এদেশে যখন গমের প্রথম যাত্রা হয়েছিল তখন কিন্তু গমের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম ছিল। সময়ের বিবর্তনে গম এখন সার্বজনীন হয়ে গেছে। সবাই জানেন গম এখন আদর্শ খাবারের একটি। সুস্থ কিংবা অসুস্থ সবার জন্য গম উপকারী। আমাদের দেশে গমের পরিচিত জাতগুলোর মধ্যে আছে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী, প্রতিভা, সৌরভ, গৌরব, প্রদীপ, শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ। উঁচু ও মাঝারি দো-আঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশি উপযোগী। লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয়। গমের উচ্চফলনশীল জাতগুলো বপনের উপযুক্ত সময় হলো কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ অর্থাৎ নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত। যেসব এলাকায় গম কাটতে ধান কাটতে ও জমি তৈরি করতে বিলম্ব হয় সে ক্ষেতে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রানী প্রতিভা ও গৌরব বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী গমের আটায় যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে তাহলো আমিষ ১২ গ্রাম, শ্বেতসার ৭০ গ্রাম, চর্বি ১.৭ গ্রাম, খনিজ ২.৭ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.৪৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.২৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ১১.৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৯ মাইক্রোগ্রাম, খাদ্যশক্তি ৩৪১ কিলোক্যালরি। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি মতে, গমের মূল্য অনেক বেশি।
অনেক জমিতে বোরো আমন ধান কাটার পর চাষ মই দিয়ে জমি পুরোপুরি তৈরি করে গম বীজ বোনার সময় থাকে না। এক্ষেত্রে বিনাচাষে গম আবাদ প্রযুক্তি অবলম্বন করা যায়। যেসব এলাকায় ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ হাঁটলে পায়ের দাগ পড়ে এমন অবস্থায় বিনাচাষে গম আবাদ সম্ভব। জমিতে রস না থাকলে ধান কাটার পর পরই হালকা সেচ দিয়ে জো আসলে বীজ বুনতে হয়। বীজ বোনার পর ১৫ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাখির উপদ্রব কমানো এবং রোদে শুকিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বীজ গোবরে গুলানো অবস্থায় রাখার পর উঠিয়ে শুকাতে হবে। এতে বীজের গায়ে গোবরের প্রলেপ লেগে যায়। এ পদ্ধতিতে গম আবাদে রাসায়নিক সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করা যায়। প্রথমত বীজ ও সার একই সময়ে ছিটানো যায় অথবা গম বোনার ১৭ থেকে ২০ দিনের মধ্যে জমিতে প্রথম সেচ দেয়ার সময় সব সার প্রয়োগ করা যায়। বীজ বোনার ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করা প্রয়োজন। এছাড়া স্বল্পচাষে গম আবাদের জন্য দেশি লাঙল দিয়ে গম বীজ বোনা যায়। এক্ষেত্রে ধান কাটার পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে চাষ দিতে হবে। যদি জো না থাকে তবে সেচ দেয়ার পর জো আসলে চাষ করতে হবে। প্রথমে চাষ দিয়ে মই দিতে হবে। দ্বিতীয় চাষ দেয়ার পর সব সার ও বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। অথবা দ্বিতীয় চাষের সময় লাঙলের পেছনে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বোনা যায়। বপনের ২১ দিনের মাথায় হালকাভাবে প্রথম সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচের সময় ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। স্বল্পচাষে গম আবাদ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।
বিনাগম-১ উদ্ভাবনের ইতিহাস
বিনাগম-১ এর মিউট্যান্ট সারি নং L-880-43 বিনার সাবেক মহাপরিচালক ড. এ এ হাছান পাকিস্তানের Nuclear Institute for Agriculture and Biology (NIAB) থেকে L-880 নামক একটি Segregating মিউট্যান্টের বীজ সংগ্রহ করেন যা থেকে জন্মানো গাছগুলোর প্রতিটি থেকে সবচেয়ে ভালো শীষটি বাছাই করে পরবর্তী বছর প্রত্যেকটি শীষ থেকে প্রাপ্ত বীজগুলো আলাদা আলাদা সারিতে বপন করা হয় এবং চেক জাতের চেয়ে বেশি ফলন দিতে সক্ষম এ রকম ১৮টি সারি নির্বাচন করা হয়। এ ১৮টি সারি পরবর্তিতে মাঠপর্যায়ে লবণাক্ত এবং অলবণাক্ত উভয় মাটিতে পরীক্ষা করে ৩টি মিউট্যান্ট সারি নির্বাচন করা হয়। সর্বশেষে, এ ৩টি মিউট্যান্টের মধ্যে L-880-43 মিউট্যান্টটি লবণাক্ত এবং অলবণাক্ত এলাকার গবেষণা মাঠ ও কৃষক মাঠে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখা যায় যে, এ মিউট্যান্টটি অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় থেকে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত প্রতি মিটারে ১২ ডেসি সিমেন লবণাক্ততায়ও চেক জাত বারিগম-২৫ অপেক্ষা শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। এ কারণে ৯ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় বীজ বোর্ডের ৮০তম সভায় L-880-43 নামক মিউট্যান্টটি বিনাগম-১ হিসেবে লবণাক্ত ও অলবণাক্ত এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন পায়।
শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
বিনাগম-১ এ আধুনিক উফশী জাতের প্রায় সব গুণ বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। লবণাক্ত মাটিতে পুনর্বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৬৭ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং অলবণাক্ত মাটিতে পুনর্বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৮-১০৪ সেন্টিমিটার। গোলাপি রঙের এবং গাছের কাণ্ড, পাতা ও শীষ মোমের আস্তরণযুক্ত। এর জীবনকাল ১০৫ থেকে ১১০ দিন। দানা মাঝারি ও বাদামি (অসনবৎ) রঙের। ১০০০ দানার ওজন ৩৬.৬ গ্রাম। লবণাক্ত মাটিতে ফলন প্রতি হেক্টরে ২.২ থেকে ৩.৫ টন ও গড়ে প্রতি হেক্টরে ২.৯ টন এবং অলবণাক্ত মাটিতে ফলন প্রতি হেক্টরে ৩.২ থেকে ৪.২ টন ও গড়ে প্রতি হেক্টরে ৩.৮ টন।
প্রচলিত জাতের তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য
বিনাগম-১ প্রচলিত লবণসহিষ্ণু গমের জাত বারিগম-২৫ অপেক্ষা উচ্চতায় সামান্য লম্বা। কা-, পাতা ও শীষে মোমের আস্তরণযুক্ত। সপ্তাহ খানেক পরে ফুল এলেও একই সঙ্গে পরিপক্ব হয়। এর ফলন চেকজাত, বারিগম-২৫ এর তুলনায় হেক্টরপ্রতি শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি। দানা মাঝারি ও বাদামি (Amber) রঙের।
চাষাবাদ পদ্ধতি
গমের এ জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী গম জাতের মতোই। এ জাতের বীজ অঞ্চলভেদে নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায়। জমিতে বীজ বপনের সময় মাটির লবণাক্ততা প্রতি মিটারে ৫ ডেসি সিমেন এর অধিক না হওয়া ভালো। ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে ১২ ইঞ্চি (৩০ সেন্টিমিটার) দূরে দূরে সারিতে গম বপন করতে হবে। সারির মধ্যে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ ইঞ্চি (৫ সেন্টিমিটার) রাখতে হবে। লবণাক্ত মাটিতে প্রতি হেক্টরে ২২০ থেকে ২৬০ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ থেকে ১৫০ কেজি টিএসপি, ১২০ থেকে ১৪০ কেজি এমওপি, ৬৫ থেকে ৮৫ কেজি জিপসাম, ৬.০ কেজি করে জিঙ্ক সালফেট ও বরিক এসিড এবং অলবণাক্ত মাটিতে প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি বাড়িয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ পুরো রাসায়নিক সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার বপনের ২০ থেকে ২৫ দিন পরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও প্রতি হেক্টর জমিতে ৫.০ টন হারে পচা গোবর সার-কম্পোস্ট ব্যবহার করা ভালো। গোবর সার-কম্পোস্ট ব্যবহার করলে গোবর সারে যে পরিমাণ বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থাকে তা হিসাব করে সে অনুযায়ী রাসায়নিক সারের পরিমাণ কমিয়ে ব্যবহার করতে হবে। গোবর সার জমি তৈরির ২ সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে। বৃদ্ধি পর্যায়ে ৮০ মিলিমিটার বা তার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলে কোনো সম্পূরক সেচ না দিলেও চলে। বৃষ্টিপাত ৮০ মিলিমিটারের চেয়ে কম হলে বা সময়মতো না হলে দুইটি সেচ দিতে হবে প্রথমটি বপনের ২১ থেকে ২৫ দিন পরে ও অপরটি ফুল আসা শুরু হলে।
রোগবালাই ও পোকামাকড়
এ জাতটি কাল দাগ (Black point) ও পাতা পোড়া (Leaf blotch) রোগ সহনশীল। যখন বাতাসের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে তখন জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিলে যে কোনো স্পর্শ বিষ প্রয়োগ করলে ভালো ফল আসবে।
শস্য পর্যায়
গমের সঙ্গে সমন্বিত শস্য পর্যায় হলো
গম-বোনা আউশ/পতিত-রোপা আমন (লবণাক্ত জমি)
গম-নাবি বোরো ধান বা আউশ ধান-রোপা আমন (অলবণাক্ত জমি)
গম-গ্রীষ্মকালীন মুগ-রোপা আমন (অলবণাক্ত জমি)
আঞ্চলিক উপযোগিতা
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় লবণাক্ত এলাকা পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনা। এছাড়াও দেশের সব অলবণাক্ত এলাকা রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী এসব এলাকায় গম উৎপাদনের উপযোগী।
সতর্কতা : লবণাক্ত এলাকায় বীজ বপনের সময় মাটির লবণের মাত্রা প্রতি মিটারে ৪ থেকে ৫ ডেসি সিমেনের অধিক হওয়া যাবে না।
ড. মো. আবুল কালাম আজাদ*
মো. কামরুজ্জামান**
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও **বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২
গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনাপরথি অরাইজি (পাইরিকুলারিয়া অরাইজি) প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। রোগটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায় এবং পরে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা এসব দেশে এর বিস্তার হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর গমের জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয় এবং ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। গমের জাত ও বপনের সময়ভেদে রোগের মাত্রা এবং ফলনের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এ রোগের কারণে আক্রান্ত গমের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ক্ষেতের ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। একই প্রজাতির ছত্রাক হলেও গমের প্যাথোটাইপ ধানে এবং ধানের প্যাথোটাইপ গমে ব্লাস্ট রোগ সংঘটিত করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সেইনসবারি ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ সিকোয়েনসিংয়ের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের ব্লাস্টের জীবাণু থেকে আলাদা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এবং গম গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষায়ও দেখা গেছে যে, গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ধানের চারা গাছে এবং ধানের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু গমের চারা গাছে রোগ সৃষ্টি করে না।
গমের ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লাস্ট আক্রান্ত গম ক্ষেতের কোনো কোনো স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে। গমের কিছু শীষের উপরিভাগ শুকিয়ে সাদাটে বর্ণ ধারণ করে যা সহজেই নিম্নভাগের সবুজ ও সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়; আবার কোনো কোনো শীষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই শুকিয়ে সাদাটে হয়ে যায়। এটি গমের ব্লাস্ট রোগের আদর্শ (Typical) লক্ষণ। প্রধানত গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। তবে শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। পাতায়ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট নেক্রোটিক দাগ পড়ে।
রোগের বিস্তার
আক্রান্ত বীজ এবং বাতাসের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ভেজা থাকলে এবং তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর বেশি হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্লাস্ট রোগের জীবাণু কিছু ঘাস জাতীয় বিকল্প পোষক আগাছার যেমন- চাপড়া, শ্যামা, আংগুলি ঘাসের মধ্যে বাস করতে পারে; তবে সেখানে রোগের স্পষ্ট লক্ষণ সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। অনুকূল পরিবেশে বিকল্প পোষক আগাছায় ব্যাপকভাবে উৎপন্ন জীবাণু ব্লাস্ট রোগের মহামারী সৃষ্টি করতে পারে।
গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়
ব্লাস্টমুক্ত গমের ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে;
অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত বারি গম ২৮, বারি গম ৩০ এর চাষ করতে হবে;
উপযুক্ত সময়ে (অগ্রহায়ণের ০১ থেকে ১৫) বীজ বপন করতে হবে যাতে শীষ বের হওয়ার সময় বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়;
বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি অথবা ৩ মিলি হারে ভিটাফ্লো ২০০ এফএফ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে গমের অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি;
গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত করতে হবে।
প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং এর ১২ থেকে ১৫ দিন পর আরেকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি-নভিটা ৭৫ ডব্লিউ জি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ দমন হবে। ছত্রাকনাশক ব্যবহারের সময় হাতে গ্লোভস এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে যাতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি শরীরের সংস্পর্শে না আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে।
রোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল
গমের ব্লাস্ট বাংলাদেশে নতুন হলেও রোগটি এদেশে গম চাষের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নতুন এ রোগটিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং এর সঠিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি কর্মকৌশল প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ গম বিজ্ঞানী, ডিএই, বিএডিসি, বারি, ব্রি, বিএইউ, সিমিট, ইউএসএআইডি এবং এফএও-এর প্রতিনিধি ছিলেন। টাস্কফোর্সের পরামর্শ অনুযায়ী সিমিটের সহায়তায় নেপালে একটি কনসালটেটিভ কর্মশালার আয়োজন করা হয় এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে যেসব স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয় তাহলো-
০১. গমের নতুন জাতের বীজ সরবরাহ
উন্নতমানের রোগমুক্ত বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ। উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পরবর্তী বছরে কৃষক পর্যায়ে ভালো মানের বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। পরীক্ষাগারে ব্লাস্ট এবং অন্যান্য প্রধান রোগের উপস্থিতি শনাক্তকরণের জন্য বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
০২. কৃষকের সচেতনতা বাড়ানো
নতুন রোগ বিধায় বাংলাদেশের কৃষক এবং অন্যান্য অংশীদারি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গমের ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফ্যাক্টশিট-লিফলেট তৈরি করে ডিএই, বিএডিসি, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সিমিট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারদের মাঝে বিতরণ;
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপসে ফ্যাক্টশিট আপলোড করা ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শন;
সচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ডিএই, বিএডিসি, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অগ্রগামী কৃষক এবং বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে গমের ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর কর্মশালার আয়োজন করা;
