয়ারা থেকে যে পানি প্রস্বেদন হয় সেটি ভেতরে জমা থাকলে সেখান থেকে ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। পেয়ারা মার্বেলের চেয়ে একটু বড় হলেই ব্যাগ পরানো হয়। ব্যাগিং করলে মাছি পোকা ফলের গায়ে বসে না সেজন্য ফল ভালো থাকে আর সরাসরি কীটনাশক পেয়ারাতে পড়ে না, তাই স্বাস্থ্যসম্মত পেয়ারা পাওয়া যায়। পেয়ারা উৎপাদন ও ফলনে ব্যাগিং পদ্ধতি এক নবদিগন্তের যাত্রা শুরু করেছে।

 

পেয়ারা গাছের কুশিভাঙা
সাধারণত বৈশাখ মাসে পেয়ারার চারা লাগানো হয়। এরপর গাছ ৮-৯ মাস বয়সের গাছে ফল আসে এবং অতিরিক্ত বৃদ্ধি কমানো এবং ডাল সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য কুশি ভেঙে দেয়া হয়। কুশি ভাঙার ২০-২৫ দিনের মধ্যেই নতুন অতিরিক্ত কয়েকটি কুশি আসে। আর যত বেশি কুশি আসবে তত বেশি ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিবে।

 

জোড় কলমের মাধ্যমে
পেয়ারা একটি সম্ভাবনাময় ফসল। অনেক চাষিই আজ প্রতিষ্ঠিত এ ফল চাষ করে। সাধারণত বীজ থেকে উৎপাদিত চারা দ্বারাই আমাদের দেশে এর চাষ হয়ে থাকে। তবে এখন বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে উন্নত জাত সৃষ্টি করে তা কৃষকের মাঝে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। বীজ থেকে যেন তেন ভাবে গজানো চারা ব্যবহার করে ফলের গুণগতমান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুতে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢলে পড়া বা উইল্টিং রোগ পেয়ারা চাষের জন্য একটি অন্তরায়। তাই জোড় কলমের মাধ্যমে উইল্টিং প্রতিরোধী গাছ তৈরি করে পেয়ারার সফল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পলি পেয়ারা, আঙুর পেয়ারা এবং স্ট্রবেরি পেয়ারার জাতের চারাকে আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করে পেয়ারার উইল্ট রোগ এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে আঙুর পেয়ারার বীজের চারা অনেক চিকন হয় বলে জোড় কলমের ক্ষেত্রে পলি পেয়রা ও স্ট্রবেরি পেয়ারা বীজের চারাকে আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।

 

 নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে তিনভাবে ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ করে পেয়ারা উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব-
ক. মৌসুমি ফল উৎপাদনের সময়ে কিছু ফুল ও ফল ছিঁড়ে দিয়ে অমৌসুমি ফল ধরাকে উৎসাহিত করে;
খ. সার, পানি ও হরমোন প্রয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় ব্যবহার করে;
গ. ব্যান্ডিং বা বাঁকানো পদ্ধতি ব্যবহার করে।

 

ফুল ও ফল ছিঁড়ে ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ
বর্ষাকালের ফলন পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে পারলে বা কমাতে পারলে শীতকালের ফলন অনেকটা বাড়ানো যায়। এজন্য বসন্তকালে গাছের চারদিকের মাটি খুঁড়ে শিকড় বের করে দিতে হবে। এরপর ১৫-১৬ দিন এভাবে রাখার ফলে সব পাতা হলদে হয়ে ঝড়ে পড়ে। এরপর গাছের গোড়ায় বিভিন্ন জৈব এবং অজৈব সার দিয়ে সেচ দিতে হবে। ফলে বর্ষার সময় নতুনভাবে ডালপালা ও ফুল ধরে। এছাড়াও এপ্রিল-মে মাসে সেগুলোকে ছিঁড়ে দিলে বর্ষায় ফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এরপর আগস্ট-অক্টোবর মাসে প্রচুর ফুল আসে এবং শীতের সময় অধিক হারে পেয়ারা পাওয়া যায়। তবে এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য।

 

হরমোন প্রয়োগ
হরমোন গাছে স্প্রে করে এপ্রিল-মে মাসের ফুল নষ্ট করে পেয়ারার উৎপাদন বাড়ানো যায়। এপ্রিল-মে মাসে গাছে যখন ফুল আসে সেই সময় ২, ৪-ডি (১০০ লিটার পানিতে ১.৫ থেকে ২ গ্রাম) অথবা ন্যাপথেলিন এসিটিক এসিড (১০০ লিটার পানিতে ১০-১২ গ্রাম) অথবা ইউরিয়া ১০% ভালো সলুশন করে ফুলের ওপর ছড়িয়ে দিলে শতকরা ৭০ ভাগ ফুল ঝরে পড়ে। ফুল ঝরার সাথে সাথে এ হরমোনগুলোর ব্যবহারে গাছে আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২-৩ গুণ ফুল বেশি আসে। হরমোন খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় ফলে খুব একটা খরচ হয় না। হরমোন প্রয়োগের ফলে ফলের মিষ্টতা, ভিটামিন ‘সি’ প্রভৃতি গুণাগুণ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে।

 

ব্যান্ডিং বা শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতির মাধ্যমে অসময়ে ফল ধারণ
শাখা-প্রশাখা বাঁকানোর মাধ্যমে পেয়ারার অসময়ে বা সারা বছর ধরে ফুল ও ফল ধারণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গাছের বয়স দেড় বছর থেকে দুই বছর হলেই এ পদ্ধতি শুরু করতে হয় এবং ৫-৬ বছর পর্যন্ত এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সাধারণত বছরে দুইবার এ পদ্ধতিতে পেয়ারার ফুল ও ফল নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সাধারণত এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত একবার বাঁকানো হয়। আর সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার ডাল বাঁকানো হয়। ডাল বাঁকানোর ১০-১৫ দিন আগে সার ও পানি দিতে হবে। ডাল বাঁকানোর সময় শাখাটির অগ্রভাগের প্রায় এক-দেড় ফুট মতো পাতা ফুল ফল রেখে বাকি অংশের পাতা, ফুল ফল ও ছোট ডাল কেটে ফেলতে হয়। এভাবে সব শাখা-প্রশাখা গুলোকে তৈরি করে নেয়া হয়। এরপর সুতলি দিয়ে গাছের ডালের মাথায় বেঁধে গাছের শাখা-প্রশাখাগুলোকে বেকিয়ে গাছের কা-ের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়। এছাড়া মাটিতে খুঁটি পুঁতে খুঁটির সাথেও বেঁধে দেয়া যেতে পারে। এপ্রিল থেকে জুন সময়ে ডাল বাঁকানোর ১০-১২ দিন পর নতুন ডাল বের হয়। নতুন ডাল ১ সেমি. মতো হলে বাঁধা জায়গা খুলে দেয়া হয়। আবার সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর ডাল বাঁকানো হলে ডাল বাঁকানোর ২০-২৫ দিন পরে নতুন ডাল গজাতে শুরু করে। সাধারণত ডাল বাঁকানোর ৪৫-৬০ দিন পরে ফুল ধরতে শুরু করে।

 

সাধারণত নতুন ডালে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ জোড়া পাতার কোলে ফুল আসে। আর ডাল বাঁকানোর পরে যদি বৃষ্টি আসে বা আর্দ্র আবাহাওয়া ৩-৪ দিন থাকে তাহলে নতুন ডালের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে যার ফলে ফুলহীন অঙ্গজ বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ডাল বাঁকানো হলে ফল পাকতে শুরু করে অক্টোবর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে। আবার সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে ডাল বাঁকানো হলে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ফল পাকে। এ সময়ের ফল মিষ্টি হয় ও অন্যান্য সব গুণাগুণ বেশি থাকে। ফলের আকৃতি, রঙ সুন্দর হওয়ায় এ সময়ের পেয়ারার বাজরদর ভালো পাওয়া যায়।

 

কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি*

*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী; মোবাইল : ০১৮১৯৯২২৬১৩

বিস্তারিত
ফসলের রোগ দমনে পরিবেশবান্ধব বিনা-জৈব ছত্রাকনাশক

বিনা-জৈব ছত্রাকনাশক ফসলের রোগবালাই দমনকারী একটি জীবাণু গঠিত ছত্রাকনাশক। এন্টাগোনিস্টিক ট্রাইকোডারমা ছত্রাকে (টিআরডি-১০) ৫০, ১০০, ১৫০, ২০০, ৩০০ এবং ৩৫০ গ্রে মাত্রার রেডিয়েশন প্রয়োগ করে প্রাপ্ত শক্তিশালী আইসোলেটটি (টিআরডি-১০এম) উক্ত জৈব ছত্রাকনাশক ফরমুলেশনে ব্যবহার করা হয়।  বিভিন্ন ফসলের গোড়া পচা ও ঢলে পড়া রোগ দমনে এটি কার্যকরী। এটি কৃষিজ উচ্ছিষ্টে জন্মানো একটি পেস্টিসাইড। তবে পিট মাটি বা ট্যালকম পাউডারেও ফরমুলেটেড করা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় মসুর, ছোলা, সয়াবিন, টমেটো ও ঢেঁড়সের গোড়া পচা রোগ এমনকি ধানের খোলপোড়া রোগ দমনেও এটির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
 

