গ্রীষ্মকালীন টমেটোর
নীরব বিপ্লব
ড. মো. জামাল উদ্দিন
টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এবং বিজ্ঞানীদের নব নব উদ্ভাবনে এটি এখন গ্রীষ্মকালেও চাষাবাদ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মে থেকে জুলাই মাসে লাগানো জাতের টমেটো শীতের আগ পর্যন্ত সময়েও বাজারে পাওয়া যায়। ভারত থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আমদানি হলেও বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগের সহায়তায় দেশজুড়ে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড জাতের টমেটো কৃষক পর্যায়ে বিস্তার ঘটছে চোখে পড়ার মতো। টমেটো চাষে কৃষকের সফলতার গল্পও শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ যাবৎ বেশ কিছু গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব জাতের মধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, হাইব্রিড টমেটো-৮, হাইব্রিড টমেটো-১০ ও হাইব্রিড টমেটো-১১ দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তারমধ্যে বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ সর্বোচ্চ শিখরে রয়েছে বলে জানা যায়। বিগত কয়েক বছর থেকে মাঠ পর্যায়ে এসব জাতের বিস্তারও ঘটছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কৃষকও চাষাবাদ করে লাভের মুখ দেখছে।
টমেটো একটি পুষ্টিকর সবজিও বটে! ইউরোপে টমেটোর গুণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘টমেটো যদি লাল হয়, চিকিৎসকের মুখ হয় নীল।’ অর্থাৎ নিয়মিত টমেটো খেলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার হয় না। বারি সূত্র মতে, টমেটোতে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’সহ অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ইয়ুথ হেলথ ম্যাগ ও টাইমস অব ইন্ডিয়া তথ্য সূত্রে, টমেটোতে রয়েছে বয়স প্রতিরোধী বিশেষ প্রভাব। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন প্রোস্টেট, কলোরেকটাল বা পেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমিয়ে দেয়। শরীরের ত্বক কুঁচকে যাওয়া, ভাঁজ পড়া বা বলিরেখা পড়া দূর করতে পারে। টমেটো হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। টমেটোর মধ্যে থাকা ভিটামিন ‘বি’ ও পটাশিয়াম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। চোখের দৃষ্টি উন্নত করতে টমেটোর ভূমিকা অপরিসীম। তাই শিশুদের ডায়েটে টমেটো রাখতে পারলে উপকার মিলবে।
বর্তমানে দেশে বছরে ১৫ হাজার মেট্রিক টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদিত হচ্ছে, পাশাপাশি বিদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন টমেটো আমদানি করতে হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার, গাজীপুরে অনুষ্ঠিত ‘বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড টমেটো উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বাড়ানো গেলে কৃষকেরা যেমন লাভবান হবে একই সাথে আমাদের টমেটো আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ হচ্ছে। এ বছর আমরা বারির পক্ষ থেকে আমাদের নিজেদের উৎপাদিত হাইব্রিড টমেটোর বীজ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করেছি এবং আগামীতেও আমরা কৃষকদেরকে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ তুলে দিতে চাই। আমরা আশা করছি দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আমরা টমেটো রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাবো।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরার কৃষক। এ জেলার উৎপাদিত টমেটো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। ফলে দিন দিন দেশের বহু জেলায় গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের বারি টমেটো চাষের খুবই সম্ভাবনাময় জেলা সাতক্ষীরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ৭১২.৫০ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো চাষ হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন এর মতে, উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ খুবই লাভজনক একটি ফসল। তবে এটি উৎপাদন খরচের পরিমাণও অনেক বেশি। তার পরও হেক্টরে ৮/৯ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। উক্ত সূত্রমতে, সাতক্ষীরা জেলা কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় টমেটো আমদানি বন্ধ থাকায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি গ্রীষ্মকালীন টমেটো ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সাতক্ষীরা ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, যশোর, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায় এর বিপুল সাড়া পড়েছে। এক কথায় বলা যায় নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। এটি গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষিদের জন্য একটি সুখবরই বটে! সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, দৌলতপুর, খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনর রশিদ জানান সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় বর্তমানে বারি হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ এক হাজার বিঘা ছাড়িয়েছে যা ২০১৮ সালে ২৫ বিঘা ছিল। এক বিঘা জমিতে ‘গ্রীষ্মকালীন টমেটো’ চাষ করতে খরচ হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ফসল আসে তিন-চার লাখ টাকার। কখনো কখনো পাঁচ লাখও ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। এই মুহূর্তে অন্য কোনো ফসল এত লাভজনক নয়। তাই কৃষক বা উদ্যোক্তারা ঝুঁকছেন গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর গ্রামের উচ্চশিক্ষিত তরুণ কৃষি উদ্যেক্তা আহমদ নুর চলতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে ১০ শতাংশ জায়গায় গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটো-৮ চাষ করে এই পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কেজি টমেটো বিক্রি করেন। প্রতি কেজি টমেটো পাইকারি ৮০ টাকা দরে এবং খুচরা ১২০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরে তিনি বেশ খুশি। তিনি বলেন শীতকালীন টমেটোর চাইতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ অনেক লাভজনক। স্থানীয় কৃষি বিভাগের কাছ থেকে তিনি সকল ধরনের উপকরণ ও কারিগরি সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান। তার দেখাদেখি অনেক কৃষক এ জাতের টমেটো চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে মন্তব্য করেন হাটহাজারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন সিকদার। শুধু হাটহাজারী নয় পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও এর চাষ শুরু হয়েছে। এ জাতের টমেটো চাষে উপজাতি কৃষকদেরও বেশ সাড়া মিলছে।
দেশের চাহিদার আলোকে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়াতে ‘বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর অভিযোজন পরীক্ষা, উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কমিউনিটিভিত্তিক পাইলট প্রোডাকশন কর্মসূচি’ শীর্ষক সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারির তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন জেলার ৩৩টি উপজেলায় এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ঘটছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে আগ্রহী করে তুলতে প্রকল্প থেকে নিয়মিত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, উপকরণ সহায়তা, মাঠ দিবস ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। বারির সিনিয়র বিজ্ঞানী ও উক্ত কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. ফারুক হোসেন বলেন চাষের ব্যবস্থাপনা উল্লেখ করে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা শীতকালীন টমেটো চাষের ব্যবস্থাপনা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। দুটো পদ্ধতিতে এ গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো যায়। একটি হলো পলিশেড দিয়ে অপরটি হলো মাটিতে পলিথিনের মালচিং বিছিয়ে। শেষের পদ্ধতি খরচ সাশ্রয়ী। আর্লি উইন্টারে এ টমেটো পাওয়া যাবে, দামও বেশি পাবে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে পতিত জমিও চাষের আওতায় নিয়ে আসা সহজ হবে এবং জমির উত্তম ব্যবহারও সুনিশ্চিত হবে। এ ধরনের কর্মসূচির ব্যাপকতা বাড়ানো গেলে বারি উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাতসমূহ মাঠ পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং সারা বছরব্যাপী টমেটো সরবরাহ বাড়বে।
বারি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো কৃষক পর্যায়ে দ্রুত বিস্তার ঘটাতে হলে এর উৎপাদন খরচ কমাতে নি¤েœাক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তা হলো: কৃষক পর্যায়ে বারি হাইব্রিড জাতের টমেটোর গ্রাফটেড চারা ও বীজ উৎপাদনে কৃষককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তুলে কমিউনিটি এপ্রোচের মাধ্যমে এগোতে হবে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এসব জাত ও উৎপাদন কলাকৌশলের ওপর ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার; বেশি বৃষ্টিপাতকে এড়িয়ে কম বৃষ্টিপাতের সময়ে পলিশেড ছাড়াই পলি-মালচিং প্রয়োগ করে চারা লাগালে খরচ সাশ্রয় হবে; উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষক দলভিত্তিক কার্যকর বিপণন চ্যানেল তৈরি করে টমেটো বাজারজাত করতে পারলে লাভবান হবে বেশি; দেশীয় উৎপাদন বাড়লে আমদানি সীমিত রাখা এবং লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম চলমান রাখা দরকার মনে করেন।
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষকের আয় বাড়াতে, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বারি জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ বাড়ানো গেলে টমেটোর বছরব্যাপী দেশের চাহিদা পূরণ হবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমবে। সে সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। মোবাইল নং: ০১৮১৫৪২৫৮৫৭, ইমেইল: jamaluddin1971@yahoo.com