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গমের উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণ কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণে ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিকরণ। রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা।
০৩. সার্ভিলেন্স এবং মনিটরিং কার্যক্রম
গমের ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে এ রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার পর্যবেক্ষণ করা;
প্রতি বছর প্রায় ২০০টি গমের ক্ষেত ব্লাস্টসহ অন্যান্য রোগ সার্ভে এবং মনিটরিংয়ের আওতায় আনা;
বিএআরআইয়ের পরীক্ষাগারে সংগৃহীত নমুনাগুলো উপস্থিত ব্লাস্ট রোগের জীবাণু মাইক্রোসকোপ ও মলিকুলার মার্কারের সাহায্যে নিশ্চিত করা এবং ছত্রাকের আইসোলেট সংরক্ষণ;
জরিপের আওতাধীন এলাকার আবহাওয়ার তথ্য সংরক্ষণ করা এবং প্রতিটি গম ক্ষেত থেকে জিপিএস ডাটা সংগ্রহ করা;
রোগাক্রান্ত এবং রোগমুক্ত ফসলের তুলনার মাধ্যমে নির্বাচিত ক্ষেতগুলো ফলনের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা। এ লক্ষ্যে গম পরিপক্ব হলে রোগাক্রান্ত এবং রোগমুক্ত উভয় প্লটের ফলনের উপাত্ত সংগ্রহ করা;
বাংলাদেশে কিছু ঘাস প্রজাতিতে ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যায়। এজন্য সার্ভিলেন্স এবং মনিটরিংয়ের সময় সন্দেহজনক বিকল্প পোষকগুলো শনাক্ত করা এবং ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষাগারে নিশ্চিত করা;
ব্লাস্ট রোগ সার্ভিলেন্স ও মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও মাঠ কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান;
গবেষণা, সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ে গ্রুপ গঠন করে সার্ভিলেন্স ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা।
০৪. ছত্রাকনাশক সরবরাহ করা
গমের ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশকের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাতে সংশ্লিষ্ট চাষি সময়মতো ছত্রাকনাশক ক্রয় ও ব্যবহার করতে পারে।
০৫. গবেষণা কার্যক্রম
ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকায় মাঠ পর্যায়ে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী গমের জাত-লাইন বাছাইকরণ ও মূল্যায়ন;
ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে সংক্রমণ করে ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের অগ্রবর্তী লাইনগুলো শনাক্তকরণ ও নির্বাচন;
বীজ শোধন ও ফসলে স্প্রে করার জন্য নতুন ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা;
গবেষণাগারে বীজ থেকে গাছে রোগ সংক্রমণ বিষয়ক গবেষণা করা;
শস্য ব্যবস্থাপনা যেমন- বপন সময়, বীজ শোধন, ফসলে স্প্রে, ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবস্থাপনা, শস্য পর্যায় অনুসরণ এসবের মাধ্যমে সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।
০৬. বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা
ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনায় গৃহীত গবেষণা কার্যক্রমগুলো অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন।
গমের ব্লাস্ট রোগ বীজবাহিত এবং বাতাসের মাধ্যমে এর জীবাণু ছড়ায় বিধায় বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রথমবারের মতো এ রোগের আক্রমণ হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন গমের উৎপাদন ব্লাস্ট রোগের কারণে বাধগ্রস্ত হতে পারে এবং এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ভীতির মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফলন টেকসইকরণের লক্ষ্যে রোগ প্রতিরোধী জাতসহ গমের ব্লাস্ট রোগের অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ অনুরূপ আবহাওয়ার দেশগুলো এ রোগের বিস্তার রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি গবেষণা ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ড. পরিতোষ কুমার মালাকার*
ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা**
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, **পরিচালক, গম গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, দিনাজপুর-৫২০০
পানিতে জন্মে বলে পানিফল। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে থেকেই চীন দেশে পানিফলের চাষ হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়। বিগত কয়েক দশক থেকে আমাদের দেশেও পানিফলের চাষ হয়ে আসছে বিচ্ছিন্নভাবে কারও কারও ব্যক্তিগত আগ্রহে। যদিও পানিফল নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা এখনও হয়নি। তবে বর্তমানে এ দেশেও সাতক্ষীরার দেবহাটা, নওগাঁ পানিফলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। এ ফলের গাছ হয় পানিতে। স্থির বা ধীর প্রবাহমান স্রোতের পানিতে পানিফল জন্মে। ফল দেখতে অনেকটা সিঙ্গাড়ার মতো বলে সাতক্ষীরার লোকরা একে ডাকে সেঙ্গারা ফল নামে। এ দেশের আরও বেশ কিছু জায়গায় পানিফল সিঙ্গারা ফল নামেই পরিচিতি। এটি একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। ইংরেজি নাম Water chestnut, উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম Trapa bispinosa পরিবার- Onagraceae। এটি ইংরেজিতে Water chestnut হলেও স্থানভেদে Water caltrop, Buffalo nut, Devil Pod এসব নামে পরিচিত। প্রজাতির নাম বাইস্পাইনোসা মানে দুইটি কাঁটা থেকেই বোঝা যায় যে ফলে দুইটি কাঁটা বর্ষজীবী জলজ ও গাছ। সাধারণত চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফিলিপাইন, আফ্রিকা এসব দেশে পানিফল আবাদ হয়। অনেকে পানিফলকে পানির বাদাম বলে কিন্তু আসলে বাদামের কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই এতে। এটি পুরোপুরিভাবে পানীয় ফল। কাঁচা অবস্থায় এ ফল খাওয়া যায়। আবার সিদ্ধ করে, রান্না করে কিংবা প্রক্রিয়াজাত করেও খাওয়া যায়। চীনে বিভিন্ন সবজির সাথে মিশিয়ে সবজি রান্না করা হয়। চীনের খাদ্য তালিকায় পানিফল বেশ জনপ্রিয় এবং আবশ্যকীয়। চীনারা পানিফলকে শুকিয়ে আটা তৈরি করা হয়। সে আটা দিয়ে তারা পিঠা কেক বিস্কুট তৈরি করে খায়, বাজারে বিক্রি করে। কোথায় কোথায় পানিফল গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অতি পরিচিত পানিফলটি শুধু গ্রামেই নয় শহরের ফুটপাতের ফলের দোকানে স্থান করে নিয়েছে। তবে লাল ও কালচে সবুজ রঙের এ ফলটি এখনও শহরের বড় বড় ফলের দোকানে স্থান করে নিতে পারেনি অজ্ঞাত কারণে।
পানিফলের পুষ্টি ও ভেষজগুণ
পানিফল পুষ্টিতে ভরপুর। প্রায় ৯০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেড, ৬০ শতাংশ শর্করা আছে। তাছাড়া বেশ ভালো পরিমাণ আঁশ, রাইবোফ্লেবিন, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ, ভিটামিন আছে। পুষ্টিমানের বিবেচনায় পানিফলে খাদ্য শক্তি আছে ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ১.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৯ গ্রাম, শর্করা ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম। পানিফলের শুধু খাদ্যগুণই নয় রয়েছে ঔষধি গুণও। পানিফলের শাঁস শুকিয়ে রুটি বানিয়ে খেলে অ্যালার্জি ও হাত পা ফোলা রোগ কমে যায়। উদরাময় ও তলপেটে ব্যথায় পানিফল খুবই উপকারী। বিছাপোকা অন্যান্য পোকায় কামড় দিলে যদি জ্বালা পোড়া হয় তবে ক্ষতস্থানে কাঁচা পানিফল পিষে বা বেঁটে লাগালে দ্রুত ব্যথা দূর হয়। কাঁচা পানিফল বলকারক, দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাচ্য খাবার। পানিফলে শর্করা ও প্রোটিন আছে যথেষ্ট। শাঁস শুকিয়ে রেখে খাওয়া যায়।
পানি ফলের বোটানি
পানিফল অনাগ্রেসি পরিবারভুক্ত। বেশ কয়েকটি প্রজাতি আছে। ফল থেকে বংশবিস্তার হয়। পানিফলের গাছ ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পানির নিচে মাটিতে এর শিকড় থাকে এবং পানির উপরে পাতাগুলো ভাসতে থাকে। মূলকাণ্ডের সঙ্গে গাঢ় সবুজ বা লালচে সবুজ ত্রিভূজাকৃতি মোটা ও নরম পাতাগুলো গোলাকারভাবে পানির উপর ভাসে। পাতা ৮ সেন্টিমিটর লম্বা ও পাতার কিনারা খাঁজকাটা, প্রায় ৬ সেন্টিমিটার চওড়া। পাতার বোঁটা পশমযুক্ত। পত্রফলক বেশ মাংসল পুরু তেল তেলে। পানিফলের ক্ষুদ্রাকার ও সাদা রঙের উভয়লিঙ্গ ফুল হয়। ফল দেখতে সিঙ্গাড়ার মতো তিন কোণাকার। দুই পাশে শক্ত দুইটি কাঁটা থাকে। তবে ফল ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে পানিফল দেখতে যেন অবিকল গরুর মাথার মতো। দুই পাশে শিঙের মতো দুইটি কাঁটা ফলের উপর চোখ নাক মুখের আবয়ব অত্যন্ত স্পষ্ট। ফলের রঙ লাল, নীলাভ সবুজ বা কালচে সবুজ। পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিণ্ডকার বা ত্রিভূজাকৃতির নারম সাদা শাঁস। কাঁচা ফলের নরম শাঁস খেতে বেশ মজা। রসাল ও মিষ্টি মিষ্টি ভাব। গাছের শিকড় থাকে প্যাক বা কাদার মধ্যে, কা- থাকে জলে ডুবে, পাতা ফুল ও ফল ভাসে পানির উপরে। পাতা দুইটি স্তরে গোলাপের পাঁপড়ির মতো চত্রাকারে বিপরীতমুখীভাবে কাণ্ডের উপর সাজানো থাকে। পাতা অনেকটা কচুরিপানা পাতার মতো দেখতে তবে ছোট ও পুরু, গাঢ় সবুজ। পাতায় শিরা তেমন চোখে পড়ে না মাংসল ভাবের জন্য। কা- নলাকার দড়ির মতো, পেনসিলের মতো মোটা হয়। গাছ ৫ মিটার গভীর পর্যন্ত পানিতে বেঁচে থাকতে পারে। পানি ফলের ৪ পাপড়ির ছোট ছোট ফুলগুলো খুবই মনোমুগ্ধকর। আগাম লাগালে প্রতি গাছে ১০ থেকে ১২টি শাখা হয়। আর দেরিতে লাগালে প্রতি গাছে ৬ থেকে ৭টি শাখা হয়। তবে অভিজ্ঞতায় বলে পানি ফলের গাত্রবৃদ্ধি বা বাড়বাড়তি ফুল আসার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। দেরিতে আসা শাখার ফল একটু ছোট এবং দুর্বল হয়।
পানিফলের উৎপাদন মৌসুম
জুন মাসের বৃষ্টি হলে চারা লাগানো হয়। তবে পানির ব্যবস্থা থাকলে অনেকে মে মাসেও চারা লাগান। বাংলা আষাঢ় মাস থেকে ভাদ্র আশ্বিন মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যায়। মৌসুম শেষে পরিপক্ব ফল কোনো পুকুরে, পানিযুক্ত স্থানে, কিংবা কাদা পানিযুক্ত পাত্রে রেখে দেয়া হয়। কয়েক মাস পর ফল থেকে চারা গজায়। সে চারা পরে মৌসুমে মূল জমিতে লাগানো হয়। চারা লাগানোর ৬০ থেকে ৬৫ দিন পর ফুল আসে মানে অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে। ফুল আসার ১৫ থেকে ২০ দিন পর ফল তোলার মতো পরিপক্ব হয়। ফলগুলো অনেক দিন পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন থাকে। অবশ্য ২ বছরের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়ে যায়। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পানিফল পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে।
পানিফলের আবাদ কৌশল
মোট জীবনকালের ৭ থেকে ৮ মাস মেয়াদি এ ফলটির পরিপক্ব বীজ রোপণ করতে হয় জ্যৈষ্ঠ মাসে। অল্প খরচে পানিতেই এ ফলের চাষ করা যায়। ১ থেকে দেড় ফুট পানি থাকাকালীন পুকুর বা বিলে কৃষক পানি ফলের চারা রোপণ করেন। এক চারা থেকে আরেক চারা দূরত্ব ১ থেকে দেড় হাত। লাগানো বা রোপণের সময়ের ওপর দূরত্ব কম বেশি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পানিফল জমির যেটুকু থেকে চারা তৈরি করা হবে সেটুকু পানিফল গাছ না তুলে রেখে দেয়া হয়। পরে পরিপক্ব ফল গাছ থেকে ফল ঝরে মাটিতে পড়ে। ওখান থেকে চারা হয়। নতুন একটি চারা থেকে অনেক চারা হয়। মে জুন মাসে বৃষ্টি শুরু হলে চারা লাগানো হয়। ফুল আসে লাগানোর ৬০ থেকে ৬৫ দিন পরে ফুল আসে। ফুল আসার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ফল তোলার মতো পরিপক্ব হয়। একটি গাছে ৫০-৭০টি ফল হয়। চার লাগানোর আগে শুকনা মাটিকে বা পানিযুক্ত মাটিতে এমওপি, ডিএপি, টিএসপি, জিপসাম সার দেয়া হয়। তবে সারের মাত্রা সব জায়গায় একরকম না। কেননা কৃষক নিজেদের বুদ্ধি আর বিবেচনায় সারের মাত্রা নির্ধারণ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষি অফিসের সহায়তা নিয়ে সারের মাত্রা নির্ধারণ করেন। কেউ কেউ জৈবসারও ব্যবহার করেন। ফল চাষ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে। ফল কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ব হলে কালো রঙ ধারণ করে।
ময়লা কলুষিত পানি পরিশোধের ক্ষমতা রয়েছে পানিফল গাছের। সে কারণে অনেকে নোংরা স্বল্প গভীর জলাশয় যেখানে মাছ চাষ করা যায় না এমন পরিত্যক্ত জায়গায় পানিফলের গাছ লাগিয়ে পানি পরিষ্কার করে পরের বছর তাতে মাছের চাষ করেন। পানি ফলের আদি বাসস্থান সম্ভবত এ উপমহাদেশে। কেউ কেউ মনে করেন আদি নিবাস ভারতবর্ষ। উত্তর আমেরিকাতে ১৮৭৪ সালে পানিফল প্রবর্তন ও চাষ শুরু করা হয় বলে জানা গেছে। এ দেশের নিচু এলাকার জলাশয়গুলোতে জন্মে থাকে। বীজ থেকে পানি ফলের গাছ জন্মে। সাধারণত পাকা ফলের বীজ প্রথম ২ বছরের মধ্যেই গজিয়ে যায়। পানিফলে সাধারণত তেমন কোনো রোগ পোকা দেখা যায় না। তবে কোনো কোনো সময় পানিবাহিত রোগ বা পাতা খাদক পোকা সমস্যা সৃষ্টি করে, আবাদ উৎপাদনের কিছুটা ক্ষতি করে। সে ক্ষেত্রে কৃষক কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেন এবং সমস্যা উতরিয়ে যান পানিফলকে বালাইয়ের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন।
পানিফলের আয়-ব্যয়
পানিফল বর্ষজীবী ফসল। মোটামুটি আবাদের ৪ থেকে ৫ মাস থেকেই ফল তোলা শুরু হয়। চলে ১ বছর পর্যন্ত। পতিত জলমগ্ন জমিতে পানিফল চাষ হয়। প্রতি বিঘায় ২ থেকে আড়াই মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতি হেক্টরে ১৮ থেকে ২০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন হয়। জলাশয়ে পানিফলের চাষাবাদ প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা থেকে আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। মণ পাইকারি পানিফলের মূল্য ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মানে প্রতি কেজি পানিফল বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকায়। তবে শুরুতে এ ফল ১ হাজার ২০০ টাকা মণ হিসাবে পাইকারি বিক্রয় হয়, যা খুচরা বাজারে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের সব জেলায় পানিফলের চাষাবাদ হয় না। তাই মানুষ এটি কম চেনে। কিন্তু সম্প্রতি সাতক্ষীরা থেকে এ ফল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। সুস্বাদু এ ফলটি এখন জেলার কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা সদর ও কলারোয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ হচ্ছে। এ ফল চাষে অনেক বেকার শ্রমিকেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। অধিক লাভ হওয়ায় দিন দিন এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে এক দিকে কৃষক লাভবান হচ্ছে, অপরদিকে বেকারত্বও দূর হচ্ছে। সবচেয়ে বড়কথা অল্প পুঁজিতে কম দামে বেশি ফলন লাভ এমন ফসল খুব কম আছে।
৭ থেকে ৮ মাস মেয়াদি এ ফলের বীজ রোপণ করতে হয় জ্যৈষ্ঠ মাসে। অল্প খরচে স্বল্প পানিতেই এ ফল চাষ করা যায়। এক থেকে দেড় ফুট পানি থাকাকালীন পুকুর বা বিলে কৃষক বীজ বপন করেন। ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই পানিফল গাছে ধরে। আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত এ ফল বিক্রি করেন।