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগে ফসলের রোগ দমনে নিবিড় গবেষণার ফলশ্রুতিতে উক্ত পরিবেশবান্ধব জৈব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবন হয়। এটি জীবাণু গঠিত তাই ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ্ধতি অন্যান্য রাসায়নিক পেস্টিসাইড থেকে একটু ভিন্ন। ব্যবহারের কৌশলের ওপর রোগদমন কার্যকারিতা অনেকাংশেই নির্ভর করে।
 

বিনা-জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহারের উপকারিতা
এ জৈব ছত্রাকনাশক মসুর, ছোলা, সয়াবিন, টমেটো, ঢেঁড়সের গোড়া পচা, ঢলে পড়া এবং ফুল ফল নষ্টকারী রোগ দমন করে, ফলে জমিতে প্রয়োজনীয় সুস্থ গাছের সংখ্যা নিশ্চিত হয় এবং তা সমবণ্টিত থাকায় ফলন বেশি হয়।
নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রয়োগ করলে ধানের খোলপোড়া রোগের আক্রমণ প্রায় ৬০% কমে  য়ায়।
ফসলের কোনো উপকারী অনুজীবকে ধ্বংস করে না তাই এর ব্যবহারে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।
মাটি ও ফসলের গুণাগুণ অক্ষুন্ন রাখে এবং কোনো কোনো ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ হলেই কৃষক উক্ত ছত্রাকনাশক সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন।
এটি পরিবেশবান্ধব যা রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
রাসায়নিক ছত্রাকনাশক বারবার ব্যবহারে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়, জৈব ছত্রাকনাশকে বরং মাটির গুণাগুণ আরও বৃদ্ধি পায়।
এটি বাড়ির আঙিনায় আবর্জনা ও জৈব পদার্থ দ্রুত পচনে সহায়তা করে তাই ফসলের কম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
অর্ধ শুষ্ক গোবরের সাথে (৪০ কেজি গোবরে এক কেজি জৈব ছত্রাকনাশক) উত্তমরূপে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে যে কোনো ফসলের জমিতে প্রয়োগ করলে একদিকে মাটি বাহিত রোগ দমন হয় অন্যদিকে জৈব পদার্থ ডিকম্পজিশন করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।   

 

মাটি ও বীজ শোধন পদ্ধতি
যে মাটিতে প্রতি বছর ফসলে গোড়া পচা রোগ দেখা যায় সেই মাটিতে জো-কন্ডিশনে বীজ বপন বা চারা রোপণের সাত দিন পূর্বে উক্ত ছত্রাকনাশক ১০০ কেজি প্রতি হেক্টরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে এবং ২০ দিন পর পর দুই বার ৫০ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে। ধানের খোলপোড়া রোগে চারা রোপণের ৩০, ৫০ এবং ৭০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে।

 

টবের মাটিতে ব্যবহার করতে হলে ৬ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত প্রতি কেজি মাটিতে ২ গ্রাম হিসেবে দিতে হবে। বীজতলাতেও অনুরূপে ব্যবহার করা যায়। তবে বীজ বপন বা চারা রোপণের ৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ শোধনে বীজের ওজনের ৩% উক্ত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।

 

ব্যবহারকারীর জন্য সতর্কতা
উৎপাদনের ৩ মাসের মধ্যে ব্যবহার করলে উত্তম ফল পাওয়া যায়।
রোদে বা বেশি তাপমাত্রায়  (৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে) এর গুণাগুণ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই অপক্ষোকৃত ঠা-া স্থানে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
ব্যবহার করার সময় নাকে মাস্ক ব্যবহার করতে    হবে। 

 

ড. মো. আবুল কাসেম*  

*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট; ময়মনসিংহ।shembina@gmail.com

বিস্তারিত
সজিনার পুষ্টি ও ব্যবহার

সজিনা একটি অতি পরিচিত দামি এবং সুস্বাদু সবজি। সজিনার ইংরেজি নাম Drumstick এবং বৈজ্ঞানিক নাম Moringa Oleifera উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও এ গাছ শীত প্রধান দেশ ব্যতীত সারা পৃথিবীতেই জন্মে। বারোমাসি সজিনার জাত প্রায় সারা বছরই বার বার ফলন দেয়। গাছে সব সময় ফুল, কচি পড দেখা যায়। আমাদের দেশে ২-৩ প্রকার সজিনা পাওয়া যায়। বসতবাড়ির জন্য সজিনা একটি আদর্শ সবজি গাছ।
 

অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ : দেশি-বিদেশি পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনাকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ আছে যা বহু উদ্ভিদেই নেই। সজিনা সবজির চেয়ে এর পাতার উপকার আরও বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
 

সজিনার পুষ্টি :  বিজ্ঞানীরা পুষ্টির দিক দিয়ে সজিনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ আখ্যায়িত করে বলেন এ গাছটি থেকে পুষ্টি, ঔষধিগুণ ও সারা বছর ফলন পাওয়া যায়  বিধায় বাড়ির আঙিনায় এটি একটি ‘মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ’ এর   পুষ্টিগুণ খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য শক্তি কি. ক্যাল ৪৩, পানি ৮৫.২ গ্রাম, আমিষ ২.৯ (গ্রাম), চর্বি  ০.২ (গ্রাম), শর্করা ৫.১ (গ্রাম), খাদ্য আঁশ ৪.৮ (গ্রাম), ক্যালসিয়াম ২৪ (মি. গ্রাম), আয়রন ০.২ (মি. গ্রাম), জিংক ০.১৬ (মি. গ্রাম), ভিটা-এ ২৬ (মি. গ্রাম), ভিটা-বি১ ০.০৪ (মি. গ্রাম), ভিটা-বি২ (মি. গ্রাম) ০.০৪ ভিটামিন-সি  ৬৯.৯ (মি. গ্রাম)। সূত্র বারটান/২০১৬
 

সজিনা পাতার গুণাগুণ : বিজ্ঞানীরা মনে করেন সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। নিরামিষভোগীরা সজিনার পাতা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর ৭ গুণ ভিটামিন-সি, দুধের ৪ গুণ ক্যালসিয়াম এবং দুই গুণ আমিষ, গাজরের ৪ গুণ ভিটামিন-এ, কলার ৩ গুণ পটাশিয়াম বিদ্যমান। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সজিনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনোসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন-সি সহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে।
 

এক টেবিল চামচ শুকনা সজিনা পাতার গুঁড়া থেকে ১-২ বছর বয়সী শিশুদের অত্যবশ্যকীয় ১৪% আমিষ, ৪০% ক্যালসিয়াম ও ২৩% লৌহ  ও ভিটামিন-এ সরবরাহ হয়ে থাকে। দৈনিক ৬ চামচ সজনে পাতার গুঁড়া একটি গর্ভবর্তী বা স্তন্যদাত্রী মায়ের চাহিদার সবটুকু ক্যালসিয়াম ও আয়রন সরবরাহ করতে সক্ষম।
 

সজিনার তেল : সজিনার শুকানো বীজ ভাঙিয়ে ৩৮-৪০% ভোজ্যতেল পাওয়া যায় যাতে উচ্চ মাত্রার বিহ্যানিক এসিড থাকে যা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক। এ তেলের কোনো গন্ধ নাই এবং অন্য যে কোনো ভোজ্যতেলের মতোই মান সম্পন্ন। তেল নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত খইল সার হিসেবে এবং পানি শোধনের কাজেও ব্যবহার হয়।
 

সজিনার ঔষধি গুণাগুণ : ভারতীয় আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার কচি পড সবজি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ঔষধিগুণ আছে।
 

০১. শরীর ব্যথা : শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা হলে বা ফুলে গেলে সজিনার শিকড়ের প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা সেরে যায়।
০২. কান ব্যথা : সজিনার শিকড়ের রস কানে দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়।
০৩. মাথা ব্যথা : সজিনার আঠা দুধের সাথে খেলে মাথা ব্যথা সেরে যায়। আঠা কপালে মালিশ করলে মাথা ব্যথা সেরে যায়।
০৪. ফোঁড়া সারায় : সজিনার আঠার প্রলেপ দিলে ফোঁড়া সেরে যায়।
০৫. মূত্রপাথরি ও হাঁপানি : সজিনা ফুলের রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে মূত্রপাথরি দূর হয়। ফুলের রস হাঁপানি রোগের বিশেষ উপকারী।
০৬. গ্যাস থেকে রক্ষা : সজিনা পাতার রসের সাথে লবণ মিশিয়ে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেট জমা গ্যাস দূর হয়।
০৭. কুকুরের কামড়ে : সজিনা পাতা পেষণ করে তাতে রসুন, হলুদ, লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে সেবন করলে কুকুরের বিষ ধ্বংস হয়।
০৮. জ্বর ও সর্দি : পাতার শাক খেলে যন্ত্রণাধায়ক জ্বর ও সর্দি দূর হয়।
০৯. বহুমূত্র রোগ : সজিনা পাতার রসে বহুমূত্র রোগ সারে।
১০. কোষ্ঠকাঠিন্য ও দৃষ্টিশক্তি : সজিনার ফুল কোষ্ঠকাঠিন্য দোষ দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।
১১. সজিনা ফুল দুধের সাথে রান্না করে নিয়মিত খেলে কামশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। এর চাটনি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।
১২. গেঁটে বাত : সজিনার ফল নিয়মিত রান্না করে খেলে গেঁটে বাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
১৩. ক্রিমিনাশক ও টিটেনাস : সজিনার কচি ফল ক্রিমিনাশক, লিভার ও প্লীহাদোষ নিবারক, প্যারালাইসিস ও টিটেনাস রোগে হিতকর।
১৪. অবশতা, সায়াটিকা : সজিনার বীজের তেল মালিশ করলে বিভিন্ন বাত বেদনা, অবসতা, সায়াটিকা, বোধহীনতা ও চর্মরোগ দূর হয়।
১৫. পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়।
১৬.  পোকার কামড়ে এন্টিসেপ্টিক হিসেবে সজিনার রস ব্যবহার করা হয়।
১৭. ক্ষতস্থান সারার জন্য সজিনা পাতার পেস্ট উপকারী।
১৮. সজিনা শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য, ভারি ধাতু অপসারণ এবং শরীরে রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি নিতে সহায়তা করে।
১৯. ইন্টেস্টাইন ও প্রোস্টেট সংক্রমণ : সজিনা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে।
২০. শ্বাসকষ্ঠ, মাথা ধরা, মাইগ্রেন, আর্থাইটিস এবং চুলপড়া রোগের চিকিৎসায় ও সজিনা কার্যকর ভূমিকা রাখে।

 

সজিনার ব্যবহার
সজিনা খাবার  টেবিলে সবজি হিসেবেই বেশি ব্যবহার হয়। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সজিনা বাজারে প্রচুর পাওয়া যায়।  এ সময় খরিপ সবজির মধ্যে সজিনার যথেষ্ট কদর থাকে। আগাম সজিনা বাজারে নিতে পারলে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হওয়া যায়। সজিনা দিয়ে ডাল তরকারিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়।  সজিনা শুধু ফল হিসেবেই নয় সজিনার কচি পাতা ও ডাঁটা বা ডাল ভাজি বা তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। পালংশাকের বিকল্প হিসেবে সজিনা শাক খাওয়া হয়। মুরগির মাংস রান্নায় কচি সজিনা পাতা সুস্বাদু লাগে। কালিজিরা, কাঁচামরিচ, রসুনের সাথে সজিনা পাতার ভর্তা একটি মজাদার খাবার। ছোট মাছের সাথে সজিনা পাতার চর্চড়ি খুবই উপাদেয়। সজিনা পাতার বড়া, সালাদ, পাতা বাটা ও সজিনা পাতার পাউডার দ্বারা খাদ্য সুস্বাদু ও শক্তি বর্ধক হয়। যে কোনো স্যুপের সাথে শুকনা সজিনা পাতার পাউডার মিশালে খাদ্যমান বেড়ে যায়। চা বা কফি তৈরিতে সজিনা পাতার

পাউডার ব্যবহার করা যায়। সজিনা থেকে তৈরি কয়েকটি বিশেষ খাবারের রেসিপি হলো-
 

১. মসুর ডালে সজিনা : প্রথমে মসুর ডাল-১ কাপ, সজিনা- ১ কাপ, পেঁয়াজ কুচি, তেল, হলুদ গুঁড়া;, রসুন কুচি, মেথি, সরষে বাটা, লবণ, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। মসুর ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর হাঁড়িতে পানি চাপিয়ে তাতে মসুর ডাল, রসুন কুচি, হলুদ গুঁড়া দিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। অন্য পাত্রে তেল দিয়ে সজনে ভেজে তাতে মেথি দিয়ে তুলে নিয়ে পেঁয়াজ কুচি বাদামি করে ভেজে তেলসহ ডালে ঢেলে দিতে হবে। কাঁচামরিচ কালি ও ধনেপাতা দিয়ে চুলা থেকে নামাতে হবে।
 

২. সজিনা লাউ নিরামিষ : সজিনা ২৫০ গ্রাম, লাউ- আধা কেজি, শুকনা শিমের বীচি-২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ  কুচি, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, টমেটো-১টি, কাঁচামরিচ-২টি, ধনেপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। সজিনার আঁশ ফেলে ১.৫-২ ইঞ্চি করে টুকরা করে নিতে হবে। একই সাথে টমেটো ও লাউ  টুকরো করতে হবে। শুকনো শিমের বীচি তাওয়ায় ভেজে পাটায় ভেঙে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। তেলে পেঁয়াজ অল্প ভেজে রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, সজিনা ও লাউ দিয়ে রান্না করতে হবে। শিমের বীচি দিয়ে ১০ মিনিট ঢেকে রাখতে হবে এরপর টমেটো দিতে হবে। লাউ ও সজিনা সেদ্ধ হলে, মরিচ ফালি ও ধনেপাতা কুচি দিয়ে ২-৩ মিনিট পর চুলা হতে নামাতে হবে।
 

৩. সজিনা পাতার পাকোড়া : সজিনা পাতা-১০০ গ্রাম, মসুর ডাল-২০০ গ্রাম, পেঁয়াজ ও আলু-২০০ গ্রাম করে, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, লবণ ও তেল পরিমাণমতো। মসুর ডাল পরিষ্কার করে ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সজিনা ডাঁটা ভালো করে ধুয়ে কুচি, কুচি করে কাটাতে হবে। আলু, পেয়াজ, ধনেপতা, কাঁচামরিচ, সব কুচি করে কেটে নিতে হবে। মসুরের ডাল হালকা করে বেটে নিতে হবে। ডালের সাথে কুচানো সজিনা পাতা, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা ভালো করে মেশাতে হবে। চুলায় কড়াই বসিয়ে তেল গরম করতে হবে। হাত দিয়ে গোল করে বড়ার মতো করে বানিয়ে তা গরম তেলে ভালোভাবে ভেজে নিতে হবে। সস্ বা চাটনিসহ গরম গরম পাকোড়া পরিবেশন করতে হবে।
 

৪. আলু সজিনার তরকারি :  সজিনা-৫০০ গ্রাম, আলু, পেঁয়াজ কুচি, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া ও কাঁচামরিচ পরিমাণমতো নিতে হবে। সজিনা ডাঁটার আঁশ ফেলে ২ ইঞ্চি লম্ব করে কেটে নিতে হবে। আলুর খোসা ছিলে লম্বাকরে টুকরা করে কেটে নিতে হবে। তেলে রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ দিয়ে সরষে বাটা, আলু, সজিনা দিয়ে চুলায় চড়াতে হবে। পরে পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সবজি সেদ্ধ হয়ে গেলে ধনেপাতা কুচি দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
 

৫. সজিনা দিয়ে ইলিশ মাছ : ইলিশ মাছ-৪ টুকরা, সজিনা  ৪-৫টি, বড় পেঁয়াজ কুচি-১টি কাঁচামরিচ, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া, জিরা বাটা, তেল ও লবণ পরিমাণ মতো নিতে হবে। ইলিশ মাছের টুকরাগুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। সজিনাগুলো ১.৫-২ ইঞ্চি করে কেটে নিতে হবে। কড়াইতে তেল গরম হলে পেঁয়াজ কুচি ও সব মসলা, লবণ কড়াইতে দিয়ে সজিনা দিতে হবে। সজিনা দিয়ে অল্প কষিয়ে নিতে হবে। কষানো হলে তাতে মাছ দিতে হবে। তারপর অল্প নাড়াচড়া করে পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ঝোল মাখা মাখা হলে নামানোর আগে কাঁচামরিচ দিয়ে নামাতে হবে।
 

৬. চিংড়ি নারিকেলে সজিনা মালাইকারি : সজিনা ২৫০ গ্রাম, চিংড়ি-১৫/২০টি (মাঝারি আকৃতির), নারিকেল বাটা-আধা কাপ, চিনি-১ চা চামচ, কাঁচামরিচ-২/৩টি, পরিমাণমতো পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, তেজপাতা, তেল, হলুদ গুঁড়া নিতে হবে। প্রথমে চিংড়ির মাথা ও ভেতরের কালো রগ ফেলে ধুয়ে সজিনার আঁশ ফেলে টুকরো করে রাখতে হবে। নারিকেল বেটে নিতে হবে। তেল গরম হলে তেজপাতা, পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, আস্ত চিংড়ি দিয়ে নেড়ে চেড়ে সজিনা ভেজে নিতে হবে। পানি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর বাটা নারিকেল, সামান্য চিনি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ২০ মিনিট রান্নার পর নামানোর পূর্বে কাঁচামরিচ দিয়ে নামাতে হবে।
 

৭. আম সজিনার ঝোল : সজিনা ভাটা-২৫০ গ্রাম, কাঁচা আম-৬-৭ টুকরা, পেঁয়াজ বাটা, পাঁচ ফোড়ন, রসুন বাটা, কাঁচামরিচ, সরিষার তেল, হলুদ গুঁড়া ও লবণ পরিমাণমতো। প্রথম সজিনা ডাঁটার আঁশ ফেলে টুকরা করতে হবে। কাঁচা আমের ওপরের সবুজ ত্বক ফেলে লম্বা করে কাটতে হবে। কাঁচামরিচ বেটে নিতে হবে। তেল গরম হলে পেঁয়াজ বাটা, পাঁচ ফোড়ন বাটা, হলুদ ও রসুন বাটা দিয়ে কষাতে হবে। এরপর সজিনা ডাঁটা ও লবণ দিয়ে ২ কাপ পানি দিয়ে অল্প আঁচে ঢেকে দিতে হবে। সজিনা সেদ্ধ হলে আমের টুকরা ও মরিচ বাটা দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। তেল ওপরে ভেসে উঠলে নামিয়ে ফেলতে হবে।
 

৮. দই সজিনা : সজনে-৫০০ গ্রাম টকদই-২০০ গ্রাম, রসুন আদা, কাঁচামরিচ বাটা, হলুদ গুঁড়া ও তেজপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। সজনে ডাঁটার আঁশ ফেলে ১.৫ ইঞ্চি করে টুকরা করে নিতে হবে। তেলে তেজপাতা ভেজে পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, হলুদ গুঁড়া ও লবণ দিয়ে কষিয়ে সজিনা ঢেলে দিতে হবে। ভালোভাবে নেড়ে টক দই দিয়ে অল্প পানি সহযোগে ২০ মিনিট পর নামাতে হবে।
 

৯. সজনে পাতার সবুজ ভাত : চাল-৪০০ গাম, মুগডাল-২০০ গ্রাম, সজনে পাতা-২০০ গ্রাম, সেদ্ধ ডিম-৩টি, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, তেজপাতা, গরম মসলা, লবণ, সয়াবিন তেল, লেবু পরিমাণমতো নিতে হবে। প্রথমে চাল ও ডাল ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সজনে পাতা ধুয়ে পরিষ্কার করে কেটে কুচি কুচি করতে হবে। পেঁয়াজ ও ধনেপাতা কুঁচি করতে হবে। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে টমেটো ও শসার সাথে সøাইস করতে হবে। আদা, রসুন ও কাঁচামরিচ বেটে নিতে হবে। চুলায় কড়াই চাপিয়ে তেল গরম হলে পেঁয়াজ ভাজতে হবে। এরপর চাল ও ডাল ২ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। তারপর আদা, রসুন, কাঁচামরিচ বাটা ও তেজপাতা দিয়ে ভালোভাবে মিশাতে হবে। তারপর সজিনা পাতা যোগ করতে হবে। পরিমাণমতো পানি দিয়ে ২০ মিনিট জ্বাল দিলে সব সেদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে যাবে। কুচানো ধনেপাতা ও গরম মসলা দিয়ে নেড়ে দিতে হবে। ডিম, টমেটো, শসা ও লেবু দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
 

১০. সজনে পাতার সবুজ রুটি : গমের আটা-৫০ গ্রাম, বেসন-২০ গ্রাম, সজিনা পাতা-২৫ গ্রাম, পেঁয়াজ-২৫ গ্রাম এর সাথে আদা জিরা, কাঁচামরিচ, তেল, লবণ পরিমাণমতো নিতে হবে। প্রথমে সজিনা পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে বেটে নিতে হবে। আদা, পেঁয়াজ কুচি করে কেটে নিতে হবে। জিরা ভেজে গুঁড়া করে নিতে হবে। এবার আটার সাথে বেসন ভালো করে মেশাতে হবে। একে একে মিশ্রণের সাথে সজিনা পাতা, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও অন্যান্য মসলা মিশাতে হবে। এরপর পানি দিয়ে রুটি তৈরির খামির বানাতে হবে। কিছুক্ষণ খামির রেখে দিয়ে রুটির গোলা তৈরি করে রুটি বেলে নিতে হবে। চুলায় তাওয়া গরম করে সাধারণ রুটির মতো সবুজ রুটি ভেজে নিতে হবে।
 

১১. পেলকা : সজিনা পাতার তৈরি দিনাজপুরের গ্রামীণ সমাজের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও উপাদেয় খাবারের নাম হচ্ছে পেলকা। পরিমাণমতো সজিনা পাতা, খাবার সোডা এক চিমটি, রসুন ১টি কাঁচামরিচ ও লবণ স্বাদমতো নিতে হবে। ডেকচিতে ২-৩ লিটার পানি চাপিয়ে পরিমাণমতো লবণ দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। সজিনা পাতা পরিষ্কারভাবে ধুয়ে কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে। চুলায় পানি ফুটলে পাতাগুলো ফুটন্ত পানিতে ঢেলে দিতে হবে। এরপর আদা, রসুন কাঁচামরিচ ও সামান্য পরিমাণ খাবার সোডা দিয়ে নেড়ে নিতে হবে। পাতিলের তলায় যেন না লাগে সেজন্য চামচ দিয়ে নাড়তে হবে। মিশ্রণটি ঘন হয়ে এলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
 

সজিনা গাছের পুষ্টিমান, ঔষধিগুণ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার অনুশীলন করে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আরও ব্যাপকভাবে সজিনার ফল, টাটকা ও শুকনা পাতা ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। সারা  বছর এ সবজি খাওয়ার অভ্যাস বাড়ানো উচিত। তাই এর চাষ পদ্ধতি ও গুণাগুণ মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশের জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য সব পুষ্টিবিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, শিক্ষক ও আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এতেই সজিনা গাছের নামকরণ অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ হিসেবে সার্থকতা পাবে।

 

কৃষিবিদ মো. মোশাররফ হোসেন*

*অতিরিক্ত পরিচালক, ডিএই, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা; মোবাইল : ০১৬৭৬৭১৩২৮০

বিস্তারিত
হাইড্রোপনিক ফার্মিং : এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানিতে যোগ করে সে পানিতে ফসল উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় হাইড্রোপনিক ফার্মিং। গাছের জন্য সরবরাহকৃত পানিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকলে মাটি ছাড়াও গাছ উৎপাদন করা যায়। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মাটির পরিবর্তে পানিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ফসলের সব খাদ্য উপাদান দ্রবণে মিশিয়ে সেখানে গাছ রোপণ করা হয়। আবার কখনও কখনও মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে চারা রোপণ করে তাতে খাদ্য উপাদান স্প্রে করেও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এটি একটি অত্যাধুনিক ফসল চাষ পদ্ধতি। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশও এ পদ্ধতি ব্যবহারে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
 

বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বর্ধিত মুখের চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত খাদ্য। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটি ছাড়া ভিন্ন মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে একদিকে যেমন অনুর্বর এবং উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জায়গা ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসল উৎপাদন করা যাবে তেমনি শহরেও বদ্ধ জায়গায় উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়া সম্ভব হবে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব এবং এ চাষে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম বিধায় ফসলে কোনো পেস্টিসাইড প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদিত ফসলে কোনো বিষাক্ত প্রভাব থাকে না। এ পদ্ধতিকে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন বলা যাবে না। এ দেশে কৃষক পর্যায়ে মনের অজান্তে অনেক আগ থেকেই কিছু হাইড্রোপনিক কালচার হয়ে আসছে। বর্তমানে সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে আরও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকে সেখানে ভাসমান জৈব বেডে এ পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে ফসল উৎপাদিত হয়ে আসছে। এ প্রাকৃতিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতেও অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে সারা বছর ফসল চাষ করার সুযোগ রয়েছে। এসব প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়নের জন্যও আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আবশ্যকতা রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে ভাসমান চাষ পদ্ধতি বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর হাইড্রোপনিক পদ্ধতি থেকে অবশ্যই আলাদা। আমরা হাইড্রোপনিক কালচার বা ফার্মিং বলতে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হাইড্রোপনিক ফসল চাষ ব্যবস্থাপনাকেই বুঝাতে চাচ্ছি। এ পদ্ধতির প্রসারে বাংলাদেশ নিবিষ্টভাবে কাজ করছে এবং দ্রুতগতিতে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক কৃষির ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভাসমান বেডে যে সবজি আবাদ হয়ে আসছে তা হাইড্রোপনিক পদ্ধতিরই একটি সাধারণ রূপ বলা যেতে পারে। আমাদের শহরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে লতানো গাছ বোতলে পানির মধ্যে রেখে বারান্দায় গ্রিলে উঠিয়ে দেয়ার যে রীতি তাও হাইড্রোপনিক ব্যবস্থাপনারই মূলমন্ত্র। অনেক সময় পাতাবাহার জাতীয় গাছের ডাল কেটে বোতলের পানিতে রেখে মূল গজিয়ে তারপর মাটিতে লাগানো হতো সেটাও একই ধারণা প্রসূত। বর্তমানে এ পুরনো ধারণার সাথে যোগ হয়েছে পানিতে গাছের খাদ্য উপাদান মিশিয়ে এবং পরিবেশের অন্যান্য প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অনেক আগে থেকেই আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল চাষ শুরু করে। বাংলাদেশ হাইড্রোপনিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করে মাত্র কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮ সালে প্রথম এ পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, সার্বিক পর্যালোচনা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে লেগে যায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত। অতপর ২০০৬ সালে এসে শুরু হয় হাইড্রোপনিক কালচারের ওপর প্রকৃত গবেষণা। বছরান্তে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণা শুরু হয় টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি নিয়ে। আরও এক বছর পরে ২০০৮ সালে তার সাথে যোগ হয় ক্ষিরা, শসা, গাঁদা ফুল ও বেগুন। এভাবে ২০০৯ সালে বামন শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি এবং চন্দ্রমল্লিকাকেও গবেষণার তালিকায় আনা হয়। অতঃপর ২০১১-১২ অর্থবছরে এ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোপনিক কালচার পদ্ধতিতে বারোটি অর্থনৈতিক ফসল উৎপন্ন করতে সক্ষম হয় যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ষোলোতে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্রেও এগিয়ে চলেছে হাইড্রোপনিক কালচারের জন্য গবেষণা। গবেষণা শুরু করেছে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়। গবেষণার পাশাপাশি হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এগিয়ে আসছেন আগ্রহী কৃষকগণ।

 

বাংলাদেশে বর্তমান হাইড্রোপনিক চাষের অবস্থা
বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক কালচারের গবেষণা অনেকটা এগিয়ে গেছে। হাইড্রোপনিক ফার্মিং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে স্বাভাবিক চাষের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ ফলন বেশি পাওয়া যায়। সেজন্য এ চাষ পদ্ধতির সুবিধার দিকগুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। বারির পটুয়াখালী উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সারা বছর তরমুজ উৎপাদনের প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে প্রদান করেছেন। বারির হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি বিএআরসি ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ফসল চাষের জন্য ঢাকার মহাখালীতে শহর পর্যায়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক সম্প্রসারণ কর্মীকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে এ চাষ ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা বেশ এগিয়ে গেছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ চলমান আছে।  

 

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ একুয়াপনিক কালচার পদ্ধতির ওপর গবেষণা করছে। এ পদ্ধতিতে পানির ট্যাংকে পিলেট খাদ্য দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পানির ওপর ককশিট দিয়ে সবজির চাষ চলছে। আলাদা জায়গায় চারা তৈরি করে সারা বছর এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যাচ্ছে। একই সাথে পানিতে মাছের পোনা মজুদ করা হয়। শীতকালে টমেটো, লেটুস, পুদিনা এবং গ্রীষ্মকালে ঢেঁড়স, পুঁইশাক ও কলমি চাষ করা যায়। শীত কালে গিফট তেলাপিয়া ও মনোসেক্স তেলাপিয়া এবং গ্রীষ্মকালে এর সাথে থাই কই, ভিয়েতনামি কই, সরপুঁটি ও লাল তেলাপিয়া চাষ করা যাচ্ছে। আশা করা যায় এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তা পাবে।
 

বাংলাদেশের হাইড্রোপনিক ফসল
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশে জন্মানো যাবে পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গিমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া ও বাঁধাকপি এসব। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, মেলন ও স্কোয়াস উল্লেখযোগ্য। ফলের মধ্যে আছে স্ট্রবেরি এবং ফুলের মধ্যে উৎপাদন করা যাবে অ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড ও চন্দ্রমল্লিকা। ভবিষ্যতে যোগ হতে পারে তালিকায় আরও অনেক নতুন ফসলের নাম। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ট্রে, প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল ও মাটির পাতিল ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সবজি উৎপাদন করতে পারবেন। গ্রিন হাউস, প্লাস্টিক হাউস, ফিনাইল হাউসে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।

 

হাইড্রোপনিক ফার্মিং পদ্ধতি
হাইড্রোপনিক ফার্মিং কেবল চারা উৎপাদনের সময় ছাড়া কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করার দরকার হবেনা। এ পদ্ধতিতে পটে পাথর নুড়ি বা স্পঞ্জ দিয়ে পূর্ণ করে তাতে শুধু চারা উৎপাদন করা হয়। পরবর্তিতে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণে এ চারা রোপণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, মিডিয়া পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক ফার্মিং করতে গাছের চারা দ্রবণে রোপণ না করে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে রোপণ করে সেখানে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণ প্রয়োগ করতে হবে। মাধ্যম হিসেবে অজৈব ও জৈব উভয় প্রকার মাধ্যমই ব্যবহার করা যাবে। বালি কণা, গ্রাভেল, বা কৃত্রিম কাদা অজৈব মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে তিন মিলিমিটার ব্যাসার্ধের চেয়ে কম আকারের বালি কণা ব্যবহৃত হয়। গ্রাভেল কালচারে নির্দিষ্ট সময় পরপর নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম কাদাতে সাধারণত শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়। জৈব উপাদানের মধ্যে কাঠের গুড়া এবং ধানের তুষ বা তার ছাই ব্যবহার করা হয়। এতেও ড্রিপিং পদ্ধতিতে নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে হবে। তৃতীয়ত, এরোপনিক্স পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক অথবা সময় সময় ফসলের মূলে নিউট্রিয়েন্ট স্প্রে করা লাগে। এখানেও কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করা হয়না বলেই একেও হাইড্রোপনিক কালচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে শুনেই আগ্রহী কৃষকদের কাজ শুরু করতে হবে। প্রযুক্তিকে সামর্থের সাথে মিলিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগ্রহীদের সহায়তার জন্য সরকারি পর্যায়েও প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা দেয়ার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে হবে।

 

হাইড্রোপনিক দ্রবণ সংগ্রহ
সব ধরনের হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখন বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে হাইড্রোপনিক কালচারের জন্য উৎপাদিত নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করছে। হাইড্রোপনিক সার তরল আকারে বা পাউডার আকারে থাকে যাকে দ্রবীভূত করে প্রয়োগ করতে হয়। মাটিতে যে সব অর্গানিক উপাদান ব্যবহার করা হয় সেগুলোর সাথে মাটির বিভিন্ন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন উপাদানের কথা বিবেচনা করে এ নিউট্রিয়েন্ট তৈরি করা  হয়ে  থাকে। হাইড্রোপনিক বাগানে যদিও গাছ পানিতে জন্মায় তবুও মূল আটকানোর জন্য মাধ্যম প্রয়োজন হয়। মাধ্যম হিসেবে পারলাইট, নারিকেলের ছোবড়া, রকউল এমনকি বালিও ব্যবহার করা যেতে পারে। যাই ব্যবহার করা হোক না কেন তাতে মৃত্তিকা বাহিত রোগের হাত থেকে গাছ রক্ষা পায়। অন্যান্য দেশে অনেকেই হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফুলের বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ পদ্ধতিই এখন চিরাচরিত মাটিতে ফুল বাগানের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফুল বাগান করার বেশ কিছু সুবিধা আছে।

 

পদ্ধতি সম্প্রসারণে উদ্যোগ
সরকারের পক্ষ থেকে হাইড্রোপনিক চাষ মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি কিছু এনজিও এ প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে। ব্র্যাক ভূমিহীন কৃষকদের হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষের কৌশল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। গত ২০১২ সালে এ প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জের ১০০ ভূমিহীন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়। এসব কৃষককে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য দশটি করে বাকেট এবং নিউট্রিয়েন্ট সলুশন সরবরাহ করা হয়। তাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত আছে। গ্রিন লিফ এগ্রো মহাখালিতে এর সেল সেন্টারে হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট সলুশন বিক্রি করে থাকে। আলফা এগ্রো প্রান্তিকও এ পদ্ধতিতে চাষের কাজ শুরু করেছে। হাইড্রোপনিক কালচার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক ফার্ম করার পরিকল্পনাও এগিয়ে চলেছে। এখনও এ ধরণের ফার্মিং ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠলেও শিগগিরই গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। তাহলেই কৃষি আর শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং সম্প্রসারিত হবে নিয়ন্ত্রিত বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক খামারে। বাংলাদেশের কৃষি পরিগণিত হবে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে।

 

সুপারিশ
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণার পাশাপাশি প্রযুক্তি বিস্তারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি বিস্তারের জন্য যথেষ্ট প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমবায়ের ভিত্তিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। ভূমিহীন কৃষকদের এ সংক্রান্তে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাদের এ চাষ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানুষ যদি বুঝতে পারে তারা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে লাভবান হবে তাহলে অবশ্যই গ্রহণ করবে। সকল পর্যায়ে হাইড্রোপনিক চাষ ও খামার গড়ে তোলার জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা আগ্রহী হবেন তাদের সহায়তা করার জন্য সরকারের কৃষি অধিদপ্তরকে সার্বক্ষণিক তৎপর থাকতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে গৃহিত পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সফল হবে।

 

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত পরিস্থিতিতিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ বাংলাদেশে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায়, পলিটানেল ও নেট হাউস কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদ করা সম্ভব হবে। বাড়ির আঙিনায় নানা ফুলের চাষ করা যাবে। এতে করে একদিকে যেমন পতিত জমি বা অব্যবহৃত জায়গার সফল ব্যবহার হবে, অন্য দিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে। সেদিন আর হয়ত দূরে নয় যখন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাটি ছাড়া হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শাক সবজি, ফল ও ফুলের চাষ হবে। আমাদের বিশ^াস আগামী দিনে হাইড্রোপনিক ফার্মিং পাল্টে দিবে বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি তথা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। আমরা সেদিনের প্রত্যাশায় থাকলাম।

ড. পিয়ার মোহাম্মদ*

*পরিচালক (অর্থ), বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা, ঢাকা

বিস্তারিত
ছোট মাছের পুষ্টি

সুস্থ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত। শারীরিক সুস্থতার জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত পরিমিত পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণ। সুষম খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানগুলো হলো- আমিষ, শ্বেতসার, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য সুষম খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।  ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এ বিখ্যাত প্রবচনটি খাদ্য হিসেবে মাছের প্রতি আমাদের আকর্ষণ, প্রয়োজনীয়তা ও নির্ভরতার সূচক নির্দেশ করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় রীতি নীতির কারণেও মাছ আমাদের প্রিয় খাদ্য।
 

এ দেশে যেসব মাছ আছে, আকার অনুসারে সেগুলোকে মোটামুটি বড়, মাঝারি ও ছোট এ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। রুই, কাতলা, আইড়, মৃগেল, বোয়াল, কালিবাউস, পাঙ্গাশ, চিতল, ইলিশ এগুলো বড় মাছের মধ্যে অন্যতম। কৈ, ফলি, রূপচান্দা, মাগুর, সরপুঁটি, বেলে, শিং- এসব মাছকে মাঝারি আকারের মাছ হিসেবে ধরা হয়। আবার মলা, ঢেলা, কেঁচকি, কাজলি, পুঁটি, টেংরা, চাঁদা, বাতাসি, খলসে এগুলোকে ছোট মাছ বলা হয়। এ হলো বড়, ছোট বা মাঝারি আকারের মাছ সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা মাত্র। এছাড়া আমাদের দেশের নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে আরও অনেক রকমের মাছ পাওয়া যায়।
 

ছোট মাছ আকারে ছোট হলেও পুষ্টিতে ছোট নয়। পুষ্টিগুণের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, বড়, মাঝারি বা ছোট মাছে কোনো তফাৎ নেই। বড় মাছের পুষ্টিগুণ যা, ছোট বা মাঝারি আকারের মাছের পুষ্টিগুণও তা। অথচ দামের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, বড় মাছের দাম এতই চড়া যে তা ক্রয় করা আমাদের অনেকেরই ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ছোট মাছ দামে অনেক সস্তা। বড় মাছের মতো ছোট মাছে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে বলে ছোট মাছও আমিষ জাতীয় খাবারের অন্তর্ভুক্ত। প্রতি ১০০ গ্রাম ছোট মাছে আমিষের পরিমাণ হলো ১৪-১৯ ভাগ এবং মাছের আমিষ হলো একটা উন্নত মানের আমিষ। এ আমিষ আমাদের দেহের বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণের কাজে লাগে বেশি।
 

গর্ভবতী মহিলার গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ও গঠন ঠিকমতো হওয়ার জন্য এবং প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ তৈরির জন্য তাদের নিত্যদিনের খাবারে আমিষের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। জন্মের পর পরই শিশুদের শরীর খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। এ সময়ে শিশুদের শরীরের এ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আমিষ জাতীয় খাবারের প্রয়োজন অত্যধিক। আমিষের অভাবে শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শরীর খাটো হয়ে যায় এবং শরীরের ওজন কমে যায়। এ অভাব ক্রমাগত চলতে থাকলে শিশুদের কোয়াশিয়রকর এবং ম্যারাসমাস নামক মারাত্মক রোগ হয়। ম্যারাসমাস রোগে শিশুরা একেবারে শীর্ণ ও হাড্ডিসার হয়ে যায়, আর কোয়াশিয়রকর রোগে শরীর ফুলে যায়।
 

মায়ের বুকের দুধই হচ্ছে শিশুর জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য। তবে শিশুর পাঁচ মাস বয়স থেকে শুধুমাত্র মায়ের দুধই তার শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই পাঁচ মাস বয়স থেকে শিশুকে মায়ের দুধের সাথে সাথে পরিপূরক খাবার দিতে হবে। শিশুর পরিপূরক খাবারে যেন একটু আমিষ থাকে সেদিকেও নজর দেয়া দরকার। এ আমিষটা  কিন্তু ছোট মাছের আমিষও হতে পারে। ডালে-ভাতে রান্না করা নরম খিচুড়ি শিশুর জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ভালো পরিপূরক খাবার। খিচুড়িতে একটু আলু, খানিকটা সবুজ শাক এবং একটু ছোট মাছ পিষে দেয়া যেতে পারে। এ খাবার শিশুকে বারে বারে অল্প অল্প পরিমাণে খাওয়াতে হবে। নিয়ামিতভাবে এসব পরিপূরক খাবার খাওয়ালে শিশুরা কোয়াশিয়রকর, ম্যারাসমাস ও অন্যান্য মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পাবে এবং শিশু সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হবে।
 

আমিষ ছাড়াও ছোট মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’। এর প্রসঙ্গে মলা ও ঢেলা মাছের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দুটি মাছে ভিটামিন ‘এ’র পরিমাণ খুব বেশি। খাবারে ভিটামিন ‘এ’ অভাব হলে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় রাতের বেলায় অল্প আলোতে দেখতে অসুবিধা হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘রাতকানা’। ক্রমাগত ভিটামিন ‘এ’র অভাব চলতে থাকলে চক্ষু প্রদাহ, চক্ষু শুষ্কতা এবং চোখে এক প্রকার ঘা হয়। এভাবে আস্তে আস্তে চোখ সম্পূর্ণরূপে অন্ধ হয়ে যায়। খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতিজনিত কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশে হাজার হাজার শিশু ও ছোট      ছেলেমেয়ে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং রাতকানা রোগে ভুগছে।
 

ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ মলা ও ঢেলা মাছ আমাদের দেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। শিশুকাল থেকে এসব ছোট মাছ এবং নানা রকমের শাকসবজি খাওয়ানোর অভ্যাস করালে ছোট ছেলেমেয়েদের চোখের এসব মারাত্মক ব্যাধি ও অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা করা যায়। ছোট মাছ খাওয়ার আর একটা বিশেষ দিক হলো যেসব ছোট মাছ কাঁটাসহ খাওয়া যায়, তা থেকে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম পেতে পারি। শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে শিশু ও ছোট ছেলেমেয়েদের ‘রিকেটস’ নামক এক প্রকার রোগ হয়। খাবারে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে গর্ভবতী মহিলাদের ‘অস্টিওম্যালেসিয়া’ নামক এক প্রকার রোগ হয়। এ রোগে প্রসবকালে মহিলাদের খুব কষ্ট হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া খাদ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত কারণে শিশুদের কণ্ঠের মাংসপেশির খিঁচুনি হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ছোট মাছকে সিদ্ধ করে অন্যান্য শাকসবজির সাথে শিল পাটায় পিষে খেলে শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটানো যায়। এভাবে ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত নানাবিধ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। লটিয়া, রিটা, পোপা এসব সামুদ্রিক ছোট মাছগুলো আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন ছাড়াও অত্যন্ত দরকারি আরেকটি পুষ্টি উপাদান আয়োডিনের চাহিদা পূরণ করে। আয়োডিন আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আয়োডিনের অভাবে গলগ- রোগ হয়। এছাড়া আয়োডিনের অভাব হলে গর্ভবতী মায়ের গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব, প্রসবোত্তর মৃত্যু, বিকলাঙ্গ ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম গ্রহণ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসহ আয়োডিনের চাহিদা পূরণের জন্য সামুদ্রিক ছোট মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 

কাজেই এ কথা বলা যায়, বড় মাছের মতো ছোট মাছও অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। অনেক দামি বড় মাছ না খেতে পারলে আপস করার কোনো কারণ নেই। দেহের পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বড় মাছের মতো ছোট মাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ছোট মাছ বলে তার প্রতি অবহেলা বা অনীহা প্রদর্শন না করে এগুলোকে সামর্থ্যনুযায়ী নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।

 

মো. আবদুর রহমান*

*উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা

 

বিস্তারিত
কবিতা (আষাঢ় ১৪২৪)

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা
মো. জুন্নুন আলী প্রমাণিক*

অমর মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে,    
স্বাধীন স্বদেশে আনন্দ ফোটে দেশবাসীর মুখে।
সবুজ কোমল গাছের পাতা তরুতাজায় ভরে,
ফুলের সুগন্ধ বাতাসে নাচে স্বাধীনতার জোরে।
পরের চোখের বাঁকানো দৃষ্টি অসহনীয় হয়,
বাঙালি জাতির মুক্তির দিশা শেখ মুজিব দেয়।
হাজার জাতের পাখির কণ্ঠে অনুপ্রেরণা বাড়ে,
সবুজ বনের অবুঝ প্রাণ নির্ভাবনায় ঘোরে।
নদীর দুরন্ত গতির মতো অগ্রগতির যাত্রা,
দুতীরে সোনার ফসল ক্ষেতে উন্নয়নের বার্তা।
গাছের শোভিত শাখায় বসে রূপলহরি ভাসে,
জলের বুকের শীতল রসে দেশ মাতৃকা হাসে।
কামার কুমার কৃষক তাঁতি একাত্বতার বলে,
সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নিশ্চয়তায় চলে।
ছয়টি ঋতুর রূপের মাঝে স্বাধীনতার বাসা,
ফলন মালার উদার মাঠে সফলতায় চাষা।
দেশীয় জাতের মাছের খেলা খালবিলের জলে,
সাগর নদীর প্রাণীর মেলা স্বাধীনতার ফলে।
বারোটি মাসের বিচিত্র কৃষি ঐশ্বর্যময় অতি,
বিশুদ্ধ সকল ফসলে জাগে কৃতজ্ঞতার স্মৃতি।
মানুষে মানুষে প্রীতির মালা ভালোবাসার মায়া,
প্রশান্তি বিলায় বায়ুর দোলা গাছপালার ছায়া।
একটি দেশের একটি জাতি সুশিক্ষা মুখি লক্ষ,
বলতে লিখতে বাংলা বুকে বাংলাদেশী দক্ষ।
বিদেশি শাসন শোষণ মুক্ত বাংলাভাষী ধন্য,
স্বপ্নের সোনার বাংলা মুগ্ধ বঙ্গবন্ধুর জন্য।

 

মাটি নিয়ে খেলা
অপু বড়ুয়া **

মাটি নিয়েই আমার যত খেলা
মাটির মাঝে ফোটাতে চাই ফুল
এ মাটিকে যারাই করো হেলা
আমি তাদের ভাঙাতে চাই ভুল।

কৃষক যখন মাঠে লাঙল চষে
গায়ের রঙটা তামাটে তার হয়
তোমরা তখন পাখার নিচে বসে
অনেক রকম মেধাই করো ক্ষয়।

মাটির মানুষ তাইতো হয়ে আমি
ফলাতে চাই রাশি রাশি ধান
চাই না হতে বাবু নামি দামি
কৃষি, লাঙল, জমিই আমার গান।


*গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম **সহকারী প্রকৌশলী (গীতিকার বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভি), বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, বান্দরবান; ফোন- ০১৮১৮-৫৯২৭৪২

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর কৃষিকথা আষাঢ় ১৪২৪

মো. গোলাম মোস্তফা, গ্রাম : মুকুন্দপুর, উপজেলা : কালিগঞ্জ, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : মরিচের ঢলে পড়া রোগের প্রতিকার কি?

উত্তর : মরিচের ঢলে পড়া একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ ছত্রাক গাছের নিচের দিকে কাণ্ডে আক্রমণ করে এবং সেখানে গাঢ় বাদামি দাগ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এ দাগ কাণ্ডের গোড়াকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে ফেলে। প্রথমে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। ক্রমে গাছ ঢলে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়। রোগের অনুকূল অবস্থা থাকলে ১০-১৫ দিনের মধ্যে গাছ সম্পূর্ণ ঢলে পড়ে, তবে প্রতিকূল অবস্থায় ২-৩ মাস সময় লাগতে পারে। এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য একটু উঁচু জমিতে মরিচ চাষ করতে হবে।  প্রতি কেজি বীজের জন্য প্রোভেক্স-২০০ অথবা ব্যাভিস্টিন ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। মরিচ লাগানোর আগে জমিতে শতাংশ প্রতি ১ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করে জমি তৈরি করতে হবে। এ রোগ দেখা দিলে ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-ক্যাপটান গুলে আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে। কখনও আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজতলার চারা লাগাতে হবে। রোগে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

 

মো. মোখলেসুর রহমান, গ্রাম : কাগজিপাড়া, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : শসার সাদা মাছি পোকা দমন করব কিভাবে?

উত্তর : সাদা মাছি পোকা খুব ক্ষতিকারক একটি পোকা। পূর্ণবয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ দুটোই গাছের ক্ষতি করে। এরা শসা গাছের পাতার রস চুষে খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, ক্রমে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর ফলন কমে যায়। গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। সাদা মাছি গাছে ভাইরাসজনিত রোগ ছড়ায়। এদের নিধন বা নির্মূল করা জরুরি। আঠাযুক্ত বোর্ড ব্যবহার করে এদের প্রতিহত করা যায়। এছাড়া ৫০ গ্রাম সাবানের গুঁড়া ১০ লিটার পানিতে গুলে পাতার নিচে স্প্রে  করলে এদের সংখ্যা কমে আসে। সাবান-পানি সপ্তাহে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কীটনাশক যেমন এডমায়ার ০.৫ মিলি/ইমিটাফ ০.২৫ মিলি/টাফগর ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। মনে রাখতে হবে স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না। সাদা মাছি দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে। এদের দলবদ্ধভাবে দমন করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

 

মো. আতিয়ার মোল্লা, গ্রাম : রাধারামপুর, উপজেলা : মাগুরা সদর, জেলা : মাগুরা
প্রশ্ন : জমিতে তিল ফসলের চাষ করতে চাই। তিল ফসলের জন্য কি কি সার ব্যবহার করব?

উত্তর : তিলের জমিতে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ছাড়াও প্রয়োজন বোধে জিংক সালফেট এবং বরিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি হেক্টরের জন্য ইউরিয়া প্রয়োজন হবে ১০০-১২৫ কেজি। হেক্টরপ্রতি ১৩০-১৫০ কেজি টিএসপি, ৪০-৫০ কেজি এমওপি এবং ১০০-১১০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে হেক্টরপ্রতি ৫ কেজি পর্যন্ত জিংক সালফেট এবং ৮-১০ কেজি বরিক এসিড জমিতে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক ও অন্য সারগুলো শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে খুব ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। ফুল আসার সময় অর্থাৎ বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।  

 

মো. আবু রায়হান, গ্রাম : শালিয়াবহ, উপজেলা : ঘাটাইল, জেলা : টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : মিষ্টিকুমড়ার পাতার ওপর কোণাকৃতির হলুদ রঙের দাগ দেখা যায় এবং পাতা নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিকার কি?

উত্তর : মিষ্টিকুমড়া গাছে ডাউনি মিলডিউ রোগ দেখা দিয়েছে। এ রোগে পাতা আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতায় নানা আকারের কোণাকৃতি ও হলদে দাগ পড়ে।  দাগগুলো দ্রুত সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় ও আকারে বড় হয়। পাতার নিচের দিকে দাগের ওপরে বেগুনি রঙের ছত্রাক জন্মে। রোগ যাতে না হয় সেজন্য  আগাম বীজ বপন করা ও  সুষম সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।  রোগ প্রতিরোধী জাত  চাষ করতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক যেমন- গেইভেট বা মনোভিট বা ম্যাকভিট ২ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে এবং আক্রান্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না।

 

মো. রুহুল আমিন, গ্রাম : চকগোপাল, থানা : কোতোয়ালি, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : আমার গরুর বাছুর হয়েছে ২ মাস আগে। গরু অল্প পরিমাণ দুধ দেয়। দিনে দিনে গরু ও বাছুর শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ চাই।

উত্তর : আপনার গরুকে প্রতিদিন ৩ কেজি পরিমাণ দানাদার খাদ্য খেতে দিতে হবে। এর পাশাপাশি ইএস এডিই ইনজেকশন অথবা ভিটা এডিই ইনজেকশন ১০ মিলি. করে চার দিন পর পর মাংসে ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে। আর বাছুরকে উক্ত ইনজেকশন ৫ মিলি. করে চার দিন পর পর মাংসে ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে।

 

সবুর হোসেন, গ্রাম : পালগিরি, থানা : কচুয়া,  জেলা : চাঁদপুর  
প্রশ্ন : আমার ২০টি কবুতর আছে। এদের মধ্যে কিছু কবুতর ঝিমায় এবং মাথা নিচু করে রাখে। এগুলোর পাতলা পায়খানা হয়েছে। পায়খানার রঙ সবুজ। আমি এ বিষয়ে পরামর্শ চাই।

উত্তর : আপনার কবুতরের কলেরা রোগ হয়েছে। সুস্থ করে তোলার জন্য কবুতরগুলোকে একটি করে সিপ্রো এ ভেট অথবা সিভক্স ভেট বোলাস পানির সাথে মিশিয়ে দিনে দুইবার করে ৫ দিন খাওয়াতে হবে। সাথে ইলেক্টোমিন ভেট পাউডার অথবা গ্লুকোলাইট ভেট পাউডার প্রতি ১ গ্রাম এর সাথে তিন লিটার পানি মিশিয়ে দিনে তিন বার খাওয়াতে হবে।

 

মো. আল মামুন, গ্রাম : বাসতলা, উপজেলা : তারাকান্দা, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : পুকুরে মাছ জেগে থাকে বা ভেসে ওঠে। কি করব?
উত্তর : পানিতে যদি অক্সিজেনের অভাব হয় তাহলে মাছ ভাসে। পুকুরে মাছের ঘনত্ব বেশি থাকলে মাছ কমিয়ে দিতে হবে। শতকপ্রতি ৪০-৫০টি মাছ রাখতে হবে। পুকুরের পাড়ে গাছপালা থাকলে এমনভাবে ছেটে দিতে হবে যেন পুকুরে আলো বাতাস বেশি থাকে এবং গাছের পাতা পানিতে পড়ে সেখানে পচন তৈরি করতে না পারে। পানিতে বুঁদবুঁদ উঠতে দেখা গেলে বা পুকুরের তলদেশে গ্যাস হলে হররা টেনে গ্যাস বের করতে হবে। পানিতে অক্সিজেন মেশানোর জন্য বাঁশ, কাঠের ঝাপটা বা পাতিলের সাহায্যে ঢেউ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়াও পুকুরে পানি ঢোকানোর সুযোগ থাকলে পানি ঢুকিয়ে পুকুরের পানি বদল করে দেয়া যেতে পারে। অল্প পরিমাণে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট কাপড়ে পুঁটলি বেঁধে পুকুরের ২-৩ জায়গায় পানির ওপরের স্তরে ডুবিয়ে রাখলে তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

 

মো. আলমগীর হোসেন, গ্রাম : শিমুলবাড়ি, উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : পুকুরে পানির গুণাগুণ কিভাবে ভালো রাখা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ চাই।
উত্তর : পুকুরের পানি ভালো রাখতে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি সচেতন থাকা দরকার। পুকুরের পানি মাঝে মাঝে পরিবর্তন করে দিতে হবে। সঠিক ঘনত্বে মাছ মজুত করতে হবে। নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগের পাশাপাশি সঠিক মাত্রায় সার ও চুন প্রয়োগ করলে পানির গুণাগুণ ভালো রাখা যায়। এছাড়াও পানি ভালো রাখার জন্য বায়ো-অক্স ১৫-২০ গ্রাম প্রতি শতকে অথবা এ্যাকুয়াক্লিন ০.৫-১.০ লিটার/একর ৪-৬ ফুট গভীর পানির জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

সুপ্রিয় পাঠক বৃহত্তর কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টার এর ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতিত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে।
 

তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৬ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

 

কৃষিবিদ ঊর্মি আহসান*
*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (এলআর), সংযুক্ত:- কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
ভাদ্র মাসের কৃষি (শ্রাবণ ১৪২৪)

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা। বর্ষার পানিতে সারা দেশ টইটম্বুর, সে সাথে ঝরছে অঝোর বৃষ্টি। এ সময় কৃষিতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। কৃষির এ ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। কৃষির ক্ষতিটাকে পুষিয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলো জেনে নেব সংক্ষিপ্তভাবে।
 

আমন ধান
আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যতœ নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করতে হবে।
আগাছা পরিষ্কার করার পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি একর জমিতে ৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিন ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
নিচু জমি থেকে পানি নেমে গেলে এসব জমিতে এখনও আমন ধান রোপণ করা যাবে। দেরিতে রোপণের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল, নাইজারশাইল বা স্থানীয় উন্নত ধান বেশ উপযোগী।

 

দেরিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে।
আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

 

পাট
বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এতে ফলনের সাথে সাথে বীজ উৎপাদনেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। বীজ উৎপাদনের জন্য ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশীপাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে প্রতি শতাংশে লাইনে বুনলে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতকপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশপ্রতি ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ১৫-২০ দিন পরপর জমিতে দিতে হবে।

 

আখ
এ সময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কা- পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত বীজ বা শোধন করা বীজ ব্যবহার করলে অথবা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। লালপচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন কয়েকটি আখের জাত হচ্ছে ঈশ্বরদী ১৬, ২০, ২১।

 

তুলা
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টির ফাঁকে জমির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বিঘাপ্রতি প্রায় ২ কেজি তুলা বীজ বপন করতে হয়।
লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হয়। তুলার বীজ বপনের সময় খুব সীমিত। হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছানাশক প্রয়োগ করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়।
বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে।
সমতল এলাকার জন্য সিবি-৯, সিবি-১২, হীরা হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-২, ডিএম-৩ অথবা শুভ্র জাতের চাষ করতে পারেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ এবং পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ করতে পারেন।

 

শাকসবজি
ভাদ্র মাসে লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে।
এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বাকরে বীজতলা করে সেখানে উন্নত জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে পারেন।

 

গাছপালা
ভাদ্র মাসেও ফলদবৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে।
এছাড়া এ বছর রোপণ করা চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, চারার আতিরিক্ত এবং রোগাক্রান্ত ডাল ছেটে দেয়া, বেড়া ও খুঁটি দেয়া, মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে।
ভাদ্র মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফলগাছে রোগও কম হয়।

 

প্রাণিসম্পদ
ভাদ্র মাসের গরমে পোলট্রি শেডে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আর টিনশেডে চটের ছালা রেখে মাঝে মাঝে পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে। যাতে করে অধিক গরমে মুরগিগুলো মারা না যায় এবং নানা রোগের বিস্তার না ঘটে।
ভেজা আবহাওয়া ও মাঝে মাঝে গরম পোলট্রির ক্ষেত্রে গামবোরো রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। এ রোগে  মুরগির পালক নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। গা গরম ও কাঁপুনি দেখা দেয়। সাদা পানির মতো পাতলা পায়খানা দেখা যায়। মুরগি সহজে নড়ে না। এমনিতে ভাইরাসজনিত এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। এজন্য আগে থেকেই সর্তক থাকতে হবে ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

বাংলাদেশে গোখাদ্যের সমস্যা এখনও বিরাজমান। সে কারণে পতিত জমিতে নেপিয়ার, বাজরা, খেসারি, মটর, ইপিল ইপিল, গিনি ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দুধবতী গাভী পালন এবং যারা গরু মোটাতাজাকরণ করবেন, তাদের অবশ্যই গবাদিপশুকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে।
কোনো জায়গায় যদি পানি জমে থাকে সে এলাকায় জন্মানো ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না। কারণ এতে গাভী বা গরুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। গরু ও ছাগলকে নিয়মিত গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

গোয়াল ঘরের গোবর চনা নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আর গরুরর গায়ের আঠালি, মাছি, জোঁক পোকামাকড় বেছে দিতে হবে। তড়কা, বাদলা, গলাফুলা রোগ যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে যোগাযোগ রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
 

মৎস্য সম্পদ
পুকুরে সার ব্যবহারের মাত্রা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলতে হবে। জৈব সার ব্যবহার না করাই ভালো। খাদ্য ঘাটতির জন্য পরিমাণমতো অজৈব সার ব্যবহার করা দরকার। পুকুরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার সময় এখন। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর জীবাণুমুক্ত করে সঠিক সংখ্যক সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে।  যেসব পুকুরে মাছ আছে সেসব পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পুকুরে পাঙ্গাশ মাছের চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, প্লাবিত এলাকায় ঘেরের মাধ্যমে রাজপুঁটি ও চিংড়ির চাষ, পুকুরে রুই জাতীয় ও চিংড়ির মিশ্র চাষ এবং প্লাবিত এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে।

 

বন্যার কারণে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ পুকুরে রাখতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলোর ১৫ থেকে ২০ মিটার দূরত্বে একটি চটের ব্যাগে ৫ থেকে ৭ কেজি ধানের কুড়া বা গমের ভুসি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পানির নিচে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। ব্যাগটিতে অবশ্যই ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। খাবার পেয়ে মাছ পুকুরেই অবস্থান করবে।
কোনো কারণে পুকুরের পানি যদি দূষিত হয় তবে ভাইরাস, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাছের ক্ষত রোগ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেহের ভারসাম্যহীনতা, শরীরে লাল দাগ দেখা যায়। পরে মাছ ক্ষতরোগে মারা যায়। এ রোগ প্রতিকারে অধিক আক্রান্ত মাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতি শতক পুকরে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে। ছোট ও ব্রুড মাছের জন্য প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৬০ থেকে ১০০ মিলি গ্রাম টেরামাইসিন মিশিয়ে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি এখন সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর, কাশবনের আলোড়ন সবই প্রকৃতির দান। সে সাথে বন্যা, প্লাবন আমাদের নিত্য সহচর। সব কৃষক ভাইয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করছি।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*

*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত