বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র এলাকা। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১,৬০,০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ্ম, এগুলোকে ‘ঠা ঠা বরেন্দ্র’ বলা হয়। ‘বরেন্দ্র’ শব্দের সরল ও ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের বরে (বর+ইন্দ্র) অর্থাৎ অনুগ্রহ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এ মাটিতে শতকরা মাত্র ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্থ রয়েছে। এ মাটিতে নাইট্রোজেন কম, ফসফরাস কম-মধ্যম, পটাশ, গন্ধক ও দস্তা কম-মধ্যম মানের রয়েছে। এ মাটি অম্লধর্মী, এর পিএইচ ৫.২-৬.২। বরেন্দ্র অঞ্চলে বেলে বা বেলে দো-আঁশ জাতীয় মাটি নেই। এখানে লাল মাটি রয়েছে। পলি অঞ্চলে লাল মাটি দেখা যায় না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয়। মাটির রস ধারণক্ষমতা কম।
সংক্ষেপে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির অতীত এবং বর্তমান অবস্থা
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির ইতিহাস ব্যাপক। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্রিটিশ কর্মচারী রেনেলা তার ১৭৭১ সালের বর্ণনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক বন জঙ্গলে আচ্ছাদিত ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিয়েছেন। পরবর্তীতে কার্টারের রিপোর্টেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু পাকা দালানের ধ্বংসাবশেষ এবং ভরাট হয়ে যাওয়া বড় বড় দীঘির উল্লেখ প্রমাণ করে এককালে এ এলাকায় সমৃদ্ধ বসতি এবং সুগঠিত কৃষি ব্যবস্থা ছিল। তবে ব্রিটিশ কর্মচারী সাইমন ১৮৮৬ সালের বর্ণনায় বরেন্দ্র অঞ্চলকে প্রধানত কৃষি বহির্ভূত, খরাপীড়িত, উঁচুনিচু কাঁটাবন হিসেবে দেখিয়েছেন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে কার্টারের ১৯২৮ সালের সেটেলমেন্ট রিপোর্টে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলকে উঁচু, উন্মুক্ত এবং বন্ধুর ভূমি, উপত্যকার মাঝ দিয়ে সরুনালা প্রবাহিত গ্রীষ্মকালে শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম ও বনের ভগ্নাংশ ব্যতীত সমগ্র বরেন্দ্র ছায়াহীন ধু-ধু প্রান্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ অঞ্চলে শুধু বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ব্যতীত তেমন কোনো ফসল চাষ হতো না। এ কারণে বছরে প্রায় ৭-৮ মাস জমি পড়ে থাকত। বর্তমানে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেচ সুবিধা প্রবর্তন করায় রোপা আমন ছাড়াও উফশি বোরো ধান এবং শাকসবজি ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ফলে কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। নলকূপগুলো থেকে আজ আর সেভাবে পনি পাওয়া যাচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাড়ি (খাল) এবং পুকুর ছিল কিন্তু বর্তমানে এগুলো বেশিরভাগ মাছ চাষে লিজ দেয়া হয়েছে। এর কারণে সেখান থেকে পানি নিয়ে সেচকাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধের জন্য নদীর পানি শুকিয়ে সেচ কাজে বিঘœ হচ্ছে। তবে আশার কথা এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান ফল হচ্ছে আম, লিচু, কলা, কুল, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য। তবে কয়েক বছর ধরে স্ট্রবেরির চাষ এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবজি চাষে এরই মধ্যে এ অঞ্চল অনেক অগগ্রতি লাভ করেছে। এর মধ্যে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী উপজেলায় লতিরাজ কচু, মাচায় তরমুজ চাষ, ফুল চাষ শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় পলিব্যাগ দ্বারা পেয়ারা উৎপাদন, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন, মাল্টা, ড্রাগনফল, মুগডাল ব্যাপকভাবে আবাদ শুরু হয়েছে।
মাটির গুণাবলি উন্নয়নে করণীয়
বরেন্দ্র্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম এ কারণে ফসল বিন্যাসে সবুজ সারের চাষ সংস্থান করা প্রয়োজন। তাছাড়া মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয় এবং মাটির রস ধারণক্ষমতা কম। সেজন্য অধিক জৈব পদার্থ যোগ করলে এসব ধর্মের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়। বছরে তিন বার ধান না করা ভালো এ ক্ষেত্রে একবার ডাল চাষ করতে হবে, যাতে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ হয় এবং মাটিতে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তবে আমন ধানের পর জাবড়া বা মালচ ব্যবহার করে আলু চাষ করা যেতে পারে। বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য মুগডালের আবাদ একটি আশীর্বাদ। মুগডালের পড বা ফল তুলে গাছগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং আমন ধানে কম ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তবে মুগডালের গাছ মাটির সঙ্গে মিশানোর ৪-৫ দিন পর আমন ধানের চারা লাগালে বেশি লাভ হয়। আর মুগডাল চাষে পানির তেমন প্রয়োজন হয় না এবং উৎপাদন খরচ কম হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে কম জৈবপদার্থ থাকার কারণে ধৈঞ্চা ফসলকে শস্য বিন্যাসে আনতে হবে। এজন্য গম, ছোলা, মসুর, সরিষার মতো রবি ফসল করে ধৈঞ্চা চাষ করলেও বছরে তিনটি ফসল করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে ধৈঞ্চা বপনের ৪-৫ সপ্তাহ পর মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানি অধিক হারে ব্যবহার না করে খাল, খাস পুকুর পুনঃখনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে, যা হতে শুষ্ক মৌসুমে বা খরায় আমন ধানে এবং গম চাষে সম্পূরক সেচ প্রদান করা যাবে। কারণ যেভাবে বোরো আবাদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আবাদ করাই কঠিন হয়ে পড়বে। তবে বিল এলাকায় কূপ খনন করা যেতে পারে। কারণ বিল এলাকায় কূপ খননের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া জমির পাশে মিনি পুকুর খনন করে আমন চাষাবাদ করতে হবে এতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমবে এবং মাটিতে পানির স্তর বৃদ্ধি পাবে। আর সেচ কাজে যদি নদীর পানি ব্যবহার করা যায় তবে সবচেয়ে ভালো, প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহার করে নদীর পানি খাল, পুকুরে সরবরাহ করতে হবে। আর খরা খেকে ফসলকে রক্ষার জন্য চাষিদের সম্পূরক সেচের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
বোরো ধান আবাদ কমিয়ে গম, আলু, টমেটো, ছোলা, মসুর, তিসি, খেসারি, সরিষার আবাদ বৃদ্ধি করা। গমের জন্য বারি গম-২৬ এবং বারি গম-২৮ বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। আর সরিয়ার জন্য বারি সরিষা-১৪ ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এগুলো অধিক ফলনশীল এবং জীবনকাল স্বল্প।
বোরো চাষ করলে আউশ আবাদ কম হয় সেহেতু বোরো ধান না করে, গম, আলু অথবা স্বল্প জীবনকালীন রবি ফসলের আবাদ করে আউশ ধান করতে হবে। আউশের জন্য ব্রিধান ৪৮ (জীবনকাল- ১১০ দিন এবং ফলন-৫.৫ টন/হেক্টর), ব্রিধান ৫৫ (জীবনকাল-১০৫ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর) চাষ করলে সঠিক সময়ে আমন চাষ করা যাবে, এ ক্ষেত্রে আমনের জন্য বিনা-৭ (জীবনকাল-১১০-১১৫ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর) বা ব্রিধান ৫৬ (জীবনকাল-১১০ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর), ব্রিধান ৫৭ (জীবনকাল- ১০৫ দিন এবং ফলন-৪.৫ টন/হেক্টর) চাষ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আউশের চারা ২০-২৫ দিন এবং আমনের চারা ২৫-৩০ দিন বয়সের হতে হবে।
স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট নেরিকা ধানের লাইন এনে আরও গবেষণা এবং মাঠপর্যায়ে এর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজশাহী অঞ্চলের জন্য আরও পানি কম ব্যবহার হয় এমন শস্য বিন্যাস উদ্ভাবন করতে হবে। তবে নিম্নলিখিত শস্য বিন্যাস এ অঞ্চলের জন্য উপযোগী হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলকে নিয়ে আলাদা ফল উৎপাদন প্রকল্প এবং আলাদা ফ্রুট জোনিং সিস্টেমের আওতায় এনে উন্নত চাষাবাদ কৌশলের জন্য গবেষণা করতে হবে।
এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে প্রধান প্রধান হচ্ছে আম, লিচু, কুল, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য। তবে আমের বাগান সবচেয়ে বেশি। বিবিএস ২০১৪ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয় এবং উৎপাদন প্রায় ৯.৫ লাখ মেট্রিক টন। এর বেশির ভাগ আম বাগানের অবস্থান এ অঞ্চলেই। তাই উন্নত জাত রোপণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগ ও পোকামাকড় দমন করলে আম চাষাবাদে বিপ্লব আসতে পারে এবং ব্যাপকভাবে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি যেহেতু শুষ্ক এবং পানির প্রাপ্যতা কম সেজন্য কুল একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফল। কিছু দিন আগেও বসতবাড়ির আশপাশেই কুল চাষ হতো। তবে এখন আপেলকুল, বাউকুল, বারিকুল-১, বারিকুল-২, বারিকুল-৩ এর মতো উন্নত জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং এর চাষাবাদের ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পেয়ারা গুণাগুণে আপেলের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। সেজন্য একে ‘গরিবের আপেল’ বলা হয়। থাই পেয়ারা একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে এ অঞ্চলের জন্য দেখা যাচ্ছে। তাই পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য এর আবাদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে নেতিয়ে পড়া বা উইল্টিং রোগের কারণে পেয়ারা চাষে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিচ্ছে। এজন্য নেতিয়ে পড়া প্রতিরোধী জাত (পলি পেয়ারা এবং স্টবেরি পেয়ারা) দ্বারা জোড় কলমের মাধ্যমে নেতিয়ে পড়া প্রতিরোধী পেয়ারা গাছ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
‘পুষ্টির ডিনামাইট’ খ্যাত বারো মাসি সজিনা গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসতবাড়ির আঙিনায় যতœ ছাড়াই বেড়ে ওঠে। তবে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর কারণে বারো মাসি সজিনা এ এলাকাতে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সুনির্দিষ্টভাবে দেশব্যাপী সজিনা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আলাদা কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করা যেতে পারে। যেখান এ অঞ্চলের কৃষকরা স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে প্রয়োজনীয় তথ্য সময়মতো পেতে পারে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে আম একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তথ্য মতে, রাজশাহী অঞ্চলে উন্নত এবং রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
কৃষি গবেষণার সঙ্গে সমন্বয় করে চাষি প্রশিক্ষণ। আম বাজারজাতকরণ এবং প্রশিক্ষণের জন্য হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করা।
গুটি আমের গাছ না কেটে টপ ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ভালো জাতে পরিবর্তন করা। এছাড়া হটওয়াটার ট্রিটমেন্টের (গরম পানিতে শোধন ৫৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় আম শোধন) সুবিধা সৃষ্টি করা। যাতে আম আরও উজ্জ্বল, বেশি দিন স্থায়ী হওয়া এবং ফ্রুট ফ্লাই রোধ করা যায়।
উন্নত পদ্ধতিতে আম উৎপাদনকারী চাষিদের তালিকা করা, নিবন্ধন করা এবং সমিতির আওতায় এনে সমন্বয় সাধন করা।
আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোর তৈরি, হিমায়িত পরিবহনের ব্যবস্থা, দ্রুত স্থানান্তরকরণ, প্যাকেজিং এবং গুণগতমান পরীক্ষা করার পরীক্ষাগার তৈরি করা।
সমবায়ভিত্তিক আম সংরক্ষণের স্থাপনা তৈরির ব্যবস্থা করা এবং বিদেশিদের চাহিদামাফিক আমের জাত উদ্ভাবন করা।
জৈব প্রযুক্তি নির্ভর আম উৎপাদনে উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে আমবাগানে আলো বাতাসের অভাবে বা অন্য কারণে আমগুলো কালো বিবর্ণ এবং মাছি পোকার আক্রমণ হয় সেসব আম বাগানে এ পদ্ধতি খুব লাভজনক। এ পদ্ধতিতে ১০০% রোগ এবং পোকামুক্ত আম উৎপাদন সম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে এ আমগুলো ১০-১৪ দিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনে ১৫-৬২ বার স্প্রে করা হয়। অথচ ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৭০-৮০ ভাগ স্প্রে খরচ কমানো যায়।
পরিশেষে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি আজ হুমকির মুখে পড়েছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, টেকসই প্রশিক্ষণ, সঠিক সময়ে সঠিক উপকরণ সরবরাহ, ভূমি ব্যবহারের সঠিক দিকনির্দেশনামূলক গবেষণা এবং কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানামুখী উদ্যোগ। তবেই বরেন্দ্র অঞ্চল হবে আমাদের ‘সোনার বাংলার’ অন্যতম শস্যভাণ্ডার।
কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী
পেয়ারা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল। বাংলাদেশের সর্বত্রই কম বেশি এ ফল জন্মে থাকে। প্রাথমিকভাবে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষাবাদ পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসব জেলায় কিছু কিছু এলাকায় চাষ হয়। বর্তমানে পেয়ারার কতগুলো উন্নতজাত ও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষে কৃষক উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এখন সারা দেশেই এ ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বহুবিধ গুণাগুণের সমন্বয়ের জন্য পেয়ারাকে নিরক্ষীয় এলাকার আপেল বলা হয়। মুচমুচ করে টাটকা পেয়ারা খাওয়ার মজাই অন্যরকম। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জ্যাম, জেলি, জুস এসব তৈরি করেও পেয়ারা খাওয়া যায়। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি উন্নত জাতের পেয়ারা যেমন কাজী পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩ (লাল শাঁস বিশিষ্ট), বাউ পেয়ারা-১ থেকে বাউ পেয়ারা-৯ পর্যন্ত, ইপসা পেয়ারা পাওয়া যায়। স্থানীয় জাতের মধ্যে স্বরূপকাঠি, কাঞ্চননগর ও মুকুন্দপুরী অতি জনপ্রিয় জাত। সাম্প্রতিক সময়ে থাই পেয়ারা চাষে কৃষকদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পেয়ারা গাছের বৈশিষ্ট্য