আষাঢ় মাসের বৃষ্টির পানিতে জলাশয়গুলো ভরে উঠলে পানি ফলের চারা ছেড়ে দেয়া হয়। ক্রমেই বাড়তে থাকে চারা গাছের সংখ্যা। পানির নিচের দিকে যেতে থাকে শিকড়গুলো। অল্পদিনের মধ্যেই গাছে-গাছে লতায় পাতায় ভরে যায় জলাশয়। পাতার কারণে তিল ফেলার জায়গা থাকে না। উৎপাদন খরচ একেবারেই কম। ভাদ্র মাস থেকে গাছে ফল আসা শুরু করে এবং পরিপক্ব হয়ে আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফল বিক্রি শুরু হয়। চলে অনেক দিন। প্রতি সপ্তাহে ফল তোলা হয়। প্রতি একর জমিতে পানিফল চাষ করে খরচ বাদে লক্ষাধিক টাকা আয় করা যায়। এতে মাছ চাষে কোনো সমস্যা হয় না। অনেকেই পানি ফল চাষ করে লাভবান হওয়ায় এলাকার পুকুর জলাশয়ের মালিকরা পানি ফল চাষের গ্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তাছাড়া পানিফলে পোকামাকড় আর রোগের আক্রমণ নেই বলে উৎপাদন খরচ একবারে কম, মানে লাভ বেশি পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরাসহ বেশ কিছু জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে পানিফল। জেলার জলাবদ্ধ এলাকার চাষি পানিফল চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ ফলের চাষ। লাভ বেশি হওয়ায় পানিফল চাষে আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের চাষি। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত ফলটি এখন জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বাংলাদেশে এ ফলটিকে পানিফল বা পানি শিংড়া বললেও এর মূল নাম বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছর দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ফসল চাষের অনুপোযুক্ত এসব জলাবদ্ধ জমিতে পানিফল চাষ করে সফল হয়েছেন অনেক চাষি।
সিঙ্গারা ফল
অনেক আবার পানি ফলের সাথে সিঙ্গারা ফলকে গুলিয়ে ফেলেন। সে জন্য সিঙ্গারা ফলের ও কিছু বর্ণনা দিয়ে দিলাম একই সাথে। সিঙ্গাড়া ফল উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম : Trapa natans; পরিবার Trapacae| সিঙ্গাড়া ফল খুব শক্ত, বাদামি রঙের শক্ত সে খোসার মধ্যে থাকে নাট বা বাদামের মতো শাঁস। দা দিয়ে জোর করে কাটতে হয়। এজন্য প্রজাতির নাম Trapa natans রাখা যায়। ইংরেজি নাম Water caltrop সিঙ্গাড়ার মতো গড়ন বলে এ ফলের নাম সিঙ্গাড়া ফল। তবে এটিও এক ধরনের পানিফল। সচরাচর আমরা যে পানিফল দেখি তার শাঁস ও খোসা নরম, কাঁটা থাকে দুই দিকে দুইটি। আর সিঙ্গাড়া ফলের শাঁস ও খোসা শক্ত, কাঠের মতো, কাঁটা থাকে চারটি। কাঁটাগুলো সরু, শক্ত বেশ তীক্ষ্ন। চারটি কাঁটা থাকায় সম্ভবত সিঙ্গাড়া ফলের আগের প্রজাতি নাম ছিল Trapa quadrispinosa সিঙ্গাড়া ফলের গাছ ভাসমান বর্ষজীবী জলজ প্রকৃতির। পাতা ত্রিভূজাকৃতির, গাঢ় সবুজ। শিকড় ও কন্দ থাকে প্যাক বা কাদার মধ্যে, কাণ্ড থাকে পানিতে আর পাতা, ফুল ও ফল পানির উপর ভেসে থাকে। ফলের আকার অনেকটা ত্রিভূজাকার, প্রিজমের মতো, শক্ত। কেটে ভেতরের সাদা শাঁস খাওয়া যায়। শাঁস স্বাদে পানসে মিষ্টি, কিন্তু চিবিয়ে খেতে মজা লাগে। কোথাও কোথাও পাকা ফলের শাঁস আলুর মতো রান্না করে খাওয়ারও প্রচলন আছে। এমনকি শাঁস শুকিয়ে গুঁড়া করে রেখে পরে খাওয়া যায়। কাঁচা ফল প্রস্রাব ও রুচি বৃদ্ধিকারক, বলবর্ধক। সিঙ্গাড়া ফলের দেখা মিলেছে পাবনার বিল কুরারিয়ায়। সুনামগঞ্জের হাওরেও আছে।
পানি ফলটি দেশব্যাপী খুব বেশি পরিচিত নয়। অনেকে হয়তো এখনও চিনেনই না। পানিফল পুষ্টি সমৃদ্ধ, ভেষজগুণ সম্পন্ন সহজ সরল কৌশলে উৎপাদিত দামি ফল। আবাদের খরচ নেই বললেই চলে। লাভ হয় অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা যেসব জমিতে অন্যান্য ফসল আবাদ করা যায় না সেখানে অনায়াসে পানিফল আবাদ করা যায়। পতিত জমি আবাদের আওতায় এনে লাভবান হওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পানিফলটি আমাদের কৃষি উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। তবে এক্ষেত্রে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহার এসবের ওপর ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার, সার ব্যবস্থাপনা, বালাই ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ পরামর্শ ও অনুমোদন দরকার। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর বিনিয়োগে পানিফল দিয়ে আমার আরও অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারব কৃষি ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ subornoml@gmail.com
চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও কৃষির প্রতি মোহ থেকে অবসর নিতে পারিনি। সময় পেলেই নতুন কৃষি, বিশেষ কৃষি এবং ঐতিহ্যবাহীর কৃষিকে জানার আগ্রহ এখনও কমেনি। এ মানসিকতাকে ধারণ করে লালন করে পথ চলছি। কয়দিন আগে উত্তরবঙ্গ ঘুরে এলাম। সেখানকার কৃষি সংশ্লিষ্ট মানুষ বেশ সহযোগিতা করেছিল। সেখানে কৃষির এত অফুরন্ত ভাণ্ডার আর বিশেষত্ব আছে এতদিন আমার অজানা ছিল। বেশ কয়দিন সেখানে সংশয় কাটিয়ে এতটুকু শুধু বলতে পারি একটু সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে উত্তরবঙ্গের কৃষি আমাদের টোটাল কৃষিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। উত্তরবঙ্গের কৃষির সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরলাম কৃষির বৃহত্তর স্বার্থে।
প্রাচীন সূর্যপুরী আম : ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারী বর্ডার গ্রাম। ওপারে ভারতের বিহার রাজ্য। দুই বিঘে জমিজুড়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন সূর্যপুরী আম গাছ। কৌতুহলী হয়েই গাছটি দেখতে যাওয়া। জুনের ১ম সপ্তাহ ২০১৬। প্রতিটি মগডালে পরিপক্ব আম। পাহাড় সদৃশ দৈত্যাকার গাছের ডালে ডালে আম আর আম। আমের আকার-আকৃতি কম বেশি একই রকম। প্রতিটি আম ১৫০-২০০ গ্রাম হতে পারে মনে হলো। গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া প্রকা- ডালগুলো কিছু দূর গিয়ে আনুভূমিক হয়ে (Horizontall) অনেক জায়গাজুড়ে মাটিতে শায়িত থেকে পুনরায় মাথা উঁচু করে নতুন নতুন শাখাপ্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, গাছটির বয়স আনুমানিক ২০০ বছর। প্রাচীন সূর্যপুরী আমগুলো জুনের শেষ দিকে পাকবে। অতি মিষ্টি স্বাদের আমটিতে কোনো আঁশ নেই, আঁটি পাতলা। সাইজ মাঝারি ছোট হওয়ায় রপ্তানিযোগ্য। হরিণমারী আসা যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সূর্যপুরীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। আমটির আরও একটি বিশেষ গুণ হলো প্রতি বছর ফল ধরে। ‘অলটারনেট বিয়ারিং’ চরিত্রের নয় যাতে এক বছর ফল ধরার পরের বছরে ফল কম অথবা না ধরার রীতি। গাছের মালিকের সাক্ষাৎ পাইনি। বর্তমান মালিক মো. সাইদুর রহমানের টিভি সাক্ষাৎকারে শুনেছি গাছটিতে প্রতি বছর ১৫০-২০০ মণ আম হয়। বাগান পরিচর্যা তথা পাহারার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের নিকট থেকে জানা গেল ফলগুলো নিলামে বিক্রি হয়। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী আসেন গাছটি দেখতে। পদস্থ কর্মকর্তা, মিডিয়াম্যান, আমচাষিসহ উৎসুক লোকের ভিড় লেগেই থাকে। প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। তাতেও দর্শনার্থীর কমতি নেই। প্রবেশ পথে টিনের ঘেরা দেয়া। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তারা জানালেন স্থানীয় নার্সারিগুলোতে সূর্যপুরী আমের কলম পাওয়া যায়। ব্যাপক আবাদ হয় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলায়। দেশের প্রধান প্রধান আম উৎপাদনকারী অঞ্চল তথা সারা দেশে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে ফলের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হতে পারে। যেহেতু ফলটি উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় জাত এবং প্রতি বছর অধিক ফলন পাওয়া যাচ্ছে, সর্বোপরি রপ্তানিযোগ্য, তাই এর ব্যাপক বংশবিস্তারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক চাষাবাদের সুযোগ রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নীতিনির্ধারণীমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারে। পাশাপাশি ফল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। গুটিকলমের মাধ্যমে বর্তমান চাহিদা পূরণ হচ্ছে। সারা দেশে ব্যাপক বিস্তৃতির প্রয়োজনে সম্ভাব্যতা যাচাই সাপেক্ষে মাতৃগাছ থেকে টিস্যু কালচার করে অফুরন্ত চারা সরবরাহ করা যেতে পারে।
খাসিয়া কমলা, মাল্টা : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কমলা প্রজেক্ট পঞ্চগড় এলাকায় ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া এরই মধ্যে এ নিয়ে অনেক প্রতিবেদন লিখেছে, এবং সম্প্রচার করেছে। জুলাই ২০১৬ এর শেষ সপ্তাহে প্রকল্প এলাকার একটি বাগান দেখার সুযোগ হলো। সদর উপজেলার হাঁড়িভাষা ইউনিয়নের একটি বাগান পরিদর্শনের সুযোগে চাষি হাবিব-উন-নবী ২০০৯ সালে বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। পূর্ণ সফলতা পেতে ৬-৭ বছর সময় লেগেছে। কমলা আর মাল্টার প্রতিটি গাছ এখন ফলে ভরা। বসতঘরের পাশের একটি মাল্টা গাছে বার মাস ফল হয়। পাকা ফল ছিঁড়ে এনে খাওয়ালেন। বেশ মিষ্টি স্বাদের ফল। ছায়াবৃক্ষ হিসেবে মেহগনি, সুপারি, সুপারি গাছে খাসিয় পান বেশ লাগছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তিনি আজ সফলতার শীর্ষে। সস্ত্রীক বাগান পরিচর্য়া করছেন। বাংলাদেশের কমলা বলতে এক সময় সিলেটের ছাতকের কমলাকেই বোঝাত। যা চাহিদার তুলনায় ছিল খুবই অপ্রতুল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কমলা প্রজেক্ট খ্যাত বিশেষ কর্মসূচির ব্যাপক সফলতার ফলে সাইট্টাস গোত্রের কমলা ও মাল্টা আজ আমাদের দেশি ফলের মর্যাদা লাভ করেছে। সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় যেমনটি দেখা যায় ঠিক অবিকল ফলন দেখা গেল পঞ্চগড়ের বাগানটিতে। অধিক বিনিয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদের ফসল বিধায় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কৃষক ছাড়া কমলা-মাল্টা চাষ সম্ভব নয়। লাভের মুখ দেখতে ৫-৬ বছর সময় লাগছে। কমলা-মাল্টা বাগানে সাথী ফসল হিসেবে পেঁপে, সিডলেস লেবু, বড় এলাচ, ছোট আকৃতির চায়না কমলা আর মরিচ দেখা গেল। আগামী অক্টাবর থেকে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করে মালচিং করার পরামর্শ দেয়া হয়। যেহেতু পঞ্চগড় জেলায় খাসিয়া জাতের কমলা, মাল্টার সফল আবাদ সম্ভব হয়েছে, তাই পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে আবাদ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
লটকনের ২য় রাজধানী পঞ্চগড় : জনপ্রিয় লটকন ফলটি নরসিংদী জেলার একক ফসল হিসেবেই পরিচিত। টকমিষ্টি স্বাদের এ ফলটি এরই মধ্যে রফতানিযোগ্য ফলের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কমলা বাগানের অপর সেডট্টি (ছায়া বৃক্ষ) লটকনের ফলভরা গাছ দেখে আমি নিজেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রই। গাছ থেকে ছিঁড়ে এনে সদ্য পাকা ফল খাইয়ে চাষি দম্পতি গর্ব করেই বললেন আমাদের লটকন সেরা। সদ্য পাকা ফল বেশ মিষ্টি লাগল। এ অঞ্চলে লটকনের বাণিজ্যিক আবাদ হয় এটা জানাই ছিল না। ফলন প্রচুর, গাছ ভরা ফল। আকারে বড়-ছোট মিলিয়ে যেন মালা গেঁথে রয়েছে। বাণিজ্যিক আবাদের বিষয়ে পরে স্থানীয় ফল বাজারে এসে তার প্রমাণ মিলল। সূর্যপুরী আম আর লটকনে বাজার ছেয়ে গেছে।
কৃষিবিদ নিখিল চন্দ্র শীল*
*উপপরিচালক (অব.), ডিএই, নারায়ণগঞ্জ; নিউ আজিম ভিলা, ১৮ খানপুর মেইন রোড, নারায়ণগঞ্জ; ০১৭১৮১৭৭৯৮৬
বর্তমানে পোলট্রি শিল্প বেশ জমজমাট। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের কেন্দ্রস্থল কোথাও এর সমাদরের কমতি নেই। এমনকি বড় বড় অট্টালিকার ছাদেও গড়ে ওঠেছে জীবন্ত এ শিল্প; যা থেকে পূরণ হচ্ছে দেশের পুষ্টি, বিশেষ করে আমিষের চাহিদা। পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্বের এক বিরাট অংশ। আর এ লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য খামারে চাই সুস্থ এবং উৎপাদনশীল মুরগি। তাই ভালো ডিম দেয়া মুরগি চেনা, এর আচরণ ও অন্য লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। মুরগির দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং এর আচরণের ওপর শরীরের অবস্থা উপলব্দি করা যায়। সুস্থ এবং উৎপাদনশীল মুরগি কীভাবে চেনা যায় তা একেক করে এবার জেনে নেয়া যাক।
মাথার অংশ : বেশি ডিম দেয়া মুরগির মাথা হবে ছোট, হালকা এবং মাংশল অংশ থাকবে কম। মাথার ঝুঁটি ও গলার ফুল হবে উজ্জ্বল লাল রঙ কিংবা গোলাপি বর্ণের। তবে এগুলো অবশ্যই নরম, সুগঠিত ও প্রস্ফুটিত হবে।
চোখ, নাক ও মুখ : পাখির চোখের বর্ণ হবে উজ্জ্বল। চোখ সব সময় সতর্ক থাকবে। নাক ও মুখ থাকবে শ্লেষ্মাহীন পরিষ্কার। নাক দিয়ে সর্দিঝরা কিংবা গলার ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হবে না।
দেহ বা শরীর : মুরগির দেহ সুগঠিত হবে। পরিমাণমতো খাদ্য এবং পানি পান করবে, যে কারণে খাদ্য থলিতে খাবারে ভর্তি থাকবে। পেটে ডিম অনুভব হলে অবশ্যই ওজনে ভারি হবে। এ ধরনের মুরগির পিঠ হয় লম্বা ও প্রশস্ত। শরীরের কোনো অংশে খুঁত, অপূর্ণতা অথবা বিকলাঙ্গ হবে না।
পালক : সুস্থ অবস্থায় মুরগির পালক উজ্জ্বল ও সুবিন্যস্ত থাকে। এ ধরনের মুরগি সাধারণত মার্চ মাসের দিকে পালক পাল্টায়। তবে মাথার উপরিভাগের পালক শূন্য হয়ে টাকের সৃষ্টি হয়।
বয়স : মুরগির বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিম উৎপাদনের হার তুলনামূলকভাবে কমে যায়। সাধারণত ৫৬০ দিন বয়স পর্যন্ত মুরগি মোট উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ডিম দেয়। তাই বয়স্ক মুরগি খাবারের জন্য বিক্রি করে খামারে নতুন মুরগি তোলা উচিত।
চঞ্চল ও সতর্কতা : স্বাস্থ্যবান মুরগি সব সময় চঞ্চল থকে এবং খাবার খুঁজতে ব্যস্ত মনে হয়। হঠাৎ কোনো শব্দ হলে অথবা শত্রুর উপস্থিত বুঝতে পারলে মুখে এক ধরনের শব্দ করে স্বজাতিকে সতর্ক করে দেয়। কেউ ধরতে গেলে দৌড়ে পালায়।
পা : সুস্থ মুরগির পা থাকবে সুন্দর ও সুগঠিত। মুরগির পা’র মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাহাঁটি করবে।
মলদ্বার এবং পাছার হাড় : ডিম পাড়া মুরগির মালদ্বার হবে প্রশস্ত ও ডিম্বাকৃতি। পরীক্ষা করলে সেখানে আর্দ্র ও রক্তাভ দেখাবে। মলদ্বারের উভয় পাশে হাত দিলে পাছার হাড় অনুভব করা যায়। উৎপাদনশীল মুরগির দুই হাড়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে দুই ইঞ্চি।
তলপেট : মুরগির তলপেটে হাত দিয়ে বুঝা যাবে এর ডিম ধারণের ক্ষমতা। ডিম দেয়া অবস্থায় তলপেট প্রশস্ত ও নরম থাকে । মুরগি ডিম পাড়া অবস্থায় বুকের হাড়ের নি¤œভাগ এবং পাছার উভয় হাড়ের মাথা পর্যন্ত দূরত্ব হবে দুই ইঞ্চি। মুরগির তলপেটে মেদ থাকবে না এবং চাপ দিলে পেটের ভেতর ডিম অনুভব হবে।
চামড়া : উৎপাদনশীল মুরগির চামড়ার নিচে কোনো মেদ জমা থাকবে না। চামড়া হবে পাতলা ও নরম।
দাঁড়ানোর ভঙ্গি : সুস্থ অবস্থায় মুরগির দাঁড়ানোর ভঙ্গি স্বাভাবিক থাকে। পাখি দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে।
রঙ পরিবর্তন : ডিম পাড়ার সাথে সাথে মলদ্বার, ঠোঁট, ঝুঁটি, গলার ফুল ও পায়ের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করে। রঙ পরিবর্তন শেষ হলে বুঝতে হবে ডিম পাড়ার সময় শেষ।
ব্যবহার ও আচরণ : উৎপাদনশীল মুরগির আচরণ হবে ভদ্র, চঞ্চল ও সতর্ক। ডিম পাড়ার সময় বাসায় ঢুকবে, কোনো সময় অলস বসে থাকবে না। ডিম পাড়া মুরগির পিঠে হাত রাখলে সহজেই বসে পড়বে। সুস্থ এবং উৎপাদনশীল মুরগি চিহ্নিত করে তবেই পালন করা উচিত। এতে একদিকে যেমন রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা কম থাকবে, তেমনি খামারি হবে লাভবান।
লিটার শব্দের অর্থ পশুপাখির বিছানা। ঘরের মেঝেতে মোরগ-মুরগির মলমূত্র লেপ্টে যেন না যায় সেজন্য কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, ছাই এসব দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিছানা তৈরি করা হয়। এ ধরনের বিছানাকে বলে লিটার। লিটার পুরু করে দিলে তাকে বলে ডিপ লিটার। লিটারে ব্রয়লার আর ডিপ লিটারে লেয়ার মুরগি পালন করা উত্তম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মুরগি খামারিদের প্রতিদিন ঘর পরিষ্কারে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এসব ঝামেলা এড়াতে তখন তারা ঘরের মেঝেতে পুরু করে খড় বিছিয়ে রাখত। ওই সময় থেকেই ডিপ লিটার পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা বিরাজমান।
