ধানের মাজরা পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ সুলতানা রাজিয়া
ধানের ক্ষতিকর পোকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাজরা পোকা। এ পোকার আক্রমণে সাধারণত ১৩ থেকে ২৬ ভাগ ফলন কম হতে পারে। ব্যাপক আক্রমণ হলে ৩০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ফলনের ঘাটতি হতে পারে। তাই একবার ধান গাছে আক্রমণ করলে সহজেই রক্ষা মিলে না। তিন ধরনের মাজরা পোকা বাংলাদেশের ধান ফসলের ক্ষতি করে। এগুলো হলো হলুদ, কালো মাথা ও গোলাপী মাজরা পোকা। হলুদ মাজরা পোকা প্রধানত বেশি আক্রমণ করে বলে এই পোকার দমন ব্যবস্থাপনা বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো।
পোকার বিবরণ
পূর্ণবয়স্ক হলুদ মাজরা পোকা এক ধরনের মথ; পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকার পাখার উপরে দুটো কালো ফোটা আছে; পুরুষ মথের মাঝখানে ফোটা স্পষ্ট নয়; তবে পাখার পেছন দিকে ৭-৮টা অস্পষ্ট ফোটা আছে; গাছে মাজরা পোকার ডিমের গাদা দেখলে বুঝতে হবে গাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে; হলুদ মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর হালকা ধূসর রঙের একটা আবরণ থাকে। দিনে এগুলো পাতার নিচে লুকিয়ে থাকে। কেবল রাতে অন্ধকারে এরা চলাফেরা করে।
অনুকূল পরিবেশ
সাধারণত এই পোকার আক্রমণ চৈত্রের শুরুতে তীব্রতর হয় এবং বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে এরপর আষাঢ়-শ্রাবণে আক্রমণ কমতে থাকে কিন্তু আশ্বিন-কার্তিক মাসে আবার আক্রমণ বেশ তীব্রতর হয়। অধিক মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে আক্রমণ বেশি হয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ধানের সব কয়টি পর্যায়ে যদি তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উষ্ণ ও আর্দ্রযুক্ত আবহাওয়া অর্থাৎ ৮০-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এই পোকার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত।
ক্ষতিরধরন
মাজরা পোকার কীড়াগুলো কা-ের ভেতরে থেকে খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাছের ডিগ পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। ফলে ডিগ পাতা মারা যায়। একে ‘মরা ডিগ’ বা ‘ডেডহার্ট’ বলে।
শীষ আসার পর মাজরা পোকা ক্ষতি করলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। একে ‘সাদা শীষ, ‘মরা শীষ’ বা ‘হোয়াইট হেড’ বলে।
মাজরা পোকার আক্রমণ হলে কা-ের মধ্যে কীড়া, তার খাওয়ার নিদর্শন ও মল পাওয়া যায় অথবা কা-ের বাইরের রং বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কীড়া বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকে। মাজরা পোকার কীড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার পর আস্তে আস্তে কা-ের ভেতরে প্রবেশ করে। কীড়ার প্রথমাবস্থায় এক একটি ধানের গুছির মধ্যে অনেকগুলো করে গোলাপী ও কালোমাথা মাজরার কীড়া জড়ো হতে দেখা যায়। কিন্তু হলুদ মাজরা পোকার কীড়া ও পুত্তলীগুলো কা-ের মধ্যে যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। আলোর চার পাশে যদি প্রচুর মাজরা পোকার মথ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষেতের মধ্যে মথগুলো ডিম পাড়া শুরু করেছে।
আক্রমণের পূর্বে করণীয়
া সঠিক দূরত্বে (লোগো পদ্ধতিতে) চারা রোপণ করা;
া সঠিক বয়সের চারা রোপণ করা;
া চারা লাগানোর পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খুঁটি পুঁতে দেয়া যাতে সেখানে পাখি বসে পোকা খেতে পারে;
া মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার প্রয়োগ করা ।
জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন
নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণের সময় মাজরা পোকার মথ ও ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেললে মাজরা পোকার সংখ্যা ও ক্ষতি অনেক কমে যায়; থোর আসার পূর্ব পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়; মাজরা পোকার পূর্ণবয়স্ক মথের প্রাদুর্ভাব যখন বেড়ে যায় তখন ধানক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোর ফাঁদ বসিয়ে মাজরা পোকার মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়; চারা লাগানোর পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে ডালপালা বা খুঁটি পুঁতে দিন যাতে সেখানে পাখি বসে পোকা খেতে পারে; মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার দিন।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন
ধানের চারা লাগানোর ১৫ দিন পর প্রথম কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় ইউরিয়ার সাথে সালফক্স ৮০ ডব্লিউ (সালফার ৮০%) ডি জি বিঘাপ্রতি ১ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে। শীষ আসার পর মাজরা পোকা যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য চারা লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পর ফিন্রোনিল+থায়ামেথোক্সাম গ্রুপের রিলোড ১৮ এস সি ৫ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া মাজরা পোকা দমনের জন্য অন্যান্য কার্যকরি কীটনাশক ক্লোরোপাইরিফস+সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের এসিমিক্স ৫৫ ই সি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। অথবা থায়োমেথোক্লাম+ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের ল্যামিক্স ২৪.৭ এস সি ২০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। অথবা ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের গোলা ৪৮ ইসি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। অথবা চারা থাকা অবস্থায় ফিপ্রনিল গ্রুপের গুলি ৩জিআর বিঘা প্রতি ১.৩ কেজি হারে অন্য সারের সাথে মিশিয়ে বাসাল ডোজ হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি তথ্য সার্ভিস, চট্টগ্রাম। মোবাইল : ০১৯২২১৫৬৬৭০