পেয়ারা খেতে খুবই সুস্বাদু, মুচমুচে ও সুমিষ্ট। পেয়ারাকে ভিটামিন সি এর ব্যাংক বলা যায়। পেয়ারা গাছ মাঝারি আকারের শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট আকৃতির হয়ে থাকে। শীতের সময় পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শেষের দিকে পেয়ারা গাছে নতুন পাতা ও ডগা আসে। সাধারণত বর্ষা ও শীত ঋতুতে গাছে পেয়ারা হয়। তবে শীত অপেক্ষা বর্ষাকালে ফলন একটু বেশি হয়। বর্ষাকালে জলীয়ভাব বেশি থাকায় ফলের মিষ্টতা ও অন্যান্য গুণাগুণ শীতকালের ফলের থেকে অনেকাংশেই কম থাকে। তাছাড়া জলীয়ভাব বেশি থাকায় পাকা ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে দাম থাকে কম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সব জাতের পেয়ারার গুণাগুণ শীতকালে বেড়ে যায়, রোগ ও পোকার আক্রমণও কম থাকে। ফলের আকৃতি এবং রঙ সবদিক থেকেই সুন্দর হওয়ায় এ সময়ে পেয়ারার দামও থাকে বেশি। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই বর্ষাকাল বাদে কিভাবে অন্যান্য ঋতুতে অত্যাধিক হারে উৎপাদন বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু হয়। অত্যন্ত আশার কথা যে, গবেষকরা আজ এ ব্যাপারে সার্থক হয়েছেন। পেয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণ এখন খুব সহজেই সম্ভব হয়।
পেয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণের পদ্ধতিগুলো
বর্তমানে পেয়ারা গাছে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের জন্য কৃষি বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। সেগুলো হলো শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি, হরমোন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ পদ্ধতি ও শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি।
ক. শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি
পেয়ারা গাছের গোড়ার মাটি তুলে বা আলগা করে দিতে হবে। মাটি তুলে গাছের শিকড়গুলো বের করে নাড়াচাড়া দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ০১ থেকে ১.৫ মিটার (পেয়ারা গাছের ক্যানপি) পর্যন্ত মাটি কোদাল, শাবল বা নিড়ানি দ্বারা খুব ভালোভাবে সাবধানতার সাথে মাটি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মাটি তুলে দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, গাছের শিকড়গুলো কেটে না যায়। বিশেষ করে গাছের আসল মূল (টেপ রুট) কাটা ও উৎপাটন করা যাবে না। গাছ নাড়ানো যাবে না। সাধারণত যে কোনো বয়সের পেয়ারা গাছে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। গোড়ার মাটি উন্মুক্ত করার কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যাকালে পরিমাণমতো সার ও সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ পদ্ধতিতে গাছের পাতা লাল হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাসে পেয়ারা গাছে শিকড় উন্মুক্ত করতে হয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পেয়ারা গাছে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফলধারণ করে।
খ. হরমোন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ পদ্ধতি
সাধারণত ২ থেকে ৫ বছর বিশিষ্ট পেয়ারা গাছে হরমোন প্রয়োগ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে হরমোন প্রয়োগ করার উৎকৃষ্ট সময়। এ সময়ে হরমোন জাতীয় পদার্থ হিসেবে ২,৪-ডি; ন্যাপথালিন এসিটিক এসিড (এনএএ), ১০% ইউরিয়ার দ্রবণ এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। স্প্রে মেশিন বা ফুটপাম্প দিয়ে খুব ভালো করে পেয়ারা গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই গাছের পাতা লালচে হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে গাছে সঠিক পরিচর্যা নিলে নতুন পাতা জন্মাবে এবং অসময়ে ফলধারণ হবে।
গ. শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি
শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি। পেঁয়ারার ডাল বাঁকালেই প্রায় দশগুণ বেশি ফলন হয়। তাছাড়া একই প্রযুক্তিতে বছরের বার মাসই ফল ধরানো সম্ভব হয়। ফলের মৌসুমে গাছের ফুল ছিঁড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরও প্রভাবিত করা যায়, যার ফলে সারা বছরই ফলের মৌসুমের তুলনায় কমপক্ষে আট থেকে দশগুণ ফল ধরবে গাছে। এ লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গবেষণার মাধ্যমে ‘গাছের ডাল বাঁকানো’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বছরে দুইবার অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এবং হেমন্তকালে শাখা-প্রশাখার নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে সারা বছর পেয়ারার ফুল ও ফলধারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাছের বয়স দেড় থেকে দুইবছর হলেই এ পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। ডাল বাঁকানোর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে গাছের গোড়ায় সার ও পানি দিতে হয়। ডাল বাঁকানোর সময় প্রতিটি শাখার অগ্রভাগের প্রায় এক থেকে দেড়ফুট অঞ্চলের পাতা ও ফুল-ফল রেখে বাকি অংশ ছেটে দিতে হয়। এরপর ডালগুলোকে সুতা দিয়ে বেঁধে তা বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি করে সাথে অথবা খুঁটির মাধ্যমে মাটিতে বেঁধে দিতে হয় । গ্রীষ্মকালে মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন পরেই নতুন ডাল গজানো শুরু হয়। নতুন ডাল ১ সেমি. লম্বা হলে বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আর হেমন্তকালে নতুন ডাল গজাতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। ডাল বাঁকানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরে ফুল ধরা শুরু হয়। এভাবে গজানো প্রায় প্রতি পাতার কোলেই ফুল আসে। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই ফলন পাওয়া যায়।
বিশেষ ব্যবস্থাপনাগুলো
পেয়ারা গাছের আকার আকৃতি, কাঠামো ও গুণগত মানের ফলধারণের জন্য গাছে বিশেষ কতগুলো ব্যবস্থাপনা করা যায়। এ ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে অঙ্গ ছাঁটাই, ডাল নুয়ে দেয়া, ফুল ছিঁড়ে দেয়া, ফল পাতলাকরণ, ফল ঢেকে দেয়া এসব পদ্ধতি।
অঙ্গ ছাঁটাই : গাছের মরা, শুকনা, চিকন, লিকলিকে, রোগাক্রান্ত ও প্রয়োজনহীন ডালপালা ছাঁটাই করাকে অঙ্গ ছাঁটাই বলা হয়। রোপণকৃত চারা বা কলমের আকার, আকৃতি ও কাঠামো সুন্দর করার উদ্দেশ্যে মাটি থেকে ১.০ থেকে ১.৫ মিটার ওপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪ থেকে ৫টি ডাল রেখে গোড়ার দিকের সব ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে। বয়স্ক গাছের ফল সংগ্রহের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। এতে গাছে নতুর ডালপালা গজায়, প্রচুর ফুল হয় এবং গুণমানের উৎকৃষ্ট ফলধারণ করে।
ডাল নুয়ে দেয়া : পেয়ারা গাছের খাঁড়া ডালে সাধারণত ফুল ও ফল খুবই কম ধরে। তাই খাঁড়া ডালগুলোকে যদি ওজন বা টানার সাহায্যে নুয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণ নতুন শাখা গজায়। নতুন ডালপালায় গুণগতমানের ফলধারণ ও ফলন বৃদ্ধি পায়।
ফুল ও ফল পাতলাকরণ : কাজী পেয়ারা ও বারি পেয়ারা-২ এর গাছে প্রতি বছর প্রচুরসংখ্যক ফুল ও ফল আসে। ফল আকারে বড় হওয়ার গাছের পক্ষে সব ফল ধারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলের ভারে ডালপালা ভেঙে যায় এবং ফল আকারে ছোট ও নি¤œমানের হয়। এ অবস্থায়, গাছকে দীর্ঘদিন ফলবান রাখতে ও মানসম্পন্ন ফল পেতে হলে প্রথমেই কিছু ফুল এবং পরে ফল ছোট থাকা অবস্থায় (মার্বেল অবস্থা) ৫০ থেকে ৬০% ফল পাতলা করে দেয়া দরকার। কলমের গাছের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই প্রথম বছর ফল নেয়া উচিত হবে না। তাই ফুল আসার সাথে সাথে ছিঁড়ে ফেলে দেয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় বছর অল্প পরিমাণ ফল নেয়া ভালো। এভাবে গাছের বয়স ও অবস্থা বুঝে ফল রাখতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে ফুল বা ফল পাতলা করে প্রায় সারা বছর কাজী পেয়ারা ও বারি পেয়ারা-২ জাতের গাছে ফল পাওয়া যাবে।
ফ্রুট ব্যাগিং বা ফল ঢেকে দেয়া : পেয়ারা ছোট অবস্থাতেই ব্যাগিং করলে রোগ, পোকামাকড়, পাখি, বাদুড়, কাঠবিড়ালি এসব থেকে সহজেই রক্ষা করা যায়। ব্যাগিং করা ফল অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এবং আকর্ষণীয় রঙের হয়। ব্যাগিং বাদামি কাগজ বা ছোট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে করা যেতে পারে। ব্যাগিং করলে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে প্রতিহত হয় বিধায় কোষ বিভাজন বেশি হয় এবং ফল আকারে বড় হয়। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ০.৫ মিলি হারে টিল্ট ২৫০ ইসি মিশিয়ে সব ফল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে পেয়ারার উৎপাদন মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার টন। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি এসব পেয়ারা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তাছাড়া অসময়ে ফলধারণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলো গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন। বিশেষ ব্যবস্থাপনাসমূহের মাধ্যমে সহজেই পেয়ারা চাষে আর্থিক লাভবান করা সম্ভব। তাই পরিকল্পিত উপায়ে প্রযুক্তিভিত্তিক পেয়ারা চাষের প্রতি কৃষক ভাইদের উদ্বুদ্ধ ও বাস্তবায়ন করার জন্য গবেষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষিকর্মী সর্বোপরি সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট
কুঁচিয়া মাছ বাংলায় যেমন- নানা (কুইচ্চা, কুঁচে, কুঁচো) নামে পরিচিত তেমনি ইংরেজিতেও বিভিন্ন (Gangetic mud eel, Rice eel, Mud eel, Swamp eel) নামে ডাকা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Monopterus cuchia বাংলাদেশ, ভারতের উত্তরাঞ্চল, নেপাল, মিয়ানমার এবং পাকিস্তান কুঁচিয়ার আবাসভূমি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়। এ দেশের সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক চাহিদার কারণে এ মাছের বাণিজ্যিক মূল্য অনেক।
রপ্তানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ মাছ হিসেবে কুঁচিয়া চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কুঁচিয়ার পোনা উৎপাদন করা সাধারণ কৃষকদের জন্য সহজসাধ্য নয়। ডিম উৎপাদন সংখ্যা কম বিধায় পৃথিবীর কোনো দেশেই এখনও কুঁচিয়ার কৃত্রিম প্রজনন বাণিজ্যিক সফলতায় পর্যবশিত হয়নি। সুতরাং প্রকৃতি থেকে নির্বিচারে কুঁচিয়া আহরণ করে বাণিজ্যিক সুবিধা গ্রহণের চেয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে পোনা উপাদন করে কুঁচিয়ার চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিপন্নতার হাত থেকে এ মাছকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।
কুঁচিয়া মাছের বৈশিষ্ট্য
কুঁচিয়া মাছের ঔষধি গুণ
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলের অধিবাসী বিশেষত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে এ মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। উপজাতীয় সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে এ মাছ খেলে শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা, রক্তক্ষরণ এবং ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এ মাছের বায়ুথলি তাজা বা শুকনা অবস্থায় খেলে অ্যাজমা এবং বাতজ্বর আর বাড়ে না। কুঁচিয়া মাছের মাংসের সুপ বা মাংসের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হার্বস মিশিয়ে কারি রান্না করে খেলে এনিমিয়া, পাইলস ইত্যাদি রোগ সেরে যায়। বিভিন্ন গবেষণার প্রকাশিত প্রতিবেদনও অনেক ক্ষেত্রে তাদের এ বিশ্বাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে।
কুঁচিয়া মাছের পুষ্টিমান
পুষ্টিমান বিবেচনায় কুঁচিয়া মাছে পুষ্টির পরিমাণ অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। ভক্ষণযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রাম কুঁচিয়া মাছে প্রায় ১৮.৭ গ্রাম প্রোটিন, ০.৮ গ্রাম চর্বি, ২.৪ গ্রাম কার্বহাইড্রেট, ১৪০০ মাইক্রো গ্রাম ভিটামিন, ১৮৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে। এছাড়া ১০০ গ্রাম কুঁচিয়া মাছ ৩০০ কিলোক্যালরির বেশি খাদ্য শক্তির জোগান দিতে পারে।
কুঁচিয়া মাছের প্রজনন বৈশিষ্ট্য
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুঁচিয়া মাছের গায়ের রঙ গাঢ় হলুদ বর্ণের এবং পুরুষ কুঁচিয়া মাছ কালো বর্ণের হয়ে থাকে। যেহেতু কুচিয়া মাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম তাই বাহ্যিক বর্ণের ওপর ভিত্তি করে পুরুষ এবং স্ত্রী কুঁচিয়া মাছকে আলাদা করা সম্ভব নয়। তবে প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুঁচিয়া মাছের জননাঙ্গ কিছুটা স্ফিত হয় এবং ডিম ধারণ করার কারণে পেটের দিক যথেষ্ট ফোলা থাকে। পুরুষ কুঁচিয়া মাছ স্ত্রী কুঁচিয়া মাছের তুলনায় আকারে ছোট হয়ে থাকে। কুঁচিয়া মাছ বছরে একবার মাত্র প্রজনন করে থাকে। প্রকৃতিতে ২০০-৪০০ গ্রাম ওজনের কুঁচিয়া মাছ পরিপক্ব হয়ে থাকে এবং গড়ে ২৫০-৬৫০টি ডিম ধারণ করে। ডিম পাড়ার জন্য কুঁচিয়া আঁকাবাঁকা গর্ত করে থাকে। এপ্রিল মাসে শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কুঁচিয়া মাছ প্রজনন কার্য সম্পাদন করে থাকে। নিজেদের তৈরি গর্তে ডিম দেয় এবং সেখানেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এ সময় মা কুঁচিয়া খুব কাছে থেকে ডিম পাহাড়া দেয় এবং বাবা কুঁচিয়া আশপাশেই অবস্থান করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া থেকে শুরু করে ডিম্বথলি নিঃশোষিত না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চাগুলো মা কুঁচিয়া শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
কুঁচিয়া মাছের নিয়ন্ত্রিত প্রজনন কৌশল
ব্রুড প্রতিপালন পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতকরণ
পুকুরের আয়তন ৩-১০ শতাংশ হলে ভালো। যেহেতু কুঁচিয়া মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত গর্ত করে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে চলে যায় সেহেতু নির্ধারিত পুকুরে কুঁচিয়াকে রাখার জন্য পুকুরের তলদেশ এবং পাড় পাকা করা সম্ভব হলে ভালো নতুবা গ্লাস নাইলনের নেট বা রেক্সিন বা মোটা পলিথিন দিয়ে পুুকুরের তলদেশ এবং পাড় ঢেকে দেয়া উত্তম। গ্লাস নাইলনের নেট বা রেক্সিন বা মোটা পলিথিনের ওপর কমপক্ষে ২-৩ ফিট মাটি দিতে হবে। পুকুরের একপাশে কম্পোস্টের স্তূপ অথবা সারা পুকুরে এক ইঞ্চি পরিমাণ কম্পোস্ট দিতে হবে। পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা থাকতে হবে। বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে কচুরিপানা পুকুরের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি পরিমাণে থাকতে হবে। যেহেতু কুঁচিয়া কম গভীরতাসম্পন্ন পুকুর বা বিলে পাওয়া যায় তাই তাদের উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে প্রজনন কালে পানির গভীরতা সর্বোচ্চ এক ফুট পর্যন্ত রাখা উত্তম।
ব্রুড কুঁচিয়া মাছ সংগ্রহ এবং পরিচর্যা
ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ২৫০-৩৫০ গ্রাম ওজনের ব্রুড কুঁচিয়া মাছ সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত ব্রুড কুঁচিয়াকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো জন্য হ্যাচারিতে বা পুকুরে হাপায় রেখে ৫-৭ দিন পরিচর্য়া করতে হবে। আহরণ পদ্ধতির জটিলতার কারণে সংগৃহীত অধিকাংশ কুঁচিয়ার মুখে আঘাত থাকে। এছাড়া সংগ্রহকারীরা দীর্ঘদিন অধিক ঘনত্বে চৌবাচ্চায় বা ড্রামে মজুদ রাখে বিধায় পেটের নিচের দিকে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায় থাকে। আঘাতপ্রাপ্ত বা শরীরে রক্ত জমাট থাকা ব্রুড কুঁচিয়াকে আলাদা করে আঘাতের পরিমাণ বিবেচনা করে ০.২-০.৫মিলি অ্যান্টিবায়োটিক রেনামাইসিন প্রয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনে একই হারে ২য় বার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে।
ব্রুড কুঁচিয়া মজুদ
সুস্থ সবল ব্রুড কুঁচিয়ার পুরুষ এবং স্ত্রী শনাক্ত করার পর ১৫০-২৫০ গ্রাম ওজনের পুরুষ কুঁচিয়া এবং ২৫০-৩৫০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী কুঁচিয়া মাছকে প্রস্তুতকৃত পুকুরে ১ঃ২ অনুপাতে শতাংশে ৩০টি করে মজুদ করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ
খাদ্য হিসেবে জীবিত মাছ ও শামুক সরবরাহের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। ১০০ গ্রাম সম্পূরক খাদ্যে মাছের ম- (৫০%), চেওয়া মাছ থেকে তৈরিকৃত চেওয়া শুঁটকি থেকে প্রস্তুতকৃত ফিশমিল (৪০%), কুঁড়া (৫%) এবং আটা (৫%) দিতে হবে। কুঁচিয়া নিশাচর প্রাণী বিধায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নির্ধারিত ট্রেতে খাদ্য প্রয়োগ করা উত্তম।
বেবি কুঁচিয়া সংগ্রহ
প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে মে-জুন মাসের মধ্যে ব্রুড প্রতিপালন পুকুর থেকে পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব। মূলত ডিম্বথলি নিঃশোষিত হওয়ার পর পোনাগুলো বাবা-মায়ের আশ্রয় ছেড়ে কচুরিপানার শেখরে উঠে আসে এবং সেখানে খাদ্যের সন্ধান করে। মে মাসের ১ম সপ্তাহে কিছু পরিমাণে কচুরিপানা উঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে প্রাথমিকভাবে গ্লাস নাইলনের তৈরি হাপার মাধ্যমে কচুরিপানা সংগ্রহ করে পুকুর পাড়ে বা সমতল স্থানে উঠিয়ে আনতে হবে।
১৫-২০ মিনিটের জন্য হাপার মুখ হালকাভাবে বেঁধে রাখতে হবে। অতঃপর হাপার বাঁধন খুলে আলতোভাবে ওপর থেকে কচুরিপানা ঝেড়ে ঝেড়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। ইতোমধ্যে জমা হওয়া পোনাগুলোকে সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে হ্যাচারিতে বা পুকুরে পূর্ব থেকে স্থাপিত গ্লাস নাইলনের হাপায় মজুদ করতে হবে। যেহেতু সব মাছ একই সময়ে পরিপক্ব হয় না তাই মে মাসে কচুরিপানা থেকে পোনা সংগ্রহের পর পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা পুকুরে পুনরায় দিতে হবে। ১৫ দিন অন্তর অন্তর কচুরিপানা পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং একই পদ্ধতিতে পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
পোনা লালন-পালন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা
কুঁচিয়ার পোনা স্টিলের ট্রে বা সিমেন্টের চৌবাচ্চায় বা পুকুরে গ্লাস নাইলনের হাপায় লালন-পালন করা যায়। ট্রে বা চৌবাচ্চা বা হাপা আয়তাকার বা বর্গাকার হতে পারে। সাধারণত মাছের ক্ষেত্রে ৩টি অর্থাৎ রেণু পোনা, ধানী পোনা এবং অঙ্গুলি পোনা পর্যায়ে পৃথক পৃথকভাবে পরিচর্যা করা হয়ে থাকে। কুঁচিয়ার পোনাও ৩টি ধাপে প্রতিপালন করতে হয়। ট্রে বা চৌবাচ্চায় বা হাপায় কুঁচিয়ার পোনা লালন-পালনের ক্ষেত্রে ওজনের ওপর ভিত্তি করে ধাপে ধাপে খাদ্য পরিবর্তন করতে হবে। কুঁচিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ পছন্দ করে বিধায় প্রতিটি ধাপে পোনা মজুদের পর পরই ঝোপালো শেকড় যুক্ত কচুরিপানা কিছু পরিমাণে সরবরাহ করতে হবে। যেহেতু ১ম ও ২য় ধাপের পোনার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, সেহেতু কচুরিপানা সংগ্রহ করে সহজেই পোনা নমুনায়ন করা সম্ভব। কুঁচিয়া মাছ স্বপ্রজাতিভোগী (Cannibalistic) প্রাণী বিধায় প্রতিটি ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষাকালীন সময়ে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং দুর্বল পোনাগুলোকে আলাদা করতে হবে।
১ম ধাপ অর্থাৎ বেবিকুঁচিয়া/গ্লাস ইল প্রতিপালন-
ডিম্বথলি নিঃশোষিত হওয়া পোনাকে বেবিকুঁচিয়া বা গ্লাস ইল বলা হয়। বেবিকুঁচিয়ার গায়ের রং গাঢ় বাদামি বা কালো বর্ণের হয়। এ পর্যায়ের পোনা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গ মিটারে ৪০০-৫০০টি কুঁচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। বেবিকুঁচিয়া মজুদের পর পর্যাপ্ত পরিমাণে জুপ্লাংটন সরবরাহ করতে হবে এবং বেবিকুঁচিয়া মজুদের ২-৩ দিন পর সম্ভব হলে রাজপুঁটি অথবা যে কোনো মাছের সদ্য প্রস্ফুটিত রেণু সরবরাহ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে জুপ্লাংটন সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। ৩-৪ দিন অন্তর অন্তর পোনার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে অপেক্ষাকৃত ছোট পোনাগুলোকে আলাদা করতে হবে।
২য় পর্যায়ে কুঁচিয়ার পোনা প্রতিপালন
সাধারণত ১০-১৫টি পোনার ওজন ১ গ্রাম হলে এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫০-২০০টি কুঁচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। এ পর্যায়ে জীবিত টিউবিফেক্স সরবরাহ করতে হবে। এজন্য ট্রে বা চৌবাচ্চায় টিউবিফেক্সের বেড তৈরি করতে হবে। তবে হাপায় পোনা লালন-পালনের ক্ষেত্রে টিউবিফেক্স কুচি কুচি করে কেটে সরবরাহ করতে হবে। এ সময় ৫-৭ দিন পর পর পোনার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অপেক্ষাকৃত ছোট পোনাগুলোকে আলাদা করতে হবে।
৩য় পর্যায়ে কুঁচিয়ার পোনা প্রতিপালন
সাধারণত ৪-৫ গ্রাম ওজনের পোনা এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৭৫-১০০টি কুঁচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। এ পর্যায়ে খাদ্য হিসেবে জলজ পোকা (হাঁস পোকা) জীবিত বা মৃত অবস্থায় সরবরাহ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে পোনার দেহ ওজনের ১০-১৫% পর্যন্ত মাছের ভর্তা সন্ধ্যার পর সরবরাহ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে এ সময় ট্রে বা চৌবাচ্চায় এঁটেল বা দো-আঁশ মাটি দিয়ে পুকুরের মতো পাড় তৈরি করে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করলে কুঁচিয়া স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাজার উপযোগী কুঁচিয়া উৎপাদনের জন্য পোনার ওজন ১৫-২০ গ্রাম হলে ব্রুড প্রতিপালনের মতো একই পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত পুকুরে মজুদ করতে হবে।
পরামর্শ
ড. ডুরিন আখতার জাহান*
*প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশের নির্বাচিত এলাকায় কুঁচিয়া ও কাঁকড়া চাষ ও গবেষণা প্রকল্প (কম্পোনেন্ট-বি), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ
গবাদিপশুর মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে বাদলা বা ব্লাক কোয়াটার (Black Quarter) একটি অন্যতম। এ রোগে পশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ মৃত্যুর হার ১০০ ভাগই। প্রতি বছর বিশেষত বর্ষার পরে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় অনেকাংশে। বাংলাদেশের অনেক গরুই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ।
কারণ ঘাতক এ রোগটির জন্য দায়ী ক্লোস্টোডিয়াম চোউভি (Clostridium chauvoei) নামক ব্যাকটেরিয়া। এটা গ্রাম পজিটিভ, অবায়ুরোধী, স্পোর সৃষ্টিকারী দ-াকৃতির ব্যাকটেরিয়া। এ জীবাণু সহজেই সংক্রামিত হতে পারে।
রোগতত্ত্ব-এপিডেমিওলজি : মারাত্মক সংক্রামক রোগ যা প্রায় সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। তবে কিছু কিছু দেশে তাদের উন্নত ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে কম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ রোগের প্রকোপ বেশি। বিশেষত বর্ষাকালে পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর পরই এর প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়।
এটি এমন রোগ যা সাধারণত হৃষ্টপুষ্ট পশুতেই বেশি হয়ে থাকে। যাদের বয়স ৬ মাস থেকে ১/২ বছরের মধ্যে। এ সময় গরুর মাংস পেশি অনেক ভালো থাকে। যার ফলে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলেই খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে রোগের পরিণাম ঘটিয়ে থাকে।
ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এ রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে এর সংখ্যা তুলনামূলক খুবই কম থাকে। চিকন পশুর চেয়ে মোটা পশুতেই এর প্রকপ বেশি লক্ষণীয়।
গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ১০ বছর পর এ রোগের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
বাদলা রোগ যেসব ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে তা হলো বয়স বাদলা রোগের ক্ষেত্রে বয়সের হিসাব নিকাশ খুবই বেশি। সাধারণত এ রোগে গরুর ক্ষেত্রে ৩ মাস থেকে ২ বছরেই বেশি হয়।
খাদ্য : বেশি পুষ্টি সম্পন্ন পশুর ক্ষেত্রে এ রোগ বেশি হয় ।
যেসব প্রাণী আক্রান্ত হয় : বাদলা বা ব্লাক কোয়াটার সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া মহিষসহ অন্যান্য প্রাণীতেও হয়ে থাকে।
যেভাবে রোগের বিস্তার ঘটে : দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে।
ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এ রোগের জীবাণু বিভিন্ন ধরনের ক্ষতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে যেমনÑ শিং কাটার সময়, খাসি করার সময়, বাচ্চা প্রসবের সময় এবং অন্যান্য অপারেশনের সময় বা অপারেশনের পরে।
স্পোরযুক্ত ঘাস বা অন্যান্য লতাপাতা গ্রহণের ফলে।
রোগ জননতত্ত্ব : স্পোর অবস্থায় এ রোগের জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। অন্ত্রের অবায়বীয় স্থানে স্পোর ভেজিটেটিভ জীবাণুতে রূপান্তরিত হয়। পরে পচনশীল পদার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ জীবাণু রক্তে প্রবেশ করে। আর বৈশিষ্ট্য গত কারণেই এ ব্যাকটেরিয়া পুরু মাংসপেশির প্রতি আসক্ত। তাই প্রধানত গ্লুটিয়াল, ঘাড়ের পেশিতে অবস্থান গ্রহণ করে। পরে সারকোল্যাকটিক এসিড বৃদ্ধির ফলে জীবাণুর বংশ বৃদ্ধির হার বেড়ে যায় অনেকাংশে।
এ জীবাণুর দ্বারা সৃষ্ট বিষ বা টকসিন (Hemolysis) আক্রান্ত পেশির মৃত্যু ঘটায়। এতে পেশির কোয়াগুলেশনসহ সিরোহেমোরেজিক প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ফলে গ্লুকোজ ফার্মান্টেড (Fermented) হয়ে এসিড ও গ্যাস উৎপন্ন হয়।
লক্ষণ
বাদলা রোগের লক্ষণ কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়। যথাÑ
১. অতি তীব্র প্রকৃতির ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পশু মারা যায়। এমনকি ১-২ ঘণ্টার মধ্যে পশু কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করেই মারা যায়।
২. তীব্র প্রকৃতির ক্ষেত্রে-
রোগ নির্ণয় : বাদলা রোগ নির্ণয় করা সহজ হয় যদি এর ইতিহাস নেয়া যায় । যেমন পশুর বয়স যদি ৬ মাস থেকে ২ বছর হয় তাহলে বাদলা হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকে। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ যেমনÑ জ্বর, খোঁড়ানো এবং আক্রান্ত মাংসপেশি টিপলে পুর পুর শব্দ হয়। পশুকে বাদলা টিকা দেয়া না হয়ে থাকলে এবং পশু স্বাস্থ্যবান হলে। এসব লক্ষণ দেখে অনেকটাই বাদলার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। মৃত পশুর ময়নাতদন্তে প্রাপ্ত ফল দেখে- আক্রান্ত পেশির টিপলে পুর পুর শব্দ হয়, ক্ষতের পাশে কোনো লিম্ফনোড থাকলে তা ফুলে যায়, দেহের স্বাভাবিক ছিদ্র পথ দিয়ে রক্ত নির্গত হয়।
গবেষণাগারে প্রাপ্ত ফল : ক্ষতস্থান থেকে ফ্লুইড নিয়ে স্মিয়ার করে গ্রামস স্টেইনিং করলে পজিটিভ দ-াকৃতির ব্যাকটেরিয়া দেখা যাবে।
চিকিৎসা
রোগের লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হয় না হলে পরে প্রাণীকে বাঁচানো যায় না। বিলম্ব না করে উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। অ্যান্টিব্লাকলেগ সিরাম আক্রান্ত পশুর সিয়ার ১০০-২০০ মিলিলিটার ইনজেকশন দিতে হবে।
অ্যান্টিসিয়াম পাওয়া না গেলে অ্যান্টিবায়েটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। এক্ষেত্রে-
১. পেনিসিলিন গ্রুপের ওষুধ বেশ ভালো কাজ করে থাকে। প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ হাজার ইউনিট হিসেবে পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে হবে। প্রথমে ক্রিস্টালাইন পেনিসিলিন শিরায় ইনজেকশন দিয়ে পরবর্তি মাত্রায় প্রোকেইন অর্ধেক মাত্রায় আক্রান্ত পেশীতে এবং বাকি অর্ধেক মাংসপেশিতে দিনে দুই বার করে ৫-৭ দিন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
২. এ রোগের চিকিৎসায় ক্রিস্টাপেন, প্রণাপেন, এক্সিসেন্টিন, ট্রিব্রিশেন ও টেরামাইসিন যথাক্রমে ৮৭৫, ৮৫৫, ৪০৩৩,৮০০ এবং ৭১৪৩ কার্যকর হয়েছে। তাছাড়াও অক্সিটেট্রাসাইক্লিন দিয়েও চিকিৎসা করা যায় ৫-৮ মিলিগ্রাম প্রতি কেজিতে মাংসে ২৪ ঘণ্টা পরপর ৪-৫ দিন দিতে হবে।
৩. পশু খুব দুর্বল হলে ৫ অথবা ১০ বা ২৫ ডেক্সট্রোজ/গ্লুকোজ দিলে যকৃতে গ্লাইকোজেনের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে যা বিষক্রিয়া খুব সহজেই দূর করা সম্ভব।
৪. হিস্টামিনের প্রভাব কমানোর জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন দেয়া যেতে পারে।
৫. আক্রান্ত পেশি কেটে মৃত টিস্যু কেটে ফেলে দিয়ে তাতে জীবাণু মুক্ত দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যেমনÑ পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণ অথবা হাইড্রোজেন পারকসাইড দ্বারা দিনে দুইবার ধোয়া।
৬. ৮ নেগুবন সঙ্গে সমপরিমাণ নারিকেল তেল এবং ৫০ গ্রাম সালফানিলামাইড পাউডার মিশিয়ে প্রত্যহ দুই বার করে ভালো না হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবহার করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা
আক্রান্ত পশুকে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাণীর খাবার পাত্র ও খাবার উপাদান ঠিকমতো পরিষ্কার করে এবং দেখে শুনে খাওয়াতে হবে।
ময়লা স্থানের ঘাস না খাওয়ানো ভালো।
প্রতি বছর নিয়মিতভাবে প্রাণীকে ঠিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গরুর ক্ষেত্রে তিন মাসের বেশি বয়সের বাচ্চাকে ৫ মিলি বাদলা ভ্যাকসিন চামড়ার নিচে দিতে হবে ছয় মাস পরপর। ছাগল ভেড়ার ক্ষেত্রে ২ মিলি চামড়ার নিচে ৬ মাস পরপর (প্রথম ডোজ দেয়ার ৪ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে তার কার্যকারিতা এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।)
সদা পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে খামারের ভেতরে এবং বাইরে। এগুলো সঠিকভাবে খেয়াল করলে বাদলার প্রভাব থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থেকে দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নতি সম্ভব হবে। দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান*
*ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সাইন্স অনুষদ, ৪র্থ বর্ষ। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
প্রতি বছরই চর এলাকা বন্যায় অক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এ বছরও বন্যায় চরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিমগ্ন হয়ে আমন ধানের ক্ষতি করেছে। চর এলাকার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান এবং বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন, উভয়েই বন্যার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। The Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)--এর পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বর্তমান মাত্রা কমানো না গেলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আগামী ২১০০ সালে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৩.৭-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। এতে গ্রীষ্মকালে উচ্চতাপমাত্রার দিনের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং শীতকালের দিনের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে দিন প্রতি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে অথচ বৃষ্টির দিনের সংখ্যা কমে যাবে। অর্থাৎ বর্ষাকালে দিনপ্রতি বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যায় এবং বছরের অন্য সময়ে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা কমে যাবে। যার ফলে বাংলাদেশে বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ বাড়তেই থাকে এবং চর এলাকা হয় তার প্রধান টার্গেট।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা এবং এদের প্রায় ৫০০ শাখা-প্রশাখা দিয়ে পানির সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টন মাটি কণা প্রবাহিত হয়। নিয়মিত এ পলি ড্রেজিং করা অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ, যার সংকুলান করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন। নদীর বুকে এ মাটি কণা জমা হয়েই প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর চরের উৎপত্তি হয়েছে। হিমালয় থেকে প্রবাহিত মাটির মধ্যে থাকে বালু কণা (Sand), পলি কণা (Silt) ও কাদামাটি কণা (Clay)। বালু কণা আকারে বড় ও ভারি বিধায় প্রথমেই দেশের উত্তরাঞ্চলের চরে তা জমা হয়, পলি কণা বালু কণার চেয়ে ছোট ও হালকা কিন্তু কাদা কণার চেয়ে বড় এবং ভারি বিধায় দেশের মধ্য অঞ্চলের চরে জমা হয় এবং পলি কণা সবচেয়ে ছোট ও হালকা বিধায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চরে জমা হয়ে থকে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্য অঞ্চলের চরের পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয়।
ভূপ্রাকৃতিক কারণেই প্রতি বছর চরে বন্যা দেখা দেয়। তবে যে এলাকায় প্রধান নদীর সঙ্গে বেশি সংখ্যক শাখা-প্রশাখা নদী যুক্ত হয়েছে সেসব এলাকায়ই বন্যার প্রকোপ বেশি হয়। প্রতি বছর বন্যা হলেও বন্যার সময়ও এর ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। আবার বন্যার সময় ও এর মাত্রা নির্ভর করে হিমালয়ে বৃষ্টির সময় ও পরিমাণের ওপর। জলবায়ুর পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের বন্যার গতি-প্রকৃতির ওপর দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে।
বন্যায় চরের কৃষির ক্ষয়ক্ষতির ধরন : চরে প্রতি বছর বন্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। এটা চরের কৃষকের জীবনের অংশ বিশেষ। কিন্তু বন্যার মাত্রা বেশি হলে কিংবা এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে কৃষককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষকের সবচেয়ে অসুবিধা হয় গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘর ভেঙে যায়, গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে এবং পশুর অসুখ বিসুখ বেড়ে যায়। দুর্গম এলাকায় চরের অবস্থান হওয়ার কারণে গরু-ছাগল চুরি বা ডাকাতির মাত্রাও বেড়ে যায়। তাই অনেক সময়ই মানুষ এবং পশুকে একই ঘরে বসবাস করতে হয়। সংরক্ষণাগার না থাকায় বন্যায় ফসলের বীজ নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষাকালের প্রধান ফসল আমন ধান বিনষ্ট হয়। তবে আমন ধানের ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে বন্যার স্থায়িত্ব, বন্যার পানির গভীরতা, ধানের জাত ও গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ের ওপর। চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে ধানের চারা সম্পূর্ণ ডুবে গেলে এবং বন্যার স্থায়িত্ব যদি দুই সপ্তাহের, তাহলে আমন ধান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যদি কুশি গজানোর মধ্য পর্যায়ে বন্যা দেখা দেয়, তাহলে বন্যার স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহের বেশি হলেও কৃষক আশানুরূপ ফলন পাবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও কৃষির জন্য করণীয় : দেখা গেছে, যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয় সে বছর রবি মৌসুমের (শীতকালীন) ফসলের ফলন ভালো হয়। এর কারণ হলো বন্যার মাত্রা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব পলিতে গাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যোপাদান থাকে। তাছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয় সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেমনÑ গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারে। ফলে ফলনের পরিমাণ হয় আশানুরূপ।
অনেক বছর আগস্ট মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় না। এরূপ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন- বিইউ ধান-১, ব্রি ধান৫৬, বিনা ধান৭ এর চাষ করা যাবে। কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য ভাসমান পদ্ধতি বা দাপোগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে ওই বছর নতুনভাবে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। যদি বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরও স্থায়ী হয় তা হলে এসব জমিতে কোনোক্রমেই আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গরুর ঘাস হিসেবে মাসকলাই কিংবা পাতা জাতীয় স্বল্পমেয়াদি জাতের সবজি চাষ করা যেতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি অবশ্যই সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসের প্রথমেই রবি ফসল যেমনÑ গম, ভুট্টা, আলু, ডালজাতীয় ফসল ইত্যাদি চাষ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।
চর এলাকায় এবছর রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। চরের কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গম চরে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে চরের কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। এর মূল কারণ হলো অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে যে, চরের কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। কারণ উঁচু ও ভালো কৃষি জমি প্রতি বছর প্রায় ০.৭০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। চরকে এজন্যই বলা হয় ‘কৃষির হিডেন ডায়মন্ড’। কারণ প্রায় এক মিলিয়ন চরই হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের খাদ্যের আধার।
যেহেতু চরে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে সেহেতু চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। দেখা যায় দুর্গম চরে আধুনিক কৃষির তথ্যাদি অনেক বিলম্বে পৌঁছে। কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চর এলাকায় এখনও সোনালিকা জাতের গম চাষ করা হয় যা কৃষি বিজ্ঞানীরা বহু আগ থেকেই চাষ করার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বারি গম-২৬ কিংবা ২৮ এরই মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে চাষ হচ্ছে। চরের শস্য নির্ঝঞ্ছাটভাবে চাষ করা যায়। তবে উত্তরাঞ্চল ও পদ্মার চরের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকায় মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয়। অন্যান্য এলাকার তুলনায় তাই চর এলাকায় বেশি সেচের প্রয়োজন হয়। আবার চরে বিদ্যুতের সুবিধা না থাকায় ডিজেলের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে হয়। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। বন্যায় যেহেতু কৃষকের বীজ নষ্ট হয়ে যায়, সেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষক সংগঠন করে বীজ রক্ষণাগার তৈরি করতে হবে। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষককে রবি ফসলের নির্বিঘœ চাষের জন্য বীজসহ কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বন্যার সময় গবাদিপশুর থাকার জন্য উঁচু করে সরকারের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় গোয়ালঘর করা যেতে পারে। গবাদিপশুর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা না হলে চরের কৃষক উন্নত জাতের গবাদিপশু লালন পালনের জন্য উৎসাহিত হবে না। চরে কেইজ বা খাঁচা/প্যানকালচার পদ্ধতিতে বর্ষাকালে দ্রুতবর্ধনশীল মাছের চাষ করা সম্ভব বলে মাৎস্যবিজ্ঞানীরা মনে করেন। তবে সেজন্য কৃষককে প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। চরে মাছের পোনা সহজে কৃষক পায় না। সেজন্য সম্মিলিতভাবে চরের কৃষকদের সহযোগিতা করতে হবে। আগামী বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রফেসর ড. এম আবদুল করিম*
*কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
আমাদের শতাধিক ফলসমৃদ্ধ ফল ভাণ্ডারে বিভিন্ন রোগ, পোকামাকড়, ইঁদুর, বাদুড়, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, সজারু, পেঁচা, পাখি, খরগোশ, আগাছা, পরগাছা এসব ফল ও ফলগাছের ক্ষতি করে। ক্ষতিকর এরাই বালাই। ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে ফলচাষিরা সাধারণত ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের ওপরই বেশি নির্ভর করেন। অন্যান্য ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহারে যতটা না জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, ফলে বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। কেননা ফল আমরা সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে কাঁচা ও পাকা খাই, কোনো রান্না বা প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন হয় না। তাই রাসায়নিক বালাইনাশক সরাসরি আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এজন্য অন্য ফসলের আগে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা করা বেশি দরকার। কিন্তু ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা যেমন জটিল তেমনি গবেষণা উদ্ভাবিত তথ্যের অভাব রয়েছে। ফলের আছে শত রকমের বালাই। ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও সেজন্য খুব সহজ নয়। বিভিন্ন ফলের বালাই সুনির্দিষ্ট, কিছু নির্দিষ্ট বালাই আবার একাধিক ফলে আক্রমণ করে। সেজন্য ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কিছু সাধারণ নীতি অনুসরণ করলে বালাইমুক্ত ফল উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়। তবুও এগিয়ে যেতে হবে।
বালাই কাকে বলে?
বালাই মানে- আপদ, বিপদ, মসিবত ও গজব। বালাই কথাটা আসলে মানুষের সাথেও সম্পর্কিত। বালাই ফলের ক্ষতি করে ঠিকই, কিন্তু সে ক্ষতি বা পরিণতির চূড়ান্ত শিকার হয় মানুষ। সেজন্য সাধারণ অর্থে বালাই বলতে সেসব জীব ও অজীবকে বুঝায় যা মানব কল্যাণে মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতি করে। ক্ষতিকর জীবসমূহ মানুষের খাদ্যকে নষ্ট করে, আশ্রয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে, রোগের জীবাণু ছড়ায়, রোগ সৃষ্টি করে নানাবিদ সমস্যা সৃষ্টি করে। মানুষকে এমন লাখো কোটি ক্ষতিকর জীবকে মোকাবিলা করেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর জীব বা প্রাণী হলো কীটপতঙ্গ। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তার প্রায় ৭৫ শতাংশ হলো পোকামাকড়। এসব পোকামাকড়ের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ফলের অন্যতম ক্ষতিকর আর একটি বালাই হলো রোগ। বিভিন্ন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, কৃমি, মাইকোপ্লাজমা, জীবাণু ফলের রোগ সৃষ্টি করে। আগাছা পরগাছাও ফলগাছের ক্ষতি করে, ফলন কমিয়ে দেয়, রোগজীবাণু ও পোকামাকড়ের বিকল্প আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করে। তাই এসব উদ্ভিদও বালাই। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীও সম্মিলিতভাবে ফলের বালাই হিসেবে ক্ষতি করে। বিশেষ করে শিয়াল, বাদুড়, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, সজারু, শামুক, খরগোশ, পাখি, পেঁচা ফল খেয়ে নষ্ট করে।
ফলের বালাই কারা?
ফলের বালাই বলতে যারা ফল ও ফলগাছের ক্ষতি করে তাদের বুঝায়। একেক ফলে একেক বালাইয়ের আক্রমণ দেখা যায়। আবার অনেক ফলে একই বালাইয়ের আক্রমণ দেখা যায়। যেমন মাজরাপোকা, জাবপোকা, ছাতরা পোকা, কা-পচা রোগ, অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এসব। কোনো কোনো বালাই কম ক্ষতি করে, কোনোটা মাঝারি আবার কোনোটা বেশি ক্ষতি করে। এসব বিষয় বিবেচনা করে ফলের বালাইসমূহকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রধান ও অপ্রধান বালাই : যেসব বালাই প্রায়শ ও বেশি ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব ঘটায়, প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। এসব বালাইয়ের প্রাকৃতিক শত্রু থাকে কম ও ক্ষতি করার ক্ষমতা থাকে অনেক বেশি। যেমন- আমের শোষক পোকা, পেয়ারার অ্যানথ্রাকনোজ ও ফলের মাছি পোকা। এদের মুখ্য বালাইও বলা যায়। আবার যেসব বালাই কম দেখা যায়, কম ক্ষতি করে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এরা খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না। প্রাকৃতিক শত্রুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের দমন করে রাখে। যেমনÑ সাইট্রাস সাইলা পোকা। এদের গৌণ বালাইও বলা যায়।
আকষ্মিক বা হঠাৎ বালাই : সচরাচর যেসব বালাই দেখা যায় না, বিভিন্ন কারণে হঠাৎ আবির্ভাব হয়, ক্ষতি করার পর আবার উধাও হয়ে যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় বা প্রভাব ও মানুষের দ্বারা এসব বালাইয়ের আবির্ভাব ঘটে। যেমন- বুনো হাতি।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বালাই : যেসব বালাই সরাসরি ফলের ক্ষতি করে। পেয়ারার ফলের মাছি, বুলবুলি পাখি, কাঠবিড়ালি, অ্যানথ্রাকনোজ রোগ, ফলপচা রোগ এসব প্রত্যক্ষ বালাই। আর যেসব বালাই সরাসরি ফলের ক্ষতি করে না, ফলগাছের পাতা বা গাছ খেয়ে ক্ষতি করে, ফলনে প্রভাব পড়ে। যেমন- লেবুর পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা। এ পোকার আক্রমণে লেবুর অনেক পাতা নষ্ট হয়। এ কারণে গাছের খাদ্য তৈরি কমে যায় ও গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এত ফুল ও ফল কম ধরে, ফল ধরলেও তা অপুষ্ট হয়। এরা পরোক্ষ বালাই।
ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কী?
ব্যবস্থাপনা হলো সমন্বয় করা। ফলের বালাই ব্যবস্থাপনায় অধিকাংশ কৃষক বালাইনাশকের ওপর নির্ভরশীল বেশি। কেননা বালাইনাশক বাজারে সুলভ, চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়, সহজে ব্যবহার করা যায় এবং দ্রুত ফল দেয়। আবার আইপিএমের ধারণাটি সাধারণ চাষিদের কাছে ততটা সহজ বোধগম্য নয়, অনেক কৌশল সম্পর্কে তারা জানেন না ও সেসব কৌশলের কার্যকারিতা সম্পর্কে বেশ অনাস্থা রয়েছে। বাণিজ্যিক ফলচাষিরা চান রোগ ও পোকামুক্ত আকর্ষণীয় ফল, তাতে যতবার যত বালাইনাশক দেয়া লাগে তারা ততবার তা দেন। সেজন্য ফলচাষিদের কাছে আইপিএম ধারণার গ্রহণযোগ্যতা এখনও বালাইনাশকের মতো হয়ে ওঠেনি। পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত যদি বিদেশে ফল রপ্তানি করতে হয় তাহলে সেসব দেশের ক্রেতারা ক্ষতিকর রাসায়নিক দেয়া ফল কিনবে না। তাছাড়া উপর্যুপরি ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারে ফলে অধিকাংশ বালাইয়ের পুনরুজ্জীবন লাভ, পুনরুত্থান, নতুন বালাইয়ের আবির্ভাব, মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট ও পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতি হয়। তাই মানসম্মত ও লাভজনক নিরাপদ ফল উৎপাদনে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। আইপিএম একটি পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা কৌশল, যার মাধ্যমে বালাই ব্যবস্থাপনার উপযোগী কলাকৌশলের মধ্য থেকে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে একাধিক কৌশল বেছে নিয়ে একযোগে প্রয়োগ করে বালাইয়ের সংখ্যাকে আর্থিক ক্ষতিসীমার নিচে নামিয়ে রাখা হয় এবং বালাই ব্যবস্থাপনার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের একটি প্রক্রিয়া। এর অর্থ এই নয় যে, আইপিএমে মাধ্যমে সব বালাই দমন বা নিধন করা হয়। বরং এর মাধ্যমে এমন এক পরিবেশ বা অবস্থা সৃষ্টি করা হয় যাতে বালাই কমবে বা নিয়ন্ত্রিত হবে। আইপিএম একাধিক প্রাকৃতিক উপাদানকে বিবেচনা করে কাজ করে বিধায় এটি পরিবেশসম্মত হয়ে পোকা দিয়ে পোকা দমন, রোগজীবাণু দিয়ে পোকা ও রোগ ধ্বংস, প্রাকৃতিক শক্তি বিশেষ করে সূর্যালোক, পানি, তাপকে আইপিএমে বিবেচনা করে। এর সফলতা বা কার্যকারিতা আসলে নির্ভর করে নিয়মিত মনিটরিং বা ফলগাছ পর্যবেক্ষণ, অবস্থা বিশ্লেষণ, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ওপর। নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য বালাই নিয়ন্ত্রণে আইপিএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য
সাধারণভাবে আইপিএমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুস্থ ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষকের প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ফসল উৎপাদন ও কৃষকের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। অনেকের ধারণা যে, আইপিএম পদ্ধতিতে আদৌ কোনো বালাইনাশক ব্যবহার চলবে না। আসলে তা নয়। পোকামাকড় ও রোগবালাই যদি অন্যান্য দমন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, শুধুমাত্র তখন শেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে। তবে তার ব্যবহার করতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ও যুক্তিসংগতভাবে। এর মধ্যে আছে- নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, কৃষি পরিবেশ বিশ্লেষণ ও নিয়মিত বালাই জরিপ নিশ্চিত করা; ক্ষেতে ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড়ের ভারসাম্য বজায় রাখা; শুধু বালাইনাশকের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া ও বালাইনাশকের এলোপাতাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা; আইপিএম ধারণায় কৃষককে দক্ষ করে গড়ে তোলা- যাতে করে নিজের ফসলের বালাই ব্যবস্থাপনার সঠিক সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই গ্রহণ করতে পারেন।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার সুফল
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা যে সব সুফল পেতে পারি তাহলোÑ সুস্থ সবল উৎপাদন; ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো; পরিবেশ দূষণমুক্ত ফসল উৎপাদন; বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ বা কমানো; জমিতে বন্ধুজীবের সংখ্যা বাড়ানো; বালাই ব্যবস্থাপনার খরচ তথা ফলের উৎপাদন খরচ কমানো; বালাই ব্যবস্থাপনায় কৃষকের দক্ষতা বাড়ানো; কৃষকের স্বাস্থ্য ভালো রাখা; কৃষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান করাই হলো বালাই ব্যবস্থাপনার সুফল।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপাদান/কৌশল
বাংলাদেশে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত আইপিএমের প্রধান ৫টি উপাদান বা কৌশল হলো-
১. বালাই সহনশীল জাতের ফল চাষ : এটি সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি উপাদান কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে এ উপাদানের কার্যকারিতা কম। কেননা, এ দেশে ফলের যত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে সেসব জাতের বালাই সহনশীলতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য খুব বেশি নেই। তবু যা আছে তার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়। বিশেষ করে কোনো এলাকায় যদি কোনো নির্দিষ্ট বালাইয়ের আক্রমণ নিয়মিতভাবে প্রতি মৌসুমে ঘটতে থাকে তাহলে নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে সে বালাই প্রতিরোধী জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে। যেমন- অ্যানথ্রাকনোজ রোগ প্রতিরোধী জাতের পেয়ারা চাষ করে বাউ পেয়ারা ১. বাউ পেয়ারা ২. বাউ পেয়ারা ৩. মুকুন্দপুরী ও কাঞ্চননগর জাতে এ রোগের আক্রমণ কম হয়। অন্য দিকে স্বরূপকাঠি ও কাজী পেয়ারাতে এ রোগ বেশি হয়।
২. জৈবিক পদ্ধতি : এটা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূলভিত্তি। প্রকৃতিতেই বালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু সেসব ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হলো আমাদের কাজ। এসব প্রাকৃতিক শত্রুর কেউ পরভোজী, কেউ পরজীবী আবার কেউবা বালাইয়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। ফলবাগানে কোনো রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ না করলে এসব উপকারী প্রাকৃতিক শত্রুদের সংখ্যা বাড়ে ও প্রকৃতির নিয়মে তারাই বিভিন্নভাবে বালাই নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের মধ্যে শত্রু মিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। এজন্য বালাই কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ফলবাগানে এসব বন্ধুজীব বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ফলবাগানে প্রধানত যেসব বন্ধু পোকামাকড় দেখা যায় তাদের কয়েকটির পরিচয় দেয়া হলো-
লেডিবার্ড বিটল : এরা ফলের ক্ষতিকর জাব পোকা, স্কেল পোকা, মাকড় ও নরম দেহের অন্যান্য পোকা শিকার করে খায়। অনেক রঙের ও রকমের লেডিবার্ড বিটল আছে। বড়দের চেয়ে বাচ্চারা বেশি সক্রিয় ও বেশি শত্রুপোকা খায়।
ইয়ার উইগ : এরা ফলের সাইলা নিম্ফ, জাব পোকা ও নরম দেহের পোকাদের শিকার করে খায়। ইয়ার উইগের পেছনে চিমটার মতো অঙ্গ আছে, যা দিয়ে তারা শিকার ধরতে ও শিকারকে কাহিল করতে পারে। স্ত্রী ইয়ার উইগের চিমটা বাঁকা, পুরুষদের চিমটা সোজা। বাচ্চারাও দেখতে বড়দের মতো, তবে বাচ্চাদের আকার ছোট। এরা রাতে সক্রিয় থাকে, দিনে লুকিয়ে থাকে। এরা আলোতে আকৃষ্ট হয়।
প্রিডাসিয়াস মিজ : পূর্ণাঙ্গ প্রিডাসিয়াস মিজ ক্ষুদ্র, লম্বা পা বিশিষ্ট, বাদামি হলদে মাছিরা রাতে সক্রিয় থাকে, এজন্য এদের খুব কম দেখা যায়। এর বাচ্চারা শিকার করে খায়। বাচ্চারা হলদে রঙের। এরা জাব পোকা শিকার করে খায়।
সিরফিড মাছি : এরা ফলের জাব পোকা, স্কেল পোকা ও থ্রিপস শিকার করে খায়। এর বাচ্চারা শিকার করে। বাচ্চারা পাবিহীন, চ্যাপ্টা দেহের, মাথার দিক সুচাল। পূর্ণাঙ্গ মাছির হলদে বাদামি ডোরাকাটা দেহ।
অ্যানথোকোরিড বাগ : পূর্ণাঙ্গ অ্যানথোকোরিড বাগ জাব পোকা, সাইলা, স্কেল, থ্রিপস ও অন্যান্য নরম দেহের পোকা শিকার করে খায়। পূর্ণাঙ্গ পোকাকে অনেক সময় ক্ষুদ্র পাইরেট বাগ নামে ডাকা হয়। এদের দেহ সরু, সুচালো মাথা, চ্যাপ্টা ও মসৃণ দেহ, পিঠে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দাগ থাকে।
মুলিয়েন বাগ : এরা সাইলা, মাকড় ও জাব পোকা শিকার করে খায়। বাচ্চারা হলদে থেকে হালকা সবুজ রঙের। এরা দ্রুত চলাচল করে।
বোলতা : এরা পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকার পরজীবী। এ পোকার পূর্ণাঙ্গ অবস্থা ছাড়া জীবনের বাকি সব স্তরই পাতার সুড়ঙ্গের মধ্যে কাটায়। বছরে এরা কয়েকবার বংশবৃদ্ধি করে। এ পোকার বাচ্চা সাদা। এর বাচ্চারা পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকার দেহ বাইরে থেকে খেয়ে মেরে ফেলে। এই পরজীবী পোকা পরজীবীতার দ্বারা প্রায় ৯৫ শতকরা পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকাকে মেরে ফেলতে পারে।
কোটেশিয়া বোলতা : এ বোলতার বাচ্চারা ফলের বিভিন্ন লেদা ও বিছা পোকার কীড়া এবং জাব পোকাদের পরজীবীতার দ্বারা মেরে ফেলে। প্রজাতির ওপর নির্ভর করে কোটেশিয়া বোলতাদের দেখতে বিভিন্ন রকম হয়। প্রধানত পূর্ণাঙ্গ পোকার রঙ কালো। পূর্ণাঙ্গ কোটেশিয়া বোলতা লেদা বা জাব পোকার দেহের ভেতরে ডিম পাড়ে, সেখানে বাচ্চা ফুটে খায় ও পোষক শত্রুকে মেরে তার দেহের বাইরে এসে মুড়ির মতো সাদা খোলসের মধ্যে পুত্তলিতে যায়।
পরভোজী মাকড় : এরা ফলের ক্ষতিকর ক্ষুদ্র মাকড়দের শিকার করে খায়। ক্ষতিকর মাকড়দের চলাচল খুব ধীর। অন্যদিকে পরভোজী মাকড়দের চলাচল খুব দ্রুত। এদের রঙ সাদা।
আধুনিক প্রযুক্তিতে ফল চাষ
ফল চাষের যত ভালো উন্নত প্রযুক্তি আছে সব মেনে ফল চাষ করাই হলো আধুনিক নিয়মে ফল চাষ। এতে সুস্থ সবল গাছ হয়, গাছের বৃদ্ধি ও তেজ ভালো থাকে। এসব গাছ প্রাকৃতিকভাবে অনেক বালাই প্রতিরোধ করতে পারে। এজন্য ফলগাছের উন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যা করা দরকার তা হলোÑ এলাকার উপযোগী উন্নত জাতের ফলগাছ লাগানো; সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় সার দেয়া। অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ফলগাছে না দেয়া; আগাছা ও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা; নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করা; আক্রান্ত ফল ও গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।
যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা : ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে হাত বা যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারই হলো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে বালাইসমূহ বিতাড়িত হয়, মরে যায় অথচ উপকারী জীবের কোনো ক্ষতি হয় না। যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করতে হবে তাহলোÑ ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ বা বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার; কাইরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছ যখন দুর্বল বা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তা থেকে কাইরোমন নিঃসৃত হয়, যা অনেক পোককে আকৃষ্ট করে। কৃত্রিমভাবে এরূপ কাইরোমোন ব্যবহার করে ফাঁদ তৈরি করে পোকাদের আকৃষ্ট ও ফাঁদে আটকে মারা যায়; আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা; বর্ণফাঁদ ব্যবহার করা; ইঁদুরের কল বা ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছের তলার মাটি চষে দেয়া; পাখি ও বাদুড় তাড়ানোর জন্য আওয়াজ সৃষ্টিকারী টিন/যন্ত্রের ব্যবস্থা করা; বিভিন্ন ব্যাগ দিয়ে ফল ঢেকে দেয়া; মালচিং করা; করাত বা দা দিয়ে কেটে আক্রান্ত অংশ সরিয়ে ফেলা।
