Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

টাওয়ার-পদ্ধতিতে-সবজি-চাষ

টাওয়ার পদ্ধতিতে 
সবজি চাষ
তাহসীন তাবাসসুম
লবণাক্ত এলাকায় সবজি চাষ করাটা কৃষকের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জের বিষয় কারণ, সেখানকার মাটির লবণাক্ততা। সেক্ষেত্রে মাটির সবজি টাওয়ার হতে পারে একটি যুগান্তকারী উপায় যা কি না বারোমাস সবজি চাষ করতে আমাদের কৃষক ও কৃষাণী ভাই বোনদের সহায়তা করবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে মাটি যেমন লবণাক্ত হয়ে থাকে তেমনি বরিশাল বা ঝালকাঠির মতো জেলাগুলোতেও বর্তমানে প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে জায়গা জমি প্লাবিত হচ্ছে। লবণাক্ত মাটি বর্ষাকালে সবজি চাষের উপযোগী হলেও শীত বা গ্রীষ্মে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে সবজি চাষের অনুপোযুক্ত হয়ে পরে। একইসাথে পানি জমা জায়গাগুলোতেও সবজি চাষ করা কঠিন হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে মাটি উঁচু করে উলম্ব পদ্ধতিতে সবজি চাষ করার পদ্ধতিটিই হচ্ছে টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ। বাঁশ ও গাছের ডাল দিয়ে বৃত্তাকারে স্ট্রাকচার তৈরি করে মাটি দিয়ে ভরাট করে সেই উঁচু জায়গায় এবং তার গায়ে সবজি গাছ লাগিয়ে এরকম জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে সবজি উৎপাদনের এই পদ্ধতি উপকূলীয় এলাকায় কৃষকদের কাছে একটা যুগান্তকারী পদ্ধতি হয়ে উঠেছে। 
টাওয়ার পদ্ধতিতে চাষযোগ্য সবজি
গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ খরিপ-১ মৌসুমে মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙা, করলা, ধুন্দুল, শসা, বরবটি, মাচার পুঁইশাক ইত্যাদি লতানো সবজির চাষ করা যায়। এছাড়া ঢেঁড়স, বেগুন, মরিচ ইত্যাদিরও চাষ করা যায়। বর্ষাকালে বা খরিপ-২ মৌসুমে চাষ করা যায় চালকুমড়া, পুঁইশাক, গিমাকলমি ইত্যাদি। শীতকালে বা রবি মৌসুমে বেগুন, টমেটো, শিম, লাউ ইত্যাদি চাষ করা যায়। টাওয়ারের গায়ে মাঝে মাঝে ফুটো করে সেখানে গিমাকলমি, মুলাশাক, ধনিয়াপাতা, পুঁইশাক, মরিচ ইত্যাদির বীজ বোনা যেতে পারে। 
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন
সাধারণত বসতবাড়ির খোলা উঠান টাওয়ার তৈরির জন্য আদর্শ স্থান। উঠানের একপাশে খোলামেলা বা দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ পড়ে এমন স্থান টাওয়ার তৈরির জায়গা হিসেবে বেছে নিতে হবে। খোলা মাঠে টাওয়ার বানাতে চাইলে সেক্ষেত্রে যেসব জমি বছরের বেশ খানিকটা সময় স্বল্প গভীরতায় জলমগ্ন ও লবণাক্ত থাকায় সেখানে সবজি চাষ করা যায় না সেরূপ জমিতে টাওয়ার তৈরি করে সবজি করা লাভজনক হতে পারে। এমনকি বন্যাপ্রবণ এলাকার জমিতেও উঁচু মাদা বা টাওয়ার তৈরি করে সবজি চাষ করা যায়। এরূপ এলাকার মাঠে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য সারি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে টাওয়ার বা উঁচু মাদা তৈরি করতে হবে। 
টাওয়ার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
টাওয়ার তৈরির জন্য যে উপকরণ লাগবে সেগুলো সাধারণত বাড়িতেই পাওয়া যায়। যেমন- বাশের খুঁটি, কাফিলার কচা, বাশের চেরা, পলিথিন, ইটের খোয়া, মাটি, গোবর, পচা বা শুকনা কচুরি পানা, রশি, ৬ ইঞ্চি ব্যাসের প্লাস্টিক পাইপ এবং বিভিন্ন সার যেমনঃ  ইউরিয়া ৪০০ গ্রাম, টিএপি ২৫০ গ্রাম এবং এমওপি সার- ২৫০ গ্রাম। 
টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষের নিয়ম
