Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ফসলের-আইলে-পাট-জাতীয়-ফসলের-বীজ-উৎপাদন-প্রযুক্তি

ফসলের আইলে পাট জাতীয় ফসলের 
বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. মোঃ বাবুল হোসেন
বাংলাদেশে জমির সীমানা নির্ধারণ করার জন্য ৬ ইঞ্চি হতে ২৪ ইঞ্চি (২ ফুট) বা তারও বেশি প্রস্থতার আইল ব্যবহৃত হয়। এই আইল সীমানা নির্ধারণ করা ছাড়াও চলাফেরার কাজে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে একখ- জমি বর্তমানে যে মালিকানা নিয়ে টিকে আছে, কয়েক বছর যেতে না যেতেই মালিকানা আরো বেড়ে খ- বিখ- হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক মালিক আবার সীমানা নির্ণয় করতে গিয়ে, জমির সীমানায় আইল তৈরি করছেন। এতে যত আইল বাড়ছে, বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আইলে কৃষি জমির এই উৎপাদন বিমুখতা তাতে এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এতে প্রভাব পড়ছে আবাদে। ফলে ঐ সীমানার আইলে আবাদি জমিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বর্ষগ্রন্থ ২০২১ এর সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.১৭৯৩৫ লাখ হেক্টর। জমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জমির মালিকানা নির্ধারণে সীমানা করতে গিয়ে আইলের জন্য যে পরিমাণ জমি যাচ্ছে তার পরিমাণ মোট জমির প্রায় ২ ভাগ (রায়, ২০২২)। সে হিসাবে আইলের ব্যবহার হয়েছে এমন জমির পরিমাণ প্রায় ১.৭৬ লাখ হেক্টর। আবার অনেক সময় মৌখিকভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সব আইলের আয়তন এক করলে প্রায় বগুড়া (২.৯২ লাখ হেক্টর) জেলার সমান হবে (কামাল, ২০১১)। 
পাট বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪.০-৪.৫ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি আয় হয়েছে ৯১২.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উক্ত সময়ের মোট রপ্তানি আয়ে এখাতের অবদান ছিল শতকরা ১.৬৪ ভাগ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭.৫৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসল চাষ হয়। যার মধ্যে দেশি পাট ০.২৮৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২৩০ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ৮ কেজি); তোষা পাট ৬.৭৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ৪০৬৬ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ৬ কেজি); মেস্তা ০.১৮৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২১৯ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ১২ কেজি) এবং কেনাফ ০.২৮৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ৪৩০ মে. টন (বীজ হার প্রতি হেক্টরে ১৫ কেজি)। এছাড়াও সংরক্ষণজনিত কারণে ক্ষতি এবং বীজ ফসল ও পাটশাক চাষের জন্য অতিরিক্ত আরো বীজ প্রয়োজন হয়। উপরোক্ত আলোচনা ও হিসাব হতে বলা যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর পাট ও পাট জাতীয় ফসলের ৫৫০০ থেকে ৬০০০ মে. টন বীজ প্রয়োজন। আর উক্ত পরিমাণ পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন করতে প্রায় ৮০০০-১০০০০ হেক্টর জমি প্রয়োজন। 
জুলাই-আগস্ট (আষাঢ়-ভাদ্র) মাসে মাঝারি উঁচু জমিতে পাট বীজ চাষের উপযুক্ত সময়। কিন্তু উক্ত সময়ে কৃষক মাঝারি উঁচু জমিতে রোপা আমন ধান ও সবজিজাতীয় উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করতে আগ্রহী। আবার পাট বীজ ফসল দীর্ঘমেয়াদি এবং সময় ও জমির ভিত্তিতে আমন ও রবি ফসলের সাথে প্রতিযোগিতা করে। ফলে একক ফসল হিসাবে শুধুমাত্র পাট বীজ উৎপাদন কৃষকের নিকট লাভজনক নয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), পাট অধিদপ্তর, বিভিন্ন বীজ কো: লি., কৃষকসহ সবাই মিলে বিজেআরআই উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের উৎপাদিত বীজে আঁশ উৎপাদন হয় মাত্র শতকরা ২৫-৩০ ভাগ। অপর দিকে পাট শিল্পের সাথে জড়িত অভিজ্ঞদের মতে বিজেআরআই উদ্ভাবিত জাত থেকে উপাদিত আঁশ গুণগতমান ভাল এবং লাভজনক।