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা : রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা হলো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে বালাই নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বিভিন্ন জৈব ও জৈব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যায় তাহলো- মরিচের গুঁড়া, আদা ও রসুনের রস এসব। জৈব পদার্থগুলো স্প্রে করে বিভিন্ন পোকাকে বিতাড়িত করা যায়; এসিটিক এসিড, লবঙ্গের তেল, ফ্যাটি এসিড প্রভৃতি স্প্রে করা; সালফার ও চুন প্রয়োগ করা; বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করা; ট্রাইকোডার্মা বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করা।
সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বুদ্ধিমত্তার সাথে বালাইনাশক ব্যবহার করা। যে কোনো বালাইনাশক ব্যবহারে আগে তার ব্যবহারের নির্দেশনা পড়তে হবে। বালাইনাশক সাধারণত কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বা জৈবিক বালাইনাশকও আছে। জৈবিক বা প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা ব্যাপক, একই বালাইনাশক বহু রকমের বালাইকে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা পোষক বা বালাই সুনির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট বালাইকে তারা মারতে পারে। এরূপ বালাইনাশক ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দ্রুত শেষ হয়ে যায় (যেমন বিটি)। কিছু বালাইনাশকের (ডিডিটি) অবশেষ ক্রিয়া থাকে অনেক দিন। কম অবশেষ ক্রিয়াসম্পন্ন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। ফলে কোনো তীব্র বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না। রাসায়নিকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক আগ্রহী হতে হবে। তবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। তানা হলে ফল ভালো আসবে না।
ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন কৌশল
ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাকে ফলপ্রসূ করার জন্য বিভিন্ন কৌশলগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেগুলো হলো-
১. ফলের বালাইগুলো চেনা ও তথ্য জানা : সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের প্রথম কাজই হলো কোন ফল গাছে ও ফলে কী কী রোগ, পোকা ও অন্যান্য বালাইয়ের আক্রমণ ঘটে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেয়া। যথাসম্ভব সেসব বালাই শনাক্তকরণে দক্ষতা অর্জন করা। সেসব বালাই দ্বারা কী ক্ষতি হচ্ছে সেসব লক্ষণ চেনাও দরকার। পাশাপাশি কোন বালাইয়ের আক্রমণ কোন স্তরে ও কোন পরিস্থিতিতে বাড়ে তাও জানতে হবে।
২. নিয়মিত ও পরিমিত খেয়াল রাখা : দ্বিতীয় ধাপ হলো ফলগাছ অন্তত সপ্তাহে একবার পর্যবেক্ষণ করা। ফলগাছে উপস্থিত রোগ, পোকামাকড় তা শত্রু বা বন্ধু পোকা হোক ও অন্যান্য বালাই পরিস্থিতি জরিপ করে কোন বালাইয়ের তীব্রতা কত তা নির্ণয় করা দরকার। নমুনায়ন করেও এ কাজ করা যায়। এ কাজে চাক্ষুষ পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো। বিভিন্ন ফাঁদ পেতেও বালাই জরিপ কাজ করা যায়।
৩. পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ : ফল ও ফলগাছের বালাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে বালাই ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্য কলাকৌশল বিবেচনা করে সর্বোত্তম কৌশল নির্বাচন করাই হলো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ সময় বিবেচনা করতে হবে কোন কৌশলটি প্রয়োগ করলে সবচেয়ে সহজে করা যাবে, স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাবে, খরচ কম হবে, লাভ বেশি হবে। অবশ্যই সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করতে শুধু একটি কৌশলের ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না, একাধিক কৌশলকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। সবশেষে প্রয়োগের জন্য রাখতে হবে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনাকে। রাসায়নিক ব্যবহার ব্যবস্থায় সঠিক ওষুধ, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক কৌশলে প্রয়োগ করলেই লাভ বেশি হবে।
৪. কাজ শেষে কার্যক্রম মূল্যায়ন : সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কৌশল প্রয়োগের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে তার ফলাফল যাচাই করতে হবে ও তার তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। এতে পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও সহজ হবে এবং বেশি আস্থার সাথে করা যাবে।
ফলের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের ফলভাণ্ডারে একশত ৩০টির বেশি ফল আছে। এর মধ্যে ৭০টি বেশ প্রচলিত। আর ১০-১২টি খুব বেশি প্রচলিত। ফল চাষ করি আমরা কিন্তু কখনও সুপরিকল্পিকভাবে করি না। আমরা একটু সচেতন হয়ে যদি পরিকল্পিতভাবে ফলের আবাদ আর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে ফল দিয়েই আমরা নতুন এক মাত্রায় পৌঁছতে পারব। গত দুইবছর ফল দিয়ে আমরা বিশ্ব মাতানো চেষ্ট শুরু করেছি। এটি আরও সম্প্রসারিত হবে যদি আমরা সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে ফলের আবাদ উৎপাদন আর ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতি প্রযুক্তি অবলম্বন করি। সব চেয়ে বড় কথা ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা আমাদের ফলভিত্তিক সমৃদ্ধিতে আরো অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশে ১২ মাসের সব সময় সামনভাবে ফল আসে না। মোট ফলের মধ্যে জানুয়ারিতে ৫%, ফেব্রুয়ারিতে ৫%, মার্চ ৭%, এপ্রিলে ৭% এ ৪ মাসে ২৪%, মে ১৩%, জুন ১৪% জুলাই ১৫% আগস্ট ১২% এর ৪ মাসে ৫৪%, সেপ্টেম্বর ৫% অক্টোবর ৫% নভেম্বর ৬% ডিসেম্বর ৬% এ ৪ মাস মিলে ২২% ফল পাওয়া যায়। সুতরাং ফলের বালাই ব্যবস্থাপনাও এ তথ্যভিত্তিক হলে এবং এভাবেই হিসাব করে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই কাজ হবে। ফল সমৃদ্ধ আয়েশি ভাণ্ডার থেকে আমরা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ফল খাব, বাড়তি ফল বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে কৃষিতে সমৃদ্ধ কর।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা ছিল এখন তা তিনগুণ অথবা তারও বেশি। যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে সে হারে কিন্তু ফসলি জমির পরিমাণ বাড়েনি বরং কমেছে। সে সময় যে হারে ফসল উৎপাদন করা হতো এখন যদি সেই একই হারে ফসল উৎপাদন করা হয় তাহলে এত মানুষের খাদ্যের চাহিদার জোগান দেয়া কি সম্ভব হতো? অথবা আজ থেকে ২০ বছর পর জনসংখ্যা যখন আরও বাড়বে তখন খাদ্যের জোগান কিভাবে দেয়া যেতে পারে? ফসলি জমিগুলো দিন দিন বসত ভিটা আর শিল্পকারখানায় পরিণত হচ্ছে। যে পরিমাণ আছে তাও আবার বন্যা, খরা অথবা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত। এসব সমস্যার সমাধান কী হতে পারে? সমাধান ফসলের জাত উন্নয়ন।
ফসলের জাত উন্নয়ন হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলকে উন্নত ও উচ্চফলনশীল, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- খরা, বন্যা ইত্যাদির উপযোগী করে তোলা। বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন একটি এলাকা চরম খরাপ্রবণ। এখন সে এলাকায় কিভাবে ফসল উৎপাদন করা যেতে পারে? এক্ষেত্রে আমাদের এমন একটি বৈশিষ্ট্য অথবা গুণ প্রয়োজন যা ফসলকে কম পানি শোষণ করে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। আমরা জানি মরুভূমির গাছগুলো কম পানি শোষণ করে বেঁচে থাকে। এই বৈশিষ্ট্যটি যদি আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত ফসলে প্রবেশ করাতে পারি তাহলে তারা যেমন খরাতে টিকে থাকবে তেমনি ফলনের নিশ্চয়তাও দিতে পারবে। এমনিভাবে ফসলকে বন্যা, লবণাক্ততা, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী করে তোলা সম্ভব। আবার ফসলের জাতকে উচ্চফলনশীল করার মাধ্যমে যে জমিতে আগে ১০ মণ ফসল পাওয়া যেতো এখন সেখানে ১০০ মণ পাওয়া যেতে পারে।
ফসলের জাত উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো
ফসলের জাত উন্নয়নের ক্ষেতগুলো হচ্ছে
১. ফসলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি (Abiotic Stress) উপযোগী করে তোলা;
২. মৌসুমি ফসলগুলো বারো মাস উৎপাদন উপযোগী করে তোলা;
৩. পোকামাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধী করে তোলা (Disease and pest Resistance);
৪. উচ্চফলনশীল করা;
৫. ফসলের বন্ধ্যত্ব (Dormanuy) দূর করা;
৬. ক্ষতিকর উপাদান দূরীকরণ যেমন- খেসারির ডালে নিউরোটক্সিন আছে, যা প্যারালাইসিস সৃষ্টি করে। এ নিউরোটক্সিন দূর করে নতুন জাত সৃষ্টি করা যেতে পারে;
৭. ফল-ফসলের পরিপক্বতার সময়কালকে কমিয়ে আনা ফলে এক বছরে কয়েকবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে;
৮. ফল-ফসলের মধ্যে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির উন্নয়ন সাধন করা;
৯. উন্নত ফসল, যা আমাদের দেশে উৎপাদন করা হয় না সেগুলো এ দেশে উৎপাদন উপযোগী করে তোলা;
১০. উন্নত কিন্তু বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির উৎপাদন করা;
১১. ফসলের এগ্রোনোমিক বৈশিষ্ট্য (Agronomic characteristics) বৃদ্ধি করা;
১২. সংগৃহীত ফল-ফসলের স্থায়িত্বকাল (Shelf life) বৃদ্ধি করা;
১৩. অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মান উন্নয়ন করা যেমন- পাটের আঁশের মান উন্নয়ন করা।
ফসলের জাত উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে উদ্ভিদের একটি উন্নত গুণ বা বৈশিষ্ট্য (জিন) অন্য একটি উদ্ভিদে প্রবেশ করানো যায়, যা সুনির্দিষ্ট এবং বংশানুক্রমিকভাবে স্থানান্তরযোগ্য। গতানুগতিক প্রজননের (Conventional breeding) ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো দেখা যায় তা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সহজেই দূর করা সম্ভব। গতানুগতিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের স্থানান্তর কেবলমাত্র এমন দুইটি উদ্ভিদের মধ্যে সম্ভব যারা যৌনজননে অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার যে বৈশিষ্ট্য আমরা আনতে চাই তার পাশাপাশি অনাকাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ ফসলে চলে আসতে পারে যা ফসলের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। এ পদ্ধতি অনেক ধীর। অপরদিকে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে একই প্রজাতির বিভিন্ন ফসলের মধ্যে যেমন গুণাগুণ স্থানান্তর করা যায় তেমনি দূরবর্তী কোনো প্রজাতি যেমন প্রাণিদেহ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তর করাও সম্ভব।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধাপগুলো
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মোটামুটিভাবে ৫টি ধাপে সম্পন্ন করা হয়।
ধাপ ১ : কাঙিক্ষত ডিএনএ সংগ্রহ (DNA extraction)
প্রজাতির গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য (জিন) ডিএনএ’তে সংরক্ষিত থাকে। ডিএনএ’র যে অংশটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে তা নির্বাচিত ও সংগ্রহ করা হয়। এজন্য বিভিন্ন এনজাইম ও কাটিং টুল ব্যবহার করা হয় যাতে প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে সম্পন্ন কর যায়।
ধাপ ২ : জিন ক্লোনিং (Gene Cloning)
এ ধাপে জিন ক্লোনিং করা হয় অর্থাৎ যে বৈশিষ্ট্য বা গুণ (জিন) নির্বাচিত করা হয়েছে তার অনেক কপি বানানো হয়। এতে একক বৈশিষ্ট্য সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়।
ধাপ ৩ : নতুন জিনের নকশা তৈরি (Gene design)
নির্বাচিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ডিএনএ’র ছোট অংশটি কাক্সিক্ষত ফসলের বিশাল ডিএনএ’র মধ্যে বিভিন্ন এনজাইম ও কাটিং টুলের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে নতুন জিনের নকশা তৈরি করা হয়।
ধাপ ৪ : রূপান্তরকরণ (Transformation)
নতুন জিনের নকশাটি রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত করা হয়। উদ্ভিদে যেহেতু লফ লফ কোষ আছে তাই প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসে এ নকশাটি প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে তৈরিকৃত ক্যালাসে প্রবেশ করানো হয়। ক্যালাস হচ্ছে অনেক কোষের সমষ্টি যা দেখতে থকথকে জেলির মতো। এ ক্যালাস থেকে পরবর্তীতে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি যার সব কোষে নতুন বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পাবে। জিনের নতুন নকশাটি বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে কোষের ভেতর প্রবেশ করানো হয়। এ কৌশলগুলোর মধ্যে জিন গান (Gene gun) এগ্রোব্যাকটেরিয়াম (Agrobacterium), মাইক্রোফাইবার ও ইলেকট্রোপোরেশান সবচেয়ে প্রচলিত। এ পদ্ধতিগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে উদ্ভিদ কোষকে না মেরে সফলভাবে জিনের নতুন নকশাটি কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করানো। রূপান্তরিত উদ্ভিদ কোষ গ্রিনহাউসের মধ্যে পরিপূর্ণ উদ্ভিদে পরিণত হয়। এ উদ্ভিদের বীজগুলো নতুন বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয় যা সংগ্রহ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করা যায়।