লিটার-ডিপ লিটারের ঘর : ঘরটি হতে হবে বেশ খোলামেলা। ঘর অবশ্যই পূর্ব-পশ্চিম দিক লম্বালম্বি করে তৈরি করতে হবে; যেন সূর্যের কিরণ সরাসরি মুরগির ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। পাশাপাশি বাতাস ঘরের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘরে মেঝে পাকা হলে ভালো হয়। পরিমিত আলো বাতাস পাওয়ার জন্য ২ থেকে ২.৫ ফুট পাকা দেয়াল কিংবা বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরির করে এর ওপর ২.৫ থেকে ৩ ফুট বাঁশের চটি দিয়ে জালের মতো বেড়া দিতে হবে। মেঝেতে প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য জায়গা প্রয়োজন শীতকালে ১ বর্গফুট গ্রীষ্মে দেড় বর্গফুট এবং লেয়ারের জন্য উভয় ঋতুতে ২ বর্গফুট করে। তবে মুরগির বয়স ও আকার ভেদে জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। ঘরে মুরগি দেয়ার ৩ থেকে ৪ দিন আগে লিটার সাজাতে হয়। ঘর শুকিয়ে লিটারের জন্য ২ ইঞ্চি এবং ডিপ লিটার হলে ৬ ইঞ্চি পুরু করে উপকরণগেুলো বিছাতে হবে।
খাদ্য সরবরাহ : স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মুরগিকে দৈনিক দুইবার বিশুদ্ধ পানিসহ পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। প্রতি ২৫টি মুরগির ক্ষেত্রে একটি করে গোলাকার খাবার পাত্র এবং ৫০টি মুরগির জন্য একটি গোলাকার পানির পাত্র দরকার। ডিম পাড়া মুরগির বেলায় যে পরিমাণ খাবার প্রযোজ্য তা হচ্ছে ১৬ শতাংশ আমিষ, ৮ শতাংশ আঁশ, ৭ শতাংশ ঝিনুক চূর্ণ, ২ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি ও পরিমাণমতো ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার।
আলো-তাপ ব্যবস্থাপনা : মুরগি পালনে কৃত্রিম আলো গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার জন্য ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত তাপের ব্যবস্থা করতে হয়। তাপের পরিমাণ বাচ্চার বয়সের ওপর নির্ভর করে। বয়স যতো বাড়বে তাপের পরিমাণ ততো কমবে। ডিমপাড়া মুরগির জন্য ঘরে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা করে আলো প্রয়োজন। আলো এমন করে ঝুলাতে নেই যেন বাতাসে দোলে। কারণ এতে মুরগি ভয় পেতে পারে। হলুদ কিংবা লাল আলোতে ডিম উৎপাদন বেশি হয়। ঘরে কখনই উজ্জ্বল আলো দেয়া যাবে না। এতে পরস্পরের মধ্যে ঠোকাঠুকির অভ্যাস জন্মাতে পারে।
পরিচর্যা : মুরগির ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা বাধ্যতামূলক। সেই সাথে সব সরঞ্জাম রাখতে হবে জীবাণুমুক্ত। লিটারকে শুকনো রাখতে প্রতিদিন একবার করে উপরের মলমূত্র নড়াচড়া করতে হবে। ডিপ লিটারে সপ্তাহে একবার কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে উল্টেপাল্টে দিলে বর্জ্যগুলো মিশে যাবে। মাঝে মধ্যে চুন ব্যবহার করলে ভালো হয়। লিটার যাতে স্যাঁতসেঁতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়।
রোগবালাই প্রতিরোধ : মোরগ-মুরগি রোগাক্রান্ত হলে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া উত্তম। নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। যারা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তারাই কেবল জীবাণুমুক্ত হয়ে মুরগির ঘরে প্রবেশ করবে। রোগ-জীবাণু ছড়ায় এমন প্রাণী বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, ইঁদুর এরা যেন খামারে ঢুকতে না পারে সেদিক অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে রোগ হওয়ার আগেই নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। প্রতিদিন পর্যবেক্ষণের সময় কোনো মুরগি যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে দেরি না করে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুরগি মারা গেলে অবশ্যই মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। অসুস্থ মুরগিকে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
পালন সুবিধা : লিটারে মুরগি পালনে সুবিধা অনেক। মুরগির পায়খানার সঙ্গে মিশ্রিত মূত্র লিটারে শুষে নেয়। ফলে ঘর থাকে শুকনো এবং দুর্গন্ধমুক্ত। এতে মুরগি আরাম অনুভব করে। শীতকালে শীত থেকে রক্ষা করে এবং গ্রীষ্মেও পায় স্বস্তি। এছাড়া মাছির উপদ্রব কম হয়। খাঁচায় পালন পদ্ধতিতে তারের সঙ্গে অনবরত ঘর্ষণের ফলে মুরগির পায়ের নিচে ফুলে যায় এবং পরে ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু লিটার পদ্ধতিতে এ রকম হওয়ার আশঙ্কা নেই। ডিপ লিটার প্রতিদিন পরিষ্কারের প্রয়োজন হয় না। লিটার প্রক্রিয়াজাত করে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরি করা যায়। অকেজো ডিপ লিটার দিয়ে জমির জৈবসার এবং মাছের খাদ্য তৈরি হয়। মুরগির ঘরের মধ্যে লিটার ব্যবহার করলে এক ধরনের পোকা, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। লিটারের কার্যকারিতায় এসব মারা যায় এবং পুনরায় জন্মে। এভাবে লিটারে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মুরগি পা দিয়ে লিটার আঁচড়ায়, উল্টেপাল্টে গোসল করে এবং লিটারে জন্মানো খাদ্য কুঁড়িয়ে খায়। এতে মুরগির স্বাস্থ্য থাকে ভালো। আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালনে লিটার পদ্ধতি শ্রেয়। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ পড়ে কম, অন্যদিকে এসব উপকরণ পাওয়া যায় হাতের কাছে।
নাহিদ বিন রফিক*
*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল, ০১৭১৫৪৫২০২৬
আমাদের দেশে ভুট্টা বা কর্ন অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি খাবার। ভুট্টার মোচা পুড়িয়ে খাবার প্রচলন চলে আসছে বহুকাল ধরেই। আধুনিক জীবনেও ভুট্টা তার নিজ গুণে ঠাঁই করে নিয়েছে নানা রূপে নানা স্বাদে। ভুট্টার খই বা পপকর্ন কখনও খায়নি অথবা খেয়ে পছন্দ করেনি এমন মানুষ আজকাল আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ক্লান্তিকর দীর্ঘ পথচলা কিংবা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার একঘেয়ে সময়গুলোকে কিছুটা বৈচিত্র্যময় করতে পপকর্ন ভালো সঙ্গী। বাচ্চাদের কাছে তো এটা সবসময়ই প্রিয়। আর সকালের নাশতায় কর্নফ্লেক্স সব ঋতুতে সব জায়গায় সব বয়সীদের জন্য উপযোগী। এছাড়াও ভুট্টা থেকে তৈরি হতে পারে নানা রকম রুটি, খিচুরি, ফিরনি, নাড়–সহ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর বিভিন্ন খাবার। মজাদার চাইনিজ খাবার তৈরিতে অপিহার্য কর্নফ্লাওয়ার ভুট্টারই অবদান। ভুট্টা যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকর। এতে রয়েছে ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে যার জুড়ি নেই। রক্তস্বল্পতা দূর করতে প্রয়োজনীয় আয়রন ও ভিটামিন বি ১২ এর ভালো উৎস ভুট্টা। ভুট্টার ভিটামিন এ সি ও লাইকোপিন ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধী ফাইবার এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে, রয়েছে কার্বোহাইড্রেট যা শরীরে শক্তি জোগায়। ভুট্টা ডায়াবেটিস ও রক্তের উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, আমাদের হৃৎপি- ও কিডনির সুরক্ষা করে। চমৎকার স্বাদ আর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এ খাবারটি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সারা বছর ধরেই জন্মানো সম্ভব। এর ফলনও হয় অনেক বেশি। মানুষের খাবার শুধু নয় ভুট্টা গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি কিংবা মাছের খাবার হিসেবেও উৎকৃষ্ট বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত। হাঁস-মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ভুট্টার ভাঙা দানা ও গাছ অতুলনীয়। জ্বালানি হিসেবেও ভুট্টা গাছ ব্যবহার করা যায়। ভুট্টার চাহিদা তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে- বাড়ছে জমিতে ভুট্টা উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের কৃষি জমিতে খাদ্য শস্য হিসেবে ধান ও গমের পরের জায়গাটি এখন ভুট্টার দখলে। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অল্প জমি থেকে অধিক ফলন এখন সময়ের দাবি। এ দাবি পূরণে সময় এসেছে ভুট্টা চাষে বাড়তি নজর দেয়ার।
জাত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এ পর্যন্ত ভুট্টার বেশ কিছু উন্নত জাত ও হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হলো শুভ্রা, বর্ণালী, মোহর, খই ভুট্টা, বারি ভুট্টা-৫, বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি টপ ক্রস হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১, বারি বেবি কর্ন-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩।
ফসলের নাম |
উৎপাদনের পরিমাণ(লাখ মেট্রিক টন) |
|||||
২০১০-১১ অথবছর |
২০১১-১২ অথবছর |
২০১২-১৩ অথবছর |
২০১৩-১৪ অথবছর |
২০১৪-১৫ অথবছর |
২০১৫-১৬ অথবছর |
|
ধান(চাল) |
৩৩৫.৪১ |
৩৩৮.৯ |
৩৩৮.৩৩ |
৩৪৩.৫৬ |
৩৪৭.১০ |
৩৪৯.৯৬ |
গম |
৯.৭২ |
৯.৯৫ |
১২.৫৫ |
১৩.০২ |
১৩.৪৮ |
১৩.৪৮ |
ভুট্টা |
১৫.৫২ |
১৯.৫৪ |
২১.৭৮ |
২৫.১৬ |
২৩.৬১ |
২৭.৫৯ |
পছন্দমতো জাত বেছে নিয়ে তা ভুট্টা চাষের উপযোগী জমিতে লাগাতে হবে। বেলে দো-অাঁশ ও দো-অাঁশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য ভালো। জমি এমন হতে হবে যেন পানি জমে না থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভুট্টা বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো রবি মৌসুমে মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং খরিফ মৌসুমে ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত।
বীজ বপনের হার ও দূরত্ব
শুভ্রা, বর্ণালী ও মোহর জাতের ভুট্টার জন্য হেক্টরপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি এবং খইভুট্টা জাতের জন্য ১৫ থেকে ২০ কেজি হারে বীজ প্রয়োজন হবে। ভুট্টার বীজ সারিতে বুনতে হয়। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেন্টিমিটার এবং সারিতে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ১টি অথবা ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে দুইটি গাছ রাখতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
ফসলের ভালো ফলনের জন্য সার ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। ভুট্টার ক¤েপাজিট জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে রবি মৌসুমে ১৭২ থেকে ৩১২ কেজি এবং খরিফ মৌসুমে ২১৬ থেকে ২৬৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। হাইব্রিড জাতের জন্য রবি মৌসুমে এ চাহিদা ৫০০ থেকে ৫৫০ কেজি। ক¤েপাজিট জাতের জন্য প্রতি হেক্টরে টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বোরিক এসিড ও গোবর সার প্রয়োজন রবি মৌসুমে যথাক্রমে ১৬৮ থেকে ২১৬ কেজি, ৯৬ থেকে ১৪৪ কেজি, ১৪৪ থেকে ১৬৮ কেজি, ১০ থেকে ১৫ কেজি, ৫ থেকে ৭ কেজি ও ৪ থেকে ৬ টন এবং খরিফ মৌসুমে যথাক্রমে ১৩২ থেকে ২১৬ কেজি, ৭২ থেকে ১২০ কেজি, ৯৬ থেকে ১৪৪ কেজি, ৭ থেকে ১২ কেজি, ৫ থেকে ৭ কেজি ও ৪ থেকে ৬ টন। হাইব্রিড জাতের জন্য রবি মৌসুমে প্রয়োজন ২৪০ থেকে ২৬০ কেজি টিএসপি, ১৮০ থেকে ২২০ কেজি এমওপি, ২৪০ থেকে ২৬০ কেজি জিপসাম, ১০ থেকে ১৫ কেজি জিংক সালফেট, ৫ থেকে ৭ কেজি বোরিক এসিড এবং ৪ থেকে ৬ টন গোবর সার। জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে মোট ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে জমি চাষ দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমান ২ ভাগ করে প্রথম কিস্তি বীজ গজানোর ২৫ থেকে ৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ গজানোর ৪০ থেকে ৫০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
সেচ
রবি মৌসুমে সেচ প্রয়োগ করলে ভুট্টার আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে। বীজ বপনের ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ, ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় সেচ, ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে তৃতীয় সেচ এবং ৮৫ থেকে ৮৯ দিনের মধ্যে চতুর্থ সেচ দেয়া যেতে পারে। ফুল ফোটা ও দানা বাঁধার সময় জমিতে পানি জমে থাকা ক্ষতিকর। চারা গজানোর ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা
ভুট্টায় সাধারণত যেসব রোগবালাইয়ের আক্রমণ দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বীজ পচা ও চারা গাছের রোগ। নানা রকম বীজ ও মাটিবাহিত ছত্রাকের কারণে এ রোগ হতে পারে। এ রোগ হলে ক্ষেতে ভুট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়। বর্ণালী ও মোহর জাত এ রোগ প্রতিরোধী। জমিতে পরিমিত রস ও তাপমাত্রায় (১৩ সেলসিয়াসের বেশি) বজায় রেখে এ রোগের প্রকোপ কমানো যায়। এছাড়াও সুস্থ সবল বীজ ব্যবহার এবং বীজ শোধন করে আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। বীজ শোধনের জন্য থিরাম বা ভিটাভেক্স (০.২৫%) ২.৫ থেকে ৩.০ গ্রাম/কেজি হারে মিশিয়ে নিতে হবে।
পাতা ঝলসানো রোগ ভুট্টার আরেকটি ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের নিচের দিকের পাতায় প্রথমে লম্বাটে ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে পাতা সময়ের আগেই শুকিয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত গাছ মরে যায়। মোহর জাতটি এ রোগ প্রতিরোধী। এ রোগের জীবাণু অনেক দিন বেঁচে থাকে এবং বাতাসের সাহায্যে তা ছড়ায় বলে ফসল সংগ্রহের পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। পুড়িয়ে ফেলতে পারলে ভালো হয়। রোগের আক্রমণ দেখা গেলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছত্রাকজনিত রোগ মোচা ও দানা পচা রোগ যা ভুট্টার ফলন কমায় সেই সাথে কমায় বীজের গুণাগুণ ও খাদ্যমান। মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা অপুষ্ট থাকে ও বিকৃত হয়ে যায় এবং সেখানে ছত্রাকের উপস্থিতি অনেক সময় খালি চোখেই দেখা যায়। গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত সময়টায় যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি থাকে তা হলে আক্রমণ বাড়ে। একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ বর্জন করতে হবে কারণ জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ বেড়ে যায় বলে এদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। পরিপক্ব ভুট্টা দ্রুত সংগ্রহ করে পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ভুট্টার কা- পচা রোগও বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক ঘটিয়ে থাকে। এতে কা- পচে গিয়ে গাছ ভেঙে পড়ে। ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে লাগিয়ে এবং নাইট্রোজেন ও পটাশ পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করে রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যায়। এছাড়াও ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেও সতর্ক হওয়া জরুরি। চারা অবস্থায় যদি কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দেয় তা হলে কীড়াগুলো মেরে ফেলতে হবে। ভোর বেলা কাটা গাছের গোড়া খুঁড়ে এদের মারা যায়। আরেকটা উপায় হচ্ছে সেচ দেয়া। তাহলে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা কীড়া মাটির ওপর আসে তখন পাখির সাহায্যে বা হাত দিয়ে মেরে এদের দমন করা যায়। কাটুই পোকার জন্য বালাইনাশক হিসেবে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ৫ মিলিলিটার ডারসবান/পাইরস ২০ ইসি মিশিয়ে চারা গাছের গোড়ায় স্প্রের করে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। শক্ত কাণ্ডে মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা দিলে মার্শাল ২০ ইসি বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানির সাথে ২ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে পাতা ও কাণ্ড ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ভুট্টা পুষ্ট ও পরিপক্ব হলে সংগ্রহ করতে হবে। মোচা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলে ভুট্টা সংগ্রহ করা যায়। ভুট্টার গড় ফলন হেক্টরপ্রতি কম্পোজিট জাতে গড়ে ৪ থেকে ৫.৫ মেট্রিক টন, হাইব্রিড জাতে ৮ থেকে ১১ মেট্রিক টন এবং খই ভুট্টার ফলন হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩ থেকে ৪ মেট্রিক টন। বীজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য মোচার মাঝামাঝি অংশ থেকে বড় ও পুষ্ট দানা বেছে নিতে হবে। যত্নে উৎপাদন করা এ ভুট্টাকে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে খুব যত্ন করে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করে সমৃদ্ধি আনতে আমাদের হয়তো আর খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
