গমের ব্লাস্ট রোগ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ ড. মো: হুমায়ুন কবীর
গম ধানের পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এবং এই উচ্চ জনবহুল দেশের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গম মোট ফসলি জমির ৩% এবং রবি মৌসুমে ১১% দখল করে আছে এবং বাংলাদেশের মোট শস্য উৎপাদনের ৭% অবদান রাখছে (বিবিএস-১০১৭ এবং গেইন রিপোর্ট-০৪-০৩-২০১৮)। ২০২১-২০২২ মৌসুমে গমের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৩.১৯৮ লক্ষ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন ছিল ১১.৬৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন (কৃষি ডাইরি, ২০২৩)। বার্ষিক ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয় (ঞযব ইঁংরহবংং ঝঃধহফধৎফ, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩)। ঋঅঙ এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বে বর্তমানে গমের উৎপাদন ৬৪২ মিলিয়ন টন থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮৪০ মিলিয়ন টন গমের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা মেটাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের গমের উৎপাদন ৭৭% বৃদ্ধি করা উচিত এবং চাহিদার ৮০% এর বেশি উল্লম্ব সম্প্রসারণ থেকে আসা উচিত ।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ গমের দিকে ঝুঁকছে, ফলে গমের চাহিদা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক নাজমা শাহিন। আজকাল মানুষ কম ভাত খায়, কারণ গমে বেশি প্রোটিন থাকে এবং বেশি শক্তি জোগায়। অন্যদিকে, ভাতে স্টার্চ থাকে যা ডায়াবেটিস হতে পারে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভাতের পরিবর্তে রুটি (চ্যাপ্টা রুটি) খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে অনেকেই দিনে একবার ভাত ও অন্য দুই বেলা রুটি খান। এইভাবে দেশে রুটি এবং গমের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে (দৈনিক প্রথম আলো, ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯)। চাহিদা পূরণ ও আমদানি হ্রাসকল্পে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার গম উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
কৃষি বিপ্লবের শুরু থেকে, আমাদের গ্রহে কিছু ভয়ঙ্কর ফসলের রোগ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যার ফলে দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আলুতে নাবি ধসা রোগের কারণে ১৮৪৫ সালে মহান আইরিশ দুর্ভিক্ষ (এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৯৯) এবং ১৯৪৩ সালে ধানের ব্রাউন স্পট রোগের কারণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল (এযড়ং, ১৯৫৬)। বিগত কিছু বছর এবং সম্প্রতি অতি ক্ষতিকর গমের ব্লাস্ট রোগের নতুন উত্থান এবং পুনঃউত্থান যা একটি ফিলামেন্টাস ছত্রাক গধমহধঢ়ড়ৎঃযব ড়ৎুুধব ঞৎরঃরপঁস (ওমধৎধংযর, ১৯৮৬) এর স্বতন্ত্র প্যাথোটাইপের কারণে ঘটে।
একটি সমীক্ষা ইঙ্গিত করে যে দক্ষিণ এশিয়ার গম উৎপাদনকারী এলাকার ৬০% গম ব্লাস্ট সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, গম চাষের ব্লাস্ট-সংবেদনশীল এলাকা প্রায় ৬৫%। সেই সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে প্রায় ৭ মিলিয়ন হেক্টর গম চাষের এলাকা এখনও ব্লাস্ট রোগের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
১৯৮৫ সালে পারানা ব্রাজিল রাজ্যে গমের ব্লাস্ট রোগের প্রথম আক্রমন দেখা যায়, তারপর থেকে ছত্রাকটি বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনায় ছড়িয়ে পড়ে যা গম চাষের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০০৯ সালে সেই বিপর্যয়ের কারণে ব্রাজিলের এক-তৃতীয়াংশ গম ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল (কড়যষর,২০১১).
২০১৬ সালে, বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, বরিশাল, ভোলা এবং দক্ষিণের অন্যান্য জেলায় হঠাৎ করে গমের ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয় (ঋঅঙ রিপোর্ট, ২০১৬)। গধমহধঢ়ড়ৎঃযব ড়ৎুুধব ঞৎরঃরপঁস কার্যকারণ ছত্রাক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল (মালাকার ২০১৬)। ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের মোট গম উৎপাদনকারী এলাকার প্রায় ২০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা দেশের সামগ্রিক গম উৎপাদনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে (গবধয, ২০১৬)। ২০১৭ সালে (ডেইলি স্টার রিপোর্ট, জানুয়ারি, ২০১৭) এই কয়েকটি জেলায় এই রোগটি আবার দেখা দেয়। ২০২০-২১ (গবধয, ২০২১) মৌসুম পর্যন্ত ও পরবর্তী বছরগুলোতে গমের ব্লাস্ট রোগ অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশে গমের গমের ব্লাস্ট রোগ এর প্রাদুর্ভাব আন্তর্জাতিক ভুট্টা এবং গম উন্নয়ন কেন্দ্র (ঈওগগণঞ) বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করেছে যে এই অঞ্চলে একই রকম আবহাওয়ার কারণে গমের ব্লাস্ট রোগ থেকে এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে (ঈওগগণঞ, ২০১৬)। বাংলাদেশ গম এবং ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইডগজও) এর উদ্ভিদ রোগ বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করেছেন যে এই রোগটি ভারত, পাকিস্তান এবং চীনে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা বিশ্ব গম উৎপাদনে যথাক্রমে তৃতীয়, সপ্তম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে (মুন্ডি, ২০১৬)।
বিধ্বংসী ব্লাস্ট রোগের সমস্যায় যদি গম চাষ করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এইভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনভাবেই সম্ভব না। গমের ব্লাস্ট রোগ এখন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। একটি অরক্ষিত পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান গম চাষে এই বিপদ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। সুতরাং, গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পরিকল্পনা ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ খুবই জরুরি।
গমের ব্লাস্ট রোগের অনুকূল অবস্থা
উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া;
ফুল ফোটার সময় ১৮-২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশ কয়েক দিন একটানা বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা, তারপরে গরম, রোদ ও আর্দ্র দিন খুবই অনুকূল;
সংক্রমণের জন্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ৩২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোত্তম ২৫০ -৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস;
উচ্চ নাইট্রোজেন প্রয়োগ, বায়বীয় মাটি এবং খরার চাপ ব্লাস্ট রোগে সহায়ক হিসাবে কাজ করে;
উচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতা যা স্পোরুলেশনের জন্য প্রয়োজন;
অ্যাপ্রেসোরিয়াম ফাংশন এবং স্পোর রিলিজের জন্য বৃষ্টি ভারী শিশির প্রয়োজন।
ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ
ক) ব্লিচড স্পাইকস এবং স্পাইকের গোড়ায় কালচে ধূসর বর্ণের দাগ (গমের ব্লাস্টের সাধারণ লক্ষণ) খ) গমের ব্লাস্টের প্যাচ গ) চোখের আকৃতির পাতায় গাঢ় ধূসর দাগ ঘ) কা-ে গাঢ় ধূসর চোখের আকৃতির ক্ষত ঙ) ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত গমের বীজ চ) জীবাণু (ঈড়হরফরধ ড়ভ গড়ঞ)
প্রতিরোধ
গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী (বারি গম ৩৩ এবং বিডব্লিউএমআরআই গম ৩) ও সহনশীল ( বারি গম ৩০, বারি গম ৩২ এবং বিডব্লিউএমআরআই গম ২) চাষ করতে হবে।
যেকোন উৎস থেকে গমের বীজ ব্লটার পদ্ধতিতে গড়ঞ-এর জন্য পরীক্ষা করা উচিত এবং সুস্থ বীজ না পাওয়া গেলে ১ কেজি বীজের জন্য ছত্রাকনাশক প্রোভাক্স (কার্বক্সিন ১৭.৫%+থিরাম ১৭.৫%) @ ২.৪-৩ গ্রাম দিয়ে বীজ শোধন করা উচিত।
সরিষা, আলু, মসুর, মরিচ ইত্যাদির মতো অ-শস্যজাতীয় ফসলের সাথে ফসলের আবর্তন বা শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা উচিত।
সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যাবে না।
গমের ক্ষেত এবং আইল আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
১৫-৩০ নভেম্বর এর মধ্যে গম বপন করতে হবে।
গমের খড় ক্ষেত থেকে অপসারণ করতে হবে।
সিলিকন (সুপার সিলিকা) ১০০ কেজি/হেক্টর, জিংক (চিলেটেড জিংক) ১১.৫ কেজি/হেক্টর এবং বোরন (সলুবোর বোরন) ৬ কেজি/হেক্টর এর সম্মিলিত প্রয়োগ রোগকে একটি গ্রহণযোগ্য স্তরে বা অন্ততপক্ষে এমন একটি স্তরে কমাতে পারে যেখানে অন্যান্য কালচারাল অনুশীলন দ্বারা আরও নিয়ন্ত্রণ, কম ব্যয়বহুল এবং পরিবেশবান্ধব করা যায়।
গমক্ষেতের কমপক্ষে ২ কিলোমিটারের এর মধ্যে বার্লি চাষ করা উচিত নয়।
মনিটরিং
নিয়মিত গমক্ষেত মনিটরিং করতে হবে।
গমের প্রি- হেডিং, হেডিং এবং মিল্ক স্টেহজ পর্যন্ত প্রতিদিন মাঠ মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
গমের নাড়া পুড়িয়ে দিতে হবে।
সরাসরি নিয়ন্ত্রণ
বুটিং, প্রি-হেডিং (ফুল আসার আগে) এবং হেডিং (ফূল আসার সময়) পর্যায়ে ন্যাটিভো (টেবোকোনাজল ৫০%+ ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন ২৫%) @০.৬ গ্রাম/লি. অথবা ফিলিয়া (ট্রাইসাইক্লাজল ৪০% + প্রোপিকোনাজল ১২.৫%) ২.০ মিলি/লি. অথবা সানফাইটার (হেক্সাকোনাজল ৩%+ ট্রাইসাইক্লাজল ২২%) ২.০ মিলি/লি. পানির সাথে মিশিয়ে ফলিয়ার স্প্রে করতে হবে। প্রি-হেডিং এর সময় একটি স্প্রে এবং এর ৭দিন পর হেডিং এর সময় আরেকটি স্প্রে খুবই কার্যকর । দানা গঠনের পর্যায়ে রাসায়নিক স্প্রে গড়ঞ সংক্রমণ প্রতিরোধ/বন্ধ করবে না কিন্তু উৎপাদন ক্ষতি কমিয়ে দিবে।
আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ফিলিয়া (ট্রাইসাইক্লাজল ৪০% + প্রোপিকোনাজল ১২.৫%) ২.০ মিলি/লি. এবং সেলটিমা (পাইরাক্লোস্ট্রবিন ১০%) ২.০ মিলি/লি. ককটেল এর দুই থেকে তিনটি স্প্রে (বুটিং- হেডিং পর্যায়ে) ব্লাস্টের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে।
পরিবেশ বান্ধব ট্রাইকোডার্মা- ৫মিলি/লি.(১০৭ ংঢ়ড়ৎবং/সষ) হারে তিনদিন পরপর ৪ বার (বুটিং থেকে হেডিং পর্যায়ে) স্প্রে করলে ব্লাস্ট এর তীব্রতা প্রায় ৪২% হ্রাস পায়।
লেখক: সহকারী প্রকল্প পরিচালক, ফ্লাড রিকনস্ট্রাকশন এমারজেন্সি এসিস্টেন্স প্রজেক্ট (ফ্রিপ), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১২৫৩৭৩৬৪, ই-মেইল:humayun7364@gmail.com