সবজি চাষে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং পেপার
ড. মোঃ আব্দুল মালেক
বর্তমানে দেশে উৎপাদিত সকল সবজিতেই ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রারিক্ত কীটনাশক, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কীটনাশক কম ব্যবহার করে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ অর্থাৎ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের জন্য দেশের কৃষিবিদগণ উদ্ভাবন করে চলেছে লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব নানা প্রযুক্তি। ফসল চাষে উদ্ভাবিত নানা পরিবেশ-বান্ধব কৃষি প্রযুক্তির একটি হলো বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং। এটি সবজি জাতীয় ফসলসহ বিশেষ করে স্ট্রবেরি চাষে বিজ্ঞাননির্ভর একটি আধুনিক চাষ পদ্ধতি। বর্তমানে সবজি চাষে জমি প্রস্তুতকরণে আধুনিক মালচিং পদ্ধতি কাজে লাগাচ্ছে অনেকে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজির ফলন ও দাম ভাল পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছেন দেশের কৃষকগণ। মালচিং করার জন্য সাধারণত যেসব মালচ উপাদান ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো- ধান বা গমের খড়, কচুরিপানা, গাছের পাতা, শুকনা ঘাস, কম্পোস্ট, ভালোভাবে পচানো রান্নাঘরের আবর্জনা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি সবজি চাষে মালচিং-এ পলিথিনের ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে। আর মালচিং পদ্ধতিতে বা মালচ হিসেবে পলিথিন ব্যবহার করা হলে তাকে পলিথিন মালচিং বলে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের মালচিং পেপার পাওয়া গেলেও এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পচনশীল অর্থাৎ বায়ো ডিগ্রেডেবল মালচিং পেপার আর তাই নির্বাহিত সবজি/ফল চাষে এ পচনশীল মালচিং পেপার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক সবজি চাষে এটি একটি পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি। এটি মূলত চীন ও জাপানে প্রচলিত পদ্ধতি হলেও বর্তমানে বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দেশের কৃষি বিভাগ বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহায়তায় দেশের কৃষকগণ বিভিন্ন স্থানে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে ভাল ফলাফল পেয়ে বেশ লাভবান হয়েছেন।
মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষে পরিমাণমতো পুষ্টি উপাদান বা খাবার হিসেবে জৈব ও বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করা হয়। জমি প্রস্তুতি শেষে বেড পদ্ধতিতে সারি তৈরি করে সারির প্রস্থ অনুযায়ী বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি কেটে (সারির প্রস্থের চেয়ে একটু বেশি) মাটির সারিগুলোর উপরিভাগ সমান করে ঢেকে দেয়া হয় এবং সারির দুই দিকের বায়ো ডিগ্রেডেবল পলিথিনের কিনারাও মাটি দিয়ে ভালভাবে ঢেকে দেয়া হয়। এরপর সারিগুলোর উপর বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি নির্দিষ্ট দূরত্বে ফুটো করে চারা রোপণ করা হয়। উল্লেখ্য, সবজির বৃদ্ধিভেদে সারি হতে সারির দূরত্ব এবং সারিতে ফুটো হতে ফুটোর দূরত্ব কমবেশি হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের বিশেষ সুবিধা হলো চারা রোপণের পর থেকে আর তেমন কোন পরিচর্যা প্রয়োজন হয় না। সারিগুলো পলি দিয়ে ঢাকা থাকায় আগাছার উপদ্রব হয় না, ফলে ফসলের পুষ্টি উপাদানের অপচয় না হওয়ায় সারের পরিমাণও কম লাগে। তাছাড়া মাটির সারিগুলো বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি দিয়ে ঢাকা থাকায় ফসলের জমির আর্দ্রতা সংরক্ষণে মালচিং বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এ প্রযুক্তি ব্যবহারে জমির মাটির আর্দ্রতা সূর্যের তাপ ও বাতাসে উড়ে অপচয় হয় না। এভাবে জমিতে রসের ঘাটতি না হওয়ায় সেচেরও তেমন প্রয়োজন হয় না আর সেচ লাগলেও তা অনেক কম পরিমাণে। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে সারের পরিমাণ কম লাগা, জমিতে আগাছা জন্মিতে না পারায় আগাছা নিয়ন্ত্রণে শ্রমিকের তেমন প্রয়োজন হয় না বিধায় উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়।
শীতকালে বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হয়, যা ফসলের জন্য বেশ উপকারী এবং গরমকালে মাটি অনেকটা ঠা-া রাখে যা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাছাড়া বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং পদ্ধতিতে ফসল চাষে পোকা-মাকড়ের আক্রমণও অনেকটাই রোধ করা যায়। বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং পেপার ব্যবহার করলে বৃষ্টিতে মাটির ক্ষয় রোধ হয় এবং মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং গরম ও ঠান্ডায় মাটির তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে ইনসুলেটর হিসেবে কাজ করে, বাষ্পীভবন হ্রাস পাওয়ায় মাটি অনেকদিন পর্যন্ত পানি ধরে রাখে, উচ্চ তাপমাত্রায় মাটির পৃষ্ঠভাগ ফেটে যাওয়া এবং মাটির উপরিভাগে কঠিন স্তর সৃষ্টিতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে মাটির ভঙ্গুরতা রক্ষা করে কর্ষণে সহায়তা করে। তাছাড়া এধরনের মালচিং মাটিতে আলো পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগমে বাঁধার সৃষ্টি করে, ফলে জমিতে আগাছার উপদ্রব হয় না।
দেশের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর অর্থায়নে সমন্বিত কৃষি ইউনিটের আওতায় ৩৭টি সহযোগী সংস্থার ২১৫টি শাখার মাধ্যমে দেশের মোট ২৬টি কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে ৩৪টি জেলার নির্বাচিত অনেক কৃষক বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। আর এর কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছেন সহযোগী সংস্থা নিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তাবৃন্দ ও সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ। কম খরচে বেশি ফলনসহ পরিবেশবান্ধব বায়ো ডিগ্রেডেবল পলি মালচিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের উচ্চমূল্যের সবজি বিশেষ করে করল্লা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স, স্কোয়াশ, ব্রোকলি, শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, মরিচ, বেগুন, ঝিঙা, ধুন্দল, পটোল, চিচিঙ্গা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া চাষ এবং ফল বিশেষ করে স্ট্রবেরি চাষে সারাদেশে পদ্ধতিটি দিনদিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
এ পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণ খুবই কম হয় বিধায় বালাইনাশক প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন না হওয়ায় এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল হয় অনেকটাই নিরাপদ। তাই আশা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে পরিবেশ-বান্ধব মালচিং পদ্ধতিটির বহুল প্রচলনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের সবজিসহ নির্বাচিত কিছু ফলের চাষাবাদ ও ফলন অনেকাংশে বাড়ার পাশাপাশি বাড়বে মোট উৎপাদনও।
লেখক : মহাব্যবস্থাপক, কৃষি ইউনিট, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল: ০১৭১২-১০৬৬২০