কৃষিবিদ উর্মি আহসান*
* উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
মাটির আবার কান্না! মাটি কি কাঁদতে পারে? কিভাবে কাঁদে? মাটি যদি কাঁদেই তার আওয়াজ শোনা যায় না কেন? বাস্তবতা হলো, সে কান্না সবাই শুনতে পাবেন না। এ কেবল একজন কৃষি বিজ্ঞানীই বুঝতে পারেন, কান্নার আওয়াজ তিনি সরাসরি শুনতে না পেলেও তা বুঝতে তার কোনো কষ্টই হয় না। প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র গাছের জীবন ও অনুভূতি নিয়ে গবেষণার মধ্য দিয়ে এবং যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। যে মাটি গাছের জন্ম, ধারণ, বন্ধন সব কিছুই সম্পাদন করে, সে মাটিরই তো জীবন, জীবন শক্তি উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ক্ষয়িষ্ণু নিয়েই একজন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীকে গভীরভাবে ভাবতে হয়। কারণ তার সব কর্মকা- তো আবর্তিত হয় এ মাটি যার মাটিতে ধারণকৃত সব জীবন্ত ফসল, লতাগুল্ম; ফলজ, ভেষজ, বনজ বৃক্ষরাজি নিয়েই। সবাই তা যথাযথভাবে বুঝতে না পারলেও কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটির দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আর্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। মাটির বুকে ধারণকৃত গাছে পরিস্ফুট হওয়া নানা ধরনের অস্বাভাবিক বিবর্ণতা অবলোকন করে কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটির নানাবিধ সমস্যাজনিত সৃষ্ট পরিবর্তনগুলো দেখে মাটির কষ্টের কারণগুলো চিহ্নিত করতে এবং প্রতিকার ব্যবস্থা বলে দিতে পারেন অনায়াসেই।
এখন তা হলে দেখা যাক, মাটির কষ্টজনিত বেদনার বহিঃপ্রকাশ কতভাবে হয়, কিভাবে হয় এবং কিভাবেই বা কৃষি বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা দেয়, অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং তা পরিমাপই বা করে কিভাবে? মাটির কান্না এবং তার বহিঃপ্রকাশের প্রকার প্রকৃতি উদ্ঘাটন করতে গেলে মাটির কষ্ট সৃষ্ঠকারী কারণগুলোর পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে নানা প্রজাতির ফসল ও গাছের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মতো পুষ্টি উপাদান প্রকৃতিই মাটিকে দিয়ে দিয়েছে। মাটির প্রকৃতি ভেঙে এসব উপাদানের তারতম্য অবশ্যই থাকবে। মানুষের দায়িত্ব বিজ্ঞানসম্মত কৃষি কর্মের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করা। কিন্তু মানুষ নিয়তই এ লক্ষ্য অর্জনের বিপরীতে ধাবমান হয়। তার লক্ষ্য একটিই এবং সেটি হলো যে কোনো উপায়ে মাটি থেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় আর্থিক সুবিধা অর্জন। এ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে চলমান আছে। প্রকৃত প্রদত্ত মাটির নানা পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি মাটিতে আরও থাকে অসংখ্য অনুজীব (সয়েল মাইক্রোবস) এবং মাটির জৈব উপদান (অরগ্যানিক ম্যাটার কনটেন্টে) থাকে।
এদেরকে মাটির মৌলিক জীবনশক্তির জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে আরও থাকে প্রয়োজনীয় সব মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। মানব দেহে যেমন ইলেট্রেলাইট ইমব্যালেন্স হলে জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি মাটির জৈব উপাদান, অনুজীবের সংখ্যা এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পরিমিত পরিমাণের নিচে নেমে গেলে মাটির উৎপাদনশীলতাও ক্রমান্বয়ে নি¤œমুখী হতে থাকে। আমাদের দেশের মাটির বর্তমান স্বাস্থ্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আছে। অনেকেই বলেন যে, আমাদের মাটি অত্যন্ত উর্বর। যে কোনো ফসল ও গাছ-গাছালি এ মাটিতে রোপণ করলে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে এবং ফলফলাদি দিতে থাকে। এ কথাটি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর বাস্তবসম্মত নয়। যে মাটি প্রতি বছর বন্যা প্লাবিত হয় সে মাটি ছাড়া অন্য সব মাটি এরই মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারা দেশের মাটির প্রায় ৭০ শতাংশতেই মাটির প্রধান জীবনী শক্তি জৈব উপাদানের পরিমাণ ১ শতাংশ বা তারও নিচে নেমে এসেছে, যা থাকা উচিত কম পক্ষে ২ শতাংশ ।
মাটি পরীক্ষায় মাটির জৈব উপাদান সংক্রান্ত এ তথ্য পাওয়া গেলেও বর্তমান ফসল উৎপাদান প্রক্রিয়া পরিচর্যা এবং চাষাবাদ পদ্ধতির আওতায় মাটিতে অবস্থানরত অনুজীবের পরিবর্তিত অবস্থা এবং মাটির মাইনোনিউট্রিয়েন্ট সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দেশের অধিকাংশ জমির মাটিতে এ দুটো উপাদানের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ করে নানা প্রকার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ক্রমবর্ধমান, চাহিদা মেটানোর জন্য এর ব্যবহার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে। অথচ বহু কৃষি বিজ্ঞানী একমত পোষণ করেন যে, মাটিতে পরিমিত পরিমাণ জৈব উপদান এবং অনুজীব থাকলে মাটিতে বহুমাত্রিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে এবং মাটিতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ভারসাম্য সংরক্ষিত হয়। মৃত্তিকা গবেষণায় এসব বিষয়াদি নিয়ে আরও সযতœ গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। মাটির মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি রাসায়নিক পর্দাথ দিয়ে পূরণ না ঘাটতি করে মাটির প্রাকৃতিক মাটইক্রোনিউট্রিয়েশনের সংরক্ষণ করা যায় সেই গবেষণা জোরদার করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মানব দেহে ‘ভিটামিন’ ও ‘মিনারালস’ যে কাজ করে মাটিতেও ‘মাইট্রোনিউট্রিয়েট’ একই কাজ করে। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও এ দেশের আবাদি জমি বিশেষ করে বন্যাপ্লাবিত হয় না এবং সেচ সুবিধার আওতায় ও আসেনি এমন সব জমিতে বছরে একটি ফসলের আবাদই হতো। তবে কোথাও কোথাও দুইটি ফসল যে হতো না তা নয়। আবাদি ফসল ওঠার পর জমিগুলো বিশ্রামেই থাকত। এ বিশ্রামের সময়টাতে মাটিতে বয়ে যাওয়া পুষ্টি উপদান এবং প্রকৃতি থেকে পাওয়া পুষ্টি উপাদান স্বযতেœ বুকে ধারণ করে মাটি স্বস্তিতেই কাটাতো।
কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটানোর তাগিদে পানি প্রিয় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের জন্য পানি সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প ছিল না। তাই পানি সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের সাথে সাথে সেচ সহজলভ্য এলাকায় একই জমিতে বিরতিহীনভাবে একের পর এক ধানের আবাদ চলতেই থাকে। ফলে এসব জমির মাটির নেই কোনো স্বস্তি, অধিকাংশ সময় বুকে ধারণ করে থাকতে হয় পানি। একই জমিতে একের পর এক ধানের আবাদ করাতে ধানের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ ও ক্রমাগত বেড়েই চলে। সাথে সাথে রাসায়নিক কীট ও বালাইনাশক দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিমাণও যায় বেড়ে। অধিকাংশ এসব রাসায়নিক বিষাক্ত দ্রব্যাদি ফসলের জমিতে ছিটিয়ে ব্যবহার করা হলেও অনেক দিন ধরেই দানাদার বালাইনাশক ফসলের ক্ষেত্রের মাটিতে সরাসরি ব্যবহার ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। এটাও সরাসরি সবারই জানা আছে যে, ধান গাছ কেবল ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি গভীর থেকে পুষ্টি উপাদান আহরণ করতে পারে। কারণ ধানের শিকড় এর চেয়ে গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে একই জমিতে ধানের আবাদ হতে থাকলে মাটির ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি নিচ দিয়ে একটি কঠিন পাললশীলার ( প্লাত্তপ্যাল) সৃষ্টি হয়, যা ভেদ করে মাটির পুষ্টি উপাদান উপরে উঠে আসতে পারে না, ফলে ধান গাছ তা নিজের পুষ্টির জন্য ব্যবহার করতে পারে না তাই ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে মাটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের বাড়াতে হয়।
মাটির বহু মাত্রিক যন্ত্রণার মাঝে একটি বিষয় যা আমাদের অনেক কৃষক ভাইরা মনে করেন যে, ধান লাগানোর আগে মাটি যত বেশি মসৃণভাবে কাদা করা যাবে ততই ধানের জন্য ভালো হবে কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। এতে ধানের ভালোর চেয়ে মন্দই হবে বেশি। কারণ এ অবস্থায় মাটির স্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মাটির বুকে ধান গাছের ধারণ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। সেচ সুবিধা পাওয়া অনেক জমিতে এমন অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্যও এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। একদিকে ধান কাটা হচ্ছে অন্যদিকে সাথে সাথে পেছন পেছন, আবার ধান লাগানোর জন্য কলের লাঙল (পাওয়ার টিলার) চলছে। আর ধানের নাড়াজলে জমি থেকে তুলে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য শুকাতে দিচেছ। এতে জমিকে কোনো অবসর না দিয়ে কালক্ষেপণ না করে একের পর এক আবাদের মাধ্যমে প্রচুর ধান পেয়ে অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে ৩ বেলা পেট ফাটিয়ে ভাত খাচ্ছেন এবং আনন্দ বোধ করছেন। অথচ যে মাটি থেকে এত ধান পাচ্ছেন সেই মাটি প্রতি নিয়ত নানাবিধ যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে ক্রমশ প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে মাটি এতটাই প্রাণহীন হয়ে পড়তে পারে যে তাকে আবার পুনর্জীবিত করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। কাজেই ভিশনসমৃদ্ধ যে কোনো কৃষি বিজ্ঞানী মাটির চলমান উদ্বেগজনক অবস্থা অবলোকন করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেই। সীমাহীন চাহিদায় উন্মুত্ত মানুষের আকাক্সক্ষা মেটাতে ফসলের ধারক বাহক মাটি কতটুকু ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে তা ভেবে দেখার অবকাশ মানুষের। তাই কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার আকুল আবেদন তারা যেন আর কালক্ষেপণ না করে মাটির হারানো প্রাণশক্তিকে ফিরিয়ে আনার, তাকে আরও সমৃদ্ধ করার এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল উদ্ভাবনে নিয়োজত হন, যাতে ক্রমবদ্ধমান জনগোষ্ঠীর টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
ড. মো. আমীরুল ইসলাম*
* সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট; মোবাইল ০১৭৪৭৫৭০৫৪৪
জনপ্রিয় সুগন্ধি মসলাজাতীয় বিরুৎ প্রকৃতির গাছ পুদিনা।
বোটানিক্যাল নাম : Menth spicata; পরিবার : Labitae; ইংরেজি নাম : Mint পুদিনার সুগন্ধির কারণে বিভিন্ন মুখরোচক কাবাব, সলাদ, বোরহানি ও চাটনি তৈরিতে ব্যবহার হয়। কাঁচা পুদিনা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় চাটনি ও সালাদে। ইদানিং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে টক দই এবং বোরহানি তৈরির জন্য পুদিনার ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া মাছ, মাংস, সস, স্যুপ, স্টু, চা, তামাক, শরবত তৈরিতে পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ভেড়ার মাংসের রোস্ট ও মিন্ট জেলি তৈরিতে পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়। বিভিন্ন দেশে পুদিনার বেশি ব্যবহার হচ্ছে তেল তৈরিতে। পুদিনার গাছ থেকে পাওয়া এ তেলের নাম পিপারমেন্ট অয়েল। এ তেল বেশ মূল্যবান। বিভিন্ন শিল্প বিশেষ করে ওষুধ, টুথপেস্ট, মিন্ট চকোলেট, ক্যান্ডি, চুইয়িংগাম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এসবে এটি ব্যবহার হয়। কোনো কোনো ব্র্যান্ডের সিগারেটেও মেন্থল ব্যবহার হয়। তাই পুদিনা গাছের শিল্প মূল্য অনেক বেশি। পুদিনা পাতার তীব্র ঘ্রানের জন্য দায়ী উপাদান মেন্থল ও মেন্থোন। প্রতি বছর আমাদের বাংলাদেশে ১৮ টন কাঁচা পুদিনা পাতার চাহিদা রয়েছে। পুদিনা পাতার ওপর ভিত্তি করে পিপারমেন্ট অয়েল শিল্প স্থাপন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সাথে সাথে প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর ১০ টনের ও অধিক পিপারমেন্ট তেলের চাহিদা রয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এ পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১০ হাজার একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় ভারতে প্রতি বছর কোটি টাকার পিপারমেন্ট তেল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের বাজারে মূলত কাঁচা পুদিনার চাহিদাই বেশি। বিরুৎ অর্থাৎ খুবই ছোট আকারের প্রকৃতির গাছ পুদিনা। কা- ও পাতা নরম। পাতা ডিম্বাকার, কিনারা খাঁজকাটা। পাতা লোমশ, তীব্র মিষ্ট গন্ধযুক্ত। গাছের উচ্চতা ৫০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার। গাছের গোড়া থেকে ধাবক বা রানার বের হয়। গাছ দ্রুত বাড়ে ও ঝোপ তৈরি করে। এর জাপানি জাতটি চাষের জন্য ভালো। আমাদের দেশে যে পুদিনা চাষ হয় তার কোনো ফল হয় না। অতীত থেকে এ দেশে পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। এক সময় ছিল যখন বাড়ির আঙিনায় ২ থেকে ৪টি পুদিনা গাছ লাগিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটানো হতো। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে গেছে। শহরাঞ্চলে পুদিনার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। পুদিনার চাষ এখন অন্যান্য ফসলের মতো বাণিজ্যিকভাবে করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
জমি ও চারা তৈরি
সারা বছরই পুদিনার চাষ করা যায়। তবে খরিফ মৌসুমে পুদিনার চাষ সবচেয়ে ভালো হয়। জৈবসারসমৃদ্ধ জমিতে কাটিং কলম লাগিয়ে শীতকালে সেচ নিশ্চিত করা গেলে সারা বছরই পুদিনার চাষ করা যায়। এঁটেল ও দো-আঁশ মাটিতে পুদিনা সফলভাবে চাষ করা যায়। জুন-জুলাই মাস পুদিনার কাটিং রোপণের উওম সময়। বীজ দিয়েও পুদিনার চারা করা যায়। কিন্তু কাটিং দিয়েই চাষ করা উত্তম। পুরনো ক্ষেত থেকে কাটিং নিয়ে বীজ তলায় বা হাপরে রোপণ করতে হবে। কাটিংয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। মূল জমিতে চারা রোপণের অন্তত ১০ দিন আগে চারা তৈরি করতে হবে। কেননা কাটিং বা তেউড়গুলোতে শিকড় গজাতে মাত্র সাত দিন সময় লাগে। জমি ভালো করে চাষ করার সময় জমির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ টন গোবর বা জৈবসার প্রতি হেক্টরে মিশিয়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ : চারা তৈরির সময় মূল জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য ৪৫ বর্গমিটার জমিতে প্রয়োজনীয় জৈব ও রাসায়নিক সারের পরিমাণ হলো কম্পোস্ট বা গোবর ২০ ঝুড়ি বা ২০০ কেজি; টিএসপি ১ থেকে ১.৫ কেজি; এমওপি বা কাঠের ছাই ১ কেজি বা ৫ কেজি; হাড়ের গুঁড়া ৫ কেজি। এসব সার মূল জমিতে বেড তৈরির সময় ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বেডে ৩০ সেন্টিমিটার পরপর কাটিং বা চারা রোপণ করতে হবে। আগাছা, আবর্জনা ও অন্যান্য দৃশ্যমান বস্তু জমি থেকে অপসারণ করতে হবে। সব সময় পুদিনার জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