যে জায়গায় টাওয়ার তৈরি করা হবে সে জায়গায় গোলাকার একটি বৃত্ত এঁকে নিতে হবে। ২৫ সেমি দূরত্ব নিয়ে পরপর একটি বাঁশ ও একটি কাফিলার কচা অর্থাৎ জিগা গাছের কচি ডাল দিয়ে ঘেরা তৈরি করতে হবে। এরপর নরম মাটি দিয়ে খুঁটির গোড়া শক্ত করে দিতে হবে। ঘেড়ার ভেতর পলিথিন দিয়ে এবার গোবর ও অন্যান্য সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে টাওয়ার একফুট পূর্ণ করে মাঝখানে প্লাস্টিক এর পাইপ বসিয়ে তার ভেতর ইটের খোয়া দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। পাইপের চারপাশে মাটির মিশ্রণ দিয়ে টাওয়ারটি ভরাট করার পর পাইপটি তুলে ফেলতে হবে। পাইপ না থাকলে সেক্ষেত্রে একটি কলাগাছের বগি রেখে মাটি ভরাট করলে এবং পরবর্তিতে বগিটি উঠিয়ে ফেললে যে গর্ত হয় সেই গর্ত খোয়া দিয়ে পূর্ণ করলেও হবে।
টাওয়ার পদ্ধতিতে চাষের সুবিধা
এ পদ্ধতিতে লবণাক্ত মাটিতেও যেমন সবজি চাষ করা যায় তেমনি জলাবদ্ধতা, জলমগ্নতা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঢল, খরা ইত্যাদি পরিস্থিতিতেও সবজি চাষ করা যায়। অল্প জমিতে সবজি চাষ, আগাম বা নাবি সবজি চাষের ক্ষেত্রে; পাশাপাশি চাষের খরচ, সেচ ও সার প্রয়োগ কমাতে এই পদ্ধতি উপযোগী। আবার টাওয়ারের ভেতরে খোয়া বসানো জায়গায় খুব সহজেই সার মিশ্রিত পানি ঢেলে দিলে তা সমগ্র মাটিতে ছড়িয়ে পরে। যার ফলে সেখান থেকে গাছ অতি সহজেই তার প্রয়োজনীয় পানি ও সার নিয়ে নিতে পারে। এ ছাড়া এ পদ্ধতিতে নিবিড় তদারকিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা যায়। একইভাবে বসতবাড়িতে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে পারিবারিক সবজির চাহিদার অনেকাংশ যেমন- পূরণ করা যায় তেমনি অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয়ও বাড়ানো যায়।
টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষে সফলতা
ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন প্রকল্পের আওতায় বস্তা ও টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা গ্রামের কৃষক মোঃ মহারাজ মোল্লা দম্পতি। 
তিনি কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে বাড়ির আঙিনাসহ ঘরের আশপাশের পতিত জমিতে বস্তা টাওয়ার পদ্ধতিতে শসা, লাউ, চিচিঙ্গা, বরবটি, ঝিঙাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষ করে ভাল ফলন পেয়েছেন। যা নিজেরা খেয়ে বাজারে বিক্রিও করছেন তারা। নিজ আঙিনায় মহারাজ মোল্লার বস্তা ও টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ দেখে এই চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অনেকে। আষাঢ়ের প্রথম দিকে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ১০ প্রকারের বীজ এবং ২৬টি বস্তা ও একটি টাওয়ার নিয়ে বাড়ির ৩৩ শতক জমির ঘর ও পুকুর বাদে বাকি সব জমিতেই সবজি চাষ করেন মহারাজ মোল্লা ও তার স্ত্রী সাহেরা বেগম। এর মধ্যে তারা বাড়ির আঙিনায় বস্তা ও টাওয়ারের উপরে নেটজাল টানিয়ে লাউ, চিচিঙ্গা, ঝিঙা ও শসা চাষ করেন। এ ছাড়া বাড়ির আশপাশের জমির মাটিতে আলাদা শেড করে ওলকপি, ঢেঁড়স, বরবটি, বেগুন, করলা ও শিম চাষ করেন। 
এ ব্যাপারে মহারাজ মোল্লা জানান, তিনি একজন কৃষক। কিন্তু এর আগে জানতেন না যে বৃষ্টির পানি জমে এমন নিচু জমিতে বস্তা দিয়ে সবজি চাষ করা যায়। তাই তিনি কৃষি অফিসের পরামর্শে বস্তা টাওয়ার ও ১০ প্রকারের বীজ নিয়ে ঘর ও পুকুর বাদে বাড়ির বাকি জমিতে সবজি চাষ করেন।
মহারাজ মোল্লার স্ত্রী সাহেরা বেগম এ প্রযুক্তি ব্যবহারে নারী হিসেবে কতটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন, প্রশ্নের উত্তরে জানান। নারীরা সাধারণত মাঠে গিয়ে কাজ করতে পারে না। তাই ঘরের আঙিনায় চাষ করে। টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
উপকূলীয় অঞ্চল খুলনায় সবজি চাষ সব মৌসুমেই ঝুঁকিপূর্ণ। শীত ও বসন্তকালে লবণাক্ততা, খরা ও বর্ষায় জমি কাদা ও জলমগ্ন হওয়ায় অধিকাংশ সবজিগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে সবজি চাষের জন্য কৃষকদের বাড়ির উঠানে টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ হতে পারে একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি।

লেখক : প্রকাশনা কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭২০২৫২৭৬৫ ই-মেইল :subhathashin@gmail.com