এমন প্রেক্ষাপটে রোপা আমন ধান ও সবজি পরিবেশে অব্যবহৃত জমির আইলে ও আইল বরাবর জমিতে আমন ধান ও সবজির আবাদে কোন পরিবর্তন না করেই পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রযুক্তিতে কৃষক রোপা আমন ধান বা বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, মরিচ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় পাট বীজ উৎপানের জন্য ঐ সকল জমির আইল বা আইল বরাবর জমিতে পাট বীজ ফসল উৎপাদন করতে পারে। ফলে আমন ধান বা সবজি (বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, মরিচ ইত্যাদি) উৎপাদনে তেমন পরিবর্তন না করেই প্রয়োজনীয় পাট বা কেনাফ বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য
া বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার মাঝারি উঁচু ও উঁচু জমিতে এই প্রযুক্তি অনুসরণযোগ্য।
া জমি ব্যবহার না করে ১ বিঘা জমির ১০০ হতে ১২০ মিটার লম্বা আইলের অর্ধেক ব্যবহার করে ১ বিঘা জমিতে প্রয়োজনীয় ৭০০-৮০০ গ্রাম তোষা পাটের বীজ পাওয়া যায়।
া ১ বিঘা জমির ১০০ হতে ১২০ মিটার লম্বা আইল ব্যবহার করে ১ বিঘা জমিতে কেনাফ চাষের প্রয়োজনীয় ১.৫-২.০  কেজি বীজ পাওয়া যায়। 
া সবজি বা আমন ধানের জমি সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে না বা খুবই কম ব্যবহার হচ্ছে বলে পাট বা কেনাফ বীজ চাষে কৃষক সহজেই উৎসাহিত হবে।
া এ প্রযুক্তিতে পাট বীজের সমতুল্য মোট ফলন ১০-১৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। 
া বাজার থেকে কেনা নিম্নমানের বীজের পরিবর্তে কৃষকের নিজের উৎপাদিত পর্যাপ্ত গুণগতমান সম্পন্ন পাট বা কেনাফের বীজ ব্যবহার করতে পারবে।
া নিম্নমানের ও কম অংকুরোদম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজের কারণে ফসল ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে না।
া পাট ও পাটজাতীয় ফসলের বীজের আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে।
া এ প্রযুক্তিতে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে।
জমি নির্বাচন : রোপা আমন বা সবজি চাষ করা হয় এমন মাঝারি উঁচু জমির যে সকল আইল চলাফেরা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং পানি জমে থাকে না সেই সকল আইল পাট বা কেনাফের বীজ চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। অথবা জমির একপার্শ্বে আইল বরাবর দেড় (১.৫০) মিটার চওড়া জমি উপআইল দিয়ে পৃথক করে নিতে হবে।
চাষ পদ্ধতি  
সরাসরি বপন : পাট বা কেনাফের বীজ জো জমিতে চাষ করে অথবা সুনিষ্কাশিত কাদা করা জমিতে সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করা যায়।
ডগা (কাটিং) রোপণ : উত্তম জো অবস্থায় জমি চাষ ও মই দিয়ে তোষা পাটের ডগা রোপণ করতে হবে। তবে কাদাকরা জমিতে তোষা পাটের ডগা রোপণ করলে অধিকাংশ ডগা মারা যায় তাই তোষা পাটের ডগা কাদাকরা জমিতে রোপণ না করে জো জমিতে ঝুরঝুরে মাটিতে রোপণ করা উচিত। এক্ষেত্রে ১০০-১১০ দিন বয়সের মাতৃ গাছের ডগা (কাটিং) ৫-৭ ইঞ্চি লম্বা (২-৩টি গিটসহ) তেছড়াভাবে কেটে উত্তর-দক্ষিণ দিকে ৪৫ ডিগ্রি হেলানোভাবে রোপণ করতে হবে।
চারা রোপণ : বৃষ্টি বা সেচের কারণে চাষকৃত জমি কর্দমাক্ত নরম হলে ৩০-৪০ দিন বয়সের পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করে বীজ ফসল চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে চারা হতে চারা ৮-১০ সেমি. পরপর এবং ৩০ সেমি পরপর সারি করে রোপণ করতে হবে।
পাট বা কেনাফের বীজতলা তৈরি : রোপণ পদ্ধতিতে বীজ চাষের জন্য জুলাই-আগস্ট মাসে চাষকৃত জমি হতে পাতলাকরণকৃত চারা বা বীজতলার ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা ব্যবহার করা যায়। প্রতি শতাংশে পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করার জন্য ১২০০-১৫০০ চারা প্রয়োজন হয়। 
চাষের সময় : বীজ বপন বা ডগা রোপণ করার ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্ট মাস উত্তম। মধ্য আগস্ট-মধ্য সেপ্টেম্বর ৩০-৪০ দিনের চারা রোপণ করা যায়। পাট বা কেনাফের চারা সংগ্রহ করে ঐ দিনেই রোপণ করতে হবে। 
জাত নির্বাচন : তোষা জাত : ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট ৬, বিজেআরআই তোষা পাট ৮, বিজেআরআই তোষা পাট ৯; কেনাফ জাত: এইচসি-৯৫, বিজেআরআই কেনাফ ৩, বিজেআরআই কেনাফ ৪ এবং দেশী জাত: সিভিএল-১, বিজেআরআই দেশি পাট ৫, বিজেআরআই দেশি পাট ৮, বিজেআরআই দেশি পাট ৯, বিজেআরআই দেশি পাট ১০। সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতা বিবেচনায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে টিএসপি ২৫০-৩০০ গ্রাম, এমওপি ৩০০-৩৫০ গ্রাম, জিপসাম ৪০০-৪৫০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪০-৪৫ গ্রাম হারে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ৪০০-৪৫০ গ্রাম সমান দুই ভাগে ভাগ করে বীজ বপন, ডগা বা চারা রোপণের ১৫-২০ দিন ও ৪০-৪৫ দিন হলে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
পাতলাকরণ ও আগাছা পরিষ্কার : পাতলাকরণ ও আগাছা পরিষ্কার করার পরে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে জো আসার সাথে সাথে আঁচড়া বা নিড়ি দিয়ে জমির মাটি আগলা বা ঝুরঝুরে করে দিলে মাটিতে আর্র্দ্রতা সংরক্ষিত থাকবে।
নিষ্কাশন ব্যবস্থা : পাট বা কেনাফ ফসল দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। আবার স্যাঁতস্যেঁতে জমিতে ফসলের বৃদ্ধি ভালো হয় না। তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে জমিতে জো অবস্থা বিরাজ করে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : রোগ ও পোকামাকড় ক্ষতির পর্যায়ে যাওয়ার আগেই দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : রোপা আমন বা সবজির সাথে চাষকৃত পাট বা কেনাফ বীজ ফসল চার দিকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে নেট দিয়ে ঘিরে দিয়ে ক্ষতি বা হেলে পড়া হতে রক্ষা করতে হবে। 
বীজ ফসল কাটা : পাট বা কেনাফের ফল ৭০-৮০ ভাগ (ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য জানুয়ারি মাসে) খয়েরি রং ধারণ করলে ফলসহ ডগার অংশ কেটে নিতে হবে। বাড়িতে গোবর লেপা উঠান বা চটের উপর পাতলা করে বিছিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোন অবস্থায় স্তূপ করে রাখা যাবে না। রোদে শুকানো বীজ গাছ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। মাড়াইকৃত বীজ পরিষ্কার করে ও শুকিয়ে (৮-১০ ভাগ আর্দ্রতায়: দুই দাঁতের মাঝে কট শব্দ হয়) বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ : পাট বা কেনাফের ভালো বৃদ্ধির জন্য জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে; কর্দমাক্ত আইলে চারা রোপণ পদ্ধতিতে ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে; মাঝারি উঁচু জমিতে চাষকৃত আমন ধানের জমির যে সকল আইল চলাফেরার কাজে ব্যবহার হয় না কেবল সেই সব আইলে পাট বা কেনাফের চারা রোপণ করতে হবে; রোপণের সময় উত্তম জো অবস্থা বজায় রাখা যায় এমন জমিতেই কেবল তোষা পাটের ডগা রোপণ করতে হবে; আইলের প্রস্থতার উপর ভিত্তি করে এক বা দুই সারিতে চারা রোপণ করা যায়; পাট বা কেনাফের গাছ যাতে হেলে না পড়ে তার জন্য আইলের মাঝে খুঁটি পুঁতে রশির মাধ্যমে খাঁড়া করে রাখতে হবে।
 
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল: ০১৭১৯ ৩৬২১৬১ (নগদ), ই-মেইল:babulbjri@yahoo.com