ফসল সংগ্রহ : গাছ লম্বা হতে শুরু করলে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা কাটিং বা ডাল কেটে ১০ থেকে ১৫টি শাখা একটি আঁটিতে বেঁধে বাজারে বিক্রি করার জন্য পাঠানো হবে। প্রতি ২ বার ফসল তোলার পর এক কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতি মাসে সার দিয়ে ফসল তুলতে হবে। সারা বছর পুদিনা চাষ করে ফসল তোলা যাবে।
রোগ নিরাময়ে পুদিনা
অরুচিতে : সাধারণত কিছুদিন রোগে ভোগার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে পুদিনার শরবত (পুদিনার রস) ২ চা-চামচ, সামান্য লবণ মরিচ চূর্ণ এক টিপ, কাগজিলেবুর রস ৮ থেকে ১০ ফোটা ও হালকা গরম পানি ২৫০ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে সকালে একবার ও বিকালে একবার; এভাবে ৫ থেকে ৭ দিন খেলে অরুচি চলে যাবে। এছাড়া পুদিনা পাতা বেটে পানিতে গুলেও শরবত করা যায়। সে ক্ষেত্রে কাঁচা পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম নিতে হবে। পুদিনা পাতার চাটনি একাধারে ৮ থেকে ১০ দিন খেলেও অরুচি কমে যাবে।
পেট ফাঁপায় : এক্ষেত্রে পুদিনার শরবত সারা দিনে ২-৩ বার করে কয়েক দিন খেলে পেটে বায়ু জমা বন্ধ হবে এবং খাদ্য রুচিও ফিরে আসবে এবং হজম শক্তিও বাড়বে।
বমিতে : পিত্ত, শ্লেষ্মাজ্বর, অম্লপিত্ত, আমাশয়, অজীর্ণ, উদরশূল প্রভৃতিতে বমি হতে পরে, আবার রোদে ঘোরাফেরা করে ঠা-া পানি খেলে এবং খালি পেটে থেকে পরিশ্রম করলে বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব ক্ষেত্রে পুদিনার শরবত (পুদিনার পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম বেটে তাতে পুরনো তেঁতুল ১ চা চামচ, সামান্য একটু চিনি ও লবণ এবং পানি ২৫০ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে) দিনে ২ থেকে ৩ বার করে কয়েক দিন খেলে বমি সেরে যাবে।
মূত্রাল্পতায় : যে ক্ষেত্রে গরমের ফলে অল্প অল্প করে প্রস্রাব হতে থাকে, কোনো কোনো সময় সে সাথে জ্বালাও থাকে, সেক্ষেত্রে পুদিনার পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম ভালোভাবে বেটে তাতে সামান্য লবণ ও কাগজিলেবুর রস এবং পোয়াখানিক ঠা-া পানি মিশিয়ে শরবতের মতো করে দিনে ২ থেকে ৩ বার খেতে হবে। এর ফলে প্রস্রাব সরল হবে। তারপর এ সমস্যার জন্য মাঝে মাঝে খেলেও প্রস্রাব স্বাভাবিক থাকবে।
মুখের বিস্বাদে : টাটকা পুদিনা পাতা, শুকনো খেজুর, গোলমরিচ, লবণ, জিরা ও কালো আঙুর পরিমাণ মতো মিশিয়ে একসাথে পিষে চাটনি তৈরি করুন। এতে লেবুর টাটকা রস মিশান। এ চাটনি খেলে মুখে রুচি আসবে, মুখের বিস্বাদ দূর হয়ে খাওয়ার ইচ্ছা হবে, বায়ুজনিত অস্বস্তি দূর হবে, হজম শক্তি বাড়বে, শরীরের নিস্তেজ ভাব দূর হবে।
পেটের বায়ু দূর করতে : পুদিনাপাতা, তুলসীপাতা, গোলমরিচ ও আদা পরিমাণ মতো একসাথে মিশিয়ে পিষে নিয়ে পানিতে জল সেদ্ধ করে, একটা ঘন ক্বাথ তৈরি করুন। এ ক্বাথ চামচে নিয়ে অল্প একটু জিহ্বা দিয়ে চেটে অন্তত ৪ বার করে ৩ দিন খেলে পেটের বায়ু দূর হবে ও খুব ক্ষিদে পাবে।
সাইনাসে : টাটকা পুদিনা পাতা পিষে বা থেঁতো করে রস বের করে নিন। এ রস কফ, সর্দি, কপালে সাইনাসের কারণে জমে যাওয়া ঘন সর্দিও বের করে আনবে। প্রতিদিন ১ চামচ করে ২ বার এবং ১৫ থেকে ২০ দিন খাবেন।
পুরনো সবিরাম জ্বরে : টাটকা পুদিনাপাতা ও তুলসীপাতা একসঙ্গে পিষে পানিতে জল মিশিয়ে পাত্র ঢাকা দিয়ে, ঘন ঝোল বা ক্বাথ তৈরি করুন। প্রতিদিন যে জ্বর কোনো একটা বিশেষ সময়ে একটানা বহু দিন ধরে আসে এ ক্বাথ প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার করে অন্তত সপ্তাহখানেক খেলে জ্বর সারবে।
টাইফয়েডে : পুদিনাপাতা, সবুজ তুলসী ও তুলসীর রস এক সাথে মিশিয়ে থেঁতো করে নিন। এতে স্বল্প চিনি মিশিয়ে অল্প করে দিনে ৪ বার খাবেন। কিছুদিন খেলেই জ্বর চলে যাবে।
নিউমোনিয়াতে : পুদিনাপাতা, টাটকা রস অল্প মধুর সাথে মিশিয়ে, প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর ১ চা চামচ করে খাওয়ালে ত্রিদোষ জ্বর অর্থাৎ নিউমোনিয়া রোগীর অনেক বিকার দূর হবে এবং জ্বরও তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
অন্ত্রের দুবর্লতায় : পুদিনা পাতায় টাটকা রস মধু মিশিয়ে খাওয়ালে অন্ত্রের দুবর্লতা ও পেটের অসুখ সারে। যারা বহু দিন ধরে আন্ত্রিক গোলযোগে ভুগছেন তাদের পক্ষে টাটকা পুদিনা পাতার রস খাওয়া অমৃতের মতো উপকারী।
সংক্রমণ প্রতিরোধে : যখন কলেরা ও আন্ত্রিক রোগ প্রবলভাবে ছড়িয়ে মহামারীর রূপ নেয়, তখন টাটকা পুদিনা পাতার রসে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে শরবত তৈরি করে খেলে সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
তীব্র পেটের ব্যথায় : পুদিনা পাতার রস ১ চা চামচ ও আদার রস ১ চা চামচ একসাথে মিশিয়ে তাতে অল্প লবণ দিয়ে এ রস দিনে ২-৩ বার খেলে তীব্র পেটের ব্যথা (উদরশূল) সেরে যাবে।
পুদিনা পাতার আরও ব্যবহার
ক. দাদের ওপর বার বার পুদিনা পাতার রস লাগালে উপকার পাওয়া যাবে;
খ. নাকের ভেতর পুদিনা পাতার রসের ১-২টি ফোটা ফেললে সর্দি সারে;
গ. পুদিনা পাতা চিবিয়ে বিছার কামড়ের জায়গায় লাগালে কামড়ের কষ্ট বা ব্যথা দূর হবে;
ঘ. পুদিনা পাতা পুড়িয়ে ছাই দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়;
ঙ. মধুর সাথে পুদিনা পাতার রস মিশিয়ে খেলে শরীরের জমে থাকা ক্লেদ ঘা হয়ে বেরিয়ে যায়;
চ. খালি পেটে মধ ুও লবণ মিশিয়ে পুদিনা বাটা খেলে কৃমি সারে;
ছ. কফ সর্দিজ্বর ও কুষ্ঠ রোগের জন্য পুদিনা পাতা উপকারী;
জ. পুদিনা পাতা কচলে নিয়ে শুকিয়ে দিলে মুর্চ্ছা রোগে উপকার হয়;
ঝ. পুদিনা পাতা সেদ্ধ করে বেটে মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে পায়ের গোদের উপকার হয়;
ঞ. বৈজ্ঞানিক গবেষণা মতে পুদিনা পাতায় ভিটামিন-এ বেশি পরিমাণে আছে। ভিটামিনের গুণের দিক থেকে দেখলে পুদিনাকে পৃধিবীর সব রোগ থেকে রক্ষাকারী একটি ঔষধি বা উপকারী উদ্ভিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। পুদিনাতে খিদে বাড়ানোর শক্তি আছে খুব বেশি পরিমাণে। রুচি বাড়াতে এর তুলনা বিরল। হাকিমি বা ইউনানি মতে পুদিনা বমি ও হেঁচকি ওঠা বন্ধ করে। পাকস্থলী, বুকে ও কিডনির যাবতীয় গ্লানি ও ক্লেদ দূর করে। আয়ুর্বেদ মতে, পুদিনা স্বাদ ও খাওয়ার রুচি বাড়ায়, খিদে বাড়ায়, বল বৃদ্ধি করে, মনে ও শরীরে সুখের আমেজ আনে, অত্যধিক মলত্যাগ ও মূত্রাবেগ থামায়, কফ ও বাত কমায়। কাশি, উম্মত্ততা, অজীর্ণ বা বদহজম, পেটের অসুখ, একটানা পুরানো পেটের অসুখ, পুরনো জ্বর ও আন্ত্রিক রোগ সারায়। কৃমিও অরুচিনাশ করে, বমি থামিয়ে দেয়। পুদিনার চাটনি যেমন খেতে মুখরোচক তেমনি হজমেও সাহায্য করে। পুদিনা চা পুদিনার পাতা, দুধ,চিনি, গোলমরিচ ও মৌরি গরম পানিতে দিয়ে এ চা তৈরি করতে হবে। চা খেতে সুস্বাদু এবং খেলে তৃপ্তি হয়। শরীরের পক্ষে পুষ্টিকর ও হিতকর পানীয়। স্বাস্থের পক্ষে ভালো এবং সব দিক থেকে উপকারী। পুদিনা পাতার বহুবিদ গুণের কারণে একে অজীর্ণহর, শোক শোভন, সুগন্ধিপত্র এসব নামে ডাকা হয়।
কৃষিবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম*
*রীতা হোমিও হল, পালপাড়া (জামে মসজিদের সামনে), বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ; ০১৭১২১৫৫০১৪, ০১৮৫০০৬৪১৩০
বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি সম্প্রসারণ ব্যাপ্তি অর্ধ শতাব্দীর মতো হলেও এর পেছনে শতাধিক বর্ষের ঘটনাবহুল ইতিবৃত্ত রয়েছে। ১৮৬২-৬৫ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য দুর্ভিক্ষ কমিশন প্রথম কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে যার ফলে ১৮৭০ সালে রাজস্ব বিভাগের অংশ হিসেবে কৃষি বিভাগের জন্ম হয়। পরে ১৯০৬ সালে স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই সময়ে ঢাকায় মনিপুর (বর্তমান জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়) কৃষি খামারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা ১ হাজার একর জমি নিয়ে বিস্তৃত। খামারটি কৃষি বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। ১৯০৯ সালে খামারের কৃষি গবেষণার জন্য একটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়। ১৯১৪ সালে তৎকালীন প্রতিটি জেলায় একজন করে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে কোনো কৃষি বিজ্ঞানে জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা ছিলেন না। পরে ১৯৪৩ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ কৃষি কলেজ থেকে পাস করা গ্রাজুয়েটরা কৃষি বিভাগে যোগদান করেন এবং তখন থেকেই বাস্তবিক পক্ষে কৃষি সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়।
১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন (ভিএআইডি) প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকের সম্প্রসারণ শিক্ষা ও উন্নয়ন কর্মকা- শুরু হয়, পরে ১৯৫৬ সালে উদ্ভিদ সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১৯৬১ সালে বিএডিসি, ১৯৬২ সালে এআইএস, ১৯৭০ সালে ডিএইএম এবং ডিএআরই সৃষ্টি হলেও কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তেমন কোনো পরিকল্পিত সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকা-কে জোরদার করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড, তামাক উন্নয়ন বোর্ড, হর্টিকালচার বোর্ড এবং ১৯৭৫ সালে কৃষি পরিদপ্তর (পাট উৎপাদন), কৃষি পরিদপ্তর (সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা) নামে ফসলভিত্তিক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু একই কৃষকের জন্য বিভিন্নমুখী-রকম সম্প্রসারণ বার্তা ও কর্মকা- মাঠপর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে ১৯৮২ সালে ফসল প্রযুক্তি সম্প্রসারণে নিয়োজিত ছয়টি সংস্থা যথা ডিএ (ইঅ্যান্ডএম), ডিএ (জেপি), উদ্ভিদ সংরক্ষণ পরিদপ্তর, হর্টিকালচার বোর্ড, তামাক উন্নয়ন বোর্ড এবং সার্ডি একত্রীভূত করে বর্তমান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সৃষ্টি করা হয়। কৃষি বিভাগ ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রবর্তিত প্রশিক্ষণ ও পরিদর্শন (টিঅ্যান্ডভি) পদ্ধতির মাধ্যমে এবং ১৯৯০ সালের পর থেকে অদ্যাবধি দলীয় সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের কৃষি ও কৃষককে অত্যন্ত সফলতা ও সুনামের সাথে সেবা প্রদান করেছে। পরিকল্পিত এবং অংশীদারিত্বমূলক সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের জন্য ১৯৯৬ সালে নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতি (এনএইপি) বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে ৮টি উইংয়ের সমন্বয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব হলো সব শ্রেণীর চাষিকে তাদের চাহিদাভিত্তিক ফলপ্রসূ ও কার্যকর সম্প্রসারণ সেবা প্রদান করা যাতে তারা তাদের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে স্থায়ী কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভিশন : খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদনক্ষম উত্তম কৃষি কার্যক্রম প্রবর্তন যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মিশন : দক্ষ, ফলপ্রসূ, বিকেন্দ্রীকৃত, এলাকানির্ভর, চাহিদাভিত্তিক এবং সমন্বিত কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে সব শ্রেণীর কৃষকের প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ, যাতে টেকসই ও লাভজনক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের বর্তমান চিত্র
বর্তমান সরকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ফলে ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ সালে মোট খাদ্যশস্য (চাল, গম, ভুট্টা) উৎপাদন হয়েছিল যথাক্রমে ৩২৮.৯৫, ৩৪২.৪৬, ৩৬০.৬৫, ৩৬৮.৩৯, ৩৭২.৬৬, ৩৮১.৭৪ এবং ৩৮৪.১৯ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল উৎপাদন হয় যথাক্রমে ৩১৩.১৬, ৩১৯.৭৫, ৩৩৫.৪১, ৩৩৮.৯০, ৩৩৮.৩৩, ৩৪৩.৫৬ এবং ৩৪৭.১০; গম উৎপাদন হয় যথাক্রমে ৮.৪৯, ৯.০১, ৯.৭২, ৯.৯৫, ১২.৫৫, ১৩.০২ এবং ১৩.৪৮; ভুট্টা উৎপাদন হয় যথাক্রমে ৭.৩০, ১৩.৭০, ১৫.৫২, ১৯.৫৪, ২১.৭৮, ২৫.১৬ এবং ২৩.৬১ লাখ মেট্রিক টন। এতে দেখা যায় যে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছরেই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় ২০১৪-১৫ সালে আলু ও সবজির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে আলু ও সবজি উৎপাদন হয়েছিল যথাক্রমে ৬৭.৪৬ ও ১০৬.২২ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে ২০১৪-১৫ সালে আলু ও সবজি উৎপাদন হয় যথাক্রমে ৯৩.২৮ ও ১৪২.৩৭ লাখ মেট্রিক টন। এ সময়ে ভুট্টার উৎপাদনও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিকতায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আউশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা
বোরো (২০০৯-১০) মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে হাওর এলাকার বোরো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য সারা দেশে উফশী আউশ (২০১০-১১) উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫১টি জেলার ৩,৪৬,৮১১ জন কৃষক পরিবারকে প্রতি পরিবারে বিনামূল্যে ২০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার প্রদান করা হয়। এ কার্যক্রমে প্রায় ২৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে;
২০১০-১১ আউশ মৌসুমে ৫১টি জেলার ৫,৩৭,৪৭৭ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ১ বিঘা আউশ ধান আবাদের জন্য বিনামূল্যে রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। ফলে আউশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে;
খরিফ-১/২০১২ মৌসুমে ৩০টি জেলার ৫৬,২৫০ জন কৃষককে নেরিকা আউশ ও ৫৬টি জেলার ৩,০৮.৯৫৬ জন কৃষককে উফশী আউশ ধান চাষাবাদে প্রত্যেককে ১ বিঘা জমি আবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। এ কার্যক্রমে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে;
খরিফ-১/২০১৩ মৌসুমে প্রণোদনা হিসেবে বোনা আউশ (নেরিকা) আবাদে ১৮টি জেলার ৭,০০০ জন ও উফশী আউশ ধান চাষাবাদে ৪৭টি জেলার ৩,২৫,৫০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে জমি আবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। এ কার্যক্রমে ৪৩০৮.৯২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ কর্মসূচিতে সেচ ও আগাছা দমনে কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৪টি জেলার ২,৩৪,৬০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে উফশী জাতের আউশ ধান ও ৩৭টি জেলার ১০,০০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে নেরিকা জাতের আউশ আবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। এ কার্যক্রমে সরকারের ৩০৬৮.৬৪৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ কর্মসূচিতে সেচ ও আগাছা দমনে কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করা হয়।
খরিফ-১/২০১৫-১৬ মৌসুমে উফশী আউশ ধান ও বোনা আউশ ধান (নেরিকা) চাষে প্রণোদনার লক্ষ্যে উফশী আউশ ধান চাষাবাদে ৪৮টি জেলার ১,৮০,০০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে মোট ১,৮০,০০০ বিঘা উফশী আউশ ধান ও বোনা আউশ (নেরিকা ) আবাদে ৩৭টি জেলার ৩০,০০০ জন কৃষককে ১ বিঘা করে মোট ৩০,০০০ বিঘা বোনা আউশ (নেরিকা) ধান আবাদের জন্য সর্বমোট ২,১০,০০০ জন কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। এ কর্মসূচিতে সেচ ও আগাছা দমনে কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তাও প্রদান করা হয়।
কৃষি পুনর্বাসন ও প্রণোদনা
এ কর্মসূচির আওতায় ২০০৮-২০০৯ সালে ২৭৪৬.৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে এবং ২০০৯-১০ সালে ৩২১৫.০৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করা হয়।
বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বিএডিসি, ডিএই, ব্রি ও বারি ফার্মে ২০০৮-২০০৯, ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ সালে ১০০ একর নাবি রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মাঝে রোপা আমনের চারা বিতরণ করা হয়েছে। এতে ওই ৩ বছর প্রায় ২০০০ একর জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করা সম্ভব হয়েছে।
খরিফ-২/২০১২-১৩ মৌসুমে দেশের ৬টি জেলায় (জামালপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ) অতিবৃষ্টি/উজান খেকে নেমে আসা প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে ৬৮০.৮১ লাখ টাকার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ৭৮,০১১ জন কৃষককে বিনামূল্যে সরিষা/গম/ভুট্টা বীজ ও সার বিতরণ করা হয়।
রবি মৌসুমে শিলাবৃষ্টি/ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাসহ নেরিকা চাষের সম্ভাবনাময় জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে উফশী ও রোপা আমন চাষে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ৯৯৯.৭৬ লাখ টাকার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে সর্বমোট ১,০১,৭২২ জন কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার প্রদান করায় এ কর্মসূচিতে ৯৯৯.৭৬০৫৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
২০১৪-১৫ সালে উজানের ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের গম, সরিষা, ভুট্টা ও বোরো ফসল উৎপাদনে সহায়তার জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার সরবরাহের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৮৪৮.৮৯২১৮ লাখ টাকা এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো গম, ভুট্টা, ফেলন ও বারি খেসারি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করাার নিমিত্ত ১৫৪৮.৯০ লাখ টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে সর্বমোট ২,০৫,০১৫ জন কৃষক-কৃষাণী উপকৃত হয়েছেন।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত জেলাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য কৃষি পুনর্বাসন এবং ফসলের উন্নত ও নতুন জাত সম্প্রসারণে প্রণোদনার (রবি/২০১৫-১৬ মৌসুমে) জন্য মোট ৩,১০,৯১৯ জন (পুনর্বাসনের জন্য ২,১২,৬৭৯ এবং প্রণোদনার জন্য ৯৮,২৪০) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে গম, সরিষা, আলু, খেসারি, ফেলন ও গ্রীষ্মকালীন মুগ চাষের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার বিতরণের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে সরকারের ৩২,৪৯,৩১,৮৯০ টাকা ব্যয় হয়েছে।
তাছাড়া হাওরে উৎপাদিত শস্য, ধান দ্রুত এবং নিরাপদে আহরণ করার লক্ষ্যে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি দ্বারা ধান কাটা, মাড়াই করার নিমিত্ত হাওড়ের ৭টি জেলার (সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া) সব উপজেলায় ১০৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০০টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার এবং ২৭৫টি রিপার কৃষকের মাঝে সরবরাহের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে।
ভুট্টা প্রণোদনা
গত ২০১১-১২ রবি মৌসুমে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৬.৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের ১১টি জেলায় ৫০,০০০ কৃষকের প্রত্যেককে বিনামূল্যে ৩ কেজি ভুট্টা বীজ, ২৫ কেজি ডিএপি ও ২৫ কেজি এমওপি সার সরবরাহ করা হয়েছে ।
কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ ও কৃষকের ব্যাংক হিসাব
কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কৃষক পরিবারকে ২,০৫,৮২,৮২৪টি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষাণীদের ১২,৫৮,৬৪৭টি এবং কৃষকের ১,৯৩,২৪,১৭৭টি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়। ফসল উৎপাদনে ঋণ, উপকরণ সহায়তা প্রাপ্তিতে কৃষক এ কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন ও ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কার্যক্রম চালু রেখে কৃষকের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
হাওরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষিদের সহায়তা কর্মসূচি
বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছরে হাওরাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩ লাখ ৮৫ হাজার কৃষককে রবি/২০১০-১১ মৌসুমে উফশী বা আধুনিক জাতের বোরো ফসল চাষাবাদে সহায়তার জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়। এ কার্যক্রমে ৪৮৪৯.০৮ লাখ টাকার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে সহায়তা
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৪টি জেলায় (পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও বরিশাল) খরিফ-২/২০১৪ মৌসুমে উফশী আমন চাষাবাদে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক প্রতি কৃষক পরিবারকে সর্বোচ্চ ১ বিঘা জমির বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করার জন্য সর্বমোট ২৩৪৯২৫ বিঘা জমির জন্য (বিঘাপ্রতি ৫ কেজি বীজ) বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণের নিমিত্ত ২,৩৪,৯২৫টি কৃষক পরিবারকে (৩৯৯.৫৭২৫+২০৯১.২৩২৫) = ২৪৯০.৮০৫ লাখ টাকা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে।
পাট ও পাট বীজ উৎপাদন
পাট মৌসুমে (২০১০-১১) পাট আঁশের মান উন্নয়ন ও চাষি সহায়তার লক্ষ্যে ২৯টি জেলায় ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ৬০০ পাট চাষিকে ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খুলে ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে জনপ্রতি ২০০ টাকা হারে সহায়তাসহ প্রতি ১০০ জনের জন্য ১টি করে সর্বমোট ১৫ হাজার ৩৯৬টি রিবনার সরবরাহ এবং কৃষককে রিবন রেটিং পদ্ধতির ওপর হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ওই কর্মসূচিতে সরকারের সর্বমোট ৩৩ কোটি ৭৯ লাখ ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বর্তমানে রিবনারগুলো চাষিপর্যায়ে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপ
১. ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য কৃষকপর্যায়ে সুষম সারের চাহিদা দূরীভূত করতে সরকার কর্তৃক সার বিতরণ মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারকরণ;
২. সারের ক্রয়মূল্য চার দফায় কমানোর ফলে সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিতকরণ;
বর্তমানে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের বাজারমূল্য কেজি প্রতি যথাক্রমে ১৬ টাকা, ২২ টাকা, ১৫ টাকা এবং ২৫ টাকা নির্ধারণ। কৃষক পর্যায়ে সার প্রাপ্তি সহজলভ্য করা। এ নীতিমালার আওতায় প্রতি ইউনিয়নে একজন করে সার ডিলার এবং ৯ জন করে খুচরা সার বিক্রেতা নিয়োগ প্রদান;
৩. কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বর্তমানে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষকপর্যায়ে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান;
৪. মানসম্মত বীজ সরবরাহ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ। বিভিন্ন ফসলের হাইব্রিড ও উফশী জাতের ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ;
৫. উপযুক্ত সেচ ব্যবস্থা/কার্যক্রম গ্রহণে কৃষককে উৎসাহিতকরণ। সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দ্বারা সেচ প্রদানে স্মার্টকার্ড প্রচলন;
৬. খরা, বন্যা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের আধুনিক জাতের আবাদ সম্প্রসারণ;
৭. ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে কৃষককে উৎসাহিতকরণ;
৮. দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের জন্য আধুনিক লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ;
৯. অটোমেটেড রিপোর্ট রিটার্নিং সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ফসল উৎপাদন সংক্রান্ত কৃষি বিষয়ক প্রশ্ন করে বিশেষজ্ঞের উত্তর পেতে ডিএইতে ইন্টারনেট কানেকশন স্থাপন;
১০. অব্যবহৃত চর, উপকূলীয় ও পার্বত্য এলাকায় মাশরুম, সয়াবিন, সুগারবিট, চিউয়িং আখ, তরমুজ, ভুট্টা, মরিচ, পাট এবং ডাল, তেল ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদ সম্প্রসারণ করে পতিত জমি নিবিড় চাষাবাদের আওতায় এনে শস্যের নিবিড়তা বাড়ানো;
১১. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি ও জনবল অবকাঠামো পুনর্বিন্যাসে ব্যবস্থা গ্রহণ;
১২. ন্যূনতম পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে সমন্বিত শস্য ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজির উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কৃষককে উৎসাহিতকরণ;
১৩. বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি আবাদ এবং বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন অপ্রচলিত ও প্রচলিত ফল লাগাতে চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণ;
১৪. দেশব্যাপী বহিরাগত পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধের জন্য উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন ২০১১ বায়ন;
১৫. রবি/২০১৫-১৬ মৌসুমে বিএডিসির ৫২ মেট্রিক টন এবং বিনা ও বারির পক্ষ থেকে যথাক্রমে ৪.২ ও ৩১.১ মেট্রিক টন বিভিন্ন ফসলের (সর্বমোট ৮৭.৩ মেট্রিক টন) বীজ/বীজ থেকে উৎপাদিত চারা বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, শেরপুর ও লালমনিরহাট জেলার ১০,২৫৭ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ;
১৬. ডাল, তেল, মসলা ও ভুট্টাসহ ২৪টি ফসল উৎপাদনের নিমিত্ত ৪% সুদহারে বিশেষ কৃষি ঋণ প্রদান;
১৭. প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিভিন্ন সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ (প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, চাষি র্যালি, উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, প্রযুক্তি মেলা, কর্মশালা) এবং প্রতিটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শতকরা ৩০ ভাগ কৃষাণীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ;
১৮. সারা দেশে ৭২৭টি কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক) স্থাপন ও কৃষকের প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ প্রদান ।
বিগত ৭ বছরের শাসনকালে সরকার দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সারের উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণ করে কৃষকদের সার প্রাপ্তি ও ব্যবহারে সহায়তা করার ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।
তাছাড়া কৃষকের অর্থনৈতিক কথা বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন সময়ে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে সহায়তা করেছে এবং কয়েক দফায় ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের মূল্য কেজি কমিয়ে আনার ফলে কৃষক সুষম সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। সুষম সার ব্যবহারের ফলে কৃষকের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। কৃষিতে বর্তমান সরকারের সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এসব কার্যক্রম সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে বিবেচ্য।
*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
শীতের কৃষি
গাজী মাজহারুল ইসলাম অপু*
শীতকাল নিশ্চিত মৌসুম অনেক ফসলের জন্য
অধিক ফসল ফলিয়ে আমার দেশকে করবো ধন্য।
ফুলকপি বাঁধাকপি লাউ মুলা গাজর আছে কত
টমেটো বেগুন শালগম ওলকপি শাকসবজি শিম শত শত।
শুকনা ভাব আছে বলে এ মৌসুমে সেচ দিতে হয়
সেচ না পেলে ভালো ফলন তাতে হওয়ার নয়।
জৈবসার রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় দেবে
সময় মতো যত্নআত্তিতে অধিক ফলন নেবে।
শাকজাতীয় ফসল আবাদ একের অধিক ভাই
একই জমিতে তিন-চারবার আবাদ করলে পাই।
স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে ভরা শীত মৌসুমের ফসল
গোলা ভরে নাও তোমরা খাটিয়ে বিশেষ কৌশল
ডাল ফসল তেল ফসল আরও কত আছে
শ্রম দিয়ে ঘাম বিনিয়োগে পাবে হাতের কাছে।
গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করো বোরো ধানে ভাই
কম খরচে বেশি লাভ এর তুলনা নাই।
আইপিএম আইসিএম প্রয়োগ করো ক্ষেতে
পরিবেশবান্ধব কৃষি দিয়ে উঠব সবাই মেতে।
অপকারি পোকামাকড় ধ্বংস কর তবে
বন্ধু পোকা বাঁচিয়ে রাখলে বেশি ফলন হবে
হাত পরাগায়ন পরিচর্যা আগাছা বাছাই করে
নিশ্চিত ফলন তুলে নাও গোলা কিংবা ঘরে
মোটেও কর না হেলাফেলা শীতের মৌসুম এলে
যত পার ফলিয়ে নাও অলস সময় ফেলে।
কৃষি দিয়ে সমৃদ্ধ করব আমাদেরই দেশ
সুখে শান্তিতে টইটুম্বুর সোনার বাংলাদেশ॥
কৃষিতে স্বাধীনতা
মো. জুন্নুন আলী প্রামাণিক**
স্বাধীনতা কৃষককে দিয়েছে মুক্ত কর্ম শক্তি,
পরাধীন নির্যাতনে নীরব কষ্ট থেকে মুক্তি।
চারিদিকে বিকশিত ফসল মাঠ স্নিগ্ধ রূপে,
আধুনিক চাষাবাদ নির্বিঘ্নে চলে নানা ধাপে।
নির্বিচার অত্যাচার মিটিয়ে গেছে আর নেই,
ঘাতকেরা পরাজয়বরণ করে জব্দ তাই।
অনাহূত অন্যায়ের ছোবল মেরে ক্ষতি করে,
হিংসার লেলিহান শিখায় শান্তি পায় পুড়ে।
উদ্ভিদের ছায়াময় শাখায় আজ পাতা নড়ে,
নির্মলতা বিস্তরণে স্বাধীন বায়ু ছোটে উড়ে।
সমৃদ্ধির জোয়ারের চলন্ত স্রোতে নব সাড়া,
ফুলফল নির্দ্বিধায় রূপের মাঝে হয় সেরা।
খাদ্যশস্য ফলানোর সোনালি আশা মনে ফোটে,
সারা দিন উৎসাহে চঞ্চল চাষি মাঠে খাটে।
স্বাধীনতা সুপথের সন্ধান দিয়ে ডাকে জোরে,
সারেসিক্ত মৃত্তিকার সবুজ বুক শস্যে ভরে।
গাছগুলো বাড়ার প্রেরণা পেয়ে শুধু বাড়ে,
বণ্যপ্রাণী বনানীর আড়ালে ভীতিশূন্য ঘরে।
বৃহত্তর ক্ষুদ্রতর খামার গড়ে মুগ্ধ চাষি,
কৃষি ক্ষেত্র উন্নয়ন সান্নিধ্যে ফল দেয় বেশি।
অনাহার অভাবের দুর্দিনগুলো গেছে সরে,
মাছে ভাতে বাঙালির সান্ত¡না জোটে স্বস্তি ফেরে।
স্বাধীনতা কৃষকের সহায় শক্তি ফিরে দেয়,
প্রযুক্তির প্রগতির ধারায় চাষি ধন্য হয়।
মৌসুম যখন শান্ত
মৌসুম যখন সহজ সরল শান্ত মেজাজে থাকে,
আকাশে বাতাসে জমিনে তখন মিষ্টি পাখিরা ডাকে।
বিচিত্র ফসলে মাঠের বুকটি শক্তি সান্ত¡না পায়,
কৃষান-কৃষানি সার্থক শ্রমের প্রাপ্তি দু’হাতে লয়।
সময় মতন বৃষ্টির জোগানে জমি সজাগ হয়,
সমস্যা থাকে না চাহিদা পূরণে সব ফসলে জয়।
শীতল বাতাস সোহাগে উড়িয়ে দিগি¦দিক ছোটে,
সবুজ হাসির শখের আবাদ পূর্ণ সকল মাঠে।
সুযোগ সুবিধা এগিয়ে চলার পথ ধরিয়ে আসে,
ফলন অধিক নিয়ম মানায় কৃষি বারটি মাসে।
চাঁদনি আকাশ রাতেরবেলায় জ্বলে আলোর মতো,
স্বচ্ছতা প্রকাশে সুনীল শূন্যের রূপ লহরী শত।
তারকাগুলোর ছড়ানো আলোক রশ্মি মাটিতে পড়ে,
অনন্ত অসীম সীমানা তখন দৃষ্টিসীমার ধারে।
স্বাগত জানার ঘাটতি থাকে না চাষি নিমগ্ন ক্ষেতে,
ওষুধ সারের অভাব হয় না সুষ্ঠু উপায়ে দিতে।
অনেক প্রকার সবজি জমিতে নিজ গতিতে বাড়ে,
দায়িত্বে বিশুদ্ধ রাখলে সেসব পুষ্টি জোগায় জোরে।
বন্যার কবলে খরার প্রকোপে বাধা বিপত্তি হলে,
উপায় পাবার অনেক সুযোগ আছে কৃষি অফিসে গেলে।
সহায় জোগাড় মৌসুমি বায়ুর সেবা যখন ভালো,
উন্নত জাতের ফসল তখন ছড়ায় সোনালি আলো॥
*গ্রাম-পূর্ব ধুপতি, ডাকঘর-ধুপতি, সদর, বরগুনা। **গ্রাম-বিদ্যাবাগিশ, ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম লঁহহঁহ১৯৬২@মসধরষ.পড়স
মো. আফজাল হোসেন
গ্রাম : বরগাছি
উপজেলা : ভোলারহাট
জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : কুল গাছের পাতার ওপর সাদা সাদা ধূসর পাউডার দেখা যায়। গাছের পাতা ও কচি ফল ঝরে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাব?
উত্তর : কুল গাছের পাউডারি মিলডিউ একটি মারাত্মক রোগ। এক ধরনের ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগের দ্বারা গাছের পাতা, ফুল ও কচি ফল আক্রান্ত হয়। উষ্ণ ও ভিজা আবহাওয়ায় বিশেষ করে মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এজন্য বাগান নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সুষম সার ব্যবহার করা প্রয়োজন। গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। গাছে ফুল দেখা দেয়ার পর থিওভিট, সালফোলাক বা কুমুলাস ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
নাহিদ পারভেজ
গ্রাম : বোয়ালমারি
উপজেলা : ভাঙ্গুরা
জেলা : পাবনা
প্রশ্ন : ধান গাছের ছড়ায় ধানগুলো হলদে কমলা রঙ হয়ে বলের মতো হয়ে গেছে। সমাধান কী?
উত্তর : এটি ধানের ছত্রাকজনিত রোগ। ধানের ‘লক্ষ্মীর গু’ নামে পরিচিত। ধান পাকার সময় এ রোগ দেখা যায়। চিকন ও সরু জাতীয় আমন ধানে এ রোগ বেশি হয়। এ ছত্রাক ধানের বাড়ন্ত চালকে নষ্ট করে বড় গুটিকা সৃষ্টি করে। এ রোগ ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রোগাক্রান্ত শীষ তুলে ফেলা। মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা। শীষ বের হওয়ার সময় ছত্রাকনাশক বেনলেট (০.২ শতাংশ), টপসিন এম (০.২ শতাংশ), ব্যাভিস্টিন (০.১ শতাংশ) অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। এটি বীজবাহিত রোগ তাই বীজ বপন করার আগে প্রোভেক্স বা ব্যাভিস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
মো. আসাদ
গ্রাম : ধলবাড়িয়া
উপজেলা : কালীগঞ্জ
জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : ধানের শীষের গোড়া কেটে দিচ্ছে। শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি ধানের শীষ কাটা লেদা পোকার জন্য হয়। এটি পাতার পাশেও কেটে ফেলে। এর জন্য ক্ষেতে ডাল পুঁতে পাখির বসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ পদ্ধতিকে ‘পার্চিং’ বলে। আক্রমণ কমানোর জন্য জমিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কীটনাশক কার্বারিল অথবা সেভিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে। ধান কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
আবদুল কাইয়ুম
গ্রাম : সকদিরামপুর
উপজেলা : ফরিদগঞ্জ,
জেলা: চাঁদপুর
প্রশ্ন : আম গাছের পাতার চারপাশ থেকে পুড়ে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি আম গাছের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। পাতায় প্রথমে হলুদ দাগ হয় এবং পরে হালকা বাদামি রঙ ধারণ করে। এটি প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছে ১ শতাংশ বোর্দমিক্সচার বা ৪ গ্রাম সানভিট অথবা ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো. জাকির হোসেন
গ্রাম : খড়রিয়া
উপজেলা : কালীয়া
জেলা : নড়াইল
প্রশ্ন : আখের কচি ডগার মাজরা পোকা কিভাবে দমন করব?
উত্তর : এ পোকা আখের চারার বয়স যখন ১ থেকে ৩ মাস তখন কা- ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে চারার মাঝ ডগা মরে যায়, যাকে ‘মরা ডিগ’ লক্ষণ বলে। মরা ডিগ টান দিলে সহজে উঠে আসে। এদের আক্রমণে একটি ডগায় ৩ থেকে ৪টি ছিদ্র দেখা যায়। এরা একটি চারা ধ্বংস করার পর অন্য চারায় আক্রমণ করে।
দমন ব্যবস্থা : আগাম আখ চাষ করা, ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আখ রোপণ শেষ করতে হবে; নালা পদ্ধতিতে আখ চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়; চারার বয়স ১ থেকে ২ মাস হলে গোড়ায় অল্প করে মাটি তুলে দিতে হবে; আলোক ফাঁদ পেতে মথ ধ্বংস করতে হবে; আক্রান্ত চারাগাছ মাটির ৫.০ থেকে ৭.৫ সেন্টিমিটার নিচ হতে কেটে পানিতে ফেলে বা আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করতে হবে; আখের জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে; আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ডায়াজিনন বা লেবাসিড প্রতি লিটার পানিতে ০.৭ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মুকুন্দ চন্দ্র দাশ
গ্রাম : তেলকুড়ি
উপজেলা : পাঁচবিবি
জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : মাসকলাইয়ের পাতার দাগ রোগ কিভাবে দমন করব?
উত্তর : মাসকলাইয়ের পাতার দাগ রোগ ছত্রাকজনিত একটি রোগ। আক্রান্ত পাতার উপর ছোট ছোট লালচে বাদামি গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশের কোষগুলো শুকিয়ে যায় এবং পাতার ওপর ছিদ্র হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ পাতাই ঝলসে যায়। দমন ব্যবস্থা : আক্রামণ শুরু হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ কার্বেনডাজিম ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ১২ থেকে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে; রোগ প্রতিরোধী জাতের (যেমন- বারি মাস-১, বারি মাস-২ ও বারি মাস-৩) চাষ করতে হবে; এছাড়াও ফসল উৎপাদনে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এতে রোগের প্রকোপ অনেক কমে যাবে।
রাসেল হক
গ্রাম : কাঁঠালিয়া
উপজেলা : মির্জাপুর
জেলা : পটুয়াখালী
প্রশ্ন : হাঁস-মুরগির টিকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাই।
উত্তর : রানীক্ষেত ভ্যাকসিন : ৫ থেকে ৭ দিন বয়স ১টি ভায়াল ৬ মিলিমিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ২-৩ ফোঁটা করে প্রতি বাচ্চা। ২১ দিন বয়স পুনরায় একই পদ্ধতিতে ২ বার দিতে হবে। ৬০দিন বয়স এক এ্যাম্পুল জউঠ ১০০ সিসি পানির সাথে মিশিয়ে ১ সিসি করে রানের মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে। প্রতি ৬ মাস পর পর পুনরায় দিতে হবে। ডাকপ্লেগ ভ্যাকসিন : ৩৫ দিন বয়সের বাচ্চা ১টি ভায়াল ১০০ সিসি পানির সঙ্গে মিশিয়ে ১ সিসি করে বুকে বা রানে পুশ করতে হয়। ৬০ দিন বয়সে পুনরায় ২য় বার। ৬ মাস পর পর নিয়মিত দিতে হবে। কলেরা ভ্যাকসিন : ৩ থেকে ৪ মাস বয়স ১০০ সিসি কলেরা ভ্যাকসিনের বোতল হতে ১ সিসি করে রানের মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে। ৬ মাস পর পুনরায় দিতে হবে। গামবোরো ভ্যাকসিন : ৭ থেকে ১৪ দিন বয়স এক এ্যাম্পুল ৫০০ থেকে ১০০০ সিসি পানির সঙ্গে মিশিয়ে ৩ থেকে ৪ ফোঁটা করে মুখ দিয়ে খাওয়াতে হবে। ২৮ থেকে ৩০ দিন বয়স দ্বিতীয় বার এক এ্যাম্পুল ৫০০ থেকে ১০০০ সিসি পানির সঙ্গে মিশিয়ে ৩ থেকে ৪ ফোটা করে মুখ দিয়ে খাওয়াতে হবে। পক্স ভ্যাকসিন : ৩৫ দিন বয়স এক এ্যাম্পুল ৬ সিসি পানির সঙ্গে মিশিয়ে পাখার নিচে সুঁইয়ের মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ বার খোঁচা মেরে দিতে হবে।
তৌহিদ হাসান
গ্রাম : হাজীপাড়া
উপজেলা : গৌড়নদী
জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : গরুকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। কী করণীয়?
উত্তর : কামড়ের ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে জধনরংরহ ইনজেকশন ১০ মিলিলিটার করে প্রথম দিন শরীরের যে যে কোনো জায়গার ৪ স্থানে ৪ সিসি করে ৪টি এবং ৭ম দিনে ৩ সিসি করে ৩ স্থানে ৩টি ইনজেকশন দিতে হবে। পুনরায় ২১তম দিনে ৩ স্থানে ৩ সিসি করে মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে।
কামরুল ইসলাম
গ্রাম : নগরঘাট
উপজেলা : তালা
জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : বাগদা চিংড়ির হোয়াইট স্পট ডিজিস বা সাদা ক্ষত রোগ হলে কী করণীয়?
উত্তর : এটি ভাইরাসজনিত রোগ। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো। চাষের আগে সঠিক নিয়মে ঘের প্রস্তুত করতে হবে। তলদেশের পচা কাদা মাটি তুলে ফেলতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে চুন ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে (শতকে ৫০০ গ্রাম) মাটি ও পানি শোধন করতে হবে; ঘন ফিল্টার নেটের মাধ্যমে ছেঁকে পানি প্রবেশ করাতে হবে যেন ভাইরাসবহনকারী প্রাণী বা তার ডিম প্রবেশ করতে না পারে; সুস্থ সবল জীবাণুমুক্ত পোনা সঠিক পরিমাণে ছাড়তে হবে; ব্যবহৃত জাল, পাত্র এবং সরঞ্জামাদি ব্যবহারের আগে ও পরে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানিতে-উচ্চ ঘনত্বের পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে ভিজাতে হবে এবং রৌদ্রে ভালোভাবে শুকাতে হবে; পানির গভীরতা ঠিক রাখতে হবে এবং নিয়মিত চুন, পুষ্টিকর খাবার ও সার দিতে হবে; চিংড়ির রেণু পোনা ছাড়ার সময় পুকুরের পানির গভীরতা ১.৫ ফুট থেকে ২ ফুট এবং চাষকালীন অর্থাৎ মাছ বড় হয়ে গেলে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকা বাঞ্ছনীয়।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
মাঘ মাসের কনকনে শীতের হাওয়া তার সঙ্গে মাঝে মাঝে শৈত্যপ্রবাহ শীতের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে যায়। কথায় আছে- মাঘের শীতে বাঘ পালায়। কিন্তু আমাদের কৃষকভাইদের মাঠ ছেড়ে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। কেননা এ সময়টা কৃষির এক ব্যস্ততম সময়। আর তাই আসুন আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-
বোরো ধান
ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
চারা রোপণের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে একরে ৬৫ কেজি গুটি ইউরিয়ার প্রয়োজন হয়;
বোরো ধানে নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছা দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে;
রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা, আলোর ফাঁদ এসবের মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাইমুক্ত করতে পারেন;
এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে তা পাতলা করে দিতে হবে;
গম গাছ থেকে যদি শীষ বের হয় বা গম গাছের বয়স ৫৫ থেকে ৬০ দিন হয় তবে জরুরিভাবে গম ক্ষেতে একটি সেচ দিতে হবে। এতে গমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দিতে হবে;
গম ক্ষেতে ইঁদুর দমনের কাজটি সবাই মিলে একসাথে করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা ক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে;
গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে জমিতে একটি সেচ দিতে হবে;
গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে;
ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
আলু
আলু ফসলে নাবিধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে;
মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে;
তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে;
আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিয়ে ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে;
আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে;
তুলা
তুলা সংগ্রহের কাজ এ মাস থেকেই শুরু করতে হবে।
তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০ শতাংশ বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০ শতাংশ পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে;
রৌদ্রময় দিনে বীজ তুলে ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩ থেকে ৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে;
ভালো তুলার সঙ্গে যেন খারাপ তুলা কখনও না মেশে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি এ সময় পাকে;
সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে যায় তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে;
ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমির উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।
শাকসবজি
বেশি ফলন পেতে শীতকাল শাকসবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে।
টমেটোর মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। আইপিএম পদ্ধতিতে এ পোকা দমন করতে হবে;
এ সময় চাষিভাইরা টমেটো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাণ্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরে ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত অনায়াসে টমেটো খেতে পারবেন।
শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে।
গাছপালা
শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে;
গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছামুক্ত রাখতে হবে;
সাধারণত এ সময় আম গাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগ পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে;
এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
পোলট্রিতে অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব সমস্যা দেখা যায় ;
মোরগ-মুরগির অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে;
শীতের তীব্রতায় পোলট্রি শেডে মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে;
পোল্ট্রি লিটারে অ্যামোনিয়া গ্যাস রোধে ১ বর্গফুট জায়গায় ১ কেজি হারে অ্যামোনিল পাউডার মিশাতে হবে;
গো খামারে শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। না হলে শীতের তীব্রতায় গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে;
এ সময় গাভীর যত্নে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে;
গাভীর খাবারের খরচ কমাতে সবচেয়ে ভালো হয় নিজেদের জমিতে গো খাদ্য চাষাবাদ করা;
সমবায় সমিতির মাধ্যমে গরুর চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করলে লাভ বেশি হয় এবং খরচ কমে যায়।
মৎস্যসম্পদ
পুকুরে পানি কমে দূষিত হয়ে যায় বলে শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে;
কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ দেখা দেয়;
মাছের ক্ষত রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে;
মাছ চাষ বিষয়ে পরামর্শে জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, সংক্ষেপে মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো। অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের গ্রহণযোগ্যতার সমন্বয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই। কৃষির যে কোনো সমস্যায় উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে অথবা কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে কল করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