বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আর্দ্র ও অব-উষ্ণম-লীয় এ দেশে ফলের সর্বাধিক উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে। জ্যৈষ্ঠ মাস মধু মাস বলে সব বাঙালির কাছে পরিচিত। এ দেশের চাষযোগ্য ফলের সংখ্যা প্রায় ৭০টি এবং বৈশাখ থেকে শ্রাবণ এ চার মাস দেশের মোট ফলের ৫৪ শতাংশ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাকি আট মাস মিলে ৪৬ শতাংশ ফল পাওয়া যায়। ফল আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল। রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় বাংলাদেশের ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফলের অবদান উল্লেখযোগ্য। এ দেশের মোট চাষভুক্ত জমির মধ্যে ফলের আওতায় ১ থেকে ২ শতাংশ জমি রয়েছে অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের ১০ শতাংশ আসে ফল থেকে।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ফলগুলো হলো আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, কুল, সফেদা, তরমুজ, আনারস, লিচু, কমলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, নারিকেল, তাল, খেজুর প্রভৃতি। এ দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল উৎপাদিত না হওয়ায় এর চাহিদা ও দাম বেশি থাকে। অন্যান্য শস্যের চেয়ে ফলের দাম সাধারণত বেশি হয় বলে ফল চাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন মৌসুমের পরে সংরক্ষিত ফল অধিক দামে বিক্রি করা সম্ভব এবং উদ্বৃত্ত ফল ও ফলজাত দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। তাই এ দেশে অধিক চাহিদার কারণে অধিক ফল উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ক্রপিং সিস্টেম বা ফসল উৎপাদন এলাকা তৈরি করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে কিছু এলাকায় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ফল যেমন- আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, নারিকেল প্রভৃতি ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে আসছে। বিশেষ বিশেষ এলাকার ফলগুলোর উৎপাদন ও গুণগতমানে স্বকীয়তা রয়েছে। অনুন্নত জাত ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা ফলবাগানে ভালো ফলন হয় না কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা এ বাগানগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। প্রতিদিন জনপ্রতি প্রায় ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও আমরা পাচ্ছি মাত্র ৪৫ গ্রাম। তবে আশার কথা, বেশ কিছু ফলের আবাদ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। যেমন- পেয়ারা, কুল, তরমুজ, লিচু প্রভৃতি। ফল গাছে বিশেষ করে বসতবাড়ির আনাচে-কানাচের ফলগাছগুলো একটু পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফলের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ও আয় অন্যান্য মাঠ ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। এক হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন যেখানে ৩.০ থেকে ৪.০ মেট্রিক টন সেখানে একই পরিমাণ জমিতে কলার উৎপাদন হচ্ছে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২০ মেট্রিক টন। একইভাবে উৎপাদিত ফল থেকে আয়ের পরিমাণও প্রধান ফসল ধানের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। কাজেই স্বল্প পরিসরে ফল চাষ করে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব।
ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলকে মানুষের মাঝে পরিচিত করা, তাদের গুণাগুণ তুলে ধরা, ফল চাষাবাদে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং ফল চাষের আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল জনগণের মাঝে সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় ফল মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। বনজ ও ঔষধি গাছের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষ রোপণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ১৬ থেকে ৩০ জুন ‘ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ’ উদযাপন করা হচ্ছে। এবারের মূল প্রতিপাদ্য হলো- ‘দিন বদলের বাংলাদেশ-ফল বৃক্ষে ভরবো দেশ’। সেই সঙ্গে জাতীয় ফল প্রদর্শনী-২০১৫ এর আয়োজন ফলদ বৃক্ষ রোপণ আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে। ফল চাষাবাদে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং ফল চাষের আধুনিক কলাকৌশল জনগণের মাঝে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় ফল প্রদর্শনী ২০১৫ এর আয়োজন করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চলমান বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে ফলদ ও ঔষধিসহ মোট ১,০২,৩৯৬০০টি চারা রোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
ফল একটি পচনশীল পণ্য। ফলের বাজারদর হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। ফল সঠিকভাবে উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফল ভিত্তিক খাদ্য পণ্য (জ্যাম, জেলি ইত্যাদি) তৈরি, মোড়কজাত ও বাজারজাতকরণ এবং রফতানির মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি লাভজনক উপায়ে করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ফলের বিশেষায়িত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে ফল চাষের বিভিন্ন উপকরণ, উৎপাদিত ফলের বাছাই, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং বড় পরিসরে যান্ত্রিক-বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফল চাষ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের জন্য ফলের সরবরাহ ও রফতানির বৃদ্ধি, ফল উৎপাদন বিষয়ক কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং সংযোগ চাষিদের দল গঠন প্রভৃতি কার্যক্রম সম্পন্ন করাও সুবিধাজনক হবে।
বাংলাদেশের রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, খুলনা এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা আম চাষের জন্য প্রসিদ্ধ, উল্লিখিত এলাকায় আম উৎপাদনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ-কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় লিচু উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এসব এলাকায় লিচু চাষ সম্প্রসারণ এর জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করার মাধ্যমে লিচুর উৎপাদন বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব। মধুপুর অঞ্চল, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে আনারস চাষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে নাটোর, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, পাবনা ও বরিশাল অঞ্চল পেয়ারা চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী বিধায় এসব এলাকায় পেয়ারা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (জ্যাম, জেলি, জুস ইত্যাদি) কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, নোয়াখালী, ও কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে নারিকেল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এলাকা রয়েছে। উল্লিখিত এলাকায় আম, আনারস এবং পেয়ারার বাণিজ্যিক উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড় এ কমলা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী যেখানে কমলা চাষের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পুষ্টিমান ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে কাঁঠাল একটি সম্ভাবনাময় ফল। উন্নত পুষ্টিমানের পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠাল ও বিচি উপাদেয় তরকারি। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ ফল গাছ থেকে উন্নতমানের কাঠও পাওয়া যায়। কাঁঠালের অভক্ষণ যোগ্য অংশ উত্তম গো-খাদ্য ও কাঁঠাল পাতা ছাগলের প্রিয় খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইহা গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পরাগায়নজনিত সমস্যা ও সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে অনেক সময় কাঁঠালের ফলন ও আকার-আকৃতি ভাল হয় না। উঁচু ও সুনিষ্কাশিত অম্ল দো-আঁশ মাটিতে কাঁঠাল ভালো হয়। দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়নের দরুন অনেক কাঁঠাল বাগান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাঁঠালের রসের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন জ্যাম-জেলি তৈরি করতে পারলে সারা বছর ব্যবহার, বাজারজাতকরণ ও রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট আকার ও গুণগত মান সম্পন্ন রোয়া পাওয়া এমন জাত নির্বাচন-উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ দরকার। সুষম সার প্রয়োগ ও আন্তঃপরিচর্যার মাধ্যমে কাঁঠালের ফলন বহুলাংশে বৃদ্ধি সম্ভব। বাংলাদেশের ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলা ও যশোরে কাঁঠাল ভালো জন্মায়।
উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে প্রায়শই ন্যায্য বাজার মূল্য পান না চাষিরা। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ফল সংগ্রহোত্তর নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে ফল সংগ্রহ ব্যবস্থাও আধুনিক না হওয়ায় ক্ষতজনিত কারণে তাড়াতাড়ি সংক্রমণ ঘটে ও নষ্ট হয়ে যায়। ভরা মৌসুমে সব ফলের বিপুল সমারোহ ঘটে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার দরুন দাম কমে যায়। চাষিরা লোকসানের সম্মুখীন হন এবং ফল চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আধুনিক উপায়ে ফলের জুস, জ্যাম, জেলি, আচার প্রভৃতি তৈরি করে সংরক্ষণ ও রফতানি করতে পারলে ফল চাষে আরও অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। বহিঃবিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন। তাই দেশের বাইরেও বাংলাদেশী ফলের বেশ চাহিদা আছে। ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পেও ফলের ব্যবহার রয়েছে। এ দেশে ফল উৎপাদন মৌসুমভিত্তিক। অধিকাংশ ফলই যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু ও আনারস বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পরিপক্ব হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই এদের প্রাপ্যতা শেষ হয়ে যায়। অনেক অপ্রচলিত ও স্বল্পপ্রচলিত ফল যেমন- কুল, আমড়া, আমলকী, জলপাই, বেল, সফেদা, ডালিম, কামরাঙা ইত্যাদি রয়েছে যেগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎপাদিত হয়ে থাকে। অতএব মিশ্র ফল বাগান বা মৌসুমভিত্তিক একক ফল বাগান সৃজন করে সারা বছর পুষ্টি জোগান দেয়ার জন্য ফল উৎপাদন প্রয়োজন। আমরা অনেকেই চাহিদা মোতাবেক ফল খেতে পারি না। তাছাড়া বছরের কিছু সময় বিশেষ করে মধু মাসে বিভিন্ন ফলের সমারোহ থাকলেও সারা বছর কিন্তু ফলের প্রাচুর্য থাকে না। আমদানি করা বাহারি ফল কিছু কিছু দোকানে শোভা পেলেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে না। অথচ আমাদের ফলের চাহিদা নিত্যদিনের। ফল কম খাওয়ার কারণে একদিকে যেমনÑ স্বাভাবিক খাবারে বাড়তি চাপ পড়ছে, অন্যদিকে অপুষ্টিজনিত কারণে বিশাল জনগোষ্ঠী নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশজ ফলের পুষ্টিমান আমদানিকৃত বিদেশি ফলের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। আপেল-আঙুরের চেয়ে পেয়ারা, আমলকী, বেল, কলা, জাম ইত্যাদিতে খনিজ এবং ভিটামিন অধিক মাত্রায় রয়েছে। দেশজ ফলে পোকা ও অন্যান্য রোগ বালাইয়ের প্রকোপ কম হয় এবং আবহাওয়ার বৈরী পরিবেশেও খাপ খাওয়াতে পারে। প্রচলিত ফলের মতো অপ্রচলিত ফল চাষের তেমন গুরুত্ব না পাওয়ার দরুন দেশ থেকে অনেক প্রজাতির ঐতিহ্যবাহী ফল বিলুপ্তি হতে চলেছে। এসব ফল রক্ষা করার লক্ষ্যে হাইব্রিড উন্নতজাতের চারা-কলমের পাশাপাশি এগুলোর চাষে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।
উন্নতজাত, মান সম্পন্ন চারা-কলম ও নিবিড় পরিচর্যার অভাব এবং বৈরী আবহাওয়ার দরুন আমাদের দেশে ফলের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। ফলের উন্নত এবং স্থান-অঞ্চল উপযোগী জাত, আধুনিক পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি সারা দেশের ফল চাষিদের দোরগোড়ার পৌঁছানোর মাধ্যমে দেশে ফলের উৎপাদান বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণ, জনগণের পুষ্টি নিশ্চিত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বনজ বৃক্ষের পাশাপাশি দেশে আরও অধিক হারে ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা দরকার। বসতবাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ সহজে জন্মে। দেশের ২ কোটি ২৫ লাখ বসতবাড়িতে ক্ষুদ্র পরিসরে ফল বাগান স্থাপন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণসহ বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে। গ্রামের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের বসতবাড়ি ও ছাদে ফল বাগান স্থাপন দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে বনায়নের ক্ষেত্রে শুধু টিম্বার বা কাঠ উৎপাদনশীল বিদেশি গাছের পরিবর্তে কাঠ ও ফল দুটোই পাওয়া যায় এমন দেশি গাছ রোপণকে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। বর্তমান কৃষকবান্ধব সরকার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। বিদেশি ফলের আমদানি নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সমন্বিত মানসম্মত উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। অধিদফতর ৭২টি হর্টিকালচার সেন্টারে চারা কলম উৎপাদন, বৃক্ষ ও ফল মেলা উদযাপন এবং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রদর্শনী স্থাপন ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ফলের আবাদ বৃদ্ধির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন বৃক্ষ রোপণের কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো বাগানের পরিচর্যার লক্ষ্যে বৃক্ষ রোপণ আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, সম্ভাবনাময় এলাকায় ফল উৎপাদনের বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাণিজ্যিক ফল বাগান স্থাপন এবং বসতবাড়িতে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লিখিত কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
এ জেড এম মমতাজুল করিম*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
আম বাংলাদেশের প্রধান ফল, গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ফলের মধ্যে আম সবার সেরা, ফলের রাজা। নানা আকারের বাহারি আম অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিতে ভরপুর। আমে রয়েছে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে এতে ভিটামিনস ও মিনারেলসের পরিমাণ অনেক বেশি। এককালে বৃহত্তর রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও রংপুর জেলা উন্নতমানের আমের জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকা প্রধানত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি, হিমসাগর, মোহনভোগ, গোলাপ খাস, সূর্যপুরি, মিসরি ভোগ, আশ্বিনাসহ প্রায় কয়েক শ’ জাতের আম উৎপাদনে অগ্রগামী ছিল। দেশের অন্য প্রান্তের জনসাধারণ মধুর মাস জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণে রাজশাহী অঞ্চলের সেরা আমের জন্য অপেক্ষা করত। পরে আম সম্প্রসারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচিতে আম্রপলি জাতের আমটিকে দেশের সব প্রান্তে সম্প্রসারণে প্রাধান্য দেয়া হয়। ফলে দেশের শুধু উত্তরাঞ্চলে নয়, বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগাম এবং বরিশাল অঞ্চলের জেলাগুলোতেও এ জাতের আম প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এ বিশেষ কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বর্তমানে মোট যে আম উৎপাদন হচ্ছে তার প্রায় শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই আম্রপলি জাতের আম।
মানবজাতির সৃষ্টি ও বিকাশের সাথে ফল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আদি মানব, আদম ও হাওয়া সৃষ্টির পর বাগানে বিচরণ করতেন এবং বিভিন্ন ফল আহার করতেন। বাগানে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার অপরাধেই মানবজাতির এ সুন্দর পৃথিবীতে আগমন। পৃথিবীতে এসেও প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকা ফলমূল আহরণ ও ভক্ষণ করেই তাদের বাঁচতে হয়েছে। ফলে তারা এসব ফলের পরিচর্যা শুরু করে দেয়। কাজেই ইতিহাসের দিক থেকেও বিবেচনা করলে ফল তথা উদ্যান বিজ্ঞানের বিকাশ কৃষি বিজ্ঞানেরও আগে। আর এ প্রাচীনতম বিজ্ঞানকে যারা দৈনন্দিন ও জাতীয় জীবনে যথার্থ স্থান দিয়েছে তারাই দুনিয়াতে স্বাধীন ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
ফল, আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত। কথায় আছে ‘ফলই বল’। আদিকালে মানুষ বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত এবং ফল খেয়েই জীবনধারণ করত। বর্তমান সোগ্লান হচ্ছে
যেসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না; দেশের সব এলাকায় জন্মে না; গাছের দেখা মেলে খুব অল্প; চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনে বাদাড়ে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে; প্রগতির ধারায় কেউ এদের পরিকল্পনায় আনে না; চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না; কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিয়ামক, ধাতব ও অন্যান্য প্রাণরাসায়নিক দ্রব্যদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না; অতীতে ফলের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় সেসব ফলের অনেকই দেশ থেকে বিল্প্তু হয়ে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে; এমন ফলকে বিলুপ্তপ্রায় ফল বলা হয়। যেমন- টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দেশীয় ফলের প্রচুর বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এদেশে প্রায় ৭০ প্রজাতির ফল জন্মে এবং প্রতিটি প্রজাতিতে আবার প্রচুর ভিন্নতা (variability) রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে কিছু প্রজাতি এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান এসব মূল্যবান জার্মপ্লাজম থেকেই উন্নতমানের জাত উন্নয়ন সম্ভব। ফলের জাত উন্নয়নের জন্য যেসব পদ্ধতি সচরাচর অবলম্বন করা হয় সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার**
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
(Hot Water Treatment Technology for Mango)
আম একটি দ্রুত পচনশীল ফল। সংগ্রহ মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা উভয়ই বেশি থাকে বলে আম পচা ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট আমের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়। প্রধানত বোঁটা পচা ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণে আম নষ্ট হয়। আম সংগ্রহকালীন ভাঙা বা কাটা বোঁটা থেকে কষ বেরিয়ে ফলত্বকে দৃষ্টিকটু দাগ পড়ে । ফলত্বকে নানা রকম রোগজীবাণুও লেগে থাকতে পারে এবং লেগে থাকা কষ রোগ সংক্রমণে সহায়তা করতে পারে। এজন্য আম পরিষ্কার পানি দ্বারা ধোয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঠাণ্ডা পানিতে ধুলে কষ দূর হলেও রোগাক্রমণ খুব একটা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সেজন্য আম হালকা গরম পানিতে ধোয়া উচিত। রোগ নিয়ন্ত্রণ, গুণাগুণ রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পাকা ও সংরক্ষণশীলতা বৃদ্ধিতে আমের হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বেশ কার্যকরী। আবার ঠাণ্ডা বা গরম পানিতে নির্ধারিত মাত্রায় সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড মিশিয়ে ওই মিশ্রণে আম চুবিয়ে রেখেও ধৌতকরণ করা যায় এবং ভালো ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের পরীক্ষায় ‘ফজলি’ আমের ক্ষেত্রে গরম পানিতে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড মিশিয়ে কার্যকরিতা অধিক পাওয়া গেছে। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জাতের ওপর নির্ভর করে ৫২ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ৫ মিনিট ধরে আম শোধন করলে বোঁটা পচা রোগ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করা যায়। এভাবে আম নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য গরম পানিতে আম শোধন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।