ধাপ ৫ : ব্যাকক্রস প্রজনন
এ উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী উদ্ভিদকে জাত হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্বাচিত করা হয় এবং পরবর্তীতে মাতৃ গাছ হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য উত্তম প্রজাতির সঙ্গে প্রচলিত পদ্ধতিতে (Traditional breeding) বার বার প্রজনন করা হয়। এতে উৎপন্ন চারা উন্নত বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়। এভাবে উন্নত জাত উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
উপসংহার
এদেশের অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আবাদি জমির স্বল্পতা প্রভৃতি নানামুখী সমস্যা সমাধানে কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদনে বিকল্প পদ্ধতির অনুসরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ফল ও ফসলের জাত উন্নয়ন এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে, এদেশের মানুষকে দিতে পারে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা।
শাব্বির আহমদ*
*ছাত্র, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন)
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কৃষক পর্যায়ে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নই এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে বিএডিসি গুণগত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ; ভূপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং মানসম্পন্ন সার আমদানি ও বিতরণ কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন করছে।
প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রেক্ষাপট : কৃষকদের নিকট কৃষি উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিতকল্পে এবং দেশের সেচ এলাকা সম্প্রসারণের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ১৯৫৯ সালের ১৬ জুলাই খাদ্য ও কৃষি কমিশন গঠন করে, এ কমিশন দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং কৃষি উপকরণ কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালের ১৬ অক্টোবর ৩৭নং অধ্যাদেশ বলে ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ইপিএডিসি) প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) নামে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য : কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও প্রযুক্তি সহায়তার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য
১. উচ্চফলনশীল মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি;
২. খামার এবং চুক্তিবদ্ধ চাষিজোন সম্প্রসারণ, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ সুবিধাদি বৃদ্ধি, আধুনিকীকরণ এবং শক্তিশালীকরণ;
৩. বীজ প্রযুক্তি হস্তান্তর, বেসরকারি পর্যায়ে বীজ শিল্প উন্নয়নে সহযোগিতা;
৪. সেচ দক্ষতা ও সেচকৃত এলাকা বৃদ্ধি এবং ফলন পার্থক্য (Yield Gap) হ্রাস;
৫. সারের বাফার স্টক সৃজন, গুণগতমান সম্পন্ন সার সরবরাহ, সারের গুণগতমান পরীক্ষার জন্য আধুনিক পরীক্ষাগার স্থাপন;
৬. জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও ভূপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যাবলি
১. মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ;
২. নন-ইউরিয়া সার আমদানি, সংরক্ষণ ও সরবরাহ;
৩. সেচ এলাকা সম্প্রসারণ ও সেচ সুবিধা প্রদান।
বিএডিসির সার্বিক কার্যক্রম
দেশের কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে সরকার বিএডিসির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প, কর্মসূচি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন ফসলের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, চারা ও গুটি কলম তৈরি এবং বিতরণসহ দেশের কৃষকদের আধুনিক বীজ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সংস্থার বীজ উইংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। আধুনিক সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, ভূপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, সেচের পানির প্রাপ্যতা ও যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি আহরণ ও হস্তান্তরসহ কৃষককে সহায়তা প্রদানের জন্য বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ উইং কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি মাটির পুষ্টিগুণ, সমতা রক্ষা এবং ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় নন-ইউরিয়া সার (টিএসপি এমওপি ও ডিএপি) আমদানি, সংরক্ষণ ও কৃষকদের কাছে বিতরণের জন্য সার ব্যবস্থাপনা উইং কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপযুক্ত জনবলের জোগান, অভ্যন্তরীণ জনবলকে জনসম্পদে রূপান্তকরণ, প্রতিষ্ঠানের কাজ গতিশীল রাখার জন্য বিধি প্রণয়ন, পরিচালন ও প্রয়োজনীয় স্থানে আইনি সহায়তা নিশ্চিতকরণ এবং বিএডিসির কর্মকা-ের প্রচার প্রচারণা ইত্যাদি কাজ সংস্থার প্রশাসন উইংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। সংস্থার যাবতীয় অর্থ, হিসাব ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম অর্থ উইংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
বিগত ৭ বছরে বিএডিসির অর্জন
ক. বীজ সংক্রান্ত অর্জন
বিএডিসি থেকে বিভিন্ন ফসলের মোট ৯.৮০ লাখ মে.টন বীজ সরবরহ করা হয়েছে। ১ হাজার ৪৪৩ মে.টন মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করা হয়েছে। বীজ সংরক্ষণের জন্য গুদামের ধারণক্ষমতা ১.৪৩ লাখ মে.টন থেকে বৃদ্ধি করে ২.১২ লাখ মে.টনে উন্নত করা হয়েছে। এছাড়া ২টি টিস্যু কালচার ল্যাব, ২টি বীজ বর্ধন খামার, ৩০টি ডিহিউমিডিফাইড স্টোর, ১টি আধুনিক বীজ পরীক্ষাগার, ৩টি ফার্মার্স সিড সেন্টার, ২টি অটো সিড প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে এবং হিমাগারের ধারণক্ষমতা ১৭ হাজার থেকে ২৯ হাজার ২২০ মে.টন বৃদ্ধি করা হয়েছে।
খ. সেচ সংক্রান্ত অর্জন
বিগত সাত বছরে ৭ হাজার ২৯৮ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। ২ হাজার ৩১৮ কিলোমিটার ভূপরিস্থ এবং ২ হাজার ১১১ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ করা হয়েছে। ৯৭০টি গভীর নলকূপ স্থাপন এবং ১ হাজার ৫২টি পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৩ হাজার ৭৩টি শক্তিচালিত এবং ১১টি সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ৪টি রাবার ড্যাম, ১৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেচ অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৬১টি।
গ. সার সংক্রান্ত অর্জন
বিগত সাত বছরে ৪৫.৪৮ লাখ মে.টন সার আমদানির বিপরীতে ৪২.৪৭ লাখ মে.টন সার সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া সার গুদামের ধারণক্ষমতা ৯৮ হাজার মে.টন থেকে ১.৫৪ লাখ মে.টন বৃদ্ধি করা হয়েছে।
চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিএডিসির লক্ষ্যমাত্রা
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০টি প্রকল্প ও ১৪টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি খাতের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১.৩৯ লাখ মে.টন বীজ উৎপাদন এবং ১.৩৫ লাখ মে.টন বীজ সরবরাহ করা হবে। ৭টি আলু বীজ হিমাগার, ২০টি ডিহিউমিডিফাইড বীজ গুদাম, ২৪৮টি সেচ অবকাঠামো, ১১.২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৪টি প্রি ফেব্রিকেটেড স্টিল গুদাম, ৫০৮টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার নির্মাণ এবং ১৫টি সারগুদাম মেরামত, ৪৬৮ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, ৪৪টি পুকুর খনন করা হবে। ৫৫৯.০৪ কিমি. ভূগর্ভস্থ এবং ১৫.২০ কিলোমিটার ভূপরিস্থ সেচনালা তৈরি এবং ৫২,২০০ মিটার ফিতা পাইপ স্থাপন করা হবে। এছাড়া সার সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯.৩০ লাখ মে.টন।
দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। খাদ্য উৎপাদনের জন্য মানসম্পন্ন বীজ, সার এবং সেচের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা অধুনিকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় তিউনিশিয়া, মরক্কো, বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা থেকে নন-ইউরিয়া সার আমদানি এবং সেচ এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে পতিত জমি আবাদি জমিতে রূপান্তরিত করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বৃক্ষের অবদান
কৃষিবিদ মো. ফরহাদ হোসেন*
বৃক্ষ মোদের অক্সিজেন দেয়, ফুল ও ফলের বাহার
মানব জাতি, পশু এবং পাখির জোগায় আহার।
জ্বালানি কাঠ, কাগজ, মধু, আসবাবপত্র যত
বৃক্ষ জোগায় রোগ ও রোগীর পথ্য শত শত।
দালান কোঠা, জাহাজ গাড়ি, নৌকা, দোকানপাট
সব খানেই আছে দেখুন, বৃক্ষ এবং কাঠ।
মৃত্তিকা ক্ষয় কমায় বৃক্ষ, কমায় মরু খরা
বৃষ্টি এনে অধিক হারে, শীতল রাখে ধরা।
গাছের ছায়ে জিরোয় পথিক, পাখি বাঁধে বাসা
সবাই ঋণী গাছের কাছে, সাহেব কিংবা চাষা।
সুগন্ধি, মোম, রঙ বানাতে বৃক্ষ লাগে ভাই
বৃক্ষ ছাড়া বাঁচার দেখি কোনো উপায় নাই।
তাইতো বলি আসুন সবে, লাগাই বৃক্ষ চারা
ধরণীরে দেই সাজিয়ে, সবার নজর কাড়া॥
বাঁচতে হলে
মো. সাজ্জাদ হোসেন**
বাড়ছে মানুষ বাংলাদেশে, বাড়ছে বাড়িঘর;
পাল্লা দিয়ে চাষের জমি কমছে নিরন্তর।
কদিন আগেও যেই জমিতে হতো ধানের চাষ,
এখন সেথায় মন্টু মিয়ার মেজো ছেলের বাস।
ধানের চাতাল, ইটের ভাটা, নতুন বাজার-হাট
খাচ্ছে গিলে শস্যভূমি, ফসলফলা মাঠ।
এমন ধারা চললে পরে খাদ্য পাবেন কই?
বলুন না ভাই-কোনো উপায় দেখেন কি লাগসই?
অনেক ভেবে একটি উপায় বলেছে সরকার
ফ্ল্যাটবাড়িতে পল্লীবাসীর বাস করা দরকার।
পল্লীগাঁয়ে গড়তে হবে ‘পল্লী জনপদ’,
নইলে পরে আসবে দেশে সমূহ বিপদ।
বসত বাড়–ক ঊর্ধ্বদিকে, বাড়তে যদি হয়,
না হয় যেনো আর আবাদি জমির অপচয়।
বাড়ির সাথে থাকবে বায়োগ্যাসের আয়োজন,
সোলার প্যানেল, গরুর খামার, আর যা প্রয়োজন।
বাঁচলে কৃষি বাঁচবে কৃষক, বাঁচবে দেশের লোক;
তাই কামনা- এই ধারণার বাস্তবায়ন হোক।
সবাই মিলে এসব কিছু সফল করা চাই,
বাঁচতে হলে প্রকল্পটির বিকল্প যে নাই॥
ঋতুর ফসল
সুশান্ত কুমার ঘোষাল***
বাড়ির পাশে জংলা জমি
রেখো নাকো ফেলে,
হাত লাগিয়ে সাফ করে নাও
তোমরা সবাই মিলে।
ঋতুর ফসল ফলাও সেথা
যখন যেটা মেলে।
লাউয়ের বিচি, কুমড়ো দানা
লাগাও পুকুর পাড়ে;
একটুখানি যত্ন নিলে
তরতরিয়ে বাড়ে।
জৈব সার একটু না হয়
সময়মতো দিলে।
লাউয়ে আছে ফলিক এসিড,
আছে ভিটামিন;
কুমড়ো খাবে, ভরা তাতে
বিটা ক্যারোটিন।
বালাই ব্যাধি দূরে রবে,
রইবে হেসেখেলে।
*উপজেলা কৃষি অফিসার, কাউখালী, পিরোজপুর **গণপূর্ত ই/এম, উপ-বিভাগ-১৩, মেইন মেকানিক্যাল প্লান্ট রুম, জাতীয় সংসদ ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫৪২৩১৬২৪; ***৯ ডব্লিউবি/৩, বর্ণালী লেকসিটি কনকর্ড, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯
মো. আল মামুন
গ্রাম-কলিগ্রাম, থানা-মুকসুদপুর
জেলা-গোপালগঞ্জ
প্রশ্ন : পেয়ারার ফল পচা ও মাছি পোকা ফল নষ্ট করে তার প্রতিকার কী?
উত্তর : পেয়ারার ফল পচা ও মাছি পোকা প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় প্রতিটি পেয়ারা মার্বেল আকার ধারণ করলে ৬টি ছিদ্রযুক্ত ব্রাউন পেপার প্যাকেট দ্বারা আবৃত করা। গাছের নিচে ঝরে পড়া পেয়ারাগুলো সংগ্রহ করে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হয়। এছাড়া ফল পচা রোগের প্রতিকার হিসাবে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার হারে টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা স্কোর ২৫০ ইসি ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা। মাছি পোকা দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে সবিক্রন ৪২৫ ইসি অথবা ০.৫ মিলিলিটার হারে ভলিয়াম ফ্লেক্সি ৩০০ এসসি নামক কীটনাশক মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে পারেন।
সুজিত সরকার
গ্রাম-জয়নগর, থানা-দুর্গাপুর
জেলা-রাজশাহী
প্রশ্ন: আমার কামরাঙা গাছে ফুল আসে কিন্তু ফুলগুলো ঝড়ে যায়। কী করলে সমাধান হবে।
উত্তর : সাধারণত বীজের গাছে ৩-৪ বছর পর ফুল আসে। তবে প্রথম বছর অধিকাংশ ফুলই ঝরে যায়। আর কলমের গাছে ১-২ বছরের মধ্যে ফুল আসে। প্রতি বছর গাছে সুষম সার প্রয়োগ এবং নিয়মিত পানি সেচ না দিলে ফুল ফুটলেও তা ঝরে যায়। এছাড়া জোরে বাতাস বইলে পরাগায়ন ঠিকভাবে না হলেও ফুল ঝরে যেতে পারে। গাছের বয়স ৫ বছরের বেশি হলে সুষম সার হিসেবে গোবর সার ৪০-৫০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম এবং ৪০০ টিএসপি সার সমান দ্ইুভাবে ভাগ করে বছরে দুইবার বর্ষার আগে (জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে) ও বর্ষার পরে (আশ্বিন মাসের প্রথমদিকে) প্রয়োগ করতে হয়। ফুল আসার সময় গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করে মাটির রস যেন জো অবস্থায় থাকে সে ব্যবস্থা করতে হয়।
গৌতম চন্দ্র
জেলা-সাতক্ষীরা, উপজেলা-তালা
গ্রাম-কুমির
প্রশ্ন : গলদা চিংড়ি পোনা পুকুরে ছাড়ার পর মাছ পাওয়া যায় না কেন?
