পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের বীজ
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মাননিয়ন্ত্রণ
কৃষিবিদ ড. মোঃ আল-মামুন
বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসল চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষকের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় এ বছর পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের বীজের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারিত হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৯ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বিএডিসি সরবরাহ করবে ১ হাজার ৩০০ টন বীজ, আর প্রায় ৫ হাজার ২০০ টন বীজ ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২০২২-২৩ উৎপাদন বছরে ৪ হাজার ১৬৬ টন পাট ও কেনাফ ফসলের বীজ আমদানি করা হয়েছিল ভারত থেকে। এভাবে প্রতি বছর পাট ও কেনাফ বীজ আমদানি করতে প্রায় ৫ থেকে ৭ শত মিলিয়ন টাকার বিশাল বাজার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাছাড়া অনেক সময়ই কৃষক বীজের গুণাগুণ সম্পর্কে না জেনে, মাঠে বপন করে কাক্সিক্ষত ফলন না পেয়ে প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশে পাট ও কেনাফ বীজ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়া এবং নিজের বীজ নিজেই উৎপাদন করে কৃষকরা যাতে অধিক লাভবান হতে পারেন, সেজন্য উন্নতমানের পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের বীজ উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে তাদের ধারনা থাকা দরকার।
বীজ ফসলের পরিচর্যা এবং রোগবালাই দমন
মাঝে মাঝে আঁচড়া বা নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে রাখতে হবে। ২য় কিস্তির সার প্রয়োগের ২/১ দিন পূর্বে নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। শেষ বা ৩য় কিস্তির সার প্রয়োগের পূর্বে আর একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছে আগামরা বা কা- পচা রোগ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে রোগাক্রান্ত গাছসমূহ উপরে ফেলতে হবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রমণ রোধ করার জন্য ম্যানকোজেব গ্রুপের যেকোনো ছত্রাকনাশক ১০ লিটার পানি ২০ মিলি. ৭ দিন পরপর ০৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে। নাবি পাট বীজ ফসলে সাধারণত হলদে মাকড়ের আক্রমণের শুরুতে নিম পাতার নির্যাস (১ ভাগ কাচা নিম পাতার রস ২০ ভাগ পানিতে মিশিয়ে) স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সুস্থ ও নিরোগ বীজ বপন করলে এবং জমি পরিষ্কার রাখলে জমিতে রোগবালাই কম হবে।
বীজ ফসল থেকে ফসল সংগ্রহের সময়
পাটবীজ বেশি পাকলে ফল ফেটে বীজ জমিতেই ঝরে পড়ে অথবা ফলের খোসা ফেটে যায় এবং রাতের বেলায় কুয়াশার পানি চুইয়ে ফলের ভেতরে জমা হয়। ক্রমাগতভাবে কয়েকদিন কুয়াশার পানি ফলের ভেতর জমলে সেই বীজ খারাপ হয়ে যায়। আর কম পাকলে বীজ চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফল বাদামি রং ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ফসল কাটার জন্য শুকনা দিন বেছে নিতে হবে। বৃষ্টি ভেজা দিনে পাকা ফসলসহ গাছ না কাটাই উত্তম। বৃষ্টির পানি বীজের ভেতরে ঢুকলে ছত্রাক জাতীয় জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে বিধায় বীজের গুণগত মান কমে যায়। তাই ফসল সংগ্রহের সময় আবহাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার।
খুব সকালে পাট বীজ কর্তন করা উচিত নয়। পরিষ্কার দিন দেখে সকাল ১০টা থেকে পাট বীজ কর্তন করা ভালো। দিনের শেষ ভাগে ফল বেশি শুকনা অবস্থায় কর্তন করলে ফল ফেটে অনেক বীজ ঝরে পড়ে। বীজ ফসল কর্তনের সময় জমিতে মরা ও শুকনা গাছগুলো বাদে বীজ ফসল সংগ্রহ করতে হবে। মরা ও রোগাক্রান্ত গাছ একই সাথে কর্তন করলে সমস্ত বীজ রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। বীজ ফসলের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বীজ ফসল মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানো
ফলসহ গাছের ডগা সংগ্রহ করার পর স্তূপ আকারে জমা না করে, কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা করে রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাতের বেলা ত্রিপল দিয়ে গাছের ডগাসমূহ ঢেকে রাখতে হবে যাতে রাতের কুয়াশা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ক্রমাগতভাবে পাঁচ দিন রোদে শুকানোর পর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। গরু দিয়ে মাড়াই করা যাবে না। গরু দিয়ে মাড়াই করলে পাটের ছোট বীজ গরুর পায়ের চাপে নষ্ট হবে। মাড়াই করার পর বীজ ভালো করে পরিষ্কার করে শুকানোর জন্য পাকা থ্রেসিং ফ্লোরে ত্রিপল বা চটজাতীয় কোনো কিছুর উপর বীজ শুকাতে হবে। অন্যথায় গরম মেঝের সংস্পর্শে বীজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ ভ্রƒণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বীজ শুকানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গরম বীজ স্তূপ আকারে রাখা না হয়। প্রতিদিন বীজ শুকানো শেষে ঠা-া করে পলিথিন, চট বা ত্রিপল দিয়ে ভালো করে রাতের বেলা ঢেকে রাখতে হবে যেন কুয়াশা বা বৃষ্টিতে না ভিজে। বীজ ছাড়ানোর সময় বীজে পানির অংশ শতকরা ১২-১৫ ভাগ দেখা যায়। এই পানির ভাগ রোদে শুকিয়ে শতকরা ৭/৮ ভাগের মধ্যে আনতে হবে। সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের ডাল-পালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ্য পুষ্ট বা রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভালো করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
কৃষকপর্যায়ে পাট বীজের গুণগত মান পরীক্ষা
আমরা জানি যে ভালো মানের বীজ সব ফসলের বেলাতেই প্রায় শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বেশি ফলন দিয়ে থাকে। বীজ যত ভালো হবে তত তাড়াতাড়ি গজাবে। এটাই ভালো বীজের লক্ষণ। পাট, কেনাফ ও মেস্তা জাতের বীজ বপন করার আগে বীজের ভালোমন্দ বিশেষত অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নেয়া ভালো। খুব সহজে এবং অল্প খরচে এ কাজ করা যায়। প্রথমে একটি মাটির সানকিতে একপরত ভেজা কাপড় বা চোষা কাগজ (ব্লটিং পেপার) বা তা না থাকলে নিউজপ্রিন্ট ২/৩ পরত বিছিয়ে পানি দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে তার উপর ১০০ টি বীজ সুন্দর করে ছড়িয়ে দিতে হবে। সানকির তলায় যে জায়গা থাকে তাই ১০০টি বীজ ছাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। একটি সানকি বা সরা দিয়ে ঐ বীজ ওয়ালা সানকি ঢেকে দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন সানকির কাপড় শুকিয়ে না যায় অথবা বীজ পানিতে ডুবে না যায়। সে জন্য দিনে একবার দেখে, শুকিয়ে থাকলে দরকার মত পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বসানোর তিন দিন পর মোট যে কয়টি বীজ গজানো দেখা যাবে সেটাই হলো বীজ গজানোর শতকরা হার। শতকরা ৮০টির অধিক বীজ গজালে তাকে ভালো বীজ বলা যেতে পারে। যদি শতকরা ৭০টির অধিক কিন্তু ৮০টির কম বীজ গজায় তাহলে বীজ বপনের সময় বীজের অংকুরোদগমের অনুপাতে বীজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে বপন করতে হবে। শতকরা ৭০টির কম বীজ গজালে ঐ বীজ বপন না করাই ভালো।
কৃষকপর্যায়ে পাটবীজের সংরক্ষণ
বীজ সংরক্ষণের পূর্বে সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের ডাল-পালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ পুষ্ট বা রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভালো করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর শুকনো বীজকে দুই দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে যদি কট করে বীজটি ভেঙে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বীজ ভালো ভাবে শুকানো হয়েছে। শুকানোর পর বীজের আর্দ্রতা সাধারণত শতকরা ৮-৯ এর কাছাকাছি অবস্থায় টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের ক্যান, প্লাস্টিক ড্রাম ইত্যাদি বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করা ভালো। যদি বায়ুরোধী পাত্র না পাওয়া যায় তখন মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় বীজ রাখা যেতে পারে। তবে এসব পাত্রে বীজ রাখার পূর্বে মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় আলকাতরা বা রংয়ের প্রলেপ দিতে হবে অথবা বীজ রাখার পূর্বে মোটা পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঐ পাত্র মুড়ে দিতে হবে যাতে মাটির পাত্রটি বায়ুরোধী হয়। বড়পাত্রে অল্প পরিমাণ বীজ রাখা ঠিক হবে না। এতে পাত্রের খালি অংশের আর্দ্রতা বীজের গুণগত মান খারাপ করে দিতে পারে। সঠিক আর্দ্রতায়, সাধারণ তাপমাত্রায় লেমোফয়েল ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করলে ৩ বছর পর্যন্ত তা ভালো থাকে। বায়ুরোধী প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণকৃত বীজ ২ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। অন্যান্য পাত্র যেমন- পাতলা পলিথিন ব্যাগ, কাপড়/ছালা বা কাগজের ব্যাগ অথবা সরাসরি মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করলে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি বীজের জন্য ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে শোধন করে রাখলে বীজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং পরবর্তী বপন মৌসুমে বীজ ভালোভাবে গজিয়ে থাকে।
কৃষক ভাইয়েরা নিজেদের উদ্যোগে যে বীজ উৎপাদন করে থাকেন তা যদি উপযুক্ত সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে কর্তন এবং সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদিত বীজের গুণগত মান খারাপ হবে অন্যদিকে বীজের অপচয় হওয়ারও আশংকা থাকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদন বৃদ্ধিতে ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকদের কাছে সব সুবিধা দ্রুত পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের দেশে অন্তত ১০ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ সম্ভব। এছাড়া শুধুমাত্র ভালো মানের বীজ ব্যবহার করে শতকরা প্রায় ২৫-৩০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি করা যায়। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব পাট শিল্পের এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন দ্রুতই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে এবং বিশ্ববাজারে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইলঃ ০১৭১১১৮৬০৫১, ই-মেইল :almamunbjri@gmail.com