উত্তর : চিংড়ি পোনা একই বয়সের এবং একই সাইজের ছাড়তে হবে। কারণ বড় চিংড়ি ছোট চিংড়িকে খেয়ে ফেলে। জাল টেনে একই আকারের থেকে বড় চিংড়ি পেলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পুকুরের তলদেশে অত্যাধিক কাদা থাকলে বা পুকুরের পাড়ের গাছপালা থেকে পাতা পুকুরে পড়ে তলদেশের পরিবেশ নষ্ট হয়ে থাকলে এ সমস্যা হয়।
সাইফুল ইসলাম
জেলা-শেরপুর, উপজেলা-নকলা
গ্রাম-উরফা
প্রশ্ন : মাছের হোয়াইট স্পট বা ব্ল্যাক স্পট রোগে কী করব?
উত্তর : এটি ভাইরাসজনিত রোগ। চাষের আগে সঠিক নিয়মে ঘের প্রস্তুত করতে হবে।
* তলদেশের পচা কাদা মাটি তুলে ফেলতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে চুন ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে (শতকে ৫০০ গ্রাম) মাটি ও পানি শোধন করতে হবে।
* ঘন ফিল্টার নেটের মাধ্যমে ছেঁকে পানি প্রবেশ করাতে হবে যেন ভাইরাস বহনকারী প্রাণী বা তার ডিম প্রবেশ করতে না পারে।
* সুস্থ সবল জীবাণুমুক্ত পোনা সঠিক পরিমাণে ছাড়তে হবে।
* ব্যবহৃত জাল, পাত্র এবং সরঞ্জামাদি ব্যবহারের আগে ও পরে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানিতে/ উচ্চ ঘনত্বের পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে ভিজাতে হবে এবং রৌদ্রে ভালোভাবে শুকাতে হবে।
* পানির গভীরতা ঠিক রাখতে হবে এবং নিয়মিত চুন, পুষ্টিকর খাবার ও সার দিতে হবে।
রফিকুল ইসলাম
গ্রাম-ময়দানদীঘী, থানা-বদা
জেলা-পাঞ্চগড়।
প্রশ্ন : পেঁপে গাছের কা- পঁচে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি ছত্রাকজনিত রোগ। বর্ষা মৌসুমে কা- পচা দেখা যায়।
- রোগাক্রান্ত চারা দেখামাত্র তা তুলে ফেলতে হবে
- পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- গাছের কাণ্ডের চারদিকে ১% বর্দোমিশ্রণ বা রিডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
কুদরত আলী
গ্রাম-সিন্দুরকৌটা, থানা-গাংনী
জেলা-মেহেরপুর
প্রশ্ন : লাউ গাছে লাল লাল পোকা আছে। পাতা ও ফুল খেয়ে ফেলাচ্ছে। কী করণীয়।
উত্তর : এজন্য
- ক্ষেতের আশপাশে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।
- হাত জাল দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফালতে হবে।
- পাতার ওপর ছাই ছিটিয়ে দিতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে রিপকর্ড (১ গ্রাম/লিটার) বা একতারা (১ গ্রাম/লিটার) বা সেভিন (২ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
মো. আরাফাত হোসেন
গ্রাম-উত্তর ডিহি, থানা-ফুলতলা, জেলা-খুলনা
প্রশ্ন : পান গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : গাছের গোড়ায় মাটির কাছে একটি মধ্যপর্ব কালো বর্ণ ধারণ করে এবং এর ওপরে সাদা সাদা মাইসেলিয়াম দেখা যায়। হাতের চাপ দিলে আঁশ ছিঁড়ে পৃথক হয়ে যায়। পরবর্তীতে লতা, পাতা ও ডগা ঢলে পড়ে। প্রতিকার হিসেবে রোগ মুক্ত বাগান থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে। রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ব্যভিস্টিন বা নোইন নামক ছত্রাকনাশক দিয়ে লতা শোধন করে নিতে হবে। আক্রান্ত লতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা নষ্ট করে ফেলতে হবে। পানের বরজ পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সরিষার খৈলের সঙ্গে ডায়াথেন এম-৪৫ মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় কপার অক্সিক্লোরাইড বা ১% বর্দোমিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি স্কোর বা ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
মো. আবদুল রাহিম
গ্রাম-একডালা, থানা-রানীনগর
জেলা-নওগাঁ
প্রশ্ন : কচি নারিকেল কালো হয়ে ঝরে পরে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : গাছ পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত নারিকেল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ স্প্রে করতে হবে বা ১% বর্দোমিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে।
আল আমিন
গ্রাম-বরতুলা, থানা-পিরগঞ্জ
জেলা-ঠাকুরগাও
প্রশ্ন : গরু বা ছাগলের ডায়রিয়া হলে কী করব?
উত্তর : এসটিনজেন্ট মিক্সার উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সংগ্রহ করে খাওয়ানো। তাছাড়া ডায়াভেট, ইস্ট্রিনেক্স, ইস্ট্রিনা বা এস্টোভেট ১৫০ গ্রাম পাউডার ১০০ কেজি ওজনের গরু বা ছাগলকে খাওয়ানো যাবে তিন দিন খাওয়াতে হবে। ছাগল বা গরুর ওজন কম হলে ওষুধের মাত্রাও আনুপাতিক হারে কমিয়ে খাওয়াতে হবে।
-গরু বা ছাগলের লালন-পালনের সবসময় পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
মমিনুল ইসলাম
গ্রাম-খুন্তি, থানা-হাতিয়া
জেলা-নোয়াখালী
প্রশ্ন : ছাগলের নিউমোনিয়ায় করণীয় কী?
উত্তর : অ্যান্টিবায়োটিক স্ট্রেপ্টোপি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ২.৫ গ্রাম ৩-৪ দিন এবং মক্সিলিন, ভেট এল এ ১৪০০ কেজি ওজনের জন্য ১০ মিলি করে ৩-৪ দিন দিতে হবে।
-আক্রান্ত গরু/ছাগলকে অতি দ্রুত অন্যদের থেকে আলাদা করে নিতে হবে। আক্রান্ত গরু/ ছাগলকে স্যাঁতসে্যঁতে স্থান থেকে দূরে রাখতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
কাশফুলের শুভ্রতা, দিগন্ত জোড়া সবুজ আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ানো চিলতে সাদা মেঘ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্ষার শেষে আনন্দের বার্তা নিয়ে শরৎ এসেছে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। বর্ষা মৌসুমের সবটুকু ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর চলতি মৌসুমের পুরো পাওনা আদায় করতে কার্যকরি প্রস্তুতি নেবার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।
আমন ধান
নাবি আমন রোপণ
আখ
বিনা চাষে ফসল আবাদ
শাক-সবজি
কলা
গাছপালা
প্রাণিসম্পদ
মৎস্যসম্পদ
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আশ্বিন মাসে সারা দেশ জুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। আমন ধান রক্ষাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য এ অভিযান চলে। এককভাবে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোন লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সকল মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রানী যেমন- পেঁচা, গুইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাস বড়ি ব্যবহার করা। আসুন সবাই একসাথে অতিচালাক আমাদের এ পরমশত্রুটিকে দমন করি। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। সবাই ভাল থাকবেন।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মানুষের পুষ্টি ও সুষম খাবারের জন্য ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ফলের উৎপাদন হয় কৃষির মাধ্যমে। সুতরাং একটি সুস্থ জাতি বিনির্মাণে ফল চাষ সম্প্রসারণ তথা ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। ফল ঔষধি গুণে সম্পৃক্ত বিধায় একে রোগ প্রতিরোধী খাদ্যও বলা হয়। ফলের উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত শ্রমঘন কাজ বিধায় এগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে দেশি ফল পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
নানা ধরনের দেশি ফল ও গুণাগুণ : আমাদের নিজ দেশে যেসব ফল উৎপাদন করা হয় সেই ফলগুলোকেই আমরা দেশি ফল বলে থাকি। এসব দেশি ফল পুষ্টিগুণ বা ঔষধি গুণেও পরিপূর্ণ।
দেশি ফল চাষের অবদান
যেহেতু দেশি ফল হতে আমরা নানা ধরনের পুষ্টিমূল্য পেয়ে থাকি তাই এর চাষ আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অধিক আয় : অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা দেশি ফলের গড় ফলন অনেক বেশি। সে হারে ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি যেমন- এক হেক্টর জমিতে ধান গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে আয় হয় ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা।
জাতীয় অর্থনীতিতে : বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ফলভিত্তিক আয়ের আনুমানিক প্রায় ১০ শতাংশ আসে ফল থেকে। এ থেকে বোঝা যায় জাতীয় অর্থনীতিতে তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ফল ও ফলদ বৃক্ষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দেশি ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিমুখী সম্ভাবনা
বিশ্বের ফল বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবদান খুবই কম। বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উল্লেখযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, লেবু, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, চালতা উল্লেখযোগ্য। টাটকা ফল ছাড়াও হিমায়িত ফল (সাতকরা, কাঁঠাল বীজ, কাঁচকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে রপ্তানি হচ্ছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০, ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে ২২৪২ মেট্রিক টন, ১৫২৮.১৩ মেট্রিক টন, ২৬৯৪.৭০ মেট্রিক টন, ৫২০৩.৭০ মেট্রিক টন, ৫৪১১.২১ মেট্রিক টন এবং ১১৭৫৬.৬৩ মেট্রিক টন ফল রপ্তানি হয়, যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফল রপ্তানিতে ও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে ফল চাষ সম্প্রসারণ
বাংলাদেশে ফলের ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৭০ ধরনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল জন্মে, যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশে কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, পেঁপে, পেয়ারা, নারিকেল প্রধান বা প্রচলিত ফল হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রামের বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৭৪.৪২ গ্রাম, সারা বিশ্বে ফল একটি আদৃত ও উপাদেয় খাদ্য। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর এ পর্যন্ত উষ্ণ এবং অবউষ্ণম-লীয় অঞ্চলে চাষোপযোগী ৩০টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের ৬৫টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলোর অধিকাংশ কৃষক পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে এবং দেশীয় ফলের চাষ সম্প্রসারণসহ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এসব উন্নত জাতের আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ হওয়া অপরিহার্য।
ফল চাষ সম্প্রসারণে সমস্যাবলি
বাংলাদেশে ফল চাষে নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. কৃষকদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব।
২. গুণগত মানসম্পন্ন কলম-চারার অভাব।
৩. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের ফল চাষ সম্পর্কিত জ্ঞানের অপ্রতুলতা।
৪. গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ও বিএডিসির সমন্বয়ের ঘাটতি।
৫. ব্যক্তি মালিকানাধীন নার্সারিতে ফলের উন্নত জাতের মাতৃগাছের অভাব।
৬. উন্নত জাতের গুণগত মানসম্পন্ন কলম-চারা উৎপাদনের জন্য সঠিক জ্ঞানের অভাব।
৭. উন্নত উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞানের অভাব।
৮. অধিকাংশ ক্ষেত্রে বীজ থেকে ফল গাছ হওয়ায় ফলের ফলন ও গুণগতমান উভয়ই নি¤œমানের হয়।
৯. বাংলাদেশের চাষের জমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
১০. ফল পচনশীল বিধায় সংগ্রহোত্তর সঠিক পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষক প্রায়ই ন্যায্যমূল্য পায় না বিধায় প্রায় ২৫ শতাংশ ফল সংগ্রহোত্তর নষ্ট হয়ে যায়।
১১. বছরের কিছু সময় (মে-আগস্ট) ফলের সমারোহ থাকলেও অবশিষ্ট সময়ে (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) দেশীয় ফলের প্রাপ্যতা থাকে খুবই কম।
১২. ফল বৃক্ষের বাগান তৈরিতে উৎসাহ কম।
১৩. অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়াগত কারণে ফলন কম হয়।
১৪. প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল চাষ তেমন গুরুত্ব পায় না তাই দেশ থেকে অনেক ফল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
১৫. পাহাড়ি জমিতে ফল চাষ করা কষ্টকর বিধায় তা চাষের আওতায় আসছে না।
১৬. ফল গাছ রোপণের পর ফল আসতে দীর্ঘ সময় লাগে বিধায় অনেকে ফল চাষে আগ্রহী হয় না।
ফল চাষ সম্প্রসারণে করণীয়
১. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত পদ্ধতিতে ফল চাষ করার মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
২. উন্নতজাতের গুণগত মানসম্পন্ন কলম-চারা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকরা তা সহজলভ্য করতে পারবে।
৩. ফল চাষ বিষয়ে কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা-বৃদ্ধি পাবে, যা দেশে ফল চাষের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
৪. প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলের উন্নত জাতের মানসম্পন্ন কলমের চারা নিজস্ব নার্সারিতে উৎপাদন ও বিপণন করতে হবে।
৫. ব্যক্তিকে উন্নত জাতের মাতৃগাছের বাগান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৬. সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নার্সারিম্যান ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৭. ফলের উন্নত টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে সারা দেশে ফলচাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে।
৮. ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে ফল চাষ হচ্ছে এমন সব অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম ফলনশীল জাত পরিবর্তন করা।
৯. বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পতিত জমি রয়েছে যেখানে অনায়াসেই উন্নত জাতের ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
১০. ফল দ্রুত পচনশীল বিধায় এর সংগ্রহোত্তর অপচয় (২৫ থেকে ৪০ শতাংশ) রোধ করা ও সঠিক গুণগত মান বজায় রাখার জন্য লাগসই উন্নতমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
১১. আমাদের দেশে বছরের কিছু সময় (মে-আগস্ট) দেশের ফলের ৬১ ভাগ উৎপাদিত হওয়ায় ফলের বিপুল সমারোহ লক্ষ করা যায়। এ সময় তা পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
১২. বেশি করে ফল বৃক্ষের বাগান তৈরিতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে।
১৩. প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন ফসলের সঠিক জাত নির্বাচন ও রোপণ করতে হবে।
১৪. বেশি করে অপ্রচলিত ফলের চাষ করতে হবে যাতে ফল বিলুপ্ত না হয়।
১৫. পতিত জমি চাষের মাধ্যমে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা এবং ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি।
১৬. বেশি করে কলমের গাছ রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার
বিদেশি ফলের তুলনায় দেশি ফলে বেশি পুষ্টিগুণ থাকে এবং দেশি ফল আমাদের জন্য সহজলভ্য। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম উপায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফল পাকিয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই দেশি ফলের স্বাদ ও পুষ্টি গ্রহণের জন্য এর চাষ বাড়াতে হবে এবং ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
সাদিয়া সাইয়ারা*
* ছাত্রী, অষ্টম শ্রেণী, হলি ক্রস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা